৩১
লাল বলটা ড্রপ খেয়ে বটুকের মাথা সমান উঠল। বটুক দেরি করল বুঝতে। মাথা বাঁচাতে কোনওমতে হুক করার জন্য ব্যাটটা ঘোরাল। বলটা ব্যাটের কানায় লাগল, তারপর উড়ে গেল ডিপ স্কোয়ার লেগের দিকে। বলটা উড়ছে। নীল আকাশ পিছনে রেখে চেরি ফলের মতো লাগছে বলটাকে। বলটা এমনভাবে উড়ছে যেন আনন্দে বহু দিন পর পাখনা মেলার সুযোগ পেয়েছে। এক মাঠ দর্শক চিৎকার করছে। জালের ফেনসিং-এর ওপারে হাজার হাজার দর্শক লাফিয়ে উঠছে। নীচে একজন ফিল্ডার দৌড়োচ্ছে বল লক্ষ করে। উঁচু হয়ে ভেসে যাওয়া বলটার দিকে সে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। হাত দুটো সামনে মেলে রেখেছে বাটির মতো করে, ঘাসের ওপর দিয়ে সে দৌড়ে যাচ্ছে। আর দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে রুহান। হাত দুটো অর্ধেক তোলা। পারবে? পারবে ক্যাচটা ধরতে? পারবে বটুককে আউট করতে? ওর সব অহংকার ভেঙে দিতে আদৌ পারবে কি?
বলটা উড়ছে এখনও। যেন কখনও আকাশের নীলে নাক ঘষছে, কখনও একটু ছুঁয়ে দিচ্ছে মেঘের সাদাটাকে। কিন্তু পড়ছে না নীচে। কেন পড়ছে না? বলটা উড়ছে, উড়েই চলেছে। আর কী আশ্চর্য! ওই তো বলটার দু’পাশ দিয়ে দুটো সেলোফেন পেপারের মতো পাতলা পাখনা বেরোল। আর তারপরই বলটা হঠাৎ ভোমরার মতো বোঁ করে উড়ে চলে গেল আরও দূরে! মাঠ পেরিয়ে, ফেনসিং পেরিয়ে, দর্শক পেরিয়ে বলটা চলে গেল। আকাশের গায়ে ছোট্ট হতে হতে মিলিয়ে গেল একদম। রুহান কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দর্শকরা ঢেউ ভাঙার মতো শব্দ করল একটা আর বটুক হাসতে লাগল। ব্যাট হাতে নিয়ে হাসতে লাগল বটুক। আর তারপরই হাসতে হাসতে বটুক…আরে বটুক কই? এ তো আদি! আদি? গলায় টাই, হাতে মোবাইল। পাশে, আরে মালিনী! মালিনীও হাসছে। ওরা কি রুহানকে দেখে হাসছে? কিন্তু রুহান কই? ওই তো একটা হাইওয়ে। ওপাশে জঙ্গল। তলতাবনির? আর আদিরা তো ওই হাইওয়ে দিয়ে হাঁটছে। হাসছে, গল্প করছে। এগোচ্ছে পায়ে পায়ে। আরে, ওটা কী? ট্রাক। হর্ন দিচ্ছে, ট্রাকটা হর্ন দিচ্ছে খুব। খেপা ষাঁড়ের মতো এগিয়ে আসছে। আদিরা শুনছে না। শুনতে পাচ্ছে না একদম। ওরা গল্প করছে। হাসছে। রুহান চিৎকার করছে। সতর্ক করছে। কিন্তু শুনছে না ওরা। ওরা ডুবে আছে গল্পে। হর্নটা বাড়ছে এবার। ট্রাকটা তীব্র গতিতে আসছে। ওরা শুনছে না। ট্রাকটা আসছে…ওরা…তীব্র একটা আওয়াজ…ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠল রুহান। সারা শরীর ঘেমে গেছে ওর। বিছানা ভিজে গেছে। মাথার বালিশও চপচপে। ওর শ্বাস পড়ছে দ্রুত!
‘কী রে, তখন থেকে ডাকছি! কিছু শুনছিস না কেন? কুম্ভকর্ণ নাকি? এই লোডশেডিং-এ এমন ঘুম ঘুমোচ্ছিস যে! বললাম না পাড়ার দোকান থেকে গুঁজিয়া এনে দিতে! কোনও কথা কানে যায় না?’ ট্রাকটা যে আসলে মা, এবার বুঝল রুহান।
‘গুঁজিয়া? কখন বললে?’ রুহান অবাক চোখে তাকাল। ঘুমের ঘোর এখনও কাটেনি।
‘দুপুরে খাবার সময় বলেছিলাম। ভুলে গেছিস?’ মা ফোঁস ফোঁস করল, ‘তা মনে থাকবে কেন? এখন খেয়া কিছু বলুক অমনি তো দৌড়োবি!’
‘মা, কীসব বলছ?’ রুহান বিরক্ত হল, তারপর দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়িটা দেখল, ‘সবে তো সওয়া চারটে বাজে। এখন গুঁজিয়া দিয়ে কী করবে?’
‘আমার শ্রাদ্ধ করব।’ মা চিৎকার করল, ‘জানিস না, পাঁচটার সময় গা ধুয়ে আমি ঠাকুরকে খাবার দিই! অপদার্থ! তোকে কেন যে পেটে ধরেছিলাম আমি?’
‘মা, বাজে কথা বোলো না।’ রুহান চাপা গলায় কথাটা বলে বিছানা থেকে নামল। হাওয়াই চটি গলিয়ে তারপর এগিয়ে গেল বারান্দার ছোট্ট বেসিনটার দিকে।
মে মাস। প্রচণ্ড গরম পড়েছে। মনে হচ্ছে কে যেন গোটা কলকাতাটাকে মাইক্রোওয়েভে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সারা শরীর সবসময় চটচট করছে। গায়ে রসগোল্লার রস মেখে বসে আছে যেন। পাঁচটা নাগাদ একটা কাজ আছে রুহানের। বেরোতে হবে। বুকুদার সঙ্গে দেখা করার ব্যাপার আছে।
বারান্দার বেসিন থেকে মুখেচোখে জল দিয়ে ঘরে এসে রুহান দেখল মা দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘরে। মুখচোখ এখনও থমথমে।
‘কিছু বলবে?’ রুহান জিজ্ঞেস করল।
‘তুই গতকাল কী করেছিস?’
‘আমি, গতকাল!’ রুহান অবাক হল।
‘ন্যাকামো করছিস কেন? জানিস না তুই কী করেছিস?’ মা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল।
‘আমি কী করেছি?’ রুহানের ফ্রাস্টেটেড লাগল। আশ্চর্য! মায়ের কী হয় মাঝে মাঝে?
‘তুই ঠাকুরপোর এক্স-রে রিপোর্ট এনে দিসনি?’
‘ককাইয়ের? এক্স-রে?’ রুহান অবাক হওয়ার ভান করল। এই রে! মা জেনে গিয়েছে। এবার একটা তুলকালাম হবে। মা কেন যে এত বাড়াবাড়ি করে! বিরক্ত লাগে রুহানের। কিন্তু কী করবে ও? মা তো আর পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়ে নয় যে, তাকে শাস্তি দেবে! ও মায়ের দিকে নিরুপায় হয়ে তাকিয়ে রইল।
মা বলল, ‘নাটক করছিস? নাটক? লাটুর মা আমায় বলেছে। সে গতকাল নিজের চোখে খেয়ার হাতে ঠাকুরপোর এক্স-রে রিপোর্ট দিতে দেখেছে তোকে।’
‘তো কী হয়েছে? যদি এনে দিয়েই থাকি তবে হয়েছেটা কী?’
‘মানে? তুই কি ওই বাড়ির বাজার সরকার নাকি?’
‘কী বলছ তুমি?’ রুহান চেয়ারের ব্যাকরেস্টে রাখা তোয়ালে তুলে পিঠ মুছল।
‘পায়ে ব্যথা বলে অফিস ডুব দিলি, আর এখন বলছিস কী হয়েছে? যদি এই শ্রমটা অন্যের জন্য খরচ না করে নিজের জন্য করতিস, তবে তো অন্তত দু’পয়সা আসত! তা নয়, তিনি চললেন সমাজসেবা করতে! আপনে শুতে ঠাঁই পায় না, শঙ্করাকে ডাক।’
‘ককাইয়ের শরীর খারাপ। কোমরে ব্যথা। তা হলে রিপোর্ট কে এনে দেবে? কাকিমা যাবে?’
‘কেন, তারা ছেলে জন্ম দেয়নি! সে কোথায়? সাহেব হয়েছে বিদেশ গিয়ে? দু’বছরে একবারও এসেছে? পা দিয়েও নেড়ে দেখেছে, বাপ-মা গেল, না থাকল! খেয়ার তো সবসময় বড় বড় কথা। আমার ছেলে, আমার ছেলে। এখন কোথায় তোর ছেলে! বাপ মরলেও কি মুখে আগুন দিতে আসবে? না বাপের শ্রাদ্ধে কালিয়া কোপ্তা খেতে আসবে?’
‘আঃ মা,’ রুহান চিৎকার করে হাতের তোয়ালেটা ছুড়ে ফেলল।
‘আবার তেজ দেখাচ্ছিস? কেন রে, তোকে ক’টাকা দিয়ে সাহায্য করে তোর কাকা? টাকার তো কুমির! এক পয়সাও দেয়!’
মা চিরকাল ভুলভাল কথা বলে। তবে ইদানীং যেন বেড়েছে আরও! কেন এমন বলে মা? রুহানকে আঘাত করে কীসের এত আনন্দ পায়?
‘মা, তুমি চুপ করবে? না হলে কিন্তু আমি বেরিয়ে যাব!’
‘কেন? আমি দোষ করেছি যে, চুপ করব?’ মা আরও জোরে চিৎকার করল।
‘আশ্চর্য! আমার কাকা হয়। শরীর খারাপ। তার রিপোর্ট এনে দিয়েছি। এতে প্রবলেম কোথায়?’
‘প্রবলেম কোথায়?’ মায়ের গলাটা ভাঙা ভাঙা শোনাচ্ছে এখন। হয়তো এত জোরে চিৎকার করছে বলেই।
‘মা, আস্তে। তোমারও কিন্তু প্রেশার হাই।’ রুহান মাকে শান্ত করতে চাইল।
‘আর দরদ দেখাতে হবে না তোকে। জুতোপেটা করতে হয় তোর মতো ছেলেকে। আমার শরীর খারাপ হলে তোর কী? সব নষ্টের মূল তুই। সব নষ্টের মূল।’
‘কী নষ্ট করেছি আমি?’ রুহানের রাগ হল।
‘সব নষ্ট করেছিস তুই। আবার বড় মুখ করে জিজ্ঞেস করছিস! তোর লজ্জা লাগে না?’
‘মা, বাড়াবাড়ি কোরো না।’ রুহানও এবার রুক্ষ গলায় বলল।
‘আমি বাড়াবাড়ি করছি? আর তুই? নিজের বাপকে খেয়েছিস। নন্দাকে তাড়িয়েছিস। একটা ক্লাবে খেলতিস, সেখান থেকেও পাছায় লাথি মেরে বের করে দিয়েছে তোকে। একটা চাকরি করিস, সেখানেও পার্মানেন্ট হোসনি। কী করেছিস জীবনে? এর বাড়ির তরকারি ওর বাড়ি পৌঁছে দেওয়া আর অন্যের বাড়ির বাজার সরকারগিরি ছাড়া, আর কী করছিস তুই?’
‘মা, নন্দা এর মধ্যে আসে কোত্থেকে?’ রুহান অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল।
এটা যে মায়ের নতুন অস্ত্র। নন্দা! মা নন্দাকে দেখেছিল একদিন। তাও সামান্য সময়ের জন্য। তার মধ্যে নন্দাকে মায়ের এমন কী পছন্দ হয়েছিল যে, তার কথা এখন তুলছে মা? নন্দাকে কতটুকু চেনে মা? কতটুকু জানে?
‘আমি জানি। আমি সব জানি। নন্দা এসেছিল আমার কাছে। তুই নাকি টাকা নিয়ে ওকে ছেড়ে এসেছিস! তুই নাকি ওর বাবাকে বলেছিলি, ষাট হাজার টাকা দিন, তা হলে আপনার মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখব না? সত্যি? এতটা নীচ তুই? এতটা জঘন্য? নোংরা?’
রুহান মাথা নিচু করল। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল নিজের অজান্তেই।
মা বলল, ‘তুই এমন! এতদিন বলিনি। কিন্তু লোকের সামনে ভাল সাজার ঢঙ করিস কেন তুই? ভাল হবি তো মনে মনে হ। লোককে দেখাচ্ছিস তুই কত মহান? কিন্তু আসলে কি তাই? আসলে তো তুই একটা অর্থপিশাচ। একটা ভণ্ড। নিজের মাকে যে কষ্ট দেয় সে যে আসলে ঠিক কী সেটা তো আর লোকে জানে না!’
‘মা আর বোলো না।’ রুহান ক্লান্ত গলায় বলল।
‘কেন বলব না? কেন বলব না বল তুই? আমার কথা শুনে কাজ করিস কিছু? নন্দার ব্যাপারটা আজ বলতে বাধ্য হলাম। এত বছর চেপে ছিলাম। আর আজ যখন বললি বাড়াবাড়ি করছি, তখন তোকে বলতে বাধ্য হলাম আমি।’
‘মা এসব বোলো না বলছি।’
‘কেন? বললে কী করবি? মারবি নাকি? টাকা নিয়ে মানুষের সওদা করেছিস আর এখন কি মাকেও মারবি নাকি? তা তুই পারিস। যেমন মানুষ বেচাকেনা করেছিস! ছিঃ ছিঃ, মেয়েটা যখন এসে কেঁদে কেঁদে আমার কাছে বলেছিল, আমার এত খারাপ লেগেছিল! নেহাত তখন অসুস্থ ছিলাম। অপারেশন হয়েছিল, তাই। না হলে দেখতিস তোকে কী করতাম আমি!’
রুহান চেয়ারে বসে দু’হাতে মুখ ঢাকল! মা এসব জানে! নন্দা এসেছিল ওদের বাড়িতে? কখন এসেছিল? তার মানে নন্দার বাবা কথা রাখেনি? বলে দিয়েছিল নন্দাকে! বিশ্বাস বলে সত্যিই কি কিছু নেই? সবটাই ব্যাবসা? লাভ-ক্ষতির হিসেব? হ্যাঁ, টাকা নিয়েছিল রুহান। মাটির সঙ্গে মিশে, লজ্জার মাথা খেয়ে, নন্দার থেকে মন সরিয়ে নিয়ে, টাকা নিয়েছিল। তারপর থেকে কত রাত যে ঘুমোতে পারেনি ও!
মা আবার বলল, ‘তা কী করেছিলি তুই টাকা নিয়ে? কোনওদিন জিজ্ঞেস করিনি। কিন্তু আজ বল তুই। তোকে বলতে হবে। কী করেছিলি সেই টাকাটা নিয়ে? জুয়া খেলেছিলি? না, নেশা-ভাঙ করেছিস? আজ বলতে হবে তোকে! তোর সাধু সেজে থাকা বের করছি। দাঁড়া। বল তুই, বল।’
রুহান আর নিতে পারল না। আলনা থেকে টি-শার্টটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। আর বেশিক্ষণ থাকলে ও পাগল হয়ে যাবে। কারণ, ও জানে মা এবার রাজ্যের দুঃখ তাক থেকে পেড়ে আনবে, আর তারপর সবকটারই কারণ হিসেবে ওর নামটা বসাবে।
সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামতে নামতেও পিছনে মায়ের গলা পাচ্ছিল রুহান। মা তারস্বরে চিৎকার করছে। এতদিন পরে হঠাৎ মায়ের সেই ষাট হাজার টাকার শোক যে এমন তীব্রভাবে দেখা দিল কেন, কে জানে!
পাড়ায় বেরিয়ে আর দাঁড়াল না রুহান। ডান হাঁটুটায় ব্যথা করছে আবার। গতকাল রাতে খাওয়া দাওয়ার পর একটু হাঁটতে বেরিয়েছিল একা। শুনশান রাস্তায় একটা মাতাল সাইকেল নিয়ে এসে ধাক্কা মেরেছিল সটান। কপাল খারাপ রুহানের। না হলে ফাঁকা রাস্তায় ওর ঘাড়ের ওপরই এসে পড়তে হল মাতালটাকে! ডান হাঁটুতে রুহানের চোট। পুরনো চোটের জায়গায় লেগেছে খুব। খোঁড়াচ্ছে ও।
লেক গার্ডেন্সের লেভেল ক্রসিংটা ফেলা রয়েছে। স্টেশনে ট্রেনটাও দেখা যাচ্ছে। তবে আপ না ডাউন বুঝতে পারছে না রুহান। ও মাথা নিচু করে গেটের তলা দিয়ে গলে গেল। তারপর দু’দিক দেখে হাঁটতে হাঁটতে লাইন পার করে অন্য দিকে গেল। এ দিকে আর লেভেল ক্রসিং-এর তলা দিয়ে যেতে হল না। বরং পাশের ছোট্ট একটা জায়গা দিয়ে গলে রাস্তায় পড়ল রুহান।
সূর্য বড্ড তেতে আছে আজ। কষ্ট হচ্ছে রুহানের। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। তবে এখানে ট্যাক্সি পাবে না। আরও-একটু হেঁটে যেখানে লেক গার্ডেন্স ফ্লাইওভার শুরু হচ্ছে, সেখান থেকে ট্যাক্সি ধরতে হবে রুহানকে। অন্য দিন হলে হেঁটে যেত রুহান। কিন্তু পায়ে কষ্ট হচ্ছে খুব। তাই লেক রোডে যেতে হলেও ট্যাক্সি করে যেতে হবে। লেক গার্ডেন্সের এই অঞ্চলটা ডেড জোন। কিচ্ছু পাওয়া যায় না। তাই আর-একটু এগিয়ে ট্যাক্সি ধরতে হবে। লেক রোডের বড় কফি শপটায় আজ বুকুদা আসবে। বুকুদা বিকেলে দেখা করতে বলেছে রুহানকে।
সেদিন বুকুদার ফোনটা পেয়ে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল রুহান। এসব কী বলছে বুকুদা? কেন বলছে? রুহান জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বুকুদা শোনেনি কিচ্ছু। শুধু ফোন কেটে দেওয়ার শব্দটা কানে বাজছিল। একঘেয়ে মনমরা একটা শব্দ। ভাল লাগছিল না রুহানের। বুকুদাও ওকে এমন ভাবল! আর কেন ভেবেছে সেটা তো ভালই জানে রুহান। ও তো নিজেই হাতে করে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল বুকুদাকে।
রুহান ফোনটার কল লিস্টে গিয়ে আবার ফোন করেছিল। দু’বার বেজেই কেটে গিয়েছিল লাইন। বুকুদা যে রেগে আছে বুঝতে পারছিল রুহান। ও মরিয়া হয়ে আবার রিং করেছিল। আবার লাইন কেটে দিয়েছিল বুকুদা। এমন করে ছ’বার রিং করেছিল রুহান। একবারও ধরেনি বুকুদা। রুহান বুঝতে পেরেছিল ভীষণ রেগে গেছে বুকুদা। আর বুকুদার রাগ সাংঘাতিক। কথা বলা বন্ধ মানে বন্ধ। ও তখন একটা এসএমএস করেছিল-‘বুকুদা, প্লিজ ভুল বুঝো না। কোনওদিন সুযোগ পেলে তোমায় বলব সব।’ না, এরও কোনও উত্তর আসেনি।
আবেশ অবাক হয়ে তাকিয়েছিল শুধু। বলেছিল, ‘কী কেস বল তো? ছেলে ফোন করেছিল না মেয়ে? এমন ল্যাজেগোবরে করল তোকে?’
‘ছেলে। বুকুদা। তুই ঠিক চিনবি না।’
‘ছেলে?’ হেসেছিল আবেশ, ‘তুই মানে…ইয়ে…’
‘শালা। দাদার মতো হয় আমার। রেগে গেছে আমার ওপর।’ রুহান বলেছিল।
‘কে তোর ওপর রাগে না বল তো? শালা, এক নম্বরের ক্যালাস। শোন, তোকে যা বলার ছিল। বোধহয়, চাপাডাঙায় একটাই ম্যাচ হবে। টি-টোয়েন্টি। মানে যেটা তুই করতে পারলি না আর কী। সেখানে একটা টিমে তুই খেলবি?’
‘না।’ রুহান সময় নেয়নি বলতে।
‘কেন? শোন না,’ আবেশ বলেছিল, ‘তোর অপনেন্ট টিমে বটুককে দেব। তারপর বদলা নিয়ে নিস। আর টাকাও পাবি।’
‘না আবেশ। জীবন হিন্দি ছবি নয় যে, বদলা নেব! আমি খেলব না আর। কোনওদিন খেলব না।’
‘কেন? খেলবি না কেন?’ আবেশ ভুরু কুঁচকে ছিল, ‘শালা, বন্ধু বলে বলছি। এমন মেদামারা হয়ে থাকলে চলবে? সবসময় যেন মাইনাস টেন থেকে শুরু করছিস! যেন সারাজীবন মাথার ওপর বৃষ্টি পড়ছে তোর! তুই শালা গোডাউনের ছাতাপড়া পাঁউরুটি।’
‘যাই বলিস। আমি খেলা ছেড়ে দিয়েছি।’ রুহান গম্ভীর গলায় বলেছিল।
‘অ্যাঁঃ, সচিন তেন্ডুলকর। খেলা ছেড়ে দিয়েছি! ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা-বিয়ে করব না! খালি পালানো, না?’ আবেশ দাঁত কিড়মিড় করেছিল, ‘আমায় যে রাহি বলল।’
‘রাহি?’ রুহানের হৃৎপিণ্ড থমকে গেছিল দু’দণ্ড।
‘ওঃ আমার উত্তমকুমার! আমার আমির খান! রুহান-রাহি। যেন যাত্রাপালা! যেই বললাম রাহি বলেছে অমনি নালে-ঝোলে একশা হলি। শালা, মেয়ের কথা শুনলেই টুনি বাল্ব জ্বলে ওঠে, না? শালা, আলুর কোল্ড স্টোরেজ আছে তোর।’
বুকুদার অমন ব্যবহারের পর আর এসব ভাল লাগছিল না ওর। রুহান বলেছিল, ‘রাহিকে দেখলাম মনে হল। এসেছিল এখানে? মানে, তোরা কি এসেছিস?’
‘ও, আজকাল রাহিকে সর্বত্র দেখছিস নাকি?’
‘বাজে কথা রাখ। যা জিজ্ঞেস করছি, বল,’ রুহান কড়া গলায় বলেছিল।
‘না আসেনি। আমি এখানে মার্চেন্টে এসেছিলাম। কাজ ছিল। আর একটু মামার বাড়িতেও দরকার ছিল।’
‘মামার বাড়ি কেন?’ রুহান অবাক হয়েছিল, ‘তোর সঙ্গে তো ওদের কোনও সম্পর্কই নেই।’
‘তাও,’ হেসেছিল আবেশ, ‘আমায় তো ওরাই “অমানুষ” করেছে। মামিমা মারা গেছেন খবর পেলাম। তাই একবার যাব।’
রুহান আর কথা বাড়ায়নি। চলে এসেছিল। তবে খচখচ করছিল মনটা। এ কী হল? বুকুদা এমন রেগে গেল কেন? ওকে ওই বাড়ি থেকে কী বলা হয়েছিল?
মনে আছে রুহানের। সেদিন অশোকনগর স্টেশন থেকে ট্রেন ধরেছিল রুহান। তারপর বুকুদার ফোন পেয়ে ও শিয়ালদায় না নেমে, তার আগেই দমদম নেমে পড়েছিল। বুকুদা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল দমদম স্টেশনের বাইরে। ওকে দেখেই বলেছিল, ‘হান, গাড়িতে ওঠ। কথা আছে তোর সঙ্গে।’
সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের সিগনালে খ্যাঁচ করে থামল গাড়িটা। এমন আচমকা ব্রেক কষায় রুহান প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল গাড়ির সামনের সিটের ব্যাকরেস্টে। থুতনিটা ঘষে গেল। ‘আঃ,’ রুহান কিছু বলার আগেই ড্রাইভারটা জানলা দিয়ে মুখ বের করে সামনের গাড়িতে বসা ড্রাইভারের উদ্দেশে বাছা বাছা বিশেষণ ছাড়ল। তারপর ওর দিকে ফিরে বলল, ‘আপকো লগা হ্যায়? মাফ কর দিজিয়েগা। ও কমবখত আয়সে অচানক ব্রেক দাবায় কে মেরা তো গাড়িহি ঠোক যাতা।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।’ রুহান সোজা হয়ে বসল। পায়ের হাঁটুতেও জার্ক লেগেছে ভালই। সামনের সিগনালটা লাল হয়ে আছে। সিগনাল টপকে আরও একটু যেতে হবে। তারপর ডান দিকে বাঁক নিতে হবে। ও ভাবল, বুকুদা কি চলে এসেছে? তাড়াহুড়োয় মোবাইলটাও ফেলে রেখে এসেছে বাড়িতে। ঘড়িও পরেনি। ক’টা বাজে কে জানে! লেট হয়ে গেলে কি বুকুদা রাগ করবে? ওর আবার মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা। সেই অশোকনগর থেকে ট্রেন ধরে ফেরার দিন, বুকুদার দেখা করতে চাওয়ার কথা।
দমদমে বুকুদার গাড়িতে বসে বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল রুহান। কী বলবে বুকুদা?
বুকুদা গম্ভীর হয়ে বসে ছিল। কাঁচাপাকা চুল। একাগ্র চোখ। শক্ত চোয়াল। কিছু জিজ্ঞেস করতে বেশ সংকোচ হচ্ছিল রুহানের। আসলে পুরনো বুকুদা আর এই বুকুদাটা তো এক নয়! এই বুকুদা কেমন যেন ল্যামিনেটেড। মোম পালিশ করা। খুব বড় কাচের দরজাওলা দোকানে ঢুকতে যেমন সংকোচ হয়, এই বুকুদাকে দেখে ঠিক তেমনই সংকোচ হচ্ছিল রুহানের। তবু সাহসে ভর করে ও কাচের দরজার হাতলে হাত রেখেছিল, ‘বুকুদা, কিছু বলবে না?’
‘তোকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করব হান। ঠিকমতো উত্তর দিবি?’
দপ করে মাথায় একটা শিরা জ্বলে উঠেছিল রুহানের। ওর মনে হয়েছিল এই প্রশ্নটা শুনবে বলেই তো এতদিন ধরে ওর মন কুডাক দিচ্ছিল। বহু বছর পর বুকুদাকে প্রথম দেখার সময় থেকেই তো ওর মনে হয়েছিল, কবে সেই প্রশ্নটা করবে বুকুদা? কবে জানতে চাইবে মুনিয়াদির কথা?
মুনিয়াদিরা থাকত লেক গার্ডেন্সে। রুহানদের পাড়ায়। ওদের বড় হলুদ দোতলা বাড়ি ছিল একটা। যার সামনে ছিল লোহার হাফ গ্রিল দেওয়া ব্যালকনি। মুনিয়াদিরা থাকত ওপরে, দোতলায়। আর নীচে থাকত মুনিয়াদির কাকা। সেই ব্যালকনিটায় মুনিয়াদি যখন এসে দাঁড়াত তখন ওদের সারা পাড়াটা ঝলমল করে উঠত।
পাড়ার ক্রিকেটে, খেলোয়ারদের মূল অনুপ্রেরণা ছিল মুনিয়াদি। তাদের খেলার উৎসাহ মুনিয়াদিকে দেখলে চড়চড় করে বাড়ত। আর ঠিক এমনই একটা ম্যাচে, এক রবিবার সকালে বুকুদা প্রথম দেখেছিল মুনিয়াদিকে।
তখন বুকুদা মাঝে মাঝে রবিবার করে আসত রুহানদের পাড়ায়। আর নেমে পড়ত ওদের গলি ক্রিকেটে। কিন্তু বুকুদা খেলতে পারত না খুব একটা। মানে ব্যাট ট্যাটগুলো ঠিকঠাক করতে পারত না। বলটাও বেশির ভাগ ওয়াইড হত।
তেমনই একদিন বুকুদা ছ’টা বলের ছ’টাই ওয়াইড করে ঘেমে নেয়ে যখন দেখল যে, এত পরিশ্রম করেও একটা ওভারই এখনও শুরু হয়নি, তখন পায়ে ব্যথা বলে পথের পাশে বাঁধানো কৃষ্ণচূড়া গাছের গোড়ায় বসে পড়েছিল। আর ঠিক তখনই সেই গাছের পাশের হলুদ রঙের বাড়ি থেকে ঝরনার মতো কলকল করে হাসি ঝরে পড়েছিল পথে।
‘হাসছ কেন?’ বুকুদা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
‘না, এমনি।’ দোতলা থেকে ঝুঁকে মুনিয়াদি কথাটা বলে আবার হেসে ফেলেছিল খিলখিল করে।
‘আরে!’ বুকুদা চিৎকার করে লাফিয়ে উঠেছিল গাছের বাঁধানো জায়গায়।
‘বাঃ, বেশ লাফাও তো!’ মুনিয়াদির হাসি থামছিলই না যেন, ‘তো পায়ে ব্যথা লাগে না?’
বুকুদা চোখমুখ লাল করে, ‘আমি ডিক্লেয়ার দিচ্ছি’ বলে ইতিহাসে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে মাঠ, মানে রাস্তা ছেড়েছিল এই বলে যে, বোলিং ডিক্লেয়ার দিল। পরে রুহানকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কে বল তো এই হাস্যকর মেয়েটা?’
‘মুনিয়াদি।’ রুহান উৎসাহের সঙ্গে বলেছিল।
‘আচ্ছা। দেখে নেব ওকে।’ বুকুদা এমন করে বলেছিল যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম বোমার পলতেয় আগুন দিল।
তবে যেভাবে দেখতে চেয়েছিল বুকুদা সেভাবে দেখতে পারেনি। বরং এক মাস পরে নিজেকেই দেখেছিল অন্য রূপে। মুনিয়াদিকে দেখে নেওয়ার জন্য বুকুদা প্রায়ই আসতে লাগল ওদের বাড়ি। যেদিন যেদিন মুনিয়াদিকে দেখে নিত, সেদিন বুকুদার ফুর্তি হত খুব। আর তারপর যেদিন দেখে নিতে পারত না, সেদিন বুকুদাকে দেখলে মনে হত হাওয়া বের করে নেওয়া প্লাস্টিকের পুতুল। তারপর একদিন আর পারেনি বুকুদা। একটা কাগজ চার ভাঁজ করে খামে পুরে রুহানের হাতে দিয়ে বলেছিল, ‘এটা নিয়ে দৌড়ে চলে যা তো। শুধু মুনিয়ার হাতে দিবি। আর কাউকে দিবি না। কেমন?’
বয়স কম হলেও কাগজটা যে চিঠি তা বুঝতে বাকি ছিল না রুহানের। আর এটাও বুঝেছিল চিঠিটা মুনিয়াদি ছাড়া অন্য কারও হাতে পড়লে বুকুদার দুর্ভোগের শেষ থাকবে না।
হলুদ বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডোরবেল-এ হাত না পেয়ে প্রাণপণে দরজার কড়া নেড়েছিল রুহান আর অবাক হয়ে দেখেছিল দরজাটা ফাঁক হয়ে গিয়েছিল আপনা থেকে। ‘মুনিয়াদি,’ জোরে ডেকেছিল রুহান। আর সেই ডাক শুনে বেরিয়ে এসেছিল ফ্রক পরা বাচ্চা একটা মেয়ে। কে মেয়েটা? রুহান তো আগে দেখেনি কোনওদিন!
‘মুনিয়াদি নেই?’ রুহান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।
‘আছে, স্নানে গেছে। তুমি কে?’ মেয়েটা বয়সের তুলনায় বেশ গম্ভীর।
‘আমি রুহান। মুনিয়াদিকে খুব দরকার আছে।’
‘কী দরকার আমায় বলো।’ মেয়েটা রীতিমতো রাগের গলায় কথা বলেছিল।
‘বা রে।’ রুহানেরও রাগ হয়েছিল। বলেছিল, ‘বলছি না শুধুমাত্র মুনিয়াদিকেই বলব।’
‘কে রে?’ মুনিয়াদি চুলে গামছা পেঁচিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।
‘আমি রুহান।’
‘ও।’ মুনিয়াদি হেসেছিল, ‘কিছু বলবি?’
‘হ্যাঁ, একটু প্রাইভেট।’
‘প্রাইভেট?’ মুনিয়াদি অবাক হয়ে তাকিয়েছিল রুহানের দিকে। তারপর বলেছিল, ‘ঠিক আছে। এই তুই ঘরে যা।’ বাচ্চা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হুকুম দিয়েছিল মুনিয়াদি। মেয়েটা অনিচ্ছার মুখ করে চলে গিয়েছিল ভেতরে।
রুহান চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘এটা বুকুদা দিয়েছে, বলেছে তোমাকেই দিতে।’
‘তাই?’ মুনিয়াদি ঠোঁটটা কামড়ে তাকিয়েছিল রুহানের দিকে। তারপর ফিক করে হেসে চিঠিটা নিয়ে বলেছিল, ‘ও, পায়ের ব্যথাটা বুকে উঠেছে?’
মুনিয়াদি চিঠিটা নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু রুহান তখনও ওই বাচ্চা মেয়েটার অপমান ভোলেনি। ও তাই বলেছিল, ‘কে গো ওই মেয়েটা? আগে তো দেখিনি।’
‘আরে দেখবি কী করে? ওরা তো কানপুরে থাকত। এখন এখানে চলে এসেছে। আমার মামাতো বোন। আলিপুরে থাকে। আজ বেড়াতে এসেছে।’
‘ও।’ রুহান চোয়াল শক্ত করেছিল, ‘বড্ড অসভ্য। কথা বলতেই শেখেনি। কী নাম গো?’
‘ওফ। তুই যা।’ মুনিয়াদি প্রায় দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।
তবু রুহান চেষ্টা ছাড়েনি। বলেছিল, ‘যাচ্ছি তো। কিন্তু ওই মেয়েটার নামটা কী?’
মুনিয়াদি দরজাটা বন্ধ করতে করতে বলেছিল, ‘ওর নাম নন্দা।’
সেই বয়সটা ছিল জলের মতো। পাহাড়ি নদীর মতো। লাল ফল টুপ করে ঝরে পড়লেও সে নদী তাকাত না। সে নিজের খেয়ালে রাজা। সে নিজের আনন্দে বিভোর। বিশ্বসংসার তার কাছে অবলুপ্ত। সে শুধু আনন্দ জানে, বহতা স্রোত জানে। সেই স্রোতে ভাসার, নিজেই স্রোত হয়ে ওঠার সময় ছিল সেটা। রুহানের মাথাতেই আর ছিল না সেই চিঠির ঘটনাটা। ওর খেলা আর পড়াশুনোর ভেতর ডুবে গিয়েছিল সব।
তারপর হঠাৎ একদিন মুনিয়াদির বাবা এল বাড়িতে। তখন দুপুরবেলা। ভদ্রলোক এসে অনেক চিৎকার চেঁচামেচি করল। দেখে নেবে টেবে বলল। তারপর ডেকে আনা হল বুকুদাকে। ককাই আর কাকিমা মিলে ঠান্ডা মাথায় বোঝানো শুরু করল। কিন্তু মুনিয়াদির বাবা কিচ্ছু শুনল না। বরং চিৎকার করল আরও। বলা হল বুকুদা অসভ্য, বাজে, ইতর। রুহান দেখেছিল সব। সিঁড়ির কোনায় দাঁড়িয়ে দেখেছিল বসার ঘরে মাথা নিচু করে বসে সব শুনে যাচ্ছে বুকুদা। কোনও কথা বলছে না। কোনও প্রতিবাদ করছে না।
তারপর একসময়ে বুকুদা উঠে বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। রুহান দৌড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ওদের বারান্দায়। দেখেছিল রোগা পাতলা বুকুদা চলে যাচ্ছে মাথা নিচু করে। শুধু যেতে যেতে ওই কৃষ্ণচূড়া গাছটার কাছে এসে একবার থমকে দাঁড়িয়েছিল বুকুদা। তাকিয়েছিল সেই হলুদ বাড়ির ব্যালকনির দিকে। শূন্য ব্যালকনির রেলিং-এ দুটো চড়াই লাফাচ্ছিল শুধু। শুধু হাওয়া এসে নাড়িয়ে দিচ্ছিল টবের পাতাবাহার। আর রোদ্দুর একা একা দাঁড়িয়ে ছিল পুরনো দেওয়ালে।
এত বছর হয়ে গেছে, তবু, সেই চলে যাওয়াটুকু কী অদ্ভুতভাবে মনে আছে রুহানের! সেই নুইয়ে পড়া রোদ, ঝিরঝির কৃষ্ণচূড়া আর হলুদ বাড়ির সামনে দিয়ে মাথা নিচু করে চলে যাওয়া বুকুদা। ভালবাসা আর তার থেকে বিতাড়িত মানুষকে সেই প্রথম দেখেছিল রুহান। বুকুদা আর কোনওদিন আসেনি এ পাড়ায়।
পরে মুনিয়াদিরাও বাড়ি বিক্রি করে চলে যায়। তবে ততদিনে রুহানের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল সেই ছোট্ট রাগী মেয়েটার। তাই মুনিয়াদিরা চলে গেলেও নন্দার সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমশ জমাট হয়েছিল রুহানের। আর নন্দার থেকেই ও খবর পেত মুনিয়াদির। নাকতলার ভেতরের দিকে চলে গিয়েছিল মুনিয়াদিরা। ওর বাবার কোম্পানি লকআউট হয়ে গিয়েছিল বলে বড় বাড়িটা বিক্রি করে ছোট্ট বাড়ি কিনেছিল ওরা। আর সেখানেই একটা স্টেশনারি দোকান দিয়েছিল। মুনিয়াদি একটা বাচ্চাদের স্কুলে পড়াবার জন্য চাকরি নিয়েছিল। তারপর হঠাৎ মুনিয়াদির বাবা মারা যায়। মা মুনিয়াদির বিয়ে দিলেও ডিভোর্স হয়ে যায় বছর দুয়েকের মধ্যেই।
এ সবই সেদিন গাড়িতে বসে বলেছিল বুকুদাকে। বুকুদা গাড়িটা নিয়ে দাঁড় করিয়েছিল সায়েন্স সিটির উলটোদিকের ফুটপাথ ঘেঁষে। রুহানের কথা শোনার সময় একটাও প্রশ্ন করেনি বুকুদা। শুধু সিগারেট ধরিয়ে গেছে একটার পর একটা। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এখনও মুনিয়া নাকতলায় আছে? স্কুলে পড়ায়? আর হান, নন্দার সঙ্গে তোর সম্পর্ক টিকল না কেন রে?’
রুহান দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল, ‘বনিবনা হচ্ছিল না বুকুদা। তাই…’
‘হান, তুই আমায় একবার মুনিয়াদের বাড়িতে নিয়ে যাবি?’
‘আমি?’ একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল রুহান।
‘প্লিজ হান। একবার।’ বুকুদাকে অমন গলায় কোনওদিন কথাই বলতে শোনেনি ও।
রুহান বলেছিল, ‘ঠিক আছে। কিন্তু দূর থেকে দেখিয়ে দেব। কাছে যাব না। কেমন?’
বুকুদা ম্লান হেসে বলেছিল, ‘নন্দার ব্যাপার নিয়ে তোর আজও খচখচ আছে, না? ঠিক আছে, দূর থেকেই দেখিয়ে দিস। কেমন?’
কেন এত বছর পরও মুনিয়াদির খোঁজ করল বুকুদা? জিয়ানা-তুতুলদের নিয়ে তো ভরাট সংসার। তা হলে? তা হলে কি যা ভরতি দেখায় তা আসলে ভরতি নয়? যা সুন্দর দেখায় তা আসলে গভীর ছলনামাত্র! বুকুদাকে তো ফিরিয়ে দিয়েছিল মুনিয়াদিরা। সেই তরুণ, মনখারাপ করা, রোগা আর নড়বড়ে কনফিডেন্সের বুকুদাকে তো এই বুকুদা পিছনে ফেলে দিয়েছে লক্ষ লক্ষ মাইল। এখনকার বুকুদা যদি সেদিনের মুনিয়াদির বাবার সামনে দাঁড়াত, তবে কি আর অমনভাবে চলে যেতে বলতে পারত ওরা বুকুদাকে? পারত না, রুহান জানে। এই বুকুদার জন্য গর্ব হয় রুহানের। মনে হয়, একদিন যাকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছিল আজ সেই ফিরে এসেছে দশ গুণ বেশি শক্তিশালী হয়ে। অন্ধকারের ভেতর থেকে, পরাজয়ের ভেতর থেকে, অপমানের ভেতর থেকে এই যে চিরন্তন ফিরে আসার গল্প, এটাই তো বাঁচতে শেখায়। তাই বুকুদাকে দেখলে নতুন করে বাঁচতে শেখে রুহান।
তবে মুনিয়াদি নিশ্চয়ই কিছু বলেছিল বুকুদাকে, তাই অমন রেগে ঝাড় দিয়েছিল ফোনে। আসলে সেদিন তো দূর থেকেই বাড়িটা দেখিয়ে দিয়ে চলে এসেছিল ও। ও তো জানে না, তারপর থেকে কতটা কথা হয়েছে বুকুদা আর মুনিয়াদির। তবে এটা জানে যে, বুকুদার কাছে ওর নামে খারাপ রিপোর্ট গেছে।
তা প্রায় পাঁচ মাস বুকুদা যোগাযোগ করেনি রুহানের সঙ্গে। রুহানও নিজের থেকে যোগাযোগ করতে যায়নি। এমনকী বাড়িতেও যায়নি বুকুদাদের। জিয়ানা দু’-একবার ডেকেছিল, তবে এড়িয়ে গেছে। আসলে জিয়ানাকেও তো বলা যায় না কী হয়েছে। ও তো জানে না জিয়ানা কতটা জানে মুনিয়াদি সম্পর্কে। বা আদৌ জানে কিনা! আর দ্বিতীয়ত, জিয়ানা যদি প্রশ্ন করে রুহানের অতীত খুঁড়তে শুরু করে, তবে? রুহান নিজে তো বিপাকে পড়বে। বরং জিয়ানা যখন নিজের থেকে বলেছে যে, আজকাল বুকু খুব উজ্জ্বল থাকে, আনন্দে থাকে, তখন একটা অদ্ভুত ফিলিং হয়েছে রুহানের। ও তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পালটে চলে গেছে অন্য প্রসঙ্গে। মনে হয়েছে যদি বুকুদার প্রসঙ্গ ধরে চলে আসে অন্য প্রসঙ্গ। যদি তাতে কোনওভাবে জড়িয়ে যায় রুহানের নাম! না, এখনও পার্মানেন্ট হয়নি রুহান। তবে জিয়ানা চেষ্টা করছে। কিন্তু সে জন্য নয়। জিয়ানা যদি জেনে যায় যে, বুকুদার পুরনো প্রেমিকার সঙ্গে রুহান আবার বুকুদার দেখা করিয়ে দিয়েছে, তা হলে রুহানের চাকরি পার্মানেন্ট হবে না-এমন ভয় ও পায় না। আসলে ও ভয় পায় ভুল বোঝার। বিশ্বাস হারানোর। ও যদি বিশ্বাস হারায় জিয়ানার, তবে? পছন্দের মানুষের, কাছের মানুষের বিশ্বাস হারানো খুব যন্ত্রণার। প্রতিদিন সেই যন্ত্রণার দেখা পায় ও। তাই জিয়ানার বিশ্বাস আর হারাতে চায় না। ফলে বুকুদার কথা উঠলে খুব যত্নে পাশ কাটিয়ে যায় ও।
সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের সিগনাল পেরিয়ে আবার লেক রোডের মুখে সিগনালে আটকাল ওর ট্যাক্সি। রুহান জানলার থেকে সরে বসল, ভীষণ রোদ উঠেছে। জানলা দিয়ে গরম হলকা এসে পুড়িয়ে দিচ্ছে সব। রুহানের শরীরও কাঁচা লোহার মতো গরম হয়ে আছে। এখন গরম হাওয়া লাগলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে। তখন আরও কেলেঙ্কারি হবে। আবার রাহি শুনলে বলবে, ‘বাচ্চা নাকি?’
এমনভাবে হঠাৎ রাহির কথাটা মনে পড়তে নিজের কাছেই লজ্জা পেল রুহান। ছি ছি। এমন একটা কাণ্ড করে ফেলেছে যে রাহির সামনে যাওয়ার মুখটা নেই ওর। সেদিন কী হয়েছিল হঠাৎ! এমন ভূত যে কেন লাফিয়েছিল মাথায়! আসলে রাহির প্রতি ভাললাগাটা বরাবরই ছিল। তবে সেটা যে আচমকা বেড়ে যাবে তা ঠিক বুঝতে পারেনি রুহান।
সেদিন রবিবার ছিল। ছুটি ছিল রুহানের। বাড়িতেই বসে ছিল। আর কেন কে জানে, সেদিন তীব্রভাবে রাহির কথা মনে পড়ছিল ওর। অমন বাদামি চুল। টোলপড়া থুতনি। অমন চোখ। বিছানাটা মনে হচ্ছিল কাঁটার তৈরি। মনে হচ্ছিল মাথাটা ফেটে যাবে যন্ত্রণায়। চোখ দুটো বেরিয়ে আসবে বাইরে। হঠাৎ ভীষণ জলতেষ্টা পাচ্ছিল রুহানের। রাগ হচ্ছিল। কষ্ট আর হিংসা একই সঙ্গে অ্যাসিডের মতো গড়াচ্ছিল বুকের ভেতর। হঠাৎ এমন তীব্র অস্থিরতা থেকে নিজেকে বাঁচাতে কী করবে বুঝতে পারছিল না রুহান। কোথায় গেলে, কার সঙ্গে কথা বললে শান্তি পাবে, বুঝতে পারছিল না একদম। আর ঠিক তখনই ফোন করেছিল কিগান।
খুবই অল্প কথা হয়েছিল কিগানের সঙ্গে। কিগান জিজ্ঞাসা করেছিল কেন রুহান আর বিশেষ যায় না চাপাডাঙায়। কেন ফোনও করে না। রুহান কথা বলতে পারছিল না। ও তো আর বলতে পারে না যে, চাপাডাঙাটা ওর এখন চোরাবালির মতো লাগে। যেখানে অসহায়ভাবে ডুবে যাওয়া ছাড়া আর ওর কোনও উপায় নেই। কিন্তু সে ডুবে যাওয়ার কোনও জীবন নেই, বরং মৃত্যু আছে। তাই বিশেষ যায় না ও। তারপর কথা ঘোরাতে ও জিজ্ঞেস করেছিল কিগান কী করছে। আর এই প্রশ্নটা করেই ভুল করেছিল ও। কিগান বলেছিল যে, ও রাহির বাড়ি যাবে দুটো ডিভিডি ফেরত দিতে।
রাহি! নামটা শুনে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল রুহানের। কিগানের থেকে ছিটকে এসে নামটা গুলির মতো এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছিল রুহানকে। ওর যেন মাথার ব্যথাটা বেড়ে গিয়েছিল কয়েক গুণ। ও অবসন্ন হাতে কোনওমতে কথা বলে রেখে দিয়েছিল ফোনটা। কিন্তু ফোন তো যন্ত্র। ইচ্ছে হলে সরিয়ে রেখে দেওয়া যায়। কিন্তু মানুষের চিন্তা তো তা নয়। এটাকে সরিয়ে রাখবে সাধ্য কার?
তবে লড়াই করেছিল রুহান। নিজের সঙ্গে তীব্র লড়াই করেছিল। কিন্তু অন্যান্য সব বারের মতো, হারের ট্র্যাডিশন পালটাতে পারেনি। ও বুঝেছিল এমন ছেলেমানুষি কষ্ট আর হিংসের থেকে মুক্তির উপায় একটাই। যোগাযোগ। আর সেটা এক্ষুনি করতে হবে।
রুহান দ্রুত জামাকাপড় বদলিয়ে লেক গার্ডেন্স স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে শিয়ালদা স্টেশন চলে গিয়েছিল।
তখন রীতিমতো হাত-পা কাঁপছিল ওর। কষ্ট হচ্ছিল। ভেবেছিল একবার কি ফোন করবে রাহিকে? কিন্তু তারপর মত পালটেছিল। ভেবেছিল, রাহিকে আচমকা ফোন করে কিছু বললে ও ঘাবড়ে যেতে পারে। ভুল বুঝতে পারে। এ ছাড়া কথা বলার সেই অভিজ্ঞতা তো আর রুহান ভোলেনি। মায়ের ওপর রাগ করে যা ইচ্ছে তাই বলেছিল ও রাহিকে। তারপর থেকে তো রাহি একরকম এড়িয়েই চলে রুহানকে। আর সেই রুহান যদি এমন একটা স্পর্শকাতর ব্যাপার নিয়ে আচমকা ফোন করে তবে আর দেখতে হবে না। তাই ঠিক করেছিল মেসেজ করবে রুহান। নিজের মনে ছড়ানো-ছিটানো সমস্ত সাহসকে একত্র করে এনে তার ওপর ভর দিয়ে রাহিকে একটা এসএমএস করেছিল রুহান।
তবে উত্তর এসেছিল বেশ কিছু পরে ছোট্ট, স্পষ্ট জবাব। রাহি লিখেছিল-‘আজ নয়। আমি ব্যস্ত আছি। লোকজন এসেছে বাড়িতে। পরে একদিন হবে।’
তবু রুহান মানেনি। জেদ করে আরও বড় একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল। লিখেছিল, ‘দেখা করতেই হবে।’
উত্তর এসেছিল আরও দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত, ‘বাচ্চা নাকি? বলছি না, পরে একদিন হবে।’
একদিন হবে। বাবা বলত একদিন হবে। মা বলত একদিন হবে। সবাই বলত একদিন হবে। কিন্তু সেই একদিনটা কই? কবে আসবে সেই একদিন? কবে আর পৃথিবী ভাল করে চোখ মেলে দেখবে যে, রুহান বলে একজন আছে? আর তার পছন্দের জিনিসগুলো একদিন নয়, আজই চাই। অনির্দিষ্ট একদিনের জন্য তার আর ফেলে রাখার সময় নেই।
উৎসাহী চড়াই যেমন আচমকা ভিজে গিয়ে তার সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে ফেলে, রুহানের নিজেকে তেমনই মনে হয়েছিল। অত বড় একটা স্টেশনে, অত মানুষের মাঝে নিজেকে খুব ছোট আর অতিরিক্ত মনে হয়েছিল। বরং লজ্জা লাগছিল ওর। কষ্ট হচ্ছিল। এমন ছেলেমানুষি করার জন্য নিজেকে মারতে ইচ্ছে করছিল। মনে হচ্ছিল সামনে সার দিয়ে দাঁড়ানো হলুদ-সবুজ ট্রেনের মাথায় বসা পায়রার যে গুরুত্ব আছে, ওর তার সিকি ভাগও নেই। মনে হচ্ছিল ওর কোনও মূল্যই নেই। মাথা নিচু করে বাড়ি ফিরে এসেছিল রুহান। তারপর আর যোগাযোগ করেনি রাহির সঙ্গে।
কফি শপের সামনে এসে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিল রুহান। নামতে গিয়ে পায়ে ব্যথা লাগল আবার। এই শপটার সামনে দিয়ে বহুবার গিয়েছে রুহান। কিন্তু ভেতরে ঢোকেনি। কেমন যেন ভয় আর লজ্জা করে। দেখেই মনে হয় খাবারের দাম বেশি হবে। মানুষজনগুলোও যেন কেমন বেশি চকচকে। একটু যেন অন্যরকম। ভুরুটা যেন সামান্য তুলে একটু অন্যভাবে তাকায় একে অপরের দিকে। এখন ঢুকতে গিয়েও কেমন যেন বুকটা কাঁপল ওর।
‘কী রে! এতক্ষণ সময় লাগল?’ বুকুদা বসে ছিল একটা গোলমতো টেবিলে। সামনে ইয়াব্বড় একটা কফির মগ। বুকুদা জিজ্ঞেস করল, ‘ফোন করছি। বেজেই যাচ্ছে। কেসটা কী তোর?’
‘সরি বুকুদা, তাড়াহুড়োয় ফোনটা বাড়িতে রেখে এসেছি। আর সাইলেন্ট করা আছে তো, তাই হয়তো মা-ও শুনতে পায়নি।’
‘ও।’ বুকুদা একটু হেলিয়ে বসল, ‘কী খাবি? কফি? সঙ্গে?’
‘শুধু কফি।’ রুহান ডান পা-টাকে সাবধানে রেখে বসল। তবে ওর ভাল লাগল যে, বুকুদার গলায় কোনও মেঘ নেই।
‘হান,’ বুকুদা ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ‘আয়াম সরি। লাস্ট টাইম, আই ওয়াজ ভেরি রুড টু ইউ। আসলে এমন একটা কথা শুনলাম। তাই…’
রুহান হাসল, ‘ঠিক আছে বুকুদা, নো প্রবলেম।’
‘না রে হান, এভাবে বলা যায় না। প্রবলেম আছে কি নেই সেটা এভাবে বোঝা যায় না।’
‘তাও। তুমি ভেবো না বুকুদা। সব ঠিক আছে।’ রুহান হাসল।
‘জানিস, মুনিয়ার মাথার অনেক চুল কেমন সাদা হয়ে গেছে! এখন হাইস্কুলে পড়ায়। গম্ভীরও হয়েছে আগের চেয়ে। দেখে এত অদ্ভুত লাগে! মনে হয়, এই মেয়েটাকেই একদিন এত ভালবেসেছি! এই মেয়েটার জন্যই জোর করে একদিন চলে গেলাম বিদেশে! সময় সব কেমন পালটে দেয় জানিস হান। এখন মুনিয়াকে দেখলে আর তেমন উথাল-পাথাল মনখারাপ করে না। শুধু তিরতিরে একটা কষ্ট হয় বুকে। যখন ফোন করে, ওর বাড়িতে গেলে যখন জল নিয়ে এসে বসে, তখন কেমন যেন গ্লাস উলটে পড়ে যাওয়া জলের মতো কষ্ট হয়। মনে হয় কী যেন হল না এ জীবনে।’
রুহান সামনে দিয়ে যাওয়া কফির কাপে ঠোঁট ডোবাল। তারপর বলল, ‘এসব আর ভেবো না বুকুদা। বউদি জানলে কষ্ট পেতে পারে।’
‘জিয়ানা?’ বুকুদা হাসল, ‘না, এসব বলব না ওকে। কী হবে বলে? মুনিয়া এখন আমার বন্ধু ছাড়া তো আর কিছু নয়। ফলে অনর্থক জটিলতা বাড়িয়ে লাভ কী? জিয়ানা শুধু জানে, মুনিয়া নামে একজন পুরনো বান্ধবীর সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়েছে। ব্যস।’
হাসল রুহান, ‘সেই ভাল।’
‘দেখ, মুনিয়া আমায় বলেছে তোর আর নন্দার ব্যাপারটা। নন্দা এসে খুব কেঁদেছিল ওর কাছে। রুহান কেন এমন করল? কেন নন্দার বাবার থেকে টাকা নিল! মুনিয়া খুব রেগে আছে তোর ওপরে। আর আমায় যখন বলল তখন আমারও এমন মাথা গরম হয়ে গেল যে, তোকে ফোনে গালাগাল করে বসলাম।’
‘আরে তুমি ছাড়ো না,’ রুহান হাসল আবার, ‘এসব কেন মনে করছ!’
‘না রে হান, হঠকারীর মতো কাজ করা আমার আজও গেল না। গত এক মাস ধরে আমার কেবলই মনে হচ্ছিল যে, তোর সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু ইগো আমার যে এখনও এতটা অবশিষ্ট আছে বুঝিনি। তারপর গতকাল রাতে তুতুল এমন করে বলল…’ বুকুদা মাথা নাড়ল।
‘কী বলল?’ জিজ্ঞেস করল রুহান।
‘খেলছিল একা একা। কম্পিউটার গেমস। ওই গুলি টুলি করে মারপিটের মতো খেলা। যদিও এসব ওর খেলা বারণ। তবু কাঁহাতক আর একটা বাচ্চাকে এটা না ওটা না বলা যায়! তা হঠাৎ দেখি, নিজের থেকেই খেলা গুটিয়ে নিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম-কী রে খেলবি না আর? তুতুল বলল, ভাবলাম আর মারব না লোকজন। ভাবলাম ক্ষমা করে দিই। কী হবে মারামারি করে! রাগ করে! ঠিক না বাবা?’
বুকু থামল একটু, কফিটায় চুমুক দিয়ে বলল, ‘একটা বাচ্চা এটা জানে আর আমি জানি না? এতদিন ধরে এত কিছু দেখলাম, শেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু এটা শিখতে পারলাম না? লজ্জা হল, জানিস হান, এত লজ্জা লাগল! আমি তাই ফোন করলাম তোকে।’
‘ভাল করেছ। তা ডাকলে কেন গো?’
‘তুই আমার রুড ব্যবহারের জন্য ক্ষমা করিস। আর পারলে নন্দার থেকেও ক্ষমা চেয়ে নিস!’ বুকুদা শান্ত গলায় বলল।
‘ক্ষমা তুমি চেয়ো না বুকুদা। আমি সত্যিই খারাপ কাজ করেছি। অন্যায় বলতে পারো। প্রতারণা বলতে পারো। তবে ক্ষমা চাইতে নন্দাকে ফোন করেছিলাম বহুবার। ও ফোনই ধরেনি। বলেছিল ওর নাকি ঘেন্না হয়।’
‘কেন এমন করেছিস হান? আমায় বল তুই। এত টাকার দরকার কেন ছিল তোর?’
রুহান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই প্রশ্নটা যে কতবার কত লোকের মুখে ও শুনেছে! কিন্তু কোনওদিন উত্তর দেয়নি। আসলে নিজের চূড়ান্ত অক্ষমতার কথা কে আর বড় মুখ করে লোকের কাছে বলতে চায়? ও-ও চায়নি। কিন্তু একদিন তো বলতেই হবে। অন্তত একজনের কাছে তো বলতেই হবে। কিন্তু সে কে? বুকুদা? আর কী বলবে রুহান? বলবে যে, মায়ের অপারেশনের জন্য ষাট হাজার টাকার দরকার ছিল। কোথাও জোগাড় করতে পারেনি ও! আর সেই সময়ই নন্দার বাবাও টাকার অফার করেছিল ওঁর মেয়ের জীবন থেকে সরে দাঁড়াবার মূল্য হিসেবে? এসব সময় নায়করা কী করে? মেয়ের বাবার মুখের ওপর টাকা ছুড়ে প্রেমের জয়গান গেয়ে ফিরে আসে? আর সক্কলের হাততালি পায়? হবে হয়তো। কিন্তু রুহান তো আর নায়ক নয়। ওর মাকে বাঁচানো, প্রেমটাকে বাঁচানোর চেয়ে জরুরি ছিল। তাই হাত পেতে টাকাটা নিয়েছিল রুহান। মাথা নিচু করে নিয়েছিল। কিন্তু এসব কী বলবে বুকুদাকে? বুকুদা কি এসব বুঝবে?
‘আমি অন্য কোনওদিন বলব বুকুদা। প্লিজ আজ নয়। ধরে নাও আমি অর্থপিশাচ।’ রুহান মাথা নিচু করল।
বুকুদা জোর করল না আর। বলল, ‘ঠিক আছে। বাদ দে। আচ্ছা, চাকরি করবি?’
‘মানে?’ রুহান চমকে গিয়ে হাসল।
‘আমাদের অফিসে। তবে বাইরে গিয়ে থাকতে হবে। পার্মানেন্ট চাকরি। করবি?’
‘না গো দাদা। আমি এখানেই ঠিক আছি।’ রুহান মাথা নামিয়ে নিল।
‘সে কী রে!’ বুকুদা অবাক হল।
‘হ্যাঁ। আমার প্রোজেকশন কর্প-ই ভাল। কলকাতা ছেড়ে যাব না। জানি, বাঙালিরা এমন হয়, সবাই বলে। বলে হোম সিক, ভিতু, রিস্ক নেয় না। না, সব বাঙালি নয়, কিন্তু অধিকাংশ। আমিও তো অধিকাংশর দলেই।’
‘তবু,’ ঝুঁকে বসল বুকুদা, ‘কী বলছিস তুই? এমন সুযোগ কেউ হারায়? ওই জিয়ানাদের কোম্পানিতে কবে তুই পার্মানেন্ট হবি তার ঠিক আছে? দেখ, ওর চাকরিই থাকে কিনা! খুব টেনশন যাচ্ছে ওই নর্থ-চব্বিশ পরগনার কাজটা নিয়ে। আমাদের এখানে আয়। তোকে পুনে পাঠিয়ে দেব। ভাল থাকবি।’
‘না গো বুকুদা। আর বোলো না।’
‘এমন জীবনের মানে কী হান? জিয়ানার কাছে শুনলাম, তুই খেলাও ছেড়ে দিয়েছিস! কোনও ক্লাব পাসনি! এভাবে কতদিন চালাবি? জীবনের তো একটা মানে থাকে। একটা তো ড্রাইভ থাকে। একটা উত্তরণ থাকবে না? এমন করে জীবন কাটাবি? পাগল?’
‘জানো বুকুদা, একবার ময়দানের কাছে একটা সাইকেল চড়া পাগল দেখেছিলাম, সে একটা গান গাইছিল-Sing for the song boys, sing for the song/ I do not do things that my heart says wrong। পরে জেনেছিলাম, বেলাফন্টের একটা বিখ্যাত গানের থেকে প্রথম লাইনটা নেওয়া। কিন্তু পরের লাইনটা ওর নিজের তৈরি। আমি এখনও ওই গানটার মতোই চিন্তা করি।’
‘মুনিয়ার সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দিয়েছিস বলে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তা বলে এটা মানছি না। তুই ভুল করেছিস। আর তুই মনের কথা শুনিস! তা হলে নন্দার সঙ্গে অমন করলি কেন? ক’টা টাকার জন্য?’
‘তুমি বোধহয় আমায় চাকরির কথাটা বলতে ডেকেছিলে, না?’ রুহান বিষণ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ। আর ভেবেছিলাম তুই আমায় বলবি নন্দার ব্যাপারটা।’
‘থ্যাঙ্ক হউ বুকুদা। আর নন্দার ব্যাপারটা কিছু বলার নেই। সত্যি টাকা নিয়েছিলাম। নন্দার কাছে দোষ করেছি আমি। তাই তোমায় চোরের মতো বাড়িটা দেখিয়ে দিয়ে চলে এসেছিলাম। আমার গল্প এটুকুই। সবার গল্পে উত্তরণ থাকে না বুকুদা। কারও কারও গল্প আমার মতোও হয়। একটা দিন আরেকটা দিনের মতো করেই কাটে তাদের। তারা শুধু বেঁচে থাকে। আমারও কোনও বড় গল্প নেই, জানি হবেও না। এটাই আমার পক্ষে ঠিক আছে। কেন ঠিক আছে, জানি না। কিন্তু ঠিক আছে।’
বুকুদা কিছু বলতে গিয়েও হাসল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, ‘আমি চাই ঠিক থাকুক। সত্যি, তুই যা করছিস, তাতে আনন্দ পেলেই হল। আয় তবে।’
রুহান হেসে উঠে পড়ল। আর বসার মানে হয় না যে।
রোদটায় এবার কমলা ছোপ লাগছে। লেকের দিক থেকে হাওয়া দিচ্ছে একটা। আর কী আশ্চর্য পায়ের ব্যথাটাও কম! দুপুরের ওষুধ কি এখন কাজ দিচ্ছে?
ফেরার পথটা হেঁটেই ফিরবে। আর ট্যাক্সির খরচ নিতে পারবে না ওর সামান্য পকেট। এই পথটার দু’পাশেই গাছ। উলটোদিকে একটা বড় ফুলের দোকান। তার শোকেসে নানারকম ফুল সাজানো রয়েছে। সেই কাচে রোদের কুচি এসে পড়েছে কিছু। রুহান ছায়ায় ছায়ায় হাঁটতে লাগল। বুকুদা এখনও বসে রয়েছে কফি শপে। কিন্তু ওকে তো ফিরতে হবে। ওর মা বসে রয়েছে। ওকে ওই গুঁজিয়া কিনে ফিরতে হবে মায়ের কাছে। যতই বকুক, মা তো। মায়ের আর কে আছে ও ছাড়া? দুঃখের কথা, রাগের কথা মা আর বলবেই বা কাকে? এই মা, এই শহর, অসম্পূর্ণ সব ইচ্ছে আর একাকিত্ব—এইসব নিয়েই তো রুহান। হয়তো কোনও বলার মতো জার্নি নেই ওর। তবু দূরত্ব পেরোবার, একটা সামান্য মানুষ হয়েও বেঁচে থাকার চেষ্টা তো আছে!
ও দেখল লেকের মাঠে ছেলেরা খেলছে। ক্রিকেট। আরে ওই রোগা কালো ছেলেটা এমন বড় রান-আপ নিচ্ছে কেন? রুহান দাঁড়িয়ে পড়ল মাঠের পাশের খয়াটে রেলিং ধরে। ছেলেটার হাতে বল। মরা লাল রং। সেলাইটাও বোধহয় ছেঁড়া। যারা খেলছে তাদের শরীরও তেমন শক্তপোক্ত নয়। তাদের পরনে হাফ প্যান্ট। এক পায়ে প্যাড। উইকেটে বেল নেই। দেখেই বোঝা যায় আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। তবু এক পায়ে প্যাড, পট্টি লাগানো ব্যাট আর সেলাই ওঠা ডিউস বল নিয়ে ওরা খেলছে। রোগা, কালো ছেলেটা লম্বা রান-আপ নিচ্ছে।
রুহান দেখল কালো ছেলেটা দৌড় শুরু করল। আঙুল দুটো বলের সেলাইকে ধরে রেখেছে। রুহান মাঠের ভাঙা রেলিং-এ হাত দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়াল। হাওয়া আসছে কোনাকুনি। ভাল ইনসুইং হবে। কিন্তু ছেলেটা কি সেটা জানে? ও কি পারবে বলটাকে ঠিক জায়গায় রাখতে?
রেলিং-এর একটা দিক ভাঙা। রুহান চট করে তার ভেতর দিয়ে গলে আরও কাছে চলে গেল। ওকে দেখতে হবে ভাল করে। ওই ছেলেটা লাফাল। হাতটা মাথার ওপর তুলে ছুড়ে দিল বলটা। শর্ট অব লেন্থ-এ পড়ে বলটা উঠল মাথা সমান। ব্যাটসম্যান বুঝতে ভুল করল আর মাথা বাঁচাতে কোনওমতে ব্যাটটা ঘোরাল। ব্যাটের কানায় লেগে উঠে গেল বলটা। তারপর উড়ে গেল ডিপ স্কোয়ার লেগের দিকে। একটা ছেলে ছুটছে। বলটা ধরবে বলে দুটো হাত বাটির মতো করে ছুটছে। বলটা উড়ে যাচ্ছে। উড়েই যাচ্ছে। রুহান অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল বলটা উড়তে উড়তে বাউন্ডারি পেরিয়ে গেল। ছয়!
বোলার ছেলেটার মুখ ঘামে ভরতি। চোখে কষ্ট। এতটা দৌড়ে এসে বলটা করল, তাতে ছয়! ছেলেটা অসহায়ের মতো তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। এরপর কী করবে ও? কোথায় বল ফেলবে? ব্যাটসম্যানটা হাসছে। হাসবেই তো। ক্রিকেট ব্যাটসম্যানের খেলা। বোলাররা তো শুধু বল করে যাবে। রক্ত, ঘাম এক করে পালিশ আনবে বলে। আর তাকে অন্যরা মারবে। মারবে? শুধু মেরেই যাবে!
‘এই যে ভাই,’ রুহান হঠাৎ হাত তুলে বোলার ছেলেটাকে ডাকল।
‘আমায় বলছেন?’ ছেলেটা হতভম্ব হল।
‘তোমারটা হচ্ছে না।’
‘মানে?’ বোলার ছেলেটা এগিয়ে এল কাছে।
‘মানে,’ রুহান বলটা চেয়ে হাতে নিল, গ্রিপ দেখিয়ে বলল, ‘এভাবে ধরো।’
অন্য ছেলেরা হাসছে। ব্যাটসম্যান ছেলেটা তো কীসব যেন বলছেও।
রুহান পাত্তা দিল না, বলল, ‘বলটার সিমটা তেমন মরেনি এখনও। একদম ব্লক হোলে ফেলবে। দেখো, ব্যাটসম্যান ওপেন চেস্টেড স্টান্স নিচ্ছে। ইয়র্কার দিলে সামলাতে পারবে না। বাঁ পা এগোতেই পারবে না তো। দাও, ইয়র্কার দাও।’
ছেলেটা আবার রান-আপ নিচ্ছে। ব্যাটসম্যান হাসছে। অন্যরাও হেসে কীসব বলছে রুহানকে দেখে। রোদ গাঢ় কমলা হচ্ছে আবার। আবার হাওয়া দিচ্ছে কোনাকুনি। রুহান চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইল ছেলেটার দিকে।
ছেলেটা দৌড় শুরু করল। পায়ের তলায় মরা ঘাস থেকে ধুলো উড়ছে। কোনাকুনি হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে শরীর। একাগ্র চোখে, চোয়াল শক্ত করে দৌড়োচ্ছে ছেলেটা। রুহান উত্তেজনায় হাতের মুঠো শক্ত করে তাকিয়ে রইল। দেখল, লাফিয়ে উঠে ছেলেটা ছুড়ে দিল বলটা। পালিশ ওঠা বলটা কোনার থেকে আসা হাওয়ায় বাঁক খেল একবার। তারপর গোঁত্তা খেয়ে ব্যাটসম্যানের ব্যাটের তলা দিয়ে গলে গিয়ে ছিটকে দিল স্টাম্প! ব্যাটসম্যান বাঁ পা নড়ানোর সময় পর্যন্ত পেল না।
বোলার ছেলেটা অবাক হয়ে দৌড়ে এল রুহানের দিকে, ‘আপনি কে স্যার?’
রুহান দাঁড়াল না। হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘তেমন কেউ নই।’
ছেলেটা পাশ ছাড়ল না, ‘আমাদের ক্লাবের নাম ইয়ং ফ্রেন্ডস। খুব শখ আমাদের ক্রিকেট খেলার। কিন্তু টাকাপয়সা নেই তো। তাই শিখতে পারি না। চেয়েচিন্তে আনা জিনিসপত্র নিয়ে আমরা ক্রিকেট খেলি। আপনি একটু সময় করে দেখিয়ে দেবেন আমাদের?’
‘আমি!’ অবাক হল রুহান।
আরও ছেলেরা এগিয়ে আসছে। ভিড় করছে রুহানকে ঘিরে। ব্যাটসম্যান ছেলেটা এবার বলল, ‘স্যার, আসবেন? দেখিয়ে দেবেন? দেখুন না আমরা পারি কিনা!’
‘কিন্তু…আমি…’ রুহান টালুমালু চোখে তাকাল ওদের দিকে।
‘সকালে আসবেন স্যার। ছ’টায়। আমরা থাকব। আমার নাম বিশু। আমি বল করি। আমাদের যা আছে তাই দিয়েই দেখিয়ে দেবেন। চারদিকে কত ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হয়। আমরা ঠিক পেরে উঠি না। জিতলে টাকা দেয়, জিনিসপত্র দেয়। আপনি দেখিয়ে দেবেন, দেখবেন আমরাও পারব।’
সমবেত আবেদনের সামনে রুহান দাঁড়িয়ে রইল। রোদ নরম হচ্ছে এবার। লেকের দিক থেকে আসা হাওয়ার জোরটাও বাড়ল। ওই স্টাম্প, বল, ওই মাঠ, ওই ঘাম আর রক্ত। সব এখনও ডাকছে রুহানকে। এখনও বলছে ‘চলে আয়’, বলছে ‘খেলবি চল’। রুহান বুঝতে পারছে ভিজে বারুদ শুকিয়ে আসছে। আবার আগুন চাইছে বারুদ। রোগা আবছায়া ছেলেগুলো চকমকি পাথর হাতে ঘিরে ধরেছে ওকে। আর ভিতু, মনমরা, হেরে যাওয়া রুহানকে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে অন্য এক রুহান। যে-রুহান একদিন একাই জিতিয়ে দিত ম্যাচ। যে-রুহান দৌড় শুরু করলে ব্যাটসম্যান আড়ষ্ট হয়ে যেত। যে-রুহান বোঝাত ক্রিকেট শুধু ব্যাটস্ম্যান নয়, বোলারদেরও খেলা। বোঝাত, জীবন শুধু মার খাবার জায়গা নয়, পালটা মার দেওয়ার জায়গাও।
‘আসবেন তো?’ বিশু জিজ্ঞেস করল, ‘কাল সকালে আমরা এখানেই থাকব। আসবেন তো স্যার?’
কমলা নিস্তেজ সূর্যের দিকে রুহান তাকাল একবার। ভাবল ডুবন্ত হলেও, সূর্য সূর্যই। প্রাণীজগৎ এখনও তার দিকে তাকিয়ে থাকে। রুহান হাসল সামান্য। মাথা নাড়ল। তারপর বলল, ‘আসব।’