২১
স্টেশনটার নাম অশোকনগর রোড। মেন রোড থেকে ঢালু হয়ে রাস্তাটা ঢুকে গেছে স্টেশন চত্বরে। দু’দিকে দোকান। নানা ধরনের দোকান। আর তাতেই রাস্তাটা খুব একটা চওড়া হওয়ার সুযোগ পায়নি। রাহি গাড়িটাকে মেন রোডের ওপরে একটা স্পিনিং মিলের সামনে পার্ক করতে বলেছে। তারপর বড় রাস্তা থেকে হাঁটতে হাঁটতে এসেছে এই স্টেশনে।
টিকিট কাউন্টারের সামনে মানুষের লাইন এঁকেবেঁকে চলে এসেছে রাস্তায়। রুহান লাইনের যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার সামনে কমপক্ষে দশজন আছে। এখান থেকে একেবারে লেক গার্ডেন্সের টিকিট কেটে নেবে ও।
লাইনে দাঁড়িয়ে রুহান দেখল একটু দূরে রাহি কথা বলছে আবেশ আর কিগানের সঙ্গে। ভাল লাগল রুহানের। বহুদিন পর প্রায় একটা গোটা দিন ও কাটিয়ে গেল কিগানের এখানে। অবশ্য আজ রবিবার বলেই সম্ভব হল।
গত পরশু কিগান হঠাৎ ফোন করেছিল রুহানকে। রুহান তখন সবে অফিস থেকে ফিরেছে। কিগানের নামটা দেখে মোটেই আশ্চর্য হয়নি রুহান। এখন কিগানের সঙ্গে দু’-তিন দিন অন্তরই কথা হয়। ও ভেবেছিল এমনিই হয়তো ফোন করেছে কিগান।
ফোনটা ধরে রুহান বলেছিল, ‘হ্যাঁ, বলো কিগানদা। ফ্যাক্টরি থেকে ফিরলে?’
‘শোন, তুই এতটা ক্যালাস হয়েছিস, জানতাম না তো!’
‘মানে!’ কিগানের গলার স্বর শুনে বেশ ঘাবড়েই গিয়েছিল রুহান, ‘কী হয়েছে গো?’
‘দেখ, তোকে রাহি বলে একটা মেয়ে ফোন করেছিল। মনে আছে? ওকে আমিই বলেছিলাম তোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তখন আমি আমার নামটা বলতে বারণ করেছিলাম, কিন্তু এখন আমি নিজেই তোকে বলছি। কী, ব্যাপারটা কী তোর?’
‘তুমি! তুমি বলেছিলে?’ অবাক হয়েছিল রুহান, ‘তো, সেদিন যখন ফ্যাক্টরিতে গেলাম, কিছু বললে না তো! মাঝে এতদিন কথা হল তাও কিছু বললে না। হঠাৎ এখন বলছ?
‘বললাম তো, আমি চাইনি এর ভেতর আমার নামটা আসুক। কিন্তু দেখ, এবার আমায় বলতেই হচ্ছে। তুই রাহির সঙ্গে একবারও এই নিয়ে আর যোগাযোগ করিসনি কেন?’
সামান্য থমকেছিল রুহান। কী বলবে ও? হ্যাঁ, রাহি ফোন করেছিল ওকে। কথাও হয়েছিল। কিন্তু রুহান তো কোনও ভরসা দেয়নি। বরং খুব নরমভাবেই বলেছিল, ‘দেখুন, ব্যাপারটা আমার পক্ষে খুব কঠিন। আমি তেমন কোনও প্লেয়ার, মানে বড় দরের কোনও প্লেয়ার নই। আমার কন্ট্যাক্টস একসময় ছিল, কিন্তু এখন আর তেমন নেই। তাই বলছিলাম যে, আপনি যেটা বলছেন সেটা বেশ কঠিন হবে।’
রাহি বলেছিল, ‘দেখুন, যিনি আপনার কথা আমায় বলেছেন, তাঁর কথার অনার রাখতে আপনাকে এটা করতেই হবে।’
‘কে বলেছে আমার কথা?’ অবাক হয়ে গিয়েছিল রুহান।
‘সেটা আপনাকে জানাতে পারছি না। সরি। কারণ, ওঁর বারণ আছে। আমার মনে হয় আপনি পারবেন। পুরনো সমস্ত কন্ট্যাক্ট কিন্তু জাস্ট একটা ফোন কলের দূরত্বে থাকে। আপনি আমায় হেল্প করুন প্লিজ। আমাদের “হেল্প আর্থ” অরগানাইজেশনটার কিন্তু একটা ভাল রকমের বুস্ট হবে। আপনি প্লিজ দেখুন।’
‘আচ্ছা…ঠিক আছে…আমি না হয়ে চেষ্টা করব।’
এটাই দোষ রুহানের। ও নিজেও বোঝে। ‘না’ বলবে না কখনও। শত অশান্তি হলেও রুহান ‘না’ বলতে পারে না। তাই নিমরাজি হয়েছিল মাত্র। কিন্তু তারপর আর কিছু করার সময়ও হয়নি। আর সত্যি বলতে কী লজ্জাও করেছিল। ক্লাবে সুখেনদাকে বললেও হয়তো হত, কিন্তু সুখেনদাকে আর কতবার বিপদের মধুসূদন করবে? তাই চুপ করে গিয়েছিল। ভেবেছিল চেপে থাকলে একদিন ঠিক ব্যাপারটা আপসে ধামাচাপা পড়ে যাবে। কিন্তু এতদিন পর হঠাৎ যে কিগান ফোন করবে সেটা বুঝতে পারেনি রুহান।
‘কী রে বল। এতটা ইররেসপন্সিবল হলি কী করে তুই?’ কিগান যে রেগে ছিল সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছিল রুহান।
‘আরে তুমি তো বললে আবেশ এখন ওই চত্বরে আছে। ওকেও তো বলতে পারতে!’
‘না, আবেশকে আমি এই ব্যাপারে খুব একটা ভরসা করি না। টাকা না থাকলে ও এসবের ভেতর ঢুকবে না। তা ছাড়া আমার মনে হয়েছে কাজটা তুই করবি। ব্যস, তুই করবি।’
‘ঠিক আছে।’ রুহান আর কিগানকে উত্তেজিত করতে চায়নি। বলেছিল, ‘পরশু তোমার ওখানে যাব। ওই রাহির সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে তা হলে! কেমন?’
কিগান বলেছিল, ‘সকাল সকাল চলে আসিস। দুপুরে এখানেই খাবি।’
কিগানের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারে না রুহান। কেন এমন আলো-ছায়ার ভেতরে থাকে মানুষটা? কেন সব কিছু স্পষ্ট করে বলে না? কেন এমন একটা কাজ ওকে করতে দিল? কোন ভরসায় দিল? তারপর নিজের নামটাও বা কেন লুকিয়ে রাখতে বলল? যদি রুহানের সঙ্গে ফ্যাক্টরিতে দেখা না হত তা হলে কি এমনভাবে সামনে এসে এই কাজটার জন্য বলত কিগান? কেন পালিয়ে বেড়াচ্ছে কিগান? কার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে? হঠাৎ যে একটা মানুষ এমনভাবে বেপাত্তা হয়ে যেতে পারে সেটা তো ভাবতেই পারেনি রুহান। তাই সেদিন ফ্যাক্টরিতে জিয়ানার সঙ্গে পার্কিং লটের দিকে আসতে থাকা মানুষটাকে দেখে সারা শরীরে হঠাৎ বিদ্যুৎ বয়ে গিয়েছিল যেন। সেই লম্বা চেহারা। সেই হেঁটে আসা। সেই প্রথম দিন দেখা রাজপুত্র না?
দৌড়ে গিয়ে কিগানকে জড়িয়ে ধরেছিল রুহান, ‘কিগানদা, তুমি?’
কিগানের হাতে একটা বড় বাক্স মতো কিছু ছিল। সেটা যাতে না পড়ে যায় তাই সামান্য ঘুরে এক হাত দিয়ে রুহানকে ধরেছিল।
রুহান বলেছিল, ‘তুমি? তুমি এখানে? আর আমরা শুধু ভাবছি মানুষটা উবে গেল কোথায়?’
‘তুই আছিস কেমন?’ কিগান অল্প হেসে বলেছিল, ‘তা ছাড়া, আদি তো জানে আমি কোথায় আছি। তুই ওর থেকে খবর পাসনি?’
‘আদি!’ চুপ করে গিয়েছিল রুহান। তারপর বলেছিল, ‘ওর সঙ্গে আর বিশেষ দেখাসাক্ষাৎ হয় না আমার। আর আমিও মানে…কেমন অস্বস্তি হত তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। যদিও মোবাইল নম্বর ছিল। তবু…।’
‘ওই নম্বরটা আর নেই,’ কিগান হেসেছিল, ‘নতুন নম্বর নিয়েছি। তবে অফিস তো জানে। আদিও সেখান থেকে জানে।’
রুহান আরও অনেক কথা বলেছিল কিগানকে। মানে, সব যে খুব দরকারি তা নয়। এমনিই সব কথা। একবছর ধরে জমে থাকা সব কথা। ওদের মাঠের কথা। অফিসের কথা। মায়ের কথা। আরও নানা কথা। কিগান শুধু শুনছিল আর হাসছিল। বিশেষ কিছু বলছিল না।
রুহানের অবাক লেগেছিল জেনে যে, জিয়ানা আর কিগান ক্লাসমেট ছিল। ওর মনে হয়েছিল, পৃথিবী সত্যিই খুব ছোট। মনে হয়েছিল, একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে, আসলে প্রত্যেকটা মানুষই পরস্পরের সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে সংযুক্ত।
গাড়িতে আসতে আসতেও রুহান উত্তেজিতভাবে জিয়ানাকে বলছিল কিগানের আর ওর সম্পর্কের কথা। বলছিল কিগানের ঠাকুরমার কথা। বলছিল কীভাবে কিগানের সঙ্গে ওদের সম্পর্ক এত ঘনিষ্ঠ হয়েছিল। কিন্তু একটা সময় পর চুপ করে গিয়েছিল রুহান। ও দেখেছিল যে, জিয়ানা কিছু শুনছে না। শুধু সামান্য সায় দিচ্ছে অন্যমনস্কভাবে। তাই চুপ করে গিয়েছিল রুহান। কথা বাড়ায়নি। আর ভেবেছিল, সত্যিই তো, কিগান তো ওর দাদা। ও আনন্দিত হতেই পারে। তা বলে সবাই কি আর ওর মতো আগ্রহী হবে? খামোকা কেন জিয়ানার মাথা খাবে ও? জিয়ানা কেনই বা শুনবে ওর কথা? শুধু তো সহপাঠী। এ ছাড়া কিগান কে হয় জিয়ানার?
লাইনটা এগোচ্ছে না কিছুতেই। যেন শামুকের পিছনে পিছনে হাঁটছে রুহান। ওর পিছনেও আরও মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে। তারা উসখুসও করছে। কয়েকজন তো তাড়াও দিচ্ছে। বলছে বনগাঁর ট্রেন চলে আসবে। বলছে শিয়ালদারটাও এই চলে এল বলে।
এই বনগাঁ লাইন সম্বন্ধে খুব ভয় ছিল রুহানের। সবার কাছে শুনত যে, এখানের ট্রেনে ভীষণ ভিড় হয়। তাই যখন ট্রেনে করে আসার কথা হয়েছিল, যথেষ্ট ভয় পেয়েছিল ও। কিন্তু দেখেছে বেশ সহজেই চলে আসতে পেরেছে। কোনও ঝুটঝামেলা বা বাদুড়ঝোলা ভিড়, কিছুই হয়নি। তাই ভেবেছিল যে, চাপাডাঙা থেকে ফেরাটাও অমনভাবেই হবে। বলেওছিল যে, সামনের স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে চলে যেতে পারবে ও। কিন্তু রাহি কিছুতেই রাজি হয়নি। বলেছিল, ‘একদম না। আমার বিকেলে একটা কাজ রয়েছে অশোকনগরে। তোমায় আমি অশোকনগর রোড স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে আসব।’
‘না না, তার দরকার নেই। শুধু শুধু অতটা…’ রুহানের খারাপ লেগেছিল। আসলে সংকোচ হয়েছিল খুব। রাহিকে প্রথমে দেখেই বেশ ভাল লেগেছে রুহানের। খোলামেলা, হাসিখুশি একটা মেয়ে।
ছোটবেলায় একবার বাবার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিল রুহান। সে বিশাল বড় বাড়ি। সামনে লন। একদিকে সুইমিং পুল। তার পাশে লম্বা লম্বা গাছেদের সারি। বাড়িটার পিছন দিকে আর একটা ছড়ানো একতলা বাড়ি ছিল। যার একটা অংশ কাচ দিয়ে ঘেরা। রুহান সেই কাচঘেরা ঘরটার ভেতর দেখেছিল একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসে আছেন গ্র্যান্ড পিয়ানোর সামনে। তাঁর পরনে সাদা হাউজকোট আর পাজামা। তিনি অদ্ভুত এক আনন্দ নিয়ে বাজিয়ে চলেছেন পিয়ানোটা।
রুহান একপাশে দাঁড়িয়ে শুনছিল সেই বাজনা। দেখছিল বাইরে, কাচের বাইরে অজস্র প্রজাপতি উড়ছে। আর তেরছা করে একটা রোদ এসে পড়েছে সেই ঘরে।
রুহান আজও জানে না, ঠিক কী ছিল সেই দৃশ্যটায়। তবু, অমন সকাল, অমন রোদ, পিয়ানোর টুংটাং আর বাইরে উড়ে বেড়ানো অজস্র প্রজাপতি, রুহানকে বুঝিয়েছিল যে, এ দৃশ্য জীবনে একবারই আসে। আর ফিরে আসে না।
ফিরে আসে না, যা যায় তা আর ফিরে আসে না। বহুবার শুনেছে রুহান। দেখেওছে। ফেলে আসা কৈশোরের মতো আনন্দ, বন্ধুত্ব, নিজের ক্ষমতা। সব চলেই যায়। আর ফিরে আসে না। রুহান ভেবেছিল ছোটবেলায় সেই দৃশ্যটার মতো অনুভূতিও বুঝি এমনই। বুঝি এমনই একবারের জন্য। কিন্তু, অবাক হয়ে দেখেছিল, জীবন মস্ত এক জাদুকর। যখন তুমি ভাববে যে, তার খেলা তুমি ধরে ফেলেছ, ঠিক তখনই সে বের করে আনবে নতুন জাদু। নতুন আনন্দ। যা অবিকল মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে তার অতীত অভিজ্ঞতার কাছে।
রুহানেরও তেমন হয়েছিল। কিগানের ঘরে গিয়ে বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই কিগান ফোন করে ডেকে পাঠিয়েছিল রাহিকে। বলেছিল, ‘এই রাহি, রুহান এসেছে। তাড়াতাড়ি চলে আয়। ইচ্ছে হলে হোমিকেও বলতে পারিস। মানে সঙ্গে আনতে পারিস।’
ওদিক থেকে কী কথা হয়েছিল তা শুনতে পায়নি রুহান। তবে ফোনটা রেখে কিগান বলেছিল, ‘ওই আসছে পাগলি।’
‘পাগলি?’ ঘাবড়ে গিয়েছিল রুহান, ‘পাগলি মানে কিগানদা?’
‘না রে তেমন নয়,’ হেসেছিল কিগান, ‘সত্যিকারের পাগলি নয়, তবে একরকম পাগলিই বলতে পারিস। আসুক। দেখবি।’
তা দেখেছিল রুহান। মিনিট দশেক বাদেই দেখেছিল। সেই লম্বা কাচের ঘর। সেই ভেসে আসা পিয়ানোর টুংটাং। আর তেরছা হয়ে ভেসে থাকা রোদের চাদর। রুহান দেখেছিল প্রজাপতি উড়ছে। প্রচুর প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে চারদিকে। এত প্রজাপতিকে না চিনলেও নিজেকে বিলক্ষণ চেনে রুহান। বোঝে নিজের মনের গতিবিধি। হাওয়া না মেপে, আকাশ না মেপে ওর মন যে বেশ উড়তে পারে তা খুব জানে ও। তাই সতর্ক হয়েছিল রুহান। প্রাণপণে ওর মনের পাখনা দুটোকে বেঁধে যথাসম্ভব নিস্পৃহ চোখে ও তাকিয়েছিল রাহির দিকে। দেখেছিল কুমোরটুলি থেকে তৈরি করে আনা এক জোড়া চোখ তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। যেন মাপছে। চোখের ভেতরে যে এমন টেপ-ফিতে থাকে তা আগে জানত না রুহান!
রুহানের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে রাহি বলেছিল, ‘এই যে কিগানদা তোমাদের জন্য দু’-একটা খাবারের পদ নিয়ে এসেছি। দয়া করে ‘ঘড়ি’ করে রেখো না।’
রুহান ঠিক বোঝেনি কথাটা। তবে রাহির গলায় ঝাঁঝ শুনে এইটা বুঝেছিল যে, এর ভেতরে একটা গল্প আছে।
কিগান কিন্তু রাগেনি। বরং হেসেছিল, ‘কী এনেছিস?’
‘পাঁঠার মাংস, ধোঁকার ডালনা আর শিমুইয়ের পায়েস।’
‘বাবা, এত!’ কিগান হেসে পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে বলেছিল, ‘বস। আর মাথাটা একটু ঠান্ডা রাখ। কেমন?’
রাহি নিচু একটা টেবিলে টিফিন বাক্সটা রেখে বলেছিল, ‘মাথা? ঠান্ডা? ঠিক আছে। চেষ্টা করব। কিন্তু তুমি যেভাবে থাকো, তা দেখলে কেউ মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে? বলো? আচ্ছা,’ এবার রাহি ঘুরেছিল রুহানের দিকে, ‘আপনি বলুন তো, মানুষটা কি চিরকাল এরকম?’
‘অ্যাঁ?’ একটু থতমত খেয়ে গিয়েছইল রুহান।
কিগানের কাছে এসে যেটুকু সামান্য সময় পেয়েছিল তাতে টুকটাক সাধারণ কথাবার্তাই বলেছে রুহান। কিগান কেন চলে এসেছে কলকাতা ছেড়ে, কেন এতদিন আলাদা, সরে থেকেছে সবার থেকে তা নিয়ে কিচ্ছু বলেনি। মানে প্রসঙ্গই তোলেনি। কিন্তু রাহির ওই একটা প্রশ্নই যেন রুহানের না বলা প্রশ্নগুলোকে এক ঝটকায় নিয়ে এসেছিল সামনে। রুহান ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়েছিল কিগানের দিকে।
কিগান তবু হাসি মুছে ফেলেনি। বরং বলেছিল, ‘আমার কথাটা কি বেশি ইমপর্ট্যান্ট? না কীসব ম্যাচ না কী করতে চাস সেটা ইমপর্ট্যান্ট?’
‘তুমি চুপ করো।’ রাহি ধমক দিয়েছিল কিগানকে। তারপর রুহানকে বলেছিল, ‘আচ্ছা, কিগানদাকে কতদিন চেনেন বলুন তো আপনি? গত বছরখানেকের ভেতর দেখলাম আবেশ আর আপনি। এই দু’জন পরিচিত আছে মানুষটার। আচ্ছা, ওর কি আর কেউ নেই? ওকে তো জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। কিচ্ছু বলে না। যেন সাধু হয়ে গেছে। পূর্বাশ্রমের কিছু বলা বারণ। আচ্ছা, আপনি বলুন তো, কিগানদা কে?’
কিগান উঠে দাঁড়িয়েছিল এবার। কোমরে হাত দিয়ে বলেছিল, ‘তোর দিদিমণিগিরি আর গেল না রে দি… মানে রাহি।’
‘কী বললে? দি? মানে?’ রাহি সচকিত হয়েছিল।
‘কোথায়? কী বললাম?’ হেসেছিল কিগান।
রাহি সামান্য হেসে, হঠাৎ আবছা গলায় বলেছিল, ‘আমি ভাবলাম…’ তারপরই হঠাৎ আবার স্বাভাবিক হয়ে গিয়ে রুহানকে চেপে ধরেছিল আবার, ‘কী হল? বললেন না?’
রুহান থেমেছিল এক মুহূর্ত। তারপর একবার তাকিয়েছিল কিগানের দিকে। বলেছিল, ‘কিগানদা কে জানেন? রাজপুত্র। ছদ্মবেশী রাজপুত্র। এর বেশি আর কেউ কিচ্ছু জানে না কিগানদা সম্পর্কে।’
কিগান এবার হাত তুলেছিল, ‘তোরা থামবি? আচ্ছা রুহান, পাগলিটা ভুল বকছে আর তুইও ওর সঙ্গে তাল দিচ্ছিস? এই জন্য সাতসকালে এখানে এসেছিস তুই?’
রুহান হেসে রাহিকে বলেছিল, ‘বাদ দিন। এবার বলুন, আমায় কী করতে হবে?’
‘আমি তো ফোনে বললাম যে, একটা প্রদর্শনী ক্রিকেট ম্যাচ করতে চাই। নামকরা প্লেয়ার এনে। তার জন্য টাকাপয়সা স্পনসরশিপ ইত্যাদির বন্দোবস্ত আমি করব। কিন্তু প্লেয়ারদের যোগাযোগ করে একটু যদি তাদের আনার বন্দোবস্ত করে দেন, খুব ভাল হয়।’
‘আচ্ছা,’ কিগান বাধা দিয়েছিল এবার, ‘তখন থেকে আমি দেখছি ব্যাপারটা। কেসটা কী বল তো?’
‘কেস!’ রুহান অবাক হয়েছিল।
‘তখন থেকে দেখছি তোরা একে অপরকে আপনি আজ্ঞে করছিস! তোরা কোন জমানার রে?’
‘তাই তো!’ রাহি কিগানের টেবিলের ওপর পড়ে থাকা একটা চুইংগাম মুখে পুরে বলেছিল, ‘ও কে রুহান, যা বলছিলাম। তুমি আমাদের প্লেয়ার জোগাড় করে দাও। আমরা কলকাতা ভার্সেস নর্থ চব্বিশ পরগনার ম্যাচ করব। প্রতিটি দলে তিনজন করে নামকরা প্লেয়ার থাকবে। দারুণ হবে।’
‘কিন্তু,’ কিগান অবাক হয়েছিল, ‘ব্যাপারটা আগে অন্যরকম ছিল না?’
‘হ্যাঁ, ছিল,’ চুলটাকে ঠিক করে সামান্য হেসেছিল রাহি। আর রুহান আবার দেখতে পেয়েছিল রোদ, কাচের ঘর, আর অজস্র প্রজাপতি। প্রজাপতি যে মশার চেয়েও বিরক্তিকর হয় সেটা প্রথম বুঝেছিল রুহান। ও মনের ভাব আড়াল করার জন্য মুখচোখ কুঁচকে, একটা ভয়ংকর কিছু চিন্তা করছে এমনভাবে তাকিয়েছিল রাহির দিকে।
রাহি বলেছিল, ‘আরে সেটাই ঠিক ছিল। তারপর হঠাৎ গতকাল রাতে এই আইডিয়াটা এল আর সঙ্গে সঙ্গে হোমিকে ফোন করে বললাম। ও বলল দারুণ। তারপর আজ সকালে সুধাদিকে ফোনে বললাম। সুধাদিও তো শুনেই খুশি।’
‘সুধাদি! পলিটিক্স ঢোকাবি এর মধ্যে?’ কিগান হাসছিল না আর।
‘কোথায় পলিটিক্স? সুধাদি তো হেল্প আর্থ-এর প্রেসিডেন্ট। আর প্রথম থেকেই তো সুধাদি এটা জানে।’
‘শোন, তোদের ‘হেল্প আর্থ’-কে ক’জন চেনে বল?’
‘মানে?’ রাহি বিরক্ত হয়েছিল, ‘ক’জন চেনে মানে? চিনবে, আস্তে আস্তে চিনবে। আর যদি আমরা এমন কাজ করতে পারি তা হলে আরও দ্রুত অনেক লোকে চিনবে। তা এমন করে বলছ কেন তুমি?’
‘চিনবে…করতে পারি—সব ফিউচার টেন্স। এসব হলে না হয় হেল্প আর্থ-এর পরিচিতি হবে। কিন্তু সুধাদি অলরেডি পরিচিত মুখ। বিধানসভার মেম্বার। একজন নোন পলিটিক্যাল ফেস। তাকে সভাপতি করাটাই তো তোদের ব্লান্ডার! তারপর সে যদি কিছু হেল্প করে, ভোটের জন্য প্রচারে সেই কথা বারবার তুলবে। তখন সেটা কি ভাল হবে?’
‘না, মানে,’ রাহি একটু গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল, ‘দেখো, নামকরা লোকজন থাকলে তো একটু সুবিধে হয়, তাই ওকে রাখা। না হলে…’
‘বাদ দে,’ কিগান এবার তাকিয়েছিল রুহানের দিকে, ‘যা বলল ও, তা তোকে করে দিতে হবে। কোনও বাহানা বা অজুহাত দিবি না। বুঝেছিস?’
‘কিন্তু আমায় কেন? তুমি জানো, আবেশ এ ব্যাপারে অনেক কম্পিটেন্ট। গত বছর তো মার্চেন্ট মাল্টিপল্সের হয়ে একটা টুর্নামেন্টের আয়োজন করার ব্যাপারটা দেখেছিল। তাই বলছিলাম যে, ও আরও ভাল করতে পারবে।’
‘শোন,’ কিগান থামিয়ে দিয়েছিল রুহানকে, ‘ওটাতে আবেশ মার্চেন্ট-এর পতাকার তলায়, সেই নামের সাহায্যে কাজ করেছিল। এখানে তা কিন্তু নয়। সুধাদির সাহায্য যত কম নেওয়া যায় তত ভাল। সবচেয়ে ভাল হয় ওকে সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে কাজটা করতে পারলে। আর শোন, এ ব্যাপারে, তুই নিজে প্লেয়ার হয়ে যদি অন্য প্লেয়ারকে অ্যাপ্রোচ করিস কাজটা সহজ হবে।’
‘দেখো কিগানদা,’ রাহি বলেছিল, ‘তুমি অনাবশ্যক সুধাদিকে এমন বলছ। সুধাদিকে আমিই ইনভল্ভড হতে না করেছি। সুধাদির যদি খারাপ উদ্দেশ্য থাকত, তবে কি ও সেটা মেনে নিত?’
‘বোকা মেয়ে,’ হেসেছিল কিগান, ‘সুধাদি খেটে মরতে যাবে কেন? তোরা যখন খাটাখাটনি করে পাহাড়টা তৈরি করবি, দেখবি সুধাদি কেমন করে পার্টির ফ্ল্যাগটা পাহাড়ের মাথায় বসিয়ে গোটা পাহাড়টা নিয়ে যাবে। আচ্ছা, তুই এসব বুঝিস না? তুই বড় হবি না?’
রাহি জেদের গলায় বলেছিল, ‘আমাদের “হেল্প আর্থ” সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটা সংস্থা। আমরা মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তা আমরা চেষ্টা করছি। আর তাতে সুধাদির কোনও কন্ট্রিবিউশন নেই। আমরাই যা করার করব। ইতিমধ্যে যশোর রোডের ধারে রাস্তা চওড়া করার নামে যেভাবে বড় বড় গাছগুলোকে কেটে ফেলার চেষ্টা চলছে, তার বিরুদ্ধে আমরা সর্বাত্মক আন্দোলনে নামব। এতে শহরের ছেলেপুলেরাও আসবে আমাদের পাশে। তাই বলছি, ওসব পার্টি কালারের ভয় আমাদের নেই। আর সত্যি কথা বলতে কী, সব বিষয়েই রিস্ক থাকে। বিফল হওয়ার চান্স থাকে। তা বলে কি হাত গুটিয়ে বসে থাকব নাকি? আমাদের তো কাজ করে যেতেই হবে।’
‘জল খাবি?’ কিগান বিছানা থেকে উঠে এক বোতল জল বাড়িয়ে দিয়েছিল রাহির দিকে, ‘তুই যে এমন ভাল স্পিচ দিস জানতাম না তো? দিদিমণি থেকে তো একটা বেশ নেত্রী-নেত্রী ভাব এসেছে দেখছি? জানিস তো ইউথ অ্যান্ড পলিটিক্স একটা খুব ভাল কম্বিনেশন!’
রাহি হেসেছিল এবার। আর আবার প্রজাপতি দেখেছিল রুহান। বুকের ভেতর যে এমন একটা কাচের ঘর রেখেছিল এতদিন ধরে সেটা তো নিজেই জানতে পারেনি রুহান! তবে সত্যি বলতে কী, তা আর তেমন জানতেও চায় না ও। কী হবে জেনে? রুহান ভালই জানে যে, ওর জীবন কেমন। তাই তখনও নিজেকে সামলে নিয়েছিল। আর ধমক দিয়েছিল নিজেকে। সুন্দরী মেয়ে দেখলে প্রেমে পড়ে যাওয়া এই রোগ যে এমন ক্রনিক আকার ধারণ করেছে, সেটা মোটেও ভাল নয়।
রুহান বলেছিল, ‘আমি বুঝেছি কনসেপ্টটা। নিশ্চয়ই বলব। মানে চেষ্টা করে দেখব। জগুদা, সুখেনদাদের বলে দেখব। তা ছাড়া আরও কিছু সোর্স আছে, মানে ছিল আর কী, তাদেরও বলে দেখব।’
রাহি বলেছিল, ‘দেখো তাড়াতাড়ি করবে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে অনেক।’
কিগান বলেছিল, ‘ঠিকই, বেশ দেরি হয়েছে।’
রাহি বলেছিল, ‘তো রুহান, তুমি কবে জানাচ্ছ আমায়?’
‘আমি?’ রুহান সময় নিয়েছিল একটু। তারপর বলেছিল, ‘দেখুন, মানে ইয়ে, দেখো, কাল মানে সোমবারই আমি যোগাযোগ করব। তারপর দেখি।’
রাহি উঠে পড়েছিল। বলেছিল, ‘তুমি যাচ্ছ কখন? মানে আজ ফিরছ কখন? বিকেলবেলা কি?’
‘হ্যাঁ,’ কিগান উত্তর দিয়েছিল, ‘ও বিকেলেই যাবে।’
‘এখান থেকে ট্রেনে ভিড় হবে। আমি অশোকনগরে যাব। একটা কাজ আছে, সেখান অবধি পৌঁছে দেব। হাবড়া থেকে হাবড়া লোকাল ছাড়ে। অশোকনগর তার পরের স্টেশন। মোটামুটি বসার জায়গা পেয়ে যাবে।’
‘তা হাবড়াতেই ছেড়ে দিবি,’ কিগান বলেছিল।
‘তা হলে তো একটুও দাঁড়িয়ে গল্প করতে পারব না আমরা। মানে, তুমিও যাবে তো? আর হাবড়া হলে ড্রপ করে দিয়েই চলে যেতে হবে,’ রাহি বলেছিল।
লাইনটা এখনও শামুকের মতো এগোচ্ছে। তবে তাও কিছুটা এগিয়েছে রুহান। সামনে এখন চারজন। আসার সময় আবেশ গাড়িতে উঠে পড়েছিল। বলেছিল, ‘কাজে গিয়েছিলাম বলে আড্ডাটা মিস হল। চল তোর সঙ্গে একটু ফেয়ারওয়েলটাই সেরে আসি।’
আবেশ জানে যে, একটা ক্রিকেট ম্যাচের কথা হচ্ছে। কিন্তু ওকে যে কিছু করতে বলা হচ্ছে না সেটা নিয়ে ওর কোনও হেলদোল নেই। রুহান একবার রাহি আর কিগানের কান এড়িয়ে চাপা গলায় কথাটা পেড়েছিল আবেশের সামনে। বলেছিল, ‘তুই জানিস তো, আমি কেন এসেছি এখানে?’
‘ওই ক্রিকেট তো?’ আবেশ দাড়িতে হাত বুলিয়ে হেসেছিল।
‘হ্যাঁ। তুই জানিস?’
‘শালা, চিরকাল চার অক্ষরের বোকা রয়ে গেলি,’ আবেশ হেসেছিল, ‘হেল্প আর্থ-এ আমি আছি। কাজ করছি। কিগানদার কথায় তোর মোবাইল নম্বরটা আমি রাহিকে দিলাম। আর শালা তুই আমায় এমন প্রশ্ন করছিস আমি জানি কিনা?’
‘না, মানে, দেখ,’ রুহান বলেছিল, ‘আমি বলেছিলাম যে তোকে বলতে। কিন্তু…’
‘দেখ ভাই, বলেনি বেঁচে গেছি। একা মানুষ আমি। কত কিছু করতে হয় জানিস?’
‘না, আমি বলেছিলাম যে তুই খুব সাকসেসফুলি একটা টুর্নামেন্ট সামলেছিলিস।’
‘আমি একা তো নই। একটা টিম সেটা করেছিল। আমিও ছিলাম সেখানে। তা, ভালই হয়েছে। তুই এই কাজটা কর না। এটা একটা নোবেল কজ।’
‘কিন্তু…’ রুহান ইতস্তত করেছিল, ‘তুই রাগ করবি না তো?’
‘খেপেছিস?’ হেসেছিল আবেশ, ‘কাজ না করতে পারলে তো বেঁচে যাই। এ সবই তো এই ছ্যাঁচড়া পেটটার জন্য। তাই, এসব ভাবিস না। তা ছাড়া…’
‘তা ছাড়া?’ রুহান জিজ্ঞেস করেছিল।
‘তা ছাড়া, দেখ না নতুন করে কিছু একটা করতে কেমন লাগে? আর দরকার হলে আমায় বলিস, হেসিটেট করিস না। আমি সাধ্যমতো হেল্প করব।’
‘থ্যাঙ্কস, আমায় তুই বাঁচালি,’ হেসেছিল রুহান।
‘তাই?’ আবেশ সিগারেট ধরিয়ে সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল যেন।
‘ট্রেন লেট আছে,’ টিকিট কেটে সামনে দাঁড়ানো মাত্র আবেশ বলল।
রুহান হাসল, ‘ওঃ, যা লাইন! উইদআউট টিকিটের যাত্রী অনেক কমে গেছে, না?’
‘কিচ্ছু কমেনি।’ আবেশ বুড়ো আঙুল দেখাল, ‘আমিই তো মাঝে মাঝে উইদআউটে যাই। তোরা ভিতুর ডিম তাই পারিস না।’
‘সত্যিই তুমি তাই করো নাকি?’ রাহি অবাক হল।
‘হ্যাঁ,’ আবেশ এমন করে বলল যেন টিকিট কাটলেই ফাইন দিতে হয়, ‘আরে বাবা, এত বড় লাইন কেউ দেয় নাকি? বাচ্চা পেটে নিয়ে এই লাইনে দাঁড়ালে লাইনের সামনে যেতে যেতে সেই বাচ্চার বিয়ে হয়ে যাবে। কেন ফালতু ঝুটঝামেলায় যাব?’
‘এটা কিন্তু অন্যায়,’ রাহি গম্ভীর হল, ‘এমন করবে না।’
‘এই সেরেছে! রাগ করলে নাকি?’ আবেশ থমকাল, ‘দেখো, আবার চাকরি থেকে বের টের করে দেবে না তো? দেখো ভাই, আমি গরিব মানুষ।’
‘এমন করলে দিতেও পারি,’ রাহি গম্ভীরভাবে বলল।
‘অ্যাঁ? সত্যিই? যাঃ, ইয়ারকি মারছ শিয়োর। তুমি রেলের কিছু নও তো?’
রাহি বলল, ‘দেখো, এটা সামাজিক অপরাধ। ট্রেনটা তো হাওয়ায় চলে না, এর একটা খরচ আছে। লোকেদের মাইনে আছে। মেনটেনেন্স আছে। আরও হাজারটা কারণ আছে। তোমার শরীরের যা ন্যূনতম দরকার, তা না দিলে কি শরীর বাঁচে? টিকিটটাও রেলের তেমনই ন্যূনতম দরকার। বুঝেছ?’
কিগান হাসল, ‘আজকাল কী হয়েছে বল তো তোর? কথায় কথায় এমন সব বক্তৃতা করছিস? ত্রয়ণের প্রভাব নাকি?’
‘ত্রয়ণ?’ যেন ছিটকে উঠল রাহি, ‘ওর প্রভাব হতে যাবে কেন?’
‘না, ও তোদের সংস্থার হয়ে কাজ করে মাঝে মাঝে, তাই বলছিলাম।’
‘না, না।’ রাহিকে হঠাৎ অধৈর্য লাগল রুহানের। মেয়েটা এমন করে বলছে কেন?
আবেশ হাসল, ‘ত্রয়ণ তো? আজকাল আর তেমন আসে না। তবে দরকার হলেই আসবে।’
‘বাদ দাও তো,’ রাহি একটা ধমক দিল এবার, ‘আর কিছু বলার নেই তোমাদের? তখন থেকে এক কথা বলছ কেন?’
‘ঠিকই তো!’ কিগান চট করে কথাটা ধরল। রাহি কোনও কারণে বিরক্ত হচ্ছে দেখেই বোধহয় বলল, ‘তা রুহান, কাকিমা কেমন আছেন রে? শরীর ভাল?’
মা? মনে মনে আঁতকে উঠল রুহান। সত্যিই মা এখন একটা আতঙ্ক হয়ে উঠেছে যেন। ওই হাত ভাঙার পর থেকে মা যেন আরও কঠিন আর রূঢ় হয়ে উঠেছে। বেশি বয়সে হাত-পা ভাঙলে যা হয়, সেটাই হয়েছে। সেরে ওঠার পরও হাতটায় তেমন জোর পাচ্ছে না মা। আর তাতেই যেন সব রাগ গিয়ে পড়েছে রুহানের ওপর।
আসলে কাকু-কাকিমাদের আর্থিক অবস্থা এখন অনেক ভাল। ঠিকে লোকের পাশাপাশি একটা সর্বক্ষণের লোকও রাখা হয়েছে। আর রুহানদের একজন মহিলা আসে বাসন মাজা আর ঘরদোর ঝাঁট দেবার জন্য। কিন্তু বাকি তো আরও কাজ থাকে সংসারে। আর সেগুলো করতে হয় মাকেই। ফলে মা ভীষণ রেগে যায় আজকাল। রুহানের মাইনে আর মা’র পেনশন দিয়ে কোনওমতে চলে গেলেও সচ্ছলতা ব্যাপারটা কিছুতেই যেন ঠিক আসে না! ক্লাবের থেকে বহু দিন টাকাপয়সা পায় না রুহান। এমনকী, এ বছর তো চুক্তিই করা হয়নি ওর সঙ্গে। তবু রুহান প্র্যাকটিস অ্যাটেন্ড করে। প্র্যাকটিস ম্যাচে খেলে। টিম মিটিং-এ থাকে মাঝে মাঝে। আর এই ওই কর্তাদের কাছে গিয়ে বলে ওর গত বছরের বকেয়া টাকাটা যেন মিটিয়ে দেওয়া হয়। কর্তারা ‘দেব দেব’ বলে কিন্তু এখনও পর্যন্ত একটা ফুটো কড়িও পায়নি রুহান। তা ছাড়া ব্রজদার ভাইয়ের বাড়ির অনুষ্ঠানের ডেকরেটিভের কাজটা করে দেয়নি বলেও ব্রজদা বকেয়া পেমেন্টে আরও টাইট দিয়েছে।
রুহান জানে ওর খেলোয়াড় জীবন শেষ। জানে, কলেজের সেই জেদি ছেলেটা এখন বুড়ো মেরে গেছে। নুয়ে পড়েছে। নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। রুহান বোঝে এবার সরে যেতে হবে। আর এসব মনে এলেই কেমন যেন অসহায় লাগে তার। মনে হয় এত বছর কী করল ও? তবে কি একটা বেসরকারি অফিসে এমন ছেঁড়াখোঁড়া কাজ করে জীবন কেটে যাবে ওর? যে-মানুষটা হওয়ার ইচ্ছে ছিল ছোটবেলায় তা কি আর হওয়া হবে না? এ সব কিছুর উত্তর রুহান জানে। তবু নিজেকে এই প্রশ্নটা বারবার করে সে। ওর মনে হয় অন্তত এই প্রশ্নটুকুর মধ্যে তো কোথাও হলেও একটা ধনাত্মক দিক লুকিয়ে রয়েছে! নিজেকে মানুষ যতদিন প্রশ্ন করে ততদিন তার আশা মরে না।
এইসব চিন্তাভাবনা মাথায় এলেই রুহানের মন আর ঠিক থাকে না। অন্যমনস্ক হয়ে যায় ও। আর কাজকম্মে ভুল করে বসে। গতকালও এমন একটা কাণ্ড হয়েছিল।
সন্ধেবেলা বাড়িতেই ছিল রুহান। ক্লাবে একটা ফাংশন ছিল। তবু যায়নি। না গিয়ে বাড়িতে বসে জোর করে মনখারাপ করছিল ও। ভাবছিল, ও যায়নি, তবু ক্লাব থেকে কেউ একজনও ওকে ফোন করল না! একবারও তো কেউ বলতে পারত, ‘রুহান আয়।’ এটুকুও বলল না? সবাই এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে নিল! রুহান তা হলে আর সত্যিই ক্লাবের কেউ নয়? আর এসব কথা ভাবতে ভাবতেই মায়ের কথাটা ঠিকমতো শুনতে পায়নি।
মা হঠাৎ ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল, ‘কোন বাঁদি পেয়েছিস আমায়? তোর গোলাম আমি?’
সাধারণভাবে বললে হয়তো রুহান এটাও মিস করত। কিন্তু মা এত জোরে চেঁচিয়েছিল যে, চমকে উঠে রুহান প্রায় পড়ে যাচ্ছিল খাট থেকে।
‘কী হয়েছে মা?’ রুহান জিজ্ঞেস করেছিল।
‘দামড়া ছেলে, তখন থেকে ডাকছি কানে যাচ্ছে না?’
‘ডাকছিলে? আমি ঠিক…মানে…ইয়ে…’
‘জানোয়ার। ধম্মের ষাঁড়। পয়সা রোজগার না করে বাড়িতে বসে আয়েস করা হচ্ছে? তখন থেকে ডাকছি। চা-পাতা নেই। বলছি নিয়ে আয়। হুঁশ নেই তোর? আমায় গাধা পেয়েছিস? সকালে বাজার করি, রান্না করি, উনো-কোটি-শিব সব কাজ করি। আর এখন এই সময়ে আমাকেই দোকানে যেতে হবে? তোর লজ্জা নেই? তোর কোনও হুঁশ নেই? মা মরলে শান্তি পাবি? বাবাকে তো খেয়েছিস। এখন কি আমাকেও খাবি? এত খিদে তোর! তুই এত রাক্ষস! মা-বাপ কাউকে ছাড়বি না? আমার দোষ হয়েছিল গত জন্মে, না হলে এমন জানোয়ার জন্মায় আমার পেটে? এমন শয়তান আসে? নির্লজ্জ। বেহায়া। ইতর।’
চা-পাতা! তার জন্য এত! রুহানের এখন আর তেমন গায়ে লাগে না এসব। মনে হয়, মা তো সবসময় বলে। তবে হ্যাঁ। এসব শোনার পর মনে হয় ওর আশপাশের পৃথিবীটা অনেক যেন শান্ত, অনেক যেন ধীর হয়ে যায়। মনে হয় সবাই যেন চাঁদের মাধ্যাকর্ষণের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে। গতকালও তাই হয়েছিল। রাস্তার মানুষ। সামনের লেক গার্ডেন্স স্টেশনের লেভেল ক্রসিং। চায়ের দোকানের বাবলাদা। সবই কেমন যেন মহাশূন্যে হাঁটছিল। চায়ের পাতা কিনে আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছিল না রুহানের। ভাবছিল, যার বাঁচার ইচ্ছে নেই, আর মরার সাহস নেই, তেমন মানুষ কী করে?
‘মা আছে। ভালই,’ রুহান বলল।
কিগান আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু পারল না। আবেশ বলল, ‘যাঃ শালা, গেট পড়ে গেছে। ওই দেখ ট্রেন আসছে। অ্যানাউন্স করল না তো!’
সত্যিই তো! অবাক লাগল রুহানের। ও বলল, ‘ঠিক আছে, তা হলে আমি আসি। কিগানদা, এতক্ষণ থাকলাম ঠিকমতো কথাই তো হল না। পরে একদিন হবে।’
রাহি বলল, ‘আমার কথাটা ভুলে যাবে না তো?’
‘তোমার?’ রুহান হাসল। বলল, ‘না, এবার সত্যিই দেখব।’
কিগান শুধু বলল, ‘ভাল থাকিস রুহান। মনটা ভাল রাখিস।’
রুহান এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের ওপর বসা মোসাম্বি লেবুওয়ালা, ঠান্ডা শরবতওয়ালা, বাদামওয়ালা আর ছড়ানো ছিটানো মানুষজনদের ফাঁকফোকর দিয়ে এঁকেবেঁকে দৌড়োল। ফ্লাইওভারটা ভেঙে যখন দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মে নামল, দেখল দূর থেকে ট্রেনের সবুজ-ঘিয়ে রঙের মুখটা ছোট্ট বাক্সের মতো দেখা যাচ্ছে। ও একটু ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়াল। মোবাইলটা বের করে অন করল। অনেকক্ষণ বন্ধ ছিল। কে জানে কারা ফোন করছিল!
ফোনটা চালু হওয়ামাত্রই টিংটিং করে বেজে উঠল। একটু অবাক হল রুহান। এমন সময় কে ফোন করল ওকে? আরে, বুকুদা যে!
ট্রেনটা এবার কাছে চলে এসেছে একদম। লোকজন ব্যস্ত আর উদগ্রীব হয়ে যে যার জায়গা নিতে শুরু করেছে। রুহান ভেবেছিল ফাঁকা থাকবে ট্রেন। কিন্তু প্রায় কুস্তি করে ট্রেনে উঠতে হবে। ফালতু গাড়ি করে এল এত অবধি!
ফোনটা বাজছে। এখন ধরলে ট্রেনে উঠতে প্রবলেম হবে। কিন্তু বুকুদার ফোন না ধরলেও বিপদ। রুহান ভাবল যা হবার হবে। ধরেই নিই।
‘হ্যালো বুকুদা, আমি এক্ষুনি ট্রেনে উঠছি। পরে ফোন…’
‘হান, মুনাইয়ের খবর আমায় দিতে পারবি?’
‘কে?’ রুহান যেন বুঝতে পারল না। ট্রেনটাও প্ল্যাটফর্ম ওলটপালট করে ঢুকে পড়ল একদম। চিৎকার চেঁচামেচি আর ঠেলাঠেলিতে রুহান বুঝতে পারল না বুকুদা কী বলছে। শুধু ‘মুনাই’ নামটা কানে বাজতে লাগল। মুনাইদি! এতদিন পর হঠাৎ?
ভিড়ের মধ্যে কিছুটা ভেসে, কিছুটা ধাক্কা খেয়ে ট্রেনে উঠে পড়ল রুহান। এক কোণে দাঁড়ানোর জায়গায়ও পেয়ে গেল। তারপর দেখল হাতের মোবাইলটা। লাইন কেটে গেছে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন।
কিন্তু সত্যিই কি বিচ্ছিন্ন? মানুষ কি সত্যিই একে অপরের থেকে ছিটকে যায়? বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়? মানুষ কি পারে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে? না হলে কেন হঠাৎ বুকুদা এতদিন পরে আবার উচ্চারণ করল সেই নাম? জানতে চাইল তার কথা! কেন?
রুহান দেখল আবার রিং হচ্ছে। আবার স্ক্রিনে ঝলসাচ্ছে বুকুদার নাম। কী বলতে চাইছে বুকুদা? এত বছর পর আবার পুরনো ছবি ঝেড়ে বের করছে কেন? রুহান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর ফোনটা কানে লাগিয়ে বলল, ‘বলো বুকুদা।’