২২
গাড়িটা শমীদার। বেশ বড়। এসইউভি। চট করে দেখা যায় না রাস্তায়। দেখেই বোঝা যায় খুব দামি। দিঘি বারণ করেছিল। বলেছিল, ‘শমীদা দরকার নেই। ছেড়ে দাও। আর্য তো গাড়ি নেবে বলছে।’
শমীদা শোনেনি। সামান্য তুতলে, হেসে বলেছিল, ‘কেন, আর্যরই কি শুধু গাড়ি আছে? আমার বুঝি গাড়ি থাকতে নেই! আর গাড়ি বুঝি আমি আমার শালিকে দিতে পারি না? আমার বড় গাড়িটা নিয়ে যা।’
‘ঠিক আছে। তবে তোমাকেও যেতে হবে আমাদের সঙ্গে। অত দামি গাড়ির রিস্ক নেবই না আমি,’ দিঘি নাছোড়বান্দা গলায় বলেছিল।
‘আমি? তোদের মধ্যে আমি? না, না,’ শমীদা একটু গুটিয়ে গিয়েছিল।
‘কেন নয়?’ দিঘি হেসেছিল, ‘তুমি বুড়ো হয়ে গেছ নাকি?’
‘হইনি!’ শমীদা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কেন? তোর দিদি তো বলে…’
‘দিদির কথা বাদ দাও। দিদি অনেককে অনেক কিছু বলে। সব ধরলে চলে না।’
শমী হেসে মাথায় হাত দিয়ে বলেছিল, ‘শুধু বলে না রে, অনেক কিছু করেও।’
দিঘি গম্ভীর গলায় বলেছিল, ‘জানি। বাদ দাও। তুমি চলো না। সপ্তমীর সকাল তো! নিশ্চয়ই ছুটি আছে তোমার! তা হলে যাবে না কেন?’
‘মহুল যাবে?’ খুব সন্তর্পণে প্রশ্নটা করেছিল শমী।
‘দিদি? পাগল! আমরা যাব গুন্ডার দিদির অর্গানাইজেশন, প্লাস ওর বান্ধবীর বাড়ির দুর্গাপুজো দেখতে। অনেক দিন, প্রায় মাস দশেক হল বলেছে। দিদি সেখানে গিয়ে কী করবে?’
‘আমিই বা গিয়ে কী করব বলতে পারিস?’ শমী ওর গদি আঁটা বড় নরম চেয়ারটায় প্রায় ডুবে গিয়েছিল।
‘ধরো, তোমায় আমি বলছি। তুমি যাবে না? শমীদা, এখানে পুজোর সময় ঘরে বসে শুধু শুধু ডিপ্রেসড না হয়ে আমাদের সঙ্গে চলো। ভাল লাগবে তোমার। আর যদি এত বলার পরও না যাও…’ দিঘি ছদ্ম রাগে চোখ পাকিয়েছিল।
‘দিদির মতো মারবি নাকি?’ হো হো করে হেসেছিল শমী। তবু সেই হাসির তলায় ইটচাপা ঘাসের মতো বর্ণহীন কষ্টটা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল দিঘি।
গাড়িটা মসৃণভাবে চলছে। শরতের রোদ দুলছে দু’পাশের মাঠে। সবুজ গাছপালার মাথায় নানান পাখি উড়ছে। দূরে মাঠের ভেতর সারি সারি ইলেকট্রিকের পোস্ট কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুপারম্যানের মতো। তাদের মাথা দিয়ে মোটা মোটা তার কোত্থেকে যে কোথায় যাচ্ছে, কে জানে!
সামনে রাস্তাটা কালো, মসৃণ। দু’পাশের গাছগুলো ঝুঁকে পড়ে মাথায় মাথা লাগিয়ে সামনের রাস্তাটাকে কেমন যেন টানেল করে দিয়েছে। ডান দিকের জানলায় বসে এই সবই চুপচাপ দেখে যাচ্ছে দিঘি। দেখছে যত, ততই ভাল লাগছে। কে বলবে কলকাতা শহরে লোকজন উন্মাদের মতো পুজো-পুজো করে লাফিয়ে পড়েছে? যেন হুল্লোড় না করলে আনন্দ হয় না! যেন গভর্নমেন্ট থেকে নিয়ম করে দিয়েছে যে, উন্মত্ত আনন্দ না করলে সবাইকে জরিমানা করা হবে! দিঘির মনে হয়, সত্যিই কি সবাই আনন্দটা মনের ভেতর থেকে করে? নাকি এটাও অন্যের দেখাদেখি, ইচ্ছে না থাকলেও করতে হয় বলে করে!
পুজো আর হুল্লোড় আজকাল আর একদম ভাল লাগে না দিঘির। বিশেষ করে গত বছর থেকে তো অসহ্য লাগছে আরও। দু’বছরের ভেতর জীবন যে কত বদলে যায়! গত দু’বছর আগেও তো এই সপ্তমীর দিনটায় দিঘি কিগানের কাছেই ছিল। আর এখন! এখন কিগান কোথায়?
‘কী রে তখন থেকে কী ভাবছিস অত?’ একদম পিছনের সিট থেকে গুন্ডা গলা বাড়িয়ে আর্য আর দিঘির কানের কাছে বাজখাঁই গলায় বলল।
‘ওফ!’ আর্য বিরক্ত হল, ‘দাঁত মাজিস না? মুখে গন্ধ।’
‘অ্যাঁ, গন্ধ?’ গুন্ডা খেঁকিয়ে উঠল, ‘খুব বাজে ছেলে তো তুই। দাঁড়া, নেমে তোকে ক্যালাব আজকে। খালি বাজে কথা, না?’
‘গন্ধকে কী বলব? সত্যি, তুই খুব নোংরা গুন্ডা,’ আর্য বিরক্তির গলায় বলল।
‘আমি নোংরা! জানিস, রোজ একটা গোটা সাবান দিয়ে স্নান করি। আধ টিউব টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মাজি। আর আমি নোংরা! জানিস তো যাদের মাথায় স্ক্রু ঢিলে থাকে তারা গন্ধ নিয়েও হ্যালুসিনেট করে। তুই শা—’ সামনে শমীর কথা ভেবেই অনেক কষ্টে জিভের ব্রেক কষল গুন্ডা।
‘আধ টিউব টুথপেস্ট!’ জয়, গুন্ডার পাশে কুঁকড়ে প্রায় অদৃশ্য হয়ে বসে ছিল। তবে এবার যেন একটু দৃশ্যমান হল।
‘হ্যাঁ,’ গুন্ডা বিরাট শরীরটা নিয়ে ঘুরল।
জয় গোল গোল চোখ করে তাকাল, ‘তোর ক’টা দাঁত রে? একশো আঠাশটা? মানে ইয়ে মানুষের তো…’
‘কেন? আমি কুমির?’ গুন্ডা চোখ পাকিয়ে জয়ের দিকে তাকাল।
‘কুমিরের একশো আঠাশটা দাঁত থাকে?’ জয় গুন্ডার চাপে আবছা হতে লাগল আবার, ‘তুই গুনেছিস? কবে ঠিক ইয়ে…’
গুন্ডা আর সামলাতে পারল না নিজেকে। শমীর সামনেই বলল, ‘শালা, আমি কি কুমিরের দাঁতের সেনসাস করি? আর এত ইয়ে ইয়ে করিস কেন? ইয়েতি খুঁজছিস?’
আর্য গম্ভীরভাবে বলল, ‘জয়, জলহস্তী কি কুমিরের দাঁতের সেনসাস করতে পারে? জলে থাকে বলেই কি আর কুমির সম্বন্ধে জ্ঞান থাকবে জলহস্তীর?’
‘শালা,’ গুন্ডা শমীকে আর তোয়াক্কা না করে গাড়িটার ভেতর প্রায় লাফিয়ে উঠল, ‘আজ তোকে…’
দিঘি দেখল ব্যাপারটা বাড়াবাড়ির দিকে যাচ্ছে। শমী ওর বন্ধু-বান্ধবদের সম্বন্ধে কী ভাবছে কে জানে! ও হাফ টার্ন করে গুন্ডার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলল, ‘গাড়িটা উলটে যাক চাস? তখন থেকে লাফাচ্ছিস কেন?’
‘আমি লাফাচ্ছি?’ গুন্ডা শান্ত হয়ে বসলেও অভিমানী গলায় বলল, ‘আর্য আমায় এমন বলল, সেটা কিছু নয়, না? আমি মোটা, বেশ হয়েছে। নিজের বাপের পয়সায় খেয়ে মোটা। কার বাপের কী?’
‘তুই বাপ তুলছিস কেন?’ আর্য সিরিয়াস হয়ে গেল হঠাৎ, ‘দেখ গুন্ডা, লিমিট ছাড়াবি না বলে দিলাম। ছোটলোকের মতো কথা বললে…’
‘কী করবি বে?’ গুন্ডাও সিরিয়াস হয়ে গেল হঠাৎ, ‘শালা, লাল্টু ছেলে। ভাতে দিলে গলে যায়, আবার রোয়াব দেখাচ্ছে! দিঘির সঙ্গে চিপকে থাকিস বলে তোর সঙ্গে কথা বলি। নইলে কে পুছত রে তোকে! তোর বাপের টাকা আছে, তাতে তোর এত গরম কেন? শমীদা, এই মালটাকে গাড়ি কাত করে ফেলে দাও তো! তখন থেকে দেখছি দিঘির শরীরে হাত দেওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। পারভার্ট শালা।’
‘কী বললি?’ আর্য ঘুরে বসে হাত বাড়াল গুন্ডাকে ধরার জন্য। আর্যর পাশে বসা রূপ বাঁ দিকের দরজার সঙ্গে চেপটে গেল একদম।
কিন্তু আর্য ধরার আগেই গুন্ডা খপ করে ওর হাতটা ধরে ঘুরিয়ে ধরল বাঁ হাত দিয়ে আর ডান হাত দিয়ে আর্যর গলার কাছের শার্টটাকে পাকিয়ে মুচড়ে ধরল একদম। হিসহিসে গলায় বলল, ‘শালা, গায়ে হাত দিচ্ছিস? আমি যাদবপুরের ছেলে। এই হাতটা ভেঙে তোর পিছন দিয়ে ঢুকিয়ে দেব, শুয়োরের বাচ্চা। তুই দিঘির বুকে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছিস না?’
‘এই কী করছ? এই,’ শমী ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে পিছনে ঘুরে চিৎকার করে উঠল। তারপর ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে গাড়িটা সাইড করতে বলে, বলল, ‘গুন্ডা, ছাড়ো ওকে। আরে, তোমরা ছাড়াও।’
জয় আর সুবর্ণ গুন্ডাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। পারল না। গুন্ডা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘শোন আর্য, ইচ্ছে করলে তোর হাতটা এখনই ভেঙে দিতে পারি আমি। দম নেই যখন, তখন গায়ে হাত তুলবি না। কখনও তোর বাপ তুলিনি। কিন্তু এবার তুলছি। তোর বাপ টাকাই রোজগার করেছে, ছেলে মানুষ করতে পারেনি। আর ফারদার যদি তোর ঢ্যামনামো দেখেছি ল্যাংটো করে ক্যালাব। তোর বাপ-ঠাকুরদা চোদ্দোগুষ্টিকে নিয়ে আয়, তারা আটকাতে পারলে আমায় আটকাক।’
গাড়িটা বাঁ দিক করে দাঁড়িয়ে পড়ল। গুন্ডা প্রায় ধাক্কা মেরে ছুড়ে ফেলে দিল আর্যকে। তারপর গাড়ির দরজা খুলে সুবর্ণকে ধাক্কা মেরে নেমে গেল রাস্তায়। এতক্ষণ সব শান্ত ছিল। কিন্তু এইটুকু সময়ের মধ্যে কী যে হয়ে গেল!
দিঘি গাড়ি থেকে নামল। কালো বাঁকানো রাস্তার একপাশে সাদা রঙের গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। সামনেই একটা বড় হোর্ডিং। তাতে অল্প কাপড়চোপড় পরে একটা মেয়ে গা-ভরতি গয়না নিয়ে বিজ্ঞাপন করছে। সেই হোর্ডিং-এর তলায় গিয়ে বসে পড়েছে গুন্ডা। আর ওর সামনে জয় আর সুবর্ণ হাত নেড়ে কিছু বোঝাচ্ছে। এদিকে আর্যকে বোঝাচ্ছে শমী আর রূপ।
গোটা দৃশ্যটাকেই খুব বিরক্তির সঙ্গে দেখল দিঘি। এরা বড় হয়েছে? তুই-এর থেকে তুমিতেই একদম এমন মারামারি করতে হবে! দিঘি গাড়ির ভেতর, জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে সুগার ফ্রি একটা সফ্ট ড্রিঙ্কস তুলে নিল। তারপর গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। দেখল আর্যর মুখটা এখনও টকটকে লাল হয়ে আছে।
সুবর্ণ এবার ডাকল দিঘিকে, ‘এই, তুই এদিকে আয়।’
দিঘি এক চুমুক খেয়ে বিরক্তির সঙ্গে বলল, ‘কেন? আমার ভাল লাগছে না।’
‘আরে, ও বলছে চলে যাবে। বলছে, চাপাডাঙা যাবে না।’
চোয়াল চিপল দিঘি। ন্যাকামো। যদি যাবে তো যাক না। আর্য ফালতু সিন ক্রিয়েট করছে। ও চায়, সবাই মিলে ওকে তোয়াজ করুক। এসব অসহ্য লাগে দিঘির। আর যত দিন যাচ্ছে আর্যর এইসব স্বভাবগুলো যেন আর সহ্য করতে পারছে না দিঘি। আর সত্যি বলতে কী গুন্ডা ঠিকই বলেছে। গাড়ির ভেতর বসে, সত্যিই দিঘির বুক ধরতে চাইছিল আর্য। আজকাল দেখা হলেই আর্য দিঘির গায়ে হাত না দিয়ে কথা বলতে পারে না যেন। একটু একা পেলেই বুকে হাত দেয়। মুখে জিভ ঢুকিয়ে চুমু খেতে চায়। এমনকী একদিন তো নীচেও হাত দিতে গিয়েছিল। বিরক্তিতে সেদিন ছিটকে দূরে চলে গিয়েছিল দিঘি। আর্য রাগ করেছিল খুব। বলেছিল, ‘আমার সব বন্ধুরা, ওদের গার্লফ্রেন্ডদের সঙ্গে শুয়েছে। আর আমিই শালা নিরামিষ হয়ে আছি। এখন কতরকম সুবিধে হয়েছে। শুলে কোনও রিস্ক নেই। তবু তুমি মান্ধাতার আমলের সেন্টিমেন্ট নিয়ে বসে আছ? জানো, আমাদের কলেজের অনেক মেয়ে আমার সঙ্গে শুতে চায়। ইউ শুড কনসিডার ইয়োরসেল্ফ লাকি।’
দিঘির মনে হয়েছিল জুতোটা খুলে ঠাস করে মারে আর্যর গালে। তার বদলে ও বলেছিল, ‘আমি আনলাকিই থাকতে চাই। আমি তোমায় আর সহ্য করতে পারছি না। লেট্স ব্রেক আপ।’
সেদিন আর্যর কোনও কথা শোনেনি দিঘি। সটান চলে এসেছিল। টানা সাতদিন কোনও যোগাযোগও রাখেনি। আর্য অনেক অনুনয়-বিনয় করে আবার দিঘির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। দিঘি বলেছিল, ‘আমি আর একবার এমন হলে কিন্তু চলে যাব। শোনো আর্য, তোমাকে একটা কথা ভাল করে বলি, তোমার প্রেমে কিন্তু আমি অন্ধ বা পাগল নই।’
আর্য ঠিক ছিল কয়েকদিন। তারপর আবার শুরু করেছে। দিঘি বিরক্ত হয়ে তাকাল সুবর্ণর দিকে, ‘গেলে যাবে। আমি আটকাতে যাব না। আর্য আর গুন্ডা, ওরা দু’জনেই বড়, আর এমন ছেলেমানুষি করার কোনও কারণই ছিল না। তাই আমার কিছু করার নেই। যা পারে করুক।’
সুবর্ণ কিছু বলার আগেই আর্য প্রায় দৌড়ে এল, ‘কী বললে তুমি? গুন্ডাকে তুমি আমার সঙ্গে এক ব্র্যাকেটে রাখলে! একটা ফালতু, পাতি ছেলে, লোফার। তার সঙ্গে আমি এক! ফালতু কথা বলবে না দিঘি। ওর কোনও ক্লাস আছে?’
দিঘি বলল, ‘তোমার আছে? কেন গায়ে হাত তুলতে গেলে তুমি? পারবে ওর সঙ্গে? কেন হুট করে গায়ে হাত দিতে গেলে? এটা কি কোনও ক্লাস বোঝায়? দেখো, তোমার যে-চুলোয় যেতে ইচ্ছে করে, সেখানে যাও। আমার মাথা খেও না।’
‘মানে? ওই হাতির বাচ্চাটার জন্য তুমি আমায় বলছ এসব!’ আর্য চিৎকার করে উঠল, ‘তোমার কাছে ওই হাতিটা বড় হল? তুমি…তুমি একটা… শালা… ইউ…বিচ।’
বোতলটা ডান হাত থেকে বাঁ হাতে নিয়ে নিমেষের মধ্যে ডান হাতটাকে আর্যর গাল লক্ষ্য করে আড়াআড়ি চালাল দিঘি। চটাস শব্দটা এত জোরে হল যে, দূরে বসা গুন্ডাও তাকাল। তারপর গন্ডগোল দেখে উঠে এগিয়ে এল এদিকে।
‘তুমি আমায়…’ আর্য গালে হাত দিয়ে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘আমায় তুমি…মারলে…কার জন্য মারলে? সবার সামনে আমায় তুমি…’ আর্য হঠাৎ কেঁদে ফেলল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
দিঘি ঘৃণার চোখে দাঁড়ানো থেকে বসে পড়া আর্যকে দেখল। তারপর সরে গেল সামনে থেকে।
‘কী যে করিস না তোরা!’ শমী কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল। দিঘি বুঝল আসলে ওটা মাথায় হাত। শমীদা চিরকালের ভালমানুষ। এমন অবস্থায় পড়ে খুব নাকাল হচ্ছে। আসলে যে ঝামেলা সবচেয়ে বেশি এড়াতে চায়, সে-ই সবচেয়ে বেশি ফেঁসে যায় ঝামেলায়। শমীকে দেখে হঠাৎ কষ্ট হল দিঘির। কী দরকার ছিল ওর শমীকে এসবের ভেতরে টেনে আনার? এমনিতেই সবসময় একটা টেনশন নিয়ে থাকে মানুষটা। তার ওপর আবার বাড়তি ঝামেলা! শমী বেশ রোগা হয়ে গেছে আজকাল। তাই আরও কেমন যেন অসহায় লাগে ওকে। দিঘির মনে হল শমীর কাছে একবার গিয়ে দাঁড়ায়।
গুন্ডা এগিয়ে এসে বলল, ‘তুই ঠিক আছিস?’
‘গুন্ডা, এখন কথা বলিস না, আর আমাকেও বলাস না,’ দিঘি অন্যদিকে তাকাল। রোদটা এবার চড়া হচ্ছে। গরম বাড়ছে।
গুন্ডা কিছুক্ষণ দেখল দিঘিকে। তারপর নিজেই এগিয়ে গেল আর্যর দিকে। বলল, ‘আর্য, যা হয়েছে ভুলে যা। আয়াম সরি। আর দিঘিও যে মেরেছে তোকে তার জন্য কিছু মনে করিস না। এমন হয় কখনও কখনও। আজ সপ্তমী পুজো। বছরে এই দিনগুলো একবারই আসে। সুতরাং বাদ দে। চল, গাড়িতে ওঠ আর দেরি করিস না।’
আর্য দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘তোদের সঙ্গে? এক গাড়িতে? আমি যাব না। কিছুতেই যাব না।’
গুন্ডা একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আর্যর দিকে। তারপর বলল, ‘শোন, এমন হয় মাঝে মাঝে। মনে নিস না। চল, আর দেরি করা ঠিক হবে না। হোমিদিরা চিন্তা করবে।’
‘হোমিদি! কে হোমিদি? মফসস্লের কোথাকার কে এক! এনজিও বানান করতে পারে না, এনজিও চালায়! সব সস্তা পপুলারিটির ধান্দা! এমন ব্যাঙের ছাতা টাইপ এনজিও অনেক আছে। আমি হোমি-টোমি কারও জন্য আসিনি এখানে। এসেছিলাম এই দিঘির জন্য। বাট ডিডন্ট নো, দ্যাট সি উইল টার্ন আউট টু বি আ বিচ।’
‘মুখ সামলে কথা বল আর্য,’ গুন্ডা আবার চোয়াল শক্ত করল।
‘না হলে কী করবি? শালা, পেটি মিড্ল ক্লাস।’ আর্য জামার হাত গুটিয়ে এগিয়ে এল গুন্ডার দিকে, ‘মাথামোটা। তুই আমায় পুজো বলে জ্ঞান দিচ্ছিস?’
‘শালা, আজ তোকে…,’ গুন্ডা আবার হাত তুলল। কিন্তু শমী, সুবর্ণ আর জয় এবার তৈরি হয়েই ছিল। একসঙ্গে তিনজনেই ঝাঁপিয়ে আটকাল গুন্ডাকে। তবু, সেই অবস্থাতেই গুন্ডা পা চালাল। আর পায়ের চটিটা খুলে, উড়ে গিয়ে লাগল আর্যর মুখে।
‘তবে রে বানচোত…’ আর্য এবার তেড়ে আসতে গেল। কিন্তু তার আগেই দিঘি গিয়ে দাঁড়াল সামনে। দু’হাত দিয়ে ওকে আটকে বলল, ‘আর একদম না। যাও, বাস ধরে বাড়ি ফিরে যাও। যাও বলছি।’
‘মানে?’ আর্য দাঁড়িয়ে পড়ল। মুখচোখ লাল।
দিঘি দেখল, জায়গাটা গ্রাম। আর তাই ধীরে ধীরে লোকজন জমছে চারপাশে। ভ্যান দাঁড়িয়ে পড়েছে, সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে কিছু মানুষ। ছেলেমেয়েরাও কিছু জড়ো হয়েছে কলকাতার মানুষদের তামাশা দেখার জন্য। দিঘি দেখল কয়েকজন তো বেশ হাসিহাসি মুখ করে তাকিয়ে রয়েছে। যেন সার্কাস চলছে। ওর রাগ হল। গুন্ডা আর আর্য কি এসব বুঝছে না? কেন এমন তামাশা করছে? খোলা রাস্তায় মানুষের চোখের সামনে এমন করার মানে কী? ওরা এই সহজ জিনিসটা বুঝছে না কেন যে, মানুষের নিজের সম্মান তার নিজের কাছে! সেটা নিজেকেই সামলে রাখতে হয়! সেটাকে হাটের মধ্যে আনতে নেই!
দিঘি বলল, ‘দেখো আর্য, আর নাটক কোরো না। বাস ধরো, বা চলতি শাট্ল ধরো, ধরে কাটো।’
‘চলে যেতে বলছ? তা তো বলবেই…জানি না আমি? কেন সেদিন ফোনে অমন কিগানদা…কিগানদা করছিলে! সবাই কিগানকে দোষ দেয়, কিন্তু আমার তো মনে হয় তোমার দোষ কিছু কম ছিল না।’
‘মানে? কী বললে তুমি!’ দিঘি অবাক হল।
‘তোমার আর আমাকে দরকার নেই। আমি খুব বুঝি। আমারই ভুল। আমি…’ আর্য রাগে খেই হারিয়ে ফেলল কথার।
‘বাজে বোকো না,’ দিঘি কড়া গলায় বলল, ‘আর দরকার? “বিচ” বলার পর আর কোন মুখে এসব বলছ তুমি?’
‘বেশ করেছি,’ আর্য চিৎকার করল, ‘আমার বাবা কোনওদিন গায়ে হাত দেয়নি আমার। তুমি দিয়েছ। আমি যাব ভেবেছ তোমাদের সঙ্গে? ইউ পিপ্ল জাস্ট গো টু হেল।’
আর্য আর কোনওদিকে না তাকিয়ে হাবড়ার দিক থেকে বারাসতের দিকে যাওয়ার একটা বাসকে হাত দেখিয়ে থামাল। দিঘি দেখল বাসটার গায়ে লেখা আছে ন’হাটা। তলায় বড় করে লেখা ‘ভালবেসো না পার্থসারথী’।
শমী আর্যর পিছনে পিছনে গিয়েছিল। কিন্তু আটকাতে পারেনি।
বাসটা চলে যাওয়ার পর, শমী এসে বলল, ‘এঃ, সপ্তমীর সকালটা কী হয়ে গেল বল তো! তোরা সব নামেই বড় হয়েছিস। আসলে, কিচ্ছু বড় হোসনি। আমি তো ভাবতাম মহুলই এমন রাগী আর রগচটা। দেখলাম দিঘি, তুইও তো কম যাস না রে! যাক গে, চল, আর দেরি করিস না।’
এতক্ষণ রূপ চুপ ছিল। কিন্তু গাড়িতে উঠেই বলল, ‘শমীদা, একটা কথা বলব?’
ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে পিছন ফিরল শমী, ‘বলো।’
‘একটা সিগারেট ধরাতেই হবে এবার। তুমি কিছু মাইন্ড করবে না তো?’
‘তুমি সিগারেট খাও?’ শমী অবাক হল।
এটাই ভাল লাগে দিঘির। শমীদা মানুষটা বড্ড সরল। অনেক ছেলেই মেয়েদের এসব ব্যাপারে আশ্চর্য হলেও সেটা দেখায় না। কিন্তু শমীদা তা মোটেও নয়। না হলে কেউ এমনভাবে বলে?
রূপ বলল, ‘হ্যাঁ, খাই, কেন? প্রবলেম আছে?’
‘না, না,’ শমী একটু ঘাবড়াল, ‘কোনও প্রবলেম নেই। মানে এত অল্প বয়সে এসব খাওয়া তো ভাল নয়। আসলে, কোনওদিনই খাওয়া ভাল নয়। কোনও বয়সেই ভাল নয়। তাই বলছি আর কী?’
‘জানি,’ রূপ গম্ভীর হল, ‘সে তো রাস্তার রোল, কাবাব, কাটা ফল, তেলেভাজা কোনও কিছু খাওয়াই ভাল না। তা বলে কি মানুষ খাচ্ছে না? তুমি খাও না?’
‘তা হলেও,’ শমী বোঝাতে চাইল, ‘দুটো কি এক হল? তোমার এই বয়সে লাংস দুটোর কী অবস্থা হবে বলো তো?’
‘দুর, ছাড়ো না,’ রূপ হাসল, ‘আমি খাচ্ছি একটা। এমন হাই ভোল্টেজ ড্রামার পরে আর কি শান্তভাবে বসে থাকা যায়? ডোন্ট মাইন্ড, কেমন?’
শমীর উত্তরের অপেক্ষা না করেই রূপ সিগারেট ধরিয়ে ফেলল। তারপর দিঘিকে বলল, ‘তোদের মধ্যে যা হল, এর পর কী হবে?’
‘তোকে কোনও ছেলে বিচ বললে, তুই কী করতিস?’ দিঘি পালটা প্রশ্ন করল।
‘আঃ, আমার কথা বাদ দে না। তুই কী করবি?’
‘আমি? তোর কী মনে হয়?’ দিঘি আবার পালটা প্রশ্ন করল।
‘আর সম্পর্ক রাখবি না। অবশ্য আমার…’ কথাটা শেষ না করেই চুপ করে গেল রূপ।
‘বল। তোর, কী?’ দিঘি জানালা দিয়ে আসা হাওয়ার ঝাপটা থেকে চুলগুলো সামলাতে সামলাতে বলল, ‘তোর কী মনে হয় সেটা বল।’
‘আমার মনে হয়, তুই কোনওদিনই আর্যকে সেভাবে ভালবাসতিস না। কিছু মনে করিস না। আমার মনে হয়েছে যে, ও যেন একটা নিয়মের মতো। যেন বয়ফ্রেন্ড থাকতে হয় বলে থাকা। ও তোর জন্য যেমন করত, তুই তো করতিস না। এই যে চলে গেল, তোর তো কষ্ট হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না! কেন বল তো এমন?’
দিঘি উত্তর দিতে গিয়েও থমকাল। আসলে সত্যিই বলেছে রূপ। গাড়িতে একটা ঝগঝম্প টাইপ হিন্দি গান চালিয়েছে শমী। হয়তো মুডটাকে ভাল করার জন্যই। তাই পিছনের সিটে বসা সুবর্ণ, গুন্ডা বা জয়, কেউ কোনও কথা শুনতে পাচ্ছে না।
দিঘি ঠোঁট কামড়ে বাইরের দিকে তাকাল। এই অশোকনগর পেরোচ্ছে গাড়ি। রেল স্টেশনের নামটা দূর থেকে পড়তে পারল দিঘি। যদিও গুন্ডাও গলা তুলে নামটা বলল। রেল গেটটার দুই পাশেই প্রায় বারোটা করে স্পিড ব্রেকার পর পর সাজানো। এত ভাল গাড়িটাকেও ডিঙি নৌকোর মতো মনে হল দিঘির।
পুজোর সকাল বলেই কি লোকের ভিড় বেশি? মাঝে মাঝে দু’-একটা প্যান্ডেল পড়ছে পথে। আর সেখানে তারস্বরে হিন্দি গান বাজছে। দিঘির মনে হল কলকাতা থেকে এত দূরে এসেও সেই বাংলা বইয়ে পড়া মফসস্লের বা গ্রামের পুজো তো পাচ্ছে না! বরং সেই এক প্যান্ডেল-মাইক আর ছিট কেটে বানানো মানুষ। সব যেন একই ফোটোকপি মেশিন থেকে বেরিয়েছে। পুজো এখন আর ভাল লাগে না দিঘির। আর সকাল থেকে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনায় হঠাৎ যেন সেই না ভাল লাগাটাই কয়েক গুণ বেড়ে গেল।
দিঘি বলল, ‘ছাড় তো, অন্য কথা বল।’
সিগারেট শেষ করে সেটা টোকা মেরে জানালা দিয়ে ফেলে রূপ হাসল। বলল, ‘তুই কি অন্য কাউকে পছন্দ করিস?’
‘মানে?’ দিঘি চমকে উঠল, ‘এমন বলছিস কেন?’
রূপ চাপা গলায় কী একটা বলতে যাচ্ছিল।
‘এই তোরা দুটো মিলে তখন থেকে কী ফুসফুস করছিস রে?’ পিছন থেকে হুংকার দিল গুন্ডা, ‘জানিস না অন্যদের সামনে এমন লো টোনে কথা বলা খুব অন্যায়। ব্যাড ম্যানার্স।’
‘অ্যাঃ, ম্যানারিজমের রেন অ্যান্ড মার্টিন!’ রূপ ঘুরে বলল, ‘আমি আর্য নই। এমন ক্যালাব না, ওই চর্বির পাহাড় নিয়েও ছত্রিশ ঘণ্টা মাস্ল পেন হবে।’
গুন্ডা হাসল, ‘সে জানি। তুই আসলে ছেলে। সকলকে বোকা বানানোর জন্য বসে হিসু করিস আর…’
‘চুপ কর,’ জয় স্বভাববিরুদ্ধভাবে ধমকে উঠল।
স্বাভাবিক। শমী বসে রয়েছে তো! গুন্ডা মাঝে মাঝে এত বাজে কথা বলে যে, দিঘির বিরক্ত লেগে যায়। দিঘি ভাবল গুন্ডাকে এবার কড়া করে একটা ধমক দেয়। কিন্তু তার আগেই হঠাৎ শমী সামনের সিট থেকে বলল, ‘এই, তোমাদের কারও কাছে ব্যথার ওষুধ আছে? আমার পেট ব্যথা করছে।’
‘পেট?’ জয় প্রথম উত্তর দিল, ‘আমারও না কেমন যেন মাথাটা ঠিক মানে…’
‘চুপ কর,’ রূপ ধমক দিল, ‘কারও কিছু হলেই তোরও কিছু হয় কেন বল তো? তুই একদম কথা বলবি না। চুপ করে থাক।’
‘তোমার কি খুব ব্যথা করছে?’ দিঘির চিন্তা হল।
‘না। তবে আমি জানি ব্যথাটা বাড়বে। নাভির সোজাসুজি হয় ব্যথাটা। প্রথমে ব্যথাটা অল্প থাকে। তারপর বাড়ে। আমি অন্য দিন ওষুধ খেয়ে ম্যানেজ করি। কিন্তু আজ ওষুধ আনিনি সঙ্গে। আর এখন…’ শমী মুখটা বিকৃত করল।
‘তুমি ডাক্তার দেখাওনি?’ দিঘি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘না। আর, আবার ডাক্তার! কয়েক মাস আগে যা হল!’ শমী পেটটা হাত দিয়ে চেপে ধরা অবস্থাতেও হাসল অল্প।
দিঘি গম্ভীর হয়ে গেল। সত্যি ঠিকই বলেছে শমী। এখনও সেই সন্ধেটার কথা মনে পড়লে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে দিঘির।
মায়ের ফোন পাওয়ার পর আর্যকে ফোন করে ঠিক কী বলছে, তা নিজেরই খেয়াল ছিল না দিঘির। শুধু আর্য বলেছিল, ‘কী বলছ তুমি? কিগান? কোথায় কিগান? কী হয়েছে?’
দিঘি বলেছিল, ‘শমীদা…শমীদা অসুস্থ! তুমি…তোমরা কই?’
‘কী হয়েছে?’ আর্য জিজ্ঞেস করেছিল।
‘কোথায় তুমি? আমি বাড়ি যাব।’
‘বাড়ি? কেন? পার্টি তো শুরুই হয়নি ঠিক করে!’ আর্য খুব অবাক হয়েছিল।
‘তো? শমীদা অসুস্থ। আমায় বাড়ি যেতেই হবে। আমি…আমি চললাম।’
‘আরে,’ আর্য চিৎকার করেছিল, ‘শমীদা অসুস্থ তো তোমার কী? ফালতু পার্টি নষ্ট করছ কেন আমাদের?’
‘আমার কী মানে?’ রাগে হাত-পা অসাড় হয়ে আসছিল দিঘির।
‘তোমার কে হয় শমীদা? তোমার দিদির ওয়ান্স আপন আ টাইম বর? চেপে বসো। আমরা আসছি। ব্যাপক পার্টি হবে।’
‘আর্য! কী বলছ তুমি?’ দিঘি যেন চিনতে পারছিল না ছেলেটাকে। আলাপ হওয়ার সময় থেকে এই সময়ের আর্য যেন অন্য মানুষ। যেন অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা! কী করে এমন কথা বলতে পারে ও!
‘আমি রাখছি,’ দিঘি বিরক্ত হয়ে আর কথা বাড়ায়নি। ফোনটা কেটে সুইচ অফ করে দিয়েছিল। তারপর প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে এসেছিল বাড়িটার থেকে। বেরোবার পথে ললিত একবার কথা বলতে এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু দিঘি পাত্তা দেয়নি বিশেষ। কারণ, কথা বললে দেরি হবে। তা ছাড়া ললিতকে বললেই নানারকম কথার জবাব দিতে হবে। ললিত মামা হলেও সম্পর্ক তো খুব একটা ঘনিষ্ঠ নয়। তাই দিঘির অত কথা বলার ইচ্ছে ছিল না। তা ছাড়া দিদি কী যে কাণ্ড ঘটিয়েছে সেটা তো স্পষ্ট বুঝতে পারছে না!
রাস্তায় বেরিয়েই একটা ট্যাক্সি পেয়ে গিয়েছিল দিঘি। নর্থে যাবে শুনে ট্যাক্সিচালক বৃদ্ধটি আর ‘না’ করেনি। ট্যাক্সিতে উঠে ফোনটা আবার খুলেছিল দিঘি। কারণ ভেবেছিল, মা তো ফোন করতেই পারে। দিঘিকে তো দরকার হতেই পারে! কিন্তু ফোনটা সুইচ অন করামাত্র আবার ফোন এসেছিল আর্যর। দিঘি আর ধরেনি। কে ধরবে? মাথা গরম হয়ে যাবে আর্যর কথা শুনলে। এখন মাথা ঠান্ডা রাখাই জরুরি। ফোনটা কেটে দিয়েছিল দিঘি। তারপর নিজেই মাকে ফোন করেছিল একটা। এনগেজ্ড। বিরক্তিতে ফোনটাকে আছাড় মারতে ইচ্ছে করছিল ওর। মা কী করছে? কার সঙ্গে কথা বলছে? দিঘি ভেবেছিল একবার দিদিকে ফোন করবে কিনা। তারপর মত বদলেছিল। কে জানে দিদি এখন কেমন মানসিক অবস্থায় রয়েছে! ফোনটাকে মুঠোয় ধরে বসেছিল দিঘি। কলকাতার সন্ধেবেলাটাকে মনে হচ্ছিল প্রকাণ্ড একটা রাক্ষসের হাঁ। মনে হচ্ছিল সমস্ত আলোগুলো তার ঝলমলে ধারালো দাঁত। তারা যেন কামড় দিতে আসছিল দিঘিকে। সমস্তটাই অসহ্য মনে হচ্ছিল দিঘির। মনে হচ্ছিল কেউ নেই ওর যাকে ফোন করতে পারে, যাকে এই অস্বস্তির সময়গুলোয় নিজের মনের অবস্থাটা বলতে পারে। ওর মনে হচ্ছিল এমন সময় যদি, যদি সে থাকত! কিন্তু কী করত থেকে? কোন কাজে আসত? কোন উপকারটা হত তার দ্বারা?
জানে না, দিঘি জানে না। তবু মনে হয়েছিল, যদি থাকত! যদি একবার দিঘির শরীরটা দু’হাতের মধ্যে নিয়ে বলত, ‘ভয় পেয়ো না।’ আচ্ছা, এমন ইচ্ছে হয়েছিল বলেই কি আর্যকে ফোন করে ও ‘কিগান’ বলে ফেলেছিল? ওর অবচেতন কি ওকে কিগানের কাছে নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল?
বিষণ্ণ, অগোছালো কলকাতার ভেতর দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল হলুদ ট্যাক্সি। সিগনালের লাল-সবুজ আলো, বাসের হর্ন, ট্র্যাফিকের সাদা-কালো মাড়িয়ে ছুটছিল ট্যাক্সি। অদ্ভুত তেতো গন্ধের এক হাওয়া ভেসে বেড়াচ্ছিল চারদিকে। আর তার ভেতর আচমকা, একদম আচমকাই মাস্কের গন্ধ ভেসে এসেছিল দিঘির কাছে! চরাচর জুড়ে এক কস্তুরী গন্ধ পেয়েছিল হরিণী। সে মুখ তুলে তাকিয়েছিল জঙ্গলের দিকে। আলো ঝলমলে এক জঙ্গল গিলে নিয়েছে তার হরিণকে। হরিণ তার গন্ধটুকু রেখে গিয়েছে শুধু। দিঘি তাকিয়েছিল জঙ্গলের দিকে। যেভাবে পৃথিবী রোজ যাবতীয় অন্ধকার বুকে নিয়ে তাকিয়ে থাকে সূর্যের দিকে, তার আলোর গন্ধের দিকে।
সপ্তমীর সকাল! সপ্তমীর এক সকালে, প্রথম সেই গন্ধ কাছের থেকে পেয়েছিল দিঘি। সম্পূর্ণ একলা একটা ছাদের ঘরে হরিণকে কাছে টেনে নিয়েছিল ও। আর তার প্রেমের গন্ধ গোটা একটা দেবীপক্ষ বদলে দিয়েছিল ওর।
আজও সেই সপ্তমীর সকাল। খোলা হাওয়ায় আজও কোথায় যেন সূর্য ছড়িয়ে রাখছে তার আলোর গন্ধ। শুধু হরিণ আর নেই।
কারও কাছে ওষুধ নেই। শমী পেটে হাত দিয়ে বসে রয়েছে সামনের সিটে। দিঘির পাশে রূপ কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনছে। পিছনে গুন্ডা, সুবর্ণ আর জয় নিচু গলায় কথা বলছে। আর্যর অমনভাবে চলে যাওয়াটা কারওই খুব একটা ভাল লাগেনি। সেটা নিয়েই হয়তো কথা বলছে!
দিঘির চিন্তা হল, শমীদার শরীরটা কি খুবই খারাপ লাগছে? আসলে মানুষটা এমনিতেই মুখচোরা। আর শরীর খারাপ হলে তো আরওই চুপ করে যায়। সেদিনও তো এমনই চুপ করে ছিল শমী। ট্যাক্সি থেকে নেমে দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে দিঘি দেখেছিল। বসার ঘরে ডাক্তারকাকু বসে ছিল। বাবা আর মা দু’দিকে দাঁড়িয়ে ছিল গম্ভীর মুখে। মহুল একটা সিঙ্গল সোফায় বসে ছিল পা মুড়ে জড়সড় হয়ে। তারপর শমীর দিকে চোখ পড়েছিল দিঘির। সোফায় আধশোয়া হয়ে আছে। মাথায় ব্যান্ডেজের পট্টি। মুখে হালকা লজ্জা লজ্জা হাসি। দিঘিকে দেখে সামান্য তুতলে ক্লান্ত গলায় বলেছিল, ‘আরে তুমি! তোমার শুনলাম নেমন্তন্ন আছে? ছেড়ে এলে কেন?’
দিঘি কিছু বলার আগেই ডাক্তারকাকু বলেছিল, ‘এ কী, তোমায় কথা বলতে বারণ করেছি না? শোনো, মাথা ফাটেনি। কিন্তু কেটেছে আর আশপাশে রক্তও জমেছে। ফলে মাথায় যেন চাপ না পড়ে। ওষুধ দিয়েছি, ঘুমোনোর চেষ্টা করো।’
তখনকার মতো চুপ থাকলেও ডাক্তারকাকু চলে যেতেই শমী আবার কথা শুরু করেছিল। মাকে বলেছিল, ‘আপনি কেন দিঘিকে ডেকে আনলেন? কী এমন হয়েছে আমার?’
মা শমীর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলেছিল, ‘তুমি আবার কথা বলছ?’ তারপর মহুলের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘তোর নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে খুব। মেরে ফেলতে পারলি না ছেলেটাকে!’
মহুল কিচ্ছু না বলে মাথা নিচু করে বসে ছিল।
মা তবু থামেনি, বলেছিল, ‘তোর ব্যাবসা বড় না মানুষ বড়? ওদের ব্যবসায় তোর জিনিসপত্র হয়তো সেভাবে কাজ করবে না, তাই শমীর বাবা-দাদারা আপত্তি করছেন। সেখানে তুই…একদম ছেলেটার মাথায় ওই ফ্লাওয়ার ভাস দিয়ে মারবি? ভাগ্যিস মাথাটা সরিয়ে নিয়েছিল, তাই এ যাত্রায় বেঁচে গেছে। না হলে কী হত বল তো! শমী তো তোর নামে অ্যাটেম্পট টু মার্ডারের চার্জও আনতে পারে। ও কোথায় তোকে নিজের কাছে নিতে চায়, আর তুই? ব্যাবসা করে কী করবি? এত এত টাকা দিয়ে কী করবি? ক্রিকেট টিম কিনবি? তুই আমার মেয়ে? তুই এমন হবি ভাবতেও পারিনি। এখন শমীর বাড়ির লোক কী ভাববে? তোর মতো রাক্ষসী আমি কোনওদিন দেখিনি।’
ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়েছিল দিঘির কাছে। ও মহুলের পাশে বসে বলেছিল, ‘দিদি, তুই ব্যাবসার কারণে এমন করেছিস? হ্যাভ ইউ গন ম্যাড? পাগল নাকি তুই!’
মহুল খুব নিচু গলায়, প্রায় অস্ফুটে বলেছিল, ‘আসলে, ও মিথ্যে বলেছিল। ও জানত যে, ওর বাবা বা দাদা আমার বিজনেসকে নিজেদের সঙ্গে ইনকর্পোরেট করবে না। তাও মিথ্যে বলে…’
‘সেটা তো তোকে পাওয়ার জন্য। তোর সঙ্গে থাকার জন্য। আর তুই সেই রাগে মাথায় মারলি শমীদাকে?’ দিঘি অবাক হয়ে তাকিয়েছিল মহুলের দিকে। মানুষ এমন করতে পারে? কতটা কেরিয়ারিস্ট হলে এমন পারে? তা হলে কি টাকা আর উন্নতি ছাড়া মহুলের কাছে আর কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়?
দিঘি দেখছিল শমীকে। চোখ বন্ধ করে মাথাটা সোফার ব্যাক রেস্টে হেলিয়ে বসে রয়েছে। যেন ঘুমিয়েই পড়েছে একদম। এমন শান্ত ভঙ্গিতে আধশোয়া হয়েছিল শমী যে, দিঘির মনে হয়েছিল মানুষটা কি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ল?
মা আরও বকেছিল মহুলকে। বাবা তো রাগে কথাই বলছিল না কোনও। সে রাতে কেউ আর খায়নি। মহুলকেও খেতে বলেনি কেউ। শুধু বাবা শমীদের বাড়িতে ফোন করে জানিয়েছিল যে, শমী আর বাড়ি ফিরছে না।
রাতে নিজের খাটে মহুলের দিকে পিছন ফিরে শুয়েছিল দিঘি। ঘুম আসছিল না। নানা কথা মাথায় আসছিল। ভাবছিল গুন্ডা শুধু খবর নিয়েছিল ফোন করে। কই, আর্য তো কোনও ফোন করল না! অমনভাবে চলে এল দিঘি, তবু আর্য তো…গুন্ডা বলছিল বটে যে, আর্য মদ খেয়ে আউট হয়ে গেছে। তবু, দিঘির এমন বিপদ, তবু আর্য অমন মদ খেয়ে আউট হয়ে গেল! ওর একবারও মনে হল না যে, দিঘির খবর নেয়! একবারও মনে হল না যে, দিঘিদের বাড়ির পরিস্থিতিটা কেমন? তার বদলে ও ড্রিঙ্ক করে আউট! এ কেমন মানুষ? এ কেমন সম্পর্ক?
একসময় চোখ বুজে এসেছিল দিঘির, ঠিক তখনই আলতো হাতে মহুল ডেকেছিল ওকে, ‘দিঘি, শোন, ঘুমিয়েছিস?’
‘চেষ্টা করছি। কেন?’ রুক্ষ গলায় বলেছিল দিঘি।
‘জানিস, আমি না মারতে চায়নি। জানি তো ও ভিতু, দুর্বল, জানি তো আমায় ভয় পায় খুব। তবু…’
‘কী তবু?’ দিঘি এবার পাশ ফিরে মহুলের মুখোমুখি হয়েছিল।
‘বলে কিনা ভালবাসে! তাই আমায় পাওয়ার জন্য ও অমন মিথ্যে বলেছে? তুই বল, মিথ্যে বলবে কেন ও? কীসের জন্য বলবে? এত মিথ্যে কেন বলবে ও? আমায় আশা দিয়ে শেষে ভালবাসা? অজুহাত! জানি, ওভাবে মারা খুব অন্যায়। আমার উচিত হয়নি। কিন্তু এমন মাথা গরম হয়ে গেল! আজ দরকারি একটা প্রেজেন্টেশন ছেড়ে এসেছিলাম। আর এসে বলে কিনা ভালবাসার জন্য ও আমার ব্যাবসার কথা তুলে মিথ্যে বলেছে! ওর বাবা-দাদারা কেউ জানেই না। ও ওদের কিছু বলতেই পারেনি! শুধু বলল, ভালবাসে, আমায় নিজের কাছে ফেরাতে চায় বলে এমন করেছে! তুই বল, ভালবাসার নাম দিয়ে কি যা খুশি তাই করা যায়? যা খুশি তা বলা যায়? কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? ভালবাসা? না সত্যি কথা? কোনটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত মানুষের?’
কোনটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত? ভালবাসা না সত্য? দিঘি বাইরের দিকে তাকাল। সত্য নাকি কিছুটা স্থির আর কিছুটা পরিবর্তনশীল। ভালবাসা? সেটাও কি তাই? সেটাও কি পালটায়? আদৌও কি তার রূপ সত্যের মতো?
‘সামনে থেকে বাঁ দিকে,’ গুন্ডা ড্রাইভারকে বলে আবার পিছনের সিটে শরীরটা ছেড়ে দিল। তারপর বলল, ‘ওঃ, এলাম। তবে সোজা যাব রাহিদির বাড়িতে। হোমিদি ওখানেই আছে। ওদের বাড়িতে তো বিরাট পুজো হয়।’
দিঘি সচকিত হয়ে বাইরের থেকে মুখ ঘুরিয়ে গাড়ির ভেতরটা দেখল। অর্থাৎ, প্রায় পৌঁছে গেছে। নানা কথা ভাবতে ভাবতে বুঝতেই পারেনি কখন সময়টা কেটে গেছে!
‘সে কী রে? তোর দিদির বাড়ি নিয়ে যাবি না?’ রূপ পাশ থেকে জিজ্ঞেস করল।
‘ওই এসে গেছে,’ গুন্ডা বলল, ‘আমি হোমিদিকে এসএমএস মেরে দিয়েছি। ওই দেখ, সামনের বড় গেটটা। ওই যে হোমিদি আর রাহিদি।’
গাড়িটা গেটের কাছে থামল। রাহি আর হোমি হাসিমুখে এগিয়ে এল একসঙ্গে। দিঘিরা দরজা খুলে নামল। দূর থেকে ঢাকের শব্দ আসছে। এখানের হাওয়াটা অনেক পরিষ্কার লাগল দিঘির। শ্বাস নেওয়া যেন খুব সহজ। ও দেখল যে, চারদিকটায় পুজোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ফুল দিয়ে সাজানো।
‘নেমে এসো,’ গুন্ডা ডাকল শমীকে।
শমী হাসল আবছাভাবে। দরজা খুলে পা বাড়াল। তারপরই হঠাৎ অদ্ভুত একটা ভোঁতা শব্দ করল মুখ দিয়ে আর ধপ করে পড়ে গেল মাটিতে।
‘শমীদা?’ দিঘি চিৎকার করে উঠল আতঙ্কে।
জয়, সুবর্ণ আর গুন্ডা থতমত খেয়ে গেল একদম। রূপ মাটিতে বসে পড়ে গায়ে হাত দিয়ে নাড়াল, ‘শমীদা।’
দিঘি স্থির হয়ে দেখল শমী মুখটা নীচের দিক করে পড়ে আছে মাটিতে। কী করবে ও? কী করা উচিত?
ও দেখল হোমি দৌড়ে গেল বাড়ির দিকে। আর রাহি ফোনটা খুলে একটা নম্বর ডায়াল করল, উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘হ্যালো। এক্ষুনি মেন গেটে এসো। খুব বিপদ। একজন পড়ে গেছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ সেন্সলেস। এক্ষুনি ডাক্তারকে ফোন করো। আর তুমি এসো, প্লিজ, এক্ষুনি এসো কিগানদা।’
কে? কে আসবে? দিঘির গায়ে যেন বিদ্যুৎ স্পর্শ হল। ও দেখল বহুদিন স্তব্ধ হয়ে থাকা একটা জঙ্গল নড়ছে আবার। তার শুকনো পাতার ওপর মড়মড় শব্দে আসছে কেউ। আসছে? অন্য কেউ? কিন্তু এই নাম আর কারও হতে পারে? আর কেউ থাকতে পারে এই নামে? পাতায় পায়ের শব্দ বাড়ছে। হরিণী তাকিয়ে রয়েছে গহন জঙ্গলের দিকে। আসবে? সেই হরিণ কি আসবে?
মেন গেটের থেকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল দিঘি। চোখ বন্ধ করল। ভাবল, দেখার তো দরকার নেই। গন্ধই তো ঠিক জানিয়ে দেবে তার উপস্থিতি! কারণ, ঘ্রাণ তো শব্দের আগে পৌঁছোয়। যেমন স্পর্শের অনেক আগে পৌঁছে যায় প্রেম!