মুহূর্তরা দু’বছর আগে – ২৫

২৫

হাতে ষাট হাজার টাকার চেক। পিছনে গ্রিলের সবুজ-হলুদ গেট আর কাঠের রেলিং দেওয়া ক্লাব টেন্টের বাউন্ডারি। মাথার ওপর বড় বড় করে লেখা ‘স্টার ইউনিয়ন’। পাশে ভিনাইল বোর্ডে লেখা ‘গ্যালাক্সি ইন দ্য মেকিং’।

আজ থেকে বহু বছর আগে এক ভোরবেলায় জীবনে প্রথমবার এই গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল রুহান। এখনও মনে আছে রুহানের। একটা সস্তার উইন্ডচিটার, সাদা প্যান্ট আর কেডস পরে শীতের ময়দান ভেঙে হাঁটতে হাঁটতে এই গেটটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ও।

ময়দানের ভারী দুধ রঙের কুয়াশা, শীতের সকালের লাজুক সূর্য আর ঠান্ডা হাওয়ার মাঝে সব কিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতো লেগেছিল রুহানের। মনে হয়েছিল, এসব কি সত্যি হচ্ছে? না স্বপ্নে?

ভোরবেলার মর্নিং ওয়াকার, প্লেয়ারদের হুল্লোড়, পেতল কলসিতে বিক্রি হওয়া চা আর দূরে রাস্তা দিয়ে ঝুলনের মতো চলতে থাকা মানুষজন, কেমন একটা অদ্ভুত শিহরন জাগাচ্ছিল ওর মনে। ক্লাবে ঢুকতে গিয়ে পা কাঁপছিল ওর। এত বড় ক্লাব, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ও? যে-মানুষটা আসতে বলেছে, তার কথায় রুহানের ইন্ডিয়া খেলার চান্স আছে। সত্যিই কি আছে? বাংলা থেকে ন্যাশনাল টিমে চান্স পাওয়া খুব কঠিন। পেলেও দু’-চারটে ম্যাচের পর কী যে হয়! সবাই সৌরভ হতে পারে নাকি?

সে সময় সৌরভের কেরিয়ার মধ্যগগনে। জগুদা বলেছিল, ‘ব্যাটসম্যান দিয়েছে বাংলা, এবার বোলার দেবে। রুহান রায়।’

এই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন রুহানের মনে হয়েছিল একদিন যখন ও এই গেট দিয়ে বেরোবে চারদিকে সাংবাদিকরা ঘিরে ধরবে ওকে। দূরে দাঁড়ানো দামি গাড়িতে বসে থাকবে নন্দা। আর অবলীলায় সব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে কালো সানগ্লাস চোখে দিয়ে রুহান বেরিয়ে যাবে সোঁ করে। রুহান ভাবত একদিন ওর হাতের বলের দিকে, ওর দিকে তাকিয়ে থাকবে গোটা দেশ।

দুটো কাক বসে রয়েছে পাশের কাঠবাদাম গাছটায়। দূরে একটা রংচটা বেঞ্চে জড়াজড়ি করে বসে রয়েছে দু’জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা। কয়েকটা গাধা ঘুরে বেড়াচ্ছে সামনে। একটা বিরক্ত লজেন্সওয়ালা মাঠ ভাঙছে মাথা নিচু করে। আর এসবের মাঝে সবুজ-হলুদ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে রুহান। গেটের কাছে দারোয়ান বলবন্ত পর্যন্ত তাকাচ্ছে না ওর দিকে। আসলে, সারা ভারত কেন, ওর নিজের মা-ই যে ভরসা করে না ওর ওপর।

আজ ওকে ফোন করে ডেকে পাঠিয়েছিলেন সুখেনদা। একটু অবাকই হয়েছিল রুহান। সপ্তাহ দুয়েক ক্লাবে যেতে পারেনি ও। তাই কি ডেকেছেন? অন্য কেউ হলে ফোনেই হয়তো জিজ্ঞেস করত রুহান। কিন্তু সুখেনদাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না ও। সুখেনদা ওর জন্য এত করেছেন যে, সুখেনদার সামনে মাথা তুলে কথাই বলতে পারে না। তাই খুব জানতে ইচ্ছে করলেও চুপ করে ছিল রুহান।

সুখেনদা সচরাচর সকালের দিকে ক্লাবে থাকেন। কিন্তু স্টারের ইলেকশন সামনে। তাই সুখেনদা আজ মাঠে ছিলেন। রুহানকে দেখে হাত তুলে ডেকে বলেছিলেন, ‘আয়, এদিকে আয়।’

ক্লাবের অফিসের সামনে ছোট একটা বাগান রয়েছে। আর পাশে লনটা মখমলের মতো সবুজ। সেখানে বেতের চেয়ার নিয়ে বসেছিলেন সুখেনদা। পাশে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে গিয়ে বসেছিল রুহান।

সুখেনদা পান খান খুব। দারুণ সুন্দর জর্দার গন্ধ আর দামি পারফিউমের গন্ধ একসঙ্গে মিলে মিশে ভরিয়ে তুলেছিল চারদিক। কেমন যেন ঝিম লেগে যাচ্ছিল রুহানের। সুখেনদা বলেছিলেন, ‘কী রে, তোর পা ভাল আছে?’

‘আছে সুখেনদা।’ রুহান নিচু গলায় বলেছিল, ‘আসলে খুব একটা চাপ পড়ে না তো।’

‘কেন, প্র্যাকটিস করিস না?’

‘করি…মানে…’ রুহান তোতলাচ্ছিল। অফিস থেকে ছুটি পায় কই যে, প্র্যাকটিস করবে রোজ? আর সারাদিন খাটাখাটনির পর ভোরবেলা উঠে আর প্র্যাকটিসে আসতে ইচ্ছে করে না ওর। মনে হয় ঘুমোয়।

ঘুম। আজকাল ঘুম খুব বেড়েছে রুহানের। সারারাত মড়ার মতো ঘুমোয় রুহান। সকালে মা ডাকতে ডাকতে গালাগালি করতে শুরু করে। তবু ওঠে না ও। আর উঠলেও ঢোলে, ঢুলতে থাকে। নাছোড়বান্দা বাচ্চার মতো ঘুম ঝুলে থাকে ওর চোখের পাতায়। প্রায়ই তাই আজকাল সকালে উঠে কাজ ভুলভাল হয়ে যায় রুহানের। এর ভেতর কী করে আসবে ও প্র্যাকটিসে?

‘আর ঢপ মারিস না, ধম্মে সইবে না।’ পিছন থেকে গম্ভীর গলায় বলে উঠেছিল জগুদা, ‘তোর টিকির দেখা পাওয়া যায়? সুখেনদাকে বুলু দিচ্ছিস?’

‘না, মানে…’ রুহান থতমত খেয়ে চুপ করে গিয়েছিল।

সুখেনদা বলেছিলেন, ‘জগু ঠিকই বলছে। আমি জানি রে। তুই খুব ভাল ছেলে রুহান। কিন্তু ভাল ছেলে দিয়ে স্কুল চলে, ক্রিকেট টিম চলে না।’

‘মানে?’ সুখেনদা কী বলছেন বুঝতে পারেনি রুহান। ও বোকার মতো মুখ করে বলেছিল, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না সুখেনদা।’

সুখেনদার মুখে বন্ধুর মতো হাসি ফুটে উঠেছিল। সুখেনদা বলেছিলেন, ‘জানিস ছোটবেলায় আমার খুব ক্রিকেটার হওয়ার শখ ছিল। খেলা হলেই মাঠে যেতাম। সোবার্সের খেলা দেখেছি। জয়সীমার খেলা দেখেছি। টনি গ্রেগকে দেখেছি। মনে হত আমিও আবিদ আলির মতো বল করব। হয়নি। তবে পারত জানিস, আমার ভাই পারত। মনোতোষ। খুব ভাল বল করত। তখন গাওস্কর একদম নতুন, মুম্বইতে একটা খেলায় গাওস্করকে ইয়র্ক করে দিয়েছিল একদম। আমরা সবাই ভাবতাম, খুব বড় বোলার হবে ও। সবাই নাম জানবে ওর। ভাবতাম, আমি যা পারলাম না ও সেটাই পারবে। আর ভাই পারতে শুরুও করেছিল। আন্ডার নাইনটিন খেলে ফিরছিল ভাই। আর তার আগের সন্ধেবেলাতেই খবর পেয়েছিলাম যে, বেঙ্গল টিমে সিলেকশন হয়েছে ওর। আমাদের বাড়িতে সে যে কী উৎসব, তোকে কী বলব। আমরা সবাই অপেক্ষা করছিলাম কখন ভাই আসবে। বাবা তো উৎসাহের চোটে পাড়ার সকলকে মিষ্টি দিয়ে এসেছিল। মাকে বলেছিল, “দেখো, যেদিন ইন্ডিয়া খেলবে, সেদিন আমি কী করি। আমি একদম…আমি একদম…” বাবা কথা শেষ করতে পারেনি। বাড়ির বেল বেজে উঠেছিল আচমকা। বাবা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে থমকে গিয়েছিল। পুলিশ। জানিস রুহান, তোর বোলিং অ্যাকশন একদম আমার ভাইয়ের মতো। ঠিক অমন হাত দিয়ে বলের সিম লুকিয়ে রাখা, সামনে ঝুঁকে পড়ে দৌড়। লাফিয়ে ওঠা। অবিকল আমার ভাই। ভাই ফিরেছিল জানিস। সাদা চাদরে মুড়ে, সারা গায়ে বস্তা সেলাইয়ের মতো দাগ নিয়ে। একটা পুঁটলির মধ্যে ফিরেছিল ভাই। রেড রোডে ভাইয়ের ট্যাক্সিকে একদম থেঁতলে দিয়েছিল একটা ডাম্পার। বাবা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। মা কথা বলেনি কতদিন। আর আমি একা-একা হেঁটে বেড়াতাম রাস্তায়। তারপর কতদিন কেটে গিয়েছিল, আমি চারদিকে খুঁজে বেড়াতাম ভাইকে। পেতাম না জানিস। কোথাও পেতাম না। তারপর তুই এলি। আমার মনে আছে, শীতকাল ছিল সেটা। আমি ইডেনের দিকের মাঠটায় বসে ছিলাম। দেখলাম জগু তোর হাতে বল তুলে দিল। তুই বলটা নিয়ে একটা দিক ট্রাউজারে ঘষে সিমটা ধরলি। তারপর বাঁ হাত দিয়ে বলের সেলাইটা লুকিয়ে ঝুঁকে পড়ে দৌড় শুরু করলি। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানিস। এ কে দৌড়োচ্ছে? মনো? কিন্তু মনো তো নেই! তবে? আর তারপর দেখলাম তুই লাফিয়ে উঠলি আর যেন বলটা করল মনো। ভাবলাম, জীবন সমুদ্রের মতো। একসময় সব নিয়ে নিলেও পরে তা ফিরিয়ে দেয়। তুই সত্যিই কী ভাল বল করতিস রে রুহান!’ সুখেনদা একটানা কথা বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। সুন্দর তামাকের গন্ধ উড়ে বেড়িয়েছিল চারিদিকে।

জগুদা বলেছিল, ‘তুই সেই খেলাটাকে হাতে ধরে নষ্ট করলি। আশ্চর্য!’

‘সত্যি, তোর কী হল বল তো রুহান?’ সুখেনদার গলায় আর নস্টালজিয়া ছিল না।

‘মানে…আমি….আমার…’ রুহানের কথা ক্রমশ গুলিয়ে যাচ্ছিল।

আসলে কী বলবে রুহান? কার কাছে গিয়ে বলবে? নন্দার ঘটনাটা ঘটার পর থেকে গোটা জীবনটাই কেমন যেন হঠাৎ বদলে গিয়েছিল রুহানের। সেই কনফিডেন্সটাই যেন চলে গিয়েছিল। কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল সারা জীবনের জন্য। সেসব কি আর অন্য লোকেরা বুঝবে? যার হয়, একমাত্র সেই বোঝে। আর কেউ বুঝবে? আর কেউ বোঝে না। তাই সুখেনদা বা জগুদা, কাউকেই বলা যে বৃথা, তা বুঝে চুপ করে ছিল রুহান।

সুখেনদা বলেছিলেন, ‘এই নে।’ পাশের টেবিল থেকে একটা খাম তুলে দিয়েছিলেন ওর হাতে। বলেছিলেন, ‘আসিস মাঝে মাঝে। যোগাযোগ রাখিস।’

‘মানে?’ খামটা হাতে নিয়ে বোকার মতো সুখেনদার দিকে তাকিয়েছিল রুহান। কী বলছেন সুখেনদা? যোগাযোগ রাখিস, মানে? আর খাম? কী রয়েছে এতে?

‘তোকে ডিসচার্জ করে দিলাম আমরা। কেমন?’ সুখেনদা নিচু গলায় বলেছিলেন।

‘মানে?’ আরও অন্ধকার হাতড়াচ্ছিল রুহান। ডিসচার্জ? সে তো হাসপাতাল থেকে করে। ও কি রোগী নাকি যে, ডিসচার্জ করল ওকে?

‘ছাগল, আস্ত ছাগল তুই!’ জগুদা রেগে গিয়েছিল, ‘তোকে আর স্টারের দলে রাখা হচ্ছে না, তোর কন্ট্র্যাক্ট শেষ হয়ে গেছে। আর রিনিউ করা হচ্ছে না কন্ট্র্যাক্ট। কেন, তুই এতদিন বুঝিসনি? ওই খামে টাকা আছে। ষাট হাজার। তোর পেমেন্ট।’

‘অ্যাঁ? রুহান অবাক হয়ে তাকিয়েছিল, ‘কিন্তু…আমি…কেন?’

সুখেনদা কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিলেন, কিন্তু জগুদা হাত দিয়ে সুখেনদার হাতটা ধরে বলেছিল, ‘আপনি চুপ করুন সুখেনদা। আমি বলছি।’ তারপর রুহানের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলেছিল, ‘দেখ রুহান, তোকে এই ফর্ম নিয়ে এতদিন যে রেখেছি সেটাই তো অনেক। আজকাল প্র্যাকটিসে আসিস না ঠিকমতো। খেলতে পারিস? চোট পেয়ে বসে থাকিস। এত ঝামেলা আমরা সামলাব কেন? তা ছাড়া তোর খেলা শেষ রে। তোর মধ্যে আর বারুদ নেই। ভেবেছিলাম তুই রকেট, দেখলাম বালি ঠাসা দু’নম্বরি রংমশাল। শালা, আবার ‘কেন’ জিজ্ঞেস করছিস! বটুক তো বটুক, সেদিনের ছেলে সতু পর্যন্ত তোকে ফ্রন্ট ফুট পুল করে ছয় মারছে। তুই এখনও ভাবিস ক্লাব তোকে রাখবে? দম নেই, জোর নেই, বলে কাজ নেই। তাও জিজ্ঞেস করছিস? সত্যিই…’ জগুদা এমন করে মাথা নেড়েছিল যেন পৃথিবী রসাতলে গিয়েছে একদম। আর উদ্ধার হওয়ার সুযোগ নেই।

খাম খুলেছিল রুহান, ‘ষাট হাজার!’ রুহান অস্ফুটে বলেছিল। আসলে বহু দিন তো টাকাপয়সা পায় না। এর চেয়ে বেশি টাকা পাওয়ার কথা যে ওর।

‘তো কত দেবে?’ সুখেনদা এবার বিরক্ত হয়েছিলেন, ‘তোর আউটপুট নেই কোনও। ওরা পঁচিশ হাজার দেবে বলেছিল, আমি ষাট করিয়েছি। আর এর সঙ্গে চাকরিগুলো যোগ কর। শোন রুহান, এখন যেখানে আছিস, সেখান থেকে চাকরি গেলে আমার কাছে কিন্তু আর চাকরির উমেদারি করতে আসিস না।’

‘না, না,’ রুহান নিমেষে গুটিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, ‘আপনি রাগ করবেন না সুখেনদা। আসলে, হঠাৎ করে এমন হল তো তাই…’

‘ছাগল একটা,’ জগুদা বলেছিল, ‘কী হল হঠাৎ করে? তুই জানতিস না যে, এমন হবে? তোকে আর টিমে রাখা হত? প্র্যাকটিস ম্যাচেও দু’-তিন ওভারের বেশি দেওয়া হত? আর দেবে কেন? তোর স্পিড গেছে। ফলো থ্রু গেছে। বল ডেলিভারির সময় মাথা স্থির থাকে না। পাড়ার ছেলেরাও তোর চেয়ে ভাল বল করে। শোন রুহান, আর কথা বাড়াস না। এবার যা। মাথা গরম করালে আমি মেরে দেব এবার।’

সুখেনদা হাত দিয়ে চেপে ধরেছিলেন জগুদার হাত, তারপর রুহানকে বলেছিলেন, ‘শোন রুহান, আজ আয়। তুই এই ক্লাবের পুরনো প্লেয়ার। এখানে এসে যখন খুশি প্র্যাকটিস করতে পারিস। এখন আয়।’

পা দুটো লোহার মতো ভারী লাগছিল রুহানের। আর মনে হচ্ছিল, মাথার ভেতর কলকাতার সমস্ত ওভারহেডের তার জট পাকিয়ে গেছে। যখন স্টারে প্লেয়ার হিসেবে রেজিস্টার্ড ছিল, তখন টাকা না পেলেও কেমন যেন একটা শান্তি ছিল মনে। যেন কোথাও একটা নিজের পরিচয় ছিল। মনে হত, আর কিছু না পারলেও ক্রিকেটটা তো ও পারে। কোথাও যেন দাঁড়াতে পারত ও সমাজে। কিন্তু এবার যে সেটাও গেল! মানুষ একটা মুখোশ খোঁজে সমাজের সামনে দাঁড়ানোর জন্য। আর সেই মুখোশটার চারপাশে সে একটা নিজের মতো দেখতে ভদ্র মানুষ তৈরি করে তোলে। সেই মুখোশটাকেই সমাজ চেনে, সমাজ দাম দেয়। তাই মুখোশটা ছাড়া মানুষ খুব অসহায়, নগ্ন।

ষাট হাজার টাকার চেকটা হাতে ধরে নিজেকে তেমনই মনে হচ্ছে রুহানের। অন্য দিন ক্লাবের দারোয়ান বলবন্ত হাসে ওকে দেখলে। আজ কিন্তু বলবন্ত ফিরেও তাকাল না। আচ্ছা, ওর কাছেও কি খবর পৌঁছে গেছে? তাই কি পাত্তা দিচ্ছে না একদম?

গড়ের মাঠটাকে যেন আরও বড় মনে হচ্ছে রুহানের। মনে হচ্ছে এর কোনও শেষ নেই। আজ আর অফিস যেতে ইচ্ছে করছে না। ভীষণ মনখারাপ লাগছে। যে জন্য নিজের দিকে তাকাত পারত ও, সেই কারণটাও আজ চলে গেল। তবে কেন বেঁচে আছে রুহান? ওর কি মরে যাওয়া উচিত? কী করবে ও? কী করবে? কিগান থাকলে ওর অনেক সুরাহা হত। নানা পরামর্শ পাওয়া যেত। কিন্তু কিগান তো ফ্যাক্টরিতে। ফোন করলে ডিস্টার্ব হবে হয়তো। তা হলে? মোবাইলটা বের করে নামগুলো দেখল রুহান। এবিসি করে আর-এ এসে আটকে গেল রুহান। রাহি। বুকের থেকে পেটের দিকে ছোট করে লাফ দিল একটা মাছ। উড়ে গেল কিছু চড়াই। একটা লাল বল বেরিয়ে গেল ব্যাটের কোণ ছুঁয়ে। দুটো শ্বাস গলার কাছে আটকে গেল অল্প সময়ের জন্য। করবে ফোন?

কিন্তু কোন মুখে করবে? কিগান ওর নাম সুপারিশ করেছিল একটা কাজের জন্য, তার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কিচ্ছু করতে পারেনি। রাহি খুব ভাল মেয়ে, তাই বিশেষ কিছু বলেনি। কিন্তু মনে মনে কী ভেবেছে কে জানে! রুহান তো শুধু রাহিকে দেখবে বলে যায় আর সেই খেলার ব্যাপারে কিছু না বলে চলে আসে। তা, সেই মেয়েকে আচমকা, কী বলতে পারে ও? কী বলা উচিত? আদৌ বলতে পারে কি কিছু?

রুহান আবার ফোনের দিকে তাকাল। রাহি, নামটা এখনও হাইলাইটেড হয়ে আছে। একবার কথা বলতে ইচ্ছে করছে খুব। ও কিছু না ভেবেই কল বোতামটা টিপে দিল, আর সঙ্গে সঙ্গে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল রুহানের। এই রে কল তো করে বসল, কিন্তু কী বলবে!

ওই কলার টিউন বাজছে, রবীন্দ্রনাথের গান। জোনাকি নিয়ে। কিন্তু কেটে গেল লাইনটা। একটু ঘাবড়ে আর একটু বিরক্ত হয়ে ফোনটা কান থেকে নামিয়ে দেখল রুহান। ইউজার বিজি দেখাচ্ছে।

কেটে দিল! জাস্ট কেটে দিল লাইনটা? কী এমন করেছে রুহান যে, এমন ব্যবহার করল রাহি?

কলকাতা বড্ড নিস্তব্ধ আজ। মাঠটা ক্রমশ বড় হচ্ছে। তা হলে এই বড় মাঠটা ভেঙে কোথায় যাবে রুহান? কার কাছে গিয়ে বসবে একটু?

‘কিঁউ রুহান ভাইয়া! তব সে খড়ে কিঁউ হো?’

রুহান মুখ ফিরিয়ে দেখল যে, বলবন্ত ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। ওদিকে খইনি ডলছে হাত দিয়ে।

‘না তো,’ রুহান অপ্রস্তুত হল, ‘আসলে…মানে… ইয়ে…’ রুহানের এই এক সমস্যা। সেই ছোট থেকেই প্রশ্নের সামনে পড়লে উত্তর গুলিয়ে যায়।

‘বটুক ভাইয়া বোল রহে থে, কী আপকো নিকাল দিয়া হ্যায় কেলাব সে। সচ হ্যায় কা ভাইয়া?’ বলবন্ত নিজের জায়গা থেকে দু’-চার পা হেঁটে এগিয়ে এল ওর দিকে।

‘বটুক!’ অবাক হল রুহান। ওঃ, তা হলে বটুক জানে! মানে ক্লাবের সবাই জানে? ও জানার আগেই জানে। বলবন্তও জানে? তা হলে বাকি রইল কে?

রুহান কথা ঘোরাতে বলল, ‘অন্যরা কি? লক্ষণ, শিউচরণ, যোগীন্দর?’

‘ওরা আছে। আপনি বোলেন না, সহি হ্যায় কা?’

বলবন্ত পুরনো দিনের লোক। বলা যায় স্টারের ঘরের লোক। ওর কাছে লুকিয়ে কী লাভ? রুহান বলল, ‘হ্যাঁ বলবন্তদা। আমি আর ক্লাবের কেউ নই গো।’

‘এত পুরনো লোককে নিকলিয়ে দিল! কৌনওদিন হামার পিছওয়াড়েপে ভি লাথ মারকে নিকাল দেঙ্গে। বহত চিন্তা কী বাত হ্যায় ভাইয়া। তুম কা কহতে হো? হম ছাপড়া লৌট যায়ে?’

‘আরে?’ রুহান এর ভেতরেও হাসল, ‘সত্যি মাইরি, তোমার আমার কেস এক নাকি? ফালতু ঝাড় হচ্ছে কিন্তু! আমি খেলতে পারছি না তাই বাদ দিয়েছে। তোমার সঙ্গে এর সম্পর্ক কী?’

‘সম্পর্ক নেই? শিয়োর?’ বলবন্ত পারলে গীতা ছুঁইয়ে সাক্ষী দেওয়ায়।

‘না রে বাবা। এত খইনি খেলে বুদ্ধি হবে কোত্থেকে? যাক, আমি আসি।’

‘আসবে? তো অর কভি আয়েঙ্গে নেহি কেলাব মে?’ বলবন্ত প্রশ্ন করল।

‘না, আর আসব না,’ রুহান কেটে কেটে বলল।

বলবন্ত দুঃখিত মুখে বলল, ‘বটুক ভাইয়া ভি কহ রহে থে।’

‘বটুক? কী বলছিল?’ রুহান ভুরু কুঁচকে তাকাল।

‘না, উও তো বদমাস হ্যায়। কুছ ভি বকতা হ্যায়।’

‘তাও,’ রুহান সটান তাকাল বলবন্তের দিকে।

‘বলছিল কী, নিকাল দে নে কে বাদ, ও তো আসবে না। কিস মুহ সে আয়েগা ও?’

‘বাদ দাও,’ রুহান হাসল। বা বলা যায় হাসির মতো ভঙ্গি করল। কোন মুখে আসবে? স্টারকে ও কি কোনও ম্যাচ জেতায়নি? ও কি চিরকাল এমন মার খাওয়া বোলার ছিল? এমন যে কেউ অপমান করতে পারত ওকে? হঠাৎ বাবার কথা মনে পড়ল রুহানের। বাবা বলত, যে-মানুষ নিজেকে সম্মান করে না, সে সম্মান আদায়ও করতে পারে না। আজ কথাটার মানে বুঝল রুহান। রুহান নিজে ঠিক থাকলে আজ বলবন্তের থেকে এসব শুনতে হত?

‘আচ্ছা বলবন্তদা, আমি আসি। কাজ আছে,’ রুহান দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

‘ঠিক হ্যায়। লেকিন অগর জিন্দেগিমে কভি মৌকা মিলে তো উস বটুক কো ছোড় না নহি। বহুত গলত বোলতা হ্যায় ও।’

‘কেন? কী বলেছে? আমায় তো ও খারাপ কথা বলেই।’

‘আপকো নহি। মুঝে ভি।’ বলবন্ত মুখটা গোমড়া করে নিল, ‘শালা, বহেনকে, অগর ছাপড়া হোতা তো তোড় দেতে উসকো। হামি বোললাম, রুহান ভাইয়া আচ্ছা পিলিয়ার হ্যায়। আর ও শুনকে উসনে কাহা কি দরওয়ান হো, ওহি রহো, জাদা বাত মত্‌ করো। আরে, কাল কা লওন্ডা আর ইতনি বড়ি জুবান! আপ উসকো দিখা দে না কি ভালা আদমি কা হি জিত হোতা হ্যায়।’

‘বলবন্তদা, জীবন কি তোমার হিন্দি ছবি না ভোজপুরি সিনেমা? আমি তো চলে যাচ্ছি। আর ফিরব না। বটুক বেঙ্গল খেলছে। ইন্ডিয়া এ-তে সিলেক্টড হয়েছে। সিনিয়র টিমেও হবে। ফলে ভাল কে আর খারাপ কে, গুলিয়ে যাবে সব। আসলে সত্যি-মিথ্যে, ভাল-খারাপগুলো তো গুলিয়েই যায় সব আজকাল। সিনেমায় যা হয়, জীবনে তা তো হয় না বলবন্তদা। জীবনে কিছুই হয় না আজকাল। এখন হয় পারফর্ম, নয় পেরিশ। মাঝামাঝি কিছু নেই। কিছু হয় না। তাই এই সিনেমায় বটুক তোমায় অপমান করলেও সে জিতে যাবে। তুমিই একদিন তার সই নেওয়ার জন্য পিছনে পিছনে ঘুরবে। তার সঙ্গে তোমার আলাপ ছিল বলে লোকের কাছে গল্প করবে। এটাই জীবন বলবন্তদা। এটাই সিনেমার শেষ। যে সফল সে-ই বিজয়ী। মানুষ নয়, আমরা সাফল্য আর পুরস্কার ভালবাসি। আমরা মানুষকে মাপি তার মন, ব্যবহার দিয়ে নয়, তার রোজগার আর নাম দিয়ে। এখানে ভদ্রতা মানে দুর্বলতা। অসভ্যতাই হল কনফিডেন্স। বুঝেছ?’

বলবন্ত মাথা নাড়ল, ‘একটু একটু। ইংরেজি তো জানি না। পর ঠিক হ্যায়। তুম কভি হিম্মত না হার না। অর আতে রহনা কিলাব মে।’

হাসল রুহান, ‘ঠিক হ্যায়। আসি। আবার একদিন দেখা হবে।’

‘জরুর,’ হাসল বলবন্ত। হাত দুটো কপালে ঠেকিয়ে বলল, ‘রাম, রাম।’

কলকাতায় এই ময়দানটা না থাকলে কী হত? এটাকে কলকাতার ফুসফুস বলা হয়। আসলে, রুহানের মনে হয়, এটা ফুসফুস নয়, ভোমরা। কলকাতার প্রাণভোমরা। এটাকে মেরে ফেললে কলকাতাও শেষ।

মাঠ পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠল রুহান। আজ আর অফিস যাবে না। ইচ্ছে করছে না। তা ছাড়া পকেটে টাকা আছে অনেক। চেক হলেও। যদি হারিয়ে যায়! রুহান জানে আজকের বাজারে এই টাকার কোনও মূল্য নেই। তবু ওই টাকাটা রুহানের কাছে অনেক। ওর হিসেবমতো যদিও দেড় লাখ টাকা ওর পাওনা, তবু যা পাওয়া গেছে তাই অনেক। সুখেনদা তো চাকরি জুটিয়ে দিয়েছে একটা। ক’জন দেয়? আর সেখানে জিয়ানা খুব হেল্‌প করছে ওকে। এতদিনে পার্মানেন্ট হয়ে যাওয়া উচিত ছিল হয়তো রুহানের। তবু, না হলেও, জিয়ানা ওকে আশ্বস্ত করেছে যে, ওর কোনও ভয় নেই।

ভয়? আর ভয় পায় না রুহান। বাবা, নন্দা, ক্রিকেট—সব হারিয়ে গিয়েছে ওর জীবন থেকে। যা-কিছু ওর শক্তি ছিল, যা-কিছু আনন্দ আর গর্ব ছিল, সব চলে গেছে। কষ্ট আর ভয় পেতে পেতে মানুষ একসময় সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ হয়ে যায়। রুহানও হয়ে গেছে। এই কোম্পানিতে যতদিন আছে রুহান, আছে, যেদিন রাখবে না, চলে যাবে। অন্য কোথাও কাজ খুঁজবে। আবেশও তো বেঁচে আছে। তবে ও কেন পারবে না? খুব পারবে। ঠিক পারবে।

আবেশ! আবার মাথার ভেতর চলকে উঠল রাহির নাম। কেন ফোন ধরল না রাহি? যেদিন শেষ ও চাপাডাঙায় গিয়েছিল জিয়ানার সঙ্গে, সেদিনও ফ্যাক্টরিতে কাজ শেষ করে একবার রাহিকে ফোন করেছিল রুহান। রাহি ফোন তোলেনি। ফোন বেজে বেজে থেমে গিয়েছিল দু’বার। কেন ফোন তোলেনি রাহি? কেন তুলছে না ও? ওই একটা ফোনের জন্য কি? ওই ফোনটা ধরেই কি বসে রয়েছে রাহি?

আসলে সেদিন যে কী হয়েছিল। রুহান কেন অমন বলেছিল। কষ্ট হচ্ছিল বলে কি? মা সেদিন খুব খারাপ কথাগুলো বলেছিল বলেই ভেতরে ভেতরে নড়ে গিয়েছিল রুহান? আলগা হয়ে গিয়েছিল ইমোশন? তাই কি অমন বোকামো করেছিল?

কাকিমার জন্য বাজার করে দিয়েছিল রুহান। তাই ভীষণ রেগে গিয়েছিল মা। রবিবার ছিল সেটা। ককাই গিয়েছিল ডেকরেটিং-এর কাজে। কাকিমার জ্বর ছিল খুব। তাই সামান্য কিছু বাজার এনে দিয়েছিল রুহান। কাকিমাদের রান্নার মাসি গুছিয়ে তুলছিল বাজারগুলো, ঠিক তখনই মায়ের চিৎকার শুনেছিল রুহান।

মা সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেছিল, ‘তুই কি ওদের বাজার সরকার? ওদের বাজার করে দিয়েছিস কেন তুই? আমার সংসারের কিছু আনতে বললে তো তখন বাহানা দেখাস। আর এখন?’

‘মা,’ রুহান দৌড়ে গিয়েছিল মায়ের কাছে, ‘এসব বলছ কেন? চলো ওপরে চলো।’

‘কেন? সিঁড়িটা কি কারও বাপের?’

কাকিমা জ্বর গায়েই বেরিয়ে এসেছিল বারান্দায়। বলেছিল, ‘দিদি, আমার ভুল হয়ে গেছে, তুমি রাগ কোরো না।’

‘ভুল তোর হয়নি খেয়া, আমার হয়েছে। এমন ঘরের শত্রু বিভীষণকে কোন আক্কেলে পেটে ধরেছিলাম আমি? বেশ করেছে তোকে বাজার করে দিয়েছে। কিন্তু নিজের মায়ের জন্যও তো কিছু করবে। কিছু করে ও? কিচ্ছু করে? অপদার্থ একটা!’

‘মা,’ রুহান মাকে চুপ করাতে বলেছিল, ‘এমন বোলো না। আমায় কী করতে হবে বলো, করব। তোমার জন্যই তো করব। আর কার জন্য করব?’

‘কেন, দুনিয়ার সব লোক পড়ে রয়েছে। সবাই পড়ে রয়েছে, কর তাদের জন্য। আমার জন্য কিচ্ছু করতে হবে না।’

মা দুমদাম করে পা ফেলে চলে গিয়েছিল ওপরে। রুহানও গিয়েছিল পিছন পিছন। তবে মা পাত্তা দেয়নি। নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল দুম করে। রুহানের শত ডাকাডাকিতেও খোলেনি। বরং চিৎকার করে রুহানের বাবার নাম ধরে বিলাপ করতে শুরু করেছিল। বলছিল, রুহান কতটা অযোগ্য। কতটা নিষ্কর্মা। মাকে কত কষ্টে রাখে। একটা রান্নার লোক পর্যন্ত রাখতে পারে না। মাকে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে পর্যন্ত নিয়ে যায় না। শুধু বাড়িতে রেখে ঝি-গিরি করায়। জঘন্য ছেলে রুহান। শুধু লোকের কাজ করে দিয়ে নাম কিনতে চায়। কোনওদিন, কোনওদিন কিচ্ছু করেনি মায়ের জন্য। এই যে মায়ের এত শরীর খারাপ, তাতে রুহানের হুঁশ নেই। ইত্যাদি ইত্যাদি।

রুহানের কষ্টটা একসময় বিরক্তিতে পরিণত হয়েছিল। মা এমন বলছে! মায়ের জন্য কিছু করেনি ও? কিডনির যখন প্রবলেম হল, যখন ইউটেরাস বাদ গেল, কে দিল অত টাকা? কে জোগাড় করল? বাবার জমানো টাকা তো প্রায় কিছুই ছিল না। তা হলে, কে আনল টাকা? চিকিৎসা করাল কে? মা কি একবারও জানতে চেয়েছে রুহান কোত্থেকে এত টাকা পেল? কে দিল? চায়নি। কেন? মা শুধু নিজের দিকটাই দেখে, রুহানের দিকটা দেখে না একদম। শুধু নিজের ইগো নিয়ে বসে থাকে। রুহান নিজের ঘরে গিয়ে বসেছিল। আর ঠিক তখনই ফোনটা এসেছিল।

বাসটায় ভিড় নেই বিশেষ। উঠে জানালার ধারের সিট অনায়সে পেয়ে গেল রুহান। কলকাতায় এই নতুন বাসগুলো খুব সুন্দর। ইয়াব্বড় কাচ লাগানো। সিট থেকে হ্যান্ডেল সব ঝকঝকে। মানুষজনও যেন এমন বাসে উঠলে সভ্য হয়ে যায়। রুহানের মনে হয় পকেটমারেরাও এমন বাসে উঠলে ভদ্রভাবে অনুমতি নেবে পকেট মারার আগে। সব দিকেই একটা কেমন যেন ঝকঝকে ভাব এসেছে। কলকাতা বলে মনে হয় না। যদিও অনেকে বলে কার্পেটের তলায় প্রচুর নোংরা, তবু কার্পেটের ওপরটা অনেক পরিষ্কার হয়েছে। রুহান কলকাতা দেখতে দেখতে চলতে লাগল। আর হঠাৎ ছ্যাঁৎ করে উঠল বুকটা। আরে ওটা রাহি না? তাই তো, রাহিই তো। কী করছে রাহি এখানে? বাসটা চলছে, তবু প্রায় লাফ দিয়ে দরজার কাছে গিয়ে বাস থামাতে বলল কন্ডাক্টরকে। রুহানের চেহারার মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল যে, কন্ডাক্টর থামাল বাসটা। রুহান নেমেই দৌড়োল উলটো দিকে। রাহিকে দেখেছে স্পষ্ট। ভুল হতেই পারে না। ওরা কি পার্ক স্ট্রিটে যাচ্ছে? না কি অন্য কোথাও? রাহি কলকাতায় এসেছে আর একবারও তো তা জানায়নি রুহানকে? সেই ফোনটাই কি দায়ী? সেই জন্যই কি এমন করছে রাহি? নিশ্চয়ই তাই।

‘হ্যালো, রুহান?’ রাহির গলাটা সেদিন উড়ে আসা পালকের মতো করে এসেছিল রুহানের দিকে।

‘হ্যাঁ,’ রুহানের গলা খুব শক্ত হয়ে ছিল।

‘তোমায় ফোন করেছিলাম, কারণ ওই ম্যাচটার জন্য।’

‘ম্যাচ?’ রুহানের রাগ হচ্ছিল, ‘আমি কী করব?’

‘মানে, কী করবে মানে?’ রাহির গলায় বিস্ময়।

‘মানে, কী করব? আমি কী করব?’ রুহানের মাথায় আগুন জ্বলছিল। রাহি সবসময় কাজের জন্যই ফোন করে কেন? ওর কি অন্য কারণে ফোন করতে নেই? ও কি রুহানের গলা শুনে বুঝতে পারছে না যে, ও কতটা কষ্টে আছে? বুঝতে পারছে না যে, রুহানের মনখারাপ? কেন পারছে না বুঝতে?

‘তুমি কী করবে মানে?’ রাহির বিস্ময় বাড়ছিল, ‘তুমি যে বললে দেখবে! কিগানদার কথায় তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম আর তুমি বলছ, কী করবে?’

‘আমি বলেছিলাম যোগাযোগ করতে? বলেছিলাম যে কাজটা করে দেবই? তবে? কেন এমন বলছ তুমি? আমি কি সবার কাছে দাসখত লিখে দিয়েছি নাকি যে, সবার হয়ে এটা-ওটা করে বেড়াব?’

‘কী বলছ তুমি? আমি কী বললাম?’ রাহি ঘাবড়ে গিয়েছিল।

‘তুমি? তুমি কী বলবে? আমি জানি কে কী বলতে পারে। সবাই আসে আর ফর্দ ধরিয়ে দেয় হাতে। আমি মানুষ নই? আমায় কী মনে হয় তোমার? যেমন খুশি বললেই হল? আমি মানুষ নই?’

‘আরে, কী বলছ তুমি? আমি তো জাস্ট ম্যাচ…’

‘পারব না। কিচ্ছু পারব না,’ ফোনটা কেটে দিয়েছিল রুহান।

ফোনটা কেটে দু’মিনিট স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বসেছিল রুহান। আর তারপরেই মাথার ভেতর ঘণ্টা পেটার মতো শব্দ শুনেছিল ও। এই সেরেছে, এটা কী করেছে ও? কার ওপরের রাগ কার ওপর দেখাল? আর তারপর কীসব হাবিজাবি কথা বলল? কেন বলল ও? রুহান তো সত্যিই নিজে বলেছিল যে ও করে দেবে কাজটা। আর এখন তা হলে এমন অসভ্যের মতো বলল কেন? ছিঃ ছিঃ। নিজের গালে থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করছিল রুহানের। মনে পড়ছিল রাহির ওই ভাঁজপড়া থুতনি, অভিমানী চোখ। মেয়েটা কি কাঁদছে এখন? কারণ ছাড়া কথা শুনতে কার ভাল লাগে? আর রুহানের বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, ও এমন করেছে। এমন অসভ্যতা যে ও করতে পারে তা যেন নতুন করে শিখেছিল নিজেই। ও তড়িঘড়ি ফোনটা নিয়েছিল। কিন্তু ফোন করবে কি? কোন মুখে করবে? ও অনেক চিন্তা করে একটা এসএমএস লিখেছিল। লিখেছিল যে, ওর মাথার ঠিক নেই। তাই খুব অন্যায় কথা বলেছে। ও নিঃশর্তে ক্ষমা চাইছে।

এসএমএস-টা পাঠিয়ে চুপ করে বসে ছিল রুহান। মায়ের ঘরের ভেতর থেকে ফোঁপানোর শব্দ আসছিল। আর মোবাইল থেকে কিচ্ছু আসছিল না। লজ্জায়, খারাপ লাগায় আর কষ্টে শীতেও দরদর করে ঘামছিল রুহান। ডিসেম্বরের শেষে যে অমন কেউ ঘামতে পারে রুহান এটাও জানত না। তবে ফোন আসেনি। মেসেজের রিপ্লাই আসেনি। বরং অদ্ভুত এক তাচ্ছিল্য যেন ভেসে আসছিল নৈঃশব্দ্য দিয়ে। মরমে মরে যাচ্ছিল রুহান। ও স্থির হয়ে বসেছিল খানিক। তারপর বালি ভরতি গলা আর চড়াইপাখি ভরতি বুক নিয়ে রাহির নম্বরটা ডায়াল করেছিল। ফোনটা কানের সঙ্গে চেপে ধরে বসে ছিল।

বন্ধ করে রেখেছে ফোন! গলার বালি ফাটিয়ে কাঁকড়া বেরিয়ে এসেছিল। বুকের চড়াইগুলো কী করে যেন বদলে গিয়েছিল শকুনে। রাহি বন্ধ করে রেখেছে মোবাইল!

সেই শুরু তারপর থেকে রাহিকে আর কিছুতেই ফোনে যোগাযোগ করতে পারছে না রুহান। হয় ফোন বন্ধ, নয়তো রিং হয়ে হয়ে কেটে যাচ্ছে। রাহি ফোন ধরছে না কিছুতেই। কী যে বোকামো করেছে রুহান! নিজের গালে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে ওর। আর ঘটনাটা কিগানকেও বলতে পারছে না। বললে কিগান প্রচণ্ড বকবে। দেখা হলে চড়থাপ্পড় মারতেও পারে। আর কিগানের গায়ে যা জোর। একবার দেখেছিল রুহান। বিশাল কাঠের জামাকাপড় ঠাসা আলমারি একা সরিয়ে দিয়েছিল ঘরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ওই জোর নিয়ে যদি একটা মারে তা হলে দেখতে হবে না রুহানকে। তবে হ্যাঁ, ভয়ও ছিল রুহানের। রাহি আবার বলে দেবে না তো? তাই সেই ঘটনার পরে যখন প্রথমবার কিগান ফোন করেছিল, খুব ভয়ের সঙ্গে ফোন ধরেছিল রুহান। তবে, না কিগান সেসব প্রসঙ্গ তোলেইনি। তখন গিল্টি ফিলিং থেকে একবার মনে হয়েছিল রুহানের যে, কিগানকে বলে। কিন্তু পরক্ষণেই মত বদলেছিল। কিগানের বকুনি শুধু নয়, মনে হয়েছিল যে রাহির সঙ্গে অমন অসভ্যতা করা মানে আসলে কিগানের বিশ্বাস ভাঙা। মানে কিগানের মুখে থাপ্পড় মারা। তাই কিগানকেও কিচ্ছু বলা হয়নি।

শীতের কলকাতা ছড়িয়ে রয়েছে চারদিকে। ফুটপাথের চায়ের দোকান। একটা ভিখিরি। বাস স্টপে আগুপিছু করা ভিড়। আর মাথার ওপর ধুলো-ময়লায় আবছা হয়ে যাওয়া একটা রংচটা নীল আকাশ। মানুষের রঙিন জামাকাপড়ের ফাঁকে কোথায় গেল রাহি? রুহান যে স্পষ্ট দেখল। এতটা ভুল দেখবে ও? রাহি একটা জিন্‌স আর পুলওভার পরে হাঁটছিল। মাথার চুল হর্সটেল করা ছিল। অমন বাদামি চুল, ভাঁজপড়া থুতনি, এতটা ভুল করবে রুহান? পাগল নাকি? কিন্তু সত্যি দেখলে, গেল কোথায়? চারদিকে শীতের নিভে আসা দুপুরে শ্লথ মানুষদের যাতায়াত।

‘কী রে তুই?’ রুহান ঘাবড়ে গেল। আবেশ।

‘তুই?’ রুহান জিজ্ঞেস করল পালটা।

‘আমি কাজে এসেছি। মামার বাড়িতে দরকার ছিল। আর তারপর মার্চেন্টের অফিসে গিয়েছিলাম।’

রুহান কিছু বলতে যাচ্ছিল। এই সময় ফোনটা বেজে উঠল ওর। বিরক্ত লাগল, কে এখন আবার? লোকজন আর ফোনের সময় পায় না। ফোনটা বের করে একবার থমকাল রুহান। বুকুদা! ধরবে? ইতস্তত করতে লাগল রুহান।

‘ফোনটা ধর। সব জায়গায় ছড়াস না। তোর সঙ্গে জরুরি কথা আছে।’ আবেশের গলাটা কেমন যেন অচেনা লাগল।

‘কী কথা?’ রুহান দেখল রিং হয়েই চলেছে ফোনে।

‘বলছি, আগে ফোনটা ধর।’

ফোনটা ধরল রুহান, ‘হ্যালো?’

‘নন্দার সঙ্গে তুই কী করেছিস রুহান?’ বুকুদার গলাটা ভোঁতা অস্ত্রের মতো এসে লাগল রুহানের কানে।

নন্দা? নন্দার কথা বুকুদা জানল কী করে? তা হলে কি… তা হলে কি বুকুদা গেছে সেইখানে?

শীতের বিকেল ফেনার বুদবুদে চড়ে নামছে কলকাতায়। রুক্ষ খড়ি ওঠা পথঘাট। উত্তরের খিটখিটে হাওয়া। সেফটিপিন আটকানো মানুষজন সব হঠাৎ উবে গেল রুহানের সামনে থেকে।

কী বলছে বুকুদা? সেই দিনের ঘটনার পর এই প্রতিদান? ওকে প্রশ্ন করছে বুকুদা? নিশ্চয়ই বলা হয়েছে বুকুদাকে, না হলে জানবে কেমন করে? বুকুদার প্রশ্নের ভেতরই তো অবিশ্বাস লুকিয়ে আছে। লুকিয়ে রয়েছে রাগ। বুকুদা চেনে না রুহানকে? খারাপ কিছু কি করতে পারে ও? তবু এই গলায় কেন কথা বলছে বুকুদা? কেন ক্ষত জায়গায় আরও বেশি করে ক্ষত তৈরি করছে?

‘ছিঃ, হান এটা এক্সপেক্ট করিনি তোর থেকে।’

রুহান দেখল ওর জবাবের অপেক্ষা না করে ফোনটা কেটে দিল বুকুদা। রাগ, মানুষকে ফোন কাটিয়ে দেয়। বিচ্ছিন্ন করে দেয় অপর মানুষের থেকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *