মুহূর্তরা দু’বছর আগে – ৩০

৩০

আর কতদিন? আর কতদিন সময় আছে? আর কতক্ষণ এভাবে থাকবে মানুষটা? এমন কঙ্কালসার শরীর। সারা দেহে কালো কালো ছোপ, মাথায় খাবলা খাবলা চুল। দেখে মনে হচ্ছে ন্যাশনাল জিয়োগ্র্যাফিক-এ আফ্রিকান কোনও ভীষণ গরিব দেশের মানুষকে দেখানো হচ্ছে। অমন সুন্দর দেখতে ঝকঝকে মানুষটা এমন হয়ে গেছে! উঠতে পারছে না ঠিকমতো। দুর্বলতায় কথা বলতে পারছে না। এমনকী, পেটটাও ডিমভরা মাছের মতো ফুলে রয়েছে। পেটে জল জমে যাচ্ছে বারবার। বের করার সাতদিনের মধ্যে আবার ফুলে উঠছে পেট। শমীদাকে চেনাই যাচ্ছে না একদম। কেবিনের ভেতরে, স্যালাইনের লম্বা স্ট্যান্ডটার পাশে মনে হচ্ছে শমীদা নয়, অন্য কেউ শুয়ে রয়েছে।

শমীদার শরীরটা আবার হঠাৎ খারাপ করেছে গতকাল। তাই ভরতি করা হয়েছে নার্সিংহোমে। আজ মাকে সঙ্গে নিয়ে দেখা করতে এসেছে দিঘি। এখন ভিজিটিং আওয়ার্স চলছে। শমীর কেবিনে শমীর বাড়ির লোকেদের ভিড়। যদিও এতজন লোক আসায় নার্সরা আপত্তি করছিল, কিন্তু ডাক্তার শমীদাদের পরিচিত, তাই নার্সদের আপত্তি ধোপে টেকেনি। তা ছাড়া সত্যিই তো, সবাই জানে মানুষটা আর বেশিদিন নেই। যতই নিয়মে বাঁধো যা হওয়ার তা হবে। যে যাওয়ার, সে যাবে। তাকে বাঁধা যাবে না।

ঘরে অনেক লোক থাকলেও কেউ কথা বলছে না বিশেষ। সবাই চুপ করে দেখছে মানুষটাকে। একটা হালকা ওষুধের গন্ধ উড়ে বেড়াচ্ছে সারা ঘরে। এই গন্ধটা ভাল লাগে না দিঘির। কেমন যেন মনখারাপ আর মৃত্যুর গন্ধ মিশে থাকে এখানে। দিঘি তাই পছন্দই করে না এসব জায়গায় আসতে। তবু মায়ের জন্য আসতে হয়েছে।

মা ঘরের এক কোনায় বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শাড়ির আঁচল গায়ে জড়ানো। চোখ ছলছল করছে। দিঘি বুঝতে পারছে যে-কোনও সময়ে কেঁদে ফেলবে মা। মহুলের সঙ্গে শমীর যেমনই সম্পর্ক হোক না কেন, মা চিরকালই খুব ভালবাসে শমীকে।

মায়ের সঙ্গে কেউ কথা বলছে না বিশেষ। শমীদের বাড়ির লোকজন কেবিনের অন্য দিকে জটলা করছে। নিজেদের বড় অবাঞ্ছিত মনে হচ্ছে দিঘির। মনে হচ্ছে ওরা যেন অস্পৃশ্য। যেন জোর করে নেমন্তন্ন বাড়িতে ঢুকে পড়া কেউ। এই জন্য এইখানে আসতে চায়নি দিঘি। কারণ, এর আগেও একবার এসে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে দিঘির। তাই আজ মা এখানে আসতে চাওয়ায় প্রথমে আপত্তি জানিয়েছিল দিঘি। বলেছিল, ‘আমি যাব না। তুমি যাও।’

‘মানে!’ মা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল দিঘির দিকে।

‘মানে, তোমার যাওয়ার থাকলে যাও। আমি যাব না। আগের দিন দেখোনি, ওরা কেমন ব্যবহার করে আমাদের সঙ্গে? ভাল করে কথা পর্যন্ত বলে না!’

‘তো?’ মায়ের গলার স্বরে রাগ এসে জমা হচ্ছিল।

‘তো মানে? আমরা মানুষ নই? আমাদের আত্মসম্মান নেই?’

‘এসব এখন বলছিস তুই? একটা মানুষ মারা যাচ্ছে আর তুই আত্মসম্মানের কথা তুলছিস?’

‘কেন তুলব না? আমরা মানুষ নই?’

‘মানুষ? একটা মৃত্যুর কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের সামনে তুই তোর ইগো দেখাচ্ছিস?’

‘মানে? আমাদের সম্মানের মূল্য নেই?’

‘মানুষ বাঁচলে তবে না সম্মান!’ মা এবার রেগে গিয়েছিল খুব, ‘তোরা, এই বয়সের ছেলেমেয়েরা একটুও ছাড়তে শিখিসনি! সবসময় এত আমি-আমি করিস কেন তোরা?’

‘আমি-আমি মানে?’

‘এত ইগো কীসের তোদের? কী এমন রাজ্য জয় করে এসেছিস? কেন মানুষকে মানুষ মনে করিস না তোরা? আসলে কী হয়েছে জানিস, আমরাই আদর দিয়ে মাথা খেয়েছি তোদের। তোদের অ্যাচিভমেন্টের চেয়ে অ্যাটিটিউড বেশি।’

‘যাই বলো, অমন সম্মান বিকিয়ে…’

‘চুপ,’ মা এবার চিৎকার করেছিল, ‘আর একটা কথাও বলবি না। সোজা ড্রেস চেঞ্জ করে চল আমার সঙ্গে। অনেক তর্ক করেছিস। অনেক সুযোগ দিয়েছি তোকে কথা বলার। এই মানুষ হয়েছিস? আত্মসম্মান নিয়ে লেকচার দিচ্ছিস? মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারিস না, আবার আত্মসম্মানের কথা বলিস!’

‘দেখো মা, ওরা দিদির সঙ্গে যা…’ দিঘি তাও বলার চেষ্টা করেছিল।

‘ছিঃ, ছিঃ,’ মা বলেছিল, ‘তুই বলছিস ওরা দিদির সঙ্গে এখন খারাপ ব্যবহার করছে বলে আমরাও করব? এটা মানুষের মতো কাজ হবে? শমী তোকে কত ভালবাসে ভুলে গেছিস? তোর দিদি ওর সঙ্গে কত খারাপ ব্যবহার করেছে ভুলে গেছিস? এমনকী, ছেলেটাকে মেরেছে পর্যন্ত! ভুলে গেছিস সব?’

না, ভোলেনি দিঘি। কিচ্ছু ভোলেনি। সত্যিই দিদি খুব অন্যায় করেছে। কিন্তু সে তো রাগের মাথায়। তখন কি জানত শমীর এমন ভয়ংকর একটা রোগ হবে? রাগের মাথায় যা বলেছে, যা করেছে, সেটার জন্য শমীর বাড়ির লোকজন এখন কেন দিদির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে? শমীর শরীর খারাপের পর থেকে দিদি তো আপ্রাণ খাটছে শমীর জন্য। এমনকী দিদি সব রিপোর্ট নিয়ে মুম্বইও গেছে। তবে কেন শমীর বাড়ির লোকজন দিদির সঙ্গে এমন করছে?

শমী ভরতি রয়েছে দক্ষিণ কলকাতার একটা নার্সিংহোমে। তাই গুন্ডাকেও ডেকে নিয়েছে দিঘি। আসলে একা কেমন যেন ওর অরক্ষিত লাগে। মনে হয় শমীদের বাড়ির লোকেরা ওদের অপমান করবে। গুন্ডা থাকলে কি অপমান আটকাতে পারবে? না, পারবে না, জানে দিঘি। তবু, গুন্ডাকে আসতে বলেছে। কারণ, বন্ধু সঙ্গে থাকলে কোথায় যেন মনে একটা জোর পায় ও।

কিছুক্ষণ আগে অবধি গুন্ডা এই কেবিনেই ছিল। কিন্তু একটু আগে দিঘিকে কানে কানে বলেছিল, ‘আমি বাইরে আছি বুঝলি। মনে হচ্ছে আমি নয়, ছ’টা মানুষ এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে ভিড় করছে। এটা ঠিক নয়। আমি আসি।’ সেই থেকে গুন্ডা দাঁড়িয়ে রয়েছে বাইরে। খারাপ লাগছে দিঘির। কেন যে এমন খারাপ সময় যাচ্ছে! দিঘি যে দিকে তাকাচ্ছে, সেদিকেই সব কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া শমীকেও মুখোমুখি এমন অবস্থায় দেখতে কষ্ট হচ্ছে খুব।

ডাক্তার বলছে আর আশা নেই। বলছে আরও আগে আনলে ভাল হত। প্যানক্রিয়াসের হেড-এ ক্যান্সার। মানে, অন্তত সাধারণ মানুষের কথা অনুযায়ী এটাই হয়েছে শমীর। এটা নাকি একদম শেষ সময়ে ধরা পড়ে। আর তখন কিচ্ছু করার থাকে না। এই রোগটাই নাকি সাইলেন্ট কিলার হিসেবে কুখ্যাত।

নিঃশব্দ ঘাতক। প্রথম দিন শব্দটা শুনে খুব আশ্চর্য লেগেছিল দিঘির। মনে হয়েছিল কোনও খুনি কি এতদিন ধরে তবে ছায়ার মতো অনুসরণ করে শমীর শরীরে পুঁতে দিয়েছিল মারণ বীজ? মৃত্যু এমন! কোনওদিন সরাসরি মৃত্যু দেখেনি দিঘি। আর এবার যখন হবে, সেটা যে এমনভাবে হবে, তা ভাবতেই পারেনি ও। তবে কি মৃত্যু সবার সঙ্গেই ঘুরে বেড়াচ্ছে? অপেক্ষা করছে সঠিক সময়ে তার শরীরে বীজ পুঁতে দেওয়ার জন্য? রাস্তাঘাটের এই অসংখ্য মানুষ কি আসলে টাইম বোম? টিকটিক করে কি তারা নিঃশব্দ ঘাতকের ঠিক করে দেওয়া সময়ের দিকে এগিয়ে চলেছে, ফেটে যাবে বলে?

মা কাঁদছে এখন। সরু ধারায় চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। শমীর শরীর খুব দুর্বল। অধিকাংশ সময়ই চোখ বন্ধ করে থাকে। তবে আজ খুলছে মাঝে মাঝে। হাসার চেষ্টাও করছে।

দিঘি দেখল শমী আবার চোখ খুলল। আর তারপর হাতটা কষ্ট করে তুলে ইশারার মতো কী একটা যেন করল। ডাকছে? শমী কি ডাকছে দিঘিকে?

দিঘি দেখল শুধু ও নয়, অন্যরাও লক্ষ করেছে। শমীর এক দাদা এগিয়ে গেল বেডের দিকে। মাথা নিচু করে কিছু বলতে গেল। কিন্তু বাধা দিল শমী। তারপর আবার দিঘির দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। ডাকছে, দিঘি বুঝল। ও দেখল, শমীর দাদার মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। কিছুটা রাগও। দিঘিরা এসেছে যখন তখন তো আর ঘাড় ধরে বের করে দিতে পারে না। কিন্তু সবাইকে বাদ দিয়ে যে, শমী দিঘিকে ডাকছে সেটা ভদ্রলোক মানতে পারছে না কিছুতেই।

দিঘি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। দাদাটি সরে গেল বিরক্ত মুখে। দিঘি বেডের পাশের গদি মোড়া টুলটায় বসে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু বলবে শমীদা?’

শমী হাত নেড়ে কাছে ডাকল দিঘিকে। তারপর দুর্বল গলায় বলল, ‘মা কাঁদছে কেন রে?’

‘তুমি রেস্ট করো তো,’ দিঘি হেসে বলল।

‘আমি মরে যাব বলে?’ শমী সামান্য তুতলে বলল।

‘ধ্যাত, বাজে কথা কেন বলো?’

‘ঠিকই তো। মাকে কাঁদতে না কর। তোরা কি আমায় মরার আগেই মারবি? এত কষ্ট দিস কেন রে?’

‘শমীদা,’ দিঘি বলল, ‘তোমায় কিন্তু এত কথা বলতে না করা হয়েছে।’

‘জানিস দিঘি, তোর নাম জানিস কেন দিঘি রাখা হয়েছিল?’

‘না তো? কেন? আর তোমায় কে বলল?’ অবাক হল দিঘি।

‘মহুল,’ শমী সামান্য থামল, ‘প্রথম প্রথম বিয়ে হয়েছে তখন আমাদের। মহুল তখন একটু ভালবাসত আমায়। বলেছিল, দিঘির চোখ দুটো দেখেছ, কী সুন্দর! একদম টলটল করছে। তাই বাবা ওর নাম রেখেছিল দিঘি।’

দিঘি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল শমীর দিকে। কেন এমন বলছে শমী? এমন নিচু, দুর্বল গলায়, এমন কমজোরি শরীর নিয়ে কেন ডুবুরির মতো তুলে আনছে সব পুরনো আসবাব?

‘শমীদা এসব বলছ কেন?’

‘তোর চোখ এমনিতেই টলটলে, তাতে আর জল আনিস না।’

‘জল!’ দিঘি চট করে চোখের কোনায় হাত দিল। আরে! তাই তো! কী আশ্চর্য! জল! চোখে জল? ও বলল, ‘দিদি তোমায় এসব বলেছে?’

‘হ্যাঁ, মহুল বলেছে। আচ্ছা, মহুল কবে আসবে রে?’

‘আসবে শমীদা, দু’-চার দিনের মধ্যেই আসবে।’

‘চলে আসতে বল। আর কী হবে? আমার ঘড়ির দম ফুরিয়ে এসেছে। যে-কোনওদিন বন্ধ হয়ে যাবে। তাও ভাগ্যিস…’ শমী চোখ বন্ধ করল।

‘কী ভাগ্যিস? কী ভাগ্যিস শমীদা?’

‘তাও ভাগ্যিস এই রোগটা হল। না হলে তো মহুল পাত্তাই দিত না।’ শমী হাসল।

‘কী বাজে বকছ?’ দিঘির এবার সত্যি সত্যি কান্না পেল।

‘আসলে কী জানিস। ও বড্ড পাগলি। প্রেম সম্বন্ধে ঠিক বোঝে না। ও যে আমায় ভালবাসে সেটাই বোঝে না। অনেকে এমন থাকে, জানিস? ভাবে প্রেম খারাপ জিনিস। ভাবে ভালবাসা দুর্বল মানুষের কাজ। বোঝে না যে, এটাই সবচেয়ে কঠিন। তুই এমন নোস তো?’ শমী হেসে আবার চোখ বন্ধ করে নিল।

দিঘি সরে এল শমীর কাছ থেকে। বসে থাকলে আরও কথা বলবে মানুষটা। তখন সমস্যা হবে শরীরে। ও দেখল মা কাঁদছে এখনও। আচ্ছা মানুষ! এতক্ষণ কেউ কাঁদতে পারে?

ও চাপা গলায় বলল, ‘মা, কী হচ্ছে কী? আর কেঁদো না। শমীদাও বারণ করেছে। ওর সামনে কাঁদলে, ওর কেমন মনে হবে বলো তো?’

‘ঠিক আছে।’ মা বুঝল ব্যাপারটা। তারপর চোখ মুছল। জিজ্ঞেস করল, ‘কী বলল রে? খারাপ কিছু?’

‘না, না, দিদির কথা জিজ্ঞেস করল,’ দিঘি চাপা গলায় বলল, ‘জিজ্ঞেস করল কবে আসবে। দিদিকে দেখতে চাইছে।’

মা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু পারল না। ঘরে একজন সিকিউরিটির লোক এসে বলল, ‘চলুন চলুন, টাইম ওভার। এবার বেরোতে হবে আপনাদের।’

এই লোকগুলো ভীষণ রুড হয়। শিক্ষার অভাব থাকে এদের। তবে হয়তো এরা এভাবে বলে কারণ কোনও কোনও লোক এভাবে না বললে শোনেও না। তবু, একজন রোগীর ঘরে এদের আচরণ ভীষণ আপত্তিকর। দিঘির মনে হয় ঠাস করে এক চড় মারে। ও আর এক সেকেন্ড না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে এল কেবিনের বাইরে।

গুন্ডা বাইরের করিডরে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিল ফোনে। ওকে দেখে এগিয়ে এল, ‘কী রে? কেমন দেখলি?’

‘কিছু দেখার আছে বলে তোর মনে হয়? আর কতদিন বল? ডাক্তার তো বলেই দিয়েছে যে, আর সময় বেশি নেই।’

‘এত রোগা হয়ে গেছে যে, তাকানোই যাচ্ছে না,’ গুন্ডা ঠোঁট কামড়াল।

দিঘি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না। গত পুজোতেও তো সব একসঙ্গে গেলাম হোমিদিদের ওখানে।’

‘শালা, ওই মালটাই অপয়া,’ গুন্ডা ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল।

‘মানে? কে অপয়া?’ দিঘির অবাক লাগল।

‘ওই যে হাইব্রিডটা, শালা,’ গুন্ডা ঘুষি পাকাল, ‘তার ওপর আবার ভালমানুষি দেখানো! এই যে দু’-একবার দেখা হয়েছে, মনে হয়েছে মেরে ওই শুয়োরের বাচ্চাটার চোয়াল খুলে নিই।’

‘আঃ গুন্ডা,’ দিঘি ধমক দিল। গুন্ডা কাকে নিয়ে বলছে স্পষ্ট বুঝতে পারছে ও।

শেষবার ও যখন চাপাডাঙায় গিয়েছিল গুন্ডাকে অনেক বুঝিয়েছিল যাতে ওখানে গিয়ে মাথা গরম করে কিছু না করে বসে। তবে গুন্ডা তো প্রথমে নিয়েই যেতে চায়নি দিঘিকে।

গুন্ডা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুই কেন যাবি রে? আমি হোমিদিকে টাকা ফেরত দিতে যাব। তুই যাবি কী করতে?’

‘আমার ভাল লাগছে না ঘরে থাকতে। দমবন্ধ লাগছে। মনখারাপ করছে, চাপাডাঙা কী সুন্দর। আমি যাবই।’

‘আরে সেখানে তো সেই রেপিস্টটা থাকে।’ গুন্ডা বলেছিল।

‘বাজে কথা বলিস না। কে রেপিস্ট? আর যে থাকে, আমার তাতে কী? সে থাকে বলে আমায় ভয় পেতে হবে নাকি? যাওয়া বন্ধ করতে হবে নাকি?’

‘ঠিক বলেছিস,’ গুন্ডা উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল, ‘শালা, বেশি ভ্যানতাড়া করলে ধাক্কা মেরে মালটার ওপর বসে পড়ব। চিড়েচ্যাপটা হয়ে যাবে। চল। আর ব্যাটাকে একবার সামনে পেলে, অ্যায়সা…’

‘না,’ দিঘি থামিয়ে দিয়েছিল গুন্ডাকে, ‘খবরদার কিচ্ছু করবি না বলে দিলাম। একটা কথাও বলবি না। যা হয়েছে হয়ে গেছে। আর একটা কথা বললে দেখিস তোকে আমি কী করি। যেমন তোর শরীর মোটা, তেমনই মাথাটাও মোটা।’

‘ঠিক আছে, বলব না,’ গুন্ডা আশ্বাস দিয়েছিল, ‘তবে দেখা তো আর সবসময় হবে না। আমি শিয়োর জানিস, দেখা হবে না। দেখিস তুই।’

জ্যোতিষী হলে গুন্ডার পশার যে জমত না, বলাই বাহুল্য।

আচ্ছা, সেদিন কেন চাপাডাঙায় গিয়েছিল দিঘি? কার টানে? কেন বাড়িতে মন বসছিল না ওর? কেন মনে হচ্ছিল শরীরের ভেতরটা ভারী লাগছে। কষ্ট হচ্ছে। কেন মনে হচ্ছিল যে, কিগানকে দেখতেই হবে একবার? না হলে মরে যাবে? একদম মরেই যাবে? তাই কি এমন নির্লজ্জের মতো গুন্ডার সঙ্গে গিয়েছিল ওখানে? তাই কি গুন্ডা আর হোমিদি, হোমিদিদের বাড়িতে ফিরে গেলেও দিঘি বসেছিল একা রাহিদের ড্রইংরুমে? ওর মন কি হিসেব করেছিল যে, হোমিদির বাড়িতে কিগানের যাওয়ার চান্স নেই, কিন্তু রাহিদের বাড়িতে আছে?

আর তারপর ড্রইংরুমে টিভি চালিয়ে বসে সেই অপেক্ষার মুহূর্তগুলো? দরজার সামান্য আওয়াজে কেঁপে ওঠা সেই মুহূর্তগুলো? মনে মনে তো ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ছিল দিঘি-আসবে, আসবে না। আসবে, আসবে না। তারপর শব্দ হয়েছিল দরজায়। আর বুকের ভেতর থেকে লাফিয়ে উঠেছিল কাঠবিড়ালি। তবে কি…না, কাঠবিড়ালি তার বাদাম পায়নি। দরজা ঠেলে ঢুকেছিল আবেশ।

আসবে না, আর আসবে না। হাত-পায়ের ভার যেন দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল কে যেন সিসে ভরে দিয়েছে শরীরে। মনে হয়েছিল সবচেয়ে বড় ক্রেন এনে সরাতে হবে ওকে। রাগ হচ্ছিল খুব দিঘির। মনে হচ্ছিল কোন বাড়িতে থাকে সেটা তো সপ্তমীর দিন এসে রাহির সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে দেখেইছে। এবার সেখানে গিয়ে আচ্ছা করে পেটালেই হয়। রাগে সারা শরীর জ্বলছিল দিঘির। মনে হচ্ছিল কিগানকে পেলে ছিঁড়ে ফেলে দেবে। একদম ছিঁড়েই ফেলে দেবে।

কী ভেবেছে কী ও? কী ভেবেছে? দিঘি ফালতু? এতটা পথ আসার কোনও দাম নেই? ওর অপেক্ষার কোনও দাম নেই? আর ঠিক তখনই, আচমকা, দরজা খুলে গিয়েছিল। আর হরিণী ঝরনার জল খেতে খেতে মুখ তুলেছিল। কস্তুরীগন্ধে ভারী হয়ে উঠেছিল বাতাস। বহু দিনের পর পরিচিত গন্ধে তীব্র হয়ে উঠেছিল হরিণীর শরীর। আর তারপর সে দেখেছিল তার নীল চোখের হরিণকে।

