মুহূর্তরা দু’বছর আগে – ৩৫

৩৫

ঘোলাটে কুয়াশার মশারিতে ঢেকে আছে পাহাড়। মাথার ওপর মেঘ ঝুলে রয়েছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি এসে লাগল মাথায়! এই বুঝি এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে বুক! বিকেল শেষ হচ্ছে এখন। বাংলোর সামনে থেকে পাথর বাঁধানো পথ থাক থাক করে নেমে গেছে নীচে। আর মিশেছে মূল রাস্তার সঙ্গে। এই পাথুরে পথের দু’পাশে ঢালু ঘাসের জমি। তাতে ছোট-বড় নানান অর্কিড আর গাছ লাগানো। তবু পথের দৃশ্য আটকায় না তাতে। কিগান দিব্যি নিজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পায় রাস্তার মানুষজনকে।

এখানে মানুষ বেশ কম। দু’কিলোমিটার নীচে ফ্যাক্টরিটা যেখানে হয়েছে সেখানে তাও মানুষজন আছে। কিন্তু এই অঞ্চলটা প্রায় ফাঁকাই। তবে ভীষণ সুন্দর। কাছেই চা-বাগান আছে একটা। তার কর্মীরাও নীচের বস্তি থেকে আসে।

কোম্পানি থেকে কিগানকে ওই জনবসতিপূর্ণ এলাকাতেই থাকার জন্য বাংলো দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মানুষজনের থেকে আলাদা পাহাড়ের ওপরে এই ছোট্ট বাংলোটাই বেছে নিয়েছে ও। মানুষজন আজকাল আর ভাল লাগে না কিগানের। মনে হয় একা থাকা সবচেয়ে ভাল। তবে জায়গাটা ফাঁকা বলেই বাংলোর পিছনের উঠোনের মতো অংশটায় দাঁড়ালে ওদের ফ্যাক্টরির চিমনিটা দেখা যায়। সব কিছুর মধ্যে এটাই যা বেমানান লাগে ওর।

এই পাহাড়টাকে দেখেই ভালবেসে ফেলেছে কিগান। প্রথমদিন এসেই মন বসে গিয়েছে ওর। আসলে পাহাড় কিগানের খুব পছন্দের জায়গা। কলকাতা থেকে পালিয়ে আসতে, নিজের থেকে পালিয়ে আসতে কতবার যে ও পাহাড়ে এসেছে তার আর কোনও হিসেব নেই। তাই চাকরির প্রস্তাবটায় প্রথমে মনস্থির করতে না পারলেও পরে মনস্থির করেছিল কিগান। কিন্তু কেন পরে মনস্থির করেছিল? সেটা কি শুধু পাহাড়ের জন্যই? অন্য কিছুর জন্য কি নয়? কলকাতায় যা ওকে ধ্বংস করে দিচ্ছিল মনে মনে, তা চাপাডাঙাতে এসে পড়াতেই কি ও এই সিদ্ধান্তটা নেয়নি? দিঘির জন্যই কি ও চলে আসেনি এখানে?

ভদ্রলোকের নাম জিতেন্দ্র তামাং। খুব সুন্দর কথা বলেন। তবে একটু নাটকীয়তা আছে কথায়। কিগান যে-কোম্পানিতে এসেছে তার মালিকের পার্সোনাল অ্যাসিট্যান্ট হচ্ছেন এই ভদ্রলোক। কিন্তু কথাবার্তা শুনে কিগানের মনে হয়েছিল যে, ভদ্রলোক নিশ্চয়ই এককালে স্টেজে কাজ করতেন! তাই অমন নাটকীয়ভাবে দশ মিনিট সময় চেয়েছিলেন।

কিগান ভদ্রলোককে নিয়ে নিজের ঘরে এনে বসিয়েছিল।

তামাং বলেছিলেন, ‘আমি “স্নো ফ্লেকস্ পার্টিকল বোর্ড” থেকে আসছি। রাবাংলায় আমাদের ফ্যাক্টরি। প্রোডাকশন সবে শুরু হয়েছে। তো আমরা আপনাকে আমাদের এজিএম প্রোডাকশনস হিসেবে পেতে চাই।’

‘আমায়?’ খুব অবাক হয়েছিল কিগান।

‘হ্যাঁ, আপনাকে,’ তামাং হেসে বলেছিলেন, ‘মার্চেন্টের চেয়ে অনেক বড় আমাদের গ্রুপ। নানা প্রোডাক্ট আছে। আমরা কোয়ালিটি আর সার্ভিসে বিশ্বাসী। সেখানে কোনও আপস করি না। আমরা চাই আপনি আমাদের হয়ে কাজ করুন। এই নিন আমাদের অফার লেটার। পার অ্যানাম কত পাবেন, গাড়ি, বাংলো সব দেব আমরা। বহু দিন তো প্লেন্স-এ কাজ করলেন, আই উইল অ্যাডভাইস ইউ টু এক্সপ্লোর দ্য মাউনটেন ফর আ চেঞ্জ। লাইফ উইল বি মাচ মোর পিসফুল অ্যান্ড হেল্‌দি আপ দেয়ার।’

কিগান অবাক হয়ে চিঠির খামটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মানে, অফার লেটার? আপনাকে আমার কথা কে বলল?’

‘স্যাম, স্যামুয়েল কুটিনহো। উনি যে নতুন কোম্পানিতে জয়েন করবেন তার মালিক আমার বসের খুব বন্ধু। তো আমরা ওঁর থেকে জানতে চেয়েছিলাম যে, প্রপার কাজের লোক কোথায় পাওয়া যায়। তখন উনি আপনার নাম বললেন।’

‘ও।’ কিগান কী বলবে বুঝতে পারছিল না।

‘কাম, জয়েন আস। ইট উইল বি ওয়ান লাইফ অল্টারিং এক্সপিরিয়েন্স। লেট্স জয়েন হ্যান্ডস অ্যান্ড মেক আওয়ার এন্ডেভার আ সাকসেস।’

তামাংয়ের কথা বলার ভঙ্গি দেখে হাসি পেয়েছিল কিগানের। যেন ‘পৃথিবী বাঁচাও’ আন্দোলন নিয়ে কাজ করছে। তবে কিগান হাসেনি। বরং গম্ভীর হয়ে বলেছিল, ‘দেখুন, এখানে আমি ঠিক আছি। আমার ভাবতে সময় চাই একটু।’

‘মিস্টার কুটিনহো যখন বলেছেন তখন আমরা শিয়োর আপনার পোটেনশিয়াল নিয়ে। তা ছাড়া মার্কেটেও খবর নিয়েছি। ঠিক আছে, আমরা আপনার ডিসিশনের জন্য ওয়েট করব। তবে প্লিজ, যা ডিসাইড করবেন, আমাদের ফেভারে করবেন। আমার বস এখন সাউথ আমেরিকায় আছেন। উনি সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে আসবেন। কলকাতায় অফিস আছে আমাদের। সেখানে আপনি ওঁর সঙ্গে মিট করতে পারবেন। আমাদের বস দারুণ মানুষ। ইট উইল বি আ ফাইন এক্সপিরিয়েন্স ফর ইউ।’

‘আমি ভাবব,’ কিগান উঠে দাঁড়িয়েছিল।

তামাং উঠে দাঁড়িয়ে হেসে বলেছিলেন, ‘মার্ক মাই ওয়ার্ড, হিল উইল রিজুভিনেট ইউ।’

না, ঠিক করতে পারেনি, কিচ্ছু ঠিক করতে পারেনি কিগান। প্রায় দু’সপ্তাহ কিছুই ঠিক করে উঠতে পারেনি। পাহাড়ের কথা শুনে ইচ্ছে করছিল খুব, কিন্তু অদৃশ্য কোনও এক টান আটকে রেখেছিল ওকে। কেন আটকে ছিল কিগান? যে-মানুষ চলে যেতে চায়, তার কাছে চাপাডাঙা আর রাবাংলার ভেতর তফাতটা কোথায়? তা হলে কেন দ্বিধা হয়েছিল ওর যেতে?

বারান্দার পাশে হেলান দিয়ে রাখা গিটারটা তুলল কিগান। এখানে আসার পর এই গিটারটা বের করেছে আজ। রবিবার বলে আজ ছুটি। সারা দুপুর ঘুমিয়েছে কিগান। ওর কাজের ছেলেটির নাম বাবুলাল। উত্তরপ্রদেশের ছেলে। বয়স তেইশ-চব্বিশ। খুব হাসিখুশি। খালি গলায় গানটাও ভাল গায়। তবে ছেলেটার জাদু তার রান্নায়। ঠাকুরমার পরে এত ভাল রান্না আর খায়নি কিগান। ওর তো ভয় হচ্ছে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই না মোটা হয়ে যায় ও!

বাবুলাল এখন দু’কিলোমিটার দূরের শহরে গিয়েছে। রাতে আজ পরোটা করবে। ময়দা আনতে গিয়েছে তাই। কিগান বারণ করেছিল, কিন্তু শোনেনি ছেলেটা। অল্প কয়েকদিনের ভেতরেই কেমন যেন মায়া পড়ে গিয়েছে ওর বাবুলাল মিশিরের ওপর।

মায়া, স্মৃতি, ভালবাসা এসব মানুষের শত্রু। মানুষকে নিশ্চিন্তে, শান্ত মনে থাকতে দেয় না। শুধু মনের মধ্যে কাঁটাঝোপ পোঁতে এরা। বড় বড় পাথর ছড়িয়ে রাখে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের বিষ মিশিয়ে দেয়। মানুষকে অস্থির করে তোলে। মানুষকে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে। এই যে কিগান চলে এসেছে এতটা দূরে কিন্তু তার পরেও কি রেহাই পেয়েছে ও? ওর মন কি রেহাই দিয়েছে ওকে? ওকে কি শান্তি দিয়েছে একটুও? তিষ্ঠোতে দিয়েছে? ক্ষত কি গভীরতর হয়নি ওর? এপ্রিলের সেই ফোন কলটা কি ভুলতে পেরেছে ও?

নিজের অফিসেই বসেছিল কিগান। নতুন প্রজেক্টের ফাইলটা দেখছিল। হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে। একটা ড্রয়িং খোলা ছিল টেবিলে। তার তলায় চাপা পড়ে আর্তনাদ করে উঠেছিল ফোনটা। কিগান দুটো রিং হওয়ার পর বের করেছিল ফোনটাকে। অচেনা নম্বর। কে ফোন করল এখন? অনেক সাপ্লায়ার ফোন করে কিগানকে। তারাই কি কেউ করল? কিগান সামান্য ইতস্তত করে আরও দুটো রিং হওয়ার পর কলটা রিসিভ করে কানে লাগিয়েছিল ফোনটা। কিন্তু ওপার থেকে কথা বলছিল না কেউ। শুধু রাস্তার গাড়ির আওয়াজ পাচ্ছিল কিগান। আর পাচ্ছিল খুব হালকা শ্বাসের শব্দ। কিগান জিজ্ঞেস করেছিল কে ফোন করছে? জিজ্ঞেস করেছিল কেন এমন মাঝে মাঝে ফোন করে? কিন্তু তবু কোনও উত্তর আসছিল না। কিগান চুপ করে গিয়েছিল তারপর। ফোনের ভেতর থেকে আসা রাস্তার হল্লা, গাড়ির হর্নের শব্দ থেকে মনে মনে আলাদা করে নিয়েছিল ওই প্রায় শব্দহীন শ্বাসের ওঠা-পড়ার শব্দ। তারপর আচমকা, একদম আচমকাই অদ্ভুত এক জুঁই-গন্ধ ভেসে এসেছিল কিগানের কাছে। ভেসে এসেছিল অনেক ছোট ছোট মুহূর্ত। নরম ঠোঁটের স্পর্শ। জিভের আস্বাদ। ভেসে এসেছিল ছন্দোময় সেই শ্বাস-ধ্বনির উত্তাপ। কিগান চিনতে পেরেছিল! ও অস্ফুটে বলেছিল, ‘তুমি?’

‘কেন? কেন তুমি এসব করছ?’ দিঘির গলা ছিটকে এসেছিল ফোনের ভেতর থেকে।

‘আমি?’ কিগান অবাক হয়েছিল।

‘মহান হবে? মহান হবে তুমি! সব বিলিয়ে দিচ্ছ, সবার জন্য কাজ করছ, কিন্তু ধন্যবাদটুকু নেবার জন্য দাঁড়াচ্ছ না! নিজেকে সাধু প্রমাণ করতে চাও? আর আমায়? আমায় কী প্রমাণ করতে চাও তুমি? আমি বুঝি না কিছু, না? আমি জানি না কিছু? কেন তুমি আজও যাজ্ঞসেনী না কে তার চিঠি বুক দিয়ে আগলে রাখো? জি নামে তোমায় লেখা কার চিঠি তুমি যত্ন করে ধরে রাখো! আমি তোমার খেলার জিনিস ছিলাম? অন্য মেয়েদের মনে আগলে রেখে তুমি খেলছিলে আমার সঙ্গে? আমি পুতুল? আমি মানুষ নই? আমার কষ্ট হয় না? আমার মন নিয়ে খেলতে কে অধিকার দিয়েছিল তোমায়? লজ্জা করেনি তোমার? আমি সব কিছু তুচ্ছ করে ভালবেসেছিলাম তোমায় আর তুমি অন্য মেয়েদের চিঠি আঁকড়ে ধরে আমার সঙ্গে…আর এখন সাধুগিরি দেখানো হচ্ছে? কেন আসো তুমি আমার সামনে? কেন? কেন চলে যেতে পারো না? এমন জায়গায় যেতে পারো না যেখানে আর কোনওদিন তোমায় দেখতে হবে না আমায়? চলে যাও তুমি। চলে যাও।’

ফোনটা কেটে দেওয়ার পর নিথর হয়ে চেয়ারে বসেছিল কিগান। এসব কী বলল দিঘি? ‘জি’ লেখা চিঠি! জিয়ানার লেখা কলেজ জীবনের প্রেমপত্র? আর যাজ্ঞসেনী আইয়ারের চিঠি? কিগান তো জানেই না সেসব আছে কিনা। ওর তো ধারণা ছিল ও সবক’টাই নষ্ট করে ফেলেছে। তবে কি পুরনো বইয়ের ভাঁজে ছিল? ওর এক আলমারি পুরনো বই ছিল। দিঘি সেসব এসে ঘাঁটাঘাঁটি করত খুব। তার ভেতরেই কি কিছু ছিল? জিয়ানা ওকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তো রাগে দুঃখে জিয়ানার সব স্মৃতি মুছে ফেলে দিয়েছিল কিগান। তবে কি একটা চিঠি বেঁচে ছিল? আর সেটা দেখেই কি…

দিঘি যে পজেসিভ ছিল খুব সেটা জানত কিগান। ওর নিজের বান্ধবীদের ও কখনও কিগানের সামনে আসতে দিত না। একবার ওর এক বান্ধবী কিগানের কাছ থেকে গিটার শিখতে চেয়েছিল বলে দিঘি কেঁদেকেটে একশা করেছিল। রাগ করে সাতদিন কথা বলেনি কিগানের সঙ্গে। আর সেই মেয়ের হাতে যখন দু’-দুটো প্রেমপত্র এসেছিল তখন সে তো অনেক কিছুই করতে পারত!

কিগান পাথরের মতো বসে ছিল। এসব কী মনের ভেতর নিয়ে ঘুরছে দিঘি? কিগান তো কোনওরকম শঠতার আশ্রয় নেয়নি। ও তো বলেছিল জিয়ানার কথা। দিঘিকে তো বলেওছিল যে, জিয়ানার পর আর কাউকে ভালই বাসেনি ও। শুধু দিঘি, কিগান শুধু ভালবাসে দিঘিকে। তবে? চিঠিগুলো দেখে কি দিঘির মনে হয়েছিল যে, আজও কিগান যক্ষের মতো আগলে বসে রয়েছে ধ্বংসস্তূপ? দিঘি কিগানকে বিশ্বাস করেনি একটুও। আর তারপর দিঘি কী বলল ফোনে? চলে যেতে বলল? ওর সামনে থেকে চলে যেতে বলল কিগানকে?

সেই অফিসরুমে বসে কিগান সেদিন স্পষ্ট টের পেয়েছিল কোথায় ওর মনের নোঙর গেঁথে রয়েছে! দিঘি চাপাডাঙায় আসে কখনও সখনও আর তাই ওকে দেখার লোভে চাকরিটা নিচ্ছে না ও। ওর মন এখনও চায় দিঘির কাছে যেতে! ওর চোখ এখনও দেখতে চায় দিঘিকে!

নিজের কাছেই যেন উলঙ্গ হয়ে গিয়েছিল কিগান। নিজের মনের ডিসিপ্লিন, মনের পাঁচিল, মনে হচ্ছিল সব যেন কাগজের তৈরি। সামান্য আগুনেই সব ছারখার হয়ে যাবে পুড়ে। নিজেকে হঠাৎ খুব ছোট মনে হচ্ছিল ওর। দিঘি এখনও এত অপছন্দ করে ওকে? তাই এমন করে চলে যেতে বলল? এমন করে তাড়িয়ে দিল ওর জীবন থেকে? আর কিগানও এতটা লোভী? শুধু দিঘিকে একটু দেখার জন্য ও পড়ে থাকতে চায় এই চাপাডাঙায়? এতটা ভিখিরি ও! এতটা কাঙাল!

ড্রয়ার খুলে একটা লম্বা সাদা খাম বের করেছিল কিগান। তারপর তার ভেতর থেকে বের করে এনেছিল একটা ভিজিটিং কার্ড। জিতেন্দ্র তামাংয়ের।

কাজটা পেতে অসুবিধে হয়নি কিগানের। ও শুধু বলেছিল জুলাই থেকে জয়েন করবে। কারণ, গৌরকে বলতে হবে যে, ও ছেড়ে যাচ্ছে চাপাডাঙা। দু’মাসের নোটিশ তো দিতেই হবে। জিতেন্দ্র তামাং আপত্তি করেননি। বরং বলেছিলেন, ‘আপনাকে ডিপ্রেস্ড শোনাচ্ছে। গ্যারান্টি দিচ্ছি পাহাড় আপনাকে সুস্থ করে তুলবে।’

গৌর দিওয়ান প্রথমে কিগানের মুখে কথাটা শুনে আর ওর চিঠিটা দেখে অবাক হয়ে বলেছিল, ‘ব্রুটাস তু ভি? আরে ইয়ার, তুম লোগ ছোড় কিউ রহে হো সবকে সব?’

‘স্যার, আমার একটু পার্সোনাল প্রবলেম হচ্ছে চাপাডাঙায়,’ কিগান বলেছিল।

‘মাইনে কম লাগছে!’ গৌর জিজ্ঞেস করেছিলেন।

‘না স্যার। মানি ওয়াজ নেভার অ্যান ইস্যু। আমার অন্য সমস্যা আছে। পার্সোনাল।’

কিগানের গলার ভেতর এমন কিছু একটা ছিল যে, গৌর আর বিশেষ কিছু জিজ্ঞেস না করে শুধু বলেছিলেন, ‘প্রোডাকশন পর অসর আয়েগা।’

‘স্যার, মহারাষ্ট্র থেকে তো আপনাদের নতুন লোকজন আসার কথা। আপনাদের ওখানকার ফ্যাক্টরি আর আমাদের ফ্যাক্টরির ওয়ার্কিং প্রিন্সিপ্‌ল তো এক। কোনও প্রবলেম হবে না,’ কিগান বলেছিল।

গৌর বলেছিলেন, ‘তু বস ইস টেন্ডার কো যারা সামহাল লে, ফির যো মর্জি আয়ে কর। ইয়ে মিনেরাল ওয়াটার আর জুস কা প্রজেক্ট পুরা বাম্বু হো গয়া হ্যায় মেরা। স্যাম ভি চলা যায়েগা। ফাইনান্স কা চুহে শালে সমঝতা তো হ্যায় নেহি সির্ফ খুজলি করতা হ্যায়। তু ইয়ে দেখ লিও ফির চলে যানা। ঠিক হ্যায়?’

গৌরের ভাব দেখে কিগান বুঝেছিল যে, গৌর খুব টেনশনে ভুগছে। এমনিতেই গৌরের মুখ আলগা। নিজের সাবঅর্ডিনেটদের সঙ্গে মেঠো ভাষায় কথা বলেন। তবে সেদিন যেন আরও বেশি আলগা হয়ে গিয়েছিলেন। চাপ, কিগান বুঝতে পারছিল যথেষ্ট চাপে রয়েছেন গৌর।

টেন্ডার কমিটিতে থাকা নিয়ে যথেষ্ট অস্বস্তিতে ছিল কিগান। জিয়ানার অমন সরাসরি কাজটা পাইয়ে দেবার প্রস্তাবটা ভাল লাগেনি ওর। আর ওয়াটার বার্ডসের ওই ভদ্রলোকের ঘুষের প্রস্তাবটাও মাথাতে ছিল। আর সব কিছুর গতিপ্রকৃতি দেখে ও বুঝতে পারছিল যে, মূল কম্পিটিশনটা হবে ওয়াটার বার্ডস আর প্রোজেকশন কর্পের ভেতরেই। তাই কাজটা নিয়ে মনে মনে একটু বিব্রত ছিল ও।

তবে পিছিয়ে আসেনি কিগান। ও ভেবেছিল, দেখা যাক কী হয়। আসলে ওর সামনে দুটো সমস্যা ছিল। একটা এই কাজ, আর দ্বিতীয়টা হল জমি। ও ভেতর থেকে খবর পেয়েছিল যে, গৌর নিজে সেফ থাকার জন্য পুরো দোষটা চাপাবে আদির ওপর। বলবে, আদির ইনকমপিটেন্সের জন্য এতদিনেও জমিটা পাওয়া যাচ্ছে না। আর তারপর আদির ওপর কোপ পড়বে। তাই ছোট ভাইটাকে কী করে রক্ষা করা যায় সেটাই প্রথমে চিন্তায় ফেলেছিল কিগানকে। কিন্তু জমি সংক্রান্ত কোনও সমাধান মাথায় আসছিল না ওর। কারণ, গৌরের উদ্ধত ব্যবহারে রাঘব চক্রবর্তী এমন চটে আছেন যে, জমি পাওয়া সহজ নয়। আর ম্যানেজমেন্ট ঘুষ বা অন্য কোনও অতিরিক্ত খরচ করতেও রাজি নয়। তাই কিগান বুঝতে পারছিল না কী করা যায়! তবে সমাধান যে হঠাৎই তার কয়েকদিনের মধ্যে নিজে পায়ে হেঁটে বাড়িতে আসবে, তা বুঝতে পারেনি কিগান।

কফি খেতে ইচ্ছে করছে কিগানের। চা-টা ও খায় না। কফিও খেত না। কিন্তু ইদানীং কফির প্রতি একটা ঝোঁক জন্মেছে ওর।

কিগান উঠল। বৃষ্টি যে নামবে তা বলে দিতে হবে না। এখানে হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি নামে। আচমকা কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে যায় সব। আচমকা আবার পরিষ্কারও হয়ে যায় চারদিক। তবে একটা অদ্ভুত শিরশিরে ঠান্ডা সেলোফেনের মতো জড়িয়ে থাকে শরীরের সঙ্গে। কিগানের খুব ভাল লাগে এই ঠান্ডাটা।

কফিটা করে একটা বড় মগে ঢালল ও। অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। ঠাকুরমা খুব ভাল কফি করত। যদিও খুব সামান্য কয়েকবারই ও খেয়েছে। আর খুব ভাল কফি করত রাহি। একবার জোর করে কিগানকে খাইয়েছিল ও। পাগলি, একদম পাগলি মেয়েটা। তাই তো ওকে সেদিন অমন অবস্থায় দেখে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল কিগান।

সবে মুখটুখ ধুয়ে ঘরে আসছিল, সেই সময়ই অমন উদ্ভ্রান্তের মতো রাহিকে আসতে দেখে কিগান বুঝেছিল বেশ ভালই কিছু গন্ডগোল হয়েছে। তবে কী গন্ডগোল, কোন দিক থেকে গন্ডগোল তা বুঝতে পারেনি।

রাহিকে শান্ত করিয়ে বসিয়ে সময় দিয়েছিল কিগান। আর তারপর শুনেছিল সব কথা।

মানুষ তার একটা জীবনে যে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায়! চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষজনের ভেতরে যে কত বিচিত্র গল্প আর অভিজ্ঞতা লুকিয়ে রয়েছে! যখনই কিগানের মনে হয়েছে জীবনের অনেকটাই দেখে ফেললাম, ঠিক তখনই জীবন ওর সামনে নতুন একটা চ্যাপ্টার খুলে ধরেছে। না হলে, রাহির মতো মেয়ের ভেতরে যে এত গল্প লুকিয়ে রয়েছে তা কি আর কিগান বুঝতে পেরেছিল?

সেদিন সব ঘটনা বলে ঝরঝর করে কাঁদছিল রাহি। অল্প বয়সের উত্তেজনা আর ভুলের মাশুল যে কতভাবে দিতে হয় মানুষকে! কিগান চুপ করে বসে কাঁদতে দিয়েছিল রাহিকে। কারণ, কান্নার মতো মানসিক ক্লেনসিং আর কিচ্ছু হয় না। কিগান বুঝতে পারছিল দীর্ঘদিনের চাপা কষ্ট, উত্তেজনা আর টেনশন জমে রয়েছে রাহির মধ্যে। এগুলো বেরিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এত ভার নিয়ে বাঁচা ভাল নয়।

রাহিকে যা বলার বলে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল কিগান। ওর সারা শরীর জ্বলছিল রাগে। এত নীচ হতে পারে কেউ? মুখে বড় বড় বুলি আউড়ে, বড় বড় কথা বলে তলায় তলায় নোংরামো! একটা অসহায় মেয়েকে টর্চার করা! তাকে ব্ল্যাকমেল করা! ত্রয়ণ যে একটা দু’পেয়ে জানোয়ার তা বুঝতে আর অসুবিধে হয়নি কিগানের। তবে কী করবে ও? কী করতে পারে? কোন অস্ত্রে বধ করা যাবে ত্রয়ণকে? মনে মনে সারাদিন যাবৎ কাজের ফাঁকে ফাঁকে হিসেব করছিল কিগান। ও বুঝতে পারছিল সাংঘাতিক কিছু একটা করতে হবে যাতে কোনওদিন ত্রয়ণ এসব করার আগে দশবার ভাববে তার ফলাফল নিয়ে। কিন্তু কীভাবে? কীভাবে করবে কিগান? এত লোক থাকতে রাহি ভরসা করেছে ওকে। তার একটা মর্যাদা তো রাখতেই হবে। কিন্তু কী উপায়ে?

হঠাৎ অজিতের কথা মনে পড়েছিল কিগানের। আগে বয়লার অপারেটার ছিল ছেলেটা। একবার কিগানের সঙ্গে সামান্য ঠোকাঠুকিও লেগেছিল। কিন্তু পরে ফ্লাই অ্যাশ নিয়ে গ্রামের লোকেদের একটা সমস্যায় কিগানই বাঁচিয়েছিল অজিতকে।

সেই অজিত আর চাকরি করে না এখানে। ব্যাবসা করে। না, সোজা ব্যাবসা নয়। বাঁকা ব্যাবসা। স্মাগলিং-এর জিনিস বিক্রি করে। পাইরেটেড ডিভিডি-র একজন এজেন্ট হিসেবে কাজ করে আর তার সঙ্গে মহাজন আর অটোচালকদের মাঝে কাটা তেলের লিঙ্কম্যান হিসেবেও কাজ করে ও। অজিত এখন আর সেই বয়লার অপারেটরটি নেই। দুটো মোবাইল, গলায় সোনার চেন, আর মোটরবাইক দাবড়ে বেড়ায় চাপাডাঙায়। তবে কিগানের সাহায্য ভোলেনি ও। দেখা হলেই হাসে। বলে, যে-কোনও সোজা দরকার বা বাঁকা দরকারে ওকে যেন বলে কিগান।

কিগান ভেবেছিল অজিতকে কী আর দরকার পড়বে? তাই হেসে এড়িয়ে যেত ছেলেটাকে। কিন্তু সেদিন মনে হয়েছিল অজিতই হয়তো উপযুক্ত মানুষ। রাহি না হয়ে অন্য কারও সমস্যা হলে কিগান সরাসরি চমককে বলত। কিন্তু এ ব্যাপারটা চমক জানতে পারলে ত্রয়ণকে কী করবে তার ঠিক নেই, কিন্তু রাহির কপালে যে দুঃখ আছে সেটা বিলক্ষণ জানত ও।

সেদিন অফিস ছুটির পরে অজিতের দোকানে গিয়েছিল কিগান। রাস্তার পাশে একটা ছোট সিডি-ডিভিডি পার্লার লোক দেখানো হিসেবে আছে অজিতের।

দূর থেকে দোকানের সামনে মোটরবাইকটা দেখে অজিত যে দোকানে আছে সেটা বুঝেছিল কিগান। ও কী বলবে মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিল।

অজিত দোকানে বসে মুড়ি খাচ্ছিল। পাশে অন্য একটা ছেলেও ছিল। কাঁচা পেঁয়াজের হালকা গন্ধ পেয়েছিল কিগান। অজিত কিগানকে দেখে প্রথমে অবাক হলেও পরে খুশি হয়েছিল বেশ। বলেছিল, ‘আরে স্যার, আপনি?’

কিগান বলেছিল, ‘তোমার সঙ্গে আমার একটা ব্যক্তিগত দরকার আছে।’

‘আমার সঙ্গে!’ অজিত অদ্ভুত মুখ করে তাকিয়েছিল কিগানের দিকে। মাথার ওপর ঝোলা প্যাঁচানো সাদা আলোয় হয়তো বোঝার চেষ্টা করছিল কী দরকার থাকতে পারে কিগানের! কিগান ইতস্তত করে পাশে বসা ছেলেটাকে দেখেছিল একবার।

অজিত বুঝতে পেরে বলেছিল, ‘এই ন্যাপলা, যা একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক নিয়ে আয়। তাড়াহুড়ো করবি না। ধীরেসুস্থে যাবি।’

ছেলেটা চলে যেতে অজিত বলেছিল, ‘আপনি স্যার ভেতরে চলে আসুন।’

কিগান মাথা নিচু করে দোকানের ভেতরে গিয়ে বসেছিল। তারপর সংকোচের গলায় বলেছিল, ‘স্যার বোলো না অজিত। আমি তো আর তোমার বস নই।’

‘স্যার, স্যার-ই,’ অজিত হেসেছিল। তারপর বলেছিল, ‘আপনি বলুন কী করতে পারি আপনার জন্য?’

কিগান সময় নিয়েছিল একটু, তারপর বলেছিল, ‘আমার সংকোচ হচ্ছে, কিন্তু উপায় নেই, একটি মেয়ের সম্ভ্রম বিপদে। তাকে উদ্ধার করা দরকার। একটা প্রতিকার করা খুব জরুরি।’

‘মেয়েছেলের কেস!’ অজিত চোখ গোল গোল করে তাকিয়েছিল।

‘একটি ছেলে আমার পরিচিত একটি মেয়ের অশ্লীল ছবি তুলে তাকে ব্ল্যাকমেল করছে। ছেলেটিকে শায়েস্তা করতে হবে,’ কিগান এক নিশ্বাসে বলে দিয়েছিল।

‘অ্যাঁ!’ অজিত থমকেছিল একটু, ‘এ যে খুব বাজে কেস!’

‘কিন্তু কাজটা যে করতেই হবে। নইলে খুব বিপদ হবে যে।’

অজিত হেসেছিল, ‘কে ছেলেটা?’

‘ত্রয়ণ বলে একটা ছেলে আছে। রোগা, চাপ দাড়ি…’

কিগানকে কথা শেষ না করতে দিয়ে অজিত বলেছিল, ‘ওরে শালা, ওই শালা? সে তো খচ্চরের আন্ডিল। আমাদের কাটা তেলের কমিশন খায়। আগে সুধাদির কাছের লোক ছিল, এখন ক্যাঁক খেয়েছে। তা মেয়েটা কে?’

‘সেটা কি জানতেই হবে?’ কিগান ঠোঁট কামড়ে তাকিয়েছিল অজিতের দিকে।

অজিত হেসেছিল, ‘না, স্রেফ কৌতূহল স্যার। পাতি কৌতূহল। তা আপনি কী করতে বলেন আমাকে? শালাটাকে কি মারতে হবে? মানে হাপিস করতে হবে, না দশ-বারোটা ফ্র্যাকচার করলেই কাজ হাসিল হবে?’

‘তা নয় অজিত। ডেডলক মানে জানো?’ কিগান তাকিয়ে ছিল অজিতের দিকে।

‘ডেড মানে তো পটল তোলা। লক মানে তালা। কিন্তু দুটো একসঙ্গে কী হবে জানি না! ডেডলক কেন বলছেন?’

কিগান বলেছিল, ‘দেখো, ব্যাপারটা কতটা সম্ভব আমি জানি না। কিন্তু চেষ্টাটা করতে হবে। মানে ধরো তোমার দিকে কেউ বন্দুক তুলল আর সঙ্গে সঙ্গে তুমিও তার দিকে তাগ করে বন্দুক তুললে। তোমরা কি কেউ কাউকে গুলি করতে পারবে? পারবে অন্যকে মারার চান্স নিতে?’

অজিত ঠোঁট কামড়ে চোখ ছোট করে তাকিয়েছিল মাটির দিকে। তারপর ধীরে ধীরে হাসির রেখা ফুটে উঠেছিল ওর মুখে, ‘স্যার, আপনি আমাদের লাইনে এলে ভাল নাম করতে পারতেন।’

কিগান বলেছিল, ‘ত্রয়ণ এখন বাড়িতেই থাকবে হয়তো।’

‘সে যেখানেই থাকুক, মালটাকে আচমকা তুলব, তারপর ঠিক জায়গায় নিয়ে গিয়ে ল্যাংটো করে ওর কুড়িটা ছবি তুলব, তারপর…’

‘ছবিগুলো আমায় দেবে। আমি কথা বলব ওর সঙ্গে।’

‘আপনি থাকবেন?’ অজিত অবাক হয়েছিল।

‘থাকতে যে হবে। না হলে ওর থেকে ছবিগুলো ফেরত আনবে কে?’

অজিত হেসেছিল, ‘আমাকে একটুও ভরসা নেই স্যার? আমি ছবিগুলো ঠিক বের করে আনব ওর থেকে। আর আপনি কী ভাবছেন, আমি বুঝতে পারি না কার ছবি?’

‘মানে?’ ভীষণ অবাক হয়েছিল কিগান।

‘রাহি বলে মেয়েটার ছবি নিশ্চয়ই। এই অঞ্চলে আপনার ও ছাড়া এমন কোনও মেয়ে পরিচিত নেই যার জন্য আপনি এতটা করবেন। আর ত্রয়ণ মালটা যে ওই মেয়েটার পিছনে ঘোরে সেটা আমরা সবাই জানি। এমন সহজ দুয়ে দুয়ে চার কি খুব কঠিন স্যার? আপনি ভাববেন না, নিখুঁত কাজ হবে। আমি আমার মরা মায়ের নামে দিব্বি দিয়ে বলছি ছবিগুলো দেখব না। আপনার কাছে এনে দেব। এটুকু ভরসা করতে পারেন স্যার।’

কিগান কী বলবে বুঝতে পারছিল না।

অজিত বলেছিল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না স্যার। আমাদের লাইনে প্রচুর খচ্চর সামলাতে হয়। সব খবর রাখতে হয়। আর ত্রয়ণটা তো ভেড়ুয়া। পার্টিতেও ওর অবস্থা খুব খারাপ। বারাসতে আপনাদেরই ওই হাউজিং-এর পিছনে কাঠি করতে গিয়ে পার্টিতে লাথ খেয়েছে। তারপর সুধাদির সঙ্গেও ঝামেলা চলছে। ওর এমনিতে কিছু পেঁচো উঠতি মাস্তান ছাড়া আর কোনও খুঁটি নেই। মালটাকে তুলে নিতে খুব একটা অশান্তি হবে না। শুধু মোবাইল নম্বরটা থাকলে দিন।’

কিগান নম্বরটা নিয়েছিল রাহির থেকে। সেটা দিয়েছিল অজিতকে। বলেছিল, ‘তা কাজটা করতে কীরকম…’

‘আরে স্যার, আপনার থেকে টাকা নেব নাকি? অজিত সামন্তর এখনও এমন অবস্থা হয়নি। যখন খারাপ সময় হবে, আপনার কাছে যাব। যা পারেন তখন হেল্‌প করবেন, কেমন!’

কিগান উঠে পড়েছিল, ‘তা হলে আমি নিশ্চিন্ত হব তো?’

‘হানড্রেড পারসেন্ট। আপনি চাপ নেবেন না। যা চাপ নেওয়ার আমি নিচ্ছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, ওই ছবি কারও হাতে পড়বে না। আমিও দেখব না।’

কিগান দোকান থেকে বেরিয়ে এসে বলেছিল, ‘তোমায় কী বলে যে ধন্যবাদ দেব!’

‘কিছু না বলে দিন স্যার। কিছু বলে দেবেন না। আর যা পাই রাতে আপনার বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসব। কাকপক্ষীতেও টের পাবে না।

প্রায় রাত দেড়টার সময় বাড়িতে এসেছিল অজিত। কোনও হুড়োহুড়ি বা হন্তদন্ত ভাব নয়। বরং ভাবটা এমন যেন তত্ত্বের মিষ্টি দিতে এসেছে। একটা প্লাস্টিকের থলে হাতে দিয়ে বলেছিল, ‘এতে দশটা পানু ডিভিডি আছে। আর দুটো পেন ড্রাইভ। আর ওর কম্পিউটারের হার্ড ডিস্‌কটাও খুলে এনেছি। ঘরে আর কিছু ছিল না, তা ছাড়া ও বলেছে আর কিছু নেই ওর কাছে। তবে স্যার থাকলেও চাপ নেই। এমন সব ছবি তুলেছি না, ওর চোদ্দো গুষ্টি সাহস করবে না কিছু করতে। বলেছি যে, ত্যান্ডাই ম্যান্ডাই করলে পুরো পোস্টার হয়ে যাবে গোটা চাপাডাঙায়। বানচোতটা ভয়ে প্যান্টে মুতে দিয়েছিল। শালা।’ অজিত হাসছিল খুব, ‘স্যার, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। ওকে বলেছি যেন এ তল্লাট থেকে ভাগে। দেখবেন, ও আর এ তল্লাটে থাকবে না।’

অজিত চলে যাওয়ার পর রাহিকে মেসেজ করে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেছিল কিগান। রাহি জানতে চেয়েছিল সব। কিন্তু কিগান বলেনি। শুধু বলেছিল, ‘তুই আর এসব নিয়ে ভাববি না। কোনওদিন একদম ভাববি না।’

কফিটা ভালই হয়েছে। কিগানের বেশ ভাল লাগছে খেতে। বাইরে হঠাৎ গুড়গুড় করে মেঘ ডেকে উঠল। বাবুলালটা কী যে করে! চিন্তা হল কিগানের। ছাতাও নিয়ে যায়নি। ভিজলে নির্ঘাত জ্বর হবে। কিগান ভাবল একবার বারান্দায় গিয়ে দেখে। কিন্তু ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল। বসার জায়গায় কাচের টেবিলটায় রাখা ছিল মোবাইলটা। নম্বরটা নতুন, কলকাতার দু’-তিনজনকে নম্বরটা দিয়েছে কিগান। তার মধ্যে কেউ ফোন করল কি? কিগান কাচের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।

আরে, আদি। স্ক্রিনে নামটা দেখে হাসল কিগান। বহুদিন আগের হারিয়ে যাওয়া ভাইটাকে আবার ফিরে পেয়েছে ও।

ফোনটা ধরে কথা বলতে গিয়ে কেটে গেল হঠাৎ। অবাক হল কিগান। কী ব্যাপার? আদি কি কেটে দিল? নাকি নেটওয়ার্কে গন্ডগোল? ফোন কি করবে কিগান? নাকি অপেক্ষা করবে? আজ রবিবার, আদি কোথায় আছে কে জানে!

ভাবতে ভাবতেই মেসেজ ঢুকল। আদি। লিখেছে একটু পরে ফোন করছে। গৌরের বাড়িতে আছে। অপেক্ষা করছিল। ডাক পড়েছে। কাজ সেরে ফোন করছে।

কিগান হাসল। বুঝল, অপেক্ষা করার সময় ফোন করেছিল আদি। ফোনটা হাতে নিয়েই বারান্দায় গিয়ে বসল কিগান। বেতের চেয়ারের পাশের কফি টেবিলে বড় মগটা আর ফোনটা রাখল। তারপর পা দুটো সামনের কাঠের রেলিং-এ তুলে দিয়ে একটু হেলিয়ে বসল। আদিটা এখন কেমন আছে কে জানে! গুলিটা ভাগ্যিস শরীরে ঢোকেনি। চামড়া ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়েছিল। অবশ্য কাঁধের পেশির ক্ষতি হয়েছে সামান্য।

টাকা মাটি আর মাটি টাকা। ল্যান্ড, জমি, মাটি, যে নামেই ডাকো না কেন এই পৃথিবীতে এটাই সবচেয়ে দুর্মূল্য বস্তু। এর জন্যই নানা অনর্থ হচ্ছে সারা পৃথিবীতে।

রাহি রাঘব চক্রবর্তীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করাবে এই ভরসায় গৌরের কাছে গিয়েছিল কিগান। ও বুঝতে পারছিল জমিটা এবার না পাওয়া গেলে আদির সমস্যা হবে চাকরি বাঁচানো। আর ভবিষ্যতে কেউ জানে না ত্রয়ণও কিছু করবে কিনা। তাই নিজেদেরই যা করার করতে হবে। কারণ, সাবধানের তো মার নেই।

অফিসের ভেতরের খবর কিগান পেয়েছিল যে, খুব চাপে আছে গৌর। বারাসতের প্রজেক্টে হিসেবমতো লাভ পাওয়া যায়নি। এই প্রজেক্টটাও বছর দুয়েক ঝুলে আছে। আর সবটাই গৌরের ক্যাজুয়াল আর প্রাউড অ্যাপ্রোচের জন্য। কিগান জানে যে, গৌরের মতো মানুষেরা নিজেদেরই নিজেরা পাঁচিল দিয়ে ঘিরে রাখে। হয়তো সেটা ভেঙে, নিজের ইগো ডিঙিয়ে ভুলটা রেকটিফাই করতে চায়, কিন্তু কোনও এক অদ্ভুত কারণে নিজের কাছেই তারা বাঁধা পড়ে থাকবে।

কিগান তাই সরাসরি যথাসম্ভব সুর নরম করে, ইগো ড্যামেজ না করে কথা বলেছিল গৌরের সঙ্গে। আদির দিকটা দেখে ও বলেছিল, ‘স্যার, আদি আজ কথা বলছে রাঘব চক্রবর্তীর সঙ্গে, এবার আপনার সঙ্গে সরাসরি বসতে রাজি হয়ে যাবেন বলে মনে হচ্ছে। আপনি স্যার একবার গুড জেশ্চার হিসেবে ওঁর সঙ্গে মিট করুন। ভুলে যান কী হয়েছে। রাজনীতি আর ব্যবসায় কেউ পার্মানেন্ট শত্রু তো আর হয় না। আপনি চলুন স্যার একবার। দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।’

গৌর তাও ইতস্তত করছিল। যেন কোনও ব্যাপারই নয় এমন ভাব দেখিয়ে বলেছিল, ‘আরে ইয়ার, মেরা যানা জরুরি হ্যায় কেয়া?’

‘হ্যাঁ স্যার। গোটা জমির সিক্সটি-সেভেনটি পারসেন্ট পেলেও তো আমাদের কাজ হয়ে যাবে। আপনি একবার চলুন। আপনি বললে আদি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্স করে দেবে। আমি ওখানে থাকি, টেম্পারামেন্ট বুঝি লোকজনের। রাঘব চক্রবর্তী ওই অঞ্চলের বিগ ম্যান। একটা নো উইন সিচ্যুয়েশনে আমরা ফেঁসে আছি। জমিটা আর অন্যভাবে তো পাওয়া গেল না। ম্যানেজমেন্ট তো একটা এক্সট্রা পয়সাও খরচ করেনি বা খরচ করবেও না। আপনি গেলেই স্যার সব মিটমাট হয়ে যাবে।’

গৌর যে নরম হয়ে গিয়েছিল মনে মনে তা বুঝেছিল কিগান। না হলে গৌর কাউকে এতটা কথা একবারে বলতেই দেয় না। তবে কিগান অপেক্ষা করছিল গৌর কী বলে তা শোনার জন্য।

গৌর চিন্তা করার জন্য সময় নিয়েছিল কিছুক্ষণ। তারপর গম্ভীরভাবে বলেছিল, ‘তু ইতনা জিদ কর রাহা হ্যায় তো, চল, ফির মিল হি লেতে হ্যায়।’

কিগান গৌরের চেম্বার থেকে বেরিয়েই রাহির সঙ্গে কথা বলেছিল প্রথমে। আর বুঝেছিল যে, রাঘব চক্রবর্তী মেয়ের কথা ফেলতে পারেননি। সঙ্গে সঙ্গে আদিকে ফোন করে কিগান সংক্ষেপে বলেছিল যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ও যেন গিয়ে রাঘব চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলে গৌরের সঙ্গে মিটিং-এর দিন স্থির করে। কিগান বলেছিল, ‘আদি প্রশ্ন করিস না। কালকেই গিয়ে মিটিংটা ফিক্স কর। আর জানবি যে, তোকে কিন্তু আমি কিছু করতে বলিনি। তুই সবটা নিজে করছিস। কেমন? মনে থাকবে? আমি কিন্তু এসবের মধ্যে নেই।’

গৌর গিয়ে রাঘব চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করার সাতদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিগান বুঝেছিল, রাঘব চক্রবর্তীর মতো মানুষ টাকা বা ক্ষমতার বশ নয়। এদের দরকার ইগো মাসাজ। তবে রাঘব চক্রবর্তী গৌরের কাছে আদির খুব প্রশংসা করেছিলেন। আর তারপর হাওয়ায় হাওয়ায় এই অঞ্চলে খবরও ছড়িয়েছে যে, গোটা ঘটনাটাই ঘটিয়েছে আদি।

মনে মনে আনন্দ পেয়েছিল কিগান। আদির যে জমি শক্ত হল, তাতে নিশ্চিন্ত বোধ করেছিল ও। ভেবেছিল, সামান্য কিছু হলেও তো ও কিছু করতে পারল ভাইটার জন্য। পৃথিবীতে এই একজন রক্তের সম্পর্কের মানুষ আছে, যার জন্য এখনও টান আর ভালবাসা অনুভব করে কিগান। মনে হয় ভাইটা ভাল থাকুক।

সব মিটে যাওয়ার পর হালকা লেগেছিল কিগানের। কিন্তু তখন কি বুঝতে পেরেছিল যে, এমন একটা ভয়ংকর সময় অপেক্ষা করে আছে ওর জন্য?

সামনের পাহাড়ের দিকে তাকাল কিগান। অন্ধকার হয়ে আসছে সব। পাহাড়ের আলো এত দ্রুত পালটায়! তার মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি নামবে যে-কোনও সময়ে। কিগানের মনে হল সেই দিন ঠিক এমনই মেঘ করে এসেছিল না!

বসিরহাটে গিয়েছিল সেদিন কিগান। অফিসেরই কাজ ছিল। ফিরতে সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। বাস থেকে নেমে অফিসের গেটে ঢোকার আগেই হঠাৎ আবেশ প্রায় দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কিগানের গায়ে। হাঁফাতে হাঁফাতে বলেছিল, ‘কিগানদা সর্বনাশ হয়েছে। আদিকে কিছু ছেলে তুলে নিয়ে গেছে তলতাবনির জঙ্গলে।’

‘মানে!’ ছিটকে উঠেছিল কিগান, ‘তোকে কে বলল?’

‘আমি দেখেছি নিজের চোখে। কিন্তু সামনে যেতে পারিনি। সাহস হয়নি। ওরা অনেকে ছিল। অনেকেই ছিল।’

‘কতক্ষণ আগে?’ কিগানের শরীর টানটান হয়ে গিয়েছিল নিমেষে।

‘মিনিট দশেক। আমি কী করব বুঝতে না পেরে চমককে বলেছি। আর তুমি কত দূরে আছ বুঝতে পারিনি বলে ফোন করিনি।’

‘শেষ কোথায় ছিল আদি?’ কিগান প্রশ্ন করেছিল।

‘চায়ের দোকানে লাস্ট বসেছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম দোকানে। তা ছাড়া তো দেখলাম ওরা চ্যাংদোলা করে জঙ্গলে নিয়ে গেল আদিকে,’ আবেশ কাঁচুমাচু করে বলেছিল, ‘আমার আর কী করার ছিল বলো?’

কিগান ফোনটা বের করে চমককে ফোন করতে যাবে ঠিক সেই সময়ই চমক এসে পড়েছিল জিপে করে এক দঙ্গল ছেলে নিয়ে। বলেছিল, ‘পুলিশও আসছে। চলো কিগানদা। আমি জানি কে তুলেছে তোমার ভাইকে। শালা ত্রয়ণ আজ এলাকায় ঢুকেছে। তোমার ভাই বানচোতটার সঙ্গে আশনাই করতে গিয়েছিল আর এখন তোমার ভাইকেই বাম্বু দিচ্ছে। চলো।’

বেশি খুঁজতে হয়নি। ভাঙা চার্চের ভেতরে ওরা হদিশ পেয়েছিল দঙ্গলটার। বহুদিন কোনওরকম মারামারিতে যায়নি কিগান। কিন্তু ও বুঝতে পারছিল এবার একটা অশান্তি হবেই। আর সত্যিই ঝড়ের মতোই যেন ঘটে গিয়েছিল সব।

কিগানরা এগোচ্ছিল সবাই। মেঘলা অন্ধকার, জঙ্গল, গাছ ও ভাঙা চার্চের ফাঁকফোকর দিয়ে ছিটকে আসা হ্যাজাকের হলুদ আলো আর তার ভেতরে পায়ের অস্পষ্ট হুটোপাটির শব্দ। দূরে, আবছা মতো চার্চের ভেতরটা দেখা যাচ্ছিল। একটা ছেলে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সর্বনাশ! এরা যে ভয়ংকর লোক!

আর জঙ্গল মানছিল না কিগান। হাত ছড়ে যাচ্ছিল কাঁটায়, কপাল ঘষটে যাচ্ছিল ডালে, তবু ও প্রায় পৌঁছে গিয়েছিল চার্চের কাছে। আরও পায়ের শব্দ আসছিল। চার্চের ভেতরের ওরাও বুঝতে পারছিল বাইরে কিছু একটা হচ্ছে। তাড়াতাড়ি কাজ সারতে গিয়ে বন্দুক হাতে ছেলেটা খুব দ্রুত বন্দুকটা তুলতে গিয়েও পারেনি। কিগানের পাশের থেকে দুম করে পর পর দুটো শব্দ হয়েছিল। চমক গুলি চালিয়েছে! আর কিগান দৌড়ে চার্চের দরজার কাছে পৌঁছে দেখেছিল ছেলেটা পড়ে আছে মাটিতে। ওর একটু পিছনে চিৎকার করছিল চমক আর ওর দলবল। ভেতরের ছেলেগুলোও গতিক সুবিধের নয় দেখে ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে ত্রয়ণকে দেখেছিল কিগান।

মাটিতে পড়ে যাওয়া বন্দুকটা তুলে ত্রয়ণ তাগ করেছিল চেয়ারে বাঁধা আদির দিকে।

একটা ঘুড়ি ঝুলছিল দূরে। কেটে যাওয়া একটা ঘুড়ি ঝুলছিল। বহু বহু দিন আগে। ধুলো ঢাকা জীবনের তলা থেকে যেন ফুটে উঠেছিল ছবি। ভাই। আদি। কিগান বলেছিল, ‘ভয় পাস না, আমি তো আছি।’

আদি চেয়ারে বসেছিল শক্ত হয়ে, নিথর হয়ে, ভয়ে হলদে হয়ে। কত সেকেন্ড সময় লেগেছিল এসব মনে পড়তে? কত সেকেন্ড সময় লেগেছিল এসব লক্ষ করতে? কিগান জানে না। মনে নেই ওর। শুধু মনে আছে ত্রয়ণের সমান্তরালভাবে তোলা হাত আর ওর নিজের ঝাঁপিয়ে পড়া। তবু গুলি চালানোটা আটকাতে পারেনি কিগান। চমকরা ত্রয়ণকে ধরে ফেলেছিল। আর কিগান হ্যাজাকের আলোয় দেখেছিল চোখ বন্ধ করে চেয়ার সমেত মাটিতে উলটে পড়ে আছে আদি। ওর বাঁ কাঁধ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে।

প্রথমে যতটা ভয় পেয়েছিল কিগান, ততটা ভয়ংকর ছিল না ক্ষত। আদি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল শকে।

পুলিশ তারপর দ্রুত এসেছিল। চমকদের জিপে প্রথমে ওদের বাড়িতে গিয়ে ডাক্তার ডেকে প্রাথমিক চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল আদির। তারপর বারাসত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওকে। আসলে হাসপাতালে পৌঁছোতে ঘণ্টাখানেকের বেশি লেগে যেত। তাই আদির ফাস্ট এডটা বাড়িতেই দেওয়া হয়েছিল।

শক কাটিয়ে নর্মাল অবস্থায় আসতে দু’দিন সময় লেগেছিল আদির। ততদিনে কলকাতার নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওকে। কিগানের স্পষ্ট মনে আছে, সেই বিকেলটায় বৃষ্টি হয়েছিল খুব। কাকু-কাকিমা চলে যাওয়ার পর কিগান ঢুকেছিল আদির ঘরে।

‘দাদাভাই?’ আদি বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে উঠেছিল কিগানকে দেখে।

‘আস্তে। অত দুম করে উঠে বসিস না,’ কিগান একটা টুল নিয়ে ওর বেডের পাশে বসে হেসে বলেছিল।

‘তুই কেমন আছিস?’

‘পাগল ছেলে, তুই কেমন আছিস?’ হেসে পালটা প্রশ্ন করেছিল কিগান।

‘জানিস দাদাভাই,’ আদি বাচ্চাদের মতো গলায় বলেছিল, ‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে।’

‘সে কী রে? ডাক্তারকে বলিসনি?’ আদি অবাক হয়েছিল।

‘না, ওরা কিছু করতে পারবে না। মনে কষ্ট হচ্ছে তো! মালিনী এলে সব ভাল হয়ে যেত!’

‘মালিনী!’ কিগান অবাক হয়ে তাকিয়েছিল আদির দিকে।

আদিকে যেন ভূতে পেয়েছিল। যেন হাজার হাজার বছর কথা বলেনি ও। যেন সমস্ত কিছু ওকে বলে দিতে হবে এই মুহূর্তেই। কিগান আটকায়নি। আদি মাথা নিচু করে অনেক কথা বলেছিল সেদিন। মালিনী থেকে জীবন, ছোটবেলা, কিগান ঘুরে আবার ওর সব কথা মালিনীতে এসেই থেমেছিল। তারপর আদি বলেছিল, ‘মালিনী আমায় ভুল বুঝল দাদাভাই। ভাবল আমি খারাপ আদিই থেকে গিয়েছি। বুঝল না ওকে আমি কত ভালবাসি। ভুল বোঝাবুঝি খুব খারাপ জানিস দাদাভাই। কোনও মানুষ কোনও মানুষকে ঠিক বুঝে সরে গেল, একরকম। কিন্তু কেউ কাউকে ভুল বুঝল আর তারপর চলে গেল, এটা খুব খারাপ। সমস্ত সম্পর্কের ক্ষেত্রেই খারাপ। দেখ না, আমি তোকে ভুল বুঝেছিলাম যাজ্ঞসেনীর ব্যাপারে।’

‘যাজ্ঞসেনী! তুই ভুল বুঝেছিলি? মানে?’ কিগান অবাক হয়েছিল।

আদি নিচু গলায় বলেছিল, ‘আমার ভাল লাগত ওকে। কিন্তু ও তোর জন্য এমন পাগলামি করত! তারপর সেবার বাড়িতে এল। আর আমি দেখলাম ও তোকে সবার সামনে খাইয়ে দিল। তুই কত হেসে হেসে কথা বললি। ওর হাত ধরলি। ওকে পৌঁছে দিলি বাস স্ট্যান্ড অবধি। আর জানিস দাদাভাই আমি দাউদাউ করে পুড়ে গিয়েছিলাম। তোর ওপর রাগ হয়েছিল। ঘেন্না হয়েছিল। তাই সরে এসেছিলাম তোর থেকে।’

‘তুই পাগল!’ কিগান বলেছিল, ‘হ্যাঁ, যাজ্ঞসেনী আমায় প্রোপোজ করেছিল। চিঠি লিখেছিল। কিন্তু আমি ওকে ভালবাসিনি। আমি সেটা বলেও দিয়েছিলাম ওকে। ভাল করে ভদ্র ভাষায় বলে দিয়েছিলাম।’

‘জানি দাদাভাই। এখন জানি,’ আদি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল, ‘আমি বোকা, একগুঁয়ে আর স্বার্থপর। আমার চোখের সামনে পরদা পড়ে ছিল। আর বয়েসটাও তো কম ছিল। তাই বুঝতে পারিনি। কিচ্ছু বুঝতে পারিনি। কিন্তু এখন বুঝি। তোর চলে আসার পর বুঝি। দিঘি তোকে অমন অপমান করার পর তুই যখন চুপ করে থাকিস, তখন বুঝি।’

‘দিঘি!’ চমকে উঠেছিল কিগান। আদি কী বলছে?

‘আমি জানি দাদাভাই। আমি এক পুজোর সকালে তোদের দেখেছিলাম।’

কিগান মাথা নিচু করে বসেছিল। আদি দেখেছিল? আদি জানে! এতদিন ধরে ও সব জানে!

আদি বলেছিল, ‘আমার অন্যায় হয়েছে দাদাভাই। আমি জেনেও কিছু বলিনি। তোর অপমান দেখেও কিছু বলিনি। আসলে রাগ ছিল যে তোর ওপর। হয়তো হিংসেও। তোর মতো ভাল নই যে। নিজের কথা না ভেবে যে তোর মতো অন্যকে সাহায্য করতে পারি না। আর এর সঙ্গে যাজ্ঞসেনীর রাগটা ছিলই। আমার খুব অন্যায় হয়েছে দাদাভাই। সারাজীবন তুই আড়াল করে গেলি আমাকে, আর আমি…এই পাপেই হয়তো মালিনী ভুল বুঝল আমায়। চলে গেল আমায় ছেড়ে।’

কিগান টুল থেকে উঠে আলতো করে হাত দিয়েছিল আদির মাথায়। বলেছিল, ‘শোন না, এসব বাদ দে। মালিনীকে একটা ফোন কর।’

আদি শান্ত গলায় বলেছিল, ‘আমায় তুই একটা কথা বলবি দাদাভাই?’

‘বল না,’ কিগান নরমভাবে বলেছিল।

‘কেন তোকে দিঘি অমন বদনাম করল রে? বলবি আমায়? প্লিজ।’

কিগান বসে পড়েছিল আবার। কেন এসব জানতে চাইছে আদি? কী হবে এসব জেনে? আর কবর খুঁড়ে মৃত সম্পর্ক বের করে লাভ কী?

আদি তবু ছাড়েনি, ‘আমায় বল না দাদাভাই। কাউকে তো বলবি। একবার তো বলবি। আমি জানতে চাই। কী হয়েছিল দাদাভাই?’

কিগান ঠোঁট টিপে বসেছিল। ওর মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই ফোন কল। সেই রাগী গলা। ভুল বোঝার গলা।

কিগান বলেছিল, ‘তুই এত স্ট্রেস নিস না। আর দিঘিটা তো পাগলি একটা।’

‘না দাদাভাই, কথা ঘোরাস না। বল আমায়। বল।’

কিগান টুল থেকে উঠে জানলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ছ’তলার ওপরে ঘর। বাইরে বৃষ্টিতে আবছা কলকাতাকে দেখে মায়ানগর বলে মনে হচ্ছিল কিগানের। মনে হচ্ছিল যেন অচেনা কোনও দেশে এসে পড়েছে ও। বৃষ্টির ঝালর সাজানো রাস্তা। ছোট ছোট খেলনা গাড়ি দিয়ে সাজানো পথঘাট। রঙিন ছাতা মেলা ফুটপাথ। সবাই চলছে। এক বিন্দু থেকে আর-এক বিন্দুর দিকে। এক সম্পর্ক থেকে আর-এক সম্পর্কের দিকে। এত লক্ষ লক্ষ মানুষ। তাদের অগুনতি কষ্ট। আর তার ভিতর কিগান কে? তুচ্ছ, ধুলোর বুকে আঁকা নামের মতো মানুষ। কেন আদি জানতে চাইছে ওর কথা? দিঘির বয়স অল্প। কত সম্ভাবনা পড়ে রয়েছে ওর সামনে। কত ভালবাসার মানুষ চাইবে ওকে। সেখানে কিগান কে? বরং আর কয়েক বছর পর হয়তো দিঘির খারাপ লাগবে। হয়তো একসময়, খণ্ড মুহূর্তের জন্য কিগানের প্রতি এই ভালবাসা ওর মনে লজ্জা জাগাবে। হয়তো হাস্যকর লাগবে কিগানকে। তাই, কী হবে আদিকে এসব বলে!

কিগান বলেছিল, ‘পুরনো কথা ভেবে লাভ আছে? বাদ দে না আদি।’

‘না, বাদ দেব না। জানিস একদিন বিকেলে ওকে আমি দেখেছিলাম। তখন হঠাৎ কী হল, কথা বললাম ওর সঙ্গে। তোর কথা তুললাম ইচ্ছে করে। আর কী দেখলাম জানিস? ওর মুখটা নিমেষে পালটে গেল। যেন অপরাধবোধ, কষ্ট আর রাগ এসে মিশে গেল একসঙ্গে। দাদাভাই আর লুকোস না। বল আমায়। কী হয়েছিল বল।’

ফোনটা একবার রিং হতেই এবার ধরল কিগান, ‘হ্যালো, আদি?’

‘দাদাভাই, গ্রেট নিউজ। আমার প্রোমোশন হয়েছে। আর পি আর গিরি করতে হবে না। এখন আমি মার্কেটিং-এ চলে এসেছি। ব্যাপক ব্যাপার। আমায় পুজোর পরে ওরা জার্মানি পাঠাবে,’ আদি থেমে থেমে কথাগুলো বলল।

খটকা লাগল কিগানের। গ্রেট নিউজ বলছে, এদিকে এমন নির্জীবভাবে কথা বলছে কেন আদি? ও জিজ্ঞেস করল, ‘তোর কী হয়েছে আদি?’

‘আমার?’ আদি একইরকম গলায় বলল, ‘কই, কিছু না তো! রবিবার হলেও আজ অফিস খোলা আছে। জার্মানি থেকে ওঁরা এসেছেন তো। তাই আমাকেও আসতে হয়েছে। তারই ফাঁকে গৌর স্যার বললেন খবরটা। মানে এখনও রিট্ন হাতে পাইনি, তবে সাতদিনের মধ্যে পেয়ে যাব।’

‘তুই খুশি হোসনি?’ কিগান জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ রে হয়েছি,’ আদি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘বাদ দে। আচ্ছা, জিয়ানা বোস তোর নম্বর চাইছিল। দেব?’

‘জিয়ানা!’ আদি হঠাৎ জিয়ানার প্রসঙ্গ তোলায় কিগান থমকাল। তারপর বলল, ‘না, দিস না। আমি যা ফেলে এসেছি পিছনে, তা আর টানতে চাই না। তুই এড়িয়ে যাস। বা না পারলে বলিস আমি বারণ করেছি দিতে। অবশ্য রুহান যদি দিয়ে দেয় তা হলে অন্য ব্যাপার।’

‘আর দিঘিকে? যদি চায়, দেব?’

কিগান হাসল। বলল, ‘ভাল লাগল তোর প্রোমোশনের কথা শুনে। তা তুই মালিনীকে ফোন করেছিলি? তোকে যে বলেছিলাম খবর নিতে।’

‘মালিনী, দিঘি, জিয়ানা, এরা কারা দাদাভাই? কেন আমরা এদের নিয়ে কথা বলি! দাদাভাই, তার চেয়ে চল আমরা আবার আগের মতো হয়ে যাই।’

‘তাই?’ কিগান হাসল, ‘জীবন কি লেড পেনসিলে লেখা খাতা যে, ইচ্ছেমতো ইরেজার দিয়ে মুছে তুই নতুন করে সব শুরু করবি? না, এটা বাচ্চাদের চোর-পুলিশ খেলা যে, আব্বুলিশ দিলেই সব আবার ইচ্ছেমতো শুরু হবে? আমরা কষ্ট পাই, আনন্দ পাই, যা খুশি তাই হোক আমাদের, তবু যারা এসেছে একবার, যারা ছুঁয়েছে একবার তারা তাদের মতো করে বদলও করে দিয়েছে আমাদের জীবনে। আগের মতো কিচ্ছু হয় না রে আদি। তার চেয়ে যা আছে তা মেনে নে। জীবন অনেক সহজ হবে। বুঝেছিস?’

আদি হাসল, ‘জিয়ানা বোসকে তা হলে…’

‘বললাম তো, না। তবে রুহান যদি দিয়ে দেয় তবে… অবশ্য ওকেও নিষেধ করেছি। যাক গে। দেখ আদি, যা ইচ্ছে হয় করিস,’ কিগান কিছুটা হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো করে বলল।

‘ঠিক আছে রে দাদাভাই, পরে আবার কল করব। এখন রাখি।’ আদি কেটে দিল ফোনটা।

জিয়ানা কেন খুঁজছে ওকে জানে কিগান। না, শুধু ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য নয়। শুধু ধন্যবাদ দেওয়ার মতো কাজ তো করেনি কিগান। তবে জিয়ানা পাগলি, ওর যা চাই তা চাই। ওকে সামলানোর ক্ষমতা নেই কিগানের। তাই ওর থেকে দূরে থাকাই ভাল।

আসলে প্রোজেকশন কর্পের কাজটা হয়েছে কিগানের জন্য। বা বলা যায় কিগানই কাজটা পাইয়ে দিয়েছে প্রোজেকশন কর্পকে। তবে না, জিয়ানার জন্য নয়। জিয়ানার কথা চিন্তা করে নয়। ওয়াটার বার্ডসের অপমানের শোধ নিয়েছে কিগান। সারাজীবন মুখ বুজে সব সহ্য করা আর মেনে নেওয়া কিগান ওয়াটার বার্ডসের শেষ দিনের কথাগুলো ভুলতে পারেনি।

প্রাইসের ফাইনাল ওপেনিং-এর ঠিক আগের আগের দিন ছিল সেটা। সন্ধে নাগাদ অফিসের কাজ গুছিয়ে বাড়িতে ফেরার তোড়জোড় শুরু করেছিল কিগান। আর ঠিক তখনই মোবাইলে ফোনটা এসেছিল। নম্বরটা সেভ করা ছিল না বলে প্রথমে একটু ইতস্তত করেছিল কিগান। তারপর ধরেছিল, ‘কে বলছেন?’

‘পুলুদা বলছি,’ ওপাশের গলাটা ভীষণ বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে বলেছিল।

‘পুলুদা? মানে, কাকে চাইছেন?’ কিগান বুঝতে পারেনি।

‘আরে কিগানভাই আপনাকেই চাইছি। আমি পুলক ব্যানার্জি। ওয়াটার বার্ডসের।’

‘ও।’ ভদ্রলোকের ছবিটা হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল কিগানের।

‘তা আমরা কাজটা পাচ্ছি তো?’

‘মানে!’ কিগান অবাক হয়েছিল।

‘আরে, পরশুদিন প্রাইসের ফাইনাল ওপেনিং। আমরা পাচ্ছি তো কাজটা? ফ্ল্যাটের কথাটা মনে আছে তো? কোনও চিন্তা নেই। ওয়ার্ক অর্ডার পাওয়ার সাতদিনের ভেতর আপনি ফ্ল্যাটের চাবি পেয়ে যাবেন।’

‘প্লিজ মিস্টার ব্যানার্জি, এমন বলবেন না। আমি জানি না। আমায় ডিস্টার্ব করবেন না।’

‘মানে?’

‘মানেটা বোঝা কঠিন হল? আর কোন মুখে আপনারা কথা বলেন? গত সপ্তাহে আমি খবর পেয়েছি ভাইজাগে আপনাদের তৈরি করা একটা ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের আরসিসি ট্যাঙ্ক ভেঙে পড়েছে। এখনও গ্যারান্টি পিরিয়ডের চার মাস বাকি আছে। কোন মুখে কাজ চান আপনারা? আপনি লোয়েস্ট হলেও আমি গৌর স্যারকে বলব যাতে আপনাদের সম্বন্ধে একবার চিন্তা করে।’

‘কত নিয়েছেন প্রোজেকশন কর্প থেকে?’ আচমকা পুলক ব্যানার্জির গলার স্বর পালটে গিয়েছিল।

‘কী যা তা বলছেন?’ কিগানও গলাটা শক্ত করেছিল।

‘সব জানি। তবে সুবিধে করতে পারবেন না। আপনাদের ফাইন্যান্সে আমাদের লোক আছে। অত সোজা নয় যে, আপনি ঘুষ নিয়ে কাজ দিয়ে দেবেন।’

‘বাজে কথা বলবেন না মিস্টার ব্যানার্জি।’ আচমকা মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল কিগানের।

‘সত্যি কথা লাগছে বুকে? চাকরি ছাড়ার আগে ভেবেছেন যে, মাল্লু গুছিয়ে কেটে পড়বেন?’

‘রাখছি।’ কিগান ফোনটা কেটে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়েছিল। কত বড় সাহস লোকটার! এমন করে কথা বলছে? ও ঘুষ নিয়েছে? ও মাল্লু কামাতে চাইছে? অপমানে ঘেমে গিয়েছিল কিগান। মনে হচ্ছিল হাতের কাছে পেলে লোকটার জিভ ছিঁড়ে ফেলে।

আর সেই মুহূর্তে, জীবনে প্রথমবার ওর ভেতরে নড়ে উঠেছিল এক সরীসৃপ। মনে হয়েছিল, অনেক হয়েছে! অনেক লাঞ্ছনা, অপমান আর মার সহ্য করতে হয়েছে ওকে। আর নয়। এবার অন্তত একবারের জন্য হলেও ঘুরে দাঁড়ানোর, মারটাকে অন্যদিকে পৌঁছে দেওয়ার সময় এসেছে।

হেড অফিস থেকে প্রাইস আর ডিসকাউন্টের খামগুলো পরের দিন সন্ধেবেলা আসার কথা। আর তা থাকবে কিগানেরই জিম্মায়। কিগান মনে মনে কর্তব্য স্থির করে নিয়েছিল।

পরেরদিন খামগুলো আসতে দেরি হয়েছিল সামান্য। রাত দশটা হয়ে গিয়েছিল। খামগুলো নিজের চেম্বারে রেখে এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করেনি কিগান। রুহানকে ফোন করেছিল সোজা। রুহান অত রাতে কিগানের ফোন পেয়ে ঘাবড়ে গিয়েছিল, ‘তুমি? কী ব্যাপার গো!’

কিগান বলেছিল, ‘তুই কত তাড়াতাড়ি তোদের লেটার হেড, স্ট্যাম্প, খাম আর কোম্পানির সিল নিয়ে আমার কাছে আসতে পারবি?

‘অ্যাঁ? আমি…ইয়ে…কাল…’

‘আজ রাতে। কত তাড়াতাড়ি পারবি? তোদের প্রাইস চেঞ্জ করতে হতে পারে। গোটা প্রাইস ফরম্যাটটা পেন ড্রাইভে করে নিয়ে আর যা যা বললাম সব নিয়ে দুটো ফাঁকা লেটার হেডে সই করিয়ে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব আয়। কাজটা যদি চাস রুহান, তবে শোন-আমি তোদের সুযোগ দিচ্ছি অন্য পার্টির প্রাইস দেখে তোদের প্রাইস কমাতে। এখন প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। আমি ঘরে থাকব। যত দ্রুত পারবি আয়। জিয়ানাকে বাড়িতে গিয়ে আমি যা বললাম বল। দেরি করিস না। দেরি করলে কিন্তু পস্তাবি বলে দিলাম।’

রুহান এমনিতে সরল, একটু কম বোঝে ধরনের হলেও সেদিন কিন্তু বুঝতে ভুল করেনি। বরং রাত পৌনে তিনটে নাগাদ খুরানার নিজস্ব গাড়ি নিয়ে ওর কাছে চলে এসেছিল ঠিক।

খুব সাবধানে ওয়াটার বার্ডসের খামের মুখটা খুলেছিল কিগান। তারপর ওদের প্রাইস আর ডিসকাউন্ট দুটো দেখে নতুন করে প্রিন্ট নিয়েছিল প্রোজেকশন কর্পের পেপারগুলো। কারণ, প্রোজেকশন কর্পের দাম বেশি ছিল। ফলে আবার খাম পালটে নতুন করে সিল করা হয়েছিল প্রোজেকশন কর্পের খামগুলো। তারপর আবার ওয়াটার বার্ডসের খামগুলো খুব সাবধানে বন্ধ করেছিল কিগান। সব করতে প্রায় ভোর চারটে বেজে গিয়েছিল। এর মধ্যে রুহানের মোবাইলে জিয়ানা ফোন করেছিল দু’বার, কিন্তু কিগান ধরেনি। ও দ্রুত মন দিয়ে কাজ সারছিল। আসলে খামগুলো তো বাড়িতে আনার নিয়ম নেই। নেহাত গুরুং বন্ধু মানুষ তাই কিগানের সার্চ হয় না। কিন্তু কিগান জানত সকাল সকাল গিয়ে যদি খামগুলো না রাখে, তা হলে ফাইনান্সের লোকজন চলে আসবে কলকাতা থেকে। তখন ভীষণ বিপত্তি হবে।

সমস্ত কাজ সেরে কিগান আর রুহান পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল কিগানদের ছাদে। শুকতারা জ্বলজ্বল করছে আকাশে। ভোরের আলো ফুটতে বাকি ছিল তখনও। শুধু হাওয়া দিচ্ছিল। খুব হাওয়া দিচ্ছিল। চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল কিগানের।

রুহান জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কেন এমন করলে কিগানদা?’

‘তোদের লাভ হল তো।’ কিগান হেসেছিল সামান্য।

‘তুমি তো এমন…মানে…’ রুহান যেন কী বলবে বোঝাতে পারছিল না।

‘রাম-রাবণের যুদ্ধ, বুঝলি। আত্মার ভেতরেও নিরন্তর রাম-রাবণের যুদ্ধ চলে। আমি জোর করে রাবণকে বেঁধে রাখি। কিন্তু কতদিন আর রাবণকে বেঁধে রাখব, বল? আমিও তো মানুষ। তাই ভাবলাম একবার রাবণটাকে খুলে দিই। দেখ তো, তুই একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলি। জিয়ানার কত বড় লিপ হল। তোরা কাজটাও পাবি। রাবণ তো ভালই কাজ করল।’

‘কিন্তু তুমি? তোমার কী হবে? এটা তো অন্যায় হল কিগানদা। আমি তো চাকরিতে বাধ্য। কিন্তু তুমি তো এসব শুরু না করলেও পারতে। তুমি আমার হিরো যে!’

‘করলাম। আর তুই জেনে গেলি কিগানেরও একটা অন্ধকার দিক আছে। একটা রাক্ষস কিগানের ভেতরেও আছে, যে খারাপ কাজ করে।’

‘জানো, এখানে আসার আগে, কেন জানি না বউদি, মানে জিয়ানাদি কাঁদছিল। বলছিল, তুমি নাকি চিরকাল এমন, এর মানে কী কিগানদা? চিরকাল এমন মানে? তুমি কেমন?’

‘জিয়ানার কথা বাদ দে।’ কিগান দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। তারপর বলেছিল, ‘জানিস, আমার যখন বয়স অনেক কম আমার মা-বাবাকে তখন হারিয়েছি। কিন্তু মাকে শেষ দেখাটুকু আমার আজও মনে আছে। গাড়িতে ওঠার আগে ছাতা সরিয়ে মা ওপর দিকে তাকিয়েছিল। মায়ের সেই হাসিহাসি মুখটা আজকাল খুব দেখতে পাই। আর সেদিন সামনের বিলবোর্ডের নীচে ধূসর রঙের পায়রারা বসেছিল সার দিয়ে। আজকাল মাঝে মাঝে সেই পায়রাগুলোকে স্বপ্নে দেখি, জানিস। কিন্তু তারা সেখানে বসে থাকে না। যতবারই দেখি, দেখি তারা উড়ছে। চক্কর দিচ্ছে। যেন শকুন। পাখিরা কি মৃত্যু টের পায় আগে থেকে? আমি আজকাল আর বিশেষ কিছু ভাবি না, জানিস। মনে হয় জীবন কিছু মুহূর্তের সমষ্টি মাত্র। আরও স্পষ্ট করে বললে কালেকশন অব মোমেন্টারি ট্রুথ্স। আর এ সত্যিগুলোও খুব পরিবর্তনশীল। তাই কালকে যে রাম, আজ সে-ই রাবণ। আর হিরো? মানুষ অল্প সময়ের জন্যই হিরো থাকে। হিরো দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে ভিলেন হয়ে যায়। কাউকে হিরো ভাবিস না, দেখবি, জীবন অনেক সহজ হয়ে যাচ্ছে। আসলে রাতে শান্তিতে ঘুম ছাড়া আর কী চাই আমরা? হিরো আর তার ভক্তদের ঘুম আসে না। তাই সেদিক থেকে দেখলে আমি ভালই করেছি। হিরো কিগানের মৃত্যু হল এই অন্যায় কাজের সঙ্গে। আর হিরো হয়ে থাকতে পারছি না রে আমি। আর বিলবোর্ডের নীচে শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারছি না। আমায় একটু ডানা মেলতে দে ভাই। ঠিক-ভুলের হিসেব ছেড়ে যা ইচ্ছে করছে সেটা একটু করতে দে।’

বাবুলাল ফিরছে না এখনও। সন্ধে এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে পাহাড়ি ঢালের অর্কিড। পাহাড়ে সন্ধে বড় নির্জন। এই নির্জনতাই কি চিরকাল খুঁজেছে কিগান? এই অন্ধকার, মেঘ আর একলা বসে থাকাই কি চেয়েছে ও সারাটা জীবন? জীবন! এটাকে কি আদৌ জীবন বলে! বেঁচে থাকা বলে? কিগান কি একাই হতে চেয়েছিল? নাকি প্রেম একা করে দিয়েছে ওকে? সত্যিকারের প্রেম কি একাই করে দেয় মানুষকে? তার কাছে পৌঁছোতে পারল না বলেই কি একা হয়ে যায় মানুষ?

স্মৃতি আর ঝিঁঝিপোকা নির্জনতায় প্রকট হয়ে ওঠে। আজও হল। কিগান হাসল। বাবুলাল আসছে কিনা দেখার জন্য বাংলোর সামনের রাস্তায় নেমে এসেছিল ও। হাতে গিটারটা ছিল। ওখানে যে-বেঞ্চিটা আছে, সেখানে বসে কিগান জি কর্ড ধরল। তারপর জিসিডি সহজ প্রগরেশনে বাজাতে লাগল আপন মনে।

গিটার ওর ভেতরের নদীটাকে খুলে দেয়। আর তার পাশের পাথরের বাড়ির চিমনি দিয়ে কালো গোল্লা গোল্লা ধোঁয়া বের হয় তখন। আর কিগান দেখতে পায় বাবা ক্যামেরা হাতে ছবি তুলছে মায়ের। নীল গামবুট পরে বসে রয়েছে ছোট্ট কিগান। হাসছে। ওরা সবাই হাসছে।

স্বপ্ন বা কল্পনার কোনও মৃত্যু নেই। কিগান জানে এগুলো কেউ নিতে পারবে না ওর থেকে।

‘বড় মিষ্টি হাত তো তোমার!’

কিগান চমকে উঠে থেমে গেল। সামনে তাকাল। ছাতা হাতে একজন বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে রয়েছেন ওর সামনে। পাহাড়ে যখন-তখন বৃষ্টি নামে, ছাতা এখানকার মানুষের নিত্যসঙ্গী।

কিগান জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি?’

‘আমি একটু বসব?’ ভদ্রলোক বললেন।

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই,’ কিগান হাত দিয়ে সামনের চেয়ারটা দেখাল।

ভদ্রলোক বারান্দায় উঠে বন্ধ ছাতাটা হেলিয়ে রাখলেন দেওয়ালে। তারপর বসে বললেন, ‘পাহাড়ে অনেকে গিটার বাজায়। তবে তোমার হাতটা স্পেশ্যালি মিষ্টি।’

‘থ্যাঙ্কস। আপনি কি গিটার বাজান?’

‘না, এখন আর বাজাই না। এখন ম্যান্ডোলিন বাজাই,’ ভদ্রলোক থামলেন, ‘আমি এখানেই থাকি। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। তোমার বাজনা শুনে লোভ সামলাতে পারলাম না। তুমি ভাই কিছু মনে করলে না তো?’

‘না, না,’ কিগান হাসল। বলল, ‘আমি স্নো ফ্লেকস্-এ জয়েন করেছি নতুন। এখানে থাকি। মানে কিছুদিন হল এসেছি আর কী! আমার নাম কিগান অর্ক ব্যানার্জি।’

‘ইন্টারেস্টিং নেম।’ ভদ্রলোক হাসলেন, ‘তোমার গিটারটা নিতে পারি?’

‘শিয়োর,’ কিগান এগিয়ে দিল।

‘আমি অনেক অনেক আগে গিটার বাজানো ছেড়েছি। তবু চেষ্টা করছি। কলেজ-জীবনে কিটসের একটা চিঠির কয়েকটা লাইনে সুর দিয়েছিলাম। আজ দেখি তোমায় শোনাতে পারি কিনা।’

ভদ্রলোক চোখ বন্ধ করলেন। তারপর ডি-তে ধরলেন-‘I could be martyr’d for my religion. Love is my religion. I could die for that. I could die for you… The pain would be too great. My love is selfish. I can not breathe without you.’

ভদ্রলোক বাজনা থামিয়ে হাসলেন, ‘সেন্টিমেন্টাল, না? কিন্তু জানো কিগান, সত্যিগুলো চিরকালই সেন্টিমেন্টাল হয়। বাই দ্য ওয়ে আমার নামটা বলা হয়নি। আমি ব্রাউন, জোনাথন ব্রাউন। এই সময়টায় আমি কফি খাই একটু। খুব অসুবিধে না হলে, এক কাপ হবে?’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *