২৪
বৃষ্টির পুকুরে যে সাঁতার কাটতে দারুণ লাগে সেটা রাহি জানে। ওদের বাড়ির চৌহদ্দিতে যে-পুকুরটা রয়েছে তার জলটা বেশ পরিষ্কার। সাধুদা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে লোক দিয়ে পরিষ্কার করায়। সেই পুকুরটার এক পাশে বেশ কয়েকটা পাম গাছ লাগানো। গাছগুলো খুব একটা বড় হয়নি। তবু ভালই লাগে দেখতে। ওখানে একটা ছোট শেড মতো করে দেওয়া হয়েছে। স্নান করার আগে জামাকাপড় রাখা আর ছাড়া যায়। রাহির ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যায় পুকুরটা। ও দেখল সেখানে উথালপাথাল করে স্নান করছে মল্লার।
ছেলেটা বেশ। গতকালই আলাপ হয়েছে। খুব আমুদে। পড়াশোনা জানে। গল্পের বইয়ের পোকা। কিগানের ভাই আদির অফিস-গাড়ির ড্রাইভার। রাহি জানে কোনও কাজই ছোট বা খারাপ নয়। তবু, সব কিছুরই তো একটা প্রযোজ্যতা আছে। তাই এমন একটা ছেলে এই কাজ করে ভাবতে বেশ অসুবিধে হচ্ছে রাহির। কিন্তু মাত্র এক সন্ধের আলাপ। তাই, কেন করে এই কাজ? কীসের জন্য করে—জিজ্ঞেস তো করা যায় না! তবে কৌতূহলটা পেটের মধ্যে পাক মারছে। আসলে ছেলেটা এত ভাল যে, রাহির মনে হয় না এমন কিছু জিজ্ঞেস করলে ও রাগ করবে।
পুকুরের পাড়ে ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে মল্লারকে প্রবল উৎসাহ দিচ্ছে আবেশ। আজ রোববার। কাজ নেই। তার ওপর প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। ডিসেম্বরের মিড্ল-এ এমন বৃষ্টি ভাবা যায় না। আর তার চেয়েও আশ্চর্য হল এই যে, এমন ঠান্ডায় মল্লার কীভাবে পুকুরে স্নান করছে!
রাহি চাদরটাকে ভাল করে জড়িয়ে নিল। আজ দুপুরে অনেক কিছু রান্না করাচ্ছে মা। হঠাৎ করে অতিথি এসে পড়েছে যে! কাল রাতে খিচুড়ি আর চার-পাঁচ রকম ভাজা ছিল। কিন্তু তা বলে তো আর দুপুরেও সেসব খাওয়ানো যায় না। যতই হুট করে এসে পড়া লোক হোক, তারা তো আর সাধ করে আসেনি। বিপদে পড়ে থাকতে এসেছে। আসলে এই চাপাডাঙায় কোথায়ই বা থাকবে আদিরা? যা বৃষ্টি শুরু হয়েছে গতকাল বিকেল থেকে! তবে আদি আর মালিনী চাপাডাঙায় এসেছিল দুপুর নাগাদ।
বৃষ্টি শুরুর দু’ঘণ্টার ভেতরেই ভয়াবহ আকার নেয় আবহাওয়া। রাস্তাঘাট সব প্রায় আবছা হয়ে গিয়েছিল বৃষ্টিতে। রাহি শুনেছিল বটে যে, বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ হয়েছে। কিন্তু সেটা যে এমন আকার ধারণ করবে তা বুঝতে পারেনি।
চাপাডাঙা নামটা কোনও চাঁপা ফুল গাছ থেকে নেওয়া নয়। জায়গাটা চাপা, মানে নিচু। তাই চাপাডাঙা বলে সবাই। গোটা অঞ্চলটাই কেমন যেন মালসার মতো। চারদিক থেকে এসে জল জমা হয় এখানে। ফলে এই বৃষ্টিতে জল জমতে সময় লাগেনি একদম। রাস্তাঘাট অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল নিমেষে। টিভিতে বলছিল যে, ক্লাউড বার্স্ট হয়েছে। মেঘ ফেটে গেছে। তাই এমন প্রলয় নেমেছে পৃথিবীতে।
ক্লাউড বার্স্ট কথাটা শুনে খুব মজা লেগেছিল রাহির। বেলুন তো ফাটে। মেঘও ফাটে! কী করে ফাটে? আর ফাটার পরে কী হয়?
ছোটবেলায় সাধুদার কাঁধে করে মাঝে মাঝে ঘুরতে বেরোত রাহি। সাধুদা ওকে এটা-ওটা শোনাত। গল্প বলত। আর রাহিও প্রশ্ন করে করে মাথা খারাপ করে দিত সাধুদার। তার মধ্যে মেঘ সম্বন্ধেও জিজ্ঞেস করত রাহি। বলত, ‘সাধুদা, ওগুলো কী গো? তুলোর মতো দেখতে?’
সাধু থেমে বলত, ‘আইসক্রিমের বেলুন গো দিদি।’
‘যাঃ, বেলুন তো রবারের হয়। তাতে হাওয়া থাকে।’
‘এটা আইসক্রিমের বেলুন।’
‘আইসক্রিম!’ খুশিতে মনটা নেচে উঠত রাহির, ‘তো বেলুনগুলো ফেটে গেলে কী হয়?’
সাধুদা বলত, ‘আইসক্রিম পড়ে। অ্যাত্তো অ্যাত্তো আইসক্রিম পড়ে।’
আকাশ থেকে আইসক্রিম পড়ে! তারপর থেকে গোল্লা গোল্লা মেঘ দেখলেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকত রাহি। ভাবত, একবার যদি, অন্তত একটা মেঘও ফাটে!
মেঘ ফাটে। কিন্তু তা থেকে জল বেরোয় শুধু। দুঃখী মানুষদের, একলা মানুষদের, অপমানিত মানুষদের চোখের জল পড়ে সারা শহর জুড়ে। সারা দেশ জুড়ে। বড় হওয়ার পর সেইসব মেঘে রাহির চোখের জলও গিয়ে জড়ো হয়েছিল। ও বুঝেছিল, সাধুদা ওকে কষ্ট দিতে চায়নি বলেই অমন কথা বলেছিল।
সেই মেঘ ফেটেছে। আর চাপাডাঙা উপচে উঠছে জলে। স্কুল থেকে ফিরে চারদিকটা দেখে মনে মনে বেশ খুশি হয়ে উঠেছিল রাহি। বৃষ্টি ওর বরাবরের প্রিয়। তারপর শীতকালের নিম্নচাপ আরও মজার। ওর ইচ্ছে করছিল কাগজের নৌকো বানিয়ে ওদের বড় উঠোনটায় ছেড়ে দেয় এক-এক করে।
ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠেছিল রাহির। আরে কিগান! একটু আশ্চর্য হয়েছিল ও। কিগান তো চট করে নিজের থেকে ফোন করে না কখনও। অর্থাৎ দরকারটা খুব জরুরি।
‘হ্যাঁ বলো কিগানদা!’ রাহি ফোনটা নিয়ে খাটের হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসেছিল। বলেছিল, ‘তুমি কোথায়? ফ্যাক্টরিতে?’
‘হ্যাঁ,’ কিগান চুপ করে ছিল সামান্য। তারপর বলেছিল, ‘একটা হেল্প করবি?’
‘হেল্প!’ রাহি সোজা হয়ে বসেছিল। কিগান হেল্প চাইছে! এ যে অষ্টম আশ্চর্য! যে-মানুষ খিদে পেলেও বলে না, সে হেল্প চাইছে! ও বলেছিল, ‘আরে নিশ্চয়ই! তুমি এত হেজিটেট করছ কেন?’
‘আসলে একটা ছোট্ট বিপদ হয়েছে। মানে, একটা নয়, দুটো অ্যাকচুয়ালি। আমার ভাই আর ওর এক কলিগ অফিসে এসেছিল। মানে আমাদের ফ্যাক্টরিতে। তারপরই গন্ডগোল হয়েছে।’
‘কী হয়েছে?’
‘ওরা বাড়ি ফিরতে পারছে না,’ কিগান অসহায় গলায় বলেছিল।
‘আরে বাড়ি ফিরতে পারছে না কেন?’ রাহি অবাক হল।
‘কী করে পারবে? আকাশের অবস্থা দেখেছিস?’
‘তাও বটে,’ রাহি বলেছিল, ‘তা তুমি কী বলবে? কী ব্যাপার?’
‘ওরা আজ রাতে থাকবে। না হলে ওরা আর যাবে কোথায় বল?’
‘ঠিক আছে। তো আমি…মানে আমায়…’ রাহি বুঝতে পারছিল না।
‘তোদের বাড়িতে এক রাতের জন্য মেয়েটাকে থাকতে দিবি? মানে কাকাবাবু, ইয়ে তোর বাবার মোবাইল ট্রাই করছি, পাচ্ছি না। ওঁর সঙ্গেই কথা বলতাম। তা তোকেই বলছি। দিবি?’
‘ধ্যাত, এমন করে বলছ কেন তুমি?’ রাহি ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলেছিল, ‘এমন ন্যাকামো করো কেন?’
‘না, চিনিস না জানিস না তাই বলছিলাম আর কী! শোন, একবার অন্তত কাকিমাকে বল। আমি না হয় দশ মিনিট পরে কল করছি আর-একবার। আসলে এত বৃষ্টি হচ্ছে! রাস্তাঘাট সব ডুবে আছে। এমন ওয়েদারে এতটা গাড়ি চালিয়ে যাওয়া তো মুশকিল। আদি আর ওর গাড়ি চালায় যে-ছেলেটা, সে না হয় শুয়ে পড়বে কোনওমতে আমার ঘরে। কিন্তু মালিনী তো পারবে না। তাই তোকে বলছি আর কী! একটু দেখ না কাকিমাকে বলে। আমি মিনিট দশেক পরে ফোন করছি।’
‘আরে আমিই তো বলছি!’ রাহি বলেছিল, ‘আমি সাধুদাকে বলছি ওদের যেন নিয়ে আসে গিয়ে। চারদিকে যেভাবে জল জমে আছে!’
‘না, তুই পাকামো না করে কাকিমাকে জিজ্ঞেস কর। আমি একটু পরে ফোন করছি,’ কিগান ফোনটা কেটে দিয়েছিল তারপর।
মা ঘরে বসে টিভিতে কীসব যেন শো দেখছিল। রাহি গিয়ে দাঁড়াতেই মা বলেছিল, ‘কিছু বলবি? দাঁড়া, ব্রেকটা হোক, তখন বলিস।’
এইসব টিভি সিরিয়াল-গেম শো দু’চক্ষে সহ্য করতে পারে না রাহি। সিরিয়ালে সব চড়া রং মেখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছে। আর তেমনই গেম শোগুলো। তবু প্রচুর মানুষ কী যে মুগ্ধতা নিয়ে এগুলো দেখে!
রাহি আরও মিনিট চার-পাঁচেক অপেক্ষা করে সুযোগ পেয়েছিল। টিভিতে অ্যাড রোল করতেই মা রিমোট টিপে টিভিটাকে মিউট করে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এবার বল, কী বলবি। দরকারি কিছু?’
রাহি মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে বলেছিল, ‘কিগানদা ফোন করেছিল একটা ব্যাপারে তোমার পারমিশন নিতে। মানে, বাবাকে ফোনে পাচ্ছে না। তাই তোমায় জিজ্ঞেস করতে বলল।’
মা চট করে টিভিটাকে দেখে নিয়ে বলল, ‘আরে, যা বলবি তাড়াতাড়ি বল না।’
‘কিগানদার অফিসের একটা মেয়ে এসেছে। কিন্তু এই ওয়েদারে ফিরতে পারছে না। তাই কিগানদা বলছিল যে, আজ রাতটা যদি আমাদের বাড়িতে থাকতে পারে! মানে যদি তোমরা পারমিশন দাও। তা হলেই আর কী!’
‘কে মেয়ে?’ মা একটু ভুরু কোঁচকাল।
‘আমি জানি না,’ রাহি গায়ের চাদরটাকে আবার ভাল করে টেনে জড়াল।
‘কে না কে!’ মা মুখটা গোমড়া করল, ‘আর কিগানের কী আক্কেল! হঠাৎ এমন বেয়ারা আবদার করে কোন সাহসে? চেনা নেই জানা নেই, থাকতে দেব কেন?’
রাহির মাথা গরম হয়ে গেল। মা যেন কত চেনা-অচেনা মানে! যাকে-তাকে বাড়িতে ঢোকায়, এটা-ওটা দেয়। সংসারের গল্প ফেঁদে বসে! আর কিগান কি তেমন ছেলে নাকি! নিশ্চয়ই ভরসা আছে বলেই বলছে। মায়ের যে হঠাৎ হঠাৎ কী হয়! কেমন যেন বাঁকা বাঁকা কথা বলে মাঝে মাঝে। এদিকে কিগান এলে এমন করে কথা বলে যেন এই পৃথিবীতে ওর চেয়ে আপন আর কেউ নেই। তা ছাড়া কিগান সম্বন্ধে মা অমন বলবে কেন?
রাহি জানে যে, কিগান ওকে অন্য কোনও চোখে দেখে না। বা আরও সঠিকভাবে বললে খুব একটা সিরিয়াসনেস নিয়ে ভাবেও না ওর সম্বন্ধে। কিন্তু যখন কারও অন্য কাউকে ভাল লাগে তখন তার তো এমনই লাগে। সেই মুগ্ধতা সে ফেরত পাবে এমন কথা নয়। তবু, শুধু ফেরত পাবে বলেই কি মানুষ দেয়! রাহি জানে সব পথের গন্তব্য থাকে না। কিন্তু পথটাই এত ভাল হয় যে, তাকে না ভালবেসে পারা যায় না।
কিছুদিন আগেও রাহি কিগানের ব্যাপার নিয়ে একটা অদ্ভুত কষ্ট পেত। মন খারাপ হয়ে থাকত ওর। কিন্তু এখন আর হয় না। মানুষের নিজের মনের ভেতরের যুদ্ধ হল সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী। কিন্তু সেই যুদ্ধ যদি সে থামাতে পারে তা হলে যোদ্ধার সাধক হতে সময় লাগে না। তা ছাড়া, এটা এক ধরনের প্র্যাকটিস। বৃষ্টির জল হাতের পাতায় পড়ে আঙুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলে তাকে মুঠোবন্দি করার লোভ সামলানোর মতো প্র্যাকটিস।
রাহি বলল, ‘ঠিক আছে, আমি বারণ করে দিচ্ছি!’
‘মানে?’ গেম শো-টা আবার শুরু হয়ে গেছে ব্রেকের পরে। মা তবু টিভির দিক থেকে মাথা ঘুরিয়ে বলেছিল, ‘আমি কি তাই বললাম!’
‘আশ্চর্য! সব কি আর “না” বলে বলতে হয়? এটা তো এমনিই বোঝা গেল। তুমি তো বললে যে চেনাজানা নেই। বললে কিগানদার আক্কেল নেই!’
‘এসব বললাম আমি?’ মা টিভির থেকে সম্পূর্ণ সরে, ঘুরে বসেছিল। বলেছিল, ‘তোরা সবাই আমায় এমন ভুল বুঝিস কেন রে? আমি বললাম তাই? আর তুই কিগানকে আমার নাম করে এসব বললে ও বিশ্বাস করবে?’
‘আমি বলব যে, মা ‘না’ করেছে। সত্যিই তো!’
‘ভারী অসভ্য মেয়ে তো তুই! বাপে তোর মাথাটা পুরোটাই খেয়েছে দেখছি। নিজেকে কী ভাবিস? দু’পাতা ইংরেজি পড়েছিস বলে তোদের দয়ামায়া বেশি? কেন আমরা পারি না মানুষের উপকার করতে?’
‘আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে,’ রাহির হাসি পাচ্ছিল এবার। বলেছিল, ‘তা হলে?’
‘তা হলে মানে? আসতে বলে দে। এক রাতের জন্য একটা অবলা মেয়ে থাকবে। ক্ষতি কী?
‘অবলা না সবলা জানি না। তবে বিপদে পড়েছে।’
‘যা, দাঁড়িয়ে থাকিস না। ফোন করে কিগানকে বল নিয়ে আসতে। তবে যা দুর্যোগ, সাবধানে আসতে বলিস। বিরক্ত লাগে, সারাদিন সংসারের ঘানি ঠেলে একটু যে শান্তিমতো টিভি দেখব তারও উপায় নেই!’
‘এই রাহি তোর ফোন বাজছে। কোথায় কোথায় যে ফেলে আসিস!’ দীপার গলা পেয়ে দরজার দিকে তাকাল রাহি। দীপা ওর মোবাইলটা হাতে নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
‘কোথায় বাজছে?’ রাহি জিজ্ঞেস করল। মোবাইলটা নিস্তব্ধ হয়ে আছে যে, ‘কে রে? মানে কে ফোন করেছে?’
‘আমি দেখিনি। খাপে ঢোকানো ছিল যে!’
‘কেন দেখিসনি?’ রাহির বিরক্ত লাগল, ‘আমার প্রাইভেট কিছু আছে নাকি?’
‘থাকতেও তো পারে!’ দীপা হাসল। তারপর চোখ নাচিয়ে বলল, ‘কেন ওই রুহান না কে ছেলেটা আসে না? তোর দিকে কেমন করে তাকায় দেখেছিস?’
‘বাজে বকিস না তো,’ রাহি উঠে গিয়ে এক ঝটকায় দীপার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে নিল। তারপর দেখল কার মিস্ড কল উঠেছে।
দীপা ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘কে রে, রুহান?’
‘ধ্যাত,’ রাহি বিরক্ত মুখে তাকাল দীপার দিকে।
দীপা হাসল, ‘ছেলেটা কিন্তু বেশ। ভাল, গুডি গুডি। এসব ছেলেকে ইচ্ছেমতো চালানো যায়।’
‘দিঘি ফোন করেছে, দিঘি। হায় ভগবান। তুই এত ভাট বকছিস কেন?’
‘ভাট?’ দীপা চোখ গোল করল, ‘আবেশের সঙ্গে মিশে মিশে কথার বারোটা বাজিয়েছিস দেখছি। বাবা যদি শোনেন না!’
রাহি পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘দিঘি ফোন করেছিল।’
‘দিঘি!’ ভুরু কোঁচকাল দীপা।
‘ওই যে লম্বা মতো মেয়েটা। সামান্য চাপা রং। বড় বড় চোখ। খুব সুন্দর দেখতে। সপ্তমীর সকালবেলা এল না!’
‘ও,’ দীপা মাথা নাড়ল, ‘সেই গম্ভীর মতো মেয়েটা!’
‘আসলে আগে যখন দেখেছিলাম তখন কিন্তু গম্ভীর দেখিনি। সেদিন কেন যে অত গম্ভীর ছিল কে জানে! একদম কথাই বলল না প্রায়।’
‘অবশ্য জামাইবাবুর অমন হঠাৎ করে শরীর খারাপ হলে সবাই একটু ওরকমই হয়ে যাবে।’
রাহি আর কথা না বাড়িয়ে ফোনটার বোতাম টিপল।
চারবার রিং হওয়ার পর উত্তর এল, ‘রাহিদি, আমি কল করেছিলাম।’
‘আরে অন্য ঘরে ছিল ফোনটা। বলো না।’
দিঘি একটু থামল। তারপর বলল, ‘না, মানে এমনি ফোন করেছিলাম।’
‘এমনি!’ একটু অবাক হল রাহি। গত পরশুও তো ফোন করেছিল। আসলে আজকাল প্রায়ই ফোন করে দিঘি। এটা ওটা কথা বলে। তারপর রেখে দেয়। রাহির একটু অস্বস্তি হয়, অবশ্য ভালও লাগে। যাই হোক, মেয়েটা অন্তত খবরাখবর তো নেয়। এখনকার দিনে ক’জনই বা তা করে! আজকাল সবার জীবনই এত জটিল হয়ে গিয়েছে যে, তার জট ছাড়াতেই গোটা সময়টা কেটে যায়। অন্য কারও খবর নেওয়াই হয় না। তার ভেতরে অন্তত এই মেয়েটা তো ফোন করে!
‘তারপর বলো, কী খবর? পড়াশোনা চলছে?’ রাহি হালকাভাবে জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ। এই চলছে। তোমরা ভাল তো?’
রাহি বলল, ‘আমরা আছি মোটামুটি। দেখো না, কাজকম্ম হচ্ছে না কিছু। তোমাদের বললাম আসতে। তোমরা তো একবার মোটে এলে। গাছ কাটার বিরুদ্ধে একটা ক্যাম্পেন করার ছিল, কিন্তু হলই না। তোমরা এলে হয়তো হত।’
‘কেন, হল না কেন?’ দিঘি জিজ্ঞেস করল।
‘আরে, সুধাদি বারণ করল শেষ অবধি। ওদিকে গাছগুলো কাটা হচ্ছে। একটা সংস্থা খুলে বসে আছে হোমিরা। আমি জয়েন করে ভাবলাম একটা নতুন লেভেল-এ নিয়ে যাব। কিন্তু কিচ্ছু হচ্ছে না। কাছেই হাইওয়ের ওপর পাঁচ কিলোমিটার পরে একটা বস্তি আছে। ভেবেছিলাম ওদের জন্য একটা সুস্থ স্যানিটেশন করে দেব। কিন্তু তাও আটকে আছে। আসলে, একটা ক্রিকেট ম্যাচ করে ফান্ড তুলব ভেবেছিলাম। কত আর অ্যাড তোলা যায় বলো তো!’ রাহি আফশোসের গলায় বলল।
‘কেন, হল না কেন?’ দিঘি আবার জিজ্ঞেস করল।
‘দুর! কানেকশন পাচ্ছি না। রুহান বলে একটা ছেলেকে কিগানদা রেকমেন্ড করল। কিন্তু এতদিন হয়ে গেল, তবু কিচ্ছু হল না। কী যে করব, বুঝতেই পারছি না!’
‘কি-গা-ন?’ দিঘির গলাটা অন্যরকম শোনাল কি?
‘হ্যাঁ, অবশ্য তুমি জানবে কী করে! আরে, এই যে লম্বা মতো। প্লেয়ার প্লেয়ার দেখতে। নীল রঙের চোখ। আরে যে তোমার জামাইবাবুকে কোলে করে আনল।’
‘কিগান? অদ্ভুত, না?’ দিঘির গলাটা কেমন ভোঁতা মনে হল।
‘হ্যাঁ, নামটা যেমন অদ্ভুত, মানুষটাও। এখানের পার্টিক্ল বোর্ডের কারখানার প্রোডাকশন ম্যানেজার। খুব ভাল মানুষ। তবে একটু একচোরা। অন্যকে হেল্প করে, কিন্তু কক্ষনও নিজের সমস্যার কথা অন্যদের বলে না। এখানে সবাই খুব পছন্দ করে,’ রাহি নিজেকে থামাল এবার। হয়তো বেশি বলে ফেলছে।
‘তাই? এত গুণ!’ দিঘির গলায় ব্যঙ্গ স্পষ্ট বুঝতে পারল রাহি।
‘কেন? এমন করে বলছ কেন?’
‘অমন করে শমীদা পড়ে গেল। ডাক্তার এল। আর তাকে শুধু একটু ক্যারি করে দিয়েই কাজ শেষ হয়ে গেল? সেদিন হঠাৎ করে কোথায় চলে গেল তোমার কিগানদা?’ দিঘির গলায় কি রাগ?
রাহি একটু চমকে গেল। কথাটা সত্যিই। সেদিন হঠাৎ কোথায় যে কিগান চলে গিয়েছিল! সবাই শমীকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল, কিন্তু তার ভেতরই কোথায় যেন চলে গিয়েছিল কিগান! তবে পরে বলেছিল।
রাহি বলল, ‘আরে ফ্যাক্টরি থেকে ইমার্জেন্সি ফোন এসেছিল। বয়লার বসে গিয়েছিল যে!’
‘অলওয়েজ অ্যান এক্সকিউজ!’ দিঘির গলায় রাগ।
‘মানে?’ রাহি অবাক হল, ‘কী বলছ তুমি?’
‘নাথিং,’ দিঘির দীর্ঘশ্বাস শুনল রাহি। দিঘি বলল, ‘বাদ দাও। যে যেমন লোক।’
‘না, তুমি জানো না কিগানদাকে। ও অমন নয়। খুব ভাল।’
‘তাই? তোমায় আরও কিছু ভালত্ব দেখিয়েছে নাকি?’ এমন করে বলছে কেন দিঘি?
‘আরে! এমন করে বলছ কেন? আচ্ছা, ঠিক আছে, পরের বার এসো, তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। দেখবে, তোমারও ভাল লাগবে।’
‘ভাল? তা তোমার মনে হচ্ছে ভাল লেগেছে?’ দিঘির গলার ধার যেন বাড়ল।
‘আমার?’ রাহির গলাটা বিষণ্ণ হয়ে এল, ‘না। যাক, ওসব বাদ দাও। আমার ভাললাগার ওপর কিচ্ছু নির্ভর করে না।’
‘ও, আচ্ছা। রাহিদি, মা ডাকছে। আমি এবার রাখি।’ হঠাৎ করে ফোনটা রেখে দিল দিঘি।
মোবাইলটা কান থেকে নামিয়ে অবাক হয়ে সেদিকে তাকাল রাহি। আশ্চর্য পাগলি মেয়ে তো! হঠাৎ এইসব ব্যাপারে এমন রাগ করল কেন? ওর কী প্রবলেম? কিগানকে নিয়ে এত কথা বলে মেয়েটা এমন রেগে গেল কেন কে জানে! মানুষ মাঝে মাঝে এমন ব্যবহার করে যে, খুব আশ্চর্য লাগে। তা ছাড়া, দিঘিকে দেখলে তো বোঝাই যায় না যে, এমন রাগ করতে পারে! আসলে মানুষকে দেখে কি আর বোঝা যায় কিছু? সেদিন শমীর জ্ঞান ফেরার পর কি কেউ বুঝতে পেরেছিল যে, লোকটা একটু আগেই এমন অজ্ঞান হয়েছিল! বরং জ্ঞান আসার পর তো মিটিমিটি হাসছিল। বলছিল, ‘এমন অ্যাটেনশন পাওয়া যায় জানলে রোজ অজ্ঞান হব।’
ডাক্তারকাকু জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আগে এমন হয়েছে?’
‘না, মানে…ইয়ে হ্যাঁ। জাস্ট একবার।’ লজ্জা লজ্জা গলায় বলেছিল শমী।
‘সে কী! ডাক্তার দেখাননি? আর কিছু চেঞ্জ এসেছে আপনার শরীরে?’
‘চেঞ্জ?’ একটু ভেবেছিল শমী। তারপর বলেছিল, ‘হ্যাঁ। বেশ কিছুটা রোগা হয়েছি আমি।’
ডাক্তারকাকু আর বিশেষ কিছু জিজ্ঞেস করেনি। শুধু বলেছিল, ‘এসব অবহেলা করবেন না।’
সেদিন সপ্তমী পুজো ছিল। তবে কেন রাহি জানে না, খুব একটা আনন্দ হয়নি। সবাই এসেছিল। শমীও স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেছিল। তবু গুন্ডা-দিঘিদের পুরো গ্রুপটাকেই কে জানে কেন খুব মনমরা আর ডিপ্রেসড লাগছিল। গুন্ডার মতো আড্ডাবাজ ছেলেও গম্ভীর হয়ে ছিল বেশ। কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিল হোমি। গুন্ডা কিছু বলেনি।
রাহি আর বিশেষ ঘাঁটায়নি। ওরা দুপুরের ভোগ খেয়ে প্রথম বিকেলেই চলে গিয়েছিল। গোটা ব্যাপারটাই খুব অদ্ভুত, দমচাপা মনে হয়েছিল রাহির। মনে হয়েছিল কোথাও নিশ্চয়ই খুব একটা গন্ডগোল হয়েছে!
‘এই, কী রে? তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছিস! মা ডাকছে যে!’
‘মা?’ অবাক হল রাহি, ‘কই আমি শুনতে পাইনি তো!’
‘তা পাবি কেন? ফোনে তো মগ্ন হয়ে আছিস!’ দীপা বলল, ‘ওদিকে মালিনী সিং তো সিং করে করে রান্না করছে!’
‘মানে?’ রাহি অবাক হল, ‘সিং করে করে মানে? আর রান্না? কেন?’
‘আরে সে এক কাণ্ড। ও বলছে, নেপালি কায়দায় আলু দিয়ে কী একটা তরকারি করবে। মা “না” করেছিল। কিন্তু কী জেদি মেয়ে! এত ভদ্রভাবে জেদ করতে কাউকে দেখিনি। তাই মা শেষপর্যন্ত হাল ছেড়ে করতে দিয়েছে রান্না। মা হাল ছেড়ে দিয়েছে। বুঝেছিস তো!’
রাহি হাসল। বলল, ‘মেয়েটা পারে বটে! সত্যি!’
সত্যি মালিনী সিংহ অদ্ভুত মেয়ে। একই সঙ্গে এমন আগুন আর বরফ ও দেখেনি কোনওদিন। কিগান যখন ঢুকেছিল ওদের নিয়ে, প্রথম দেখেই মালিনীকে ভাল লেগে গিয়েছিল রাহির। অমন রং। গোলাপি মার্বেলের মতো স্কিন। আর ফিগারও গ্ল্যামার ম্যাগাজিন থেকে কেটে বসানো। চুল দেখলে মনে হয় যেন মাথায় কালো সিল্কের কাপড় বেঁধে রেখেছে।
কিগান ওর গার্ডেন আমব্রেলার মতো বড় ছাতাটা বন্ধ করে লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলেছিল, ‘কাকিমা আপনাদের বড্ড বিপদে ফেললাম।’
‘সে কী! কেন?’ মা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল কিগানের দিকে।
‘এমন না বলে-কয়ে হুট করে চলে এলাম যে,’ কিগান ছাতাটাকে ওদের বারান্দার পাশে হেলান দিয়ে রেখে বলেছিল, ‘আসলে আদি, মানে আমার ভাই আর মল্লার আমার ওখানেই শুয়ে যেতে পারবে। কিন্তু মালিনীর তো সমস্যা হবে। তাই আপনি এখানে থাকার অনুমতি দিয়ে যে কী উপকার করেছেন!’
মা বলল, ‘আমার মেয়ে যদি হত! তবে? তুমি একে উপকার বলছ কেন? মানুষ মানুষের পাশে না দাঁড়ালে কে দাঁড়াবে? এটা তো মানুষের কর্তব্য!’
রাহির হাসি পেয়েছিল খুব। প্রচুর বাংলা সিরিয়াল দেখার ফল। মা পুরো সিরিয়ালের সংলাপ মুখস্থ করে ঝাড়ছে! এরপর মানুষের কর্তব্য টর্তব্য থেকে বিবেকানন্দের উপদেশে জাম্প করে জীবে প্রেম বললেই পুরো ঝাড় হয়ে যাবে।
কিগান আর অন্যরা বসার ঘরে এসে বসেছিল সোফায়। শুধু মল্লার দাঁড়িয়ে ছিল কোণে।
মা বলেছিল, ‘আরে তুমি বসো, দাঁড়িয়ে কেন?’
মল্লার বলেছিল, ‘আই অ্যাম অলরাইট। আর স্যার আছেন। ওঁর সামনে…’
‘মানে?’ মা অবাক হয়েছিল।
এবার কিগানের পাশে বসা সামান্য শ্যামলা, গোমড়া মুখের আদি বলেছিল, ‘তুমি আবার শুরু করেছ? চুপ করে এই চেয়ারটায় বসো।’
‘ও কে স্যার,’ মল্লার আর সময় নষ্ট না করে একটা বেতের চেয়ারে বসে পড়েছিল।
কিগান তারপর সবার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোমার ভাই আছে? জানতাম না তো!’
কিগান লজ্জা পেয়ে কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে গিয়েছিল।
রাহি কিগানকে বাঁচাতে বলেছিল, ‘আশ্চর্য মা। কিগানদা কতক্ষণ থাকে এখানে? আসে কতটা? সবসময় তো ফ্যাক্টরি নিয়ে পড়ে আছে। আর নিজের হাঁড়ির খবর কি তোমায় দেবে নাকি?’
‘না, না…’ কিগান আমতা আমতা করে কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গিয়েছিল।
তখন আদি বলেছিল, ‘দাদাভাই এমনই। খুব চুপচাপ। খিদে পেলেও কক্ষনও বলে না। এমনকী অনেক অন্যায়ও মুখ বুজে মেনে নেয়।’
‘ধ্যাত,’ কিগান লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল। তারপর কথা অন্য দিকে ঘোরানোর জন্য বলেছিল, ‘আরে, অনেক বেজে গেল। আমায় ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে। আদি চল, আমরা যাই।’
‘কোথায় যাবে না খেয়ে?’ মা দাঁড়িয়ে উঠেছিল, ‘আমি সবার জন্য খিচুড়ি করতে বলেছি আজ। সঙ্গে ডিমভাজা, আলুভাজা, বেগুনভাজা আর বেসনে ডুবিয়ে ফুলকপি ভাজা। না খেয়ে যাবে মানে?’
‘কিন্তু, শুধু তো মালিনী থাকবে।’
‘আদি আর মল্লারও থাকতে পারে। আমাদের ঘরের অভাব? তোমার তো শুনেছি ছোট্ট একটা ঘর। তিন জনে শোবে কোথায়?’
‘আমি মাটিতে শুয়ে পড়তে পারব,’ মল্লার নিচু গলায় বলেছিল।
‘কেন, বিছানায় শুলে তোমার সমস্যা হয়?’ মা হেসে জিজ্ঞেস করেছিল।
‘নট অ্যাট…মানে, হয় না মাসিমা,’ মল্লার ভিতু চোখে একবার তাকিয়েছিল আদির দিকে।
কিগান হেসে বলেছিল, ‘না কাকিমা, আমার প্রবলেম হবে না।’
‘কোনও কথা নয়। ওরা এখানেই থাক। আর বাড়িতে ওর বাবা বা চমক কেউ এখন নেই। ওর বাবা ব্যাবসার কাজে বাইরে আর চমক তো ইলেকশনের জন্য গোটা নর্থ চব্বিশ পরগনা ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়ি খালিই আছে। ওরা সবাই থাকুক।’
‘ও, চমক নেই!’ কিগান যেন স্বস্তি পেয়েছিল কিছুটা। তারপর আদির দিকে তাকিয়ে হেসে বলেছিল, ‘তা হলে থাক, কাকিমা যখন বলছেন। এত কাজ ফ্যাক্টরিতে! তিন শিফটে প্রোডাকশন হচ্ছে। আমি তো রাতে ঠিকমতো ঘুমোতেই পারি না।’
আদি বলেছিল, ‘ঠিক আছে। মালিনীর আপত্তি নেই তো?’
‘আমার?’ মালিনীর বাংলায় সামান্য টান লক্ষ করেছিল রাহি। তবে ওই প্রথম ও গলার স্বর শুনেছিল মালিনীর। অদ্ভুত মিউজিক্যাল গলার স্বর।
মালিনী বলেছিল, ‘আমার প্রবলেম হবে কেন?’
‘হবে না! গুড,’ আদি চোয়াল শক্ত করে বলেছিল, ‘আমি ভেবেছিলাম…যাক গে।’
মালিনী বিরক্ত গলায় বলেছিল, ‘হ্যাঁ, যাক।’
রাহির কানে মালিনীর গলাটা কেমন যেন লেগেছিল। দু’জনের ভেতর কি কোনও গন্ডগোল আছে? হতে পারে। থাকতেই পারে। তাতে রাহির কী? তাই রাহি এই নিয়ে আর চিন্তা করেনি। এরা তো এসেছে মোটে এক রাত্তিরের জন্য।
কিগান চলে যাওয়ার পর মালিনী এসে আড্ডা মারতে শুরু করেছিল রাহি আর দীপার সঙ্গে। ও গান শুনিয়েছিল। নিজের গল্প বলেছিল। বলেছিল ওদের চা-বাগানের কথা। ছোটবেলাকার পাহাড়ে থাকার কথা। বলেছিল জোনাথনদাদু নামে একজন মানুষের কথা। বলেছিল মায়ের মৃত্যুর কথাও।
দীপা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আরে তোমাদের চা-বাগান আছে? আর তুমি চাকরি করছ? পাগল নাকি?’
‘তাতে কী হয়েছে? বাবা তো বরং উৎসাহ দেয়। বলে আমার নিজের যোগ্যতায় কিছু করা উচিত। অন্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার চেয়ে নিজের চেষ্টা করে দেখা উচিত। আর আমারও ভাল লাগে। খুব চ্যালেঞ্জিং কাজ।’
দীপা নিচু গলায় বলেছিল, ‘দেখো, রাহিও স্কুলে পড়ায়। সবাই কেমন নিজের নিজের মতো স্বাধীন! শুধু আমার কিছু করা হল না। সবার গলগ্রহ হয়ে রইলাম!’
‘গলগ্রহ কেন?’ মালিনী অবাক হয়েছিল।
‘তুমি গলগ্রহ মানে বোঝো?’ দীপা হেসেছিল ফিক করে, ‘তুমি আর কী কী বোঝো? তুমি তো হেভি মেয়ে!’
‘হ্যাঁ, বুঝব না? আমার মা শান্তিনিকেতন থেকে পড়াশোনা করেছিল মিউজিক নিয়ে। খুব ভাল গান গাইত। মা-ই শিখিয়েছে গান গাওয়া। আর বাংলাটাও। তাও একটা হালকা টান থেকে গেছে, জানি।’
দীপা বলেছিল, ‘তুমি শুনে শুনে এত ভাল শিখে ফেললে আর আমি কিচ্ছু পারলাম না। আমাদের এখানে ইংরেজিটাও ভাল করে পড়ায় না। তা ছাড়া, আমারও দোষ আছে। পড়ায় মনই বসত না। এত উড়ু-উড়ু করত মন! মনে হত পালিয়ে যাই। তারপর রাহির দাদার সঙ্গে প্রেম হল। ব্যস, আরওই সব ডকে উঠল! এখন আর আফশোস করে কী হবে!’
‘ওঃ এই ঠান্ডায় তুমি যা খেল দেখালে না, ইংলিশ চ্যানেল পার হতে পারো তুমি,’ বারান্দায় উঠে আবেশ চিৎকার করে বলল।
‘ইচ্ছে ছিল তো!’ মল্লার বলল।
‘সে কী রে!’ আবেশ কথাটা বলে জানালা দিয়ে হাত নেড়ে ডাকল রাহিকে। রাহি দুটো ঘর ঘুরে বারান্দায় দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। দেখল, মল্লার ভেজা চুল আর লাল চোখ নিয়ে একটা পাতলা টি-শার্ট আর প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যদিও টি-শার্টটা টাইট হয়েছে। এটা চমকের ছিল। দেখে চিনল রাহি। তবে প্যান্টটায় দড়ি রয়েছে বলে সমস্যা নেই।
রাহিকে দেখে আবেশ বলল, ‘বোঝো ছেলের কাণ্ড! বলে কিনা ইংলিশ চ্যানেল পার হবে। আরে এ কি তোর বাংলা-হিন্দি টিভির চ্যানেল পেয়েছিস? ইংলিশ চ্যানেল রে খোকা, ইংলিশ চ্যানেল।’
‘জানি। ম্যাথু আর্নল্ডের কবিতা আছে এর শোর-এর ওপর, ‘ডোভার বিচ’। Ah, love, let us be true/ To one another… দারুণ লেখা!’
‘শালা, তুই কে রে? শেক্সপিয়র? নাকি বিদেশি স্পাই ছদ্মবেশে ড্রাইভার সেজে এসেছিস! তোর গল্পটা কী বল তো!’
রাহি দেখল, আবেশ দু’ঘণ্টার আলাপে খুব মসৃণভাবে তুমি থেকে তুইতে চলে গেল। আর মল্লার সেটা মাইন্ডও করল না।
আবেশ আবার বলল, ‘তোর বসও এত লেখাপড়া জানে না। তুই সত্যি করে বল তো তুই কে? ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ নোস তো! বা ক্রিপ্টন গ্রহের কোনও কিপটে বাসিন্দা টাইপ।’
‘না না,’ মল্লার হাসল। গত আঠারো ঘণ্টায় প্রথম। তারপর বলল, ‘না না, তেমন কিছু নয়। আসলে ছোট থেকে হরিদ্বারে মানুষ। এই কনকনে জলে সাঁতার কাটতে অভ্যস্ত। তারপর ইংরেজি মিডিয়ম স্কুলে পড়তাম। মা হঠাৎ মারা গেল। বাবা আবার বিয়ে করল। ব্যস তারপর সব গন্ডগোল। টুয়েলভের পরে আর পড়া হয়নি। কিন্তু ইংরেজি এত ভাল লাগত! এখনও এত ভাল লাগে! তাই ছাড়িনি ভাষাটাকে। কাজ খুঁজতে কলকাতায় আসা। বাবার এক বন্ধুর মাধ্যমে এই কাজটা পাই। আমার খারাপ লাগে না।’
মল্লার কথা শেষ করে হঠাৎই থতমত খেয়ে চুপ করে গেল। রাহি দেখল মল্লার ওর কাঁধের ওপর দিয়ে পিছন দিকে তাকাচ্ছে। রাহি পিছনে ফিরে দেখল আদি। আবেশও দেখছে একসঙ্গে।
আবেশ আদিকে বলল, ‘শালা, তুই কেমন সারথি পেয়েছিস রে! এ ম্যাথু আর্নল্ড পড়েছে! আর আমি আর্নল্ড বলতে শোয়ারজেনেগার বুঝি! ওফ্, ভাবা যাচ্ছে না!’
‘সরি স্যার,’ মল্লার একদম কাঁচুমাচু হয়ে গেল।
‘কেন, সরি কেন?’ আবেশ উৎসাহের সঙ্গে বলল, ‘ঠান্ডা জলে সাঁতরাতে পারিস, কবিতা পড়িস, গাড়ি চালাস? ইংরেজি জানিস ভাল, তাও “সরি”? আমি তো কিছুই জানি না। তাও “সরি” নই।’
‘মল্লার তুমি তোমার জায়গায় যাও,’ আদি গম্ভীর গলায় বলল।
‘কেন রে শালা? তুই ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন যে, “তোমার জায়গা” বলছিস! এঃ, যেন ফিল্ডিং সাজাচ্ছে! তোমার জায়গায় যাও! মামদোবাজি। আজ রোববার, আজ ছুটি। ও তোর ড্রাইভার নয়। ও স্বাধীন মানুষ! একদম বসগিরি ফলাবি না। ও কত কিছু জানে! আর তুই ওকে দাবিয়ে রাখছিস! এই মল্লার, বল তো, “আমায় দাবায়ে রাখতে পারবা না।” শালা ক্যাপিটালিস্ট পিগ। শ্রেণিসংগ্রাম করে যাদের বাঁচতে হয় তাদের ওপর অত্যাচার? দেব, ত্রয়ণের চার-পাঁচটা স্পিচের সিনপসিস? পেট খারাপে মরে যাবি। শালা ঠাকুরের থালার সাইজের গোল গোল চিংড়ি আর খেতে হবে না। বুঝেছিস!’
‘যা খুশি কর তোরা!’ আদি মুখটা গম্ভীর করে চলে গেল বসার ঘরে। গতকাল আসার পর থেকে শুধু টিভি দেখছে। অবশ্য কী-ই বা করবে?
আদি চলে যেতেই মল্লার বলল, ‘এটা দাদা আপনি কী করলেন? স্যার রেগে গেলে আমার খুব বিপদ হবে। উনি খুব রাগী। আমার নামে যদি গৌর স্যারের কাছে রিপোর্ট করেন আমার খুব সমস্যা হয়ে যাবে। চাকরি গেলে কী খাব? আর কে চাকরি দেবে আমায়?’
‘আমি দেব। আমাদের হেল্প আর্থ-এ আমার হেল্পার। আমার সঙ্গে নানান কোম্পানিতে যাবি। আর আমি একটু ঠেকে গেলেই ইংরেজি বলে ম্যানেজ করে নিবি। কোনও চাপ নেই।’
‘কী যে বলেন দাদা? আমি কি…’
হাতে ধরা ফোনটা কেঁপে, চিৎকার করে উঠল হঠাৎ। রাহি ঘাবড়ে গেল। আবার কার ফোন!
ত্রয়ণ! চমকে উঠল রাহি। হঠাৎ এই সময়ে ত্রণ ফোন করল! তাও ওকে? ইলেকশনের কাজে ত্রয়ণও তো ব্যস্ত। তা হলে হঠাৎ ওকে ফোন!
‘হ্যালো?’ রাহি ফোনটা কানে লাগাল।
‘ঢ্যামনাটা এসেছে?’ ত্রয়ণের গলায় জন্তু ঢুকে আছে যেন!
‘মানে?’ রাহি চমকে গেল। আজকাল ত্রয়ণ বড্ড ঘনিষ্ঠ হয়ে বাজে কথা বলার চেষ্টা করে। সবার সামনে ও যতটা ভদ্র রাহির সঙ্গে একান্তে ততটাই ছোটলোক।
‘ওই মাগিবাজ আদিত্য শুনলাম তোমাদের বাড়িতে ঢুকেছে! শালা কিগানটা ঢুকিয়েছে, না? এক-এক করে শালা সব পেটোয়াগুলোকে ঢোকাচ্ছে।’
‘ত্রয়ণ, কী বাজে বকছ?’
‘বাজে বকছি! খবরদার তুমি আদিত্যর কাছে যাবে না। ও এক নম্বরের মাগিবাজ। লাগিয়ে পেট করে দেবে। আর তুমি তো মাল ঢলানি আছই। শোনো, আমার সঙ্গে শোবে তুমি। আমিই তোমায় লা…’
ফোনটা কেটে সুইচ-অফ করে দিল রাহি। কী নোংরা, কী নোংরা! এমন হতে পারে মানুষ! এমন দু’মুখো? এমন নোংরা? রাহির মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে চমককে গিয়ে সব বলে দেয়। কিন্তু তারপরেই আবার ভয় লাগে। ত্রয়ণের হাতে যে মারণাস্ত্র রয়েছে! এদিক ওদিক করলে যদি সব ফাঁস করে দেয়! রাহির মনে হয় একটা অক্টোপাস ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ধরে পিষে দিতে চাইছে একদম। রাহি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
‘কী হল?’ আবেশ প্রশ্ন করল।
‘না…কিছু…মানে, কিছু না,’ আবেশের চোখের থেকে চোখ সরিয়ে নিল রাহি।
‘ত্রয়ণ, না?’ আবেশ হাসছে। কেন হাসছে? কী জন্য হাসছে? তবে কি…? সেই রাতের কথা মনে পড়ে গেল রাহির। আবেশ কি কিছু বলতে চাইছে? কিছু বোঝাতে চাইছে!
আবেশ আবার বলল, ‘একটা কথা বলব?’
কথা! ছ্যাঁত করে উঠল রাহির বুক। কতটা দেখেছে ও? কী দেখেছে?
‘কী কথা?’ রাহি শক্ত হয়ে গেল।
আবেশ হাসল আবার। মল্লারকে ‘ভেতরে যা’ বলে পাঠিয়ে দিয়ে কাছে এসে বলল, ‘যা শুনলে তোমার লাভ হবে।’
রাহি শক্ত শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কী বলবে আবেশ? কী বলতে চায় ও?
আবেশ পায়ে-পায়ে এগিয়ে এসে হাসল প্রথমে। তারপর কথা শুরু করল।