২০
আজ রবিবার। সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। মনে হয় নিম্নচাপ। কারণ, গত দু’দিন ধরে আকাশ এমনই গোলা পায়রার পাখনার মতো মুখ করে রয়েছে। সল্টলেক অঞ্চলটা এমনিতেই নির্জন। আর আজ যেন আরও নির্জন মনে হচ্ছে।
এই বারান্দাটা চওড়া। খুব সুন্দর করে তৈরি। বারান্দার মাঝখানে সিলিং থেকে পাট দিয়ে তৈরি একটা দোলনা ঝুলছে। গড়িয়া থেকে সল্টলেকে বাড়ি করে আসার সময় বাপি নিজে যত্ন করে তৈরি করিয়েছে বাড়ির প্রতিটা অংশ। বিশেষ করে এই বারান্দাটা। ওদের গড়িয়ার বাড়িতে কোনও বারান্দা ছিল না। মায়ের চিরকাল এই নিয়ে আক্ষেপ ছিল। দিদিও বলত, ‘বাপি আমাদের কোনও বারান্দা নেই কেন? জানো, জুলিয়েটদের বারান্দা ছিল। আর সেখানে জুলিয়েট অপেক্ষা করত দাঁড়িয়ে।’
বাপি বুঝত না জুলিয়েট কে। জিজ্ঞেস করত, ‘কে জুলিয়েট? তোদের ক্লাসে পড়ে? কোথায় ওদের বাড়ি?’
‘আমাদের ক্লাসে?’ দিদি হেসেই খুন হত। ফরসা গালগুলো লাল হয়ে উঠত খুশিতে।
‘এ বাবা, বাপি জানে না!’ দিদি বলত, ‘আরে না। জুলিয়েট গো। রোমিওকে যে ভালবাসত, শেক্সপিয়র লিখেছেন না। আমি অ্যাব্রিজড ফর্মে পড়েছি। নাটকটাও ট্রাই করেছিলাম, কিন্তু কেমন যেন ইংলিশ!’
বাপি হাসত। দিদির গালে হাত দিত সস্নেহে। বলত, ‘ও, তাই? ঠিক আছে, আমরা যখন বাড়ি করে যাব, সেখানে খুব সুন্দর একটা ব্যালকনি থাকবে। কেমন?’
মা তখন এসে ঢুকত আলোচনায়। রাগ করে বলত, ‘আহা, কী সোহাগ হচ্ছে! ক্লাস সিক্সের মেয়ে প্রেম করবে বলছে আর বাপ তার জন্য ব্যালকনি বানিয়ে দেবে!’
‘কেন? প্রেম করা খারাপ?’ দিদি জানতে চাইত। বলত, ‘তা হলে শেক্সপিয়ার লিখলেন কেন? ক্লাসে পড়ানো হয় কেন? আচ্ছা মা, তুমি এখনও উত্তমকুমার আর সুচিত্রা সেনের ওই লাভস্টোরিগুলো দেখো কেন? তখন তো খারাপ বলো না?’
মা রাগ করত। ফরসা মুখ লাল করে বলত, ‘তবে রে, মুখে মুখে কথা! এই বয়সে আমরা মা-বাবার দিকে চোখ তুলে তাকাতাম না। আর তুই এসব নিয়ে কথা বলছিস? সাহস পাস কোথা থেকে এত? কে তোকে সাহস দিচ্ছে?’
দিদি হাসত। বাপিও হাসত। সেই দেখে মা রেগে যেত আরও। বলত, ‘এসব না করে চল, গানের রেওয়াজে বসবি চল।’
দিদি যেতে যেতে হাত তুলে বাপিকে বলত, ‘তা হলে সেই কথা রইল তো?’
বাপি প্রশ্রয়ের হাসি দিয়ে বলত, ‘রইল। সেই কথাই রইল।’
কত ছোট্ট তখন জিয়ানা। কিন্তু আজও যেন ছবির মতো সব ভেসে আসে। ওই দিদির হাত তুলে কথা বলার ধরন। বাবার হাসিহাসি মুখ। সব যেন টলটলে জলের মতো স্পষ্ট। স্বচ্ছ। তবে সত্যিই কি সব মনে আছে? না, এইসব গল্প বহুবার শুনতে শুনতে একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেছে জিয়ানার! আসলে স্মৃতি একটা অদ্ভুত জিনিস। তা এতভাবে পালটে যায় যে, মাঝে মাঝে তার হদিশ পাওয়া যায় না।
তবে এই ব্যালকনিটায় বসলেই দিদির কথা মনে পড়ে জিয়ানার। না, দিদি দেখেনি এই বাড়ি। তবে কেন কে জানে জিয়ানার মনে হয় এই বাড়ির সর্বত্র দিদি ছড়িয়ে আছে।
বৃষ্টিতেও, একটা দোয়েল পাখি সামনের পেয়ারা গাছের ডালে বসে লেজ নাড়াচ্ছে। কী আনন্দ! এমন যদি বৃষ্টিতে ভিজতে পারত ও! কিগানের সঙ্গে ছাড়া কোনওদিন তেমনভাবে বৃষ্টিতে ভেজেনি জিয়ানা। মা ভিজতেই দেয়নি। দিদি চলে যাওয়ার পর মা এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছিল জিয়ানাকে! দমবন্ধ হয়ে যেত জিয়ানার।
আর কিগান? কেন যে বারবার ভিজতে চাইত! বলত, ‘জানিস, বৃষ্টি হলেই না আমার মায়ের কথা মনে পড়ে। শেষ মাকে যেদিন দেখেছিলাম, সেদিনও বৃষ্টি হচ্ছিল। আর মা, পার্পল রঙের ছাতা সরিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখেছিল আমায়। বৃষ্টি হলেই মনে হয় এই বুঝি মা আসবে। এই বুঝি পার্পল ছাতা সরিয়ে উঁকি দেবে আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মুখটা।’
এখনও তেমনই রয়েছে কিগান। সেই লম্বা, ছিপছিপে চেহারা। মাথা ভরতি এলোমেলো চুল। থ্রি-কোয়ার্টার করে গোটানো শার্টের হাত আর সেই অব্যর্থ নীল চোখ। এখনও তেমনই নরম গলার স্বর।
কথা বলতে পারছিল না জিয়ানা। কষ্ট হচ্ছিল ওর। চোখে জল চলে এসেছিল আচমকা। ও শুধু তাকিয়েছিল অবাক হয়ে। কিগান সত্যিই দাঁড়িয়ে রয়েছে সামনে! সেই কলেজের ছেলেটা! সেই গড়িয়াহাটের সামনে শেষ দেখা হওয়া ছেলেটা! আজ এত বছর বাদে একইভাবে এসে দাঁড়িয়েছে ওর সামনে!
কিগান স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল জিয়ানার দিকে। যেন ওরও মুখ সেলাই করে দিয়েছিল কেউ। যেন অনেক কষ্টে শুধু বলেছিল, ‘কেমন আছিস?’
জিয়ানার চোখের কোণ দিয়ে জলের রেখা নামছিল। না, মোছার কোনও চেষ্টা করেনি ও। যেন বুঝতেই পারেনি ওর চোখ দিয়ে জল পড়ছে!
কিগান ধীরে ধীরে এসে দাঁড়িয়েছিল ঘরের মাঝখানে। তারপর দু’পাশে দু’হাত ছড়িয়ে বলেছিল, ‘আবার সে আসিয়াছে ফিরিয়া।’ হাসছিল খুব। সেই পাথরের মতো মুখটা ক্রমশ যেন গলে যাচ্ছিল হাসিতে। কিগান বলেছিল, ‘আমি জানতাম, তুই আসবি। তবে আজ আসবি জানতাম না।’
‘তুই জানতিস?’ অবাক হয়েছিল জিয়ানা।
‘হ্যাঁ রে। আমাদের জিএম বলেছিলেন তোদের কোম্পানির কথা। তোর কথাও। তখনই জানতাম একদিন না একদিন ঠিক আসবি তুই। তোদের প্রজেক্টের জন্য সাইট ভিজিট তো করতেই হবে। না?’
‘জেনেও তুই…’ জিয়ানা কথা বলতে পারছিল না। হাতের উলটোপিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলেছিল, ‘জেনেও তুই আমায় ফোন করিসনি?’
‘ফোন?’ অবাক হয়েছিল কিগান, ‘কেন, ফোন করব কেন? আমার তো ফোন করার কথা নয়!’
‘কথা নয় মানে?’ কিগানের মুখে হালকা হাসি দেখে গা-পিত্তি যেন জ্বলছিল জিয়ানার, ‘কেন, আমায় ফোন করতে প্রবলেম কোথায় ছিল? কে বারণ করেছিল ফোন করতে?’
‘বারণ কে করেছিল?’ কিগান নিজের চেয়ারে বসে চুলে হাত ডুবিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল, ‘তুই।’
‘আ-,’ চুপ করে গিয়েছিল জিয়ানা। ওর হাত কাঁপছিল তখনও। গলাও স্টেডি হচ্ছিল না। কী বলবে বুঝতে পারছিল না। ও বারণ করেছিল! ঠিক। ও-ই তো বারণ করেছিল! তা বলে কি সব বারণ শুনতে হবে? ও তো পাহাড়েও ওর পিছু নিতে বারণ করেছিল কিগানকে। কিগান শুনেছিল? ওকে ভালবাসতেও বারণ করেছিল। তাও কি শুনেছিল কিগান? তা হলে, এই কথাটা শুনল কেন? কেন, ওর কথা জানতে পেরেও এমন নির্লিপ্ত, সরে থাকতে পারল কিগান! তা হলে কি এতটা বদলে গেছে ও!
জিয়ানা নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু পারছিল না। কিছুতেই পারছিল না। একটা ছোট্ট ঘর। তার ভেতরে বসে রয়েছে ও। আর এত বছর পর ওর এত কাছে কিগান! যেন ভাবতেই পারছিল না। ও অবাক হয়ে দেখছিল কিগানের অল্প হাসিহাসি মুখটা। কী করে হাসতে পারছে কিগান! কী করে এমন নিষ্ঠুর আর নির্লিপ্ত থাকতে পারছে ও? জিয়ানার তো বুকের ভেতর লক্ষ লক্ষ হরিণ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর সেখানে কিগান হাসছে!
জিয়ানা রুমাল দিয়ে চোখের কোণটা টিপে টিপে মুছে বলেছিল, ‘অবশ্য তুই ফোন করবিই বা কেন? কবে কী হয়েছিল তা মনেও তো রাখিসনি। আর হয়তো তোর বউ তোকে অন্য মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে বারণ করেছে। তা তোর ছেলেমেয়ে কিছু হয়েছে?’
‘না,’ কিগান হাসিহাসি মুখেই মাথা নেড়েছিল। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোর?’
‘এক মেয়ে আছে। তুতুল।’
‘নিশ্চয়ই খুব ছোট্ট!’ কিগানের চোখে এই প্রথম আগ্রহ দেখেছিল জিয়ানা।
‘হ্যাঁ ছোটই। তুই, আমি কেমন আছি জানতে চাইলি, কিন্তু উত্তরটা যে দিইনি সেটা খেয়াল করলি না তো?’ জিয়ানার রাগ হচ্ছিল। কেন হচ্ছিল কে জানে! তবে হচ্ছিল।
‘তুই তো ভালই থাকবি। খারাপ থাকবি কেন?’
‘তোর এতগুলো বছর জানতে ইচ্ছে করেনি আমি কেমন আছি? কোথায় আছি? জানতে ইচ্ছে করেনি যে, আমি কীভাবে আছি?’
‘করেছে তো। কিন্তু ভেবেছিলাম…’ কিগান ঠোঁট কামড়ে টেবিলের দিকে তাকিয়েছিল। একটা গোল কাচের পেপার ওয়েট নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে বলেছিল, ‘ভেবেছিলাম, সত্যিই খুব ভেবেছিলাম যে, তোর মা, বাবা বা তুই হয়তো ব্যাপারটাকে ভালভাবে নিবি না। বিশেষ করে তুই যখন অমন করে…যাক গে। বাদ দে। কী হবে আর এসব ভেবে? আমরা এখন বুড়ো হয়ে গিয়েছি। আমাদের দিন গিয়েছে। বাদ দে। তা কী খাবি বল?’
‘কিছু না। আমি কিছুদিন আগে জন্ডিস থেকে উঠেছি।’ জিয়ানা গম্ভীর হয়ে বলেছিল।
‘সে কী তোর শরীর খারাপ! তাও এতটা জার্নি করলি?’ এবার সত্যিই চিন্তিত দেখাচ্ছিল কিগানকে, ‘কেন এভাবে এলি? কনসালট্যান্টরা তো সবটাই দিয়েছিল। তা হলে?’
জিয়ানার ইচ্ছে করছিল না একদম এইসব কথা বলতে। কিন্তু যে-কাজের জন্য গেছে সেটা তো করতেই হবে। ও বলেছিল, ‘আমাদের এমডি খুরানাজি চাইলেন যেন আমরা সাইটটা দেখে তার স্পেস আর লোকেশনটা এগজ্যাক্টলি নিয়ে আসি। কারণ, কনসালট্যান্টরা তো পুঁথিগত বিদ্যা দিয়ে সব দেখে। সাইটে কাজ করাটা বা প্র্যাক্টিক্যালি সব দেখাশোনা করে নেওয়াটা দরকারি। তাই আমি এসেছি।’
‘তুই-ই কেন? আর কেউ নেই!’ কিগান বলেছিল, ‘তুই বলতে পারলি না যে, তোর শরীর খারাপ, তুই পারবি না। অন্য কাউকে যেন পাঠানো হয়।’
‘দেখ, কর্পোরেট অফিসে কাজ করি। উই লিভ ইন আ ওয়ার্ল্ড অব টাফ কম্পিটিটর্স। সেখানে, বেশ কিছুদিন বাড়িতে শুয়েছিলাম। তার জন্য একটা চাপ আছে। তার ওপর যদি বলি যে, যাব না, পারব না। তা হলে তো আরও সমস্যা হবে।’
‘তা বলে এমন শরীর নিয়ে এতটা আসবি? নিশ্চয়ই তোর টাকাপয়সার এতটা অভাব পড়েনি যে, কাজ না করলে ভাত জুটবে না।’
‘না না,’ কিগানের কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলেছিল জিয়ানা, ‘আসলে বিদেশ থেকে এখানে এসে নানারকম কাজের অফার ছিল। কিন্তু এই অফিসটা কাছে। পে-প্যাকও ভাল। খুরানাজিও চমৎকার মানুষ। তাই…আর টাকা কোনওদিন কারও বেশি হয়?’
‘তা ঠিক। আর মানুষ তো ভালটাই চায়।’
‘বুকু তো প্রথমে মৃদু আপত্তি করেছিল। বলেছিল যে, কলকাতার খরচ এত বেশি নয় যে, দু’জনকেই চাকরি করতে হবে। তাও, বাড়িতে বসে কী করব? ভাবলাম পাচ্ছি যখন, তখন লেগে পড়ি।’
‘তা ঠিক। তা তোর হাজব্যান্ড…’
‘বিনয়কৃষ্ণ বোস। দাদু দাদু নাম, না?’ খুব হেসেছিল জিয়ানা। ওই প্রথম। বলেছিল, ‘কিন্তু খুব বড় চাকরি করে। বিদেশি ডিগ্রি। বিদেশি গাড়ি। সে একদম ফাটাফাটি ব্যাপার।’
‘যাক, তোর মা তা হলে খুব খুশি, বল?’ কিগান পেপার ওয়েটটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলেছিল।
‘মা!’ জিয়ানা চোখ তুলে তাকিয়েছিল কিগানের দিকে। তারপর মৃদু গলায় বলেছিল, ‘হ্যাঁ, খুশি। সবাই খুশি।’
কিগান হেসেছিল আবার। নরম গলায় বলেছিল, ‘যাক, তা হলেই হবে। আর বল, কী কী দেখতে চাস? মানে সাইট দেখবি তো?’
জিয়ানার ইচ্ছে করছিল না। তবু বাধ্য হয়েছিল উঠতে। কাজ তো করতেই হবে। কিগানের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘মেজারিং টেপ আছে? আমরা আনতে ভুলে গিয়েছি।’
‘ও তোর সঙ্গে লোক আছে?’
‘হ্যাঁ, তোদের পার্কিং লটের ওখানে।’
‘মেজারিং টেপ দিয়ে কী করবি?’ কিগান অবাক হয়েছিল।
‘তোদের অ্যাভেলেবেল স্পেসটা এগজ্যাক্টলি মাপব,’ জিয়ানা বলল।
‘নাউ কাম অন। এগজিকিউটিভরা এসব করে নাকি? সত্যি তুই পাগলিই রয়ে গেলি। ওসব করতে হবে না। আমার নিজের করা ড্রইং-এর কপি তোকে আমি দিয়ে দেব। ডোন্ট ওরি। সত্যিই, টেপ দিয়ে তুই মাপামাপি করবি!’
জিয়ানা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল কিগানের দিকে। হুবহু সেই গলার স্বর। সেই চাহনি। হুবহু সেই জিয়ানাকে কিছু করতে না দেওয়া। যেন আগলে রাখার ইচ্ছে সমস্ত ছোটখাটো প্রবলেম থেকে। কিগান একইরকম রয়েছে!
জিয়ানা কিগানের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সাইট দেখেছিল তারপর। পাশে হাঁটতে হাঁটতে দু’-একবার হাতে হাতও লেগেছিল। বহুদিন পরে সেই স্পর্শ। সেই চমকে ওঠা। সব ছিল। আর অদ্ভুত এক ভাললাগা ক্রমশ অবশ করে দিচ্ছিল জিয়ানাকে। কিগান যা যা বলে যাচ্ছিল সব যেন ঠিক মন দিয়ে শুনছিলও না জিয়ানা। মনে হচ্ছিল শরীর যেন খুব হালকা হয়ে গেছে! পালকের তৈরি হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল সব কিছুই অর্থহীন। সব কিছুই বড় অতিরিক্ত।
আবার কিগানের চেম্বারে ফিরে গিয়েছিল ওরা। চেয়ারে বসে কিগান জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী খাবি বল তো? ফল খাবি? বাতাবি লেবু। জন্ডিসে ভাল শুনেছি। ফ্যাক্টরির পিছনের দিকে লক্ষ্মণ বলে একটা ছেলে থাকে। তার ঘরের পাশে ইয়াব্বড় বাতাবি লেবু গাছ রয়েছে। দাঁড়া কয়েকটা দিয়ে দেব তোকে। সবাই মিলে খাবি।’
‘পাগল নাকি তুই!’ জিয়ানা ভাল করে তাকিয়েছিল কিগানের দিকে। এতগুলো বছরে কি কিচ্ছু বদলায়নি ছেলেটার? না, বদলেছে। ছটফটে কিগান এখন শান্ত হয়ে গেছে অনেক। খানিকটা যেন ক্লান্তও হয়েছে। চোখের সেই চঞ্চলতাটা আর নেই। জিয়ানার মনে হয়েছিল যেন একটা ঘরকে বহু দিন পর দেখছে আবার। শুধু তফাত এই, ঘরটা আগে অগোছালো ছিল আর এখন যেন অনেকটা গুছিয়ে রাখা হয়েছে।
‘কেন, পাগল কেন? তোকে বাতাবি লেবু দিতে পারি না?’ কিগান অবাক হয়েছিল।
‘গুডনেস! তুই বড় হবি না?’ জিয়ানা হেসেছিল, ‘বাতাবি লেবু টানতে টানতে আমি অত দূর নিয়ে যাব? আর বাতাবি লেবু খেলে আমার দাঁতে প্রবলেম হয়। তাই খাই না। বুঝেছিস?’
কিগান কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ, তারপর বলেছিল, ‘তা হলে তোকে কী দিই বল তো?’
‘কী আবার দিবি? ধ্যাত,’ হেসেছিল জিয়ানা।
‘না, মানে তোর মেয়ের জন্য অন্তত কিছু! কী নাম যেন?’
‘তুতুল,’ জিয়ানা মোবাইল থেকে বের ছবি দেখিয়েছিল কিগানকে।
‘বাঃ, দারুণ! খুব ভাল,’ কিগান বিহ্বল হয়ে তাকিয়েছিল ছবিটার দিকে। চোখ দুটো ছলছল করেছিল কি মুহূর্তের জন্য? তারপর হঠাৎ বলেছিল, ‘দাঁড়া, একটা অদ্ভুত জিনিস আছে। একটু বড়। দু’ফুট বাই দেড় ফুট মতো। কাচের বাক্সে রাখা।’
‘কী?’ জিয়ানা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।
কিগান ওর চেয়ারের পিছনের কাঠের আলমারিটা খুলে খুব সাবধানে একটা কাচের বাক্স বের করে রেখেছিল টেবিলে। আর জিয়ানা অবাক হয়ে দেখেছিল অদ্ভুত সুন্দর দেখতে মাটি দিয়ে তৈরি করা একটা গ্রাম। তাতে কুঁড়েঘর, গোরুর গাড়ি থেকে শুরু করে মেঠো পথ, বোষ্টম বোষ্টুমী সব রয়েছে। সবটাই খুব সুন্দর করে তৈরি করা। অবাক হয়ে দেখছিল জিয়ানা, ‘এটা কোত্থেকে এনেছিস? এত সুন্দর!’
‘কৃষ্ণনগরের মেলার থেকে কিনেছিলাম। এটা নিয়ে যা। তুতুলকে দিবি।’
‘কিন্তু,’ ইতস্তত করেছিল জিয়ানা, ‘অনেক দাম হবে তো!’
‘দাম? হোক না। আর এসব তুই ভাবছিস কেন? তুতুলকে দিস, কেমন?’
তারপর ফেরার পালা। কাচের ওই বাক্সটা কিগান নিজেই বয়ে আনছিল সঙ্গে করে। জিয়ানা হাঁটছিল পাশাপাশি। বৃষ্টি শেষ হওয়ার পর সুন্দর হাওয়া দিচ্ছিল তখন। আল্ট্রামেরিন আকাশে বাসন্তী আঁচল মেলে বসেছিল রোদ্দুর। ভাঙা মেঘ ফাটিয়ে বের হচ্ছিল সূর্য। আর হাওয়া দিচ্ছিল। ফ্যাক্টরির উঁচু জল ট্যাঙ্কিটা ছুঁয়ে অন্য এক সময়ের হাওয়া যেন বয়ে যাচ্ছিল সেই মুহূর্তকালের মধ্যে দিয়ে। নিমেষের জন্য। জিয়ানার মনে হয়েছিল যে, ওর জীবন চলে গেছে দশ দশ বছরের পার। মনে হচ্ছিল সেইসব লেকের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার বিকেলগুলোয় ও যেন কোন এক জাদুবলে পৌঁছে গেছে আবার। মনে হয়েছিল বয়স আবার হাঁটছে পিছনের দিকে। আবার নতুন করে আলো ফিরে আসছে জীবনে। মনে হয়েছিল এ জীবন দ্বিতীয়বার ওকে সুযোগ দিচ্ছে বেঁচে ওঠার।
তবু এ মুহূর্ত ভ্রম। এ জীবন ধুলোর তৈরি। জিয়ানারও বাস্তবে ফিরে আসতে সময় লাগেনি বিশেষ। ও দেখেছিল কিগান মাথা নিচু করে হাঁটছে। চুলগুলো কপালের ওপর পড়ে আছে। আগে হলে জিয়ানা হাত দিয়ে সরিয়ে দিত চুলগুলো। কিন্তু সেদিন পারেনি। অদৃশ্য এক কাঁটাতারের দু’পাশ দিয়ে যেন হাঁটছিল দু’জন।
তবু আর পারেনি জিয়ানা। পার্কিং লটের বেশ কিছুটা আগে একটা বন্ধ ড্রায়ার মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিল হঠাৎ। সামান্য অন্যমনস্ক কিগানকেও আচমকা হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়েছিল। কিগান একটু আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
জিয়ানা কোনও ভণিতা করেনি, সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুই আমার ওপর খুব রেগে আছিস, না রে? আমায় খুব ঘেন্না করিস, না?’
‘আমি!’ কিগান অবাক হয়েছিল।
‘না তো কী?’ কেন যে এত রাগ হচ্ছিল জিয়ানার। ওর মনে হচ্ছিল কিগানের জামাটা ধরে খুব ঝাঁকায়। হাতের কাচের বাক্সটা আছড়ে ভেঙে ফেলে।
‘কেন? রাগ করব কেন? ঘেন্না করব কেন?’
‘আমি তোকে অমনভাবে না করেছিলাম। অমনভাবে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। তোর রাগ হয় না?’
কিগান হেসেছিল। ভীষণ ক্লান্ত এক হাসি। কষ্টের এক হাসি। তারপর বলেছিল, ‘দেখ জিয়ানা, এটা তোর জীবন। তাতে তুই যা ভাল বুঝেছিস করেছিস। যাকে নিজের কাছে রাখার রেখেছিস। যাকে দূরে ঠেলার ঠেলেছিস। আমি আর কী বলব বল?’
‘দূরে ঠেলার মানে?’ জিয়ানার ভেতরটা পনেরো-ষোলো বছরের বালিকার মতো ছটফট করছিল। ও বুঝতে পারছিল বালিকা বয়স ওর কাটেনি এখনও।
কিগান বলেছিল, ‘বাদ দে না। আমি রাগ করিনি। ব্যস, আর কিছু মনে রাখতে হবে না তোকে।’
‘তুই এখনও ভীষণ নিষ্ঠুর!’ জিয়ানার শরীর খারাপ লাগছিল হঠাৎ। এতটা মানসিক স্ট্রেস যেন নিতে পারছিল না আর।
‘তাই? হবে,’ কিগান মাথা নিচু করেছিল।
‘তা কাকে বিয়ে করলি তুই?’ উলটো খোঁচা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল জিয়ানা।
‘সে বাদ দে।’
‘ও বলবি না তা হলে? ঠিক আছে। বলিস না। তা এমন একটা ফালতু চাকরি নিয়ে অজ পাড়াগাঁয়ে পড়ে আছিস যে! জীবনে উন্নতি করার ইচ্ছে নেই?’
‘না। নেই রে,’ কিগান হাসছিল। জিয়ানার কথায় কিছুই যেন মনে করছিল না।
‘ও, তোর জীবন তা হলে ভরে আছে, বলছিস?’ জিয়ানা নিজেকেই যেন চিনতে পারছিল না। এসব কেন বলছে ও? এত হিংসে কোথায় লুকিয়ে ছিল?
কিগান তবু রাগ করেনি। বলেছিল, ‘কাকিমা আর কাকু কেমন আছে রে?’
কিগানের মাথা চিরকাল ভীষণ ঠান্ডা। কিন্তু তা বলে এত! জিয়ানার মনে হচ্ছিল কোথায় যেন হেরে যাচ্ছে ও। কোথায় যেন কিগান পিছনে ফেলে বেরিয়ে যাচ্ছে ওকে। কেন এমন মনে হচ্ছিল ওর? কেনই বা বিয়ের পর থেকে মাঝে মাঝেই ওর মনে পড়ত কিগানের কথা? কেন কষ্ট হত? কেন ও মনে মনে চাইত যে, কিগান এখনও ভালবাসুক ওকে? আর সেই কিগানকে এমন অবস্থায় দেখে কি তাই রাগ হয়েছিল ওর? মনে হয়েছিল যে, কিগান ভুলে গেছে? কোথাও কি মনে মনে আশা করেছিল জিয়ানা যে, ওকে ছাড়া ভাল থাকবে না কিগান? আর এমন করে কিগানকে দেখে সেই আশাই কি পূরণ হয়নি? তাই কি ওভাবে রাগ করেছিল জিয়ানা? বোঝে না। মানুষ নিজেকে বোঝে না কিছুতেই। সে শুধু হাত-পা ছোড়ে। ক্ষণিকের আনন্দকে সারাজীবনের ভেবে নেয়। ভেবে নেয় বালির তৈরি ফুলও একদিন তার গন্ধ ছড়াবে। মৃত ধান বেঁচে উঠবে মাঠে!
‘আরে কিগানদা?’ পার্কিং লটের কাছে পৌঁছোতেই আচমকা চিৎকারে থতমত খেয়ে গিয়েছিল জিয়ানা। দেখেছিল গাড়ির সামনে দাঁড়ানো রুহান এগিয়ে আসছে দ্রুত পায়ে! রুহান চেনে কিগানকে? ভীষণ অবাক হয়েছিল জিয়ানা।
রুহান এসে প্রায় জড়িয়ে ধরেছিল কিগানকে। কিগান হাতের কাচের বাক্সটাকে সামলাতে গিয়ে প্রায় ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, ‘আরে আস্তে। কেমন আছিস তুই?’
‘তুমি কেমন আছ? তুমি কোথায় আছ? ভাবতে ভাবতে মাথা খারাপ হয়ে গেছে আমার। কেন কলকাতা ছেড়ে বেপাত্তা হলে তুমি? কার ওপর রাগ করে? কী হয়েছিল? আমাকে একবার জানালেও না! পায়ের চোটে কাবু হয়ে কিছুদিন যোগাযোগ করতে পারিনি আর সেই ফাঁকে তুমি পুরো বেপাত্তা! কোথায় ছিলে তুমি?’
‘বেপাত্তা?’ জিয়ানা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল কিগানের দিকে, ‘তুই কলকাতা থেকে বেপাত্তা হওয়ার জন্য এখানে এসে উঠেছিস? কেন? কলকাতায় কী হয়েছে? আর তোর বউ? তোর বউ কিছু বলেনি?’
‘বউ? তুমি বিয়ে করেছ নাকি?’ রুহান অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।
‘বিয়ে করেছ মানে?’ জিয়ানা রুহানের কথার ভাবটা ধরে চট করে তাকিয়েছিল কিগানের দিকে, ‘তুই… তুই যে বললি বিয়ে করেছিস?’
‘আমি বললাম?’ হেসেছিল কিগান, ‘আমি কখন বললাম রে?’
‘তুই বিয়ে করিসনি? কেন?’ জিয়ানা অবাক হয়েছিল।
‘কেন!’ কিগান ইয়ারকি মেরে বলেছিল, ‘সত্যিই তো! ও, ভুলে গিয়েছিলাম বোধহয়। আসলে জানিসই তো আমার খুব ভুলো মন।’
‘তুই…তুই…,’ জিয়ানার গলার স্বর বুজে এসেছিল। ও দেখছিল রুহান কথা বলে যাচ্ছে কিগানের সঙ্গে। কিগানও উত্তর দিচ্ছে সাধ্যমতো। জিয়ানা শুধু ভাবছিল, বিয়ে করেনি! এখনও বিয়ে করেনি কিগান! কেন? কোন দুঃখে বিয়ে করেনি ও? আচ্ছা, আর কোনও প্রেমে পড়েছে কিগান? ভালবেসেছে আর কাউকে? খুব জানতে ইচ্ছে করেছিল এইসব। তারপর আচমকাই রুহান আর কিগানের কথার ভেতর ঢুকে পড়ে কিগানকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমি তোকে ফোন করতে বা টেক্সট করতে পারি? রাগ করবি না তো?’
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পারিস,’ কিগান হেসে ওর ফোন নম্বরটা দিয়েছিল।
‘তুই পালটাবি না?’ গাড়িতে ওঠার আগে জিজ্ঞেস করেছিল জিয়ানা।
কিগান বলেছিল, ‘পালটেছি তো। অনেক পালটে গেছি। কিন্তু কী জানিস, তোরা আমায় অনেক পুরনো দিন থেকে চিনিস তো তাই বেসিকটা ধরতে পারিস। আর বেসিক ক্যারেক্টার তো পালটায় না। তাই ভাবছিস যে, আমি পালটাইনি। কিন্তু পালটে গেছি, জানিস, অনেক পালটে গেছি।’
গাড়িতে ফেরার সময় সামনের সিট থেকে পিছন দিকে ফিরে রুহান বলেছিল, ‘আপনারা ক্লাসমেট ছিলেন! এটা কিন্তু দারুণ ব্যাপার হল। কাজটা পেতে কিগানদা হেল্প করবে।’
জিয়ানা হেসেছিল শুধু। রুহানকে আর কী বলবে? আসলে অন্য মানুষদের সত্যিই কিছু বলার নেই জিয়ানার। যে যেমন খুশি ভেবে নিক। জিয়ানা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। পিছন দিকে ছিটকে যাওয়া মাঠ, মানুষ, গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে ও নিজেও যেন ছিটকে যাচ্ছিল কোথাও। কষ্টটা যে গলার থেকে ছড়াতে পারে যেন প্রথম বুঝতে পারছিল ও। রুহান অনেক কথা বলে যাচ্ছিল। কিগানকে ও কীভাবে চেনে। কিগান কেমন। হঠাৎ করে দেখা হয়ে যাওয়াতে ও কতটা খুশি—সব বলে যাচ্ছিল মুখস্থ করা উত্তরের মতো। কিন্তু জিয়ানা শুনছিল না কিছু। ওর শুধু কান্না পাচ্ছিল। খুব কষ্ট হচ্ছিল। বুকুর কথা মনে পড়ছিল না আর। ওর মনে হচ্ছিল কুয়াশার ভেতর থেকে আবার কি বেরিয়ে আসছে সাইকেল? আবার তার ক্রিং কি শুনতে পাচ্ছে ও? জিয়ানার ইচ্ছে করছিল প্রাণপণে দুই হাত দিয়ে কুয়াশা খুঁড়ে ও বের করে আনে ছেলেটাকে। কিন্তু ছেলেটা কি আর সেই সাইকেল চালানো ছেলেটার মতো আছে?
ফেরার পথে গুমার পর থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল আবার। রুহানও হতোদ্যম হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। জিয়ানা জানালায় মাথা রেখে দেখছিল বৃষ্টির জল কীভাবে কাচে লেগে ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে।
জীবন ছিটকে যায়। মানুষ ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে, ফোঁটা ফোঁটা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে অন্য মানুষদের মধ্যে। কিগানকে দেখে জিয়ানার মনে হয়েছিল যে, কিগানও তেমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
‘দিদি চা খাবেন?’ মায়েদের কাজের মেয়েটি দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
‘চা?’ জিয়ানা চিন্তা করল একটু। তারপর বলল, ‘নাঃ, ইচ্ছে করছে না। মা কই?’
‘ঘরে আছে। টিভি দেখছে।’
‘ও,’ জিয়ানা উঠল, ‘আমি ভেতরেই যাচ্ছি। চল।’
মা ঘরে বসে সিরিয়াল দেখছে। শুনেছে, সন্ধেবেলার সিরিয়ালগুলোই দুপুরবেলা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখায়। মা তো সন্ধেবেলা দেখে। তা হলে দুপুরবেলা আবার কেন দেখে!
‘মা?’ জিয়ানা ডাকল, ‘বাপি কই গো?’
মা টিভির স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল জিয়ানার দিকে। বলল, ‘ঘরে রয়েছে। কীসব পেপার্স নিয়ে বসেছে। আয় না, তখন থেকে কী বারান্দায় বসে রয়েছিস!’
‘তুমি তো টিভি দেখছ।’
‘তো কী করব? তুই বারান্দায়, তোর বাপি ব্যস্ত। আমার টিভি ছাড়া আর কে আছে বল?’
জিয়ানা হাসল। মা এমন করে কথাটা বলল যেন টিভি কোনও মানুষ!
‘জানো মা, তোমায় একটা কথা বলার ছিল,’ জিয়ানা বিছানায় আধশোয়া হল।
‘শুনব, তার আগে বল তো, তুতুলকে নিয়ে বুকু কোথায় গেছে?’
‘আরে ওই শপিং মলটায়। কীসব জুতো টুতো কেনার আছে।’
‘অনেকক্ষণ তো হল। এখনও আসছে না কেন বল তো?’ মাকে চিন্তিত শোনাল, ‘তুই একটা ফোন করে দেখ না।’
‘ছাড়ো তো,’ জিয়ানা বিরক্ত হল, ‘সময়মতো ঠিক আসবে।’
‘তুই যেন কেমন!’ মা ভুরু কোঁচকাল, ‘একটা ফোন করতে কী হয় তোর? চিন্তা হয় না রে?’
‘মা, বুকু আছে। তুতুলকে নিয়ে চিন্তা কোরো না।’
মা মাথা নামাল। তারপর বলল, ‘তুই কী বুঝবি? আমি হারিয়েছি তো, আমি জানি। এমন করে মেয়েটাকে অবহেলা করিস না। জানিসই তো মেয়েটা একটু গম্ভীর প্রকৃতির।’
‘আচ্ছা মা, আমি অবহেলা করি? কেন করব? তুতুল ছাড়া আমার বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না যে।’
মা এবার একটু নরম হল। রিমোট দিয়ে টিভিটাকে মিউট করে ঘুরে বসল জিয়ানার দিকে, তারপর বলল, ‘বল, কী বলবি বল। তুতুলের ভাইবোন নেওয়ার কথা ভাবলি?’
‘মা! সত্যি! তুমি পারো বটে!’ জিয়ানা অবাক হয়ে গেল, ‘তোমার মতো এমন ওয়ান ট্র্যাক মাইন্ড আমি জীবনে দেখিনি। কথা হচ্ছিল কী! আর তুমি ঠিক গোরুর রচনার মতো ঢুকে গেলে!’
‘না…’ মা অপ্রস্তুত হল একটু, ‘তোদের ভালর জন্যই বলছিলাম।’
‘জানি মা। কিন্তু আমরাও তো বড় হয়েছি। একটু ভালমন্দ বোঝার মতো বয়সও হয়েছে। এমনভাবে সবসময় বোলো না।’
মা মুখটা গম্ভীর করল, ‘জানি তোরা বড় হয়েছিস। হয়তো একটু বেশিই বড় হয়েছিস।’
জিয়ানার হতাশ লাগল। মা বড্ড বেশি একটা জিনিস নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করে। মায়ের সমস্যা হল যা চায় তা চায়ই। যা মাথায় ঢুকবে তা ঢুকবেই। অন্যের কথা চিন্তা করে না মা। নিজের ধারণাটা অন্যের মাথায় ঢোকানোর জন্য কানের কাছে বকেই যায়।
জিয়ানা বলল, ‘মা, কেন সেন্টিমেন্টাল হচ্ছ? আমি আর বুকু আর সন্তান নেব না। আমাদের আর প্রয়োজন নেই। কেন বুঝছ না?’
মা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘একটা মেয়ে ইচ্ছে করলে সব পারে। তুই একটু ইচ্ছে কর। তা হলেই ঠিক হবে।’
‘মা!’ জিয়ানা সোজা হয়ে বসল, ‘আমি বারান্দাতেই যাই।’
‘আঃ, বড্ড রাগ তোর। বড্ড জেদ,’ মা বিরক্ত হল, ‘ঠিক আছে আর বলব না। যা পারিস কর। আমাদের আর কী? আমরা তো বুড়ো-বুড়ি। এক পা বাড়িয়েই রেখেছি। তোর জন্য চিন্তা হয় তাই বলছিলাম। সন্তান জীবনের মূলধন। মানুষের প্রাণের আরাম। কেন যে বুঝিস না!’
‘মাগো,’ জিয়ানা শুয়ে পড়ল এবার, ‘সত্যিই মা, তোমার সেল্স-এ যাওয়া উচিত ছিল। এমনভাবে যে কেউ পুশ করতে পারে আমি জানতাম না।’
‘সেই তো। এখন তো বলবিই,’ মা রাগ করল।
‘মা, তোমায় একটা কথা বলব বলে বসলাম। আর তুমি…’
মা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, ‘ঠিক আছে। ঠিক আছে। বল।’
‘কিগানকে মনে আছে তোমার?’ জিয়ানা মায়ের দিকে তাকাল।
মা কি কেঁপে উঠল একটু? নাকি জিয়ানার চোখের ভুল। মা সময় নিল। চোখের থেকে চশমাটা খুলে হাত দিয়ে চোখের কোণ দুটো টিপে ধরল একটু। তারপর বলল, ‘ওই সুন্দর মতো, নীল চোখের ছেলেটা কি? মানে সেই ছেলেটা তো?’
‘তোমার মনে আছে?’ জিয়ানা অবাক হল।
‘হঠাৎ ওর কথা বলছিস কেন?’ এবার মায়ের গলায় সাবধানতা।
‘ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার।’
‘মানে?’ মা চট করে তাকাল জিয়ানার দিকে। গলায় উদ্বেগ স্পষ্ট।
‘মানে কিগানের সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার। কাজের সূত্রে একটা ফ্যাক্টরিতে গিয়েছিলাম। সেখানে কাজ করে ও।’
‘লেবার?’ মা মুখে অবজ্ঞার ভাব করল।
‘সে তো আমরা সবাই লেবার। আসলে তা নয়। ও ওই গোটা ফ্যাক্টরিটার প্রোডাকশন ইনচার্জ। আর দেখে তো মনে হল জিএম-র অনুপস্থিতিতে গোটাটা ওই দেখাশোনা করে।’
মা মুখ গোমড়া করে বলল, ‘তুই ওই ফ্যাক্টরিতে আর যাস না।’
‘মানে?’ জিয়ানা অবাক হয়ে উঠে বসল আবার।
‘মানে, ওই ছেলেটার সঙ্গে দেখা করতে হবে না তোকে।’
‘আশ্চর্য! কেন? আর কাজের জন্য তো আমায় যেতেই হবে।’
‘মানে তুই যোগাযোগ রাখবি?’ মায়ের গলাটা আর্তনাদের মতো শোনাল, ‘কী বলছিস তুই!’
‘তুমি এভাবে রিঅ্যাক্ট করছ কেন?’ জিয়ানা মাকে শান্ত করার চেষ্টা করল।
‘তোর মনে নেই? সব ভুলে গেছিস? মনে নেই ছেলেটা কোথায় কোথায় ধাওয়া করেছিল! অনেক কষ্টে ওকে ঘাড় থেকে নামানো গেছে। আর সেখানে তুই গিয়ে নিজের থেকে দেখা করেছিস? তোর কি মাথাখারাপ হয়ে গেছে মিষ্টি? তুই পাগল হয়ে গেছিস নাকি? তোর বাপি শুনলে কত রাগ করবে বল তো? তা ছাড়া বুকু যদি জানে?’
‘কী জানবে মা?’ জিয়ানার খুব অসহায় লাগল, ‘আমি কী এমন করেছি? হঠাৎ করে দেখা হয়ে গেছে আমাদের। ও-ও জানত না। আমিও জানতাম না।’
‘ঠিক আছে।’ মা শান্ত হয়েছিল একটু, ‘দেখা হয়েছে, ব্যস। আর যোগাযোগ করিস না।’
‘মা, যোগাযোগ রাখতে হবে। আমাদের কোম্পানি ওখানে একটা বড় কাজ করছে।’
‘তা হলে তুই যাবি না। অন্য কাউকে পাঠিয়ে দে।’
‘দেখো মা, এমনিতেই অফিসে একটা এনিমিটি সহ্য করতে হয়। খুরানাজি আমায় পছন্দ করেন দেখে অনেকেই পিছনে লাগছে আমার। বলছে যে, আমি নাকি জিরো আউটপুট দিয়ে মাইনে নিচ্ছি। বিদেশ থেকে এসেছি বলে নাকি আমার লেজ আছে। তাই এই কাজে তো আমায় এফর্ট দিতেই হবে।’
‘ছেড়ে দে। কাজটা ছেড়ে দে,’ মা নিশ্চিতভাবে বলল।
‘এমন হয় নাকি? আমার রেপুটেশন বলে কিছু নেই? সবসময় কি আমি পিছিয়ে আসব নাকি? সারাজীবন তো তোমাদের সব কথা শুনলাম। এটা পারব না মা। কাজটার শেষ না দেখে আমি ছাড়ব না। সে তোমরা যাই বলো।’
‘আশ্চর্য! তোর সংসার যখন ভাঙবে তখন ভাল হবে?’
‘সংসার ভাঙবে! কেন?’ জিয়ানার অবাক লাগল।
‘বুকু যদি জানে যে, তোর সঙ্গে এখনও ওই ছেলেটার যোগাযোগ রয়েছে…তা ছাড়া ও-ও তো বিবাহিত নিশ্চয়ই। ওর কথাও চিন্তা কর,’ মা এমন করে বলল যেন মা-ই কিগানের একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী!
‘না, ও বিয়ে করেনি।’
‘অ্যাঁ?’ মা যেন আরও ভয় পেল, ‘অমন সুন্দর দেখতে একটা ছেলে এখনও বিয়ে করেনি!’
‘তো কী হয়েছে মা?’ জিয়ানার খুব অসহায় লাগল, ‘আমার কথাটা তুমি শোনো। ভয় পেয়ো না। আর ও অমন নেই। আমি ফোন করলে খুব নর্মাল কথাবার্তা হয়। কিছুদিন আগে রাতে ফোন করেছিলাম, বলল, খুব ক্লান্ত, দু’রাত ঘুমোয়নি। পরে কথা বলবে। বুঝতে পারছ? তেমন কিছু নয়।’
মা তাও বলল, ‘তোকে আমি চিনি মিষ্টি। এসবে একদম ঢুকবি না। কেন এমন করছিস তুই?’
চেনে? মা জিয়ানাকে চেনে? সত্যিই চেনে? তাই কি অমন করে কিগানের থেকে উপড়ে এনেছিল ওকে? আর এখন যতই আশ্বাস দিক না কেন, মা কি সত্যিই বুঝতে পারছে! ওর মনের ভেতরে যে অদ্ভুত একটা ঢেউ শুরু হয়েছে, তা কি বুঝতে পারছে মা? যতই ও মাকে আশ্বাস দিক যে, সব ঠিক আছে! সত্যিই কি ঠিক আছে সব? থাকলে, কেন কিগানকে বারবার ফোন করতে ইচ্ছে হয় ওর? কেন মনে হয় একটু খবর নিয়ে জানে কিগান কী খেল? কেমন আছে? কেন আজ সকাল থেকে বারবার মনে পড়ছে যে, আজ তেরোই আগস্ট, কিগানের বাবা-মায়ের মৃত্যুদিন? কেন খুব সংযত করে নিজেকে রাখতে হচ্ছে ওর? কেন মনে হচ্ছে এমন বৃষ্টির দিনে যদি একবার কিগানের কাছে যেতে পারত ও! মা কি সত্যিই বোঝে ওকে? মা কি ওকে বোঝে বলেই ভয় পাচ্ছে?
‘মিষ্টি, নিজেকে সামলা। যা হয়ে গেছে, তা হয়ে গেছে। একদম এমন করিস না। কক্ষনও আর পাগলামো করিস না। তোর কিন্তু একটা ছোট মেয়ে আছে।’
‘মা,’ এবার বিরক্ত লাগল জিয়ানার, ‘কেন এমন বলছ! বললাম তো, তোমাদের কথা অনেক শুনেছি। অনেক বোঝা বয়েছি তোমাদের! আর পারব না। আমার জীবনটা কি আমার নয়? শুধু অন্যের মেয়ে, অন্যের বউ আর অন্যের মা হয়েই থাকতে হবে গোটা জীবনটা?’
‘যদি বুকু জানে? তা হলে? তা হলে কী হবে ভাবতে পারছিস?’
‘বুকু জানলে জানবে। বুকুকে অনেক আগেই জানানো উচিত ছিল আমার,’ জিয়ানা রাগের চোটে জোরে জোরে বলল কথাগুলো।
‘কী জানানো উচিত ছিল?’ দরজার থেকে আচমকা বুকুর গলা পেয়ে থমকে গেল জিয়ানা।
বুকুর পাশে বিশাল বড় একটা প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে তুতুল। বুকুর চোখে-মুখে বিস্ময়। কখন ওপরে এল ওরা? জিয়ানা শুনতেই পায়নি। আর কতটা শুনেছে বুকু? জিয়ানার পিঠ দিয়ে একটা হিলহিলে সাপ চলে গেল যেন।
বুকু তাকিয়ে রয়েছে এখনও। চোখে প্রশ্ন। জিয়ানা বুঝতে পারল না কী হবে। কী বলবে। তবে কি এতদিন আড়াল করে রাখা ঘটনাটা এবার প্রকাশ্যে আনতে হবে? তবে কি বুকুকে বলতে হবে, জিয়ানার জীবনে ও-ই প্রথম পুরুষ নয়?