মুহূর্তরা দু’বছর আগে – ৩৬

৩৬

ফোনটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসে রইল দিঘি। বাইরে, কাচের জানলার ওপারে আজ বৃষ্টি নেমেছে খুব। গড়পাড়ের দিকে জলও জমেছে। রামমোহন মিশন লাইব্রেরির সামনে বাবা আটকে আছে। গাড়িটা খারাপ হয়েছিল বলে আজ গাড়ি ছাড়াই অফিসে গিয়েছিল বাবা। ফেরার পথে তুমুল বৃষ্টিতে আটকে আছে। আজ যেন ফুটো হয়ে গেছে কলকাতার ছাদ। মা খিচুড়ি বসাতে বলেছে রান্নার মাসিকে। আর গজগজ করছে এমন খারাপ আবহাওয়ার জন্য, বাবার আটকে পড়ার জন্য। সব শুনছে দিঘি। কিন্তু তবু যেন কিছু শুনছে না। বুকের ভেতরের খাঁচাটায় যেন ছটফট করছে একটা চড়াই। মনে হচ্ছে এক্ষুনি সব বদলে ফেলে। সব আগের মতো করে ফেলে। যখন প্রজাপতির ডানার মতো আলো অন্ধকার টপকে উড়ে উড়ে বেড়াত ও-তেমন করে ফেলে।

আজ প্রজাপতি ঝলসে গেছে আগুনে। সে নির্জীব। সারা শরীর তার পোড়া। ডানা মেলার কৌশলও হয়তো ভুলেছে সে আজ।

দিঘির অদ্ভুত লাগছে। মনে হচ্ছে অসংখ্য ঝিঁঝিপোকা কে যেন ঢুকিয়ে দিয়েছে শরীরে। মনে হচ্ছে সারা শরীর কাঁপছে। হাতে-পায়ে জোর নেই। মাথাও কেমন যেন ঘুরছে। এ কী খবর শুনল ও? রাহি ওকে এমন একটা খবর শোনাল?

আজ কলেজও যেতে পারেনি দিঘি। গত সাতদিন জ্বরে ভুগে গতকাল থেকে ভাল আছে ও। তাই এমন স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় আর রাস্তায় বের হয়নি দিঘি। বা বলা ভাল বেরোনোর ঝুঁকি নেয়নি।

সারাটা দিন পড়াশোনা করেছে দিঘি। কয়েকদিনের পড়া জমে গিয়েছিল। তারপর শেষ বিকেলের দিকে গুছিয়ে রেখেছিল বইপত্তর। ভাল লাগছিল না পড়তে। শুধু মনে হচ্ছিল, সব কেমন যেন ফাঁকা। কী যেন নেই। কী যেন হলে মন ভাল হয়ে যেত। কী করবে বুঝতে পারছিল না। কার সঙ্গে কথা বলবে ঠিক করতে পারছিল না। মোবাইলটা নিয়ে বারবার ফোনবুকে সেভ করে রাখা নামগুলো দেখছিল। মনে হচ্ছিল এত জনের নম্বর সেভ করা আছে, তবু কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না কেন? তারপর ভাল করে ভেবেছিল দিঘি। সত্যিই কি কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না? নাকি…

ফোনবুকের ‘কে’ অক্ষরে এসে আটকে যাচ্ছিল ওর চোখ। কিগান। ওর নম্বরটা টানছিল দিঘিকে। ইচ্ছে করছিল ফোন করতে। হাতের আঙুল অস্থিরভাবে এক দ্বিধার ভেতর জড়িয়ে গিয়েছিল। করব? কল করব? পেন্ডুলামের মতো দুলছিল ওর মন। কষ্টে কে যেন ওর শ্বাসনালিটাকে পেঁচিয়ে ফেলছিল রাবার দিয়ে। যেন কেউ জলে ডুবিয়ে দিচ্ছিল ওকে। মনে হচ্ছিল আবহাওয়ায় অক্সিজেন কমে যাচ্ছে দ্রুত। আর তাই থাকতে না পেরে ফোনটা করেছিল শেষ পর্যন্ত। তবে কিগানকে নয়, রাহিকে।

দিঘি বিছানা থেকে উঠে জানলার কাছে দাঁড়াল। বৃষ্টি বাড়ছে। বাবা আসবে কী করে? বাবার নাকি ছাতা ভেঙে গেছে। মা যে অন্য ঘরে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে তা বেশ বুঝতে পারছে দিঘি। তবু চিন্তাটা আবার বেঁকে যাচ্ছে। আবার চলে যাচ্ছে রাহির কথাগুলোর দিকে।

দিঘির ফোনটা পেয়ে রাহি যেন অবাকই হয়েছিল একটু। বলেছিল, ‘আরে, তুমি? এতদিন পর! হঠাৎ! কী মনে করে?’

দিঘি অপ্রস্তুত হয়েছিল। রাহি ঠিকই বলছে। ও বহু মাস ফোন করেনি। আর দীর্ঘদিন যোগাযোগ না করলে চেনা সম্পর্কের ভেতরেও ধুলো আর ঝুল জমে। ময়লা পড়ে। মনের দৃষ্টি আবছা আর তির্যক হয়ে যায়। সহজ হতে চেয়েও মন যেন সহজ হতে পারে না। দিঘিও যেন সহজ হতে পারছিল না। তবু সহজ গলায় বলেছিল, ‘দেখো না প্রজেক্ট, পরীক্ষা আরও কত কিছু ছিল। সব নিয়ে একদম ঘেঁটে ছিলাম। খুব ইচ্ছে হত ফোন করি, কিন্তু এই করব করছি করে করে কেমন যেন পেরিয়ে গেল এক-একটা দিন। তাই ঠিক করলাম যে, আজ আর কেউ আটকাতে পারবে না আমায়। আজ আমি ফোন করবই।’

রাহি হেসেছিল, ‘এমন করে বলছ যেন কঠিন একটা কাজ। তবে আমারও ঠিক হয়নি তোমায় এভাবে জিজ্ঞেস করা, কারণ, আমি নিজেও তো তোমায় ফোন করিনি।’

দিঘির ভেতরটা ছটফট করছিল। মনে হচ্ছিল এসব অনর্থক কথা বলছে কেন ও? কেন সময় নষ্ট করছে এভাবে? ও তো অন্য কথা বলতে চায়। জানতে চায়।

দিঘি বলেছিল, ‘তারপর? কেমন আছ তোমরা? তোমাদের ওখানকার সবাই?’

রাহি সময় নিয়েছিল সামান্য। তারপর বলেছিল, ‘মাঝখানে খুব সমস্যা আর গন্ডগোল হয়েছিল। এখন ঠিক আছে।’

‘সমস্যা!’ দিঘি প্রশ্ন করেছিল।

‘হ্যাঁ, জমি-জায়গা নিয়ে সে তো বিরাট কাণ্ড। আদিত্যর মানে কিগানদার ভাই তো আহত হয়েছিল। তারপর অবশ্য সব মিটে গেছে। ভাগ্যিস কিগানদা ছিল, না হলে যে কী হত?’

‘কিগানদা?’ দিঘির গলা শুকিয়ে আসছিল। মাথা এলোমেলো হচ্ছিল আবার। মনে হচ্ছিল এখানেও লোকটা? তবু যথাসম্ভব গলাটা সহজ রাখার চেষ্টা করছিল। বলেছিল, ‘কেন, কী করেছে আবার?’

‘ও না থাকলে যে কী হত! আদিত্যর বা আমার যে…’ রাহির দীর্ঘশ্বাস স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিল দিঘি। রাহি বলেছিল, ‘সে অনেক কথা। একদিন বলব। তবে এটুকু বলছি, কিগানদার মতো মানুষ আমি আর দেখলাম না।’

রাহি কিগানের প্রশংসা করছে! মৌমাছি যেন হুল ফোটাল দিঘির বুকে। লোকটার কি সব বিষয়ে হিরোগিরি না করলেই চলে না!

দিঘি ব্যঙ্গ করে বলেছিল, ‘তোমার সবসময় কিগানদার দিকে ঝোল টেনে কথা বলার স্বভাব।’

‘না, একদম না,’ রাহির গলা শক্ত হয়ে গিয়েছিল আচমকা, ‘তুমি জানো না বলে এমন বলছ। কিন্তু আমি তো জানি মানুষটাকে। এমন সেল্ফলেস মানুষ আমি দেখিনি কোনওদিন। যাক, তোমায় আর কী বলব। আসলে কাউকেই আর কিছু বলার নেই। কারণ মানুষটাই তো আর নেই।’

‘মানে!’ দিঘির বুকের ভেতর আচমকা আছড়ে পড়েছিল বিদ্যুৎ। নেই? মানুষটা নেই এর অর্থ কী? ‘নেই মানে? কে নেই?’

‘মানে নেই,’ রাহি থেমেছিল কিছুক্ষণ, তারপর বলেছিল, ‘আর নেই এখানে। চাপাডাঙায়। এখানকার চাকরি ছেড়ে চলে গেছে।’

‘চলে গেছে!’ দিঘির কথা বেরোচ্ছিল না মুখ দিয়ে।

‘হ্যাঁ, চলে গেছে।’ রাহি থেমেছিল আবার, ‘কী যে হল হঠাৎ! জানো, একদিন বলল চলে যাবে। চলে যাবে অন্য চাকরি নিয়ে। জিজ্ঞেস করলাম। বলল, একলা হতে চায়। কেন চায়, কীসের জন্য চায়। তা বলল না। আমি জানি, প্রথম থেকেই জানি, মানুষটা দুঃখী, একা। তবে এমন হবে বুঝতে পারিনি।’

দিঘি কথা বলতে পারছিল না। হু হু করে গড়পাড়ের জল এসে বুজিয়ে দিচ্ছিল ওর গলা। কথা তলিয়ে যাচ্ছিল স্রোতে। চলে গেল লোকটা! এমনভাবে চলে গেল? কেন গেল? ওর জন্য? ওর ওই ফোনটার জন্য? কী যে ভূত ঢুকেছিল দিঘির মাথায়! কিগান তো চলেই গিয়েছিল কলকাতা থেকে। তার পরেও কেন ওসব বলতে গিয়েছিল ও?

কিন্তু সত্যিই কি চলে গিয়েছিল কিগান? চলে যাওয়া কাকে বলে? সশরীরে চলে গেলেও, আসলে কি কিগান গিয়েছিল? চলে যাওয়া যে কতটা চলে আসা সেটা বুঝতে পেরেছে দিঘি। ও কোনওমতে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কোথায় গেল মানুষটা?’

রাহি বলেছিল, ‘পাহাড়ে। নতুন চাকরি নিয়ে চলে গেছে।’

কোথায় গেছে? কোন জায়গায়? কোন কোম্পানি? নতুন ফোন নম্বর নিয়েছে? নম্বরটা কী? রাহির কাছে কি আছে সেটা? রাহি কি একবার দেবে ওকে? বলবে কিগান যাওয়ার সময় ওর কথা একবারও বলেছিল কিনা?

কিন্তু জল ঢেকে দেয় সব। দৃশ্য আবছা হয়ে যায়। শব্দ ডুবে যায়। জল ধর্ম অনুযায়ী আলাদা করে দেয় মানুষকে। দিঘি সেই ডুবে যাওয়া জল পেরিয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। আচমকাই ‘পরে কথা বলছি’ বলে কেটে দিয়েছিল ফোনটা।

আচমকা ফোনটা কেটে দেওয়া কি অসভ্যতা হয়েছে? অন্যায় হয়েছে? জানে না দিঘি। ও জানতেও চায় না। ও যে কথা বলতে পারছিল না! ওর যে কষ্ট হচ্ছে খুব!

জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল দিঘি। কলকাতার এই অংশটা পুরনো। অনেক পুরনো। এখানে পুরনো দালান বাড়ি আছে অনেক। ঝুল বারান্দা, লাল রোয়াক, আছে লোহার বিচিত্র কাজের থামওলা পোর্টিকো। ওদের বাড়ির উলটোদিকেই একটা বাড়ি আছে যার সামনে রয়েছে একটা রোয়াক।

দিঘি দেখল সেই নীচের রোয়াকে দুটো বাচ্চা ছেলে কাগজের নৌকো তৈরি করে রাস্তার কোণে জমা জলে ছাড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কাগজের দুটো নৌকো ভাসছে না। এক দিকে কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে বারে বারে। তবু ছেলে দুটো চেষ্টা করে যাচ্ছে। ছাতা মাথায় দিয়ে রোয়াক থেকে উপুড় হয়ে ঝুঁকে দুটো ছেলে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে নৌকো দুটো সোজা করার। নৌকো দুটো ভাসানোর।

‘কী দেখছিস রে দিঘি?’

মহুলের গলার স্বরে পিছনে ফিরল দিঘি, ‘কিছু না।’

‘এ কী!’ মহুল ওর হাতে খোলা বইটা পাশের টেবিলে উপুড় করে রেখে এগিয়ে এল ওর দিকে, ‘কী হয়েছে তোর? চোখে জল কেন?’

‘কই?’ দিঘি তাড়াতাড়ি চোখটা মুছল। সত্যি কখন যে জল গড়িয়ে নেমেছে সেটা বুঝতেই পারেনি!

‘কী হয়েছে দিঘি?’ মহুল কাছে এসে হাত রাখল মাথায়।

কখনও কখনও মানুষের স্পর্শে স্নেহ থাকে। ভরসা থাকে। ভালবাসা থাকে। আজ হঠাৎ এই সমস্ত কিছু মহুলের স্পর্শ থেকে বুঝতে পারল দিঘি। মানুষ রূঢ় কথায় যত না কাঁদে, ভালবাসায় কাঁদে তার চেয়ে বেশি। দিঘি যেন এই স্পর্শটুকুর অপেক্ষাই করছিল। বাড়তে থাকা জল নরম স্পর্শে এবার ঝোরা হয়ে নামল। দিঘি মহুলকে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল জোরে।

‘এই পাগলি, কী হয়েছে?’ মহুল অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল।

দিঘি উত্তর দিল না। বরং আরও জোরে আঁকড়ে ধরল মহুলকে। ঝরনা তার উদ্দামতা বাড়াল আরও।

মহুল আর কিছু বলল না। কাঁদতে দিল দিঘিকে। শুধু ধরে থাকল ওকে। নরমভাবে ধরে থাকল। তারপর একসময় কান্না ধরে এল। দিঘি ঠোঁট কামড়ে মহুলের কাঁধ থেকে মাথা তুলে ধীর পায়ে গিয়ে বসল বিছানায়। ভেজা চোখের পাতা তুলল না একবারও।

মহুল এসে বসল ওর পাশে। বলল, ‘কাউকে কষ্ট দিয়েছিস? না কেউ তোকে কষ্ট দিয়েছে?’

দিঘি ঠোঁট কামড়ে রইল। উত্তর দিল না কিছু।

মহুল হাসল, ‘তুই এখনও একদম পাগলিই রয়ে গেলি! বল না কী হয়েছে?’

দিঘি মহুলের দিকে তাকাল। একদম পালটে গেছে ওর দিদিটা। সেই দাবাখাবা, আত্মকেন্দ্রিক, জেদি মেয়েটা যেন আর নেই। এত দিনকার ঘোলা জল থিতিয়ে এখন টলটলে জলটা পড়ে রয়েছে শুধু। কষ্ট মানুষকে কি থিতিয়ে দেয়? মানুষকে কি স্বচ্ছ আর স্পষ্ট করে দেয়?

মহুল আজকাল মাঝে মাঝেই এসে থাকে ওদের সঙ্গে। এমনকী মাঝে মাঝে শ্বশুর বাড়িতেও যায়। শমীর বাবা আর মায়ের সঙ্গে অদ্ভুত সহজ হয়ে গিয়েছে মহুলের সম্পর্ক। আর কোনও চাহিদা নেই মহুলের। যেন শমীর সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোও মিশে গেছে জলে আর হাওয়ায়। এ মহুল যেন আগুনে পোড়া। খাঁটি।

মহুল আলতো করে হাত রাখল দিঘির মাথায়। তারপর সরে এল ওর কাছে, ‘কার জন্য এত মনখারাপ করছে তোর? কে তোকে এত কষ্ট দিয়েছে রে? কার জন্য এমন করে কাঁদছিস? আমায় বলতে পারিস তুই। বিশ্বাস করে বলতে পারিস।’

দিঘি ছলছলে চোখ তুলে তাকাল মহুলের দিকে। বলবে? বলতে পারবে সেইসব কথা, যা কোনওদিন কাউকে বলেনি ও? মহুল কি বুঝবে? মহুল কি খারাপ ভাববে ওকে? কিংবা কিগানকে? মহুল কি বুঝতে পারবে কোন স্পন্দনে দিঘি বেজে উঠেছিল কিগানের সঙ্গে?

তবু চূড়া স্পর্শ করতে চায় আকাশ। নদী মিশতে চায় সমুদ্রে। প্রেম চায় তার প্রকাশধর্ম।

দিঘি তাকাল মহুলের দিকে। তারপর নিচু গলায় বলল, ‘তুই ভুল বুঝবি না তো?’

‘না, সারাজীবন তো ভুলই বুঝলাম দিঘি। আর কত ভুল বুঝব বল? তুই বল। বলেই দেখ না তোর দিদি কতটা ভুল বোঝে।’

দিঘি ঠোঁট কামড়ে সংযত করল নিজেকে। বালিশটা নিয়ে কোলের ওপর রাখল। তারপর শান্ত গলায় বলল, ‘জানিস দিদি আমি না খুব ভুল করেছি একটা।’

মহুল বলল না কিছু। স্থির চোখে তাকিয়ে রইল দিঘির দিকে। দিঘি বুঝল মহুল সময় দিচ্ছে ওকে। দিঘিও সময় নিল। গুছিয়ে নিল নিজেকে। বড্ড এলোমেলো হয়ে আছে ও। বড্ড আগোছালো হয়ে আছে। নিজের কথা বলতে গেলে এত আগোছালো হলে চলে না।

মহুল হাতটা ধরল দিঘির। বলল, ‘এবার বল, মন খুলে বল।’

দিঘি সময় নিল আরও একটু। তারপর বলল। সবটা খুলে, গুছিয়ে বলল।

কলকাতায় বৃষ্টি বাড়ল কি? জলও কি ছাপিয়ে উঠল আরও একটু? লাল হলুদ ট্র্যাফিক আলো কি ক্লান্ত মানুষের চোখের মতো জেগে রইল? সার সার গাড়ি, রংবেরঙের হোর্ডিং আর অসংখ্য মানুষজন, সবাই কি ভিজে ভিজে ফিরতে পারল নিজের নিজের গন্তব্যে? আকাশ নেমে এল কি আরও একটু নীচে? বৃষ্টি কি আরও একটু কাছাকাছি এনে দিল জোড়াতালি দেওয়া, রিফু করা মানুষগুলোকে।

কথা শেষ করে দিঘি মাথা নিচু করে বসে রইল। একবারও মুখ তুলে তাকাল না মহুলের দিকে। বালিশের দিকে তাকিয়ে, তার ওপর আঁকিবুকি কাটতে লাগল।

‘তুই ফোন করে ওসব কথা বলেছিস?’ মহুল অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল।

দিঘি চোয়াল শক্ত করে মাথা নাড়ল শুধু।

‘তোর মাথা খারাপ! তুই কী না কী চিঠি দেখে অফ অল পিপ্‌ল সুবর্ণকে গিয়ে অমন কথা বললি! আর ও গিয়ে কিগানদার কাকাকে বলল! তোর মনে হল না যে, কিগানদা ইচ্ছে করলে তোকে বিপদে ফেলতে পারে? তুই কিগানদাকে প্রচুর মেসেজ পাঠাতিস বলছিস, বহুবার ফোন করেছিস-তার রেকর্ড যদি কিগানদার কাছে থাকে! সেসব যদি দেখিয়ে দিয়ে বলত যে, তুই ওকে উসকেছিস? আর সেটা তো মিথ্যেও নয়। তোর কোন বুদ্ধি তোকে এমন একটা কাজ করতে বলল? আর আননেসেসারি মানুষটাকে অপমান করলি, বদনাম দিলি। আর শেষমেশ মানুষটা দূরে গিয়ে একটা জায়গায় থিতু হল সেখানেও তাকে অপমান করলি! ফোন করে বললি সে যেন চলে যায়! যেন দূর হয়ে যায়! তোর কি মাথা খারাপ! আর দেখ তো, লোকটা সত্যিই চলে গেল! কেন এমন করলি দিঘি? মানুষ এমন করে? জেলাসির জন্য এত দূর যেতে হবে? তোর রাগ হয়েছে বলে এমন করতে হবে? অমন একজন মানুষকে অনেকেই ভালবাসবে। সেটাতে আশ্চর্যের কী আছে!’

‘দিদি,’ এবার মুখ তুলল দিঘি, ‘কিন্তু যত্ন করে কেউ প্রেমিকার চিঠি রেখে দেয়?’

‘আরে, তুই পুরনো বই ঘাঁটতে গিয়ে পেয়েছিলি। নিজেই বললি ধুলো জমা ইংরেজি পেপার ব্যাক থ্রিলার। মানুষের কত কিছু এখানে ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়ে যায়। সেসব কি ধরতে হয়? সেসব কি আর মনে রাখতে হয়?’

‘আমার হিংসে হয়েছিল দিদি, মনে হয়েছিল আমায় ভালবাসে বলে, আর ওদিকে অন্য মেয়েদের স্মৃতি আঁকড়ে বসে আছে! আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তুই বল দিদি, আমাদের যা সোসাইটি, কেউ মানবে আমার চেয়ে পনেরো বছরের বড় কোনও মানুষের সঙ্গে আমার রিলেশন? তবু, সব বাদ দিয়ে, সব ভুলে, সবার বিপরীতে গিয়ে ওকে আমি ভালবেসেছি। আর সেখানে অন্য মেয়েদের প্রেমপত্র? আগে রিলেশন থাকতেই পারে, সে নিয়ে তো রাগ নেই আমার। কিন্তু তা বলে এখন? আই লস্ট কন্ট্রোল ওভার মাইসেল্ফ।’

‘জানিস,’ মহুল শান্ত গলায় বলল, ‘আমাদের তো একই রক্ত, আমিও জীবনের একটা দীর্ঘ সময় কন্ট্রোল লুজ করে বসেছিলাম। তারপর সব হারিয়ে এখন বুঝেছি। শমীর যে ক্যান্সার হয়েছে সেটা আমায় যখন বলেছিল, আমি প্রথমে বিশ্বাস করিনি। তারপর দেখলাম ও কাঁদছে। বলেছিলাম, তুমি ভয় পেয়ো না। কিচ্ছু হবে না। জানিস শমী কী বলেছিল? শমী বলেছিল, ও মৃত্যুভয়ে কাঁদছে না, ওর কষ্ট হচ্ছে আমায় দেখতে পাবে না বলে। ওকে তো সারাটা জীবন আমি অপমান করেছি, গালাগালি করেছি, এমনকী মেরেওছি। তাও ভালবাসত এত! ওর জীবনের শেষ ক’টা দিন ওর সঙ্গে ছিলাম। আর থাকতে থাকতে, একটা জিনিস বুঝেছি। আমরা বড্ড বেশি ‘আমি আমি’ করি। আমাদের, নিজেদের গুরুত্ব দিই। আমার দুঃখ, আমার অপমান, আমার পাওয়া-না পাওয়া, এ সবই যেন মুখ্য হয়ে ওঠে। আমরা ভুলেই যাই আসলে প্রেম কী! শমী যেদিন মারা গেল, তার আগের রাতে আমায় ফিসফিস করে বলেছিল, জানো মহুল, আমি না জলটা দেখতে পাচ্ছি। কালো, স্বচ্ছ এক পুকুর জল। তুমি আমার হাতটা ধরে জলের কিনারা অবধি নিয়ে এসেছ। জলটুকু কিন্তু শুধু আমার। এখানে ডুবে যেতে যেতে আমি শুধু তোমায় দেখব। শেষ অবধি তোমায় চোখে নিয়ে আমি যাব। কে কাকে চোখে রাখে দিঘি? যখন নার্সিংহোম থেকে কাপড়ে মুড়ে বের করে আনল ওকে, তোর মনে আছে খুব হাওয়া দিচ্ছিল সেদিন। মাথার যেটুকু চুল অবশিষ্ট ছিল, সেটুকু কেমন দুলছিল হাওয়ায়! মনে আছে তোর? জানিস দিঘি, আমার আমার করে জীবনটাকে শেষ করিস না। যা তোর, তা তোর কাছেই থাকবে। যা তোর নয়, তা থাকবে না। শুধু নিজের কিছু জোর করে ঠেলে ফেলে দিস না। নষ্ট করিস না। কারণ, এই কাকচক্ষু জলটা অবধি একজন কাউকে লাগে, যাকে পাশে করে হাঁটা যায়। যাকে চোখে নিয়ে নেমে যাওয়া যায় চিরকালীন জলে।’

দিঘি মুখ তুলে তাকাল মহুলের দিকে। তারপর অস্ফুটে বলল, ‘আমি এখন কী করব দিদি?’

‘তুই কি এখনও পছন্দ করিস কিগানদাকে?’

দিঘি কিছু বলতে গিয়েও পারল না। ঠোঁট কামড়ে মাথা নামিয়ে নিল। গলার কাছে যেন আটকে আছে কিছু। স্বর বেরোচ্ছে না একটুও।

মহুল এগিয়ে এসে মাথায় হাত রাখল দিঘির, ‘ফোন নম্বর আছে তোর কাছে?’

দিঘি অসহায়ের মতো মুখ করে তাকাল মহুলের দিকে। বলল, ‘না তো, রাহিদির থেকে নিইনি। মানে…’

‘তা হলে নে,’ মহুল বলল, ‘নিসনি কেন তখন?’

‘না, কী বলব রাহিদিকে? হঠাৎ কোন অজুহাতে চাইব? আর রাহিদি প্রশ্ন করলে সব বলে দিতে হবে। আমি পারব না রে দিদি। আর আমি পারব না। আমি মরে যাব এবার। ঠিক মরে যাব, দেখবি।’

‘বোকার মতো কথা বলিস না,’ মহুল বিছানা থেকে উঠে পায়চারি করল কিছুক্ষণ, আর বলল, ‘বৃষ্টি হচ্ছে এত, নয়তো…’

‘নয়তো?’ দিঘি মাথা তুলে তাকাল মহুলের দিকে।

‘আদিকে বাড়িতে দেখেছি আজ। ওর কাছে শিয়োর পেয়ে যেতিস কনট্যাক্টটা।’

‘আদিদা?’ দিঘি অনিশ্চিত চোখে তাকাল।

‘হ্যাঁ, আদি। যদি একবার যেতে পারতিস!’

‘আমি!’ দিঘির গলায় দ্বিধা।

‘আমি গেলে কেমন লাগবে না?’ মহুল বলল, ‘তবে আজ থাক, কাল যাব।’

‘কাল?’ দিঘি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল আবার। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল জানলার কাছে। বৃষ্টি বাড়ল আরও। পাড়ার রাস্তার কোনায় জমা জল বাড়তে বাড়তে রাস্তার মাঝখানটাও ঢেকে গেছে।

‘হ্যাঁ, কাল গিয়ে নিয়ে আসবি।’ মহুল আবার বলল।

‘আদিদাকে তো পাড়াতে পাওয়াই যায় না। ওর দেখা পাওয়াই তো ভার!’ দিঘি জানলা দিয়ে বাইরে চোখ রেখে বলল।

‘তা হলে কি তুই…’

‘এখন যাব?’ দিঘি জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে মহুলের দিকে তাকাল।

‘এখন? এই বৃষ্টিতে?’ মহুল অবাক হল।

‘দিদি, অনেক দেরি তো হয়ে গেছে অলরেডি। আমার যে কী হচ্ছে মনের ভেতর! আমার যে আর…’ দিঘির গলাও বুজে এল আবার। ও দেখতে পেল লম্বা বারান্দার শেষে একটা ঘর। তাতে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে বসে রয়েছে একজন। তার ঝুঁকে পড়া কাঁধ, হলুদ গিটার আর আগোছোলা চুল উড়ছে হাওয়ায়। আর ভেসে আছে, অদ্ভুত এক জঙ্গলের গন্ধমাখা কস্তুরী সুবাস ভেসে আছে হাওয়ায়। শরীর অবশ হয়ে আসছে দিঘির। মাথায় ঝিম ধরছে। দৃষ্টি বুজে আসছে ক্রমশ। মনের ভেতরের হরিণীটা পা দাপাচ্ছে, মাথা নাড়ছে, হৃত্স্পন্দন দ্রুত হচ্ছে তার।

দিঘি বলল, ‘আমি এখনই যাব দিদি। আমায় এখনই যেতে হবে।’

‘ঠিক আছে। বড় ছাতাটা নিয়ে যাস। আর মাকে আমি ম্যানেজ করব।’ মহুল হাসল। তারপর টেবিলের ওপর উপুড় করে রাখা বইটা তুলে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

দিঘি চট করে নিজেকে দেখে নিল আয়নায়। এলোমেলো হয়ে আছে একটু। বিশেষ করে মাথার চুলটা। আর কান্নার ফলে চোখটা ফুলে রয়েছে বেশ। কিন্তু এখন কি এসব দেখার সময়? আসলে রাহির সঙ্গে কথা বলার পর কেমন যেন গুলিয়ে গিয়েছিল মাথাটা। এখন মহুলের কথায় বেশ মনে জোর পাচ্ছে। তবে একটা ‘কিন্তু কিন্তু’ ভাবও আছে। যদি আদি না দেয় ফোন নম্বর? যদি আদি ফিরিয়ে দেয়! আর সত্যিই তো, আদি যদি বলে যে, দিঘির জন্যই তো আজ কিগানের এই অবস্থা! দিঘিকে কেন দেবে কিগানের ফোন নম্বর বা ঠিকানা? কেন আবার কিগানকে ঠেলে দেবে দিঘির সামনে?

আর যদি পালটা প্রশ্ন করে, কেন এমন করল দিঘি? কোন অধিকারে করল? তবে? যৌনঈর্ষা! যৌনঈর্ষার কথা কি বুঝবে ও? এর চেয়ে তীব্র মোটিভ কি আর কিছু হতে পারে জীবনে? তবু, ওর ঈর্ষার জন্য কেন কষ্ট পাবে অন্যজন? আদি এসব প্রশ্ন করলে কী বলবে দিঘি?

জানে না, দিঘি কিছু জানে না। শুধু জানে, অন্ধকার সম্পূর্ণ করে আলোকে। এতদিন অন্ধকার বুকে করে বসে ছিল ও। জানত না সেই অন্ধকারের ব্যবহার। কিন্তু আজ বুঝতে পারে, আলোর দিকে গিয়ে তাকে সম্পূর্ণ করাই ওর প্রধান কাজ।

বড় ছাতাটা নিয়ে দরজার কাছে যেতেই প্রথম বাধাটা পেল দিঘি। বাবা। একদম ভিজে কাক হয়ে গেছে। দিঘিকে দেখে বাবা হতবাক হয়ে গেলেও সেটা সামলে নিয়ে হাসল, ‘কী রে ছাতা নিয়ে এখন বেরোচ্ছিস কোথায়?’

‘আমি!’ দিঘি অপ্রস্তুত হল।

‘হ্যাঁ। যা ওয়েদার, আর বেরোস না। তখন থেকে দাঁড়িয়েছিলাম লাইব্রেরির সামনে। ছাতাটাও তো গেছে। তারপর ভাবলাম ছাতা থাকলেও তো কিছু হত না। যা দমকা হাওয়া চলছে! ওয়েট না করে ভিজতে ভিজতে চলে এলাম। তাই বলছি, বেরোস না।’

দিঘি ঠোঁট কামড়ে চুপ করে থাকল। বাবা আর পাঁচ মিনিট পরে এলেই হত।

বাবা জলে ভেজা জুতোজোড়া খুলে রাখতে রাখতে বলল, ‘তোর মাকে বল তো একটু আদা দিয়ে চা করতে। আমি স্নান সেরে আসছি।’

‘আমি বলছি।’ দিঘি কিছু বলার আগেই হঠাৎ মহুল বলে উঠল পিছন থেকে, ‘ওকে জাস্ট দশ মিনিটের জন্য যেতে হবে আদির আছে। আমার বিশেষ দরকার। একটা জিনিস আনবে।’

‘আদি? মানে আদিত্য? ওই ব্যানার্জিদের বাড়ি?’ বাবা অবাক হল, ‘কী এমন দরকার এই দুর্যোগে?’

‘আদিদের অফিসের কাজ রয়েছে। ইন্টিরিয়ারের কাল প্রাইস দিতে হবে। ও স্পেসিফিকেশনগুলো নিয়ে এসেছে অফিস থেকে।’

‘ও!’ বাবা বলল, ‘কী যে করিস না তোরা? সবসময় কাজ আর কাজ!’ তারপর দিঘির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সাবধানে যাস।’

দিঘি বলল, ‘বাড়িটা তো এই কোনায়। সাবধানের কী হয়েছে? আমি এখনই আসছি।’

সামনের বাড়ির রোয়াকে ছাতা মাথায় দিয়ে বাচ্চা দুটো এখনও নৌকো ভাসানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু নৌকো কিছুতেই সোজা থাকছে না। বারেবারে কাত হয়ে যাচ্ছে! এত বৃষ্টিতে কি কাগজের নৌকো থাকে? কিন্তু কে বোঝাবে ছেলে দুটোকে? ওরা চেষ্টা করেই যাচ্ছে যে!

পাড়াটা নিঝুম হয়ে আছে একদম। জলে ভেজা ক্লান্ত পায়রার মতো শান্ত হয়ে আছে পথঘাট। হলুদ আলোয় বৃষ্টির রংটাই কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। ছাতাটা বড়। অনেকটা ছড়ানো। সেটা মাথায় দিয়ে কোনওমতে জলের ভেতর ছপছপ করে একটু হেঁটে, একটু দৌড়ে এগিয়ে গেল দিঘি। টেনশন হচ্ছে ওর। বুকটা ঢিপঢিপ করছে। কিন্তু ও জানে, ওকে যেতে হবে। ওই বাড়িটার দরজায় পৌঁছোতে হবে। মনে সাহস আনল দিঘি। ভাবল, আদি যা বলবে বলুক। ও পাত্তা দেবে না। শুধু কিগানের ফোন নম্বরটা পেতে হবে ওকে। যে করেই হোক কিগানের সঙ্গে দেখা করতে হবে।

বেল বাজাতে আদিদের কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দিল।

দিঘি একটু অপ্রস্তুত মুখে বলল, ‘আদিদা আছে?’

‘ছোড়দা?’ মেয়েটা বলল, ‘আছে। আসুন ভেতরে। ছাতাটা এই বারান্দায় মেলে রাখুন।’

‘থ্যাঙ্কস।’ কথাটা বলতে গিয়ে দিঘি বুঝল যে, ওর গলাটা কেঁপে গেল একটু। টেনশন। টেনশন হচ্ছে দিঘির!

‘ছোড়দার ঘরটা…’

‘আমি চিনি,’ দিঘি শেষ করতে দিল না মেয়েটাকে। বলল, ‘আমি যেতে পারি তো?’

মেয়েটা দিঘির মুখ চেনে। তবু কী ভাবল দু’-এক মিনিট। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে।’

বহুদিন পর এ বাড়িতে পা রাখল দিঘি। এই সেই সিঁড়ি। তার ল্যান্ডিং। তাতে বসানো রঙিন কাচ। এই আরও ওপরে তিনতলায় উঠে যাওয়ার সিঁড়ি। আগে আলো জ্বলত ওই ওপরটায়। কিন্তু এখন অন্ধকার। আবছায়া। দেখলে মনেই হয় না ওখানে কেউ ছিল। মনে হয় সমস্ত জীবন অমন অগোচরে, অবহেলায় পড়ে রয়েছে এই তলাটা।

অদ্ভুত এক টান অনুভব করল দিঘি। মনে হল একবার উঠে যায় সিঁড়ি বেয়ে। মনে হল ওপরে গেলেই হয়তো দেখবে লম্বা বারান্দার শেষের ঘরটার পরদা অর্ধেক টানা। শুনবে টুংটাং করে ভেসে আসছে গিটারের শব্দ। এইখানে দাঁড়িয়েও গন্ধের স্মৃতি হঠাৎ যেন ফিরে পেল দিঘি। যেন মনে হল ব্রুট মাস্কের গন্ধে অবশ হয়ে আছে বর্ষার ভারী বাতাস।

আদির ঘরের পরদা উড়ছে। বাড়িটা শুনশান লাগছে বড্ড। কেউ নেই নাকি? দিঘি ঠোঁট চাটল একবার। বুঝতে পারছে না ও কী বলবে! কী করবে! আদির সামনে দাঁড়িয়ে প্রথম কোন কথাটা বলবে! বা আদৌ ও কিছু বলবে কিনা!

দিঘি দরজার পাল্লায় আলতো টোকা দিল, ‘আদিদা, আছ?’

‘কে?’ ঘরের ভেতর থেকে প্রশ্ন করল আদি।

পরদাটা সরিয়ে ঘরের ভেতর এক পা রাখল দিঘি।

‘আরে তুমি?’ আদি চমকে উঠল, ‘বেল বাজিয়ে তুমিই এলে! আমি তো ভাবলাম বাবা-মা ফিরল বোধহয়।’

‘না, আমি এলাম,’ দিঘি নরম গলায় বলল।

‘এসো এসো,’ আদি হাত দিয়ে একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল, ‘বসো।’

দিঘি বসল, তারপর ইতস্তত করে বলল, ‘বিরক্ত করলাম, না?’

‘না,’ আদি হাসল, ‘কোনও কাজ করছিলাম না তো! এই ছবি দেখছিলাম।’

দিঘি দেখল খাটের ওপর ছড়ানো আছে প্রচুর ছবি। আর চেয়ারে বসেও, তার মধ্যে বেশ কয়েকটা যে কিগানের, সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না। ও বলল, ‘আসলে, একটা ইয়ে…’

‘কোনও দরকার ছিল?’ আদি বিছানায় বসল।

দিঘি ঠোঁট কামড়ে মাটির দিকে তাকাল। তারপর বলল, ‘একটা দরকারে এসেছি।’

‘বলো,’ আদি সরাসরি তাকাল দিঘির দিকে।

‘শুনছিলাম তোমার কীসব সমস্যা হয়েছিল। মানে চাপাডাঙায়…’

‘হ্যাঁ,’ আদি বলল, ‘সে একটা গন্ডগোল হয়েছিল। দাদাভাই না থাকলে মারাও যেতে পারতাম। নেহাত দাদাভাই আর কপাল-এই দুটো ফ্যাক্টরের জন্য বেঁচে গেছি।’

‘এখন কেমন আছ?’

‘এখন ভাল,’ আদি হাসল, ‘অফিস করছি তো।’

‘ও,’ দিঘি তাও ইতস্তত করতে লাগল। বলবে? এভাবে বলবে? বলা ঠিক হবে?

কিন্তু না বলেও যে উপায় নেই। আর বেশিদিন এভাবে থাকলে দিঘির ভেতরটা যে ফেটে যাবে একদম। ও যে আর ঠিক থাকতে পারবে না।

দিঘি বলল, ‘আমি জানি যে, কিগানদা চলে গেছে। অনেক দূরে চলে গেছে। আমি কিগানদার মোবাইল নম্বরটা…’

‘দেওয়া যাবে না,’ আদি সহজ গলায় বলল।

‘মানে!’ থতমত খেয়ে গেল দিঘি।

‘মানে,’ আদি হাসল, ‘দেওয়া যাবে না নম্বরটা। দাদাভাইয়ের বারণ আছে।’

‘কিন্তু আমার যে ভীষণ দরকার।’

‘কেন দরকার দিঘি?’ আদি ভুরু কোঁচকাল সামান্য, ‘লোকটা এনাফ হার্ট। আর কষ্ট ডিজার্ভ করে না। ওকে এবার ছেড়ে দাও।’

‘কিন্তু আমি তো…’ দিঘি কাতর গলায় বলল, ‘কষ্ট দিতে চাই না।’

‘তাই?’ আদি বলল, ‘ঘটনা তো অন্য কথা বলে দিঘি। মানুষকে থাপ্পড় মারলে সেটা সহ্য হয় কিন্তু কাউকে দুশ্চরিত্র বলে মানুষের সামনে প্রোজেক্ট করলে সেটা কি মেনে নেওয়া যায়?’

‘আমি ভুল করেছি…ভুল করে…’ দিঘির আবার কান্না পেল হঠাৎ।

‘শোনো দিঘি, কোনও কোনও জিনিস আছে যা ঠিক বা ভুলের ঊর্ধ্বে। তুমি সেটাই করেছ। দাদাভাইয়ের মতো মানুষ, যার গোটা জীবনটা অমন একাকিত্বে ভরা, তাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছ তুমি।’

‘কিন্তু আমি তা চাইনি। এমন রাগ হয়ে গেল যে…’ দিঘির কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।

‘আমি জানি। সেই “জি” লেখা চিঠি। সেই যাজ্ঞসেনীর লেখা চিঠি। নার্সিংহোমে দাদাভাই বলেছে আমায়। “জি” নামে মেয়েটির সঙ্গে দাদাভাইয়ের কলেজ-জীবনে প্রেম ছিল। আর যাজ্ঞসেনীকে দাদাভাই ভালই বাসত না। মেয়েটা একসময় পাগলের মতো প্রেমে পড়েছিল দাদাভাইয়ের। ব্যস, এটুকুই। এমন দুটো চিঠি পুরনো বইয়ের ভেতর ছিল জাস্ট। সেখান থেকে তুমি তিলকে তাল করে দিলে? তারপর ফোন করেও দাদাভাইকে বললে চলে যেতে! এরপর তুমি নম্বর চাইছ? আর কিছু বাকি আছে বলার?’

‘না, তা নয়,’ দিঘি আর্তনাদ করে উঠল, ‘আমার ভুল হয়েছে। মস্ত বড় ভুল হয়েছে। আমি কিগানদাকে একবার দেখতে চাই। একবার ওর কাছে যেতে চাই।’

‘কেন দিঘি? কেন যেতে চাও?’

‘কারণ, কারণ,’ দিঘির শ্বাস দ্রুত হল। জিভ শুকিয়ে এল। কিন্তু আর কিছু বলতে পারল না।

‘জানো, সেদিন নার্সিংহোমে দাদাভাই তোমার কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিল। সারাজীবন এত কষ্ট সহ্য করেছে লোকটা, কিন্তু কোনওদিন কাঁদতে দেখিনি মানুষটাকে। কিন্তু সেদিন দেখলাম কেঁদে ফেলল। কাচের জানলার কাছে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছিল দাদাভাই। দিঘি, তোমার বয়স অল্প। মনও চঞ্চল। কিন্তু জেনো, চোখের জল কিন্তু এমনি এমনি আসে না। আমিও জীবনে ভুল করেছি দিঘি। আমাকেও আমার নিজের ভুল শোধরাতে হবে। আমাকেও পৌঁছোতে হবে তার কাছে। আর যেহেতু ভুল করেছি তাই জানি। দু’দিনের আনন্দ, মজা এক জিনিস, কিন্তু ভালবাসা তা নয়।’

‘আমি জানি আদিদা, তাই…’ দিঘি অনেক চেষ্টা করেও চোখের জলটা আটকাতে পারল না, ‘তাই…নম্বরটা…’

‘দিতে পারব না। প্লিজ, রিকোয়েস্ট কোরো না। কিন্তু,’ আদি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘শোনো, দাদাভাই রাবাংলায় আছে। একটা পার্টিকল্ বোর্ডে চাকরি করে। পারলে, ইচ্ছে হলে খুঁজে নিয়ো।’

‘রাবাংলা? সেখানে, মানে অত বড় জায়গায়…’

‘স্নোফ্লেক্স পার্টিকল্ বোর্ড। ব্যস আর কিচ্ছু বলতে পারব না।’ আদি উঠল, ‘কোঁদো না দিঘি। কেঁদে কী হবে? দাঁড়াও তোমায় জল দিই। তুমি চোখ মোছো।’ আদি পরদা সরিয়ে বেরিয়ে গেল জল আনতে।

দিঘি চোয়াল শক্ত করে সামলাল নিজেকে। রাবাংলা, স্নোফ্লেক্স পার্টিকল্ বোর্ড এই ম্যাপ সম্বল করে কি ও খুঁজে পাবে গুপ্তধন? চট করে দরজাটার দিকে দেখল দিঘি। দ্রুত পায়ে উঠে গিয়ে বিছানার ওপর ছড়ানো ছবির ভেতর থেকে দ্রুত হাতে তুলে নিল কিগানের একটা ছবি। তারপর টি-শার্টের ভেতর ঢুকিয়ে নিল চটপট। ওর কাছে আর কোনও ছবি নেই কিগানের। সব তো ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে রাগ করে!

‘জল খাও,’ আদি এক গ্লাস জল হাতে নিয়ে ঢুকল, ‘আর কান্নাকাটি কোরো না। কী লাভ বলো? দাদাভাইয়ের যা হওয়ার তো হল। সে যা কষ্ট পাওয়ার তা তো পেল। সেটা তো আর বদলাতে পারবে না। ফলে আর ভেবো না ওসব নিয়ে।’

দিঘি উঠে দাঁড়াল এবার। বলল, ‘ফোন নম্বরটা না পাওয়া কি আমার শাস্তির অংশ?’

‘না, সব কিছু অত সহজে পেতে নেই দিঘি। মানুষ সহজে পাওয়া জিনিসের কদর বোঝে না। তোমায় তো দুটো পয়েন্টার দিলাম। ইচ্ছে হলে এটা দেখে খুঁজো।’

‘আমি আসি,’ দিঘি বেরোতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। ঘুরে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, একটা উত্তর দেবে আদিদা?’

‘বলো,’ আদি শান্ত গলায় বলল।

‘কিগানদা নার্সিংহোমে কেঁদেছিল কেন? দুঃখে?’

আদি হাসল। হাত দিয়ে এলোমেলো চুল ঠিক করে বলল, ‘বর্ষাকালে বৃষ্টি হয়, এই এখন যেমন হচ্ছে। কিন্তু তা বলে কি অন্য সময় বৃষ্টি হয় না?’

নৌকোটা কাত হয়ে যাচ্ছে বারবার। ছেলে দুটো তবু ছাড়ছে না। নাছোড়বান্দা হয়ে আঁকড়ে ধরেছে চেষ্টাটাকে। দুটো নৌকো কাগজের গোল্লা হয়ে ভাসছে তো আরও দুটো বানিয়ে আনছে। চেষ্টা করে যাচ্ছে। ছাড়ছে না একদম। নৌকো ভাসাতেই হবে তাদের।

দিঘি ছাতা মাথায় দিয়ে সামনের দিকে তাকাল। বৃষ্টিতে আবছা হয়ে আছে কলকাতা। কিন্তু এই বৃষ্টি ছাড়িয়ে, মেঘ ছাড়িয়ে যদি মানুষ ওপরে ভেসে ওঠে? সেখানে তো পরিষ্কার আকাশ। কালো গহন মহাশূন্য। রাত্রি। সেই রাত্রি চিরে পৃথিবী কোথায় এগোয়? কার দিকে এগোয়? পৃথিবী এগোয় সূর্যের দিকে। আলোর দিকে। সে বারবার তার হেলে পড়া নৌকোকে সোজা করে। সে বারবার অন্ধকার ভেদ করে ছুটে চলে আলোর দিকে। এই রাত্রির কলকাতাকে বুকে নিয়ে এই মুহূর্তে যেমন পৃথিবী ছুটে যাচ্ছে তার ঔজ্জ্বল্যের দিকে।

মানুষকেও তো এভাবেই খুঁজে নিতে হয় তার নিজস্ব আলো। ঠিক করে নিতে হয় তার পরিক্রমণ রেখা। কক্ষপথ।

হলুদ বৃষ্টির তলায় দাঁড়িয়ে দিঘি দেখল একটা নৌকো ভেসে যাচ্ছে। বৃষ্টি তুচ্ছ করে, জলের রাগ তুচ্ছ করে সে ভাসছে, সে যাচ্ছে। দিঘি বুঝল নোঙর তোলার সময় হল ওর। বুঝল এতদিনে ওকে ওর হরিণ ডাকছে। আলোর ডোরাকাটা জঙ্গলের ভেতর ওর জন্যে অপেক্ষা করছে হরিণ। প্রতীক্ষায় অস্থির হয়ে উঠেছে তার শরীর। সে পা দাপাচ্ছে। মাথা নাড়াচ্ছে। তার শরীর চকচক করছে সূর্যের রশ্মিপাতে।

দিঘি বুঝল ওর সমগ্র পৃথিবী ওই আলোর কস্তুরী গন্ধের দিকেই ছুটে চলেছে। প্রাণপণ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *