৩২
তুতুলের ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক আনন্দ বোধ করল জিয়ানা। কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে মেয়েটা! নিশ্চিন্তে, কোনও টেনশন, কষ্ট বা মনখারাপ ছাড়াই কী অদ্ভুত ঘুমোচ্ছে! দেখে কোথায় যেন একটা আফশোসের কাঁটা ছোট্ট করে বিঁধলও। ইস, যদি এমন নিশ্চিন্তে ও ঘুমোতে পারত! কতদিন ঠিকমতো ঘুমোয়নি ও। এমন নিথর পাথরের মতো একটা ঘুম খুব দরকার জিয়ানার। যে-ঘুম ওকে ভুলিয়ে দেবে সব।
ভুলতে চায়, এখন সব ভুলতে চায় জিয়ানা। বুকের ভেতরও পাথর ঘোরে যেন। এত কষ্ট কেন হয় ওর? কী নেই? একটা মানুষ যা চায় তার সবটাই তো আছে ওর। তবু কীসের চোরা টান টের পায় ও? কেন চোখ বন্ধ করলেই পাহাড়ি সেই রাস্তাটা দেখতে পায়? কেন দেখতে পায়, কুয়াশার ঝাঁঝরির ভেতরে মিলিয়ে যাওয়া সেই সাইকেলটাকে? ওরও তো মিলিয়ে যেতে ইচ্ছে করে অমনভাবে কুয়াশার ভেতর। দেখতে ইচ্ছে করে কুয়াশার ভেতরের সেই অন্য পৃথিবীটা। যেটা গিলে নিয়েছে কিগানকে।
মা যে কেন অপছন্দ করত ওকে? জিয়ানা বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মা শোনেইনি। বরং কলেজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছিল কার্শিয়াং। ওর এক মামা থাকত ওখানে।
যেতে চায়নি জিয়ানা। রাগ করেছিল। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। একা একা কেঁদেছিল খুব। কিন্তু মা একদম শোনেনি। লোহার মতো কঠিন হয়ে গিয়েছিল মা। সেই সময় যেন মাকে চিনতেই পারেনি জিয়ানা। মায়ের ভেতর থেকে কে যেন বেরিয়ে এসেছিল?
শুধু চলে যাওয়ার আগে অনেক কষ্টে কোথায় যাচ্ছে তার ঠিকানা এক বন্ধুর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল কিগানের কাছে।
ছোট্ট, শান্ত, কুয়াশার মাফলার জড়ানো মানুষের মতো শহর কার্শিয়াং। পাহাড়ি পথ। তার দু’পাশে সবুজ গাছ। খাড়া পাহাড়ের ঢাল আর তারই এক কোনায় ছিল মামার বাংলো। কাঠের বারান্দায় দাঁড়ালেই দেখা যেত কিছুটা দূরের পিচের রাস্তা। সেই বারান্দায় একা একা দাঁড়িয়ে থাকত জিয়ানা। ভাবত আসবে না কি একবারও? কিগান কি একবারও আসবে না?
সপ্তাহ তিনেকের মাথায় এসেছিল কিগান। বাড়ি থেকে নেমে ছোট্ট বাজারটায় শ্যাম্পু কিনতে গিয়েছিল জিয়ানা। আর সেখানেই হঠাৎ, প্রায় মাটি ফুঁড়েই যেন উদয় হয়েছিল কিগান!
এত চমকে গিয়েছিল জিয়ানা! এত আশ্চর্য এক আনন্দ ঘিরে ধরেছিল ওকে যে, কথাই বলতে পারছিল না প্রথমে। সেই ফরসা লম্বা ছেলেটা, গায়ে লাল জ্যাকেট, আর পিঠে ছোট্ট একটা ব্যাগ।
নরম রোদ উঠেছিল সেদিন। হাওয়া দিচ্ছিল ফুরফুরে। কিগানের কপালের ওপরে পড়ে থাকা চুলগুলো উড়ছিল। নীল চোখ দুটো চকচক করছিল।
জিয়ানা যেন পারছিল না আর। মনে হচ্ছিল ঝাঁপিয়ে পড়ে কিগানের ওপর। ওর জামা থেকে ভেসে আসা ব্রুট মাস্কের গন্ধ ভারী করে তুলছিল পাহাড়ি হাওয়া। সব গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছিল জিয়ানার। বাজার, তার লোকজন, সব আবছা হয়ে আসছিল। ঠিক মনে করতে পারছিল না কেন এসেছে ও বাজারে!
অনেকক্ষণ কিগানের সঙ্গে ঘুরেছিল ও। পাহাড়, তার নির্জন রাস্তা। বড় পাথরের ওপর বসে কিগানের হাতটা ধরে রেখেছিল শক্ত করে। মনে হচ্ছিল ছেড়ে দিলে হারিয়ে যাবে। তারপর একসময় কিগান বলেছিল, ‘এভাবে থাকার কোনও মানে হয়? চল, আমার সঙ্গে পালিয়ে যাবি।’
‘পালিয়ে!’ ভয়ে গোলাপি হয়ে গিয়েছিল জিয়ানা।
‘ওরা তোকে আমার থেকে সরাবার চেষ্টা করছে।’ কিগান গাঢ়ভাবে চোখ রেখেছিল জিয়ানার চোখে।
কষ্ট হচ্ছিল। জিয়ানার কষ্ট হচ্ছিল খুব। পালিয়ে যাবে? তা হলে মা কী ভাববে? কী বলবে? বাবা? আত্মীয়স্বজনরা? দিদির অমন ঘটনার পর যদি ও এমন করে, তা হলে!
কিগান শান্ত গলায় বলেছিল, ‘এখন বলিস না। একটা দিন ভেবে নে। কাল দুপুর নাগাদ আমি তোদের বাড়ি ছাড়িয়ে আরও ওপর দিকে গেলে পাহাড়ের ধারে যে একটা লাল বেঞ্চ আছে, সেখানে থাকব। দেখবি ওটা পাহাড়ের একটা এন্ড। সবুজ রেলিং দিয়ে ঘেরা আছে জায়গাটা। আমি আসব ওখানে দুপুর দুটো নাগাদ।’
কোথা থেকে একটা সাইকেল জোগাড় করেছিল কিগান কে জানে! সেটা চড়ে ও চলে গিয়েছিল তারপর। জিয়ানাও ফেরার পথ ধরেছিল বাড়ির।
তবে বাড়িতে ফিরে অশান্তি হয়েছিল খুব। মামা-মামি সবাই খুব বকেছিল জিয়ানাকে। এতক্ষণ কোথায় ছিল জিজ্ঞেস করেছিল। তারপর ফোন করেছিল কলকাতায়।
মনে আছে, খুব কেঁদেছিল জিয়ানা। সারা দুপুর কেঁদেছিল নিজের ঘরে শুয়ে। তারপর বিকেল থেকে হঠাৎ শরীর ম্যাজম্যাজ করতে লাগল। গা, হাত-পা ব্যথা হল। আর সন্ধে থেকে এল ধুম জ্বর। গরম তুলোর ভেতর কে যেন ডুবিয়ে দিল জিয়ানাকে। চোখের সামনে সমস্ত কিছু আবছা হয়ে যেতে শুরু করল। তারপর একসময় নিভে গেল সব।
জ্বলল আবার। ক’টা বাজে তখন? জিয়ানার দু’চোখ দিয়ে গরম জল গড়াচ্ছে। ও দেখতে পাচ্ছিল না ঠিকমতো। শুধু আবছামতো মামার মুখ দেখল। মামি কি জলের গ্লাস হাতে এগিয়ে এল? আর ঘড়ি? দেওয়াল ঘড়িটা কোথায়? কে যেন জলে ডুবিয়ে দিতে লাগল জিয়ানাকে। ভাসাতেও লাগল। আর জিয়ানা দেখল দূরের রাস্তা আর আশপাশের গাছগুলোর গায়ে কে যেন জড়িয়ে দিয়ে গেছে কুয়াশা। একটা সাইকেল চেপে কে যেন মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশার ঝাঁঝরির ভেতর। তার গলার গোলাপি স্কার্ফ লোমওলা গোল্লা কুকুরের জিভের মতো বেরিয়ে আছে কুয়াশার ভেতর থেকে।
সাতদিন পর সুস্থ হয়েছিল জিয়ানা। ততদিনে বাবা-মাও এসে গিয়েছিল। আর মামার কাছে মা রাখতে চায়নি ওকে। জিয়ানার প্রাণ প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল উৎকণ্ঠায়। কিগানের কী হল? ও কি এসেছিল? ও কি জানে যে, জ্বর হয়েছিল জিয়ানার? ও কি একবার দেখার চেষ্টা করেছিল জিয়ানাকে?
বাড়িতে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি জিয়ানা। শুধু একবার সুযোগমতো কাজের মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিল, একটা ছেলে এসেছিল একদিন। মামা নাকি তাকে গেট থেকেই ভাগিয়ে দিয়েছিল। ছেলেটি লম্বা। পিঠে ব্যাগ ছিল।
‘কিন্তু কী নাম ছেলেটার? মানে ছেলেটা নাম বলেনি?’ জিয়ানা অধীর হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।
কাজের মেয়েটি অনেকক্ষণ চিন্তা করে বলেছিল, ‘নামটা মনে নেই। তবে হ্যাঁ, একটা জিনিস আমার মনে আছে।’
‘কী?’ জিয়ানা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়েছিল।
‘ছেলেটার চোখের রংটা একদম নীল। আমি অমন চোখ কোনওদিন দেখিনি।’
জিয়ানা সেদিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে গিয়েছিল ওদের বাড়ি থেকে সামান্য ওপরে, সেই পাহাড়ের সবুজ রেলিং ঘেরা প্রান্তে, লাল বেঞ্চটার কাছে। দেখেছিল বেঞ্চের গায়ে ছুরি দিয়ে কেটে খোদাই করা আছে-‘আমি তোর জন্য এসেছিলাম…’
মা-বাবা যে জানত কিগান এসেছে সেটা জিয়ানা বুঝতে পেরেছিল কলকাতায় এসে। বুকুর সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধটাও এসেছিল তখন। মা-বাবা আর দেরি করেনি। জিয়ানাকে একদম সাজিয়ে গুছিয়ে বসিয়ে দিয়েছিল পাত্রপক্ষের সামনে। বুকুরা তো একরকম রাজি হয়েই ছিল, এবার এক দেখাতেই সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল।
সারারাত কেঁদেছিল জিয়ানা। কিন্তু মা এমন শুরু করেছিল বাড়িতে যে প্রতিবাদ করতে পারেনি। এর দু’দিন পরে মায়ের তাড়নাতেই কিগানকে ফোন করে গড়িয়াহাটের মেঘমল্লারের কাছে ডেকেছিল জিয়ানা। কিগান ফোনে অনেক কথা বলেছিল, কিন্তু জিয়ানা উত্তর দেয়নি, শুনতে চায়নি কিছু।
মেঘমল্লারের ওখানে মা-ও গিয়েছিল জিয়ানার সঙ্গে। শুধু ফুটপাথ বদল করে ওই দিকে যায়নি। কিগান অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। জিয়ানা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ওর সামনে।
কিগান এগিয়ে এসে বলেছিল, ‘জি, তুই…মানে… এভাবে…’
জিয়ানা কথা বাড়ায়নি। শরীর কাঁপছিল ওর। মনে হচ্ছিল যে-কোনও সময় মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। আর পারবে না। আর পারবেই না দাঁড়িয়ে থাকতে। ও বলেছিল, ‘কিগান, আমায় ভুলে যা তুই। আমার অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’
‘জি, কী বলছিস?’ কিগান আর্তনাদ করে উঠেছিল।
‘আমায় আর ফোন করবি না কক্ষনও। বুঝেছিস?’ জিয়ানা আর দাঁড়ায়নি। বেগুনি চুড়িদার আর শিফনের দোপাট্টার ঝাপটা মেরে চলে এসেছিল। আর চলে আসতে আসতে, না, একবারও পিছনে ফিরে তাকায়নি। দেখেনি কী করছে দাঁড়িয়ে কিগান। ও শুধু চলে এসেছিল। রাস্তা, ফুটপাথ আর সমস্ত স্মৃতি টপকে ও চলে এসেছিল। শুধু ভেবেছিল, কিগানকে তো বলা হল না ওর লেখা চিঠিগুলো যেন নষ্ট করে দেয়!
কিন্তু কিছু কি নষ্ট করা যায়? মন কি হোয়াইট বোর্ড না স্লেট? একবার লিখে তারপর কি তা আবার মুছে ফেলা যায়? কিগান পেরেছে? ওকে দেখলে তো বোঝা যায় যে, মনের ভেতর অনেক কষ্টের পুঁটলি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! আর জিয়ানা? ও নিজেই কি আর পেরেছে মুছে ফেলতে?
দীর্ঘশ্বাসের সংখ্যা কি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে? ক্লান্ত লাগছে মনে হওয়াটাও কি বাড়তে থাকে? জানে না জিয়ানা। আর জানতে ইচ্ছে করে না। যখন বয়স কম ছিল মনে হত পালকের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে যেন। তারপর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কে যেন পালকগুলো এক-এক করে লোহার করে দিল। এখন এ ঘর থেকে ও ঘর যেতেই সময় লেগে যায়। কষ্ট হয়। মনে হয় লোহার পালক ঝনঝন করে শেকলের মতো বাজছে।
তুতুলের ঘর থেকে এসে একবার শাশুড়ির ঘরে উঁকি মারল জিয়ানা। ঘুমিয়ে পড়েছেন। এখান থেকেই স্টাডিটা দেখা যায়। সেখানেও লাইট জ্বলছে। অর্থাৎ বুকু কাজ করছে। জিয়ানার কিছু ভাল লাগছে না আজ। কেমন যেন ঝিঁঝি করছে হাত-পা। টেনশন হচ্ছে বলে কি?
কালকে টেন্ডারের প্রাইস ওপেনিং হবে। আসলে এখানে মার্চেন্ট নিজেদের নিয়মে গেছে। প্রথমে সবাই প্রাইস দিয়েছিল। সেটা সিল্ড খামে করে জমা করতে হয়েছে। তারপর ওদের কাছ থেকে পারসেন্টেজে রিবেট চাওয়া হয়েছে। সেটাও সিল্ড খামে জমা করতে হয়েছে। এখন কোটেড প্রাইস আর সিল্ড খামের সেই প্রাইসের ওপর দেওয়া রিবেট থেকে হিসেব করে দেখা হবে যে, কার প্রাইস কম।
আগে পাঁচটা পার্টি ছিল। কিন্তু কনসালট্যান্ট তার থেকে দু’জনকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। এখন পার্টির সংখ্যা তিন। আর তার মধ্যে একজন আবার রিবেট জমা দেয়নি। অর্থাৎ শেষমেশ কমপিটিশন দু’জনের মধ্যে। ওয়াটার বার্ডস আর প্রোজেকশন কর্প।
আজ সেই নিয়ে মদন খুরানার সঙ্গে একটা মিটিং হয়েছে। তবে মিটিং নামেই, আসলে খুরানা ডিপ্রেসড ছিলেন খুব। উনি নাকি ভেতরের সোর্স থেকে খবর পেয়েছেন যে, ওয়াটার বার্ডের কোট জিয়ানাদের চেয়ে কম। খুরানা এই কাজটার ওপর অনেকখানি নির্ভর করে ছিলেন। এমনিতেই বিজনেস একটু ডাউন চলছে তার ওপর গোটা প্রোজেক্টটা কয়েক কোটি টাকার। এটা ফসকালে বড় চোট খাবে প্রোজেকশন। আর তা ছাড়া এটা একটা প্রেস্টিজ ফাইট। সেই যে প্রোজেকশন কর্পের থেকে ছ’জনকে ওরা নিয়ে গেল, তারপর থেকে ওয়াটার বার্ডসকে ঠিক মোক্ষম জবাব দেওয়া হয়নি। এই ছিল সেই সুযোগ। কিন্তু খুরানা বলছেন যে, তা বোধহয় আর হল না।
জিয়ানা বলেছিল, ‘স্যার কিছু ভাববেন না। দেখুন না কাল কী হয়।’
এই প্রথম খুরানা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন জিয়ানার ওপর। বলেছিলেন, ‘তুম বাত হি না করো তো আচ্ছা হ্যায়। বললাম ওই ব্যানার্জিকে ম্যানেজ করো। পারলে না। তোমার পারফরমেন্স এমনিতেই উইক। তার ওপর এই প্রোজেক্টটায় বোর্ড অব ডাইরেকটার্সদের তোমার ওপর নজর ছিল। বাট ইউ ব্লিউ দ্যাট অফ। জানি না তোমার ভবিষ্যৎ কী।’
জিয়ানা জানে ওর ওপরই চাপ আসবে। ললিত এই প্রোজেক্টে থাকলেও শেষের দিকে ওকে অন্য প্রোজেক্টে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে যা চাপ তা আসবে জিয়ানার ওপর। সমস্ত না-পারাগুলোর দায় নিতে হবে জিয়ানাকেই। এটাই সমস্যার। যদিও জিয়ানা চেষ্টা করেছিল। ইচ্ছে ছিল না, তবু কিগানকে বলেছিল ও। একদিন কলকাতায় এসেছিল কিগান। তখন ধরেছিল ওকে। মানে প্রায় জোর করেই ওর সঙ্গে দেখা করেছিল।
দুটো ওষুধ খাওয়ার আছে জিয়ানার। কয়েকদিন ধরে হজমের সমস্যা হচ্ছে ওর। আসলে জন্ডিস হওয়ার পর থেকেই টুকটাক হজমের সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে সেটা বেড়ে গেছে। ফলে ডাক্তার দেখাতে হয়েছে।
ওষুধটা নিয়ে একবার স্টাডিতে গেল জিয়ানা। বুকু এক মনে কথা বলে যাচ্ছে। ও বুঝল বিদেশের অফিসের সঙ্গে ভিডিয়ো কনফারেন্সে কথা বলছে। আসলে বড় চাকরি করার এই এক সমস্যা। বুকু এখন একটা কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে আছে। আর যে-কোনও উন্নতির সঙ্গে যেটা কমে যায় সেটা হল সময়। একটা সময় আসে যখন মানুষ এমন পজিশনে চলে যায় যেখানে তার আর নির্দিষ্ট কাজের সময় থাকে না। সারাটা দিন তাদের কাজ করতে হয়। বুকু এখন যেমন। এই রাত এগারোটাতেও অফিসের কাজ করে যাচ্ছে।
ওকে দেখে বুকু না তাকিয়েও হাত তুলে দাঁড়াতে বলল। জিয়ানা ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন?’ বুকু হাতটা তুলে ইশারাতেই বলল, দু’মিনিট দাঁড়াতে। তারপর আবার কথা বলতে লাগল।
পাঁচ মিনিট পর মাথার থেকে হেডফোন খুলে নিয়ে বুকু চেয়ারটায় পাক মেরে ঘুরে বসল। বলল, ‘সামনের মাসে একবার বাইরে যেতে হতে পারে।’
‘তাই? কোথায়?’
‘সুইডেন যাব প্রথমে। তারপর ইটালি আর বেলজিয়াম। দুটো নতুন কোম্পানির সঙ্গে টাই-আপ আছে।’
‘ও,’ জিয়ানা চুপ করল একটু। তারপর বলল, ‘তোমার কাজ শেষ?’
‘না। আরও একটু সময় লাগবে। তুমি শুয়ে পড়তে পারো।’
‘না, ঠিক আছে।’ জিয়ানা চোয়াল শক্ত করল। বুকু যদি জানত যে, আজ আর ওর ঘুম আসবে না, তা হলে এ কথা বলত না।
বসার ঘরে গিয়ে টিভিটা চালিয়ে দিল জিয়ানা। কীসব নাচ-গান হচ্ছে। দেখে মাথাটা যেন আরও গরম হয়ে গেল। কাল দুপুর দুটোয় ফাইনাল প্রাইস ওপেনিং। কাল সবার সামনে রিবেটের পারসেন্টেজটা খোলা হবে। ব্যাপারটা ক্লিয়ার করতে, পরিচ্ছন্নতা রাখতে সবার সামনে এটা করা হবে। খুরানার যাওয়ার কথা ছিল জিয়ানার সঙ্গে। কিন্তু বুড়ো কাল যাবে না। বলেছেন, ‘আপনা মুহ কালা করওয়ানা হ্যায় ক্যায়া?’
অর্থাৎ জিয়ানাকেই নিজের মুখ কালো করতে হবে। ফাক। একা একা চিৎকার করে উঠল জিয়ানা। কিগান যে এমন করবে ভাবতে পারেনি। ও তো ভেবেছিল কিগানকে একবার বললেই হবে। কিন্তু ও যে কী ভুল করেছিল! এর চেয়ে ওদের স্যামুয়েল কুটিনহোকে হাত করলে কাজ দিত। অন্তত চেষ্টা তো করা যেত। কেন যে ও নিজের হাত পোড়াতে কিগানের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিল?
কিগানকে নিজের গাড়িতেই তুলেছিল জিয়ানা ধর্মতলা থেকে। যদিও কিগান গাঁইগুঁই করছিল, তবু জোর করেছিল জিয়ানা। বলেছিল, ‘আমার কথা শুনবি না?’
রেস্তরাঁটা ছোট হলেও আরামদায়ক। আর এতদিন পরে ঢুকেও জিয়ানা সেই ভিনিগার আর সয়া সসের পেটেন্ট গন্ধটা পেয়েছিল। সেই কলেজ জীবন থেকে এখনও পর্যন্ত এই গন্ধটা পালটায়নি একটুও।
কিগান চেয়ারে বসে মাথা ঘুরিয়ে চারদিকটা দেখে বেশ অবাক গলায় বলেছিল, ‘কী রে তুই আমায় এখানে আনলি?’
‘কেন? এটা খারাপ?’ জিয়ানা হেসেছিল।
‘খারাপ বলছি না। বলছি, আমায় অনেক দূর ফিরতে হবে। তা এই মল্লিকবাজারের এই রেস্টুরেন্টটায় আনলি কেন?’
‘কেন, তোর ভাল লাগল না?’ জিয়ানা একটা পেপার টাওয়েল নিয়ে ভাঁজ করতে করতে জিজ্ঞেস করেছিল।
‘সেটা প্রশ্ন নয় জিয়ানা। তুই জানিস এসব ঠিক নয়।’
‘কেন? আমরা তো গল্প করছি। তুই জানিস তোর সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করে আমার। তোর সঙ্গে সেই পুরনো দিনের মতো কথা বলতে ইচ্ছে করে।’
‘তাই?’ কিগান হেসে মেনুকার্ড তুলেছিল হাতে।
জিয়ানা ছোঁ মেরে মেনুকার্ডটা ছিনিয়ে নিয়ে বলেছিল, ‘তুই ব্যঙ্গ করছিস? আর মেনু দেখছিস কেন? আমরা কী খেতাম ভুলে গেছিস?’
‘কিছুই ভুলে যাইনি জিয়ানা। তবে মানুষ যেমন কিছু জিনিস আর ব্যবহার করে না, তেমন আমিও কিছু স্মৃতি লফ্টে তুলে রেখেছি। আর নামাই না।’
‘আমি নামাই,’ জিয়ানা কথাটা বলে থমকেছিল এক মুহূর্ত। তারপর বেয়ারাকে ডেকে অর্ডার দিয়ে আবার কিগানের দিকে তাকিয়েছিল, ‘এখনও তোর চিকেন উইথ রোস্টেড কাজু পছন্দ তো?’
‘না। আর খাই না ওটা।’
‘তো, না করলি না কেন?’ জিয়ানা উত্কণ্ঠা দেখিয়েছিল, ‘যখন অর্ডার দিলাম, তখন বললি না তো! আমি আসলে পুরনো দিনের মতো ভেবে…’
কিগান হেসেছিল, ‘পুরনো দিনের গায়ে ধুলো জমে আছে। বেশি নাড়াচাড়া করিস না। আমার পুরনো ধুলোয় অ্যালার্জি হয়।’
‘তবু,’ জিয়ানা থমকেছিল কয়েক মুহূর্ত, ‘তোর জানতে ইচ্ছে করে না, কেন তোকে আমি “না” বলেছিলাম?’
‘কারণটা আমি জানি।’ কিগান হেলিয়ে বসেছিল চেয়ারে। তারপর একটা ফর্ক নিয়ে খেলা করতে করতে বলেছিল, ‘তুই আমায় ভালবাসলেও তেমন ভাল বাসিসনি।’
‘মানে?’ জিয়ানা অবাক হয়েছিল, ‘তেমন ভালবাসিনি মানে?’
‘মানে, প্রেম। প্রেমের কথাই বলছিলাম। আমার প্রতি তেমন, কী যেন বলে, ইয়েস মনে পড়েছে, প্রেমাসক্ত, প্রেমাসক্ত হোসনি তুই।’ কিগান হেসেছিল খুব।
‘তোর রাগ হয় না আমার ওপর।’
‘ওটা আগেও জিজ্ঞেস করেছিলি একবার,’ কিগান হাসিটা বাঁচিয়ে রেখে বলেছিল, ‘কেন রাগ করব জিয়ানা? জীবনটা তোর। তুই যা ভাল বুঝেছিস তাই করেছিস। একটাই তো চান্স বল বাঁচার। যে যার মতো বেঁচে তো নেবেই।’
‘তোর সত্যিই কোনও রাগ হয়নি?’ জিয়ানা ঝুঁকে পড়ে গভীরভাবে তাকিয়েছিল কিগানের দিকে।
‘না। তবে কষ্ট হয়েছিল খুব, জানিস। আমার তখন পাগলের মতো লাগত। সারা কলকাতায় একা একা ঘুরে বেড়াতাম। কখনও শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে একা একা চলে যেতাম দূরের স্টেশনে। কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, মছলন্দপুর, বসিরহাট। কত জায়গায় গিয়েছি। আমার তখন কেমন যেন অস্থির লাগত। মনে হত শরীরের ভেতর লক্ষ লক্ষ চড়াই পাখি ঢুকে গেছে। বুঝতাম না কী করলে শান্তি পাব। কী করলে রাতে আমার ঘুম হবে একটু। তখন এমনও দিন গেছে আমি ফুটপাথে গোটা দিন একা একা বসে থেকেছি। গোটা দিন কাটিয়েছি বাইপাসের ধারে এসে বসা জিপসিদের সঙ্গে। একটা গোটা দিন কথা না বলে থেকেছি। রাসবিহারী মোড় থেকে হেঁটে হেঁটে সুকিয়া স্ট্রিট গিয়ে দেখেছি কত পা হাঁটতে হল। আরও কত কী! কত কী করেছি! তারপর একদিন খবর পেলাম তোর বিয়ে হয়ে গেছে। তারপর কেমন যেন সব থম মেরে গিয়েছিল। দশদিন প্রায় খেতেই পারিনি কিছু। কথা বলতে পারিনি। সারাদিন ঘর বন্ধ করে বসে থাকতাম। এমন একদিন ছাদে দাঁড়িয়ে একা কাঁদছি, তখন হঠাৎ পিছন থেকে এসে ঠাকুরমা হাত রেখেছিল কাঁধে। আমি কোনওমতে কান্না চেপে চোখের জল মুছে ঠাকুরমার দিকে তাকিয়েছিলাম। ঠাকুরমা জিজ্ঞেস করেছিল, কী হয়েছে। আমি বলেছিলাম, ঠাকুরমা আমার এই খারাপ সময়টা আর কতদিন যাবে বলো তো? ঠাকুরমা হেসে বলেছিল, আর দু’মাস। দু’মাস? তারপর? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। ঠাকুরমা হেসে বলেছিল যে, তারপর নাকি এটাই অভ্যেস হয়ে যাবে।’
জিয়ানা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুই আমায় ক্ষমা করতে পারবি না?’
‘ক্ষমা!’ দিয়ে যাওয়া খাবার মুখে তুলে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল কিগান, ‘কেন ক্ষমার কথা উঠছে? আর কীসের জন্য ক্ষমা?’
‘এই যে তোর এত কষ্ট হল। এই যে তোকে আমি এমন করে সরিয়ে দিয়েছিলাম জীবন থেকে। এই সব কিছুর জন্য ক্ষমা।’
‘ধ্যাত! ওসব বাদ দে। বাদ দিয়ে দে। আর আঁকড়ে ধরে বসিস না, কেমন?’
‘তা হলে যখন রাগ নেই বলছিস, আর একটা উপকার করবি?’ জিয়ানা সাবধানে কথাটা বলে তাকিয়েছিল কিগানের দিকে।
উপকার করা কিগানের ফার্স্ট নেচার। কলেজে কারও কিছু সাহায্যের দরকার হলে সবসময় তাদের যার কথা প্রথম মাথায় আসত তার নাম কিগান। জিয়ানা মাঝে মাঝে এই নিয়ে রাগ করত। বলত, ‘না’ বলতে শিখিসনি কেন? ‘না’ বলতে জানাটাও জীবনের একটা শিক্ষা। তুই কি ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো নাকি?
এটা ঠিক, জিয়ানা কক্ষনও কিগানকে কিছু করে দিতে বলত না। তবে দরকারও পড়ত না। কিগান জিয়ানা কিছু বলার আগেই কাজ করে দিত। তবু জিয়ানা নিজের থেকে কক্ষনও কিছু চাইত না।
কিগান বলেছিল, ‘তুই উপকার চাইছিস? উপকার?’
‘একটা হেল্প দরকার। কিন্তু বলতে সংকোচ হচ্ছে আমার।’ জিয়ানা কুণ্ঠিত গলায় বলেছিল।
‘সংকোচ?’ কিগান হেসেছিল, ‘বল না।’
জিয়ানা চোয়াল শক্ত করে চোখ বন্ধ করেছিল। যেন কোনও গভীর জলে ডুব দিতে যাবে এবার। তারপর সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বলেছিল, ‘তোদের কন্ট্রাক্টটা আমাদের কোম্পানিকে পাইয়ে দে তুই।’
‘মানে!’ কিগান খাওয়া থামিয়ে তাকিয়েছিল অবাক হয়ে।
‘মানে,’ জিয়ানা কেটে কেটে বলেছিল, ‘তুই এমন একটা ব্যবস্থা কর যাতে করে আমরা কাজটা পাই। না, তোকে ঘুষ অফার করছি না আমি। এর বদলে তোকে কিচ্ছু দেব না। কিন্তু আমাদের কাজটা তোকে পাইয়ে দিতেই হবে। কীভাবে আমি জানি না। কিন্তু দিতে হবে।’
‘এসব কী বলছিস তুই জিয়ানা?’
‘কেন? আমরা কমপিটেন্ট নই? আমাদের ইনফ্রাস্ট্রাকচারও খুব ভাল। আর ওয়াটার বার্ডস নামকরা কোম্পানি হলেও প্রচুর কাজকম্ম ওদের ঝুলে আছে। তোদের প্রোজেক্ট এমনিতেই ডিলেড, যদি আরও ডিলে হয়ে যায়! তোদের জার্মানির একটা কোম্পানির সঙ্গে যে জয়েন্ট ভেঞ্চার প্ল্যান হচ্ছে, সেটা কতটা ধাক্কা খাবে বল!’
‘তুই আমায় এসব কী বলছিস জিয়ানা?’ কিগান যেন বিশ্বাস করতে পারছে না এমন করে বলেছিল।
‘আমায় তোকে হেল্প করতেই হবে। তোর কাছ থেকে কোনওদিন কিছু চেয়েছি আমি? আমি জানি গৌর দিওয়ান তোকে খুব কাছের লোক ভাবে। টেন্ডার কমিটিতে তুই আছিস। প্রাইস তুই জানবি।’
‘আমি এটা করতে পারব না জিয়ানা।’ কিগান মাথা নামিয়ে নিয়েছিল।
‘আমার চাকরি চলে যেতে পারে। তুই আমার পজিশনটা বোঝ।’ জিয়ানা হাত বাড়িয়ে কিগানের হাতটা ধরেছিল, ‘তোর কাছ থেকে কোনওদিন কিছু চেয়েছি আমি?’
‘আমি এটা পারব না জিয়ানা।’ কিগান সরিয়ে নিয়েছিল হাতটা।
‘কেন? কেন পারবি না?’
‘আমি পারব না। আমার পক্ষে এসব করা সম্ভব নয়।’
‘ও,’ জিয়ান চোয়াল শক্ত করল, ‘তুই এভাবে রিভেঞ্জ নিচ্ছিস?’
‘রিভেঞ্জ!’ কিগান অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।
‘তাই তো। রিভেঞ্জই তো।’ জিয়ানা উত্তেজিত হয়েছিল, ‘তুই চাস যাতে আমি বিপাকে পড়ি।’
‘কেন চাইব এমন আমি?’ কিগান শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করেছিল।
‘কারণ তুই জানিস।’
‘কী কারণ? বল!’ কিগান গম্ভীর গলায় বলেছিল।
‘তোকে আমি যে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম তার রিভেঞ্জ নিচ্ছিস?’
কিগান অবাক হয়ে গিয়েছিল, ‘তুই এসব কী বলছিস?’
‘ঠিক বলছি। তুই যতই নিজেকে মহাপুরুষ দেখাস না কেন আসলে তুই আমায় জব্দ করতে চাস। তুই চাস না যে আমি উন্নতি করি।’
‘তুই জানিস এটা ঠিক নয়।’ কিগান শান্ত হয়ে গিয়েছিল আবার।
‘তুই বল তো, কোনও বাবা-মা তোর আর বুকুর মধ্যে বাছতে বললে তোকে বাছত? তুই জানিস বুকুর কোয়ালিফিকেশন? কত বড় চাকরি করে? কত রোজগার করে? কেন তোকে পছন্দ করত আমার বাবা-মা? বুকু কি তোর চেয়ে যোগ্য নয়?’ জিয়ানার মাথা দিয়ে আগুন বেরোচ্ছিল।
কিগান পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে টাকা রেখেছিল জলের গ্লাস দিয়ে চাপা দিয়ে। তারপর বলেছিল, ‘পুরনো কথা যখন তুললি, তখন বলি আমি জানি আমি অতটা যোগ্য নই। কিন্তু আই গেস উই ওয়্যার ইন লাভ। আর পছন্দ? বাবা-মা বাদ দে, তুই-ই তো তোর পছন্দটা জানিয়ে দিয়েছিস? ইউ হ্যাড মেড ইওর চয়েস লং ব্যাক।’
কিগান আর দাঁড়ায়নি। চলে গিয়েছিল।
তারপর থেকে জিয়ানা আর যোগাযোগ করতে পারেনি কিগানের সঙ্গে। বেশ কয়েকবার ফোন করেছে জিয়ানা, কিগান ফোন তোলেনি। মেসেজ করেছে তবু রিপ্লাই দেয়নি। হঠাৎ করে কিগান যেন কেমন ‘নেই’ হয়ে গেছে।
জিয়ানার কষ্ট হচ্ছে খুব। রাগের মাথায় ও হয়তো বেশি বলে ফেলেছে। তা বলে কিগান এমন যোগাযোগ বন্ধ করে দেবে! জিয়ানা জানে ওর অনুরোধটা হয়তো অন্যায় হয়েছে। কিন্তু আর কী করতে পারত! আর কী বলতে পারত! আর যে কিচ্ছু করার ছিল না। আচ্ছা, ও কি বড্ড বেশি স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে? বড্ড বেশি ‘আমি আমি’ করে ফেলছে? ও কি সত্যিই এমন?
জিয়ানা উঠল। টিভিটা ভাল লাগছে না। সারা শরীরে অস্বস্তি, টেনশন। কাল ফার্স্ট হাফে অফিস যাবে না। এই এগারোটা নাগাদ অফিসের গাড়ি আসবে। তখন সোজা চাপাডাঙা চলে যাবে। দুটোর ভেতর পৌঁছে যাবে নিশ্চয়ই। জিয়ানার সঙ্গে ললিতও যাবে কাল।
‘তুমি এখনও জেগে আছ?’ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল বুকু।
‘তোমার কাজ শেষ?’ জিয়ানা অবাক হল।
‘হ্যাঁ।’ বুকু হাসল, ‘আজ এত ডিস্টার্বড কেন তুমি? কী হয়েছে?’
জিয়ানা বুকুর দিকে তাকাল। বুকুর মেজাজ আজকাল একদম অন্যরকম থাকে। ওর মনে হল, বুকুর সঙ্গে কথাগুলো শেয়ার করলে কি খানিকটা মনের ভার কমবে?
জিয়ানা শোওয়ার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, ‘এসো, আমি সত্যিই খুব ডিস্টার্বড হয়ে আছি আজ।’
‘কী হয়েছে?’ বুকু পিছন পিছন এল জিয়ানার।
ঘরে বিছানা করা আছে। জিয়ানা একটা বালিশ তুলে কোলে নিয়ে বসল। মাথাটা দপ্দপ্ করছে রাগে। তবে বুঝতে পারছে না কেন রাগ হচ্ছে এত। কিগান কাজটা করবে না বলেছে বলে, না ও কিগানের সঙ্গে অমন ব্যবহার করেছে বলে? মানুষ মাঝে মাঝে এমন অবস্থায় পড়ে যখন সে নিজেই বোঝে না তার কী করা উচিত।
বুকু বসল বিছানায়, তারপর চশমাটা খুলে হাত বাড়িয়ে রাখল বেড সাইড টেবিলে। জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে বলবে?’
‘কিগান।’ দাঁত চেপে বলল জিয়ানা।
‘কী করেছে? আবার প্রোপোজ করেছে?’ বুকু হাসল।
‘ধ্যাত,’ জিয়ানা বিরক্ত হল, ‘সবসময় ইয়ারকি মারো কেন আজকাল?’
‘আরে রাগ করছ কেন? তবে কি কিগান বিয়ে করছে? তাই তোমার প্রবলেম হচ্ছে?’
‘আশ্চর্য! আমি মরছি আমার জ্বালায় আর তুমি এমন করছ কেন?’ জিয়ানা জোরের সঙ্গে বলল।
‘আরে, আই ওয়াজ জোকিং। বলো, কী হয়েছে বলো।’
‘আমি কিগানের কাছে একটা ফেভার চেয়েছিলাম কাজের ক্ষেত্রে। ও সরাসরি না করে দিয়েছে!’
‘মানে? কী ফেভার?’ বুকু অবাক হল।
‘আমাদের কোম্পানি ওদের ওখানে টেন্ডার দিয়েছে। আমি বলেছিলাম বন্ধু হিসেবে আমার অপনেন্ট পার্টির কোটটা যেন বলে দেয় ও। যেন কাজটা আমাদের পেতে সাহায্য করে।’
‘মানে!’ বুকু ভুরু কোঁচকাল, ‘তুমি এমন একটা কথা বললে কী করে? আরে, ও তো চাকরি করে। একটা ইন্টিগ্রিটি তো আছে, নাকি?’
‘আরে ওয়াটার বার্ডস, মানে আমাদের রাইভাইলের চেয়ে আমরা সব বিষয়ে কমপিটেন্ট। তাই বলেছিলাম। কোনওদিন ওর কাছে কোনও ফেভার চাইনি। আর ও এমন করল? আমাদের ওয়ার্কম্যানশিপও ওয়াটার বার্ডসের চেয়ে ভাল। তাই বলেছিলাম। হি হ্যাজ দ্য অ্যাকসেস টু দ্য প্রাইস ফোল্ডারস। ওর ইচ্ছে হলেই ও বলতে পারত আমায়। কিন্তু বলল? বলল না!’
‘দেখো, কিগান যে ভাল এতেই প্রমাণ হয়। আর এটা তো এথিকালও নয়।’
‘এথিক্স?’ জিয়ানা উত্তেজিত হল, ‘এথিক্স মানে? জানো, ওয়াটার বার্ডস অন্য চারটে প্রজেক্ট কীভাবে ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করেছিল? সেখানে কোথায় ছিল এথিক্স? তুমি এত বড় চাকরি করো, জানো না জীবনে এথিক্স বলে কিছু হয় না! আসলে এগুলো হল মানুষের ল্যাবেঞ্চুস। কিছু ভিতু মানুষ এসবের আড়ালে নিজের ভয় আর অপদার্থতাকে লুকোনোর চেষ্টা করে। বিজনেস একটা ওয়ার-ফেয়ার। সেখানে সব কিছু চলে। আর কিগানকে আমি অপমান করিনি। কোনও ঘুষ অফার করিনি। বলেছি, বন্ধু হিসেবে একটা ফেভার করতে, পরিবর্তে ওকে কিচ্ছু দেব তো বলিনি। অ্যান্ড হি জাস্ট ওয়াকড আউট।’
‘আচ্ছা, তুমি হলে কী করতে?’ বুকু একটা বালিশ কোলের ওপর টেনে নিয়ে বসল।
‘মানে? আমি হলে নিশ্চয়ই হেল্প করতাম।’
‘না, তুমি যদি কিগান হতে, তবে কী করতে?’
‘আমি? মানে?’ জিয়ানা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল।
‘তোমায় ভালবাসত সে। তাকে তুমি পাত্তা না দিয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করেছ। তারপর তার দিকে ঘুরেও তাকাওনি। আর সে কলকাতা থেকে দূরে একটা আধা গ্রাম আধা শহর অঞ্চলে পড়ে আছে। বিয়ে করেনি। একা থাকে। প্রায় কেউ নেইও বোধহয়। তারপর হঠাৎ এতদিন পরে তুমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালে। তোমার এত ভাল পজিশন লাইফে, মোটামুটি সাধারণ মানুষ যা চায় তার সব তোমার আছে। আর সেই তুমি হঠাৎ এমন করে বলছ? এমন করে ফেভার চাইছ? সে কী করবে আনা? সেও তো মানুষ! তুমি হয়তো জানো না কিন্তু আমি জানি। অপমানিত হতে, রিজেক্টেড হতে কেমন লাগে আমি জানি। “কী হয়েছে” মুখে বলা যায়, কিন্তু যাকে সহ্য করতে হয় সে জানে। তাই বলছি, কিগানকে দোষ দিয়ো না। ওর কোনও দোষ নেই।’
জিয়ানা বলল, ‘সে তো অনেক আগের ব্যাপার।’
‘আগের ব্যাপার?’ হাসল বুকু, ‘আগের ব্যাপার বলে, অতীত বলে কিছু হয় না আনা। মানুষ যতদিন বাঁচছে তার জীবনের সমস্ত কিছুই বর্তমান। প্রতিটা কষ্ট, চোট আর অপমান সব বর্তমান।’
‘কিন্তু, যা হয়ে গেছে তা নিয়ে বসে থেকে লাভ?’
‘আরে এ কি ব্যাবসা নাকি যে, লাভ আর ক্ষতি মেলাতে হবে? হয় না আনা, অত সহজে সব কিছু হয় না। আর আমি জানি তুমি যাই বলো, তোমারও ভাল লাগত কিগানকে। ঠিক না?’ জিয়ানার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসল বুকু।
‘আমার!’ জিয়ানা হতবাকের মতো তাকিয়ে রইল বুকুর দিকে।
‘কেন লুকোচ্ছ আনা? আমি কিচ্ছু মনে করব না। তুমি বলো আমায়, কেন তুমি ছেড়ে দিয়েছিলে কিগানকে? আনা, বলে ফেলো। আমি দেখেছি তোমায় রাতে একা কাঁদতে। বিয়ের পরও দেখেছি, এখনও দেখছি। আমি কোনওদিন কিচ্ছু জিজ্ঞেস করিনি। কিন্তু আজ বলে ফেলো। আর, লেট্স বি ফ্রেন্ডস।’
জিয়ানা কিছু বলতে গিয়েও থমকে গেল হঠাৎ। কোত্থেকে যে মনের ভেতর এত শুকনো পাতা এসে জড়ো হয়েছে! এত হাওয়াই বা দিচ্ছে কেন? জিয়ানার গলা শুকিয়ে গেল হঠাৎ আর চোখ ভিজে উঠল। তবে কি ঝড়ের পিছনেই মেঘ ছিল?
‘আনা?’ বুকু নিজের জায়গা থেকে উঠে এসে বসল জিয়ানার পাশে। ওকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমায় বলো আনা। দ্বিধা কোরো না। আমি ভুল বুঝব না।’
জিয়ানা প্রাণপণ সামলানোর চেষ্টা করল নিজেকে। তারপর বলল, ‘মা, মায়ের জন্য। দিদি উনিশ বছর বয়সে একজনের সঙ্গে ভাব করেছিল। মা মেনে নেয়নি। একদিন ছেলেটাকে বাড়িতে ডেকে এনে মা যা নয় তাই বলে অপমান করেছিল। এমনকী মামাকে দিয়ে দু’-চারটে চড়থাপ্পড়ও দিয়েছিল। ছেলেটা মাথা নিচু করে বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। তারপর আর কোনওদিন দিদির সঙ্গে দেখা করেনি। দিদি মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করেছিল খুব। খায়নি। কথা বলেনি। মা দিদিকেও মেরেছিল। বন্ধ করে রেখেছিল ঘরে। এমন প্রায় দশ দিন চলেছিল। তারপর আস্তে আস্তে সব ঠান্ডা হয়ে যায়। দিদি আবার নর্মাল হতে থাকে। টিউশন, কলেজ শুরু করে। আবার হাসাহাসি, লুডো খেলা, গান শুরু করে। আমরা আবার আগের মতো হতে থাকি। তারপর কলকাতায় বর্ষা এল। সেদিন দিদি খুব ভিজে ফিরল কলেজ থেকে। বাড়িতে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা হল। আমরা সবাই লুডো খেললাম, গান গাইলাম। জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরলাম। তারপর খিচুড়ি খেলাম। দিদি বলল রাত জেগে পড়বে, সামনে নাকি পরীক্ষা আছে। আমরা সবাই শুয়ে পড়লাম। শুধু শোওয়ার আগে দিদি আমায় জড়িয়ে ধরল। খুব আদর করল। দু’হাত দিয়ে নিজের সঙ্গে একেবারে মিশিয়ে নিল। তারপর বলল, আমায় ভুলে যাবি না তো? আমি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম দিদির দিকে। কেন এমন বলছে? দিদি তো এমন করে না! তবে? আমি দিদির মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছিলাম কেন এমন বলল? পারিনি। ছোট ছিলাম, তাই এই নিয়ে আর বিশেষ কিছু ভাবিওনি। সোজা শুতে চলে গিয়েছিলাম।
‘পরদিন ঘুম ভাঙে চিৎকারে। উঠে জানলা দিয়ে দেখেছিলাম তখনও মেঘ করে আছে। আর বাড়িতে অনেক লোক। আমি দৌড়ে গিয়ে দেখেছিলাম দিদি শুয়ে আছে মেঝেতে। চাদর দিয়ে ঢাকা। মুখে তুলো। আর ফ্যানের সঙ্গে একটা নাইলন দড়ির ফাঁস দুলছে। দিদি চিঠি লিখে গিয়েছিল। মাত্র এক লাইন-‘আটকাতে পারলে?’ জানো, এই একটা ঘটনার যে কী তীব্র প্রভাব পড়েছিল আমার জীবনে! মা যেন আরও কেমন হয়ে গেল তারপর থেকে। কেমন যেন বদমেজাজি, রুক্ষ। মাকে কাউনসেলিং করানো হয়েছিল। প্রায় বছর দুয়েক লেগেছিল মায়ের ঠিক হতে। কিন্তু তারপর মা আমার ওপর ওভার পজেসিভ হয়ে পড়ে। আর কিগানকে তো সেই জন্যই সহ্য করতে পারত না। জানো, আজও বাপি দিদির কথা মনে করে কাঁদে। যখনই কোনও রবি ঠাকুরের গান শোনে বাপির চোখ ছলছল করে ওঠে। আজও দিদি না থেকেও যে কী ভীষণভাবে আছে তুমি জানো না। দিদি নেই, তবু দিদির জন্যই আমার গোটা জীবনটাই অন্যরকম।’
বুকু মাথা নাড়ল, ‘না, আনা, অন্যরকম নয়। দিদির জন্য নয়। তোমার নিজের জন্যই। ভাল করে ভেবে দেখো, তুমি বুঝবে। আজ তোমায় বলি, আমারও একটি মেয়ের সঙ্গে ভাব ছিল। তোমায় বলেছি তার কথা। হ্যাঁ, মুনিয়া। কিন্তু তার বাড়ির লোকেরা আমায় অপমান করে সরিয়ে দেয়। সেই মেয়েটি এখন স্কুলে পড়ায়। বিয়ে ভেঙে গেছে তার। সে একরকম একাই থাকে। এই যে আমরা, ভালবাসা না-বাসার মধ্যে ঘুরি। কেউ পাই, কেউ পাই না। এতে আদতে কী হয়? মনের মধ্যে একরাশ অভিযোগ আর কষ্ট ছাড়া আর কী বয়ে নিয়ে বেড়াই আমরা? প্রেম এত সুন্দর জিনিস, কিন্তু আমরা সবসময় তার পোড়া ছাইটা বুকে আগলে ঘুরি কেন? এত কষ্ট নিয়ে ঘুরি কেন? দেখো, এত বছর পরেও তোমার চোখ ভিজে গেছে। তুমি আজও কষ্ট পাচ্ছ কিগানের জন্য। তা হলে তার কথা ভাবো আনা। সে কত কষ্ট আর মনখারাপ নিয়ে এতগুলো বছর কাটাল! আমি এই প্রায় মধ্য চল্লিশে এসে বুঝেছি একটা জিনিস, অভিমান করে লাভ হয় না কিছু। কষ্ট বাড়ে শুধু। তুমিও ভুলে যাও। আমি প্রেম ভুলতে বলছি না, কষ্টটা ভুলতে বলছি। তুমি জিজ্ঞেস করো না, আমি এখন এমন হাসিখুশি থাকি কী করে! আসলে আমি দেখেছি হাসির মধ্যে যে সহজ বোধ আছে তা আর কিছুর মধ্যে নেই। তুমি কষ্ট পেয়ো না আনা। জানি তোমার কষ্টটা কাজটা না পাওয়ার জন্য নয়, ওটা কিগানের তোমাকে “না” বলতে পারার জন্য। কিগান যে তোমায় “না” বলতে পারে তা তুমি ভাবতেই পারো না। আর সেখানেই তোমার যত রাগ, যত কষ্ট। তোমার এখনও কিগানের ওপর অধিকারবোধ প্রবল। ছাড়তে হয় আনা, মানুষকে ছাড়তে হয়। তাকে নিজের মতো বাড়তে দিতে হয়।’
‘বুকু, কিন্তু…।’ জিয়ানা অসহায়ের মতো তাকাল।
‘কোনও কিন্তু নয় জিয়ানা। এত বছর বিয়ে হয়েছে আমাদের, কিন্তু কোনওদিন আমরা এভাবে কথা বলিনি। না, আমি বলব না নতুন করে বাঁচতে, বরং বলব ভাল করে বাঁচতে। মনে রাগ রেখো না। আনন্দ রেখো। যা গেছে তাকে কি আর গায়ের জোরে তুমি আটকাতে পারবে? ফেরাতে পারবে? সে চেষ্টা করলে শুধু কষ্টই পাবে।’
‘আমি কী করব?’ জিয়ানা তাকাল বুকুর দিকে।
‘কিচ্ছু করতে যেয়ো না জোর করে। ব্যস।’ বুকু হাত ধরল জিয়ানার।
জিয়ানা বুঝল এই হাতের মধ্যে শাসন নেই, কর্তৃত্ব নেই, স্বামিত্ব নেই, কাম নেই, শুধু বন্ধুত্ব আছে। অগাধ আর অপার একটা বন্ধুত্ব ও খুঁজে পেয়েছে এই হাতের মধ্যে। এক জীবনে একটা ঠিকঠাক বন্ধুত্ব পাওয়া খুব কঠিন। এই বন্ধুত্বটুকু ও আর হারাতে চায় না।
জিয়ানা আলতো করে মাথা রাখল বুকুর কাঁধে। আর বুকুর অলক্ষ্যে পুঁচকি এক কুচি জল চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে গেল। জিয়ানা আঙুল দিয়ে তা মুছে তার নাম দিল, কিগান।
ডোরবেলটা বেজে উঠল হঠাৎ। জিয়ানা আর বুকু দু’জনেই চমকে উঠল। প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। এত রাতে কে এল?
বুকুর সঙ্গে জিয়ানাও উঠে গেল। এমন সময় তো সাধারণত কেউ আসে না! বেলটা বাজল আবার! জিয়ানা ভুরু কোঁচকাল। এত তাড়া! ও দেখল বুকু দ্রুত পায়ে গিয়ে মেন দরজাটা খুলে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে ওরা দু’জনে একসঙ্গে চমকে উঠল! আরে এ এখন? এত রাতে? বুকু অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘রুহান, তুই!’