মুহূর্তরা দু’বছর আগে – ৩

কুয়াশার ঝাঁঝরির ভেতর মিলিয়ে যাচ্ছে সাইকেল। হলুদ-লাল পাতা নিয়ে ইয়া বড় বড় সব গাছেরা দাঁড়িয়ে রয়েছে আর তার ফাঁকে তুলোর মতো গোল্লা কাটছে হাওয়া। প্রতিটা ঘাসের মাথায় মুকুটের মতো শিশির পায়ের তলায় বুঝতে পারছে ও। পাহাড়ি শহরের ভোর মেঘ সরিয়ে উঁকি দিতে শুরু করেছে ক্রমশ। তার কালো ফিতের মতো রাস্তা, সবুজ রেলিং আর লাল কাঠের বেঞ্চ-সবেতেই মাফলারের মতো জড়িয়ে রয়েছে কুয়াশা। আর তার ঝাঁঝরির ভেতর ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে সাইকেল। শুধু একটা গোলাপি স্কার্ফ উড়ছে। কুয়াশার ভেতর থেকে লোমে ঢাকা কুকুরের জিভের মতো বেরিয়ে রয়েছে সেই ছোট্ট স্কার্ফটা।

ওই স্কার্ফ কার? কে চলে গেল সাইকেল করে? কবে সে মৃদু ঘণ্টি বাজিয়ে এসেছিল পাহাড়ি সেই শহরে? কার কাছে এসেছিল সে? আর কেনই বা অমন করে মিলিয়ে গেল? এখন শুধু শূন্য রাস্তা দেখতে পায় ও। সবুজ রঙের রেলিং দেখতে পায়। লাল বেঞ্চে দেখতে পায় কে যেন ছুরি দিয়ে খোদাই করে রেখে গেছে, ‘আমি তোর জন্য এসেছিলাম…’

‘জিয়ানা ওয়েক আপ, ওয়েক আপ ডার্লিং’, নরম শব্দটা বারবার বাজতে বাজতে জিয়ানাকে প্রায় আইসক্রিম কেটে তুলে নেওয়ার মতো তুলে ফেলল ঘুম থেকে।

ব্লাইন্ডসের ফাঁক দিয়ে আলোর লম্বা চ্যাপটা আঙুলগুলো ক্রমশ ঢুকে আসছে ঘরে। আর সেই আলোর রং দেখে জিয়ানা বুঝল আজ একটু বেশিই ঘুমিয়েছে ও।

‘জিয়ানা ওয়েক আপ, ওয়েক আপ ডার্লিং’-টকেটিভ ঘড়িটাকে থাবড়ে চুপ করাল জিয়ানা। ঘড়িটা অস্ট্রেলিয়া থেকে নিয়ে এসেছিল বুকু। একসঙ্গে হাফ ডজন অ্যালার্ম সেট করা যায়। ঘড়িটা প্রথম প্রথম ভাল লাগলেও এখন কেমন যেন একঘেয়ে লাগে জিয়ানার। আর আজ তো বিরক্তিতে ওটাকে মাটিতে ছুড়ে ভেঙে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। আর-একটু, ইস আর-একটু যদি ঘুমোতে পারত তা হলে ঠিক বুঝতে পারত কে সেই সাইকেল চালক। দেখতে পারত লাল বেঞ্চে খোদাই করে রাখা পুরো কথাটা।

জিয়ানার মাথাটা ভোঁ হয়ে আছে। এত জীবন্ত ছিল স্বপ্নটা যে, মনে হচ্ছে এখনও পায়ের তলায় শিশির লেগে রয়েছে!

গোলাপি স্কার্ফ। হঠাৎ মনে পড়ল স্কার্ফটার কথা। অন্য স্বপ্নে এটা থাকত না কিন্তু আজ যোগ হয়েছে স্কার্ফটা। সাদা কুয়াশার ভেতর কী সুন্দর উড়ছিল স্কার্ফটা। মনে আছে। সব মনে আছে জিয়ানার। মনে আছে কাকে ও দিয়েছিল গোলাপি স্কার্ফটা। দশ বছর হয়ে গেছে। দশটা বছর হয়ে গেছে! তবু স্বপ্নটা এখনও এত জ্যান্ত! জিয়ানা দু’হাতে মুখ ঢাকল। স্বপ্নটাও যদি এমন দু’হাত দিয়ে ঢেকে রাখতে পারত!

প্রথম অ্যালার্মটা মিস করে দ্বিতীয় অ্যালার্মটায় ঘুম ভেঙেছে আজ। মানে সাড়ে সাতটা বাজে। সাড়ে ন’টার মধ্যে অফিস ঢুকতে হবে। অবশ্য সেটা খুব একটা অসুবিধে হবে না। ওর বাড়ি থেকে অফিস যেতে পনেরো মিনিট লাগে। তাও জ্যাম থাকলে। কিন্তু আজ একবার মেয়ের স্কুলে যেতে হবে। ক্লাস-টিচারের সঙ্গে দেখা করার আছে। সোয়া আটটায় সময় দিয়েছেন টিচার। কে জানে আবার কী কাণ্ড করেছে? এদেশে এসে বৈভবীর সমস্যা হচ্ছে মানিয়ে নিতে। চার পেরিয়ে পাঁচে পড়েছে মেয়েটা। কিন্তু একেবারে বাপের ফোটোকপি। এ বয়সেই এত গম্ভীর! কথাও বিশেষ বলে না বাড়িতে এসে। খুব করে জিজ্ঞেস করলে দু’-একটা কথা বলে, তাও অনিচ্ছার সঙ্গে।

গতকালই অফিস থেকে আসার পর বৈভবী এসে একটা কাগজ হাতে ধরিয়ে বলেছিল, ‘মাম্মা, এটা ক্লাস-টিচার দিয়েছে তোমার জন্য।’

‘কী এটা?’ অবাক হয়ে হাত বাড়িয়ে ভাঁজ করা কাগজটা নিয়েছিল জিয়ানা, ‘কী, বললি না কী এটা?’

বৈভবী গোমড়া মুখে বলেছিল, ‘দেখছ না স্টেপ্ল করা আছে। আমি জানি না ওটা কী। আর দেখিনি। অন্যের চিঠি দেখতে নেই।’

বৈভবী আর দাঁড়ায়নি। চলে গিয়েছিল নিজের ঘরের দিকে।

চিঠিটা খুলে ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল জিয়ানার। ক্লাসটিচার আর্জেন্টলি দেখা করতে বলেছে পেরেন্টকে। এমন কিছু ডিসকাস করতে চায়, যা ফোনে বলা যাবে না।

অবাক লেগেছিল জিয়ানার, কী এমন কথা রে বাবা! এইটুকু মেয়ের ব্যাপারে কী এমন কথা থাকতে পারে? তবে বৈভবীকে জিজ্ঞেস করেনি কিছু। জিয়ানা জানত লাভ হবে না। ও মেয়ে কিছু করলেও উত্তর দেবে না। তবে রাতে বুকুকে বলেছিল ঘটনাটা। ল্যাপটপ খুলে কী একটা কাজ করছিল বুকু। জিয়ানা গিয়ে বসেছিল পাশে। বুকু তাকাওয়নি। একমনে তাকিয়ে ছিল স্ক্রিনের দিকে।

জিয়ানা অপেক্ষা করেছিল সামান্য। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, ‘বুকু, তোমায় একটা কথা বলার ছিল।’

‘বলো,’ যেন যন্ত্রের ভেতর থেকে উত্তর বেরিয়ে এসেছিল।

‘একটু এদিকে মন দাও।’ বিরক্ত লেগেছিল জিয়ানার।

‘মন দিতে হলে তাকাতে হয় বা দেখতে হয়, এমন ব্যাপার নয়।’

জিয়ানার রাগ হলেও গিলে নিয়েছিল পুরোটা। তারপর মনকে শান্ত করে বলেছিল, ‘তুতুলের স্কুল থেকে কমপ্লেন লেটার এসেছে। কাল দেখা করতে বলেছে।’

‘কমপ্লেন?’ এবার মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল বুকু, ‘কী কমপ্লেন করেছে?’

‘না, মানে স্পেসিফিক কিছু লেখেনি, তবে…’ ইতস্তত করেছিল জিয়ানা।

‘তবে কে বললে কমপ্লেন?’

‘লিখেছে এমন কিছু বলতে চায় যা ফোনে বলা যাবে না।’

‘তার মানে কি কমপ্লেন? অন্য কিছুও তো বলতে চাইতে পারে।’

‘তা পারে…’ জিয়ানার নিজেকে একটু বোকাই লাগছিল।

‘তুতুল বাড়িতেই কাউকে ডিস্টার্ব করে না, তো স্কুলে কী করবে!’ বুকু আবার ল্যাপটপে ফিরে গিয়েছিল।

জিয়ানা সরিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। বুকু যে আর কিছু বলবে না, তা বুঝতে পেরেছিল ও। আর এও বুঝেছিল যে, স্কুলে ওকে একা-একাই যেতে হবে। আসলে বিয়ের পর থেকে একাই সব কিছু করে করে এখন অভ্যেস হয়ে গেছে জিয়ানার।

বিয়ের আগে আগে কিন্তু এত কিছু পারত না ও। সবটাই বাপি করে দিত। মা আর বাপি একদম কাঁটাতার দিয়ে মুড়ে রাখত জিয়ানাকে। ইউনিভার্সিটি যেতে যেদিন দেরি হয়ে যেত মা সেদিন ভাত মেখে খাইয়েও দিত। বন্ধুরা বলত, ‘তোর মা বড্ড বাড়াবাড়ি করে কিন্তু।’

জিয়ানা কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকত। লজ্জা লাগত ওর। বন্ধুরা আরও খ্যাপাত, বলত, ‘সব কিছুতেই তোর মা এত নাক গলায়, ফুলশয্যাতেও কী করবি সেটাও কি তোর মা দাঁড়িয়ে ডিরেকশন দেবে?’

জিয়ানার কান লাল হয়ে উঠত, ও প্রতিবাদ করত। কিন্তু ঠিক পেরে উঠত না। আর ঠিক তখনই সে এগিয়ে আসত। মৃদু গলায় বলত, ‘রাস্তায় পাথরকে কে গার্ড দেয়? হিরেকেই মানুষ আগলে রাখে। তোরা সব বৃথাই হিংসে করিস জিয়ানাকে।’

বন্ধুরা বলত, ‘তোর তো সবটাতেই বেশি বেশি। জিয়ানা বলতে তো তুই অজ্ঞান!’

তখন কতজন যে অজ্ঞান ছিল জিয়ানা বলতে! কিন্তু একজনের জ্ঞান হারানোটাই শুধু চোখে পড়ত ওর। কষ্ট হত। কিন্তু কিছু বলতে পারত না। মায়ের ভয়ে বা ভালবাসায় মায়ের কথাকেই বেদবাক্য হিসেবে মেনে চলত। তাই তো সেই জ্ঞান হারানো ছেলেটাকে অমন ‘না’ করে দিয়েছিল।

তখন গড়িয়ায় থাকত ওরা। গড়িয়াহাট থেকে গড়িয়া যাওয়ার অটো ধরত বাড়ি ফেরার পথে। ও সঙ্গে করে আসত। শেষ দিন ওকে ‘না’ বলে দিয়ে ফুটপাথ টপকে চলে গিয়েছিল অটোস্ট্যান্ডের দিকে। মা দাঁড়িয়ে ছিল ওর জন্য। তখনও ফ্লাইওভার হয়নি গড়িয়াহাটে। আকাশ থেকে রোদ এসে ধুয়ে দিচ্ছিল পথঘাট। পিছন ফিরে একবারও তাকায়নি জিয়ানা। তবু বুঝতে পারছিল একজন শেষবারের মতো দেখছে ওকে। বুঝতে পারছিল ওর পথ অনুসরণ করছে এক জোড়া নীল রঙের চোখ।

বুকুদের দিক থেকে সম্বন্ধটা এসেছিল সেই সময়তেই। ওদের সঙ্গে আগেই বুকুদের এক ক্ষীণ যোগাযোগ ছিল। তারপর সম্বন্ধ আসায় মা একদম ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বলা যায় মায়ের একক প্রচেষ্টাতেই গোটা বিয়েটা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সেই মাকে যেন চিনতে পারত না জিয়ানা। বুকুর সঙ্গে জোর করে ঘুরতে পাঠাত ওকে। সিনেমা, রেস্তরাঁয়, শপিং, বুকুর সঙ্গে সব জায়গায় গিয়েছে জিয়ানা। আনন্দ করার চেষ্টাও তো করেছে। ভুলে যেতে চেয়েছে সব কিছু। বুকুকে জড়িয়েই নতুন করে বেঁচে উঠতে চেয়েছে ও। প্রবলভাবে বেঁচে উঠতে চেয়েছে।

দেখাশুনো ও ঘোরাঘুরির শেষে আবার বিদেশ চলে গিয়েছিল বুকু। ওর দু’মাসের ছুটি শেষ হয়ে গিয়েছিল। শুধু যাওয়ার আগে বলেছিল সামনের মাঘে এসে একদম নিয়ে যাবে জিয়ানাকে।

তেসরা ফেব্রুয়ারি বিয়ে হয়ে গিয়েছিল জিয়ানার। সানাই, শব্দ, আলো আর প্রচুর লোকের মাঝে বুকুকে দেখে ওর বুকও কেঁপেছিল একটু। ভালও লেগেছিল যখন লোকে বলেছিল, ‘তোর বর কত নামকরা ইঞ্জিনিয়ার। ফরেনে থাকে। ওখানে শুনেছি দারুণ ফ্ল্যাট পেয়েছে!’

বুকুর গলায় মালা দিয়ে, ওর পাশে বসে খুব ভাল লেগেছিল জিয়ানার। এমন নম্র চুপচাপ মানুষটা যে সম্পূর্ণ ওর, ভাবতে ভাল লেগেছিল। মায়ের মুখের আভা আর বাপির গর্ব দেখে জিয়ানার মনে হয়েছিল, যাক, বাবা-মাকেও খুশি করতে পেরেছে ও। সবার মন রাখতে পেরেছে।

ফুলশয্যার পরের দিন খুব ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল জিয়ানার। শরীরের নরম জায়গায় বুকুর দাঁতের দাগের ওপর হাত বুলিয়ে গত রাতের রোমাঞ্চ মনে এসেছিল ওর। শরীরে পদ্মফুল ফুটেছিল যেন। বালাপোশের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা বুকুর তৃপ্ত, ঘুমন্ত মুখটা দেখে জিয়ানার মনে হয়েছিল, যাক, সবার মন রাখতে পেরেছে ও।

নিজেই বুঝতে পারেনি তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল আবার! আর আচমকা, একদম আচমকাই ও দেখেছিল, কুয়াশার ঝাঁঝরির ভেতর মিলিয়ে যাচ্ছে একটা সাইকেল। হলুদ-লাল পাতার ইয়া বড় বড় সব গাছেরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর তার ফাঁকে তুলোর মতো গোল্লা কাটছে হাওয়া। কালো ফিতের মতো রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে, দূর থেকে আরও দূরে ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে সাইকেলটা।

ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসেছিল জিয়ানা। মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে যাবে, মনে হচ্ছিল মরেই যাবে এবার। বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটাকে কে যেন আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলছিল। যেন বুকে চাপ দিয়ে বের করে আনতে চাইছিল সব হাওয়া। দম নিতে পারছিল না জিয়ানা। গলার কাছে যেন আটকে ছিল বল। পেটের ভিতর যেন এক সমুদ্র মাছ দাপাচ্ছিল। কষ্ট হচ্ছিল, ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল জিয়ানার। ও যেন দেখতে পাচ্ছিল দূর থেকে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে বড় বড় দুটো চোখ। দুটো নীল রঙের চোখ। জিয়ানা সেই ভোরবেলা ঘুমন্ত বরের পাশে বসে বুঝেছিল, না, সবার মন রাখতে পারেনি ও। সবাইকে খুশি করতে পারেনি।

পরে, সময়ের সঙ্গে জিয়ানা বুঝেছে সবাইকে একসঙ্গে খুশি করা যায় না। একসঙ্গে খুশি করা সম্ভব নয়। এই যে সূর্য। এমন প্রতাপশালী, সম্পূর্ণ জীবজগতের নিয়ন্তা। সে-ই কি সবাইকে একসঙ্গে খুশি করতে পারে? তার আলোয় যত জোরই থাকুক না কেন, সে পৃথিবীর এক দিকে দিন করলেও আর-এক দিকে তখন কিন্তু অন্ধকারই থাকে।

বুকুর কাছ থেকে উঠে বিছানার যে-দিকটায় ও শোয়, সেদিকে ফিরে গিয়েছিল জিয়ানা। ও জানত বুকু এখনও অনেকক্ষণ কাজ করবে।

বিয়ের আগের ওই মাস দুয়েকের ঘোরাঘুরির সময়ও বুকু চুপচাপ থাকত, তবে ঠিক এতটা নয়। এখন যেন বুকুর কথা বলতেই কষ্ট হয়। যেন একা থাকতে পারলে বেঁচে যায়। জিয়ানার খারাপ লাগত প্রথম প্রথম, কিন্তু এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। ও নিজে থেকে আর বুকুকে ঘাঁটায় না। কোনও কোনও দিন ইচ্ছে হলে বুকু ওর পাশে শোয়। আবার কোনওদিন ওর স্টাডির ছোট্ট খাটটাতেই শুয়ে পড়ে। তবে কালেভদ্রে শরীরের ডাকে তাড়াতাড়ি বিছানায় আসে বুকু। কিন্তু সেই ডাকও ইদানীং কমে আসছে দ্রুত। আর সত্যি বলতে কী জিয়ানাও আর বুকুর প্রতি শারীরিকভাবে টান অনুভব করে না। ওদের যৌনতা এখন অনেকটাই রিচুয়াল হয়ে গিয়েছে।

গতকাল শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি হয়েছে বেশ। সেপ্টেম্বরের দশ তারিখ আজ। কিন্তু তবু শহরের নানা পকেটে চোরাগোপ্তা অনেক মেঘ লুকিয়ে আছে। এখনও মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে আচমকা। সামনে পুজো, ভগবান জানে বৃষ্টি কতটা ভোগাবে!

গতকাল শেষ রাতে জলতেষ্টায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল জিয়ানার। তখনই দেখেছিল পাশে বুকু নেই। বিছানার ওই অংশটা নিপাট হয়ে আছে। ও জল খেয়ে পরদা সরিয়েছিল। বাইরে রাস্তার হলুদ আলোয় বৃষ্টিটা দেখে কেমন গা-ছমছম করছিল। এসি-তে কুড়ি ডিগ্রি টেম্পারেচার সেট করা ছিল। তাতে কেমন যেন শীত শীত করছিল ওর। চব্বিশ ডিগ্রি সেট করে ও শুয়ে পড়েছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুম এসে গিয়েছিল।

সাড়ে সাতটা-টা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। প্রথম অ্যালার্মটা মিস করল কী করে ও? এ দেশটাই কি এরকম? লোককে কুঁড়ে বানিয়ে দেয়? ইউএসএ-তে থাকার সময় তো এমন হত না। এই কলকাতার ভেতরে কীসের যেন একটা বীজ আছে। মানুষের মধ্যে সেই ‘কী যেন’ জিনিসটা পুঁতে দেয় এ শহর। মানুষ একটু শ্লথ হয়ে যায়। একটু কম দৌড়োয়। একটু নরম হয়ে যায়। হ্যাঁ, নরম তো হয়েই যায়, না হলে আজ ভোরবেলা ও আবার সেই সাইকেলটা দেখবে কেন? কেন আবার বুক তোলপাড় করে ফুঁড়ে বেরোবে হলুদ-লাল পাতা সেই গাছেরা? কেন এতদিন পরে উড়ে উড়ে এসে স্বপ্নে জড়িয়ে যাবে গোলাপি স্কার্ফ?

বিছানা থেকে উঠে কলিকে চা করতে বলে বাথরুমে ঢুকে গেল জিয়ানা। বৈভবীর মর্নিং স্কুল। কলি ঠিক তৈরি করে পাঠিয়ে দেয়। ওকে চিন্তা করতে হয় না। শুধু অফিস যাওয়ার আগে শাশুড়ির ঘরে যায় জিয়ানা। ভদ্রমহিলার একটা দিক পড়ে গেছে। বারো ঘণ্টার শিফটে দু’জন মহিলা অ্যাটেনডেন্ট সবসময় থাকে। সকাল আটটায় রাতের আয়া চলে গিয়ে দিনের আয়া আসে।

শাশুড়ির কাছে গিয়ে মিনিট দু’-তিনেক দাঁড়ায় জিয়ানা। শাশুড়ির মাথায় হাত বুলিয়ে একটু খোঁজখবর নেয় শরীরের। তারপর আয়াদের ওষুধপত্র কী লাগবে জিজ্ঞেস করে বেরিয়ে আসে। আবার সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে শাশুড়িকে একবার দেখে আসে ও। শাশুড়ি মানুষটা ভাল। অল্প কথা বলেন। বিরক্তি বা রাগ কিছু প্রকাশ করেন না। চেয়ার-টেবিলের মতো পড়ে থাকেন ঘরের কোনায়। কষ্ট হয় জিয়ানার। মনে হয় শাশুড়িকে একটু সঙ্গ দেয়, একটু গল্প করে বসে, কিন্তু পারে না। সময়টাই যে নেই ওর!

শ্বশুরমশাই যতদিন ছিলেন, শাশুড়ি ভালই ছিলেন। কিন্তু শ্বশুরমশাইয়ের মৃত্যুর শকটা নিতে পারেননি তিনি। বছর না ঘুরতেই সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়। আর তার ফলে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে যান। মা থাকবে কোথায়? কার কাছে? তাই বিদেশের বাস গুটিয়ে বুকু চলে আসে এখানে। বুকুর যা কোয়ালিফিকেশন তাতে নতুন চাকরি পেতে কোনও অসুবিধেই হয়নি। চিন্তা ছিল জিয়ানার। তবে আশ্চর্যজনকভাবে ওরও চাকরি পেতে অসুবিধে হয়নি। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটরের চাকরি পেয়ে গিয়েছে জিয়ানা।

অফিস! অফিসের কথা চিন্তা করে এই সকালবেলাতেই একটু মন খারাপ হয়ে গেল ওর। ওদের কোম্পানি ভাল। এম ডি মিস্টার মদন খুরানা মাটির মানুষ। একান্তে জিয়ানাকে ‘বেটি’ বলে কথা বলেন। কিন্তু কলিগরা এক-একজন এক-একটা যন্তর। বিদেশ থেকে এসেছে বলেই কিনা কে জানে, সবার ভেতর একটা কমপ্লেক্স আছে ওকে নিয়ে! কেউই খুব সহজ হতে পারে না। তবে জিয়ানা চেষ্টা করে, সবার সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে।

বাথরুম থেকে স্নান সেরে বেরিয়ে ড্রেস করে নিল ও। একটা ছাতা নিতে হবে আজ। যদিও গাড়িতেই যাতায়াত করে, তবু যা হুটহাট বৃষ্টি হচ্ছে, কখন দরকারে লাগে কে জানে!

ড্রেস করে ডাইনিং টেবিলে এল জিয়ানা। কলি চায়ের সঙ্গে দুটো মার্জারিন দেওয়া টোস্টও দিয়েছে। শরীর ঠিক রাখা খুব দরকার। ইদানীং একটু মোটা হচ্ছে জিয়ানা। কোমরের নীচে স্ট্রেচ মার্কস দেখা দিচ্ছে। দেখলে মনে হয় যেন মাটিতে লাঙল টানা হয়েছে। দেখতে এত বিশ্রী লাগে! আজকাল লো-ফ্যাট, লো-ক্যালরি খাবারের দিকে মন দিয়েছে ও। এমনিতে জিয়ানা খেতে ভালবাসে, কিন্তু এখন বাধ্য হয়ে সেন্সর করেছে। প্রায় বত্রিশ হল, শরীরের দিকে নজর দিতেই হবে এবার।

আটটা বাজে, ওরে বাব্বা! লাফিয়ে উঠল জিয়ানা। বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এবার যেতেই হবে। স্কুলে কতক্ষণ লাগবে কে জানে! আজ আর শাশুড়ির ঘরে যাবে না।

ও নিজেই গাড়ি চালায়। ফ্রিজের মাথায় ছোট একটা বাক্স থেকে চাবিটা তুলে নিয়ে শোওয়ার ঘরে ঢুকল। চট করে একবার নিজেকে আয়নায় দেখে নিল ও। তারপর ব্যাগ আর ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখল নীচে কাকিমা দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গল্প না জুড়ে দেয়!

ভদ্রমহিলার সব ভাল, শুধু বয়স হয়েছে বলেই বোধহয় একটু বেশি বকেন। বেশি বকা লোক ঠিক সহ্য করতে পারে না জিয়ানা। সে ওর যতই শুভাকাঙ্ক্ষী হোক না কেন। আর এখন তো বেদম তাড়ার মধ্যে আছে। একবার কথার ফুলঝুরি ছুটলে কালীপুজোর আগে থামবে না।

‘আরে জিয়ানা, কেমন আছ?’ কাকিমা একমুখ হাসল।

সর্বনাশ! সব আশঙ্কা কি এভাবেই সত্যি হবে ওর জীবনে? ও বলল, ‘এই চলে যাচ্ছে কাকিমা। আসলে মেয়ের স্কুলে একটা মিটিং আছে তো, তাই একটু তাড়ায় আছি।’

কাকিমা বুঝল বলে মনে হল না। বরং আঁচল ঠিক করে চওড়া হেসে বলল, ‘তা খেয়া যে রান্না করে পাঠিয়েছিল, তা খেয়ে বললে না তো কেমন লাগল?’

‘সেই ছানাভাপা?’ জিয়ানা মনে মনে নিজেকে সাবাশ জানাল। মনে রেখেছে ঠিক! ছানা জিনিসটা একদম সহ্য করতে পারে না ও। তাই মুখেও দেয়নি। বুকু খুব ভালবাসে। গোটাটা ও একাই খেয়েছে।

‘হ্যাঁ, সেই যে রুহান দিয়ে গেল।’

রুহান, নামটা বেশ ভাল লেগেছিল জিয়ানার। যদিও পরিচয় হয়নি। যেদিন ছেলেটা এসেছিল, ও বাড়ি ছিল না। শুনেছে যে, ওদের বিয়েতেও নাকি আসেনি। এখন বিয়েতে কে এসেছিল আর কে আসেনি তা কি আর মনে রেখেছে ও? তবে এটা শুনেছে যে, খেয়াদির জায়ের ছেলে এই রুহান।

জিয়ানা বলল, ‘হ্যাঁ, খেয়েছি তো, খুব ভাল হয়েছে। আসলে নয়-দশ দিন আগের ব্যাপার তো, তাই ঠিক মনে ছিল না।’

‘ও, তো বুকু কেমন আছে?’

জিয়ানা ঘড়ি দেখল। এবার সর্বনাশ হবে। সাড়ে আটটাতেও স্কুলে পৌঁছোতে পারবে না। আর বুকু? সকালে বিছানায় ছিল না। নির্ঘাত স্টাডিতে ঘুমিয়েছে। তাড়াহুড়োয় দেখেও আসতে পারেনি একবার।

ও বলল, ‘ভাল আছে কাকিমা। আচ্ছা, এবার আমি…’

জিয়ানাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে কাকিমা বলল, ‘দেখো তো, এক বাড়িতে থাকি আর খবর নিতে হচ্ছে এভাবে। শরীরে গাঁটে গাঁটে এমন ব্যথা যে, সিঁড়ি ভাঙতে পারি না। দিদিও তো শয্যাশায়ী, তাকেও একবার চোখে দেখতে পারি না।’

যে যা পারে না সেটা নিয়ে এত বিলাপ করে কেন, কে জানে! জিয়ানা বুঝল, কাকিমা সহজে ছাড়ার পাত্রী নয়। কিন্তু যা অবস্থা, ওকে ছাড়াতেই হবে।

ও বলল, ‘আসি কাকিমা। বড্ড দেরি হয়ে গেছে।’

‘দেরি?’ কাকিমা আতান্তরে পড়ল, ‘এঃ, বয়স হয়েছে তো তাই বড্ড বকবক করি। জানো তো, আমার মায়েরও এই স্বভাব ছিল। একবার কথা শুরু করলে আর থামবে না। একবার কী হয়েছিল জানো? বাবা তখন বিহারে পোস্টেড। রেলে চাকরি করত তো, তাই ট্রান্সফারেব্‌ল জব ছিল। তো হয়েছিল কী…’

‘আসি কাকিমা,’ জিয়ানা আর দাঁড়াল না। বাবার গল্প শুনতে বসে গেলে আজ সারা দিনের কাজ ভন্ডুল হবে। কাকিমার থতমত মুখের ওপর দিয়ে বেরিয়ে এল ও।

ঘুম ভাঙার সময়কার সেই রোদটা আর নেই। বরং তার জায়গায় মেঘ করেছে বেশ। ওদের বাড়িতে কোনও গ্যারাজ নেই। তবে পাশেই অশোকদার গ্যারাজ। সেখানেই ওদের দুটো গাড়ি রাখা থাকে।

আমেরিকায় থাকার সময়ও ওদের দুটো গাড়ি ছিল। তবে দুটোই ছিল বড়। কিন্তু এদেশে এসে দেখেছে যে, পার্কিং-এর ভীষণ অসুবিধে। আর রাস্তার তুলনায় গাড়ির সংখ্যা প্রচুর বেশি। তাই এখানে ছোট গাড়ির রমরমা। জিয়ানা নিজের জন্য তাই একটা ছোট গাড়িই কিনেছে। কিন্তু বুকু তা করেনি। বড় গাড়িই কিনেছে।

মেরুন রঙের গাড়িটা শেডের তলায় রাখা ছিল। মাসে পাঁচশো টাকা নেয় অশোক। আর শেডের তলায় রাখলে দেড়শো বেশি। জিয়ানার গাড়ির প্রতি মায়া খুব বেশি, তাই শেডের তলাতেই রাখে।

রিমোট টিপে গাড়ির দরজার লক খুলে গাড়িতে বসল জিয়ানা। নিচু হয়ে উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে আকাশটা দেখল। মেঘ বাড়ছে বেশ। যে-কোনও সময় ঢালবে। জিয়ানা গাড়িতে স্টার্ট দিল।

এই দশ বছরে কলকাতা কত পালটে গেছে! বিয়ের পর বিদেশ গেলেও বৈভবী হওয়া অবধি দু’বছর অন্তর ওরা দেশে আসত। তারপর এই এসেছে। আর এসেই যেন কেমন লাগছে শহরটাকে। প্রথম প্রথম এখানে গাড়ি চালাতে ভয় লাগত ওর। মনে হত এই বুঝি অ্যাক্সিডেন্ট হল। কিন্তু এখন হাত স্টেডি হয়ে গেছে। শুধু মাঝে মাঝে বেয়াড়া টেম্পো, অটো আর ঠেলাওয়ালারা খুব ঝামেলা করে।

সকালের কলকাতায় অফিস আওয়ার্স শুরু হয়ে গেছে। সবাই সবাইকে টপকে, পিষে এগিয়ে যেতে চাইছে। মেঘ করে আছে বলে একটা ভ্যাপসা গরম লাগছে জিয়ানার, ও সুইচ টিপে কাচ তুলে এসি-টা চালিয়ে দিল।

বৈভবীর স্কুলটা শিয়ালদার কাছে। লেনিন সরণি ধরে বেরিয়ে যাবে। তবে জ্যামের জন্য চট করে বেরোতে পারল না। বারবার লাল আলো, ঠোক্কর আর বেহিসেবি পথচারীদের কাটিয়ে যখন স্কুলে পৌঁছোল তখন আটটা চল্লিশ বাজে। এই রে, বড্ড লেট হয়ে গেছে! গাড়িটা পার্ক করে প্রায় দৌড়ে স্কুলে ঢুকল ও।

স্কুলটা পুরনো। ঐতিহ্যশালী। সামনের বড় উঠোনের মতো অংশটাকে থার্ড ব্র্যাকেটের মতো ঘিরে রেখেছে স্কুল বিল্ডিং।

টিচার্স রুমেই বসে ছিল ম্যাডাম। সুলগ্না সেন। চিঠিতে নামটা দেখেছিল জিয়ানা। বৈভবীর স্কুলে যখন যা হয় জিয়ানাই যায়। তবে বেশি দিন তো হয়নি তাই স্কুলে সবার সঙ্গে জিয়ানার অতটা পরিচয় হয়নি এখনও। তবে সুলগ্নাকে দেখেই চিনতে পারল জিয়ানা। মাজা রং। কিন্তু মুখশ্রীতে অদ্ভুত একটা মন-ভাল-করা ব্যাপার আছে।

‘মিস সেন?’ জিয়ানা টিচার্স রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল।

সুলগ্না উঠে দাঁড়িয়ে দু’-এক পা এগিয়ে এল দরজার দিকে, ‘আপনি?’

‘জিয়ানা বোস, তুতু… মানে বৈভবীর মা। আপনি চিঠি দিয়েছিলেন।’

‘ও ইয়েস,’ সুলগ্না হেসে এগিয়ে এল আরও, ‘আসুন আমরা পাশের ঘরে বসি।’

টিচার্স রুমের পাশেই একটা মাঝারি মাপের ঘর। তাতে আলমারি, আরও নানা টুকিটাকি জিনিসের সঙ্গে একটা টেবিল আর চারটে চেয়ারও রয়েছে।

সুলগ্না জিয়ানার মুখোমুখি বসে নিজেই প্রথম কথা শুরু করল, ‘আচ্ছা, মিসেস বোস আমি ডাইরেক্টলি পয়েন্টে আসছি। বৈভবীকে নিয়ে আমাদের একটু চিন্তা হচ্ছে।’

‘কেন?’ একটু অবাক হল জিয়ানা।

‘শি ইজ বিহেভিং কোয়াইট স্ট্রেঞ্জলি।’

‘স্ট্রেঞ্জলি?’ জিয়ানা ওর ব্যাগটাকে কোলের থেকে নিয়ে টেবিলে রাখল।

‘ও কারও সঙ্গে মিক্স করে না। ঠিকমতো কথা বলে না। ক্লাসওয়ার্ক করে না। আচমকা ভায়োলেন্ট হয়ে যায়। ড্রইং ক্লাসে মরবিড সব ছবি আঁকে।’

‘মরবিড ছবি মানে?’

‘মানে মরা পাখি, মাথা কাটা ভল্লুক, রক্তমাখা ছোরা হাতে মানুষ। মানে এখনও তো ভাল করে আঁকতে শেখেনি, তবু বোঝা যায়। ওর মতো বয়সের মেয়েকে এতটা মরবিড আর ভায়োলেন্ট হতে আগে দেখিনি।’ সুলগ্না চিন্তিত মুখে জিয়ানার দিকে তাকাল, ‘আপনারা বাড়িতে কখনও এমন টের পাননি? মানে, ওর পড়াশোনার বইখাতা ঘেঁটে দেখেননি?’

জিয়ানা একটু লজ্জা পেল। মা হয়ে ও এসব জানে না বলতে সত্যিই খারাপ লাগছে ওর। আসলে বুকু বা জিয়ানা, বৈভবীকে নিয়ে বসার সময় পায় না বিশেষ। ওদের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এমনিতেই সেশনের মাঝখানে এসে ভরতি হয়েছে বৈভবী। সবার চেয়ে একটু পিছিয়েই আছে। আর বিদেশের সঙ্গে পড়াশোনোর ধাঁচেরও একটা পার্থক্য আছে। একটা ছোট্ট মেয়ে এত সব কিছু সহজে মানিয়ে নেবে কেমন করে? তার ওপর ওকে যে-মেয়েটা পড়াতে আসে, সেও যে কতটা ঠিকঠাক পড়াতে পারছে কে জানে? জিয়ানা ভাবল, এবার থেকে পড়াশোনার ব্যাপারটা মাঝে মাঝে দেখতেই হবে ওকে। তবে মরবিডিটির ব্যাপারটা সত্যিই চিন্তার। হঠাৎ দিদির কথা মনে পড়ল জিয়ানার। দিদিও তো এমন ছিল। তা হলে কি দিদির লক্ষণই প্রকাশ পাচ্ছে বৈভবীর মধ্যে? মরবিডিটি কি জিনবাহিত?

সুলগ্না বলল, ‘মিসেস বোস, ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝছেন? আপনাদের বাড়িতে নিশ্চয়ই এমন কিছু হয় না যাতে ওর এই মরবিডিটি আসবে? কিছু মনে করবেন না, কিন্তু প্রশ্নটা আমায় করতেই হল।’

‘দ্যাটস ও কে,’ জিয়ানা হাসার চেষ্টা করল। পারল না। ও বলল, ‘আপনার কী সাজেশন? ওকে কি কাউন্সেলিং করালে ভাল হয়?’

‘আমি এখনই বলব না, কিন্তু পরে হলেও হতে পারে।’

‘তা হলে এখন কী করব?’ জিয়ানার নিজের কাছেই নিজের গলাটা অসহায় শোনাল।

‘যতটা সম্ভব ওকে চিয়ারফুল রাখুন। ছুটির দিনে ঘুরতে নিয়ে যান, আনন্দ করুন। ওকে বিশেষ একা থাকতে দেবেন না। আর আমরা তো আমাদের মতো করে চেষ্টা করবই।’

জিয়ানা মাথা নিচু করে রইল খানিকক্ষণ। মেয়েটা সত্যিই একা থাকে। ওই শয্যাশায়ী ঠাম্মা, আর আয়া, আর কলি—স্কুল থেকে ফেরার পর তো এদের সঙ্গে ছাড়া আর কারও সঙ্গে কথাই বলে না। ওদের আশপাশে তো কোনও সমবয়সি বাচ্চা নেই যার সঙ্গে একটু খেলবে মেয়েটা। কী যে করবে বুঝতে পারছে না জিয়ানা।

সুলগ্না এবার উঠল, বলল, ‘সরি, এবার আমায় উঠতে হবে, ক্লাস আছে। তবে আই উইল কিপ ইন টাচ উইথ ইউ। বৈভবী খুব সুইট মেয়ে। খুব মিষ্টি মেয়ে। আপনি নজর রাখবেন, কিন্তু টেনশন করবেন না। এভরিথিং উইল বি অলরাইট।’

স্কুল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠল জিয়ানা। সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে পার্কিং থেকে বেরোতে যাবে, হঠাৎ বাঁ দিকের কাচে একটা ধপধপ শব্দ হচ্ছে শুনে মুখ ফেরাল ও। দেখল বালা পরা হাত দিয়ে একটা ছেলে মারছে কাচটায়।

‘হোয়াট ননসেন্স!’ জিয়ানার বিরক্ত লাগল, ‘এভাবে কাচে মারছ কেন?’

কাচ বন্ধ থাকায় ক্ষীণভাবে ছেলেটার গলা শোনা গেল, ‘আরে দিদি পারকিন ফি না দিয়েই সটকাচ্ছেন! তাড়াতাড়ি মাল ছাড়ুন।’

‘মাল?’ জিয়ানার রাগ হয়ে গেল ছেলেটার কথায়। এরা এত অসভ্য কেন!

কলেজেও একবার দুটো ছেলে ওকে টিজ করেছিল। ওড়না টেনে ‘মাল’ বলেছিল। ও দু’দিন কলেজে যেতে পারেনি। ভয়ে, লজ্জায়, কষ্টে নিজের ভেতরেই গুমরেছিল সারাটা সময়। ভাল করে খায়নি। ঘুমোয়নি। এমনকী কারও সঙ্গে কথা বলেনি। বারবার ছেলে দুটোর মুখ মনে পড়ছিল। কলেজের ফুটবল টিমের ষণ্ডা টাইপের দুটো ছেলে। ওদের বিরুদ্ধে যে কিছু করবে তাও পারেনি। তৃতীয় দিন কলেজে গিয়েছিল ও। মাথা নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিল। হঠাৎ কোত্থেকে যে একজন এগিয়ে এসেছিল! এসে সে জানতে চেয়েছিল, ‘তোর মুখচোখ এমন কেন রে? গত দু’দিন আসিসনি কেন? তোকে কেউ কিছু বলেছে?’ এ ছাড়াও একবার সুমন্ত বলে একটা ছেলে চূড়ান্ত অসভ্যতা করতে গিয়েছিল জিয়ানার সঙ্গে। সেখানে এসে দাঁড়িয়েছিল সেই ছেলেটা।

দুটো ক্ষেত্রেই বুকের কাছে ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে ও চোখ তুলে দেখেছিল ওর দিকে সটান তাকিয়ে আছে দুটো বড় বড় নীল চোখ।

জীবন আজ অনেক দূরে বেঁকে এসেছে। অমন নীল রং আর চোখেই পড়ে না জিয়ানার। ছুটিতে একবার ইংল্যান্ডে ঘুরতে গিয়েছিল বুকুর সঙ্গে। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত কাউন্টিগুলোতে ঘুরতে ঘুরতে বুকু বলেছিল, ‘দেখো, আকাশটা কেমন চোখের মতো নীল!’

না, সেই নীল নয়। মাথা নামিয়ে নিয়েছিল জিয়ানা। কিছু বলেনি। বুকু ওকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলেছিল, ‘ইস, আমার চোখ দুটো যদি এমন নীল হত!’

ওই চোখ তুলে কেবলমাত্র একজনই তাকিয়েছিল। আর কেউ কোনওদিন পারেনি, কোনওদিন পারবেও না। জিয়ানা বুকুর জ্যাকেটে মুখ গুঁজে কেঁপে উঠেছিল সামান্য। বুঝেছিল এই কম্পনটুকুই একমাত্র ওর ব্যক্তিগত, আর কোনও কিছু নয়।

পার্কিং ফি দিয়ে গাড়িটা বের করে নিল জিয়ানা। এবার অফিস যাবে। আকাশ কালো করে এসেছে। মনে হচ্ছে যেন নোংরা একটা চাদর কেউ টাঙিয়ে দিয়েছে শহরের মাথায়। বিরক্ত লাগছে জিয়ানার। মেঘলা দিনে পলিউশন রেট যেন আরও বেড়ে যায়। ওর মাঝে মাঝে মনেই হয় না যে, এই তেলকালির শহরে ও এতগুলো বছর কাটিয়েছে। মাঝের ন’-দশটা বছর যেন ওকে পালটে দিয়েছে শারীরিকভাবে। যেমন এখন মুখ ফসকে কখনও সখনও বলে ফেলে, ‘আমাদের ওখানে এমন হয় না।’ জিয়ানা মাঝে মাঝে ভাবে, সত্যি মানুষ কখনও কখনও বোঝে না, কোনটা তার দেশ! যেখানে সে শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকে সেখানে, না যেখানে তার মন পড়ে থাকে সেখানে।

পার্ক স্ট্রিটে ওদের অফিসটা বেশ বড়। নীচে পার্কিং লট আছে। গত সপ্তাহ থেকে এখানে গাড়ি রাখার সুযোগ পায় ও। কারণ তার আগে গোটা জায়গাটাই একদম বুক্‌ড থাকত।

দুটো বড় গাড়ির মাঝে নিজের গাড়িটাকে সাবধানে পার্ক করে নামল জিয়ানা। তারপর গাড়ি লক করে এগিয়ে গেল লিফ্‌টের দিকে।

এই বিল্ডিংটা ছ’তলা। এর ওপরের দুটো ফ্লোর ওর কোম্পানির। ওরা প্রজেক্টের কাজ করে। সিভিল, মেক্যানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল ইত্যাদি আরও ডিভিশন নিয়ে ওরা ব্যাবসার যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করে। আর এই সবকিছুকে কো-অর্ডিনেট করে, ওদের সেলসের সঙ্গে টেকনিক্যাল ব্যাক-আপ দিয়ে কাজটাকে সিনক্রোনাইজ করাই হল প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটরের কাজ। তবে মাঝে মাঝে বেয়াড়া জায়গায় সেলস টিমের সঙ্গে ছুটতে হয় কো-অর্ডিনেটরকে। যদিও এই শেষের ব্যাপারটা এখনও করতে হয়নি জিয়ানাকে। আসলে এত বছর বিদেশের ওয়ার্ক কালচারে ছিল ও, তাই খুরানা ওকে ধাতস্থ হওয়ার জন্য হয়তো তেমন প্রজেক্টে ঠেলছেন না। তা ছাড়া সেলসে পুরনো কমপিটেন্ট লোকের অভাব নেই ওদের। ছ’জন, প্রায় কুড়ি বছরের এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে বসে আছে। তারা খুবই হেল্‌পফুল আর কাজটাও বোঝে। ফলে কো-অর্ডিনেটরদের চাপ কম।

যদিও অফিসে একটা কানাঘুষো চলে যে, খুরানা জিয়ানাকে বিশেষ চোখে দেখেন তাই এত মাইনে দিয়ে রাখলেও সেফ জোনে খেলতে দেন। জিয়ানা এসব পাত্তা দেয় না। কর্পোরেট সেক্টর হল চাইনিজ চেকার্স-এর বোর্ড। কে কাকে কীভাবে টপকাবে, বোঝা মুশকিল। সবার ভেতরেই একে ওপরকে টপকানোর ইচ্ছে ক্রমাগত চলে। ফলে চোরাগোপ্তা মার, বদনাম, বিপদে ফেলার মতো ঘটনা ঘটতেই থাকে।

জিয়ানার সঙ্গে আরও চারজন প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর আছে। শ্যাম ভার্গব, ললিত রায়, শালিনী মেটা আর অনুজ সান্যাল। এদের মধ্যে শ্যাম নিজের চরকায় তেল দিতে পছন্দ করে। কিন্তু শালিনী আর অনুজ হল শয়তানের রিপ্রেজেনটেটিভ। ললিত ছেলেটা ভাল। একটু চুপচাপ, কিন্তু ভাল।

লিফ্‌টের ভেতরের ফ্যানটা চলছে না আজ। এমনিতেই মেঘের শহর খুব গুমোট, তার ওপর লিফ্‌টের মতো একটা কফিনে যদি ফ্যান না চলে তা হলে যে কী ঘোরতর অবস্থা হয়, কাকে বোঝাবে জিয়ানা! এই দেশে, মেনটেনেন্স বলে একটা ব্যাপার যে আছে, বোঝাই যায় না। লিফ্‌টের ফ্যানটা যে খারাপ হয়েছে সেটা জানালেও, জিয়ানা জানে যে, কিচ্ছু ঠিক হবে না। এদেশে সবাই যে-কোনও কাজ কাল করার পক্ষপাতী।

এখন পিক আওয়ার্স, তাই লিফ্‌টে এ ওর কোলে উঠে পড়ার মতো অবস্থা। গুটখা, পান, নস্যি, সিগারেট-নানারকম গন্ধের মিশ্রণ যেন পাক খাচ্ছে কফিনের মধ্যে। চিরকালই এসব গন্ধে গা গুলোয় জিয়ানার। বুকু যেদিন স্মোক করত সেদিন চুমু পর্যন্ত খেতে দিত না ও। বুকু বলত, ‘আরে বাবা, পুরুষ মানুষ সিগারেট না খেলে মানায়?’ বলত, তবে তারপর বহু দিন আর খেত না। আসলে সিগারেটটা বুকুর নেশা ছিল না কোনওদিনই। মাঝেমধ্যে কলিগদের পাল্লায় পড়ে খেত। তবে বুকু আর সিগারেট খায় না। বছর চারেক হল ড্রিঙ্ক করা শুরু করেছে। মদের গন্ধও ভাল লাগে না জিয়ানার। তবে এখন খুব একটা বেশি সহ্য করতে হয় না সেই গন্ধ।

লিফ্‌ট থেকে যখন ছ’তলায় বেরোল, জিয়ানার মনে হল স্নান করে বেরিয়েছে। লিফ্‌ট থেকে বেরিয়েই একটা চৌকো জায়গা, তার এক দিক দিয়ে ছাদের দিকে সিঁড়ি গেছে। এক দিকে ওয়াশরুম আর সোজাসুজি সামনের কাচের সুইংডোর। অফিসে ঢোকার দরজা। কাচটা ফ্রস্টেড, আর তার ওপর লেখা প্রোজেকশন কর্প।

দরজায় বনমালী বসে একটা হাত দেখার বই পড়ছিল। লোকটার দু’হাতে আঙুলে মোটমাট চোদ্দোটা আংটি। এত কীসের বিশ্বাস কে জানে! জিয়ানার মাঝে মাঝে অবাক লাগে। কৌতূহলও হয়। ভাবে জিজ্ঞেস করবে বনমালীকে যে, এইসব বই পড়ে কী জানতে চায় ও? যা হবে তা তো হবেই, সেটাকে জেনে বা বদলে দিতে কেন চায় মানুষ? তবে জিজ্ঞেস করতে পারে না, স্বভাবগত ও পদমর্যাদাগত ব্যাপারটা ওকে গম্ভীর করে রাখে।

ওকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা ঝোঁকাল বনমালী। জিয়ানাও মাথা নাড়িয়ে ঢুকে গেল ভিতরে। ঠান্ডা করিডরে দাঁড়িয়ে শান্তি পেল ও। এখানে ঢুকলে মনেই হয় না পচা ভাদুরে গরমে গোটা কলকাতাটাই তন্দুর হয়ে গেছে।

ন’টা চল্লিশ বাজে, অফিস এখনও তেমনভাবে জমেনি। যতটা দেরি হবে ভেবেছিল, ততটা হয়নি। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল জিয়ানা। ওদের এখানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডিটেক্টর দিয়ে অ্যাটেডেন্স রাখা হয়। সেসব সেরে ডেস্কে গিয়ে বসল ও।

জিয়ানার সিটটা একদম ধারে। পাশে দেওয়াল। তাতে বড় কাচ লাগানো। জিয়ানার এখানে বসতে ভাল লাগে বেশ। ভেতর থেকে বাইরে দেখা গেলেও বাইরে থেকে ভেতরটা দেখা যায় না। আর অত ওপরে বসে গোটা শহরটাকে কম্পিউটারের রেসিং গেমের মতো মনে হয়। মনে হয় কালো রাস্তা দিয়ে অসংখ্য গাড়ি পাল্লা দিচ্ছে একে অপরের সঙ্গে। আর একটা সময়ও খুব ভাল লাগে জিয়ানার। সূর্যাস্তের সময়। এত ওপর থেকে ওর মনে হয় ওপরের সূর্য আর মাটির শহরের মাঝে কেমন যেন ভেসে বেড়াচ্ছে ও। ওর মনে হয় একদিন অনেক উঁচু একটা বাড়িতে ও থাকবে।

তবে একদিন থাকবে, আজ নয়। আজ এখন কাজ করতে হবে ওকে। কোরাপুটে ওদের একটা প্রজেক্ট চলছে। ম্যানেজমেন্টের মতে তাতে এক্সপেনডিচার বেশি হচ্ছে। খুরানা বলেছে একটা প্রজেক্ট ট্যালি তৈরি করতে।

প্রায় দু’বছর ধরে প্রজেক্টটা চলছে। জিয়ানার এখানে জয়েন করার অনেক আগে থেকে। কিন্তু প্রথম থেকেই ঝামেলার জন্য কাজে দেরি হচ্ছে। তার মধ্যে বাজেটে দাম বেড়েছে জিনিসপত্তরের। যদিও প্রজেক্ট কনট্র্যাক্ট-এর ক্লজে এস্কালেশনের কথা ছিল, তবু যা এস্টিমেট ছিল খরচ তারও বেশি হচ্ছে। কতটা প্রফিট মার্জিন যে ড্রেন হবে তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তায় আছে ম্যানেজমেন্ট। গত কয়েকদিন ধরে এটা নিয়েই কাজ করছে ও। আজ হোপফুলি শেষ করে ফেলতে পারবে।

ব্যাগটা টেবিলে রেখে কম্পিউটারটা সুইচ অন করল জিয়ানা। বাঁদিকের ড্রয়ার খুলে দুটো প্রজেক্টের কস্টিং ফাইল বের করল। এত বড় প্রজেক্ট, প্রায় সাড়ে চারশো কোটি টাকার। তার হিসেব করা কি চাট্টিখানি কথা! অবশ্য এ তো আর শুধু অ্যাকাউনটেন্টের হিসেব নয়, এর মধ্যে ট্রিগনোমেট্রি, কেমিক্যাল ব্যালেন্স করে নানান রাসায়নিকের ওজন বের করে তার খরচ, অ্যালজেব্রা, লগ, ক্যালকুলাস আরও অনেক কেরামতির অঙ্ক লুকিয়ে আছে।

অঙ্ক করতে ভাল লাগে জিয়ানার। তাই কাজটা করতে ভালই লেগেছে। ও জানে চেপে করতে পারলে লাঞ্চের পরেই হিসেবটা খুরানাকে সাবমিট করতে পারবে। কিন্তু তার জন্য কিছুক্ষণ নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে হবে।

কম্পিউটারে স্প্রেডশিটটা খুলে দেখতে যাবে, এমন সময় ফোনটা ক্যানক্যান করে বেজে উঠল। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ গেল জিয়ানার। মা। মা? এমন সময়! বিরক্তিতে মুখটা বেঁকে গেল জিয়ানার। সত্যি, মায়ের সময়জ্ঞানের তুলনা নেই! ভুলভাল সময়ে ফোন করতে মা ওস্তাদ! ভদ্রমহিলাকে বলে বলে পারে না জিয়ানা যে, এমন করতে নেই। অফিস টাইমে ফোন করতে নেই একদম। কিন্তু জিয়ানা এও জানে যে, ফোনটা ওকে তুলতেই হবে নইলে আর রক্ষে থাকবে না। মা কেঁদেকেটে একশা করবে। মায়ের রাগ, দুঃখ সব চড়া সুরে বাঁধা। একগুঁয়ে বাচ্চার মতো মায়ের যা চাই, তা চাই। ইচ্ছার সামান্য এদিক-ওদিক হলেই কেলেঙ্কারি।

‘বলো মা,’ ফোনটা তুলে বিরক্তি চেপে বলল জিয়ানা।

‘তুই কি আমার ফোন পেয়ে বিরক্ত হলি মিষ্টি?’

জিয়ানা ঠোঁট কামড়াল। এই রে! যতই চাপা দেওয়ার চেষ্টা করুক, মা ঠিক বুঝে ফেলেছে। এসব ব্যাপারে ভদ্রমহিলার একটা নিজস্ব ইন্‌সটিংক্ট আছে।

জিয়ানা হাসার চেষ্টা করল, ‘না মা, একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। ইম্পর্ট্যান্ট কাজ করতে হচ্ছে তো, তাই হয়তো তোমার গলাটা অন্যরকম লেগেছে।’

‘তাই?’ ফোনের ওপার থেকে দীর্ঘশ্বাস শুনল জিয়ানা। মা বড্ড বেশি সেন্টিমেন্টাল।

জিয়ানা বলল, ‘মা, একটু তাড়াতাড়ি বলবে কী দরকার?’

‘বলছি,’ মা আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘তোর বাবা বলেছিল তোকে একবার আসতে।’

‘এই তো কিছুদিন আগে গেলাম।’

‘তো? আর আসা যায় না?’

‘ঠিক আছে, যাব।’ জিয়ানা কথা শেষ করে রাখতে পারলে বাঁচে এমনভাবে বলল।

মা তবু ছাড়ল না। বলল, ‘আর সেই ব্যাপারটা নিয়ে কি কিছু ভাবলি?’

‘কোন ব্যাপারটা?’ জিয়ানা কমপিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকাল। প্রজেক্ট কস্ট বের করার সময় ইলেকট্রিক্যাল এস্টিমেশনে মনে হচ্ছে এরিয়া লাইটেনিং-এ কিছু গড়বড় থেকে গেছে।

‘আঃ,’ মা বিরক্ত হল, ‘তুই শুনছিস না ঠিকমতো। তুতুলের একটা ভাই নেওয়ার ব্যাপারটা। আর দেরি করিস না। একটা বাচ্চার কোনও ভরসা নেই। তাড়াতাড়ি নিয়ে নে। দেখলি তো কী হয় মানুষের জীবনে!’

‘মা,’ জিয়ানা কঠোর হল, ‘প্লিজ, আমায় এবার কাজ করতে দাও। বাপির কাছে আমি ঠিক যাব, বলে দিয়ো, কেমন?’

‘কিন্তু, মিষ্টি তুই কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছিস।’

‘মা, এখন রাখছি, বাই।’ কুট করে ফোনটা কেটে দিল ও।

এটা মায়ের নতুন সংযোজন। দেশে ফেরার পর থেকে শুরু করেছে, ‘আর একটা বাচ্চা নে।’ কেন? একটা সন্তানের নাকি গ্যারান্টি নেই। মাকে বুঝিয়ে পারে না ও যে, মানুষের জীবন টিভি, ফ্রিজ বা মোবাইল নয় যে, গ্যারান্টি কার্ড সমেত আসবে। কিন্তু মা বোঝে না। আসলে মা এমন করে কেন ও বোঝে। নিজের ছোটবেলার দিকে তাকালে মায়ের সেই মুখটা মনে পড়ে ওর। মনে পড়ে শোওয়ার ঘরে দেখা সেই দৃশ্যটা।

তবে যাই ঘটে থাকুক, অতীত তো অতীতই। আর মায়ের সঙ্গে অমন হয়েছে বলে জিয়ানার সঙ্গেও অমন হবে, তা তো নয়। কিন্তু মা কিছুতেই বোঝে না এটা, শুধু চাপ দেয়। নিজের মত অনুযায়ী কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দেয়। আর এটা সম্ভব হয় বাপির জন্য। বাপি কেন যে মাকে একটু কিছু বলে না! জিয়ানা মায়ের সঙ্গে না পেরে মাঝে মাঝে বাপির ওপর রাগ করে। কখনও কখনও ভাল-মন্দ কথাও শুনিয়ে দেয় বাপিকে। তবু বাপি কিছু বলে না। শুধু তাকিয়ে থাকে।

বাচ্চা নেওয়ার কথা আর ভাবতে পারে না জিয়ানা। বাচ্চা নিতে গেলে যেমন সম্পর্ক চাই, বুকুর সঙ্গে তা আর প্রায় নেই। সারাদিন খাটাখাটনির পর জিয়ানার আর ইচ্ছে করে না। তা ছাড়া পুরনো, বহু পুরনো একটা জিয়ানাকে আজকাল ভেতরে আবার টের পায় ও। মনে হয় বহু বহু দিন ঘুমের পর পুরনো সেই মেয়েটা ওর ভেতরে জাগছে। এত বছরের এত ঘটনা সরিয়ে, জিয়ানা বোঝে একজন যেন মাথা তুলছে। যেন তার ফেরত আসার পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু কেন? কেন হচ্ছে এমন?

জিয়ানা বোতল থেকে জল খেল খানিকটা। তারপর নিজেকে সংযত করে ডুবে গেল কম্পিউটারে। মনে মনে নিজেকে লাঞ্চ অবধি সময় দিল ও। তার ভেতর যে করে হোক এটা শেষ করে খুরানার কাছে সাবমিট করবে।

বারোটা অবধি মন দিয়ে কাজ করে ঠিক কাজটা গুটিয়ে আনল জিয়ানা। এবার শুধু সামারিটা করা বাকি। ও হাঁফ ছাড়ল। সত্যিই খুব জটিল ছিল কাজটা। আর এটাও সত্যি যে, ম্যানেজমেন্টের আশঙ্কাও ঠিক। বেশ কিছু টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়ে গেছে। জিয়ানা জানে এটা নিয়ে সাইট ম্যানেজারদের ওপর একটা স্টেপ নেওয়া হবে।

জিয়ানা উঠল। একটা কফি দরকার। ওদের বড় ঘরের কোনায় কফি মেশিন রাখা থাকে। অফিসে জিয়ানা কফিটা প্রেফার করে। এদের চায়ের যা কোয়ালিটি, মুখে দেওয়া যায় না।

পাশে রাখা একটা পেপার কাপে কফিটা নিল জিয়ানা। গন্ধটাই রিফ্রেশিং। ও চুমুক দিতে যাবে এমন সময় পিছনের থেকে শুনল, ‘আরে জিয়ানা, তুমি খবরটা শুনেছ?’

‘খবর?’ জিয়ানা কাপটা হাতে ঘুরল। ললিত। বেঁটে কালো মানুষটাকে বেশ উত্তেজিত লাগল।

‘আরে বিশাল কেলো!’ ললিত বাঁ হাত দিয়ে টাইয়ের নটটা ঠিক করে বলল, ‘এক সঙ্গে ছ’জন গেছে।’

‘মানে?’ জিয়ানা ভুরু কুঁচকে তাকাল। ললিতের এই এক সমস্যা। কোনও কথা সরাসরি বলে না।

‘প্লিজ কাট দ্য ক্র্যাপ, কী হয়েছে বলো?’

‘বিশাল কেস! পুরো কোম্পানির ব্যাকবোন কেঁপে গেছে।’ ললিত বলল।

‘আরে, কী হয়েছে বলবে, না একশো পাতা ইনট্রো দেবে?’ এবার ঝাঁঝিয়ে বলল জিয়ানা। ও জানে এটা ললিতের ওষুধ।

ললিত বোকার মতো হাসল। বোধহয় জিয়ানার রাগটাকে প্রশমিত করার জন্যই। তারপর বলল, ‘সেল্‌সের ছ’জন গতকাল একসঙ্গে রিজাইন করে অন্য জায়গায় জয়েন করেছে।’

‘মানে!’ জিয়ানার হাত থেকে কফিটা একটু চলকাল। বলছে কী ললিত?

‘হ্যাঁ, আমাদের সেল্‌স টিমের ছ’জনকে ওয়াটার বার্ড কোম্পানি জাস্ট একসঙ্গে তুলে নিয়েছে।’

‘সে কী?’ জিয়ানা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

ওয়াটার বার্ড ওদের সবচেয়ে পুরনো কমপিটিটর, আর হার্ড কমপিটিটর। গত মাসেই ওরা একটা সুইডিশ কোম্পানির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে। তারপর এ মাসে জিয়ানাদের সেল্‌সের টিমটাকে এমনভাবে তুলে নিল! এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার।

জিয়ানা বলল, ‘তুমি ঠিক জানো?’

ললিত হাসল, ‘সারাদিন কম্পিউটারে মুখ গুঁজে থাকলে জানবে কেমন করে? আরে বাবা, ঘাস খেতে খেতে মাঝে মাঝে আকাশের দিকেও মুখ তুলে তাকাতে হয়। খবরটা অফিসের সবাই জানে আর তোমায় দেখে মনে হচ্ছে যেন গাছ থেকে পড়লে!’

জিয়ানা কফিটা শেষ করে, কাপটা বিনে ছুড়ে ফেলে বলল, ‘তা হলে কী হবে?’

ললিত চলে যেতে গিয়েও দাঁড়াল একটু, ‘কী আর হবে! বাঁশের সময় আসছে। সেল্‌স থেকে আমাদের ওপর বিশেষ চাপ আসত না। এবার ‘কাম কা বাম্বু লেনা হ্যায় জাম্বো’ হবে। হার্ড ডেজ আর কামিং জিয়ানা, হার্ড ডেজ আর কামিং।’

হার্ড ডেজ। কঠিন দিন। সেল্‌সের প্রচণ্ড চাপ এবার বুঝতে পারবে জিয়ানা। টেনশন হচ্ছে ওর। সামনে অনেক কাজের লিড। সেসব ফলো-আপ আর তার পরের ধাপের কাজকর্ম খুব কঠিন হয়ে গেল। এভাবে ছ’জন কখনও ছেড়ে যায়!

জিয়ানা নিজের সিটে ফিরে গিয়ে বসল। কিন্তু কম্পিউটারের দিকে না তাকিয়ে জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল। রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। এ ওকে টপকাচ্ছে, ও একে মেরে বেরিয়ে যাচ্ছে। লোকজন প্রাণ হাতে করে রাস্তা পেরোচ্ছে। হকাররা চিৎকার করছে। আর পুরনো বাড়ির লম্বা লম্বা ছায়া বিপদের রং লাগিয়ে দিচ্ছে সব কিছুতে। কম্পিউটার গেমসের শহরটার দিকে তাকিয়ে রইল জিয়ানা। ও বুঝল, এ খেলার কন্ট্রোল ওর হাতে নেই। কারণ এই বিশাল খেলাটার ভেতর ও নিজেই যে ঢুকে পড়েছে এখন!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *