মুহূর্তরা দু’বছর আগে – ৪

অফ স্টাম্পের ওপর বলটা ছাড়বে, না খেলবে ভাবতে ভাবতেই মেট্রোটা চলে এল। আদি বিরক্তিতে মাথা নাড়ল শুধু। আর দু’মিনিট সময় পেলে ও ঠিক জিনিসটাকে লাইনে এনে ফেলত।

জিনিস! জিনিসই তো। আদি জানে মেয়েরা জিনিস। একটি মেয়েই ওকে শিখিয়েছিল এটা সেই এগারো ক্লাসে। স্কুলের শিক্ষা। এত সহজে কী করে ভোলে ও? সেই থেকে এই আঠাশ বছর বয়স অবধি ও মেয়েদের এভাবেই দেখে এসেছে।

ট্রেনটা জমাট হয়ে আছে ভিড়ে। বিকেলের দিকের মেট্রোগুলোর এই এক প্রবলেম। তার ওপর স্টেশন বেড়ে যাওয়াতে ভিড়টা বেড়েছে আরও। পিঠের ব্যাগটা ঠিক করে ভিড় ঠেলে একটা কোনায় গিয়ে দাঁড়াল আদি।

বারাসতে গিয়েছিল ও। ওদের কোম্পানি এখন রিয়েল এস্টেটে নেমেছে। তার যোগাযোগ করতে ওকে যেতে হয়। বস ওকে অফিসে বসে কাজ করতে দেয় না। টো-টো করে ঘুরিয়ে মারে। বর্তমানে উত্তর চব্বিশ পরগনায় ওদের কোম্পানির ব্যাবসা ক্রমশ বাড়ছে।

মার্চেন্ট মাল্টিপল্‌স লিমিটেড বর্তমানে উত্তর চব্বিশ পরগনার ওপর দৃষ্টি দিয়েছে। ওদের ইস্টার্ন রিজিয়নের ডিরেক্টর গৌর রোশন দিওয়ান বলেন যে, এত বড় একটা টেরিটরি পড়ে রয়েছে আর সেটাকে কেউ ট্যাপ করছে না! এটা তো এবার ধরতেই হবে।

মছলন্দপুরের কাছে চাপাডাঙা গ্রামে একটা পার্টিকল বোর্ডের ফ্যাক্টরি খুলেছে ওদের কোম্পানি। একটা মিনারেল ওয়াটার, ফ্রুট জুসের ফ্যাক্টরিও খুলতে চায়। তার সঙ্গে বারাসত অঞ্চলে বিশাল জমি কিনে রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে।

গৌর রোশন দিওয়ানের বয়স সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ মতো। লম্বা, দোহারা চেহারা। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। মানুষটা খুব মাই ডিয়ার ধরনের। সবার সঙ্গে হেসে, কাঁধে হাত রেখে কথা বলেন। আদিকে বিশেষ পছন্দ করেন। বলেন, ‘আদিত্য, তুমি আমার চোখ। বুঝলে? চোখ যা করে, তোমায় তাই করতে হবে। আমি জানি তুমি তোমার কোম্পানির প্রতি লয়াল থাকবে।’

লয়াল, লয়ালটি। আদি হাসে মনে মনে, কথাগুলোর কি সত্যি কোনও মানে আছে? গৌরের কাছ থেকে ও ভাল মাইনে পায়, তাই সাধ্যমতো কাজ করে। এর চেয়ে বেশি টাকা যদি কেউ ওকে অফার করে তা হলে ও সেখানে চলে যাবে। লয়ালটি ফয়ালটির কোনও দাম আদির কাছে নেই।

আজ বারাসত থেকে দমদম, তারপর সেখান থেকে বেলগাছিয়ায় গিয়েছিল আদি। বারাসতের এই প্রজেক্টটার যারা অ্যাড ক্যাম্পেন করছে তাদের অফিস বেলগাছিয়ায়। সেখান থেকে বেরিয়ে এই মেট্রোটা ধরেছে। আজ দমদম থেকেই পুরো লোড হয়ে এসেছে গাড়ি।

ওর অফিস ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটে। হাইকোর্টের উলটোদিকে। পুরনো একটা বাড়ির ভেতর ঝাঁ-চকচকে অফিস ওদের। আদি জানে আজকের মিটিং-এর ফলাফল শোনার জন্য গৌর অপেক্ষা করে আছে।

আসলে ওদের এই আবাসন প্রকল্প নিয়ে একটা স্থানীয় সমস্যা হচ্ছে। কিছু লোকাল লোক চাইছে কাজটা পণ্ড করতে। যদিও মস্তান হিসেবে তারা আসছে না, আসছে সমাজসেবী হিসেবে। কিন্তু আদি খবর নিয়েছিল ওদের সম্বন্ধে, এবং জেনেছিল যে, ওরা আসলে মস্তানই।

এমনিতেই অর্থনৈতিক মন্দার বাজারে নানারকম প্রজেক্ট আটকে আছে। ঘরবাড়ির বুকিং খুব একটা হচ্ছে না। তার মধ্যে একটা প্রজেক্ট যদি ডিলেড হয় তা হলে অবস্থা আরও খারাপ হবে।

ওই সমস্ত মানুষগুলোর দাবি হল যে, মার্চেন্ট মাল্টিপল্‌স যে-পরিমাণ জমি কিনেছে তার থেকে একটা অংশ বাচ্চাদের পার্ক করতে দিতে হবে। কারণ, জমিটা যখন কেনা হয়েছিল তখন মার্চেন্ট থেকে বলা হয়েছিল যে, আবাসনের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষদের জন্য এই জমির একটা অংশ থেকে একটা পার্ক তৈরি করে দেওয়া হবে।

আসলে সেটা ছিল জাস্ট কথার কথা। গৌর ভেবেছিল স্থানীয় ক্ষমতাশালী লোকদের কিছুটা দান-দক্ষিণা দিয়ে ব্যাপারটা চাপা দিয়ে দেবে। কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক পালাবদল হওয়ায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। পার্টির ছত্রচ্ছায়ায় থাকা কিছু উটকো মস্তান সমাজসেবী হিসেবে এসে প্রজেক্ট বন্ধ করে দেবে বলে হট্টগোল করছে।

‘উটকো মস্তান’ কথাটা অবশ্য গৌরের কয়েনেজ। আর প্রথম দিকে আদিও তেমন ভাবত। কিন্তু এখন, মানে, আজকের মিটিং-এর পর আর ভাবছে না। কারণ, রোগা চাপদাড়ির একটা ছেলে আজ মিটিং-এ ছিল যে যথেষ্ট গুছিয়ে কথা বলতে পারে। উটকো মস্তানরা এমন হয় না। ছেলেটাকে সবাই বিল্টু বলে ডাকছিল। যদিও ভালনাম ত্রয়ণ। ছেলেটি বারাসতের নয়। আরও দূরে থাকে। ছেলেটির ভেতরে একটা অদ্ভুত গোঁ দেখেছে আদি। যেন পণ করে নিয়েছে যে, পার্ক না করে দিলে কিছুতেই আবাসন করতে দেবে না। ছেলেটি যে ভোগাবে খুব, বুঝতে পারছে আদি। এই পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের ছেলেটির ভেতরে যে-ধরনের প্রতিরোধ রয়েছে তা অনেকদিন দেখেনি আদি।

অনেকদিন মানে কতদিন? মাস দেড়েক? তাতেই কি অনেকদিন মনে হচ্ছে? সে থাকতে তো এমনটা মনে হয়নি! তা হলে দাদাভাই চলে যাওয়ার পর এমন মনে হচ্ছে কেন? গত দেড় মাস দাদাভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ নেই ওর। না, সেইসব কারণের জন্য নয়, এমনিই যোগাযোগ করা হয়নি আদির। এমনি? নাকি আদির ভেতরে একটা সূক্ষ্ম অপরাধবোধ রয়েছে? ও তো জানত, তবু ও এমনটা হতে দিল! কেন দিল? আদি কারও জন্য কেয়ার করে না বলে? ওর কারও প্রতি লয়ালটি নেই বলে? ও বিশ্বাস করে না লয়ালটি বলে কিছু আছে বলে? নাকি দাদাভাইকে ভালবাসত না বলে?

প্রশ্ন। জীবন নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন আদির। কিন্তু উত্তর বিশেষ পায় না।

উত্তর চব্বিশ পরগনা ওর কাজের জায়গা হলেও দীর্ঘদিন চাপাডাঙায় যায়নি। অবশ্য তেমন দরকারও পড়েনি। দাদাভাই সব সামলে রেখেছে ওখানে গিয়ে। তবু দাদাভাই ওখানে যাওয়ার আগে তো যেত প্রায়ই। এমনিই সব দেখাশোনা করে আসত। কিন্তু এখন যায় না। দাদাভাইকে এড়াবে বলেই কি?

দাদাভাই কি খুব অসুবিধে করেছিল সবার? হঠাৎ তবে এমন হল কী করে? বাড়িতে চিরকালই সম্পত্তি নিয়ে ভিতর ভিতর একটা চাপা টেনশন চলে। তা বলে তার জন্য এমনটা করতে হবে? না, আদি এসব ব্যাপারে থাকে না। অফিস করে, আড্ডা মেরে বা ডিস্‌কে গিয়ে সময় কেটে যায় ওর। আর সত্যি বলতে কী, বাড়ির লোকজনও বেশ ভয় পায় ওকে। ও কখন যে কী বলে দেবে সে ব্যাপারে বাবা, মা, সবাই খুব তটস্থ থাকে। আসলে আদি তো বাবা-মাকে উলটোপালটা কথা বলেওছে। আর এখনও বলে। দাদাভাইয়ের মতো এমন চুপ করে থাকার পাত্র নয় আদি। অন্যের ক্ষেত্রে আদি চুপ করেই থাকে। তেমন হলে তো দাদাভাইয়ের জন্য গলা ফাটাত। তা তো করেনি। বরং সে রাত্রে বাড়িতেই ফেরেনি। মদ খেয়ে, ডিস্‌ক হপিং করে কাটিয়ে দিয়েছিল রাতের অধিকাংশ সময়। তারপর এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

সত্যিই সেই ঘুম কি আজও ভেঙেছে?

মাস দেড়েক ধরে এই কথাগুলো কেমন যেন খোঁচাচ্ছে আদিকে। আগে হত না কিন্তু এখন এমন কেন হচ্ছে, ঠিক বুঝতে পারছে না। গত দেড় মাসে কি সেক্স কমিয়ে দিয়েছে আদি? তাই কি এমন হচ্ছে?

নিজেরই হাসি পেল। ও জানে এমনটা নয়। তবু মনে হল। গত তিনদিন কারও সঙ্গে শোয়নি আদি। আজ হলে চারদিন হবে। যা ওর কাছে রেকর্ড। রেকর্ড যাতে না হয় সেটা দেখতে হবে। আসলে রিনা, দিয়া বা শালিনী এখন কলকাতায় নেই। তবে মহুল আছে। কিন্তু মহুল কি দেবে? মহুল আজকাল আর তেমন পাত্তা দেয় না আদিকে। দেখা যাক, কিছু না হলে আজ মহুলকে ট্রাই নেবে।

মহুল এক অদ্ভুত মেয়ে। কী জেদি আর একগুঁয়ে রে বাবা! ছোট থেকে পাশের বাড়িতে থাকত। কিন্তু কোনওদিন পাড়ার কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে যেত না। নিজের খেয়াল আর অ্যাম্বিশন নিয়ে থাকত। মহুলকে প্রথম থেকেই পছন্দ ছিল আদিত্যর। কিন্তু মহুল পাত্তা দিত না। আসলে কাউকেই পাত্তা দিত না মহুল। তাতে যেন আরও কাতর হয়ে পড়ত আদি।

একবার ক্লাস টেনে পড়ার সময় তো সত্যি সত্যি হাতে কম্পাস ঢুকিয়ে রক্ত বের করে মহুলের নাম লিখেছিল একটা চিঠিতে। তবে শুধু নামটাই লিখেছিল। পুরো চিঠিটা লেখেনি। অত রক্ত যে দিতে পারবে না সেটা ভালই বুঝেছিল আদি। তবে চিঠিটা পৌঁছে দিয়ে খুব সাবধানে আদি বলেছিল, ‘তোমার নামটা আমার রক্ত দিয়ে লেখা।’

ক্লাস ইলেভেনের মহুল ভুরু কুঁচকে বলেছিল, ‘কেন? পেনের কালি ফুরিয়ে গিয়েছিল? না যাত্রা দেখছিস আজকাল বেশি? ইউ বয়েজ আর ইনকরিজব্‌ল। তো বল, আমায় তোর জন্য কী করতে হবে? চুমু খাবি। নে খেয়ে যা। বুকে হাত দিবি। দে। তারপর আমায় রেহাই দে। এসব মেলোড্রামা আমার সামনে আনবি না।’

প্রায় পালিয়ে এসেছিল আদি। কষ্টে দু’রাত ঘুমোতে পারেনি। মাধ্যমিকের সিলেকশনে নম্বরও কমে গিয়েছিল। তারপরও বেশ কিছুদিন লেগেছিল মহুলের শক থেকে নিজেকে বের করে আনতে।

সেই আদিকে দেখলে এই এখনকার আদির হাসি পায়। সেই গালে হালকা দাড়ি, রোগা আর ভিতু ছেলেটার অসহায় মুখ মনে পড়লে আদির মনে হয় কী বোকা, কী বোকা ছিল ও! ‘জিনিস’-এর জন্য এমন মনখারাপ করে কেউ!

তবে সে সময় তো আর মেয়েদের ‘জিনিস’ ভাবত না ও। যাজ্ঞসেনীকে তো নয়ই। যাজ্ঞসেনী আইয়ার। মা বাঙালি, বাবা কেরলের লোক। যাজ্ঞসেনীর বোন কৃষ্ণা পড়ত আদিদের কেমিস্ট্রি ব্যাচে। আর সেখানেই মাঝে মাঝে বোনের সঙ্গে আসত কলকাতার নামকরা কলেজের সেকেন্ড ইয়ার কেমিস্ট্রি অনার্সের যাজ্ঞসেনী। প্রথম দিনই আদিকে দেখে বলেছিল, ‘আরে, আই হ্যাভ সিন ইউ আরলিয়ার। আমাদের কলেজের সায়েন্স ক্যাম্পে তুমি এসেছিলে না লাস্ট ইয়ারে? আরে সেই যে বার্নার উলটে তুমি আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলে খাতায়। তোমার দাদা তাড়াতাড়ি নিভিয়ে দিয়েছিল। হি ওয়াজ দি এক্স স্টুডেন্টস রিপ্রেজেনটেটিভ। কান্ট রিমেম্বার হিজ নেম, বাট আমার মনে আছে যে, হি হ্যাড বিউটিফুল আইজ। বিগ অ্যান্ড ব্লু আইজ। তোমার দাদার অমন নীল চোখ আমি বাঙালিদের মধ্যে দেখিনি। হাউ ইজ হি নাউ?’

যাজ্ঞসেনীর কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিল আদি। ওই নরম হাওয়ায় উড়তে থাকা যাজ্ঞসেনীর চুল। ওর হালকা জোড়া ভুরু। বিশাল বড় আকাশজোড়া চোখ। ওর ঘাড়ের কাছে ভেঙে পড়া চুলের কুচি। ছোট ছোট সার দেওয়া বিজ্ঞাপনের মতো দাঁতের সারি। গোলাপি আঙুল। এইসব দৃশ্য যেন ক্রমাগত ছুরি দিয়ে আঘাত করছিল আদিকে। গন্ডগোল হচ্ছে, ঘোরতর গন্ডগোল হচ্ছে বুঝতে পেরেও যেন নিরুপায় হয়ে তাকিয়েছিল আদি। সেই ছুরিকাঘাত থামানোর মতো জোর যেন ছিল না ওর। একসময় কথা থামিয়ে হাত নেড়ে চলে গিয়েছিল যাজ্ঞসেনী, কিন্তু বুঝতে পারেনি যে, পিছনে একজন মানুষ পড়ে রইল। প্রেমে পড়ে রইল সে।

আদির সেই রাতে মনে হয়েছিল, এই মেয়েটির জন্য যা খুশি তাই করতে পারে ও। এই মেয়েটির জন্য শরীরের সমস্ত রক্ত দিয়ে চিঠি লিখতে পারে। পারে সারা জীবন নিজের বুকের ভেতর একে ধরে রাখতে। সাতদিন নাওয়া-খাওয়া প্রায় ভুলে গিয়েছিল আদি। তারপর এসেছিল সুযোগ, যাজ্ঞসেনীর কাছে যেতে পারার সুযোগ। তাই কৃষ্ণার জন্মদিনের নেমন্তন্নটা দু’হাত দিয়ে ভগবানের প্রসাদের মতো গ্রহণ করেছিল আদি। কিন্তু কিচ্ছু হয়নি। কিচ্ছু করতে পারেনি আদি। যাজ্ঞসেনী ভেসে বেড়িয়েছিল দূরে। আর তার কিছুদিন পর আদি জেনেছিল যাজ্ঞসেনীর মনের কথা।

চাঁদনিতেও নামলে হত, কিন্তু নামল না আদি। এসপ্ল্যানেডে নামবে। একটা ছোট্ট কাজ সেরে তারপর অফিস যাবে।

এসপ্ল্যানেড স্টেশনটা যেন কুয়াশা দিয়ে তৈরি। অন্য কোনও স্টেশন নয়, এই স্টেশনটায় নামলেই কেন যে এটা মনে হয় আদির, ও নিজেই জানে না। মনে হয় দূর কোনও পাহাড়ের প্রচুর কুয়াশা এসে ঢুকে পড়েছে এই মাটির তলায়। কী আছে এসপ্ল্যানেড স্টেশনে যে, এমন মনে হয়? কাউকে এই কথাটা বলতে পারে না আদি। ও জানে কেউ পাত্তা দেবে না। তা ছাড়া ভাববে ইয়ারকি মারছে। আসলে আদির ইমেজের সঙ্গে যেন এইসব কথাবার্তা খাপ খায় না।

আদি ভাবে যে, এই ইমেজ রক্ষা করতে গিয়ে বা ভাঙতে না পেরে কত মানুষের যে ঠিকমতো বাঁচাই হয় না! কত মানুষ যে বলতেই পারে না সে আসলে কী চায়? কত মানুষ ভাল করে তাকাতেই পারে না তার গোপন পছন্দের মানুষটার দিকে। ইমেজ আসলে একটা কারাগার। নিজেকে বন্দি রাখার জায়গা।

আদি ঘড়ি দেখল। এখনও প্রচুর সময় আছে। গৌর বলেছে সন্ধে সাতটার মধ্যে ফিরলেই হবে। ভিড় ঠেলে প্ল্যাটফর্মে পা দিল আদি।

‘এই আদিত্য, এই আদিত্য।’ গলাটা শুনে মুহূর্তের জন্য থমকে গেল আদি। আর সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে গুঁতো আর বিরক্তিসূচক শব্দ ভেসে এল একরাশ। আদি দ্রুত ভিড়ের স্রোতকে বাধা না দিয়ে সরে গেল একটা থামের পাশে। প্রচুর মানুষ পিঁপড়ের মতো সার দিয়ে হাঁটছে। তার ভেতর একজন নির্দিষ্ট মানুষকে ঠাহর করা খুব মুশকিল। তবু এদিক-ওদিক তাকাতে থাকল আদি। গলার স্বরটা বেশ চেনা লাগছে। কিন্তু ডাকছে কে? পুজোর মুখের কলকাতা এখন। শহরের সবাই যেন শপিং করতে বেরিয়ে পড়েছে একসঙ্গে। রংচঙে এত মানুষ আর প্লাস্টিকের ব্যাগের খচমচের ভেতরে কে ডাকল আদিকে? ও ভাল করে চারিদিকে তাকাল।

আচমকা ঠাস করে থাপ্পড় পড়ল মাথায়, ‘এই শালা অন্ধ, দেখতে পাচ্ছিস না?’ আদি আচমকা থাপ্পড়ে ঘাবড়ে গিয়ে পিছনে তাকাল। আরে, আবেশ!

আবেশ গোস্বামী। দাদাভাই আর আদির কমন ফ্রেন্ড। ছেলেটা একটু অদ্ভুত। বিশাল বড়লোক মামার বাড়িতে আশ্রিতের মতো থাকে। ছোটবেলায় ওর বাবা অন্য একজনকে বিয়ে করে চলে গিয়েছিল বাড়ি ছেড়ে। আর সেই দুঃখে ওর মা ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করে। তারপর থেকে আবেশ মামার বাড়িতে মানুষ। ওর ভাষায়, ‘মামার বাড়িতে অমানুষ।’

মামা আবেশকে নিজেদের চালের আড়তে বসাতে চেয়েছিল। তাতে আবেশ বসেনি, বরং বলেছিল, ‘আমি অমন চালবাজ হতে পারব না।’ আদি মাঝে মাঝে ভাবে যে, আবেশের চলে কী করে?

আবেশ ছবি আঁকা শেখায়। আবেশ মাঝে মাঝে কোনও প্রোডাক্টের প্রোমোশনের জন্য খেপ খাটে। কেটারিং-এর দলে ভিড়ে কখনও পরিবেশন করে আসে। কোনও কনট্রাক্টরের অধীনে সাত-দশদিন কাজও করে দেয়। আর এসব সাতপাঁচ কাজ নিয়ে জিজ্ঞেস করলে ও বলে, ‘এসব করতে করতেই একদিন এমন একটা দাঁও মারব না, তোরা সক্কলে চমকে চোদ্দো হবি!’

না, এখনও পর্যন্ত চোদ্দো তো দূরের কথা, একও হয়নি আবেশের। তবে ওর এই মনখারাপ না করা, সদ্যহাস্যময় চেহারাটা ভাল লাগে আদির। মনে হয় এই পৃথিবীর কোনও কিছুই স্পর্শ করতে পারে না আবেশকে।

‘কী রে শালা? চিনতে পারছিস না?’ আদির থতমত মুখটা দেখে চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করল আবেশ, ‘মাস চারেক ছিলাম না আর তাতেই শালা ভুলে মেরে দিলি আমায়? ভুলে গেলি আমি বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলাম বলেই রিনাকে প্রথমবার লাগাতে পেরেছিলি?’

‘তোকে কি ভুলতে পারি রে দালাল?’ আদি শব্দ করে হাসল, ‘তা হঠাৎ এখানে? এতদিন কোথায় ছিলিস?’

‘আমি? কুকুর ধরছিলাম।’ আবেশ ভারিক্কি গলায় বলল।

‘কী ধরছিলি?’ আদি উত্তর শুনে একটু ঘাবড়ে গেল।

‘কুকুর ধরছিলাম রে, কুকুর ধরছিলাম।’ আবেশ এমন করে বলল যেন টেররিস্ট ধরছিল।

‘কুকুর! মানে?’ আদি বুঝতে পারল না আবেশ কী বলতে চাইছে।

‘মানে কুকুর ধরছিলাম। ডগ রে ডগ। শালা নিজের নাম বুঝতে পারছিস না?’

আদি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কুকুর ধরছিল! ছেলেটা বলে কী?

‘মিজোরাম গিয়েছিলাম। ওখানে কুকুর খায় ওরা। তারপর অসম, ত্রিপুরা ইত্যাদি জায়গায় স্ট্রে ডগ ধরছিলাম।’

‘ইয়ারকি মারছিস না তো?’ আদি দেখল দমদমের দিকে যাওয়ার মেট্রো ঢুকল। আবেশ কোন দিকে যাবে?

আবেশ হাসল, ‘আরে না না, ইয়ারকি মারব কেন রে? আমি একটা কনট্রাক্টরের হয়ে কাজের জন্য গিয়েছিলাম নর্থ-ইস্টে। সে ব্যাটা হাফ কাজ করে পার্টির টাকা মেরে পালিয়ে গিয়েছিল। আর আমরা গিয়েছিলাম ফেঁসে। তা সেখান থেকে একজনের হয়ে কুকুর ধরার কাজে লেগে গিয়েছিলাম। ভদ্রলোকের আরও ব্যাবসা ছিল। একটা মেয়েও ছিল। ভাবলাম যদি জামাই হওয়া যায়। কিন্তু সেই মেয়ে শালা বহুত খচ্চর। নিজের একটা ডোবারম্যান ছিল। লেলিয়ে দিল। শালা গত চার মাস কুকুরে কুকুরে জেরবার হয়ে গেছি একেবারে! তাই চলে এলাম।’

আদি ঘড়ি দেখল। আবেশ বকতে শুরু করলে মাথা খারাপ করে দেবে। দেরি হয়ে যাবে খুব। তখন আবার গৌরের থেকে ঝাড় খাবে। ফলে এখন যেতে হবে ওকে।

আদি বলল, ‘শোন না, আমায় অফিস যেতে হবে একবার। তুই বাড়িতে আয় একদিন। গল্প হবে।’

‘বাড়িতে? চাঁদু তুমি বাড়িতে থাকো কখন? অফিস, কফি শপ, ডিস্‌ক আর রংবেরঙের মেয়েছেলের বিছানা ছাড়া তোমায় পাওয়া যায়?’

আবেশ এমন করে কথাগুলো বলল যে, আশপাশের লোকজন ফিরে তাকাল ওদের দিকে। খুব বাজে লাগল আদির। আবেশের হইহই করার স্বভাবটা মাঝে মাঝে খুব অস্বস্তিতে ফেলে ওকে।

আদি বলল, ‘বাজে কথা রাখ। তোর মাইরি সেন্স হবে না কোনওদিন। এই যে আমার কার্ড নে। অফিসে আসিস।’

‘কার্ড?’ আবেশ হিহি করে হাসল, ‘আজকাল মেয়েদের সঙ্গে শুয়েও কি এমনভাবেই কার্ড দিস? দেখাস যে, দেখো কার সঙ্গে তুমি ইয়ে করলে?’

‘শালা, তোর সঙ্গে কি শুয়েছি?’

আবেশ চোখ টিপল, ‘চাস নাকি? আজকাল শালা সবার কী হয়েছে বল তো?’

‘আমি আসছি। তুই ভাট বকে যা।’ আদি এগোতে গেল।

‘শোন না, তোর সেন্স অফ হিউমারটা বরাবর খারাপ।’

‘এগুলো ননসেন্স হিউমার। যাক এবার যেতে হবে আমায়। ওই দেখ আর-একটা মেট্রো ঢুকছে।’

‘ও কে, রাগ করিস না ভাই। শোন না, আমি একদিন তোদের অফিসে যাব। ছোট্ট একটা দরকার আছে। ভয় পাস না। টাকাপয়সা চাইব না।’

আদি হাসল, ‘আসিস অফিসে। এখন ভাগ। আমাকেও যেতে দে।’

কুয়াশার ভেতর থেকে বেরিয়ে আচমকা ঝকঝকে রোদ্দুরে এসে পড়ল আদি। পুজোর মুখের কলকাতা একদম ছড়িয়ে রয়েছে সামনে। এত লোক কীভাবে সামলায় এই শহর? আদি দেখল হাতে ব্যাগ নিয়ে উদ্‌ভ্রান্তের মতো মানুষজন খানিকটা যেন ছোটাছুটিই করছে।

বিরক্তি নিয়ে ফুটপাথে নামল আদি। লোককে সঙ্গে ধাক্কা না মেরে এগোনোর উপায় নেই। নেহাত খুব দরকার, তাই এখন এসেছে। বিখ্যাত এক পরোটার দোকানের দু’-চারটে দোকান পরেই ক্যামেরা সারাইয়ের দোকান। সেখানেই যেতে হবে আদিকে। দোকানটা অনেক পুরনো। কিন্তু ক্যামেরাটা এরা খুব ভাল সারায়।

ঠাকুরদার একটা ভাল ক্যামেরা ছিল। ঠাকুরমা সেটা দিয়েছিল দাদাভাইকে। যদিও তা নিয়ে জলঘোলা হয়েছিল বিস্তর। মানে বাবা আর মা-ই মূল জলটা ঘুলিয়েছিল। কিন্তু ঠাকুরমা শোনেনি। ঠাকুরমা কারও কথা শুনত না। দাদাভাইকে নিজের বুকের কাছে আগলে রাখত।

মায়ের বক্তব্য ছিল যে, নাতি তো আদিও। তা হলে আদি পাবে না কেন? আদি তখন ক্লাস টেনে পড়ত। ওর মনে হয়েছিল যে, মা আর বাবা ফালতু ঝামেলা করছে। ওর ছবি তোলার প্রতি আগ্রহই নেই। তা হলে ক্যামেরা নিয়ে কী করবে ও? আর অন্য দিকে দাদাভাই ছবি বলতে পাগল! তো দাদাভাইকে ক্যামেরাটা দিয়ে ভালই করেছে ঠাকুরমা। কিন্তু বাবা-মাকে কে বোঝাবে? দাদাভাইকে তো দু’চক্ষে দেখতে পারে না ওরা। কেন পারে না সেটা জানত আদি। কিন্তু, সেটা কি খুব ন্যায্য কারণ? আদির তো মনে হয় এর পিছনে অন্য একটা কারণ আছে। বাবা-মা না বললেও সেটা আন্দাজ করে ও।

দাদাভাইয়ের তিন-চারটে ক্যামেরা। তার মধ্যে দুটো ডিজিটাল এসএলআর। তবু দাদাভাইয়ের এই মান্ধাতা আমলের ক্যামেরাটা যে কী ভাল লাগত কে জানে! সেটাই একটু চোট পেয়েছিল বেশ কিছুদিন আগে। না, দাদাভাইয়ের হাত থেকে নয়। আদির হাত থেকে পড়েই। চলে যাওয়ার আগে দাদাভাই নিজে এসে এটা দিয়ে গিয়েছিল আদিকে। আদি কিচ্ছু বলেনি। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। আসলে বলেনি না, বলতে পারেনি। অপরাধী মনে হচ্ছিল নিজেকে।

প্রায় সপ্তাহ দুয়েক আগে নিজের আলমারিটা খুলে দরকারি একটা কাগজ খুঁজছিল আদি। তখনই হঠাৎ হাতের ধাক্কায় ক্যামেরাটা মাটিতে পড়ে ভেঙে গিয়েছিল। মানে বাইরে ভাঙেনি। কিন্তু ক্যামেরার ভেতরটা কয়েন ভরতি কৌটোর মতো ঝকং ঝকং করছিল। তখন নেট ঘেঁটে এই দোকানটার নাম পেয়েছিল আদি। আজ ক্যামেরাটা ডেলিভারি নেওয়ার দিন।

ভিড় এড়িয়ে দোকানে গিয়ে ক্যামেরা নিতে আরও আধঘণ্টা কেটে গেল। দোকান থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে আকাশের দিকে তাকাল আদি। হঠাৎ কোত্থেকে এত মেঘ এল! শহিদ মিনারের মাথার ওপর এক বস্তা কালো তুলো কে যেন উলটে দিয়ে গেছে। মেঘ জিনিসটা দু’চক্ষে সহ্য করতে পারে না আদি। বৃষ্টি, কাদা, পট হোল্‌স, জ্যাম, টেলিফোন বিকল, হাজারও সব সমস্যা। এবার ভাল বৃষ্টি হয়নি বর্ষাকালে। মনে হচ্ছে পুজোতে ভালই ঢালবে। দু’দিন পরেই মহালয়া। বৃষ্টি হলে কোটি কোটি টাকার সব পুজোর যে কী হবে!

ওদের সুকিয়া স্ট্রিটেও বেশ কয়েকটা বড় পুজো হয়। বিশেষ করে ওদের পাড়াতে তো হয়ই। দাদাভাই পুজোর আগে আয়োজনে খাটাখাটনি করত খুব। কিন্তু সপ্তমীর সকালবেলাতেই নিজেকে গুটিয়ে নিত। কেন নিত কে জানে! কোনও পুজোয় দাদাভাইকে পায়নি ও। তবে আদির বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাদাভাইয়ের সঙ্গে দূরত্বও বাড়ছিল ওর। আর-একটা সময় পর থেকে দাদাভাই থাকল, কি গেল, সেসব পাত্তাও দিত না আদি।

পাড়ার পুজোয় আদি ঢোকে না কোনওদিনই। এসব উটকো ঝামেলা মনে হয়। আর যেহেতু সবাই আদির তিরিক্ষি মেজাজের কথা জানে, ওকে বিশেষ ঘাঁটায়ও না কেউ। পুজোর দিনগুলোয় ও নিজের পরিচিতদের আড্ডায় যায়। আর প্রচুর ড্রিঙ্ক করে। পুজো নিয়ে আর পাঁচটা বাঙালির মতো মাতামাতি ওর নেই।

তবে নিজে যতই পুজোর থেকে দূরে সরে থাকুক না কেন, আদি পুজোর ইকনমিক ইমপ্যাক্টটা বোঝে। তাই বৃষ্টি হলে কত মানুষের যে কত টাকা মার যাবে, সেটা ভেবে একটা অস্বস্তি হয় ওর।

হঠাৎ মোবাইলটা বেজে ওঠায় সচকিত হল আদি। গৌরের ফোন। ও ফোনটা ধরল, ‘হ্যাঁ, স্যার। আয়াম অন মাই ওয়ে।’

‘আরে ইয়ার, তু তো হামেশা ওয়ে মে হি রহতা হ্যায়। সুন এক বাত। মেরা এক মিটিং হ্যায়। আচানক ফিক্স হুয়া হ্যায়। তো, জরা লেট হোগা মেরা। তুই একটু ওয়েট করিস। আই হ্যাভ সামথিং টু টেল ইউ। কেমন?’ গৌর মাঝেমধ্যে তুই করে বলে আদিকে। বলে, ‘তু তো মেরা ছোটা ভাই হ্যায়।’ আদি কিছু মনে করে না। গৌর খুশি থাকলেই হবে। আর গৌরকে খুশি রাখে ও। আসলে গৌর কখনও প্রশ্ন করে না আদির টাকাপয়সা সামলানো নিয়ে। ঘুষ টুস যা দিতে হয় তাতে আদির কথাই বিশ্বাস করে গৌর। আর আদিও যথাসম্ভব সততা বজায় রাখে। হ্যাঁ, যথাসম্ভব। পুরোটা নয়। প্রতিটা ঘুষে ও পাঁচ পারসেন্ট কাটমানি খায়। আদির এসব ব্যাপারে ছুঁতমার্গ নেই। ওর মনে হয় যে, সমুদ্র থেকে এক ঘটি জল তুললে সমুদ্রের কিছু যায় আসে না। তবে হ্যাঁ, গৌরের কাজকর্ম খুব মন দিয়ে করে ও। সেখানে ফাঁক রাখে না।

‘আরে ইয়ার তু সোচতা বহত হ্যায়। ডোন্ট থিঙ্ক টু মাচ। কুচ রিপ্লাই তো দে।’

‘স্যার আপনি বলেছেন যখন, আমি থাকব।’

গৌর শব্দ করে হাসল, ‘এক আচ্ছা সারপ্রাইজ হ্যায় তেরে লিয়ে। আই থিঙ্ক ইউ উইল লাইক ইট। চলো, বাই ফর নাউ।’

আদি হাসল মনে মনে। গৌর সবার সঙ্গে এমন করে কথা বলে যেন তার কথাই চিন্তা করছে সবসময়। কিন্তু আদি জানে এই মিষ্টি কথার মানুষটার আড়ালে কী ভয়ংকর এক মানুষ রয়েছে! নিজের কাজের জন্য খুন-জখম করা গৌরের কাছে নস্যি।

এই বারাসতে জমিটা নিয়ে যে ঝামেলা হচ্ছে, তাতে ও জানে যে, গৌরের বিরক্তি বাড়ছে। সেটা যদি সহ্যের বাইরে চলে যায় তা হলে গৌর কিছু করতে পারে।

তাই আদি জানে ‘ইউ উইল লাইক ইট-টা আসলে গৌরীয় বচন মাত্র, তার বেশি কিছু নয়।

এক মুহূর্ত ভাবল আদি। অফিসে কাজ নেই তেমন। তাই হুড়োহুড়ি করে না গেলেও চলবে। ও ভেবেছিল ট্যাক্সি নিয়ে যাবে। কিন্তু এবার ভাবল, এখান থেকে অফিসের দূরত্ব একটু বেশি হলেও, হেঁটেই যাবে অফিস। হাঁটতে খারাপ লাগে না আদির।

আবার ভিড় ঠেলে রাস্তা পেরিয়ে অন্যদিকের ফুটপাথে গিয়ে উঠল আদি। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে হেড সেটটা লাগিয়ে নম্বর ডায়াল করল। দেখা যাক কথা বলতে বলতে হাঁটা যায় কিনা।

কলার টিউনে ভারী গলায় একটা পুরনো ইংরেজি গান চলছে। ধরতে দেরি করছে কেন? আদি একবার মাথা ঘুরিয়ে বিপুল জনস্রোত দেখল। তারপর চুলে হাত বোলাল। কলার টিউনে গান বাজছে। সত্যি বড্ড দেরি করছে মেয়েটা। তা হলে কি…

খট শব্দে ফোনটা ধরল কেউ, ‘হ্যালো? আদিত্য?’ আদি থমকাল। বহু দিন পর গলাটা শুনছে। একসময়ের বন্ধুর গলা।

ও দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘হাই কনভ।’

‘হ্যালো? তোর খবর কী?’ কনভ হালকাভাবে জিজ্ঞেস করল।

আদি ভিড় ছাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে আকাশের দিকে তাকাল। মেঘ গাঢ় হচ্ছে ক্রমশ। মাতব্বরি মেরে যে হাঁটতে গেল, এতে হিতে বিপরীত না হয়! হঠাৎ বৃষ্টিতে যদি ভিজে যায়? ছাতা তো নেই।

‘হ্যালো আদি! হ্যালো…’ কনভ বুঝতে পারছে না আদি লাইনে আছে, না কেটে গেছে।

লাইন। শব্দটা বড় অদ্ভুত। বিশেষত বাঙালির কাছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব জায়গায় লাইন দিতে হয় মানুষকে। তারপর লাইন বাড়ছে, লাইন করতে হবে, লাইন মারছে—এমন নানারকম ব্যাপারস্যাপার তো আছেই। এই কনভের কথাই ধরা যাক না। আদির চেয়ে দেড়-দু’ বছরের ছোট, কিন্তু তুই-তোকারির বন্ধু। তবে ছিল, এখন আর নেই। এখন তো বহুদিন কথাই হয় না। আর আগে আদিদের বাড়িতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকত। মহুলের সঙ্গে তো সেখানেই দেখা কনভের।

‘আছি, আছি।’ সামান্য ক্লান্ত গলায় বলল আদি। কনভকে স্রেফ নাচায় মহুল। তেমন পাত্তাই দেয় না। আর সে ব্যাটা এঁটুলির মতো লেগে থাকে মহুলের পিছনে। বিশাল বড়লোকের ছেলে। কাজকর্ম তো করতে হয় না বিশেষ। পঁচিশ লাখের গাড়ি চড়ে। দশটা ক্রেডিট কার্ড নিয়ে ঘোরে। শুনেছে খুব শিগগিরি বিদেশে চলে যাবে। নিজেকে দায়িত্ব নিয়ে এক পয়সাও রোজগার করতে হয় না। মহুলের কোনওদিন এমন আতা টাইপের ছেলে পছন্দ হয়? তবু মহুল কেন কনভকে এখনও ঝেড়ে ফেলেনি তা আদি জানে না।

‘ক্যা ইয়ার বাত নেহি কর রাহা হ্যায় তু? কী বলতে ফোন করলি?’ কনভের গলায় অসহিষ্ণুতা।

‘মহুলের সঙ্গে দরকার ছিল।’ আদি সামনের সিগনাল বন্ধ দেখে হালকা হেঁটে রাস্তা পার হল। এ দিকটা বেশ ফাঁকা। বড় বড় গাছ আছে। একটু দূরে ইডেন গার্ডেন্স দেখা যাচ্ছে। তার উঁচু লাইট টাওয়ারগুলো ঘিরেও যেন মেঘেদের জটলা বাড়ছে।

‘কী দরকার রে?’ কনভ হালকা চালে প্রশ্নটা করল। কিন্তু প্রশ্নটার ভেতরে একটা পোড়া গন্ধ পেল আদি। জ্বলছে, কনভ জ্বলছে।

আদি বলল, ‘সেটা পার্সোনাল। তোকে বলব না। আর তুই মহুলের ফোন ধরেছিস কেন? মহুল কই?’

‘ও একটু লু-তে গেছে, আর আমি ওর ফোন ধরেছি কেন তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি?’ কনভ হঠাৎ রেগে গেল।

মনে মনে হাসল আদি। ভাবল, ও তো জানে না আদির সঙ্গে মহুলের কেমন সম্পর্ক। ও ভাবল কনভকে নিয়ে একটু মজা করা যাক।

‘শোন কনভ, রেগে লাভ নেই। আমার আর মহুলের মধ্যে একটা কনফিডেনশিয়াল রিলেশন আছে। সেটা, তোর সামনে ওপেন করব না। তুই ফোন রাখ, আমি পাঁচ মিনিট পরে ফোন করব।’

‘শালা,’ কনভ চিৎকার করল, ‘দু’পয়সার যোগ্যতা নেই আর তুই এখানে মহুলকে নিয়ে এমন বলছিস? জানিস তোর মতো পাতি এগজিকিউটিভ আমার কফি এনে দেয়?’

আদি শব্দ করে হাসল। ওর মজা লাগল খুব। প্রিয় বন্ধু আজ আর এমনি বন্ধুও নেই। আসলে বন্ধুর মধ্যে কখনও সখনও এমন সব ঘটনা বা মানুষ চলে আসে যে, ‘বন্ধু’ শব্দটার মেটামরফসিস ঘটে যায়। ওদের মধ্যে কি সেটা হয়েছে? কীসের জন্য আজ ওরা এমন করছে?

‘সে যাই বলিস। আমায় কিন্তু বি এসসি দু’বার দিতে হয়নি।’ আদি বলল।

‘ইউ ফাকিং…’ কনভ আর কিছু বলার আগে ফোনে আর একটা গলা পেল আদি। মহুল।

‘কার সঙ্গে এমন অসভ্যতা করছ? আর আমার ফোন তোমার হাতে কেন?’ মহুল এমন করে কথাটা বলল যেন এক্ষুনি কনভকে কান ধরে বেঞ্চির ওপর দাঁড় করিয়ে দেবে।

‘আমি… মানে…’ কনভকে তোতলাতে দেখে মজা পেল আদি।

‘আমায় দাও।’ মহুলের গলাটা এবার স্পষ্ট করে এল, ‘হ্যালো, হু ইজ দিস?’

‘হাই মহুল। আদি হিয়ার।’

‘ও হ্যালো ফ…বাডি? ‘ফ’ দিয়ে বহুল প্রচারিত শব্দটা বলতে গিয়ে বলল না মহুল। নিশ্চয়ই কনভ আছে বলেই বলল না।

আদির হঠাৎ খেয়াল হল যে-প্রস্তাব দেবে, সেটা নিয়ে ও কনভের সামনে কথা বলবে কীভাবে? ও ঠিক সময় ফোন করেনি। নিজের ওপরই বিরক্ত লাগল আদির। কনভকে রাগানোর জন্য অতক্ষণ কথা বলা একদম ঠিক হয়নি ওর।

‘হাই, আরে কথা বলছিস না কেন?’ মহুলের গলায় চিরপরিচিত বিরক্তি আর তাড়া।

‘হ্যাঁ, এই তো…,’ আদি নিজেকে গুছিয়ে নিল, ‘এখন কি কথা বলা যাবে?’

মহুল বুঝল সংকেতটা। হালকা গলায় বলল, ‘আদি এক সেকেন্ড,’ তারপর কনভের উদ্দেশে বলল, ‘আরে ফেচ মি সাম কোলা কনভ। আয়াম ডাইং অব থার্স্ট।’

আদি হাসল মনে মনে। কনভকে কাটাতে চাইছে মহুল।

দশ সেকেন্ড পর মহুল বলল, ‘নাউ টক, হি ইজ আউট। কেন ফোন করেছিস? ওয়ান্না ফাক টুডে?’

বড্ড কাঠ কাঠ কথা বলে মেয়েটা। আরে যেখানে শরীরী মিলনের কথা হচ্ছে, সেখান একটু ভালভাবে তা বলবে। না, যা ইচ্ছে তাই বলছে। মহুলকে নিয়ে আর পারা যায় না। আদি সাবধানে আর-একটা রাস্তা পার হয়ে ইডেন গার্ডেন্সের পাশের ফুটপাথ ধরে এগোতে এগোতে বলল, ‘হ্যাঁ মানে… আজ কি তোমার…’

‘ঝেড়ে কাশ না। লাগাবি তার জন্য কত ন্যাকামো!’ মহুলের হুল বড্ড বেশি।

‘তোমার কি এই আটটা নাগাদ সময় হবে?’ আদি জিজ্ঞেস করল।

দীর্ঘশ্বাস শোনাল মহুল, ‘না রে আদি। আজ নয়।’

‘কেন? কত দিন আমরা বেড শেয়ার করি না বলো তো?’

‘আরে বাবা, আমার এখন অন্যরকম দিন চলছে। দ্য রেড সি ইজ ফ্লোয়িং ইয়ার। বোঝ ব্যাপারটা। ইউ হ্যাভ নক্‌ড অন দ্য রং ডোর ডিয়ার। গো ফাইন্ড সামওয়ান এল্‌স।’

যা বাবা! বিরক্ত লাগল আদির। শালা আজ দিনটা পুরো ফালতু। হাইকোর্ট যাওয়ার রাস্তায় ঢুকে ঘড়ি দেখল আদি। হঠাৎ অফিসে যেতে ইচ্ছে করছে না ওর। মনে হচ্ছে পার্ক স্ট্রিট গিয়ে কোনও বারে বসে যায়। নয়তো কলেজ স্ট্রিটের গোপন ডেরায় গিয়ে ধোঁয়া টেনে পড়ে থাকে। কারণ ছাড়া, একদম কোনও কারণ ছাড়াই ভদ্র সমাজের দু’পায়ের ফাঁকে লাথ কষিয়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে কোনও পাহাড়ে।

‘কী রে, মুড অফ হয়ে গেল?’ মহুলের গলায় ইয়ারকি।

‘নাঃ। ঠিক আছে।’

‘তোর তো অনেক ক্যান্ডিডেট। যা না একজনের কাছে।’

‘আমি রাখছি।’ মহুলের সঙ্গে আর কথা বলার কোনও পয়েন্ট নেই।

‘ঠিক আছে। পরে কোনওদিন ফোন করিস।’

আদি কিছু বলার আগেই কট করে ফোনটা নিজেই কেটে দিল মহুল।

হাইকোর্টের গথিক চার্চের মতো চুড়োটা দেখে প্রতিদিনই, কেন কে জানে, গা শিরশির করে ওঠে আদির। আজও করল। এখানে আসলে হঠাৎ মনে হয় গোটা দৃশ্যটা উত্তমকুমারের যুগে ফিরে গিয়েছে। প্রচুর লোক সাদা-কালো জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট সিনেমার যুগ। আর তার ভেতর আজও লাল কোট পরা রং-চটা সাইকেল নিয়ে জিঙ্গল পাগলাকে দেখতে পেল আদি।

লাল কোটটা অবশ্য তেমন লাল নেই আর। বরং মাছের জমাটবাঁধা রক্তের মতো কালচে লাল হয়ে গেছে। জিঙ্গল পাগলা কোটের তলায় একটা শতছিন্ন জামা পরে, যার রং এখন আর বোঝা যায় না। নীচের প্যান্টটা বেগুনি রঙের আর দু’পায়ে দু’রঙের দুটো ছেঁড়া স্নিকার। মাথায় একটা সোনালি রঙের ফিতে ফেট্টির মতো বাঁধা। কাঁচাপাকা চাপ দাড়ি আর রোদে পোড়া তামাটে মুখ দেখলে লোকটার বয়স আন্দাজ করা একটু মুশকিল হয়। তবে ষাট-পঁয়ষট্টি তো হবেই।

কিছু মানুষ আছে যারা জিঙ্গল পাগলার টার্গেট। তাদের দেখলেই এঁকেবেঁকে সাইকেল চালিয়ে তাদের সামনে এসে দু’লাইন গান গায় জিঙ্গল পাগলা। তারপর নিখুঁত ইংরেজিতে বলে, ‘হাই, আয়াম জিঙ্গল অ্যান্ড ইউ আর লিসনিং দ্য ফেমাস সংস। প্লিজ শেয়ার ইয়োর ফরচুন।’ তারপর হাত পেতে দাঁড়িয়ে পড়ে।

এইসব টার্গেটদের একজন হল আদি। দেখা হলেই দু’টাকার একটা কয়েন জিঙ্গলের বরাদ্দ। কম দিলে জিঙ্গল নেয় না, বেশি দিলেও নেয় না। বরং বলে, ‘গ্রিড ইজ আ ডেড্‌লি সিন।’

তবে রোজ রোজ এই পাগলামো ভাল লাগে না আদির। না, অবশ্যই দু’টাকার জন্য নয়। ওর ভাল লাগে না ওই নাটুকেপনার জন্য। জিঙ্গল পাগলার ওই সাইকেল চালিয়ে আসা, লাফ মেরে সাইকেল থেকে নামা, গান গাওয়া-এ সবটাই বড্ড নাটুকে মনে হয় ওর। মনে হয় বাড়াবাড়ি। তবু দু’টাকা দেয় আদি। কী করবে? গরিব মানুষ তো!

আজও গরিব মানুষটার নজর এড়াতে পারল না ও। ওকে দেখেই হইহই করে সাইকেল চালিয়ে এসে পড়ল ওর সামনে। তারপর যথারীতি লাফ দিয়ে নামল সাইকেল থেকে। সাইকেলের লগবগে স্ট্যান্ডটা নামিয়ে হাসল চওড়া করে। তারপর দু’হাত দু’পাশে ছড়িয়ে গান ধরল, ‘জিঙ্গল বেল জিঙ্গল বেল জিঙ্গল অল দ্য ওয়ে/ তোমার সমস্ত মার এখন আমার গেছে সয়ে,’ গান শেষ করে হেসে দু’হাত পাতল আদির সামনে তারপর বলল, ‘প্লিজ, শেয়ার ইয়োর ফরচুন।’

দু’টাকা রেডি করাই ছিল আদির। ও দিয়ে দিল। জিঙ্গল টাকাটা কোটের ভেতরের পকেটে ঢুকিয়ে আবার সাইকেলে বসে চলে গেল অন্য এক শ্রোতার দিকে।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচল আদি। পৃথিবীতে এক-এক পিস পাগল আছে বটে! তবে জিঙ্গলের এই সাইকেলটা নিয়ে খুব কৌতূহল হয় ওর। কোনও পাগলের কাছে তো এমন সাইকেল দেখেনি ও। তা হলে? তা ছাড়া লোকটা এত ভাল ইংরেজি বলে কী করে? আর গানের গলাটাও বেশ। লোকটা আসলে কে? ছদ্মবেশী কেউ নয় তো? কোনও গুপ্তচর টর নয় তো? আদি জানে, এসব নয়, তবে কিছু তো একটা গল্প আছেই। আফশোস হয় আদির যে, কোনওদিন এটা জানতে পারবে না ও।

হাইকোর্টের মুখোমুখি বড় সাদা বিল্ডিংটাতেই আদিদের অফিস। মার্চেন্ট মাল্টিপল্‌স লিমিটেড। ওখানে মান্ধাতার আমলের লিফ্‌ট চলে। আর তার সামনে সবসময় কেরোসিনের দোকানের মতো লাইন। আদি এই ঠাকুরদা লিফ্‌টে ওঠে না। বরং কাঠের সিঁড়িটাই প্রেফার করে।

মার্চেন্ট মাল্টিপল্‌সের বড় পেতলের নেমপ্লেটটার সামনে দাঁড়িয়ে ঘাম মুছল আদি। ভেতরটা পুরো এসি। ঘাম গায়ে বসলে ঠান্ডা লেগে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা হবে। আসলে বৃষ্টি তো হল না। বরং মেঘ করে পুরোটা ভ্যাপসা হয়ে আছে। সত্যি, পুজোয় না…আদি কাচের ভারী দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল।

কাঠের সিঁড়ি, পুরনো লিফ্‌ট আর বুড়ো দাদুর মতো বাড়ির ভেতরে এই অফিসটা যেন টাইম মেশিন করে দুশো বছর এগিয়ে যাওয়া কোনও পৃথিবী।

গোটা অফিসটা মার্বেলে মোড়া। ওর ভার্টিকাল ব্লাইন্ডস দেওয়া ঘষা কাচের ঘর সব। আর তার সঙ্গে আছে ঘষা কাচেরই পাঁচ ফুট উঁচু পার্টিশন দেওয়া কিউবিক্‌ল। এর একটায় বসে আদি।

‘হাই আদি।’ কিউবিক্‌লে বসে নিজের রোলিফ্লেক্স ক্যামেরাটা সামনের টেবিলে রাখামাত্র ও ডাকটা শুনল। রায়না সেন। গৌরের পিএ। মেয়েটা কাজকর্মে যেমন চৌখস তেমন শরীরেও সাংঘাতিক। তবে খুব বুদ্ধিমতী। প্রথম প্রথম ট্রাই নিয়েছিল আদি। পাত্তা পায়নি। বরং রায়না এমন মুখ করে তাকিয়েছিল যে, আদির নিজেকে খুব চিপ মনে হয়েছিল। তখন থেকে রায়নার প্রতি নিজের মনোভাব বদলেছে ও। তবু আজ শরীর ভায়া একটু গন্ডগোল করছে বলেই বোধহয় রায়নার বুকের দিকে দু’-এক পলক বেশি তাকিয়ে ফেলল আদি। বুকের বোতাম দুটো কি ভেসে উঠছে টপের ওপর দিয়ে?

রায়নার গলার স্বর কঠিন হল, ‘আদি লিসন। মিস্টার কুটিনহো তোমায় ডাকছে। এক্ষুনি।’

স্যামুয়েল কুটিনহো ওদের পার্টিকল্ বোর্ডের জেনারেল ম্যানেজার। সপ্তাহে দু’দিন এখানে আসেন ভদ্রলোক। মানুষটি সত্যি খুব ভাল। বলেন, ‘আমি জিএম বলে স্যরট্যার বলবে না। কল মি স্যাম।’

রায়নার গলার স্বরে সতর্ক হল আদি। নিজেকে মনে মনে ধমকও দিল একটু। তারপর সময় নষ্ট না করে স্যামের ঘরের দিকে গেল।

স্যামুয়েল কুটিনহো। বছর পঞ্চাশের মানুষ। মাথায় ইয়াব্বড় টাক। তবে থুতনিতে ফরাসি কাটের দাড়ি। স্যামকে বললে বলে, ফ্রেঞ্চ নয় পর্তুগিজ কাট। বলে ফরাসিরা আবার এমন শিখল কবে থেকে?

‘কাম ইন,’ আদি নক করার একটু পরে স্যামের গলা শুনল। ও দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। আর সঙ্গে সঙ্গে নদীর ধারে ফুটে থাকা ফুলের অদ্ভুত এক মিষ্টি গন্ধ এসে নাকে লাগল ওর।

একটি মেয়ে বসে রয়েছে স্যামের টেবিলের এদিকে। কিন্তু দরজার দিকে পিছন বলে মুখটা দেখতে পাচ্ছে না আদি। কে মেয়েটা?

‘বোসো আদি।’ স্যাম মেয়েটার পাশের চেয়ারটা আদিকে দেখাল। আদি বসল। নদীর পাশের ফুলেরা যেন মাতোয়ারা হল আরও একটু বেশি।

‘মিট হার, আওয়ার নিউ পাবলিক রিলেশন অফিসার। ও-ও এবার তোমার সঙ্গে নর্থ চব্বিশ পরগনাটা কভার করবে।’

এবার মেয়েটাকে দেখল আদি। দেখল কর্মক্ষেত্রে ওর রাইভালকে। কিন্তু দেখামাত্র কোথায় কী যেন হল আদির। যেন এমন একটা ঘর শরীরে খুলে গেল যেটার কথা ও নিজেই জানত না। ওর মনে হল, সেই ঘরের মেঝেয় কে যেন রেললাইন পেতে দিয়েছে আর তার ওপর দিয়ে ঝিকঝিক করে চলছে একলা রেলগাড়ি।

কে এই মেয়েটা? এমন পেঁয়াজ রঙের শিফনে মুড়ে কে এল ওর সামনে? সামান্য চাপা নাক। সামান্য লালচে চুল। সামান্য টোল পড়া থুতনি। তবু এই অসামান্য রূপ কার? রেলগাড়িটা বুকের ঠিক মাঝখানে চক্কর খাচ্ছে, খুব চক্কর খাচ্ছে, বুঝল আদি।

আদির ফ্যালফ্যালে দৃষ্টির সামনে মেয়েটা যেন সামান্য হাসল। লজ্জা পেয়ে গেল আদি। লজ্জা পেল ও? ও নিজের হতভম্ব ভাব কাটানোর জন্য বলল, ‘হাই, আয়াম আদিত্য ব্যানার্জি।’

‘হাই,’ মেয়েটা ছোট্ট করে মাথা নাড়ল। আদির মনে হল বহু দূর কোনও চার্চে অর্গান বেজে উঠল যেন। যেন এবার প্রার্থনা শুরু হবে। মেয়েটা আবার বলল, ‘আয়াম সিংহ, মালিনী সিংহ।’

আদি নিজের বুকের ভেতরের চক্কর মারতে থাকা রেলগাড়িটা দেখে বুঝতে পারল না, কেন সেটা এমন পাক মারছে। বুঝতে পারল না এই মেয়েটি কি অফ স্টাম্পের বাইরের বল না ইয়র্কার!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *