৬
নীল দুটো চোখ তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। আকাশে এখন আলো। আর তাতে ডুবে এই জঙ্গলের লতাপাতা, গাছপালা ও পুরনো চার্চের গন্ধের মধ্যে নীল দুটো চোখ তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে।
জলটা একদম স্থির। কাচের মতো। তলতাবনির এত ভেতরে চট করে কেউ আসে না। ফলে এই ছোট্ট জলাশয়টা প্রায় ব্যবহারই হয় না। কাচের মতো জল বুকে নিয়ে সে শুধু অপেক্ষা করে। কার অপেক্ষা করে?
সেই জলের ধারে ঝুঁকে রয়েছে ও। আর ওর নীল দুটো চোখ তাকিয়ে দেখছে ওকেই। অক্টোবরের প্রায় শেষ এখন। ঠান্ডা গুটিসুটি মেরে ঢুকে পড়তে চাইছে জীবনে, জঙ্গলে। জলের ওপার থেকে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। ভাঙা হ্যাঙার আর আগাছায় ঢেকে যাওয়া চার্চের ফাঁকফোকর দিয়ে টুকরো টুকরো হাওয়ার ভেতর ঢুকে আসছে শীত।
জলাশয় থেকে এক আঁজলা জল তুলে ঘাড়ে মুখে দিল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ভেজা আঙুলগুলো চুলের মধ্যে চালিয়ে দিল কিগান। প্রেশারটা বেড়েছে বোধহয়। ডাক্তারকাকা বলত, ‘ঠাকুরমার ধাঁচ। অল্প বয়স থেকেই হাই প্রেশার।’
হৈমবতী হাসতেন, বলতেন, ‘হবেই তো। আমার নাতি কি অন্যের মতো হবে নাকি?’ অন্যের মতো কী করে হবে কিগান? ঠিকমতো জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তো শুধু ঠাকুরমাকেই দেখে এসেছে ও।
পাশের পেয়ারা গাছের ডালে ঝোলানো ক্যামেরাটা খুলে গলায় ঝুলিয়ে নিল কিগান। ক্যামেরাটা দামি। ডিএসএলআর। সিক্সটিন পয়েন্ট ওয়ান মেগা পিক্সেল। কিগানের খুব শখের জিনিস।
গিটার, মাউথঅর্গান আর ক্যামেরা। শখ বলতে এই। এ ছাড়া তো একাই থাকে ও। সেই ছোট্ট থেকে প্রায় একাই থাকে। হ্যাঁ, চেনা-পরিচিতি অনেক হয়েছে জীবনে। কিন্তু বন্ধু? মনে করতে পারে না কিগান।
আসলে যেন কিছুই মনে করতে পারে না ও। সবই যেন কেমন ধোঁয়াশা। যেন সব কিছুর ওপর কয়েক হাজার বছরের ধুলো জমে আছে। আর তার ফাঁক দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে আসে এক-একটা মুখ। এক একটা মুহূর্ত। কিগান বোঝে, ও নিজেই ধুলোয় ঢেকেছে সব। বোঝে, এ ধোঁয়াশাও ওরই তৈরি। আসলে সবকিছু ভুলতে চায় ও। ওর কষ্ট, যন্ত্রণা আর অপমান। সব ভুলে যেতে চায়।
আর-একটা হাওয়ার ওড়না ভেসে এল বিকেলের ওপর দিয়ে। আর সঙ্গে করে নিয়ে এল জল, জঙ্গল আর আলোর গন্ধ।
আলোর গন্ধ থাকে? থাকে। কিগান জানে, প্রতিটা আলোর একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। ছোট থেকেই সকালের প্রথম আলোটা ঘরে ঢোকামাত্র তার গন্ধ পেত ও। উত্তর কলকাতার গলি, ঠাকুরমার চন্দন, ধূপ আর কর্পূর ছুঁয়ে ভেসে আসা অদ্ভুত এক আলোর গন্ধ পেত কিগান। সেই ছোট থেকেই কিগান বুঝেছিল প্রতিটা মানুষের মতো প্রতিটা সময়ের আলোরও আলাদা আলাদা গন্ধ থাকে।
এখন এই জঙ্গলে দাঁড়িয়ে শেষ বিকেলের আলোর অন্য এক গন্ধ পেল কিগান। ক্যামেরাটা হাতে তুলে ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে দূরে ভাঙা হ্যাঙারের ফাঁক দিয়ে ডুবন্ত সূর্যের দিকে ফোকাস করল ও।
বাবার সবসময়ের সঙ্গী ছিল ক্যামেরা। ছোট থেকেই নাকি ক্যামেরার প্রতি, ছবির প্রতি, বাবার একটা অদ্ভুত আগ্রহ ছিল। ঠাকুরমা বাবাকে প্রথম ক্যামেরা কিনে দিয়েছিল চোদ্দো বছর বয়সে। তারপর থেকে বত্রিশ বছর বয়স অবধি আর কোনওদিনই ক্যামেরা ছাড়া থাকেনি বাবা।
হ্যাঁ, বত্রিশ বছর। বত্রিশ বছর বয়সেই তো মারা যায় বাবা আর মা। তখন চার বছর বয়স কিগানের।
তাই ওর কাছে বাবা আর মায়ের প্রায় পুরোটাই গল্পের মতো করে শোনা, আর প্রচুর ছবির মধ্যে দেখা। তবে মাঝে মাঝে হঠাৎ একটা বিশাল বড় লেক দেখতে পায় ও। তার পাশের প্লাস্টিকের ওপর পড়ে থাকা একটা অদ্ভুত মাছ দেখতে পায়। দেখতে পায় কোথায় যেন বরফ পড়ছে। আর টেপরেকর্ডারে নিচু স্বরে বাজছে ক্রিসমাসের গান। দেখতে পায় পাথরের বাড়ির মাথায় বসানো চৌকো পাথরের চিমনি দিয়ে গোল্লা গোল্লা ধোঁয়া বেরোচ্ছে। আর অদ্ভুত আলোর ভেতর ঝাঁকড়া লাল মাথা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে চেরি ট্রি।
বাবা-মায়ের স্মৃতি বলতে মূলত এই। কিন্তু এর ভেতর বাবা-মা কোথায়? কিগান জানে, যখন-যখন ও এইসব জিনিস দেখেছে ওর দু’পাশে মা আর বাবা থাকত। তাই স্পষ্ট না হলেও মনের মধ্যে, স্পর্শের মধ্যে আর এইসব টুকরো-টাকরা ছবির মধ্যে বাবা-মাকে অনুভব করতে পারে কিগান অর্ক ব্যানার্জি।
বাইশ বছর বয়সে ঘর ছেড়েছিল কিগানের বাবা অর্কপ্রভ। প্রথমে দিল্লি, তারপর চেন্নাই। আর সব শেষে মুম্বই। আর তারপর পঁচিশ বছর বয়সে বিদেশি কাগজে চাকরি নিয়ে সোজা ইংল্যান্ডে।
কিয়েরা ফেরেল ছিল অর্কপ্রভর চেয়ে বছর দুয়েকের বড়। ওই কাগজেরই স্পেশ্যাল করেসপন্ডেন্ট। নানা জায়গায় কিয়েরার সঙ্গে ঘুরতে হত অর্কপ্রভকে। আর সব জায়গার থেকেই নানা পিকচার পোস্টকার্ড সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে মায়ের কাছে পাঠাত অর্কপ্রভ। তাতে নানা ঘটনার কথা সঙ্গে দু’-এক লাইন কিয়েরার কথাও থাকত।
কিন্তু ক্রমশ সেইসব পোস্টকার্ডে ঘটনার কথা কমতে থাকে আর কিয়েরার প্রসঙ্গ বাড়তে থাকে। হৈমবতী বুঝতে পারছিলেন যে, ব্যাপারটা খুব একটা ভাল দিকে গড়াচ্ছে না। ছেলের কথার ভাঁজ কেমন যেন পালটে যাচ্ছে। কিন্তু আগ বাড়িয়ে কিছু বলতেও পারেননি স্পষ্ট করে। শুধু লিখেছিলেন, ভবিষ্যতে যা পদক্ষেপ নেবে অর্কপ্রভ তা যেন বুঝেশুনে নেয়।
তবে সে চিঠি অর্কপ্রভর কাছে পৌঁছোনোর আগেই সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে আর-একটা খাম এসে পৌঁছোয়। চিঠিতে অর্কপ্রভ লেখে যে, সে কিয়েরাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে আর কিয়েরা তাতে রাজি হয়েছে। সেই চিঠির সঙ্গে বারোটা ছবিও অর্কপ্রভ পাঠিয়েছিল। কিয়েরার ছবি। অর্কপ্রভর তোলা।
সেসময় গোটা পরিবারেই এই নিয়ে ঝড় বয়ে গিয়েছিল। বাড়ির লোকজন আর আত্মীয়স্বজন সবাই একজোট হয়ে বলেছিল, অর্কপ্রভকে ত্যাগ করা হোক। বলা হয়েছিল যে, অর্কপ্রভকে সমস্ত অংশীদারী থেকে বরখাস্ত করা হোক ও তাকে যে ত্যাজ্য ঘোষণা করা হল সেই কথাটাও জানিয়ে দেওয়া হোক।
সেই মর্মে হৈমবতীর আর-এক ছেলে সূর্যশেখর চিঠি লিখে জানিয়েও দেয় অর্কপ্রভকে। উত্তরে অর্কপ্রভ নিজেদের বিয়ের ছবি পাঠিয়েছিল। আর লিখেছিল যে, কারও কোনও ভয় নেই। সম্পত্তির এক কানাকড়িও সে দাবি করবে না।
এই সব কিছুর ভেতরই হৈমবতী ছিলেন। কিন্তু কিছুতেই সরাসরি যোগ দেননি। বরং কিয়েরার ছবি দেখে মেয়েটাকে ভালই লেগেছিল ওঁর। যত্ন করে রেখেও দিয়েছিলেন সমস্ত ছবি। সেসব একটু বড় হওয়ার পর হৈমবতীর কাছে কিগান দেখেওছে।
হৈমবতী কিগানকে বলেওছিলেন যে, ‘জানিস তোর মাকে আমার বেশ পছন্দও হয়েছিল। অমন রং, চোখ, নাক। অমন ঘন কালো চুল আর নীল চোখ। ক’জনের হয় রে! শুধু অন্য জাত বলে একটু খটকা লাগছিল। তবে অর্ক যা করেছে ভালই করেছে। কলের পুতুলের মতো অন্যের বেছে দেওয়া মেয়ের সঙ্গে জীবন না কাটিয়ে নিজের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করেছে। সারাজীবন তো এই আফশোস থাকবে না যে, যাকে চাইলাম তাকে পেলাম না!’
মায়ের ছবিগুলো দেখেছে কিগান। এখনও দেখে। নানা জায়গায় নানা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে, বসে রয়েছে মা। কোনও সময় হাসছে, কোনও ছবিতে সামান্য গম্ভীর। আবার কোনও ছবিতে কেমন যেন আনমনা। বাবা যত পেরেছে, মায়ের ছবি তুলে গেছে। যেন সমস্ত রকমভাবে মাকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিল বাবা।
কিগান মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে যেন নিজেকেই দেখতে পায়। যেন মায়ের মুখ-চোখ কেউ যত্ন করে কেটে বসিয়ে দিয়েছে কিগানের মুখে। অমন নীল চোখ আর কারও নেই এ তল্লাটে। সবাই মনে রেখে দেয় কিগানের মুখ। আর ওর ওই নীল চোখ দুটো। নিজের ভেতর মাকে দেখতে পায় ও। দেখতে পায় চৌকো চিমনি দিয়ে ধোঁয়ার গোল্লা উঠছে। আর শুনতে পায় ঠাকুরমার গলা, ‘মাতৃমুখী পুত্র, সুখী হয়।’
‘সুখ’ শব্দটার মানে ঠিক বোঝে না কিগান। ছোট্ট চেরি ট্রি-র কাছে গিয়ে দাঁড়ানো আবছা ছোটবেলাটা কি সুখের মধ্যে পড়ে? বাবা-মায়ের অস্পষ্ট মুখটা কি কোনও অদ্ভুত অনুভূতি এনে দেয় ওকে? নাকি ঠাকুরমার কাছে চলে আসার পর উত্তর কলকাতার সেই লম্বা ছাদ, ঠাকুরমার কাছে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা বৃষ্টি রাত বা গলি ক্রিকেটে সব্য জেঠার বারান্দায় বল তুলে দিয়ে ছয় মারাটা সুখ?
আসলে সেই ছোট্ট থেকে কিগানের জীবনে এমন সব তীব্র বাঁক ও ভাঙন এসেছে যে, সুখ টুখের মতো ব্যাপারগুলো গুলিয়ে গেছে একদম। তবে হ্যাঁ, দুঃখটা স্পষ্ট টের পায় ও। ছোট থেকেই টের পায়।
সিন্থিয়া নামে একজন ন্যানি ছিল কিগানের। মহিলা কালো আর মোটা। মাথায় কেমন ছোট ছোট গোল্লা করে বেঁধে রাখত চুল। বাবা-মা দু’জনকেই কাজে বেরোতে হত বলে সকাল আটটার ভেতর চলে আসত সিন্থিয়া।
সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল খুব। কিগানের মনে আছে ওদের অ্যাপার্টমেন্টের পিছন দিকে যে-লোহার সিঁড়ির পাশে ফুলের টব রাখা থাকত তাতে বৃষ্টির জল জমে একদম উপচে পড়ছিল। আর লাল-হলুদ ফুলগুলো নিরুপায় হয়ে তাকিয়েছিল এ ওর দিকে।
উলটো দিকে একটা বিলবোর্ডের তলায় ধূসর রঙের পায়রারা বসে ছিল সার দিয়ে। কিগান কাচের জানলার গায়ে নাক লাগিয়ে দেখেছিল নীচে ছাতা মাথায় বাবা আর মা একটা গাড়িতেই দৌড়ে উঠে গেল। শুধু গাড়িতে ঢোকার মুখে মা যেন একবার পার্পল ছাতা সরিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়েছিল।
তারপরের সময়গুলো যেন জল পড়ে লেপটে যাওয়া ফাউন্টেন পেনের লেখা। যেন ঘষা কাচের ওপারে কিছু মানুষের নড়াচড়া। যেন বহু দূরের কোনও আবছা গলার স্বর।
কিগানের মনে আছে সিন্থিয়ার দৌড়ে আসা। পুলিশ গাড়ির ভেজা শীতল সারি। অনেক লোক। ক্যামেরা। আর ‘রোড অ্যাক্সিডেন্ট’, ‘রোড অ্যাক্সিডেন্ট’ শব্দ দুটো। কিছু বুঝতে পারেনি কিগান। এখনও যেন কিছু পারে না। শুধু মনে হয় সার বেঁধে বসে থাকা ধূসর পায়রা। মনে হয় পার্পল ছাতা সরিয়ে উঁকি দেওয়া মায়ের হাসি একটা মুখ।
হৈমবতী কারও কথা শোনেননি। প্রচুর পয়সা ছিল। কারও ওপর নির্ভরশীল ছিলেন না হৈমবতী। তাই নিজেই লন্ডনে গিয়ে নিয়ে এসেছিলেন নাতিকে।
অ্যাপার্টমেন্টে ফরসা মোটা হৈমবতীর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল কিগান। ওকে বলা হয়েছিল গ্র্যান্ড মাদার। বলা হয়েছিল, ওঁর সঙ্গে এবার থেকে থাকতে হবে ওকে। হৈমবতী জড়িয়ে ধরেছিলেন কিগানকে। খুব সুন্দর একটা গন্ধ পেয়েছিল কিগান। ঝাঁঝালো, মিষ্টি আর নির্ভরতার গন্ধ। এই গন্ধটা তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত হঠাৎ হঠাৎ ভেসে আসে কিগানের কাছে।
হৈমবতী বলেছিলেন, ‘আমার সঙ্গে থাকবে তুমি। আমাদের অনেক দূর যেতে হবে, কেমন?’
অনেক দূর যেতে হবে। অনেক অনেক দূর যেতে হবে। সেই ছোট থেকে কিগান বুঝেছিল ওকে অনেক দূর যেতে হবে, একা।
আজ দীপাবলী। ফ্যাক্টরি ছুটি। অবশ্য সবার ছুটি নয়। বয়লার একবার ফায়ার করতে সময় লাগে কিছুটা। তাই বয়লার নেভানো যায় না। বয়লার চলছে। কিগানকে শুধু সন্ধের দিকে একবার ফ্যাক্টরিতে রুটিন ভিজিট করতে হবে। গত কয়েকদিন ধরে বয়লার নিয়ে একটা গন্ডগোল চলছে। যদিও সেটা কিগান খানিকটা মিটিয়েছে। তবু পুরোটা মেটেনি। আসলে বয়লারম্যান যারা আছে তাদের মধ্যে সন্ধের শিফ্টে যে থাকে, সেই অজিত ছেলেটা খুব ত্যাঁদড়। কথায় কথায় ইউনিয়ন দেখায়। প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে কিগানকে গোটা প্রোডাকশনের চেনটা দেখতে হয়। কারণ, একটা কোথাও গন্ডগোল হলে পুরো প্রোডাকশনের ওপর প্রভাব পড়ে।
রুহান বলেছিল, ‘এসব প্রোডাকশন ম্যানেজার ফ্যানেজার হতে যেয়ো না। পুরো বাঁশের কাজ। থ্যাঙ্কলেস জব। প্রোডাকশন যখন স্মুদ চলবে কেউ নাম করবে না। কিন্তু যখনই আটকাবে, সে এক ঘণ্টার জন্য হলেও, গালাগাল দিয়ে বাপের নাম ভুলিয়ে ছাড়বে। কলকাতা ছেড়ে মরতে কেন যে, অত দূর যাচ্ছ?’
মরতে কি? না, বাঁচতে? কেন কলকাতা ছেড়েছে কিগান? না ছেড়ে কি কোনও উপায় ছিল না?
কিগানের ঘাড়ের কাছটা ব্যথা করছে। মাথাটাও ঘুরছে যেন। প্রেশারটি কি আবার বাড়ল? শ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে বেশ। বুকে কষ্ট হচ্ছে। ভেবেছিল সব পিছনে ছেড়ে আসবে। কলকাতার সব ভুলে যাবে এই গ্রামে এসে। কিন্তু গত দু’-আড়াই মাসে তা আর হল কই? এখনও তো কষ্ট হয় ওর। তীব্র একটা যন্ত্রণা পাক খায় শরীরে, মনে। কাউকে বলতে পারে না সে কথা। বলতে পারবেও না কোনওদিন। আসলে ও যে কী মনে করে, তা কোনওদিন বলতে পারবে না দিঘিকে। কোনওদিন বলতে পারবে না যে, দিঘির চুল থেকেও ও অন্য এক আলোর গন্ধ পেত!
একা হতে খুব ভাল লাগে কিগানের। আর এই তলতাবনির জঙ্গল ওকে একা হতে সাহায্য করে। তাই এই পুজোর দিনে ও কোলাহল ছেড়ে ঢুকে এসেছে এই গাছপালাদের ভিড়ে। ছবি তুলেছে মনমতো। আর বসে থেকেছে। হেমন্তের অরণ্যে নির্জন হয়ে যেতে চেয়েছে কিগান।
সূর্যটা আর আকাশে নেই। একটা মনমরা বেগুনি রঙের আলো ধীরে ধীরে চেপে বসছে জঙ্গলের শরীরে। জলাশয়ের ওপারে এলোমেলো ঝোপের ভেতরে জোনাকিরা স্পষ্ট হচ্ছে ক্রমশ। মশাও মুকুটের মতো ঘন হয়ে আসছে মাথার ওপর। এবার ফিরতে হবে।
কিগান ক্যামেরাটাকে ব্যাগে ভরে জঙ্গল থেকে বেরোনোর জন্য এগোল। এখান থেকে বেরিয়ে সোজা ফ্যাক্টরি যাবে। তারপর বাড়ি।
ফ্যাক্টরির কাছেই একটা বাড়ির দোতলাটা ভাড়া নিয়েছে কিগান। অফিসই রেন্ট দেয়। চমক জোগাড় করে দিয়েছে বাড়িটা।
বুধিয়া নামে বছর আঠারোর একটা ছেলে কিগানের কাজকর্ম আর রান্নাবান্না করে দেয়। কলকাতা থেকে এই চাপাডাঙায় ট্রান্সফার নিয়ে আসার পরে কোথায় থাকবে ঠিক করতে পারছিল না কিগান। তখন ফ্যাক্টরির শশীবাবু আলাপ করিয়ে দিয়েছিল চমকের সঙ্গে। চমকই এই বাড়িটা ঠিক করে দিয়েছিল কিগানকে।
রোগা, বেঁটে আর নিপাট ভালমানুষের মতো চেহারার ছেলেটাকে প্রথমে ঠিক বুঝতে পারেনি কিগান। কিন্তু এখন এখানে থাকতে থাকতে ওর দাপট বুঝতে পারছে।
বাড়িটার মালিক মানিক রায়। ভদ্রলোক এখানকার স্থানীয় এমএলএ সুধাদির দলেই আছেন। ওঁর চাল-গমের পাইকারি কারবার আছে। মানুষটা সদাশয়। সর্বক্ষণ হাসি লেগেই রয়েছে মুখে। কিগানকে দেখে বলেছিলেন, ‘আমাদের গ্রামে বহুদিন পর আবার আপনিই সাহেব এলেন।’
‘সাহেব?’ কিগান অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে।
‘নন? এমন সুন্দর গায়ের রং, নীল চোখ, আপনি সাহেব না হলে কি আর এই ভুসোকালি, আমি সাহেব?’
‘আমার বাবা বাঙালি।’ কিগান চেষ্টা করেছিল বোঝাতে, ‘মা আইরিশ, কিন্তু বাবা বাঙালি।’
‘তা হলেও, আমার কী সৌভাগ্য যে আপনি আমার বাড়িতে থাকবেন!’
কিগান আর কথা বাড়ায়নি। বুঝেছিল যে, কলোনিয়াল হ্যাংওভার কাটতে এখনও অনেক দেরি আছে এদের। গায়ের রঙের জন্য এখনও যে কত কিছু সামলাতে হয় মানুষকে!
তবে সেই সূত্রে চমকের সঙ্গে আলাপ ওর। আর এখন যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। তবে সবটাই চমকের দিক থেকে। চমকের একটু হামলে পড়া স্বভাব আছে। মাঝেমধ্যে খাবার দাবার নিয়ে হাজির হয় কিগানের ডেরায়। সঙ্গে মদও আনে। কিগান নিজে এসব খায় না। কিন্তু চমককে বারণও করে না। শুধুমাত্র মাত্রা ছাড়াতে না করে।
আজ কালীপুজো, কিগান জানে চমক আজকেও হানা দিতে পারে বাড়িতে। তবে আজ এসব ভাল লাগছে না কিগানের। আজ চমক আসলে ফিরিয়ে দেবে। কেন, কিগান জানে না, কিন্তু যে-কোনও উৎসবের সময়ই কিগানের মন খুব খারাপ হয়ে থাকে।
আজ আলোর উৎসব। ফ্যাক্টরিটাকেও ছোট ছোট আলো দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। দূরে, বিশাল লম্বা ওয়াটার রিজার্ভারটা দেখা যাচ্ছে। তার লম্বা সেন্ট্রাল কলামে আলোর সাপ পেঁচিয়ে উঠেছে। কিগান স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল। আর হঠাৎই ওর মনে পড়ে গেল সেই রিজার্ভারটার কথা! মনে পড়ে গেল তার চারপাশে গুটিয়ে আসা সন্ধের কথাও। কিগান মাথা নাড়ল। তারপর সামনের দৃশ্যে মনোযোগ দিল। ওর মনে হল, গোটা ফ্যাক্টরিটাকেই কেমন যেন ভিনগ্রহের আকাশযান মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এটা কোত্থেকে এল হঠাৎ? আগে তো এখানে ছিল না!
কিগান মেন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল। গেটের ডান দিকে সিকিউরিটির ঘর। তাতে চারজন বসে থাকে। বাইরের কেউ ঢুকতে গেলে তাদের আগাপাশতলা চেক করে, ফোটো তুলে তবে ঢুকতে দেওয়া হয়।
আজও গেটের পাশের ঘরে রিটায়ার্ড ক্যাপ্টেন গুরুং বসে ছিল। এখানকার সিকিউরিটি ইন চিফ। কিগানকে দেখে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বলল, ‘কিগানভাই, কার্ড পাঞ্চ করবে না?’
‘না,’ কিগান হাসল, ‘আরে, আমি একরকম ছুটিতেই আছি ক্যাপ্টেন। কিন্তু বাড়িতেও তো কিছু করার নেই, তাই ভাবলাম বয়লারটা দেখে যাই।’
‘একরকম ছুটি মানে?’ গুরুং হাসল, ‘তুমি ছুটি নাও না কেন বলো তো?’
‘নেব, একদিন নেব।’ কিগান হাসল।
‘ঠিক আছে, অন্তত লগ-এ সই করে ঢোকো।’ গুরুং হেসে ঘরের দিকে ইঙ্গিত করল।
ঘরটা ছোট। কেমন যেন গুমোট। এখানে এরা বসে থাকে কী করে, ভাবল কিগান। সই করে ও বেরিয়ে এল ঘরের থেকে।’
গুরুং বলল, ‘আরে চলো আমাদের গ্রামে। দেখবে মন একদম ফ্রেশ হয়ে গেছে। পাহাড়, চা-বাগান, মেঘ, ঝরনা, সুন্দরী মেয়ের দল, কী নেই? চলো একবার, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘কী ঠিক হবে? আমার তো কিছু ভুল নেই।’ কিগান হেসে তাকাল গুরুং-এর দিকে।
গুরুং বলল, ‘আমার কি এমনি এমনি বয়স হয়েছে নাকি? সারাজীবন আর্মিতে কি আমি ঘোড়ার ঘাস কেটেছি মনে হয় তোমার? যাক গে, পাহাড়ে চলো, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
পাহাড়? কিগান গেছে পাহাড়ে। বেশ কয়েকবার ঘুরতে গেছে কিগান। বহুদিন আগে পাহাড় ওকে কষ্ট দিয়েছিল খুব। তবু পাহাড় খুব পছন্দের জায়গা ওর। সেই পাহাড়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে? সমস্ত কিছু আবার হয়ে যাবে জলের মতো সহজ!
গুরুং ঘর ছেড়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে এসে দাঁড়াল কিগানের পাশে। কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘ভুল নেই তো? তা হলে এবার বিয়ে করো একটা। দেখবে ঠিক হয়ে যাবে সব।’
সব ঠিক, সব ঠিক হয়ে যাবে। সবাই একসঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা বলে কেন? জীবন কি হিন্দি সিনেমা যে, শেষ হওয়ার আগে সব ঠিক হবে, সব গুছিয়ে উঠবে? কত মানুষ তো অসমাপ্ত কাজ, অসমাপ্ত বন্ধুত্ব, অসমাপ্ত সম্পর্ক রেখে দিয়ে ফট করে মারা যায়। তার বেলা? সব কি ঠিক হতেই হবে? এই ‘সব ঠিক হওয়া’র কনসেপ্টটা ঠিক বুঝতে পারে না কিগান।
তা ছাড়া, বিয়ে! কাকে করবে? সেই কলেজ জীবনে বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল জিয়ানাকে। তার এত বছর পরে আর-একজনকে। কিন্তু…কোনওমতে চিন্তার রাশটা থামাল কিগান। যা সম্ভব নয়, তা বলে লাভ নেই। ভেবেও লাভ নেই।
কিগান হাসল, ‘খুব বিয়ের কথা বলছ ক্যাপ্টেন! ভাবির জন্য মন-কেমন করছে?’
‘আর ভাবি,’ গুরুং হাসল, ‘প্রথম প্রথম অমন ছিল। এখন বিয়ের বাইশ বছর হয়ে গেছে। মন আর কেমন করে না।’
কিগান বলল, ‘ঠিক আছে ক্যাপ্টেন, আমি একটু পিছনের দিকে যাব। বয়লার রুমের দিকে। তা হলে আসি?’
ফ্যাক্টরি চত্বরটা বেশ বড়। বয়লার রুম পিছন দিকে। অর্থাৎ, অনেকটা হাঁটতে হবে কিগানকে।
আজ ফ্যাক্টরি প্রায় শুনশান। শুধু হঠাৎ হঠাৎ সিকিউরিটির দু’-চারজন বেতের লাঠি হাতে ঘুরছে। আর কখনও কখনও দু’-একজন লেবারের মুখ দেখা যাচ্ছে।
কিগান হাঁটতে হাঁটতে আকাশের দিকে তাকাল। নানা রঙের বাজি ফাটছে। কোনওটা লাল, কোনওটা সবুজ, আবার কোনওটা সাদা। মানুষজন প্রাণপণে তথাকথিত বড় অনুষ্ঠানের শেষটা উপভোগ করতে চাইছে।
বয়লার রুমের কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠল কিগান। আরে এগুলো কী? এগুলো আবার ব্যাগের বাইরে বেরিয়ে এসেছে? আসলে কেউ দেখেনি কেন? এ শিফ্টে তো অজিত থাকে। ও দেখছে না কেন?
কিগান প্রায় দৌড়ে গেল বয়লার রুমের দিকে। দেখল, বাইরে একটা চেয়ারে বসে সামনে একটা চেয়ারে পা তুলে কানে ইয়ারফোন গুঁজে প্রবল বেগে মাথা নাড়ছে অজিত। মনে হচ্ছে যে-কোনও মুহূর্তে ওর মাথাটা খুলে পড়ে গিয়ে ড্রপ খাবে মাটিতে। কিগানের রাগ হয়ে গেল। আচ্ছা ছেলে তো! কোম্পানি কি ওকে গান শোনার জন্য মাইনে দিচ্ছে নাকি?
‘অজিত।’ কিগান সামনে গিয়ে ডাকল।
অজিত শুনতেই পেল না। বরং মাথা নাড়ার বেগ যেন বাড়ল বেশ। হয়তো গানটা তার ক্লাইমেক্সের দিকে যাচ্ছে।
‘অজিত।’ কিগান এগিয়ে গিয়ে অজিতের কাঁধ ধরে ধাক্কা দিল।
‘অ্যাঁ?’ অজিত ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়াল। কান থেকে ইয়ারফোনটা খুলল।
‘তুমি গান শুনছ?’
‘তো কী হয়েছে?’ অজিত মুখের ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা মুছে ফেলে ভুরু কুঁচকে তাকাল।
‘কালেক্টর ব্যাগ ফাটছে কী করে? এই দেখো বয়লার রুমের পিছনে আবার ফ্লাই অ্যাশ উড়ছে।’
‘ব্যাগ ফেটেছে!’ অজিত ঠোঁট চাটল। তাকিয়ে দেখল চারদিক। সত্যি পাতলা মিহি ছাই ভেসে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়।
‘না তো এমনি এমনি ছাই উড়ছে নাকি? আর তুমি গান শুনছ?’
অজিত পকেট থেকে চিরুনি বের করে চুলটা কয়েক বার আঁচড়ে নিয়ে বলল, ‘আমি কী করে বুঝব যে, এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যাগ ফেটে আবার বয়লারে ছাই উড়বে?’
‘বুঝতে তো কেউ বলেনি। তোমার তো নজর রাখার কাজ। আর তুমি গান চালিয়ে মাথা নাড়াচ্ছ?’
অজিত হাসল, ‘আপনি ফালতু টেনশন নিচ্ছেন স্যার। কিচ্ছু হবে না। না হয় ছাই উড়ল। গ্রামে ছড়াল। গ্রামের লোকদের একটু অসুবিধে হল। তাই বলে আমরা ভয় পাব কেন?’
‘তর্ক কোরো না।’ কিগান চোয়াল শক্ত করল।
‘রিপোর্ট করবেন তো?’ অজিতের গলায় ধার, ‘করুন রিপোর্ট। আমিও ইউনিয়নে বলব।’
‘ইউনিয়নের ভয় দেখিয়ো না। তুমি কাজে অবহেলা করবে আর ইউনিয়ন দেখাবে?’
অজিত হাসল, ‘আপনি স্যার ফালতু ক্যাচাল করছেন। ব্যাগ ফেটেছে, পালটে দিচ্ছি। ফালতু মটকা গরম করছেন কেন? আর যখন সময় হবে তখন ইউনিয়ন কেন অনেক কিছুই দেখাব। যা আপনি দেখেননি।’
কিগান চোয়াল শক্ত করে তাকাল অজিতের দিকে। ছেলেটা বেঁটে, মোটা। মাথায় খোঁচা খোঁচা চুল। কিগানের ছ’ফুট দুই চেহারার সামনে লিলিপুট। ও যদি কলেজ জীবনের কিগান হত তা হলে এখনই অজিতকে তুলে দূরে এই ওয়েস্ট বিন-এ গুঁজে দেওয়া ওর কাছে দশ সেকেন্ডের ব্যাপার হত। কিন্তু এ-কিগান সেই কিগান নয়। এ-কিগানের বয়স হচ্ছে। প্রেশারের সমস্যা আছে। হাঁটুতে চোট আছে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল সেই দামাল কিগানটাকে খুব দক্ষ হাতে মেরে ফেলা হয়েছে এগারো বছর আগে।
না, সম্পূর্ণ মেরে ফেলা নয়। একজনকে দেখে নিজের অজান্তেই বেঁচে উঠেছিল কিগান। আবার হাসতে শুরু করেছিল। কিন্তু সেটাও গন্ডগোল হয়ে গেল। আর সেই গন্ডগোলটা এমনভাবে হল যাতে ও ছিটকে পড়ল এত দূরে। আজ কিগানের সমস্ত অস্ত্র শস্ত্র হারিয়ে গেছে। আজ কিগান সম্পূর্ণ প্রতিরোধহীন। প্রতিক্রিয়াহীন। কিগান বেঁচে আছে বেঁচে থাকতে হয় বলে।
কিগান অজিতের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর শান্ত গলায় বলল, ‘এসব কেন বলছ? কাজ করতে বলেছি, করবে। আর যদি কিছু দেখাতে চাও, দেখিয়ো। কেমন?’
অজিত, কিগানের শান্ত গলা শুনেই বোধহয় থমকাল একটু। তারপর ঠোঁট চেটে হেঁ হেঁ করে বলল, ‘না, না, স্যার তা নয়…’
‘গ্রামের লোকজন যদি ফ্লাই অ্যাশ কেন উড়ছে বলে এবার তেড়ে আসে আমি তোমায় এগিয়ে দেব। কেমন! তখন ইউনিয়নে বোলো।’ কিগান অজিতকে কথা শেষ না করতে দিয়ে হাঁটা দিল অন্যদিকে।
ফ্যাক্টরির এদিকটায় অন্ধকার। পিছনের দিক বলেই। বাউন্ডারির ওয়ালের গায়ে একটা বড় ক্র্যাকও দেখা দিয়েছে। কিগান মেনটেনেন্সে খবর দিয়েছিল। এখনও যে কাজ হয়নি বুঝতে পারছে। তবু ক্র্যাকটা কতটা বেড়েছে তা দেখে নেওয়ার জন্য কিগান এগিয়ে গেল।
দেওয়ালটা স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে, মাথায় কাঁটাতারের ফেনসিং। দূরে লাগানো আলোয় আবছাভাবে ফাটলটা দেখা যাচ্ছে। হাত দিল কিগান। একটু বেড়েছে। গত মাসে দেওয়ালের আর-এক দিকে একটা বড় গর্ত হয়ে গিয়েছিল। পাম্প হাউস থেকে দুটো মোটর চুরি যায়। মেনটেনেন্স আর গুরুং চিঠি খেয়েছিল সেজন্য। চিঠি মানে শো-কজ। গুরুং-এর দোষ ছিল না। তবে ওর একটা ছেলে সে রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আসলে মেনটেনেন্সের শশীবাবু খুব গেঁতো। চব্বিশ মাসে বছর। করছি করব করে কাটিয়ে দেয় সময়। এই যে, দেওয়ালটা ফেটেছে সেটার দিকে নজরই দিচ্ছে না। একটা কেলেঙ্কারি যখন হবে তখন লেজ ঘাড়ে করে দৌড়োবে।
কিগান ভাবল, কাল সকালেই একবার শশীবাবুকে ঝাড় দিতে হবে। লোকটার নিজের ভালর জন্যই।
ক্যামেরার ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে আবার ফ্যাক্টরির দিকে গেল কিগান। আর ঠিক তখনই দেখল সিকিউরিটির একটা ছেলে দৌড়ে আসছে ওর দিকে।
‘কী হল?’ কিগান জিজ্ঞেস করল।
ছেলেটা হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘স্যার, বড়সাহেব আর জিএম সাহেব এসেছেন। আপনাকে ডাকছেন। আপনি চলুন।’
‘স্যার!’ কিগান অবাক হল। এই দীপাবলির রাতে স্যার এসেছে? অবাক তো! কেন? অবশ্য ও জানে না প্রতি বছরই আসে কিনা। হয়তো কাজ আছে। কিগান জানে বস ফ্যাক্টরিতে এলে কোথায় বসে। ও সেই দিকে হাঁটা দিল।
গৌর রওশন দিওয়ানের তিরিশ লাখি সিলভার রঙের লম্বা গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে মূল অফিস বিল্ডিং-এর বাইরে। বয়স্ক ড্রাইভারটি বাইরে দাঁড়িয়ে টুপিটা খুলে ঝাড়ছে। লোকটি ভাল। কম কথা বলে, কিগানকে দেখে হাসল। কিগানও হেসে দুটো সিঁড়ি করে লাফিয়ে উঠে গেল ওপরে।
কনফারেন্স রুমের পাশে গৌরের প্রাইভেট চেম্বার। দরজার কাছে গৌরের সর্বক্ষণের সঙ্গী বেয়ারাটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। ও কিগানকে দেখে হেসে ছোট্ট কলিংবেলটা টিপল। চল্লিশ সেকেন্ড পরে দরজাটা খুলে দিল গৌর নিজে।
আজ সাদা পাজামা-পাঞ্জাবিতে অন্যরকম লাগছে মানুষটাকে। গলায় দড়ির মতো মোটা সোনার চেনটা চকচক করছে।
গৌর হাসল কিগানকে দেখে। চওড়া প্রাণখোলা হাসি, ‘আরে কিগান, তু কাঁহা থা ইয়ার? কব সে তুঝে খোঁজ রাহা থা। আর এ কী? দিওয়ালিতেও এমন সাদা-মাঠা ড্রেস পরে আছিস? তু বহত ভেজ হ্যায়। চল অন্দর আ।’
গৌরের কথাবার্তার ধরনটাই এমন। খুব মাই ডিয়ার টাইপ। তাই ‘তুই’ করে বললেও কেউ কিছু মনে করে না।
ঘরে ঢুকে দেখল স্যামও রয়েছে। স্যামুয়েল কুটিনহো এমনি হাসিখুশি। কিন্তু আজ স্যামের মুখ গম্ভীর। হাসিখুশি মানুষটা এমন হয়ে আছে কেন?
কিগান ওদের সামনের সোফায় বসল। টেবিলে খুব দামি স্কচ আর মাংসের দু’-তিন রকমের প্রিপারেশন রাখা।
‘বৈঠা কিউ হ্যাঁয়? এক ড্রিঙ্ক বনা আপনে লিয়ে।’ গৌর সামনে সোফায় শরীরটাকে ছেড়ে দিয়ে বলল।
‘নো স্যার,’ কিগান হাসল, ‘অ্যালকোহল সহ্য হয় না।’
‘তাই!’ গৌর হাসল, ‘আচ্ছা তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করছি। এমন অদ্ভুত নাম কেন তোর? ক্যায়া মতলব হ্যায় ইসকা?’
কিগান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ছোট থেকে এক উত্তর বারবার দিতে হয়েছে ওকে। ও বলল, ‘স্যার কিগান মানে লিট্ল অ্যান্ড ফিয়ারি, অর্ক মানে সূর্য, সান।’
‘লেকিন অ্যায়সা মিক্সড নাম কিউ হ্যায় তেরা?’ গৌর যেন আজ গল্পের মুডে রয়েছে।
কিগান বলল, ‘মা রেখেছিল। মা, আইরিশ ছিল। কিয়েরা ফেরেল।’
‘ছিল মানে?’ গৌর আজ একটু বেশি পার্সোনাল হচ্ছে যেন।
‘আই ওয়াজ ফোর, হোয়েন দে বোথ ডায়েড।’ কিগান শান্ত গলায় বলল। আজ নিজের বলা কথাটার সঙ্গে সঙ্গেই যেন ও দেখতে পেল সার সার ধূসর পায়রা। পার্পল ছাতা সরিয়ে উঁকি দেওয়া মায়ের মুখ।
‘সরি। এক্সট্রিমলি সরি।’ গ্লাসটা টেবিলে রেখে সোজা হয়ে বসল গৌর। তারপর হাত নাড়িয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘রহনে দে উও সব। তারপর বল এই জায়গা কেমন লাগছে?’
‘ভাল। কাম অ্যান্ড কোয়ায়েট।’
‘তুই তো নিজেই জোর করে এলি।’ গৌর হঠাৎ উঠে এসে কিগানের পাশে বসল। গ্লাসটা আবার তুলে নিল টেবিল থেকে। গোল গোল করে ঘুরিয়ে সরষের তেলের মতো তরলটাকে নাড়াল। তাতে ভাসমান দু’খণ্ড বরফের কিউব পরস্পর ধাক্কা খেল। ঠুংঠাং শব্দ করল। গৌর সেই দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তো, রাঘববাবুর সঙ্গে কথা হল? শুনলাম তো যে, দুর্গাপুজোয় ইউ ওয়্যার ইনভাইটেড।’
অবাক হল কিগান। লোকটা এও জানে? কে খবর দেয় এত?
গৌর হাসল, ‘আরে আমি সব খবর রাখি। তার ওপর তোকে টম ক্রুজের মতো দেখতে, তোর খবর তো হাওয়ার আগে ছুটবে।’
‘হ্যাঁ স্যার, গেছিলাম।’ কিগান কথাটা বাড়তে না দিয়ে ছোট করে বলল।
‘তো? ল্যান্ড নিয়ে কথা হল?’ গৌর সটান তাকাল কিগানের দিকে।
‘স্যার?’ কিগান চমকে গেল একটু।
‘ল্যান্ড, জমি। কথা হল এ নিয়ে?’ গৌর এবার স্থির। গলাটাও আর অত বন্ধুত্বপূর্ণ নেই।
‘কোন ল্যান্ড স্যার?’ কিগান অবাক হল।
গৌর ভুরু কুঁচকে স্যামের দিকে তাকাল, ‘স্যাম আপনে বোলা নেহি ইসকো?’
স্যাম থতমত খেল। বলল, ‘না স্যার, মানে…’
‘হাউ ক্যালাস অফ ইউ।’ গৌর দাঁতে দাঁত ঘষল, ‘ইয়ার, আপ লোক মেরে গান্ডকে পিছে কিউ লগে হো? আর আমারও মাথায় লোক আছে। প্রেসিডেন্ট আমায় ভাল করে বাম্বু দেবে। জুস ফ্যাক্টরির সঙ্গে মিনারেল ওয়াটারের কাজটাও চালু করা দরকার, দ্যাট রাঘব চক্রবর্তী, জমিটা বিক্রি করেও ওই একটা ভাইটাল পিস কেন আটকে রেখেছে বুঝতে পারছি না। আরে বাবা, ফালতু সেন্টিমেন্ট দিয়ে কি জীবন চলে? তা ছাড়া আমি বলেছিলাম, আপনি যা টাকা নেবেন আমরা দেব। আর তাতেই বুড়োর ইগোতে লাগল। বলে আমরা নাকি টাকার গরম দেখাচ্ছি! শালা, ইগোইস্ট! ওই সামান্য কথায় জমিটা আটকে দিয়েছে! তু মুঝে বতা কিগান, মিনারেল ওয়াটার কে লিয়ে ও জমিন তো চাহিয়ে না? নেহি তো ক্যায়সে চলেগা? আর তোকে ব্যাপারটা নিয়ে রাঘববাবুকে বোঝাতে হবে। আমরা অফিশিয়ালি ওঁকে কনভিন্স করতে পারছি না, তু জরা পার্সোনালি দেখ। কাম হোনা চাহিয়ে।’
ওদের পার্টিক্ল বোর্ডের পাশেই মার্চেন্ট মাল্টিপল্স একটা বড় জমি কিনেছে টেট্রাপ্যাকে গ্রেপ আর অরেঞ্জ জুস তৈরি করবে বলে। তার সঙ্গে মিনারেল ওয়াটারও তৈরি করতে চায় ওরা। কিন্তু তার জন্য জমি আর দিচ্ছে না রাঘব চক্রবর্তী। কেন? না ওই জমিটা নাকি স্পেশ্যাল। আর গৌর নাকি অসভ্যের মতো টাকা দেখিয়ে কথা বলেছে রাঘবকে। তাই রাঘব চক্রবর্তী বলেছেন যে, জমিটা বিক্রির জন্য নয়। কিন্তু গৌর কি আর সেসব বুঝবে? ওর তো ব্যাবসা হলেই হয়। এর সবটাই জানে কিগান। কিন্তু তবু গৌরের মুখ থেকে না শুনে নিজে কিছু বলতে চায়নি।
কিগান পুজোর দিন গিয়েছিল বটে ওখানে। রাঘববাবু নিজে যেতে বলেছিলেন, কিন্তু অমন ভিড়ে কথা হয়নি ঠিক। সামান্য কুশল বিনিময় হয়েছিল মাত্র। আর কিগানের মূল আকর্ষণ ছিল অর্কিড। একটা বড় গ্লাস হাউস করেছে রাঘববাবুরা। সেখানে প্রচুর অর্কিড রাখা। তার ছবি তোলাতেই মূল নজর ছিল। আর সেখানেই হঠাৎ রাঘববাবুদেরই একটা গোরু ঢুকে পড়ে। সেটা বের করতে গিয়ে হাতে সামান্য ব্যথাও পেয়েছিল কিগান। অবশ্য তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সাধুদা আর রাহি এসে পড়েছিল।
আচ্ছা, রাঘব চক্রবর্তীর সঙ্গে কি এসব নিয়ে কথা বলতে পারে কিগান? ও তো প্রোডাকশনের দায়িত্বে আছে। পাবলিক রিলেশনের লোকজন এসব সামলাক না। আদিকে বলছে না কেন গৌর?
গৌর একটা চিকেন উইং তুলে কিগানকে বলল, ‘তু তো হিরো হ্যায়। জান পহেচান বড়াহ। তারপর কনভিন্স কর। ফর দ্যাট ল্যান্ড আমি ভাল প্রাইস দেব। টাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।’
‘টাকা!’ কিগান বলল, ‘রাঘব চক্রবর্তী তেমন লোক নয়।’
‘দুর,’ গৌর হো হো করে হাসল, ‘কেউই তেমন থাকে না। তাদের তেমন করে নিতে হয়। এভরি ওয়ান ইন দিস ফাকিং ওয়ার্ল্ড ইজ সেলেবল। শুধু প্রাইস ঠিক করতে হয়। জাস্ট নো রাঘব চক্রবর্তীজ প্রাইস। কেমন?’
কিগান ভাবল, ব্যাপারটা যদি তেমন সহজ হত, তবে গৌর কেন পারল না? কেন গৌরের টাকার সঙ্গে গৌরকেও দরজা দেখিয়ে দিয়েছিলেন রাঘববাবু? এইসব টাকাপয়সা কোথাও কোথাও ভোঁতা হয়ে যায়। হঠাৎ স্যামের ফোনটা বেজে উঠল। স্যাম পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে নামটা দেখে বিরক্ত হল যেন। বলল, ‘ওঃ, আজকেও পিছু ছাড়বে না।’ তারপর ফোনটা কেটে, একদম সুইচ অফ করে দিল।
গৌর হাসল, ‘কৌন থা স্যাম? গার্ল ফ্রেন্ড?’
‘না স্যার,’ স্যামও হাসল, ‘নট দ্যাট লাকি। ওই প্রোজেকশন কর্পের মেয়েটা।’
‘আরে, মেয়ে? অর, আপনে ডিসকানেক্ট কর দিয়া?’ গৌর চুকচুক শব্দ করে মাথা নাড়ল, ‘আপ পাগল হো?’
স্যাম বলল, ‘স্যার ওই জুস ফ্যাক্টরির প্রজেক্টটা নিয়ে মাথা খাচ্ছে। জাস্ট স্পেসিফিকেশন দিয়েছি সবে, তাতেও দিনে চল্লিশবার ফোন আসছে।’
‘কৌন সা কোম্পানি? কে এমন করছে?’ গৌর আর-একটা বড় ড্রিঙ্ক বানাল।
স্যাম বিরক্ত মুখে নিজের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, ‘প্রোজেকশন কর্পের একটা মেয়ে। ওদের ছ’জনকে তো ওয়াটার বার্ড তুলে নিয়েছে। ফলে মেয়েটা সেল্স টিমে নতুন। মাথা খেয়ে নিচ্ছে গত কয়েকদিন ধরে।’
‘আপ তো লাকি হো।’ গৌর হালকা গলায় কথাটা বলে কিগানের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল।
‘না স্যার,’ স্যামের মুখে বিরক্তি, ‘কিছুই এখনও হয়নি, আর মাথা খাচ্ছে! ওই জমিটা যতক্ষণ না পাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ তো আর কাজ শুরু করা যাবে না। কে ঝামেলা হ্যান্ডেল করবে?’
‘তা মেয়েটার নাম কী? হ্যাভ ইউ মেট হার?’
‘কলকাতায় একবার মিট করেছি। ম্যারেড। বাট কোয়ায়েট চার্মিং, আই মাস্ট সে।’ স্যাম এক চুমুকে গ্লাসটা শেষ করল, বলল, ‘লাস্ট টেন ইয়ার্স শি ওয়াজ আউট অব ইন্ডিয়া।’
‘তাই? ইন্টারেস্টিং।’ গৌর হাসল, ‘নাম কী?’
‘নাম?’ এক মুহূর্ত ভাবল স্যাম। তারপর বলল, ‘আ লিট্ল আনইউজুয়াল। ইয়েস, বোস, জিয়ানা বোস।’
আলতো একটা কুয়াশার পরদা উড়ল কোথাও? ভোরের কলকাতা থেকে কে যেন লঘু পায়ে হেঁটে এল এত বছর পর। এত বছর পর একটা রোদ এসে পড়ল ক্লাস ঘরে। কে যেন গেয়ে উঠল, ‘আমি কান পেতে রই…’
কিগান বুঝল, এই নীল রঙের গ্রহটা বড্ড বেশি গোল আর বড্ড ছোট। এখানে বারবার যার সঙ্গে দেখা হওয়ার নয়, তার সামনেই পড়তে হয়। যে কথা শুনতে ইচ্ছে করে না, সে কথাই শুনতে হয়। যে স্মৃতি ভুলতে চায় তাই ঝাঁপিয়ে পড়ে মাথায়। কিগান বুঝল, ও কলকাতা আর অতীত ছেড়ে আসতে চাইলেও তারা ছাড়ছে না কিগানকে।
কিগান মাথা নিচু করল। ভাবল, জিয়ানা কি তবে এই চাপাডাঙাতেও আসবে? আবার কি এই কিগানের দেখা হবে সেই কলেজবেলার কিগানের সঙ্গে?