২
বুটটা খুলে রেখে এবার পায়ে জড়ানো ক্রেপটা খুলছে ছেলেটা। মাথা নিচু। ছোট করে কাটা চুলগুলো ঘামে ভিজে সপসপ করছে। জামাটাও শরীরের সঙ্গে লেপটে আছে একদম। ছেলেটা যে বেশ ক্লান্ত তা ওর হাঁপানো দেখে বোঝা যাচ্ছে। ছেলেটার নাম জয়নাল। জগুদার নতুন বাছাই। বয়স বড়জোর কুড়ি। ছেলেটাকে আজই প্রথম নেটে দেখল রুহান। বলের স্পিড বেশ ভাল। দু’পাশে মুভমেন্টও ভাল। ওদের টিমের এক নম্বর ব্যাটসম্যান বটুক চারবার এজ করেছে ওর বল। আর দু’বার তো একদম মিড্ল স্ট্যাম্পে খেয়েছে।
বটুকের ব্যাটটা সলিড। কিন্তু একটা নতুন ছেলের কাছে ক্রমাগত নাস্তানাবুদ হয়ে জয়নালকে চার অক্ষরের মালা পরিয়ে দিয়েছিল। তার ফলস্বরূপ পরের বলটা বটুক হেলমেটের ভাইজারে খেয়েছে। প্যাড-গ্লাভ্স খুলে, ব্যাট ছুড়ে ফেলে, বটুক রীতিমতো রাগারাগি করে বেরিয়ে গেছে।
খুব মজা লাগছে রুহানের। আনন্দ হচ্ছে। বটুককে একদম পছন্দ করে না ও। স্টার ইউনিয়নের এক নম্বর ব্যাটসম্যান বলে ব্যাটার খুব তেল। তা ছাড়া বেঙ্গলের নিয়মিত ওপেনার। ন্যাশনাল লেভেলে মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশের তিনজন ব্যাটসম্যানের সঙ্গে বটুক ঘোষের প্রতিযোগিতা চলছে ইন্ডিয়া স্কোয়াডে ঢোকার জন্য। যদিও রুহান জানে ব্যাপারটা সোজা নয়। ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিম রাবড়ি মালাই নয় যে, চেটেপুটে খেয়ে নেবে। ক্রিকেটের পারফরম্যান্সের পাশাপাশি আরও অনেক ইকুয়েশন এখানে চলে। রুহান জানে, বটুকও এসবের জন্য বোর্ডের নানা লবিতে সিঁড়ি লাগানোর চেষ্টা করছে। পাশাপাশি পারফরম্যান্সও দেখাচ্ছে। এ বছর রঞ্জিতে তিনটে সেঞ্চুরি মেরেছে। যার মধ্যে একটা ডাবল। অসমের সঙ্গে। যদিও সেটার খুব একটা বোধহয় দর নেই, তবু ডাবল সেঞ্চুরি যে-কোনও স্তরের ক্রিকেটেই একটা দারুণ ব্যাপার।
সেই বটুককে জয়নাল এমন ঘোল খাইয়েছে! রুহানের মনে হল ছেলেটার সঙ্গে আলাপ করবে একবার।
আলাপ তো করবে, কিন্তু আর-একটা অস্বস্তি মনের মধ্যে পাক খাচ্ছে রুহানের। ছেলেটাকে কোথায় যেন দেখেছে ও। ঠিক মনে করতে পারছে না, কিন্তু কোথায় যেন দেখেছে। মানুষের মুখ চট করে ভোলে না রুহান। কিন্তু এটা কেন যে মনে পড়ছে না! মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে অস্বস্তি লাগল রুহানের। যেন পরীক্ষায় উত্তর লিখতে বসে সব উত্তরই পেটে আসছে, মুখে আসছে না।
আসলে সত্যিকারের পরীক্ষার সময় তো এমনই হত রুহানের। পড়ি পড়ি করেও মনে পড়ত না সঠিক উত্তর। বা গোটা উত্তরটা লিখল, তারপর শেষের আসল পয়েন্টটা আর মনে এল না। ফলে যা হওয়ার তাই হত। রেজাল্ট ভাল হত না।
ক্লাস নাইনে ওঠার পর অ্যাডিশনালে বায়োলজি নিয়েছিল রুহান। বাবা চাইত ডাক্তার হোক রুহান। সবাই বলেছিল স্ট্যাটিসটিক্স বা মেক্যানিক্স নিতে। তাতে নম্বর উঠত। আর নাইনে বায়োলজি নিলেই কেউ ডাক্তার হয় না। কিন্তু বাবার ছিল গোঁ। বায়োলজি নিতেই হবে। জয়েন্টে বসতে হলে প্রথম থেকে জীববিদ্যাটা পোক্ত করা দরকার।
কিন্তু বায়োলজি বিশেষ মাথায় ঢুকত না রুহানের। এইসব বিজ্ঞানসম্মত নাম। তাদের ল্যাটিন আর গ্রিক অরিজিন। তাদের শ্রেণি, উপশ্রেণি। কর্ডাটা, নন-কর্ডাটা, ভার্টিব্রেটা থেকে শুরু করে অর্থোপোডা, মোলাস্কা ইত্যাদি হাজারও ফ্যাচাংওয়ালা নামের লিস্টি। ওসব কিছুই মনে থাকত না ওর। ভয়ে ঘাম দিত রুহানের। জিব শুকিয়ে আসত। স্যার পড়া জিজ্ঞেস করলে জিবে যেন গিট দিয়ে দিত কেউ। ও কেবল, ‘ওই যে স্যার…’ ‘মানে স্যার…’ বলত। আসলে উত্তরগুলো আশপাশেই উড়ত ওর, কিন্তু তবু ঠিক ধরতে পারত না। তাই ভাল নম্বরও পেত না রুহান। চিরকালই সেকেন্ড ডিভিশন হয়ে রইল ও।
মাধ্যমিকে চুয়ান্ন শতাংশ নম্বর পেয়েছিল রুহান। রেজাল্ট জেনে বাড়ি ফিরে রুহান দেখেছিল বাবা তাড়াতাড়ি চলে এসেছে অফিস থেকে। অস্থিরভাবে পায়চারি করছে বারান্দায়।
রুহানকে দেখে বাবা জানতে চেয়েছিল, ‘কত? লাইফ সায়েন্স আর অ্যাডিশনাল বায়োলজিতে কত?’
নম্বরটা মাথা নিচু করে বলেছিল রুহান। তারপর আর কিছু স্পষ্ট মনে নেই।
শুধু আছড়ে পড়া বেল্ট। চড়। মাটিতে ফেলে গলা টিপে ধরা। আর কাত হয়ে শুয়ে দেখা দূরে মায়ের শঙ্কিত, বিধ্বস্ত মুখ। এটুকুই মনে আছে। ককাই এসে না ছাড়ালে রুহান বাঁচত কিনা কে জানে!
ককাই, মানে রজত রয়। রুহানের কাকা। রুহানের ঠাকুরদা রুদ্রাংশুশেখর রয়, লেক গার্ডেন্সে ওদের বাড়িটা তৈরি করেছিল। দেওয়াল দিয়ে ঘেরা বাড়িটার সামনে ছোট্ট একটা বাগান রয়েছে। নীচতলায় একজন ভাড়াটে রয়েছে ওদের। আর ওপরের তলাটার দুটো অংশ দুই ভাইয়ের।
এ ছাড়াও রুহানের এক পিসি রয়েছে। বাবা আর ককাইয়ের মাঝের বোন। থাকে সল্টলেকে। পিসেমশাইয়ের বড় ব্যাবসা আছে। লেদার এক্সপোর্টের। তবে পিসিমা বিশেষ আসেটাসে না ওদের বাড়িতে।
এসব নিয়ে বিশেষ ভাবে না রুহান। বাবার মৃত্যুর পর থেকে কোথায় যেন আত্মবিশ্বাসে আরও ঘাটতি হয়েছে রুহানের। জানা প্রশ্ন ভুল করে। বাজারে গেলে দরদাম করার মতো মনের জোর পায় না। বাসে কেউ পা মাড়িয়ে দিলে নিজেই ‘সরি’ বলে সরে আসে। রিকশাওয়ালা চার টাকা বেশি ভাড়া চাইলে মুখ বুজে দিয়ে দেয়। এরকম আরও কত কী!
আসলে বাবা যতই বকুক আর মারুক, রুহান জানত যে, বাবা খুবই ভালবাসে ওকে। বাবাকে দেখলে রুহান আলাদা একটা ভরসা পেত।
মাধ্যমিকের রেজাল্টের পর সেই মার দিলেও, বাবাই উদ্যোগ নিয়ে নানা কাঠখড় পুড়িয়ে একটা স্কুলে ঠিক সায়েন্স নিয়ে ভরতি করিয়েছিল রুহানকে। প্রতিটা সাবজেক্টের জন্য আলাদা করে টিচার রাখার পরেও নিজে বায়োলজিটা দেখত। লজ্জা লাগত রুহানের। ও ভাবত, বাবা যে এত খাটছে, তার ফল কি দিতে পারবে রুহান? ও তো এখনও সব ভুলে যায়। মনে করতে পারে না পুরো উত্তর। ও তো এখনও বিজ্ঞানসম্মত নামগুলোর বানান ভুল লেখে। এখনও ত্রিকোণমিতির ফরমুলা গুলিয়ে ফেলে। তা হলে? ও যখন পারবে না, তখন বাবা কত কষ্ট পাবে! কিন্তু তারপর বাবার চেষ্টা, আত্মবিশ্বাসী চোখ দুটো আর অধ্যবসায় দেখে ভাবত, না, কিছুই অসম্ভব নয়।
ছোট থেকেই ক্রিকেট খেলত রুহান। ফাস্ট বল করত। ভালই করত বলটা। বাবার অধ্যবসায় দেখে ও পড়ার পাশাপাশি খেলাতেও উৎসাহ পেত। ক্রমশ সব বিষয়েই রুহানের চেষ্টাটা বাড়ছিল। এমনকী, ইলেভেন থেকে টুয়েলভে ওঠার পরীক্ষাতেও ক্লাসের বন্ধুদের, স্যারদের, এমনকী, নিজেকে পর্যন্ত অবাক করে উনষাট শতাংশ নম্বর পেয়েছিল রুহান। এক শতাংশ, মাত্র এক শতাংশের জন্য ফাস্ট ডিভিশন পায়নি।
এক রাতে, বাবা আর মাকে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুনেছিল রুহান। তার ভেতর রুহানের নামটা আসছিল দেখে কান পেতেছিল ও।
মা বলেছিল, ‘তোমার এমনিতেই মাঝে মাঝে বুকে ব্যথা করে। তারপর অফিসে এত কাজের চাপ। তাই বলছিলাম, অফিস থেকে এসে আর ছেলেটার সঙ্গে বই নিয়ে বসে শরীরের স্ট্রেন কোরো না।’
‘ধুর, কিচ্ছু হবে না,’ বাবার হাসি শুনতে পেয়েছিল রুহান।
‘তোমায় বলেছে,’ মা রেগে গিয়েছিল সামান্য, ‘ভাল কথা বলছি, এসব থামাও। শরীরের যত্ন নাও। তা ছাড়া ছেলের পিছনে এত যে খাটছ, কী লাভ? যা চাইছ তা যদি না হয়? যদি জয়েন্টে সুযোগ না পায়?’
‘তা হলেও ওর এই চেষ্টাটার কথা তো মনে থাকবে। এই পরিশ্রম, ডিসিপ্লিন আর নিষ্ঠাটার কথাটা তো মনে থাকবে। সেদিন ওকে যে বেল্ট দিয়ে পিটিয়েছিলাম তা কি শুধু রেজাল্ট খারাপের জন্য ভেবেছ? তা নয়, একদম নয়। মাধ্যমিকে ওর নিষ্ঠার অভাব ছিল, পরিশ্রমের অভাব ছিল। ডিসিপ্লিন ছিল না ওর। তাই রাগ করে অমন মেরেছিলাম। পরে ভাবলাম, ও তো ছোট। মেরে কী লাভ হবে? তার চেয়ে যদি ওর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চেষ্টা করি তা হলে অন্তত ছেলেটা বুঝবে। সব সময় চাবুক চালালেই কাদায় বসা ঘোড়ার গাড়ি ওঠে না। কখনও কখনও নিজেকেও কাদায় নেমে হাত লাগাতে হয়। আর দেখলে তো এইচ এস-এর কঠিন সিলেবাসেও পাঁচ পারসেন্ট নম্বর বেড়েছে ওর। দেখো না, আর তো মাত্র এক পারসেন্ট। তা হলেই ফার্স্ট ডিভিশন হয়ে যাবে।’
মাত্র এক শতাংশ। মাত্র। এই ‘মাত্র’টুকুই আর ছুঁতে পারল না রুহান। এই ঘটনার চারদিনের মাথায় বাবা হঠাৎ মারা গেল। দিনটা সোমবার ছিল। জুনের মাঝামাঝি। গরমে কলকাতার খুলি ফুটো করে ধোঁয়া উঠছিল যেন। রাস্তায় পিচ গলে বাব্লগামের মতো লেগে যাচ্ছিল জুতোর তলায়। গরম একটা হাওয়া পাক খেয়ে উঠছিল থেকে থেকে।
এর ভেতর বাবা হাঁটছিল। বাস না পেয়ে প্রায় চার কিলোমিটার দূরের অফিস থেকে হেঁটে ফিরছিল মানুষটা। ফুলবাগানের কাছে এসে আর পারেনি। বসে পড়েছিল রাস্তার পাশের একটা দোকানের সিঁড়িতে। আর ওঠেনি।
বাবা ওঠেনি। রুহানও আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ও আবার নেমে গিয়েছিল পঞ্চাশে। নিষ্ঠা, পরিশ্রম, ডিসিপ্লিন সব জট পাকিয়ে গিয়েছিল মাথায়। মায়ের নামে এমআইএস, বাবার পেনশন আর একতলার ভাড়াটেদের ভাড়ার ভাগ নিয়ে হাঁটতে থাকা সংসারটা যেন হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছিল। উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে কলেজে বি এসসি পাস কোর্সে ভরতি হয়েছিল রুহান। বুঝেছিল, আর কিছু হবে না ওর জীবনে। এবার যদি খেলে একটা চাকরি-বাকরি কিছু জোটে।
কিন্তু তাও তো জুটল না। এটা-ওটা হাবিজাবি কাজ করতে করতে কোত্থেকে যে বয়সটা তিরিশ ছুঁয়ে ফেলল কে জানে! তেমনভাবে কিছুই শেষ করা হল না রুহানের। এমনকী নন্দার সঙ্গে সম্পর্কটাও শেষ করা হল না।
আজ দূরে থেকে জয়নালের বোলিং দেখতে দেখতে খুব ভাল লাগল রুহানের। বহু দিন আগে শোনা বাবার কথাগুলো মনে পড়ে গেল আবার। মনে পড়ে গেল পরিশ্রম, ডিসিপ্লিন আর নিষ্ঠা। রুহান বুঝল জয়নাল ছেলেটির ভেতরে তিনটেই আছে। তবে কতদিন থাকে, সেটাই দেখার।
ডান পা-টা প্লাস্টিকের নিচু টুলটার ওপর থেকে মাঠের ওপর নামিয়ে পিছনে ঘুরল রুহান। আঃ, ব্যথা লাগল! ব্যথাটা গিয়েও যাচ্ছে না। এখনও ভোগাচ্ছে। পা ফেলতে, টানতে কষ্ট হচ্ছে। দৌড়োনো তো দূরের কথা। কবে ভাল করে হাঁটতে পারবে কে জানে! আদৌ পারবে তো কোনওদিন?
হঠাৎ খুব অসহায় লাগল রুহানের। কলকাতায় একজন মানুষও নেই যার কাছে গিয়ে নিজের কষ্টের কথা, যন্ত্রণার কথা বলতে পারে! আর যে ছিল সে তো কলকাতায় থাকে না এখন। তীব্র এক কলঙ্ক নিয়ে সে তো মাথা নিচু করে চলে গেছে কলকাতা ছেড়ে। এখনও রুহান ওই নীল চোখ দুটো দেখতে পায়। এখনও নীল চোখ দুটো ওকে ভরসা জোগায়।
‘কী রে শালা, এতদিন পর মাঠের কথা মনে এল?’ নির্ভুলভাবে গলাটা চিনতে পারল রুহান। জগুদা।
ও আবার পিছনে ঘুরল, ‘আরে জগুদা। কেমন আছ?’
‘তুই কেমন আছিস বল! আর তোর হাঁটুটা?’
‘এই আছে, স্লো রিকভারি হচ্ছে। কবে মাঠে নামতে পারব ভগবান জানে!’
‘তা ভগবান তো সবই জানে। কিন্তু মুশকিল কী জানিস, ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গে কোনও ইনফরমেশন শেয়ার করেন না। বহুত খিটকেল পাবলিক। ইনফরমেশন ইজ পাওয়ার, লোকটা জানে। তাই অন্যের হাতে দেয় না সেই পাওয়ার। পাছে তার গুরুত্ব হারায়!’ জগুদা হাসল।
সাদা টি-শার্ট আর প্যান্ট পরা মানুষটার মুখটা ভাল করে দেখল রুহান। না, এগারো বছরে, মাথায় চুলের রঙের চেয়ে আর বেশি কিছু পালটায়নি। জগুদা রয়েছে জগুদাতেই।
কলেজের ফার্স্ট ইয়ারেই কলেজ টিমে চান্স পেয়ে গিয়েছিল রুহান। তার আগে লেকের মাঠে একটা ছোট্ট কোচিং সেন্টারে ক্রিকেটটা শিখত ও। কলেজের ট্রায়ালে ওই শেখাটা কাজে লেগেছিল।
ফাস্ট বল করত রুহান। খুব বেশি লম্বা নয় ও। এই পাঁচ ফুট সাত আর কী। তাই কলেজের ট্রায়ালে বল হাতে লম্বা রান-আপ নিচ্ছিল যখন, স্যার অবাক হয়েছিলেন, ‘তুমি মিডিয়াম পেসার?’
‘না স্যার, আমি ফাস্ট বল করি।’
ট্রায়ালে কলেজের নামকরা এক সিনিয়র ব্যাটসম্যানকে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিল রুহান। তবে সে রাগ করেনি। এগিয়ে এসে বলেছিল, ‘তোর ল্যাটেরাল মুভমেন্ট খুব ভাল তো! তা আমাদের এখানে তো ঠা ঠা পোড়া রোদে সারাদিন খেলা হয়। এই পেসে বল করে যেতে পারবি তো?’
তা পারত রুহান। ওটাই একমাত্র পারত ও। ওই লাল চেরি ফলের মতো বলটা নিয়ে যখন বোলিং রান-আপ থেকে দৌড় শুরু করত, মনে হত এটাই ওর জীবন। বলের সেলাইয়ের ওপর আঙুল দিয়ে গ্রিপ করে ভাবত, এভাবে, ঠিক এভাবেই ও ধরতে চায় জীবনকে। তারপর সামনে দাঁড়ানো ব্যাটসম্যানের দিকে বলটা করার সময় ও ওর সমস্ত ব্যর্থতা, অপমান আর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা ভরে দিত বলটার মধ্যে। চেরি ফলটা রুহানের হাত থেকে বেরোবার পরে পালটে যেত উত্তপ্ত লোহার গোলায়।
এমনই একটা সময়ে কলকাতার একটা নামকরা কলেজের সঙ্গে খেলা ছিল ওদের কলেজের। প্রথমে ব্যাট করে রুহানদের কলেজ খুব অল্প রানে গুটিয়ে গিয়েছিল। লাঞ্চ ব্রেকের সময় সব প্লেয়াররা মাথা নিচু করে বসে ছিল শামিয়ানার নীচে। সেমিফাইনাল ছিল ম্যাচটা। হারলে ফাইনালে যাওয়ার সম্ভাবনা শেষ। স্যার বলেছিলেন, পরের বছরে আবার চেষ্টা করা যাবে। কেউ যেন মনখারাপ না করে।
পরের বছর, পরের বার। সব পরে। মাকে মাংস করতে বললে মা বলে পরের রোববার। জুতো ছিঁড়ে গেছে বললে, পরের মাসে কেনার কথা বলে। কলেজ থেকে ঘুরতে যাওয়ার কথা হলে মা বলে, এবার না, পরের বার। সব পরে হবে। এই বারের জন্য কিচ্ছু নয়! এই জীবনের জন্য কিচ্ছু নয়! তা হলে এই জীবন কীসের জন্য? মাসের পর মাস নিরামিষ ঘাসপাতা চিবোনোর জন্য? ছেঁড়া জুতো পরে হাঁটার জন্য? কলেজের বন্ধুদের ঘুরতে যাওয়ার সময় স্টেশন অবধি পৌঁছে দেওয়ার জন্য? অন্যের সাফল্যে হাততালি দেওয়ার জন্য? এ জন্ম শুধু হাসিমুখে কখন পরের বার আসবে তার অপেক্ষায় থাকার জন্য?
স্যার বলেছিলেন, পরের বার হবে। বলেছিলেন, দুঃখ না করতে। মনখারাপ না করতে। বলেছিলেন, সব বার সবাই পারে না। পরের বার চেষ্টা করা যাবে। মাথা ঠান্ডা রাখতে বলেছিলেন স্যার।
প্রথম ওভারের প্রথম চারটে বলে চারটে চার খেয়েছিল রুহান। তার পরের বল দুটো ব্যাটসম্যানের শরীর লক্ষ্য করে করেছিল। রান হয়নি। ব্যাটসম্যানটি ওভারের শেষে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলেছিল, ‘উই উইল ক্রাশ ইউ। দশ ওভারে খেলা শেষ করে দেব।’
‘মানে?’ টুপি হাতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল রুহান।
‘শালা, মানে বোঝো না? দেব এবার তোদের।’ ব্যাটসম্যান ছেলেটি হাত দিয়ে অশালীন ইঙ্গিত করেছিল।
রুহানের সারা শরীরের রক্ত জমাট বেঁধেছিল মাথায়। ও একদৃষ্টে তাকিয়েছিল ব্যাট হাতে ছেলেটির দিকে। গন্ডগোল এড়ানোর জন্য রুহানের টিমের একজন সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রুহানকে।
ডিপ থার্ডম্যানে দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসছিল রুহান। খেলায় হার-জিত আছেই, তা বলে এভাবে বলবে? কাছেই রুহানদের টিমের শামিয়ানা টাঙানো ছিল। রুহানকে বাউন্ডারি লাইনে এসে দাঁড়াতে দেখে স্যার এসে দাঁড়িয়েছিলেন কাছে। বলেছিলেন, ‘মাথা গরম করছিস কেন? যে যা বলছে বলুক। কান দিবি না। এবার না-ই পারলাম জিততে। পরের বার না হয় জিতব।’
পরের বার! কেন সব কিছু পরের বার হবে? রুহান চোয়াল শক্ত করে নিয়েছিল।
বল হাতে নিজের দ্বিতীয় ওভার করতে যাওয়ার সময় একবার আকাশের দিকে তাকিয়েছিল রুহান। বিবেকানন্দ পার্কের পাশের বড় বড় গাছগুলোর মাথার ওপর সূর্যটা নতুন মোহরের মতো চকচক করছিল। লেকের দিক থেকে কোনাকুনি হাওয়া বইছিল একটা। বিকেলবেলার ভিড় ধীরে ধীরে বাড়ছিল মাঠের পাশে।
বলটা হাতে নিয়ে দৌড়োনোর সময় রুহানের মনে হয়েছিল পরের বার বলে কিছু নেই এ-জীবনে। আসলে একটাই জীবন। একটাই সুযোগ। ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ।
পপিং ক্রিজের কাছে গিয়ে লাফিয়ে উঠেছিল রুহান। না হওয়া থেকে হওয়ার দিকে ছিল সেই লাফ। মাটি থেকে সূর্যের দিকে ছিল সেই লাফ। পরের বারের থেকে এবারের দিকে ছিল সেই লাফ।
একা ছ’টা উইকেট নিয়ে বিপক্ষকে একরকম ধ্বংস করে দিয়েছিল রুহান। ম্যাচ শেষে স্যার জড়িয়ে ধরলে রুহান বলেছিল, ‘স্যার, পরের বার বলে কিছু হয় না। যা করতে হবে এবার করতে হবে।’
ফাইনালেও পাঁচ উইকেট নিয়ে টিমটাকে জিতিয়েছিল রুহান। ম্যান অফ দ্য ম্যাচের হাজার টাকা নিয়ে কিট গুছিয়ে যখন মাঠের বাইরে বেরিয়ে আসছে ঠিক তখনই একজন লম্বা দোহারা চেহারার মানুষ এসে দাঁড়িয়েছিল ওর সামনে। ডান হাতটা বাড়িয়ে হেসে বলেছিল, ‘হ্যালো, আজ খুব ভাল খেলেছ। আমার দারুণ লেগেছে। তুমি কি কোনও ক্লাবে খেলো?’
‘আমি?’ লোকটির সঙ্গে হাত মিলিয়ে অবাক গলায় জিজ্ঞেস করেছিল রুহান।
‘হ্যাঁ, তুমি, খেলো নাকি অন্য কোনও ক্লাবে?’
‘না, মানে, তেমন কিছু নয়। এক জায়গায় জাস্ট প্র্যাকটিস করি।’
‘তা খেলবে আমাদের ক্লাবে?’
‘আপনাদের ক্লাবে?’ রুহান কী বলবে বুঝতে পারছিল না।
‘হ্যাঁ, স্টার ইউনিয়ন।’
‘আপনি কে বলুন তো?’
লোকটি হেসেছিল খুব। তামাটে লম্বা মুখটায় বাচ্চাদের মতো আনন্দ দেখেছিল রুহান। লোকটি বলেছিল, ‘আমার নাম জগন্ময় মিত্র। তবে ময়দানে সবাই আমায় জগুদা বলে।’
‘তা রুহান, এতদিন মাঠে আসিসনি কেন রে?’ জগুদা জিজ্ঞেস করল।
‘এই হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। তার ওপর মায়ের শরীরটা এত খারাপ ছিল যে, বাড়ি থেকে বেরোতেই পারিনি। জানোই তো, মায়ের বাতের ব্যাপারটা এমন হয় যে…’
জগুদা মাথা নাড়ল। পকেট থেকে সিগারেট বের করে বলল, ‘তা অফিস করছিস তো? নাকি সেখানেও ডুব দিয়েছিস?’
রুহান মাথা নিচু করল। গত দশ দিন অফিস যেতে পারেনি। একদম, কোনও কিছু না জানিয়েই যায়নি। তবে একবার অফিসে ফোন করেছিল মাত্র।
জগুদা সিগারেটটা ধরিয়ে অনেকখানি ধোঁয়া বুকের ভেতর নিল। চোখ বন্ধ করে ধোঁয়াটাকে ধরে রাখল খানিক। তারপর বলল, ‘এমন চিরক্যালানে হয়ে থাকলে চলবে? দেখ, সুখেনদা তোকে এই চাকরিটা দিয়েছেন। জানি খুব সামান্য কাজ। তবু এ বাজারে চাকরি তো! তা, সেখানেও লাফড়া করছিস! যে-রুহানকে প্রথম খেলার মাঠে দেখেছিলাম, সেই ছেলেটা কোথায় গেল? তোর কী হয়েছে বল তো? জানিস তো তোদের কোম্পানির অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। তার ওপর এমন কামাই করলে কিন্তু বিপদে পড়বি।’
রুহান জানে কোম্পানি খুব একটা ভাল চলছে না। ক্লাবের কোষাধ্যক্ষ সুখেন বোস রুহানকে পছন্দ করেন। গত বছর একটা ক্যুরিয়র কোম্পানি থেকে চাকরি গিয়েছিল রুহানের। তখন সুখেনদাই এই কনসালটেন্সি ফার্মে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ওকে।
এই কোম্পানিটা বড় বড় স্টিল ফ্যাক্টরির কনসালটেন্সি করে। কিন্তু এই বাজারে অনেক কোম্পানির মতো রুহানদের ফার্মেরও অবস্থা ভাল নয়। গত মাসেই চারজনকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই জগুদা ঠিকই বলছে। রুহানের হঠাৎ গা শিরশির করে উঠল।
জগুদা বলল, ‘আচ্ছা আগে তো তুই খেলার মাঠে অন্তত চাগিয়ে থাকতি। গত মরশুমের থেকে দেখছি মাঠেও তোর কেমন ঢিলে অবস্থা। কেন বল তো?’
মাথা নামাল রুহান। কী যে বলবে ও! সব কথা কি আর জগুদাকে বলা যায়! নিজের অন্যায়ের কথা আর বলে কী করে ও?
রুহান হাসল, ‘এই বাড়ির নানা সমস্যা। চাকরির চাপ। তার ওপর ইনজুরি। আর মন ভাল থাকে, বলো? আর তো প্রথম টিমেও চান্স পাই না।’
‘খেলিস আর মন দিয়ে? যে, পাবি!’ জগুদা রাগের গলায় বলল, ‘যখন তোকে প্রথম দেখেছিলাম কী বল করতিস! বড় একটা জুতোর কোম্পানিতে চাকরিও তো পেলি। কিন্তু রাখতে পারলি কাজটা! জুতোর সোলগুলো টিফিন বাক্সে লুকিয়ে কেন বাইরে আনতে গিয়েছিলি তুই? চাকরিটা খোয়ালি। স্টারও তোকে লাথি মেরে বের করে দিত, যদি না সুখেনদা তোকে বাঁচাতেন। তুই এমন চুরি-ছ্যাঁচড়ামো করবি ভাবিনি কোনওদিন।’
‘ও, সেই কথা তুমি এখনও তুলছ!’ রুহানের খারাপ লাগল, ‘টিফিন বাক্সটা আমার ছিল না জগুদা। অন্য একজনের ছিল। তার ডাবল শিফ্ট ডিউটি ছিল বলে বলেছিল যে, বাড়ি যাওয়ার পথে যেন টিফিন বক্সটা বাড়িতে দিয়ে যাই। আমি কী করে জানব ওর ভেতর দিয়ে জুতোর সোল বাইরে পাচার করছে?’
‘আরে সে তো তুই সবসময় বলিস। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করবে? তুই গাধা বলে তোর এই দশা!’
‘তা বলে তুমি এমন বলবে?’ রুহানের গলাটা বুজে এল।
জগুদা সিগারেটটা শেষ করে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষল। তারপর বলল, ‘যাক গে, সবাই কী ভাবল গুলি মার। এই চাকরিটা ভাল করে করিস আর পায়ের যত্ন নিস। না হলে কষ্ট বাড়বে। আরও এক-দু’ বছর খেলা আছে তোর।’
জগুদা চলে গেল নেটের অন্য দিকে। প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে বসল রুহান। সাড়ে দশটা বাজে। আজ ও ক্লাবে এসেছে মূলত ব্রজদার ডাকে। ব্রজদা ক্লাবেরই এক কর্মকর্তা। গতকাল ফোন করেছিল রুহানকে। বলেছিল একটু দরকার আছে। যেন দেখা করে।
ব্রজদা হল সেই ধরনের মানুষ যে, নিজের যে-কোনও কাজে অন্যকে ভিড়িয়ে নিতে পারে। কিন্তু রুহান বুঝছে না ও কী কাজ করে দিতে পারে! ব্রজদাকে মনে মনে খুব একটা পছন্দ করে না রুহান। কিন্তু গত চার মাস ক্লাবের থেকে কোনও টাকা পায়নি। মাসে চার হাজার টাকা করে ক্লাব দেয় রুহানকে। অন্যরা অনেক বেশি পেলেও রুহান যা পায় তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। ভাবে, সত্যিই তো কী আর এমন খেলছে যে, বেশি টাকা পাবে! ক্লাব এই যে দেয়, এটাই বেশি।
আজ আগস্টের শেষ দিন। ওদের অফিসে দু’ধাপে মাইনে হয়। চোদ্দো তারিখ আর একত্রিশ তারিখ। আজ এখান থেকে কাকিমার বাপের বাড়ি যাবে একবার তারপর অফিসে ঢুঁ মারবে। মাইনেটা নিতে হবে তো!
‘কী রে, কতক্ষণ এসেছিস?’ পিছন থেকে ব্রজদার গলা পেল রুহান।
ও ঘুরে দাঁড়াল, ‘এই তো খানিকক্ষণ।’
‘তা, কী খবর তোর? টাকাপয়সা লাগবে না? চার মাস পেমেন্ট পাসনি তো?’
অবাক হল রুহান। ভূতের মুখে রাম নাম! ব্রজদার ধান্দাটা কী?
ব্রজদা বলল, ‘হ্যাঁরে, তোর পা কেমন আছে? ক’দিনে সেরে উঠবি মনে হয়?’
রুহান মাথা নাড়ল, ‘জানি না ব্রজদা, ফিজিয়োথেরাপি করাচ্ছি, দেখি কী হয়?’
‘আচ্ছা শোন’, ব্রজদা একটা লাল প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে এনে সামনে রাখল, ‘তোর সেই বন্ধুটির খবর কী বল তো?’
‘কোন বন্ধু? আবেশ?’ রুহান জানতে চাইল।
আবেশ গোস্বামী, রুহানের কলেজবেলার বন্ধু। খেলাধুলোয় যথেষ্ট আগ্রহ আছে ওর। রুহানের সঙ্গে মাঠেও এসেছে বেশ কয়েকবার। আর নিজের অদ্ভুত মিশতে পারার গুণে সবার সঙ্গে আলাপও করে গেছে।
‘ওই যে ফরসা, খুব সুন্দর দেখতে। খাড়া নাক। আরে বুঝতে পারছিস না? আচ্ছা গাধা তো তুই! ওই যে রে তোর বন্ধুটা। যার নীল রঙের চোখ!’
‘ও!’ রুহান চোয়াল শক্ত করল। খুব অপ্রিয় একটা বিষয় ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
‘কোথায় রে ছেলেটা? একদিন তো মাঠে নিয়ে এসেছিলি। হ্যাঁরে, ও তো ব্রাহ্মণের ছেলে। বিয়ে করবে না? যতদূর মনে পড়ে ওর সঙ্গে আলাপের পর জানতে পেরেছিলাম যে, বিয়ে হয়নি। কী রে, ও বিয়ে করবে?’
‘অ্যাঁ?’ ঘাবড়ে গেল রুহান, ‘তা আমি বলব কী করে?’
‘তোর বন্ধু, তুই জানিস না?’
‘বন্ধু ঠিক নয়। আমার চেয়ে প্রায় তিন বছরের বড়। তবে ও আর কলকাতায় নেই। ওসব চিন্তা ছাড়ো ব্রজদা। ওর কেস প্রচুর খিটকেল।’
‘যাঃ!’ ব্রজদা মাথা নাড়ল, ‘শালা, আমার কপালটাই খারাপ।’
ব্রজদার তিন রকমের ব্যাবসা আছে। মিষ্টির দোকান, ট্রাভেল এজেন্সি আর বিবাহ বন্ধনীর অফিস। তিনটে ব্যাবসাই ভাল চলে। তবু ব্রজদার কথায় কথায় কপাল খারাপের ব্যাখ্যাটা ঠিক বোঝে না রুহান।
‘বাদ দে,’ ব্রজদা পকেট থেকে রুমাল বের করে তালের মতো মুখটা মুছল, ‘ওঃ, শালা পচা ভাদুরে গরম। যা অবস্থা না! তা শোন না, তোর কাকার ডেকরেটিং-এর ব্যাবসা আছে না?’
‘আছে।’ রুহান বলল, ‘কাকার তো ওটাই ব্যাবসা। তা কোনও বিয়ে ফিয়ে আছে নাকি?’
‘ক্যালানে নাকি? ভাদ্র মাসে বিয়ে? আমার ছোট ভাই, লেক গার্ডেন্সেই থাকে। ছেলের জন্মদিন। সেপ্টেম্বরের দশ তারিখ। প্যান্ডেল ফ্যান্ডেলগুলো করে দিতে হবে। কী, পারবি তো? খুব ইম্পর্ট্যান্ট কাজ কিন্তু!’
‘তা এত ডেকরেটার থাকতে আমায় কেন?’
‘সামনে পুজো সবাই বাঁশ-ত্রিপল অন্য জায়গায় ইউজ করে ফেলেছে। তাই তোকে বললাম, ডোবাসনি ভাই! প্রেস্টিজ প্যাংচার হয়ে যাবে।’
রুহান বলল, ‘আরে আমি কী করতে পারি বলো? কাকাকে বলি। দেখি, যদি কাকা পারে। তা বাড়ি ভাড়া নিলেই তো মিটে যায়।’
‘তুই তো ওখানেই থাকিস! ভেতর দিয়ে লর্ডসের মোড়ের দিকে যেতে হলে একটা মাঠমতো পড়ে না? তার পাশের বিরাট বড় বাড়িটাই তো ভাইয়ের। মানে ভাইয়ের ঠিক নয়। ওর শ্বশুরের। ভদ্রলোক মারা যাওয়াতে একমাত্র মেয়েকে সব দিয়ে গেছেন। শাশুড়ি তো আগেই ছিল না। ফলে এখন ভাইয়ের একচ্ছত্র রাজত্ব। ভেতরে একটা লন আছে। দেখলে চোখ ট্যারা হয়ে যাবে। শালা, আমার যদি এমন এক পিসশ্বশুর থাকত!’ ব্রজদা এমন মুখ করল যেন পারলে এখনই একটা অমন শ্বশুর ধরে আনে।
ব্রজদা আবার বলল, ‘শ্বশুরের টাকায় বড়লোক হওয়ার যে কী মজা, কী করে তুই বুঝবি?’
কথাটার ভেতরের বিদ্যুৎটা আলতো করে রুহানের বুকটা ছুঁল আর তার ফলে আঁতকে উঠল ও। শ্বশুরের পয়সায় বড়লোক? ও যত এইসব থেকে পালাতে চায় ততই যেন এই প্রসঙ্গ ধাওয়া করে ওকে। চেপে ধরে।
রুহান নিজে কষ্টের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে বলল, ‘যাক গে, বাদ দাও। কাকাকে বলছি, দেখি যদি পারি।’
‘দেখি বললে তো হবে না। কাজটা করে দিতে হবে। বাড়ির ভেতরের লনে শামিয়ানা টাঙিয়ে প্যান্ডেল হবে। তুই নিজে যাবি কিন্তু।’
‘আমি?’ রুহান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
ব্রজদা হাসল, ‘শোন, এটা তুই যেভাবেই হোক কর। আমি ভাইকে কথা দিয়ে দিয়েছি। আর না করিস না। তা ছাড়া…’
‘কী তা ছাড়া?’ অবাক হল রুহান।
‘চার মাসের বকেয়া পেমেন্টের সঙ্গে এক মাসের বোনাসও দিয়ে দেব। বুঝলি? কিন্তু অনুষ্ঠানের পর। আগে নয়।’
বোনাস? ব্রজদার কথাটা খট করে কানে লাগল রুহানের। হঠাৎ বোনাস? ও তো খেলতে পারছে না। এমন যদি হত যে, দারুণ খেলে টিমকে জিতিয়েছে তা হলে কর্মকর্তারা বোনাসের কথা বলে। এখানে তো তেমন ব্যাপার নেই। চার মাসের টাকা ওর প্রাপ্য, বোনাসটা ভাল শোনাচ্ছে না। কাজটা করার পরিবর্তে টাকা! একটা সূক্ষ্ম অপমান লাগছে রুহানের। অবশ্য এমন টুকটাক অপমান এখন অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেছে রুহানের। বাইরের লোক তো বাইরের লোক, মা নিজেই কত কথা শোনায়!
আগে কিন্তু মা এমন ছিল না। বরং শান্তশিষ্টই ছিল। রুহানের সব ব্যাপারে খেয়াল রাখত। ইদানীং ব্যাপারটা আর তেমন নেই। বিশেষ করে গত এক বছর ধরে মা যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছে। সবসময় তেতো মুখে ঘুরে বেড়ায়। হয় কী নয় রুহানকে যা নয় তাই বলে অপমান করে। বাবার মৃত্যুর এত বছর পর মায়ের হঠাৎ মনে হয়েছে যে, বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী রুহান। কেন মনে হয়েছে ও জানে না, কিন্তু আজকাল হয় কি নয় মা বলে, ‘তোর বাবা বেঁচে থাকলে আমায় কি এমন দিন দেখতে হত? তোর জন্য, শুধু তোর জন্য তোর বাবা আজ নেই।’
আসলে বাবার পেনশন, ভাগের বাড়িভাড়া আর রুহানের সামান্য রোজগারে সংসার চালাতে মায়ের কষ্ট হয়। এটা রুহান বোঝে আর এটাও বোঝে যে, পাশাপাশি ককাইয়ের ব্যবসায় গত এক বছর যাবৎ উন্নতি হয়েছে বেশ। ককাইয়ের ছেলে রাজাও ভাল চাকরি পেয়ে বিদেশ চলে গেছে। কম্পিটিশন, মা কম্পিটিশনে কোথায় জানি হেরে যাচ্ছে বলে মনে হয় রুহানের। আর তাই তার শোধ তোলে রুহানের ওপর।
ককাইয়ের প্রথম জীবনে বাবা প্রচুর করেছে ককাইয়ের জন্য। পড়াশোনোয় ভাল ছিল না ককাই। ফেলটেলও করেছে কয়েকবার। বিএ-টাও কমপ্লিট করেনি। তখন বাবাই টাকাপয়সা দিয়ে এই ডেকরেটিং-এর ব্যাবসাটা শুরু করায় ককাইকে।
কিন্তু সব শুরুই তো কারও না কারও হাত ধরেই হয়। ককাইয়েরও হয়েছে। তা বলে সারা জীবন কি তার পায়ে মাথা ঠেকাতে হবে নাকি? তাও ককাই আর কাকিমা অনেক করে রুহানদের জন্য। আর প্রায় সবসময় বলে যে, ‘দাদা না থাকলে আমাদের যে কী হত!’
রুহান ভাবে আর কী করতে পারে ককাই? মাথাটা কেটে তো আর মায়ের পায়ে রাখতে পারে না! আর বাবা ব্যাবসা শুরু করিয়ে দিলেও এখনকার এই সাফল্যের কৃতিত্ব গোটাটাই ককাইয়ের নিজের।
আর কোথায় যেন এটাই ঠিক মানতে পারে না মা। রুহান দেখে কীরকমভাবে পদে পদে ককাই আর কাকিমার দোষ ধরে মা। রুহানের বিরক্ত লাগে। মাঝে মাঝে লজ্জাও। মাকে বলেও সে কথা। কিন্তু মা আমলই দেয় না। বরং উলটে রুহানকে বলে, ‘তোকে অত ওদের ধামা ধরতে হবে না। জানিস তো না কীভাবে তোর বাবার টাকার শ্রাদ্ধ করেছে ওরা। আর আমাকেই এখন ভিক্ষে করতে হচ্ছে।’
ভিক্ষে মোটেও করতে হয় না মাকে। রুহান জানে এখন মায়ের বাড়িয়ে বলা স্বভাব হয়েছে। কিন্তু সেটাকে যে কীভাবে রুহান সামলাবে তা ঠিক বুঝতে পারে না। তা মায়ের খারাপ ব্যাবহারটাকে সামাল দেওয়ার জন্য ককাই আর কাকিমার ফাইফরমাস খেটে দেয় রুহান।
এই আজই তো একটা কাজ নিয়ে বেরিয়েছে কাকিমার। এখন মাঠ থেকে যেতে হবে নিউ মার্কেটের ওখানে। কাকিমার বাপের বাড়িতে। তবে এই ব্যাপারটা মা জানে না। জানলে অশান্তির শেষ রাখবে না। কাকিমাও তাই প্রথমে রুহানকে যেতে বলেও পরমুহূর্তে নিষেধ করেছিল। বলেছিল, ‘রুহান, তুই যাস না। দিদি জানলে আবার অশান্তি করবে।’
রুহান হেসেছিল, ‘বাদ দাও তো। আর জানবে কেমন করে? তুমিও বলবে না, আমিও বলব না। ফলে সব ঠিক আছে।’
কাকিমা বলেছিল, ‘আসলে বুকুটা এতদিন পরে বিদেশ থেকে ফিরল। তাই ওর জন্য ছানাভাপা করেছিলাম।’
‘তুমি দাও না, আমি দিয়ে আসব।’ রুহান একরকম জোর করেই টিফিন বাক্সটা কেড়ে নিয়েছিল কাকিমার কাছ থেকে।
কাকিমার প্রেশারটা বেড়েছে কিছুদিন হল। গত পরশু তো পড়েও গিয়েছিল। ডাক্তার বলছে কমপ্লিট বেড রেস্ট। কিন্তু কোনও মহিলা কবে ডাক্তারের কথা শুনেছে? কাকিমাও শোনেনি। বরং নিজের খুড়তুতো ভাইটির জন্য রান্না করেছে নিজে।
খুড়তুতো ভাই বুকু। মানে বুকুদা। পুরো নাম বিনয়কৃষ্ণ বোস। প্রায় সারা জীবনই হস্টেলে হস্টেলে কাটিয়েছে বুকুদা। তবে ছুটিছাটায় কলকাতায় এলে খুব আসত রুহানদের বাড়ি। তখন খুব আড্ডা দিত, ইয়ারকি মারত রুহানের সঙ্গে। এমনকী পাড়ায় ক্রিকেটও খেলত। রুহান খুব ভক্ত ছিল বুকুদার। তবে একসময় আসা বন্ধ করে দেয় বুকুদা। তারপর ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে, ম্যানেজমেন্ট পাশ করে সোজা বিদেশে চলে গিয়েছিল। মাঝখানে শুধু একবার এসে বিয়ে করে আবার চলে গিয়েছিল বউ সমেত। না, বিয়েতে যেতে পারেনি রুহান। তখন খেলতে অসম গিয়েছিল। তবে ফিরে এসে কাকিমার কাছে গল্প শুনেছিল বিয়ের। বর-বউয়ের ছবিও দেখেছিল। খুব মিষ্টি দেখতে বুকুদার বউকে। নামটাও খুব অদ্ভুত। জিয়ানা। নামের অর্থ কী কে জানে! বিয়ের পরে বিদেশ চলে গেলেও প্রথম প্রথম দু’বছর অন্তর মাসখানেকের জন্য আসত বুকুদা। তবে রুহানদের বাড়িতে আসত না। কাকিমা দেখা করতে যেত আর গল্প বলত এসে। বুকুদার সব ব্যাপারেই মুগ্ধ কাকিমা খুব প্রশংসা করত ওদের। তারপর বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় রুহান শুনল একটা মেয়ে হয়েছে বুকুদার। আর তারপরই বন্ধ হয়ে গেল বুকুদার আসা। কাকিমা বলত, ‘চাপ, খুব কাজের চাপ। বুকু উন্নতি করছে খুব।’ বলত, ‘বুকুর বউটাও খুব ভাল হয়েছে, কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করেছে। চাকরিও পেয়েছে ওখানে। ওরা একদম মেড ফর ইচ আদার। আচ্ছা, রুহান তুই বিয়ে করছিস না কেন রে? সারা জীবন এমনই থাকবি?’
রুহান হাসত কাকিমার কথায়। কিচ্ছু বলত না। কার কথা বলবে? কী কথা বলবে? ওর রোজগারে বিয়ে করা যায় নাকি এই বাজারে? তা ছাড়া নন্দার ব্যাপারটা তো এখনও…
কত বছর হল বুকুদার বিয়ের? তা প্রায় আট-ন’ বছর তো হবেই। বহু বহু দিন পরে আজ বুকুদার বাড়িতে যাবে রুহান। বুকুদার সামনে দাঁড়াবে। কিন্তু আড্ডা হবে কি? না, হবে না। রুহান জানে আড্ডা হবে না একদম। আচ্ছা, বুকুদা চিনতে পারবে তো ওকে? সেই কুড়ি-একুশ বছর বয়সের বুকুদা এখন চল্লিশ। কোথা দিয়ে কেটে গেল দু’দশক? সম্পর্ককে কীভাবে চিরে দিয়ে চলে যায় সময়?
বুকুদা এখানেও খুব বড় চাকরি নিয়ে এসেছে। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির পঁচিশ-তিরিশ তলা মতো উঁচু পোস্টে আছে। কাকিমার কাছে ছবি দেখেছে বুকুদার। কাঁচা-পাকা চুল। মোটা গোঁফ। সেই পাতলা দোহারা ছেলেটার জায়গায় এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে মোটাসোটা একটা মানুষ। শুধু ঠোঁটের তিলটা একইরকম রয়ে গেছে।
আজ বুকুদার ছুটি। কে জানে কেন ছুটি নিয়েছে! রুহান শুনেছে বুকুদার বউও বড় চাকরি করে এখন। তবে যেহেতু এদিকে আসেনি কোনওদিন, রুহানের সঙ্গেও আলাপ নেই। আজ দেখা যাক আলাপ হয় কিনা।
পায়ের চোটটা ভালই রয়েছে। আজ আর এই অফিস টাইমের ভিড় ঠেঙাতে পারবে না। ক্লাব থেকে বেরিয়েই রুহান ট্যাক্সি ধরল একটা। আজকাল অল্প দূরত্ব হলেও ট্যাক্সিওয়ালারা ‘না’ করে না। তা ছাড়া নিউ মার্কেট চত্বর থেকে নতুন ভাড়া পেতেও সমস্যা হবে না।
কাকিমাদের বাপের বাড়িটা পুরনো হলেও এখনও একটুও জীর্ণ হয়নি। কাকিমার বাবারা চার ভাই। চারজনের জন্য চারটে তলা বরাদ্দ। বুকুদার বাবা নেই। মা আছে। তবে প্যারালিসিস হয়ে গেছে এক দিকে। সঙ্গে সর্বক্ষণের আয়া থাকে। এ বাড়িতেই এসে উঠেছে বুকুদারা। রুহান শুনেছে যে, বুকুদা কোম্পানি থেকে একটা এলাহি ফ্ল্যাট পেয়েছে নিউটাউনে। কিন্তু যায়নি। কারণ জিয়ানার কষ্ট হবে নিউটাউন থেকে ক্যামাক স্ট্রিটে ওর অফিসে রোজ যাতায়াত করতে। তা ছাড়া বুকুদার মেয়েকেও নামকরা একটা স্কুলে ভরতি করা হয়েছে যেটা এই বাড়ি থেকে বেশ কাছে।
ট্যাক্সি থেকে নেমে বুকটা একটু কাঁপল রুহানের। কেন কাঁপল? বহু দিন পরে বুকুদার সামনে দাঁড়াবে বলে? নাকি এমনি এমনি, রুহানের যেমন আচমকা ভয় লাগে, তেমনই হচ্ছে?
বাড়িটা উঁচু। কাঠের সিঁড়ি বসানো। একতলা থেকে আর-এক তলায় উঠতে প্রায় দু’সপ্তাহ সময় লাগার মতো অবস্থা হয়। সিলিং দেখলে মনে হয় কোনও ঐতিহাসিক মনুমেন্টের তলায় এসে দাঁড়িয়েছে। তবে বাড়ি দেখলে বোঝা যায় যে, কাকিমার বাপের বাড়ির অবস্থা খুবই ভাল। নেহাত ককাইয়ের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে, না হলে ওদের মতো বাড়িতে কাকিমার জীবন কাটে নাকি? কিন্তু কাকিমার কোনও অহংকার নেই। রাগ নেই। সবসময় হাসিখুশি।
বাড়ির একতলায় কাকিমার বাবা-মা থাকেন। প্রথমে সেখানেই গেল রুহান। দরজা খুলল কাকিমার মা নিজে, ‘আরে রুহান! আয় আয়।’
রুহান পায়ের স্যান্ডেলটা খুলে ভেতরে ঢুকল, ‘দিদা, কাকিমা ফোন করে বলেনি যে, আমি আসব?’
‘আরে ল্যান্ডলাইন খারাপ, মোবাইলেও চার্জ নেই। কী যে বিপদে পড়েছি! তবে খেয়া গতকাল বলেছিল যে, তুই আসবি। কিন্তু কখন সেটা বলেনি। তা খেয়ে এসেছিস? এখানে দুপুরে ভাত খেয়ে যাবি কিন্তু।’
‘না দিদা, আমায় খুব তাড়াতাড়ি অফিস যেতে হবে। এই ছানাভাপাটা বুকুদাকে পৌঁছে দিয়েই কাটব।’
‘তুই অফিস শুরু করেছিস নাকি? পা ভাল হয়ে গেছে? খেলতে গিয়ে এমন চোট পেলি!’ দিদা প্রশ্ন করল।
‘পা, পুরো সারেনি। তবে মায়ের শরীর খারাপ ছিল বলেও যেতে পারিনি। তা আজ মাইনে হবে, তাই…’
‘ও,’ দিদা বলল, ‘শরীরটার যত্ন নিস রুহান। ক্রিকেট খুব কঠিন খেলা।’
রুহান হাসল। তা কি আর ও জানে না? খুব জানে, হাড়ে হাড়ে জানে।
রুহান বলল, ‘দিদা, আমি চট করে বুকুদাকে দিয়ে আসি টিফিন বাক্সটা। আচ্ছা, তোমার কি কিছু বলার আছে কাকিমাকে? থাকলে বলো আমি বলে দেব।’
দিদা হাসল, ‘বলিস অনেকদিন আসে না এদিকে, একবার যেন আসে। রজতকে নিয়ে আসে।’
দিদার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এবার দোতলায় উঠতে হবে রুহানকে। হাঁটুটায় এখনও ব্যথা আছে অল্প। এই এভারেস্ট কীভাবে চড়বে ভাবল ও। তবে চড়তে হবেই। ধীরে ধীরে সিঁড়িগুলো ভেঙে ওপরে উঠল রুহান। ঘাম হচ্ছে বেশ। তবে সবটাই কিন্তু পরিশ্রমের জন্য নয়। টেনশন, আসলে ভীষণ টেনশন হচ্ছে রুহানের। এতগুলো বছর কেটে গেছে। কী জানি বুকুদা কতটা পালটে গেছে! একসময় তো চব্বিশ ঘণ্টা বকবক করে মাথা খেত সবার। মনে আছে ওদের বাড়িতে এলে বাবা বলত, ‘বুকু, বোকো না।’
সেই বেশি কথা বলা, ইয়ারকিবাজ ছেলেটা লোক হতে হতে কতটা পালটেছে কে জানে! আজও বুকুদার সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার দিনটার কথা মনে আছে। মনে আছে বুকুদার সেই বিহ্বল দৃষ্টি। কতই বয়স তখন রুহানের? নয়, কি দশ। তবু আজও সব স্পষ্ট মনে আছে ওর।
সেই দিনের সেই বুকুদা আজ এত বছর পরের রুহানকে দেখে কী বলবে?
ডোরবেলটা টিপে নিজের মনকে স্টেডি করল রুহান। এই বয়সে এমন ব্যাপার নিয়ে নার্ভাস হওয়াটা কোনও কাজের কথা নয়। বেলের শব্দটা কেমন গির্জার ঘণ্টার মতো। মনে হচ্ছে যেন প্রার্থনা শুরুর সময় হল।
খুট শব্দে এক পাল্লার কফি রঙের দরজাটা একটু ফাঁক হল। রুহান বুঝল ডোর-চেন লাগানো আছে দরজায়। একটা ষোলো-সতেরো বছরের মেয়ের মাথা দরজার ফাঁক দিয়ে বের হল। চোখে-মুখে জিজ্ঞাসা। আগে মেয়েটিকে দেখেনি রুহান।
মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কাকে চান?’
‘বুকুদা আছে?’
‘বুকুদা? ও দাদাকে খুঁজছেন? আপনি রুহানদাদা?’ মেয়েটি হাসল।
আশ্চর্য হল রুহান। ওকে চিনল কী করে?
মেয়েটি দরজা বন্ধ করল দশ সেকেন্ডের জন্য, তারপর খুট করে ডোর-চেনটা খুলে দরজাটা খুলে দিল পুরো। বলল, ‘আসুন, আমি জানতাম আপনি আসবেন।’
রুহান অবাক হয়ে মেয়েটিকে দেখল। এ বাড়িতে যে কাজ করে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটি দেখতে ভাল। পালিশ পড়লে সুন্দরী বলেও চালানো যায়। তা মেয়েটির কি কোনও অলৌকিক শক্তি রয়েছে? এভাবে মুখ দেখে সব গড়গড় করে বলে দিচ্ছে?
রুহান বোকার মতো হাসল, ‘তুমি আমায় চেনো?’
‘কেন? কাকিমা তো ফোন করে বলেছিল বউদিকে। বউদি তো বলল যে রুহান আসবে সকালে। তাই বুঝতে পেরেছি।’
রুহান বুঝল মেয়েটি একটু বেশি কথা বলে। অবশ্য এই বয়সে এটা হয়।
দরজা থেকে নরম কার্পেটে ঢাকা মেঝে। এই তলাটা এমন ছিল না আগে। ও বুঝল বুকুদা এসে পালটেছে এসব। জুতোটা কোথায় খুলবে বুঝতে পারে না রুহান। দামি কার্পেটের ওপরে ওর এই ধুলো মাখামাখি স্যান্ডলটা খুব বেমানান লাগল ওর। মেয়েটা হাসল, বলল, ‘এই কোনাতেই ছেড়ে রাখুন। কিচ্ছু অসুবিধে নেই। ধুলো পড়ুক। আমার নাম কলি। আপনি সোফায় বসুন আমি ভেতরে খবর দিচ্ছি।’
বসার ঘরটা নতুন করে সাজানো হয়েছে। ওয়াল টু ওয়াল ক্যাবিনেট, পেল্লায় লেদারের সোফা, দেওয়ালে ঝোলানো পাঁউরুটির মতো চ্যাপটা টিভি, স্প্লিট এসি।
রুহান অদ্ভুত দেখতে গ্লাস-টপের সেন্টার টেবিলে খুব সাবধানে প্লাস্টিকে জড়ানো টিফিন বাক্সটা রাখল। এমন বাড়িতে ঢুকলে সবসময় খুব অস্বস্তি হয় রুহানের। মনে হয়, কী করবে ঠিক জানে না। ও ঘড়ি দেখল, প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। বারোটার ভেতর অফিস গেলে ভাল হত। ওই অবধি বস থাকে এই অফিসে। আরও দিন সাতেকের ছুটি লাগবে। রুহান জানে, পাওয়া কঠিন তবু চেষ্টা করবে। এখন ব্যাপারটা হল এখানে কতক্ষণ বসে থাকতে হবে কে জানে! আসলে কুড়ি বছর আগের বুকুদা যে আর তেমন নেই তা বুঝতে পারে ও। সেই পাজামা-পাঞ্জাবি আর ঝোলা নিয়ে চলে আসা মানুষটার এখনকার বাড়িঘর দেখেই তফাতটা করতে পারছে রুহান।
‘কী রে হান? কেমন আছিস?’
প্রশ্নটা বিদ্যুতের মতো আছড়ে পড়ল রুহানের শরীরে। ও চকিতে উঠে দাঁড়াল। প্রায় কুড়ি বছর, তবু গলার স্বর একই আছে!
‘বুকুদা…’ রুহান অবাক হয়ে তাকাল। হুবহু ছবির মতো মানুষটা। শুধু পরনে টি-শার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট।
‘আরে দাঁড়ালি কেন? বোস।’ বুকু হাসল।
‘হ্যাঁ…।’ রুহান বসল। এসি চলছে তবু ঘাম হচ্ছে ওর।
‘তারপর বল, কী করছিস হান?’
‘আমি? এই কাকিমার থেকে এটা নিয়ে দিতে এলাম।’ রুহান বুঝল ও ভুল বলছে।
‘তাই, ক্যুরিয়ারের কাজ করছিস?’
হাসল রুহান, ‘চাকরি করি একটা। ছোটখাটো। তেমন সিরিয়াস কিছু নয়।’
‘সিরিয়াস নয়?’ হাসল বুকু, ‘আসলে কিছুই সিরিয়াস নয়, বুঝলি?’
রুহান বুঝল, ওর মতো বুকুও কথা খুঁজে পাচ্ছে না। ও বলল, ‘বুকুদা, এই টিফিন বাক্সটা রইল। আমি আসি গো। অফিসে দেরি হবে।’
‘তাই? শিয়োর।’ বুকু দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘অনেকদিন পর দেখা হল তোর সঙ্গে। আর এক দিন আসিস, জমিয়ে গল্প হবে।’
‘আসব বুকুদা।’
‘আনা আজ নেই। বাবার কাছে গেছে। তাই আলাপ হল না তোর সঙ্গে। পরে আসিস কিন্তু।’
‘আসব।’ রুহান হেসে দরজার দিকে এগোল।
‘হান,’ বুকু ডাকল পিছন থেকে।
রুহান দাঁড়াল, ‘কী বুকুদা?’
‘মা ভাল আছেন?’
‘হ্যাঁ, তবে এই বয়সে যা হয়। একটু শরীর খারাপ থাকে।’
‘আর…’ বুকু ঠোঁট চাটল। ইতস্তত করল একটু। গোঁফে আঙুল বোলাল, তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘পাড়ার সব ভাল?’
রুহান এই প্রথম সত্যিকারের হাসল, ‘আসি বুকুদা, আর একদিন এসে অনেক গল্প করব।’
‘রুহানদা তুমি এখন এলে?’ অফিসের করিডরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল ব্রত।
ছেলেটা রুহানের চেয়ে বেশ ছোট। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। রুহানের চেয়ে উঁচু পদেই আছে, কিন্তু তবু কখনও রুহানকে অসম্মান করে না বা নিজের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করে না। ছেলেটাকে ভাল লাগে রুহানের। এই পৃথিবীতে, যেখানে একে অন্যকে পিষে মাড়িয়ে এগিয়ে যেতে চায়, সেখানে ব্রত অন্যরকম এক মানুষ। ভাল মানুষ।
রুহান একটু খোঁড়াল। খানিকটা ব্রতকে দেখানোর জন্যই যে, ও কত অসুস্থ এখনও। ওর খারাপ লাগল ব্রতর সামনে এমন মিথ্যাচার করতে, কিন্তু যে দশ দিন না আসে তাকে তো এমন একটু-আধটু অভিনয় করতেই হয়। খেলার ভাষায় ওরা বলে প্লে অ্যাক্টিং।
‘কী হল? তোমার পায়ের চোটটা এখনও কমেনি, না?’ ব্রতর গলায় দুঃখ।
‘কী আর করব বল। এমন লাগল যে, প্রায় ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড বানিয়ে ছেড়েছে আমায়। দেখ না অফিসে পর্যন্ত আসতে পারছি না।’
ব্রত বলল, ‘যাও, মাইতিদার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নাও।’
মাইতিদা অ্যাকাউন্টসে বসে। সারাদিন পান খায় আর কীসব যোগবিয়োগ করে। তবে মাসের দুটো মাইনের দিনে একটু কথাবার্তাও বলে।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রুহান মাইতিদার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই, মাইতিদা নিস্পৃহ গলায় বলল, ‘তোমার মাইনে এখানে নেই। সাহেবের ঘরে।’
‘অ্যাঁ! স্যার দেবেন?’ ভীষণ অবাক হল রুহান, ‘কেন?’
‘কর্তার ইচ্ছেই কর্ম। আমি কীভাবে জানব কেন?’
রুহান পিছন ফিরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে স্যারের ঘরের দিকে এগোল। শুনল মাইতিদা নিজের মনে বলছে, ‘আরে বাবা এটা কি স্কুল যে, একটু খুঁড়িয়ে হেঁটে দিলাম আর সব ঠিক হয়ে গেল? তাও যদি ঠিকমতো খোঁড়াত। আসার সময় বাঁ পায়ে খোঁড়াল আর এখন ডান পা খুঁড়িয়ে হাঁটছে! যত্তসব?’
রুহানকে নক করতেও হল না। কাচের দরজার ওপারের থেকে রুহানকে দেখে বস ডেকে নিলেন ঘরে। তারপর একটা খাম বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘রুহান, এই যে দু’মাসের মাইনে।’
‘দু’মাসের!’ রুহান ঘাবড়ে গেল।
‘হ্যাঁ, আমরা তোমায় ছেড়ে দিচ্ছি। উই ডোন্ট নিড ইউ এনি মোর।’
‘স্যার…’ কথা শেষ করতে পারল না রুহান। যে-পায়ে চোট নেই সেই পায়েও জোর পেল না যেন! মনে হল ও জলের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। রুহান যেন দেখতে পেল একটা ছেলে ডুবছে! ডুবেই যাচ্ছে!