‘কী রে, এখানে দাঁড়িয়ে আছিস তোরা? নীচে যাসনি?’ মায়ের কথায় ফিরে তাকাল দিঘি। মা এসে দাঁড়িয়েছে পিছনে। চোখ এখনও লাল। মা কাঁদতেও পারে! আসলে কষ্ট দিঘিরও হয়। কিন্তু তবু কিছুতেই এমন সবার সামনে কাঁদতে পারে না ও। একদম পারে না। কান্না ওর কাছে খুব ব্যক্তিগত ব্যাপার। বাথরুমে স্নান করার মতো। তবু, আজ একটু কেঁদে ফেলেছিল শমীর কথায়। তবে সামলে নিয়েছে দ্রুত।

মা আবার বলল, ‘চল এবার। তোর বাবারও ফেরার সময় হয়ে গেল। আর কী হবে? সব তো শেষ হয়ে গেল। এই বয়সে এমন হয়? মেয়েটাও ছেলেটাকে সারাজীবন শান্তি দিল না আর এমন কপাল যে, একটা রোগ বাসা বাঁধল!’

‘কাকিমা চলো,’ গুন্ডা নরম করে বলল।

নার্সিংহোমটা বেশ বড়। আর একদম গিজগিজ করছে মানুষে। প্রথম তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামলেই বিরাট বড় লাউঞ্জ। তাতে ভিজিটিং আওয়ার্স ভাঙা মানুষের ঢল। কেউ হাসছে, কেউ গোমড়া, আবার কেউ মোবাইল কানে দিয়ে চিন্তিত মুখে ঘুরছে। এর ভেতর দিয়ে এগোতে যথেষ্ট বেগ পেতে হল দিঘিদের।

গাড়িটা বাইরেই রাখা ছিল। মা বলল, ‘গুন্ডা, তোকে বাড়ি ছেড়ে দেব?’

‘আরে ঢাকুরিয়া থেকে যাদবপুর আর কত দূর? তুমি শুধু শুধু এসব ভেবো না। আমি তো হাঁটতে হাঁটতে চলে যাব।’

‘এতটা হাঁটবি?’ মা অবাক হল।

‘কোথায় এতটা? তা ছাড়া আমার শরীরটা দেখেছ? সুন্দরবনের বাঘেদের সাতদিনের খাবার। অন্তত এটুকু হেঁটে হাফবেলায় খাবারটা কমাই।’

‘বাজে বকিস না,’ মা আলতো করে মারল গুন্ডার হাতে। হাসলও একটু।

গুন্ডা বলল, ‘আমি আসি তা হলে? আবার এলে বোলো। এমন অবস্থা, তোমাদের যে আমার বাড়িতে যেতে বলব তাতে…’

‘বাদ দে গুন্ডা,’ দিঘি বাধা দিল, ‘আমরা আসি রে। কেমন? আমায় আবার একবার ক্যামাক স্ট্রিটে নামতে হবে।’

‘ঠিক আছে, আয়,’ গুন্ডা আর দাঁড়াল না।

গাড়িটা গড়িয়াহাট ফ্লাইওভারে ওঠার পর মা জিজ্ঞেস করল, ‘তুই ক্যামাক স্ট্রিট যাবি? এই সময়ে? কেন?’

‘কাজ আছে,’ দিঘি গম্ভীর গলায় বলল।

‘কী কাজ? আজকাল খুব কাজ দেখাচ্ছিস দেখছি?’ মায়ের গলায় রাগ।

‘তা থাকলে কী করব? আমাদের কলেজের একটা মেয়ে থাকে ওখানে। ওর কাছে যাব। আর শুধু তো পৌনে সাতটা বাজে। কেন এত টেনশন করছ?’

‘আমার আর ভাল লাগে না। তোরা দুই বোন মিলে কি পাগল করে দিবি আমায়? দেখছিস যে সময় খারাপ যাচ্ছে। তার মধ্যে তুই এসব করছিস?’

‘এসব করছি মানে!’ দিঘি বিরক্ত মুখে চোখ কুঁচকে তাকাল মায়ের দিকে।

‘এমন রাত করে বাড়ি ফিরবি? আগে আর্য সঙ্গে থাকত, এখন তাও থাকে না। আমার চিন্তা হয়।’

‘মা, আমি তো স্কুলে থাকতে বন্ধুদের সঙ্গে একা একাও ঘুরতে গেছি। বহুবার ট্রেকিং-এ গেছি। তখন তো তুমি কিছু বলোনি। তা হলে এখন কেন বেকার হাইপার হচ্ছ?’ দিঘি গম্ভীর হল।

‘আমি জানি না বাবা। তোর মতিগতি বোঝা ভার। এই ভাল আছিস, এই খারাপ। কিগান থাকাকালীন কী যেতিস ওদের বাড়ি! তারপর, একদম বন্ধ করে দিলি! তোকে আর কিগানকে জড়িয়ে কীসব রটল। তুই আজ পর্যন্ত তা নিয়ে কিছু বলিসনি। সেও পালাল। তারপর আর্য। তাকেও দূর করে দিলি একদম। আচ্ছা, কী চাস তুই? আমায় শান্তি দিবি না তোরা দুই বোনে?’

দিঘি উত্তর না দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। মায়ের এসি সহ্য হয় না বিশেষ। এতক্ষণ নার্সিংহোমের এসি-র পর তাই আর গাড়ির এসি চালায়নি। জানালার কাচ নামানো। বাইরের আওয়াজ আসছে। মা বলছেও কথাগুলো নিচু স্বরে। তবু, ড্রাইভার মধুদা যদি শোনে! মায়ের এই ক্যালাসনেস সহ্য হয় না দিঘির। সবার সামনে কি সব কথা না বললেই নয়?

তবে হ্যাঁ। মায়ের ব্যাপারটা বোঝে দিঘি। কিগানের ঘটনাটা সুবর্ণ সোজা গিয়ে কিগানের কাকাকে বলে দিয়েছিল। তারপর কাকার চিৎকারে যেটুকু হাওয়ায় ছড়িয়েছিল। মা সেটুকুই জানে। তবে মা দিঘিকে জিজ্ঞেস করেছিল। দিঘি বলেনি কিছু আর মা যাতে কিগানের কাকার কাছে এই নিয়ে না যায় সেটাতেও বারণ করেছিল। যদিও মা প্রথমে মানতে চায়নি। রাগ করেছিল খুব। কান্নাকাটিও করেছিল এই বলে যে, ‘আমায় জানতেই হবে, কী কথা রটছে। কিগান তো ভদ্র বলে জানতাম। তার সঙ্গে তোর কীসের সম্পর্ক?’

‘মা,’ দিঘি বলেছিল, ‘লোকে নানা কথা রটায়। এসব নিয়ে মাথা খারাপ কোরো না।’

‘তা হলে ওর কাকা কেন ওকে এমন তুলোধোনা করছে?’ মা জিজ্ঞেস করেছিল।

‘ওর কাকা তো ছুতো করে ওকে বাড়ি থেকে বের করতে চায়। জানো না? পাড়ার সবাই তো জানে।’

‘কিন্তু, নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে, যা তুই আমায় বলছিস না,’ মা তাও মানেনি।

দিঘি তখন মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করেছিল, ‘মা, ভবিষ্যতে আমার বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে নেই তোমার? যেটা এমনি গুজবের মতো রটছে, সেটা নিয়ে পাড়ায় তুমি নামলেই লোকে সত্যি বলে ধরে নেবে। তখন? বদনাম কতটা হবে বুঝেছ? বুঝেছ তুমি যে, লোকে কেমন ঢিঢি করবে? তখন পারবে সামলাতে সব কিছু?’

মা আর কিছু বলেনি। এমনকী, কথাটা আর বাবার কানেও তোলেনি। বাবা শান্তশিষ্ট মানুষ। পাড়াতে মেশে না বিশেষ। তাই আর ব্যাপারটা গড়ায়নি বেশি দূর। তবে আজও সময় সুযোগ পেলে মা খোঁচা দিতে ছাড়ে না।

মা চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ‘তা আর্যর সঙ্গে কী হল তোর? সেটা তো বলবি? অমন সুন্দর একটা ছেলে! সবসময় “দিঘি দিঘি” করত, তাকে ঘাড়ধাক্কা দিলি কেন তুই?’

দিঘি চোয়াল শক্ত করল। সপ্তমীর দিনের সেই ঘটনা মা জানে না। শমীকে ও-ই বলতে বারণ করেছিল। আর শমীও বলেনি। সেই দিনের ঘটনার প্রায় দু’সপ্তাহ পর একদিন ফোন করেছিল আর্য। তখন সবে কলেজ থেকে বেরিয়ে কলেজ স্কোয়ারের জলের পাশে বসে আড্ডা মারছিল ওরা। কলেজে স্পেশ্যাল ক্লাস ছিল ওদের। ফোনটা আসায় বেশ অবাক হয়েছিল দিঘি। না, ফোনটার জন্য নয়, ও অবাক হয়েছিল এই ভেবে যে, ফোনটা আসার জন্য ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হচ্ছে দিঘি। ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে। তবু নিজেকে সংযত করে ফোনটা ধরেছিল দিঘি।

‘হ্যালো,’ আর্যর গলাটা খুব স্বাভাবিক শোনাচ্ছিল।

‘হ্যাঁ বলো,’ দিঘিও স্বাভাবিক গলায় কথা বলেছিল।

‘তোমার সঙ্গে একবার দেখা হতে পারে? আমি কলেজ স্ট্রিট মোড়ে ওয়েট করছি।’

‘কেন? তুমি এখানে এসো,’ দিঘি সামান্য হেসেছিল।

‘ওখানে? মানে তোমাদের আড্ডায়? না, তুমি এসো প্লিজ। জাস্ট পাঁচ মিনিট নেব।’

‘তোমাকে কে বলল আমি এখানে থাকব?’ দিঘি প্রশ্ন করেছিল।

‘আমার কাছে খবর থাকে। তুমি তাড়াতাড়ি এলে ভাল হয়। আয়াম ইন আ হারি।’

দিঘি কিছু মনে করেনি। ওর মনেই হয়নি, যে ডাকছে তার তাড়া আছে বলে ওকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। ও বন্ধুদেরকে, ‘জাস্ট একটুক্ষণের জন্য আসছি’ বলে চলে গিয়েছিল।

কলেজ স্ট্রিট মোড়ে দাঁড়িয়েছিল আর্য। বেশ ফিটফাট চেহারা। হালকা গোলাপি টি-শার্ট আর সাদা জিন্‌স। দিঘি ওর সামনে দাঁড়িয়ে হেসেছিল।

আর্য কোনও ভণিতা করেনি। হাতের প্লাস্টিকের থেকে একটা ব্রাউন খামে মোড়া কিছু বই বের করে এনে বলেছিল, ‘তোমার বইগুলো। গল্পের। আমার কাছে ছিল। রাখো।’

‘পড়া হয়েছে?’ দিঘি জিজ্ঞেস করেছিল।

‘না, সব হয়নি। আর সত্যি বলতে কী, ইচ্ছেও নেই পড়ার।’

দিঘি বইগুলো নিয়ে হেসেছিল শুধু।

আর্য বলেছিল, ‘আমি আসি। গাড়িটা বেনিয়াটোলার সামনে রাখা আছে। শ্রীপর্ণা অপেক্ষা করছে আমার জন্য। টেক কেয়ার। গুড বাই।’

দিঘি শুধু মাথা নেড়ে হেসেছিল। তারপর ফিরে এসেছিল কলেজ স্কোয়ারে।

ব্রেক আপ এমন হয়! কিন্তু কই ওর তো কষ্ট হল না! বরং বেশ হালকা লাগছিল। মন ভাল লাগছিল। মনে হচ্ছিল-বাঁচা গেল। তবে কি কোনওদিনই ও ভালবাসেনি আর্যকে? জাস্ট এমনি ভাল লাগত? কেন? কেন ভালবাসেনি আর্যকে? কেন ওর মনে জায়গা করতে পারেনি আর্য? কে দখল করে রেখেছে মন? কে বসে রয়েছে সেখানে? সদ্য পুজোয় দেখা সেই লম্বা মানুষটা যেন হঠাৎ ভেসে উঠেছিল সামনে। সেই নীল চোখ। শমীকে কোলে তুলে হাঁটার সময়কার সেই সোজা ভঙ্গি। হালকা মনটা আবার ভারী হয়ে এসেছিল দিঘির। মুখ কালো করে মেঘ জমেছিল মনে। কষ্ট হচ্ছিল ওর। ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল।

‘মালটা এসেছিল, না?’ গুন্ডা আর জয় প্রায় একসঙ্গে প্রশ্ন করেছিল।

‘মানে?’ দিঘি থতমত খেয়ে গিয়েছিল।

‘তোর আর্য। এসেছিল, না? সব শেষ করতে এসেছিল?’

‘বেঁচেছিল কিছু, যে শেষ করবে?’ দিঘি চোয়াল শক্ত করে বলেছিল।

‘এমন বিরক্ত মুখ করে থাকিস না,’ রূপ বলেছিল।

‘না তো!’ দিঘি নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা করেছিল।

‘আমার খারাপ লাগছে, জানিস দিঘি। আমার মনে হচ্ছে, যেন আমার জন্যই হল। তবে,’ গুন্ডা সিরিয়াস হতে গিয়েও হেসেছিল, ‘ভালই হয়েছে জানিস। আমাদের মতো অনার্যদের সঙ্গে আর্যর মাখামাখিটা বন্ধ হয়েছে, ভালই হয়েছে।’

ভাল। কত কী-ই যে ভাল হয় সারাদিন, মাঝে মাঝে ভাবে দিঘি। এই যে অন্ধকার পার করে পৃথিবী রোজ সূর্যের দিকে তাকায়। সেটার চেয়ে ভাল আর কী আছে! এই যে বাচ্চারা সার বেঁধে স্কুলে যায়। খেলতে নেমে আপন-পর ভোলে। এই যে অন্ধ মানুষটিকে রাস্তা পার করে দেয় একলা ছেলেটি। কাটা ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে মুহূর্তের জন্যে হলেও হেসে ফেলে চায়ের দোকানে কাজ করা বালক। প্রেমিকা আচমকা কাঁধে মাথা রাখায় স্বস্তির শ্বাস ফেলে প্রেমিক। সারা সকাল অপেক্ষার পর বৃদ্ধের হাতে এসে পৌঁছোয় চায়ের কাপ। বিয়ে না হওয়া দিদিটির দিকে তাকিয়ে থাকে কেব্‌ল-এর মই কাঁধে ছেলেটি! এমন কত ভাল যে রোজ উড়ে বেড়ায় চারিদিকে! দিঘি ভাবে এমনই হয়তো ভাল হয়েছে আর্যর চলে যাওয়া। কোনও মালিন্য নেই, ঝগড়া নেই, মন খারাপ নেই। শুধু চলে যাওয়াটুকু আছে। কারও চলে যাওয়া হালকা করে দেয় মানুষকে। আবার এমনও কেউ হয় যে চলে গেলে তার যাওয়াটুকু চোখে লেগে থাকে সারাজীবন!

‘দেরি করিস না, তাড়াতাড়ি আসিস,’ মা দিঘিকে নামিয়ে দিয়ে আবার সাবধানবাণী আউড়ে চলে গেল।

সন্ধে হয়ে গেছে। ক্যামাক স্ট্রিট চকচক করছে আলোয়। যেন মিল্কিওয়ের এক টুকরো ভেঙে এনে কেউ তারার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়েছে সারা জায়গায়।

আসলে একটা নোট নিতে হবে। তাই এখানে আসতে হল দিঘিকে। মেয়েটার বাড়ি একটু এগিয়ে। বড় ফার্নিচারের যে-দোকানটা রয়েছে, তার পাশে একটা মাল্টি স্টোরিড বিল্ডিং আছে। সেখানে। দিঘি নিজে ঠিক বুঝতে পারেনি, তাই একটু আগেই নেমে পড়েছে। যাই হোক, এইটুকু হাঁটতে খুব একটা কষ্ট হবে না।

দিঘি ঘড়িটা দেখে নিয়ে পা বাড়িয়েও থমকে গেল। একদম সামনে আদিত্য! আদিদা! এই ছেলেটার সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা বলে না দিঘি। ছেলেটা নাকি ভাল নয়। মহুলও একসময় ছেলেটার সঙ্গে ঘুরেছিল কিছুদিন। তবে আদিও খুব একটা মেলামেশা করে না কারও সঙ্গে। ফলে দিঘির সঙ্গে কোনওদিন তেমন করে হাই-হ্যালোও করেনি।

কিন্তু আজ আদি দাঁড়াল, ‘হাই দিঘি।’

‘হ্যালো,’ দিঘি অপ্রস্তুত মুখে দাঁড়াতে বাধ্য হল।

‘কেমন আছ?’

দিঘির অবাক লাগল। এক পাড়ায় থাকে। কথা হয় না। হঠাৎ এমন একটা জায়গায় ‘কেমন আছ’! কী অবাক কাণ্ড! দিঘি বলল, ‘ভাল। তোমরা?’

আদি যেন শুনতেই পেল না। বলল, ‘জানো, দাদাভাই এখন অনেক দূরে থাকে?’

হঠাৎ এমনভাবে কিগানের নাম শুনবে ভাবতে পারেনি দিঘি। ওর বুকের ভেতরে কী যেন একটা ছলাৎ করে উঠল।

‘তাই? ও! মানে…’

‘জানো, দাদাভাই না আর ফিরবে না কোনওদিন।’

‘তাই?’ দিঘির মনে হল কে যেন ওর কানে গরম সিসে ঢালছে। ‘তাই’ ছাড়া আর কিছু বেরোচ্ছে না মুখ দিয়ে!

‘আচ্ছা, তুমি তো দাদাভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে একসময়, এখনও বলো?’ আদি আবার জিজ্ঞেস করল।

এবার বিব্রত হল দিঘি। কী হয়েছে আদির? যার সঙ্গে কথাই হয় না, সে আজ এমন ভূতে পাওয়া মানুষের মতো কথা বলছে কেন?

‘আমি? মানে?’ দিঘি তাকিয়ে রইল আদির দিকে।

আদি গলার টাইটা খুলে ভাঁজ করে প্যান্টের পকেটে ঢোকাল। তারপর জামার হাতা দুটো গুটিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, ‘দাদাভাইটা এমন বোকা। খুব বোকা। গোটা সম্পত্তিটা আমায় লিখে দিয়েছে!’

‘ও, কিন্তু এসব আমায়…মানে…’ দিঘি অপ্রস্তুত মুখে বলল।

‘তোমায় বলব না?’

আদি এমন করে বলল যে, মাটি কেঁপে উঠল যেন। যেন টাল খেয়ে গেল কলকাতা। দিঘির মনে হল রাস্তার ওপারের বাড়িঘরগুলো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে না তো ওর মাথায়? ওর মনে হল কে যেন ওর ওপর টন টন সিমেন্ট ঢেলে দিয়েছে। ও আঠায় আটকে যাওয়া মাছির মতো দাঁড়িয়ে রইল।

আদি হাসল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। বলব না। আসি। ইউ টেক কেয়ার।’

আদি চলে গেলেও নড়তে পারল না দিঘি। কেন এমন বলল আদি? আর কিগান নিজের সম্পত্তি ছেড়ে দিল এভাবে? মানে আর আসবে না কিগান? আর পাড়ায় ফিরবে না? মানে, ওকে আর দেখতে পাবে না? দিঘির হাত-পা কেমন অবশ হয়ে আসছে। কষ্ট হচ্ছে বুকে। তোলপাড় করা কষ্ট হচ্ছে। কেন এমন হল? কেন এমন করল কিগান? কেন করল দিঘি নিজে? শুধুমাত্র হিংসে? মাত্র দুটো কাগজের টুকরো! তাতেই সব শেষ! শেষ কি এমনভাবে হয়? এমন করে কি কোনও কিছু শেষ করা যায়? এ কি মেলা যে, তাঁবু ফেললাম, আর তারপর ইচ্ছেমতো গুটিয়ে নিয়ে চলে গেলাম! শুধু শূন্য মাঠ আর শালপাতা পড়ে রইল পিছনে? কেন এমন করবে কিগান? কোন সাহসে করবে এমন? দিঘির সঙ্গে ওকে এমন করার অধিকার কে দিয়েছে?

পাশেই একটা পানের দোকান। তাতে লোকাল আর এসটিডি কল করার জন্য ফোনও রাখা আছে। দিঘি এগিয়ে গেল, ‘একটা ফোন করব?’

পানওয়ালা তার খয়েরি দাঁত দেখিয়ে হাসল, ‘করুন। আপনাদের জন্যই রাখা।’

দিঘি মোবাইল বের করল না। নম্বরটা ওর মুখস্থ। সেই সপ্তমীর দিন যখন গিয়েছিল, তখন এক সময় লুকিয়ে রাহির মোবাইলে সেভ করা কিগানের নম্বরটা দেখে নিয়েছিল ও। নতুন নম্বর। একবার দেখেই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। আসলে দিঘি আন্দাজ করেছিল যে, নম্বরটা নিশ্চয়ই থাকবে রাহির মোবাইলে। তাই ‘তোমার মোবাইলটা কী সুন্দর গো!’ বলে মোবাইল দেখার ফাঁকে নম্বরটা দেখে নিয়েছিল দিঘি। তারপর বেশ কয়েকবার রাস্তা থেকে ব্ল্যাঙ্ক কল করেছে দিঘি। না, কথা বলার জন্য নয়। শুধু একবার কিগানের গলার স্বরটা শোনার জন্য। হয়তো পাগলামি, কিন্তু কী করবে দিঘি? ওর যে শুনতে খুব ইচ্ছে করে!

এখনও রিং করে কানে রিসিভারটা লাগাল দিঘি। রিং হচ্ছে। রিং হয়ে যাচ্ছে। একটা। দুটো। তিনটে। চারটে। কিগান শুনতে পাচ্ছে না? কাছে নেই মোবাইল? নাকি ফ্যাক্টরির মেশিনের আওয়াজে শোনা যাচ্ছে না? আচ্ছা, অচেনা নম্বর বলে কি ধরছে না ফোনটা?

‘হ্যালো?’ আচমকা কিগানের গলা ভেসে এল।

চুপ করে রিসিভার কানে চেপে ধরে রইল দিঘি।

‘হ্যালো, কে বলছেন? প্লিজ কথা বলুন। এমন মাঝে মাঝে কেন ফোন করেন? হ্যালো? কী চান আপনি?’

দিঘি নিজেকে প্রাণপণে বেঁধে ধরে রইল ফোনটা।

কিগান চুপ করল কিছুক্ষণ। নিস্তব্ধ যন্ত্র। যেন অসীম অন্ধকার। অন্তহীন ব্যোম। নিকষ মহাশূন্য। তারপর হঠাৎই আলোর মতো, বহু দিন আগে ভোলা গান মনে পড়ার মতো, ঠোঁটের ওপর অন্য ঠোঁটের নরম স্পর্শের মতো কিগান অস্ফুটে বলল, ‘তুমি?’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *