২৮
আবেশ বলল, ‘তুমি এত দেরি করছ কেন? এখনও মাথা শান্ত করে বলতে পারলে না? কী আশ্চর্য! তাড়াতাড়ি বলো।’
জামরুল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। এদিকটায় বেশ ছায়া। মার্চের প্রচণ্ড গরম আর যেখানেই হোক, কিছুতেই বিশেষ সুবিধে করতে পারে না এই বাগানটায়। জামরুল গাছের পাশেই ইয়া মোটা একটা কাঁঠাল গাছ। তার তলায় সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো একটা বেদি রয়েছে। এতক্ষণ সেখানেই বসেছিল রাহিরা। এবার এসে দাঁড়িয়েছে জামরুল গাছের নীচে।
বাগানটা অনেক শখ করে বানিয়েছিল বাবা। ফুলের চেয়ে বাবার বেশি উৎসাহ ফলের বাগানের প্রতি। ছোট থেকেই দেখে আসছে রাহি। বাবা সৌন্দর্যের চেয়ে উপযোগিতাকে গুরুত্ব দেয় বেশি। মা আবার উলটো। ফুল ফুল করে একসময় পাগল ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফলের থেকে বাবা আর ফুলের থেকে মা, দু’জনেই সরে গেছে অনেকটা। বাবা তার কাজকর্ম নিয়ে আর মা সংসার নিয়ে খুব ব্যস্ত। আর বাবা-মায়ের শখ এখন এসে পড়েছে সাধুদার ঘাড়ে।
আজ রবিবার। স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। তাই ছুটির দিন হলেও খাতা দেখার চাপ আছে রাহির। সারা সকাল খাতা দেখেছে বসে। সিক্সের হিস্ট্রি খাতা। তারপর এই বারোটা নাগাদ এসে একটা গল্পের বই নিয়ে বসেছিল কাঁঠাল গাছটার গোড়ায়। তার কিছু পরেই এসেছে আবেশ।
আজ ‘হেল্প আর্থ’-ও বন্ধ। আসলে এখন কাজকর্ম একটু কমের দিকে। এই গোটা অঞ্চলটাতেই এখন একটা ভোট ভোট হাওয়া। তাই সুধাদি বলেছে, চমকও বলেছে একটু চুপচাপ থাকতে। তবে বস্তি অঞ্চলের স্যানিটেশনের ব্যাপারটা নিয়ে সুধাদি বলেছিল যে, পার্টির সহযোগিতায় কাজ করতে। কিন্তু হোমি আর রাহি রাজি হয়নি। বাবাও বারণ করেছিল। হেল্প আর্থ-কে একটা রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে দেওয়া নিয়ে আপত্তি আছে ওদের। আর ত্রয়ণও বিরোধিতা করেছিল। বলেছিল যে, রাজনৈতিকভাবে এক্সপ্লয়েটেড হওয়ার কোনও মানেই হয় না। এক্সপ্লয়েটেশন পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণ্য কাজ।
বড় বড় কথা বলা ত্রয়ণের যেন জন্মগত স্বভাব। একটা মানুষ সবসময় এমন মুখোশ পরে থাকে কী করে? সবার সামনে ভদ্র আর ভালর উদাহরণ, আর যেই রাহির সঙ্গে একা থাকে অমনি ভেতরের জন্তুটা দাঁত-নখ বের করে। কতদিন, জানে না, কতদিন আর এসব সহ্য করতে হবে রাহিকে! আর দিনকে দিন যেন সমস্যা বাড়ছে। গতকালই তো ত্রয়ণ ভয়ংকর কথা বলে গিয়েছে। মাঝে মাঝে রাহির মনে হয় ও যেন ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছে জালে। যেন সব চেপে বসছে ওর চারদিকে। এর থেকে যেন বেরোতে পারছে না ও।
‘কী হল?’ আবেশ কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল। ভঙ্গিটাই বলে দিচ্ছে যে, ও উদগ্রীব।
‘শোনো আবেশ, তুমি যেটা বলছ সেটা কিন্তু খুব সহজ নয়।’
‘সহজ নয়? কেন?’ আবেশ অবাক হল, ‘তোমার জিনিস, তুমি যাকে খুশি দেবে, এতে প্রবলেমটা কী? আর জানোই তো, নানারকম শকুনের দৃষ্টি আছে ওটার ওপর।’
চোয়াল শক্ত করল রাহি। কথার ভেতর কথা লুকিয়ে থাকে। ‘শকুন’ বলতে কী মানে করছে আবেশ তা খুলে না বললেও রাহির কাছে কিন্তু স্পষ্ট। নিশ্চয়ই সেই সন্ধেবেলায় আবেশ কিছু শুনেছিল। বা আরও স্পষ্ট করে বললে, বুঝেছিল। না হলে ও এমন প্রস্তাব দিতই না। সেদিন আবেশ যখন প্রথমে অমন একটা কথা বলেছিল, রাহি সত্যি বলতে কী, খুব আশ্চর্য হয়েছিল।
আবেশ বলেছিল, ‘টাকা লাগবে কিছু। আমার চেনাশুনো ছেলেপিলে আছে কিছু। তাদের হাজার বিশেক টাকা দিলেই এই ত্রয়ণের বাঁদরামো সব ঠিক হয়ে যাবে। ও যে তোমায় বিরক্ত করে, আমি জানি। আর তোমায় দেখে বুঝি যে, সেটার লেভেলটাও খুব হাই। তাই তুমি বললে মালটাকে উচিত শিক্ষা দিতে পারি।’
‘না, না,’ রাহি ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আবেশ কতটা জানে সেটার সম্বন্ধে ওকে জিজ্ঞেস করতে বেশ ভয় লাগছিল। মনে হচ্ছিল এসব প্রসঙ্গ যাতে না ওঠে। কিন্তু আবেশকে কোনওদিনই ও কর্মচারী হিসেবে দেখেনি। চিরকাল বন্ধুর মতো ব্যবহার করেছে। সেটাই হয়তো ভুল হয়েছে, মনে হয়েছিল রাহির। এমন কেন যে বলছে ছেলেটা! ত্রয়ণ সম্পর্কে কেউ ঘাঁটাঘাঁটি না করলেই ভাল। যদিও রাহি ভাবে, ঘটনাটা যদি কাউকে বলা যেত তবে খুব ভাল হত। কিন্তু বলবে কাকে? বাবা-মাকে বলা সম্ভব নয়। ত্রয়ণের কাজিন হল দীপা। ওকেও বলা যাবে না। তবে কি হোমি? কিন্তু সেটা আরও ভয়ংকর হবে। তবে? তবে? মাঝে মাঝে মাথা খারাপ লাগে রাহির। কষ্ট হয়। মনে হয় বুকের ভেতর এক দঙ্গল পাগলা হাতি ঢুকে পড়েছে। ত্রয়ণের সামনে আর কতদিন ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে ওকে? তবু আবেশ যা বলেছিল তাতে সায় দিতে পারেনি ও। কারণ, ত্রয়ণকে মারার থাকলে চমককে বললেই হয়।
‘তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? ত্রয়ণ একটা জানোয়ার। নরকের কীট। ওর চরম শাস্তি হওয়া উচিত।’
আবেশকে অমন রাগ করতে কোনওদিন দেখেনি রাহি। ও বলেছিল, ‘বাদ দাও। ওসব ভেবো না।’
আবেশ স্থির হয়ে তাকিয়েছিল রাহির দিকে। তারপর বলেছিল, ‘ত্রয়ণ তো জমিটা বাগাতে চায়, না?’
‘জ-জমি?’ রাহির অবাক হওয়া ক্রমশ বাড়ছিল।
‘ধরো, এমন কিছু হল যে, জমিটা ওর হাত হয়ে মার্চেন্টদের কাছে না গিয়ে তুমি সরাসরি দিলে মার্চেন্টদের? তবে?’
‘কিন্তু জমিটা তো…মানে…’ রাহি তোতলাচ্ছিল।
‘শোনো, আমি জানি, জমিটা তোমার নামে আছে। অর্থাৎ ওটা তোমার জমি। আর এটাও জানি, ত্রয়ণ সেটা তোমার থেকে নিয়ে মার্চেন্টদের দিয়ে দালালি খাবে। তার আগে তুমি যদি সেটা মার্চেন্টদের দিয়ে দাও। তবে ত্রয়ণের থোঁতা মুখ ভোঁতা হবে।’
‘কিন্তু…’ রাহি চুপ করে ছিল। কী বলবে ও? কী বলতে পারে? ত্রয়ণ যখন জানবে তখন যদি ও সব ফাঁস করে দেয়? তবে? তখন কে বাঁচাবে?
‘শোনো, শুধু টাকা নয়, আমরা আরও কিছু চাইব। সেটা হলে কাকুকে, মানে তোমার বাবাকে কনভিন্স করতে অনেক সুবিধে হবে।’
‘আরও কিছু মানে?’ রাহি এই প্রথম আগ্রহী হয়েছিল।
‘মানে, টুর্নামেন্ট। আমরা বলব যে, মার্চেন্টরা যেন ‘হেল্প আর্থ’-এর সঙ্গে জয়েন্টলি একটা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট করে। নামকরা প্লেয়ারদের নিয়ে। আমি এমন একটা টুর্নামেন্ট আগেই কন্ডাক্ট করেছি। এতে ‘হেল্প আর্থ’-এর যে কতটা প্রচার হবে, ভাবতে পারবে না। শোনো রাহি, একটা প্রদর্শনী ম্যাচ করে আর কত টাকা তুলবে? নামকরা প্লেয়ারদের নিয়ে, সামনে একটা নোবেল কজ রেখে যদি টুর্নামেন্ট করতে পারো, তবে দেখবে বাকি জীবনটা আর আমাদের পিছনে ঘুরে তাকাতে হবে না। আর জমিটারও দাম দেবে একটা। জমি ফালতু পড়ে থেকে কী লাভ হচ্ছে বলো? ফ্যাক্টরি হলে স্থানীয় কত লোক কাজ পাবে বলো? আর ত্রয়ণও জোর করতে পারবে না। একটু বাবাকে বোঝাও যে, ইগো আর রাগ ধরে না বসে থেকে এই সুযোগে মানুষের চোখে নিজেদের ভাবমূর্তিটা আরও উজ্জ্বল করে নিতে হবে।’
গোটা ব্যাপারটা যতটা সহজ মনে হচ্ছে আসলে অতটা নয়। এটা বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারছিল রাহি। জমিটা রাহির নামে হলেও, সেটা শুধু নামেই। বাবার ইচ্ছেতেই আসলে সব হবে। আসলে জমি নিয়ে ওর কোনও আগ্রহ নেই। সত্যি, বাবা কেন যে ওই জমিটা দেবে না, সেটা বুঝতে পারছে না ও। ইগো এত বেশি কেন হয় মানুষের? ফ্যাক্টরি হলে তো সত্যিই লোকের চাকরি হয়। এতে বাবার সুখ্যাতি আরও বাড়বে। এমন নয় যে-জমিটা খুব কিছু কাজে লাগছে। পড়েই আছে। আর রাহি জানে ও নিজে যদি বাবাকে বলে বাবা অমত করবে না। ওর কথাতেই না বাবা প্রতি মাসে টাকা দিয়ে আবেশকে রেখেছে। ওদের যে পরিমাণ জমিজমা আছে, তাতে এই জমিটা না থাকল, কী গেল তাতে কিছু এসে যাবে না। তবু সুধাদির প্রস্তাব পর্যন্ত বাবা ভদ্রভাবে ফিরিয়ে দিয়েছে। রাহি বোঝে বাবা যতই ‘না’ বলুক, সুধাদির সঙ্গে বাবার একটা ঠান্ডা লড়াই চলে তলায় তলায়। তবু, রাহি বললে বাবা অমত করবে না। শুধু কাঁটা বলতে ত্রয়ণ। আর ওর হাতের ওই জিনিসগুলো।
‘কী হল? বলো?’ আবেশ অস্থির হয়েছিল।
‘আমি…মানে, আমায় একটু ভাবতে দাও।’ রাহি ভুরু কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করেছিল।
‘সময়ই তো নেই। দেখো, আদি আছে। আমি কথা বলিয়ে দিচ্ছি।’
‘না,’ রাহি তীব্র স্বরে বলেছিল, ‘একদম নয়।’
‘আরে, তুমি ভেবো না। আমি সেই সুযোগে প্রাথমিক কথাটুকু বলে রাখি মাত্র।’
‘দেখো, আমার একটু সময় লাগবে। তুমি কিন্তু কিছু কমিট করবে না।’
‘না না,’ আবেশ হেসেছিল, ‘আমার জমি যে, আমি কমিট করব?’
‘তাও, আমি কিন্তু কিছু বলছি না।’ রাহি আর দাঁড়ায়নি।
আবেশ শুধু বলেছিল, ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা। মনে রেখো। সঙ্গে ‘হেল্প আর্থ’-এর পাবলিসিটি। তোমার বাবার নাম। ত্রয়ণের মুখে জুতো। শুধু তোমায় রাজি হতে হবে। বুঝেছ রাহি? না বুঝলে, বোঝার চেষ্টা করো।’
বোঝার চেষ্টা করেছে রাহি কিন্তু বুঝতে পারেনি ঠিক। বাবার কাছে গিয়ে বলতেও পারেনি কিছু। আসলে কী বলবে? কতটা বলবে? কীভাবে বলবে? বাবা আজকাল বাড়িতে থাকে খুব কম। ব্যাবসার কাজে খুব ঘোরাঘুরি করে। ব্যাবসা যত বাড়ছে বাবার চাপও তত বাড়ছে। মাঝে মাঝে চিন্তা হয় রাহির। যদি বাবার কিছু হয়ে যায়! এত বড় ব্যাবসাটার তবে কী হবে? দিন দশেক আগে তো এই আশঙ্কার কথা বলেও ছিল বাবাকে। বাবা তখন সবে খেতে বসেছিল। মা, বাবা আর রাহিই কেবল ছিল খাবার টেবিলে। রাহি একবার ভেবেছিল যে, জমির কথাটা তোলে। কিন্তু ভরসা হয়নি। কেন হয়নি ঠিক জানে না। হয়তো ভয় ছিল কথাবার্তার খোঁচায় যদি বেরিয়ে আসে আসল সত্যগুলো। সত্য জীবনের এক মর্মান্তিক দিক। কেন যে প্রয়োজনীয় আর ভাল জিনিসগুলোই তেতো হয়! রাহি বুঝতে পারছিল ও এমন বয়সে পৌঁছে গেছে যেখানে বাবা-মা আর ওর ভেতরে একটা কাঁটাতার উঠে গেছে। ও বুঝেছিল কাঁটাতার পেরোনোর আর কোনও উপায় ওর নেই।
বাবা হয়তো বুঝেছিল সেই দ্বিধা। হয়তো রাহির আপাত স্থিরতাই তার কাছে অস্বাভাবিক লেগেছিল। তাই বাবা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী রে মা? কিছু বলবি?’
‘আমি?’ যেন ধরা পড়ে গেছে এমনভাবে চমকে উঠেছিল রাহি।
‘হ্যাঁ। আজ বড্ড চুপচাপ যে,’ বাবা মৃদু হেসেছিল।
‘না, এমনি। এই ভাবছিলাম তোমার কথা,’ রাহি কোনওমতে বলেছিল।
‘আমার কথা? কেন রে পাগলি?’ বাবার মুখে আনন্দের হাসি দেখেছিল রাহি।
বাবা যে খুশি হয়েছে বুঝেছিল রাহি। হাসি পেয়েছিল ওর। যেই মিথ্যে বলল, অমনি খুশি হয়ে গেল বাবা। কিন্তু যদি সত্যিটা বলত? তবে? তবে কি আর এমন করে আনন্দ পেত বাবা? বরং দুঃখ পেত, হয়তো রাগও করত। কিন্তু দেখো, যেই মিথ্যে করে বলল অমনি সারাদিনের খাটুনিতে ক্লান্ত লোকটা কেমন ঝলমল করে উঠল!
রাহি বলেছিল, ‘না, ভাবছিলাম, তুমি যে এত পরিশ্রম করছ, তার ফলে কিন্তু তোমার শরীর যে-কোনও দিন খারাপ হতে পারে। এমনিতে তোমার সুগার আছে। প্রেশার হাই। দু’বার কিডনি স্টোন হয়েছে। তারপর এত খাটনি। শরীরে দেবে তো? তোমার যদি শরীর খারাপ হয়, তোমার ব্যাবসার কী হবে বলো তো? মানে এত বড় করছ যে ব্যাবসাটা, সেটা দেখবে কে তুমি অসুস্থ হলে?’
বাবা বলেছিল, ‘শোন, শুয়ে-বসে খাওয়া আমার পোষাবে না। আর আমার সঙ্গে যারা আছে, তারা যথেষ্ট বিশ্বাসী আর পরিশ্রমী।’
‘তাও, তোমার দেখা আর অন্যদের দেখা কি এক হল? দাদা যদি তোমার সঙ্গে থাকত, তা হলে না হয় একটা সাপোর্ট হত। কিন্তু তা তো আর হয় না। তাই বলেছি যে, আর এত দৌড়ঝাঁপ কোরো না। কী হবে দৌড়ঝাঁপ করে?’
‘তোর দাদাকে টানছিস কেন এর মধ্যে?’ মা বলেছিল হঠাৎ, ‘তোর বাবার মতো কি সবাইকে টাকার পিছনে দৌড়োতে হবে?’
‘ক্ষমতার পিছনে দৌড় এর চেয়েও সাংঘাতিক।’ বাবা শান্ত গলায় বলেছিল, ‘তোমার ছেলে যেটা করছে সেটা খুব ভয়ংকর। ক্ষমতাকে গ্রাস করতে গেলে একদিন ক্ষমতা মানুষকে গ্রাস করে। আর যেভাবে ও বোমা পিস্তলের ভরসায় বেঁচে থাকে, সেটা আরও মারাত্মক। তুমি ওকে লাই দিয়ো না।’
‘আমি লাই দিচ্ছি?’ মা অবিশ্বাসভরা চোখে তাকিয়েছিল বাবার দিকে।
‘নয়তো কী?’ রাহি পক্ষ নিয়েছিল বাবার, ‘এই যে আজ এমন নেশা করে এসে বমি করতে শুরু করল সন্ধেবেলা, সেই থেকে যে ঘরে গিয়ে পড়ে আছে, দীপাকে বাজে কথা বলছে ক্রমাগত, সে ব্যাপারে মা তুমি কী করছ? তোমার তো ছেলেকে শাসন করা উচিত ছিল, নাকি?’
‘সে কী!’ বাবা চমকে উঠে তাকিয়েছিল মায়ের দিকে।
‘তোমার আর উঠতে হবে না। দীপা ঘরে খেয়ে নিয়েছে। আর চমকও ঘুমিয়ে পড়েছে।’ মা বাবাকে খাওয়া ছেড়ে উঠতে না করে এক নিশ্বাসে বলেছিল কথাগুলো।
‘তাও, মা তুমি কতদিন দাদার হয়ে সাফাই গাইবে?’ রাহির রাগ হয়ে গিয়েছিল।
‘এই হয়, বয়সে বিয়ে না দিলে মেয়েদের এমনটাই হয়,’ মা রাগে গরগর করতে করতে কথাটা বলে ভস্ম করে দেওয়ার মতো তাকিয়েছিল রাহির দিকে।
‘বিয়ে? এর মধ্যে বিয়ে এল কোত্থেকে?’ রাহি অবাক হয়েছিল ভীষণ।
‘কেন, বিয়ে করবি না তুই?’ মা বলেছিল।
‘আশ্চর্য! এর ভেতর বিয়ে আসে কোত্থেকে?’ রাহি আবার জিজ্ঞেস করেছিল।
‘তোর মতো বয়সে আমার চমক হয়ে গেছে। আর তুই বাড়িতে বসে ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে বিবেকগিরি করছিস?’
মায়ের যে কেন হঠাৎ রাগ হয়ে গিয়েছিল ঠিক বুঝতে পারেনি রাহি।
‘আরে, তুমি এমন করে বলছ কেন?’ রাহি আবার জিজ্ঞেস করেছিল।
‘কেন? আমি তোর মা, তোর বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে পারি না?’
‘নিশ্চয়ই পারো। কিন্তু তা বলে এখন?’
‘কেন? বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে হলে পঞ্জিকা দেখতে হবে নাকি?’ মায়ের রাগ ক্রমশ যেন বাড়ছিল, ‘তোর কাছে চিঠি লিখে পারমিশন নিয়ে বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে হবে?’
‘আরে, তাই বললাম?’ রাহির রাগ হচ্ছিল।
‘তুমি জিজ্ঞেস করো মেয়েকে, কবে বিয়ে করবে ও?’ মা এবার বাবার দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।
বাবা এতক্ষণ যেন পিংপং খেলা দেখছিল। এবার বলল, ‘এটা কিন্তু সঠিক প্রশ্ন। তা, তুই কবে বিয়ে করবি রে?’
‘বাঃ,’ মা বিরক্তিতে মাথা নেড়েছিল, ‘বাপ এমনভাবে জিজ্ঞেস করছে যেন কবে বাদামভাজা খাবে!’
বাবা হেসেছিল, তারপর রাহির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘তোর কি কাউকে পছন্দ? মানে বিশেষ কেউ আছে যাকে তুই বিয়ে করতে চাস?’
‘আমি বিয়ের কথা চিন্তাই করিনি,’ রাহি গম্ভীর গলায় বলেছিল।
‘তোর কি কিগানকে পছন্দ?’ বাবা আচমকা জিজ্ঞেস করেছিল।
‘অ্যাঁ?’ রাহি থতমত খেয়েছিল। তারপর কথাটা বোধগম্য হওয়ার পর আচমকা মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিল রাহির।
‘তুই তো প্রায়ই যাস ওর কাছে। রান্নাবান্না করেও নিয়ে যাস। তা, তোর কি ওকে পছন্দ?’
‘না, না,’ কোনওক্রমে বলেছিল রাহি। তারপর হেসে ব্যাপারটা হালকা করার জন্য বলেছিল, ‘তোমার মাথায় এসব এল কেন?’
‘না, ভাল লাগতেই পারে। ছেলেটি সুন্দর, আর ভাল। আমার তো ভালই লাগে,’ বাবা হেসে তাকিয়েছিল রাহির দিকে।
‘বোঝো,’ মা বিরক্ত হয়ে তাকিয়েছিল রাহির দিকে, ‘সেই জন্যই তোকে বলতাম যে, এমন হুটহাট করে ওর বাড়ি যাস না। এমনিতে একা থাকে, বিয়ে করেনি। লোকে খারাপ কথা বলবে। তা শুনতিস আমার কথা? নে, এখন নিজের বাবাই বলছে।’
‘মানে?’ বাবা থতমত খেয়েছিল, ‘আমি তো এমনি বলছি। আর রাহি যায়, ভাল করে। একটা মানুষ একা থাকে। কী খায় না খায়, রাহি গিয়ে খোঁজখবর নেয়, ভাল করে।’
‘তবে বেশি যাওয়া মোটেও ভাল নয়। তুমিই বলছ বিয়ের কথা। তা হলে, চিন্তা করো, অন্যরা কী বলবে? আর আমার মেয়ের বিয়ে ওর সঙ্গে দেব কেন? অর্ধেক বাঙালি, অর্ধেক সাহেব। চালচুলো নেই,’ মা কথাগুলো বলে তাকিয়েছিল রাহির দিকে।
কিগান। কিগানকে বিয়ে করতে পারলে কেমন হত? রাহি জানে তা সম্ভব নয়। কিগান এক গ্র্যানাইট পাথরের দুর্গ। ওকে ভেদ করা যায় না। কী আছে ওই দুর্গের ভেতরে তাও জানা যায় না। শুধু দূর থেকে দেখা যায় যেন। রাহি বোঝে, এখন আর কিগানের জন্য ওর মন পাগলামোও করে না। আগে যেমন ওর ঘরে ঢুকলে সেই হাওয়ায় জড়িয়ে থাকা মাস্কের গন্ধটা ওকে পাগল করত, এখন আর তেমনটা করে না। বরং শুধু একটা কষ্ট দেয়। ঘাসের ঘন সবুজ রঙের এক কষ্টের ছায়া যেন পড়ে রাহির বুকের মধ্যে। যা কোনওদিন পাওয়া যাবে না, তার সামনে এলে যেমন কষ্ট হয় মানুষের। তবে তা আর পাগল করে না ওকে। বরং শান্ত করে। ওর সীমানাটা বোঝায়। রাহি জানে, কিগান আজও ওর দেওয়া ঘড়িটা পরেনি। আজও বাক্সবন্দি হয়ে ঘড়িটা পড়ে আছে ঘরে। জানে, আজও মাঝরাতে কিগান বসে থাকে অন্য কারও জন্য।
রাতে, নিজের ঘরে বসে রাহি মাঝে মাঝে ওই একলা, নিঃঝুম কিগানের কথা মনে করে। মনে হয় কোথা থেকে এল এই ছদ্মবেশী রাজপুত্র? কোন অভিশাপে সে এমন নির্জনবাসী হয়েছে? কেন অমন শান্ত, স্থিত মানুষটার চোখ দুটো অমন অস্থির? কাকে খোঁজে তারা? কাকে খোঁজে তার মাঝরাতের মাউথঅর্গান? তার গিটারের কর্ড? কে তার মনে, মাথায় পদ্মচিহ্ন এঁকে নির্বাসিত করেছে? আসলে কে এই কিগান অর্ক ব্যানার্জি? কার এই কিগান অর্ক ব্যানার্জি?
রাতে, হাওয়ায় তীব্র হয়ে ওঠে কাঠালচাঁপার মনখারাপ। ওদের নিঝুম বাড়ি আর বাগানের ভেতর ঝিঁঝি-র শব্দ ঘন হয়। চাঁদ গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে লম্বা বাঁশবাগানের মাথায়। রাহি বোঝে, এই রাজপুত্র ওর নয়। এ রাজপুত্রের জীবন অন্য কোথাও রাখা আছে।
সেদিন বাবা-মায়ের কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল রাহি। তবু বাবা বলেছিল, ‘আমার মেয়ে যদি কাউকে পছন্দ করে, তবে সে যে-ই হোক আমি তার সঙ্গেই ওকে বিয়ে দেব। আমার মেয়ে যা চায় আমি তাই দেব ওকে। একটা জীবনে যেন কোনও আফশোস না থাকে ওর।’
রাহির খুব ইচ্ছে করছিল সেই সুযোগে জমির কথাটা একবার তোলে। না, ঠিক বিক্রির জন্য নয়। তবে অন্তত কথাটা তুলে বাবার এখনকার মতামতটা জেনে নেওয়া দরকার মনে হয়েছিল ওর। তবু তুলতে পারেনি। সংকোচ হয়েছিল। মনে হয়েছিল এ যেন অপরাধ। যেন না বলে অন্যের দুর্বলতার সুযোগ নেওয়া।
‘মাথা খাও। আরও মাথা খাও মেয়ের,’ মা এঁটো বাসন জড়ো করে সরিয়ে রাখতে রাখতে গজগজ করছিল।
বাবা হেসে বলেছিল, ‘ওর সময়মতো ও ঠিক বিয়ে করবে।’
‘এ কি ট্রেন না প্লেন যে, সময় না হলে ছাড়বে না? আমার হয়েছে বিপদ। বাপ আর মেয়েকে নিয়ে জেরবার হয়ে গেলাম,’ মা গজগজ করতে করতে চলে গিয়েছিল।
‘তুমি আমায় সব দিতে পারো?’ রাহি হেসে জিজ্ঞেস করেছিল।
‘চেয়ে দেখ,’ বাবা হেসে হাত ধুতে চলে গিয়েছিল।
রাহি দেখেছিল বিশ্বাস আর তার পরের নানা বন্ধুর পথ। দেখেছিল বাবা, মা, আর তার মধ্যে নানা রঙের আবদার, আনন্দ। এসবকে কি তুচ্ছ, নস্যাৎ করে দিতে পারে ও? কার জন্য পারে? কতটা পারে?
‘কী হল? এমন থম মেরে গেলে কেন?’ আবেশ জিজ্ঞেস করল।
‘না, থম মেরে না। আসলে ভাবছিলাম কী হবে,’ রাহি জামরুল গাছের তলা থেকে সরে হাঁটতে লাগল।
‘কী হবে মানে?’ আবেশ অবাক মুখ করে পাশে পাশে হাঁটতে লাগল।
‘মানে দেখো,’ রাহি শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে বলল, ‘আমরা তো কত কিছু প্ল্যান করি, সব কি হয়? বস্তির লোকেদের জন্য সুস্থ স্যানিটেশন, রাস্তার গাছ কাটা আটকানো, কিছুই পারলাম কি? স্যানিটেশনের জন্য নাকি কীসব অনুমতি নিতে হবে। গাছ কাটা নিয়ে বলতে গেলে নাকি সুধাদির সমস্যা হবে। তা এত কিছুর মধ্যে যদি নাই হল ম্যাচ। নাই হল সব। তাতে কী হল?’
‘আরে?’ আবেশ প্রায় চিৎকার করে উঠল, ‘এতদিন আমি যে এত দৌড়োদৌড়ি করলাম তার কী হবে? বেশ কিছু টাকার স্পনসর আনলাম। তাদের বললাম যে, এমন একটা ক্রিকেট ম্যাচ হবে, যাতে তাদের নাম ডিসপ্লেড হবে। তার বেলা? এবার তো তারা আমায় চাঁদা তুলে ঠেঙাবে। তখন কী করব আমি? আর এবার তো আর মোটে একটা ম্যাচ নয়। আমি গোটা একটা টুর্নামেন্ট করার কথা বলছি। ভাবতে পারছ কতটা গ্র্যান্ড স্কেলে হবে কাজটা? এখন যদি কিচ্ছু না হয়, অ্যাডভারটাইজাররা কি আমায় রক্ষে রাখবে?’
‘মানে? তুমি তাদের এসব বলেছ কেন?’ রাহির অবাক লাগল।
‘আরে, না বললে কি আর টাকা দিত? সমাজসেবা ক’জন করতে চায়? সবাই তো নাম চায়। আর এরা বিজনেস হাউজ। প্রফিটেবল অর্গানাইজেশন। প্রফিট ছাড়া ফালতু টাকা ঢালবে কেন? এরা চায় পাবলিসিটি, তাই আমি বলেছি। গত সপ্তাহখানেক ধরে তো এরা ঝালাপালা করে দিচ্ছে আমায়। রাহি তুমি সিরিয়াস হও। দেখো, জমিটা নিয়ে কী করবে।’
রাহি হাসল। আবেশ কাজটা বেশ মন দিয়ে করছে। ‘হেল্প আর্থ’-এর লাভও হচ্ছে। তবে ওর সমস্যা হল এই যে মাঝে মাঝেই লিমিট ক্রস করে যায়। এই যে দুম করে এমন একটা কমিটমেন্ট করে বসে আছে, তার কি কোনও কারণ আছে? শর্ট টার্ম লাভের জন্য এমন মিথ্যে বলার কারণ আছে কি? এতে তো নিজেকেই অপ্রস্তুত আর অপদস্থ হতে হয়। তা ছাড়া, ‘হেল্প আর্থ’-এর তো বদনাম হচ্ছে। এটা কেন বোঝে না ও?
রাহি ভাবল এটা নিয়ে ওকে কিছু বলে, কিন্তু তার আগেই বাধা পেল। দেখল সাধুদা আসছে। বেশ হন্তদন্ত হয়েই আসছে। আর চেঁচিয়ে বলছে, ‘চলো চলো, অতিথি এসেছে। তাড়াতাড়ি চলো।’
‘অতিথি?’ অবাক হল রাহি। এমন দিনে হঠাৎ অতিথি আবার কে?
ফলের বাগানটা বাড়ির পিছনের দিকে। ওর সামনে দিয়ে পাথরের তৈরি একটা রাস্তা ঘুরে সামনের দিকে গেছে। এটা খুব সুন্দর। পথের পাশে একটু দূরে দূরে পুরনো আমলের গ্যাসবাতির মতো ঘোমটা লাইট পোস্ট লাগানো রয়েছে। সন্ধেবেলা তার আলোয় জায়গাটা ভীষণ সুন্দর দেখায়।
রাস্তাটা আগে ছিল না। কিছু বছর আগে তৈরি করা হয়েছে। এক দিকে ভালই হয়েছে। আসলে আগে জায়গাটা জঙ্গলের মতো হয়ে ছিল। সাপ বেরোত প্রায়ই। তাই নিয়ে সাধুদা বলেছিল বাবাকে। বাবা একদম পরিষ্কার করে রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে।
রাহি আর আবেশের সঙ্গে কথা বাড়াল না। সাধুদার দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘কে এসেছে সাধুদা?’
সাধুদা রাস্তাটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘হোমিদিদি।’
‘হোমি?’ আশ্চর্য হল রাহি, ‘তা ও এখানে এল না কেন? ও এ বাড়িতে নতুন নাকি?’
‘না না, আসতেই তো চেয়েছিল। কিন্তু বউরানি বারণ করলেন।’
‘কেন?’ রাহি অবাক হল, ‘মা বারণ করেছে কেন?’
‘কারণ, এমন রোদ, গরম, কলকাতায় ওদের তো আর অভ্যেস নেই। এর আগে একজন এসে অমন মুখ থুবড়ে পড়ল। তাও শীতকালে। আর এখন চৈত্রর শুরু। কিছু হলে কাণ্ডটা কী হবে বুঝতে পারছ? তাই বউরানি আর ঝুঁকি নেননি।’
‘সাধুদা,’ রাহি সাধুদার দিকে তাকাল ভুরু কুঁচকে।
‘কী হল?’ সাধুদাও দাঁড়িয়ে পড়ে পিছন দিকে তাকাল, ‘কী হয়েছে?’
এবার আবেশ কথা বলল, ‘সত্যি সাধুদা, মাইরি তুমি গুপ্তধনের নকশা বলছ নাকি? সোজাভাবে রাহি জিজ্ঞেস করছে কে এসেছে আর তুমি যা পায়ে ধরে সাধা শুরু করলে।’
‘কী বললে পায়ে ধরে সাধা? মানে?’ সাধুদা আবার হাঁটতে শুরু করল।
‘সাধুদা তুমি বলবে?’ রাহি দেখল প্রায় বাড়ির সামনে চলে এসেছে ওরা।
সাধুদা এবার দাঁড়াল। বলল, ‘ওই যে গো হোমিদিদির ভাই, ওই স্বাস্থ্যবান ছেলেটা সঙ্গে লম্বা সুন্দরমতো মেয়েটা।’
‘স্বাস্থ্যবান ছেলে? গুন্ডা? সে ব্যাটা তো মোটা,’ আবেশ খিকখিক করে হাসল, ‘মাইরি, সাধুদা ভদ্রতায় পিএইচডি করেছে। তুমি তো ক্লাস নিতে পারো, কীভাবে ভদ্র হবেন। আর সুন্দর মতো মেয়ে মানে? কোন সুন্দর মতো মেয়ে?’
‘আরে দিঘি এসেছে,’ রাহি বলল।
‘দিঘি? সেই সুকিয়া স্ট্রিটের মেয়েটা?’
‘হ্যাঁ। তো হঠাৎ ও এল যে!’ রাহি যেন কতকটা নিজেকেই প্রশ্ন করল।
‘জানো, মেয়েটাকে কোথায় যেন সুকিয়া স্ট্রিটে দেখেছি। আসলে বহু দিন সুকিয়া স্ট্রিটে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি তো। তাই ঠিক প্লেস করতে পারছি না,’ আবেশকে চিন্তিত দেখাল।
রাহি দেখল, ওর সঙ্গে আবেশ গেলে ভুলভাল আরও বকবে। তাই ওর যাওয়ার দরকার নেই। হয়তো হোমি কোনও পার্সোনাল দরকারে এসেছে।
ও আবেশকে বলল, ‘শোনো, তুমি বরং একবার হিসেবটা গিয়ে চেক করো। মার্চ এন্ড-এ কাগজপত্তর তো জমা দিতে হবে। আজ রোববার, ছুটি পাবে। অন্য দিনগুলো তো নানা কাজ করতে হয়। বুঝেছ?’
আবেশ হাসল। অর্থাৎ, বুঝেছে। মানে, রাহি যেটা বলেছে সেটা বুঝেছে, আর যেটা বলেনি, সেটাও বুঝেছে। তাই আর দাঁড়াল না। হাঁটতে হাঁটতে মেন গেটের দিকে চলে গেল। শুধু যেতে যেতে বলল, ‘আমি অল্প সময়ের জন্য একবার আসব।’
সাধুদা তাড়া দিল, ‘আঃ, দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? চলো।’
‘যাচ্ছি তো,’ রাহি জোরে পা চালাল।
দুপুর তার ধারালো জিভ দিয়ে চাটতে শুরু করেছে সবটুকু। মাথার ওপর নীল আকাশটা ঝলসে কেমন যেন সাদা লাগছে। দূরে গাছপালাগুলো প্রদীপের শিখার মতো কাঁপছে। চৈত্র মাসে ভয়াবহ গরম পড়েছে এবার। কাঁঠালতলাটা বেশ ঠান্ডা ছিল। আর এখানে যেন আকাশ থেকে আগুন ঝরে পড়ছে। রক্ষে এই যে ঘরে এসি আছে।
‘আরে কোথায় ছিলিস তুই?’ ওকে দেখামাত্র প্রায় চিৎকার করে উঠল হোমি।
‘কেন? আবেশের সঙ্গে বাগানে ছিলাম।’
‘ও,’ হোমি হাসল, ‘আমি তো ভাবলাম তোর লাভার বয় এসেছে।’
‘মানে?’ রাহির বিরক্ত লাগল। হোমিটার মুখে কোনও ট্যাক্স নেই। মায়ের সামনে এসব বলার কোনও মানে আছে?
‘মানে রুহান রে। বাব্বা, যখন আসে তখন তোকে এমনভাবে দেখে!’
‘রুহান?’ হঠাৎ পাশের সোফায় বসা দিঘি বলে উঠল।
‘কেন? তুমি চেনো?’ হোমি দিঘিকে জিজ্ঞেস করল।
‘আমি? না না,’ দিঘি ঠোঁট চাটল, ‘আসলে নামটা আনকমন তো, তাই…’
‘ও, তবে ছেলেটা ভীষণ কমন। আবার আবেশের বন্ধু। কিগানদারও।’
‘কিগানদা কোথায়?’ গুন্ডা জিজ্ঞেস করল গম্ভীর মুখ করে।
‘আছে হয়তো বাড়িতে বা ফ্যাক্টরিতে,’ রাহি হালকা গলায় বলল, ‘কেন?’
‘ও কিছু না,’ দিঘি গুন্ডাকে চুপ করিয়ে বলে উঠল, ‘ওর কথা বাদ দাও তো! কত কিছু বলে। আসলে শমীদার সেই ঘটনার পর গুন্ডার শখ হয়েছিল ওর সঙ্গে আলাপ করার।’
মা এতক্ষণে প্রথম কথা বলল, ‘ছেলেটা ভাল। পরোপকারী। চুপচাপ।’
‘ভাল?’ গুন্ডা আবার ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করল।
‘নিশ্চয়ই ভাল,’ দিঘি হাসল, ‘শমীদাকে সেদিন কী হেল্প করল, না?’
‘ভাল কথা, শমীদা কেমন আছেন?’ রাহি জিজ্ঞেস করল।
‘শমীদা?’ দিঘির ছটফটে ভাবটা হঠাৎ যেন কেমন নেতিয়ে এল। গলাটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে এল। যেন জানালায় জ্বলতে থাকা আলো নিভে গেল নিমেষে।
‘কেন? কী হয়েছে?’ রাহির সঙ্গে সঙ্গে মা-ও ঝুঁকে পড়ল এবার।
‘ক্যান্সার হয়েছে শমীদার। প্যানক্রিয়াসের হেড-এ। শেষ স্টেজ। ডাক্তার বলেছেন আর দু’-তিন মাস বড়জোর।’
‘অ্যাঁ?’ মা অবাক হল, ‘কী বলছ তুমি? সেদিন দেখলাম তো। ইয়ং বেশ। এখনই এই রোগ? ভাল করে চেক করা হয়েছে তো?’
‘হ্যাঁ আন্টি। সব করা হয়েছে। আর বেশি দিন নেই।’ দিঘি ক্লান্ত গলায় বলল।
‘ও, সো স্যাড,’ হোমি মাথা নাড়ল, ‘মুম্বই নিয়ে গেলেও হয় না?’
‘না, কিচ্ছু করা যাবে না। ওরাল কেমো চলছে। আর ব্যস, অপেক্ষা। তবে দিদি একবার মুম্বই যাবে। এই বিষয়ে ওপিনিয়ন নিতে।’
রাহির খারাপ লাগল। মানুষের জীবনের নশ্বরতা সম্পর্কে আরও একবার যেন নিশ্চিত হল ও। একটা সুস্থ সবল মানুষের ভেতরে কী আশ্চর্যভাবে যে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে মৃত্যু! রাহির মনে হল কিছু বলা উচিত ওর। কিন্তু কী বলবে? মৃত্যুর কোনও সান্ত্বনা হয় না যে! তাই রাহি চুপ করে রইল।
দিঘিই প্রথম কথা বলল, ‘যাক গে। কী আর করা যাবে। তা রাহিদি, এই যে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলাম সেটার জন্য তো একবারও খুশি হলে না?’
‘আমার সঙ্গে? সত্যি!’ রাহি অবাক হল।
‘নাকি মিথ্যে! আরে গুন্ডা আসছিল হোমিদির বাড়ি। আমার বাড়িতে মনখারাপ করছিল বলে ঝুলে পড়লাম। বলা যায় একরকম নিজের থেকেই নেমন্তন্ন নিলাম হোমিদির থেকে।’
‘ধ্যাত, কী মিথ্যুক!’ হোমি হাসল, ‘মেয়েটা খুব পাজি। সবসময় এমন করে কথা বলে! আমায় বলল আসবে কিনা। আমি বললাম হ্যাঁ। এতে আমার থেকে নেমন্তন্ন নেওয়ার কী আছে?’
‘তা বেশ তো। তোমরা সবাই এখানে খেয়ে যাবে,’ মা হেসে বলল।
‘মানে?’ হোমি তিড়িং করে লাফ দিয়ে উঠল।
‘মানে খুব সোজা। দুপুর হয়ে গেছে। খেয়ে যাবে। গৃহস্থের একটা কল্যাণ-অকল্যাণ তো আছে, নাকি?’
‘তা বলে খেতে হবে! তুমি একটা মিষ্টি দাও কাকিমা, তা হলেই হবে।’ হোমি প্রতিবাদ করে উঠল।
‘পাকামি করবি না হোমি। যা বললাম শুনবি।’
‘আর আমাদের বাড়ির রান্নাগুলো? সেগুলোর কী হবে?’ হোমি হাসল।
‘তোর মাকে আমি ফোন করছি। আমি বললে ও না করবে না।’
‘না কাকিমা, প্লিজ না। মাকে ফোন কোরো না।’
‘আমি বলছিলাম কী,’ গুন্ডা হাসল, ‘আমি যদি দু’ জায়গাতেই খাই। মানে, আন্টি এত করে বলছেন যখন, তখন না করাটা ঠিক ভাল ঠেকছে না। আমি এখানেও খাব। তারপর হোমিদির বাড়িতেও খাব।’
‘মানে? তুই নিজের চেহারাটার দিকে দেখেছিস? পুরো সুমো রেসলার। আর খাস না। কোনদিন দুম করে ফেটে যাবি,’ হোমি ধমক দিল।
গুন্ডা বলল, ‘সত্যি বলছি, আমি পারব। কাকিমা কষ্ট পাবেন, এটা হতে দেওয়া যায় না। কাকিমা তুমি আমায়, মানে আপনি আমায় খাবার দিন অল্প করে, আমি পারব।’
দিঘি সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘আমায় কিন্তু দেবেন না আন্টি। আমি পারব না।’
‘একটু খাও। মাংস দিচ্ছি,’ মা নাছোড়বান্দা হয়ে বলল।
‘না না,’ দিঘি প্রায় লাফিয়ে উঠল।
মা কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সেটা শোনার আগেই রাহির মোবাইলটা নড়ে উঠল। এসএমএস। বিরক্ত লাগল রাহির। এসব ভাল লাগে না ওর। কিন্তু কী আর করবে? ও মোবাইলটা দেখল। এ তো রুহান!
রুহান! তা হঠাৎ করল এসএমএস? অমন খারাপ ব্যবহার করার পর রাহির একটা বিরক্তি এসেছে ছেলেটার ওপর। না, রাগ নয়, বিরক্তি। ছেলেটা কেমন যেন! তোর রাগ হয়েছিল, তুই খারাপ কথা বলেছিস, ঠিক আছে, কিন্তু তারপর বারবার ফোন করা কেন? রাহি মিস্ড কল অ্যালার্টে বহুবার ওর নম্বর দেখেছে, কয়েকবার তো এমনিই উত্তর দেয়নি। একবার-দু’বার তো কষ্ট করে কেটে দিয়েছে ফোন। রাহি বুঝতে পারছিল যে, রুহান বোধহয় ক্ষমা চাইবে, কিন্তু রাহি তেমন পাত্তা দেয়নি। ছেলেটা ওকে যে চোখেই দেখুক না কেন, তাতে ওর কিছু এসে যায় না। রাহি মেসেজটা খুলল। ভুরু কুঁচকে দেখল লেখা আছে-‘আমি শিয়ালদা স্টেশনে আছি। তোমার সঙ্গে খুব জরুরি কথা আছে। ফ্রি থাকলে মেসেজ করো। আমি ট্রেন ধরব। খুব আর্জেন্ট।’
রাহি অবাক হয়ে মেসেজটার দিকে তাকিয়ে রইল। কী লিখেছে এটা? রুহান এসব কী লিখেছে? কেন লিখেছে? কী এমন জরুরি কথা পড়ল? অবাক হয়ে মেসেজটার দিকে তাকিয়ে রইল রাহি। কী উত্তর দেবে এর? রাহির কি উত্তর দেওয়া উচিত?