মুহূর্তরা দু’বছর আগে – ১৬

১৬

‘I thought I had forgotten,

But it all came back again

To-night with the first spring thunder

In a rush of rain.

With the wild spring rain and thunder

My heart was wild and gay;

Your eyes said more to me that night

Than your lips would ever say…

I thought I had forgotten,

But it all came back again

To-night with the first spring thunder

In a rush of rain.

লেখাটার নাম ‘স্প্রিং রেন’, বহু দিন আগে পড়া। কিন্তু আজ আবার মনে পড়ল জিয়ানার। যদিও এখন বসন্তকাল নয়। বরং এখন পুরোদস্তুর বৈশাখ। তবু বসন্তের বৃষ্টি মনে পড়ল ওর। আলতো করে গাড়ির বন্ধ জানলায় মাথাটা ঠেকিয়ে হেলান দিল জিয়ানা। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়ে চলেছে। রাস্তাঘাট সব সাদা। বৃষ্টির ঝালর এসে ধুইয়ে দিচ্ছে ওদের গাড়ি। ধুইয়ে দিচ্ছে পথঘাট। ওই দূরের ছড়ানো ধানখেত। একলা চাষি। গাছেদের নির্বিবাদী সারি। ধুইয়ে দিচ্ছে ইলেকট্রিকের পোস্ট, মাইল-মাইল চলে যাওয়া তার আর তার ওপরে বসা শালিখ, চড়ুই আর ফিঙে। বহু দিন পরে প্রায় এরকম গ্রামের পরিবেশে বৃষ্টি দেখছে জিয়ানা। গাড়ির এসি-র ভেতরে বসে জলে ঝাপসা কাচ দিয়ে বৃষ্টি দেখছে ও। আর আবার হু হু করে মনে পড়ে যাচ্ছে সব। সেই কলেজের রাস্তা, ক্লাসরুম, সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের জল। মনে পড়ে যাচ্ছে গাছের তলায় উলটোনো ছাতা ঠিক করতে চেষ্টা করা সেই লম্বা ছেলেটাকে।

‘আপনার শরীর ঠিক আছে তো ম্যাডাম?’ সামনের সিট থেকে পিছন দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল রুহান।

ম্যাডাম কথাটা শুনতে ভাল লাগে না জিয়ানার। বিদেশে চট করে কেউ এমন ম্যাডাম ট্যাডাম বলত না। ফার্স্ট নেম ধরে ডাকাটাই সেখানে রেওয়াজ। নইলে মিসেস বাসু। এখানে এসে অন্য সব কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিলেও ‘ম্যাডাম’ ডাকটার সঙ্গে ঠিক এখনও মানাতে পারেনি ও। আর ওর আরও অস্বস্তি হয় যখন রুহান এভাবে ডাকে। এর আগে যেদিন প্রথমবার অফিসে এমন করে ডেকেছিল রুহান, খুব অদ্ভুত লেগেছিল। সত্যি কথা বলতে কী, প্রথমে তো বুঝতেই পারেনি যে, ওকে ডাকছে। নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছিল জিয়ানা। শুনছিল কে যেন পাশে দাঁড়িয়ে ‘ম্যাডাম’ ‘ম্যাডাম’ করছে। ও পাত্তা দেয়নি। ওর পাশে শালিনী বসে। হয়তো, শালিনীকে বলছে কেউ।

জিয়ানা পাত্তা দেয়নি অত। ও কাজ করে যাচ্ছিল। হঠাৎ শালিনী বলেছিল, ‘আরে জিয়ানা, স্পেয়ার আস চার্ম। এত কাজ কোরো না। কতক্ষণ থেকে তোমায় ডাকছে। তুমি শুনছই না! তুমি এত কাজ করলে খুরানা স্যার তো আমাদের ওপর রেগে যাবেন।’

‘আমায় ডাকছে?’ একটু বিস্মিত হয়ে চোখ তুলেই থমকে গিয়েছিল জিয়ানা। আরে, রুহান যে! ও বলেছিল, ‘তুমি আমায় ম্যাডাম বলছ কেন?’

রুহান নিচু গলায় বলেছিল, ‘অফিস তো…মানে…’

‘বউদি বাদ দাও, দিদি তো বলতেই পারো। ম্যাডাম ভাল লাগে না।’

‘না, সবাইকেই তো বলি। তাই…ম্যাডামটাই ঠিক আছে।’

জিয়ানা ঠোঁট উলটেছিল। ব্যাপারটা ভাল লাগেনি। কিন্তু এটা নিয়ে তেমন শোরগোল করার মতোও কিছু হয়নি বলে জিয়ানা আর কথা বাড়ায়নি।

রুহান বলল, ‘ম্যাডাম, আপনার কি ক্লান্ত লাগছে? জন্ডিসের পর খুব উইক লাগে। আপনি আজ এতটা দূর না আসলেও পারতেন।’

‘আমি ঠিক আছি,’ জিয়ানা আবার জানলা দিয়ে তাকাল।

জায়গাটার নাম বিড়া। না, জিয়ানা জানত না। একটা ছোট্ট জনবসতির ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় দোকানের সাইনবোর্ডে নামটা দেখেছে ও। তখনও বৃষ্টির তোড়টা এতটা ছিল না। এখন খুব বেড়েছে বৃষ্টি। তবে রাস্তা বেশ ভাল। ফাঁকা। মাঝে মাঝে দু’-একটা গাড়ি বা ট্রাক আর টোকা মাথায় ভ্যানচালকেরা যাচ্ছে।

এদিকটায় কোনওদিন আসেনি জিয়ানা। আসলে কোন দিকটাতেই বা ও গেছে? আসল সময়টা তো পড়াশোনা করল আর বিয়ের পর বিদেশে গিয়ে কাটল। নিজের দেশ তো দেখাই হল না। না, বিয়ের আগে ঘুরতে গেছে। একবার মা রাগ করে কালিম্পঙের ওখানে এক মামার বাড়িতেও পাঠিয়ে দিয়েছিল। এমনই ছুটকো-ছাটকা ভাবে বেড়িয়েছে জিয়ানা। কিন্তু তা তো নিয়ন্ত্রিত। তাতে তো আর সঠিকভাবে দেশ দেখা যায় না।

এইখানে এসে বেশ ভাল লাগছে জিয়ানার। বৃষ্টি আর গ্রাম। হাইওয়ে দিয়ে নিমেষে মিলিয়ে যাওয়া বাস। এইসব আবার কেমন যেন কলেজ জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। একবার কলেজ পালিয়ে কিগানের সঙ্গে তো এমন করেই বেরিয়ে পড়েছিল ও।

ওদের সঙ্গে বরুণ বলে একটা ছেলে পড়ত। প্রচুর টাকার মালিক ছিল ওর বাবা। বরুণ দেদার খরচ করত। বন্ধুদের খাওয়াত। নিজের গাড়িতে লিফ্‌ট দিত। সিনেমা দেখাত। তবে ছেলেটা একটু খামখেয়ালি প্রকৃতির ছিল। নিপা বলে বটানি অনার্সের একটা মেয়ের সঙ্গে ভাব ছিল ওর। মেয়েটা রীতিমতো ওকে নিয়ে ছেলেখেলা করত।

এমনই একদিন বরুণ এসে বলেছিল, ‘কিগান, মাইরি খুব বিপদে পড়ে গেছি।’

‘কেন?’ কিগানরা সবাই ক্যান্টিনে বসেছিল। কিগান ঘুগনির চামচটা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।

‘দেখ না নিপা খুব বায়না করছে!’

‘বায়না করছে মানে?’ কিগান ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল।

বরুণ লজ্জা লজ্জা গলায় বলেছিল, ‘ওর বাড়িটা আজ ফাঁকা আছে। তাই, মানে…’

কিগান হেসে নিচু গলায় বলেছিল, ‘তা আমায় বলছিস কেন? ওসব ব্যাপারে আমি তো হেল্‌প করতে পারব না। তোর গার্লফ্রেন্ড তুই বোঝ।’

‘না না।’ বরুণ ঠোঁট চেটে তাকিয়েছিল, ‘আসলে সমস্যা হল আমার মোটরবাইকটা।’

‘কেন? আজ যখন বাইক নিয়ে এসেছিস তখন বাইকে বসে বোঁ করে চলে যা। সমস্যা কেন বলছিস?’

‘ওদের ওখানে বাইক নিয়ে গেলে ঝামেলা আছে। বাড়ির বাইরে পার্ক করে রাখতে হবে তো! সবাই দেখে ফেলবে রে শালা। পুরো কেস খেয়ে যাব। নিপা বলছে বাইকটা রেখে যেতে।’

‘তো যা। কলেজের গ্যারাজে রেখে যা।’ কিগান ওর ঘুগনিতে মন দিয়েছিল।

‘দুর। এভাবে হয় না। শোন না,’ এবার বরুণ বায়নার গলায় বলেছিল, ‘তুই বাইকটা নিয়ে যা। একদিন রাখ। কাল নিয়ে নেব।’

‘আমি! পাগল না পেটখারাপ?’ কিগান ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল।

‘কেন নয়? তুই রাখ। প্রবলেম কী?’

‘শোন, আমার সঙ্গে লাইসেন্স নেই। রাস্তায় যদি পুলিশ ধরে?’

‘এই বৃষ্টিতে পুলিশ ধরবে! ওদের খেয়েদেয়ে কাজ নেই, না?’ বরুণ এমন করে কথাটা বলেছিল যেন সেদিন সমস্ত পুলিশকে রেনি ডে-র ছুটি দেওয়া হয়েছে।

‘তা ছাড়া,’ বরুণ মিচকের মতো হেসেছিল, ‘আমার বাইকে তেল লোড আছে। তোরা বেরিয়ে যা না।’

‘আমরা মানে?’ কিগান অবাক হয়েছিল।

‘ন্যাকা খোকা আমার! সবাইকে যত ঢপ মারো কাকা, আমায় পারবে না। তুই আর জিয়ানা। বেরিয়ে পড় না। কে আটকাবে তোদের? সবে সাড়ে এগারোটা বাজে। কোথাও লং ড্রাইভ মেরে আয়।’

কিগান বলেছিল, ‘দেখ, মাসের শেষ। পকেট মানি কম আছে। তোর তেলের টাকা দিতে পারব না।’

‘তেলের টাকা?’ বরুণ এমন মুখ করেছিল যেন ওর কাছে ওর হৃৎপিণ্ডের দাম নিয়ে কথা বলা হচ্ছে, ‘তোকে বলেছি দিতে? আমার বাপের প্রচুর হারামের পয়সা আছে। তেলও হয়েছে বলতে পারিস। তার থেকে চার-পাঁচ লিটার গেলে কিস্‌সু হবে না।’

কিগান আড়চোখে পাশে বসা জিয়ানাকে দেখেছিল। জিয়ানা চট করে নামিয়ে নিয়েছিল চোখ।

কিগান বলেছিল, ‘জিয়ানাকে জিজ্ঞেস কর।’

বরুণ হেসে বলেছিল, ‘শালার পেটে খিদে মুখে লাজ। মারব এক লাথ। দেখছিস না ওর চোখ “হ্যাঁ” বলছে? শালা, প্রেম করতে এসেছে!’

সেদিন বৃষ্টি পড়ছিল বেশ। একরাশ মেঘ কে যেন লেপে দিয়েছিল কলকাতার চোখে-মুখে। জিয়ানা কিগানের কোমর জড়িয়ে ধরে বসেছিল। আর মোটরবাইক ছুটছিল বিদ্যাসাগর সেতুর দিকে। বৃষ্টি বাড়ছিল ক্রমশ। জলের রেখাগুলো তেরছা হয়ে এসে বিঁধছিল ওদের। সালোয়ারের ওপর দিয়ে যেন জল টোকা মারছিল জিয়ানার শরীরে। কিন্তু কষ্ট হচ্ছিল না। একটুও কষ্ট হচ্ছিল না ওর। বরং আনন্দ লাগছিল। কিগানের কোমর জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে খুব আনন্দ হচ্ছিল জিয়ানার।

সেতু পেরিয়ে, নদী পেরিয়ে ওরা সোজা যাচ্ছিল। কিগানকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করেছিল জিয়ানা। ওর মনে হচ্ছিল যেন ভার নেই শরীরে। মনে হচ্ছিল এই তো ওই ছায়া রঙের মেঘগুলোর ভেতরে পৌঁছে গেছে ও। কিগান বাইকের গতি বাড়াচ্ছিল ক্রমশ। যেন সত্যিই মেঘের ভেতর চলে যেতে চাইছিল ও। কিন্তু একসময় বৃষ্টি এমন জোরে শুরু হয়েছিল যে, ওরা বাধ্য হয়েছিল বাইকটা থামাতে। যদিও দু’জনে ভিজে গিয়েছিল সম্পূর্ণভাবে, তবু একটা ভাঙা চালার নীচে দাঁড়িয়েছিল দু’জনে।

বৃষ্টিতে ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছিল চরাচর। বাইরে রাস্তার পাশে কাত হয়ে তুমুল ভিজছিল মোটরবাইক। আর ওই আধভাঙা চালার নীচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিল ওরা দু’জন।

আনন্দও যে কষ্টের জন্ম দেয়, সেদিন বুঝেছিল জিয়ানা। এই যে কিগানের সঙ্গে থাকার সময়টুকু, এই যে এই মুহূর্তটুকু, এই বৃষ্টি, নির্জন ছায়াতল, এই জনমানবহীন চরাচর। কিগানের সঙ্গে এই সমস্ত কিছু ভাগ করতে পেরে ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল জিয়ানার। আর তারই সঙ্গে যখন মনে পড়ছিল যে, আর কিছুক্ষণ পরেই ওরা আবার ফিরে যাবে যে যার বাড়িতে। ওরা হয়ে যাবে আলাদা। তখন ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল ওর।

আর তাই খানিকটা নিজের অজান্তেই জিয়ানা ধরে ফেলেছিল কিগানের হাত। নরম, ভীষণ নরম ছিল কিগানের হাত। জিয়ানার মনে হচ্ছিল নরম পাখি ধরেছে ও। মুখ ঘুরিয়ে দেখেছিল কিগান তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকেই। নরম নীল চোখ নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে।

জিয়ানা যেন নড়তে পারছিল না। কেমন যেন বন্ধনে পড়ে গিয়েছিল। নিজের অজান্তেই কিগানের হাতটাকে ও নিজের কোমরে জড়িয়ে নিয়েছিল। তারপর ঘন হয়ে দাঁড়িয়েছিল কিগানের কাছে। কিগানের ঘাড়ের পিছনে হাত দিয়ে ও নামিয়ে এনেছিল কিগানের ঠোঁট। জিয়ানার ঠোঁটের মাঝে কাঁপছিল কিগানের ঠোঁট দুটো। আর সেই ঠোঁট দুটোকে ভরসা দিতেই জিয়ানা আলতোভাবে জিভটা বাড়িয়ে দিয়েছিল।

সেদিন বৃষ্টির আড়াল নিয়েছিল ওরা। সেদিন আর কোনও আড়াল রাখেনি ওরা। জিয়ানা বুঝেছিল শারীরিক মিলন হয়তো হয়নি। কিন্তু মানসিকভাবে ও আর কুমারী নেই।

তারপর বৃষ্টি থেমেছিল একসময়। ওরা আবার বাইকে চড়ে ফিরে এসেছিল কলকাতায়। ভেজা সপসপে গা নিয়ে বাড়িতে গিয়ে নিয়মমতো জ্বরেও পড়েছিল জিয়ানা। রাতের দিকে জ্বর বেড়েছিল। গরম একটা ভাপ যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছিল জিয়ানাকে। শরীরে থাবা বসাচ্ছিল যন্ত্রণা। তবু তারই ভেতরে জিয়ানা যেন টের পাচ্ছিল সেই ঠোঁটের কম্পন। যেন বুঝতে পারছিল নরম ভেজা একটা জিভ এসে গলে যাচ্ছে ওর জিভের ওপর। মনে পড়ছিল কানের কাছে মুখ নিয়ে কিগানের জিজ্ঞাসা, ‘আমায় কেমন খেতে রে?’ জিয়ানার মনে পড়েছিল ওর উত্তরের অপেক্ষা না করে কিগান শান্ত গলায় বলেছিল, ‘Your eyes said more to me that night/ Than your lips would ever say…’

‘I thought I had forgotten,/ But it all came back again/ To-night with the first spring thunder/ In a rush of rain.’ চোখের মাটি ভিজিয়ে বেয়াড়া এক কুচি পুঁচকি জল মাথা তুলল। গাড়ির বাইরেটা সত্যি প্রায় সন্ধের মতো কালো করে আছে। সত্যি আজও সেইরকমই বৃষ্টি হচ্ছে। আজও আশপাশ প্রায় নির্জন। আজও সামনে পড়ে আছে ভেজা হাইওয়ে। সবই এক। তবু কোথায় যেন সব এক নয়। সেই কাত হয়ে থাকা মোটরবাইকটা নেই। সেই ভাঙা চালাঘরটা নেই আর সেই নীল চোখের ছেলেটাও কোথাও যেন হারিয়ে গেছে! হারিয়ে গেছে কি? না হারিয়ে ফেলেছে জিয়ানা! বাবা, মা আর নানান চাপে ও আর ধরে রাখতে পারেনি কিগানকে! আজ এত বৃষ্টিতে কোথায় কিগান? কাকে ভালবাসছে ও? কার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলছে, ‘আমায় কেমন খেতে?’

সামনে ডানদিকে একটা পেট্রোল পাম্প দেখে ড্রাইভার গাড়িটা ঘুরিয়ে দিল। তেল নেবে বোধহয়। জিয়ানা সোজা হয়ে বসে ঘড়ি দেখল। দুপুর একটা বাজে। রুহানের নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। জিয়ানা দেখল সামনের সিটে মাথা রেখে চুপ করে বসে আছে রুহান। ছেলেটা ভাল। নির্বিবাদী। কখনও ঝঞ্ঝাট করে না। কখনও ঘ্যানঘ্যান করে না। যা পায়, যেটুকু পায় তাতেই খুশি। এই যে এতটা পথ এসেছে, দু’বার, শরীর কেমন আছে ছাড়া অন্য কিছু জিজ্ঞেস করেনি। একদম ডিস্টার্ব করেনি। ছেলেটার সম্বন্ধে মাঝে মাঝে কৌতূহল হয় জিয়ানার। দু’-একবার বুকুকেও জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু বুকু তো জগদ্দল পাথর। বলেছে, ‘ওই ছোট থেকে চিনতাম। ভাল ছেলে। একসময় ক্রিকেটটাও ভাল খেলত। এখন নাকি আর তেমন ভাল খেলে না।’

‘আর? ভাইবোন আছে? বাবা তো নেই শুনলাম। মা? ওর মা কেমন?’

বুকু যেন ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে, এমন মুখ করে বলেছে, ‘আমি জানব কেমন করে?’

আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি জিয়ানা। আজকাল বুকুর সঙ্গে যোগাযোগের সাঁকোগুলো কেমন যেন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জিয়ানা পড়েছিল যে, প্রাচীনকালে চিন দেশে যোদ্ধারা যখন যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যেত তখন নদী পেরোনোর কাঠের সাঁকোগুলো পুড়িয়ে দিতে দিতে যেত। বুকুও যেন আজকাল সাঁকো পোড়াতে পোড়াতে যাচ্ছে। আর জিয়ানাও যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচছে কোথাও! কীসের সমস্যা ওদের ভেতর? জিয়ানা জানে না। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে যে, ওর তরফ থেকে কি কোনও গন্ডগোল হয়েছে? শরীর দিয়ে যতটা করার তা তো ও করেছে! তবে? তবে যাই হোক, বুকুর ক্রমশ সরে যাওয়াও যেন আরও বেশি করে আজকাল মনে করিয়ে দেয় কিগানকে। না, কিগান ছিলই। তবে এখন যেন কেমন স্পষ্ট হয়ে উঠছে আরও। যেন আরও ঢুকে পড়ছে মনে। মাঝে মাঝে আজকাল খুব দমবন্ধ লাগে জিয়ানার। মনে হয় সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে যদি পালিয়ে যেতে পারত! কিন্তু যাবে কোথায় ও? নিজের থেকে তো আর পালাতে পারবে না। সেটা পারলে কাজের কাজ হত। কিন্তু তা যখন হবে না, তখন আর ভেবে লাভ কী!

জিয়ানা ব্যাগ থেকে ছোট্ট আয়নাটা বের করে চুলটা ঠিক করে নিল একটু। তারপর নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘রুহান, তুমি খাবে না? খিদে পায়নি?’

‘হ্যাঁ ম্যাডাম?’ রুহান সামনের সিট থেকে ঘুরে বসল।

‘আর বাড়াবাড়ি কোরো না তো। ড্রাইভারও তো নেই গাড়িতে। এখন ম্যাডাম-ম্যাডাম করছ কেন?’

জিয়ানার কথার ধরনের জন্যই বোধহয় রুহান শব্দ করে হাসল। বলল, ‘ডাকটা ইমপর্ট্যান্ট নয়। তবে ঠিক আছে। বউদি বলছি। না, বউদি খিদে পায়নি। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় নুডুল্স সেদ্ধ করে খেয়ে এসেছিলাম। অম্বল হয়ে গেছে এমন যে, আর খিদে আসার জো নেই।’

‘সে কী! তুমি নুডুলস সেদ্ধ করেছ মানে? আসলে কিছু মনে কোরো না, তোমায় চিনলেও তোমার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু আমি জানি না।’

‘না না ঠিক আছে,’ রুহান হাসল, ‘আমি আর মা থাকি বাড়িতে। মায়ের হাতটা ভেঙে গেছে। তাই আমিই টুকটাক রান্না করে নিই।’

‘খেয়াকাকিমা হেল্‌প করে না?’

রুহান একটু চুপ করল। জিয়ানা ওর মুখ দেখে বুঝল প্রশ্নটা এমন হয়ে গেছে যে, উত্তর দিতে গেলে বেশ কিছু সত্যি মিথ্যে ঘেঁটে গুলিয়ে যাবে।

কিন্তু রুহান বলল, ‘আসলে, এখানে একটা ছোট্ট সমস্যা আছে। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই মা একটু কেমন হয়ে গেছে যেন। আমি তো তেমন খুব কিছু রোজগার করি না, তাই অবস্থাটাও ভাল নয়। সব মিলিয়ে মা কষ্টে থাকে খুব। হয়তো একটু কঠিন কথাও বলে ফেলে মাঝে মাঝে। কাকিমা যদিও গায়ে মাখে না ওসব। আমাদের কাছে আসতে চায়, কাজ করে দিতে চায়। তবে আমিই বারণ করি। কী হবে অশান্তি এনে সংসারে? বন্যেরা বনে সুন্দর, মানুষ সুন্দর নিজের গণ্ডিতে।’

জিয়ানা বলল, ‘তা বাড়িতে যখন তোমরা দু’জন তখন বিয়ে করো একটা। বউ আসলে মায়ের একজন কম্প্যানিয়ান হবে। প্লাস বউ চাকরি করলে একটা এক্সট্রা হেল্‌পিং হ্যান্ডও হবে সংসারে। তাই বলছি যত তাড়াতাড়ি পারো একটা বউ এনে ফেলো।’

‘বিয়ে!’ রুহান বাচ্চাদের মতো হাসল আবার, ‘আমায় কে বিয়ে করবে? দুর! চালচুলো নেই। এত বয়স হল ঠিকমতো রোজগার হল না। ময়দানের ডাইনোসর ক্রিকেটার, ক্লাবও টাকা দেয় না ঠিকমতো। বউদি, আমি সব জায়গা থেকেই প্রায় বাতিল। আমায় আর কে বিয়ে করবে? আর তা ছাড়া আমি ওসব স্বপ্ন দেখি না আর। কারণ দুঃস্বপ্ন দেখতে কারই বা ভাল লাগে?’

জিয়ানা হাসল, ‘আচ্ছা ড্রাইভারটা কোথায় গেল বলো তো?’

‘বাথরুম গেছে। ওই পাম্পের পিছন দিকে একটা বাথরুম আছে।’

‘ও!’ জিয়ানা ব্যাগ খুলে চুইংগাম বের করে রুহানকে দিল। তারপর বলল, ‘তা প্রেম তো করতে পারো। তুমি না হয় সেল্ফ প্রোক্লেমড বাতিল ছেলে। কিন্তু জানো তো, মেয়েরা প্রেমে পড়লে আর ওসব দেখে না। জাস্ট অন্ধের মতো ভালবাসাটাই শুধু দেখে।’

‘তাই?’ রুহান দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

‘তাই’ শব্দটা তিরের মতো এসে গেঁথে গেল জিয়ানার শরীরে। সত্যিই কি মেয়েরা প্রেমে পড়লে ভালবাসা ছাড়া আর কিছু দেখে না? তা হলে কি কিগানকে ভালবাসেনি ও? নেহাত মায়ের কথায় এমন করে কিগানকে যে ছেড়ে দিল, তার মানে কি এই যে, ও কিগানের প্রেমে পড়েনি? হ্যাঁ, মা অনেক মানসিক অত্যাচার করেছিল। কোথাও হয়তো বাবারও মায়ের ব্যবহারের দিকটায় নিঃশব্দ সমর্থন ছিল। তা বলেই ও একদম সাত দিনের মধ্যে কিগানকে বাদ দিয়ে দিয়েছিল জীবন থেকে? এই যে রুহানকে মেয়েদের প্রেম নিয়ে যা বলল তা কি এখনকার সন্ধের বাংলা সিরিয়ালগুলোর থেকে ধার নিয়ে বলার মতো হয়ে গেল খানিকটা? এটা কি শুধুমাত্র বলার জন্য বলল জিয়ানা?

রুহান বলল, ‘আমার একটা প্রেম ছিল বউদি। নন্দা নাম মেয়েটার। তবে এখন আর নেই। ওর একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। কলকাতাতেও থাকে না আর। তবে কোথায় থাকে তা আমি জানি না।’

জিয়ানা দেখল রুহান মাথাটা নিচু করে রেখেছে। হয়তো পুরনো কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে। জিয়ানা একটা জিনিস লক্ষ করে দেখেছে যে, স্মৃতি অধিকাংশ সময়ই মানুষকে ডিপ্রেস্‌ড করে দেয়। হয়তো কোনও কথা মনে করে হালকা হাসি এল, কিন্তু সেটা স্থায়ী হয় না বিশেষ। কারণ, তার পিছনেই কষ্ট দুঃখগুলো সিঁদ কেটে ঢুকে পড়ে। কে যে বলেছিল স্মৃতি সততই সুখের! এর মতো দুঃখজনক ব্যাপার খুব কমই আছে।

রুহান বলল, ‘যাক গে, আর ভেবে কী হবে? যা হওয়ার হয়েছে।’

জিয়ানা ঘড়ি দেখল আবার। বলল, ‘সেকেন্ড হাফ হয়ে যাবে চাপাডাঙা পৌঁছোতে। কী জানি আজ আদৌ কাজটা হবে কি না!’

ললিতেরও আজকে আসার কথা ছিল, কিন্তু অন্য কাজ পড়ে যাওয়ায় আর আসতে পারেনি। খুরানা স্যার তো গতকাল বলেওছিলেন, ‘তোমায় আর যেতে হবে না জিয়ানা। অনুজ বা শালিনীকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এমনিতেই এমন শরীর খারাপ থেকে উঠলে, তার মধ্যে এসব নিয়ে আর মাথা ঘামিয়ো না।’

তবু জিয়ানা শোনেনি। খুরানা স্যার সেই সরস্বতী পুজোর সময় এই কাজটাকে একটু গুরুত্ব দিতে বলেছিলেন। নামও বলে এসেছিলেন কনট্যাক্ট পার্সনের। কিন্তু কাজ তেমন এগোয়নি। ওদের মিজোরামের প্রজেক্টের ব্যাপারে একটা গন্ডগোল হয়েছিল। জিয়ানা সরস্বতী পুজোর পর সেই নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আর তার পরেই তো হঠাৎ জন্ডিসে পড়ল।

ইতিমধ্যে ললিত কনসালট্যান্টদের সঙ্গে দু’-তিনবার মিটিং করেছে। তারা টেকনিক্যাল ডেটায় বদল ঘটিয়েছে কিছুটা। সেই ডেটাগুলো কালেক্ট করে এবার আবার অফার দিতে হবে জিয়ানাদের। সঙ্গে ড্রইং। পাইপিং অ্যান্ড ইন্সট্রুমেনটেশন ড্রয়িং, লেআউট আর ফ্লো ডায়াগ্রাম।

কিন্তু ড্রইং দিতে গেলে একবার জায়গাটা তো চাক্ষুস করতে হবে। কনসালট্যান্টরা একটা টোপোগ্রাফির ড্রইং আর সয়েল টেস্টিং রিপোর্ট দিয়েছে। তবু একবার চাক্ষুস দেখা দরকার। এইসব নানা কারণেই জিয়ানা আজ এসেছে এখানে। আর যদি কোনও দরকার পড়ে, তাই সঙ্গে রুহানকেও রেখেছে। কাজটা নিয়ে ওয়াটারবার্ডও খুব চেষ্টা করছে। তাই জিয়ানাদের এখন থেকেই কোমর কষতে হবে।

ড্রাইভারটা এসে পড়ায় জিয়ানা আর কথা বাড়াল না। সঙ্গে সঙ্গে এটাও দেখল যে, রুহানও কেমন যেন গুটিয়ে নিল নিজেকে।

বৃষ্টিটা কমেছে একটু। তাই আশপাশটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে আরও। পাশে, সিটের ওপর ফাইল পড়ে আছে প্রজেক্টের। তার ওপর মোবাইলটা রাখা। জিয়ানা দেখল মোবাইলটা কাঁপছে। মায়ের নম্বর। বিরক্ত লাগল জিয়ানার। মা বড্ড বেশি জীবনে ঢুকে পড়ছে আজকাল। অনেকটা সেই কলেজ জীবনের মতো। আসলে যত দিন বিদেশে ছিল, মা ফোন করলেও যেহেতু চট করে ওর কাছে চলে যেতে পারত না, সেহেতু এতটা ইন্টারফেয়ার করত না জীবনে। কিন্তু এখন মা চলে আসতে পারে। আর জন্ডিসের সময় তো মা কিছুদিন ছিলও বাড়িতে। ফলে পুরনো মা-টা আবার মাথাচাড়া দিয়েছে। কিন্তু মা তো! কী করবে জিয়ানা? যতই রাগ হোক। একটা ভালবাসাও তো আছে!

‘হ্যালো?’ জিয়ানা ফোনটা ধরল।

‘কোথায় তুই?’ মায়ের গলায় উদ্বেগ।

‘রাস্তায়। চাপাডাঙা যাচ্ছি, কেন?’ জিয়ানা বলল।

‘চাপাডাঙা? কোথায় সেটা?’ মায়ের উদ্বেগ যেন বাড়ল।

‘নর্থ চব্বিশ পরগনা।’

‘সে কী! অত দূর!’ মা আঁতকে উঠল, ‘কীসে যাচ্ছিস? ট্রেনে?’

‘ট্রেনে? কেন, ট্রেনে যাব কেন? অফিসের গাড়ি আছে তো!’

‘আর খেয়েছিস? ভাল করে খেয়েছিস তো? ওষুধ খাচ্ছিস তো?’

‘হ্যাঁ মা,’ জিয়ানার এবার হাসি পেল। সত্যিই এমন করছে মা যেন ও তুতুলের বয়সি! যেন ওকে সব কিছু করে দিতে হয়!

‘ঠিক করে ওষুধ খাস মিষ্টি। খুব কঠিন অসুখ থেকে উঠেছিস। এমন করিস না।’

‘এমন করিস না, মানে?’ জিয়ানা যথাসম্ভব চাপা গলায় বলল।

‘মানে হুটহাট করে অমন দূরে যাস না। গাড়িতে গেলেও শরীরের ওপর চাপটা তো পড়ে! অত চাপ নিস না। জানবি, শরীর ঠিক থাকলে সব ঠিক থাকবে। শরীর বাদ দিয়ে কিন্তু কিচ্ছু হবে না।’

‘জানি মা, জানি,’ জিয়ানা নিজেকে সংযত করল। মা বরাবর এমন সময়ে এমন কথা বলে যে, নেওয়া যায় না। টাইমিং এত খারাপ মায়ের!

‘জানলে এত দূর যেতিস তুই?’ মা রাগ করল, ‘তুই কী ভেবেছিস? বড় হয়ে গেছিস? ডাক্তার বলেছেন না যতটা সম্ভব রেস্ট নিতে?’

‘আরে, তুমি চিন্তা করছ কেন?’ জিয়ানা বলল, ‘আমি গাড়িতে চুপ করেই বসে আছি। রাস্তাও খুব ভাল। ফলে কোনও অসুবিধে নেই। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছ! এমনিতেই হাই প্রেশার তোমার। কেন ফালতু মাথা ঘামাচ্ছ এই নিয়ে? এমন ভেবো না। প্লিজ।’

‘ফালতু মানে?’ মা একটু রেগে গেল, ‘সামনে তোকে বাচ্চা নিতে হবে একটা, তার জন্য শরীরটা সুস্থ করে তুলতে হবে না তাড়াতাড়ি?’

‘মানে?’ জিয়ানা অনেক কষ্টে গলার স্বর সংযত রাখল। গাড়ির ভেতরটা বেশ নির্জন। এই জায়গাটা এসব কথা বলার জন্য একদম উপযুক্ত নয়। কিন্তু কে বোঝাবে কাকে? মা যে কেন বোঝে না এসব!

‘মানে,তুতুলের একটা ভাই হওয়া খুব প্রয়োজন। না হলে ও কেমন ভায়োলেন্ট আর একাচোরা হয়ে যাচ্ছে! তোরা যত দ্রুত সম্ভব আর একটা ইসু নে। বুঝেছিস?’

‘মা, কেমন করে এসব বলছ তুমি? আমি তো বলেছি আর না।’

‘তুই ‘না’ বললেই হবে? আমরা আর কতদিন বাঁচব বল? এটা একটা অনুরোধ ধরে নে আমার…মানে আমাদের আর কী? তোর বাপিও তো…’

‘মা প্লিজ, ডোন্ট স্টার্ট ইট অল ওভার আগেন। বাপির নাম দিয়ে আর না। প্লিজ, আর না। অনেক হয়েছে। আমরা অনেক দেখেছি। আর এমন কোরো না।’

‘ও, বাপির নাম দিয়ে বলছি? তোর তাই মনে হয়? শোন মিষ্টি, আমি চাই না আমাদের মতো তোকেও কষ্ট পেতে হোক। দিদির ঘটনা ভুলে গেলি? দুটো সন্তান থাকা কতটা জরুরি জানিস না? এমন করে বলছিস তুই যেন আমরা তোকে মেরে ফেলছি। আমার কথা শোন মিষ্টি। শরীরটা তাড়াতাড়ি সুস্থ করে নে। তারপর…’

‘আমায় রাখতে হবে মা। অফিস থেকে একটা ফোন আসছে। পরে কথা বলছি,’ জিয়ানা মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কেটে দিল ফোনটা। ও জানে মায়ের এই কথা সহজে ফুরোবে না। আর বেশি বললে ওরও মাথা গরম হয়ে যাবে।

‘মিষ্টির দিদি মিঠি। টু সুইট, না?’ দিদি বলত। দিদি বলত আর হাসত। গালে লম্বা লম্বা দুটো টোল জেগে উঠত। বড় বড় চোখ দুটো চকচক করে উঠত। দিদিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যেত জিয়ানা। এত সুন্দর কী করে দেখতে হয় কোনও মানুষ! পাশাপাশি বড় হয়ে উঠলেও কোনওদিন দিদির প্রতি কোনওরকম হিংসে বা প্রতিযোগিতা অনুভব করেনি জিয়ানা। বরং মনে হত সমান সমান নয়, বেশিটা দিদিরই প্রাপ্য। অত সুন্দর, নরম স্বভাবের কোনও মানুষকে তো সত্যিই নিজের ভাগটাও ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে।

আর সত্যি বলতে কী, জিয়ানার একমাত্র বন্ধু ছিল দিদিই। ভালটা-মন্দটা সবই ও দিদির কাছে এসে বলত। ক্লাস সিক্সের একটা ঘটনা এখনও মনে আছে ওর। সেদিনও এমন আকাশভাঙা বৃষ্টি হয়েছিল।

বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে একটু গম্ভীর হয়েছিল জিয়ানা। দিদিকে বলবে কী বলবে না ভাবছিল ব্যাপারটা। গম্ভীর মুখে টিফিন করে ও বসেছিল ওদের বারান্দায়। কথা বলছিল না বিশেষ।

দিদি গান গাইছিল বসার ঘরে হারমোনিয়াম টেনে। রোজ বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে দিদির সঙ্গে গান গাইতে বসত জিয়ানা। কিন্তু সেদিন বসেনি। তাই দিদিরও হয়তো মনে হয়েছিল কিছু। আর ক্লাস টুয়েলভের দিদি তো বরাবরই একটু পরিণত ছিল।

জিয়ানা হঠাৎ শুনেছিল সুরের গুঞ্জন থেমে গেল। তবে কি দিদি থামিয়ে দিল গান? দিক। ও তাও বসেছিল। ভাল লাগছিল না যে একদম। স্কুলে শোনা কথাগুলো বড্ড কষ্ট দিচ্ছিল যে!

হালকা চন্দনের গন্ধ পেয়েছিল জিয়ানা। তারপর শুনেছিল, ‘মিষ্টি, কী হয়েছে রে?’

জিয়ানা উত্তর করেনি। চুপ করে বসে ছিল শুধু।

দিদি পাশে এসে বড় হাতলবিহীন চেয়ারটায় বসে আলতো করে জড়িয়ে ধরেছিল ওকে, ‘এই, কী হয়েছে তোর? এমন মুখ করে বসে আছিস কেন?’

‘কিছু না,’ জিয়ানা ঠোঁট চেপে বসেছিল।

‘সত্যি করে বল না,’ দিদি বলেছিল, ‘সত্যি করে মনের কষ্টটা বল। এমন মনখারাপ করে থাকতে নেই।’

‘দিদি,’ জিয়ানা ঘুরে বসেছিল সামান্য, ‘স্কুলের ওরা যা দেখাল সব সত্যি?’

‘কী দেখাল?’ দিদির গলায় অনেকগুলো প্রশ্ন ছিল।

‘দাঁড়া।’ জিয়ানা উঠে স্কার্টের পকেট থেকে ছোট্ট একটা কাগজ বের করে এনেছিল, তারপর সেটা দিদির সামনে মেলে ধরে বলেছিল, ‘বাবা-মাও এমন করেছে?’

জিয়ানা এখনও দেখতে পায় ভয়ে আর লজ্জায় ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া দিদির মুখ। জিয়ানার হাত থেকে ছোট্ট পৃষ্ঠাটা নিয়ে নিয়েছিল দিদি। রঙিন পাতলা ছবির বই থেকে ছিঁড়ে নেওয়া একটা পাতা। আর তার দুই দিকেই নানা মাপের রতিচিত্র, নানা ভঙ্গিমায় মিলনরত নরনারীর ছবি। ফোটোগ্রাফ। স্পষ্ট, আলোছায়ার কারিকুরিবিহীন, যৌনতার ক্ষুধার্ত ছবি।

‘এটা কে দিয়েছে তোকে?’ দিদি প্রায় তোতলাচ্ছিল।

‘আমায়? কেন, স্কুলের এক বন্ধু, ইন্দ্রাণী।’

‘ইন্দ্রাণী? মানে ওই ফরসা মতো মিষ্টি দেখতে মেয়েটা?’ দিদি যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না, ‘ও তোকে এটা দিয়েছে? ক্লাস সিক্সে পড়ে আর এসব বই…কোথায় পেয়েছে ও?’

‘তা বলেনি। কিন্তু তুই বল এটা সত্যি যে, বাবা-মা এমন করেছে?’

‘কে বলেছে তোকে?’ দিদি এবার গলাটা শক্ত করেছিল।

‘ইন্দ্রাণী বলেছে। আমার একটা সন্দেহ ছিল। কিন্তু ইন্দ্রাণী ছবি দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে আমাকে। বলেছে সবার বাবা-মা-ই নাকি এমন করে। এমন করে দিদি? এমন অসভ্যতা করে? নোংরামো করে?’ কষ্টে, কান্নায় গলা বুজে আসছিল জিয়ানার।

‘আচ্ছা বল তো, সিনেমা তো দেখিস। সেখানে যা যা দেখায় তা সত্যি হয়?’ দিদি শান্ত গলায় বলেছিল, ‘হয়, যে একটা মানুষ একাই কুড়িজনকে মেরে শুইয়ে দিচ্ছে?’

‘না। ওটা তো বানানো,’ জিয়ানা বুঝতে পারছিল না দিদি কী বলতে চাইছে।

‘তেমনই এটাও বানানো। এমনভাবে কিছু হয় না। ইন্দ্রাণী তোকে ভুল বলেছে।’

‘কিন্তু ও যে ‘আপন গড’ বলল। বলল, এভাবেই আমরা মায়ের পেটের ভেতর ঢুকে আস্তে আস্তে বড় হই। সেটা? ‘আপন গড’ বলে কেউ মিথ্যে বলে? বল?’

‘না। কিন্তু ও তো ভুলটাকে ঠিক ভেবে আপন গড বলেছে। আর মিষ্টি শোন, যেভাবে আমরা মায়ের পেটের ভেতর জন্ম নিই সেটা এমনভাবে নয়। আরও সুন্দরভাবে। কিন্তু সেটা বললে তুই ঠিক বুঝতে পারবি না এখন। জাস্ট মনে রাখ এমনভাবে মারামারি বাবা-মায়েরা করে না।’

কিন্তু জিয়ানা ছাড়েনি। বলেছিল, ‘কেন বুঝতে পারব না? নিশ্চয়ই বুঝতে পারব। তুই বলে দেখ, আমি শিয়োর বুঝতে পারব।’

‘পারবি?’ দিদি হেসেছিল। পৃথিবীর সেই সবচেয়ে সুন্দর হাসি।

‘হ্যাঁ। তুই বলে দেখ।’

‘বাসাংসি জির্ণানি যথা বিহায়। বল তো, এটার মানে কী?’ দিদি ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিল, ‘বল, আমি দেখি এটা তুই বুঝতে পারলি কি না!’

‘কী মানে এটার? আমি বুঝতে পারছি না। এটা তো স্যানস্‌ক্রিট। এটা চিটিং কিন্তু।’

‘না, চিটিং নয়। আমি কী বলছি শোন। এখনও সব কিছু বোঝার মতো বয়স তোর হয়নি। একটা ঘটনার নানারকম ব্যাখ্যা হয়। কিন্তু তার মানে সবটাই ঠিক ব্যাখ্যা তা কিন্তু নয়। তাই বলছি, ইন্দ্রাণী তো তোরই বয়সি, ও তোর মতোই ছোট। সব এখনও বোঝার বয়স ওর হয়নি। তাই বলছি যে, বড় হ, সব জানতে পারবি। আর দে, ছবিটা ফেলে দে।’

দিদি ছবিটা কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল সামনের ড্রেনে। তারপর বলেছিল, ‘যে কথা তোর জীবনকে নষ্ট করে দেয়, হাসি কেড়ে নেয়, সেই কথা শোনার কোনও দরকার নেই। এরপর ইন্দ্রাণী তোকে এমন কিছু বললে তুই আমার ক্লাসে নিয়ে আসবি। কেমন? আর এই নিয়ে একদম মনখারাপ করবি না। এখন চল গান গাইবি আমার সঙ্গে। একা থাকবি না।’

‘বাসাংসি জির্ণানি যথা বিহায়।’ পরে, বছর দুয়েক পরে মানেটা জেনেছিল জিয়ানা। গীতাপাঠ হচ্ছিল বাড়িতে। তখন যিনি পাঠ করছিলেন, তিনি ব্যাখ্যা করতে করতে বলেছিলেন এর অর্থ। তবে সেদিন জিয়ানার পাশে দিদি আর ছিল না। দিদি সামনে, সাদা ফুল দিয়ে সাজানো টেবিলের ওপর মালা পরে ছিল ছবি হয়ে। ছবির মধ্যে থেকে দিদি হাসছিল জিয়ানার দিকে তাকিয়ে। যেন বলছিল, ‘বলেছিলাম না মিষ্টি, বড় হলে জানতে পারবি এর মানে।’

ক্লাস এইটের জিয়ানা দিদির ছবির দিকে তাকিয়ে ভেবেছিল, সত্যিই কি জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল বাসস্থান, যে দিদি চলে গেল তা ছেড়ে! জিয়ানা বড় হয়ে গিয়েছিল সেদিন। সেই বৃষ্টির বারান্দা থেকে দূরে, চন্দনের গন্ধের থেকে দূরে দাঁড়িয়ে, জিয়ানা বুঝেছিল আর কোনও দিদি নেই যে পাশে এসে বসবে ওর। যার মনখারাপ হবে ওর মনখারাপে। বুঝেছিল বাদবাকি জীবন গানটা গাইতে হবে একা একাই।

চাপাডাঙায় ফ্যাক্টরিতে যখন ওরা পৌঁছোল, বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু আকাশটা কালো হয়ে আছে এখনও। ওই পেট্রোল পাম্প থেকে এই ফ্যাক্টরি অবধি মোটামুটি তাড়াতাড়িই পৌঁছেছে ওরা। হাবরা স্টেশন আর হাবরা বাজার অঞ্চলটায় ভিড় আর ট্র্যাফিক ছিল বেশ। সেটুকু পার করে চোংদার পর থেকে গাড়ি আবার খুব মসৃণ আর দ্রুত এসেছে। এই দিকটা যে এত সুন্দর তা আগে বুঝতে পারেনি জিয়ানা।

ফ্যাক্টরির গেটটা খোলা ছিল না। ওরা হর্ন দিতেই দারোয়ান এগিয়ে এল। আগে থেকেই সিকিয়োরিটিকে বলা ছিল যে, ওরা আসবে। তবে মিস্টার ব্যানার্জি বলে যে ইনচার্জ রয়েছেন তাঁর সঙ্গে কথা হয়নি। সিকিয়োরিটির হেড গুরুং বেরিয়ে এসে জিয়ানার আইডি দেখে গেটটা খুলে দিতে বলল।

গাড়িটা ধনুকের মতো বাঁকা কালো রাস্তা দিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে।

‘নমস্কার, আমি শশী হালদার,’ জিয়ানা গাড়ি থেকে বেরোতেই একটা লোক এগিয়ে এল, ‘আপনি ভেতরের ঘরে বসুন। ব্যানার্জিবাবু আসবেন। এই সামনে যে অফিস তার ডান দিকের ওই নীল রঙের দরজাটা। বসুন আপনি।’

ফ্যাক্টরিটা বেশ বড়। এরা যে এক্সপানশন করছে সেটাও বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু জমি নিয়ে কী একটা ঝামেলা আছে, তাই নাকি ঠিকমতো কাজ এগোচ্ছে না। তাই এতদিন এই প্রজেক্টটা উইথহেল্ড ছিল। কিন্তু এখন এদের এমডি গৌর রওশন দিওয়ানের সঙ্গে খুরানা সাহেবের কথা হয়েছে। ওরা নাকি কিছু পজিটিভ ইঙ্গিত পেয়েছে, যার ফলে ওরা আর কাজটা ঝুলিয়ে রাখতে চায় না। তাই ওরা যে-কনসালটেন্সি ফার্মকে কাজে নিযুক্ত করেছে তারা আবার কাজটা নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

অফিসটা খুব একটা বড় নয়। অফিসের টেবিলে ফাইল, কাগজ আর পেনের গোছার ভেতর একটা ক্যামেরা আর মাউথঅর্গান পড়ে আছে। অবাক লাগল জিয়ানার। এ কেমন মানুষ রে বাবা! অফিসে কেউ এসব এনে রাখে? জিয়ানা সামনে রাখা দুটো চেয়ারের একটায় বসল। কখন এই ব্যানার্জি আসবে কে জানে!

ফোনটা বাজল হঠাৎ। না, কল নয়, মেসেজ এসেছে। দেখল জিয়ানা। ‘সামনের মানডে প্লিজ ফাঁকা রেখো। গোল্ডিজ-এ একবার তোমায় নিয়ে যাবই। প্লিজ।’ হাসি পেল জিয়ানার। মালিনীটা পাগলি একদম। এই মার্চেন্ট মাল্টিপল্‌সেই রয়েছে। তবে তার সঙ্গে এই ওল্ড এজ হোম নিয়েও ওর খুব উৎসাহ। অনেকবার বলেছে ওদের হোমে যেতে। কিন্তু সময় বা ইচ্ছে কোনওটাই এখনও পর্যন্ত হয়নি জিয়ানার। আসলে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে আলাপ হওয়া কারও সঙ্গে ফোন নম্বর দেওয়া নেওয়া অবধি ঠিক আছে। কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। তাই প্রতিবারই মালিনীকে ছুতোনাতায় কাটিয়ে দিয়েছে ও। এই রোববারও তাই দেবে।

হঠাৎ পায়ের আওয়াজে সচকিত হল জিয়ানা। সঙ্গে ঘরের এক পাল্লার দরজাটার নব ঘোরানোর শব্দও পেল। ও নিজেকে একটু গুছিয়ে নিল। সোজা হয়ে বসল। বুঝল কে এ ব্যানার্জি এসেছে। তবে পিছনে তাকাল না। সচেতনভাবেই তাকাল না।

দরজাটা খুলল। পায়ের শব্দটা ভেতরে এল। তারপর বন্ধ হয়ে গেল দরজা আবার। কয়েক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হল সব। পায়ের শব্দটা থেমে আছে। তবে কি জিয়ানার একবার পিছন ঘুরে দেখা উচিত? ও ইতস্তত করে ঘুরতে গিয়েও পাথর হয়ে গেল নিমেষের জন্য।

বহু বহু জন্মের ওপার থেকে যেন ভেসে আসছে শব্দ। যেন বহু দিন পর নির্জন গুহামুখ ফাটিয়ে বেরিয়ে আসছে ঝরনা। মেঘ থেকে যেন বহু দিন পরে নেমে আসছে বৃষ্টি।

‘কেমন আছিস?’

কেমন থাকে প্রিয় মানুষকে ছেড়ে থাকা মানুষ? ঘুমের মধ্যে পাহাড়ি পথে মিলিয়ে যাওয়া সাইকেল যে আসলে মিলিয়ে যায় না! শরীরের ভেতর সেই রোগা সাইকেলের দাগ বয়ে বেড়ানো মানুষ কেমন থাকে? কতটা কষ্ট পেলে সে একলা হয়ে যায়?

পায়ের শব্দটা পিছন থেকে সামনে এসে থামল এবার। নাকি এক দশকের ওপার থেকে এই সময়ে এসে থামল? জিয়ানা অবশ মাথাটা তুলে তাকাল সামনে। দেখল কে এ ব্যানার্জিকে। সেই একই রকম লম্বা, একই এলোমেলো চুল। দাড়িগোঁফ কামানো। আর একই রকম সেই নীল রঙের চোখ। জিয়ানা দেখল কিগান অর্ক ব্যানার্জি হাসছে। হালকা, তুলোর মতো এক হাসি।

জিয়ানা দেখল, দেখতে থাকল। আর ওর বুকের ভেতর থেকে উড়তে থাকল পায়রা। অসংখ্য সাদা-ধূসর সব পায়রা। জিয়ানা বুঝল ওর চোখের মাটি ভিজে উঠছে আবার। বুঝল ওর ভেতরের বর্ষাকাল আর এ জীবনে শেষ হওয়ার নয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *