৫
উঠোনের ওপর এসে পড়া রোদটা দেখে রাহি বোঝে যে, সাতটা বেজে গেছে। গানদাদু চলে গেল আজ। মালিদার মাটি কোপানো, নিড়ানো আর জলসাজি হয়ে গেছে। বোঝে পালোয়ান এতক্ষণে লেজ নাড়তে নাড়তে বাবার পিছন পিছন খেতের আল ধরে হাঁটছে। মা পিছনের তরকারি বাগানে গিয়ে খুদেকে দিয়ে আনাজ তোলাচ্ছে। জীবনদার হয়তো মাছ ধরাও হয়ে গেছে অনেকটা। পুশিদির বিড়ালটা পাঁচিলের ওপর বসে থাবা চাটছে এখন। বোঝে একটু দূরের ওই বাড়ির মানুষটারও হয়তো বারান্দায় বসে মাউথঅর্গান বাজানো শেষ।
আসলে রোদটা রাহির অ্যালার্ম ক্লক। ওকে ঘুমের রাজ্য থেকে এই পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার সিঁড়ি। আজও সেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল রাহি। বিছানায় শুয়ে দেখল বড় উঠোনটায় শিউলি বোঁটার মতো রোদ পড়ে ভেসে যাচ্ছে। খুলে রাখা জানলা দিয়ে শরতের হাওয়া হইহই করে ঢুকে পড়ছে ঘরে। আর উনিশ-বিশ নামের কাঠবেড়ালি পাশের বড় কাঁঠালচাঁপার থেকে দৌড়ে নেমে আসছে জানলার গোড়ায়।
রাহির আজ মাথাটা একটু ধরে আছে। আসলে শুতে শুতে অনেক রাত হয়েছে গতকাল। প্রায় দুটো। সন্ধিপুজো দেখছিল যে। কিন্তু পুরোটা দেখতে পারেনি। সাধুদার কাঁধে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। তখন মা-ই জোর করে শুতে পাঠিয়েছিল। তাই তো উঠতে দেরি হয়ে গেল। আর দিনটা ওকে ফাঁকি দিয়ে গড়িয়ে গেল খানিকটা।
আজ নবমী। ঠাকুরদালান থেকে মন্ত্রপাঠের স্বর হালকা প্রজাপতির মতো উড়তে উড়তে আসছে এদিকে। পুরুতমশাইয়ের সংস্কৃত উচ্চারণটা ভাল। বাবা সকাল দশটার আগে ঢাক বাজাতে দেয় না। বলে, সবার অসুবিধে হবে। আর যখন বাজায় তখনও একটুখানি সময়ের জন্য। কারণ বাবার কথায়, রাহি পছন্দ করে না। মা রাগ করে বলে, ‘আদিখ্যেতা।’ বলে, ‘বাপসোহাগি।’ বলে, ‘তোমার মতো করে মেয়ের মাথা আর কাউকে খেতে দেখিনি আমি।’
বাবা হাসে। কিছু বলে না। আসলে বাবা যেন অন্ধ রাহির প্রতি। রাহির মাঝে মাঝে মনে হয় এত আদর কি ওর প্রাপ্য? বাবা কি একটু বেশিই ভালবাসে না ওকে? একটু বেশিই কি প্রশ্রয় দেয় না? দাদার বেলায় তো বাবা এমন নয়। কারও বেলাই নয়। শুধু রাহি কিছু বললে বাবা না করে না। বা বলা যায় রাহিকে নিজের থেকে একদম কিছু বলতেই হয় না। ওর কী চাই না চাই, সবটাই বাবা যেন কীভাবে বুঝে যায় আর এনে দেয়।
চাপাডাঙার মতো একটা গ্রামে থেকেও কী নেই রাহির? কম্পিউটার থেকে স্কুটি। বাড়িতে ছোট্ট একটা জিম থেকে পাথর বাঁধানো রাস্তা, সব, সব করে দিয়েছে বাবা। ওর বন্ধুরা এসে তো বলে ওদের বাড়িটা ফাইভ স্টার রিসর্ট একটা। বলে, ইস এমন বাবা যদি ওদের থাকত!
এমন বাবা আর কারও থাকতে পারে না। রাহি জানে। এমন ঝাল, টক, নোনতা, মিষ্টির সমান মিশ্রণ আর কারও ভেতর থাকতেই পারে না। না হলে কি আর সবাই এমনি এমনি রাঘব চক্কোত্তির নামে মাথা নোয়ায়? এমনকী অঞ্চলের এমএলএ, এমপি পর্যন্ত বাবাকে খাতির করে। পুলিশ খাতির করে। আবার সাধারণ গ্রামের মানুষ, হাটুরে ভ্যাবাচ্যাকা সব মানুষও ভালবাসে বাবাকে। সবার ভালবাসা পাওয়া অত সোজা নয়। আর সবাই তো ছাড়, একজনের ভালবাসা পাওয়াই কত কঠিন!
একজন! বুকের ভেতরটা চলকে উঠল একটু। একটা মাউথঅর্গান যেন দেখতে পেল ও। দেখতে পেল দুটো অদ্ভুত নীল চোখ।
একেতেই মাথা ধরে আছে, তার ওপর হঠাৎ ‘একজন’-এর কথা মনে পড়াতে মনটা কেমন যেন টলোমলো হয়ে গেল প্রথমেই। বাইরের রোদের দিকে তাকিয়ে রাহির মনে হল, এবারের শরৎটা যেন কেমন। যেন কেমন একটা নিঃসঙ্গতার মতো। একলা মেঘের মতো। বেখেয়ালি ফিঙের মতো।
বিছানা থেকে উঠল রাহি। জানালা দিয়ে দেখল নন্দঢাকি আর তার দুই শাগরেদ পালক লাগানো দুটো ইয়াব্বড় ঢাক নিয়ে যাচ্ছে। না, এখন বাজাবে না। বরং পুজো করবে। ঠাকুরের সিঁদুর থেকে একটু নিয়ে ঢাকের গায়ে লাগিয়ে নন্দ হাঁটু গেড়ে নিজের মনে কীসব প্রার্থনা জানায়। দেখে হাসি পায় রাহির। পুজো-আচ্চার ভেতরের কাজকর্মগুলো ভাল লাগে রাহির। কিন্তু কোথায় জানি মনের ভেতরে ঈশ্বরবিশ্বাসে একটা ঘাটতি আছে ওর। এটা কাউকে ও বলে না। কিন্তু ও নিজে জানে ঠাকুর প্রণাম করা, বা সন্ধিপুজো দেখার উৎসাহটা আসলে বানানো। বাবাকে খুশি করা। বাবার তো দেবদ্বিজে অতিরিক্ত ভক্তি। আসলে বাবাকে খুশি করতে পারলে রাহির নিজের ভাল লাগে। মনে হয় কিছু তো করছে মানুষটার জন্য। দাদা তো আর মানুষ নেই। সবসময় বাবার থেকে দূরে থাকে। তাই রাহি দেখে ওর থেকে বাবা যেন কোনও দুঃখ না পায়।
দুঃখ ব্যাপারটা রাহি পছন্দ করে না একদম। মনে হয় এর মতো খারাপ জিনিস পৃথিবীতে আর নেই। কেন রে বাবা? মানুষ কতদিন বাঁচে যে, তার মধ্যে আবার দুঃখ টুঃখ পেতে হবে? হাসি আর মজা দিয়ে নিজের জীবনটাকে বানানো কি এতই কঠিন? তাই তো রাহি কক্ষনও দুঃখের সাপোর্টার নয়। বরং শাহরুখ খানের সাপোর্টার। ওঃ, কী আনন্দই না করতে পারে লোকটা! সব ছবিতে হাসি আর মজা। না, ঠিক সব ছবিতে নয়। তবে বেশির ভাগ ছবিতে। সেই আনন্দ আর হাসির ছবিগুলোই বেশি করে দেখে রাহি। বারবার দেখে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে। দুঃখ কী ও জানতেই চায় না।
কিন্তু চাওয়ার ওপর যদি সব নির্ভর করত তা হলে পৃথিবীর এত সমস্যা থাকত কি? আর পৃথিবীর কথা বাদ দাও, রাহির নিজেরও কি এত সমস্যা থাকত?
এই চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত রাহি যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। পড়াশোনা মোটামুটি করেছে, ইতিহাসে অনার্স নিয়ে পাশ করে বাবার প্রতিষ্ঠা করা স্কুলেই চাকরি করছে। তবে মাইনেপত্তর নেয় না। সারাদিন বাচ্চাদের সঙ্গে থাকাটাই ওর আনন্দ। ওর সুখ।
কিন্তু সুখ কি ওর সহ্য হয় না? কষ্ট কি সবার মতো ওকে পেতেই হবে? না হলে, প্রায় মাস দুয়েক হল, কেন ওর এমন মনখারাপ হয়ে থাকে? বুকটা কেন এমন টুপুটুপু গ্লাস ভরতি জল হয়ে আছে? কেন আচমকাই বড্ড কাঁদতে ইচ্ছে করে? মনে হয় সব থেকেও কী যেন নেই? কেন ক্লাসের বাইরের পুকুরটায় পানকৌড়ির ডুব দেখলে মনখারাপ হয়ে যায়? কেন মনে হয় বাগানের এত ফুল অনর্থক ফুটে রয়েছে? মনে হয় কেউ রাহিকে ভালই বাসে না?
কে রাহিকে ভালবাসে না? বাবা, মা থেকে শুরু করে পাড়াপ্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব সব্বাই খুব ভালবাসে রাহিকে। এমনকী দাদা যে অমন মানুষ, সেও খুব ভালবাসে ছোট বোনটাকে। তবু কেন মনে হয় কেউ ভালবাসে না? কেন মনে হয় একদিন পুকুরে ডুবে মরবে? সাধুদাকে দিয়ে একশোটা ঘুমের বড়ি কিনে আনিয়ে খাবে? কেন মনে হয় পাগলির মতো কাটিয়ে দেবে জীবনটা?
পাগলি! পাগলিই তো। বাবা তো রাহিকে ‘পাগলি মা’ বলেই ডাকে। আসলে চব্বিশ বছর বয়সই হয়েছে রাহির, কিন্তু মনে মনে বড়টি হয়নি একদম। ও জানে বাবার স্কুল বলেই চাকরি করতে পারছে, না হলে কবে চাকরি চলে যেত ওর! কোনও টিচার যদি টিফিনে শাড়ির আঁচল গুঁজে ছাত্রীদের সঙ্গে এক্কাদোক্কা খেলে, তাকে কি কেউ মানবে? যদি ছুটির পর ঢিল মেরে আম পাড়ে, তার ক্লাসে কি কেউ পড়া করে আসবে?
আসলে চাপাডাঙার সবাই জানে যে, রাঘব চক্কোত্তির ছোটমেয়েটি ছেলেমানুষ। তাই কেউ কিছু ধরে না। বরং উলটে প্রশ্রয় দেয়।
শুধু একজন দেয় না। কারণ সে লক্ষই করে না যে, রাহি বলে একটা মেয়ে এই পৃথিবীতে আছে। সে সারাদিন ফ্যাক্টরিতে কাজ করে আর সন্ধেবেলা মাউথঅর্গান নিয়ে, গিটার নিয়ে বসে থাকে বারান্দায়। আর কখনও কখনও ক্যামেরা কাঁধে গ্রামের পথে বেরিয়ে পড়ে ছবি তুলতে। তলতাবনির জঙ্গলে সে ঘুরে বেড়ায় একা।
তলতাবনির জঙ্গল এই অঞ্চলে বিখ্যাত। বা বলা যায় কুখ্যাত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই জঙ্গলের একটা অংশকে পরিষ্কার করে হ্যাঙার তৈরি করা হয়েছিল। যুদ্ধবিমান রাখা হত ওখানে। বিদেশি সৈন্যদের জন্য একটা চার্চও তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এখন সব কিছুর কঙ্কাল পড়ে আছে। এরোপ্লেনের ভাঙা পাখনা, মেশিনগানের প্রায় নেই হয়ে যাওয়া শরীর, হেলমেটের ক্ষয়াটে মাথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এখানে ওখানে। আর রয়েছে অন্ধ, ফোকলা দৈত্যের মতো হ্যাঙার, লতানো গুল্মে ঢেকে যাওয়া বৃদ্ধ চার্চ।
রাহিদের এই চাপাডাঙা অঞ্চলটা বর্ডারের কাছে। ফলে ছায়াছন্ন কাজকর্ম ভালই হয় এখানে। তা ছাড়া রাজনৈতিক টেনশনও আছে। এই দুইয়ের যোগফলে দু’-চারটে লাশ এখানে ওখানে বাতিল প্লাস্টিকের মতো প্রায়ই পড়ে থাকে। বিশেষ করে এই হ্যাঙার অঞ্চলে। তাই এ অঞ্চলের সবাই তলতাবনির জঙ্গলটা এড়িয়ে চলে। শুধু ওই একজন এসব মানে না। প্রায় দু’মাস তো দেখছে মানুষটাকে। সে এসব কেয়ারই করে না। বরং ফাঁক পেলেই ক্যামেরা কাঁধে ঢুকে পড়ে জঙ্গলে। ভয় লাগে রাহির। বুক কাঁপে। সেই দুপুরগুলোয় ভাত-ই খেতে পারে না ঠিকমতো। ছাত্রছাত্রীদের খাতা দেখতে বসলে ভুল ঠিক সব গুলিয়ে যায় একদম। নিজেকে এসবের ভেতর জড়াতে চায় না ও। কিন্তু পারে না। কেবলই মনটা গড়িয়ে যায় ওদিকে।
আর সমস্যা হচ্ছে, এসব কাউকে বলতে পারে না ও। এমনকী বন্ধু যে বন্ধু হোমি, ওকেও বলতে পারে না। শুধু মনে হয় ও হাসবে। একদম গুরুত্ব দেবে না। আর হোমির যা পেটপাতলা, দু’দিনের ভেতর চাপাডাঙার লোকাল হেডলাইন হয়ে যাবে খবরটা। তার চেয়ে এই ভাল। বুকের ভেতর টুপুটুপু হয়ে ভরে থাকা জলের গেলাস আর পেটের ভেতর নুড়ি কুড়োনো ডুবুরি নিয়ে এই ভাল বেঁচে থাকা রাহির।
তবে মাঝে মাঝে বাবার পরিচিত কিছু মানুষ ওকে রাজনীতির ময়দানে ডাকে। বলে, ‘তুমি এসো আমাদের সঙ্গে।’ কিন্তু পাত্তা দেয় না ও।
এসব পার্টি-পলিটিক্স বোঝে না রাহি। আর বুঝতেও চায় না। এই ক্ষমতা টমতা দিয়ে কী হবে? যত্তসব ঝঞ্ঝাট! তবু কী অবাক! মানুষ এর পিছনেই অন্ধের মতো ছোটে। দাদাকেই দেখো না।
চাপাডাঙার সবাই দাদাকে ভয় পায় খুব। চমক একটা ত্রাস সৃষ্টিকারী নাম। স্থানীয় এমএলএ সুধাদির খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে কাজ করে চমক। সেই সুধাদি পর্যন্ত চমককে সমীহ করে।
চমক বেঁটে। পাঁচ দু’-আড়াই হবে। রোগা, দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। দেখলে মনে হয় ভাজা বা সেদ্ধ কোনও মাছ-ই উলটে খেতে পারবে না। কিন্তু চমক খতরনাক ছেলে। রাহি নিজে চমকের কাছে পিস্তল দেখেছে।
চমক বি কম পাশ করার পর বাবা ওকে একটা চাকরি জোগাড় করে দিয়েছিল। বাবার কথা হচ্ছে, মানুষকে নিজের উপার্জনে দাঁড়াতে হয়। অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে যে-মানুষ ওঠে সে প্রকৃত মানুষ নয়। বাবা নিজের যা-কিছু রোজগার তা নিজেই করেছে। কারও সাহায্য নেয়নি। কিন্তু সবাই তো আর বাবা নয়। আর রাহি জানে, বাবার মতো পরিশ্রমী বা অধ্যবসায় ওর দাদার নেই। চমকের সব কিছুই খুব দ্রুত চাই। ছোট থেকেই। সাইকেল চাই মানে তক্ষুনি চাই। বাইক চাই মানে একদিন দেরি করা যাবে না। এমনকী এই যে দীপাঞ্জলিকে বিয়ে করেছে সেটাও তড়িঘড়ি।
কলেজ থেকেই রাজনীতি করত চমক। কলেজের জিএস পর্যন্ত হয়েছিল। আর তার জন্য যেখানে যেখানে যা যা করতে হয়েছে, করেছে। বোমাবাজি থেকে ক্ষুর রড দিয়ে মেরে বিরোধীদের চোয়াল ভেঙে দেওয়া থেকে ভয় দেখাতে বিরোধী প্রার্থীর বাড়ির কুকুরের গায়ে অ্যাসিড মারা—সব করেছে। আসলে চমক সব করতে পারে। সেই জন্যই সবাই এত ভয় পায় ওকে।
রাহি তো শুনেছে যে, চমক নাকি মানুষও মেরেছে! কিন্তু রাঘব চক্কোত্তির ছেলে বলে পার পেয়ে গিয়েছে। চমক দুর্দান্ত, ডানপিটে আর রগচটা হতে পারে, কিন্তু মানুষ মারবে? এতটা বিশ্বাস করে না রাহি। চমক অমন মানুষ হলে দীপার মতো মেয়ে কি আর ভালবাসত ওকে?
দীপা যেন চমকের উলটো পিঠ। যেমন নম্র, তেমন শান্ত। এই মেয়ে যে কী করে চমকের সঙ্গে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল কে জানে!
আজ থেকে পাঁচ বছর আগের কথা। তখন চমক সুধাদির সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেছে। একটা রক্তদান শিবির উপলক্ষে দীপাদের বাড়িতে গিয়েছিল চাঁদা তুলতে। এমনিতে চমক এসব ব্যাপারে থাকে না। কিন্তু দীপার বাবা উমেশ রায় দশ হাজার টাকা দিতে অস্বীকার করেছিল। তাই শুভকাজে দীপার বাবার সম্মতি আনতে সুধাদি চমককে পাঠিয়েছিল।
সেই ছিল দীপা আর চমকের প্রথম দেখা। তারপর যত সময় গড়িয়েছে ওদের সম্পর্ক তত ঘন হয়েছে। দীপার বাবার দুটো পেট্রল পাম্প ছাড়াও চালের হোলসেল কারবার আছে। দুটো মাছের ভেড়িও আছে। ফলে পয়সাওয়ালা মানুষ হিসেবে রাঘব চক্কোত্তিকে সে খুব একটা সমীহ করে না। বরং কিছুটা অবজ্ঞাই করে। আর জোর করে দশ হাজার টাকা আদায়টাকে খুব ভালভাবে নেয়নি ভদ্রলোক। চমকের বিরুদ্ধে থানায় জুলুমবাজির অভিযোগে ডায়েরিও করেছিল। কিন্তু রাঘবের হস্তক্ষেপে ব্যাপারটা এগোয়নি।
তারপর উমেশ যখন জানল যে, মেয়ের সঙ্গে এই চমকই প্রেম করছে, তখন তো পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে। দীপাকে বর্ধমানে পাঠিয়ে দেয়। চমক এক রাতে গিয়ে উমেশের পেট্রল পাম্পে ভাঙচুর চালায়। তারপর সোজা বাড়িতে ঢুকে উমেশকে বন্দুক নাচিয়ে শাসিয়ে আসে। উমেশও বাইরের থেকে গুন্ডা আনিয়ে চমককে মার খাওয়ানোর প্ল্যান করে। কিন্তু পারেনি। সাধুদার জন্য পারেনি।
তারপর মাস তিন-চারেক আচমকাই সব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। সবাই ভেবেছিল অশান্তি বোধহয় মিটল। কিন্তু তখনই এক সন্ধেবেলা সব ওলটপালট হয়ে যায়। দিনটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে রাহির। সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল।
‘রাহি,’ মায়ের ডাকে জানলার দিক থেকে মুখ ফেরাল ও। মা পুজোর জোগানের তদারক করে আর খুদেকে দিয়ে আনাজ তুলিয়ে এরই ভেতর চা নিয়ে এসেছে। রাহি মাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। কী করে একটা মানুষ এত কিছুর ভার একা সামলায়? মায়ের বিয়ে হয়েছিল আঠারো বছর বয়সে তারপর থেকে এই পঞ্চাশ বছর অবধি মা-ই আসল দশভুজা।
‘হাই মা,’ রাহি বিছানায় বসেই আড়মোড়া ভাঙল।
‘এ কী, নাইটি পরে আছিস?’ মায়ের গলায় বিরক্তি, ‘এমন ছেঁড়াফাটা জিনিস পরিস কেন রে? তোর কিছু নেই নাকি? তা ছাড়া এমন পুজোর বাড়ি কে কখন এসে পড়বে। এমন উদলা হয়ে বসে আছিস!’
‘যা গরম!’ রাহি হাসল।
‘তা এসি চালাসনি কেন? আর শরৎকালে এমন গরম এখন নেই যে, এরকম জামাকাপড় পরতে হবে।’
‘এসি ভাল লাগে না, তুমি তো জানো। কেমন বদ্ধ আর শুকনো মনে হয়। আর তা ছাড়া, আমার ঘরে কেউ আসবে না।’
‘তা হলেও,’ মা চায়ের কাপটা বেডসাইড টেবিলের ওপর রেখে বলল, ‘এমন জামাকাপড় কেউ পুজোর দিনে পরে?’
‘আচ্ছা বাবা আচ্ছা,’ রাহি বিছানার থেকে উঠে গালটা টিপে দিল মায়ের, বলল, ‘মা, দাদা কোথায় গো?’
‘কেন? কোথায় বেরোল যেন।’
‘আমার স্কুটির হ্যান্ডেল অ্যালাইনমেন্টটা নষ্ট হয়ে গেছে। ওকে বলেছিলাম ঠিক করিয়ে আনতে। ভেবেছিলাম হোমিকে নিয়ে গোবরডাঙা আর মছলন্দপুরের ঠাকুরগুলো দেখে আসব।’
‘অত দূরে?’ মা আঁতকে উঠল, ‘পাগলি নাকি তুই? তা ছাড়া বাড়িতে পুজো, কত লোকজন এসেছে। কোথায় এখানে থেকে একটু দেখাশোনা করবি, না বাড়ির মেয়ে ধিঙ্গিপনা করতে বেরোবে! যেমন দাদা, তেমন তার বোন। দীপার হয়েছে এক জ্বালা। ও একা কত দিক সামলাবে? এবার একটু সংসারটার টুকটাক কাজের দায়িত্ব নে।’
‘মা,’ রাহি চায়ের কাপটা নিয়ে বিরক্ত হয়ে তাকাল, ‘আজকেও তুমি শুরু করলে?’
‘শেষ হয়েছে নাকি যে শুরু করব? একটু বড় হ রাহি। এমন ছেলেমানুষ হয়ে থাকিস না।’
‘মা, প্লিজ তুমি এবার যাও। আমি ফ্রেশ হয়ে নেব এবার।’
বাথরুমটা রাহির খুব প্রিয় জায়গা। এখানে যেটুকু সময় কাটায় মন ভাল হয়ে যায় ওর। বাথরুমের দেওয়াল সমুদ্রনীল রঙের। বাথরুমে গিজার থেকে বাথটব সব আছে। সময় থাকলে বাথটবে শুয়ে পড়ে রাহি। কিন্তু আজ আর সময় নেই। কারণ পুজোমণ্ডপে যেতে হবে। আর দেরি হলে বাবা রাগ করবে। বাবা ওর ওপর রাগ করলে সবচেয়ে কষ্ট হয় রাহির।
আজ ব্রাশ ট্রাশ সেরে শাওয়ার খুলে দাঁড়িয়ে পড়ল রাহি। ঠান্ডা জল মাথা বেয়ে লক্ষ লক্ষ আঙুলে চেপে ধরল শরীরটাকে। চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল ও। আর সঙ্গে সঙ্গে চোখের পাতা ফুঁড়ে কোত্থেকে যেন উদয় হল এক জোড়া চোখ। অমন অদ্ভুত নীল রঙের চোখ কোনওদিন দেখেনি রাহি। নিমেষে শরীরে গোলাপকাঁটা জেগে উঠল ওর। বৃন্ত দৃঢ় হল। গরম রক্তের স্রোত চলকে উঠল শিরায়। শ্বাস গাঢ় হয়ে উঠল।
রাহি চোখ খুলল সঙ্গে সঙ্গে। পাগলি, ছেলেমানুষ, যে যাই বলুক, রাহি নিজে জানে ও কতটা বড় হয়েছে। এইসব নিস্তব্ধ আর একান্ত মুহূর্তগুলো ওকে বড় করে দেয় আরও। রাহি বোঝে শরীরের কষ্টের মতো কষ্ট খুব কম আছে পৃথিবীতে। নিজের পছন্দের মানুষের থেকে দূরে থাকার কষ্টও খুব কম আছে।
আজ একটু সময় নিয়ে শরীর মুছল রাহি। বাবার রাগ হতে পারে দেরি হলে, এই সম্ভাবনাটা মনের ভেতরের কোন পুকুরে যে, ডুব মারল কে জানে! বরং নিজের হাতের স্পর্শটা ক্ষণিকের জন্য অন্যের মনে হল। মনে হল একজন পরম যত্ন নিয়ে শরীর থেকে সরিয়ে দিচ্ছে অতিরিক্ত জলের দৃষ্টি।
স্নান সেরে শাড়ি পরে সামান্যই সাজল রাহি। ও কখনওই কসমেটিক্সের বিজ্ঞাপন হয় না।
শরতের আকাশ আজ দারুণ ফর্মে আছে। দিগন্তজোড়া অ্যাকোরিয়ামের ভিতর হাওয়া মিঠাইয়ের মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। গাছগুলোও যেন আজ বাড়াবাড়ি রকমের সবুজ। এবার পুজোয় টুকটাক বৃষ্টি হচ্ছে। যেমন গতকালও হয়েছিল। কিন্তু কী এক জাদুতে যে এক রাতের ভেতর পুরো দৃশ্যপটই পালটে গেল কে জানে।
রাহি ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে দাঁড়াল। মুগডালের মতো রোদ আকাশের বাটি উলটে গড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। সেলোফোনের মতো পাতলা হাওয়া বইছে একটা। একটু দূরে সাধুদা বসে নারকেল ছাড়াচ্ছে। কাল বিজয়াদশমী। বাড়িতে নাড়ু হবে। যদিও অন্য কাজের লোকজনের এসব করার কথা। তারা করেও। তবু এই বিশেষ দিনটায় সাধুদা নারকেলের দায়িত্ব নেয়। নিজে নারকেল ছাড়ায়। দাঁড়িয়ে থেকে কোরানো, পাক, ছাঁচ সব নিজে তদারক করে। সাধুদার রান্নার হাত খুব ভাল। দেশি-বিদেশি নানারকম রান্নায় মানুষটা সিদ্ধহস্ত। আসলে সাধুদা অনেক কিছুতেই সিদ্ধহস্ত। এ অঞ্চলের সবাই জানে রাঘব চক্কোত্তির ডান হাত হল সাধু সেনাপতি।
রাহি জন্মের সময় থেকেই এই মানুষটাকে দেখছে। লম্বা, পাকানো চেহারা। কাঁধ অবধি চুল। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। মেটে মেটে গায়ের রং মানুষটার। ভাল গান করে, তবলা আর বেহালা বাজায়। আর দুর্দান্ত সাহস।
সাধুদা বিয়ে-শাদি করেনি। ওদের এই বিশাল কম্পাউন্ডের একধারে দু’কামরার ঘরে থাকে। নিজেই দুটো ফুটিয়ে খায়। রাহি কতবার বলেছে, ‘তুমি আমাদের সঙ্গে খাও না কেন সাধুদা? আমাদের রান্না খারাপ?’
সাধুদা উত্তর দিয়েছে, ‘না গো দিদি, খারাপ কেন হবে? আমার পেটেই ভাল জিনিস সহ্য হয় না। কুকুরের পেটে কি আর ঘি সহ্য হয়?’
‘বাজে কথা বোলো না তো।’ রাহি রাগ করেছে। কিন্তু সাধুদা কিচ্ছু মনে করেনি। বাবার চেয়ে প্রায় বছর দশেকের ছোট সাধুদা। মায়ের সমবয়সি। তবু সাধুদা বলে রাহি। জন্মের পর কথা বলার সময় থেকেই ডেকে আসছে এমনভাবে। মা রাগ করত প্রথম প্রথম। কিন্তু সাধুদা হাসত। বলত, ‘থাক না বউঠান। ডাকটাই কি আসল? আসল তো মনটা। কে কাকে কী বলে ডাকে তার চেয়ে জরুরি হল, কে কাকে কী মনে ডাকে।’
ভীষণ সত্যি কথাটা। রাহি ছোটবেলায় না বুঝলেও এখন বোঝে। আসলে যে যতই ওকে ছেলেমানুষ বা পাগলি বলুক, রাহি যে কত কিছু বোঝে তা তো আর অন্যরা জানে না!
সাধুদা হাতের দা-টা পাশে রেখে ফতুয়ার হাতায় মুখ মুছল। মেটে রঙের মুখটা গর্জন তেল লাগানো মূর্তির মতো চকচক করছে। লম্বা লম্বা চুলগুলোর গোড়ায় স্ফটিকের মতো ঝুলছে ঘামের দানা। দেখো তো, পুজোর দিনে কীভাবে খেটে মরছে লোকটা!
রাহি বলল, ‘কী গো সাধুদা একদম তো স্নান করে গেছ। এসব নিজে করো কেন?’
সাধু হাসল, ‘পুজোর শেষের কাজ। অন্যরা কি তেমনভাবে করতে পারবে?’
‘না পারলে অত পিঠে, পায়েস, নাড়ু খেতে হবে না। বাড়ি ভরতি লোকজন আর তুমি এই বয়সে…’
‘বয়স?’ সাধুদা হাসল, ‘বয়স মানে কী? শরীর কতটা পুরনো হল, তাই তো?’
‘আচ্ছা, বাবা আচ্ছা…’ রাহি রাগ দেখাল, ‘কেবল ফিলজফি আর ফিলজফি। পড়াশোনাটা করলে না কেন বলো তো?’
সাধুদা আবার দা-টা তুলে নিয়ে বাঁ হাত দিয়ে ফলার ধারটা পরীক্ষা করল। তারপর বলল, ‘তুই অত বকিস না তো। যা, মণ্ডপে যা। সারা রাত জেগে সকাল দশটা অবধি ঘুমিয়ে এখন আমার ওপর দিদিমণিগিরি হচ্ছে। দেখ, এরপর থেকে এমন ঘুমোলে নন্দঢাকিকে বলব তোর জানলার পাশে দাঁড়িয়ে অ্যায়সা ঢাক বাজাতে যে তোর যেন চার মাস ঘুম না হয়।’
‘অ্যাঁঃ, সাহস আছে? নন্দদার মাথার পিছনের ওই চারানার চুল তা হলে তুলে নেব আমি।’
সাধুদা হাসল, ‘বড্ড চোপা হয়েছে তোর। যা এখন, আমায় কাজ করতে দে।’
‘ভারী তো মঙ্গলে যাওয়ার রকেট বানাচ্ছ!’
সাধুদা বাঁ হাত দিয়ে একটা নতুন নারকোলের মাথা ধরে দা তুলে কোপ বসাতে বসাতে বলল, ‘যা, মণ্ডপে যা। তবে সাবধানে, আজ ত্রয়ণ এসেছে।’
ত্রয়ণ। নিমেষের জন্য হলেও ভুরুটা একটু কুঁচকে গেল রাহির। ছেলেটাকে দেখলেই নিজের বোকামো মনে পড়ে যায় ওর। আর মনে পড়ে যায় তার পরের ঝামেলাগুলো। এই ছেলেটা আবার আজ এসেছে!
সকালটা আর তেমন ভাল লাগছে না রাহির। রোদটাকে মনে হচ্ছে পুড়ে যাওয়া ডাল। কেন আজ ত্রয়ণ এল? চমক কি ডেকে পাঠিয়েছে? না দীপা? চোয়াল শক্ত করল রাহি। ওর কিচ্ছু করার নেই। ও জানে বাবা অপেক্ষা করছে মণ্ডপে। নবমীর অঞ্জলিটা মিস করা যাবে না। শাড়ির আঁচলটাকে জড়িয়ে নিয়ে মণ্ডপের দিকে হাঁটা দিল রাহি।
রাহির জন্ম এই চাপাডাঙাতেই। সাতচল্লিশে পার্টিশন হওয়ার অনেক আগেই ওর ঠাকুরদারা বাংলাদেশ ছেড়ে এখানে চলে আসে। টাকাপয়সা সঙ্গে আনতে পেরেছিল প্রচুর। আর তার একটা অংশ দিয়েই এই খামারবাড়ির মতো জায়গাটা কেনা হয়েছিল। ক্রমে ক্রমে মদের ডিলারশিপ, ধান-গমের পাইকারি, কলকাতায় দুটো খুব বড় ওষুধের দোকান, ট্রান্সপোর্ট ইত্যাদি নানা ব্যাবসার মাধ্যমে রাঘব চক্কোত্তি তার সম্পদ আর প্রতিপত্তিকে আরও বহু গুণ বাড়িয়ে নিয়েছে।
আগে এই বাড়ির ভেতর একটা নুইয়ে পড়া ঠাকুরদালান ছিল। কিন্তু বছর চারেক হল সেটার পাশে নতুন ঠাকুরদালান আর মণ্ডপ করা হয়েছে। তবে পাশের পুরনো মণ্ডপটা কিন্তু ভাঙা হয়নি। রাঘবের মতে, এর ঐতিহাসিক একটা গুরুত্ব আছে। আসলে পুরনো মণ্ডপটার বয়স প্রায় চারশো বছর। পাতলা লাল ইট আর চুন-সুরকির গাঁথনি দিয়ে তৈরি। তার ওপর টেরাকোটার কাজ করা। হেরিটেজ বলেই মণ্ডপটাকে ভাঙা হয়নি।
নতুন মণ্ডপটাও পুরনো ধাঁচেই তৈরি। বিশেষ অর্ডার দিয়ে পাতলা ইট আনিয়ে বানানো মণ্ডপের গায়ে পোড়ামাটির মূর্তি বসানো হয়েছে টেরাকোটার শিল্প আনিয়ে। তারপর আলোও লাগানো হয়েছে সুন্দরভাবে। রাতেরবেলা আলো জ্বালাবার পর গোটা মণ্ডপটাকে অদ্ভুত সুন্দর দেখতে লাগে।
মণ্ডপের একটু দূরেই ত্রিপল টাঙিয়ে রান্নার বন্দোবস্ত হয়েছে। এমনিতে সবার জন্য খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি আর মিষ্টির বন্দোবস্ত করা হয়েছে। আর বিশেষ অতিথিদের জন্য পোলাও, দু’-তিন রকমের ভাজা, নিরামিষ তরকারির চারটে পদ, চাটনি, মিষ্টি ও পায়েস হয়েছে।
এই পুজোতে অঞ্চলের সমস্ত মান্যগণ্যদের নেমন্তন্ন করা হয়। আর রান্নার গুণে, ঠাকুরের গুণে বা হয়তো রাঘব চক্কোত্তির গুণেই মান্যগণ্যেরা আসেন পুজোতে। ওদের গেটের বাইরে এই পুজো উপলক্ষে বড় মেলাও বসে। সেখানে যাত্রাও হয়। চক্রবর্তী বাড়ির পুজোর কথা এখানে সবাই জানে।
মণ্ডপের সামনে শামিয়ানা টাঙানো। তার তলায় সার দিয়ে মানুষজন দাঁড়িয়ে। অঞ্জলির প্রস্তুতি চলছে। মণ্ডপের ওপর পুরুতমশাই মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে। আর তার পাশে রাঘব। মানুষটা ভীষণ শান্ত। চোখমুখ দেখলে মনে হয়, কাউকে জোরে কথা বলতে পারে না। এমন দিনেও খুব সাধারণ একটা ধুতি আর খদ্দরের চাদর গায়ে জড়িয়ে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে মানুষটা।
রাহি জানে ওকে এই ভিড়ে যেতে হবে না। মণ্ডপের পাশের সিঁড়ি বেয়ে ও গিয়ে দাঁড়াবে বাবার পাশে। এখানে চমকেরও থাকার কথা। কিন্তু দাদাকে চট করে দেখতে পেল না রাহি। মা তো বলল বেরিয়েছে। কিন্তু কোথায় গেছে কে জানে! বাবা যে ভেতরে ভেতরে রেগে আছে তা খুব জানে ও। কিন্তু রেগে থাকলে কী হবে? চমককে বাবা সরাসরি কিছু বলে না। কেন, তা রাহি জানে না।
‘তোর দেরি হল এত?’ দীপার গলার স্বরে পাশে তাকাল রাহি। স্নানটান সেরে দীপা পুরো তৈরি।
রাহি বলল, ‘তুই তো দেখছি অঞ্জলির ইউনিফর্ম পরে ফেলেছিস একদম।’
‘ধ্যাৎ, তাড়াতাড়ি ওপরে চল।’
‘কেন?’ রাহি দীপার তাড়া দেখে অবাক হল।
‘আরে, পনেরো মিনিট ধরে এই অঞ্জলিটা থামিয়ে রাখা হয়েছে তোর জন্য।’
‘সে কী? আমায় তো কেউ কিছু বলেনি।’ রাহির খারাপ লাগল।
‘বাপের আদুরে মেয়েকে কেউ কিছু বলে!’ দীপা হাসল। ভারী সুন্দর হাসি। অন্য কেউ এমন বললে রাহির খারাপ লাগত। কিন্তু এখন লাগল না। কারণ, দীপার কথায় কোনও হুলই ছিল না। দীপা কখনও কাউকে কষ্ট দিয়ে কথা বলে না।
রাহি জিজ্ঞেস করল, ‘দাদা ফেরেনি এখনও? দেখছি না তো!’
দীপার মুখটায় হঠাৎ মেঘ করল যেন। চারদিক একবার চট করে দেখে নিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘গতকাল রাত তিনটে অবধি ওসব খেয়েছে। তারপর একটু আগে বেরিয়ে আবার ফিরে এসে খেতে বসেছে। মা জিজ্ঞেস করছিল। আমার এত লজ্জা লাগছিল বলতে। তাই বলেছি, বেরিয়েছে।’
রাহি দীপার হাত ধরে সিঁড়ির দিকে টানতে টানতে বলল, ‘চল, এখানে দাঁড়িয়ে আর সময় নষ্ট করব না। আর শোন, দাদার এসব করতে লজ্জা লাগে না। তোর কেন লাগছে? তুই তো আর মদ খেয়ে কিছু করিসনি।’
দীপা মাথা নিচু করে নিল।
রাহি গিয়ে দাঁড়াতেই রাঘব হাসল। শান্ত প্রশ্রয়ের হাসি।
রাহি সংকোচের সঙ্গে বলল, ‘বাবা সরি, এত দেরি হয়ে গেল। আসলে, কাল রাতে…’
রাঘব হাত তুলল, ‘বাদ দে, কিচ্ছু দেরি হয়নি।’ তারপর একটু সময় নিয়ে দীপাকে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁরে, চমক কই?’
দীপার মুখটা আবার কালো হয়ে গেল। মাথা নিচু করে নিল ও।
রাহি অবস্থা সামলাতে বলল, ‘ও জানবে কী করে? দাদা তো সকালবেলা বেরিয়েছে শুনলাম। কেন? মা তোমায় কিছু বলেনি?’
রাঘব অবাক হয়ে গেল। কিন্তু কিছু বলল না। শুধু পুরোহিত মশাইয়ের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করল অঞ্জলি শুরু করার জন্য।
অঞ্জলির মন্ত্র রাহির কানে অর্ধেক গেল, অর্ধেক গেল না। আসলে কোনওদিনই যায় না। আর আজ যেন আরওই গেল না। কেন গেল না ঠিক বুঝতে পারল না ও। আসলে মানুষ নিজেই বোঝে না তার মন তার কাছে নেই। বা হয়তো বোঝে কিন্তু সেটা নিজের কাছে স্বীকার করতে চায় না।
অঞ্জলি শেষ করে নামতেই হোমি এসে ধরল ওকে, ‘এই তুই চা খাস তো সকালে। সেই নিয়েই অঞ্জলি দিলি!’
‘তো?’ অবাক হল রাহি।
‘তো কী রে?’ হোমি চোখ পাকাল, ‘জানিস না এমন করতে নেই।’
হাসল রাহি। হোমিকে হাড়ে হাড়ে চেনে ও। খালি ভড়কি দেওয়ার চেষ্টা। নিজে কিন্তু অঞ্জলি দেয়নি। ঠাকুর টাকুর বিশ্বাস করে না। বলে, ‘আমার সঙ্গে ঠাকুর-দেবতাদের হেভি ক্ষার।’
হোমি মেয়েটা খুব ভাল। এখন এমএ করছে। আর পাশাপাশি ‘হেল্প আর্থ’ নামে একটা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। ওরা গাছ সংরক্ষণ নিয়ে কাজকর্ম করে। হোমির কাছে নেচারই হল আসল ভগবান। ও বলে, ‘পুরনো দিনের মানুষ প্রকৃতির পূজা করত। কারণ, তারা সকলে বিজ্ঞানটা বুঝত। আর এখনকার মানুষ বিজ্ঞানে বেশি পণ্ডিত হয়ে গেছে তো তাই বেসিকটা ভুলে গেছে।’
হোমি মাঝে মাঝেই রাহিকে বলে ওদের সঙ্গে যোগ দিতে। বলে, ‘দেখ, তুই রাঘব চক্রবর্তীর মেয়ে। এই অঞ্চলে তোর একটা আলাদা ওজন আছে। তুই আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলে কত সুবিধে হবে বল তো? তা ছাড়া জীবনটা শুধু ছেলেমানুষি করে কাটিয়ে দিবি? সাবস্ট্যানশিয়াল কিছু করবি না? তোরা যদি না আসিস তা হলে পৃথিবীতে কাজ হবে কী করে? বোঝ, রাহি বোঝ। পৃথিবীর খুব দুর্দিন। আমাদের কাছাকাছি, পাশাপাশি দাঁড়াতে হবে। বুঝলি?’
‘পৃথিবী?’ হোমির কথায় অবাক হয়ে তাকিয়েছিল রাহি। কী, বলে কী মেয়েটা? কোথায় পৃথিবী আর কোথায় রাহি? পৃথিবীর দুর্দিনে ও কী করবে? এই বিশাল পৃথিবীর তুলনায় ও কে? ওর কী এমন গুরুত্ব?
রাহি আলতো কিল মারল হোমির পিঠে। তারপর বলল, ‘বিকেলে বেরোবি? স্কুটিটা দাদাকে বলেছি ঠিক করে এনে দিতে।’
‘বিকেলে?’ হোমি একটু ভাবল, ‘মা বলেছিল, বাড়িতে থাকতে। মাসি, গুন্ডা সব আসবে কিন্তু…বাই দ্য ওয়ে, কীভাবে বেরোবি? এই পুজোর দিনে কোনও গ্যারাজ তোর গাড়ি ঠিক করে দেবে?’
রাহি কিছু বলার আগেই পিছন থেকে একটা গলা বলে উঠল, ‘কার ঘাড়ে ক’টা মাথা যে, রাঘব চক্কোত্তির মেয়ের স্কুটি ঠিক করবে না? পুজো হোক বা কারফিউ, গাড়ি ঠিক হবেই।’
রাহি চোয়াল শক্ত করল। ত্রয়ণের গলায় সবসময় কেমন যেন কাঁটা থাকে। সামান্য কথাও কেমন বিষ হয়ে আসে যেন। রাহির বিরক্ত লাগে। আর ওই সিড়িঙ্গে চাপ দাড়িওয়ালা ছেলেটার চেহারাটাও বদখত লাগে। টিপিক্যাল আঁতেল। সব বোঝে আর সব বিষয় নিয়ে শেষকথা বলার জন্য যেন মুখিয়ে থাকে। সবাই ভাবে খুব ভাল ছেলে। কিন্তু রাহি তো জানে ত্রয়ণ কী জিনিস।
‘কেমন আছ হোমি?’ ত্রয়ণ সামনে এসে দাঁড়াল।
‘চলছে।’ হোমি কাঁধ ঝাঁকাল। যেন কাঁধে আরশোলা বসেছে।
ত্রয়ণ এবার তাকাল রাহির দিকে। মুখে চটচটে একটা হাসি। রাহির মনে হল থাপ্পড় মেরে চোয়াল ভেঙে দেয়।
ত্রয়ণ জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছ রাহি? সব ভাল তো?’
রাহি বলল, ‘চলছে একরকম। তুমি হঠাৎ এলে?’
ত্রয়ণ বলল, ‘তোমায় দেখতে ইচ্ছে করল তো। তাই…’
‘মানে?’ রাহি ছিটকে উঠল। হোমির চোখে-মুখেও আশ্চর্য ভাব।
ত্রয়ণ হাসল, ‘জাস্ট জোকিং। সেন্স অব হিউমার তো পুরো নষ্ট হয়ে গেছে দেখছি! জেঠু নেমন্তন্ন করল, আর দিদিও বলল, তাই…’
বাবা তো নেমন্তন্ন প্রতি বছরই করে। আর দিদি মানে দীপা? ও তো ত্রয়ণকে পছন্দ করে না খুব একটা। বলে এই মামাতো ভাইটা নাকি চিরকালের সৃষ্টিছাড়া। বলে, ও একটা কলঙ্ক। সারাদিন মাঠেঘাটে ঘুরে নাকি পার্টি করে বেড়ায়। উমেশ রায়দের বাড়িতে অবশ্য টাকা ছাড়া অন্য কিছুতেই গুরুত্ব দেওয়া হয় না। দীপা হয়তো সেই শুনেই বলে।
কিন্তু আসলে তা নয়। পার্টির হয়ে কাজ করা তো খারাপ কিছু নয়। সেই জন্য যে, ত্রয়ণকে খারাপ বলতে হবে তা মানে না রাহি। ত্রয়ণ খারাপ অন্য কারণে। সেটা একমাত্র ও জানে।
হোমি বলল, ‘রাহি, আমি আসি রে। দুপুরে মায়ের সঙ্গে কথা বলে তোকে ফোনে জানিয়ে দেব যে, আদৌ আমার যাওয়া হবে কিনা।’
‘প্লিজ, চেষ্টা করিস। মছলন্দপুরে নাকি জ্যান্ত দুর্গা এসেছে। লক্ষ্মী-সরস্বতী-গণেশ সব নাকি জ্যান্ত। শুধু পেঁচা-ইঁদুর-সিংহ-হাঁসগুলো মাটির। চল না খুব মজা হবে। ক্যামেরা নিয়ে যাব।’
ত্রয়ণ বলল, ‘ফালতু কনসেপ্ট। এসব মানুষজন করে কী করে? পুজোতেও সিরিয়াসনেস নেই। আমি গতকাল দেখেছি। ছাইমাখা মাগুর মাছের মতো লাগছে সবক’টাকে।’
‘হোক, তবু দেখব।’ রাহি বলল।
হোমি আর কিছু না বলে হাত নেড়ে চলে গেল।
ভিড় বাড়ছে ক্রমশ। দ্বিতীয় দফায় অঞ্জলি শুরু হবে। এবার ভিড় যেন আরও বেশি। রাহি জানে ত্রয়ণের সামনে দাঁড়ালে ও আরও মাথা খাবে। ও আলতো পায়ে সরে এল ত্রয়ণের সামনে থেকে। ত্রয়ণও আসত, কিন্তু মোক্ষম সময়ে মা আর দীপা এসে আটকে দিল ত্রয়ণকে।
রাহি কী করবে বুঝতে না পেরে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। আর ঠিক তখনই সাধুদা এসে দাঁড়াল ওর সামনে।
‘তুমি? নারকোল দিয়ে রকেট বানানো শেষ?’ রাহি সিরিয়াস মুখে বলল।
‘খালি ইয়ারকি, না?’ সাধু হাসল। তারপর বলল, ‘চল, চমক ডাকছে তোকে।’
‘দাদা!’ রাহি অবাক হল একটু।
‘হ্যাঁ রে, চমক বারান্দায় এসেছিল। মাইকে মন্ত্র শুনে আবার ঘরে ঢুকে গেছে। পরে বেরিয়ে আমায় বলল তোকে ডেকে দিতে।’
‘ওফ! তোমায় কিছু জিজ্ঞেস করলে নাড়ি-নক্ষত্র সব বলে দাও।’
‘ঠিক আছে, চল।’ সাধুদা হাত ধরে টানল রাহিকে।
বারান্দা দিয়ে উঠে বাড়ির একদম অন্য দিকে দোতলায় চমকের ঘর। বাড়ির অন্য কেউ বিশেষ আসে না এখানে। এমনকী মা-ও নয়। যা আসার রাহিই আসে।
এই ঘরের দরজাটা মোটা ঘষা কাচের। স্লাইডিং। সাধুদা গিয়ে টোকা দিল দরজায়। রাহি চাপা গলায় বলল, ‘তুমিও যাবে?’
সাধু নিরুপায় মুখে বলল, ‘কী করব? আমাকেও যে ডেকেছে।’
দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে মিঠে-কড়া একটা হাওয়া এসে ঝাপটা মারল রাহির মুখে। এখনও বোতল খুলে বসে আছে? রাহির মাথা গরম হয়ে গেল।
‘আয়,’ চমক সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
‘ডেকেছিস?’ রাহি ভুরু কুঁচকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল। তার মধ্যেও দেখল সাধুদা দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজার বাইরে।
‘গন্ধ পাচ্ছিস?’ চমক হাসল।
‘কেন ডেকেছিস বল।’ রাহি বিরক্তি লুকোনোর চেষ্টাই করল না।
‘আরে বলিস না,’ চমক না কামানো গালে হাত ঘষে বলল, ‘বর্ডার থেকে বাইশ পেটি মাল ঢুকেছে। দেখ না জোর করে এক পেটি আমায় গছিয়ে দিল। বললাম নেব না। শোনে কথা? খাঁটি স্কটল্যান্ডের জিনিস। ঝরনার জলে তৈরি। ওক কাস্কে জমানো ছিল বহু দিন। গন্ধে গোলাপ ফেল। তাই আমি এই পুণ্য প্রভাতে চেখে দেখছিলাম।’
‘বাজে কথা বলিস না। বাবাকে সবার সামনে অমন করে হেনস্তা করলি কেন? তোর জন্য সবার সামনে অপমান হতে হল। প্রতিবার আমি আর তুই অঞ্জলিতে থাকি। এবার গেলি না কেন?’
‘এবার?’ চমক একটু অন্যমনস্ক হল যেন। বলল, ‘জীবন কি আর এক থাকে রে রাহি? পালটায়। সব পালটায়। গতবারের আমিটার সঙ্গে এবারে আমিটাও তো এক নই। আমার যে, তৃতীয় চক্ষু খুলে গেছে। তাই ভগবানের দরকার আর আমার নেই।’
‘মানে!’ রাহি অবাক হল। সাতসকালে বড্ড বেশি খেয়েছে কি? অবশ্য, আশ্চর্য কিছু নয়। চমক যখন খায় তখন বাহ্যজ্ঞান থাকে না ওর।
‘বাদ দে,’ রাহির রাগ হচ্ছে খুব। ও বলল, ‘ডেকেছিস কেন? আর সাধুদাকেও বা দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেন?’
‘সাধুদা?’ চমক দরজার দিকে তাকিয়ে হাসল আপন মনে। তারপর বলল, ‘লোকটা খুব লয়াল না? কুকুরের মতো।’
‘কী যা তা বকছিস?’ রাহির মাথা ঠিক থাকছে না আর, ‘কেন ডেকেছিস?’
‘গিফ্ট,’ চমক টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা প্যাকেট তুলল টেবিল থেকে। ক্যালকুলেটারের মতো মাপের প্যাক করা একটা জিনিস।
‘কী এটা?’
‘পাম-টপ কম্পিউটার। তোর পুজোর গিফ্ট। মালয়েশিয়ার জিনিস। সরি, দিতে লেট হয়ে গেল।’
‘পাম-টপ!’ রাহি অবাক হল। চমক এমন একটা জিনিস দিল!
‘হ্যাঁ, আর এটা সাধুদার,’ চমক ঘরের কোণে বড় একটা প্যাকেট দেখিয়ে বলল।
‘সাধুদার গিফ্ট?’ রাহি অবাক হল খুব। চমকের কী হয়েছে? কোনওদিন তো সাধুদার জন্য কিছু আনে না! তা হলে?
‘অবাক হচ্ছিস কেন?’ চমক হাসল। তারপর এগিয়ে বিছানার মাথার কাছের থেকে হলুদ তরল পূর্ণ গ্লাসটা তুলে বলল, ‘সাধুদা আমাদের ফ্যামেলির জন্য যা করেছে, তাতে কি এটা ডিসার্ভ করে না?’ তারপর সাধুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটাতে মাইক্রোওয়েভ আছে। তোমার রান্নার সুবিধে হবে।’
সাধু দরজায় বাইরে থেকে ইতস্তত করল।
চমক আবার বলল, ‘কেন এমন করছ? নাও এটা।’
রাহি অবাক হয়ে চমকের দিকে তাকাল। একটু কি বেশি বিষণ্ণ লাগছে দাদাকে? মনটা কি একটু বেশি খারাপ ওর?
‘তোরা আয়।’ চমক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অন্যমনস্কভাবে গ্লাসটা দেখল। রাহি কী বলবে বুঝতে না পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সাধুদাও রাহির পিছন পিছন চলে এল। ঘর থেকে বেরিয়েই রাহির মনে পড়ল, যাঃ স্কুটির ব্যাপারটা যে, জিজ্ঞেসই করা হল না।
আসলে চমককে দেখে কেমন যেন লাগল রাহির। এমন কোনওদিন লাগে না। কেন মনখারাপ চমকের? দীপা জানে কি?
কিন্তু এই নিয়ে বেশি চিন্তা করতে পারল না রাহি তার আগেই হইচই করে খুদে এসে হাজির হল।
সাধু হাতের প্যাকেটটা বেলগাছের গোড়ায় রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কী রে খুদে এমন লাফাচ্ছিস কেন?’
খুদে হাউমাউ করে বলল, ‘পেছনের কাচের ঘরে গোরু ঢুকে গেছে। আর ক্যামেরাদা ওকে বের করতে গেলে…’
পুরো কথা শোনা হল না। ক্যামেরাদা? তবে ও এসেছে? ছমছমে বুক নিয়ে দূরে কাচের ঘরের দিকে তাকাল রাহি। দেখল, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ওদের দিকে আসছে সে। বুকের ভেতরের টুপুটুপু ভরতি জলের গ্লাসটা এবার চলকাল একটু। শয়ে শয়ে ডুবুরি নেমে পড়ল পেটের ভেতর। ওর মনে হল চাপাডাঙার হাওয়ায় কি অক্সিজেন কমে এল হঠাৎ?