মুহূর্তরা দু’বছর আগে – ৩৩

৩৩

বড় রাস্তার এপার থেকে ফ্যাক্টরিটাকে দেখতে কেমন যেন কেল্লার মতো মনে হয়। উঁচু পাঁচিল। বড় শক্ত লোহার গেট। তার ভেতর থেকে টাওয়ারের মতো উঠে যাওয়া জলট্যাঙ্কি, আর কালো গম্ভীর চিমনি। এই পিচের রাস্তা যদি মুছে দেওয়া যেত, তবে পুরো দৃশ্যটাই অন্যরকম লাগত একদম। পিছনে জঙ্গল আর সামনে কেল্লা। এবং এই দুইয়ের মাঝে কে ও? আদিত্য? আদি? নাকি মনমরা এক মানুষ?

চায়ের দোকানের বেঞ্চটা নড়বড় করছে। তবে দু’দিকে পা দিয়ে সাইকেলে বসার মতো করে বসেছে ও। আর দু’পায়ের ফাঁকে রেখেছে চায়ের গ্লাস।

সন্ধে হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ। একটা ঘোলাটে বাল্‌ব জ্বলছে চায়ের দোকানটার সামনে। ফ্যাক্টরিতে ক্যান্টিন আছে। খাবারের মানও ভাল। তাই হয়তো বাইরে খুব একটা দোকানপাট নেই।

আদি ক্যান্টিনেও চা খেতে পারত। কিন্তু ইচ্ছে হয়নি। সেই দুপুর থেকে একটানা বকবক করে যেতে হয়েছে ওকে। প্রোজেকশন কর্পের লোকজন এসেছে। লোকজন মানে তিনজন। মদন খুরানা, জিয়ানা বোস আর রুহান। রুহান আসলে জিয়ানার সঙ্গে সব জায়গাতেই যায়। ওরা এখনও কথা বলছে। কিন্তু তাতে আর আদির থাকার দরকার নেই। তাই গৌরের অনুমতি নিয়েই ও বাইরে এসে বসেছে।

মিটিং আর মিনিট দশেকের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তারপর সবাই চলেও যাবে। কিন্তু থাকতে হবে আদিকে। কারণ দুটো-একটা অফিশিয়াল আর একটা ব্যক্তিগত।

অফিশিয়াল কারণটা হল, কিগান আজকের মিটিং-এ ছিল না। ওকে গোটা ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে হবে। কারণ, স্যামুয়েল কুটিনহো গত সাতদিন আগে চাকরি ছেড়ে অন্য কোম্পানিতে জয়েন করেছেন আমদাবাদে। তার জায়গায় একজন নতুন জিএম আসার কথা। কিন্তু সে এখনও আসেনি। তাই কিগানকে আজকের মিটিং-এর সিনপ্‌সিস দেওয়াটা জরুরি। আসলে কিগান গেছে বসিরহাটে। ওদের কোম্পানির কাজে। তাই মিটিং-এর ব্রিফিংটা গৌর শশীবাবুর ভরসায় রেখে দিতে চায় না। আদিরও থাকতে কোনও আপত্তি নেই। আসলে ফিরতে হলে তো বাড়িতে ফিরতে হবে। সেখানে কে আছে ওর? মা? বাবা? তারা কে? আদি বুঝেছে জীবনে বাবা-মায়েদের নিয়ে একটা মিথ তৈরি করে দেওয়া হয়। ছোট থেকে শেখানোর চেষ্টা করা হয় যে, তারা ভগবান। আসলে পুরোটাই কন্সপিরেসি থিয়োরির মতো। যুগ যুগ ধরে বাবা-মায়েরাই তা তৈরি করে এসেছে। না, ভালবাসা টাসা আছে, নেই তা নয়। কিন্তু একটা সময় পরস্বার্থটাই বড় হয়ে ওঠে। বাবা-মায়েরা একটা সময় পরসম্পত্তির মতো মনে করে সন্তানকে। তাদের ইচ্ছের গণ্ডির ভেতর সন্তান থাকলে তবে সে সুসন্তান। না হলেই অশান্তি, রাগারাগি। সম্পর্ক নষ্ট। এই জন্যই তো বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রায় কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে আদি।

লোভ। বাবা-মায়ের লোভ দেখলে মাঝে মাঝে ঘেন্না হয় আদির। ওই বাড়ির তিনতলাটা নেওয়ার জন্য বাবা যেন হন্যে হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে সফল হয়েছে বাবা। তবে, না, কিগান বাবার নামে লিখে দেয়নি তিনতলাটা, দিয়েছে আদির নামে। আদি নিতে চায়নি। প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু কিগান শোনেইনি। হেসে বলেছিল, ‘আমার জিনিস তো, নাকি? ঠাকুরমা তো আমায় দিয়ে গিয়েছিল। তা আমার জিনিস তো আমি যাকে খুশি দিতে পারি।’

‘কিন্তু, দাদাভাই, কলকাতায় এলে তুই থাকবি কোথায়?’

‘বোকার মতো কথা বলিস না আদি। তুই থাকতে দিবি না? আর হোটেল, লজ, গেস্ট-হাউস সব বন্ধ হয়ে গেছে, নাকি?’

‘কিন্তু দাদাভাই, সব ভুলে গেলি তুই? বাবা তোকে কত খারাপ কথা বলেছে মনে নেই? মনে নেই কেমন করে অপমান করেছে তোকে?’

‘তো? তুই তো কিছু করিসনি। তাই না!’ কিগান হেসেছিল।

‘আমি?’ আদি থমকেছিল মুহূর্তের জন্য। কিছু করেনি ও। ঠিক। কিন্তু সেটাই কি কিছু করা নয়? কিগানকে বাবা জুতো ছুড়ে মেরেছিল পর্যন্ত। কিন্তু তার কি প্রতিবাদ করেছিল আদি? ও তো চুপ করে ছিল। দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল নিজের ঘরের। তবে?

কিগান বলেছিল, ‘শোন না, এই আদি, আমিও তো খুব কিছু ভালবাসা বা সম্মান কোনওদিন দিইনি কাকু-কাকিমাকে। ফলে ওসব নয়। তা ছাড়া, আরও দুটো কারণ আছে।’

‘কী কারণ?’ অবাক হয়েছিল আদি।

‘একটা এই যে, আমার এই পৃথিবীতে কেউ যদি আপন থেকে থাকে, সেটা হলি তুই। তাই তোকেই তো দেব।’

‘আর অন্যটা?’ জিজ্ঞেস করেছিল আদি।

‘সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য। কেমন!’

আর জিজ্ঞেস করেও কিছু জানতে পারেনি আদি। কিগান যেন একদম কুলুপ এঁটেছিল মুখে। একটা শব্দও বের করতে পারেনি। শুধু বলেছিল, ‘আমি পেপার্স তৈরি করাচ্ছি। তোকে যথাসময়ে ডাকব।’

আজ আদির থেকে যাওয়ার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে এটা। কিগান বলেছে যে, পেপার্স সব তৈরি হয়ে আছে। আদি এলেই দিয়ে দেবে। তাই আদিকে অপেক্ষা করতে হবে সেই জন্যও।

চা-টা খুব কিছু স্বাদের নয়। কেমন যেন পেঁপেপাতা সেদ্ধ করে তৈরি করা হয়েছে মনে হচ্ছে। তবে সঙ্গের লোকাল বেকারির তৈরি বিস্কিটটা ভাল লাগছে বেশ। ছোট ছোট বাদাম দিয়ে তৈরি। কুকির মতো। সামনের রাস্তা দিয়ে হু হু করে ট্রাক যাচ্ছে। মাল বোঝাই সব ট্রাক। সব বেনাপোল যাচ্ছে। এক্সপোর্ট হবে। বিস্কিটে ছোট ছোট কামড় দিয়ে তাই দেখছে কিগান।

সারাদিনের গরমটা এখন কম। বরং অদ্ভুত একটা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। হয়তো বৃষ্টি হয়েছে কোথাও। জুনের প্রথম এখন। বর্ষা শুরু হবে যে-কোনও দিন। এখানে হাওয়া অনেক পরিষ্কার। আদি বুকভরে শ্বাস নিল। কলকাতায় থেকে থেকে ওরা যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন সিন্থেটিক। কেমন যেন মেকি। এই অঞ্চলের হাওয়া-বাতাসের মধ্যে একটা সহজিয়া ভাব আছে। একটা আনন্দ আছে। এই যে আদি এখানে বসে আছে ওর মনে বেশ একটা হালকা ভাব এসেছে এরই মধ্যে। সবসময়ের দমচাপা মনখারাপটা আর নেই। তবে বাড়ি ফিরেই তো আবার চেপে ধরবে সব। আদি এখন বোঝে কেন কিগান আর কলকাতায় থাকতে চায় না!

দিঘির সঙ্গে কিগানের সম্পর্কটা প্রথমে বুঝতে পারেনি আদি। আসলে ততদিনে কিগানের সঙ্গে দূরত্ব অনেক অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তাই অতটা খেয়াল করেনি। তবে বাড়িতে মাঝে মাঝে মাকে কাজের মেয়েটির সঙ্গে চাপা গলায় আলোচনা করতে শুনেছিল আদি। তবে পাত্তা দেয়নি। আসলে ছেলে আর মেয়ের বন্ধুত্বটা মায়ের কাছে অন্যরকম ঠেকলেও আদির কাছে এর কোনও আলাদা গুরুত্ব ছিল না। তাই ও আমল দেয়নি।

ব্যাপার যে আছে সেটা আদি বুঝেছিল এক পুজোর সপ্তমীর সকালে। সাধারণত তিনতলায় বা ছাদে যেত না আদি। তবে সেদিন মায়ের তাড়নায় ছাদে যেতে বাধ্য হয়েছিল। কী? না, কেব্‌ল-এর তার নাকি খুলে গেছে বক্স থেকে। পুজো বলে কেউ এসে ঠিক করবে না। তাই মায়ের বকবক থেকে মুক্তি পেতে একরকম বাধ্য হয়েই ছাদে উঠেছিল আদি।

আর ছাদে উঠেই চিলেকোঠায় অস্পষ্ট নড়াচড়ার শব্দ, আলোর হেরফের টের পেয়েছিল আদি। কে আছে ওখানে? দাদাভাই? আদি পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল। জানলার পাল্লা খোলা ছিল। আর আদি তার পাশে দাঁড়িয়ে দম বন্ধ করে দেখেছিল দাদাভাইকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে দিঘি। দু’জনের ঠোঁট একাকার। চোখ বন্ধ। দু’জনেই যেন বিস্মৃত হয়েছে জগৎসংসার।

মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল আদি। কী দেখেছে ও? দাদাভাই? কিগান ব্যানার্জি? যে সন্ন্যাসীর মতো জীবন কাটায়, সে দিঘির সঙ্গে? না, বয়সের কথাটা যে মাথায় আসেনি আদির তা নয়। কিন্তু প্রেমের যে বয়স হয় না সেটা ভালই জানে আদি। যাজ্ঞসেনী আইয়ারের ঘটনাটা থেকে তো ও নিজেই শিখেছিল। তাই সেই চিন্তাটা মাথায় এলেও চিন্তাটার চলে যেতে সময় লাগেনি। ও আশ্চর্য হয়েছিল, এমনটা ঘটল কী করে—এই ভাবনায়। কখন হল এসব? আর দিঘিকে যতটুকু ও খেয়াল করেছিল তাতে তো ও কিগানের সম্পূর্ণ বিপরীত। দিঘি খুব হইচই করে। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। আর এই বয়সে যা হয়, সুন্দরী মেয়েদের প্রচুর ফ্যান জুটে যায়। তাদের বয়স অল্প হয়। আর তাই তাদের সঙ্গে কানেকশনটা খুব সহজেই হয়। কিন্তু সেখানে কিগান? কিগান এল কীভাবে এর ভেতর? দিঘির সম্পূর্ণ বিপরীত হল কিগান। বইমুখো, বন্ধুবান্ধবহীন, একা থাকতে পছন্দ করা একটা মানুষ। এদের মধ্যে যে কীভাবে প্রেম হল!

আদি সন্তর্পণে সরে এসেছিল জানলার পাশ থেকে। ও চায়নি আর এই দৃশ্যের সাক্ষী হতে। ছাদ থেকে নীচে নামতে নামতে ভেবেছিল, জীবন সত্যিই বিচিত্র। যখনই মানুষ মনে করে সমস্ত খেলা শেষ, ঠিক তখনই জীবন তার টুপির ভেতর থেকে বের করে আনে নতুন খেলা!

আদি জানত, কলেজজীবনে দাদাভাইয়ের একটা প্রেম ছিল। কিন্তু সেটা ভেঙে যাওয়ার পর তো দাদাভাই আর কোনও সম্পর্কে জড়ায়নি। কিন্তু যখন জড়াল তখন এমন একটা মেয়ের সঙ্গে! আশ্চর্য লেগেছিল আদির। তবে, কাউকে বলেনি ও। ঠিক করেছিল কাউকে বলবেও না।

তাই এর পর যখন দিঘির পাড়ার বন্ধু সুবর্ণ অভিযোগ করল ওর বাবার কাছে এসে, তখন ভীষণ অবাক হয়েছিল আদি। কী বলেছে সুবর্ণ? কিগান দিঘির ওপর জোর করেছে? জোর? কিন্তু ছাদে তো ও দেখেছিল দিঘি আঁকড়ে ধরে রয়েছে কিগানকে! যদি কেউ কাউকে আঁকড়ে ধরে তা হলে যে ধরছে তার ওপর জোর করা হয় কী করে? আদির হিসেব মিলছিল না। ওর আরও অবাক লাগছিল যখন শুনেছিল যে, দিঘি নিজে এমন কথা বলেছে!

কিগান কিন্তু কিছু বলেনি। সব মাথা নিচু করে হজম করে নিয়েছিল।

হ্যাঁ, আদি যায়নি। সব জানা সত্ত্বেও ও এগিয়ে যায়নি কিগানের জন্য। হয়তো মনে হয়েছিল অন্যের ঝামেলায় ঢুকব না। বা হয়তো মনে হয়েছিল যে-দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে দাদাভাইয়ের সঙ্গে, তা আর টপকানো সম্ভব নয়। আবার হয়তো যাজ্ঞসেনী আইয়ারের ঘটনাটাও পিছনে টেনেছিল ওকে। ব্যর্থ প্রেম আর তার থেকে জন্ম নেওয়া প্রতিহিংসার যে কত রূপ আছে তা আজকাল খুব বুঝতে পারে আদি। কিন্তু তখন বুঝত না। আফশোস হয় আদির। কেন বুঝত না ও? কেন বারবার ছাতা নিয়ে না বেরোলেই সেদিনই সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়?

‘আরে আপনি এখানে বসে রয়েছেন?’

জিয়ানার গলায় মুখ তুলে তাকাল আদি। বলল, ‘হ্যাঁ, আপনাদের হল?’

‘তা হল,’ জিয়ানা হাসল, ‘আপনাদের প্রোডাকশন ম্যানেজারটি, মানে আপনার দাদা, আসবে কখন?’

‘দাদা? ও আপনি…’ আদি থমকাল সামান্য, তারপর হাসল, ‘কিগানদা যে আমার জ্যাঠতুতো দাদা আপনাকে রুহান বলেছে নিশ্চয়ই!’

‘এগজ্যাক্টলি,’ হাসল জিয়ানা, ‘তবে রুহান আপনাকে একটা কথা বলেনি। কারণ, ও জানতই না তো কী বলবে?’

আদি হাসল, ভদ্রমহিলা কাজটা পেয়ে খুব উত্ফুল্ল। হবেই, এমন একটা কাজ একা জোগাড় করা চাট্টিখানি কথা নয়। তাই হয়তো একটু অন্যরকম, হিসেবের বাইরে কথা বলছে!

আদি বলল, ‘কী কথা?’

‘আপনার দাদা আমার ক্লাসমেট ছিল।’

‘তাই!’ অবাক হল আদি।

‘আর আমরা খুব ভাল বন্ধু ছিলাম। যদিও প্রায় দশ বছর যোগাযোগ ছিল না। আসলে বিয়ের পরে বিদেশে চলে গিয়েছিলাম তাই যোগাযোগ ছিল না। বাট আই মাস্ট সে আপনার দাদা খুব ভাল মানুষ।’

খুব ভাল বন্ধু ছিল! তাও সম্পর্ক ছিল না! কেন? আদির কেমন যেন আশ্চর্য লাগল।

জিয়ানা বলল, ‘কিগানটা এত অদ্ভুত, ওর তো টিকির দেখাই পাওয়া যায় না আজকাল। কাজটা পাওয়ার পর কতবার চেষ্টা করেছি ওর সঙ্গে কথা বলার, কিন্তু তেমন করে কথাই বলেনি! এতটুকু বদলায়নি। কেন যে সারা পৃথিবীর ওপর ওর রাগ?’

আদি হাসল, ‘দাদাভাইকে খুব রাগ করতে আমি বিশেষ দেখিইনি।’

‘ওর তো চাপা রাগ। মুখে হাসি থাকলেও তো ভেতরটা আগুন।’

হাসল আদি, ‘আপনি দেখছি খুব রেগে আছেন দাদাভাইয়ের ওপর!’

‘তা একটু আছি। আর থাকব নাই বা কেন? একটু ঠিকমতো কথাও কি বলতে নেই?’

আদি বলল, ‘সে কী! আপনারা আমাদের কাজ করছেন। দাদাভাইয়ের সঙ্গে তো আপনাদের রেগুলার ইন্টার্যাকশন করতে হবে। সেখানে যদি দাদাভাই না কো-অপারেট করে তবে তো বিপদ! আমায় গৌর স্যারকে বলতে হবে।’

‘আরে না না,’ আদিকে থামাল জিয়ানা, ‘কাজের কথা ঠিকই বলে। কিন্তু কাজেই কি পৃথিবী শেষ হয়?’

‘ও,’ হাসল আদি, ‘দাদাভাই তো অমনই।’

‘যাই হোক, থ্যাঙ্কস ফর ইয়োর টাইম। ওই মিস্টার দিওয়ানের গাড়ি বেরোবে এবার। আমি চট করে একবার ওঁর সঙ্গে দু’-একটা কথা সেরে নি। বাই দ্যা ওয়ে, মালিনীর কী খবর? বহুদিন যোগাযোগ নেই ওর সঙ্গে। ফোন করেছিলাম, বলছে নম্বরের অস্তিত্ব নেই। ব্যাপারটা কী? কোথায় আছে ও?’

‘মালিনী?’ আদির যেন কষ্ট হল কথাগুলো বলতে।

‘হ্যাঁ? কোথায় ও? একদম কর্পূরের মতো মিলিয়ে গেল মনে হচ্ছে!’

‘ও চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। এখন লন্ডনে গেছে ওর বাবার সঙ্গে। পরে দেশে ফিরবে। আর হ্যাঁ, ওর নতুন নম্বর হয়েছে। আপনাকে দেব?’

‘না না,’ জিয়ানা হাসল, ‘আমি নিয়ে কী করব আর! তবে, সি ইজ আ গ্রেট গার্ল। যেমন মিষ্টি দেখতে, তেমন ভাল মন। আচ্ছা, আসি।’

আদির মনে হল কে যেন অতিরিক্ত হাওয়া ভরে দিয়েছে ওর ফুসফুসে। মনে হল, এবার হয়তো ফুসফুস দুটো ফেটে বেরিয়েই যাবে মুখ দিয়ে।

মালিনী, মালিনী সিংহ। আদির জীবনে কী অদ্ভুত পরিবর্তন এনে দিয়েছে মেয়েটা। সেই উচ্ছৃঙ্খল, ডোন্ট কেয়ার টাইপ আদির জায়গায় এই আদিটা একদম নতুন। মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই চিনতে পারে না ও। ভাবে এই আদিটা এল কোত্থেকে? কোথায় গেল সেই মানুষটা?

আদি এখন চুপচাপ হয়ে গেছে অনেক। সেই ডিস্‌ক হপিং, সেই লেট নাইট, ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড সব ভুলে গেছে এখন। যে-কোনও মেয়ের সঙ্গে শুয়ে পড়ার জন্য বিছানাটাও আর টানে না ওকে। এখন শুধু ওর মনের ভেতর বড় বড় চিমনি থেকে বেরোনো ধোঁয়ারা গোল্লা কাটে। মনখারাপের মতো মেঘের তলায় সবুজ ছাতা নিয়ে বসে থাকে একটা বাচ্চা ছেলে। ওর মনের ভেতর নীল-হলুদ গামবুট পরে বাচ্চারা বৃষ্টির জল ভেঙে বাড়ি ফেরে। কষ্ট বলে একটা খিটখিটে আগুন মনের ভেতর বুঝতে পারে আদি। বুঝতে পারে ভীষণ মিষ্টি দেখতে একটা মেয়ে আর ওর দিকে তাকায় না বলে বজ্রবিদ্যুৎসহ ভারী বৃষ্টিপাত হয়ে চলে ওর ভাঙাচোরা জীবনে।

কেন আর ওর সঙ্গে যোগাযোগ করে না মালিনী? কেন? আদি ওর ওপর রাগ করেছিল বলে? শুধুমাত্র সেই জন্য? সেই জন্য মাত্র একবার ফোন আর একটা এসএমএস করে নিজের কর্তব্য সেরেছে মালিনী? এটুকুতেই কি ফুরিয়ে যায় সব? সারা হয়ে যায় সব কর্তব্য?

নার্সিংহোমটার সামনে দু’-চারটে গাড়ি প্রায় এ ওর কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ানোর মতো করে দাঁড়িয়ে ছিল সেদিন। আদি ট্যাক্সি থেকে নেমে প্রায় দৌড়ে ঢুকেছিল রিসেপশনে। নেশা সম্পূর্ণ কেটে গিয়েছিল ওর। খবর পেয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছিল আদি। ‘আসবে না’ ভেবেও না এসে থাকতে পারেনি ও। ‘মালিনীর বিপদ’, এই শব্দ দুটোই একদম অস্থির করে তুলেছিল ওকে। ও তো জানত না মালিনীর গ্র্যানির কী নাম! জানত না কোন রোগের জন্য ভরতি হয়েছেন গ্র্যানি!

রিসেপশনের মেয়েটি চোখ বড় বড় করে আদিকে দেখেছিল। জানতে চেয়েছিল আদি কী চায়? আদি নিজের শ্বাস সংযত করে বলেছিল, ‘খুব বৃদ্ধা কেউ একজন ভরতি হয়েছেন কি এখানে?’

‘খুব বৃদ্ধা মানে? আজ বিকেল থেকে পাঁচজন ভরতি হয়েছেন, যার মধ্যে চারজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা আর একজন বয়স্ক ভদ্রলোক।’

‘আরে, অনেক বয়স,’ আদি বোঝানোর চেষ্টা করেছিল।

‘সবারই অনেক বয়স। আর ফ্র্যাঙ্কলি অনেক বয়স কথাটা আপেক্ষিক। আপনার যাকে অনেক বয়স্ক মনে হবে, আমার তাকে তেমন মনে না-ই হতে পারে।’

‘কী আশ্চর্য! আমার খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হন উনি,’ আদি মরিয়া হয়ে বলেছিল।

‘তাই? কী নাম ওঁর?’ মেয়েটি ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করেছিল।

‘গ্র্যানি,’ কী বলবে বুঝতে না পেরে আদি বোকার মতো ফস করে বলে ফেলেছিল কথাটা।

‘গ্র্যানি?’ মেয়েটা চমকে গিয়েছিল ভীষণ, ‘মানে?’

‘মানে…ইয়ে…’ আদি তোতলাতে শুরু করেছিল।

‘মানে আপনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, আর আপনি তার নাম জানেন না?’ মেয়েটা ক্রমশ ভুরু দুটো বাঁকিয়ে সন্দেহকে ঢোকার মতো জায়গা করে দিচ্ছিল মনে।

আদি বুঝতে পারছিল না কী বলবে। ঠিক তখনই ও দেখেছিল রিসেপশনের পাশের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে মালিনী।

‘মালিনী!’ আদি প্রায় প্রাণ ফিরে পাওয়ার মতো করে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ওর সামনে।

মালিনী চমকে গিয়েছিল খুব, ‘তুমি!’

‘এলাম।’ আদি আর কী বলবে বুঝতে পারছিল না।

‘তোমায় খবর দিল কে?’ মালিনীর অবাক ভাব তখনও কাটেনি।

‘আমায়?’ আদি জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বলেছিল, ‘রুহান।’

‘ও, তাই!’ মালিনী হেসেছিল সামান্য, ‘ও আমায় ফোন করেছিল। আমিই তখন বলেছিলাম যে, গ্র্যানি ভরতি হয়েছে। ও জিজ্ঞেস করেছিল আসবে কি না। আমিই বারণ করেছিলাম, বলেছিলাম যে দরকার নেই, এভরিথিং ইজ আন্ডার কন্ট্রোল। এখন দেখছি ও নিজে না এসে তোমায় পাঠিয়েছে! আশ্চর্য! আর, ফ্র্যাঙ্কলি আদিত্য, তোমারও আসার দরকার ছিল না।’

‘এসব কী বলছ? দরকার ছিল না মানে?’ আদির অসহায় লাগছিল খুব। মনে পড়ছিল ওর মরণপণ প্রতিজ্ঞা যে, আসবেই না। কিন্তু কত সেকেন্ডের জন্য ছিল সেই প্রতিজ্ঞা? মত বদলাতে তো মুহূর্তও লাগেনি ওর। ট্যাক্সি ধরে নিমেষে রওনা দিয়েছিল নার্সিংহোমের উদ্দেশে। আর তারপর মালিনী বলছে দরকার ছিল না আসার!

মালিনী বলেছিল, ‘বাদ দাও। আমায় এখন একটু বেরোতে হবে।’

‘কোথায়?’ অবাক হয়েছিল আদি।

‘ওষুধ আনতে। এরা তো দেবে না। আমাকেই কিনে দিতে হবে।’

‘তুমি আমায় দাও। আমি এনে দিচ্ছি।’ আদি হাত পেতেছিল।

‘ডোন্ট বদার ইয়োরসেল্‌ফ। এটা কোনও ব্যাপার নয়।’

‘মালিনী,’ আর নিজেকে সামলাতে পারেনি আদি, ‘এবার আমি কিন্তু চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করব। তুমি কী ভেবেছ?’

‘আস্তে,’ মালিনী শান্ত গলায় বলেছিল।

‘এভরিথিং শুড হ্যাভ আ লিমিট। দাও প্রেসক্রিপশন,’ আদি প্রায় ছিনিয়ে মালিনীর হাত থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে নিয়েছিল। তারপর বলেছিল, ‘তুমি চুপ করে এখানে তো বসো। একটা কথা বলবে না। খবরদার, একটাও কথা বলবে না। আমি নিয়ে আসছি ওষুধ।’

‘ঠিক আছে। তবে না হলেও…’ মালিনী আলতো গলায় বলেছিল।

‘শাট আপ। তোমার প্রথমেই আমায় খবর দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা দাওনি। আর এখন এসব বলছ? চুপ করে বোসো।’

আদির চোখে-মুখে এমন কিছু একটা ছিল যার ফলে মালিনী রিসেপশনের সামনের সোফায় বসে পড়েছিল চুপ করে। আদি একবার রাগী রাগী চোখ করে তাকিয়েছিল ওর দিকে। তারপর বেরিয়ে গিয়েছিল। ও নর্থের ছেলে হলেও সাউথ কলকাতাও ওর কাছে অপরিচিত নয়। বিশেষ করে এই ট্রায়াঙ্গুলার পার্ক চত্বরটা। কলেজ লাইফে ওর প্রচুর বান্ধবী এই অঞ্চলে থাকত। ফলে ওষুধ কোথায় পাওয়া যায় সেটা আদি খুব ভালই জানে।

আধঘণ্টার ভেতরে ওষুধ নিয়ে নার্সিংহোমে ফিরে এসেছিল আদি। দেখেছিল সোফায় চোখ বন্ধ করে বসে রয়েছে মালিনী।

এর পর সাতদিন গ্র্যানি নার্সিংহোমে ছিল। আর রোজ অফিসের পরে আদি নিয়ম করে আসত নার্সিংহোমে। প্রথম দু’দিন মালিনী আপত্তি করলেও তার পরে আর করেনি। বরং, আদির মনে হত কোথায় যেন মালিনী এক্সপেক্ট করছে ওকে। যেন চাইছে আদি আসুক। ততদিনে মালিনীদের অন্য আত্মীয়রাও এসে পড়েছিল। তারা অন্য বড় নার্সিংহোমেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল গ্র্যানিকে। কিন্তু মালিনী নিতে দেয়নি। অবশ্য তার প্রয়োজনও ছিল না। গ্র্যানি বেশ দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছিল। আর আট দিনের দিন বাড়িতেও ফিরে গিয়েছিল।

মালিনীও যেন অনেকটা পুরনো মালিনী হয়ে উঠেছিল তারপর। সেই হাসি, অল্প ইয়ারকি আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট মনোযোগ। আদি শ্বাস নিতে পারছিল আবার। আবার সকালে ঘুম থেকে উঠে পাশবালিশে মুখ ডুবিয়ে চিন্তা করতে পারছিল মালিনীকে। শপিং উইন্ডোয় কোনও সুন্দর ড্রেস দেখলে মনে মনে কল্পনা করতে পারছিল মালিনীকে কেমন লাগবে এটা পরলে!

তারপর একদিন মালিনী অদ্ভুত সুন্দর একটা খাবার টিফিন বক্সে করে এনে বলেছিল, ‘এটা তোমার। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খেয়ো। আমি বানিয়েছি।’

‘তুমি? তুমি রান্না করেছ!’ আদি অবাক হয়েছিল।

‘হ্যাঁ, করি তো! কেন চাপাডাঙায় করেছিলাম মনে নেই?’

‘তাও…মানে…’

‘এটা নতুন একটা আইটেম। ভাবলাম তোমায় গিনিপিগ করি।’

সেদিন অল্প হাওয়া বইছিল। গাড়িটা দাঁড় করিয়ে মালিনী আর আদি হাঁটছিল ময়দানের ঘাসের ভেতর দিয়ে। দূরে গাড়ির ভেতরে বসে গল্পের বই পড়ছিল মল্লার।

অফিস থেকে কনসালট্যান্টদের ওখানে যাওয়ার কথা ছিল সেদিন। কিন্তু মাঝপথে ওরা জানতে পারে যে, মিটিং ক্যানসেল হয়েছে। তাই আর যেতে হয়নি। তার বদলে, একরকম অফিস ডুব মেরেই ওরা ঘুরছিল ময়দানে।

মার্চের রোদ পশ্চিম থেকে পাকা সুপুরির রং মেখে চুঁইয়ে পড়ছিল মেঘ ফাটিয়ে। পশ্চিমে ভাঙাচোরা কিছু মেঘ জমেছিল সেদিন। আদির ভাল লাগছিল খুব। মানুষ যার কাছে যেতে চায়, যার সঙ্গে থাকতে চায়, তার কাছে পৌঁছোতে পারলে যেমন অদ্ভুত এক হাওয়া বইতে থাকে শরীরে, তেমনই হাওয়ায় ডুবে ছিল আদি। টিফিন বক্সটা হাতে নেওয়ার সময় আলতো করে মালিনীর আঙুলে আঙুল ঠেকে গিয়েছিল। আদির মনে হয়েছিল সেই মুহূর্তটুকুই আসল। সেই মুহূর্তটুকুই পরম। এর জন্যই এতদিন অপেক্ষা করে ছিল আদি।

সূর্য নিচু হচ্ছিল। দূরে ইডেন গার্ডেন্সের আলোর স্তম্ভগুলোকে মনে হচ্ছিল গল্‌ফ ব্যাগ থেকে বেরিয়ে থাকা গল্‌ফ ক্লাব। পাখিরা কিচিরমিচির বাড়িয়ে দিয়েছিল ময়দানের সমস্ত গাছে। দূরে দূরে ছড়িয়ে থাকা মানুষেরা কেমন যেন গতি কমিয়ে দিয়েছিল তাদের।

আর পারছিল না আদি। আর ধরে রাখতে পারছিল না নিজেকে। বুকের ভেতর কষ্টটা যেন বেড়ে গিয়েছিল কয়েক হাজার গুণ। মনে হচ্ছিল এবার বলে দেবে। বলেই দেবে, তাতে যা হওয়ার হোক।

আদি হঠাৎ থেমে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল মালিনীর মুখোমুখি। বলেছিল, ‘মালিনী।’

‘কী আদি?’ মালিনীর গলায় স্বর হাওয়া-মিঠাইয়ের মতো লাগছিল।

আদি! এতদিন পরে? আদির হাত কাঁপছিল, গলা শুকিয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল জিভ জড়িয়ে আসবে যে-কোনও সময়ে। তবু ও বলেছিল, ‘মালিনী, আমি…আমি বহুবার ভেবে দেখেছি। বহুবার নিজেকে আটকানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারলাম না। আমি যেখানেই থাকি আমার শুধু তোমার কথা মনে পড়ে। শুধু তোমার কাছে থাকতে ইচ্ছে করে। আমার শুধু ইচ্ছে করে তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে। আমি আর কিছু চাই না। শুধু তোমায় চাই মালিনী। শুধু তোমার হয়ে থাকতে চাই। আমার আর কিচ্ছু ভাল লাগে না।’

মালিনী কোনও কথা না বলে চুপ করে তাকিয়েছিল আদির দিকে।

আদি আবার বলেছিল, ‘মালিনী আমি তোমায় বলছি। তুমি কি শুনতে পাচ্ছ? বুঝতে পারছ?’

মালিনী কিছু না বলে হেসেছিল শুধু।

আদি আবার বলেছিল, ‘আমি যে তোমায় কী করে বোঝাই? কী করে বলি? আমি…আমার…মানে…দিনগুলো যে কী করে কাটে! মনে হয়…মনে হয়…তুমি…তুমি হাসছ কেন? কিছু বলবে না? সত্যিই কিছু বলবে না?’

মালিনীর মুখে শেষ আলোর রং এসে লেগেছিল। গালের টোল দুটো জেগে উঠেছিল নিখুঁতভাবে। চোখ দুটোর ভেতর যেন সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বাদামি গাছের জঙ্গল। মালিনী হেসে ঠোঁটটা কামড়ে ধরেছিল আলতো দাঁতে। তারপর বলেছিল, ‘আমি কত নম্বর? মানে শুয়ে শুয়ে নয়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কত নম্বর?’

সূর্যের পাত আড়াআড়িভাবে এসে যেন দ্বিখণ্ডিত করে দিয়েছিল আদিকে। আচমকা প্রশ্নের ধারে থতমত খেয়ে গিয়েছিল আদি। তারপর বুঝেছিল সারা শরীর জুড়ে অসংখ্য দমকল ঘণ্টা বাজিয়ে মাথার দিকে ছুটছে। ও চোয়াল শক্ত করে তাকিয়েছিল মালিনীর দিকে। মালিনী হাসছে! কোনও মানুষ নিজের সমস্তটা অসহায়ের মতো কারও সামনে অপর্ণ করার পর কেউ যদি এমন করে হাসে, তবে সেটাকে কী বলে? অপমান? অবজ্ঞা? নাকি আরও অন্য কিছু?

আদি মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ। তারপর আচমকা দৌড়োতে শুরু করেছিল। মাঠ ভেঙে, গাছপালাদের পাশ দিয়ে, পিছনে হতভম্ব মালিনীকে রেখে দৌড় শুরু করেছিল আদি। মালিনী ডেকেছিল কি? শোনেনি। শুনতে চায়নি ও। শুধু ও দেখছিল সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাদামি গাছের জঙ্গল থেকে হিংস্র কোনও পশু আক্রমণ করছে ওকে। ওর জীবন বিপন্ন। ওকে পালাতেই হবে না হলে মৃত্যু নিশ্চিত।

দৌড়ে গাড়ির সামনে এসে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়েছিল আদি। পিছনে তাকায়নি। পিছনে ফিরে তাকায়নি একবারও। শুধু দরজাটা খুলে হাতের টিফিন বক্সটা পিছনের সিটে রেখে, নিজের ব্যাগটা তুলে মল্লারকে বলেছিল, ‘ম্যাডামকে নিয়ে যেয়ো। আমার অন্য কাজ আছে।’ তারপর রাস্তা দিয়ে যাওয়া চলতি একটা ট্যাক্সিকে দাঁড় করিয়ে উঠে পড়েছিল। আর মোবাইলটা বন্ধ করে দিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে।

না, এদিক-ওদিক কোথাও যায়নি। বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল আদি। একা নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল চুপ করে। মা অবাক হয়েছিল খুব। জানতে চেয়েছিল কী হয়েছে। কিন্তু বলেনি আদি। কিচ্ছু বলেনি, কাউকে বলেনি। তবু বলতে ইচ্ছে করছিল ওর। মনে হচ্ছিল কে যেন নেই, কার যেন থাকার কথা ছিল। কাকে যেন সব বলতে পারত ও! আর হঠাৎই ওর মনে পড়েছিল দাদাভাইয়ের কথা, কিগানের কথা। যাজ্ঞসেনীর থেকে ফেরত এসে তো কিগানের ঘরের বিছানার ওপরই উপুড় হয়ে শুয়ে কেঁদেছিল। কিন্তু কিগান তো আর নেই। এখন আদি কোথায় যাবে? আদি যাবে না কোথাও। আদি আর যায় না কোথাও। ওর মনে দাদাভাই যেমন ক্রমশ পোর্সেলিনের হয়ে গেছে, তেমন হয়তো ও নিজেও ক্রমশ পোর্সেলিনেরই হয়ে গেছে।

তারপর সাতদিন ছুটি নিয়েছিল আদি। পরদিন সকালে ফোন অন করে মিস্‌ডকল অ্যালার্টে দেখেছিল একটা ফোন এসেছে মালিনীর থেকে। আর সেই দিন এসেছিল একটা মেসেজ। তাতে মালিনী ছোট করে লিখেছিল, ‘আমায় একবারও কিছু বলতে দিলে না! আমি আর কোনওদিন তোমায় ফোন করব না!’

ফোন করবে না তো করবে না। মহারানি ভিক্টোরিয়া নাকি যে, ফোন করবে না বলে হেদিয়ে মরে যাব? আদি চোয়াল শক্ত করে নিজেকে প্রস্তুত করেছিল। মনে মনে ভেবেছিল দাদাভাই সারাজীবন এত কিছু সামলাতে পারলে, ও পারবে না? পারবে, নিশ্চয়ই পারবে। ওকে যে পারতেই হবে।

সাতদিন পর অফিসে ঢোকার সময় একবার বুকটা হাওয়া লাগা পালের মতো কেঁপেছিল আদির। তবে সামলেছিল ও। ধমক দিয়ে, চোখ পাকিয়ে, ঠিক সামলে নিয়েছিল নিজেকে। তারপর মাথা উঁচু করে ঢুকেছিল অফিসে।

গত চারদিন আগে মালিনী নাকি চাকরি ছেড়ে চলে গেছে! প্রথম বলটাই গুড লেন্থ স্পট থেকে আচমকা লাফিয়ে পাঁজরে আঘাত করেছিল আদিকে। চাকরি ছেড়ে চলে গেছে! মালিনী! সে কী! কিন্তু এখানে তো এমন হুট করে কাজ ছেড়ে চলে যাওয়া যায় না? তবে? ও গেল কী করে?

আদি খবর নিয়ে জেনেছিল যে, যত ছুটি জমা ছিল তা নিয়ে, আর স্যালারির একটা অংশ ক্ষতিপূরণ বাবদ দিয়ে নাকি চলে গেছে মালিনী। ওর বাবার সঙ্গে গতকালই লন্ডনে উড়ে গেছে ও।

আদি জানত মালিনীদের বাড়ির অবস্থা খুব ভাল। চাকরিটা ও করত শখ করে, আর নিজের পড়াশোনাটাকে কাজে লাগানোর জন্য। তাই হয়তো চাকরিটা ছাড়তে হাত কাঁপেনি ওর। কিন্তু আদিকে একবারও বলল না? একবারও ভাবল না আদির কথা? আদি যে কষ্ট পাবে সেটা মাথাতেও আনল না একবারের জন্য? একটা এসএমএস করেও তো জানাতে পারত!

আদির মনে হচ্ছিল কে যেন ওর শরীরের সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে। কে যেন মাথা ফুটো করে ঢেলে দিয়েছে অ্যাসিড। নিজেকে কেমন যেন পোড়ো, ফোকলা বাড়ির মতো মনে হচ্ছিল ওর। লু-তে গিয়ে চোখের জল ঢাকার জন্য বারবার জলের ঝাপটা দিচ্ছিল ও। তবু পারছিল না আদি। মেঝেতে বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে হাউহাউ করে কেঁদেছিল ও। শুনেছিল ভালবাসার কান্নার প্রতিটা ফোঁটা জল যদি মাটিতে পড়ে, তবে সেখানে একটি করে গন্ধরাজ ফোটে। বাথরুমের মেঝেতে অসংখ্য জলের ফোঁটা পড়েছিল। কিন্তু সাদা মার্বেল ফাটিয়ে কোনও ফুল আসেনি। আদি বুঝেছিল, ফুল আসে না। রাজকুমারী কোনওদিন অপেক্ষা করে না রাখাল বালকের জন্য। নদীর পাড়ে একলা বসে থাকা ছেলেটির কাছে কোনওদিন পৌঁছোয় না কোনও চিঠি।

লু থেকে বেরিয়ে লম্বা করিডর দিয়ে যেতে যেতে আদির মনে হয়েছিল, তবে কি এই শেষ? তবে এইভাবেই শেষ হল ওদের দেখাশোনো? এর পর কী? নিস্তব্ধতা? এর পর কী? পাথুরে একটা উপগ্রহকে জ্বলন্ত ফোসকার মতো বয়ে বেড়ানো আজীবন? আমৃত্যু?

আর-একটা চা বলল আদি। একটু আগে খুরানা-জিয়ানা-রুহান আর গৌরের গাড়ি দুটো বেরিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় জিয়ানা হাত নেড়েছে ওর দিকে তাকিয়ে। রুহান সামনের সিটে বসে ছিল। ও আর আজকে এগিয়ে এসে কথা বলেনি। আদি জানে রুহান আর কোনওদিন এগিয়ে আসবে না হয়তো নিজের থেকে। কিন্তু আদি চায় রুহান আসুক। ও একসময় একদম অনাবশ্যকভাবে খুব বাজে ব্যবহার করেছিল রুহানের সঙ্গে। কেন, ঠিক জানে না। আসলে রুহানের ক্যালাসনেস দেখলে রাগ হত ওর। ওর বন্ধু হয়ে দাদাভাইয়ের ক্লোজ হয়ে গিয়েছিল বলে রাগ হত। ওর অমন মেরুদণ্ডহীন ভাবে লোকের সামনে দাঁড়ানো দেখে রাগ হত আদির। তারপর মালিনী যখন ওর সঙ্গে কথা বলা বাড়ায় তখন তো রাগটা চরমে ওঠে। রাগ আর হিংসে। তখন মনে হত রুহানকে কুচি কুচি করে কেটেই ফেলে একদম। কিন্তু তারপর যখন মালিনীর বিপদের সময় রুহান এসএমএস করেছিল ওকে, তখন কোথায় জানি মরে গিয়েছিল আদি। কোথায় জানি রুহান একদম শেষ মারটা দিয়ে গিয়েছিল ওকে।

না, ওই মার খেয়ে কষ্ট হয়নি আদির। বরং মরে যাওয়া বাচ্চাটাই যেন জেগে উঠেছিল কোথাও। বেঁচে উঠেছিল কোথাও। কিন্তু আদির গম্ভীর আর বড় হয়ে যাওয়া মানুষটা এখনও বাচ্চাটাকে শেকল খুলতে দিচ্ছে না। ওর ইচ্ছে করছিল রুহানের সঙ্গে ডেকে কথা বলে, কিন্তু কেন যে পারল না! অনেক সহজ জিনিসও বড় হয়ে গেলে কেমন যেন জটিল আর দুরূহ হয়ে যায়!

চা-টা হাতে নিয়ে বসে রইল আদি। আবেশও আজ কেমন যেন এড়িয়ে গেল ওকে। দূর থেকে হাত তুলে চলে গেল।

সন্ধে ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে এখন। মাথার ওপর পাক মারছে মেঘ। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে খুব। বৃষ্টি হয়েছে। খুব কাছেই বৃষ্টি হয়েছে কোথাও। এখানেও নামবে বোধহয়। যা গরম পড়েছে! নামলে ভালই হয়! আদি চায়ের কাপে চুমুক দিল।

ইলেকশনের পর গোটা অঞ্চলটাই কেমন যেন শান্ত হয়ে আছে। এবারও এখানে সুধাদি জিতেছে। এতে একটু ভয় ছিল আদির। জমিটা না আরও জলের তলায় তলিয়ে যায়। কারণ, সুধাদির কোনও ডিমান্ডই তো ওরা মানেনি। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল আদি। এক সকালে যখন কিগানের ফোন পেয়েছিল ও। কিগান বলেছিল, ‘নে, উঠে পড়। জমিটা হয়ে গেছে।’

‘অ্যাঁ?’ খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল আদি।

‘অ্যাঁ নয়, হ্যাঁ। গৌর স্যারকেও বলেছি। উনি আসছেন আজ। তুইও চলে আয়।’

কীভাবে হল, কেন হল, কিচ্ছু জানে না আদি। এ যেন দস্যু মোহন সিরিজ। যেন ‘কীসের থেকে কী হইল আর মোহন পলাইয়া গেল’ ধরনের ব্যাপার। সপ্তাহ দুয়েকের ভেতর ভোজবাজির মতো রাঘব চক্রবর্তী দিয়ে দিলেন জমিটা! তবে না, পুরোটা নয়, সত্তর শতাংশ। আর তাতেই রাজি হয়ে গেলেন গৌর। কারণ, জার্মান কোম্পানিটি নাকি আর অপেক্ষা করতে রাজি নয়।

তবে কী হল বুঝতে না পারলেও, আপদ যে ঘাড় থেকে নেমেছে তাতেই খুশি আদি। শুধু তাই নয়, আদি গৌরকে বলে এর মধ্যে সুধাদির সঙ্গে মিটিং করিয়েছে একদিন। আর তাতে বলা হয়েছে যে, নতুন ফ্যাক্টরিতে সমস্ত কর্মী এই অঞ্চল থেকে নেওয়া হবে। এতে সুধাদির প্রেস্টিজও বেড়েছে। আর বারাসতের আবাসনের ঝামেলাটার বিষয়েও যে সুধাদি দেখবেন, সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

একটা জমির গিট খুলতেই পর পর অনেক কিছু সহজ হয়ে গেছে। আর পুরো ব্যাপারটা কিগান গৌরকে এমন করে বলেছে যাতে মনে হয় আদিরই কৃতিত্বে সব হয়েছে। সেই দাদাভাই। গুড ওল্ড দাদাভাই। ঘুড়ি পেড়ে দেওয়া থেকে আজ পর্যন্ত একই রয়ে গেছে মানুষটা। অপেক্ষা করবে আদি, দাদাভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করবে। যাজ্ঞসেনী আইয়ারের সেই ঘটনার পর দাদাভাইকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস না করে সরে যাওয়াটা খুব ভুল হয়েছে আদির। দিঘির ব্যাপারটায় দাদাভাইয়ের পিছনে না দাঁড়ানোটাও ভুল হয়েছে। অনেক, অনেক ভুল করে এসেছে আদি। এবার সেইসব শুধরে নিতে হবে।

‘দাদা, আপনি কি আদিত্য ব্যানার্জি?’

আদি মুখ তুলে তাকাল। ছেলেটা রোগা। গায়ে গাঢ় রঙের গোল গলার টি-শার্ট। চেহারায় একটা চোয়াড়ে ভাব আছে। আদি জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি?’

‘আমি ত্রয়ণদার কাছ থেকে আসছি। ওই সামনে দাঁড়িয়ে চারটে ছেলের সঙ্গে কথা বলছে ত্রয়ণদা। সঙ্গে আপনাদের শশীবাবুও রয়েছেন। আমায় বললেন অসুবিধে না থাকলে যদি একটু আসতেন।’

‘আমি! কেন?’ আদির অবাক লাগল।

‘জানি না দাদা। তবে আপনাদের বয়লারের অ্যাশ আবার উড়ে যাচ্ছে গ্রামে। আপনাদের কিগানবাবু তো নেই। তাই শশীবাবুকে বললাম। উনি ত্রয়ণদার সঙ্গে কথা বললেন আর বললেন যে, আপনি যখন আছেন, তখন…’

‘আচ্ছা, চলো,’ আদি এক চুমুকে চা শেষ করে চায়ের দাম দিয়ে এগোল।

ছেলেটা যতটা বলেছিল তার থেকে আরও কিছুটা দূরে, জঙ্গলের দিকে গিয়ে কয়েকজনকে জটলা করতে দেখল আদি। এদিকটায় আলো নেই বিশেষ। তার ওপর আকাশে মেঘ ঘন হচ্ছে। আদি বুঝল না যে, গ্রাম আর বয়লার যেদিকে, সেদিকে না থেকে এরা জঙ্গলের দিকে কী করছে! শশীবাবুই বা ফ্যাক্টরি ছেড়ে এদের সঙ্গে এখানে কী করছে?

জটলার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াল আদি। মানুষগুলোকে আবছা লাগছে। স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে না। ও ডাকল, ‘শশীবাবু, শশীবাবু।’

‘শুয়োরের বাচ্চা!’ জটলার থেকে যে এগিয়ে এল গলা শুনে তাকে চিনল আদি। ত্রয়ণ! জায়গাটা একদম নির্জন। আদির মন কুডাক দিল। এখানে এসে ঠিক করেনি ও। একদম বুঝতে পারেনি যে এটা ফাঁদ। ত্রয়ণের গলার স্বর এক নিমেষে ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, একদম অচেনা একটা ছেলের কথা শুনে এভাবে আসাটা মূর্খামি হয়েছে।

আদি দ্রুত পিছু হটল। ত্রয়ণের গলার স্বর ওকে পালাতে বলছে এখান থেকে। কিছুটা দূরেই হাইওয়ে। সেখানে উঠতে পারলে আর কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। আদি পিছন ঘুরে দৌড় লাগানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তার আগেই মাথার পিছনে ভারী মতো কী একটা এসে ঠক করে লাগল। আদির মনে হল মাথায় যেন চকোলেট বোমা ফাটল একটা। দূরের হাইওয়ের পাশের ঝুপড়ি দু’-একটা দোকান কেমন যেন দুলে উঠে কাত হয়ে গেল। মাথার ওপর ঘন অন্ধকার। চোখের পাতা দুটো ভারী। কালো কাচের ওপার দিয়ে দেখার মতো, আদি জ্ঞান হারানোর আগে দেখল দু’-চারটে আবছায়া মাথা নিচু হয়ে ঝুঁকে পড়ছে ওর ওপর। তারপর বাকিটা নিস্তব্ধতা।

হলুদ আলোটা কেমন যেন চোখে লাগছে। ভাঙাচোরা এই বাড়িটা কোথায়? ভারী চোখের পাতা কষ্ট করে খুলে আদি তাকানোর চেষ্টা করল। কোথায় রয়েছে ও? আঃ। মাথার পিছনে, ঘাড়ে ব্যথা। হাত তুলতে গিয়ে আবার ব্যথা পেল আদি। আরে, হাত দুটো বাঁধা যে হাতলের সঙ্গে! চেয়ারের হাতল। চেয়ার? ও চেয়ারে বসে রয়েছে? চোখ খুলে তাকাতে গিয়েও পারল না আদি। বিদ্যুৎস্পর্শের মতো একটা ব্যথা ছোবল মারল ঘাড়ে আর মাথায়। কিন্তু নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল আদি। চোখ বন্ধ রাখলেও অজ্ঞান হওয়া চলবে না।

‘বানচোতটা নড়ছে।’

‘জল মার। শালা অনেক ঘুমিয়েছে। এবার খাওয়াব মালটাকে। আমায় রেস্টুরেন্টে খাইয়েছিল না? এবার সত্যিকারের জন্য খাওয়াব। পিছন দিয়ে।’ ত্রয়ণের গলা।

নোংরা, তেতো জল ছপাৎ করে এসে মুখে পড়ল আদির। বাধ্য হয়ে কোনওমতে চোখ খুলল ও।

‘কী চাঁদ, আমায় বুলু দিয়ে জমিটা বাগিয়ে নিলে? আমার ক্যাশ মেরে দিলে?’ ত্রয়ণ হাসল।

হ্যাজাকের আলোয় ওর রোগা দাড়িওয়ালা মুখটাকে কেমন যেন বিকৃত লাগছে।

‘আমি…আমি…’ আদির কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে।

‘ন্যাংটো খোকা যে! কথা ফোটেনি?’ ত্রয়ণ ঠাস করে চড় মারল আদিকে, ‘শুয়োরের বাচ্চা, তোকে আজ নামাব, তারপর তোর ওই নীল চোখো দাদাটাকে দেব। আমার প্ল্যান মাটি করা? আমায় বাঁশ দেওয়া?’

‘আমি…আমি সত্যি কিছু জানি না ত্রয়ণবাবু। আমার… আমার কোনও ধারণা নেই…’ আদির কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে। তবু বলল।

‘আজ তোকে আমি দেখছি। তোর দাদার জন্য আমার এখানে আসা বন্ধ হয়েছে। পার্টি থেকে সাসপেন্ড হয়েছি। তোকে ছাড়ব না শুয়োরের বাচ্চা।’ ত্রয়ণ এলোপাথাড়ি হাত-পা চালাল। হাত-পা বাঁধা আদি অসহায়ের মতো সহ্য করল সেইসব।

যন্ত্রণায় শরীর ছিঁড়ে যাচ্ছে আদির। তবু বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। কেন এমন করছে ত্রয়ণ? ওকে যখন দরকার পড়েনি তখন টাকা দেবে কেন? টাকা না পেয়ে ওকে মারছে ত্রয়ণ! তবে রাহির কথা আসছে কেন? আর কিগান? কিগানই বা এর মধ্যে এল কোত্থেকে?

‘শেষ করে দে শালাকে।’

আদি কেঁপে উঠল। মেরে ফেলবে? মেরে ফেলবে ওকে? কেন? কী করেছে ও? কেন মারবে? কষ্ট হচ্ছে আদির। ভয় লাগছে। ও কোনওমতে বলল, ‘প্লিজ আমায় মারবেন না। আমি তো কোনও ক্ষতি করিনি। প্লিজ।’

‘দালাল। পুঁজিপতিদের দালাল। আমাদের স্বার্থ মেরে ‘ক্ষতি করিনি’! জানোয়ার!’ অন্য একটা ছেলে এগিয়ে এল এবার। হাতে অদ্ভুত দেখতে একটা বন্দুক। দেশি পিস্তলের মতো। কাগজে এর ছবি দেখেছে আদি। তবে কি সত্যিই মারবে ওকে? আদির চোখে জল চলে এল। ও কী করবে? এ কী হচ্ছে? ও শেষবারের মতো চিৎকার করে উঠল, ‘মারবেন না। দয়া করে মারবেন না। আমায় মেরে কী হবে?’

‘শালার মুখে ন্যাকড়া মার। মার ন্যাকড়া,’ ত্রয়ণ ধমক দিল।

সঙ্গে সঙ্গে দু’জন এসে ন্যাকড়া গুঁজে মুখটা বেঁধে দিল আদির। আদি দেখল হলুদ হ্যাজাকের আলোয় ছেলেটা দেখছে ওকে। হাতের বন্দুকটা এখনও নামানো। চোখমুখ অসম্ভব শান্ত। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আদির চোখ দিয়ে জল বেরোতে লাগল। আর উপায় নেই। চোখ বন্ধ করে ফেলল আদি। আর তখনই দেখল মালিনীকে! একটা পাহাড়ি বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরে তাকিয়ে রয়েছে মালিনী। হাওয়া দিচ্ছে, আর হাওয়ায় নরম চুল উড়ছে ওর।

দুম্। আদি মাথাটা নামিয়ে ফেলল। যন্ত্রণা হল কি? গুলিটা শরীরে ঢোকার ঠিক কতক্ষণ পরে যন্ত্রণা বোঝা যায়! এক মাইক্রোসেকেন্ড? না দুই? কিন্তু যন্ত্রণা হচ্ছে না কেন? এখনও কি এক মাইক্রোসেকেন্ড সময় পার হয়নি?

দুম্। এবার চোখ খুলল আদি। সামনের ছেলেটা মাটিতে পড়ে আছে, ছটফট করছে। আশপাশের ছেলেগুলো ছত্রভঙ্গ। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আর অন্ধকার বাইরেটায় অনেক পায়ের শব্দ। হল্লার শব্দ। আদি দেখল ত্রয়ণ নিচু হয়ে বন্দুকটা কুড়িয়ে নিমেষে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর পিছনের হ্যামারটা হাত দিয়ে টেনে হাতটা ওঠাল আদির দিকে। আর সঙ্গে সঙ্গে বাইরের থেকে সাদা বিদ্যুতের মতো কে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল ত্রয়ণের ওপর। তবু বন্দুকটা চলল। আদি বুঝল খুব গরম একটা ধাতু এসে ডুবে গেল ওর কাঁধের পেশিতে। রক্ত ছলকে উঠল। চেয়ার উলটে পড়ে গেল আদি। ওর মনে হল কে যেন ওর শিরায় পেট্রল ভরে তাতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।

একটা গোলকের ভেতর শুয়ে আছে আদি। ওই ওপরে গোলকের আবছা হলদেটে ছিদ্র। আর তার ভেতর দিয়ে ভেসে আসা কথাগুলো কেমন যেন অদ্ভুত শোনাচ্ছে। আরে, ওটা কার মুখ? ‘আদি, আদি,’ করে কে ডাকছে? দাদাভাই? আরও সব গলা কার? ছিদ্রটা ছোট হচ্ছে। আগুন ক্রমশ ছড়াচ্ছে শরীরে। আদিকে কি কেউ খুলে ফেলল চেয়ার থেকে? কেউ কোলে তুলল? এটা কীসের গন্ধ? মাস্ক? কে যেন এই গন্ধটা লাগায়? কার থেকে ছোটবেলায় গন্ধটা পেত ও? ছিদ্রটা বন্ধ হয়ে আসছে। সব কথা জড়িয়ে যাচ্ছে কানে। ও না ভেবেছিল এবার সব ভুলগুলো ঠিক করে দেবে? তা হলে? সেটা কি আর হল না? তবে কি আর নতুন করে সব শুরু করা হল না? ওই তো পাহাড়ি বাংলোর বারান্দা। শূন্য। কে দাঁড়িয়েছিল যেন ওখানে? মালিনী? মালিনী তুমি কোথায়? গাছ চারদিকে। কুয়াশা রিবনের মতো জড়িয়ে রেখেছে গাছকে। তার ফাঁকে ফাঁকে বাঁক থেকে বাঁকে ঘুরে যাচ্ছে পথ। কে চলে যাচ্ছে সেই পথ দিয়ে? আবছা শরীরটা কার? হাঁটার ভঙ্গিটা যে খুব চেনা! কে যাচ্ছে ওই পথ দিয়ে? আচ্ছা, পথ কি শুধু চলে যাওয়ার জন্যই? ফিরে আসার জন্য কি নয়? তা হলে কেন চলে যায় সবাই? কেন ফিরে আসে না কেউ? মালিনী, তুমিও কি শুধু চলেই যাবে? ফিরে আসবে না আর? কোনওদিন ফিরে আসবে না?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *