২৬
আচমকা গত সাতদিন ধরে শীত পড়েছে কলকাতায়। সামনে সরস্বতী পুজো। অন্যান্যবার এসময় এতটা ঠান্ডা পড়ে না। কিন্তু এবার হঠাৎই শীত পড়ল। যদিও মাঘ মাস, তবু বাঘের গায়ে কাঁটা ধরিয়ে দেওয়ার মতো ঠান্ডা আর পড়ে না আজকাল। শীতকাল যেন শুধু লোকগাথায় আর যশ চোপড়ার ছবির লোকেশনের ভেতরেই আবদ্ধ হয়ে আছে। তাই গত সপ্তাহ ধরে নেমে আসা আচমকা ঠান্ডায় জিয়ানা বেশ অবাকই হয়েছে।
যখন বিদেশে থাকত, তখন ও ভাল করে টের পেয়েছে, কাকে শীত বলে। আর এখানে ঠান্ডা লাগেই না ওর। তবে এই যে হঠাৎ ঠান্ডা, এটা বেশ উপভোগ করছে জিয়ানা।
শীতে কলকাতা বেশ রঙিন হয়ে ওঠে। গাড়িতে বসে চারদিকে নানা রঙের রং দেখতে পাচ্ছে জিয়ানা। দূরে পেনসিলের মতো শহিদ মিনারের মাথার ওপরও শেষ আলোর রঙে সন্ধে হচ্ছে। দিন নিভে আসছে শহরে।
আজকাল কখনও কখনও চাপাডাঙায় যেতে হয় জিয়ানাকে, তাই খুরানা ওর জন্য গাড়ি দিয়েছেন। ফলে নিজের গাড়িটা বের করে শুধুমাত্র শহরে থাকলে। আজ যেমন শ্যামবাজারের কাছে কনসালট্যান্টদের অফিসে মিটিং ছিল বলে নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিল। মিটিং সেরে এখন অফিসে ফিরছে জিয়ানা। খুরানা অপেক্ষা করছে ওর জন্য।
এই মার্চেন্ট মাল্টিপল্সের কাজটা নিয়ে প্রথম থেকেই নানা ধানাইপানাই চলছে। এই কাজ হচ্ছে, তো এই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই মনে হচ্ছে এবার প্রাইস ফাইনালাইজ হবে, তো তারপরেই আবার আটকে যাচ্ছে। আসলে জমি নিয়ে একটা সমস্যা হচ্ছে বলে প্রজেক্ট আটকে আছে। কিন্তু এবার খুরানা বলছেন যে কাজ হবেই। খবর নাকি আছে যে, মার্চেন্ট মাল্টিপল্স এবার পুরো ঝাঁপিয়ে পড়েছে প্রজেক্টের জন্য। জার্মান কোন এক কোম্পানির সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে যাচ্ছে ওরা। আর সেই জার্মান কোম্পানি নাকি বলেছে যে চাপাডাঙার এই প্রজেক্ট আর তার সঙ্গে ঝামেলা না মিটলে তারা কাজ করবে না। কারণ, মার্চেন্টের রেপুটেশন যদি খারাপ হয়, তার প্রভাব পড়বে ওদের ওপর। প্রজেক্টের প্রচুর ইন্সট্রুমেনটেশনের কাজ রয়েছে। তার স্পেসিফিকেশনের জন্য গন্ডগোল হচ্ছে। আর তাই নিয়ে আজ একটা ডিসকাশন ছিল জিয়ানার সঙ্গে ওদের। মিটিং-এ ললিতও ছিল। তবে মিটিং থেকে বেরিয়ে ললিত চলে গিয়েছে সুকিয়া স্ট্রিটে নিজের পার্সোনাল কীসব কাজ আছে বলে। দিঘি নামে যে-মেয়েটার সঙ্গে একবার একটা পার্টিতে আলাপ হয়েছিল, তারা থাকে সেখানে। তাদের কীসব প্রবলেম হয়েছে যেন। ললিত ডিটেলে কিছু বলেনি, আর পারিবারিক ব্যাপার বলে জিয়ানাও জোর দিয়ে কিছু জানতে চায়নি। তবে ললিতের মুখচোখ দেখে মনে হচ্ছিল যে সমস্যাটা গুরুতর।
আজ রুহান নেই সঙ্গে। বম্বে রোডের ওপর একটা কাজ চলছে। তার জন্য কিছু মাল দিয়ে ওকে পাঠানো হয়েছে সাইটে। আসলে রুহানের ওর সঙ্গে থাকাটা অফিসের অনেকেই ভাল চোখে দেখছে না। ললিত বলছিল ওকে। বলছিল, ‘জিয়ানা, তুমি রুহানকে অন্য কাজের জন্যও ছাড়ো মাঝে মাঝে। অফিসে এই নিয়ে কথা হচ্ছে।’
‘কথা হচ্ছে? মানে?’ জিয়ানা সেদিন নিজের ডেস্কে বসে একটা ফাইল ওলটাচ্ছিল। ফাইলটা বন্ধ করে ও অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ললিতের দিকে।
‘মানে, অন্যরা একটু ডিসকাস করছে এই নিয়ে। বলছে যে, চামচা ছাড়া নাকি জিয়ানা আজকাল নড়তে পারে না।’
‘চামচা! আর তুমি সেসব আমায় বলছ?’
‘শোনো, ভালর জন্যই বলছি। এই যে বেশ কিছুদিন আগে প্রায় গোটা সেল্স টিমটাকে ওয়াটার বার্ডস ছোঁ মেরে তুলে নিল, তাতে খুরানার ওপর ভাল চটেছে বোর্ড অব ডাইরেক্টর্স। তারপর গত এক বছরে নতুন রিক্রুটরাও ভাল কাজ করতে পারছে না। বিজনেস ফল করেছে। সব মিলিয়ে অবস্থা ভাল নয় একদম। তার কোপটা এসে কিন্তু প্রথমে পড়বে খুরানা তারপর অন্যান্যদের ওপর।’
‘মানে? কোপ মানে?’
‘মার্চেন্টের এই কাজটা না পেলে কিন্তু কপালে দুঃখ আছে। খুরানা আর আমাদের ওপর চাপ আসবে পুরোটা, কারণ কাজটা পারস্যু করছি আমরা।’
‘তো? এই কাজগুলো তো লাইক গেম। ইউ উইন সাম, ইউ লুজ সাম।’
‘আমাদের লুজটা একটু বেশিই হচ্ছে কিনা, তাই সমস্যাটা বেশি।’
‘তো? উপায়?’ জিয়ানা একটু অবাক হয়েছিল।
‘জানো তো, খারাপ সময়ে ছোটখাটো জিনিসগুলোকেও বড় করে দেখানো হয়। তাই বলছি আপাতত রুহানকে একটু ঢিলে দাও। তারপর কাজটা পাওয়ার চেষ্টা করো।’
কলকাতার সিগনালগুলো খুব অদ্ভুত হয়। অনেকক্ষণ ধরে এক রং নিয়ে প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে থাকে। যেমন লাল আলোটা তখন থেকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টে। ফুটপাথের কোনায় তারের জালের একটা খুপরিতে বসে থাকে ট্রাফিক পুলিশ। সেও কি ঘুমিয়ে পড়ে? জিয়ানার গাড়ি নিয়ে সিগনালে আটকালেই রাগ হয়। আর তারপর সিগনাল পেলেও আর-এক সমস্যা। এই শহরটার লোকজন এত ব্যস্ত যে, এক ফুটপাথ থেকে অন্য ফুটপাথে পৌঁছোনোর জন্য এরা আকুল হয়ে ওঠে। তাই চলন্ত গাড়ির ফাঁকফোকরের মধ্যেও লোকজন প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের গুঁজে দেয়। এই ধাক্কা লেগে যায় লেগে যায় অবস্থা। কলকাতায় গাড়ি চালানো যে কী সমস্যা তা বোঝে জিয়ানা। কনসেনট্রেট করতে করতে মাথা পুরো ধরে যায়।
সিগনালটা এতক্ষণে খোলা পেল জিয়ানা। গাড়িটা নিয়ে কাটাতে কাটাতে এগোতে লাগল কলকাতার ভিড়ে। কষ্ট হয় জিয়ানার, কেন জানে না কিন্তু আজকাল স্ট্রেস নিতে কষ্ট হয় খুব। গাড়ি চালানোটা ওর কাছে একটা স্ট্রেস। কিন্তু বুকুর কাছে নয়। ও গাড়ি চালাতে খুব ভালবাসে। এবার একটা হুডখোলা গাড়ি কিনতে চায়। কথাটা বুকুই বলেছে। আজকাল বুকু বেশ বদলে গেছে। কেমন যেন এলোমেলো আর মিশুকে হয়েছে আজকাল। সেই দিনের পর থেকে বুকুর ভেতর থেকে যেন একটা নতুন মানুষ বেরিয়ে এসেছে। আসলে বিয়ের পর থেকে বুকু তো এমন নয়। চিরকালই ও একটু গম্ভীর ছিল। কিন্তু সেই দিনটার পর বুকু পালটে গেছে।
মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে জিয়ানা কিন্তু প্রথমে বুঝতে পারেনি। বরং দরজার কাছে বুকুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল বুকু কি শুনে ফেলল কিছু? জেনে ফেলল কোনও কথা? জিয়ানা বুঝেছিল যে, নিজের সংসার ওর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
‘কী ব্যাপার?’ বুকু বিস্মিত হয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে।
‘না… মানে…’ মা ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছিল।
‘না, জিয়ানাকে আপসেট দেখাচ্ছে। আর আমার কী জানার ছিল?’
‘কিছু না, পেটি ম্যাটার্স’ জিয়ানা নিজেকে সামলে নিয়েছিল।
‘না, আই থিঙ্ক, সামথিং সিরিয়াস,’ বুকু স্থির হয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে।
‘না রে বাবা, তেমন কিছু নয়,’ জিয়ানা বিছানা থেকে উঠে আর দাঁড়িয়ে থাকেনি, আবার বেরিয়ে গিয়েছিল বারান্দায়।
তবে ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হয়নি। বাড়িতে ফিরে রাতে খাওয়া দাওয়ার পর শাশুড়ির ঘর থেকে ফিরে দেখেছিল বুকু ল্যাপটপ নিয়ে বসে ছিল বিছানায়। তুতুল অন্য দিন নিজের ঘরে শুতে যাওয়ার আগে কিছুটা সময় বুকুর সঙ্গে খেলা করে। কিন্তু সেদিন ঘোরাঘুরির জন্যই ক্লান্ত ছিল, আর তাই ঘুমিয়ে পড়েছিল আগে।
জিয়ানা শুতে যাওয়ার আগে প্রতিদিন কিছুটা সময় কাটায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে। কিন্তু সেদিন কাটায়নি। ফেসওয়াশ দিয়ে আগেই মুখ ধুয়ে এসেছিল। এবার শুধু ময়েশ্চারাইজার দিয়ে মুখটা আর্দ্র করে শুতে চলে গিয়েছিল বিছানায়।
বালিশে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করতে যাবে, ঠিক তখনই ও শুনেছিল বুকু বলছে, ‘নট সো ফাস্ট।’
‘মানে?’ জিয়ানা ঘুরে তাকিয়েছিল বুকুর দিকে।
বুকু ল্যাপটপটা বন্ধ করে পাশের টেবিলে রেখে একটা বালিশ কোলে নিয়ে বসেছিল। বলেছিল, ‘বলো এবার। আমার কী জানা উচিত।’
‘মানে?’ আবার প্রশ্ন করেছিল জিয়ানা।
‘হোয়াট ওয়্যার ইউ টকিং অ্যাবাউট। ডোন্ট থিঙ্ক আয়াম ডাম। তোমার মায়ের বাড়িতে কথা বাড়াইনি। কিন্তু এবার বলো। দশ বছরের বেশি বিয়ে হয়েছে আমাদের। কোন কথাটা জানা বাকি আমার?’
জিয়ানা বসে ছিল চুপ করে। এ যেন নতুন পরীক্ষা। এ যেন আবার সিন্দুকের চাবি খুলে বের করে আনা হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির ম্যাপ। যেন সেই ম্যাপ ধরে এগিয়ে যাওয়া জঙ্গল থেকে আরও গভীরতর জঙ্গলের দিকে।
‘কী হল আনা, বলো,’ বুকু স্থির গলায় বলেছিল, ‘দেখি, তোমায় নতুন করে জানতে পারি কিনা।’
‘কী বলব?’ জিয়ানা ঠিক গোছাতে পারছিল না নিজেকে।
‘তোমার মা অমন মুখ করে বসেছিলেন কেন আনা? তুমিই বা ছলছলে চোখে কেন তাকিয়েছিলে? কেন মাঝে মাঝেই তুমি আনমনা হয়ে যাও? কার কথা চিন্তা করে তোমার চোখে জল চলে আসে? মাঝরাতে কাকে মনে করে তুমি আঁকড়ে ধরো আমায়? তারপর ঘুম ভেঙে আমায় ছেড়ে দাও? কে অলক্ষ্যে রোজ তোমায় এসে দুঃখ দিয়ে যায় আনা? কাকে তুমি আমার থেকে লুকিয়ে রেখেছ? বলো আনা, বন্ধু হিসেবেই বলো। আমাদের যা হওয়ার ছিল হয়েছে। স্বামী বা স্ত্রী হওয়া আমাদের হল না। কিন্তু বন্ধু তো হওয়াই যায়, না?’
‘বন্ধু?’ জিয়ানা অবাক হয়েছিল, ‘তুমি তো একা থাকো। একা মানুষ। তুমি আমার বন্ধু হবে কেমন করে?’
‘আমি একা থাকি, ঠিক। কিন্তু জানো, একা থাকতে ভাল লাগে না আমার। কষ্ট হয়। আমি চিন্তা করে দেখেছি, আমরা যখনই কোনও আনন্দের স্মৃতির কথা ভাবি, সেটা কিন্তু কখনও কোনও একা উপলব্ধি করা ঘটনা হয় না। সবসময় সেটা অনেকের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া কোনও মুহূর্ত হয়। মুহূর্ত। এমন অসংখ্য মুহূর্ত দিয়েই তো জীবন, মানে সুস্থ জীবন, আনন্দের জীবন তৈরি হয় আনা। একা জীবন তো আনন্দের নয়। আমিও আনন্দে থাকি না। আজ তোমায়, মায়ের সঙ্গে অমন মুখ করে কথা বলতে দেখার পর সারাদিন অনেক ভেবেছি আমি। দেখলাম, স্বামী তো দূরের কথা, কিছুই হতে পারিনি আমি। তাই ভাবলাম, সবচেয়ে কঠিন জিনিসটা চেষ্টা করা যাক একেবারে। বন্ধু। বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করা যাক। জানি সবচেয়ে কঠিন এটা। কিন্তু বিনয়কৃষ্ণ বোস কবে সহজ জিনিস ট্রাই করেছে?’
অবাক হয়ে বুকুর দিকে তাকিয়েছিল জিয়ানা। এটা কি বুকু? ওর চেনা বুকু? এত কথা একসঙ্গে বলতে পারে ও? তাও এমনভাবে? ও বলেছিল, ‘কিন্তু কী বলব তোমায়?’
বুকু হেসেছিল সামান্য। গালে হাত ঘষে বলেছিল, ‘আচ্ছা, সহজ করে দিচ্ছি না হয়। আনা, কে সেই ছেলেটা?’
ধক করে উঠেছিল জিয়ানার বুকটা। আর-এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে পড়ে গিয়েছিল সেই নীল রঙের চোখ। উসকোখুসকো চুল। কুয়াশার ঝাঁঝরির মধ্যে মিলিয়ে যাওয়া গোলাপি মাফলার।
‘কে ছেলেটা জিয়ানা? কার কথা মনে করলে আজও কাঁদো তুমি?’
‘কাঁদি না বুকু। ইচ্ছে করে কাঁদি না। চোখে মাঝে মাঝে জল চলে আসে। সত্যি বলছি, ইচ্ছে করে নয়। এমনি আসে।’
‘তুমি ভালবাসতে তাকে?’
‘আমি?’ জিয়ানা টালুমালু চোখে তাকিয়েছিল বুকুর দিকে, ‘জানি না সঠিক। আসলে ও আমায় ভালবাসত খুব। আমারও ভাল লাগত। বেশ ভাল লাগত, কিন্তু…’ জিয়ানা অবাক হয়ে দেখছিল নিজেকে। কী চায় ও? বুকুর কাছে ভাল হতে? বুকু যাতে কষ্ট না পায়? নাকি তুতুলের জন্য এমন ডিপ্লোম্যাট হচ্ছে ও? কেন এমন রেখেঢেকে কথা বলছে?
‘কিন্তু?’ বুকু সামান্য হেসে ঝুঁকে বসেছিল, ‘কিন্তু কী আনা?’
‘আমি যদি ভালবাসতাম তবে তোমায় বিয়ে করতে রাজি হতাম না। আর জানো, আমি ভেবেছিলাম ও আমায় ভুলে যাবে। বিয়ে করে সংসার পাতবে। কিন্তু…’ জিয়ানা অবাক হয়ে যাচ্ছিল নিজেকে দেখে। ও যে ভালবাসত কিগানকে সেটা স্বীকার করছে না একবারও!
‘আবার কিন্তু?’ বুকু এবার হেসে উঠেছিল জোরে। এটা কোন বুকু? চিনতে পারছিল না জিয়ানা। ভয় লাগছিল ওর। বুকু এমন করে কথা বলছে কেন? ও চুপ করে তাকিয়েছিল বালিশের দিকে। বুকু বলেছিল, ‘তোমার আবার সেই ছেলেটার সঙ্গে এখন দেখা হয়েছে, না?’
কার পার্কে গাড়িটা রেখে বেরোল জিয়ানা। এই বিকেলের শেষ সময়টায় লিফ্টের সামনেটা ফাঁকাই থাকে। গাড়িটা লক করে চাবিটা রাখতে ব্যাগ খুলতেই ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। এমন সময় কে? জিয়ানা দেখল ফোনটা। মা!
মা আর বাপি আজ এসেছে ওদের বাড়িতে। থাকবে। আসলে কাল মায়ের একটা ডাক্তার দেখানোর আছে ওদের বাড়ির কাছে। মায়ের হাঁটুর সমস্যা হচ্ছে একটা। তাই দেখানোটা প্রয়োজন। কাল সকালে অ্যাপয়েন্টমেন্ট।
তা হঠাৎ মা ফোন করল কেন? জিয়ানা ফোনটা ধরল, ‘বলো, মা?’
‘অলিভ অয়েল নেই রে বাড়িতে? খুঁজছি, কোথাও পাচ্ছি না।’
‘অলিভ অয়েল! কী হবে?’ অবাক হল জিয়ানা।
‘রান্নায় লাগবে। বুকু খেতে পছন্দ করে এমন একটা পদ রাঁধব।’
‘কী রান্না যে অলিভ অয়েল লাগবে?’
‘ওফ, জীবনে রান্না করেছিস তুই যে, জানবি? তা কখন আসবি তুই?’
‘আমি?’ জিয়ানা ঘড়ি দেখল, ‘জানি না। বসের সঙ্গে মিটিং আছে। আটটা হবে। কেন?’
‘এক বোতল অলিভ অয়েল আনিস না।’
‘অলিভ অয়েল! অত রাতে? যদি না পাই? বা ভুলে যাই?’ জিয়ানা হাসল।
‘থাক, তোকে ফোন করাই ভুল হয়েছে। তোর বাপিকে বলছি।’
‘বাপি জানবে কোথায় পাওয়া যায়? মানে, বাপি তো চেনে না সব কিছু।’
‘জিজ্ঞেস করে নেবে। তা ছাড়া আজ বুকুর জন্য এটা রান্না করতেই হবে।’
‘কেন ঝামেলা করছ মা। আর কেন করতেই হবে রান্না?’
‘ছিঃ ছিঃ,’ মায়ের গলায় রাগ, ‘বাস্তবের মাটিতে নাম মিষ্টি। ভুলে গেছিস সব? ভুলে গেছিস যে, আজ বুকুর জন্মদিন? তোর শাশুড়ি বললেন, তুই তো একবারও বললি না। আমার আশ্চর্য লাগছে তোকে দেখে। ছিঃ ছিঃ! আমার মেয়ে হয়ে তুই এমন?’ মা কেটে দিল ফোনটা!
জিয়ানা ঠান্ডাতেও ঘেমে উঠল নিমেষে। তাই তো। এটা যে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিল। কেমন করে এটা ভুলল ও? কেমন করে মাথা থেকে বেরিয়ে গেল এটা? কী আশ্চর্য! কিন্তু কিগানের জন্মদিন তো কখনও ভোলে না ও!
লিফ্টের বাক্সটা নীচে নামল পাঁচ-ছ’জনকে নিয়ে। ওপরে ওঠার পথটায় জিয়ানা একা। লিফ্টে উঠে, সানমাইকা লাগানো দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল ও। মায়ের ফোনটা কেমন যেন গন্ডগোল করে দিল সব। আজ বুকুর জন্মদিন, আর সেটা ভুলে গেল ও। কী করে ভুলে গেল? দায়িত্ব কর্তব্যগুলো কি ক্রমশ বিস্মৃত হচ্ছে জিয়ানা? আচ্ছা, জিয়ানা কি ভালবাসে বুকুকে? না হলে সেদিন কেন অমন সত্যি-মিথ্যে মিশিয়ে কথা বলল বুকুকে? কেন বারবার নিজের দিকটা ঢেকে ও কথা বলছিল কিগানের দিকটা দেখিয়ে? সেটা কি বুকুর প্রতি ভালবাসার জন্য? না তুতুল এসে গেছে বলে? ওর কি ভয় হয় যে, বুকু ওকে ছেড়ে দেবে? নাকি মা-বাবার কথা চিন্তা হয় ওর? মুখে যতই বলুক ‘ওর জীবন কি ওর নয়’? আসলে জিয়ানা বুঝতে পারছে যে, ও নিজেই আর ওর নিজের জীবনকে নিজের জন্য রাখেনি।
অফিসের ভেতরটা আজ আশ্চর্য রকম নিস্তব্ধ আর ফাঁকা। জিয়ানা নিজের টেবিলে গিয়ে ব্যাগটা রাখল। দূরে খুরানার কেবিনের চেকার্ড কাচের ফাঁক দিয়ে ফাঁকা চেয়ারটা দেখা যাচ্ছে। এখনও ফেরেননি খুরানা। অর্থাৎ, হাতে সময় আছে একটু। জিয়ানা পাশের বিরাট কাচের জানালা দিয়ে শীতের কলকাতার দিকে তাকাল। আলো-জ্বলা একটা শহর। আর রাস্তাগুলো শিরা-উপশিরার মতো জড়িয়ে ধরেছে কলকাতাকে। কে যেন হলুদ থকথকে একটা তরল ঢেলে দিয়েছে সেইসব শিরা-উপশিরায়। আর তার ভেতর ডুবে-ভেসে ছোট ছোট গাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবিকল কম্পিউটার গেমসের স্ক্রিন যেন।
লু-এর দিকে এগোল জিয়ানা। একটু ফ্রেশ হতে হবে। যদিও ওর গাড়িটার কাচ বন্ধ ছিল তবু ধুলোধোঁয়া তো লেগেছে গাড়িতে ঢোকার বেরোনোর সময়। নিজের স্কিন সম্বন্ধে জিয়ানা খুব সচেতন। মেকআপ করার চেয়ে ন্যাচেরাল স্কিন অনেক ভাল লাগে ওর।
লু-এর ভেতরটা কালো গ্রানাইটের দেওয়ালে মোড়া। তার এক দিকটায় আবার গোটা আয়না। সেখানে নিজেকে দেখল জিয়ানা। বয়স হয়েছে মনে হচ্ছে কি? বুকু তেমনই বলেছিল না?
জিয়ানা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল বুকুর দিকে। কী করে বুঝল ও যে কিগানের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
বুকু বলেছিল, ‘কী নাম ছেলেটির? নাকি লোক বলব?’
‘কিগান,’ ছোট্ট করে বলেছিল জিয়ানা।
‘কিগান? আইরিশ?’ অবাক হয়েছিল বুকু, ‘বিদেশি প্রেমিক? কলকাতায় পেলে কী করে? ভেরি ইন্টারেস্টিং!’
‘না, হাফ আইরিশ, হাফ বাঙালি। বাবা বাঙালি ছিল। মা আর বাবা একই সঙ্গে মারা যায় অ্যাক্সিডেন্টে। তখন কিগান অনেক ছোট। তারপর ওর ঠাকুরমা লন্ডন থেকে নিয়ে আসে ওকে। সুকিয়া স্ট্রিটে থাকত ওরা। পুরো নাম কিগান অর্ক ব্যানার্জি। কলেজে আলাপ হয়েছিল। আর সেখানেই পছন্দ করেছিল আমায়।’
‘আর তুমি?’ বুকু স্বাভাবিক গলাতেই জিজ্ঞেস করেছিল।
‘আমি?’ সামান্য থমকে ছিল জিয়ানা, ‘আমারও ভাল লাগত। অত সুন্দর দেখতে একজন ছেলে! খারাপ লাগবে কেন? তবে মা সহ্য করতে পারত “না” ওকে। আমায় বকত। আমিও কিগানকে না করে দিয়েছিলাম।’
‘না করে দিয়েছিলে? তা কার জন্য? মায়ের জন্য, না তোমার নিজের জন্য?’
‘দেখো, সেসব জানি না। ওকে না করে দিয়েছিলাম, বাবা-মা খুশি হয়েছিল। আর তারপর তুমি এলে।’
‘ও। হুম্। তা এখন গল্পটা কী?’ বুকুর যেন আগ্রহের সীমা ছিল না।
‘গল্প?’ জিয়ানার বিরক্ত লেগেছিল, ‘গল্প মানে? আমি চাপাডাঙায় যে-প্রজেক্টের কাজে যাই, সেখানকার ফ্যাক্টরির প্রোডাকশন ম্যানেজার হল এই কিগান। প্রায় এক ডিকেড পর দেখা। আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।’
‘হঠাৎ দেখা হল? আর তুমি অবাক হলে?’ বুকু অবাক হয়েছিল।
‘হ্যাঁ। আমি এত আশ্চর্য হয়েছি যে, কী বলব। একটা মানুষ এমন বেপাত্তা হয়ে গেল তারপর হঠাৎ এত বছর পর এভাবে দেখা! অবাক হব না?’
‘তা সেই কিগান কী বলল? বিয়ে করেছে?’
‘কিছুই কোনওদিন বলে না কিগান। বরং বসার ঘরে যে নতুন একটা শো-পিস রয়েছে সেটা তুতুলের নাম করে দিয়েছে। আর বিয়ে? না করেনি।’
‘বিয়ে করেনি?’ হেসেছিল বুকু, ‘গ্রেট লাভার।’
‘বাজে কথা বোলো না। কতদিন আগেকার ঘটনা, সেসব দিয়ে রিলেট করছ কেন? এসব একদম নয়।’
‘নয়? তা হলে কাঁদলে কেন জিয়ানা?’ বুকু শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করেছিল।
‘কাঁদলাম? জানো, কিগানের কথা মাকে বলেছিলাম। এমনিই বলেছিলাম। মা সেই শুনে এমন আরম্ভ করল, কী বলব তোমায়! আমার এত বছরের সমস্ত কিছুর কি কোনও দাম নেই?’
‘মায়ের দিকটাও ভাবো। তোমার দিদির ব্যাপারটা…’
‘না,’ বুকুকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছিল জিয়ানা, ‘দিদির ঘটনা তো দিদির। তাতে আমার দোষ কোথায়? মা চিরকাল দিদির ঘটনা দেখিয়ে আমায় চেপে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এটা যে কত বড় অন্যায়!’
‘তাই তুমি কাঁদছিলে?’
‘জানি না কেন কষ্ট হয়েছিল। আমি জানি না। তবে হ্যাঁ, কিগানের কথাটা তোমায় না বলাটা আমার অন্যায় হয়েছে।’
‘দুর,’ হেসেছিল বুকু, ‘একদম নয়। মানুষের জীবনে কত কিছু হয়। কত কিছু ঘটে। সব বলা যায় না। তা ছাড়া আমাদের বর্তমান জীবনে ওর কত দূর প্রভাব?’
‘নেই,’ জিয়ানা মাথা নিচু করেছিল, ‘কোনও প্রভাব নেই।’
‘তা ছাড়া, সবারই বয়স হচ্ছে।’ বুকু হেসেছিল আবার, ‘তোমারও বয়স হয়েছে জিয়ানা। কিগানেরও হয়েছে। আমারও তো হয়েছে। তোমরা কি আর সেই অতীতে ফিরে যেতে পারো? আমিই কি পারি?’
‘তুমি?’ অবাক হয়েছিল জিয়ানা।
‘কথার কথা বলছিলাম। তা কিগানকে একদিন বাড়িতে ডাকো না। আলাপ করি। আড্ডা মারি। নামটা এমন ইন্টারেস্টিং যখন মানুষটাও নিশ্চয়ই হবে।’
‘ও আসবে না। কিছুতেই আসবে না। চিরকালই কেমন যেন ছেড়ে ছেড়ে থাকত ও। কেমন যেন একা থাকত। আর এখন তো দেখলাম পুরো একা হয়ে গেছে। ও আসবে না। এই কিগান সেই কলেজ লাইফের কিগান নয়। ও অন্য মানুষ।’
বুকু বলেছিল, ‘তুমি…মানে তোমার এখনও মায়া আছে না ওর ওপর?’
‘আমার?’ জিয়ানা চুপ করে গিয়েছিল। গলার ভেতর কষ্ট হচ্ছিল একটা। যেন কিছু আটকে গেছে। যেন কিছু বের হতে চেয়েও পারছে না। বুকে চাপ লাগছিল। জল এসে যাচ্ছিল চোখে। কেবল মনে পড়ছিল পাহাড়ি পথে শেষবারের মতো চলে যাচ্ছে একটা সাইকেল। কুয়াশার ঝাঁঝরির ভেতর দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে কিগান।
‘থাকাটাই স্বাভাবিক। ভালও,’ বুকু বলেছিল, ‘যে তোমায় এত ভালবাসল, কিছু না পেয়েও যে তোমায় এত করে মনে রেখেছে তার ওপর মায়া না থাকাটাই অমানুষের কাজ। মায়া, ভালবাসাই তো মানুষের হলমার্ক। তুমি কাজ হয়ে গেলেও ওর সঙ্গে যোগাযোগ রেখো। আমি কিছু মনে করব না। অনেস্টলি।’
সেই রাতের পর থেকে হঠাৎই কেমন যেন বদলে গেছে বুকু। কেমন যেন খোলামেলা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে অস্বস্তি লাগে জিয়ানার। অচেনা ঠেকে। মনে হয় এ বুকুকে তো চেনে না ও। কেন এমন পালটে গেল বুকু? কী হয়েছে ওর? তুতুলও মাঝে মাঝে অবাক হয়। বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে। জিয়ানার মাঝে মাঝে ভয় লাগে। মনে হয়, সব ভেঙে যাবে না তো?
তবু তার পাশেও কেন তা হলে কিগানের কথাও মনে পড়ে ওর? কেন কষ্ট হয় কিগানের জন্য? কিগানকে কেন এত ভালবাসতে ইচ্ছে করে ওর? আচ্ছা, ও কি খারাপ মানুষ? নিজের ঘর-সংসার, সিকিয়োরিটি ঠিক রেখে কি ও গোপনে কিগানকে চায়? কিগান কি ওর গোপন জীবন? ওর গুপ্ত সম্পদ? সবার সামনে কি কোনওদিন স্বীকার করতে পারবে না যে, ও নিজেও ভালবাসে কিগানকে? মাঝে মাঝে বড্ড বাজে লাগে জিয়ানার। নিজের ওপর বিরক্তি আসে।
বেশ কিছুদিন চাপাডাঙায় যাওয়া হয়নি জিয়ানার। বলা ভাল ও যায়নি। আগে যেমন দু’-চারবার ছুতোনাতায় গিয়েছিল, এবার আর যায়নি। আসলে শেষ দিনে কিগানের বলা কথাগুলো মনে আছে ওর। প্লেজ, টার্ন আর প্রেস্টিজ। কিগানের জীবনে প্রেস্টিজ আসেনি এখনও। এখনও খরগোশ আসেনি ফিরে। খরগোশ কি আনন্দ? নাকি প্রেম? এতদিন পরেও কিগান কি প্রেমের জন্য অপেক্ষা করছে? কার প্রেমের জন্য? জিয়ানার কি? না অন্য কারও? জিয়ানা তো কথার ভাঁজে নিজেকে কিছুটা এগিয়েই দিয়েছে কিগানের কাছে। কিন্তু কিগান তো তা শুনছে না, বুঝছে না। ও তা হলে কোন খরগোশের ফেরত আসার অপেক্ষা করছে? ম্যাজিক, চিরকালই কিগান ম্যাজিকে বিশ্বাস করত। এখন সেটা আরও বেড়েছে কি? নেহাত মেটাফর হিসেবে কথাগুলো বলে কিগান কী বোঝাতে চেয়েছিল? আর হাসতে হাসতে তো কিগান বলেও দিয়েছিল যে, জিয়ানা ওকে ছেড়ে চলে গেছে। তাই কি রাগ? কিগান কি এখনও রেগে আছে জিয়ানার ওপর? এখনও কি ও অপমানিত বোধ করে? ওর কি মনে হয় জিয়ানা সুবিধেমতো ওর সাহায্য নিয়ে তারপর সরে গিয়েছে? না হলে অমন হেসে কি কেউ বলতে পারে, ‘টার্ন দেখালি ভ্যানিস হয়ে’? জিয়ানা জানে কিগান ভোলে না কিছু। জানে ওপরের শান্ত, ভদ্র মানুষটার নীচে একটা রাগী আগ্নেয়গিরি চাপা আছে। একবার দেখেছিল কলেজে।
কলেজের অনেক প্রেমিকের মতো সুমন্ত বলে একটা ছেলে ছিল। সে-ও জিয়ানার পিছনে ঘুরঘুর করত খুব। এমনকী, বাড়ির ফোন নম্বর জোগাড় করে বাড়িতেই হুটহাট ফোন করত ছেলেটা। ভাল লাগত না জিয়ানার। বড্ড বিরক্ত লাগত। কেমন যেন গায়ে-পড়া টাইপ ছিল। সুমন্তকে ‘না’ বলে দেওয়ার পরও সুমন্ত শুনত না। বরং দিনকে দিন অসভ্যতা বাড়ছিল ছেলেটার। তারপর একদিন সেটা সীমা ছাড়িয়েছিল।
তখন কিগানের সঙ্গে রাগ-অভিমান চলছিল জিয়ানার। কিগান যাজ্ঞসেনী বলে একটা মেয়ের বাড়িতে গিয়ে সপ্তাহে একদিন অঙ্ক দেখিয়ে দিত। সেটা একদম ভাল লাগত না জিয়ানার। কারণ যাজ্ঞসেনীকে একবার দেখেই জিয়ানা বুঝেছিল যে, মেয়েটার দুর্বলতা আছে কিগানের ওপর। তাই কিগানকে ওই বাড়িতে যেতে বারণ করেছিল জিয়ানা। কিন্তু কিগান শোনেনি। বরং হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘পাগলি নাকি তুই? এসব মাথায় আনছিস কেন? তোকেও তো কত ছেলে পছন্দ করে, তা বলে তুই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিবি? তুই কি পাগল নাকি?’
জিয়ানা উত্তর দেয়নি। সোজা কথা বন্ধ করে দিয়েছিল। কিগান বোঝানোর চেষ্টা করেছিল ওকে। জিয়ানা কিছু শোনেইনি। পাত্তাই দেয়নি। এমন ভাব করেছিল যেন চেনেই না কিগানকে। বরং দেখিয়ে দেখিয়ে অন্যদের সঙ্গে বিশেষ করে সুমন্তর সঙ্গে কথা বলা বাড়িয়েছিল। আর সেখানেই শুরু হয়েছিল সমস্যা।
টিচার্স ডে ছিল সেদিন। কলেজের অডিটোরিয়ামে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। জিয়ানার ছিল গান আর আবৃত্তি। তবে গানে ও একা ছিল না। শিল্পী বলে একটা মেয়েও ছিল। অনুষ্ঠানের আধ ঘণ্টাখানেক আগে শিল্পীর সঙ্গে গানটা একবার রিহার্স করে নেবে ভেবেছিল জিয়ানা, কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিল না শিল্পীকে।
একতলা, দোতলা কোথাও শিল্পী নেই। তিনতলাটা একদম শুনশান। সেখানে ওঠার পথে হঠাৎ সুমন্তর সঙ্গে দেখা হয়েছিল জিয়ানার। সুমন্তও শিল্পীকে খুঁজতে উঠছিল তিনতলায়। ফাঁকা ক্লাসরুম, নির্জন করিডর। কিন্তু শিল্পী কোথায়? হঠাৎ সুমন্ত বলেছিল, ‘ওই সামনের ঘরটা থেকে আওয়াজ পেলাম মনে হল। চল তো। দেখ হয়তো ফাঁকা পেয়ে কারও সঙ্গে প্রেম করছে।’
‘চল তো। প্রেম করা বের করছি ওর,’ জিয়ানা আগে আগে গিয়েছিল ঘরটায়। তারপর ঘরে ঢুকে থমকে গিয়েছিল, ‘কোথায় রে! কেউ তো নেই?’ ও ঘুরে দরজার দিকে মুখ ফিরিয়েই থতমত খেয়ে গিয়েছিল। একদম সামনে দাঁড়িয়েছিল সুমন্ত। জিয়ানা দেখেছিল সুমন্তর নিশ্বাস ঘন, চোখে জঙ্গলের আলো।
সুমন্ত আচমকা জিয়ানার হাত চেপে ধরে বলেছিল, ‘কেউ নেই তো কী হয়েছে? আমি তো আছি। দেখ, কেউ আসবে না। কেউ জানবে না। আমি ভালবাসি তোকে। তুই আমায় একবার দে। কাউকে বলব না। শুধু তুই আর আমি জানব। আর কেউ জানবে না। সত্যি বলছি। প্লিজ একবার দে…’ জিয়ানা ‘না’ বলছিল ক্রমাগত। কিন্তু কিছুতেই শুনছিল না সুমন্ত। আঁকড়ে ধরে নাকটা জিয়ানার গলার মধ্যে, বুকের মধ্যে চেপে ধরার চেষ্টা করছিল। জিয়ানা প্রাণপণে চিৎকার করছিল। হাত দিয়ে সরানোর চেষ্টা করছিল সুমন্তকে। কিন্তু লম্বাচওড়া সুমন্তর সঙ্গে পারছিল না। ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল জিয়ানা। ভয়ে লজ্জায় অপমানে কেঁদে ফেলেছিল। সুমন্ত ঠেলতে ঠেলতে ওকে টেবিলে শুইয়ে দিয়েছিল। চেপে বসেছিল ওর শরীরের ওপর। ভয়ে, লজ্জায়, ঘেন্নায় চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল জিয়ানা।
হঠাৎই হালকা হয়ে গিয়েছিল সব। কোনও চাপ নেই। ভার নেই। কী হল? চোখ খুলে জিয়ানা দেখেছিল শূন্যে উঠে একটু দূরে আছড়ে পড়ল সুমন্ত। সুমন্তর মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে। দু’হাত জোড় করে রয়েছে। আর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিগান।
‘সরি, ভেরি সরি, আমার মাথার ঠিক ছিল না। আমায় ক্ষমা করে দে,’ সুমন্ত পালানোর পথ খুঁজছিল।
‘জানিস তো, তোর মতো চারটেকে একা নিতে পারি আমি। তোর সাহস কী করে হল জিয়ানার গায়ে হাত দেবার?’ কিগানের অমন হিংস্র রূপ আগে কোনওদিন দেখেনি জিয়ানা। কথা শেষ করে কিগান সুমন্তকে কলার ধরে তুলে সজোরে থাপ্পড় মেরেছিল একটা। সুমন্ত ঘুরে পড়ে গিয়েছিল আবার।
‘আরও মার আমায়। কিন্তু প্লিজ, ক্ষমা করে দে। আর কোনওদিন হবে না,’ সুমন্ত প্রায় পায়ে পড়েছিল কিগানের।
‘ছেড়ে দে,’ জিয়ানা অস্ফুটে বলেছিল।
‘আমায় প্লিজ ক্ষমা করে দে।’ সুমন্ত আর দাঁড়ায়নি। দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল।
‘তুই, হঠাৎ?’ জিয়ানা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল কিগানের দিকে।
‘হঠাৎ নয়। সুমন্তকে তোর সঙ্গে দেখে লক্ষ রাখছিলাম। শোন, আমার ওপর রাগ করে, আমায় শাস্তি দিতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনিস না। তুই আমার সঙ্গে কথা বলিস না, সেটাই যথেষ্ট শাস্তি আমার পক্ষে। আর নতুন করে কিছু করতে হবে না।’
জিয়ানা কিছু বলেনি। শুধু চোখ বন্ধ করে জড়িয়ে ধরেছিল কিগানকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল কিগানকে। বলেছিল, ‘তোকে ছাড়া আমি আর কাউকে বিয়ে করব না।’
কিগানকে বিয়ে করেনি জিয়ানা। মা-বাবার কথায় ও ঘুরিয়ে নিয়েছিল নিজের মন। চলে এসেছিল বুকুর কাছে। খরগোশটা ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিল। আর ফিরে আসেনি টুপির ভেতর। আর এখন জিয়ানা বুঝেছে খরগোশটাকে ফিরিয়ে আনার ক্ষমতাও ওর নেই। সে ইন্দ্রজাল ভুলেছে ও। প্রেস্টিজ বা সম্মান আর ফেরাতে পারবে না জিয়ানা।
নিজের টেবিলে ফিরে এসে ব্যাগ থেকে ময়শ্চারাইজার বের করে মুখে, হাতে মাখল জিয়ানা। পুরনো দিনের কথাগুলো খুব মনে পড়ে আজকাল। কেন পড়ে কে জানে। কিন্তু পড়ে। আর সব কিছুতেই নিজেকে দোষী মনে হয়। কিগানকে যতবার দেখে, ততবার নিজেকে অপরাধী লাগে। কিগানকে ভালবেসে কেন পরে মায়ের কথায় ওকে ছেড়ে এল জিয়ানা? কেন এমন একটা অন্যায় করল ও? ভেবেছিল সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সত্যিই কি সব ঠিক হয়?
‘স্যার আপনাকে ডেকেছেন।’ জিয়ানা দেখল বেয়ারা ছেলেটি দাঁড়িয়ে রয়েছে সামনে।
‘আমি আসছি। স্যার কতক্ষণ আগে এসেছেন?’ জিয়ানা জিজ্ঞেস করল।
‘একটু আগে,’ ছেলেটি আর দাঁড়াল না।
খুরানার চেম্বারে চেকার্ড ফ্রস্টেড গ্লাসের দরজায় দাঁড়াতেই খুরানা ‘আও বেটি’ বলে ডেকে নিলেন ওকে। তারপর বসতে বললেন।
জিয়ানা চেম্বারে ঢুকে চেয়ারে বসল। নরম গদিওয়ালা চেয়ার। প্রায় অর্ধেক ঢুকে গেল জিয়ানা। কিন্তু আরাম অনুভব করার আগেই দেখল খুরানার মুখ গম্ভীর। চোয়াল শক্ত। অর্থাৎ টেনশন, চাপ আছে। ওপর থেকে বিস্তর চাপ আছে। আর কর্পোরেট পৃথিবীতে চাপের কনডাকটেন্স খুব ভাল। খুব দ্রুততার সঙ্গে ওপর থেকে নীচে অবধি ছড়িয়ে যায় চাপটা। অর্থাৎ খুরানার ওপর চাপ মানে জিয়ানার ওপর চাপ এল বলে।
‘জিয়ানা, উই মাস্ট গেট দিস প্রজেক্ট। দিস মার্চেন্ট মাল্টিপল্স থিং,’ খুরানার গলাটা কেমন যেন আশঙ্কার মতো শোনাল।
‘শিয়োর স্যার,’ জিয়ানা আশ্বস্ত করার গলায় বলল।
‘না, অত সোজা নয়। বাই হুক আর বাই ক্রুক আমাদের এটা পেতেই হবে। কোম্পানির টপ লেভেল খুব চটে আছে। ন্যারো মার্জিনে তিন-চারটে কাজ ফসকে গেছে। আর নয়। এবার ডু অর ডাই।’
‘কিন্তু বাই ক্রুক!’ জিয়ানা চিন্তিত হল, ‘সেটা কেমন করে সম্ভব?’
খুরানা ঠোঁট কামড়ে নিজের গ্লাস টপ টেবলটার দিকে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর বললেন, ‘কিগান অর্ক ব্যানার্জি।’
‘হ্যাঁ স্যার?’ জিয়ানা ঠিক বুঝল না।
‘কিগান। প্রোডাকশন ম্যানেজার। গৌর রওশন দিওয়ানের খুব কাছের লোক। তোমার বন্ধু না?’
‘হ্যাঁ স্যার, বন্ধু,’ জিয়ানা সংক্ষেপে বলল।
‘তো ইয়ারি কব কাম আয়েগি?’ খুরানা হাসলেন।
‘মানে স্যার?’ জিয়ানার কেমন যেন গুলিয়ে গেল সব।
‘মানে, বন্ধুকে ধরো। বলো। কাজটা যাতে হয়, বলো। শোনো জিয়ানা, ও কাজটা না পেলে প্রোজেকশন কর্প-এর অবস্থা খুব খারাপ হবে। তাই এটা পেতে হবে আমাদের। যেভাবে হোক পেতেই হবে। বুঝেছ?’