২৯
একটা জল ট্যাঙ্ক। উঁচু একটা জল ট্যাঙ্ক। তার শরীর সবুজ টুনি বাল্ব দিয়ে সাজানো। আবছা হয়ে আসছিল আলো। দূরে সোনার কাস্তের মতো চাঁদ জেগে উঠছিল ধীরে ধীরে। ভয় লাগছিল কিগানের। অমন ফাঁকা মাঠ, হিম জড়ানো হাওয়া আর দিঘি! ভয় লাগবে না?
দূরে, রাজারহাট নিউ টাউনের রাস্তা। খেলনার মতো গাড়িগুলো চলে যাচ্ছিল দ্রুত। আরও দূরে ডাইনোসরের পাঁজরের মতো লাগছিল লম্বা বাড়িগুলো। আর এসবের ফাঁক দিয়ে সন্ধে নামছিল আকাশের ঢালু বেয়ে।
ফুল শার্টের হাতাটা গুটিয়ে রেখেছিল কিগান। কবজিতে বাঁধা ঘড়িটা থেকে সবুজ এক আশ্চর্য আলো বলের মতো যেন জেগেছিল শূন্যে। গলা শুকিয়ে আসছিল কিগানের। কষ্ট হচ্ছিল কথা বলতে। মনে হচ্ছিল কেন এখানে এসেছে ও? পাশে ওর গা ঘেঁষে বসে ছোট ছোট কামড়ে চকোলেট খাচ্ছিল দিঘি। হালকা কোকোর গন্ধ, পারফিউমের সঙ্গে মিশে পাক খাচ্ছিল হাওয়ায়। ওরা কেউ কোনও কথা বলছিল না।
দিঘি ফোনে কিন্তু অনেক কথা বলেছিল। কিগান তখন কলকাতায় পোস্টেড। লাঞ্চের পর কাজের চাপ ছিলই না সেদিন। নিজের টেবিলে বসে একটা রুবিক্স কিউব নিয়ে সল্ভ করার চেষ্টা করছিল ও। দুটো লেয়ার মিলিয়েও দিয়েছিল। কিন্তু তৃতীয় লেয়ারটা মেলাতে পারছিল না কিছুতেই। আসলে এর একটা ফর্মুলা হয়। তার শেষটা কিছুতেই মনে পড়ছিল না কিগানের। মানে, একটা অংশ মনে পড়ছিল, বাকিটা পড়ছিল না। কিগান জানে, এটাই ওর সমস্যা। একবার রোখ চেপে গেলে কিছুতেই সেই কাজটা না করে থাকতে পারে না ও। কেবলই মনে হয়, মানুষ হয়ে পারবে না? কিগানের আশপাশ থেকে ক্রমশ মুছে যাচ্ছিল অফিসের হইচই, মানুষজন, ফাইলপত্তর। শুধু একটা ঘনক আর তার ছ’টা তল শুষে নিয়েছিল ওর সমস্ত মনোযোগ। আর ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠেছিল আচমকা।
ফোনটা আসায় একটু চমকে উঠেছিল কিগান। ফোনের সুরেলা গিটারটাও কেমন যেন কর্কশ মনে হয়েছিল ওর। কিউবটায় একটা মোচড় দিয়ে ও বিরক্ত মুখে তাকিয়েছিল ফোনটার দিকে। কে এসময়? আর ও অবাক হয়ে দেখেছিল স্ক্রিনে লেখা উঠেছে ‘দিঘি’।
দিঘি? হঠাৎ দিঘি ফোন করল ওকে? কিউবটা রেখে মোবাইলটা তুলেছিল কিগান, ‘হ্যালো?’
‘তুমি কোথায়?’ দিঘির গলায় টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ।
‘আমি? আমি তো অফিসে। কেন?’ কিগান আশ্চর্য হয়েছিল।
‘দেখা করবে আমার সঙ্গে?’
‘কী?’ ঠিক বুঝতে পারেনি কিগান।
‘বলছি, আমার সঙ্গে আজ দেখা করবে?’
‘তো—তোমার সঙ্গে?’ খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল কিগান। কী বলে কী মেয়েটা?
‘কেন, দেখা করা যায় না? আমি বাঘ, না ভালুক যে, দেখা করবে না?’ দিঘির গলায় ঝাঁঝ। ও বলেছিল, ‘কেন দেখা করবে না?’
‘না, মানে…অফিসে কাজ…ইয়ে…’
‘একদিন কাজ না করলে পৃথিবী রসাতলে যাবে না। তুমি এসো। আমি ইডেন গার্ডেন্সে চার নম্বর গেটের সামনে অপেক্ষা করছি।’
‘আরে!’ কিগান বিপন্ন গলায় বলেছিল, ‘আরে করছ কী? আমি যাব কী করে এখন? হুট করে বেরিয়ে যাওয়া যায় নাকি?’
দিঘি জেদের গলায় বলেছিল, ‘তুমি না এলে আমিই তোমার অফিসে আসছি। তুমি না বললে কি ভেবেছ যে, আমি জানতে পারব না কোথায় তোমার অফিস?’
‘এই সর্বনাশ!’ কিগান ঢোক গিলেছিল, ‘আরে বাবা, অমন কোরো না। তোমার মাথা খারাপ হয়েছে?’
‘কেন, মাথা খারাপের কী হয়েছে?’ দিঘি গম্ভীর গলায় বলেছিল, ‘তুমি এমন বলছ কেন? দাঁড়াও আমি অফিসে আসি তারপর তোমায় দেখাচ্ছি।’
‘আরে! আমি আসছি। দাঁড়াও একটু, আমিই আসছি,’ কিগান তাড়াতাড়ি বলেছিল।
‘দ্যাটস লাইক আ গুড বয়। তাড়াতাড়ি এসো।’
ফোনটা কেটে চুপ করে একটু বসেছিল কিগান। টেবিলের ওপর আধখ্যাঁচড়া রুবিক্স কিউব পড়ে ছিল। জটিল। জীবনের সব কিছুই বড় জটিল। তবে এই ঘনকের ধাঁধার ফর্মুলা আছে। তা দেখে সমাধান করা যায়। কিন্তু জীবনের কোনও ফর্মুলা হয় না। কোনও নিয়ম হয় না। জীবন কক্ষনও নিয়ম মেনে চলে না।
বসের কাছ থেকে ছুটি পেতে সময় লাগেনি কিগানের। তারপর বেরিয়েই একটা অফিসের গাড়ি পেয়ে গিয়েছিল। তাকে বলেছিল ওকে ইডেনের চার নম্বর গেটের কাছে ড্রপ করতে।
একটা লেবু রঙের কুর্তি আর জিন্স পরে ব্যাগ কাঁধে দাঁড়িয়ে ছিল দিঘি। নরম হাওয়ায় উড়ছিল কপালের চুলগুলো। গাড়ি থেকে নেমে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়েছিল কিগান। অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল দিঘিকে। বুকের ভেতর আশ্চর্য এক মোচড় অনুভব করেছিল কিগান। মনে হচ্ছিল ওর বুকের ভেতরটাতে কিছু একটা মেলানোর জন্য কে যেন ওর মনটা মোচড় দিচ্ছে প্রাণপণে। তবু মিলছে না। কিচ্ছু মিলছে না। পায়ে পায়ে দিঘির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল কিগান।
‘যাক, তুমি এলে তবে,’ দিঘি ঠোঁট টিপে হেসেছিল, ‘ভিতু কোথাকার।’
‘হঠাৎ এভাবে? কী ব্যাপার?’ প্রশ্ন করেছিল কিগান।
‘তুমি আজকের আকাশটা দেখেছ?’
‘আকাশ? কেন? সেই তো ছাই রঙের।’
‘ধ্যাত, দুপুরে একটু বৃষ্টি হল না?’ দিঘি বলেছিল, ‘তখন স্যারের কাছে পড়তে গিয়েছিলাম। বৃষ্টি থামতেই দেখি কেমন দারুণ নীল রঙের আকাশ! ঠিক তোমার চোখের মতো। তাই আর পড়তে ইচ্ছে করল না। স্যারকে বললাম, মাথা ব্যথা করছে।’
‘সে কী? কেন?’ কিগান অবাক হয়েছিল।
‘আচ্ছা বোকা তো! তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। তোমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করছিল। তাই চলে এলাম। মনে হচ্ছিল তোমার সঙ্গে একা একা সময় কাটাই।’
‘দিঘি,’ কিগান নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিল, ‘আমাদের বোধহয় এসব না করলেই ভাল হয়। আমাদের বয়সের পার্থক্যটা দেখো। অবস্থার পার্থক্যটা দেখো। তোমার গোটা জীবন পড়ে আছে। আর…’
‘আর?’ দিঘি গভীর চোখে তাকিয়েছিল, ‘আর কী?’
‘বলছি। কিন্তু এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে কথা বললে…মানে পরিচিত কেউ দেখলে…তুমি বুঝতে পারছ তো, কী বলতে চাইছি?’
এবার দিঘি চিন্তিত হয়েছিল। ঠোঁট কামড়ে সামান্য চিন্তা করে সামনে দিয়ে যাওয়া একটা ট্যাক্সিকে দাঁড় করিয়েছিল দ্রুত। তারপর উঠে পড়েছিল এক নিমেষে। কিগানকেও ডেকে নিয়েছিল।
‘রাজারহাট, নিউ টাউন।’ ট্যাক্সিওলাকে কথাগুলো বলে গাড়ির সিটে ছড়িয়ে বসেছিল দিঘি।
‘নিউ টাউন?’ কিগান কী বলবে বুঝতে পারছিল না।
‘হ্যাঁ। ওখানে কেউ আমাদের ডিস্টার্ব করবে না। কেউ চিনতেও পারবে না।’
‘তা বলে অত দূর?’
‘ধ্যাত, এ তো সত্যিই ভিতু দেখছি!’ দিঘি আলতো হাতে ঘুসি মেরেছিল কিগানকে। বলেছিল, ‘বাদ দাও। কী যেন বলছিলে! “আর” না কী?’
‘হ্যাঁ,’ কিগান দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল, ‘বলছিলাম, আমি এসব খেলায় পারদর্শী নই। তুমি হয়তো জানো না যে, কলেজজীবনে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার প্রেম ছিল। সে আমায় ছেড়ে অন্য একজনকে বিয়ে করে নেয়। সেটা আমার কাছে একটা মারাত্মক শক ছিল। আমি খুব মনখারাপ করে থাকতাম। একরকম ডিপ্রেশনই বলতে পারো। সেইখান থেকে আমি নিজেকে সামলেছি। নিজেকে ঠিক করেছি। আমি আর-একবার হার্ট ব্রেক নিতে পারব না।’
‘হার্ট ব্রেক? কেন? তোমার কী মনে হয়? আমি হার্ট ব্রেক করব তোমার? তোমায় ছেড়ে চলে যাব? কেন যাব?’
‘কারণ…,’ কিগান মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘যাবে। আমি জানি তুমি যাবে। তোমার অল্প বয়স। প্রচুর ছেলে বন্ধু তোমার। মনও থিতু নয়। আজ আমায় ভাল লাগছে। কাল অন্যকে লাগবে। কিন্তু আমার তখন কী অবস্থা হবে, ভাবতে পারছ? তাই বলছি, এমন কোরো না। প্লিজ।’
দিঘি রাগ রাগ মুখ করে বলেছিল, ‘তোমার আমাকে এতটা শ্যালো মনে হয়? মনে হয় যে, খুব সহজেই আমার মন পালটে যাবে?’
‘দেখো,’ কিগান ঘুরে দিঘির দিকে বসেছিল, ‘তোমার বয়স কম। সামনে পুরো জীবনটা পড়ে আছে। তুমি সামনে আরও অনেক ছেলের সংস্পর্শে আসবে। তারা তোমায় পছন্দ করবে, আর তুমিও পছন্দ করে ফেলবে একজনকে। দেখো, তখন আর এমন মনে হবে না।’
‘মানে!’ দিঘি প্রায় সরে এসে কিগানের বুকের কাছে ঢুকে পড়েছিল।
‘আরে। কী করছ?’ কিগান সরে ট্যাক্সির দরজার সঙ্গে ঘেঁষে বসেছিল। একবার চট করে সামনে দেখে নিয়েছিল। রিয়ার ভিউ মিরর দিয়ে ট্যাক্সিচালক দেখছে না তো ওদের! তারপর বলেছিল, ‘এমন কোরো না। লোকজন দেখছে।’
‘দেখুক। তাতে আমার কী? আর তুমি আমায় একটা সত্যি উত্তর দাও।’
‘কী?’ কিগান জিজ্ঞেস করেছিল। জানালা দিয়ে আসা হাওয়ায় উড়ছিল দিঘির চুল। হালকা শ্যাম্পুর গন্ধ, দিঘির মিন্টের চিকলেটের সঙ্গে মিশে কোথায় যেন একটু বদলে দিচ্ছিল কলকাতাকে। কিগান নিজেকে ঘুরিয়ে নিতে চাইছিল। কিন্তু পারছিল না। দিঘি ডান হাতের সামান্য বাড়িয়ে রাখা নখ দিয়ে আঁকিবুকি কাটছিল কিগানের হাঁটুতে। কিগান নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, ‘কী উত্তর দেব?’
‘তুমি আমায় ভালবাসো না?’ দিঘি আঁকিবুকি কাটা থামিয়ে আলতো করে হাত রেখেছিল কিগানের হাতে।
‘আমি তো সবাইকেই ভালবাসি,’ কিগান স্বাভাবিক গলাতেই উত্তর দিয়েছিল।
‘আবার? আবার ভুলভাল, পাশ কাটানো কথা শুরু করেছ?’ দিঘি আলতো করে চিমটি কেটেছিল কিগানের পায়ে, ‘আর যদি বলো না এমন কথা, এমন রাম চিমটি দেব যে, বুঝতে পারবে!’
‘আরে।’ কিগান হেসে ব্যাপারটা লঘু করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, ‘আমি সত্যিই সবাইকে ভালবাসি।’
‘খুব ঘ্যাম হয়েছে, না? আমি হ্যাংলা? আমার কোনও সম্মান নেই? নিজের থেকে তোমার কাছে এসেছি বলে এত কথা শুনতে হবে?’ দিঘি হঠাৎ ছিটকে গিয়েছিল।
‘আরে!’ কিগান অবাক হয়ে তাকিয়েছিল দিঘির দিকে, ‘কী হল?’
‘তুমি, আমায় সত্যি করে বলো তো, আমায় তুমি ভালবাসো কি না? আই মিন প্রেম। বুঝেছ, প্রেম?’
কিগান চোয়াল শক্ত করে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। আকাশ থেকে রোদ সরে যাচ্ছিল ক্রমশ। বাইপাসের দু’পাশের দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছিল। ক্রমশ নিউ টাউনের দিকে বাঁক নিচ্ছিল গাড়ি। মাথার ওপর মাফলারের মতো পেঁচিয়ে যাচ্ছিল উড়ালপুল। কিগান না তাকালেও বুঝতে পারছিল দিঘি আবার সরে এসেছে ওর দিকে।
‘তুমি এমন কেন করছ দিঘি? এতে কার ভাল হবে?’ কিগান শেষ চেষ্টা করেছিল।
‘তুমি জানো আর্য বলে একটা ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছে আমার। জানো, ও আমায় প্রোপোজ করেছে?’
‘তাই?’ কিগান স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও ভেতরে কোথায় যেন আবার অদৃশ্য হাত এসে রুবিক্স কিউব মোচড়াতে শুরু করেছিল। প্রোপোজ? তা তো করতেই পারে। একটা অল্পবয়সি ছেলে, একটা অল্পবয়সি মেয়েকে প্রোপোজ করতেই পারে। স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু তবু কষ্ট হচ্ছিল কিগানের। কেমন যেন ভারী লাগছিল বুকের ভেতরটা। মনে হচ্ছিল কী হবে আর ওর কাজকম্ম করে? কীসের জন্য বেঁচে থাকবে? ভেতরে রাগও ঘুরপাক খাচ্ছিল একটা। মনে হচ্ছিল আর্য না অনার্য তাকে ধরে বেদম ঠেঙায়।
‘তাই না তো কি মিথ্যে?’ দিঘি রাগের গলায় বলেছিল, ‘ছেলেটা ভাল দেখতে। বিশাল বড়লোক। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। বুঝেছ?’
‘বুঝেছি,’ কিগান হাতের মুঠো শক্ত করে তাকিয়েছিল দিঘির দিকে।
‘তো? তুমি ভালবাসো আমায়? বুকের ভেতরটা জ্বলছে? হিংসে হচ্ছে?’
‘দিঘি, স্টপ ইট,’ কিগান আর নিতে পারছিল না।
‘কেন, স্টপ করব কেন? তোমাকে আজ বলতেই হবে। সেদিন ছাদে যখন চুমু খেয়েছিলাম সেদিন হোয়াই ডিড ইউ কিস মি ব্যাক?’
‘আমি…আমি…কী করব?’
দিঘি এবার মাথাটা নামিয়েছিল কিগানের কাঁধে, ‘এত ভয় কীসের? আমি তো তোমার।’
কিগানের কষ্ট হচ্ছিল গলার কাছে। মনে হচ্ছিল কোনও পাথর আটকে আছে। মনে হচ্ছিল কে যেন চাড় দিয়ে উপড়ে ফেলতে চাইছে সেই পাথর। কিগান আর পারেনি নিজেকে সামলাতে। আলতো করে জড়িয়ে ধরেছিল দিঘির হাত। বলেছিল, ‘আমার ভয় করে দিঘি। আমি যাকে ভালবাসি সেই আমায় ছেড়ে চলে যায়। বাবা, মা থেকে ঠাকুরমা, সবাই ছেড়ে গেছে আমায়।’
দিঘি বলেছিল, ‘দেখো ঠাকুরমার বয়স হয়েছিল। আর ছেড়ে যাওয়ার কথা বলছ? তোমার বাবা-মায়েরটা অ্যাক্সিডেন্ট। আর কলেজের প্রেম? দেখো, হয়তো তোমায় ভালই বাসেনি সেভাবে। আমি তোমার। বুঝেছ?’
দিঘি এরপর গাড়ি থামাতে বলেছিল। কিগান ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়েছিল দিঘির সঙ্গে। তারপর দিঘির দেখানো পথেই ওরা হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে বসেছিল দূরে এক উঁচু জল ট্যাঙ্কের গোড়ায়।
দিঘি কত কিছু বলে যাচ্ছিল। কত কথা যে জমা ছিল মেয়েটার! কখনও কিগানের হাতে হাত রেখে। কখনও ওর কাঁধে মাথা রেখে। তারপর ব্যাগের থেকে চকোলেট বের করে খেতে শুরু করেছিল। দু’-এক টুকরো জোর করে খাইয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করেছিল কিগানকে। কিগানের কেমন যেন হালকা মনে হচ্ছিল সব কিছু। মনে হচ্ছিল এমন সময় আর কোনওদিন আসেনি। সন্ধে তার চাদর বিছিয়ে দিচ্ছিল চরাচর জুড়ে। সোনার কাস্তের মতো চাঁদ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল আকাশে।
দিঘি চকোলেট খাওয়া শেষ করে হঠাৎ এসে দু’দিকে পা দিয়ে কিগানের কোলে বসেছিল মুখোমুখি। কিগান বাধা দেয়নি আর। দিঘি কিগানকে দু’হাতের মধ্যে জড়িয়ে ধরে খুব যত্ন করে ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছিল। কিগান জড়িয়ে ধরেছিল দিঘির কোমর। বুঝেছিল দিঘির চকোলেটটা ফ্রুট অ্যান্ড নাট।
সেই নিস্তব্ধ তারার সন্ধে, সেই নির্জন মাঠ, লম্বা জল ট্যাঙ্ক, সব উদগ্রীব হয়ে তাকিয়েছিল দু’জনের দিকে। ওরা দু’জন মুহূর্তের মধ্যে জমে গিয়েছিল, যেমন ভাবে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে অ্যাম্বারের মধ্যে জমে থাকে পতঙ্গ।
তারপর একসময় দিঘি ঠোঁট সরিয়ে তাকিয়েছিল কিগানের দিকে। অস্ফুটে বলেছিল, ‘কিছু বলো আমায়। এমন কিছু যা তুমি কোনওদিন কাউকে বলোনি। আর কাউকে বলবেও না।’
কিগান স্থির হয়ে তাকিয়েছিল দিঘির দিকে। হেমন্তের নিস্তব্ধ আবছায়ায় দিঘির চোখ দুটো আটকে ধরেছিল ওকে। পাবলো নেরুদার সেই কবিতা কিগান অস্ফুটে বলেছিল, ‘Don’t go far off, not even for a day, because-/ because-I don’t know how to say it: a day is long/ and I will be waiting for you, as in an empty station/ when the trains are parked off somewhere else, asleep.’
জলের ট্যাঙ্কিটা বেশ উঁচু। সন্ধে হয়ে আসছে আজও। আজও সোনার কাস্তের মতো চাঁদ উঁকি মারছে আকাশে। শুধু ছোট টুনি বাল্বগুলো নামিয়ে আনা হচ্ছে জল ট্যাঙ্কি থেকে। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাদিবস ছিল দু’দিন আগে। সেটা শেষ হয়েছে। এবার অলংকার খুলে নেওয়ার পালা।
কিগানের সব মনে আছে। ও আপনমনে হাসল একটু। Don’t go far off, not even for a day.
‘স্যার,’ শশীবাবু কখন এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।
‘বলুন,’ কিগান শশীবাবুর দিকে তাকাল।
‘গৌরসাহেব আর শ্যামসাহেব আপনাকে মোবাইলে পাচ্ছেন না বলে আমায় ফোন করেছিলেন। আপনি কিছুক্ষণ পর একটু কল করে নেবেন প্লিজ।’
‘ও, ঠিক আছে।’ কিগান আর দাঁড়াল না। নিজের অফিসের দিকে হাঁটতে লাগল।
মোবাইলের চার্জ ফুরিয়ে গেছে বলে সুইচ অফ করে মোবাইলটা চার্জে বসিয়েছে কিগান। তাই গৌর পায়নি। আসলে ওদের ড্রায়ারটা গন্ডগোল করছে। সেটা দেখতেই এতক্ষণ ফ্যাক্টরির মেনটেন্যান্স-এর লোকদের সঙ্গে ড্রায়ারের ওখানে গিয়েছিল কিগান। ওর এয়ার রিসিভার ট্যাঙ্কে কীসব সমস্যা আছে। মেনটেন্যান্স-এর লোকজন কাজ শুরু করে দিয়েছে। সমস্যা জটিল নয়। সারাই হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি।
কিগানের আজ শরীরটা ভাল নেই। ঘাড়ে ব্যথা হচ্ছে। এবার এত গরম পড়েছে যে, রাতে ঘুম আসছে না। তার ওপর প্রোডাকশনের চাপ আছে খুব। ফলে টেনশন থেকেই যায়। সব মিলিয়ে শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। তার ওপর ওদের নতুন ওই ফ্রুট জুস আর মিনারেল ওয়াটারের সেগমেন্টটা খোলা নিয়েও চাপ যাচ্ছে। গৌর আর দেরি করতে চায় না। এতদিন ম্যানেজমেন্ট হচ্ছে-হবে করে সময় কাটাচ্ছিল। কিন্তু এবার তারা নড়েচড়ে বসেছে। আর সময় নষ্ট করতে রাজি নয়। গৌর বলেছে অ্যাভেলেবেল ল্যান্ডে কাজ শুরু হবে। আর তারপর ঠিক দরকারমতো বাকিটা নিয়ে তাতেও কনস্ট্রাকশন হবে।
জমিটা নিয়ে রাঘব চক্রবর্তীর স্ট্যান্ড খুব পরিষ্কার। আমার জমি, আমি দেব না। যতটা বিক্রি করার করেছি। আর না। তবে অন্য কেউ হলে মার্চেন্ট মাল্টিপল্স-এর পক্ষে তার হাত থেকে জমি আদায় করা অসুবিধে হত না। কিন্তু রাঘব চক্রবর্তী তো আর এলেবেলে কেউ নন। তাঁরও অনেক অদৃশ্য হাত আছে। ফলে তাঁকে সহজ পথে কাবু করা যাবে না। বরং তাঁর ঘর থেকে মাল সরাতে হলে সিঁদ কাটতে হবে। সেই কাজটাই এখন করার চেষ্টা করছে আদি। যদিও সেটা খুব একটা ভাল লাগছে না কিগানের। কিন্তু যেখানে গৌর ভরসা দিচ্ছে সেখানে ও আর কী করে। তবে এই নতুন কাজটা নিয়ে অন্য একটা ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয়েছে কিগানকে। ওয়াটার বার্ডসের থেকে একজন এসেছিল ওর সঙ্গে গোপনে দেখা করার জন্য।
ঘটনাটা গত রবিবারের। দুপুরবেলা ল্যাপটপ নিয়ে সিনেমা দেখতে বসেছিল কিগান। একটা ফরাসি সিনেমা। খুব অন্যরকম। বেশ মন দিয়েই দেখছিল কিগান। হঠাৎ ডোরবেলের শব্দ শোনে ও। আগে ডোরবেল ছিল না ওর। সবে লাগিয়েছে, ফলে এখনও ঠিক শব্দটার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি। তাই ওর ঘরেই যে বেল বাজছে সেটা বুঝতে একটু সময় লেগেছিল ওর। সিনেমাটা পজ করে ও উঠে গিয়েছিল। ওর টুকটাক কাজ করে দেয় বুধিয়া নামের যে-ছেলেটা সে দেশে গিয়েছে এখন।
দরজা খুলতেই সাদা হাফ শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরা একজনকে দেখেছিল কিগান। ভদ্রলোকের বয়স বছর পঞ্চাশ। মাঝারি উচ্চতা। গা দিয়ে খুব সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে। ভদ্রলোকের মুখে ভীষণ ভালমানুষ ভালমানুষ ছাপ। কে লোকটা? জীবনে প্রথমবার দেখছে লোকটাকে। কিগান চিনতে পারেনি। ও অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ভদ্রলোকটির দিকে।
‘আপনি মিস্টার ব্যানার্জি তো?’ ভদ্রলোকের গলার স্বরটাও খুব সুন্দর, ‘আমিও ব্যানার্জি, শাণ্ডিল্য। পি কে ব্যানার্জি। ভেতরে আসতে পারি?’
‘ভেতরে?’ কিগান অপ্রস্তুত হয়েছিল। লোকটা এত হাসিখুশি আর অমায়িক যে, নিজেরই অস্বস্তি লাগছিল ওর। এমন অচেনা একটা লোক যদি দু’হাজার বছর ধরে চেনে ধরনের ব্যবহার করে, তা হলে কি অবাক লাগবে না?
‘আসুন,’ কিগান সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে হেসে সরে দাঁড়িয়েছিল।
ভদ্রলোক হেসে দরজায় দাঁড়িয়েই ঘরটা দেখে নিয়েছিল একঝলক। তারপর পায়ের স্লিপ-ইন ধরনের শু-টা খুলে রেখে ঘরে ঢুকেছিল। বলেছিল, ‘আপনি বেশ গোছগাছ করে থাকেন তো! যতদূর জানি বিয়ে করেননি। তবু এত ফিটফাট, অবাক লাগছে!’
আসলে এই নয় যে কিগান খুব গোছগাছ করতে পারে। তবে রবিবার সকালটায় ছুটি থাকে বলে নিজের বাড়িঘর নিজেই পরিচ্ছন্ন রাখে।
ঘরে খাট, দুটো ক্যাম্প চেয়ার, আলমারি আর একটা টেবিল। এ ছাড়া বিশেষ কিছু নেই। ভদ্রলোক গিয়ে একটা ক্যাম্প চেয়ারে বসেছিল, ‘ওঃ, ভীষণ গরম এদিকে। একদম রোস্ট হয়ে গেছি গাড়ি থেকে নেমে আপনার এখানে আসতে গিয়ে। গাড়ির ভেতরটা এসি বলে রক্ষে। কী করে এই মাইক্রোওয়েভে থাকেন মশাই? তারপরও এমন সোনার বরণ ধরে রেখেছেন কী করে?’
কিগান কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না ভদ্রলোক কে! এমন হঠাৎ করে এসে, ঘরে ঢুকে গ্যাঁট হয়ে চেয়ারে বসেছে কেন লোকটা? কিন্তু স্বভাবগত ভদ্রতায় লোকটাকে জিজ্ঞেসও করতে পারছিল না কিগান।
‘আচ্ছা!’ ভদ্রলোক হেসেছিল, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, ডোন্ট মাইন্ড। আপনি বিয়ে করবেন না? মানে, কিছু মনে করলেন না তো?’
কিগান ঢোক গিলে তাকিয়েছিল। এ ঘটক নাকি? এসি গাড়ি চড়া ঘটক আগে কোনওদিন দেখেনি কিগান। এ যদি ঘটক হয়, তবে একটা ইউনিক এক্সপিরিয়েন্স হবে। তবে কিগান বুঝতে পারছিল না, এ ঘটক হলে হঠাৎ ওর কথা জানল কী করে!
‘আমার পুরো নাম পুলককুমার ব্যানার্জি। আমার এক শালি আছে। সুন্দরী, গান জানে, ভাল চাকরি করে জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ায়। মুখার্জি ওরা। একদম পাল্টি ঘর। কী বুঝলেন?’
এ শিয়োর ঘটক। এখন হাইটেক যুগ। তাই নিশ্চয়ই কোনও বিবাহবন্ধনী থেকে এসেছে। এখনকার দিনে খবরাখবর পাওয়া খুব সোজা। ওরাও হয়তো কিগানের খবর জোগাড় করে এসেছে বিয়ের ঘটকালি করতে।
কিগান মৃদু হেসে বলেছিল, ‘কিছু মনে করবেন না, আসলে আমার এখন বিয়ের কোনও ইচ্ছে নেই। তাই, প্লিজ আমাকে আর এসব বলবেন না।’
‘সে কী! বিয়ে করবেন না কেন? আপনার বাড়ির বড়রা কেউ…’
‘মা-বাবা আগেই মারা গেছেন, ঠাকুরমা ছিলেন, কিন্তু তিনিও গত হয়েছেন।’
‘ঠাকুরমাও নেই? সো স্যাড! কী হয়েছিল?’ পুলক খুব গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করল।
‘বয়স হয়েছিল, হার্ট অ্যাটাকে সব শেষ,’ কিগান সহজ গলায় বলেছিল। ওর বিরক্ত লাগছিল এবার। আচ্ছা মানুষ তো! কে তার ঠিক নেই, উড়ে এসে জুড়ে বসে ক্যুইজ শুরু করেছে!
‘সো সরি,’ পুলক মাথা নেড়ে শোক পালনের মতো মুখ করে বসেছিল।
‘দেখুন, আপনাকে ঠিক চিনলাম না। মানে… আপনি…,’ কিগান ইতস্তত করেছিল।
‘আমি কে আমি বলিনি?’ ভদ্রলোকের যেন ঘুম ভেঙেছিল।
‘না, বলেছেন। কিন্তু আপনি কী জন্য এসেছেন, সেটা বলেননি।’
‘না, আমি বলিনি আমি কে! শুধু নাম বলেছি, তাতে কি আর বলা হয় কে আমি! আমি পুলককুমার ব্যানার্জি, সেল্স ম্যানেজার, ওয়াটার বার্ডস।’
‘ও,’ কিগান এবার বুঝেছিল, ‘কিন্তু আজ সানডে, ফ্যাক্টরি প্র্যাক্টিক্যালি বন্ধ। তা আপনাদের লোক তো এসে ডিটেল নিয়ে গেছে। আপনার আজকে আসার কারণ?’
‘তা নিয়ে গেছে। তারাই বলেছে আপনার কথা। আপনি খুব ডায়নামিক, এনার্জেটিক। তাই ভাবলাম আপনি বুঝবেন। সেই জন্য আপনার সঙ্গে একান্তে দু’-একটা কথা বলার ছিল।’
‘একান্তে?’ এই প্রথম ভুরু কুঁচকেছিল কিগানের। কী বলতে চায় লোকটা?
‘আপনি মিস্টার দিওয়ানের খুব কাছের একজন। এমনকী, কাজটার টেন্ডার কমিটিতেও আপনাকে রেখেছেন মিস্টার দিওয়ান। তাই ভাবলাম আপনাকে বলি। দেখুন মিস্টার ব্যানার্জি, যেসব পার্টিরা রয়েছে, তারা সবাই এক জিনিস কোট করবে। আপনাদের কনসালট্যান্ট তো সবাইকে মেটিরিয়াল ওয়াইজ এক প্ল্যাটফর্মে এনে দিয়েছে। কিন্তু সেই মেটিরিয়াল তো বাজারেই পাওয়া যায়। সবাই মেক দেখে কিনবে আর সাপ্লাই দেবে। কেউ প্রফিট কম রাখবে ফাইভ পারসেন্ট কেউ আবার টেন পারসেন্ট। কম প্রাইস যার তাকে আপনারা চোখ বুজে কাজ দেবেন। তাই তো? কিন্তু সব দেখার পরও যে, এক্স ফ্যাক্টরটা থাকে সেটা আপনারা দেখবেন না?’
‘মানে?’ কিগান অবাক হয়েছিল।
‘আরে ওয়র্কম্যানশিপ। কাজটা কীভাবে করা হবে। সেটা দেখবেন? সেটা দেখেন? না। কারণ, সেটা কিছুতেই দেখা সম্ভব হয় না। যদি ওয়র্কম্যানশিপ খারাপ হয় তবে প্রোজেক্ট কতটা ডিলেড হবে বোঝেন তো? এমনিতেই আপনাদের এত ডিলেড প্রোজেক্ট! কস্ট বেড়ে গেছে নিশ্চয়ই! তার ওপর যদি সাপ্লায়ার ঝোলায়, তবে কোথায় গিয়ে ঠেকবেন বুঝেছেন? তাই বলছি ওয়র্কম্যানশিপটাই কিন্তু আসল। এটা মাথায় রাখবেন।’
কিগান হেসেছিল, ‘সেই জন্য গত চার বছরে আপনাদের ছ’টা বড় বড় প্রোজেক্ট এখনও শেষ হয়নি। জাস্ট সবক’টা হয় হাফ ডান, নয়তো লিটিগেশনে ঝুলে আছে। ওয়র্কম্যানশিপ আপনাদের ভাল হলে এমন হত?’
পুলক একটুও অপ্রতিভ হয়নি। বরং হেসে বলেছিল, ‘সমস্যা সব কাজেই থাকে। দেড়শো কোটি টাকার দুটো প্রোজেক্ট যে দারুণ শেষ করলাম সেটা তো বললেন না! আর হাফ ডান জবের কথা বললেন তো, কিছু মনে করবেন না, আপনাদের দু’-একটা প্রোজেক্টও যে অবস্থায় আছে…’
‘দেখুন, আপনি এত সব কেন বলছেন? আমাদের কোম্পানি পলিসি নিয়ে তো অন্যের মাথাব্যথা না থাকলেও চলবে।’
‘আরে চটছেন কেন?’ পুলক হেসেছিল, ‘আমি চাই না আপনাদের এই কাজটায় এমন হোক। বরং যাতে না হয় তার জন্য আমাদের তরফ থেকে একটা অফার আছে। খুব সহজ, সাধারণ একটা অফার।’
‘মানে?’ কিগানের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল।
‘দেখুন, পুরো কাজটা প্রায় দশ-বারো কোটি টাকার। আমরা সবাই কোটেশন জমা দেব উইথ প্রাইস। আপনারা সেটা বিহাইন্ড ক্লোজড ডোর দেখবেন, তারপর আমাদের কাছে রিবেট চাইবেন। মানে কে কত ডিসকাউন্ট দিচ্ছে সেটা জানতে চাইবেন। সেটাও আমরা আপনাদের জমা দেব। তারপর আপনারা সেই মূল প্রাইস থেকে ডিসকাউন্ট বাদ দিয়ে দেখবেন কে লোয়েস্ট দাম দিয়েছে। তাই তো?’
‘হ্যাঁ। তাই।’ কিগান বলেছিল। আসলে এটাই ওদের ওয়ার্কিং পলিসি।
‘আপনি জাস্ট আমাদের বলে দেবেন অন্যান্যরা কত ডিসকাউন্ট দিয়েছে। আমরা সেইমতো আমাদেরটা অ্যাডজাস্ট করে আপনাকে দিয়ে দেব। আপনি সেইমতো অনভলপটা চেঞ্জ করে দেবেন। রাজারহাটে সাউথ ফেসিং টু বেডরুম একটা ফ্ল্যাট আপনার। কেমন?’
‘আরে কিগানভাই, তোমাকেই খুঁজছিলাম!’ সিকিউরিটি অফিসের সামনে থেকে ডাক দিল গুরুং।
‘আমায়? কেন ক্যাপ্টেন?’
‘তোমায় ফোনে না পেয়ে ওই আবেশ ছেলেটি ফোন করেছিল আমায়। তোমায় খুঁজছিল,’ গুরুং সিকিউরিটি অফিস থেকে এগিয়ে এল ওর দিকে।
‘আমায়? কেন?’ অবাক হল কিগান, ‘কিছু বলেছে ও?’
‘না, তা তো বলেনি,’ গুরুং বলল, ‘আর একজন এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে।’
‘আমার সঙ্গে? কে?’ কিগানের বিরক্ত লাগল। আবার কোনও কোম্পানির লোক নয় তো?
‘তা জানি না। বলেছে যে, আবার পনেরো-কুড়ি মিনিট পরে আসবে। দেখা করা খুব জরুরি। কালকেই ভদ্রলোক সিকিম ফিরে যাবেন।’
‘সিকিম? সেখান থেকে আমার সঙ্গে দেখা করতে কে এল আবার?’ অবাক হয়ে গুরুংয়ের দিকে তাকাল কিগান, ‘ঠিক আছে ক্যাপ্টেন। আসলে একটু তোমার ঘরে বসিয়ো। আমায় বসকে ফোন করতে হবে একবার। ফোনটা সেরে আমি আসছি। কেমন?’
‘আর আবেশ যদি ফোন করে আবার? তখন কী বলব আমি?’
‘বলবে যেন রাতে আমায় ফোন করে নেয়। এখন আমি ব্যস্ত আছি।’
এবার অফিসের দিকে হাঁটা দিল কিগান। অনেকক্ষণ হয়েছে গৌর ফোন করেছিল। তবে আবেশ কেন ফোন করল সেটা নিয়ে খচখচ করছে মনটা। ব্যাটা এমন এমন সব কাণ্ড করে মাঝে মাঝে যে, অস্বস্তি হয় ওর। এই তো কিছুদিন আগেই যা করেছিল!
ছুটি ছিল সেদিন। দুপুরের দিকে রাহির থেকে আনা দুটো ডিভিডি ফেরত দেওয়ার জন্য ওদের বাড়িতে গিয়ে রীতিমতো চমকে গিয়েছিল কিগান। রাহিদের বসার ঘরে একা বসে ছিল দিঘি!
মানুষ যা চায়, তা প্রায় কখনওই হয় না। আর তারপর না হতে হতে, মানুষ যখন ভাবে, থাক হওয়ার দরকার নেই, ঠিক তখনই কোত্থেকে যেন সব হতে শুরু করে। জীবনের মতো বড় ম্যাজিশিয়ান আর কোনওদিন দেখেনি কিগান। সে এমন সময় ঝোলা থেকে বেড়াল বের করবে যে, মানুষ তার থই পাবে না।
রাহিদের বসার ঘরে ঢুকে তাই থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল কিগান। এত সামনে দিঘি! এত কাছে!
দিঘিও কয়েক সেকেন্ডের জন্য অবাক হয়ে তাকিয়েছিল কিগানের দিকে। তারপর যেন পূর্বজন্মের স্মৃতি ফিরে এসেছে, এমন মুখ করে ভুরু কুঁচকে চোয়াল শক্ত করে নিয়েছিল। আর ঠিক সেই সময়ই ভেতর থেকে এসেছিল আবেশ। বলেছিল, ‘আরে কিগানদা, তুমি একটু বোসো। তোমায় রাহি দেখেছে ভেতর থেকে। বলল বসতে। আসলে আমি দু’-একটা হিসেবের জিনিস দেখানোর জন্য এইমাত্র এসেছি। মার্চের এন্ডে অডিট আছে তো! আমি দেখে নিই, তারপর আসছি। বাই দ্য ওয়ে, ওর সঙ্গে আলাপ আছে তো?’ আবেশ দিঘিকে দেখিয়ে প্রশ্ন করেছিল।
কিগান কিছু বলার আগেই দিঘি বলেছিল, ‘না নেই। একে আমি চিনি না।’
‘আরে তোমার জামাইবাবুকে সেদিন কোলে তুলে এনেছিল। মনে নেই?’
‘ও,’ দিঘি ছোট্ট করে মাথা নেড়ে ঘরের কোনায় রাখা টিভির দিকে মুখ ফিরিয়েছিল।
আবেশ তাও থামেনি, ‘কিগানদা হেভি লোক। ব্যাপক গিটার বাজায়, মাউথঅর্গান বাজায়, শুনে দেখবে। দারুণ লাগবে তোমার। তা তোমরা গল্প করো। আমরা আসছি এক্ষুনি।’
আবেশ চলে যেতে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল কিগান। অবস্থাটা একদম ঘেঁটে দিয়েছিল ছেলেটা। দিঘির সামনে এত কথা বলার দরকার ছিল কি?
কিন্তু ভাবতে ভাবতেই আবার ফিরে এসেছিল আবেশ। বলেছিল, ‘আচ্ছা দিঘি, তুমি না সুকিয়া স্ট্রিটে থাকো? আরে কিগানদাও থাকত। আমি যেতাম একসময়।’
কিগানের মনে হচ্ছিল ধাক্কা মেরে আবেশকে বের করে দেয় ঘর থেকে। ও বলেছিল, ‘যাবি তুই ভেতরে?’
‘যা বাবা! আমার ওপর খচে যাচ্ছ কেন? আচ্ছা, আমি আসছি।’
এসি-র ঠান্ডাতে কেমন যেন কান নাক গরম হয়ে যাচ্ছিল কিগানের। বসে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছিল খুব। কিন্তু উঠে যেতেও পারছিল না।
‘হাতে ওই দুটো কী তোমার?’ দিঘিই প্রথম জানতে চেয়েছিল।
‘ডিভিডি,’ কিগান অস্ফুটে বলেছিল।
‘এখনও সিনেমা গেলো!’
সেই এক গলা! এক ঝাঁঝ! এক রকম শাসনের ভঙ্গি।
‘তা, মানে ওই আর কী!’ কিগানের মনে হচ্ছিল যে, কথা নয়, ও পাহাড় ঠেলছে।
‘তা সেদিন শমীদাকে নামিয়ে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলে কেন?’
‘আমি? মানে…’ অন্ধকার ঘরে কালো বিড়াল ধরার মতো কথা খুঁজছিল কিগান।
‘সবসময় পালায়। ভিতু, হেরো,’ দিঘি ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠছিল, ‘সেদিন পুজোয় দেখে এমন ভাব করল যেন বাঘ দেখেছে!’
কিগান উঠে পড়েছিল। আর বসার মানে হয় না। দিঘি কি ভুলে গেছে কেন চলে এসেছে কিগান?
‘আবার পালাচ্ছে!’ দিঘি রাগী গলায় বলেছিল।
কিগান ঘুরে দাঁড়িয়েছিল এবার। বলেছিল, ‘হ্যাঁ, চলে যাচ্ছি। তুমি বোসো। রেস্ট করো।’
‘কেন?’ দিঘির রাগ উধাও হয়ে হালকা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল গলায়। নাকি সবটাই মনের ভুল ছিল কিগানের?
‘কী কেন?’ রাহি এসে ঢুকেছিল ঘরে, ‘বাইরে থেকে শুনছি দিঘি কীসব বলছে!’
‘না, কিছু না তো,’ দিঘি ব্যাগ খুলে চকোলেট-বার বের করেছিল।
‘তবে?’ রাহির ভুরু কুঁচকে ছিল তাও।
‘কিছু না। এই দুটো ডিভিডি রাখো। আমার কাজ আছে। আমি আসছি,’ কিগান আর কাউকে কোনও কথা বলতে দেয়নি। বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে। শুধু বেরিয়ে আসার আগে দেখেছিল দিঘি চকোলেটের টুকরো ভাঙছে। কোকোর মধ্যে দিয়ে উঁকি মারছে শুকনো ফল আর বাদাম। ফ্রুট অ্যান্ড নাট।
‘ওয়ান্ট টু হ্যাভ সাম?’ দিঘি তবু পিছন থেকে ডেকেছিল।
কিগান দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলেছিল, ‘আমি ফ্রুট অ্যান্ড নাট চকোলেট খাই না।’
‘আরে কিগানভাই,’ গুরুং প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে এসে অফিসে ঢোকার মুখটায় ধরল কিগানকে।
‘আরে ক্যাপ্টেন! তুমি আবার?’
‘কী করব? লোকটা দশ মিনিটেই ফিরে এসেছে। খুব তাড়া দিচ্ছে।’
‘মানে?’ অবাক হল কিগান, ‘তাড়া দিচ্ছে কেন? ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছে নাকি? বললাম না ওয়েট করতে।’
গুরুং কাঁচুমাচু গলায় বলল, ‘আরে পাহাড় থেকে এসেছে। ভাল মানুষ। একবার চট করে দেখা করে নাও না।’
‘ক্যাপ্টেন! তুমি না!’ কিগান রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলল, ‘চলো।’
সিকিউরিটি অফিসের সামনে আলো জ্বলছে। এগুলো নতুন লাগানো মার্কারি ভেপার। পুরো জায়গাটাই যেন থইথই করছে আলোয়। আর ভেতরে দাঁড়িয়ে রয়েছে লোকটা। সামান্য বেঁটে। মোটা। পাহাড়ি গড়ন। এ কে? কেন এসেছে কিগানের কাছে? কিগান কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। ভদ্রলোকের চেহারার মধ্যে একটা ভালমানুষ ভালমানুষ ভাব আছে। পকেটে হাত দিয়ে ভদ্রলোক এদিক ওদিক দেখছে।
কিগান গিয়ে সামনে দাঁড়াল। বলল, ‘নমস্কার। আমি কিগান। আপনি আমায় খুঁজছেন?’
ভদ্রলোক হাসল। দেখেই বোঝা গেল যে, আনন্দ হয়েছে ওর।
‘বলুন, আমি কী করতে পারি আপনার জন্য?’
‘অনেক কিছু। অনেক কিছু করতে পারেন। তবে সবচেয়ে আগে দশ মিনিট সময় যদি দেন।’
‘দশ মিনিট?’ কিগান হাসল, একটা জীবন এমনি এমনি কাটিয়ে দিল ও আর একজন মাত্র দশটা মিনিট চাইছে? ও বলল, ‘দিলাম। এবার বলুন, মাত্র দশ মিনিটে কীসের কথা বলবেন আপনি?’
ভদ্রলোক হাসল, বলল, ‘জীবন বদলানোর কথা বলব। নতুন জীবনের কথা বলব। আপনি শুধু একটু মন দিয়ে শুনুন আমার কথা। কেমন?’