মুহূর্তরা দু’বছর আগে – ২৭

২৭

‘ফেব্রুয়ারিতে বৃষ্টি আসছে খুব
আলো ঝলমল কলকাতা ভাসছে
কাগজ-নৌকো, ম্যানহোল ঘূর্ণি
মুঠোয় বেলুন, ন্যাড়া গাছ হাসছে
তবু স্পর্শের বুদবুদ ঘুরে যায়
বৃষ্টির ছাঁটে উঁচু নিচু বাস্তব
হোঁচট খাচ্ছি, দাঁড়িয়ে থাকছি, তাও
শুনশান পথ…চিরদিন বাসস্টপ…

কবিতা বোঝেন? কবিতা?’ ত্রয়ণ হাসি হাসি মুখ করে তাকাল।

‘কবিতা? মানে পোয়েট্রি?’ আদি ভুরু তুলল। মদের গ্লাসটার ধারে আঙুল দিয়ে গোল করে ঘোরাল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ‘আমি অন্য কবিতা বুঝি। মানে মহিলা, নাম কবিতা। সোনাগাছিতে থাকে। ক্লাস টুয়েলভে থাকতে গিয়েছিলাম।’

ত্রয়ণ হাসল, ‘যাঃ, তেমন ধরলে আমিও অনেক কিছু বুঝি। কিন্তু, আমি পোয়েট্রির কথা বলছি। যেটা বললাম, সেটার কথা বলছি। আপনি জানেন এসব? মানে বোঝেন?’

‘না,’ আদি হাসল, ‘এসব বুঝে কোনও লাভ নেই। কবিতা একটা সেল্ফ ইনডালজিং আর্ট। স্বার্থপর লোকেদের জন্য। আমার ভাল লাগে না। কী সব ভুলভাল, হাবিজাবি লেখে আর বুঝতে না পারলে, মানে জিজ্ঞেস করলে বলে, এসবের মানে বলতে নেই। কেন রে শালা? মানে বললে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে? যত্তসব ফালতুগিরি! আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কয়েক পিস ছিল। এমন টাইপ। অর্থহীন সব সেনটেন্স লিখে কী ঘ্যাম, কী ঘ্যাম! জিজ্ঞেস করলে হাসত। শালা, পুরো মাথা গরম হয়ে যেত আমার। যত্তসব ভাটের জিনিস। বাই দ্য ওয়ে, আপনি কি আর-একটা ভদকা নেবেন? সঙ্গে মাংসও বলব কি আর-একটু?’

‘তা বলতে পারেন,’ ত্রয়ণ হাসল, ‘আসলে কবিতা আর মানুষ এক। বুঝতে পারলে পারলেন। না হলে ঝাড়। পুরো ট্যান হয়ে যাবে। আমার তো মানুষজন নিয়েই কারবার, তাই কবিতা বোঝার চেষ্টা করি।’

‘ও,’ আদি মাথা নাড়ল। তারপর হাত তুলে বেয়ারাকে ডেকে আরও একটা করে ভদকা আর চিকেনের দু’রকম কাবাব অর্ডার করে গুছিয়ে বসল। বলল, ‘তা, আমরাও তো মানুষের মধ্যেই পড়ি। আমাদেরটা নিয়ে কী ভাবলেন? অনেকদিন তো হয়ে গেল।’

‘তিনটে ফ্ল্যাট। সুধাদি আপনাদের কাছে তিনটে ফ্ল্যাট চেয়েছিলেন। তাই না?’

‘তি—তিনটে?’ আদি চোখ কুঁচকে চিন্তা করার ভান করল।

‘কেন অ্যাক্টিং করছেন দাদা? আমি জানি। সঙ্গে ষাট লাখ টাকা। ইলেকশনের জন্য। সামনে ভোট। নোট তো লাগবেই।’

‘তা হবে হয়তো। কেন?’ আদি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল।

‘আপনি আমায় দুটো ফ্ল্যাট বলেছিলেন কেন?’

‘আমি যা জানতাম তাই বলেছি,’ আদি বেয়ারার দিয়ে যাওয়া গ্লাসটা থেকে ছোট্ট চুমুক দিল। জিভটা কেমন অসাড় অসাড় লাগছে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক বসে আছে ও। বেশ কয়েকটা ড্রিঙ্ক নিয়েছে এর মধ্যে। কেমন যেন নেশা হয়েছে মনে হচ্ছে।

‘আবার ঢপ?’ ত্রয়ণ হাসল, ‘মাইরি, ঢপোলজিতে পিএইচডি করেছেন দেখছি! ভুল করেও একটা সত্যি বলছেন না।’

‘আশ্চর্য,’ আদির বিরক্ত লাগল। ও তো মিথ্যেটাকে আপ্রাণ অভিনয় দিয়ে সত্যি করতে চাইছে। তবু পারছে না! কেন পারছে না? এটুকু তো পারতেই পারে। ধুস, মদ যেন সব গন্ডগোল করে দিচ্ছে।

‘শুনুন,’ ত্রয়ণ বলল, ‘আপনি মিথ্যে বলেছেন, তাই কাজটা এখনও হয়নি।’

‘তা আপনি তো বলেছিলেন যে, বারাসতের এই প্রজেক্টটায় কোন ক্লাবের জমিতে একটা ছোট পার্ক আর পঁচিশ লাখ টাকা দিলেই কেল্লা ফতে হবে। তবে?’

‘তবে এই যে, এখন দাম বদলেছে। আপনারা সুধাদির ডিমান্ড না মেনে, সুধাদিকে বলেছেন যে, দুটো ফ্ল্যাট আর কুড়ি লাখ দেবেন। ঠিক, না? একটা ডুপ্লে বিক্রি করলে আপনারা কত লাভ করেন বলুন তো? তারপর সুধাদিকে অত টাকা, আর আমায় ওই পি-নাট? মামদোবাজি!’

‘আরে কথা হয়েছিল যা তারপর খেলাপ করছেন?’ আদি বিরক্ত গলায় বলল, ‘এটা কি ভদ্রলোকের মতো কাজ হল?’

‘ভ-দ্র-লো-ক?’ ত্রয়ণ একটা মাংসের টুকরো তুলে মুখে পুরে বলল, ‘কে ভদ্রলোক? আপনি? গৌর? মার্চেন্ট মাল্টিপল্‌স? রাঘব চক্কোত্তি? চমক? কোন শালা ভদ্রলোক? সব এক। এক প্রোডাকশন লাইনের থেকে বেরিয়েছে। প্রত্যেকটা মাল। সুতরাং এসব ফান্ডা দেবেন না।’

‘না, দেখুন, আপনার যদি স্টেক বাড়ে তবে আপনি আমাদের বলেননি কেন?’

‘খিদেটা কার?’ ত্রয়ণ হাসল, ‘আর আমার বলাটা কি ঠিক হত?’

‘তা ঠিক,’ আদি আর-একবার চুমুক দিল গ্লাসে। নাঃ, জিভ সত্যিই অসাড়। কোনও স্বাদ পাচ্ছে না। মাংস মুখে দিলেও মনে হচ্ছে রাবার চিবোচ্ছে। মদটা একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেছে। তবে মাথা এখনও কাজ করছে। ত্রয়ণ যে নিজের থেকে কেন যোগাযোগ করেনি সেটা বুঝতে পারছে বেশ। পাওয়ার গেমের নিয়ম একটাই। অন্যকে নিজের কাছে আসতে দাও। তুমি নিজে আর্জ দেখালে তোমার দাম কমে যাবে। কোনও রকম নেগোসিয়েশনে তুমি আর সুবিধে করতে পারবে না। তাই চুপ করে থাকতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে, অন্য পক্ষ কখন আসবে তোমার কাছে।

আদি বলল, ‘তা আপনার নতুন কিছু বলার আছে কি?’

‘আপনারা তো বলবেন,’ ত্রয়ণ হাসল, ‘আমি তো আপনার ডাকে এসেছি। ফালতু আনতাবড়ি কথা বাড়িয়ে লাভ আছে? আপনি কবিতা কেন বোঝেন না জানেন? জানেন কেন কবিতা আপনার ওপর দিয়ে যায়?’

‘না,’ আদি মাথা নাড়ল। নাক আর ভুরুর কাছের সাড় যেন চলে যাচ্ছে।

‘কারণ কবিতায় কিছু সংকেত থাকে। তা আপনি ধরতে পারেন না। জীবনেরও কিছু সংকেত আছে। তাও আপনি ধরতে পারেন না। এত না নিয়ে বেঁচে থাকেন কী করে? কোম্পানি চাকরিতে রেখেছে কেন আপনাকে?’

আদি ঠোঁট কামড়াল। এটা রাগ করার মতো কথা বলছে ত্রয়ণ। কিন্তু মাথা গরম করা ঠিক হবে না। কারণ কাজটা করাতে হবে। বহুদিন যাবৎ ঝুলে আছে ব্যাপারটা। রাঘব চক্রবর্তী লোকটা তো আর কথা বলতেই চাইছেন না। তাই অন্য নানা দিক দিয়ে চেষ্টা করছে। কিন্তু কেউ-ই কিছু করতে পারছে না। আসলে সবার খাই এত বেশি যে, মার্চেন্ট অত খিদে মেটাতে পারবে না। বা বলা ভাল গৌর পারবে না। সব প্রজেক্টের একটা কস্ট আছে। ঘুষ বা কাটমানির জন্য যদি কস্ট বেড়ে যায় তবে আর প্রজেক্ট হবে কী করে? তা ছাড়া, এত টাকা চট করে ব্ল্যাকে দেওয়াও তো একটু সমস্যার। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়ে আছে খুব।

আদি হাসল, ‘আপনি আমায় অপমান করছেন,আমি জানি। কিন্তু কেন করছেন? আমি তো দূত মাত্র। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছি এই জন্য যে, প্রায় সাত-আট মাস হয়ে গেল। আপনি আমাদের অফার নিয়ে কিছু বলছেন না। কেন?’

‘কারণ অফারটা বাজে,’ ত্রয়ণ সরাসরি বলল, ‘আমার টাকা আর পার্কের কথাটা আপনারা কনফার্ম করেছেন এক মাস পর। কিন্তু এতদিনে আমি খবর নিয়েছি যে, সুধাদিকে আপনারা কত অফার করেছেন।’

‘আমরা তো ভাবলাম আপনি কাজ শুরু করেছেন।’

‘তাই এত মাস পর আমার কথা মনে পড়ল?’ ত্রয়ণ হাসল আবার, ‘ঢপোলজিতে আপনার সত্যিই দক্ষতা আছে। আমায় বোকা পেয়েছেন? অন্যদিকে চেষ্টা করেননি? কেউ কিছু পারেনি বলেই তো আমায় ডেকেছেন, নাকি?’

‘আচ্ছা। বাদ দিন,’ আদির ভাল লাগছে না আর। মাথায় ব্যথা করছে। প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে রাত। তখন থেকে এক কথার চারদিকে গোল গোল করে চক্কর কাটছে। ছেলেটা ঝেড়ে কাশছে না কিছুতেই।

আদি বলল, ‘আপনার কাছে আবার না হয় বলছি। আমরা দশ লাখ দিতে পারব আর পার্কটা করে দেব। রাজি হয়ে যান।’

‘সুধাদিকে ইলেকশনের জন্য অলরেডি কুড়ি লাখ এমনি দিয়েছেন। আমি জানি।’

‘আরে সে তো এমনি। জমির সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। দেখুন, জমি নিয়ে ওঁর দাবি কিন্তু আমরা মানিনি। মানলে আপনাকে বলতাম? তাই বলছি একটু দেখুন।’

‘তিরিশ লাখ, আর পার্ক। এক পয়সা কম নয়,’ ত্রয়ণ চোয়াল শক্ত করল।

‘এ কী! এ যে আগের চেয়েও বাড়িয়ে দিলেন,’ আদির মাথাটা কেমন টলমল করে উঠল।

‘অত বড় জমি পাবেন আর তার দাম দেবেন না, হয়? রাঘব চক্রবর্তী এই জমি আপনাদের দেবে না। ভদ্রলোককে আপনারা অপমান করেছেন। তবে যার জমি সে দেবে আর জলের দামেই দেবে। সেখানে ফ্যাক্টরি করে আপনারা কত কোটি টাকা কামাবেন! আর তার একটা অংশ আমায় দিতে বলছি বলে এমন মরে যাওয়ার মতো ভান করছেন! সত্যিই, ক্যাপিটালিস্ট ঢেমনামি দেখে বমি পায়,’ ত্রয়ণ নাক টানল।

‘আরে আপনি একটু কনসিডার করুন। থার্টি ল্যাক্‌স ইজ টু মাচ।’

‘শুনুন আদিত্যবাবু,’ ত্রয়ণ লম্বা চুমুকে মদ শেষ করল, ‘আমি পলিটিক্সে আছি। এটা আমার পেশা। ব্যাবসা। গিভ অ্যান্ড টেক। মানুষ আর তার মানসিকতা আমার মূলধন। ব্যবসায় কিচ্ছু টু মাচ হয় না। আমিই পারলে পারব এই জমি আপনাদের দিতে। তেমন উপায় আমার জানা আছে। আর না হলে কেউ পারবে না। বুঝেছেন? আমি কথা বাড়াচ্ছি না আর। অনেকটা ফিরতে হবে। আমি আসি। রাজি থাকলে আপনি আমাকে জানাবেন।’

‘কিন্তু, আপনি বড্ড বেশি বলছেন না কি?’ আদি শেষবারের মতো বলল।

‘না, কিছুই বেশি না। জমিটা থেকে আপনারা যে-প্রফিট করবেন, সেইটা ভাবুন, কিচ্ছু বেশি হবে না। আচ্ছা, থ্যাঙ্কস ফর দ্য ড্রিঙ্ক। আমি আসি।’

ত্রয়ণ চলে যাওয়ার পর নিজের চেয়ারে ঝুম হয়ে বসে রইল আদি। ত্রয়ণ বেয়াড়াপনা করছে খুব। তবে হাতে বোড়েটা নিশ্চয়ই খুব শক্তিশালী ওর।

নেশা হয়েছে আদির। তবে বেহেড অবস্থা নয়। শুধু খুব সামান্য একটা দুলুনি অনুভব করছে ও। মনে হচ্ছে একটা বেঁধে রাখা নৌকো আলতো ঢেউয়ের ধাক্কায় নড়ছে। দোল খাচ্ছে।

ত্রয়ণ ছেলেটা খুব ঘোড়েল। কীসের জোরে যে এমন দাম হাঁকাচ্ছে সেটা ঠিক বুঝতে পারছে না আদি। তবে ত্রয়ণকে দিয়ে কাজ করানোর একটা রিস্ক আছে। সুধাদি জানেন যে, কাজটা উনি করবেন, সেটা না করলে সুধাদি রাগ করবেন। ফলে ভবিষ্যতে ফ্যাক্টরিতে লেবার বা লোকাল প্রবলেম হলে খুব সমস্যায় পড়বে আদিরা। সুধাদি তখন হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন একদম। তবে ভরসা আছে একটা। সুধাদির বিপরীতে যোগেশ সমাদ্দার বলে যে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন তিনি যদি জিতে যান। তিনি ইলেকশন ক্যাম্পেনিং-এর জন্য এসেছিলেন গৌরের কাছে। গৌর বেশি টাকা দেয়নি। কিন্তু জিততে পারলে নতুন পার্টি অফিস বানিয়ে দেবে বলেছে।

ঘোলাটে হয়ে আসছে আদির মাথা। ভদকা তার কাজ দক্ষতার সঙ্গে করছে। আদি তবু নিজেকে গোছানোর চেষ্টা করল। প্রাণপণে চেষ্টা করল উপস্থিত সমস্যাটা থেকে বেরোতে। গৌরের ধৈর্য শেষ হচ্ছে। অবস্থা অনুকূল নয় বুঝতে পেরেও রাগ মেটাতে আদির চাকরিটা খেতেও পারে। তাই মনঃসংযোগ করতে হবে আদিকে।

ও ভুরু কুঁচকে টেবিলের ওপর থেকে একটা পেপার টাওয়েল তুলে নিল। তারপর পেন বের করে লিখল সমস্যাগুলো। ত্রয়ণকে দিয়ে কাজটা করালে সুধাদি চটে যাবেন। সুধাদিকে দিয়ে কাজটা করালে প্রচুর টাকা খসবে, প্লাস ত্রয়ণের কথা অনুযায়ী কাজটাও হবে কিনা সন্দেহ। আর তৃতীয় অপশন হল আবেশ।

ডিসেম্বরে, যেদিন খুব বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিল চাপাডাঙায়, তার পরের দিন আবেশ প্রায় চুপি চুপি আদিকে নিয়ে গিয়েছিল একটা নির্জন বারান্দায়। তারপর বসিয়েছিল একটা চেয়ারে। বেশ অবাক হয়েছিল আদি। হঠাৎ আবেশ এমন করছে কেন? ওর আবার কী হল? ছেলেটাকে তো বিশ্বাস নেই। যখন তখন যা খুশি তাই করতে আর বলতে পারে। তাই আদি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী রে এমন লুকোচুরি করছিস কেন? কিছু বলবি?’

‘তোর সঙ্গে জরুরি কথা আছে একটা,’ আবেশ চারদিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলেছিল।

‘কী কেস বল তো? টাকাপয়সা দরকার নাকি তোর? আমি কিন্তু দিতে পারব না।’

‘শালা,’ আবেশ ঠোঁট কামড়ে বলেছিল, ‘সবসময় দোকলাবাজি। টাকাপয়সা চেয়েছি তোর কাছে? এত মেয়েছেলে জোগাড় করে দিয়েছি একসময়, তার পরিবর্তে কিছু বলেছি যে, দে আমায়? টাকাপয়সার কথা উঠছে কেন? তবে হ্যাঁ, টাকাপয়সা আমার দরকার। কিন্তু তোর থেকে নয়। তোর কোম্পানির থেকে দরকার।’

‘মানে?’ আদি অবাক হয়ে গিয়েছিল, ‘একবার বলছিস টাকা চাইছিস না, আবার বলছিস টাকা চাইছিস। কেসটা কী বল তো? গাঁজামদ ধরেছিস নাকি?’

‘ক্রিকেট ম্যাচ করবি?’ আবেশ পাত্তা না দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।

‘মানে? ম্যাচ? কীসের?’ অবাক হয়েছিল আদি।

‘বললাম তো, ক্রিকেট। করবি? এখানে, নর্থ চব্বিশ পরগনায়। হেল্‌প আর্থ-এর সঙ্গে জয়েন্টলি।’

‘দাঁড়া, দাঁড়া,’ আদি থামিয়ে দিয়েছিল, হেল্‌প আর্থ, মানে তো এই রাহি বলে মেয়েটিদের সংস্থা। না?’

‘ঠিক ধরেছিস। মানে আমি যেখানে কাজ করি আর কী!’

‘তা ওদের সঙ্গে ম্যাচ করলে জমি দিয়ে দেবে?’

‘দিতেও পারে।’ আবেশ হেসেছিল।

‘একটা ম্যাচের খরচ জানিস? মানে বড় স্টার প্লেয়ারদের আনার খরচ জানিস? পড়তায় পোষাবে?’

‘সে জানি না, তবে করলে বলিস।’

‘দেখ আমার তো মনে হয়, এটা ভায়াবেল নয়। একটা ব্যক্তিগত প্রপার্টি আমরা তো জোর করে নিতে পারি না। আর প্রপার্টিটা এ অঞ্চলের একজন প্রভাবশালী মানুষের। এমন নয় যে, গরিব কৃষক, তার থেকে চাপ দিয়ে নিয়ে নিলাম। বরং তেমন করতে গেলে হাত পুড়বে। আর গৌর স্যার ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়ানোর জন্য খরচ করতে পারে, এ জন্য এত খরচ করবে না।’

‘কিন্তু তোদের কত টাকা ওই জমিটার জন্য আটকে আছে বল।’

আদি হেসেছিল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, ধর ম্যাচ হল। কিন্তু রাহির কথায় রাঘববাবু জমিটা দিয়ে দেবেন আমায়? এত সস্তা?’

‘সে দায়িত্ব আমার। সেজন্যই তো আমায় টাকা দিবি তোরা, না?’

‘শালা, হারামিই রয়ে গেলি,’ আদি হেসেছিল, ‘তুই কী করবি শুনি?’

‘জাদুকর কেন দর্শকদের থেকে আলাদা বল তো?’

‘কারণ সে জাদু জানে, দর্শকরা যা জানে না।’

‘ঠিক বলেছিস। দর্শকরা জাদুর ট্রিক্‌সগুলো জানতে চায়। তারা সুযোগ পেলে জাদুকরের সামনে অনুনয়-বিনয় পর্যন্ত করে। কিন্তু জাদুকর কি ম্যাজিক শেখায় তাদের, শেখায় না। কারণ ম্যাজিকটাই জাদুকরের গুরুত্ব। তার সম্মান। তার সম্ভ্রম আদায়ের জায়গা। সে জানে দর্শক ম্যাজিকের ট্রিক্‌স জেনে যাওয়ামাত্র জাদুকরকে আর পাত্তা দেবে না। অর্থাৎ জাদুকর তার সম্মান, গুরুত্ব হারাবে। তার বেঁচে থাকার মেরুদণ্ডটাই চলে যাবে। তাই জাদুকর কাউকে কিচ্ছু শেখায় না। নেভার গিভ অ্যাওয়ে ইয়োর সিক্রেটস। আদি, তুই কী করে ভাবলি আমি তোকে বলে দেব আমার ট্রিকটা! বলব না গুরু, বলব না। করলে বল, না করলে যা বললাম ভুলে যা। কেমন?’

তা ভুলেই একরকম গেছে আদি। একটা এত বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি কোনওদিন এমন একটা লোকের ভরসায় বসে থাকতে পারে! না বসে থাকবে? তাও এমন লোক যে সব কিছু ঝেড়ে কাশছে না। তাই আবেশের কথায় গুরুত্ব দেয়নি আদি। শুধু, ‘ঠিক আছে, দেখছি,’ বলে চুপ করে গিয়েছিল।

আদি জানে, কলকাতা কেন্দ্রিক একটা টুর্নামেন্ট করে যে-প্রচার আর লাভ মার্চেন্ট করতে পেরেছে, তা উত্তর চব্বিশ পরগনায় করা সম্ভব নয়। এখন যদি এখান থেকে লাভ বা নজর টানতে হয় তবে অনেক বড় বড় প্লেয়ারদের হায়ার করে আনতে হবে। যা একদমই অসম্ভব। মার্চেন্ট অত খরচ আর এখন করবেই না। ফলে গৌরকে গিয়ে বললে আদি ঝাড় খাবে খুব।

তবে এখন ভদকার প্রভাবেই কিনা কে জানে, আদির মনে হচ্ছে, খুব একটা খারাপ কথা বলেনি আবেশ। তবে ব্যাপারটাকে আরও ঠিকভাবে প্রেজেন্ট করতে হবে। আরও ডাউন সাইজ করতে হবে। তা হলে একটা সম্ভাবনা বের হলেও হতে পারে।

দাম মিটিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল আদি। শীত যাই যাই করছে শহর থেকে। বরং বসন্তের অদ্ভুত একটা হাওয়া বইছে এখন। পার্ক স্ট্রিট ক্রমশ নির্জন হচ্ছে। আর আলোর ঝলমলানিও কেমন যেন ম্লান লাগছে আদির। কোথায় যাবে যেন এখন ও? বাড়ি? সেখানে কে থাকে? বাবা? মা? এরা কারা? কেমন দেখতে হয় এদের? কতদিন একসঙ্গে কুড়িটা শব্দ বলেনি এদের সঙ্গে? মাথাটা টিপটিপ করছে আদির। নৌকোর দুলুনি বাড়ছে।

বাড়িতে কাজ হচ্ছে এখন। ওপরে ঠাকুরমার তলাটার পাঁচটা ঘরের তিনটে ঘর খোলা বলে সেখানে মেঝেতে মার্বেল বসাচ্ছে বাবা। দেওয়ালে প্লাস্টিক পেন্ট করাচ্ছে। বাকি দুটো ঘর করাতে পারছে না বলে খুব রাগ বাবার। কারণ ঘর দুটো তালাবন্ধ আর চাবি দাদাভাইয়ের কাছে। বাবার ইচ্ছে পুরো বাড়িটা দখল করার। দাদাভাইকে ইতিমধ্যে ফোন করে বাবা বলেওছে যে, এসে যেন সইসাবুদ করে সম্পত্তি ছেড়ে দেয়। যদিও দাদাভাই আসেনি। বাবা মাঝে মাঝেই এই নিয়ে একা একাই রাগ করে। চিৎকার করে। বলে লম্পট ছেলেটাকে হাতের কাছে পেলে জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দিতে ইচ্ছে করে।

আদি জানে না, দিঘি কেন অমন করেছিল। অন্তত আদি তো জানে দিঘি বা ওর ওই সুবর্ণ বলে ছেলেটা যাই বলুক, সত্যিটা কী। আদি নিজের চোখের চেয়ে তো আর কাউকে বেশি বিশ্বাস করে না। সত্যিই দাদাভাই মানুষটা যেন কেমন। এমন অপবাদ মাথায় নিয়েও কেউ এরকম চুপ করে থাকতে পারে? হয়তো দিঘির বদনাম চায় না দাদাভাই। এ দেশে তো মেয়েদের নামে খারাপ কথা বলা সবচেয়ে সোজা। আর হয়তো সেই অপবাদের ভয়েই, দিঘির বাবা-মা চুপ করে থেকেছে। হয়তো ভেবেছে, কিগান তো চলেই গেছে আর এসব নিয়ে জলঘোলা করে লাভ কী?

তবে যাই হোক, দাদাভাই মানুষটা কিন্তু বদলায়নি। এখনও সেই ঘুড়ি পেড়ে আনা মানুষটাই রয়ে গেছে। সে বৃষ্টিতে আটকে পড়া অবস্থা থেকে আদিদের থাকার বন্দোবস্ত করে দেওয়ার ঘটনা বা আদির বিপদের কথা চিন্তা করে তাকে সাবধান করা। সবটাই সেই পুরনো দাদাভাই।

দক্ষিণী হাওয়ায় কেমন যেন ক্লান্ত লাগল আদির। কষ্ট হচ্ছে ওর। একটা অজানা কষ্ট শামুকের মতো গুটিগুটি করে হেঁটে বেড়াচ্ছে চারদিকে। ও মাথা উঁচু করে চাঁদটা দেখল। নানা বাড়িঘরের মাথা ছাড়িয়ে বাল্‌বের মতো জ্বলে রয়েছে আবছা আকাশে। তার ছোট্ট বাষ্পবৃত্ত কলকাতার পলিউশনে আবছা। বাষ্পবৃত্ত দেখতে অদ্ভুত লাগে আদির। চাঁদের চারপাশে হলুদ মাখনের মতো, গোল চাঁদকে ঘিরে থাকে ওই আভা। দেখলেই দাদাভাইয়ের কথা মনে পড়ে আদির। মনে হয় আদি এত বড় হয়ে গেলেও সমস্ত রকম শাস্তি থেকে আদিকে রক্ষা করতে আজও দাদাভাই সমান তত্পর। সে বাবার থেকে পাওয়া শাস্তিই হোক, বা চমক চক্রবর্তীর স্থির করা শাস্তিই হোক।

চমক! নামটা প্রথম দিন শুনেই খুব অদ্ভুত লেগেছিল আদির। কিন্তু কোনওদিনই তেমন সম্মুখসমরে নামতে হয়নি। তবে চমক যে ওর ওপর খুশি নয় সেটা ও জানে। কিগানই ওকে বলেছে।

সেদিন অফিসের সামনে নেমে ও ভেবেছিল মালিনীর সঙ্গে কথা বলে ওর রূঢ় ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেবে। কিন্তু মালিনী এত রেগে ছিল যে, প্রায় দৌড়ে অফিসে ঢুকে গিয়েছিল। আদি ভেবেছিল পিছন পিছন যাবে। কিন্তু পারেনি। কিগান ওকে ডাক দিয়েছিল।

‘বিপদ?’ প্রথমে ঠিক বুঝতে পারেনি আদি। কীসের বিপদের কথা বলছে কিগান? কিগান বলেছিল, ‘তোর ওপর চমক খুব রেগে আছে। বলেছে ত্রয়ণের সঙ্গে জমি নিয়ে ডিল করতে গেলে তোকে দেখে নেবে।’

‘ত্রয়ণের সঙ্গে?’ আদি অবাক হওয়ার ভান করেছিল। বলেছিল, ‘দাদাভাই, তুই ভুল করছিস, ত্রয়ণের সঙ্গে জমি নিয়ে কোনও ডিল আমার হয়নি।’

‘আমার ঠিক ভুলের ব্যাপার নেই,’ কিগান ম্লান হেসেছিল, ‘চমকের ধারণা হয়েছে। নিশ্চয়ই তোকে আর ত্রয়ণকে দেখেছে একসঙ্গে।’

‘ত্রয়ণ তো পার্টির ছেলে। বারাসতের প্রজেক্টে বাগড়া দিচ্ছে বলে কথা বলছিলাম।’

‘চমক ভাবছে ওদের জমির ব্যাপারটা কেন ত্রয়ণকে বলা হবে। তোকে মারবে বলেছে। খুব সাবধানে থাকবি।’

হেসেছিল আদি, ‘তুই তো ভিতু নোস। তবে এমন করছিস কেন? আমি ত্রয়ণকে কিছু বললে তো জানতেই পারতিস। আর চমক কি তবে ছেড়ে দিত আমায়? এতদিন যখন কিছু করেনি, জানবি, কিছু করবে না। তুই টেনশন করিস না। বুঝলি?’

‘তবু, মানে…’ কিগান বলেছিল, ‘ভয় হয় রে আদি। এত খারাপ দেখছি সারা জীবন যে ভয় হয় খুব। কষ্ট হয়। জানি এভাবে তোকে আগ বাড়িয়ে বলাটা হয়তো বাড়াবাড়ি হচ্ছে, তবু, চিন্তা হয়, জানিস?’

‘না, না’, আদির অপ্রস্তুত লাগছিল, এ মানুষটার কাছে ও চিরকাল হাত পেতে দাঁড়িয়েছে। আর সেই মানুষটাই যদি এমন সংকুচিত হয়ে কথা বলে, তবে কার ভাল লাগে! ও বলেছিল, ‘এমন কেন বলছিস দাদাভাই? তুই তো আমায় বলতেই পারিস। যখন যা ইচ্ছে হয় বলতে পারিস। সারাজীবনই পারিস।’

‘সারাজীবন?’ কিগান অপ্রস্তুত চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়েছিল। বলেছিল, ‘আসলে আমাদের জীবন তো আর একরকম নেই। তাই মানে, আমার জন্য হয়তো তোদের অনেক ঝামেলা আর অপমান সহ্য করতে হয়েছে।’

‘না, না। তুই ওসব বাদ দে।’ আদি পালাতে চাইছিল ওখান থেকে। এসব একদম ভাল ট্যাকল করতে পারে না ও। তা ছাড়া, আদির কেবল মনে হচ্ছিল যে সত্যিটা জেনেও তো ও কিগানকে বাঁচায়নি। ওর পাশে দাঁড়ায়নি। সারা জীবন যে-মানুষটা ওর জন্য চিন্তা করল, ওর দোষ ঢাকার চেষ্টা করল, তাকে তো কোনওরকম সাপোর্টই করেনি আদি। না, কিগান হয়তো জানত না যে, আদি জানে অনেক কিছু। কিন্তু আদি নিজে তো জানে। তাই নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী লাগছিল ওর। মনে হচ্ছিল কিগানের সামনে দাঁড়ানোর কোনও মুখ নেই আর।

‘তুই ভাল আছিস তো?’ কিগান হয়তো আদির চোখেমুখে অপ্রস্তুত ভাব দেখে সামলে নিয়েছিল নিজেকে।

‘আছি। তুই?’ আদি ব্যস্ততা বোঝানোর জন্য ঘড়ি দেখেছিল।

‘ও, তোর বোধহয় দেরি হচ্ছে, সরি। আসলে চমক খতরনাক ছেলে। তারপর আমায় ডাইরেক্ট বলল তো! তাই তোকে বললাম আর কী!’

‘তুই চিন্তা করিস না। কিচ্ছু হবে না,’ আদি আশ্বস্ত করেছিল।

কিগান যাওয়ার আগে তবু বলেছিল, ‘শোন, যদি কিছু এদিক ওদিক বুঝিস, নির্দ্বিধায় আমাকে বলবি। একদম চুপ করে থাকবি না। জাস্ট আমায় জানাবি। কেমন? কক্ষনও চেপে রাখবি না। বুঝলি, আমি যাই হই না কেন, আজও তোর দাদাভাই।’

চাঁদের দিকে তাকাল আদি। কলকাতার সিলিং-এ আটকে আছে একটা ফ্লুরোসেন্ট বেলুন। ওর মনে হল একটা চাঁদের তলায় কত মানুষ বেঁচে আছে আলাদা আলাদা। দাদাভাই বেঁচে আছে। বাবা বেঁচে আছে। ও বেঁচে আছে। এমনকী, মালিনীও বেঁচে আছে।

‘মালিনী!’ আচমকা নামটা মাথায় আসতেই পেটের ভেতর ফড়িং উড়ল যেন। চাঁদ নিয়ে মালিনী অদ্ভুত একটা কথা বলেছিল না?

মালিনীর সঙ্গে সেই ঝামেলার পর, ও কেমন যেন দূরে দূরে থাকে এখন। আদি যতই কাছে যেতে চায় ততই যেন সরে যায় দূরে। কাজের জন্য যতটুকু বলার ঠিক ততটুকুই বলে। গোল্ডিজ-এও আর আসতে দেয় না আদিকে। এক গাড়িতে করে ঘুরলেও এমন মুখ করে বসে থাকে যেন দু’জনের মধ্যে দেওয়াল আছে একটা। এই যে ওরা একসঙ্গে চাপাডাঙায় ছিল দু’মাস আগের সেই দিনটায়, সেখানেও তো আদি চেষ্টা করেছিল বরফ ভাঙার। কিন্তু পারল কই?

সেই শীতের বৃষ্টির দিনটা অদ্ভুত ছিল। সন্ধেবেলা ওই বিরাট বড় বাড়িটার পিছনের রাস্তায় ছাতা মাথায় একা একা হাঁটতে থাকা মালিনীকে ধরেছিল আদি। ও অবাক হয়েছিল। এমন বৃষ্টির ভেতর কেন ঢাউস ছাতা মাথায় নির্জন রাস্তাটায় হাঁটছে মালিনী?

বাড়ির সীমানার ভেতর পাথর দিয়ে বাঁধানো এমন যে একটা রাস্তা থাকতে পারে তা কোনওদিন ভাবতেই পারেনি আদি। সাদা আর গোলাপি পাথর বাঁধানো রাস্তার পাশে হলুদ ঘোমটা দেওয়া আলো। গোটা চাপাডাঙার চেয়ে ওই জায়গাটা উঁচু বলে জল জমে না। আর সেখানে রং-বেরঙের বড় ছাতাটা নিয়ে হাঁটতে থাকা মালিনীকে কেমন যেন অন্য গ্রহের মনে হচ্ছিল আদির। একটা মেয়ের জন্য যে, ওর মনে এমন কষ্ট হতে পারে তা ভাবতেই পারছিল না আদি। মনে হচ্ছিল কেন হল এমন? এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। কত মেয়ের সঙ্গে তো সম্পর্ক হচ্ছে আদির, কিন্তু কেউ তো কষ্ট দিতে পারেনি ওকে। সেই যাজ্ঞসেনী আইয়ারের জন্য পাওয়া কাঁচা বয়সের কষ্ট যেন আবার লক্ষ গুণ বেশি হয়ে ফিরে এসেছিল আদির মধ্যে। ও রাহির থেকে একটা ছোট্ট ছাতা নিয়ে পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল মালিনীর পাশে। মালিনী সামান্য অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।

‘হাই,’ আদি কথা শুরু করেছিল।

‘এমন বৃষ্টি। বাড়ি যেতে পারলাম না। গ্র্যানি যে কী করছে!’

‘তুমি ফোন করে দাওনি?’ আদি মালিনীর সহজ গলা দেখে উৎসাহিত হয়েছিল।

‘করেছি, তবু গ্র্যানি ভাববে। কিন্তু যা ওয়েদার কিচ্ছু করারও তো নেই।’

‘ঠিক বলেছ,’ আদি নরম গলায় সমর্থন করেছিল। তারপর বলেছিল, ‘একটা কথা বলব?’

‘বলো,’ সহজ গলায় বলেছিল মালিনী।

‘তুমি এতদিন ধরে রাগ করে থাকতে পারো কীভাবে?’ কথাটা বলে সামান্য হেসেছিল আদি। ও চাইছিল পরিস্থিতি যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে নিতে।

‘রাগ? কেন?’ মালিনী ছাতাটা সামান্য তুলে ধরে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।

‘আমার সঙ্গে কথা বলো না তো আজকাল!’

‘বলি তো। কাজের সমস্ত কথা যতটা সম্ভব বলি,’ মালিনীর গলাটা তখনও ভীষণ সহজ আর স্বাভাবিক ছিল।

‘না, মানে…আগে যেভাবে বলতে…সেভাবে…’

হঠাৎ মালিনী পায়চারির অবস্থা থেকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, ‘কীভাবে? আমি জানি যে, আমাদের রিলেশন স্ট্রিক্টলি অফিশিয়াল।’

‘মানে?’ আদির অবাক লেগেছিল।

‘মানেটা খুব সোজা। আমাদের ওয়র্ক প্লেস এক। আমরা কলিগ।’

‘শুধু তাই?’ আদির বুকের ভেতরের পারদটা বাড়ছিল ক্রমশ।

‘ঠান্ডা পড়েছে। এমন বৃষ্টি। তোমার অল্পতেই সর্দি লাগে। তুমি ভেতরে যাও।’

‘আমার কথার উত্তর দিলে না কিন্তু। তা ছাড়া তোমার ঠান্ডা লাগবে না?’

‘আদিত্য, উত্তর দেওয়ার কিছু নেই। আমি শুধু ওয়র্ক এথিক্‌স মেনটেন করছি।’

আদির ওই ডিসেম্বরের ঠান্ডাতেও মাথা দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছিল। ও বলেছিল, ‘তুমি এমন করছ কেন? মাথা গরম করে কী বলেছি সেটাই বড় হল তোমার কাছে? আর বাকি সব ফালতু, না? আমি ফালতু, না?’

বৃষ্টির রাস্তাটা পাশের নরম আলোর জন্য কেমন মায়াময় লাগছিল। রাস্তাটা বাড়ির কম্পাউন্ডের মধ্যেই অনেকটা ঘুরে এঁকেবেঁকে বসানো। সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল ওরা। ডিসেম্বরের ঠান্ডা হাওয়া বৃষ্টির জন্য আরও ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। শরীরে ছোট বাচ্চাদের দাঁতের মতো নরমভাবে কামড় বসাচ্ছিল।

‘তুমি ভেতরে যাও। ঠান্ডা লেগে যাবে,’ কথার উত্তর না দিয়ে বলেছিল মালিনী।

‘তোমার ঠান্ডা লাগছে না? তুমি কেন বাইরে ঘুরছ? আদির রাগ বাড়ছিল।

‘আমাদের পাহাড়ে খুব ঠান্ডা পড়ে। এখানে আমার অসুবিধে হচ্ছে না।’

‘তুমি কেন এমন রোবটের মতো কথা বলছ? গত মাসে তো বাড়ি গিয়েছিলে, তার পরও মন ভাল হয়নি? আচ্ছা ঠিক আছে,’ উত্তেজনায় আদি মালিনীর ছাতার হাতলটা চেপে ধরেছিল, ‘আমায় তুমি ক্ষমা করে দাও।’

‘ক্ষমা? কেন?’ মালিনী অবাক চোখে তাকিয়েছিল, ‘তুমি এমন বোলো না। তুমি আমার কলিগ। তোমার মনে হয়েছে যে, আমার কাজে খুঁত আছে তাই আমায় বকেছ। আমি মাইন্ড করিনি কিছু। আর হ্যাঁ, গত মাসে আমি রাবাংলা গিয়েছিলাম বটে। আর আমার মনও যথেষ্ট ভাল আছে।’

আদি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল মালিনীর দিকে। যেন নিরেট লোহার তৈরি একটা মেয়ে। এমন নিষ্ঠুর হতে পারে মালিনী? রাগের মাথায় অত মাস আগে কী বলেছিল সেটা ধরে বসে রয়েছে এখনও? এ মেয়েকে কী করে বোঝাবে ও? কী করে বোঝাবে কতটা ভালবাসে আদি? কতটা অসহায় বোধ করে ও মালিনীকে ছাড়া?

‘আর কিছু বলবে?’ মালিনী কঠিন মুখ করে তাকিয়েছিল।

আদি ক্লান্ত গলায় বলেছিল, ‘বলছি তো। কিন্তু তুমি তো শুনছ না কিছু। জানো, আমি কোনওদিন কারও সামনে এতটা ছোট হইনি!’

‘ছোট!’ মালিনী ভুরু তুলেছিল, ‘তা হচ্ছ কেন? আমি তো বলিনি হতে।’

‘তা বলোনি। কিন্তু…’ আদি কথা খুঁজে পাচ্ছিল না।

‘আমায় একটু একা থাকতে দেবে? প্লিজ।’

আর দাঁড়ায়নি আদি। মাথা নিচু করে পাথরের রাস্তা দিয়ে ফিরে এসেছিল ঘরে। শুধু আসতে আসতে একবার মাত্র তাকিয়েছিল পিছনে ফিরে। দেখেছিল, তুমুল বৃষ্টিতে, পাথরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে মালিনী। বৃষ্টিতে আবছা অবয়বটা কেন যেন অপার্থিব আর দূরের মনে হচ্ছিল আদির। মনে হচ্ছিল মালিনী এক দ্বীপখণ্ড। কিন্তু তাতে পৌঁছোনোর কোনও উপায় আদির আর জানা নেই।

এই ঘটনার পর মালিনী যেন চুপ করে গিয়েছিল আরও। যেন আরও ‘প্রয়োজন ছাড়া কথা বলব না’ ধরনের হয়ে গিয়েছিল। ক্রমশ মন ভাঙছিল আদির। কাজে প্রভাব পড়ছিল। একদিন আর না পেরে দুটো পয়েন্ট ফাইভ ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিয়েছিল। তবু ঘুম আসেনি। শুধু মাথার ভেতরে একটা ভুতুড়ে বাড়ি জেগে উঠেছিল ক্রমশ। মনে হচ্ছিল আর পারবে না। এবার ঠিক মাথার ভেতরটা ফেটে যাবে। ঠিক মরে যাবে। মালিনী তখন বুঝবে, আদি ওর জীবনে কী?

একদিন রাতে তাই আচমকাই মালিনীকে ফোন করেছিল আদি। কোনও কারণ ছিল না। এমনিই রাতে ছাদে পায়চারি করছিল একা একা। হঠাৎ চাঁদটা, তার লেবু রঙের আলো আর শীতের হাওয়া এসে উলটোপালটা করে দিয়েছিল মনটা। ও সাত পাঁচ না ভেবেই ফোন করে দিয়েছিল। চারপার রিং হওয়ার পর গলাটা শুনতে পেয়েছিল আদি। নরম পালক খসে পড়ার মতো শান্ত কিন্তু নিশ্চিত আওয়াজ।

‘হ্যালো, কোনও দরকার আছে?’

‘আমি পাগল হয়ে যাব মালিনী। এমন জ্যোৎস্নায় আমি পাগল হয়ে যাব,’ কোনওরকমে কথাগুলো বলেছিল আদি।

‘এসব বলছ কেন?’ খুব কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করেছিল মালিনী।

‘একবার চাঁদটাকে দেখো। একবার দেখো। দেখো, ওটা তোমার দৃষ্টির সঙ্গে যোগ করাচ্ছে আমার দৃষ্টিকে। তোমার মনের সঙ্গে যোগ করাচ্ছে আমার মনকে। মহাবিশ্ব এই স্যাটেলাইট শূন্যে ছেড়ে রেখেছে শুধু আমাদের দু’জনের মধ্যে যোগাযোগ করানোর জন্য। তুমি দেখো, তুমি একটি বার দেখো,’ প্রায় ভিখিরির মতো করে বলেছিল আদি।

‘তুমি দেখো। ভাল করে দেখো। তাকাও। চাঁদটার দিকে তাকাও ভাল করে আদি।’ মালিনী যেন আদেশ দিয়েছিল।

‘হ্যাঁ, তাকিয়েছি তো। তাকাচ্ছি তো,’ করুণ গলায় বলেছিল আদি।

‘এটা একটা স্যাটেলাইট আদিত্য। ওর আলোটা নিজের নয়। ওটা একটা ড্রাই, ডাস্টি বডি। ওটা তোমাকে আমার সঙ্গে যোগ করছে—হয়তো এটাই বলতে চাইছ। তবে শোনো এটা স্যাটেলাইট তো, তাই একটা ওয়র্ক স্টেশনের সঙ্গে আর-একটা ওয়র্ক স্টেশনের সম্পর্ক ঘটাচ্ছে শুধু। আর কিছু নয়। ডোন্ট ফ্যান্টাসাইজ। একটা সামান্য স্যাটেলাইটকে গ্লোরিফাই করার মানে নেই। বাই, গুড নাইট।’

পাথুরে, শুকনো আর পরের আলো ধার করে বেঁচে থাকা বুদ্ধুটার দিকে আর একবার তাকাল আদি। কলকাতার মাথার ওপর জ্বলে আছে। যেন ভোল্টেজ কম হওয়ার পরে জ্বলে থাকা জন্ডিস রোগীর চোখের মতো বাল্‌ব। আদির অপরিষ্কার মাথাটার মনে হল, তবু ওটাকে সুন্দর লাগছে কেন? লাগে কেন? এত হাজার হাজার বছর ধরে সব্বাই ওর দিকে তাকায় কেন?

আদির পা দুটো কেমন যেন বেয়াড়াপনা করছে। কোনও কথাই শুনছে না। কলকাতাকে ক্রমশ কেমন যেন শঙ্কু আকৃতির কোনও ফানেলের মধ্যে দিয়ে দেখতে পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে ওর। গাড়ি-ট্যাক্সিগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে ওর। উলটো হয়ে যাচ্ছে যেন।

হঠাৎ বুকপকেটে ফোনটা দুটো ছোট্ট পিংপিং শব্দ করে নড়ে উঠল। মেসেজ। এখন মেসেজ? নিশ্চয় সার্ভিস প্রোভাইডার। না হলে এমন রাতে কে মেসেজ করবে ওকে? কার দায় ঠেকেছে?

অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেসেজটা কাঁপা হাতে খুলল আদি। আর দেখামাত্র বুক কেঁপে গেল ওর। রুহানের ম্যাসেজ। লিখেছে: Malini’s Granny Hospitalised. Nurs, Holy Grass, Triangular Park ITS urgent.

হসপিটালে গ্র্যানি! মালিনীর। আর মালিনী রুহানকে সেটা জানাতে পেরেছে, আদিকে পারেনি! কত দূর গেছে মালিনী? আর কত অপমান করবে ও আদিকে? এখন রুহানের মেসেজ থেকে ওকে জানতে হচ্ছে এমন একটা খবর! আদির চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। ও কোনও রিপ্লাই করল না। চুপ করে রইল শুধু। সেলটা বন্ধ করে মনে মনে বলল, যাবে না ও। মালিনী কী ভেবেছে, ওরই শুধু রাগ আছে? আদি ফালতু, ফেলনা? ওর রাগ হতে পারে না? আদি যাবে না। তাতে যা হওয়ার হোক, ও যাবেই না। মালিনী সিংহও বুঝবে আদিত্য ব্যানার্জি কে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *