মুহূর্তরা দু’বছর আগে – ১৮

১৮

‘আমার তো ইচ্ছে আছে যে, মাসাজ পার্লারের মতো সুড়সুড়ি পার্লার খুলব। লোকজন আসবে। চটপট জামাকাপড় ছেড়ে আন্ডার গার্মেন্টস পরে নরম গদির বিছানায় শুয়ে পড়বে। আর ব্যস, অমনি সুড়সুড়ি দেওয়ার লোক এসে সুড়সুড়ি দিতে থাকবে। ছেলেদের জন্য পুরুষ আর মেয়েদের জন্য মহিলা। প্রতি পনেরো মিনিটে ষাট টাকা। ব্যাপারটা দারুণ হবে, না?’ আবেশ খুব উৎসাহের সঙ্গে সবার দিকে তাকাল।

আবেশের উৎসাহ দেখে হাসি পেল রাহির। একদম ভুলভাল কথার রাজা। মাথায় সবসময় উদ্ভট সব চিন্তা নিয়ে বসে থাকে ছেলেটা। তবে এমনিতে ভালই মনে হয়। অন্তত এখনও পর্যন্ত তো ভাল বলেই মনে হচ্ছে।

আজ পনেরোই জুন। মায়ের জন্মদিন। তাই রাহি ছোট্ট একটা খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করেছে বাড়িতে। মা আপত্তি করেছিল। বলেছিল, ‘বাড়াবাড়ি করিস না রাহি। এই বুড়ো বয়সে এসব করলে লোকে হাসবে।’

রাহি বলেছিল, ‘আমি কী করেছি যে, লোকে হাসবে? তার ওপর তো তোমায় কেকও কাটতে বলছি না, বা মাথায় জোকার টুপি পরে হ্যাপি বার্থডে গান শুনতেও বলছি না। আমি জাস্ট তোমার পঞ্চাশ বছর বয়সটা সেলিব্রেট করতে চাই। হাফ সেঞ্চুরি করলে আর লোকে সেটা জানবে না? আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। খুব ক্লোজ কয়েক জনকে বলব। তুমি প্লিজ না কোরো না।’

মা তাও আপত্তি করেছিল, ‘এমন পাগলামি করিস না রাহি। হঠাৎ হঠাৎ কী যে ভূত চাপে তোর মাথায়!’

রাহি হেসেছিল, ‘ভূত তো ভূত। তুমি আর এ নিয়ে একদম মাথা ঘামাবে না। লক্ষ্মী মেয়ের মতো চুপটি করে বসে থাকবে। যা করার আমি আর দীপা করব। তুমি কিন্তু বাগড়া দেবে না একদম। বুঝেছ?’

মা আর কিছু বলেনি। বরং আজ সকাল থেকেই কেমন যেন একটা লাজুক লাজুক মুখ করে ঘুরছে। বেশ সেজেছে আজকে মা। এমনিতেই সুন্দরী, আজ যেন আরও সুন্দরী লাগছে। এত সুন্দর বলেই বোধহয় অমন গরিব ঘরের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও ঠাকুরদা বাবার সঙ্গে মায়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিল। বন্ধুরা তো বলে, ‘রাহি তুই তোর মায়ের টেন পারসেন্ট সুন্দরীও নোস।’ একটা ছেলে তো এও বলেছিল, ‘আর বেশি দিন তোদের বাড়িতে গেলে মাইরি তোর মাকে প্রোপোজ করে ফেলব।’

মায়ের জন্য বারাসত থেকে একটা আইপড কিনে এনেছে রাহি। যদিও ভগবান জানে মা ব্যবহার করবে কি না। তা ছাড়া বাবাকেও পইপই করে মনে করিয়ে দিয়েছে যে, রাতে ফেরার সময় যেন অতি অবশ্যই মায়ের জন্য কিছু একটা গিফ্‌ট নিয়ে আসে। কিন্তু বাবা যে কখন ফিরবে! সেই বনগাঁ গেছে। তার ওপর বিকেল থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে। বর্ষাকাল পড়তে না-পড়তেই এমন বৃষ্টি ভাবাই যায় না। চাপাডাঙাতে বৃষ্টি হলেই জল জমে যায়। তবে বাবা ফোনে বলেছে যে, চিন্তা নেই। ঠিক পৌঁছে যাবে।

রাহির একটাই ভরসা সাধুদা গেছে বাবার সঙ্গে। এই লোকটা থাকলে রাহির আর চিন্তা থাকে না। এমন জান-কবুল করা লোক কোনওদিন দেখেনি রাহি। একটা মানুষ কীভাবে এতটা নিষ্ঠাবান হতে পারে? এমন নয় যে, সাধুদাকে প্রচুর টাকা দেওয়া হয়। বা বলা ভাল দিলেও নেয় না। খুব সাধারণ ধুতি-ফতুয়া আর হাওয়াই চটি পরে দিন কাটিয়ে দেয়। খাওয়া দাওয়াতেও আড়ম্বর নেই। ওদের বাড়ির চৌহদ্দিতে একাই থাকে। একাই দুটো ফুটিয়ে খায়। কোনও লোভ নেই মানুষটার। কোনও ইচ্ছে নেই। বাবার ইচ্ছেই যেন সাধুদার ইচ্ছে। বাবার কথাতে যেন সব করতে পারে! বা আরও বলা ভাল, এই বাড়ির জন্য যেন সাধুদা সব করতে পারে। রাহি এখনও যে সেই দিনটার কথা ভুলতে পারে না!

সেদিনও বৃষ্টি হয়েছিল খুব। সামনে পরীক্ষা ছিল বলে পড়ছিল রাহি। হঠাৎই ঘরের দরজায় খুব জোরে ধাক্কার শব্দ শুনতে পায় ও। দরজা ধাক্কানোর মধ্যে এমন একটা ব্যাপার ছিল যেন রাহি প্রায় দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিল। আর দেখেছিল ওর মায়ের বিভ্রান্ত মুখ।

‘কী হয়েছে মা?’ রাহি ভয় পেয়ে গিয়েছিল।

‘তোর দাদা…তোর দাদা…’ মা হাঁফাচ্ছিল খুব। মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে লাগছিল মায়ের, ‘তোর দাদার হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে আর…ও…ও উমেশ রায়ের…’

‘মা কী হয়েছে?’ রাহির খুব টেনশন হচ্ছিল। মায়ের অমন অবস্থা দেখে হাত-পা কাঁপছিল। ভাবছিল, দাদা নিশ্চয়ই কিছু একটা করেছে। আর এমন দিনে করেছে যখন বাবা নেই বাড়িতে। বাবা সেদিন ব্যাবসার কাজে কলকাতা গিয়েছিল। বৃষ্টির জন্য ফিরবে না জানিয়েও দিয়েছিল।

রাহি বুঝতে পারছিল না কী করবে। ও মায়ের হাত ধরে কাঁপা গলায় বলেছিল, ‘মা, তুমি শান্ত হও মা, শান্ত হও। আর বলো কী হয়েছে? দাদা কী করেছে মা? বলো।’

মা কিছু বলতেই পারছিল না। বরং কোনওমতে বলেছিল, ‘দেখে যা, দেখে যা তুই। ওই শয়তান ছেলেটা উমেশ রায়ের মেয়েকে তুলে এনেছে। ওর এক বন্ধু বলছে আসার পথে নাকি একজনের পায়ে গুলি করেছে। ওরাও তোর দাদার হাতে কোপ দিয়েছে। এখন…এখন কী যে হবে! কী যে…’ মা আর বলতে পারছিল না।

রাহি দৌড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে। দেখেছিল দাদার ঘরের দরজা খোলা। সেখানে এক কোনায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দীপা। আর খাটে বসা দাদার ক্ষতয় খুব দ্রুত হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধছে সাধুদা!

রাহি অবাক হয়ে চমকের নির্লিপ্ত মুখ দেখেছিল। যেন কিছুই হয়নি এমন করে সাধুদার করে দেওয়া ব্যান্ডেজ দেখছিল চমক। রাহিকে দেখে খুশি খুশি গলায় বলেছিল, ‘এই দেখ, দীপাকে তুলে এনেছি। শালারা আটকাতে চেষ্টা করেছিল। পারেনি। আর দেখ, দীপাটা কেমন ফালতু ভয় পাচ্ছে!’

‘তুই এটা কী করেছিস?’ রাহি আতঙ্কিত গলায় বলেছিল, ‘তোর হাতে কোপ দিয়েছে। তুইও নাকি একজনের পায়ে গুলি করেছিস! তুই সত্যিই গুলি করেছিস? জানিস তো কোনও কারণে একবার রক্ত ঝরতে শুরু করলে তা ঝরতেই থাকে। তুই কেন এমন করলি? আর কি ভেবেছিস ওরা ছেড়ে দেবে? এখন যদি বাড়িতে চড়াও হয়? যদি পুলিশ নিয়ে আসে?’

‘আমি গুলি করিনি,’ চমক হেসেছিল, ‘আমার বন্ধুদের থেকে একজন করেছে। তা ছাড়া ওরা এলেও কিছু হবে না। গেটের কাছে চারজন যন্তর নিয়ে তৈরি রয়েছে। ফালতু টেনশন নিস না। কারও ক্ষমতা নেই কিছু করে।’

রাহি দেখছিল যে, ভেজা সালোয়ার পরে এক কোণে দাঁড়িয়ে দীপা কাঁদছে, কেঁদেই চলেছে। খুব খারাপ লাগছিল রাহির। দেখো তো, কী বিপদেই না পড়েছে মেয়েটা!

মা-ও ততক্ষণে চলে এসেছিল ঘরে। কিন্তু কথা বলছিল না কোনও। মা যেন চিরকাল ভয় পায় চমককে। রাহি মোবাইলে বাবাকে ধরার চেষ্টা করছিল। কিন্তু দুটো মোবাইলের একটাতেও বাবাকে ধরতে পারছিল না ও। দুটোই সুইচড অফ বলছিল।

চমক উঠে এসে বলেছিল, ‘কেন বাবাকে ঘাঁটাচ্ছিস? আমি যা করেছি নিজের দমে করেছি। কারও হেল্‌প আমার লাগবে না। তুই চিন্তা করিস না। যা গিয়ে পড়তে বোস। আর না হলে মাকে সামলা।’

রাহি কী বলবে বুঝতে পারছিল না। ঠিক তখনই একটা ছেলে ঝড়ের মতো দৌড়ে এসে ঢুকেছিল ঘরে। বলেছিল, ‘ওরা আসছে চমক, অনেকে মিলে আসছে। আমরা যে-ক’জন আছি পারব না। তুই দীপাকে নিয়ে পিছন দিক দিয়ে পালা। শিগগিরি পালা।’

‘পালাব কেন?’ চমক চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে উঠেছিল, ‘আমি, শালাদের…’

‘বসো, চুপ করে বসো।’ হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠেছিল সাধুদা। অমন মুখচোখ কোনওদিন দেখেনি রাহি। সাধুদাকে যেন চিনতেই পারছিল না ও। কালো, নিরীহ মানুষটার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল আরও একটা মানুষ। ইস্পাতের তৈরি একটা মানুষ। চমক পর্যন্ত থতমত খেয়ে গিয়েছিল যেন। সাধুদার এমন রূপ তো ও নিজেও দেখেনি।

তবু চমক চেষ্টা করেছিল। বলেছিল, ‘সাধুদা তুমি যেয়ো না। আমি দেখছি।’

‘চুপ করে এইখানে বসো। এই ঘর থেকে বেরোবে না। দেখছ না মেয়েটা কাঁদছে? ওকে সামলাও। আর কিছু করতে হবে না। যারা আসছে তাদের আমি দেখছি।’

কী ছিল সাধুদার গলায়? রাহি আজও জানে না। তবে যাই ছিল, তা চমককে নড়তে দেয়নি। অমন দাদাটা পর্যন্ত চুপ করে বসে পড়েছিল খাটে। আর রাহি দেখেছিল সাধুদা হাত দুটো জামায় মুছে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়িয়েছিল। আর যেতে যেতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘আপনি ভাববেন না। আমি দেখছি।’

রাহি যেন শুনতে পেয়েছিল মা অস্ফুটে বলছে, ‘সাবধানে।’

‘ধ্যাত, সুড়সুড়ির পার্লার মানে?’ হোমি হাসতে হাসতে বলল।

‘মানে সুড়সুড়ির পার্লার।’ আবেশের গলায় ইয়ারকির লেশমাত্র নেই।

‘তোমার এমন ভুলভাল কনসেপ্ট কেন বলো তো?’ হোমি হাসল আবার।

‘আচ্ছা রাহি,’ আবেশ ওর দিকে ফিরল, ‘তুমি বলো, কনসেপ্ট হিসেবে এটা খারাপ? শুনেছি জাপানে ঘুমোনোর পার্লার আছে। সেখানে ওই মানুষগুলো এমন মেশিন বের করেছে যাতে নাকি ঘুমোনোর সময় ইচ্ছেমতো স্বপ্ন দেখা যাবে। তো, আমি এখানে তা না পারি সুড়সুড়ির পার্লার তো খুলতেই পারি। আচ্ছা তোমরা বলো, ছোট থেকে এখন অবধি, কার না সুড়সুড়ি খেতে ভাল লাগে? বেশ পিঠে আলতো হাতে সুড়সুড়ি, তারপর চুলের ভেতর নরম করে বিলি কেটে দেওয়া। কী দারুণ ব্যাপার, না!’

‘এ সমস্তটাই বুর্জোয়া চিন্তাভাবনা,’ আড্ডার তাল কেটে দরজার সামনে থেকে ত্রয়ণ বলে উঠল কথাটা।

ওফ। বিরক্তিতে মুখটা আপনি কুঁচকে গেল রাহির। ভেবেছিল এত বৃষ্টিতে আপদটা আসবে না। কিন্তু ঠিক এসেছে! মা যে কেন সব অনুষ্ঠানে ওকে নেমন্তন্ন করে!

আসলে রাহির ইচ্ছেই ছিল না ত্রয়ণকে ডাকার। দীপাও বলেছিল ডাকতে হবে না। কিন্তু মা এসে এই ব্যাপারটায় বাগড়া দিয়েছিল। বলেছিল, ‘ত্রয়ণকে কেন ডাকবি না তোরা?’

‘ডাকব না। ইচ্ছে নেই,’ রাহির রাগ হয়েছিল।

‘ছিঃ। ভাল ছেলে একটা। অন্যের জন্যে খেটে প্রাণপাত করছে। আর তোরা সবসময় ওকে এমন হেলা তুচ্ছ করিস, কেন বল তো?’

‘ওকে আমার ভাল লাগে না,’ রাহি গোমড়া মুখে বলেছিল।

‘ছিঃ ছিঃ, দীপার না ভাই হয় ও? ওর সামনে এমন বলছিস?’

রাহি বলেছিল, ‘ভাই না ছাই! নিজের ভাই নাকি? তা ছাড়া ও ভাল নয়।’

‘বাজে কথা বলিস না। ওকে আমি আসতে বলে দিয়েছি। ও আসবে। একটা ছেলে। একা থাকে। বাড়িতে একটু ভালমন্দ হলে ওকে ডেকে খাওয়াতে ইচ্ছে করে না? এমনিতেই তো দীপার বাড়ির লোকজন বিশেষ সম্পর্ক রাখে না আমাদের সঙ্গে। আর যে রাখে তার সঙ্গে কি অমন করতে আছে? রাহি তুই তো এমন ছিলি না!’

মায়ের কথার তোড়ে দীপা চুপ করে ছিল। হয়তো বাপের বাড়ির লোকজনদের প্রসঙ্গ ওঠাতেই গুটিয়ে গিয়েছিল ও। এটা ঠিক যে, দীপার বাপের বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ নেই রাহিদের। কিন্তু সেটা তো আর দীপার দোষ নয়। চমক নিজেই তো সম্পর্ক রাখে না। মা কেন যে এমন আর্কিটাইপাল শাশুড়ি হয়ে যায় মাঝে মাঝে! আর রাহি তো আর ত্রয়ণের প্রতি ওর বিদ্বেষের আসল কারণটা বলতে পারবে না! তাও মাকে শেষ একবার মত বদলানোর চেষ্টা করেছিল, ‘মা, দাদাও কিন্তু ত্রয়ণকে পছন্দ করে না। একদম পছন্দ করে না।’

‘তোর দাদার কথা বলিস না। রাত বারোটার আগে কোনওদিন ফেরে? ও ফেরার আগেই সবাই খেয়ে দেয়ে চলে যাবে। তুই আর এই নিয়ে একদম তক্কো করবি না। বুঝেছিস?’

‘বুর্জোয়া?’ আবেশ বেশ ঘাবড়ে গেল।

ত্রয়ণ হাত দিয়ে গা আর মাথা থেকে জল ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘হ্যাঁ, বুর্জোয়া। সরি, আমি আপনাকে চিনি না, কিন্তু এমন একটা ধারণা যারই মাথা থেকে বেরোবে তাকেই আমি বুর্জোয়া বলে প্রতিবাদ জানাব। অর্থ রোজগার মানে কি নিজের সমস্ত সত্তা বিকিয়ে দেওয়া? শরীর, বা আরও সঠিকভাবে বললে ইন্দ্রিয়কে বিকিয়ে দেওয়াকে কী বলে, জানেন নিশ্চয়ই। তা হলে কেন এমন ভাবেন?’

আবেশ থতমত মুখে বলল, ‘না না, আমি তো জাস্ট ইয়ে…’

‘ইয়ে মানে?’ ত্রয়ণ ধমক দিল। তারপর হোমি আর রাহির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জানো, গত কয়েকদিন পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় ঘুরতে ঘুরতে আমার বারবার মনে হয়েছে, এই জেনারেশনের কিচ্ছু হবে না এই “জাস্ট ইয়ে”র জন্য। সবাই এত ক্যাজুয়াল কেন? কেন এমন করে সবাই ঘুরে বেড়ায়? আর বললেই বলে, জাস্ট এমনি! কেউ কোনও কিছু পাত্তা দেয় না। সবারই যেন একটাই লক্ষ্য। অর্থ উপার্জন। টাকা চাই। আরও টাকা চাই। কোলিয়ারি বেল্টগুলোয় গেলাম। জানো চোরাইভাবে খাদান থেকে কয়লা তুলে কী সর্বনাশ করছে মানুষ! স্যান্ড ফিলিং করছে না। ওয়াটার বডির নিয়ম মানছে না। সে যাচ্ছেতাই ব্যাপার! তারপর কাটা তেল। কলকাতায় খণ্ডযুদ্ধ করে গ্রিন অটো চালাচ্ছে। আর অন্য জায়গায়? সেই মান্ধাতার আমলের অটোগুলো। কোথাও কোথাও তো আরও খারাপ অবস্থা। পাতি ভ্যানের সঙ্গে চোরাই পুরনো মোটরবাইকের ইঞ্জিন লাগিয়ে “ভ্যানো” নামে একটা যান তৈরি করে চালানো হচ্ছে। এতে দূষণের পরিমাণটা বুঝতে পারছ? সব বড় বড় মাথারা এই তেলের পিছনে আছে। এর ট্যাঙ্কার আসে। রীতিমতো লাইন দিয়ে বিক্রি হয় তেল। কিন্তু কেউ এর কোনও খবর রাখে? কেউ প্রতিকার করে? না। কারণ ওই “জাস্ট ইয়ে”। সবার টাকা চাই আজকাল। সব্বার শুধু দামি জিন্‌স, নতুন মোবাইল, অদ্ভুত দেখতে ঘড়ি আর দামি রেস্টুরেন্টে খাওয়ার জন্য টাকা চাই। তার জন্য “জাস্ট ইয়ে” করতে রাজি তারা। একটা গোটা প্রজন্ম কীভাবে বুর্জোয়া হয়ে গেল! মুক্ত অর্থনীতি চিবিয়ে খেল তাদের। পয়সার জন্য মানুষ এখন কী না করছে। ছিঃ। লজ্জা লাগে আমার। ভীষণ লজ্জা লাগে।’ ত্রয়ণ মাথা নামিয়ে নিল।

‘দারুণ তো,’ আবেশ দু’সেকেন্ড সময় নিয়ে অবাক ভাবটা কাটিয়ে লাফিয়ে উঠল, ‘কাকা, তুমি তো পুরো ঘ্যামচ্যাক জিনিস! বুর্জোয়া না প্রোটোজোয়া কীসব বলে ব্যাপক একটা খিল্লি দিলে তো! আমি স্পেলবাউন্ড!’ তারপর হোমির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘একে নিয়ে যাব প্লাস্টিক ম্যানুফ্যাকচারারদের কাছে? অ্যাড পেতে সুবিধে হবে। নেব?’

ত্রয়ণ এবার অবাক চোখে তাকাল রাহির দিকে। অর্থাৎ আবেশ ঠিক কে আর কী বলছে, সেটা বুঝতে পারছে না। স্বাভাবিক। আবেশ যখন ওদের সঙ্গে জয়েন করেছে তখন ত্রয়ণ ছিল না এখানে, আর ত্রয়ণকে জানানোও হয়নি। অবশ্য হোমি বলেছিল যে, ‘ত্রয়ণকে না জানিয়ে এমন একজনকে অ্যাপয়েন্ট করা কি ঠিক হবে?’

‘কেন? হেল্‌প আর্থ-এর কোনও কাজে ওর পারমিশনের দরকার কেন?’

‘না, পারমিশন নয়। আসলে, সব কাজেই তো ত্রয়ণ থাকে। তাই বলছিলাম আর কী। নিজের থেকে সবটা করে দেয় তো। তাই…’

‘দেখ, কিগানদা বলেছে নিতে। আমরা নেব। আমি বাবাকে বলেছি। বাবাও বলেছে, ভাল অ্যাড পাইয়ে দেবে হেল্‌প আর্থকে। মাইনে হয়তো বেশি দিতে পারব না, কিন্তু তোর আর আমায় বাদ দিলে যারা কাজ করে, তারা খুব একটা এফিশিয়েন্ট নয়, বা সময়ও দিতে পারে না। মাইনে করা লোক নিলে কাজ ভাল হবে। তা ছাড়া সুধাদিদের সঙ্গে কথামতো ক্রিকেট ম্যাচের সম্ভাবনা আছে। এতে অ্যাওয়ারনেস আর তার সঙ্গে টাকাও আসবে। আমাদের কাজের পেরিফেরিটাও বাড়বে। সব ত্রয়ণকে বলতে হবে না। বুঝেছিস?’

রাহির এমন জোরালো সওয়ালের পর হোমি আর কিছু বলেনি। রাহি নিজেই আবেশকে ডেকে এনেছিল ফোন করে। তারপর কাজের কথা বলেছিল। রাহি ভেবেছিল কলকাতার ছেলে। এমন মফস্‌সল অঞ্চলে, ছোট্ট একটা এনজিও-র কাজ করতে হয়তো আগ্রহী হবে না। কিন্তু আবেশ এককথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, ‘কিগানদা বলেছে যখন আমার আপত্তি নেই। আমার একটা কাজ পেলেই হল। তবে মাথা গোঁজার জন্য যদি একটা থাকার বন্দোবস্ত করে দেন ভাল হয়।’ রাহি হেসেছিল। উসকোখুসকো দাড়ি আর একমাথা চুলের ছেলেটাকে দেখে মায়াও হয়েছিল। চোখের মধ্যে একসঙ্গে বুদ্ধি আর অসহায়তা কোনওদিন দেখেনি ও।

রাহি বলেছিল, ‘আমাদের একটা দু’ঘরের অফিস আছে। আসলে সামনেটায় অফিসঘর আর পিছনটা মোটামুটি ফাঁকাই। শুধু পোস্টার, ব্যানার আর ফেস্টুন থাকে। সেখানটা পরিষ্কার করে খাট পেতে দিয়ে আপাতত একটা বন্দোবস্ত করা যেতে পারে। তারপর একটা ঘর দেখে নিলেই হবে। তাতে তোমার যদি আপত্তি না থাকে। আর বাই দ্য ওয়ে। আমরা তুমি তুমি করেই কথা বলব। আপনিটা প্রোটোকলের বাইরে। কেমন?’

‘নো প্রবলেম,’ আবেশের চোখ চকচক করে উঠেছিল।

‘আরে ঘরটা দেখে “নো প্রবলেম” বোলো, আর টাকাপয়সা কত দিতে পারব সেটাও তো জানবে, নাকি?’ অবাক হয়েছিল রাহি।

‘টাকাপয়সা? যা হোক দিয়ো। থাকতে পারব। কাজ করব। এটাই অনেক। জানো, মামার বাড়িতে কেমন জায়গায় থাকতাম আমি? একটা ছোট্ট তিনকোনা ঘর ছিল। সিঁড়ির তলার। তাতে কষ্টেসৃষ্টে একটা ক্যাম্প খাট পাতা যেত। সেখানে শুতাম। আর ট্যাক্সির ভেতরে ছোট্ট পাখা থাকে না? তেমন একটা পাখা চলত মাথার কাছে। তার স্পিড বাড়ালে আবার কিটকিট শব্দ করত। মনে হত আইসক্রিমের কাঠি স্পোকে বেঁধে কেউ সাইকেল চালাচ্ছে। ঘুমোয় কার বাপের সাধ্য! সেখানে একটা সম্পূর্ণ ঘর! ও দেখার কিছু নেই।’

ছেলেটা মিশুকে। করিতকর্মাও। কাজটাও বুঝে নিয়েছে। এর মধ্যে দুটো ছোটখাটো ডোনেশনও জোগাড় করেছে। কিছু করোগেটেড টিনের ফ্যাক্টরি রয়েছে কাছাকাছি। তাদের গ্যালভানাইজিং থেকে দূষণ ছড়াচ্ছে। কিন্তু দূষণ নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা তারা কিছুই করছে না। আবেশ তাদের কীভাবে যেন বুঝিয়েছে যে, ‘হেল্‌প আর্থ’-এর সঙ্গে তাদের নাম জোড়া থাকলে, কেউ আর তাদের দিকে আঙুল তুলতে পারবে না। তাই তাদের উচিত ‘হেল্‌প আর্থ’-কে সাহায্য করা। আর কী অবাক কাণ্ড, তারা খুব বেশি না হলেও দশ-দশ করে কুড়ি হাজার টাকা দিয়েছে। অল্প কয়েকদিনেই ছেলেটা ভাল কাজ করেছে।

এ ছাড়াও এত মিশুকে ছেলেও খুব একটা দেখেনি রাহি। এ অঞ্চলের সবার সঙ্গে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছে। এমনকী চমক পর্যন্ত আবেশের সঙ্গে কথা বলার সময় একটু হাসে। বাবাও যেন সামান্য প্রশ্রয়ের সুরে কথা বলে আবেশের সঙ্গে। আর মা তো একদিন বারাসত থেকে মার্কেটিংও করে এসেছে আবেশকে নিয়ে গিয়ে। এক মাসও হয়নি, কিন্তু মায়ের জন্মদিনে আবেশকে নেমন্তন্ন করতে একটুও দ্বিধাবোধ করেনি রাহি। তবে সবটাই হয়েছে ত্রয়ণ এখানে না থাকার সময়ে।

ত্রয়ণ জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কি কিছু মিস করছি? ইনি কে?’

হোমি যে আড়চোখে রাহিকে দেখল সেটা লক্ষ করে রাহি নিজেই বলল, ‘ওর নাম আবেশ। আমাদের হেল্‌প আর্থ-এর নতুন কর্মী।’

‘কর্মী?’ ত্রয়ণ ভুরু কুঁচকে তাকাল, ‘কর্মী মানে! জানো কর্মী কাকে বলে?’

রাগ হল রাহির। ত্রয়ণের ভাবটা এমন যেন কর্মী শব্দটার ওপর একশো বছর গবেষণা করে এসেছে। ছেলেটার সব বিষয়ে সমালোচনা আর জ্ঞান দেওয়ার স্বভাব। রাহি বলল, ‘জানি। আর না জানলেও তোমার থেকে শুনব না। আবেশ খুব ভাল কাজ করছে। আর যা কাজ করছে তার তুলনায় তেমন টাকা ওকে আমরা দিতে পারছি না।’

‘টাকা?’ ত্রয়ণের ভুরু বিরক্তিতে আরও হিজিবিজি হয়ে গেল, ‘পেড কর্মী? বাবা, হেল্‌প আর্থ এত বড়লোক হয়ে গেছে যে, মাইনে দিয়ে লোক রাখছে? তোমরা কি জানো না যে, ভাড়াটে সৈন্য দিয়ে যুদ্ধ জেতা যায় না?’

মাথাটা হট করে গরম হয়ে গেল রাহির। ছেলেটা ভীষণ অসভ্য তো! আবেশকে জানে না, চেনে না, তাও এমন করে কথা বলছে! আর ‘হেল্‌প আর্থ’-এর কে হয় ত্রয়ণ? উপযাচক হয়ে কিছু কাজ করে দেয়। তার মানে কি মাথা কিনে নিয়েছে নাকি? খুব রাগ হল রাহির। ও বলল, ‘ভদ্রভাবে কথা বলতে গেলে কিন্তু পকেট থেকে পয়সা খরচ হয় না। তা ছাড়া অন্যের সঙ্গে অভদ্রতা করা মানে কিন্তু নিজের আপব্রিঙ্গিংকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া। এটা বোঝানো যে, তোমার বাবা-মা, তোমাকে শিক্ষা দেয়নি। ফলে এমন কোরো না।’

ত্রয়ণ গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রইল। রাহি বুঝল আবার জুতসই কিছু জ্ঞান আর তোতাপাখির মতো চোখা বুলি কপচাবে ছেলেটা।

কিন্তু তার আগেই হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল আবেশ।

রাহিকে বলল, ‘বাঃ, তুমিও তো কম যাও না দেখছি। চলো, তোমাকেই নিয়ে প্লাস্টিক ফ্যাক্টরিতে যাই। তুমিও জমিয়ে দেবে।’

রাহি দেখল হোমি আবেশের কথায় হেসে পরিস্থিতিটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করল। বলল, ‘তা যা বলেছ। আর হবে না? রাহি স্কুলে পড়ায়। দিদিমণি। কম বক্তৃতা করতে পারে ভেবেছ?’

আবেশ হাসল আবার। তারপর ত্রয়ণের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি রাগ কোরো না ভাই। কিগানদা রিকোয়েস্ট করেছিল বলে ওরা আমায় কাজে রেখেছে। টাকার দরকার আমার। অনেক বয়স হল। ভেসে, উঞ্ছবৃত্তি করে কেটে গেল এত বছর। তাই এখন একটা কাজ পেয়ে ভাল লাগল খুব। ভাড়াটে সৈন্য হলেও মন দিয়েই যুদ্ধ করব। তুমি ভেবো না।’

ত্রয়ণ বাঁ হাতের ঘড়িটাকে ঠিক করল। তারপর শান্ত কিন্তু কঠিন গলায় বলল, ‘ও কিগানদা! তাই! রাহি তো আবার কিগানদার কথা ফেলতে পারে না। না?’

‘মানে?’ রাহি আর পারল না। উঠে দাঁড়াল মোড়া থেকে। ছেলেটার তো বড্ড বাড় বেড়েছে!

‘মানে কে এই কিগান অর্ক ব্যানার্জি? এমন লম্বা চওড়া আধা সাহেব আধা বাঙালি মানুষটা কে যে, তার কথা শুনতে হবে? তুমি জানো? জানো ওর পাস্ট লাইফ সম্বন্ধে?’

রাহি মাথা নিচু করল। বাইরে বৃষ্টির শব্দটা বাড়ল বোধহয়। রাত ঘন হল যেন আরও একটু। ঘরটা হঠাৎ নিস্তব্ধ মনে হল রাহির। যেন মনে হল সব্বাই ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। যেন অপেক্ষা করছে ও কী বলবে তা শোনার জন্য।

রাহি দেওয়াল ঘড়ির আওয়াজটা শুনতে পেল স্পষ্ট। যেন ত্রয়ণের কথায় সায় দিয়ে বলছে ‘ঠিক ঠিক’। সত্যিই তো কিগানের সম্বন্ধে কী জানে ও? কতটা জানে? সত্যিই তো কে এই কিগান লোকটি? সারাদিন ফ্যাক্টরিতে পড়ে থাকে। রাতে একা বারান্দায় বসে গিটার বা মাউথঅর্গান বাজায়। ছুটির দিনে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে এদিক-ওদিক। আর পুরনো দিনের কথা, বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলে কিচ্ছু বলে না। যেন সন্ন্যাসী একটা! যেন পূর্বাশ্রমের কথা বলা বারণ মানুষটার।

কিগানের বাড়িওয়ালার কাছে কিগানের ঘরের একটা ডুপ্লিকেট চাবি রাখা থাকে। কখনও সেটা নিয়ে কিগানের ঘরদোর একটু পরিষ্কার করে দিয়ে আসে। তখন ঘরটাকে ভাল করে লক্ষ করেছে রাহি। না, তাতে কিচ্ছু পায়নি বিশেষ। শুধু বইয়ের ভেতর পেয়েছে কিগানের নাম। উপহার হিসেবে লিখে রাখা শুভেচ্ছা। আর হ্যাঁ, পেয়েছে শুকনো পাতার মতো দেখতে একটা কার্ড। বইয়ের ভেতরে গোঁজা। তাতে লেখা-‘আসলে তুমি জলের পাশে নেই। জলই তোমায় ঘিরেছে চারিপাশে। আসলে তোমার আনমনা ওই চোখ। দেখেনি, জল আগুন ভালবাসে।’

অনেকবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লেখাটা পড়েছে রাহি। একটা ইংরেজি কবিতার বইয়ের সামনের পাতায় মেয়েলি বাঁকা অক্ষরে গোটা গোটা করে লিখে রাখা কবিতা। সামান্য কাঁচা, অল্পবয়সি ছাপ রয়েছে লেখাটায়। বইয়ে নাক ঠেকিয়ে গন্ধও নেওয়ার চেষ্টা করেছে রাহি।

কিগানের ঘরের ভেতরে কোনও কিছু থেকে কিগানের বয়স ছাড়া আর কিচ্ছু জানতে পারেনি রাহি। কোনও ধারণাও পায়নি। শুধু এই একটা লেখা। এতেই যা কিছু রহস্যের আভাস। যা কিছু সংকেত আর কৌতূহল। তবে রাহি জিজ্ঞেস করেনি। কিগানকে জিজ্ঞেস করেনি কিছু। শুধু দেখেছে বিক্রিয়াহীন, সম্পর্কে অনিচ্ছুক একটা নিস্তব্ধ মানুষ। সব কিছুর ভেতরে থেকেও যেন কোনও কিছুতেই নেই। যেন তাকে পোড়ানো যায় না। ভাঙা যায় না। ছেঁড়া যায় না। কিগান যেন কেমন আলো দিয়ে তৈরি মানুষ। দেখা যায়। স্পর্শ করা যায় না। অনুভব করা যায়, কিন্তু আকার দেওয়া যায় না। রাহি ভাবে কিগান যেন আলোর গন্ধ। যেন ঝড়ের সঙ্গে না আসা মেঘ। যেন চিঠির ওপর কোনওদিন না লেখা হওয়া অক্ষর। যেন প্রেমিকের একার দীর্ঘশ্বাস। গোপন। অগোচর।

ত্রয়ণ বলল, ‘দেখলে তো, কিগানদার সম্বন্ধে কিচ্ছু জানো না। ওর কথা বেদবাক্য হিসেবে দেখার কিছু নেই। না, আবেশবাবুকে নিয়েছ বলে বলছি না। হেল্‌প আর্থ কি তেমন স্বাবলম্বী হয়েছে যেখানে সে নিজে টাকা দিয়ে লোক রাখতে পারবে? আমি সেই প্রশ্ন তুলেছি মাত্র।’

হোমি বলল, ‘না, না, ঠিক আছে। আসলে সুধাদির সঙ্গে সেই যে কথা হল না যে, একটা প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ করা হবে। আমাদের সেসব আয়োজন করতে গেলে তো লোকবল চাই। তুমি অন্যদিকে ব্যস্ত হয়ে পড়ছ দিনকে দিন। আমাদের পড়াশোনা বা অন্য কাজকম্ম আছে। তাই এমন একজনকে আমাদের দরকার যে সারাটা সময় সংস্থাটাকে দেখবে। ম্যাচের আয়োজনও তো যজ্ঞিবাড়ির কাজ। আর আবেশ খুব এফিশিয়েন্টলি কাজ করছে।’

ত্রয়ণ হাসল। রাহির যেন মনে হল তাচ্ছিল্যের হাসি। ত্রয়ণ জিজ্ঞেস করল, ‘তা সেই ম্যাচ সম্পর্কে কিছু কথা এগোল?’

রাহি ঠোঁট কামড়াল। এই প্রসঙ্গটা উঠুক ও চায়নি। কারণ, ব্যাপারটা তো কিছুই হয়নি।

সুধাদি, এই ‘হেল্‌প আর্থ’-এর অনারারি প্রেসিডেন্ট। তা সুধাদি নিজেই বলেছিলেন যে, এই ক্রিকেটপাগল বাজারে ‘হেল্‌প আর্থ’ যদি একটি প্রীতি ম্যাচ করতে পারে নামীদামি প্লেয়ারদের নিয়ে, তা হলে ভাল হয়। তখন রাহি যেচে পড়েই দায়িত্বটা নিজে নিয়েছিল। বলেছিল যে, ও যোগাযোগ করে ম্যাচটা আয়োজন করার চেষ্টা করবে। ত্রয়ণ বারণ করেছিল। বলেছিল, ‘এসব কেন করছ? তুমি ক্রিকেট বোঝো? যুবরাজ সিং মার্কা হিরো টাইপ কিছু প্লেয়ার ছাড়া আর কারও নাম জানো? যা পারবে না, তা কোরো না।’

সেদিন চমকও উপস্থিত ছিল সেখানে। ত্রয়ণের কথার উত্তরে রাহি কিছু বলার আগেই চমক দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, ‘না, রাহিই করবে। আর তাতে আমি আছি ওর সঙ্গে। সম্ভব হলে সচিন তেন্ডুলকরকেও আনব।’

তবে সেই অবধিই। চমক তারপর আর কিছুই করেনি। ত্রয়ণকে চুপ করিয়ে দেওয়ার জন্যই যেন কথাটা বলেছিল শুধু। তাই রাহি বিপদে পড়েছিল আরও। আর সেই জন্য কী করবে বুঝতে না পেরে ও গিয়েছিল কিগানের কাছে।

আবেশ রাহির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রুহান ব্যাটা যে ঝোলাবে জানতাম। বললাম, আমি যোগাযোগ করে দিচ্ছি। তুমি শুনলে না। আর রুহান কেন? সদ্য একটা টুর্নামেন্ট করেছি আমি, অনেককেই চিনি। তুমি কেন যে নিজের ওপর দায়িত্ব নিলে! তুমি ফোন করলে আর ওই ব্যাটা বলল, আসবে। কিন্তু এল কি? আরে, ওকে আমি ভাল করে চিনি। খুব গেঁতো ছেলে। প্রায় উজবুক। ওর ভরসায় থাকলে প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ কেন, পাড়ার ক্রিকেট ম্যাচও হবে না। বুঝলে?’

‘আসলে কিগানদা বলল তো। তাই…’ রাহির গলা অস্পষ্ট হয়ে এল।

‘আবার কিগানদা!’ ব্যঙ্গের হাসি হাসল ত্রয়ণ, ‘লোকটা ব্ল্যাক ম্যাজিক জানে নাকি? এভাবে বশ করল তোমায়?’

‘বশ? ব্ল্যাক ম্যাজিক?’ রাহি রাগের গলায় বলল, ‘যাকে জানো না তার সম্বন্ধে এমন করে কথা বলো কোন সাহসে?’

ত্রয়ণ হাসল, ‘হুঁঃ, মানুষ নিয়ে কাজ করি আমরা। একটা ভাত টিপে বলে দিতে পারি গোটা হাঁড়ির ভাত সেদ্ধ হয়েছে কিনা। এমন যন্তর অনেক দেখা আছে। যে-মানুষ যত চুপচাপ থাকে সে তত গন্ডগোলের।’

‘হাউ ডেয়ার ইউ?’ রাহির ব্রহ্মতালু অবধি জ্বলে গেল। এমন করে কীভাবে বলতে পারে একজন! তাও অন্যকে না জেনে? আর আবেশই বা চুপ করে আছে কী করে? ও তো কিগানকে চেনে। তা হলে এমন করে চুপ করে আছে কেন আবেশ?

‘তুমি কিছু বলছ না তো?’ আবেশকে লক্ষ্য করে বলল রাহি, ‘তোমার তো এর প্রতিবাদ করা উচিত। আর তুমি বসে এসব শুনছ? ছিঃ ছিঃ!’

আবেশ হাসল, ‘কিগানদাকে ডিফেন্ড করার দরকার হয় না। ও নিজেই সবটা পারে। আর কারও কথায় মানুষের মনের অন্ধকার যায় না। যার যার নিজের একটা করে ধারণা থাকে। সেটা নিজের থেকে দূর হওয়াই ভাল।’

‘এটা ডিফেন্সিভ কথা। শোনো ত্রয়ণ,’ রাহি রাগের গলায় বলল, ‘লোক চরালেই হয় না। তোমরা যারা পলিটিক্সের সঙ্গে অ্যাক্টিভলি যুক্ত তারা সবসময় ভাবো যে, সব বিষয়ে তোমরা পণ্ডিত। সব বিষয়ে তোমরা মাথা গলিয়ে দাও আর মাতব্বরি ফলাও। জানো তুমি? জানো যে, কিগানদাকে খুব দামি একটা ঘড়ি প্রেজেন্ট করেছিলাম আমি। সেটা তো পরেইনি। খুলে পর্যন্ত দেখেনি। তাই বলছি, মানুষ আর ভাত এক জিনিস নয়। সব কিছু এক প্যারামিটারে বিচার করলে হয় না।’

ত্রয়ণ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ হোমি লাফ দিয়ে উঠে দু’জনের মাঝখানে দাঁড়াল। বলল, ‘চুপ। একদম চুপ। তোরা দু’জন কী শুরু করেছিস? আজ কিগানদাকেও নেমন্তন্ন করা হয়েছে। যে-কোনও সময়ে আসবে। তোরা এসব টপিক বন্ধ কর। কাকিমার জন্মদিন, কোথায় আনন্দ করব! না বসেছিস ঝগড়া করতে! কেন বল তো?’

‘আচ্ছা কাকিমা কই?’ আবেশও যেন প্রসঙ্গ পালটাতে পারলে বেঁচে যায়, এমনভাবে বলল।

‘দেখো না,’ রাহি নিজের গলাটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল, ‘বললাম আমি সব আয়োজন করব। কিন্তু তোমরা আসতেই আমায় তোমাদের কাছে ঠেলে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে খাবার দাবারের তদারকি করতে লেগেছে।’

‘তা দীপাই বা কই?’ ত্রয়ণ জিজ্ঞেস করল।

প্রশ্নটা সহজ শুনতে লাগলেও খুব একটা সহজ নয়। কারণ, ত্রয়ণ জানে যে, দীপা এই বাড়িতে একটু কোণঠাসা হয়ে থাকে। আর আজও তো মা-ই ওকে নিজের সঙ্গে রান্নাঘরে আটকে রেখেছে। কোথায় এখানে এসে সকলের সঙ্গে আড্ডা দেবে, তা না, আটকে রেখেছে! যেন দীপা সাত বুড়ির এক বুড়ি! যেন ওর আনন্দ-আহ্লাদ বলে কিছু নেই!

রাহি তো আপত্তি করেছিল, ‘কেন মা দীপা রান্নাঘরে থাকবে? আমাদের সঙ্গে এসে বসুক না। আর রান্নাও তো সব ঠাকুররাই করবে। তুমি তো জাস্ট সুপারভাইজ করবে। দীপা বোর হবে। বরং আমাদের সঙ্গে এলে আনন্দ করতে পারবে একটু।’

‘আনন্দ করবে? তা বাড়িতে আনন্দ কিছু কম হয় নাকি? বাড়ির বউকে বাইরের লোকের সামনে অত ধিঙ্গিপনা করতে হবে না। খাওয়ার সময় থাকবে, ব্যস। তা ছাড়া ওকে তো দাঁড়িয়ে থেকে শিখতে হবে যে, আমাদের বাড়ির অনুষ্ঠানে কেমন রান্নাবান্না হয়, নাকি?’

ত্রয়ণের প্রশ্নে রাহি থমকাল একটু, তারপর বলল, ‘দীপা জেদ করে মায়ের সঙ্গে রয়েছে রান্নার জায়গায়। ওকে নাকি শিখতে হবে! বোঝো!’

ত্রয়ণ হাসল। ভুরু তুলে অদ্ভুত মুখভঙ্গি করল। যার অর্থ, বুঝেছি। আর বানিয়ে বলতে হবে না।

মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয় রাহির। খুব হেল্‌পলেস লাগে। একটা বোকামোর জন্য, ভুলের জন্য সারাজীবন কি এই ছেলেটার অসভ্যতা সহ্য করতে হবে ওকে! কেন যে সে সময় অমন ভূত চেপেছিল ওর মাথায়! কেন যে স্যারের কাছে…

‘এই গান শুনব। আর এমন গম্ভীর কথাবার্তা ভাল লাগছে না।’ হোমি হয়তো আগাম ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের জন্যই নেমে পড়ল।

‘কী গান? সিডিগুলো আমার ঘরে আছে। চল, বেছে আনবি।’ রাহি মোড়া থেকে উঠল।

‘না আমি যাব না। তুই যা। নিয়ে আয়। ঘুমপাড়ানি গান আনবি না কিন্তু। বেশ নাচা যায় এমন কিছু আন। কাকিমাকেও তা হলে নাচাব আজ।’

‘নাচের মতো?’ রাহি একটু চিন্তিত হল, ‘আমার তো তেমন কিছু নেই। ঠিক আছে তোরা বোস, আমি দেখছি।’

রাহি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বসার ঘর থেকে লম্বা একটা প্যাসেজ চলে গেছে সোজা। তারপর ইংরেজি এল অক্ষরের মতো বেঁকে গেছে বাঁদিকে। ওই বাঁদিকের একদম শেষ প্রান্তে রাহির ঘর। গোটা প্যাসেজটাই গোলাপি মার্বেল মোড়া। আর নরম জ্যোৎস্নার মতো আলোয় ঢাকা।

রাহি ঘরে গিয়ে একটু সময় নিয়ে সিডি খুঁজল। না, তেমন নাচানাচির মতো গান ও শোনে না। তবে বেশ কিছু ভাল সফ্‌ট রক আছে। তারই দুটো সিডি নিয়ে ঘরের থেকে বেরোল রাহি। আর বেরিয়েই থমকে গেল একদম। প্যাসেজের বাঁ দিকটা গোটাটাই ঘষা কাচে মোড়া। তাতে বৃষ্টি দামাল বেগে তার নখ দিয়ে আঁচড়ে চলেছে। আর সেই কাচের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ত্রয়ণ। মুখে অদ্ভুত গা-ঘিনঘিনে এক হাসি।

রাহি চোয়াল শক্ত করল। করিডরটা নির্জন। বাড়ির সকলে অন্য প্রান্তে ব্যস্ত। আড্ডা ছেড়ে কী অজুহাতে যে এল ত্রয়ণ সেটা বুঝতে পারছে না ও।

রাহি আর ভাবল না কিছু। দ্রুত পায়ে প্যাসেজটা দিয়ে হাঁটা দিল। কিন্তু ত্রয়ণের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আচমকা ত্রয়ণ হাত দিয়ে ওর পথটা আটকাল। তারপর এক ঝটকায় রাহির হাত ধরে ওকে টেনে আনল নিজের কাছে।

লাগছে। রাহির হাতে লাগছে। ত্রয়ণ রোগা হলেও শক্তি আছে শরীরে। গা দিয়ে ঘামের গন্ধ বেরোচ্ছে ছেলেটার। গা গুলোচ্ছে রাহির। ও বুঝল ত্রয়ণ ওকে টেনে নিয়ে ওর বুক ছোঁয়ার চেষ্টা করছে।

রাহি চাপা গলায় বলল, ‘ছাড়ো, দাদা যদি জানে না!’

ত্রয়ণ হাসল। শয়তানের হাসি। চোখ দুটো যেন জ্বলছে ছেলেটার। গরম শ্বাসের জিভ যেন চাটছে রাহির গাল। প্রতিটা অংশ থেকে লোভ আর অশ্লীলতা টোপাচ্ছে। ত্রয়ণ হিসহিসে গলায় বলল, ‘আমার কাছেও কিন্তু কিছু আছে। দাদা কি সেগুলোও জানবে?’

হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে রাহি বলল, ‘নোংরামো করবে না। ছাড়ো, ছাড়ো বলছি।’

‘আমি করলে নোংরামো! আর তোমরা করলে…আমায় কবে দেবে রাহি? আর তো ভাল লাগে না। কবে দেবে তুমি?’

‘ছাড়ো।’ প্রায় চিৎকার করে সর্বশক্তি দিয়ে এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিল রাহি। তবে বুঝল ত্রয়ণ তারই মধ্যে বুক ছুঁয়ে ফেলেছে ওর।

রাহি যেতে যেতে শুনল ত্রয়ণ বলছে, ‘আমার কিন্তু চাই।’

রাহি প্রায় দৌড়ে প্যাসেজের মোড় ঘুরে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল থতমত খেয়ে। ওর হাত-পা কাঁপছে। উত্তেজনায় মুখ লাল। রাহি দেখল, আবেশ দাঁড়িয়ে রয়েছে সামনে। মুখে প্রায় অদৃশ্য এক হাসি।

কেন হাসছে আবেশ? কী দেখেছে ও? কিছু নজরে পড়েছে? না হলে অমনভাবে হাসছে কেন? রাহি দেখল জ্যোৎস্নার মতো আলোর ভেতরে দুই সংকটের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে ও নিজে। ও ভাবল আবেশ ঠিক কতটা শুনতে পেয়েছে? কতটা জেনেছে? কতটা বুঝেছে? আর এর ফল কী হবে?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *