মুহূর্তরা দু’বছর আগে – ৩৪

৩৪

হোমির জন্মদিন আজ। ওর বাবা-মা বেশ অনেককে নেমন্তন্ন করেছে। এত বড় মেয়ের জন্মদিন নিয়ে যে এমন হুল্লোড় কেউ করতে পারে সেই নিয়ে হোমিকে খুব রাগিয়েছে রাহি। হোমি লজ্জা পেয়েছে। বলতে চেয়েছে যে, ওর ইচ্ছে নেই একদম। কিন্তু বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে এসব। কিন্তু রাহি জানে তা কিন্তু একদম ঠিক নয়। হোমির বেশ ইচ্ছে আছে। চোরা চাপা ইচ্ছে আর ভাললাগায় হোমি বেশ উজ্জ্বল হয়ে আছে। আর তার কারণ যে শুধু জন্মদিন নয়, তাও জানে ও। এই জন্মদিনের ছুতোয় হোমির বাবার বন্ধুর ছেলের সঙ্গে হোমির দেখা করিয়ে দেওয়াটাও একটা ঘটনা আজ। এটা অবশ্য আগে জানত না রাহি। গতকাল হোমি বলে ফেলেছে। তাও মুখ ফসকে। ছেলেটি গুজরাতে থাকে। ছুটিতে বাড়িতে এসেছে। হোমির বাবা-মা চায় ওদের দেখাশোনা হোক।

গতকাল হোমি যখন এই কথাগুলো বলছিল, মা সামনে ছিল। ব্যস, আর যায় কোথায়? তারপর থেকে পিন আটকে যাওয়া গ্রামাফোনের মতো মা বলে চলেছে, ‘তুই কবে বিয়ে করবি? তুই কবে বিয়ে করবি?’

বিয়ে? বিয়ের কথা ভাবতেই পারে না রাহি। কেন কে জানে! কিন্তু পারে না একদম। এত বছরে, সেই সতেরো-আঠারো বছরের ওই ভুলটুকু বাদ দিলে ওর ভাল লেগেছে কিগানকে। কিন্তু পাশাপাশি এটা বুঝতেও অসুবিধে হয়নি যে, সেই ভাললাগাটার কোনও পরিণতি নেই। শুধু ভাল লাগাটুকুই তার সীমানা। কারণ, প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি কাজের মাধ্যমে কিগান বুঝিয়ে দিয়েছে যে, রাহির জন্য সে নয়। বিয়ে নিয়ে আর তাই ভাবাই হয়নি ওর।

মা তবু ঘ্যানঘ্যান করছিল। বলছিল, ‘মেয়েদের যৌবন, ঘাসের ডগায় শিশির। এই আছে, এই নেই। তোর কি কাউকে পছন্দ? থাকলে বল। আমরা দেখি।’

রাহি একসময়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে বাবার কাছে নালিশ করেছিল। বাবা তখন প্রায় ধমকের সুরে মাকে বলেছিল, ‘তখন থেকে এক কথা বলছ কেন বারবার? মেয়ে কি জলে পড়ে রয়েছে? ওর যখন ইচ্ছে বিয়ে করবে। তাতে যার সমস্যা হবে সে এসে আমায় বলুক।’

তারপর থেকে মায়ের মুখ বন্ধ হয়েছে। কিন্তু মুখের মেঘ সরেনি একটুও। সারা সকাল থেকে দুপুর, আর এই বিকেল পর্যন্ত হাতে গুনে দশটা কথাও বলেনি ঠিকমতো। না, রাগ হয়নি রাহির। মা একটু এমনই। রাগ করলে দু’-একদিন কথা বন্ধ করে ভাববাচ্যে চলে যায়, তারপর আবার ঠিক ফিরে আসে। রাহি জানে কাল সকাল থেকে ঠিক হয়ে যাবে সব।

রাহি শাড়িটা দেখে নিল একবার। তাঁতের শাড়ি। একটু ভারী। পানিফলের ভেতরটার মতো রং, তার ওপর ঘন সবুজ পাড় আর তাতে জরির কাজ করা। বাবা যখন বাংলাদেশ গিয়েছিল নিয়ে এসেছে। মা রাগ করেছিল এমন সাদাটে রং দেখে। কিন্তু রাহির পছন্দ হয়েছে। হালকা রং ওর খুব পছন্দ।

শাড়িটা পরে বড় আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল রাহি। তারপর আয়নার পাল্লা খুলে সবুজ রঙের টিপ বের করে দুই ভুরুর মাঝে বসিয়ে দিল। এবার আইলাইনার।

আজ সাজতে ইচ্ছে করছে রাহির। না, হোমির জন্মদিনের জন্য নয়। আজ সাজতে ইচ্ছে করছে, কারণ ও জানে না আজকের পরে আর কোনওদিন ও দেখতে পাবে কিনা কিগানকে।

এতক্ষণে প্যাকিং হয়ে গেছে কিগানের। পাঁচটা নাগাদ গাড়ি আসবে। মালপত্তর চাপিয়ে বেরিয়ে যাবে ও। ট্রেনে গেলেই হয়তো সুবিধে হত। কিন্তু লটবহর নিয়ে এই বনগাঁ লাইনের ট্রেনে যাওয়াটা সমস্যার। তাই অফিস থেকে গাড়ির বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়েছে।

গত পরশুদিন প্রথম জানতে পেরেছিল রাহি যে, কিগান চলে যাচ্ছে। প্রথমে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু দাদা বলেছিল, ‘আমায় কিগানদা নিজে বলেছে।’

‘মানে?’ রাহির অবাক লেগেছিল খুব, ‘আমায় তো বলেনি!’

‘কাউকেই বলেনি। আমাকেও বলত না, নেহাত শশীবাবু কোম্পানির মানুষ, ওকে ইনস্ট্রাকশন দিতে গিয়ে বলে ফেলেছে যে, চলে যাচ্ছে কিগানদা!’

‘কেন যাচ্ছে? এত কিছুর পর কেন চলে যাচ্ছে কিগানদা?’ রাহির মনের ভেতরটা উলটোপালটা হয়ে যাচ্ছিল। অদ্ভুত শূন্যতা এসে ছড়িয়ে পড়ছিল শরীরে। মনে হচ্ছিল ভেতরটা কেমন যেন ভারী হয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন ঝিঁঝি ডাকছে শরীরে।

চমক বলেছিল, ‘জানিসই তো মানুষটা কেমন। কিছু কি বলে? কিচ্ছু বলে না। আমি অনেক পীড়াপীড়ি করার পর বলল যে, নতুন চাকরি পেয়েছে। তাই যাচ্ছে। কে জানে! হয়তো মাইনে বেশি দিচ্ছে!’

চমক আর দাঁড়ায়নি। চলে গিয়েছিল। কিন্তু রাহির মন থেকে খুঁতখুঁতানি যায়নি। টাকা বেশি বলে চলে যাচ্ছে কিগান? শুধু টাকা বেশি বলে! এমন হয় নাকি? ও বিশ্বাসই করতে পারেনি। তাই সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে ধরেছিল কিগানকে।

‘হ্যালো? বল,’ চারবার রিং হওয়ার পর ফোনটা ধরেছিল কিগান।

‘তুমি চলে যাচ্ছ?’ রাহি সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিল।

কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধতা। তারপর কিগান বলেছিল, ‘হ্যাঁ রে। চলে যাচ্ছি।’

‘আমায় বলোনি তো?’ রাহির গলার ভেতর কষ্ট হচ্ছিল।

‘কাউকে বলিনি। আসলে হঠাৎ ঠিক হল তো!’

‘হঠাৎ ঠিক হল! মিথ্যে কথা বলছ কেন?’ রাহির কষ্টটা রাগ হয়ে বেরোচ্ছিল এবার।

‘খুব রেগে গেছিস, না?’ কিগান হেসেছিল।

‘আমি কেন রাগব? আমি কে যে, রাগ করব?’

‘শোন, আমায় যেতেই হত যে। আমায় যেতেই হবে। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা, এভাবেই সারা জীবনটা কাটবে আমার। থিতু হওয়া আমার ধাতে নেই।’

‘আবার বাজে কথা! ভীষণ বাজে কথা বলছ তুমি। একদম এসব বলবে না।’

কিগান হেসেছিল, ‘ওরা টাকাটাও ভাল দেবে বলছে।’

‘আমায় বিশ্বাস করতে হবে এটা?’ রাহি বিরক্ত গলায় বলেছিল।

‘আচ্ছা, আমার টাকার দরকার নেই ভেবেছিস?’

‘বাজে কথা বোলো না। কেন যাচ্ছ তুমি?’

কিগান বলেছিল, ‘সবাইকেই যেতে হয় রে পাগলি। চলে যেতে সবাইকেই হয়। কারওটা চোখে দেখা যায়, কারওটা যায় না।’

‘রাখো তোমার ফিলোজফি। কাল যাচ্ছি তোমার ওখানে। মজা দেখাচ্ছি তোমায়।’

আবার হেসেছিল কিগান, ‘কাল সকাল সকাল আমি কলকাতায় চলে যাব। অফিশিয়াল কাজকম্ম আছে কিছু। তারপর একটু দেখা করব আদির সঙ্গে। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। পরশু দিন আসিস।’ কিগান আর কোনও সুযোগ না দিয়ে কেটে দিয়েছিল ফোনটা।

আজ সেই দিন। সকালে স্কুল ছিল রাহির। যেতে পারেনি। তাই এখন যাবে।

রাহি ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করল, ‘মা।’

মা এল না, কিন্তু দীপা এল দৌড়ে, ‘কী হয়েছে?’

‘টিফিন বক্সটা তৈরি আছে?’ রাহি জিজ্ঞেস করল।

‘টিফিন বক্স!’ দীপা ধরতে পারল না ঠিক।

‘আরে কিগানদার খাবারটা। ট্রেনে করে যাবে, রাত্রে কী খাবে? মাকে বলেছিলাম।’ রাহি অধৈর্য গলায় বলল।

‘ও আচ্ছা,’ দীপা ঠোঁট কামড়াল, ‘আসলে তোর দাদার শরীরটা এত খারাপ হয়েছে যে, আমি ভুলে গেছিলাম রে।’

‘দাদার? দুপুরে তো বললি জ্বর কমেছে,’ রাহি অবাক হল।

গতকাল রাত থেকে হঠাৎ জ্বর এসেছে চমকের। অনেক জ্বর। সকালে ডাক্তারও এসেছিল বাড়িতে। ওষুধ খেয়ে দুপুরে জ্বর কমেছিল। কিন্তু আবার কী হল সেটা ঠিক বুঝতে পারল না রাহি।

‘আর বলিস না। সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। অমন মানুষ যন্ত্রণার চোটে কেঁদে ফেলেছে পর্যন্ত। মা বসে আছে ওখানে।’

‘আর আমায় একটা খবর দিসনি!’ রাগ হল রাহির।

‘আরে ডাক্তারকাকুকে ফোন করেছিলাম। ওষুধ বলেছেন। খাইয়েওছি, কমতে সময় লাগবে। তবে কমবে।’ দীপা রাহির হাতটা আলতো করে ধরল, ‘তা ছাড়া তুই বেরোবি। কিগানদা চলে যাচ্ছে। তাই আর ডাকিনি তোকে।’

‘কী যে করিস না!’ রাহি রাগ করে দীপার হাতটা সরিয়ে দিল। তারপর জোর পায়ে হেঁটে গেল দীপাদের ঘরের দিকে। দীপাও পিছন পিছন হাঁটা লাগাল।

কিন্তু ঘরের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াল রাহি। মা না দাদার ঘরে ছিল? রাহি দেখল চমকের ঘরের বাইরে কাচের টানা দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মা। তা হলে মা কী করছে দরজার বাইরে?

‘মা তুমি এখানে? দাদা একা রয়েছে নাকি ঘরে?’ রাহি অবাক হল।

‘না,’ মায়ের গলার সারা দিনের কাঠিন্য যেন আর নেই। মা বলল, ‘তোর বাবা আছে দাদার কাছে।’

‘বাবা!’ রাহির সঙ্গে সঙ্গে দীপাও অবাক হয়ে তাকাল। বাবা কী করছে চমকের ঘরে?

‘হ্যাঁ, চমকের জ্বর বেড়েছিল। আমি জলপট্টি দিচ্ছিলাম। তখন ঘোরের মধ্যে “বাবা বাবা” করে ডাকছিল ছেলেটা। ভাবলাম ওঁকে একবার ডেকে আনি। আজ তো কাজে বেরোয়নি। ডাকতে যাব বলে উঠেছি, দেখি তোর বাবা স্লাইডিং দরজাটা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেখি ছেলের ওই অবস্থা দেখে চোখ ছলছল করছে।’

‘বাবা!’ দীপা যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না।

মা কিছু বলার আগেই রাহি এগিয়ে গিয়ে স্লাইডিং পাল্লাটা ফাঁক করল সামান্য আর দেখল বাবা বসে রয়েছে বিছানায়। এক হাতে জলপট্টির কাপড়। অন্য হাত বুলিয়ে দিচ্ছে চমকের মাথার চুলে। আর চমক শান্ত হয়ে শুয়ে রয়েছে।

রাহি অবাক হয়ে দেখল দৃশ্যটা। দাদার তো বাবার সঙ্গে কথাই হয় না প্রায়। দু’জন তো সামনাসামনিই হয় না ঠিকমতো বহু বছর। যেন বোঝে অশান্তি লাগবে, তাই দু’জনেই দু’জনকে এড়িয়ে যায়। আর আজ জ্বরের ঘোরে বাবাকে খুঁজছে দাদা! আর বাবা এসে বসে রয়েছে দাদার কাছে! তা হলে? তা হলে সত্যি কোনটা? ঝগড়াটা না ভালবাসাটা? তবে কি সমস্ত বিভাজন আর বৈরিতার তলায় তলায় জল ঠিক জলের কাছেই পৌঁছোয়? ভালবাসা ঠিক ফুল হয়ে ফুটে ওঠে নির্দিষ্ট আবহাওয়ায়? মত, বিরুদ্ধ মতের বাইরে দাঁড়িয়ে কি মানুষ তা হলে ঠিক খুঁজে পায় তার সরল স্নেহ? বুঝতে পারে এই স্পর্শটুকুই সত্যি, বাকিটা ভান মাত্র, অভিনয় মাত্র?

রাহি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর প্রায় নিঃশব্দে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল। কে জানে এর পর যখন চমক সুস্থ হয়ে উঠবে তখন আবার বাবার সঙ্গে কেমন সম্পর্ক হবে! কে জানে তখন আবার দু’জনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যাবে কিনা।

যা খুশি হোক, যেমন খুশি হোক, তা বলে এই মুহূর্তটা তো আর মিথ্যে হয়ে যায় না। এই দৃশ্যটা তো আর মিথ্যে হয়ে যায় না। রাহি যেন বুঝল ভবিষ্যতে খারাপ হতে পারে ভেবে, মানুষ কত না সম্পর্কের থেকে পিছিয়ে আসে! কষ্ট পেতে পারে ভেবে সে কত না ভালবাসা হারায়। রাহি যেন বুঝতে পারল জীবনে হাতের কাছে এসে বসে থাকা মুহূর্তকে অবজ্ঞা করার মতো বোকামো আর কিছুই হয় না।

মা নরম গলায় বলল, ‘তোর বাবা যে চমককে কতটা ভালবাসে, ছেলেটা বুঝলই না।’

রাহি মায়ের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘সময় চলে গেছে মা? ঠিক বুঝবে, দেখো। আর দাদাও তো খুব ভালবাসে বাবাকে। না হলে কেউ জ্বরের ঘোরে অমন করে নাম ডাকে?’

‘কী জানি!’ মা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘বুঝি না রে।’

রাহি হাসল, ‘কী হবে অত বুঝে? শুধু এই দৃশ্যটা দেখো।’

মা বলল, ‘তুই যা। ওদিকে ছেলেটার যাওয়ার সময় হল।’ তারপর দীপাকে বলল, ‘খাওয়ার টেবিলে টিফিন বক্সটা রাখা আছে, ওটা দিয়ে দাও রাহিকে।’

‘মা, আমি যাব? দাদা…’ রাহি ইতস্তত করল।

‘ওষুধ পড়েছে। দেখলি তো শান্ত হয়েছে এখন চমক। এখানে তোর কী কাজ? তুই থাকলে কি আর জ্বর আসবে না?’

‘তা হলে আমি কিগানদাকে এটা দিয়েই চলে আসছি।’

‘না,’ মা জোর গলায় বলল, ‘হোমি নিজে এসে বলেছে তোকে। ওর বাবা-মা এসে বলেছেন আমাদের। সেখানে আমরা যেতে পারছি না কেউ। তুই অবশ্যই যাবি।’

রাহি একবার দীপার দিকে তাকাল। মনে হল, দীপার তো খারাপ লাগতেই পারে।

দীপা হাসল, ‘যা তাড়াতাড়ি। কিগানদা না হলে বেরিয়ে যাবে। আর হোমির ওখান থেকে এসে বলবি ওর হবু বর কেমন হল। বুঝেছিস?’

জুনের তিরিশ তারিখ আজ। এবার বৃষ্টি হচ্ছে না বিশেষ। শুনছে নর্থ বেঙ্গলে বৃষ্টি হচ্ছে বেশ। কিন্তু সাউথ বেঙ্গল শুকনো।

পথে বেরিয়ে হাওয়ায় গরম ভাপ টের পেল রাহি। বাড়িতে এসি আছে বলে বোঝা যায় না যে, কতটা তেতে আছে পথঘাট। রাহি টিফিন বক্সটা নিয়ে গেটের দিকে এগোল। দেখল পুকুরে সাধুদা স্নান করছে।

আজকাল হঠাৎ ভগবানে ভক্তি হয়েছে সাধুদার। কণ্ঠি নিয়েছে। বিকেলের এই সময়টায় স্নান করে জপ করতে বসে। তারপর আবার লেগে যায় কাজে। সাধুদা রাহিকে দেখে হাত তুলল, ‘একা একা যাচ্ছ কোথায়?’

‘কিগানদার বাড়িতে যাব।’ রাহি পুকুরের দিকে এগিয়ে গেল।

‘একা যাচ্ছ নাকি?’ সাধুদা তাড়াতাড়ি ঘাটের দিকে এগিয়ে এল।

‘হ্যাঁ, কেন?’ অবাক হল রাহি।

‘তোমায় বলেছি না সন্ধের পর একা বেরোবে না? এত বড় কাণ্ড ঘটে গেল আর তুমি…দাঁড়াও আমি যাচ্ছি।’ সাধুদা উঠে এল পুকুর থেকে।

‘সাধুদা!’ রাহি ছদ্ম রাগ দেখাল, ‘কী হবে আমার? তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?’

‘আরে, ভয় পাচ্ছ মানে? ভুলে গেলে কী হয়েছে?’ সাধুদা পরনের ধুতিটার নীচের অংশটা নিংড়ে এগিয়ে গেল পুকুর পাড়ের শেডটার দিকে।

‘আশ্চর্য!?’ রাহি এবার সত্যি রাগ করল, ‘কিচ্ছু হবে না আমার।’

‘সে তুমি জানলে কী করে? ওই জানোয়ারটা কী বলেছে তোমায় বলিনি?’

রাহি চুপ করে গেল। প্রসঙ্গটা ভীষণ অপ্রিয়। কিন্তু সত্যি।

সাধুদা বলল, ‘তুমি দু’মিনিট দাঁড়াও, আমি আসছি। একা তুমি এমন সময় বেরোবে না। শয়তানটা নেই, কিন্তু ওর চেলাচামুণ্ডাগুলো তো থাকতেই পারে। মানুষকে বিশ্বাস করি না। মানুষ যখন-তখন যা-খুশি তাই করতে পারে। তুমি দাঁড়াও একটু।’

সাধুদা যেভাবে দুদ্দাড় করে চলে গেল, সেই দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাহি। এই যে সবাই ওর জন্য দুশ্চিন্তা করে এসব তো হতই না যদি ও একটু সতর্ক হত।

রাহি মাঝে মাঝে ভাবে, জীবনটা যেন দাবা খেলার বোর্ড। এক-একটা ঘটনার গুরুত্ব, পরে কী সাংঘাতিকভাবে বোঝা যায়! সেই আঠারো বছর বয়সে কি ও বুঝতে পেরেছিল এক দিনের একটা ভুলের কত বড় মাশুল দিতে হবে ওকে!

হিস্ট্রির স্যার ছিলেন তিনি। লম্বা, গম্ভীর, চুপচাপ। একা থাকতেন। বিয়ে করেননি। উত্তরবঙ্গের এক ছোট্ট শহরে বাবা-মা থাকত স্যারের। অলক মাস্টারের নাম চাপাডাঙায় অল্পদিনেই ছড়িয়ে পড়েছিল। ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ বছরের মানুষটার ব্যবহারও ছিল খুব ভাল। ক্লাস টুয়েলভের মাঝামাঝি স্যারের কাছে পড়ার জন্য ভরতি হয়েছিল রাহি। স্যার প্রথমে নিতে চাননি। কিন্তু রাঘব চক্রবর্তীর মেয়ে শুনে নিমরাজি হয়েছিলেন। তবে রাহি দেখত স্যার কেমন যেন আড় হয়ে থাকতেন। ভাল করে কথা বলতেন না ওর সঙ্গে। পান থেকে চুন খসলে বেশ বকাবকি করতেন। রাহিকে কঠিন কঠিন প্রশ্ন করতেন আর সুযোগ পেলেই এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন যে, রাহি ভাল ছাত্রী নয়। হয়তো জোর করে পড়াতে হচ্ছে বলে এমন হয়ে ছিলেন স্যার।

মাস দেড়েক পরে রাহিরও যেন কেমন রোখ চেপে গিয়েছিল। স্যার আমায় পাত্তা দেন না? সবার সামনে অপমান করেন? আমায় ছোট করার চেষ্টা করেন? দাঁড়াও, আমিও দেখিয়ে ছাড়ব।

অন্যান্য সব সাবজেক্টের চেয়ে হিস্ট্রিতে সবচেয়ে বেশি সময় দিতে শুরু করেছিল রাহি। পাগলের মতো খুঁটিয়ে টেক্সট পড়তে শুরু করেছিল। কোশ্চেন আনসার লিখতে শুরু করেছিল। কিন্তু তবু, স্যারও কঠিন থেকে কঠিনতর প্রশ্ন রাখতে শুরু করেছিলেন ওর সামনে। মাস দুয়েক পরে ব্যাপারটা যেন ডুয়েল হয়ে উঠেছিল। স্যার রাহিকে প্রশ্ন করে বিপদে ফেলবেন আর রাহি স্যারের যাবতীয় চেষ্টা পণ্ড করে দেবে! তারপর একদিন স্যার পরীক্ষা নিলেন।

প্রচণ্ড পড়াশোনো করে পরীক্ষা দিয়েছিল রাহি। মাথা গুঁজে গোটা সময়টা মন দিয়ে লিখেছিল শয়ে শয়ে বছর আগেকার রাজনীতি আর অর্থনীতির কথা। তারপর লেখা শেষ করে খাতা জমা দিয়ে ভীষণ আনন্দ হয়েছিল ওর। কারণ, ও জানত খুব ভাল পরীক্ষা দিয়েছে।

এরপর পুজো এসে যাওয়ায় পড়ানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। স্যারও চলে গিয়েছিলেন নিজের বাড়ি। রাহিরাও চলে গিয়েছিল ঘুরতে, কুলু-মানালি।

ঘুরে টুরে চাপাডাঙায় ফিরে এক বান্ধবীর বাড়িতে ফোন করেছিল রাহি। কারণ, পড়া তো শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। আর অন্য সব পড়া বাদ দিয়ে রাহির বিশেষভাবে জানতে ইচ্ছে করেছিল ইতিহাসের যে-পরীক্ষা দিয়েছিল তাতে কী নম্বর পেল ও? কিন্তু বান্ধবীটির উত্তর শুনে আগুন জ্বলে গিয়েছিল মাথায়। স্যার সবার নম্বর বলেছেন কিন্তু রাহিরটা বলেননি। কারণ, রাহির খাতা নাকি হারিয়ে ফেলেছেন স্যার!

খাতা হারিয়ে ফেলেছেন! মামদোবাজি! এতদিন নানাভাবে জব্দ করার চেষ্টা করেছেন, সবার সামনে অপমান করেছেন আর আজ যখন ভাল পরীক্ষা দিয়েছে, যখন সবার সামনে প্রমাণ হয়ে যাবে যে, রাহি আসলে কত ভাল হিস্ট্রিতে, তখনই খাতা হারিয়ে ফেলেছেন! আজ স্যারেরই একদিন কী আমার একদিন। ফোনটা রেখে দৌড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল রাহি। স্যার ভেবেছেনটা কী যে, যা খুশি করবেন আর সবাই মেনে নেবে? কোন লাটসাহেব স্যার যে, সবসময় এমন রুড ব্যবহার করবেন?

দৌড়ে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল রাহি। মাথার আগুন পায়েও পৌঁছেছিল বোধহয়, না হলে অত জোরে কোনওদিন সাইকেল চালায়নি ও।

স্যারের পড়ানো ছিল না সেদিন। রাহি কোনওমতে সাইকেলটা রেখে পাগলের মতো ডোরবেল বাজিয়েছিল। একটু পরে দরজাটা স্যার নিজেই খুলেছিলেন, ‘তুমি!’

ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন স্যার।

‘আমার খাতা কই?’ স্যারকে প্রায় ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়েছিল রাহি।

‘অ্যাঁ! খাতা!’ স্যার হকচকিয়ে গিয়েছিলেন।

রাহি পড়ানোর ঘরে গিয়ে প্রায় লাফিয়ে পড়েছিল পড়ার টেবিলের ওপর। সাজিয়ে রাখা খাতা-বই লন্ডভন্ড করে খুঁজছিল ওর খাতা।

‘কী করছ তুমি?’ স্যার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

‘আমার খাতা কই? কোথায় আমার খাতা? আপনি আমায় অপমান করার জন্য নতুন চক্রান্ত করছেন, না? বের করুন আমার খাতা। বের করুন, নইলে কিন্তু খুব দুঃখ আছে আপনার কপালে।’

‘মানে?’ স্যার রেগে গিয়ে এক হ্যাঁচকা টান মেরেছিলেন রাহিকে, ‘তুমি আমায় শাসাচ্ছ? কী ভেবেছ তুমি? নিজেকে কী ভেবেছ?’

আচমকা হ্যাঁচকায় রাহি টাল সামলাতে না পেরে স্যারকে নিয়ে পড়ে গিয়েছিল মেঝের ওপর।

তারপর যে ঠিক কী হয়েছিল মনে নেই রাহির। শুধু মনে আছে স্যারের মুখে চুইংগাম ছিল। স্যারের হাত দুটো ওপর পিঠ বেয়ে আরও নীচের দিকে নামছিল। আর মনে আছে ও নিজে স্যারে ঠোঁট, বুক হয়ে চুমু খেতে খেতে নেমে গিয়েছিল বিপদসীমার কাছে।

বৈরিতা থেকে প্রেম আসে? নাকি শরীর আসে? কোনও গভীর মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ রয়েছে কি এর পিছনে? কেন, যে মানুষটাকে শিক্ষা দিতে ইচ্ছে করে তার সঙ্গেই এমন মিলেমিশে যায় মানুষ? তবে কি শুধু পড়াশোনার জন্যই অমন দম বেঁধে পড়ছিল না রাহি? তবে কি অবচেতনে ও স্যারের মনোযোগ চাইছিল? গম্ভীর, চাপা মানুষটা যে ওকে অবহেলা করছেন সেটা মন থেকে মানতে পারত না বলেই কি ও এমন করত? জানে না, কিচ্ছু জানে না রাহি। ও শুধু জানত যে, এই গম্ভীর চাপা মানুষটা আকর্ষণ করে, প্রচণ্ড আকর্ষণ করে ওকে।

পড়তে বসলে পড়া গুলিয়ে যেত ওর। শুধু স্যারের কথা মনে পড়ত। ওঁর পারফিউমের গন্ধ মনে পড়ত। ভাঁজপড়া থুতনিটা মনে পড়ত। আর তখনই ইচ্ছে করত সব ছেড়ে স্যারের কাছে চলে যায়।

স্যার প্রথম প্রথম বারণ করতেন। বলতেন, বয়সের পার্থক্যের কথা। বলতেন, লোক জানলে কী হবে। বলতেন, রাহির গোটা জীবনটা পড়ে রয়েছে সামনে। কিন্তু ঢেউয়ের মাথায় চড়ে যার সময় কাটে সে কি ভাবে পাড়ে বালি আছে, না পাথর আছে? রাহি তখন উড়ছিল। সময় পেলেই স্যারের কাছে চলে যেত। স্যারকে ছোঁয়ার চেষ্টা করত। স্যার বারণ করতেন প্রথম প্রথম। বলতেন একদিন ভুল হয়ে গেছে একটা, আর এসব না করাই ভাল।

কিন্তু কী যে ভূত চেপেছিল রাহির মাথায়! ও নিজের থেকে যেত স্যারের কাছে। সময় পেলে একদম স্যারের কোলে বসে দু’পা দিয়ে জড়িয়ে ধরত স্যারকে। স্যারও আর পারতেন না সামলাতে। ধীরে ধীরে সব বাধা কেটে গিয়েছিল। রাহি একদম জড়িয়ে পড়েছিল অলক স্যারের সঙ্গে। কেউ জানত না ব্যাপারটা। শুধু জানত ওরা দু’জন।

তারপর একদিন স্যার ক্যামেরা বের করেছিলেন একটা। চ্যাপটা, পাতলা, ডিজিটাল। বলেছিলেন, ‘তোমার ছবি তুলে রাখব আমার কাছে।’

‘ছবি!’ আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল রাহি।

‘সম্পূর্ণ ছবি। বন্ধনহীন ছবি,’ স্যার ফিসফিস করে বলেছিলেন।

রাহিকে দু’বার বলতে হয়নি। সমস্ত পোশাক ছেড়ে রাহি দাঁড়িয়েছিল স্যারের সামনে।

ছবিগুলো স্যার নিজের কম্পিউটারে ট্রান্সফার করে নিয়েছিলেন ক্যামেরা থেকে।

রাহির পরে ভয় হয়েছিল। ও জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কেউ যদি দেখে ফেলে?’

‘কেউ দেখবে না। আমার কম্পিউটারে কেউ হাত দেয়?’

‘তাও যদি কেউ দেখে ফেলে?’

স্যার হেসে বলেছিলেন, ‘আমি বেঁচে থাকতে তা হতে দেব না।’

স্যার মারা গিয়েছিলেন সরস্বতী পুজোর দিন সকালে।

সেদিন স্কুলে গিয়েছিল রাহি। বান্ধবীরা সব ফিরছিল দুপুরে খিচুড়ি খেয়ে। রাহিও ছিল ওদের সঙ্গে। বড় রাস্তা থেকে যেই বাঁকটা নিতে হয় ওদের বাড়ির দিকে সেইখানে পৌঁছে রাহি দেখেছিল পিলপিল করে মানুষ ছুটছে বড় রাস্তা দিয়ে আরও সামনের দিকে। কী হয়েছে কিচ্ছু বুঝতে না পেরে রাহিরাও এগিয়ে গিয়েছিল।

ভিড় আর জটলাটা দূর থেকেই দেখতে পেয়েছিল রাহি। আর দেখতে পেয়েছিল ভিড়ের মাথা ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ট্রাক। যার সামনের কাচ একদম চুরমার হয়ে গেছে।

কে মারা গেছে? ভিড় ভাঙার ক্ষমতা ছিল না রাহি বা তার বান্ধবীদের। কিন্তু স্বাভাবিক প্রশ্নটা তো আসছিলই মাথাতে। কিন্তু যাকেই জিজ্ঞেস করছিল সেই ঠিক উত্তর দিতে পারছিল না। সবাই ‘জানি না,’ ‘দেখি,’ ‘কেউ হবে একটা’-এসব বলে ভিড় বাড়াচ্ছিল আরও। ঠিক তখনই ভিড় থেকে বেরিয়ে এসেছিল একটা ছেলে। রোগা, ফরসা, গালে হালকা দাড়ি। কণ্ঠার হাড়টা প্রখরভাবে বেরিয়ে পড়েছে।

ছেলেটা গম্ভীর কিন্তু শান্ত গলায় বলেছিল, ‘স্যার মারা গেছেন। রান ওভার কেস।’

‘স্যার? কে?’ রাহি জিজ্ঞেস করেছিল।

ছেলেটি গালে হাত দিয়ে থমকেছিল মুহূর্ত কয়েক। তারপর বলেছিল, ‘অলক স্যার। হিস্ট্রি পড়াতেন। সাইকেল করে যাচ্ছিলেন, ট্রাকটা…’

আচমকা আলো কমে এসেছিল রাস্তায়। হাওয়াও যেন মরে এসেছিল আচমকা। পাশে বান্ধবীর দিকে হাত বাড়িয়ে অবলম্বন খুঁজেছিল রাহি। কিন্তু হাত পৌঁছোনোর আগেই ঢলে পড়েছিল ও। পড়ে যেতে যেতে সংজ্ঞার শেষ বোধটুকু দিয়ে বুঝতে পেরেছিল দুটো সবল হাত ধরে ফেলেছে ওকে।

রাহির জ্ঞান ফিরেছিল বাড়িতে। বাবা-মায়ের উদ্বিগ্ন মুখ, দাদার কোঁচকানো ভুরু, এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা সাধুদা-সবার ওপর চোখ ঘুরে অবশেষে আর-এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা সেই হালকা চাপ দাড়ি আর রোগা মতো ছেলেটার দিকে চোখে পড়েছিল রাহির।

‘এখন কেমন লাগছে?’ মা আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।

বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, ‘ডাক্তার আসছে, তুই উঠিস না।’

রাহি কোনও কথা বলতে পারছিল না। শুধু কাঁদছিল। দু’চোখ ছাপিয়ে গরম জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল বালিশের দিকে। স্যার নেই? অলক স্যার আর নেই? এই ছিল, এই নেই? এমন হতে পারে! জীবনে সব কিছু এমনভাবে এক মুহূর্তে লন্ডভন্ড হয়ে যেতে পারে? পরশুই তো পড়া ছিল, আদর ছিল, ভালবাসা ছিল। আর আজ সব রাক্ষসের মতো একটা ট্রাকের তলায় চাপা পড়ে শেষ হয়ে গেল? এত সহজ সব শেষ হয়ে যাওয়া? এত সামান্য এই জীবন?

ডাক্তার এসে দেখে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল রাহিকে। বলেছিল দুশ্চিন্তা না করতে। টেনশন না করতে। বাবা চিন্তিত হয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে দরজা অবধি গিয়েছিল। আর সেই সুযোগে মা ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোমার নাম কী গো?’

ছেলেটি ভুরু কুঁচকে, গালের দাড়িতে হাত বুলিয়ে গম্ভীরভাবে বলেছিল, ‘ত্রয়ণ।’

তারপর থেকে ত্রয়ণ সহজ হয়ে গিয়েছিল ওর বাড়িতে। ক্রমে জানা গিয়েছিল যে, দীপার কাজিন হয় ও। তবে দীপা তো তখনও বউ হয়ে আসেনি তাই দীপার ব্যাপারটা তখন আলোচনা হত না।

অলক স্যারের বাড়ি থেকে তাঁর বৃদ্ধ বাবা এসেছিলেন। ভদ্রলোক অদ্ভুত শক্ত ছিলেন ওই বয়সেও। ছেলের অমন আচমকা মৃত্যুতেও একদম সোজা হয়ে ছিলেন উনি। ত্রয়ণ আর বন্ধু-বান্ধবেরা সব মালপত্তর বেঁধেছেঁদে লরি বুক করে দিয়েছিল।

রাহি কেমন যেন অবশ আর মনমরা হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল গোটা জীবনটা শূন্য হয়ে গিয়েছে ওর। যেন কোথাও যাওয়ার নেই, কারও কাছে গিয়ে বসার নেই।

সেই সময় ত্রয়ণের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়ে রাহির। ত্রয়ণ হেল্‌প করত নানাভাবে। বাড়িতেও কেউ বিশেষ কিছু বলত না এই নিয়ে। কারণ, সবাই দেখত যে, রাহি আবার হাসছে, আবার ফিরছে স্বাভাবিক জীবনে। তা ছাড়া চমক নিজেই তখন প্রশ্রয় দিত ত্রয়ণকে।

কয়েক মাসের মধ্যেই রাহি স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল আবার। মনে হয়েছিল যেন অনেক আগের আবছা কোনও স্মৃতি এই অলোক স্যার। সবটাই যেন ধোঁয়া-কাচের অন্য দিক দিয়ে দেখা। আসলে ওই বয়সটাই অমন। তেলতেলে। কোনও কিছুই যেন আটকে থাকে না মনে। যেন যেটুকু চোখে দেখা যায় সেটুকুই পৃথিবী। যেটুকু হাতে ধরা যায় সেটুকুই নিজের। যেটুকু সময় পাওয়া যায় সেটুকুই জীবন। ত্রয়ণের সঙ্গে বন্ধুত্ব ক্রমশ গাঢ় হয়ে উঠেছিল রাহির।

এরই মধ্যে এইচএস দিয়েছিল ও। তারপর হিস্ট্রি অনার্স নিয়ে ভরতিও হয়েছিল কলেজে। ত্রয়ণ তখন পার্টির সদস্য। সেই কলেজের জিএস। ফলে বন্ধুত্ব বেড়েই চলছিল ক্রমাগত। আর পরের বছর সরস্বতী পুজোর দিনই হঠাৎ কলেজে ত্রয়ণ প্রোপোজ করে বসেছিল রাহিকে!

রাহি এটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। আসলে ত্রয়ণ ওর ক্রাইসিসের সময় পাশে ছিল বলে ওর প্রতি একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ভাললাগা ছিল রাহির। কিন্তু সেটা কখনওই ভালবাসা নয়। ফলে ত্রয়ণের প্রোপোজালটা যথেষ্ট হকচকিয়ে দিয়েছিল রাহিকে। তবে, কী করবে, সে ব্যাপারে দ্বিধা ছিল না রাহির। ও ত্রয়ণকে স্বাভাবিকভাবেই ‘না’ বলে দিয়েছিল।

কিন্তু তারপরই ত্রয়ণ পাগলামো শুরু করে। ওর বাড়িতে এসে বসে থাকতে শুরু করে। রাস্তায় ওর সঙ্গে যাওয়ার ব্যাপারে জেদ করতে শুরু করে। রাহি প্রথমে ব্যাপারটাকে হালকাভাবে নিলেও পরে ওর বিরক্তি বাড়তে থাকে। আর তাই একদিন রাহি বিরক্তিটা প্রকাশও করে দিয়েছিল। কড়াভাবে ত্রয়ণকে বলেছিল দূরে থাকতে।

এরপর ত্রয়ণ চুপ করে যায় হঠাৎ। রাহি ভেবেছিল যে, ও বিরক্ত হচ্ছে বুঝতে পেরেই বোধহয় নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে ত্রয়ণ। ফলে মনে মনে স্বস্তি পেয়েছিল রাহি। ভেবেছিল, ‘যাক বাঁচা গেল।’ কিন্তু বাঁচা যে যায়নি, তা বুঝেছিল সপ্তাহ দুয়েকের মাথাতেই।

বাড়ি ফাঁকা ছিল সেদিন। বাবা-মা নেমন্তন্নে গিয়েছিল বনগাঁয়। আর সেই খবর পেয়েই বোধহয় দুপুরবেলা এসেছিল ত্রয়ণ।

ত্রয়ণকে সেদিন আর এলোমেলো দেখাচ্ছিল না। বরং ভাল জামাকাপড় পরে, দাড়ি সুবিন্যস্ত করে এসে বসেছিল বসার ঘরে। উপায়ন্তর না দেখে ভদ্রতাবশত রাহিও গিয়ে বসেছিল সামনে। বলেছিল, ‘তুমি? হঠাৎ এমন সময়?’

ত্রয়ণ শান্ত, গম্ভীর গলায় বলেছিল, ‘তোমার কাছে এসেছি।’

‘ও,’ বলে একটু থেমেছিল রাহি। তারপর বলেছিল, ‘কেন এমন করছ ত্রয়ণ? তোমায় তো বলেছি…’

‘অলক স্যার পেতে পারলে, আমি পেতে পারি না?’ ত্রয়ণ রাহির চোখে চোখ রেখেছিল।

‘মানে!’ কে যেন ইলেকট্রিকের চাবুক দিয়ে মেরেছিল রাহিকে। কী বলছে ত্রয়ণ! অলক স্যার!

ত্রয়ণ সামান্য হেসে একটা ব্রাউন খাম থেকে দুটো ছবি বের করে সাবধানে রেখেছিল রাহির সামনে। বলেছিল, ‘আমি এটা দেখাতাম না। ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু বাধ্য হলাম। অলক স্যার তোমায় পেলে আমি দোষ করলাম কোথায়?’

রাহি কোনও কথা বলতে পারছিল না। কাঁপছিল ভয়ে, লজ্জায়। সামনের ছবিগুলো অলক স্যারের তোলা। এগুলো কী করে হাতে গেল ত্রয়ণের? ও ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। ত্রয়ণ ছবিগুলো গুছিয়ে তুলে বলেছিল, ‘সবক’টা ছবি আমার কাছে আছে। স্যারের মালপত্তর প্যাক করে তোলার আগে কম্পিউটারটা ঘেঁটেছিলাম আমি। তখনই হঠাৎ এটা পেয়ে যাই। কেউ জানে না এর কথা। জানবেও না। শুধু আমি জানব। তবে তার পরিবর্তে আমাকে তোমার কাছে আসতে দিতে হবে। বুঝেছ?’

রাহির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সেদিন ত্রয়ণ ওর শরীরে হাত দিয়েছিল। রাহি চোখ বন্ধ করে সহ্য করেছিল ত্রয়ণের ঠোঁট আর হাতকে। তারপর ত্রয়ণ চরম সীমায় পৌঁছোতে গেলে রাহি কেঁদে ফেলেছিল। ত্রয়ণের পা জড়িয়ে ধরে বলেছিল যেন অমন না করে।

ত্রয়ণ হেসে সরে বসেছিল। তারপর বলেছিল, ‘ঠিক আছে। অপেক্ষা করব আমি। তবে ওটা আমিই নেব কিন্তু। আর কেউ যেন না নেয়। কেমন?’

‘কেমন?’ শব্দটার ভেতরের প্রচ্ছন্ন হুমকি কান এড়ায়নি রাহির। ও মাথা নিচু করে নিয়েছিল। আর মনে মনে নিজের নির্বুদ্ধিতাকে দোষ দিচ্ছিল কেবল।

তবে তারপর থেকে সতর্ক হয়ে গিয়েছিল রাহি। পারতপক্ষে ত্রয়ণের সঙ্গে একা থাকত না। অবশ্য ত্রয়ণও খুব বেশি জোর করত না। কখনও সখনও শরীরে হাত দেওয়া আর চুমুর সঙ্গে সেই কথাটা মনে করিয়ে দেওয়া। এভাবেই সময় কাটছিল। এর পর বেশ কয়েক বছরের জন্য পার্টি থেকে ত্রয়ণকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় উত্তরবঙ্গে। সংগঠনের কাজে। আর রাহিও হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল। তবে মনের মেঘ কাটেনি। কারণ, ছবিগুলোর ব্যাপার তো নিষ্পত্তি হয়নি পুরোপুরি। রাহির মনে হত কে জানে ত্রয়ণ কবে আবার নতুন রূপে হাজির হয়!

‘চলো,’ সাধুদা পোশাক পালটে এসে দাঁড়াল সামনে। হাতে সাধুদার বিখ্যাত বেতের হাতলওলা মোটা কাপড়ের ছাতা।

‘এ কী! ছাতা কেন?’ রাহি আশ্চর্য হল।

‘আষাঢ় মাস, বর্ষা আসবে যখন-তখন,’ সাধুদা গম্ভীর হল।

‘সাধুদা, এটা আষাঢ়ে গল্প হয়ে যাচ্ছে,’ রাহি হাসল, ‘গত সাতদিনে বৃষ্টি হয়েছে? আর আকাশ দেখো, একদম স্টেনলেস। তোমার বৃষ্টি কোথায় হচ্ছে? কার মাথায়? রেখে দাও ছাতা।’

সাধুদা হাসল, ‘হবে গো দিদি। আজ বৃষ্টি হবে। আকাশের গন্ধ দেখো না।’

রাহি হাসল, ‘তুমি কে গো সতীনাথ বন্দ্যো…?’

‘মানে!’ সাধুদা হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল।

‘সে আছে একজন। সে আকাশের গায়ে টকটক গন্ধ পায়।’

‘তাই?’ সাধুদা অবাক হল, ‘তা হবে। পৃথিবীতে কতরকম লোক আছে! কম তো দেখলাম না! এই দেখো না, কিগান। যেমন অদ্ভুত নাম, তেমন অদ্ভুত মানুষ। ভালই কাজকম্ম করছিল। তারপর কী হল, হঠাৎ করে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে কোথায় না কোথায় যেন চলল। তা কোথায় যাচ্ছে বলো তো?’

‘কোথায় যাচ্ছে তা তো এগজ্যাক্টলি বলতে পারব না। তবে চলে যাচ্ছে।’

সাধুদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘সত্যিই তো, কে আছে ওর! থাকার মধ্যে ওই আদিত্য আর কাকু-কাকিমা। আজকালকার দিনে আত্মীয় মানেই তো বিষ। বিষাক্ত। তাদের এড়িয়ে চলাই হয়তো ভাল।’

রাহি জানে সাধুদা কেন এইসব বলছে। সেদিন গুলি লাগা অবস্থায় আদিত্যকে প্রথমে ওদের বাড়িতে আনা হয়েছিল তারপর ওদের গাড়ি করেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বারাসত হাসপাতালে। সেখানে প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা হওয়ার পর আদিকে ট্রান্সফার করা হয়েছিল কলকাতায়। তবে সেইটুকু সময়ের ভেতর যতটুকু জ্ঞান ফিরেছিল আদিত্যর সেই গোটা সময়টাতেই ও কিগানের উদ্দেশে নানারকম কথা বলে যাচ্ছিল জড়িয়ে জড়িয়ে। তাতে যা বোঝা গেছে সেখান থেকেই মানে করে কথা বলছে সাধুদা। তবে আদিত্য আরও কিছু বলছিল যা রাহি শুনেছে। ওদের বসার ঘরের সোফায় শুয়ে থাকা অবস্থায় আদি বলছিল, ‘দাদাভাই আমি পারিনি…ওই মেয়েটা মিথ্যে…আমি…দাদাভাই আমার ভুল…’

কিগান দ্রুত কথাটাকে ঢেকে দিয়েছিল অন্য কথা দিয়ে। কিন্তু রাহির মনে খচখচ ভাবটা থেকেই গিয়েছে। কিগানকে ওর চিরকাল ছায়ার মানুষ মনে হয়। এই বয়সে এমন একা থাকতে কাউকে দেখেনি রাহি। আর নিজের সম্বন্ধে তো বলতেও চায় না কিছু। তবু সেদিন আদির কথার ফাঁকফোকর দিয়ে মাথা বের করেছিল রহস্যময় কিছু। কী সেই রহস্য? রাহি জানে, এ আর জানা যাবে না কোনওদিন।

সাধুদা বলল, ‘ওই দেখো পশ্চিম আকাশে কেমন মেঘ ঘনাচ্ছে।’

রাহি দেখল সত্যিই তাই। সাধুদা সতীনাথ বন্দ্যো নয় তো?

সাধুদা বলল, ‘সেদিনও এমন মেঘ করেছিল না? সেদিনই তো শেষ বৃষ্টি হয়েছিল। তারপর দেখো আজ হবে।’

রাহির ভেতরটা কেঁপে উঠল সেদিনের কথা চিন্তা করে। ত্রয়ণ যে এতটা যেতে পারে ও কোনওদিন বুঝতে পারেনি। আসলে ঘটনাটা শুরু হয়েছিল অন্যভাবে।

‘হেল্‌প আর্থ’-এর অফিসে একদিন একাই ছিল রাহি। তখন ত্রয়ণ এসে ঢোকে আর শাসিয়ে বলে যে, এবার জমিটা মার্চেন্টের নামে লিখে দিতে হবে রাহিকে। আর রাহি ওর কথা না শুনলে সেইসব ছবি পোস্টারের মতো মারবে চাপাডাঙার দেওয়ালে। ত্রয়ণ চারদিন সময় দিয়েছিল এই কাজটা করার জন্য। খুবজোর মিনিট পাঁচেক ছিল ত্রয়ণ, কিন্তু সেটুকুতেই ভেতরে ভেতরে নাড়িয়ে দিয়েছিল রাহিকে।

ত্রয়ণ বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই ঢুকেছিল আবেশ। ও শিস দিয়ে কিছু একটা গাওয়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু রাহিকে হতভম্ব অবস্থায় বসে থাকতে দেখে শিস বন্ধ করে ঘাবড়ে গিয়েছিল খুব। জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এমন করে বসে আছ কেন?’

‘কিছু না,’ রাহি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল।

আবেশ চেয়ার টেনে সামনে বসে তাকিয়েছিল রাহির দিকে। তারপর চাপা গলায় বলেছিল, ‘একটা কথা বলব, অভয় দাও যদি।’

‘অভয়!’ রাহি অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।

‘দেখো, আমি জানি ত্রয়ণ তোমায় কিছু নিয়ে একটা ব্ল্যাকমেল করছে। আমি ওকে এখান থেকেও বেরোতে দেখলাম। না, না, আমায় কিছু বলতে হবে না। তবে আমার মনে হয় জমিটার কেসে ও তোমায় চাপ দিচ্ছে। মার্চেন্টের লোকজন যে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করছে তা তোমার দাদার বন্ধুদের থেকে আমি জেনেছি। নানা কথা হওয়ার পরও মার্চেন্ট তো ম্যাচ বা টুর্নামেন্ট, কিচ্ছু করছে না। ফলে ওরা অন্য পথ যে ধরবে সেটা গেস করাই যায়। আমি এটাও জানি যে, ওই জমিটা তোমার নামে আছে।’

রাহি কোনও কথা বলতে পারছিল না। আবেশ ওর বাস্তব বুদ্ধি দিয়ে যা বলছে তা একদম ঠিক। কিন্তু সেই নিয়ে তো বেশি কিছু বলতেও পারছিল না ও।

আবেশ বলেছিল, ‘শোনো রাহি, তোমার দাদাকে এই নিয়ে খুলে বলো। আর ত্রয়ণ কিছু করার আগে তুমি জমিটা মার্চেন্টকে দেওয়ার বন্দোবস্ত করো। তোমার বাবাকে বলো, বোঝাও। ডু এনিথিং। আমার কাছে খবর আছে যে, ত্রয়ণের কিন্তু অ্যান্টিসোশ্যাল এলিমেন্টদের সঙ্গে দহরম মহরম বাড়ছে। ফলে ও কিন্তু সাংঘাতিক মাল। যা করবার তাড়াতাড়ি করো।’

রাহি সে রাতে ঘুমোতে পারেনি। ভয়ে দুশ্চিন্তায় কাঁটা হয়ে ছিল একদম। চমককে যে কিছু বলা যাবে না সেটা একদম নিশ্চিত। বাবা-মাকে বলাও আউট অব কোশ্চেন। তা হলে? কাকে বলবে রাহি? বাবাকে বলে জমিটা দিতে পারেই ও। কিন্তু ওই ছবিগুলো নিয়ে যদি একের পর এক ব্ল্যাকমেল শুরু করে ত্রয়ণ? বাঘ একবার রক্তের স্বাদ পেয়ে গেলে কি আর ছাড়বে? নিজেকে অতি কষ্টে বাঁচিয়ে রেখেছে ও, কিন্তু এবার যে অন্যদিকে হাত বাড়াতে শুরু করেছে ত্রয়ণ। এই লোভের হাত কোথায় গিয়ে থামবে?

সারারাত জেগেই কাটিয়েছিল রাহি। একদম ভোরের দিকে পায়ে পায়ে উঠে গিয়েছিল ছাদে। পূর্ব দিক লাল হচ্ছিল সবে। অল্প অল্প করে মাথা তুলে পৃথিবীর এই অংশের দিকে তাকাচ্ছিল সূর্য। আর সেই আলোর দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক শান্তি পেয়েছিল রাহি। ছাদ থেকে দেখেছিল পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে সাধুদা মন্ত্রোচ্চারণ করছে। হাতে জল নিয়ে তা অর্পণ করছে অর্কদেব-এর উদ্দেশে। আর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকের মতো কথা বলার লোকটার নাম মাথায় এসেছিল রাহির। অর্ক, কিগান অর্ক ব্যানার্জি।

সকাল সাড়ে আটটায় ফ্যাক্টরিতে যায় কিগান। সেটা রাহি জানত। ও দেরি না করে সাতটা নাগাদ চলে গিয়েছিল কিগানের বাড়িতে। কিগান তখন সবে দাঁত ব্রাশ করে উঠেছিল। কাঁধে তোয়ালে আর সারা মুখে জল নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাহিকে দেখে অবাক হয়েছিল কিগান, ‘তুই? আশ্চর্য তো! এত সকালে কী করছিস?’

রাহি এতটা পথ এলেও কিগানকে দেখেই কেমন যেন পা কাঁপছিল ওর। আগের দিনের থেকে চেপে রাখা যন্ত্রণা আর মানসিক কষ্ট কেমন যেন অবশ করে দিচ্ছিল ওকে। তার ওপর ছিল সারারাত ঘুম না হওয়া। কোনওমতে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে কিগানের ঘরে গিয়ে চেয়ারে প্রায় অবশ হয়ে বসে পড়েছিল রাহি।

‘কী হয়েছে রে?’ কিগান ঘরে এসে চেয়ারের হাতল ধরে মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসেছিল।

‘কিগানদা আমার খুব বিপদ,’ রাহি কোনওমতে কথাটা বলে দু’হাতে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলেছিল।

‘বিপদ!’ কিগান থতমত মুখ করে বিছানায় উঠে বসেছিল।

সময় নিয়েছিল রাহি। মিনিট পাঁচেক সময় নিয়েছিল। তারপর বলেছিল, ‘আমি কথাটা কোনওদিন কাউকে বলতে পারব না। বাড়ির কেউ জানলে আমায় কেটে ফেলে দেবে।’

‘মানে?’ কিগান অবাক হয়ে তাকিয়েছিল রাহির দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তো আমায় বলছিস কেন?’

কেন কিগানকে বলছে? সত্যিই তো হঠাৎ কিগানকেই বা বলছে কেন? এত লোক থাকতে হঠাৎ কিগানকে বা বলছে কেন? জানে না, কিচ্ছু জানে না রাহি। আসলে জীবনে সব কি আর লজিক দিয়ে মাপা যায়? সব কিছুর পিছনে কি আর ভয়ংকর অঙ্ক থাকে? কিছু জিনিস এমনিই হয়, আপনা থেকে জন্মায়, মনে আসে হঠাৎ করে। তার কোনও তেমন কঠিন লজিক থাকেই না। এটাও তেমন। কিগানের নাম ওই সূর্যোদয়ের সময় কেন মনে এসেছে তা জানে না রাহি। শুধু জানে যে, মনে এসেছে।

রাহি বলেছিল, ‘আমি জানি না কেন তোমায় বলছি। কিন্তু তুমি কি শুনবে না?’

‘নিশ্চয়ই শুনব,’ কিগান হেসেছিল, ‘তুই টেনশন বাদ দিয়ে ঠান্ডা মাথায় বল।’

তার পরও সময় নিয়েছিল রাহি। মনে মনে গুছিয়ে নিয়েছিল সব। তারপর বলেছিল।

কিগান সব শুনে মাথা নিচু করে বসেছিল কিছুক্ষণ। তারপর বলেছিল, ‘তুই শিয়োর আর কেউ এসব জানে না? মানে ত্রয়ণ বাদ দিয়ে আর কেউ জানে না?’

‘তাই তো মনে হয়। মানে সত্যিই বলছি আমার ধারণা আর কেউ জানে না।’

‘হুম,’ কিগান ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করেছিল।

‘আমি তখন সত্যিই বুঝতে পারিনি কিগানদা যে, এর ফলে আমায় এত কিছু অশান্তি পোহাতে হবে। আমি যে কী ভুল করেছি! আমি…’ রাহির গলা ভিজে এসেছিল আবার।

‘শোন, ওসব আর ভাবিস না।’

‘অতীতটাকে যদি পালাতে পারতাম! এত আফশোস হচ্ছে,’ রাহি দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকেছিল।

‘শোন রাহি, অতীত না থাকলে আমরা থাকতাম না। আমাদের জীবনে যা-কিছু ঘটে গেছে জানবি সব কিছুর প্রভাব এই সময়টাতে আছে। ফলে এসব চিন্তা করে আর নিজেকে বিপাকে ফেলিস না।’

রাহি কী বলবে বুঝতে না পেরে তাকিয়েছিল কিগানের দিকে।

কিগান বলেছিল, ‘গৌর স্যার, মানে আমাদের এমডি তোর বাবার সঙ্গে একটু রুড হয়ে গিয়েছিলেন এই জমিটা নিয়ে আলোচনায়। বিচ্ছিরিভাবে টাকা অফার করেছিলেন। এই জমিটা তোর বাবা, মানে কাকুর প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে গেছে এখন। যদি গৌর স্যার এসে কাকুর সঙ্গে কথা বলেন, যদি একটা সমঝোতা করা যায় তবে কি জমিটা মার্চেন্ট পেতে পারে?’

‘দেখো, জমিটা আমার নামে হলেও বাবার কথাই শেষ কথা।’

‘জানি রে,’ কিগান বলেছিল, ‘ঠিক আছে আমি গৌর স্যারের সঙ্গে কথা বলব। তুইও কাকুর সঙ্গে বলিস। ফ্যাক্টরিটা হলে সব স্থানীয় লোক কাজ পাবে। তার ডাউনস্ট্রিম হিসেবেও দেখবি টুকটাক নানা লোকের রোজগার বাড়বে। কাকুকে এগুলো বোঝাতে হবে। আর হ্যাঁ, গৌর স্যার যা ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিলেন সেটা মেটাতে উনি নিজেই আসবেন।’

‘আসবেন! উনি এলে বাবা না করবে না বোধহয়।’ রাহি বলেছিল।

‘ম্যানেজমেন্টের গুঁতো খেয়েছে। বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে কাজটা হ্যাম্পার হচ্ছে। প্রজেক্ট ডিলে হচ্ছে। গৌর স্যারকেও তো চাকরি বাঁচাতে হবে, নাকি? দু’বছরের ওপর প্রজেক্টটা ঝুলে আছে। নট আ নাইস থিং ফর গৌর রওশন দিওয়ান। জমিটা কাকু যদি নিজের থেকে দিয়ে দেন তা হলে ত্রয়ণটা অন্য কিছু করতে পারবে না।’

‘কিন্তু যদি করে? ছবিগুলো তো ওর কাছে আছে।’

কিগান বলেছিল, ‘এতদিন এই অঞ্চলে আছি। আমিও তো দু’-চারজনকে চিনি। দেখি। আজ সন্ধেবেলা ত্রয়ণের বাড়ি যাব একবার।’

‘তুমি কী করবে কিগানদা? তোমার কিছু বিপদ হবে না তো?’

‘বিপদকে সবসময় ভয় পেলে চলে না রে মেয়ে। আর একটু-আধটু বিপদ সামলাতে জানি। তুই ভাবিস না।’

‘ত্রয়ণের সঙ্গে খারাপ লোকদের যোগাযোগ আছে। ওরা যদি তোমার ক্ষতি করে?’

‘দুর, ওসব কিচ্ছু হবে না,’ কিগান হেসেছিল, ‘ত্রয়ণের মোবাইল নম্বরটা শুধু আমায় দে একবার।’

মোবাইল নম্বরটা দিয়ে রাহি উঠে পড়েছিল, ‘সত্যিই কিছু হবে না তো?’

‘পাগলি। কিচ্ছু হবে না। তুই নিশ্চিন্তে স্কুল কর। আর রাতে কাকুকে একটু বোঝাস।’

রাতে বাবার সঙ্গে কথা বলেছিল রাহি। বাবা তো প্রথমে শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী ব্যাপার বল তো? জমিটা নিয়ে তুই কী বলছিস?’

‘আমি চাই সবটা না হলেও মার্চেন্ট মাল্টিপল্‌সের দরকার মতো জমি তুমি দাও বাবা। এই অঞ্চলে একটা প্লাস্টিকের কারখানা আর একটা স্পিনিং মিল গত ছ’মাসে বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষজন কী করবে বলো তো? তুমি জমিটা দিলে ফ্যাক্টরিটা হয়। মানুষগুলো কাজ পায়।’

‘তুই ভুলে গেলি ওই মার্চেন্টের গৌর বলে ভদ্রলোক কেমন অসভ্যের মতো কথা বলেছিল? টাকা কি আমার নেই? অমন করে টাকা নিয়ে কথা বলে যে, তার সামনে আমি আগে যাব? রাঘব চক্রবর্তীর কি এই দশা হয়েছে?’

‘বাবা, আমি জানি সবটা। কিগানদা বলছিল গৌর অনুতপ্ত। ও এসে তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। গৌর এলে তুমি বারণ করবে না তো?’

বাবা হেসেছিল, ‘ও, এসব তা হলে তোর আর কিগানের মাথায় এসেছে! না, আমি এখনও অত অসভ্য হইনি যে, মানুষ দেখা করতে চাইলে দেখা করব না। বুঝেছিস?’

তারপর যে কী হল স্পষ্ট জানে না রাহি। শুধু সেদিন রাতে কিগান মেসেজ করে জানাল যে সব ঠিক আছে। ত্রয়ণকে সামলানো হয়েছে। আর যেন দুশ্চিন্তা না করে। রাহি জানতে চেয়েছিল কী হয়েছে, কীভাবে হয়েছে, কিগান কিচ্ছু বলেনি। শুধু জোর দিয়ে বলেছিল রাহি যেন আর দুশ্চিন্তা না করে।

এর সাতদিনের মাথায় গৌর রওশন দিওয়ান এসে দেখা করেন বাবার সঙ্গে। তার দু’দিনের মাথায় সুধাদি আসে বাড়িতে। তার পরের দিন রাহিকে সই করতে হয় কিছু পেপারে। আর এরপর এক বিকেলবেলা হঠাৎ প্রচুর মিষ্টি আর উপহার ওদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন গৌর রওশন দিওয়ান! চাপাডাঙার চারদিকে দ্রুত ছড়িয়ে যায় যে, রাঘব চক্রবর্তী গ্রামের উন্নয়নের জন্য জমি দিয়েছে। আর অন্য এক দিকে খবর ছড়ায় যে, আদিত্য ব্যানার্জির মধ্যস্থতায় সব হয়েছে।

আর ত্রয়ণ যেন উবে গিয়েছিল পুরো ঘটনাটার থেকে। যেন ত্রয়ণ বলে কেউ ছিলই না এই চাপাডাঙায়।

রাহির খুব অবাক লাগে এখনও। পুরো ব্যাপারটা করল কিগান আর সেখানে ওর নাম পর্যন্ত এল না! জানলই না কেউ! আর সেই মানুষটা এইসব করে দিয়ে আচমকা চলে যাচ্ছে! কেন যাচ্ছে? এমন নির্বিকার, গাছের মতো বিক্রিয়াহীন মানুষ হয় নাকি? এমন আড়ালে থাকা, ছায়ার মতো বেঁচে থাকতে পারে কেউ?

কিগানদার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে গাড়িটা। কোম্পানির গাড়ি। পিছনের ডিকিটা খোলা। তাতে মালপত্তর তুলছে আবেশ। সাধুদা দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানেই। মালপত্রেও হাত লাগাল। আবেশ এসেছে! অবশ্য আসবে যে সেটাই স্বাভাবিক।

আবেশ বলল, ‘এত লেট করলে! কিগানদা তো এই বেরোবে এবার।’

‘এত তাড়াতাড়ি?’ অবাক হল রাহি।

‘তা একটু তাড়াতাড়ি বটে। কিন্তু একবার ওদের অফিসে যাবে। কীসব পেপারে এখনও সই করার আছে। যাক গে তুমি তাড়াতাড়ি যাও।’ আবেশ আবার মন দিল মালগুলো গাড়িতে সেট করায়।

‘তুমি স্টেশনে যাবে?’ রাহি জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ, তারপর কলকাতায় রাত কাটিয়ে কাল ফিরব। আসলে বস্তির স্যানিটেশনের জন্য যে-প্রকল্পটা জমা দেওয়া হয়েছিল মিউনিসিপ্যালিটিতে সেটার জন্য যেতে হবে একবার। কাল কলকাতা থেকে একদম ওদের অফিস হয়ে তারপর আসব।’

রাহি আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। ‘হেল্‌প আর্থ’ এখন স্যানিটেশন প্রজেক্টটা নিয়ে কাজ করছে। আর আবেশ খুব খাটছে সেখানে। ছেলেটা অদ্ভুত ভাল কাজ করছে। বাবা বলছিল আবেশ চাইলে বাবার ব্যাবসাতেও কাজ করতে পারে। কিন্তু আবেশের যে এই কাজ কী এত ভাল লাগে!

রাহি টিফিন বক্সটা নিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে দেখল আকাশটা আরও কালো করে এসেছে। যে ক’দিন বৃষ্টি হয়নি তার শোধ এবার তুলবে হয়তো প্রকৃতি।

ঘরের দরজায় গিয়ে থমকে দাঁড়াল রাহি। রুহান! দরজার দিকে পিছন করে বিছানার ওপর ঝুঁকে কিছু একটা করছে। বহু বহু দিন পর দেখল ওকে। সেই যে এসএমএস করেছিল আসবে বলে, তারপর এই দেখল। কোথায় ছিল ছেলেটা?

‘রুহান?’ রাহি ডাকল।

‘অ্যাঁ?’ কিছুটা চমকে উঠে ঘুরল রুহান।

‘তুমি?’ অবাক হল রাহি।

‘হ্যাঁ, কিগানদার সঙ্গে যাব তো। তাই এলাম।’

‘কেমন আছ?’ রাহি হাতের টিফিন বক্সটা টেবিলে রেখে একটা চেয়ার টেনে বসল।

‘আছি আমি। ঠিক আছি,’ উজ্জ্বলভাবে হাসল রুহান।

‘আর তো আসোই না।’

‘আসি তো। ফ্যাক্টরিতে কাজ হচ্ছে সিভিলের। তার জন্য তো প্রায়ই আসতে হয়।’

‘আমার সঙ্গে দেখা করো না তো!’ রাহি অভিমানী গলায় বলল।

‘তা ঠিক,’ রুহান আমতা আমতা করল, ‘আসলে… মানে, এখানেই এত কাজ থাকে আর যেটুকু সময় পাই তাতে…মানে…’

‘ও এখন কোচ হয়েছে জানিস,’ বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে হাসল কিগান।

‘মানে! ও তো খেলত! আর এখন কোচ?’

‘হ্যাঁ, কিছু ছেলেপিলেকে ক্রিকেট শেখায়। বিনি পয়সার কোচ। ছেলেগুলোর আর্থিক অবস্থাও ভাল নয়। ওরা সব একসঙ্গে খেলে। টুর্নামেন্টেও যায়। দারুণ ব্যাপার। ওর সময় কোথায়?’

‘ধ্যাৎ,’ রুহান হাসল। পরিষ্কার, খোলা হাসি। বলল, ‘আমি এই ব্যাগটা নিয়ে নীচে যাচ্ছি। তুমি এসো কিগানদা।’

রাহি টিফিন বক্সটা দেখিয়ে বলল, ‘ওতে খাবার আছে। মা দিয়েছে। নিয়ে যাও প্লিজ। দাদার তো জ্বর, তাই আসতে পারল না।’

‘ও, চমক অসুস্থ? আমি একবার দেখে যাব?’ কিগান উদ্বিগ্ন হল সামান্য।

‘কেন?’ হঠাৎ রাগ হল রাহির। ও থামল। রুহান বেরিয়ে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করল। তারপর বলল, ‘কেন দাদাকে দেখতে যাবে তুমি? আমরা তোমার কে হই? কে হই আমরা তোমার?’

‘আরে, পাগলি, তুই রাগ করছিস কেন?’ কিগান হাসল।

‘কেন যাচ্ছ তুমি কিগানদা? কেন চলে যাচ্ছ? আর চলে যে যাবে তা তো কাউকে বলোনি? কেন বলোনি? কেন?’

‘আমায় তো যেতেই হত রাহি।’

‘কেন? কেন কিগানদা? আমি তোমায় আমার সব কথা বললাম আর তুমি সব ছেড়ে চলে যাচ্ছ সেটা বললে না একবারও? তুমি এত নিষ্ঠুর কেন? এমন সরে থাকো কেন? এতে কী আনন্দ পাও? এটা কি বীরত্বের খুব?’

‘খুব রেগে আছিস যে! শোন রাহি, আমারও জীবনে কিছু ঘটনা আছে, কিছু কষ্ট আছে। কলকাতা ছেড়ে সেটা এখানেও এসে পড়েছে। তাই আমায় যেতেই হবে এবার। যেতেই হবে।’

‘কী কষ্ট কিগানদা? আমায় বলো,’ রাহি করুণ গলায় বলল।

কিগান হাসল, ‘বাদ দে রাহি। আমি যাচ্ছি, কিন্তু যোগাযোগ তো থাকবে।’

‘এগজ্যাক্টলি যাচ্ছটা কোথায়?’

‘পাহাড়ে। রাবাংলা। ওখানে একটা পার্টিকল্ বোর্ডের ফ্যাক্টরি হয়েছে। সেখানে যাব। আমায় এজিএম প্রোডাকশন করে নিয়ে যাচ্ছে।’

‘ও,’ রাহি মাথা নিচু করল। কষ্ট হচ্ছে গলায়। চোখ উপচে জল আসছে।

‘শোন, ত্রয়ণ এখন জেলে। ভাল কেস খেয়েছে। ভয় পাস না। কিছু হবে না। আর প্রয়োজন হলে আমায় ফোন করিস। চলে আসব।’

‘তুমি আমায় ভুলে যাবে কিগানদা?’ রাহি কেঁদে ফেলল।

‘রাহি মানে জানিস? পথিক। এমন কাঁদিস না। যে পথিক হয়, তাকে বহু দূর যেতে হয়। তোর স্কুল, তোর কাজ, সব নিয়ে তুই ভাল থাকিস। মনখারাপ করিস না। জানিস, জীবন কিন্তু একটা, এটার দাম দিস। কদর করিস। খারাপ হতে, খারাপ করতে তো এক সেকেন্ড লাগে। বুঝলি? চল আমায় যেতে হবে এবার।’ কিগান উঠল।

‘তুমি আমায় ভুলে যাবে?’

কিগান হাসল। তারপর বাঁ হাতটা তুলে কবজিটা দেখাল। রাহি অবাক হয়ে দেখল ওর দেওয়া সেই ঘড়িটা!

কিগান বলল, ‘ভুলব কী করে বল? আমার স্মৃতি আমার শত্রু। তাই তো আমায় পালিয়ে বেড়াতে হয়। তাই তো যাযাবরের মতো ঘুরতে হয় আমায়। বুঝলি?’

গাড়ির পিছনের সিটে বসে জানলা দিয়ে মুখ বাড়াল কিগান, ‘কাঁদবি না। একদম কাঁদবি না। আমি তো আছি রে। তুই যখনই আমার কথা ভাববি, জানবি আমি তখনই আছি। সশরীরে থাকার চেয়ে মনে থাকাটা বেশি জরুরি, জানিস তো?’

‘তুমি কার জন্য চলে যাচ্ছ?’ রাহি শেষবারের মতো চেষ্টা করল।

‘আমার জন্য। আসি রে রাহি। বুঝলি? যাচ্ছি না কিন্তু, আসছি।’

গাড়িটা ছোট হতে হতে মিলিয়ে গেল দূরে। সন্ধে নামছে এবার। মেঘ করেছে বলেই হয়তো একটু তাড়াতাড়ি নামছে। সাধুদার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতে লাগল রাহি। না, যাবে না হোমিদের বাড়ি। যেতে পারবে না ও। ইচ্ছেই করছে না। জোর করে কিচ্ছু করতে ইচ্ছে করছে না। তাতে মা বকলে, বকুক। হোমি রাগ করলে, করুক। রাহি শূন্য রাস্তাটার দিকে তাকাল আবার। এই দু’বছরে কী হল ওর জীবনে? আদৌ কিছু হল কি? কিছু মুহূর্তরা বেঁচে থাকল শুধু। কোথাও পৌঁছোল কি রাহি? কিছু সম্পূর্ণ করল কি? কিছুই তো করল না। শুধু এক সময় থেকে হাঁটতে হাঁটতে অন্য সময়ের মধ্যে চলে এল যেন। পথিক কি পৌঁছোনোর জন্য পথে বেরোয়? গন্তব্যেই কি মানুষের আনন্দ? নাকি এই পথটা, এই চলনটারও অন্য একটা মানে আছে? তার অন্য আনন্দ আছে?

সাধুদা বলল, ‘আমার ছাতায় দু’জন আঁটব না। তাড়াতাড়ি চলো।’

‘কেন সাধুদা? তার চেয়ে আজ একটু ভিজি চলো।’

‘পাগল নাকি? আমার কি আর সেই বয়স আছে?’

‘কেন? ভিজতে বয়স লাগে নাকি?’

‘লাগে গো দিদি। সব কিছুর বয়স আছে একটা। ভেজারও আছে,’ সাধুদা হাসল।

‘আমার ভেজার বয়স নেই?’

‘সেটা নিজেকেই ঠিক করতে হয় দিদি। এবার পা চালিয়ে চলো, দেরি কোরো না।’

সাধুদা হনহন করে হাঁটতে লাগল। আকাশ ফাটিয়ে বিদ্যুৎ ছিটকে পড়ল এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। আর তার আলোয় দূরে নিজেদের বাড়িটা দেখতে পেল রাহি। ওখানে ফিরতে হবে ওকে। বৃষ্টি আসার আগেই ফিরতে হবে। রাহি বুঝল বৃষ্টিতে ভেজার বয়স ওর আর নেই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *