মুহূর্তরা দু’বছর আগে – ১৯

১৯

বাড়িটা পুরনো। কাঠের সিঁড়ি দেওয়া। এই বালিগঞ্জ অঞ্চলে যে এমন বাড়ি থাকতে পারে তা কল্পনাও করতে পারেনি আদি। বড় লোহার গেট ঠেলে ঢুকে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে প্রথমে একতলার বারান্দায় উঠতে হয়েছে। তারপর ডানদিক দিয়ে উঠে যাওয়া আর-একটা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ওকে পৌঁছোতে হয়েছে মালিনীদের এই দোতলায়।

দেখলেই বোঝা যায় বাড়িটা খুব পুরনো। পুরনো হলদেটে কাগজের মতো দেওয়ালের রং। সিলিং-এ কড়িবরগা। উঁচুতে স্কাইলাইট। মোটা দেওয়াল। মনে হয় যে-কোনও সময় গ্র্যান্ডফাদার ক্লক বেজে উঠবে যেন। যেন নুড়িপাথরের রাস্তায় ফিটনের চাকার শব্দ শোনা যাবে যে-কোনও মুহূর্তে।

সাধারণত ভূতের সিনেমায় এমন ধরনের বাড়ি দেখা যায়। এইসব বাড়ির করিডরে একা হাঁটলেই মনে হয় থামে খোদাই করা মূর্তিরা চোখ ঘুরিয়ে লক্ষ করছে মানুষজনকে।

দোতলায় উঠে সবুজ কাঠের পুরনো বড় একটা দরজার সামনে দাঁড়াল আদি। ডানদিকে বড় গোল কলিংবেল। দরজায় কাঠখোদাই করে লেখা-সিংস্।

কলিংবেলটার শব্দটাও পুরনো দিনের মতো গম্ভীর। কেমন যেন থেমে থেমে ঢং ঢং করে বাজল। আর তার একটু পরে খট করে ছিটকিনি খোলার শব্দ পেল আদি। একজন বয়স্ক পাহাড়ি মানুষ। ফতুয়া আর খাটো পাজামা পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

‘বোলিয়ে,’ মানুষটার গলার স্বরটাও কেমন যেন খোনা, পুরনো।

‘মালিনী হ্যায় ঘর মে?’

‘আপ কৌন?’ অদ্ভুত দাগধরা মুখটায় খুব সামান্য কৌতূহল দেখতে পেল আদি।

‘আদিত্য।’

‘ও। আপনার আসার কথা ছিল?’ লোকটার বাংলাটা ভাঙা। কিন্তু বোঝা যায় স্পষ্ট।

‘হ্যাঁ। আসার কথা ছিল।’ আদি ছোট্ট করে বলল।

লোকটা ভাল করে আদির মাথা থেকে পা অবধি দেখল। তারপর বলল, ‘আসুন তবে। আর ওই দরজার কাছে জুতোটা খুলে আসবেন।’

বসার ঘরটা পুরো কার্পেটে মোড়া। নরম কার্পেটের ওপর আদির পা দুটো ঢুকে গেল আপনা থেকে। ঘরটা পুরনো সেগুন কাঠের সোফা আর পাথরের মূর্তি দিয়ে সাজানো। একটা গদার মতো দেখতে ফ্যান ক্লান্ত হয়ে ঘুরছে মাথার ওপর। হাওয়া বিশেষ লাগছে না। তবু গরম লাগছে না আদির। বাড়ির ভেতরটা কেমন যেন স্যাঁতসেঁতে আর ঠান্ডা।

বৃদ্ধ মানুষটি সোফা দেখিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপ বৈঠিয়ে। আমি দিদিকে খবর করছি।’

আদি বসল। কাঁধের ব্যাগটাকে পাশে রেখে, তার থেকে কাগজের একটা তাড়া বের করে কোলের ওপর রাখল। কনসালট্যান্টদের কাছ থেকে বুঝে নিয়েছে এই পেপারগুলো। কিন্তু তাও একবার এখানে বসে দেখে নেবে। কারণ, গৌরকে না হলে বোঝানো যাবে না কিছু।

চাপাডাঙায় মার্চেন্ট মাল্টিপল্‌সের জুস আর মিনারেল ওয়াটারের ফ্যাক্টরিটায় যেন ভদ্রা লেগেছে। কাজ যেন এগোচ্ছে না কিছুতেই। পলিটিক্যাল কানেকশন দিয়ে ব্যাপারটা সল্‌ভ করতে গিয়ে যেন আরও প্যাঁচ খেয়ে গেছে। তবে পাশাপাশি গৌর কাজ এগিয়ে রাখছে। আর এইসব টেকনিক্যাল রিপোর্ট নিয়ে দৌড়োদৌড়িও শুরু করে দিয়েছে সরকারের ঘরে। আসলে ‘শিল্প স্থাপন করতে চাই’ ধরনের একটা প্রেশার সরকারের ওপর রাখতে চাইছে গৌর।

আজ শনিবার। তার ওপর সারাদিন ধরে টিপটিপ করে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। অফিস বেরোতেই ভাল লাগছে না আদির। আসলে শনিবার ছুটি থাকে ওদের। কিন্তু গৌর আজ এক্সিকিউটিভদের নিয়ে স্পেশ্যাল মিটিং ডেকেছে। সামনের বছর একটা জার্মান কোম্পানির সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে যাওয়ার কথা আছে মার্চেন্ট মাল্টিপল্‌সের। তার আগে গৌর অন্তত এই নতুন কাজটা শুরু করে দিতে চায়। কিন্তু জমিটা নিয়ে এমন ঘোঁট পেকে রয়েছে! রাঘব চক্রবর্তী ভদ্রলোক অত্যন্ত সজ্জন, কিন্তু তেমনই খুব ঢ্যাঁটা। আসলে গৌরের অভদ্রতায় ভদ্রলোক জমির ব্যাপারটা সম্মানের ব্যাপার করে নিয়েছেন। কিছুতেই টলছেন না। আদি খবর নিয়ে জেনেছে যে, আসলে জমিটা ভদ্রলোকের মেয়ের নামে রয়েছে। অন্তত ত্রয়ণ তো তাই বলেছে। আর জমিটা এমন অদ্ভুত একটা স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টে রয়েছে যে, ওটা না পেলে ফ্যাক্টরিটা হবেই না।

আদি গৌরকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘স্যার, আপনি কি শুধু গভর্নমেন্টের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্যই কনসালট্যান্ট অ্যাপয়েন্ট করে নানা কোম্পানির থেকে অফার আনছেন?’

‘না রে আদি,’ গৌর হেসেছিল, ‘শোন, শুধু যে চাপ তৈরি তা নয়। আমি চাই যে, ওয়ান্স দ্য ল্যান্ড ইজ ফাইনাল কাজটাও যেন ঝটপট শুরু করে দিতে পারি।’

‘কিন্তু স্যার, মিস্টার রাঘব চক্রবর্তী তো কো-অপারেট করছেন না। তবে?’

‘মেক হিম ডু সো। আমার কাছে এসব বলে লাভ নেই। শোনো আদি, তোমায় এটা যে করেই হোক করতে হবে। জাস্ট কোথায় কী দরকার আমায় বলো অ্যান্ড আই উইল স্টেপ ইন! কাজটা করতে হবে, ব্যস।’

‘কাজটা করতে হবে,’ ছোট্ট একটা মশা সবসময় কানের কাছে ভনভন করে আদির। ও জানে এই প্রজেক্টটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা না হলে দায় নিতে হবে ওকে। গৌর হয়তো তাড়িয়েই দেবে। এইসব কর্পোরেট জগতে হায়ার অ্যান্ড ফায়ার হল বীজমন্ত্র, যা ম্যানেজমেন্ট সারাদিন জপ করে যায়। সেই দিক থেকে একটু এদিক-ওদিক হয়েছে কী ব্যস, গর্দান যাবে। আর আদি চায় না ওর গর্দান যাক। তাই মাস দুয়েক আগে এক বিকেলে একটা ফোন করছিল ও।

তবে ফোনটা করার আগে চিন্তা করেছিল অনেক। কারণ, যে-কোনও জায়গাতেই পলিটিক্যাল ফ্যাক্টরটা এখনকার দিনে খুব বড় হয়ে দাঁড়ায়। সব কিছুতেই পার্টির দাদা-দিদিদের একটা অদৃশ্য বরাভয় থাকতে হয়। বিশেষ করে এই ফ্যাক্টরি ধরনের ব্যাপার-স্যাপারগুলোয়। মানে যেখানে অনেক টাকা আর অনেক মানুষজন এসে একত্র হয়। তাই এই ফোনটা আবার অন্য কোনও অ্যাঙ্গেল আনতে পারে কি না সেটা নিয়েই ভেবেছিল আদি।

তবু ফোনটা করেছিল।

চারবার রিং হওয়ার পর ফোনটা তোলা হয়েছিল, ‘হ্যালো?’

‘ত্রয়ণ?’ নিজের গলাটাই নিজের কাছে সাবধানী লেগেছিল আদির।

‘হ্যাঁ, বলছি, আপনি কে বলছেন?’

‘আমি আদিত্য ব্যানার্জি।’

‘আদিত্য ব্যানার্জি?’ ত্রয়ণ থমকেছিল একটু। তারপর বলেছিল, ‘ও, আদি ব্যানার্জি! মার্চেন্ট মাল্টিপল্‌স। তা হঠাৎ আপনি?’

‘সব কথা ফোনে শুনবেন? আপনি কি কলকাতায় আসেন?’

‘তা আসি মাঝে মাঝে। কেন?’

‘একবার দেখা করার ছিল। জরুরি ভিত্তিতে দেখা করার ছিল,’ আদি কেটে কেটে বলেছিল।

‘আমার সঙ্গে?’ অবাক গলায় জানতে চেয়েছিল ত্রয়ণ।

‘হ্যাঁ, আপনার সঙ্গে। দরকারটা জরুরি। খুব জরুরি।’

ত্রয়ণ হেসেছিল শব্দ করে। বলেছিল, ‘জরুরি যে বুঝতে পারছি। না হলে ক্যাপিটালিস্ট কখনও ফোন খরচ করে এমনি এমনি?’

‘আপনি যা ভাবেন। কিন্তু কত তাড়াতাড়ি আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন বলুন। আর দেখা হলেও আপনি এইসব ক্যাপিটালিস্ট খোঁচাগুলো ব্যবহার করতে পারবেন।’

ত্রয়ণ হেসেছিল, ‘একেবারেই কি ফোনে বলা যাবে না? সামনে চারদিন কলকাতায় যাওয়ার প্ল্যান নেই আমার।’

‘আমি আসতে পারি আপনি বললে। বারাসতের কাছাকাছি কোনও রেস্টুরেন্টে আসতেই পারি আমি। আপনি বলুন কখন আসব।’

‘আপনি আসবেন!’ ত্রয়ণ চিন্তা করেছিল সামান্য। তারপর বলেছিল, ‘ঠিক আছে, পরশু আসুন। দত্তপুকুরের কাছে একটা বড় রেস্টোরেন্ট খুলেছে। এদিকে আসার সময় বাঁ হাতে পড়বে। ক্যাসেল ট্রিট। একটা বড় পেট্রোল পাম্প আছে উলটোদিকে। খুব সোজা। দেখবেন, চিনতে অসুবিধে হবে না একটুও। ওখানে আসুন এই বিকেল চারটে নাগাদ। আমি থাকব।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ। আমি কি আর ফোন করব?’

‘না, তার দরকার নেই। একরকম ফিক্সই তো করলাম। কোনও চেঞ্জ থাকলে আমি ফোন করে বলে দেব আপনাকে।’

‘থ্যাঙ্কস।’ ফোনটা রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস আপনা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল আদির। সত্যি, দরকারে মানুষ গাধাকেও বাপ বানায়!

‘দিদির একটু সময় লাগবে। আপনি কি চা খাবেন?’ সেই বয়স্ক মানুষটি এসে দাঁড়িয়েছে আবার।

‘অ্যাঁ?’ আদি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। তারপর কথাটা বুঝতে পেরে বলল, ‘না, তবে এক গ্লাস জল হলে ভাল হত।’

‘জি, আমি এখনই দিচ্ছি।’ লোকটা মাথা নামিয়ে চলে গেল।

এখনও আসতে দেরি হবে? কেন? দেরি হবে কেন? মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল আদির। মালিনী যেন কেমন গা-ছাড়া ভাব দেখাচ্ছে আজকাল। না, কাজকম্ম ঠিকঠাক করছে, কিন্তু তার বাইরে কোথায় যেন একটা ক্যাজুয়াল হয়ে যাচ্ছে আদির সামনে এসে। সকালে যে আদি বলল গৌর জরুরি মিটিং-এ ডেকেছে, তা কি পাত্তা দিল মালিনী? কথা ছিল আদি আসামাত্র বেরিয়ে যাবে। কিন্তু এখন শুনছে যে, সময় লাগবে। কেন? সময় লাগবে কেন? কী এমন রাজকার্য করছে যে সময় লাগবে? গৌর কি কোনও এক্সকিউজ শুনবে? ফালতু গালাগাল খাবে। আদি শুধু শুধু কনসালট্যান্টদের কাছ থেকে তাড়াহুড়ো করে পেপার্স নিয়ে দৌড়ে এল। সকালে খাওয়াও হয়নি। ভেবেছিল অফিসে গিয়ে খাবে। কিন্তু মালিনী এমন ঝুলিয়ে দিল যে, কী বলবে! আদি চোয়াল পিষল। মনে মনে ভাবল, মালিনীকে কি ও বেশি মাথায় তুলে ফেলেছে? মালিনী কি বুঝে ফেলেছে যে, আদি ওর প্রতি দুর্বল? তাই কি এমন করছে?

আসলে আদি দেখেছে, অনেক মেয়েই এমন করে। কোনও ছেলে তার প্রতি দুর্বল বুঝতে পারলেই যেন লেজে খেলাতে শুরু করে। যাজ্ঞসেনী আইয়ারও তো তাই করত। কম ঘোরাত আদিকে? কিন্তু এখন সময়টা অন্য। বয়সটাও। আদিও আর এক নেই। এখন মালিনী যদি প্যাঁচ দিতে চায়, আদিও প্যাঁচ দেবে। দেখবে, কতক্ষণে প্যাঁচ কাটে।

আদি বোঝে জীবন একটা অদ্ভুত টাগ-অফ-ওয়ার। একটা অদ্ভুত মানসিক খেলা। সবসময় যেন দু’জন যুযুধান প্রতিপক্ষ, একে অন্যকে টেনে মাটিতে ফেলার চেষ্টা করছে। জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রই যেন এমন। সেদিন ত্রয়ণের সঙ্গে দেখা হওয়ার ব্যাপারটাতেও যেন এমনই একটা লড়াই কাজ করছিল।

ক্যাসেল ট্রিট! কেন একটা অমন নাম দেওয়া হয়েছে জায়গাটার তা হয়তো ভগবানও জানে না। ভিনাইল বোর্ডে, পৃথিবীর সমস্ত চড়া রং ব্যবহার করে বড় বড় করে লেখা আছে ক্যাসেল ট্রিট! হয়তো মালিক ভেবেছে যে ইংরেজি নাম ব্যবহার করলেই বোধহয় কৌলীন্য বাড়ে!

রেস্তরাঁটা ছোট। কাঠের চেয়ার, টেবিলে গ্লাসটপ। হালকাভাবে এসি চলছিল। মল্লারকে গাড়িটা একটু দূরে পার্ক করে রাখতে বলে রেস্তরাঁর ভেতরে বসেছিল আদি।

ত্রয়ণ এসেছিল চারটে বেজে দশ মিনিটে।

‘আসুন।’ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল আদি।

কবজিতে ঢিলে হয়ে নেমে যাওয়া ঘড়িটা ঠিক করতে করতে হাসিমুখে এগিয়ে এসেছিল ত্রয়ণ। তবে হাসির ভেতরে কোথায় যেন একটা আবছা সতর্কতা লক্ষ করেছিল আদি।

‘তারপর?’ সামনে চেয়ার টেনে বসে এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে প্রশ্ন করেছিল ত্রয়ণ, ‘এমন জরুরি তলব?’

‘বলছি।’ আদি সময় নিয়েছিল, ‘কী খাবেন বলুন?’

‘আমার তেমন খিদে পায়নি। শশা আর মুড়িতেই আমার চলে যায়।’

‘তাও, কিছু তো একটা খাবেন?’ আদির বিরক্তি বাড়ছিল। যদি তুই এখানে এসে সাধুপনা দেখাবি তো এমন জায়গায় না বসে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে বসলেই পারতি।

ত্রয়ণ যেন মনের কথা পড়তে পেরেই বলেছিল, ‘আমি ভাবলাম আপনি হয়তো সাধারণ জায়গায় কমফর্টেবল বোধ করবেন না। আমাদের আর কী আছে, বলুন না। আমরা মাঠেঘাটে চরে বেড়ানো মানুষ। জল, মাটি, রোদ আমাদের নিত্য সঙ্গী। মেহনতি মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে আমরা কাজ করি। এমন সাহেবি খাবার আমাদের ঠিক রোচে না।’

আদির মনে হচ্ছিল ঠিক কানের পিছনে একটা থাবড়া দেয় ত্রয়ণকে। তবু মাথা ঠান্ডা রেখে বলেছিল, ‘ঠিক আছে। আজ না হয় কিছু খান। একটু অসুবিধে হবে হয়তো। তবু কিছু অর্ডার দিই?’

ত্রয়ণ বিশেষ আপত্তি করেনি এর পর।

খাবারের অর্ডার দিয়ে আদি গুছিয়ে বসেছিল, ‘তা হলে আমি বলি?’

‘বলুন,’ ত্রয়ণ আলতো করে হেলান দিয়ে বসেছিল চেয়ারে।

‘আমাদের দুটো প্রজেক্ট খুব বাজেভাবে হেল্ড-আপ হয়ে আছে এই উত্তর চব্বিশ পরগনায়। কোটি কোটি টাকার ব্যাপার। এই ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই আমরা। এখন আপনি বলুন কেমনভাবে সাহায্য করতে পারবেন?’

‘শুনুন,’ ত্রয়ণ এবার এগিয়ে এসে টেবিলের ওপর দু’হাত রেখে বসেছিল, ‘আপনারা যে-পদ্ধতিতে কাজ করেন, তেমন করলে দুটো কেন, দু’হাজার প্রজেক্ট হলেও তা অমন হয়ে থাকবে। কেন আপনারা বারাসতের এই হাউজিংটায় পার্ক আর গ্রিনারি করে দিলেন না? সবটাই অমন কংক্রিট করে দিলেন! শুধু পয়সা দেখলে চলবে?’

শেষের কথাগুলো কেমন যেন টিটকিরির মতো লেগেছিল আদির। ও দম ধরে রাগটাকে সামলেছিল আবার। নিজের ওপরও বিরক্ত হয়েছিল। চাকরির জন্য এমন সব লোকজনকে সহ্য করতে হচ্ছে ওকে!

আদি বলেছিল, ‘দেখুন, বিজনেস মানে প্রফিট। এখন যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে। আপনি একটা পথ বাতলান।’

‘কেন, চমক চক্রবর্তীকেও তো ট্যাপ করেছিলেন। তা কী বলল সে?’ ত্রয়ণ হেসেছিল।

আদি দ্রুত হিসেব করে নিয়েছিল, ত্রয়ণের কথাতেই স্পষ্ট যে, দু’জনের মধ্যে যথেষ্ট ঝামেলা আছে। কিন্তু আদি তো আর এর ভেতরে ঢুকতে চায় না। কারণ, তা হলে এই ঝঞ্ঝাট মেটাতে গিয়ে আরও দশটা ঝঞ্ঝাটে ফেঁসে যাবে ওরা।

আদি বলেছিল, ‘দেখুন, কে কী করতে পারল বা পারল না তা আমার কনসার্ন নয়। আমার মনে হয়েছে যে, আপনি ইয়ং, ডায়নামিক। আপনি এর ঠিক একটা পথ খুঁজে বের করতে পারবেন।’

‘বাড় খাওয়াচ্ছেন?’ হেসেছিল ত্রয়ণ, ‘আপনাদের এই গৌর সাহেব তো বারাসতের হাউজিং-এর সামনে, একবার সবার সামনে আমায় বলেছিল, আমার তেল বের করে নেবে। তা হঠাৎ এই তেলের খনির দিকে আবার নজর পড়ল কেন আপনাদের? তা ছাড়া বারাসতে সুধাদির সঙ্গে মিটিং-এও তো আমায় পাশের ঘরে পাঠানো হয়েছিল। এখন সেই বাতিল ছেলেটাকেই দরকার পড়ল? মাইরি, আপনাদের গায়ের কোনও চামড়া নেই! টাকা ছাড়া সত্যিই আর কিছু বোঝেন না।’

খাবার দিয়ে যাওয়ার সময়টায় আদি একটু চুপ করেছিল। কথাগুলো যে ত্রয়ণ ভুল বলছিল তা নয়। সত্যিই তো আদি ওই সুধাদির সঙ্গে দেখা করে মিউচুয়াল বেনিফিটের আশ্বাস দিয়ে গৌরের সঙ্গে মিটিং ফিক্স করিয়েছিল। আর সত্যিই সেই মিটিং থেকে ত্রয়ণকে যে বের করে দেওয়া হয়েছিল তাও পরে শুনেছে।

আসলে এইসব কিছু হতই না, যদি না সুধাদি চমককে দিয়ে অমন তিনটে ফ্ল্যাটের ডিম্যান্ড রাখত।

আদি বলেছিল, ‘সেটা ভুল হয়েছিল। আমি মিটিং-এ থাকলে কোনওদিনই এমন কিছু হত না।’

ত্রয়ণ খাবার ভাগ করতে করতে বলেছিল, ‘দেখুন, ব্যাবসা করুন। কিন্তু অন্যেরটা মেরে নয়। সবাই যাতে ঠিক থাকে, সন্তুষ্ট থাকে সেটা তো দেখবেন।’

‘ঠিকই তো। তাই তো আপনার কাছে এসেছি। বারাসতের প্রজেক্টের সামনে আপনারা যে প্রতিবাদ, পিকেটিং করছেন তা নিয়ে ডিটেলে কিছু বলছি না। আমরা শুধু চাই যে, অবস্থাটা স্বাভাবিক হোক। চাই, আবাসিকরা নির্ভয়ে এসে ফ্ল্যাটের পজেশান নিক। আমরাও পাশাপাশি বাকি যেটুকু কাজ আছে সেগুলো করে দিই। দেখুন, এখন একটা ডেডলক হয়ে আছে। পার্কের জন্য যে বলা হয়েছিল, সেটা যে-কোনও কারণেই হোক, করা যায়নি। উপরন্তু সেই জায়গায় কংক্রিটের বিল্ডিং উঠে গেছে। অত টাকা লেগেছে। এখন কি আর তা ভেঙে ফেলা যায়?’

ত্রয়ণ খাবার সমেত বলেছিল, ‘পুরোটা হয়েছে কই? থার্টি পার্সেন্টের মতো কনস্ট্রাকশন হয়েছে। সেটাকে ভেঙে ফেলুন। প্রবলেম কোথায়? ভেঙে পার্ক করে দিন।’

‘আরে বললেই হয় নাকি? ওখানে আবাসনের জন্য একটা কমিউনিটি হল হচ্ছে। সেটার কী হবে? ব্যাপারটা বুঝুন। আপনার লোকজন নিয়মিত স্লোগান দিচ্ছে। আমাদের ওয়ার্কারদের কাজে ঢুকতে দিচ্ছে না। এটা তো বুঝতেই পারছেন আমাদের তরফ থেকে কতটা ক্ষতিকারক। তাই বলছিলাম আপনি তো এটা একদম সামনে থেকে লিড করছেন। একটু দেখুন না!’

‘চমকদা, মানে চমক আর কী, আপনাদের কী শর্ত দিয়েছে?’

‘চমক?’ আদি ঠোঁট কামড়াল। দর কষাকষি শুরু হচ্ছে। ও খুব সাবধানে বলল, ‘সেটা ঠিক মানে…আমি মানে ঠিক ওটা…’

‘কেন ন্যাকামো করছেন?’ ত্রয়ণ বিরক্ত হয়েছিল। পাশের পেপার টাওয়াল দিয়ে জামায় পড়া একফোঁটা মাংসের ঝোল মুছে বলেছিল, ‘আমি শুনেছি বলেই বলছি। বলুন।’

‘দুটো ফ্ল্যাট চায়,’ তিনটেকে দুটো করে কমিয়ে বলেছিল আদি।

‘হুম,’ ত্রয়ণ মাথা নেড়েছিল, ‘দুটো ফ্ল্যাট। কীরকম ফ্ল্যাট?’

‘ওই থ্রি বেডরুম।’

‘আপনাদের তো ওখানে ডুপ্লেও আছে, না?’

‘তা আছে।’ আদি বুঝতে পারছিল না। এরপর ত্রয়ণ কী বলবে।

‘কত দাম ডুপ্লের?’

‘ওই ষাট-সত্তর থেকে শুরু,’ আদি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ত্রয়ণের দিকে।

‘দেখুন, পার্ক আপনাদের করে দিতেই হবে। যেভাবেই হোক। বুঝেছেন? এটা আমার প্রেস্টিজের ব্যাপার। ওখানে কোনও কম্প্রোমাইজ নেই।’

‘মানে?’ অবাক হয়েছিল আদি। এত কথা বলার পর এই!

‘মানে পার্ক চাই। বুঝতে পারছেন না?’

‘না। প্রবলেম তো রয়েই গেল তা হলে।’

ত্রয়ণ হেসেছিল, তারপর থেমে কেটে কেটে বলেছিল, ‘আমি তো বললাম পার্ক চাই। কোথায় চাই, কত বড় চাই, তা তো বলিনি।’

‘সরি। এক্সট্রিমলি সরি,’ দরজার দিকে মুখ না তুলেও গলার স্বর আর অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ পেয়ে আদি বুঝল মালিনী এসে গিয়েছে।

এবার আদি মুখ তুলল, ‘সব ঠিক আছে?’

‘হ্যাঁ, ডোন্ট ওরি। স্যার ফোন করেছিলেন। হি হিমসেল্‌ফ ইজ লেট। সো উই ডোন্ট হ্যাভ টু হেস্ট। আসলে গ্র্যানির কাছে ছিলাম। প্লাস কাল গোল্ডিজের জন্য গিফ্‌ট প্যাক করছিলাম। ওখানে একজন নতুন মানুষ এসেছেন। তাঁকে কাল ওয়েলকাম করা হবে,’ মালিনী জলের গ্লাসটা টেবিলে রাখল।

‘নতুন মানুষ?’ আদির গোল্ডিজ সম্পর্কে কোনও আগ্রহ নেই। কিন্তু মালিনীর যাতে খারাপ না লাগে তাই বলল।

‘হ্যাঁ, আগে হাইকোর্টের কাছে ঘুরে বেড়াতেন মানুষটি। আ কাইন্ড অফ ভ্যাগাবন্ড ভাবত সবাই। কিন্তু ওঁর ফ্যামিলির লোকজন ওঁকে নিয়ে আসে আমাদের কাছে। অবশ্য আমিই ওঁকে দেখে গিয়েছিলাম নিজের থেকে আলাপ করতে। আ নাইস ফেলো। যদিও একটু মেন্টালি আপসেট আছেন। তবে উই হ্যাভ মেডিসিনাল রেমিডিজ ফর দ্যাট।’

‘অ্যাঁ?’ আদি অবাক হল, ‘তুমি এর মধ্যে রাস্তার একটা ভ্যাগাবন্ডকে নিজের গোল্ডিজে তুলে এনেছ? হ্যাভ ইউ গন ম্যাড? আর কে লোকটা? হাইকোর্টের সামনে মানে তো আমাদের অফিস অঞ্চল। সেখানকার কোন ভ্যাগাবন্ড?’ আদি জলের গ্লাসটা তুলল এবার।

‘আরে লোকটা পিকিউলিয়ার পোশাক পরত। মাথায় টুপি। আর লাল সাইকেল চালাত। মজার মজার রাইম বলত। একদিন বলে-হিকরি ডিকরি ডক/ মানুষ করছে ছক/ দ্য ক্লক স্ট্রাক ওয়ান/ পয়সা ইজ ভগবান। হ্যাঁ, জানি হাস্যকর। ক্রুড। কিন্তু ভ্যাগাবন্ড একটা মানুষ এমন রাইম বানায়! তারপর টাকা চায়। আমার অবাক লেগেছিল। তাই আলাপ করলাম। একটু মেন্টালি অস্থির হলেও বাড়ির ঠিকানা সব বলল। আই কন্ট্যাক্টেড দেম। তারপর ব্যস, ওর বাড়ির লোকজন ওকে গোল্ডিজে নিয়ে এল,’ মালিনী গভীর টোল ফেলে হাসল।

এইসব মুহূর্তের জন্যই বেঁচে থাকে মানুষ। এই পুরনো দিনের বাড়ি। তার শান্ত গম্ভীর পরিবেশ আর এমন মোমের দেশের একটা মেয়ে। তার ঘূর্ণির মতো টোল! আদির মনে হল কেন মালিনী ছ’ফুট দূরের ওই চেয়ারটায় বসে রয়েছে? কেন আদি গিয়ে বসতে পারছে না ওর কোল ঘেঁষে? কেন ওর অমন সুন্দর হাতগুলো ধরতে পারছে না হাতের মুঠোয়? আদির অসহায় লাগছে খুব। কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে গোটা জীবনটাই বৃথা গেল। এত নারীশরীর পেয়েছে ও, তবু কোনওদিন কোনও মেয়ের জন্য এমন ক্ষুদ্র আর তুচ্ছ মনে হয়নি ওর নিজেকে। বরং আরও স্পষ্ট করে বললে, মালিনীর শরীর নিয়ে এক মুহূর্তের জন্যও কিছু মনে হয়নি ওর। বরং ওর ভেতরে যে কোত্থেকে একটা চোদ্দো-পনেরো বছরের ছেলে গজিয়ে উঠেছে, কে জানে! যার কেবল হিংসে হয়, কষ্ট হয়। যে কেবল কোলে মুখ দিয়ে শুয়ে থাকতে চায়। আর চায় মালিনী ভালবাসুক ওকে। শুধুমাত্র ভালবাসুক ওকেই। আর কাউকে নয়।

‘কী হল?’ মালিনী হাসল আবার, ‘এমন পাথরের মতো হয়ে গেলে কেন?’

আদি চোয়াল শক্ত করল। মালিনীর এই দ্বিতীয় ধরনের হাসিটা সহ্য করতে পারে না ও। কেমন যেন একটা পর করে দেওয়া হাসি। দূরে রেখে দেওয়া হাসি। যেন একটা কাঁটাতার তুলে দিল সামনে। এমন হাসির সামনে আদির সমস্ত ইচ্ছে কেমন যেন নিভে যায়। কেমন যেন হ্যাংলা লাগে ওর নিজেকে। মনে হয় বড্ড বেশি লোভ করে ফেলছে বোধহয়।

‘না, ভাবছিলাম। তুমি জিঙ্গল পাগলাকে জোটালে শেষপর্যন্ত!’

‘জিঙ্গল পাগলা! বাট হি ইজ মাইকেল,’ মালিনী অবাক হয়ে হাসল আবার। আদি চোখ সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। কী হবে ফালতু কষ্ট পেয়ে? মালিনী কেন বোঝে না? আদি তো খুব বোঝানোর চেষ্টা করে। তবু বোঝে না। হয়তো মালিনীর অন্য কাউকে পছন্দ। অন্য কেউ আছে ওর জীবনে।

আদি বলল, ‘লেট্‌স মুভ। কনসালট্যান্ট আমায় পেপার্সগুলো দিয়েছে। একবার চোখ বুলিয়ে ইম্পর্ট্যান্ট আসপেক্টসগুলো স্যারকে বলতে হবে। ঠিকমতো দেখাই হয়নি।’

মালিনী বলল, ‘আচ্ছা, তুমি আমায় এই নর্থ চব্বিশ পরগনার কাজের থেকে একটু সরিয়ে রাখছ কেন বলো তো?’

আচমকা প্রশ্নটায় একটু ঘাবড়ে গেল আদি।

আসলে ঘটনাটা সত্যি। নর্থ চব্বিশ পরগনার দুটো প্রজেক্টই একটু বাজে দিকে বাঁক নিচ্ছে। আর ভবিষ্যতে ব্যাপারটা আরও খারাপ হতে পারে। আদি তাই এসবের থেকে একটু সরিয়েই রাখতে চায় মালিনীকে। অন্য প্রজেক্টের কাজ ওকে ডিল করতে বলে। তবে সবটাই করে সন্তর্পণে। গৌরকে বাঁচিয়ে। কারণ আদি চায় না যে, চমক-ত্রয়ণ-সুধাদি এমন সব মানুষজনের পাল্লায় পড়ে মালিনী!

আদি বলল, ‘মানে? তোমার তো অন্য কাজও আছে, না? তা ছাড়া আমি তো দেখছি। আর এতে পলিটিক্স ঢুকে যাচ্ছে। নানারকম লোক তাদের ভেস্টেড ইন্টারেস্ট নিয়ে এসে ঢোকার চেষ্টা করছে। এতে তোমার খারাপই লাগবে। আর আমার তো ম্যানেজ করতে ভালই লাগছে।’

মালিনী তাকিয়ে রইল চুপ করে। তারপর বলল, ‘জানো জোনাথনদাদু কী বলে?’

‘কে?’ আদি বুঝতে পারল না, কী বলতে চাইছে মালিনী।

‘বলে, সেল্‌ফ হেল্‌প ইজ দ্য বেস্ট হেল্‌প। কেন তুমি গার্ড করো আমায়? দেখো না আমি এসব সামলাতে পারি কিনা।’

জোনাথনদাদু! নামটা প্রথম শুনল আদি। আসলে মালিনীর সম্পর্কে শুনতে, জানতে খুব ইচ্ছে করে আদির। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে কোথায় যেন বাধোবাধো ঠেকে ওর। মনে হয় মালিনী যদি অতিরিক্ত কৌতূহল দেখালে রাগ করে? যদি ওর সঙ্গে কথা বন্ধ করে দেয়! এই যেটুকু স্বাভাবিকভাবে কথা বলে, সেটাও যদি না করে! তা হলে!

আদি কথা ঘোরাতে বলল, ‘গ্র্যানির শরীর ভাল আছে?’

‘কথা ঘুরিয়ো না।’ মালিনী যেন ধমক দিল, ‘একা একা কি পারছ কোনও কিছুর সমাধান করতে? সব তো তেমনই অবস্থায় পড়ে রয়েছে। আমি তো কাজে লাগতে পারতাম! তোমার বড্ড ইগো। আই ডোন্ট লাইক দ্যাট!’

আদি ঠোঁট কামড়াল। এ তো উলটো বুঝলি রাম। করতে গেল এক, হয়ে গেল আর এক। এই নিয়ে যদি গৌরকে কমপ্লেন করে মালিনী যে, আদি ওকে প্রজেক্টের ব্যাপারে কর্নার করছে, তবে বড়সড় একটা ঝামেলা অপেক্ষা করছে ওর জন্য।

মালিনী আবার বলল, ‘গৌর স্যার তো গোটাটা জানেন না যে, তুমি আমায় ছাড়া এমনভাবে মুভ করছ! জানলে… যাক গে। তুমি দাঁড়াও, আমি চট করে ব্যাগটা নিয়ে আসি।’

এখন বৃষ্টি নেই। তবে আকাশ কালো করে এসেছে আবার। নুড়িপাথর ফেলা রাস্তা দিয়ে মালিনীর পাশে হাঁটতে হাঁটতে আদি মাথা তুলে আকাশটা দেখল। বৃষ্টি নামতে পারে যে-কোনও মুহূর্তে। দুর, এমন দিনে কাজ করতে ইচ্ছে করে কারও? ওর মনে হচ্ছে একটা ছাতার নীচে মালিনীকে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে বেরিয়ে যায় শনিবারের এই ভাঙা হাটের কলকাতায়। তা না, এখন গিয়ে গৌরের বকবকানি শুনতে হবে!

মল্লার গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে একটা বই পড়ছিল। ইংরেজি। আদিকে দেখে সোজা হয়ে বইটা হাত দিয়ে লুকোনোর চেষ্টা করল। মল্লারের রকমসকম দেখে হাসি পায় আদির। এখনও পেল। তবে হাসল না। স্বভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল, ‘ডিউটিতে গল্পের বই পড়ছ?’

‘না স্যার। মানে…আমি সরি। এক্সট্রিমলি সরি স্যার।’

‘চাকরির তো একটা নিয়ম আছে, নাকি? যেমন তেমন করলেই হল? আমি কি এখন ইচ্ছে হলে দাবা খেলতে বসতে পারি?’

‘না স্যার।’ মল্লারের ফরসা মুখটা লাল হয়ে গেছে ভয়ে।

আদির হাসি পেল খুব, ‘তা হলে? বই পড়ছিলে কেন?’

এবার মালিনী বলল, ‘কী বই পড়ছিলে মল্লার? দেখি না।’

মল্লার ইতস্তত করে বইটা বাড়াল। আদি দেখল ক্ল্যাসিক একটা। চার্লস ডিকেন্সের ‘আ টেল অফ টু সিটিজ’।

ছেলেটাকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে আদি। এমন একটা ছেলে গাড়ি চালায় কেন?

না, গাড়ি চালানোতে অগৌরবের কিছু নেই। কিন্তু বিদ্যার ব্যবহারিক একটা দিকও তো আছে। ডিকেন্স-পড়া কোনও ড্রাইভার তো আদি জন্মে দেখেনি। মাঝে মাঝে তাই আদির খুব কৌতূহল হয় ছেলেটা সম্বন্ধে। কিন্তু পেশাগত একটা বাধা মনে মনে অনুভব করে ও। ফলে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। তবু, আদি লক্ষ করল, মল্লারের কান লাল হয়ে আছে। ছেলেটা ভয় পেয়েছে খুব। হয়তো ভাবছে গল্পের বই পড়ে খুব জঘন্য একটা কাজ করে ফেলেছে ও।

মালিনী মোবাইলে কী একটা দেখছিল তারপর হাসি হাসি মুখ করে মোবাইলটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বলল, ‘তোমার বন্ধু রুহান জোক পাঠিয়েছে। বেশ ফানি। শুনবে?’

‘রুহান?’ দপ করে মাথায় আগুন জ্বলল আদির। এত বড় সাহস যে, মালিনীকে আজকাল এসএমএস-ও করে। আর এইসব জোক টোক পাঠানো মোটেও ভাল কথা নয়। এককাঁড়ি অশ্লীল গল্প চালাচালি করা। অসহ্য লাগে!

‘হ্যাঁ, রুহান। আমায় মাঝে মাঝে এসএমএস করে তো ও। যদিও দেখা করার সুযোগ পায় না বিশেষ। গোল্ডিজ-এ তো আসেই না।’

আদি গুম মেরে গেল। রুহান যদি এসএমএস করে, তা করুক না। সেটা ওকে জানানোর কী হয়েছে? এসএমএস করুক, দেখা করুক, গোল্ডিজ-এ যাক-যা খুশি করুক। এসব জেনে আদির কোন লাভটা হবে?

আদি বলল, ‘না, ওই নোংরা জোক শুনব না।’

‘নোংরা!’ মালিনী ভুরু কোঁচকাল, ‘রুহান মোটেই আমায় ডার্টি জোক পাঠায় না। সবাই ডার্টি হয় না আদি। সবাই মেয়েদের অগ্রাহ্য করে না।’

‘মানে?’ আদির মাথার ভেতরে আগুনটা বাড়ল আরও, ‘হোয়াট এগজ্যাক্টলি ডু ইউ ওয়ান্ট টু মিন? আঁকাবাঁকা কথা না বলে স্পষ্ট ভাষায় বলো। কী বলতে চাইছ তুমি?’

‘কিচ্ছু না,’ মালিনী বিরক্ত মুখে বাইরে তাকাল।

‘না, না,’ আদি চোয়াল শক্ত করল, ‘সবাই বলতে কোন দিকে হিন্ট করছ তুমি? কতটুকু জানো তুমি রুহানকে? টাকার জন্য কতটা নামতে পারে ও, জানো?

‘স্টপ ইট আদি। ব্যাকবাইটিং খুব খারাপ লাগে আমার। যেমন খারাপ লাগে মেয়েদের পিছনে ছেলেদের ছোঁকছোঁক করা,’ মালিনীর গলাটাও কঠিন শোনাল।

‘ছোঁকছোঁক?’ আদি ভুলে গেল যে, সামনে মল্লার গাড়ি চালাচ্ছে।

‘কিপ ইট ডাউন,’ মালিনী কড়া গলায় বলল, ‘একটা এসএমএস নিয়ে এমন রিঅ্যাক্ট করছ কেন? কী হয়েছে তোমার?’

‘আমার কিচ্ছু হয়নি। জাস্ট ডোন্ট ওয়ান্ট টু হিয়ার বুলশিট ফ্রম ইউ,’ আদি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘তুমি কী ভাবো? আমি বাচ্চা ছেলে?’

‘মানে?’ মালিনী আচমকা আদির বাঁ হাতটা ধরে টান মারল, ‘কী বলতে চাইছ তুমি? কী বোঝাতে চাইছ? এমন রুডলি কথা বলছ কেন?’

আদি থমকাল এক মুহূর্ত। ভীষণ সুন্দর একটা হাত ধরে রয়েছে ওর হাতটা। গোলাপি পরিষ্কার করে কাটা নখ। মোমের মতো পিছলে যাওয়া আঙুল। হাতের ওপরে পর পর দুটো বাদামি তিল। আদির দম বন্ধ হয়ে গেল, নিমেষের মধ্যে। মনে হল হাতটা ধরে বসে থাকে সারাজীবন। মনে হল এমন হাত পেলে আর কোনওদিন, কোনওদিন কিচ্ছু চায় না ও। আদি নিজেকে সংযত করল, ‘সরি। এক্সট্রিমলি সরি।’

‘নো। আই ডোন্ট অ্যাকসেপ্ট দ্যাট। বলো তুমি, সবসময় এমন অর্ধেক কথা মুখে, অর্ধেক কথা পেটে রাখবে, তা তো হবে না। বলো তুমি, কীসের এত রাগ তোমার?’

‘কিচ্ছু না,’ আদি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। সত্যি এসএমএস-এর কথা শুনে অমনভাবে রিঅ্যাক্ট করার কোনও মানেই হয় না।

মালিনী হাতটা সরিয়ে নিয়ে, নিজেও সরে বসল একটু, ‘ঠিক আছে। তবে যা বলার বলে দিলেই পারতে। এমনভাবে রুড হওয়ার কোনও মানে নেই। দেখো আদি, তুমি কিন্তু কিছুই বলো না। এটাও আজ পর্যন্ত বলোনি যে, কিগান ব্যানার্জি, চাপাডাঙার ফ্যাক্টরির প্রোডাকশন ইনচার্জ তোমার কাজিন। তুমি নিজেকে আমার বন্ধু বলো কিন্তু এসব ডিটেল কিছু দাও না। আমি জানি কেন তুমি আমায় চাপাডাঙার কাজটায় যেতে হিন্ডার করো। তোমার কি মনে হয় যে, কিগানের থেকে আমি অনেক কিছু জেনে যাব তোমার সম্পর্কে? আবেশ আমায় বলেছে যে, তোমাদের মধ্যে কিছু একটা প্রবলেম আছে। কিন্তু সেটার জন্য অফিসের কাজ হ্যাম্পার করাটা কি খুব প্রফেশনাল ব্যাপার?’

‘মানে?’ আদির হাত-পা চিড়বিড় করছে, ‘তুমি কী বলতে চাইছ? তুমি জানো পলিটিক্যাল প্রবলেমে কাজটা কেমন গুলিয়ে আছে? জানো, ওদের ডিমান্ডে গৌর স্যার সায় দিচ্ছেন না বলে প্রজেক্টটা ঝুলে আছে? আর গৌর স্যার আবার আমায় চাপছেন কাজটা দ্রুত করানোর জন্য! তুমি কী করবে বলো? আরও কাজ আছে আমাদের, আরও প্রজেক্ট রয়েছে। প্লাস, এই কাজের জন্য শহরেও কো-অর্ডিনেশনের দরকার। সেটা তো করো না। আমায় বললে তোমায় পিক-আপ করতে। কোথায়, কনসালট্যান্টদের ওখানে গিয়ে সকালে পেপার্সগুলো বুঝে তো এলে না! তোমার বাড়ি, তোমার গ্র্যানি, তোমার কাজ, গোল্ডিজ। এগুলোই তো তোমার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট বেশি। বলো তো, এটা কি খুব প্রফেশনাল ব্যাপার?’

মালিনীর ফরসা মুখটা লাল হয়ে গেল নিমেষে। ঠোঁট টিপল ও। গালে টোল দুটো জেগে উঠল স্পষ্টভাবে। আদি বুঝল উত্তেজনার চোটে হয়তো একটু বেশিই বলে ফেলেছে ও। কিন্তু বলে তো ফেলেছ, আর তো ফেরানোর উপায় নেই। ও চুপ করে মুখ ফিরিয়ে নিল। জানালা দিয়ে এলোমেলো কলকাতা দেখা যাচ্ছে। শনিবারের ছানাকাটা ভিড় দেখা যাচ্ছে। কালো আকাশ দেখা যাচ্ছে জুলাইয়ের।

অফিস পর্যন্ত আর একটা কথাও বলল না মালিনী। সারাটা পথ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েই কাটিয়ে দিল। আদির খারাপ লাগছিল। কিন্তু কিছু বলতেও পারছিল না ও। হয়তো একটু বেশিই রাফ হয়ে গিয়েছে কথাগুলো।

অফিসের কাছাকাছি গাড়িটা থামতেই মালিনী স্প্রিং-এর মতো ছিটকে বেরিয়ে গেল গাড়ি থেকে। একবারও ঘুরে তাকাল না আদির দিকে। আদির মুখটা তেতো হয়ে গেল একদম। মনে হল, দুর, আর অফিস গিয়ে কী হবে? নিজেকেই মনে মনে গালাগাল দিল। সত্যিই হঠাৎ হঠাৎ খুব রুড হয়ে যায় আদি! তখন যে ওর নিজেরই হুঁশ থাকে না। কেন যে মাঝে মাঝে এমন হয়ে যায় ও!

মনমরা হয়ে গাড়ি থেকে নামল আদি। বুঝতে পারল না মালিনীকে কীভাবে সামলাবে এবার!

‘আদি,’ একটা ডাক হঠাৎ থমকে দিল আদিত্যকে। খুব পরিচিত গলার স্বর। বহু বহু দিন ধরে শোনা। খুব নির্ভরতার ডাক। ভালবাসার ডাক। ওর মনে হল কোনও জন্মের ওপার থেকে ডাকটা যেন আসছে! আদির হঠাৎ গলার কাছটা ব্যথা করে উঠল। চোখটাও জ্বালা করে উঠল অল্প। বুকের ভেতরের একটা হিজিবিজি কষ্ট যেন আরও কিছুটা হিজিবিজি হয়ে গেল। আদি পিছন ঘুরল।

সামান্য রোগা হয়ে গেছে দাদাভাই। আর কেমন যেন শান্ত হয়ে গেছে। তবে সাদা টিশার্ট আর নীল জিন্‌স পরা মানুষটা আগের মতোই সুন্দর আছে। আর চোখ দুটোও সেই আগের মতোই একা। নির্জন।

‘দাদাভাই?’ আদির মুখ দিয়ে আপনা-আপনি বেরিয়ে এল কথাগুলো।

‘শোন। তোর সঙ্গে খুব দরকারি কথা আছে। একটু সময় হবে?’

‘সময়?’ আদি কী বলবে বুঝতে পারল না। দাদাভাই এমনভাবে বলছে!

‘একটু সময় দে আদি। জরুরি কথা বলার আছে তোকে। শোন, তোর কিন্তু বিপদ হতে পারে। খুব বিপদ হতে পারে। বুঝলি?’

আদি এখনও তাকিয়ে রইল। কী বলছে দাদাভাই? বিপদ? কীসের বিপদ? আর হলেও দাদাভাইয়ের কী? ও তো দাদাভাইয়ের সঙ্গে আর যোগাযোগই রাখে না। তবে? দাদাভাই চিন্তিত কেন? তবে কি দাদাভাই এখনও ফেলে যেতে পারেনি কিছু? তবে কি সেই ঘুড়ি পেড়ে আনা মানুষটা আজও রয়ে গেছে তেমনই? তার সুতোর টান এখনও ভোকাট্টা হয়নি!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *