মুহূর্তরা দু’বছর আগে – ১৭

১৭

লম্বা রাস্তা গিয়ে শেষ হয়েছে লেকে। আর তার ধারে সরু কাঠের একটা জেটি চলে গেছে জলের অনেকটা ভেতরে। আর সেই জেটির ধারে বসে কে যেন ছিপ ফেলে রয়েছে জলে। তার পাশে নীল বাস্কেট। ভেতরে অদ্ভুত দেখতে একটা মাছ। জলের ধারে একটা বাড়িও রয়েছে। তার পাথরের দেওয়াল। কাঠের ছাদ আর তার ওপর চৌকো একটা পাথরের চিমনি। গোল্লা গোল্লা ধূসর কাবলি বিড়ালের মতো ধোঁয়া বেরোচ্ছে চিমনি দিয়ে। আর ধোঁয়াগুলো উড়তে উড়তে যেখানে গিয়ে শেষ হচ্ছে, সেখানে সার সার চেরি গাছ। লাল হয়ে আছে তারা। আর ওইটা? ওইটা কে? কে ওই চেরি গাছের সারির পাশে সবুজ বেঞ্চটায় বসে রয়েছে! কে ওটা? ওই তো লাল রঙের জামা আর পার্পল ছাতা মাথায়। কে বসে আছে ও? কে লুকিয়ে রেখেছে মুখ? ঢাকা দিয়ে রেখেছে মুখটা? এক পা-দু’পা করে এগোচ্ছে ও। জলের ওপর দিয়ে বয়ে আসা হাওয়া এলোমেলো করে দিচ্ছে চুল। তবুও এগোচ্ছে ও। চেরি গাছগুলো নড়ছে খুব। গোল্লা গোল্লা ধোঁয়া ভেঙে যাচ্ছে আকাশে। আর লোকটা বসে রয়েছে মূর্তির মতো।

পার্পল রঙের ছাতার একদম পিছনটায় গিয়ে দাঁড়াল ও। তারপর ধীরে, খুব ধীরে হাতটা দিয়ে ছাতার তলা দিয়ে বাঁ কাঁধটা ধরল। আর সঙ্গে সঙ্গে নড়ে বসল ছাতাটা। সে ঘুরল পিছন দিকে। আর ও দেখল…এ কী! এ যে দিঘি! দিঘি? দিঘি কী করছে এখানে? ও জিজ্ঞেস করতে চাইল কেন এসেছ তুমি দিঘি? কী চাও? কেন? কেন? আমি তো চলে এসেছি। আমি তো আর যাব না তোমার সামনে। আর কখনও এ মুখ দেখাব না তোমায়। আর কোনওদিন…কিন্তু দিঘি মুখ খুলল। কিছু বলবে কি দিঘি? বলছে, ওই তো বলছে দিঘি। দিঘি বলল, কিন্তু কথা কই? এ তো শব্দ। অদ্ভুত ধাতব সুরেলা শব্দ, ক্রমশ বাড়ছে। দিঘি মুখ খুলল আর শব্দটা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সুরেলা ধাতব একটা শব্দ বাড়তে লাগল। তীব্র হতে হতে আচমকা যেন কর্কশ হয়ে গেল। আর চোখ কুঁচকে ঘুম ভেঙে তাকাল কিগান।

ফোনটা বালিশের পাশে পড়ে হিসু করে শুয়ে থাকা বাচ্চার মতো চেঁচাচ্ছে। তীব্র বিরক্তির সঙ্গে ফোনটার দিকে তাকাল কিগান। খুব চোখ জ্বালা করছে। ঘুমটা যে সম্পূর্ণ হয়নি। তার ওপর এমন একটা মুখ দেখল যে এখনও মাথাটা কেমন টালুমালু করছে। এত স্পষ্ট করে দিঘিকে দেখল কেন ও? বুকে যে কী কষ্ট হচ্ছে কিগানের! আর ছোটবেলার সব কিছুর ভেতরে হঠাৎ দিঘি এসে যোগ হল কেন? কার জন্য এল দিঘি তাও অমন একটা ছাতা মাথায়?

চোখ কুঁচকে ফোনটা তুলল কিগান। অচেনা নম্বর। কিন্তু ধরার আগেই কেটে গেল ফোনটা। ওয়ান মিস্‌ড কল। কিগান বিরক্ত মুখে বোতাম টিপে নম্বরটা দেখল। অচেনা নম্বর। কার হতে পারে? ভাবতে ভাবতেই কট করে চোখে লাগল কিগানের, কম ঘুমের লক্ষণ। ইস ফোনটা সাইলেন্ট করে শুলে ঘুমটাও হত আর দিঘি কী বলতে চাইছিল তাও জানতে পারত! ও আবার পাশ ফিরল। আর তখনই খেয়াল হল পায়ের থেকে মোজাটাও খোলা হয়নি।

কোনওমতে উঠে বসল কিগান। ঘরটা দোতলায় বলে সারা দিন সরাসরি রোদ পায়। খুব তেতে থাকে ছাদ আর দেওয়াল। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে তাই সবার আগে জানলাগুলো খুলে দেয় ও। কিন্তু আজ তাও পারেনি। শুধু জুতোটা খুলেছিল মনে আছে। আর কিচ্ছু মনে নেই। আচ্ছা, দরজাটা বন্ধ করেছিল তো? আসলে এখন আর সর্বক্ষণের ছেলেটা থাকে না। বেশ কিছুদিন আগে ও কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে।

ঘরের আলোটা নেভানো রয়েছে, শুধু ফ্যানটা চলছে। তবু গায়ের জামাটা খোলা হয়নি বলেই হয়তো একদম ঘেমে জল হয়ে আছে ও। এখন মে মাসের মাঝামাঝি। গোটা পৃথিবী যেন তেলে ফুটছে। ক’টা বাজে এখন?

মোবাইলটা তুলে সময় দেখল কিগান। আটটা বারো। সন্ধে! মানে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়েছে মাত্র! তাই শরীরটা এমন ছেড়ে দিচ্ছে আর চোখটা টানছে! ব্যথা করছে! আবার পাশ ফিরল কিগান। গত দু’দিন, দু’রাত সম্পূর্ণ জাগা। তার ওপর পরিশ্রম। শরীর তো, যন্ত্র তো নয়!

গত পরশুদিন বিকেলে হঠাৎ করে বয়লারটা বসে গিয়েছিল। ব্যস, কেলেঙ্কারি। স্টিম ছাড়া ওদের প্রোডাকশন অচল। তাই সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গিয়েছিল। আর তার মধ্যে আরও কেলেঙ্কারি ঘটিয়েছিল শশীবাবু। সে প্যানিক করে গৌরের অফিসে ফোন করে বসেছিল। ব্যস, আর কী! গৌর তো একদম ফোন করে, চিৎকার করে, একশা কাণ্ড করেছিল। আর জেনারেল ম্যানেজার স্যাম ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল ফ্যাক্টরিতে।

আসলে বয়লারের প্রাণ হল জল। আর সেটা ট্রিট করে বিশুদ্ধ করে ডিমিনারালাইজেশন প্লান্ট। এর সাহায্যে জলের সমস্ত সল্ট রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন আর হাইড্রক্সিল অণু দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয়। আর এই অতিবিশুদ্ধ জল ব্যবহার করা হয় বয়লারে।

গত মাস দুয়েক ধরে ডিমিনারালাইজেশন বা ডি এম প্ল্যান্টটা গড়বড় করছিল। সেই কথা বেশ কয়েকবার স্যাম আর গৌরকে জানিয়েছে কিগান। কিন্তু ওরা পাত্তাই দেয়নি। বরং বলেছে যে-প্ল্যান্টের নাকি মেনটেনেন্স ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু সেটা ঠিক নয়। আসলে কম দামে একটা ফালতু পার্টির থেকে প্ল্যান্ট কিনেছে গৌর। তখন তো আর কিগান এই ফ্যাক্টরিতে আসেনি। তখন ও কলকাতায়। আর কেনার সময় থেকে নানারকম সমস্যা করছে প্ল্যান্টটা। আজ ভাল্ভ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কাল শেলের ভেতরের রাবার লাইনিং ফুলে উঠছে। পরশুদিন রেজিন ট্র্যাপ ছিঁড়ে অর্ধেক রেজিন ড্রেনে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর গত দু’মাসে তো অ্যাসিড ফিউম লেগে শেলের গায়ের লোহা খয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছেতাই কাণ্ড। কতবার কিগান বলেছে ফিউম অ্যাবজরবারের বন্দোবস্ত করতে। কিন্তু কে কার কথা শোনে? আর গত পরশু যেই বয়লার বসে গেছে অমনি সবাই একদম দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে!

এত অল্প সময়ে কোন কোম্পানি থেকে লোক পাঠাবে? কেউ তো আর বসে নেই যে, কখন মার্চেন্ট মাল্টিপল্‌স-এর ডি এম প্ল্যান্ট বসে যাবে আর ছুটে গিয়ে তা রিপেয়ার করে দেবে!

স্যামের তো মাথায় হাত পড়ে গিয়েছিল। কিগানকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড বস? তুমি থাকতে এমন হল কী করে?’

কিগান অবাক হয়েছিল খুব। আরে, ও কি অরণ্যদেব নাকি? অত টাকা নিয়ে কিপটেমো করলে প্ল্যান্ট তো বসে যাবেই। কিন্তু কিগান জানত এখন এসব কথা বলার সময় নয়। আসলে, সমস্যার সময় আরও সমস্যার কথা বললে তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে দেয়।

কিগান বলেছিল, ‘স্যার, এভাবে যে প্ল্যান্ট বসে যাবে তা আমি আগেই বলেছিলাম। কিন্তু সে কথা পরে। এখন কী করা যায় সেটাই দেখতে হবে।’

‘আমি জানি। গৌর ইজ সো স্টাবর্ন। আমিও বলেছি। কিন্তু ওর ওয়ান পাইস ফাদার মাদার। যাক গে,’ স্যাম বিরক্তিতে মাথা নেড়েছিল, ‘এখন কী করতে হবে বলো। এগজ্যাক্টলি কী হয়েছে?’

‘স্যার, আমি দেখলাম যে, ক্যাটায়ন ইউনিটটার বেড প্লেটের স্ট্রেনার ভেঙে গেছে আর সেখান দিয়ে রেজিন বেরিয়ে গোটা পাইপলাইন আর ওয়াটার মিটার পুরো জ্যাম করে দিয়েছে। দিন তিনেকের কাজ।’

‘কী, দিন তিনেকের কাজ?’ স্যাম গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল।

‘স্যার, পুরো পাইপ লাইন খুলে আটকে থাকা রেজিন ওয়াশ করে বের করতে হবে। ওয়াটার মিটারটা দেখতে হবে ঠিক আছে কি না। তারপর ক্যাটায়ন শেলটা খুলে বাকি রেজিন বের করে ভাঙা স্ট্রেনারগুলো বের করতে হবে। তার জায়গায় নতুন স্ট্রেনার লাগিয়ে তারপর আবার রেজিন চার্জ করতে হবে। তারপর পাইপ লাইন ফিক্সিংও রয়েছে। স্যার, ইট উইল টেক টাইম।’ কিগান মাথা নেড়েছিল। সময় যে লাগবে তা স্যামকে বোঝাবে কী করে?

স্যাম বলেছিল, ‘ম্যাক্সিমাম টু ডেজ আই ক্যান গিভ। শোনো, ডিপ্লয় অল ইয়োর স্ট্রেন্থ অ্যান্ড মেক ইট হ্যাপেন ইন টু ডেজ। প্রোডাকশনের কী লস হবে জানো?’

‘জানি স্যার।’ কিগান মাথা নামিয়ে চিন্তা করেছিল। তারপর বলেছিল, ‘ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করছি। দেখি কত তাড়াতাড়ি পারি।’

‘কত তাড়াতাড়ি নয় কিগান,’ স্যাম মাথা নেড়েছিল, ‘খুব তাড়াতাড়ি। মেক ইট ফাস্ট বয়ো।’

কিগান হেসেছিল। খুব তাড়াতাড়ি মানে? বেশ বড় এই ক্যাটায়ন ইউনিট। রেজিনও প্রায় দু’হাজার লিটার। চাট্টিখানি কথা নাকি? স্যাম টেকনিকাল লোক নয়, তাই বুঝতে পারছে না। কিন্তু কী বা করা যাবে? কিগান আর সময় নষ্ট করেনি। কাজে হাত দিয়েছিল।

ছ’জন লেবার আর কিগান নিজে। মোট সাতজন মিলে লেগে গিয়েছিল কাজে। স্যাম দাঁড়িয়েছিল প্রথমে। বলছিল, ‘আরও লোক লাগাও।’

হাসি পেয়েছিল কিগানের। আরে লোক লাগলেই কি আর কাজ তাড়াতাড়ি হয়? বরং মাঝে মাঝে বেশি লোক থাকলে জট লেগে যায়, আর কাজ হয় না। কিগান কিছু বলেনি। চুপ করে কাজে মন দিয়েছিল। প্যান্ট গুটিয়ে নিজেও রেঞ্চ হাতে নাটবোল্ট খোলায় মন দিয়েছিল।

কাজ এগোচ্ছিল ভালই কিন্তু হঠাৎ ক্যাটায়ন ইউনিটের একটা লেগ ভেঙে পড়ে গিয়েছিল আচমকা। আর অন্য লেগগুলোও কেমন আলগা হয়ে এসেছিল সিমেন্টের বেস থেকে। কিগানের মনে হচ্ছিল পাগল হয়ে যাবে। একটার পর একটা সমস্যা। গৌর যদি ওর কথা শুনত! স্যাম পর্যন্ত মাথায় হাত দিয়ে পাশে পড়ে থাকা একটা মোটা পাইপের ওপর বসে পড়েছিল। কিগান বুঝেছিল কাজটা লম্বা হবে।

তা লম্বা হয়েছে কাজটা। দুটো রাত ধরে কাজ করেছে ওরা সবাই। প্রথম দিন স্যাম রাত দশটা অবধি ছিল। তারপর রণে ভঙ্গ দিয়েছে। কিন্তু কিগান তো আর পালাতে পারবে না। ওর সঙ্গের বিল্টু, নিতাই, জগারাও খাটছে যে! যখন যেমন বলেছে কিগান, তেমনই করেছে। ওদের ফেলে তো আর কিগান গিয়ে আরাম করতে পারে না। তাই সময়ে সময়ে চা-টিফিন, রাতের খাবার সব জোগাড় করেছে। শশীবাবু কিগানের কথামতো এনে দিয়েছে।

আর ছেলেগুলো তাদের চূড়ান্ত পরিশ্রম দিয়ে আজ বিকেল তিনটে নাগাদ শেষ করেছে কাজ। সবারই প্রায় হাত-পা কাঁপছে তখন। চোখ লাল। তবে আনন্দ প্রচুর। একসঙ্গে কাজ করে সফল হওয়ার মতো আনন্দও খুব কম আছে। ওরা শুধু কিগানকে আবদার করে বলেছে যে, একদিন পাঁঠার মাংস-ভাত খাওয়াতে হবে। কিগান সামনের বুধবারই খাওয়াবে কথা দিয়ে শশীবাবুকে সেইমতো নির্দেশও দিয়েছে।

ফোনটা বাজছে আবার। সেই একই অচেনা নম্বর। কে ফোন করছে? মাথাটা টলমল করছে কিগানের। ঘুম চায় শরীর। ফাটা মাটি যেভাবে জল চায়, শরীরও ঘুম চাইছে সেভাবে। কিগান ফোনটা ধরল না। বরং সুইচ টিপে রিংটা বন্ধ করে দিল। আবছা অন্ধকার ঘরে মোবাইল স্ক্রিনের আলোটা শুধু লাফাতে লাগল তিরতির করে। ও শুয়ে পড়ল আবার। ঘুম আসাটা খুব জরুরি। কিন্তু কিগান যা চায় তা আসে না সহজে। ঘুমও এল না। বরং মাথার মধ্যে ভিড় করতে লাগল হাজার চিন্তা। সমস্যা। আসলে সেদিন কাকু ফোন করেছিল যে!

কাকু, মানে আদির বাবা। প্রথম থেকেই যে কাকু ওকে পছন্দ করত না, সেটা ভালই বুঝতে পারত কিগান। সব কিছুতেই বাঁকা কথা বলত। আর ঠাকুরমা না থাকলে সামান্য ভুলেও চড়চাপড় দিত। কিছু বলত না কিগান। ঠাকুরমাকেও নালিশ করেনি কোনওদিন। কারণ, ও বুঝত এতে অশান্তি বাড়বে বই কমবে না। তবে যতটা সম্ভব নিজেকে গুটিয়ে নিত কিগান। তারপর ঠাকুরমা মারা গেল একদিন। স্বাভাবিক মৃত্যু। বয়স হয়েছিল তো অনেক। কিগানের সারা জীবনের ছায়াটা সরে গিয়েছিল। তবে সামলে নিয়েছিল কিগান। ছোটবেলাতেই তো মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল ওর।

ঠাকুরমার মৃত্যুর পর কিগান আরও সরে গিয়েছিল কাকা-কাকিমার থেকে। তবু কাকু আর কাকিমা ওকে যে-কোনও উপায়ে হেনস্থা করতে চাইত।

চারদিন আগের কথা। কিগান লাঞ্চ করছিল বসে। তখনই ফোনটা আসে। কিগান বলেছিল, ‘হ্যাঁ কাকু, বলো।’

কাকু স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, ‘কী রে কেমন আছিস?’

প্রশ্নটা খুব ভাল। কিন্তু উত্তরটা কেমন দেবে বুঝতে পারেনি কিগান। ও অবাক হয়েছিল এই ভেবে যে, সত্যিই তো কেমন রয়েছে ও? এই প্রায় এক অজ্ঞাতবাসে কেমন আছে কিগান! ও সামান্য ভেবে, একটু অন্যমনস্কভাবে বলেছিল, ‘আমি আছি। চলছে।’

‘মানে?’ কাকুর গলায় বিস্ময় প্রকাশ পেয়েছিল, ‘মানে? এ কেমন কথা?’

‘আমি ঠিক আছি কাকু,’ প্রশ্নটা যাতে আর না বাড়তে পারে তার জন্য একটা দায়সারা উত্তর দিয়েছিল কিগান।

‘ও!’ কাকু দম নিয়েছিল একটু। বলেছিল, ‘তা, কী ভাবলি তুই?’

কাকু এমন স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে দেখে কিগানের ভাবতে অবাক লেগেছিল যে, এই মানুষটাই ওকে কেমন করে জুতো ছুড়ে মেরেছিল! কেমন অপমান করেছিল! আর সে-ই নিজের থেকে ফোন করেছে! কেন?

কিগান জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি আমার নম্বর পেলে কী করে?’

‘তুই ভুলে গেছিস যে, আমার ছেলে তোদের কোম্পানিতেই চাকরি করে। তোর নম্বর ও-ই দিয়েছে।’

‘ও আদি!’ নিজের মনেই বলেছিল কিগান।

আদি, কাকুর ছেলে। কিন্তু ওরও তো ভাই। সেই ছোট্ট, মিষ্টি, কোঁকড়া চুলের আদি। বায়নাবাজ, গম্ভীর আর রগচটা। তবে তলায় তলায় ভীষণ ছেলেমানুষ। জন্মের পর আদিকে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতাটা আজও মনে আছে কিগানের। তখন কিগানের বয়স অনেক কম ছিল তবু সেই দিনটা এখনও মনে আছে।

ঠাকুরমার সঙ্গে নার্সিংহোমে দেখতে গিয়েছিল ও। রোববার ছিল সেদিন। বাচ্চাদের দেখতে যেতে দেওয়ার দিন। নার্সিংহোমের লবিতে গিজগিজ করছিল লোক। ভয় লাগছিল কিগানের। ও চেপে ধরেছিল ঠাকুরমার হাত। মনে হচ্ছিল একবার যদি হারিয়ে যায়, তা হলে তো আর ফেরত আসতে পারবে না বাড়িতে। আর যে-ছোট্ট বাচ্চাটা এসেছে তাকেও দেখতে পারবে না।

তবু হারিয়ে যায়নি কিগান। লিফ্‌টের ভেতর শক্ত করে ধরে রেখেছিল ঠাকুরমার হাত। অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ আসছিল ঠাকুরমার শরীর থেকে। বহু দিনের চেনা সেই গন্ধ। বড় নির্ভরতার সেই গন্ধ।

তারপর আদিকে দেখেছিল কিগান। ছোট্ট বেবিকটে সাদা চাদরে মুড়ে রাখা হয়েছে ফরসা একটা বাচ্চাকে। কিগান অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। যেন, মোমের পুতুল। মোমের সূক্ষ্ম কাজ করা হাত-পা। মাথার চুলগুলো হালকা পশমের মতো। কিগান অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। কী সুন্দর দেখতে! কোত্থেকে এল এ? কে হয় ওর? ‘তোর ভাই। দেখ,’ ঠাকুরমা কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে বলেছিল।

ভাই? ওর ভাই? অবাক হয়ে তাকিয়েছিল কিগান। ভাই ঘুমোচ্ছে। সামনে বহু দিনের পথ পাড়ি দিতে হবে, তাই ভাই ঘুমোচ্ছে। কিগান আলতো আঙুলে ছুঁয়েছিল ভাইয়ের গাল। বুঝেছিল আজ থেকে ও বড় হয়ে গেল। দাদা হয়ে গেল।

‘তা কিছু ভাবলি তুই? হ্যালো?’ কাকুর গলায় অধৈর্য।

‘হ্যাঁ,’ সংবিৎ ফিরে পেয়েছিল কিগান, ‘কী বলছিলে?’

‘আজকাল গাঁজা টাঁজা খাচ্ছিস নাকি?’ কাকু পুরনো ফর্মে ফিরছিল।

‘না, সরি। কী বিষয়ে ভাবব বলো তো?’

‘আরে সম্পত্তি বিষয়ে!’ কাকু অবাক হয়েছিল, ‘এমন করছিস যেন ভাজা মাছ উলটে খেতে জানিস না? আরে বাবা ওপরের তলাটা মা তোকে দানপত্র করে দিয়েছিল। সেটা এবার ফেরত দে!’

‘ও! ফেরত চাও ওটা?’ কিগান অবাক হয়েছিল বেশ।

ঠাকুরমা মৃত্যুর বেশ কিছুদিন আগে যে-তলায় কিগান থাকত সেটা নিজের নাম থেকে দানপত্র করে দিয়ে গিয়েছিল কিগানের নামে। সেই নিয়ে কাকুর সঙ্গে বিস্তর অশান্তি হয়েছিল ঠাকুরমার। কিন্তু কাকু কিচ্ছু করতে পারেনি। ঠাকুরমা যা ভেবেছিল তার থেকে তাঁকে সরানো যায়নি। কাকু শুধু গজগজ করেছিল একা একা। সেই কাকু এখন সুযোগ পেয়েছে। আর ছাড়ে?

‘শোন কিগান,’ কাকু বলেছিল ‘ফেরত যে চাই তা তুই জানিস। দেখ, তোকে দয়া করে মা এনেছিল বাড়িতে। রেখেছিল। তুই যে দাদার ছেলে সে বিষয়েই আমার সংশয় আছে। অমন নীল রঙের চোখ দাদার ছিল না। যাই হোক, মা যা ভুল করেছে তা তুই শুধরে দে। আমি দানপত্র তৈরি করে নিয়েছি। এসে জাস্ট সই করে দিয়ে যা।’

‘কিন্তু ঠাকুরমা যে…’

‘শোন,’ কাকু কড়া হয়েছিল এবার, ‘মাথাগরম করাস না। তুই এখানে যা করে গেছিস তারপর তুই আর এই পাড়ায় ঢুকতে পারবি ভেবেছিস? তোর লজ্জা লাগবে না? যা বলছি চুপচাপ কর।’

কিগানের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল, ‘কাকু, এমন বোলো না।’

‘বলব না মানে? শুয়োরের বাচ্চা,’ কাকু ফোনের ওপারে খেপে উঠেছিল আচমকা, ‘একটা রেপিস্ট তুই, একটা বানচোত। তুই আমায় চোখ গরম করছিস? নেহাত মেয়েটা পুলিশে যায়নি। গেলে তোর পিছনে না রুল দিত ওরা! বড় বড় কথা বলিস না।’

‘কাকু শোনো, আমি…’

‘চুপ কর,’ কাকু ধমক দিয়ে উঠেছিল, ‘যেমন আমার মা! বাহাত্তুরে ধরেছিল বুড়ির! না হলে তোর মতো একটা দোআঁশলাকে কেউ এমন করে নিয়ে আসে! সম্পত্তি দান করে?’

‘ঠাকুরমা সম্বন্ধে কোনও খারাপ কথা বলবে না,’ কিগান কেটে কেটে বলেছিল।

‘এঃ, খুব গায়ে লাগছে, না!’ কাকু বলেছিল, ‘বুড়ি আগে মরলে বাঁচা যেত। তোর মতো হারামির সঙ্গে আমায় কথা বলতে হত না!’

‘কাকু, ঠাকুরমাকে খারাপ কথা বোলো না।’ কিগানের রাগটা বাড়ছিল আচমকা।

‘দাঁড়া জানোয়ার, দিঘির বাপকে গিয়ে বলছি পুরোটা, তারপর তোর বন্দোবস্ত করছি।’

‘তোমার যা ইচ্ছে হয় কোরো,’ দুম করে ফোনটা কেটে দিয়েছিল কিগান।

জীবন একটা অন্ধকার টানেলের মতো। কখন যে শেষ হবে, কিগান জানে না। জানে না সেই অন্ধকার থেকে কখন ঝাঁপিয়ে পড়বে বুনো জন্তু। কাকুর মতো বুনো জন্তু।

জানে না। কিগান অনেক কিছুই জানে না। কেমন যেন একটা ধোঁয়ার ভেতর বেঁচে আছে ও। একরাশ প্রশ্ন দুলছে সামনে। তবে আজকাল কেমন যেন আগ্রহও হারিয়ে ফেলেছে ও। যেন মনে হয়, যা হওয়ার হোক। মনে হয় আর কত খারাপ হবে ও দেখতে চায়।

নাঃ, আর ঘুম আসবে না। চোখটা বড্ড জ্বলছে! কিগান বিছানার ওপর উঠে বসল। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। ও উঠে ঘরের লাইটটা জ্বালাল। টেবিলে ওটা কী? আশ্চর্য হল কিগান। একটা থালায় কিছু রয়েছে ঢাকা দেওয়া। এ নিশ্চয়ই ওই রাহি পাগলির কাজ। কখন দিয়ে গেল? আগেই কি দিয়ে গিয়েছিল? ঘুম পেয়েছিল বলে লক্ষ করেনি? মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে কিগানের।

মেয়েটা যে কী করে না! কিগান ঢাকনা তুলে দেখল। পরোটা আর মাংস রাখা আছে। আশ্চর্য! এই গরমে কেউ এসব খেতে পারে? বললেই তো রাগ করবে! ও দেখল থালার তলায় একটা খাম।

খাম? হঠাৎ ভুরু কুঁচকে খামটা খুলল কিগান। চিঠি? বোঝো! হাসি পেল ওর। দেখল লেখা আছে, ‘তুমি খারাপ, তোমার বন্ধু আরও খারাপ।’

কিগান হাসল আরও মন খুলে। অনেকক্ষণ পর। না, আসলে অনেকদিন পর এভাবে হাসল কিগান।

রাহির এখন নতুন পাগলামি হচ্ছে ‘হেল্‌প আর্থ’। ওর বান্ধবী হোমির সঙ্গেও আলাপ আছে কিগানের। মেয়েটা ভাল। কথাও বলে ভাল। ও চায় ওদের সংস্থা ‘হেল্‌প আর্থ’-কে আরও ছড়িয়ে দিতে। রাহির মুখে শুনেছে যে, কলকাতায় গিয়ে ও কিছু ইয়ং ছেলেমেয়েকে বলে এসেছে এইখানে আসতে। যদিও এখনও কেউ আসেনি। তবে রাহির ধারণা ওরা আসবে। ঠিক আসবে। কিগান আর জানতে চায়নি কিছু। কারণ, তা হলে রাহি আরও বকবক করবে। আর এই সংস্থার জন্য অ্যাওয়্যারনেস বাড়াতে ওরা এই নর্থ চব্বিশ পরগনায় একটা প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ করাতে চায়। নামকরা ক্রিকেটারদের সঙ্গে উত্তর চব্বিশ পরগনার একটা টিম নিয়ে।

সুধাদি ইচ্ছে করলেই এর বন্দোবস্ত করে দিতে পারে সহজে। কিন্তু রাহি তার আগে বলে বসেছে যে, ও নিজে প্লেয়ারদের সঙ্গে যোগাযোগের বন্দোবস্ত করবে।

‘কে বলেছিল তোকে এসব বলতে?’ কিগান সামান্য বিরক্ত হয়েছিল।

‘কেন তুমি হেল্‌প করবে না আমায়?’ রাহি টেবিলের ওপরে পড়ে থাকা সেই নতুন ঘড়িটা হাতে তুলে বলেছিল।

‘আমি?’ অবাক হয়েছিল কিগান, ‘আমার ভরসায় তুই বলেছিস যে, ম্যাচে প্লেয়ার আনবি, ম্যাচটা অর্গানাইজ করবি? আশ্চর্য!’

‘ঘড়িটা এখনও পরোনি কেন?’ রাহি গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করেছিল।

‘কথা ঘোরাস না রাহি। কেন এসবের ভেতরে ঢুকছিস?’

‘তোমার ভরসায়,’ রাহি ঘড়িটা রেখে সোজা চোখ রেখেছিল কিগানের চোখে।

‘মানে?’ কিগান চোখটা সরিয়ে নিয়েছিল চট করে।

‘তুমি অনেক আগে আমায় বলেছিলে, তোমার এক বন্ধু আছে। কলকাতায় ক্রিকেট খেলে। বেঙ্গল টিমে খেলার চান্স আছে। আমার ঠিক মনে আছে। নামটাও মনে আছে। রুহান। রুহান রায়। আমায় ওর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দাও।’

‘তা আর সম্ভব নয় রাহি। আমি পারব না।’

‘কেন? কেন পারবে না? তোমার বন্ধুকে তুমি বলতে পারবে না? তা হয় নাকি?’

কিগান চুপ করে থেকেছিল কিছুক্ষণ। তারপর বলেছিল, ‘আমার সঙ্গে আর কারও তেমন যোগাযোগ নেই। তাই বলছিলাম…’

‘আমি কিচ্ছু শুনব না। খালি পিছলে যাওয়ার ধান্দা, না? শোনো, তোমায় আগের কথা বললে বা জিজ্ঞেস করলেই এমন করে ওঠো কেন বলো তো? তুমি কি সাধু হয়ে গেছ নাকি যে, পূর্বাশ্রমের কথা মনে করতে চাও না? দাও, তোমার বন্ধুর মোবাইল নম্বর দাও।’

মাথা নামিয়ে চুপ করে বসেছিল কিগান। সাধু? ও কি আর সাধু হতে পারল? না, পারেনি। চায়ওনি। ও শুধু চেয়েছে সবার মাথা থেকে দুঃস্বপ্নের মতো মুছে যেতে। আর ফোন নম্বর? সেই ক্রিকেটার বন্ধুটির? মানে রুহানের? রুহানের তো মোবাইল ছিল না। তা হলে? হঠাৎ আবেশের কথা মনে পড়েছিল কিগানের। কিছুদিন আগে আবেশ তো ফোন করেছিল ওকে। ওর কাছে নিশ্চয়ই রুহানের যোগাযোগের নম্বর পাওয়া যাবে।

কিগান তখনকার মতো বলেছিল, ‘আমার কাছে রুহানের নম্বর নেই। জোগাড় করার চেষ্টা করছি। পেলে দিয়ে দেব।’

‘আমায় দিতে হবে না। তুমি ফোন করে কথা বলবে।’

‘আমি?’ অবাক হয়ে তাকিয়েছিল কিগান, ‘আমি এসব ব্যাপারে জড়াতে চাই না নিজেকে। আর ডিটেল কিচ্ছু জানি না। তার ওপর তোদের কাজ, তোরা করবি।’

‘আমাদের কাজ? এতটা স্বার্থপর কেন তুমি?’ রাহি রেগে গিয়েছিল খুব।

‘শোন রাহি, আমি চেষ্টা করব রুহানের নম্বর জোগাড় করতে। তারপর তোকে ওর সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমি কথা বলব না। কেমন? তাতে তুই আমায় যা ভাব, আমি তাই।’

চোয়াল শক্ত করে রাহি বসেছিল কিছুক্ষণ, তারপর দুদ্দাড় করে চলে যাওয়ার আগে বলেছিল, ‘আমি সাধুদাকে পরশুদিন পাঠিয়ে দেব। তারপর তুমি নম্বর পেলে দিয়ো, না হলে দিয়ো না।’

রাহি চলে যাওয়ার পরই আবেশকে ফোনে ধরেছিল কিগান।

এই ছেলেটাকেও রুহানকে চেনার সময় থেকেই চেনে কিগান। একটু পাগলাটে ধরনের হলেও বুদ্ধিমান ছেলে। তবে ওর সবটা ভাল লাগে না কিগানের। বড্ড বেশি টাকাপয়সায় লোভ ছেলেটার। সেদিন গাড়ির ভেতর আচমকা ওর ফোন পেয়ে তো অবাক হয়ে গিয়েছিল কিগান। আর সত্যিই পরদিন বিকেলে এসে হাজির হয়েছিল আবেশ।

ফ্যাক্টরি গেটে বলে রেখেছিল কিগান। তাই ঢুকতে অসুবিধে হয়নি আবেশের। ওকে দেখে বেশ অবাক হয়েছিল কিগান। হালকা চাপ দাড়ি। শরীরেও মেদ লেগেছে। তবে সেই ফক্কড় ধরনের হাসিটা আছে ঠিক।

‘কী রে তুই?’ কিগান হেসেছিল, ‘এত্তদিন পর! কী ব্যাপার?’

‘কুকুর আর ক্রিকেট,’ হেসেছিল আবেশ।

‘মানে? কী যা-তা বলছিস? হাবিজাবি কথা বলার অভ্যেসটা এখনও গেল না তোর?’

‘আরে বেশ কিছুদিন মিজোরামে ছিলাম। কুকুর ধরছিলাম। তারপর এখানে এসে তোমাদের কোম্পানির হয়ে একটা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করলাম।’

‘ও, টুর্নামেন্টটায় তুই-ও ছিলি? তাই?’ অবাক হয়েছিল কিগান, ‘আর কুকুরের কেসটা কী?’

‘ও সে অনেক বড় গল্প। বাদ দাও না। শোনো না, তুমি কেমন আছ গো? কলকাতায় তোমার টিকির দেখা তো পেলাম না। আদিকে বলে অনেক কষ্টে তোমার নম্বর পেলাম। কী কেস বলো তো তোমার? আদির সঙ্গে তোমার ঝামেলা হয়েছে?’

‘আমার সঙ্গে?’ কিগান হেসেছিল জোর করে, ‘আরে না না, তা নয়। কোম্পানি আমায় এখানে ট্রান্সফার করেছে। তাই এসেছি। প্লাস, এখানে প্রোডাকশনের প্রচুর চাপ। সময় হয় না যোগাযোগ বা গল্প করার। তাই আর যোগাযোগ করা হয় না। তা তুই কী মনে করে?’

‘আমায় এখানে একটা কাজ দিতে পারবে? আমার খুব সমস্যা চলছে কিগানদা?’

‘কাজ?’ কিগান মাথা নেড়েছিল, ‘কী বলছিস! আমি নিজেই চাকরি করি। কাজ দেব কোত্থেকে?’

‘আমি জানি না। ভাবলাম তোমায় ধরলে কিছু হবে।’

‘আমায়? হঠাৎ এমন মনে হল কেন?’

‘তোমাদের অফিসে গিয়েছিলাম। গৌর স্যারের সঙ্গে তো আলাপ হয়েছিল টুর্নামেন্ট করার সময়। তারপর ওঁকে বলেছিলাম কাজের ব্যাপারে। উনি বললেন তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তাই আদির থেকে নম্বর নিয়ে তোমার কাছে এলাম। দাদা, জানোই তো, মামার বাড়িতে অমানুষ আমি। একটা স্টেডি কিছু না করলে তো পুরো ঝাড় হয়ে যাচ্ছে। তুমি দাদা উদ্ধার করে দাও।’

সেদিন কিছুই আশ্বাস দিতে পারেনি কিগান। আর বেশি সময় কথাও বলতে পারেনি। তবে সংক্ষেপে রুহানের খবরও নিয়েছিল। প্রোডাকশন চলছিল বলে কিগান উঠে পড়েছিল। বলেছিল পরে কথা বলবে। আবেশ যাওয়ার আগে শুধু বলেছিল, ‘আমার একটা কাজ কিন্তু দরকার কিগানদা। প্লিজ, দেখো একটু।’

গৌর বলেছে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে? কিন্তু কই, ও তো জানে না? গৌর তো ওকে বলেনি কিছু! অর্থাৎ পাশ কাটানোর জন্য গৌর এসব বলেছে আবেশকে! তবু কিগানের মনখারাপ করছিল। এতদিন পর পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা, তবু ও কিছু করতে পারল না! কিগানের মনে হচ্ছিল কিছু একটা করতে পারলে বেশ হত!

তারপর ওই রাহির সঙ্গে কথা হওয়ার পর আবেশের কথাটা মনে হয়েছিল। রাহিকে রাতের দিকে তাই ফোনে ধরেছিল ও।

‘বলো।’ রাহি গম্ভীর গলায় বলেছিল।

কিগান বুঝেছিল যে, সন্ধেবেলার রাগটা এখনও মাথায় চেপে বসে আছে মেয়েটার। তাই এমন গলায় কথা বলছে। কিগান বলেছিল, ‘তোদের এনজিও টাকাপয়সা দিয়ে লোক রাখতে পারবে? যে প্লেয়ার জোগাড় করবে, স্পনসর ধরবে, সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করে দেবে। পারবে?’

রাহি চুপ করে ছিল কিছুক্ষণ, তারপর বলেছিল, ‘আমি হোমির সঙ্গে কথা বলব এই নিয়ে। কেন?’

কিগান বলেছিল, ‘একটা ছেলে আছে। আবেশ। রুহানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তবে নিডি ছেলে। তোদের এনজিও-তে কাজে লাগবে। ও সবটা অ্যারেঞ্জ করে দেবে। তোকে ওর মোবাইল নম্বর এসএমএস করে দিচ্ছি। আমার রেফারেন্স দিয়ে কথা বলিস। ওর থেকে রুহানের নম্বর পেয়ে যাবি।’

রাহি গম্ভীর গলায় বলেছিল, ‘ও, তুমি তা হলে জড়াবে না? ঠিক আছে পাঠিয়ে দিয়ো নম্বরটা।’

রাহির সেই অভিমানী গলাটা শুনে খুব হাসি পেয়েছিল কিগানের। আর আজ এই ছোট্ট চিঠিটা পেয়ে আবার মনে পড়ে গেল ওর রাগী মুখ।

দরজাটায় খটখট করে শব্দ হল একটা। কিগানের বিরক্ত লাগল। কে আবার এসেছে এ সময়ে? ওর খেতে ইচ্ছে করছিল না। বিছানাটা আবার খুব টানছিল ওকে। তার মধ্যে আবার কে এল?

জড়ানো পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল কিগান। আরে চমক! দোতলায় ওঠার সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এর সামনে একটা চল্লিশ ওয়াটের বাল্‌ব জ্বলছে। অন্য দিন আলোটাকে ঘোলাটেই মনে হয় কিগানের। কিন্তু আজ যেন আরও অন্ধকার মনে হল। আর সেই আলোর সামনে চমকের কালো ছায়ার মতো শরীরটা দেখে একটু অবাকই হল কিগান। হঠাৎ এমন সময় এল ছেলেটা… এমন সময় তো আসে না খুব একটা!

চমক টলছে। কড়া অ্যালকোহলের গন্ধ ছড়াচ্ছে বাতাসে। কিগান সরে দাঁড়াল, ‘আয়, ভেতরে আয়।’

চমক হাফ পাঞ্জাবির হাতায় মুখটা মুছে টলমলে পায়ে ঘরে ঢুকল। অল্প আলোর ভেতরেও ফরসা মুখটা লাল হয়ে আছে ছেলেটার।

কিগান চোখটা ভাল করে কচলে নিয়ে সামনের বিছানাটা দেখিয়ে বলল, ‘ওখানটায় বোস। আজ এত গিলেছিস কেন?’

চমক নড়বড়েভাবে বসল বিছানায়। মাথাটা নিচু হয়ে আছে ছেলেটার। চুলগুলো ঝুলছে কপালের ওপর। কোনও কথা বলছে না চমক।

‘কী হল রে? কী হয়েছে তোর?’ কিগান গিয়ে পাশে বসল চমকের।

চমক কোনওমতে মাথাটা তুলল। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। ঠোঁট থেকে একটা সরু লালার সুতো ঝুল খেয়ে জামায় আটকে আছে। চমক বলল, ‘আদিত্য ব্যানার্জি তোমার নিজের ভাই?’

আদিত্য। আদি! কিগান সোজা হয়ে বসল। ভাল করে দেখল চমককে। ছেলেটার সুনাম নেই এই অঞ্চলে। বা বলা যায় দুর্নাম আছে। তার ওপর ওর চোখ দুটোও ভাল লাগল না কিগানের। কিগান সাবধানী গলায় বলল, ‘কেন, কী হয়েছে?’

‘আঃ বলো না,’ চমক পা দুটো তুলে বসল বিছানায়।

‘হ্যাঁ। কেন? কী হয়েছে বল।’

‘তোমার সঙ্গে কি ওর কোনও খিঁচ আছে?’ চমক এলোমেলো হাতে একটা বালিশ নিয়ে বিছানার হেড বোর্ডে রেখে তাতে হেলান দিয়ে বসল।

‘খিঁচ? হঠাৎ এ কথা বলছিস কেন?’ কিগান আরও সতর্ক হল। তা ছাড়া বিরক্তও লাগছে ওর। এ কেমন ঝঞ্ঝাট? কোথায় একটু ঘুমোবে, না, এসে ঝামেলা শুরু করেছে একজন!

‘দেখো গুরু, তখন থেকে আমার প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করে যাচ্ছ! আমার মাইরি ভাল লাগছে না কিন্তু। বলো না যা জিজ্ঞেস করছি!’

‘কী বলব?’ কিগান একটু কড়া হল, ‘এই ভর সন্ধেবেলা এসব গিলেছিস কেন? তোর বাবার এত নাম। সেখানে রাস্তা দিয়ে এমন অবস্থায় হাঁটতে তোর খারাপ লাগে না?’

‘হুঁ, বাপের নাম! ওসব ঢপবাজির বাপ অনেক দেখেছি। বাদ দাও। আদিত্যর সঙ্গে তোমার কী নিয়ে খিঁচ বলো তো?’

‘কিচ্ছু নিয়ে নয়।’

‘আঃ, আবার ঢপ! শালা গোটা দুনিয়াটা ঢপ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না, না? সবাই ভাবে ঢপ মারবে আর বেঁচে যাবে, না? আমি খবর নিয়েছি। তোমাদের মধ্যে খিঁচ আছে। সে যতই লুকোও খিঁচ একটা আছেই।’

‘আর যদি থেকেও থাকে। তাতে তোর কী?’ কিগান আরও একটু কড়া হল।

‘তুমি এখনও ভালবাসো তোমার ওই মাগিবাজ ভাইটাকে?’

‘আঃ চমক। কী হচ্ছে কী? তোকে বলেছি না আমার সামনে এমন করে কথা বলবি না? তাও বলছিস কেন? জানিস না এমন কথা শুনতে আমি অভ্যস্ত নই?’

চমক জুলজুল করে তাকিয়ে রইল। তারপর হেসে ফেলল হঠাৎ। বলল, ‘মাইরি তোমার দম আছে। চমক চক্কোত্তিকে এই অঞ্চলে সবাই ভয় পায়। সামনে দাঁড়ালে মুতে দেয়, আর সেখানে তুমি শালা আমায় হুড়ো দিচ্ছ? জিও ক্যাপ্টেন। কিন্তু যাই বলো আমি জানি এক পিস খিঁচ আছে। আমি ওপর ওপর খবর নিয়ে এটুকু জেনেছি। বলো না, ওই ভাই মালটাকে এখনও ভালবাসো তুমি?’

‘কেন, ভালবাসি কি, না বাসি জেনে কী করবি?’ কিগান গলাটা নরম করল না একটুও।

‘বানচোতটাকে কেলাব। বুঝলে, কেলিয়ে লাট করে দেব শুয়োরের বাচ্চাকে,’ চমকের গলাটা নিমেষে বদলে গেল, ‘ওই জুস আর মিনারেল ওয়াটার না ওর পিছনে দিয়ে দেব একদম। শালা, ঢ্যামনামো হচ্ছে, না?’

‘আঃ তুই এমন ভাষায় কথা বললে বের হ এখান থেকে,’ কিগান সরাসরি বলল।

‘বেরোব বেরোব। তার আগে বলি, জানো কী করেছে? ত্রয়ণকে হাত করতে গেছে তোমার ওই ভাই। বলেছে সুধাদিকে অন্যভাবে ম্যানেজ করতে! হুঁ, সুধাদিকে ম্যানেজ! তাও এই ত্রয়ণটাকে দিয়ে? তুমি বলো একবার! এটা কোনও কথা হল?’

কিগান বলল, ‘তুই বাড়ি যা। ভাল করে স্নান করে ঘুমো। আমারও শরীর ভাল নেই। আমিও ঘুমোব। তুই এখন সুস্থ নেই। কাল সুস্থ অবস্থায় কথা বলবি।’

‘আমি সুস্থ নই? আমার চেয়ে সুস্থ এ তল্লাটে কেউ নেই। তোমার ভাই শেষে ত্রয়ণকে ধরল! আচ্ছা, মার্চেন্ট মাল্টিপল্‌সের কি এ অঞ্চলে কাজ করার ইচ্ছে নেই? তোমার ভাই কি বোকা?’

‘দেখ, ও চাকরি করে মাত্র। ওকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। একদমই লাভ নেই। ওপরের নির্দেশ মতো কাজ করে আদি।’

‘ব্যাঙ করে। ও নিজে লিড জোগাড় করছে। ত্রয়ণ কোন হনু যে, ম্যানেজমেন্ট ওর নাম জানবে? ওই আদি এভাবে এগোচ্ছে। শোনো কিগানদা, যা বলতে এলাম। তোমার ভাইকে সাবধান করে দিয়ো। নেক্সট দু’দিনের ভেতর যদি ত্রয়ণকে সিন থেকে না হাটায়, আমি খেল দেখাব। দেখব তখন কার বাপ বাঁচাতে আসে? আমার পিছনে কাঠি করতে এলে কিন্তু আমি উলটে সবার পিছনে বাঁশ করে দেব। তোমার ভাইকে বলে দিয়ো।’

‘শোন চমক…’ কিগান শান্ত করার চেষ্টা করল চমককে।

চমক পাত্তা না দিয়ে উঠে দাঁড়াল, ‘শোনো, তুমি শোনো। তোমায় পছন্দ করি তাই বলতে এলাম। না হলে আমার বয়ে গেছে। সোজা তুলব, তলতাবনির জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে নামিয়ে দেব। লোড হাপিস হতে সময় লাগবে না। তাই বলছিলাম তোমার ভাইকে সাবধান করে দিয়ো।’

কিগান কিছু বলার আগে ফোনটা বাজল আবার। সেই অচেনা নম্বর। কার ওটা? ধরবে ফোনটা?

‘কী হল? ধরো,’ চমক এলোমেলো গলায় বলল, ‘ফোনটা ধরো।’

কিগান দ্বিধার সঙ্গে ফোনটা তুলল, কার নম্বর এটা? বলল, ‘হ্যালো?’

‘কিগান?’ গলাটা হঠাৎ জলের মধ্যে একফোঁটা বিষের মতো এসে পড়ল। আবার ফোন করেছে? আবার? কিন্তু অন্য নম্বর থেকে। অন্য নম্বর থেকে? কীসের জন্য এই ফোন? কিগান ফোনটা কানে চেপে বসে রইল। দেখল সামনে বসে থাকা চমকের চোখ ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। ধরে রাখতে পারছে না চমক। নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। কিগান ভাবল ও কি নিজেকে ধরে রাখতে পারবে?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *