মুহূর্তরা দু’বছর আগে – ২৩

২৩

‘তোদের প্রজেক্টটার এমন দশা কেন রে? আল্টিমেটলি হবে তো কাজটা? বারবার এত ডেফার করছে কেন?’ জঙ্গলের দিকটায় তাকিয়ে অন্যমনস্ক গলায় জিজ্ঞেস করল জিয়ানা। যেন জিজ্ঞেস করতে হয় বলে করা।

কিগান বলল, ‘আসলে জমিটা নিয়ে এত সমস্যা হচ্ছে। মানে রাঘব চক্রবর্তী বলে যে-মানুষটি আছেন, তিনি এই নিয়ে কথাই বলছেন না। মানে কথা বলার জন্য টেবিলে বসতেই চাইছেন না। অদ্ভুত জেদি মানুষ!’

‘কথা বলতে আপত্তি কোথায়? শুনেছি ভদ্রলোক খুব ইনফ্লুয়েন্সিয়াল, তাই?’

‘হ্যাঁ, খুবই। মানে এই অঞ্চলে তো বটেই, বিরাট ব্যাবসা। ছেলেও পার্টির উঠতি নেতা। ভদ্রলোক যেখানে হাত দেন লোকজন আপনা থেকে বশ হয়ে যায়।’

‘মানে?’ জিয়ানা এখনও অন্যমনস্ক।

‘এই দেখ না,’ কিগান বলল, ‘ওর মেয়ে, রাহি, এখানে “হেল্‌প আর্থ” বলে একটা সংস্থায় যোগ দিয়েছে। সংস্থাটা ছোট ছিল। কিন্তু মেয়ে যেই যোগ দিল, ব্যস টাকাপয়সার অভাব নেই সংস্থায়। এমনকী আমার একটি পরিচিত ছেলে, আবেশ, মাইনে নিয়ে কাজও করছে ওখানে। কী করে হচ্ছে এসব? ভদ্রলোক পিছন থেকে, মানে আড়াল থেকে ব্যাক করছেন। আবেশ তো বলে অ্যাডভারটাইজ বা হেল্‌প কোনও কিছুর জন্য গেলে ‘রাঘব চক্রবর্তী’ নামটা অদ্ভুতভাবে কাজ করে।’

‘তো, ওঁর ইচ্ছে না হলে তো তোরা হাতে পাবিই না জমি,’ জিয়ানা নির্লিপ্ত গলায় বলল।

হাসল কিগান, ‘ব্যস, তা হলে তোদের কোম্পানিরও কাজ পাবার আশা গেল।’

‘কাজ পাওয়া!’ জিয়ানা আবছাভাবে হাসল, ‘চারটে ফার্মকে তোদের কনসালট্যান্ট অ্যাপ্রুভ করেছে। তার মধ্যে ওয়াটারবার্ড আমাদের প্রাইম কম্পিটিটর। ওরা যেন তেন প্রকারে কাজটা পেতে চায়। কনসালট্যান্টরাও ওদের প্রেফার করছে। মোটা টাকা দিয়েছে কনসালট্যান্টদের। একজনকে তো শুনেছি সিঙ্গাপুরে ফ্ল্যাট দেবে।’

‘তা দিতেই পারে,’ কিগান বলল, ‘এখানে এত বড় প্রজেক্ট। তারপর এমন একটা সেম প্ল্যান্ট অসমেও হবে। কত টাকার কাজ! কামড়াকামড়ি তো হবেই।’

‘আমার কেরিয়ার গোটাই ডিপেন্ড করে আছে এর ওপর।’

‘কেন? তোর কেন?’ কিগান অবাক হল।

জিয়ানা আলগোছে হাসল, ‘গোটা প্রজেক্টটা দেখছি আমি আর ললিত। খুরানাজি মাথার ওপর আছেন, তবু আউটকামটা তো আমাকেই নিতে হবে প্রথমে। টেকনিক্যাল টিম তো কাজ শুরু হওয়ার পর আসবে।’

‘কনসালট্যান্টরা তো জাস্ট প্রপোজ করতে পারে। গৌর স্যার তার কাছ থেকেই কাজ নেবেন যার দাম কম থাকবে। আর এটা এক্সক্লুসিভলি দেখছে স্যাম আর গৌর স্যার নিজে। দামটা রিজনেবল রাখিস, কাজ পেয়ে যাবি,’ কিগান হাসল।

‘স্যামুয়েল কুটিনহো তো তোর কাছের লোক,’ জিয়ানাও হাসল, ‘তুই দেখ না যাতে কাজটা আমরা পাই।’

‘তাই?’ কিগান ছোট্ট করে হাই তুলল, ‘আগে জমিটা পাক কোম্পানি, নইলে সব বিশ বাঁও জলের তলায়।’

‘তুই হাই তুলছিস কেন?’ জিয়ানা ভুরু কোঁচকাল, ‘রাতে ঘুমোস না?’

‘প্রোডাকশনের খুব চাপ। গত এক সপ্তাহ রাতেও কাজ হচ্ছে। এক্সপোর্ট অর্ডার আছে। বাড়ি ফিরতেও পারি না রোজ।’

‘কেন এত খাটিস কিগান?’ জিয়ানার গলা নরম হয়ে এল হঠাৎ, ‘কার জন্য এত কষ্ট করিস? একা তো মানুষ!’

‘শোন কারও জন্য কিছু করি না। একটা ফ্যাক্টরিতে আছি, তার তো একটা কমিটমেন্ট আছে। তাই কাজটা করি।’

‘কিন্তু তোর শরীরটা দেখবি না? কলেজের সময় যা চেহারা ছিল, তেমনই আছে। সেই বাইশ-তেইশ বছর থেকে এখন। বয়স হলে মানুষ তো একটু আকারে বাড়ে। তুই তো তেমনই আছিস। দেখলে মনে হয় আমার চেয়ে ছোট। অতিরিক্ত পরিশ্রম করলে এই হয়।’

‘তাই?’ কিগান চুলে হাত ডোবাল, ‘মানুষ তো রোগাই থাকতে চায় আজকাল। তুই তো দেখছি উলটো কথা বলছিস!’

‘না, তোর আর-একটু মোটা হওয়া দরকার। এবার একটা বিয়ে কর। বউ এলে যদি তার কথা শুনিস। আমার কথা কেন শুনবি!’

‘বিয়ে?’ হাসল কিগান, ‘দেখ, একা থাকার একটা আনন্দ আছে। আর একা থাকতে থাকতে এখন এটাই আমার অভ্যেস হয়ে গেছে।’

জিয়ানা থমকাল একটু। সামনের জঙ্গলটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা সবাই তো একাই। আমিও একা। কিন্তু আমার অভ্যেস হল না কেন বল তো!’

‘দুর,’ হাসল কিগান, ‘বাদ দে। তা তুতুল কেমন আছে?’

‘এমন করে বলছিস যেন কত দেখেছিস তুই আমার মেয়েকে! কতবার বললাম আমাদের বাড়িতে আয়। এসেছিস? ফোন করলেই তো কেমন পালাই পালাই, রেখে দিই রেখে দিই ভাব তোর। যেন আমি বাঘ বা ভালুক। কেন বল তো তুই এমন! পালটাবি না কখনও?’

‘ওল্ড হাবিটস ডাই হার্ড! কাকিমা, মানে তোর মা কেমন আছেন? জানেন, তুই আমার সঙ্গে কথা বলিস!’ কিগান ভুরু নাচিয়ে হাসল।

‘মা?’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল জিয়ানা, ‘মা একইরকম আছে। এখনও ভাবে তুই আমায় ভালবাসিস।’

‘তাই?’ কিগান উঠল। বেঞ্চটা বেশ নড়বড়ে।

‘আমি মাকে বলেছি যে, অমন কিছু নয়। বলেছি, আসলে কিগান কোনও দিনই ঠিক ভালবাসেনি আমায়। জাস্ট একটা…জাস্ট…’ জিয়ানা হঠাৎ চুপ করে হাতে ধরা চায়ের গ্লাসটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, ‘তোর আমার ওপর খুব রাগ, না রে?’

‘তাই?’ কিগান পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা দশ টাকার নোট দিল দোকানদারকে।

‘হ্যাঁ, তোর মনে হয় না যে, আমি তোকে ঠকিয়ে চলে গেছি!’

কিগান হাসল, ‘জিয়ানা ওসব বাদ দে। পুরনো কাসুন্দি।’

‘না, বল না,’ জিয়ানা ডান হাতটা দিয়ে আলতো করে কিগানের হাত ধরল, ‘তোর মনে হয় না যে, তোর সঙ্গে ঘুরলাম আর যেই প্রতিষ্ঠিত একজনের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করল বাবা-মা আর সঙ্গে সঙ্গে আমিও তোকে ছেড়ে তাকে বিয়ে করে নিলাম। তোর মনে হয়নি যে, আমি খুব খারাপ, খুব স্বার্থপর? তোকে ভালবাসিনি একদম!’

‘এসব কেন বলছিস? বাদ দে না। এসব মন থেকে বাদ দে। যা হওয়ার হয়েছে।’

‘না, তুই বল না। তোর মনে হয়েছিল যে আমি লোভী? তোর সঙ্গে চিট করেছি? ঠিক কি না বল? তুই আমায় ঘেন্না করিস, না? আমি ফোন করলেই বুঝতে পারি তুই কেমন যেন পালাই পালাই করিস। কেমন যেন অনিচ্ছার সঙ্গে কথা বলিস। এই যে আমি মাঝে মাঝে তোর সঙ্গে কথা বলি, তোর খোঁজখবর নিই, তোর মনে হয় না বল যে, আমি ন্যাকামো করছি? তোর মনে হয় না যে, এত বছর পর কোত্থেকে উড়ে এসে আবার জুড়ে বসেছি!’

‘কেন বলছিস এমন!’ কিগান হাসল। জিয়ানার চোখমুখ কেমন যেন উদ্‌ভ্রান্তের মতো লাগছে। যেন ভূতে পেয়েছে ওকে।

‘না, তুই সত্যি করে বল। তোর কি মনে হয়েছে যে, আমি ইচ্ছে করে এসব করেছি, না? মানে তোর সঙ্গে বেশ আনন্দ করলাম তারপর সুবিধেমতো তোকে ছেড়ে দিলাম। আমি খুব স্বার্থপর, না রে?’

‘কী হয়েছে তোর?’ কিগান আবার বলল, ‘এমন করে বলছিস কেন?’

জিয়ানা কিগানের চোখে চোখ রাখল। তারপর আবছা গলায় বলল, ‘জানিস, তোর চোখ দুটো পালটে গেছে। না না, রঙের কথা বলছি না। তোর চোখের ভাবের কথা বলছি। কেমন যেন শান্ত হয়ে গেছে তোর চোখ দুটো। তুই এখন অন্য কাউকে ভালবাসিস, না রে?’

‘জঙ্গলটা যেদিন এগিয়ে আসবে, সেদিন তোমার মৃত্যু হবে।’ তলতাবনির জঙ্গলটা এখানে এসে যখন প্রথম দেখেছিল কিগান, ওর এটাই মনে হয়েছিল। ফ্যাক্টরির সামনে বড় রাস্তা। তার ধারে এবড়োখেবড়ো কিছু সস্তার চা, কচুরি, শিঙাড়ার দোকান। তার পিছনে ফাঁকা জায়গা আর সেখান থেকেই একপা-দু’পা করে তলতাবনির জঙ্গল শুরু।

প্রথমবার ফ্যাক্টরির গেটে দাঁড়িয়ে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে কেন যে অমন মনে হয়েছিল কিগানের! আসলে জঙ্গল মানে কি শুধুই ঘন গাছ, শুকনো পাতা আর নানা প্রাণী? কিগানের মনে হয় জঙ্গল মানে আসলে অজানা একটা জীবন। মানে অজানা একটা মন। জঙ্গল মানে সেই মনের ভেতরে লুকোনো নানা ইচ্ছে আর কামনার প্রাণীজগৎ।

বিকেলের রোদে একটা কমলা রঙের জঙ্গল পড়ে রয়েছে সামনে। হেমন্তের বেলা শেষ হয়ে আসছে। সূর্যের মরচে ধরা আলোয় সামনের শুকনো গাছপালার স্তূপ থেকে একটা অদ্ভুত লালচে, প্রায় ব্রোঞ্জের রং ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। কার জঙ্গল এটা? কার সমস্ত পাতা খসে যাচ্ছে ক্রমশ? কে বড় বেশি সোজাসুজি আর খোলামেলা হয়ে যাচ্ছে?

কারণ ছাড়া, একদম কারণ ছাড়াই সপ্তমীর সকালটা আবার মনে পড়ে গেল কিগানের। বছরখানেক পরেও কি জুঁই ফুলের গন্ধ একই রকম থাকে? গন্ধ কী করে থেকে যায় স্মৃতিতে?

উলটো করে মাটিতে পড়ে ছিল শমী। চোখ বন্ধ। নিথর। হাত লাগাতে ভয় পাচ্ছিল সবাই। দূর থেকে বুঝতে না পারলেও দৌড়ে মেন গেটে আসার পর থমকে গিয়েছিল কিগান। এটা কে? কে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওখানে? ওই যে দোহারা চেহারা, বড় বড় চোখ, নিখুঁত থুতনি? কে ওটা? কিগানের পা কেঁপে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল আবার সপ্তমীর সকাল!

সে এক সপ্তমীর সকাল ছিল। ঠাকুরমা মারা গিয়েছে তখন সদ্য। অন্যান্য বার পুজোয় বাইরে চলে গেলেও সেবার আর যায়নি কিগান। ঠাকুরমা ছাড়া ওদের তলাটা কেমন যেন ফাঁকা আর অসমাপ্ত লাগত কিগানের।

ওদের সুকিয়া স্ট্রিটে বড় পুজো হয়। বাদুড়বাগানের দিকে আড্ডা দিতে যেত কিগান আর রুহান একসময়। কিন্তু বড় হওয়ার পর থেকেই সবই কেমন যেন ছানাকাটা ভিড় হয়ে গিয়েছিল। পুজোর দিনগুলো একা থাকতেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করত কিগান। কিন্তু সেবার আর যাওয়া হয়নি।

দিনটা এখনও মনে আছে কিগানের। নিজের ঘরে গিটার নিয়ে বসেছিল ও। দূরে আবছাভাবে রাস্তার ট্র্যাফিকের শব্দের সঙ্গে মিলেমিশে ভেসে আসছিল ঢাকের বাদ্যি। গিটারে আরপিজিও করছিল কিগান। না, কোনও গান নয়। এমনই মনের খুশিতে বাজাচ্ছিল। হঠাৎ পিছনে আলতো পায়ের শব্দের সঙ্গে জুঁই ফুলের গন্ধ ভেসে এসেছিল।

‘তুমি?’ কিগান ঘুরে বসে থামকে গিয়েছিল একদম! এ কে? এমন ফলসা রঙের শাড়ি, ছাড়া চুল, মুক্তোর মালা গলায় তুমি কে এসে দাঁড়ালে আমার সামনে!

‘কেন আসতে নেই?’ দিঘি অভিমানী গলায় বলেছিল।

‘না, না। তবে…এভাবে…মানে… তোমার মা কই?’

‘মা আসেনি। পাঠিয়ে দিয়েছে,’ দিঘি থালায় ঢাকা খাবার দেখিয়ে বলেছিল।

‘ও,’ কিগান বলেছিল, ‘আমায় দাও। আমি রেখে দিচ্ছি।’

‘আমি রাখছি,’ দিঘি কিগানের উত্তরের অপেক্ষা না করে খাবার ঘরে গিয়ে ডাইনিং টেবিলের ওপর খাবার রেখে এসে আবার দাঁড়িয়েছিল সামনে।

‘কিছু বলবে?’ কিগান জিজ্ঞেস করেছিল।

‘আমার ছবি তুলে দেবে একটা?’

‘ছবি?’ কিগান বুঝতে পারছিল যে কষ্ট হচ্ছে ওর। দিঘির শরীর থেকে ভেসে আসা জুঁই ফুলের গন্ধ ক্রমশ অবশ করে ফেলছিল কিগানকে।

‘হ্যাঁ, কেন দেবে না? আমি কি রোজ রোজ শাড়ি পরি নাকি? তুমি এমন করে বলছ কেন?’

কিগান অপ্রস্তুত হয়েছিল একটু। বলেছিল, ‘না না, কেমন করে আর বলছি? ঠিক আছে।’

‘কিন্তু, কোথায় তুলবে? এখানে?’ দিঘি ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে বলেছিল, ‘ঘরটা যে পুরো বাজারের মতো অগোছালো হয়ে আছে। এখানে তুলবে নাকি?’

‘এখানে?’ কিগান চারদিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হয়েছিল খুব। আসলে একা মানুষ কিগান। আর কোনওদিন ঠিক গোছানোও নয় ও। তাই ঘরবাড়ির অবস্থাটা এমনই হয়ে থাকে। ও বলেছিল, ‘ছাদে যাব।’

শরতের রোদ পুরনো ঘিঞ্জি উত্তর কলকাতাকেও সেদিন নতুন রং করা দেওয়ালের মতো চকচকে করে তুলেছিল। ওদের ছাদটা বিশাল বড়। তার একপাশে সিঁড়ির সঙ্গে চিলেকোঠার ঘর। ছাদে উঠে দিঘি চঞ্চল হয়ে উঠেছিল খুব। বলেছিল, ‘কী দারুণ না তোমাদের ছাদটা! কী বড়! আমাদেরটা ভাল নয়। তার ওপর সবসময় ওঠাও যায় না। আমার কতদিনের ইচ্ছে এমন একটা ছাদওয়ালা বাড়ি থাকবে আমার!’

কিগান কিছু না বলে ক্যামেরা নিয়ে খুটখাট করে কীসব অ্যাডজাস্ট করছিল। দিঘি জানত ক্যামেরাটা দামি খুব, ভাল ছবি ওঠে। কিগান ওর ছবি তুলেছিল বেশ কয়েকটা। শাড়ি পরা দিঘি যেন বড় হয়ে গিয়েছিল এক দিনে। ছবি তুলতে তুলতে কিগান হুঁ হাঁ করে যাচ্ছিল দিঘির অনবরত কথায়। তারপর একসময় দিঘি রাগ করে বলেছিল, ‘কী তখন থেকে হ্যাঁ হ্যাঁ করছ। আমায় পেঁচার মতো দেখতে?’

‘পেঁচা?’ ঘাবড়ে গিয়েছিল কিগান। দিঘি কি পেঁচা নিয়ে কিছু বলছিল নাকি?

‘আমি বললাম যে, তর্পণ বলে একটা ছেলে আমায় প্রোপোজ করল আর “না” বলতেই বলল আমায় নাকি পেঁচার মতো দেখতে! আর তাতে তুমি “হ্যাঁ” বললে?’

‘তাই?’ কিগান অবস্থা সামলাতে বলেছিল, ‘তা কেন না করলে! খারাপ ছেলে?’

‘খারাপ? পাগল! দারুণ দেখতে। আইআইটি ক্র্যাক করেছে। পরে আইএএস-এ বসবে।’

‘তা হলে?’ কিগান হেসেছিল। তবে কোথায় যেন বুকের ভেতরে রথের চাকা বসে গিয়েছিল সামান্য। ঝুমকোলতার ঝোপে একা বসে থাকা টুনটুনিটা হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। একটা ছোট্ট ছেলের হঠাৎ যেন রুবি গুলি হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট মনে পড়ে গিয়েছিল। কেন এমন হচ্ছে? দিঘিকে কোনও ছেলে পছন্দ করেছে। আর তাকে না বললেও, দিঘি ভাল ছেলের দলে তাকে রাখছে বলে অমন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল কেন কিগান? নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল কিগানের। বিরক্ত লাগছিল! এ কেমন ছেলেমানুষি রে বাবা! কেন এমন মনে হচ্ছে ওর? কে হয় ওর দিঘি?

‘আমি তোমার সঙ্গে একটা ছবি তুলব,’ দিঘির কথায় হঠাৎ সংবিৎ ফিরেছিল কিগানের।

ও আশ্চর্য হয়ে বলেছিল, ‘আমার সঙ্গে!’

‘হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে! কেন, তুলতে দেবে না!’

‘কিন্তু কে তুলে দেবে?’ কিগান ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলেছিল।

‘আমায় বোকা পেয়েছ, না? চিলেকোঠায় তোমার ট্রাইপড রাখা আছে। ওতে ক্যামেরা বসিয়ে অটোমোডে তোলো। কাটিয়ে বেরিয়ে যাবে, তা হতে দেব না।’

একটা ভাল ট্রাইপড কিগানের নিজের শোবার ঘরে ছিল। কিন্তু চিলেকোঠার ঘরে একটা পুরনো ট্রাইপড রাখা ছিল। সেটার লেভেল গেজটা ঠিক কাজ করে না। কিন্তু নীচে যেতে ইচ্ছে করছিল না কিগানের। আর সত্যি বলতে কী, দিঘির সঙ্গে ছবি তুলতে ইচ্ছে করলেও কোথায় যেন বাধোবাধো ঠেকছিল। নিজেকে খুব বাজে মনে হচ্ছিল কিগানের। পনেরো বছরের ছোট একটা মেয়েকে কেন ভাল লাগবে ওর? মানুষে শুনলে কী বলবে? একই সঙ্গে আকর্ষণ আর বিকর্ষণ হলে কেমন লাগে স্পষ্ট বুঝেছিল কিগান!

ও বলেছিল, ‘সে তো হল, কিন্তু আমার যে একদম ভাল লাগছে না ছবি তুলতে। আসলে আমার ছবি এত খারাপ ওঠে!’

‘ন্যাকামো দেখলে গা জ্বলে যায়!’ দিঘি চুলের ঝাপটা দিয়ে বিরাট বড় চোখ দুটোতে রাগ ফুটিয়ে তুলেছিল অনায়াসে। বলেছিল, ‘দাঁড়াও, আমি আনছি। তোমায় আনতে হবে না।’

চিলেকোঠার ঘরের দিকে দুদ্দাড় করে হেঁটে গিয়েছিল দিঘি। আরে পাগল নাকি মেয়েটা? ঘরটা খুব একটা পরিষ্কার থাকত না তখন। ঝুল, ধুলো-ময়লা অত ভাল শাড়িটায় লেগে যাবে যে! কিগান পিছনে পিছনে ছুটেছিল দিঘির।

চিলেকোঠার ঘরটা ছোট। সামান্য নিচু ছাদ। আর মাত্র একটা জানালা থাকায় একটু যেন আলোও তার কম। ট্রাইপডটা একটা উঁচু তাকের ওপর কেসের মধ্যে ভরে আড়াআড়িভাবে শুইয়ে রাখা ছিল। দিঘি হাত পাচ্ছিল না। কিগান বলেছিল, ‘সরো, আমি দেখছি। পাগলামি কোরো না।’

দিঘি রাগ করে একপাশে সরে গিয়েছিল। বলেছিল, ‘একমাত্র আমিই বুঝি পাগল? আর তুমি কী? ঘরকুনো!’

এক বাগান জুঁই ফুল। দিঘির শরীর থেকে ফুলের ঝাপটা এসে লাগছিল কিগানের গায়ে। কিগান হাত বাড়িয়ে শরীর প্রসারিত করেছিল ওই তাকটার দিকে। আর ঠিক তখনই হঠাৎ, একদম হঠাৎ বাগানটা এসে ঘিরে ফেলেছিল কিগানের শরীর। নরম একটা শরীর আর দুটো মসৃণ হাত এসে পিছন থেকে জাপটে ধরেছিল কিগানকে। বিদ্যুৎস্পর্শ! ছিটকে উঠেছিল কিগান! এ কী হচ্ছে, ও চকিতে পিছনে ফিরেছিল। দেখেছিল দুটো বড় বড় চোখ!

‘কী করছ তুমি?’ কিগান চাপা গলায় বলেছিল।

‘তুমি আমার হরিণ। তোমার শরীর থেকে এমন মাস্কের গন্ধ পাই কেন আমি?’

‘দিঘি, কী হচ্ছে এসব?’ কিগান হাত দিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করেছিল।

‘কেউ আসবে না এখানে। আমি ছাড়া আর কেউ আসে তোমার কাছে? তুমি বোঝো না? কেন বোঝো না তুমি? আর কবে বুঝবে? আর কত নির্লজ্জ হব আমি? তুমি বোঝো না, মাই হার্ট বিট্‌স ফর ইউ?’

কিগানের প্রতিরোধ ভাঙছিল। জুঁই ফুলের গন্ধে, দিঘির স্পর্শে অবশ হয়ে আসছিল বোধ। তবু ও শেষ চেষ্টা করেছিল, ‘ছোট তুমি। আমার চেয়ে অনেক ছোট।’

‘প্রেমে বয়স বলে কিছু হয়? কে ছোট? কত ছোট? পনেরোটা কোনও সংখ্যা হল? তুমি জানো আমি কতদিন তোমায় বোঝাতে চেয়েছি?’ দিঘির নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছিল।

‘তুমি…তুমি এমন…’ কিগান কথা বলতে পারছিল না। নিজের হাত দুটো কথা শুনছিল না ওর। কখন, খানিকটা অজান্তেই ও কোমর জড়িয়ে ধরেছিল দিঘির।

দিঘি টেনে নিয়েছিল কিগানের মাথাটা। বলেছিল, ‘তুমি আমার। শুধুমাত্র আমার।’

এরপর রোদ-জলের পৃথিবী, ধুলো-ময়লার পৃথিবী মুছে গিয়েছিল ক্রমশ।

চোখের কোণ দিয়ে ঘরের জানালার কাছের আলোর রংটা হঠাৎ কেমন পালটে গিয়েছিল যেন! কে ওখানে? কিগান এক ধাক্কায় বাস্তবে ফিরে এসেছিল। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল দিঘির থেকে। তারপর তাকিয়েছিল জানালার দিকে। কে ছিল ওখানে? কেউ কি ছিল? নাকি ভ্রম! কিগান শ্বাস নিয়েছিল বড় করে। দেখেছিল, দিঘি তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। বলছে, ‘কী হল? এমন সরে গেলে কেন? আর…এ বাবা, আমার লিপগ্লস লেগে রয়েছে তোমার ঠোঁটে।’

‘থাক,’ কিগান কথা বলতে পারছিল না, ‘আমি…আমি… মুছে নেব।’

‘আমি মুছে দেব,’ দিঘি এগিয়ে এসে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিয়েছিল ঠোঁট। কিগান বাধা দিতে পারেনি। কেমন যেন অসাড় হয়ে গিয়েছিল ও।

দিঘি বলেছিল, ‘আজ থেকে তুমি আমার। শুধুমাত্র আমার। যদি কোনওদিন অন্য মেয়ের নাম শুনি, এমন শাস্তি দেব না! সারাজীবন মনে থাকবে।’

কিগান নিজেকে সামলাতে সামলাতে বলেছিল, ‘এসব আর না বাড়লেই ভাল।’

দিঘি শুধু বলেছিল, ‘তুমি তোমার মাস্কের গন্ধ দিয়ে যেমন আমায় বেঁধে রেখেছ, তেমনই আমিও তোমায় বেঁধে রাখব আমার জ্যাসমিন দিয়ে, সারাজীবন।’

গন্ধবন্ধন! শমীকে পাঁজাকোলা করে তুলে বাড়ির ভেতরের দিকে নিয়ে যেতে যেতে আবার বহু পুরনো সেই বন্ধন, তার টান টের পেয়েছিল কিগান। ওর পা কাঁপছিল, কষ্ট হচ্ছিল বুকে। মনে হচ্ছিল, এখানে না এলেই তো হত!

কিছুটা যেতেই এসে পড়েছিল সাধুদা। কিগানের হাত থেকে নিতে চেষ্টাও করেছিল শমীকে। কিগান দেয়নি। শমী ছোটখাটো মানুষ। হালকা, পাতলা। যেন প্লাস্টিকের তৈরি। আগে দেখা শমীর সঙ্গে এই রোগা হয়ে যাওয়া শমীর যেন আকাশপাতাল পার্থক্য।

কিগানের পাশে হোমি আর রাহি হাঁটছিল। অন্য পাশে মোটা মতো একটা ছেলে। বুঝতে পারছিল হোমির ভাই বা সেরকম কেউ হবে। আর না দেখতে পেলেও বুঝতে পারছিল পিছনের আর তিন-চারজনের মধ্যে দিঘিও আসছে। জ্যাসমিনের গন্ধ এক অদ্ভুত নির্দেশকের মতো নির্দেশ করছিল ওর উপস্থিতি।

রাঘব চক্রবর্তী আর তার সঙ্গে যে চার-পাঁচজন এগিয়ে এসেছিলেন মণ্ডপ ছেড়ে, তাঁদের মধ্যে দু’জন ডাক্তার। দুর্গাপুজোয় অনেকেই নিমন্ত্রিত থাকে রাহিদের বাড়িতে। ফলে ডাক্তার পেতে অসুবিধে হয়নি।

শমীকে নিয়ে সবাই যখন ব্যস্ত হয়েছিল, কিগান দাঁড়িয়ে ছিল একপাশে। কেন শমীর এমন হল বুঝতে পারেনি। আর আরওই বুঝতে পারেনি দিঘিরা এখানে কীভাবে এল! মানে, হোমির ভাইয়ের সূত্রে যে দিঘিরা আসতে পারে সেটা কল্পনাও করতে পারেনি কিগান।

সুবর্ণ প্রথম কথা বলেছিল কিগানের সঙ্গে। বলেছিল, ‘আরে, কিগানদা! তুমি এখানে! মানে…পাড়ায় তো দেখি না…তাই…’

কিগান কিছু বলেনি। হেসেছিল শুধু। ভেবেছিল সুবর্ণর অ্যাক্টিংটা কাঁচা হচ্ছে। যা হয়েছে, তাতে এই ছেলেটাও তো ছিল। ও তো সবটাই জানে। তবু, কিছু বলেনি কিগান। সরে গিয়েছিল আর একটু দূরে। শুধু দেখেছিল ভিড়ের ভেতর থেকে ওর দিকে মাত্র একঝলক তাকিয়ে মুখ সরিয়ে নিচ্ছে দিঘি।

কিগান আর দাঁড়ায়নি। ও নিজেকেই সরিয়ে নিয়েছিল ওই জায়গা থেকে।

‘কী রে বল, তুই এখন অন্য কাউকে ভালবাসিস, না?’ জিয়ানা আবার জিজ্ঞেস করল।

‘কী সব ছেলেমানুষি করছিস?’ কিগান হাসল, ‘তোর সায়েন্টিস্টবাবু কেমন আছেন? বুকুদা? আমি বুকুদা বলি?’

‘কথা ঘোরাচ্ছিস? সে আছে, ভালই আছে বোধহয়। তার কথা বাদ দে। আমার কথা শোন। আমি যে মাঝে মাঝে তোকে ফোন করি। মাঝে মাঝে যে তোর কথা জিজ্ঞেস করি। খাবার খাচ্ছিস কিনা ঠিকমতো জিজ্ঞেস করি, তোর রাগ হয়, না রে?’

‘কেন রাগ হবে! তুই তো আমার বন্ধু। বন্ধু তো বন্ধুর কথা জানতে চাইতেই পারে। এতে তো কোনও ভুল নেই,’ কিগান দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

‘বন্ধু!’ হাসল জিয়ানা, ‘তোর মনে আছে, প্রথমবার আমায় যখন প্রোপোজ করেছিলি আমি তোকে না করে দিয়ে বলেছিলাম যে, আমরা বন্ধু। মনে আছে? তুই তখন রেগে গিয়েছিলি খুব। কথা বন্ধ করে দিয়েছিলি আমার সঙ্গে। জিজ্ঞেস করায় বলেছিলি তোর বন্ধুর দরকার নেই। তোর অনেক বন্ধু রয়েছে। মনে আছে তোর?’

কিগান হাসল। মনে আছে, সব মনে আছে ওর। কিন্তু কী করবে? সেই জিয়ানা যে আর নেই। সেই কিগানও যে হারিয়ে গিয়েছে কবে। আসলে মরে গিয়েছে সেই কিগান। পথের ধারে জিয়ানা একসময় ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল কিগানকে। একবার তো ফিরেও তাকায়নি চলে যাওয়ার সময়। একা পড়ে থাকতে থাকতে তো মারাই গিয়েছিল কিগান। আর মৃত অবস্থাতেই তো থাকত যদি না দিঘি আসত! যদি না দিঘি স্পর্শ করত ওকে!

‘হাসছিস!’ জিয়ানা উঠল এবার। বলল, ‘জানি। আজ সব কিছুই বড় হাস্যকর লাগে তোর। মনে আছে কিগান, একবার কার্শিয়াং গিয়েছিলি তুই আমায় ধাওয়া করে!’

‘এসব কেন বলছিস জিয়ানা? কেন মাটি খুঁড়ে বের করছিস এসব?’ কিগান আস্তে আস্তে ফ্যাক্টরির দিকে হাঁটতে লাগল।

জিয়ানা ওর পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘জানি না, আমার মনে হয়, জীবন কেমন যেন এক জাদু বাস্তব। এই দেখ, একসময় তুই আর আমি কেমন করে থাকতাম আর এখন কেমন করে থাকি। মনে হয় না তোর? সেই বিকেল আর এই বিকেল কেমন জাদুময় আর কেমন বাস্তব?’

‘নোলানের নাম শুনেছিস?’ কিগান জিজ্ঞেস করল।

‘নোলান!’ জিয়ানা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘নোলান, শোনা শোনা মনে হচ্ছে। ঠিক কে বল তো!’

‘ক্রিস্টোফার নোলান। ব্রিটিশ। হলিউডে ছবি তৈরি করেন। ওঁর “দ্য প্রেস্টিজ” ছবিটা দেখেছিস? ওখানে একটা দারুণ কথা জেনেছি। ম্যাজিক সম্বন্ধে,’ কিগান হাসল।

‘কী রে?’ জিয়ানার গলায় কৌতূহল লক্ষ করল কিগান।

কিগান বলল, ‘যে-কোনও ম্যাজিক তিনটে ভাগে বিভক্ত। এক, প্লেজ। মানে ধর, তোকে ম্যাজিশিয়ান একটা টুপি দেখাল। একদম কাছ থেকে দেখাল। দেখলি টুপিটা ফাঁকা। ম্যাজিশিয়ান সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাল করে তোকে দেখতে দিল। তুই দেখলি সত্যি একটা সাধারণ টুপি। ভেতরে কোনও চোরা পকেট বা খুপরি নেই। তুই সন্তুষ্ট হলি। এটাই হল প্লেজ। বুঝলি?’

‘হুম,’ জিয়ানা মাথা নাড়ল, ‘তারপর?’

‘তার পরের ধাপ হল টার্ন। এই ধাপে ম্যাজিশিয়ান একটা খরগোশ বা পাখি সবাইকে ভাল করে দেখিয়ে ঢুকিয়ে দিল সেই টুপির ভেতর। তারপর একটা সাধারণ রুমাল দিয়ে ঢেকে দিল সেই টুপিটা। তুই কী দেখলি? যে, টুপির ভেতর রয়েছে খরগোশ। তারপর জাদুকর হাত ঘুরিয়ে, ছড়ি ঘুরিয়ে নিজস্ব মন্ত্রবলে এক ঝটকায় সরিয়ে নিল রুমালটা। আর দেখলি, আরে! খরগোশটা গেল কোথায়? টুপি তো ফাঁকা! তুই হতচকিত! সবাই হতচকিত! কিন্তু বল তো, এখানেই কি শেষ হয়ে যায় ম্যাজিকটা?’

‘ম্যাজিকটা?’ জিয়ানা সামান্য চিন্তিত মুখে বলল, ‘না। মানে… আসলে কোথায় গেল খরগোশটা? সেটা না জানলে তো ইনকমপ্লিট থেকে যায় ব্যাপারটা।’

‘ব্রাভো,’ কিগান হাসল, ‘ঠিক বলেছিস। এবার, একজন দর্শককে ডেকে আনল জাদুকর। ডেকে আনল স্টেজের ওপর। তারপর সকলকে অবাক করে দিয়ে তার কোটের ভেতর থেকে বের করে আনল সেই ভ্যানিশ হওয়া খরগোশ। অর্থাৎ, ফিরিয়ে আনল সেই খরগোশটাকে। এইটাই হল প্রেস্টিজ। ম্যাজিকের প্রেস্টিজ। বুঝলি? এই জন্য, এই প্রেস্টিজের জন্য জাদুকর খেলা দেখায়। এই প্রেস্টিজের জন্য মানুষ বেঁচে থাকে। এই প্রেস্টিজের জন্যই তাকে স্যাক্রিফাইস করতে হয় অনেক কিছু। তাকে দাম দিতে হয় অনেক। আমার জীবনে খরগোশটা উধাও হয়েছে। সে এখনও ফিরে আসেনি। আমি এখনও ফিরিয়ে আনতে পারিনি তাকে। আমার জীবনে প্রেস্টিজ পার্টটা আসেনি এখনও। আমি জানি তার জন্য অনেক দাম দিতে হবে আমায়। তাই জাদু-বাস্তবতা বলে কিছু আমার জীবনে নেই। আমার এখনও টার্ন চলছে। খরগোশ এখনও ফিরে আসেনি।’

‘তুই প্রেস্টিজের অপেক্ষা করছিস?’ জিজ্ঞেস করল জিয়ানা।

‘অপেক্ষা করে লাভ নেই। প্রতিটা মানুষকে তা নিজেকেই আনতে হয়। আমি এখনও তা আনতে পারিনি।’

হাঁটতে হাঁটতে কিগানরা এসে পৌঁছোল ফ্যাক্টরি গেটের কাছে।

‘আরে কিগানদা, তোমাদের কথা হয়েছে?’ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে চওড়া করে হাসল রুহান।

‘হ্যাঁ, ওই কথা বলছিলাম। তা রাহি কোথায় বল তো?’

‘রাহি? স্কুল থেকে নিশ্চয় ফিরেছে এতক্ষণে। বাড়িতে আছে বোধহয়।’

‘কেন? কথা বলিসনি?’

‘হ্যাঁ, বলেছি। মানে, ওই ম্যাচ নিয়ে আর কী! আসলে বিশেষ কিছু করতে পারছি না গো। সব সম্পর্কে কেমন যেন জং ধরে গেছে। কেউ পাত্তা দিচ্ছে না,’ রুহানের মুখে হঠাৎ রক্ত চলকে উঠল।

জিয়ানা হাসল, ‘তোমার ওই সোর্স অব ওয়াটার নেওয়া হয়ে গেছে তো?’

‘হ্যাঁ,’ রুহান মাথা নাড়ল। তারপর বলল, ‘আমি তা হলে…’

জিয়ানা বলল, ‘গাড়িতে বোসো, আমি আসছি।’ তারপর কিগানকে বলল, ‘তো? ঠিক আছে?’

রুহান চলে যেতেই কিগান জিয়ানাকে বলল, ‘এই সামান্য জল নেওয়ার জন্য তোর এতটা আসার দরকার ছিল না।’

‘অফিসে কাজ ছিল না। ভাবলাম, যাই। তোর সঙ্গে দেখা তো হল।’

কিগান হাসল, ‘একদিন বুকুদা আর তুতুলকে নিয়ে আসিস।’

‘তুই আমার প্রেস্টিজ দেখতে চাস?’

‘মানে?’ কিগান অবাক হল, ‘হঠাৎ এমন বলছিস!’

জিয়ানা গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘তুই যখন পাহাড়ে সাইকেল নিয়ে একদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলি, সেই দিন তোর গলার মাফলারটার কী রং ছিল মনে আছে তোর?’

কিগান হাসল, ‘মনে আছে। গোলাপি। আসলে প্লেজ কেউ ভোলে? তোর মামা যেভাবে আমায় দেখেছিল! তারপর তো টার্ন দেখালি তুই। ভ্যানিশ হয়ে!’

গাড়িটা ফ্যাক্টরি গেট দিয়ে বেরিয়ে ছোট হতে হতে একসময় একদম নেই হয়ে গেল। তবু রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল কিগান। রোদ কমে আসছে আরও। হাওয়ায় শীতের শিরশিরানি। শুকনো পথের থেকে ধুলো আর পাক খাওয়া পাখির বাসা হঠাৎ শূন্য করে দিল কিগানের মন। ও ভাবল, এটুকু! শুধু এটুকুই জীবন! কিগানের মনে হল অনর্থক এই মরা রোদ, নিস্তব্ধ জঙ্গল, অনর্থক এইসব চলাচল। কী হবে এই জীবন যাপনে? কী আছে এর শেষে? মনে হল, কেন জিয়ানা আসে এখানে? কেন ফোন করে ও? কী চায় ওর কাছে? বড় ক্লান্ত লাগে কিগানের। সারা জীবন ধরে সহ্য করা অপমান, কষ্ট আর যন্ত্রণাগুলোর দিকে ও তাকিয়ে থাকে নিরাসক্তভাবে। মনে হয় এগুলো ওকে করা হয়নি। মনে হয়, কোনও কিছুতেই আর ও নেই।

এই শেষ বিকেলের ঢালু রোদের ভেতর দাঁড়িয়ে হঠাৎ কিগানের মনে হল, এবার বোধহয় পাল তোলার সময় হয়েছে। চেনা পরিচিত সবাইকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু কোথায় যাবে কিগান? কার থেকে দূরে যেতে চায় ও? চেনা-পরিচিতদের থেকে শুধু? নাকি অচেনা মানুষদের থেকেও? কেন যেতে চায়? কেউ ওকে করুণা করছে বলে? নাকি সেই ঘুরিয়ে নেওয়া মুখটার জন্য? পথ আর ফ্যাক্টরির মধ্যে দাঁড়িয়ে কিগান ভাবল আসলে ও কে? পথ? না পথের শেষের কোনও নিশ্চিত গন্তব্য!

পকেটে ফোনটা নড়েচড়ে উঠল হঠাৎ। কিগান বের করল ফোনটা। অফিসের নম্বর। কলকাতা অফিসের।

‘হ্যালো,’ কিগান কানে লাগাল ফোনটা।

‘আরে কাঁহা হ্যায় ইয়ার তু?’ গৌরের গলা।

‘স্যার, ফ্যাক্টরি গেটে।’

‘কেন? গেটম্যানরা সব প্রোডাকশন সামলাচ্ছে নাকি? শোন, একটা সমস্যা হয়েছে। ল্যাব থেকে জানিয়েছে যে, নতুন যে-অ্যাডহেসিভের কেমিক্যাল এসেছে সেটা ভাল নয়। বোর্ডের কোয়ালিটি ঝাড় খাবে। তু আভি উসে ইউজ না করিও। কেমন?’

‘ওকে স্যার,’ কিগান বলল, ‘কিন্তু তা হলে প্রোডাকশনের ব্যাপারে যে একটু চাপ হবে। এক্সপোর্ট মাল। লেটার অব ক্রেডিটের সময় পেরিয়ে যাবে। তখন?’

‘আমি ইমার্জেন্সি বেসিসে অ্যাডহেসিভ পাঠাচ্ছি কিছু। তু দেখ কে প্রোডাকশন না রুকে। নহি তো বাম্বু হো জায়েগা।’

‘ওকে স্যার’, কিগান বলল।

‘আর শোন, তোর ভাইটাকে সামলা তো।’

‘ভাই!’ কিগান সচকিত হল। আদির কথা বলছে কেন গৌর? আদি আবার কী করল?

‘ডর মত্‌ ইয়ার!’ গৌরের গলায় ইয়ারকির সুর, ‘তোর ক্যাসানোভা ভাই অফিসে প্রেম করছে, জানিস?’

‘অ্যাঁ?’ কিগান থতমত খেল। তবে আশ্চর্য হল না। গৌর মানুষটা এমনই।

এই সিরিয়াস তো এই হাসিখুশি। কাজের প্রেশারটা যথাসম্ভব কমাতে চায়।

গৌর বলল, ‘আরে ওয়ান সাইডেড লাভ। মালিনীর দিকে।’

‘স্যার মানে…,’ কিগান ইতস্তত করল, ‘আপনি জানলেন কী করে?’

‘আমায় বলেনি কিছু। কিন্তু আমি কি গাধা? আদির কাজে প্রবলেম হচ্ছে। একটু র‍্যাশ হয়ে যাচ্ছে। মাথা গরম করছে। জমিটারও বন্দোবস্ত করতে পারল না এখনও। ছেলেটার বোধহয় চাকরি করার ইচ্ছে নেই। দেখি আর ক’দিন! কী বল!’ গৌর হাসল, ‘যাক গে। তুই প্রোডাকশনের কাছে থাক। গুরুংয়ের কাজ তোকে করতে হবে না। আমার অত শিক্ষিত গেটকিপার না হলেও চলবে। বুঝেছিস! যা, কাম পে লোট আভি। অনেক গল্প করেছিস মেয়েদের সঙ্গে। চল শুরু হো যা।’

কানটা লাল হয়ে গেল কিগানের। গৌর খুব স্পষ্ট করে কথা শুনিয়ে দিল। কে বলল গৌরকে যে, ও জিয়ানার সঙ্গে বসে আছে? আর আদি? প্রেম করছে! চাকরি চলে যাবে নাকি ছেলেটার? গৌর ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নরমে গরমে যা বলল তা ভাল ঠেকল না। তার মধ্যে কিগান শুনেছে যে, এখানে যে জমি নিয়ে একটা সমস্যা হচ্ছে সেটা ওই বিদেশি কোম্পানি, যাদের সঙ্গে মার্চেন্ট মাল্টিপল্‌স-এর কাজ করার কথা, তারা জেনেছে। আর অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দুর্বল বলে তারা এখন হঠাৎ জয়েন্ট ভেঞ্চার নিয়ে গড়িমসি শুরু করেছে। এদিকে এই অঞ্চলে নির্বাচনও আসছে। ফলে সুধাদিও যে বিশেষ হস্তক্ষেপ করবে জমি টমির ব্যাপারে, তা মনে হচ্ছে না। রাঘব চক্রবর্তী ইলেকশন ক্যাম্পেনে টাকা দেয়। তাকে কে ফালতু চটাবে এখন? পুরো ব্যাপারটা বিচ্ছিরিভাবে ঝুলে রয়েছে।

ফোনটা আবার নড়ে উঠল। নম্বরটা দেখল কিগান। অপরিচিত। কে করল ফোন? কিগান কানে লাগাল ফোনটা, ‘হ্যালো।’ কোনও উত্তর নেই, ‘হ্যালো। কে বলছেন?’ কোনও উত্তর নেই। শুধু বাসের আওয়াজ। মানুষের অস্পষ্ট আওয়াজ। আর মাইকে স্লোগান শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। খুব কাছেই কোথায় যেন মিটিং হচ্ছে। ছাত্র, রাজনীতি, সমাবেশ। এসব শব্দ টুকরো টাকরা ভেসে আসছে।

‘হ্যালো। কে বলছেন?’ কিগান আবার জিজ্ঞেস করল। ওপার নিস্তব্ধ। ‘আশ্চর্য, কে আপনি?’

হালকা শ্বাসের শব্দ যেন শুনল কিগান। তারপর কেটে গেল লাইনটা। কিগান অবাক হয়ে নম্বরটা দেখল। বোধহয় বুথ থেকে করা। আজকাল নানারকম নম্বর দেখা যায়। কিন্তু কে যে করল ফোনটা! ছোট্ট কাঁটার মতো প্রশ্নটা ভেতরে পাক খেতে লাগল কিগানের। পাক খেতে লাগল বিকেল শেষের মরচে রঙের আলো। গৌরের গলা। জীবন ক্রমশ জড়িয়ে আসছে। জটিল হয়ে আসছে। আদিকে যে সেদিন কথাগুলো বলল সেটা ছেলেটা শুনল কি? চিন্তা হচ্ছে কিগানের। খুব চিন্তা হচ্ছে। সামনের দিনগুলোর ভেতর একটা জট পাকানো মেঘ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ও। দেখতে পাচ্ছে যে, ঝড় আসছে। হয়তো জঙ্গলও এগিয়ে আসছে! কে বলতে পারে!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *