১৫
জয়নালের রাগটা বটুক ওর ওপর দিয়ে নিল! এমন মার বহু দিন খায়নি রুহান। মুখটা তেতো হয়ে আছে পুরো। দেশপ্রিয় পার্কের সিগনালে দাঁড়িয়ে আকাশে সূর্যের দিকে তাকাল রুহান। মরা আলো। মেঘ করে আছে আজ। কিন্তু হাওয়া নেই। গোটা শহরটাই প্রেশার কুকারের মতো হয়ে আছে। কিন্তু সেফ্টি ভালভটা কোথায় কেউ জানে না!
আজ রোববার, রাস্তায় গাড়ি কম। কলকাতার গায়ে কেমন আড্ডা আর ছুটির গন্ধ। তবে বেশিক্ষণ থাকবে না। চৈত্র সেল-এর দোকানপাট খুলল বলে। মাথা নিচু করে রাস্তাটা পার হল রুহান। বুকুদা গাড়ি করে নামিয়ে দিয়ে গেছে দেশপ্রিয় পার্কে। রুহান বলেছিল পাড়ায় যেতে। বুকুদা রাজি হয়নি। বলেছিল, ‘অন্য দিন যাব।’ রুহান জোর করেনি। তা ছাড়া মা কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবে কে জানে!
মা দিনকে দিন ইম্পসিব্ল হয়ে উঠছে। পৃথিবীর যাবতীয় আফশোস যেন রুহানের ওপর মেটাচ্ছে। গত সপ্তাহে তো তার মধ্যে আবার হাত ভেঙে ফেলেছে। সে এক কাণ্ড। বাথরুমে স্নান করতে গিয়ে শ্যাওলায় পা পিছলে গিয়েছিল। আসলে বাথরুম পরিষ্কার করে রুহান নিজেই। কিন্তু বাথরুমটা কয়েকদিন পরিষ্কার করতে পারেনি। তাই খুব হালকা শ্যাওলা ধরেছিল। তাতেই যে মা এমন করে পড়ে যাবে বুঝতে পারেনি ও।
বাঁ হাতে চোট পেয়েছে মা। প্লাস্টারের মতো করে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। তারপর থেকে রুহানকে দেখলেই খেপে যাচ্ছে একদম। গতকাল রাতে তো হাওয়াই চটিটা ছুড়ে মেরেছিল। শরীরে কিছুই লাগেনি। কিন্তু লেগেছে মনে।
পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখল রুহান। ন’টা পঁচিশ। আজ মার খেয়ে তাড়াতাড়ি মাঠ থেকে চলে এসেছিল বুকুদার বাড়ি। ভোরে প্র্যাকটিস ছিল। ম্যাচটা হঠাৎ ঠিক হয়। নিজেদেরই মধ্যে। কিন্তু বটুকটা এমন মারল যে, জগুদা বের করে দিল মাঠ থেকে। চার ওভারে পঁচাত্তর রান। মনে হচ্ছিল হাতে-পায়ে যেন জোর নেই। যেন কেউ নল ঢুকিয়ে শরীরে সমস্ত রক্ত বের করে নিয়েছে। বটুক যেন আজ ঠিক করেছিল ক্লাবের সবার সামনে রুহানের জামাকাপড় খুলবে। জয়নালের কাছে অফ স্টাম্পের বাইরে যতবার নাকানিচোবানি খেয়েছে তার পরের ওভারে তত ঠেঙিয়েছে রুহানকে।
চার ওভারের পর তো রুহানকে এসে বটুক বলেছিল, ‘ছেড়ে দাও রুহানদা। এই বয়সে কি আর এসব খাটনি পোষায়? তার চেয়ে অন্য লাইন দেখো।’
অন্য লাইন? অন্য লাইন মানে? রুহান তাকিয়েছিল বটুকের দিকে। হেলমেট খুলে রিস্টব্যান্ড দিয়ে কপালের ঘাম মুছছিল বটুক। আর হাসছিল। পুরনো রুহান হলে পরের ওভারেই ওর খুলি উড়িয়ে দিত। কিন্তু সেই রুহানটা যে আর নেই। বরং ওর মনে পড়েছিল অন্য একটা কথা। মনে পড়েছিল নন্দার বাবাও এমন বলেছিল না? ‘অন্য লাইন দেখো।’
লাইন। চকচকে একটা রেললাইন পার করে রোজ বাড়ি ফেরে রুহান। দেখে রাতের অন্ধকারে রেললাইনটা মিলিয়ে গেছে কালোর ভেতর আর আবার সকালবেলা জেগে উঠেছে। কখনও দেখে সামনের লেক গার্ডেন্স স্টেশনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সবুজ-হলুদ ট্রেন। মনে হয় যদি মাথা পেতে দেওয়া যেত। যদি এই লাইনটা ধরা যেত!
না, মাথা নামিয়ে নিয়েছিল রুহান। বটুক ইন্ডিয়া ‘এ’ খেলে ফিরেছে সদ্য। সামনে ইন্ডিয়া সিলেকশনেও খুব ভাল চান্স আছে। আজ বটুককে বল করতে যাওয়ার সময় বারবার এই কথাগুলো মনে পড়ছিল ওর। তাই কেমন যেন নার্ভাস লাগছিল। সফল মানুষদের দেখলে কেমন যেন গুটিয়ে যায় রুহান। কেমন যেন ভয় লাগে। মনে হয় ওদের সামনে খুব ছোট্ট লাগছে ওকে।
এর পরই জগুদা মাঠ থেকে তুলে নিয়েছিল ওকে। বলেছিল, ‘দেখেছিস তো, কেন ফাইনালে সেদিন তোকে খেলাইনি? যা বাইরে বোস।’
আর কত বাইরে যাবে রুহান? বন্ধুদের থেকে বাইরে, প্রেমের থেকে বাইরে, মায়ের থেকে বাইরে, সবার থেকে বাইরে সরে গেছে তো। আর কত বাইরে যাবে?
সাইড লাইনে বসে ব্যাগ গোছাতে গোছাতে রুহান ঠিক করেছিল, না, সবার থেকে সরে যাবে না ও। বরং নিজেই চেষ্টা করবে মানুষের কাছে আসার। আর তাই নিজেই যাবে বুকুদার বাড়ি। ময়দান থেকে খুব একটা দূরে তো থাকে না ওরা!
জিয়ানার সঙ্গে আজকাল প্রায় সবসময়ই কথা হয় রুহানের। আসলে জিয়ানা ওদের বসকে বলে রুহানকে নিয়ে এসেছে ওর সেকশনে। এখানে আর খুচরো ভুলভাল কাজ করতে হয় না। বরং জিয়ানার সঙ্গেই ‘সাইট ইন্সপেকশন’-এ যেতে হয়। তবে হঠাৎ করেই কয়েকদিন হল জিয়ানা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাই মাঠ থেকে বেরিয়ে রুহান ঠিক করেছিল যে, ও যাবে একবার দেখতে।
উত্তর চব্বিশ পরগনায়, চাপাডাঙা বলে একটা জায়গায় আদিদের কোম্পানির একটা পার্টিকল্ বোর্ড কারখানা আছে। সেখানে একটা কাজের জন্য প্রোজেকশন কর্প চেষ্টা করছে। ললিত আর জিয়ানার দায়িত্ব এই কাজটা ফলো-আপ করা। কিন্তু এখনও চাপাডাঙায় যেতে হয়নি ওদের। তবে শুনেছে যাবে। জিয়ানা তো বলেছিল, ‘স্যার তো ওখানের একজনকে কনট্যাক্টও করতে বলেছেন। কিন্তু কনসালটেন্টরা বলেছে আগে ওদের সঙ্গে বসতে। অনেক টেকনিক্যাল ব্যাপার ডিসকাস করার আছে। যদি সত্যিই একবার সাইটটা দেখে আসা যেত!’
‘তা যাচ্ছেন না কেন?’
‘আরে জানোই তো প্রেশার কত! ওই লস প্রজেক্টটাও এখন দেখতে হচ্ছে। প্লাস চাপাডাঙায় যাওয়া মানে এক দিন নষ্ট। আর ওই মিস্টার ব্যানার্জি না কে একজন তার সঙ্গে যোগাযোগও হবে কিনা কে জানে! এদিকে সামলে তারপর তো যেতে হবে। তার ওপর শুনলাম ওখানে জমি নিয়ে একটা ঝামেলা চলছে। তাই সাততাড়াতাড়ি গিয়েও কি লাভ হবে?’
‘তা, আমি যাব?’ রুহান নিজেই বলেছিল।
‘তুমি?’ জিয়ানা অবাক হয়েছিল।
‘যাব?’ রুহান আবার জিজ্ঞেস করেছিল।
‘শোনো, টেকনিক্যাল ডিটেল আর স্পেস মেজারমেন্ট করতে হবে। প্লাস আরও টুকিটাকি কাজ আছে। ভাল করে না পারলে তোমার ওপরে সবার ইমপ্রেশন খারাপ হবে। আমার সঙ্গেই যেয়ো।’
জিয়ানা অযাচিতভাবেই রুহানকে নিজের অধীনে নিয়ে এসেছে। ওকে কাজ শেখানোর আর গাইড করার চেষ্টা করছে। কেন করছে, রুহান জানে না। এমনিই করছে হয়তো! ছোট ভাইয়ের মতো দেখে বলেই হয়তো! বুকুদার সঙ্গে আত্মীয়তা আছে বলেই হয়তো! আসলে এই বাজারে কেউ তো কারও জন্য কিছু করে না। আর আত্মীয়রা তো আরওই কিছু করে না। তাই একটু অদ্ভুত লেগেছে রুহানের। প্রশ্নগুলোও তাই আপনা-আপনি তৈরি হয়েছে ওর মনে।
জিয়ানা অসুস্থ। জন্ডিস হয়েছে। অফিসে আসছে না। তাই আজ মাঠ থেকে বেরিয়ে ওর মনে হয়েছিল একবার দেখতে যাবে। আর বুকুদাও তো বলেছিল যেতে। সরস্বতী পুজোর দিন শেষ দেখা হয়েছিল বুকুদার সঙ্গে।
বুকুদা পালটে গেছে অনেক। সেই বকবক করার মানুষটা কেমন যেন চুপ করে গেছে। কেমন যেন সবার মধ্যে থেকে একা হয়ে গেছে। মনখারাপ। মনখারাপ একটা অদ্ভুত রং। রুহানের মনে হয় ও সেই রংটা বুকুদার মুখে দেখতে পায়।
সরস্বতী পুজোর দিন চুপচাপ এক কোণেই বসেছিল রুহান। আর সবার কথা শুনছিল। আসলে বুকুদা আর জিয়ানা বলেছিল বলে ও গিয়েছিল। না হলে অমন বাড়িতে ঠিক কমফর্টেবল বোধ করে না ও। তখনই জিয়ানার বাবা-মায়ের কথার থেকে ও শুনেছিল যে, বুকু চিরকাল চুপচাপ। গম্ভীর। কম কথার মানুষ।
চিরকাল! রুহান অবাক হয়ে তাকিয়েছিল বুকুর দিকে। চিরকাল মানে? যে-বুকুদাকে ও চেনে সে তো ভীষণ ইয়ারকিবাজ ছিল। হাসত, পাড়ায় ক্রিকেট খেলত, মজা করত, আর প্রচুর কথা বলত। মুনাইদি তো নামও দিয়েছিল ‘বকবাস’। সেই মানুষটা চিরকাল গম্ভীর! জিয়ানার বাবা-মায়ের কাছে চিরকাল মানে তো বিয়ের সময় থেকে। তার মানে সেই সময় থেকেই বুকুদা গম্ভীর? নাকি তার একটু আগে থেকে? ওই মুনাইদির বাড়ির সেই ঘটনার থেকে?
তুতুল। ছোট্ট একটা পুতুলের নাম তুতুল। বুকুদার মেয়ে। অদ্ভুত গম্ভীর আর চুপচাপ একটা মেয়ে। রুহান চুপ করে বসে দেখছিল মেয়েটাকে। মাথাভরতি গোল্লা গোল্লা চুল। বড় বড় চোখ। যেন জিয়ানার মুখটাই কেটে বসানো রয়েছে। তুতুলও যেন ওকে দেখছিল। তারপর একসময় উঠে এসে দাঁড়িয়েছিল রুহানের সামনে। বলেছিল, ‘তুমি কি কিডন্যাপার?’
‘মানে?’ খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল রুহান।
‘তোমার কি ছুরি আছে? আর তাই দিয়ে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে বাচ্চাদের হাত-পা কেটে দিয়ে কি তুমি তাদের বাকেটে বসিয়ে রাখো? তাদের বেগার তৈরি করে দাও?’
‘মা-মানে?’ রুহান খুব ঘাবড়ে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল।
জিয়ানা সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসেছিল, আলতো ধমক দিয়ে বলেছিল, ‘আঃ তুতুল! আবার শুরু করলে?’ তারপর রুহানকে বলেছিল, ‘কিছু মনে কোরো না। ও এমন বলে।’
জিয়ানার মা উদ্বিগ্ন গলায় বলেছিল, ‘তুতুলকে কাউন্সেলিং করা মিষ্টি। এমন ভাল নয়, সবসময় এত ভায়োলেন্ট কথাবার্তা ভাল নয় একদম।’
জিয়ানা চিন্তিত মুখে বলেছিল, ‘ওদের স্কুল থেকেও এমন কমপ্লেন করেছে। বুকুকেও বলছি…কিন্তু…’
রুহান আন্দাজ করছিল ব্যাপারটা স্পর্শকাতর দিকে চলে যাচ্ছে। তাই খুব অস্বস্তিতে পড়েছিল। খুব অসহায়ও লাগছিল তার সঙ্গে। ও আড়চোখে তাকিয়েছিল বুকুদার দিকে। দেখেছিল বুকুদা পেপারে মুখ ঢেকে বসে রয়েছে।
জিয়ানা বলেছিল, ‘দেখছ তো মা। ওর কোনও হুঁশ আছে?’
বুকুদা পেপার সরিয়ে মুখ তুলেছিল এরপর, ‘হুঁশ? হয়তো তুতুলের সেটাই বেশি আছে। তাই হয়তো এমন করে বলে ও। ছোট তো, তাই এগুলো উপচে ওঠে ওর ভেতর থেকে। বেরিয়ে পড়ে। আর আমরা দেখি। কী করবে বলো তো ও? সকালবেলা পেপারে দেখে মানুষের মুন্ডু কাটা দেহ। মানুষ মেরে ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। বাচ্চারা বুলেট নিয়ে খেলছে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে মৃত মায়ের সামনে বসে বাচ্চা অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। টিভি খুললেই ব্যাট দিয়ে থেঁতলে মারা মানুষ। হাত-পা কেটে বস্তাবন্দি মানুষ। রক্ত আর রক্ত। খুন। জখম। কান্না আর চিৎকার। আর তার মাঝে মাঝে বডি ডিও আর সফ্ট ড্রিঙ্কস। এ কোন পৃথিবী আমরা ওর সামনে রেখেছি? ও যা দেখবে তাই তো আঁকবে। কোথায় কাউন্সেলিং করাবে? পৃথিবীটা কি ডিজনিল্যান্ড? কোন ডাক্তার চিকিৎসা করবে এই রোগের? সে নিজে হয়তো গ্রামে না গিয়ে ফাঁপানো প্র্যাকটিস খুলে বসেছে শহরে। সে ওষুধ কোম্পানির টাকায় বিদেশ ঘুরতে যায়। যার নিজের জীবনেই এত লোভ আর ভায়োলেন্স সে কী করে চিকিৎসা করবে ওর? গোটা পৃথিবীরই তো কাউন্সেলিং দরকার।’
রুহান অবাক হয়ে তাকিয়েছিল বুকুদার দিকে। এ কোন বুকুদা? ও দেখেছিল জিয়ানাও অবাক। মুখ হাঁ হয়ে আছে। বুকুদা এমন করে কোনওদিন বলতে পারে তা রুহান ভাবেইনি। ছোট্ট তুতুলও ভয় পেয়ে ঘাবড়ে গিয়েছিল। চুপ করে তাকিয়েছিল বাবার দিকে।
বুকুদা আবার খবরের কাগজটা তুলে মুখ ঢেকে নিয়েছিল। তারপর খানিকটা যেন নিজের মনেই বলেছিল, ‘সুকুমার রায় পড়াও, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
ঘরটার দু’দিকে দড়ি বেঁধে কেউ যেন ডুবিয়ে দিয়েছিল গভীর জলের ভেতরে। সবাই চুপ করে গিয়েছিল। সবার চলাফেরাও যেন কেমন স্লথ হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে এসে পড়া ললিতও কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। পুজোর দিনে এমন পরিবেশ, মোটেও ভাল লাগছিল না রুহানের। তাই সবার সামনে ও পকেট থেকে একটা কয়েন বের করে সেটা তুলে ধরেছিল তুতুলের সামনে। বলেছিল, ‘এটা কী বলো তো?’
সবাই তাকিয়েছিল। আর তুতুল পরিবেশের গাম্ভীর্য বজায় রেখে, গম্ভীরভাবে বলেছিল, ‘কয়েন তো। কেন তুমি চেনো না? আমায় জিজ্ঞেস করছ কেন?’
রুহান হেসে বলেছিল, ‘এই দেখো।’ তারপর দু’হাত দিয়ে কয়েনটা চেপে হাতের পাতায় বন্ধ করেই হাতটা খুলে শূন্য হাতের পাতা দেখিয়ে বলেছিল, ‘কোথায় গেল?’
কয়েন গায়েব দেখে তুতুল অবাক হয়েছিল খুব। বলেছিল, ‘সত্যিই তো কোথায় গেল?’
রুহান ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলেছিল, ‘তুমি নিয়েছ, ফেরত দাও।’
‘হোয়াট আ লায়ার!’ তুতুল চোখ বড় করে গালে দু’হাত রেখে বলেছিল, ‘আমি নিইনি। সত্যি বলছি। মাম্মাকে জিজ্ঞেস করো।’
‘নাওনি?’ বলেই হাতটা তুতুলের কানের কাছে নিয়ে সেখান থেকে কয়েনটা নিয়ে এসে রুহান চোখ পাকিয়ে বলেছিল, ‘এইটা কী? তুমি না নিলে এটা কোথায় পেলাম?’
প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে উঠে তুতুল হেসে উঠেছিল হো হো করে। হাততালি দিয়ে বলেছিল, ‘ও হো, ম্যাজিশিয়ান?’
জিয়ানার বাবা-মাও খুব খুশি হয়েছিলেন। ললিতও হাততালি দিয়েছিল বেশ। আর বুকুদা পেপারটা না সরিয়েই বলেছিল, ‘এখনও এসব পারিস তা হলে?’
পারে। এসব রুহান এখনও পারে। একা-একা রাতে বসে হাত সাফাই প্র্যাকটিস করে ও। ভাল লাগে। নিজের কষ্ট করে শেখা জিনিসটা আর অবহেলায় হারাতে চায় না। মা অবশ্য জানে না। কেউই তেমন জানে না। আর সত্যি বলতে কী, রুহান চট করে এসব অন্যের সামনে বেরও করতে চায় না। মনে হয়, কী হবে নিজেকে জাহির করে? ও তো আর প্রফেশনাল ম্যাজিশিয়ান নয়। এমনি শখের টানে এসব করে। লোকে নাই জানল। তাতে কী এল গেল? কিন্তু সেদিন ঝুলি থেকে বেড়াল বের করতেই হয়েছিল। না হলে যে, ঘরের ভেতর বড্ড মেঘ জমছিল!
লেভেল ক্রসিং-এ গিয়ে দাঁড়াল রুহান। বজবজ থেকে ট্রেন শিয়ালদা যাচ্ছে। ও বুঝল আবার পকেটে নড়ছে ফোনটা। এই রে! ও বের করল। আবার আদি! আশ্চর্য! ফোনটা ধরছে না রুহান। কারণ, ও ধরতে চায় না। এই সিম্পল ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না? বিশেষ করে গত কয়েকবারে যা ব্যবহার করেছে ও, তারপর আর ইচ্ছে করে ফোন ধরতে? ও ফোনটার দিকে তাকাল। বেজে চলেছে। সামনের স্টেশন থেকে লম্বা ভোঁ দিয়ে ট্রেন ছাড়ল। আর তার আওয়াজে ঢাকা পড়ে গেল ফোনের শব্দ। শুধু কম্পনটা বুঝতে পারল রুহান। ফোনের রিংটা আবার সাইলেন্ট করে দিল। ধরতে সত্যিই ইচ্ছে করছে না। আদির কথাগুলো এখনও স্পষ্ট কানে বাজছে ওর।
মালিনীকে সেদিন আদির বাড়িটা ও-ই চিনিয়ে দিয়েছিল। তারপর নিজে বসেছিল নীচে, মালিনীর গাড়িতে। বাড়িটার দিকে তাকিয়ে মনখারাপ হয়ে যাচ্ছিল রুহানের। কত এসেছে এই বাড়িতে। ওই সেই দরজা। ওপরে উঠে যাওয়ার সিঁড়ি। আর ওই দক্ষিণ দিকের সেই জানালা। লাল-নীল-সবুজ কাচ বসানো। ওটাই তো কিগানদার ঘর। ওখানে কত আড্ডা দিয়েছে ওরা। গিটার শুনেছে কিগানদার থেকে। শিঙাড়া আর মুড়ি খেতে খেতে ক্রিকেট দেখেছে। কত রাতে থেকেও গেছে! এই বাড়িটা তো ওর বড় হয়ে ওঠার একটা অঙ্গ। আর তার ভেতর কোত্থেকে যে কী হল! সব ভেস্তে গেল। মাঝপথে খেলা ভেঙে কোথায় যে চলে গেল কিগানদা! জানে না ও। আদিও বলে না। গোটা একটা মানুষ চলে গেল আর কারও যেন সে বিষয়ে হুঁশবোধ নেই!
রুহান মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে নিজেকে। ও কেন নিজের থেকে যোগাযোগ করে না? কেন এমন ও নিজেও প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে রইল? কেন একবারও ও গেল না কিগানদার কাছে? লজ্জা! রুহানের মনে হয় কিগানদাকে যদি জিজ্ঞেস করতে হয় কেন ও চলে এল, কিগানদা নিশ্চয়ই উত্তর দিতে লজ্জা পাবে। তাই, ও সেই অবস্থাটা থেকে পালাতে এসবের ভেতর ঢুকতে চায় না। রুহান জানে না, এটা কতটা জোরালো ব্যাখ্যা। তবু, ব্যাখ্যা বটে একটা, অন্তত নিজের কাছে।
এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ও দেখেছিল আদি আর মালিনী এগিয়ে আসছে গাড়ির দিকে। ও সচেতন হয়ে সোজাভাবে বসেছিল। গাড়িটা মালিনীর। ও-ই চালিয়ে নিয়ে এসেছিল। রুহান সামনের সিটে মালিনীর পাশেই বসেছিল।
আদি গাড়ির কাছে এসে খুব বিরক্ত হয়েছে এমন মুখ করে বলেছিল, ‘আরে, তুই? কী করছিস তুই? মালিনীকে বাড়ি চিনিয়ে এনেছিস?’ তারপর মালিনীর দিকে তাকিয়ে রাগের গলায় বলেছিল, ‘এই তোমার সারপ্রাইজ! একটা ভোঁদাই কেষ্ট!’
মালিনী বলেছিল, ‘ছিঃ আদি। ডোন্ট বি রুড। রুহান খুব ভাল ছেলে।’
‘ভাল!’ হেসেছিল আদি, ‘আপনি ভাল মিসেস বড়ুয়া?’
লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল রুহান। কবে স্কুল লাইফে কোন টিচারের সঙ্গে একটু কী হয়েছিল, সেটা কেন বারবার টানে আদি আর আবেশ? অবশ্য ভুলটা ওর নিজের। অল্প বয়সে কেরামতি দেখিয়ে ও কতটা ইরেজিস্টেব্ল সেটা বন্ধুদের বোঝাতে গিয়ে পুরো ঘেঁটে গেছে সব। তখন এমন না করলে মালিনীর সামনে অমন কথা বলতে পারত আদি?
মালিনী জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মিসেস বড়ুয়া মানে?’
আদি ভুরু নাচিয়ে বলেছিল, ‘বলব নাকি রুহান?’ তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, ‘যা পিছনের সিটে বস গিয়ে। সামনে বসেছে!’
‘কী হচ্ছে কী?’ মালিনী অবাক হয়ে তাকিয়েছিল আদির দিকে, ‘তুমিও তো পিছনে বসতে পারো, না?’
‘ইউ ওয়ান্ট মি টু লিভ?’ আদি ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল মালিনীর দিকে।
মালিনী এক মুহূর্ত আদিকে দেখে ঠান্ডা গলায় বলেছিল, ‘দ্যাটস ইয়োর চয়েস। ডোন্ট এভার শো মি দ্যাট অ্যাটিটিউড।’
রুহান আর পারেনি। তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে পিছনের সিটে গিয়ে বসেছিল। বলেছিল, ‘আদি, প্লিজ বাদ দে। আমি পিছনেই বসছি। ছেলেমানুষি করিস না। নে চল।’
মালিনী আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু এসব একদম ভাল লাগছিল না রুহানের। ও হাত জোড় করেছিল, ‘প্লিজ মালিনী, আমরা কেউ ক্লাস ওয়ানে পড়ি না। বসলেই হল। গোল্ডিজ অনেকটা দূর আর দেরি কোরো না।’
মালিনী কড়া চোখে আদিকে মেপে গাড়িতে উঠেছিল। আদিও সামনের সিটে বসে মাথা ঘুরিয়ে রুহানকে বলেছিল, ‘আগেই নেমে যেতে পারতিস, ফালতু মালিনীকে রাগিয়ে দিলি।’
মালিনী কিছু বলার আগেই রুহান হেসে উঠেছিল জোরে। যেন আদি খুব একটা মজার কথা বলেছে। ঝামেলার চেয়ে এসব কথা গায়ে না মাখলেই হয়। জীবনে সব কথা ধরলে কষ্ট ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। অন্তত, নানারকম অশান্তি পার হয়ে এই বয়সে এসে পৌঁছে এই সার কথাটাই বুঝেছে রুহান।
সারাটা পথ রুহান কথা বলেনি খুব একটা, শুধু হুঁ হাঁ করে গিয়েছিল। আদিও তেমন কথা বলছিল না। শুধু চাপা গলায় একবার মালিনীকে জিজ্ঞেস করেছিল গতকাল কেন মালিনী ফোন করেনি ওকে! কেন খবর নেয়নি ওর! মালিনী গম্ভীর হয়ে বলেছিল, ‘এটা আমার ডিউটির মধ্যে পড়ে না।’
জোকায় পৌঁছোতে দুপুর হয়ে গিয়েছিল। মালিনীর সঙ্গে ঘুরছিল আদি। আর রুহান একটু আলাদা, একলা হয়ে ঘুরছিল। তবু লক্ষ রাখছিল মালিনীকে। কী অসম্ভব যত্নের সঙ্গে ও বয়স্ক মানুষদের পরিচর্যা করছে! কী আন্তরিকভাবে কথা বলছে। যেন সেই মানুষটাই পৃথিবীর কেন্দ্র। মুগ্ধ হচ্ছিল রুহান। এমন মেয়ের সঙ্গে প্রেম করার কথা ও ভাবল কী করে? এ যে অবাস্তব! এমন মেয়েকে তো ‘আপনি-আজ্ঞে’ করবে ওর মতো ছেলে! রুহান তাই ক্রমশ পিছোচ্ছিল। মনে মনে।
বিকেল শুরুর মুখে খেতে বসেছিল ওরা। মালিনী বলেছিল, ‘এই বৃদ্ধ বয়সটা ইজ লাইক উইন্টার। নো ফ্লাওয়ার্স, নো চেরি ট্রি, নো ফ্রুটস, নো নাথিং। শুধু ঠান্ডা, ধূসর একটা ঢালু মাঠ যেন। গুরুত্বহীন, ইউজ্ড আপ ল্যান্ড। লাইক ওয়েস্ট ল্যান্ড। খুব ইনসিকিয়োর্ড একটা সময়। যে-মানুষগুলো সারাজীবন সংসার নিয়ন্ত্রণ করে, একটা পিভটের মতো কাজ করত, হঠাৎ তারা এখন অ্যাপেনডিক্স হয়ে গেছে। জানো, এদের কথা “শুনব না” বলার লোকটুকুও নেই। জানো তো কাউকে “না” বলার চেয়ে অবজ্ঞা করা আরও সাংঘাতিক আঘাত। এরা সেই আঘাতে আহত সব মানুষ। তাই এদের কাছে আমি আসি। আমি তোমাদের এখানে নিয়ে এসেছি, কারণ, আমি চাই, তোমরাও, ইন ইয়োর ওন স্মল ওয়ে ওদের এন্টারটেন করো। মেক দেম ফিল ইমপর্ট্যান্ট। মেক দেম ফিল ওয়ান্টেড।’
খুবই সামান্য সব কথা। তবু মুগ্ধতা বাড়ছিল রুহানের। আর সঙ্গে সঙ্গে প্রেমের থেকে দূরে আরও দূরে ছিটকে যাচ্ছিল ও। বরং একসময় মালিনীকে অমনভাবে দেখেছিল বলে নিজের প্রতি কেমন বিরক্তি আসছিল। ওর মনে হচ্ছিল, মালিনীকে ওর সঙ্গে মানাবে না একদম।
খাওয়া শেষে মালিনী একটু উঠে গিয়েছিল ভেতরে। তখন রুহান বলেছিল, ‘আদি, মালিনী সত্যিই খুব অদ্ভুত মেয়ে, বল? অত বড়লোকের মেয়ে হয়ে চাকরি করছে। পাশাপাশি এমন করে আর্তদের, বয়স্কদের সেবা করছে। খুব ভাল মেয়ে, না?’
‘ভাল? তাতে তোর কী রে? ফালতু লোনা করিস না রুহান। এ তোর মিসেস বড়ুয়া নয় যে, লাগিয়ে কেটে পড়বি। শালা, যদি ঢ্যামনামো করতে দেখি না, তবে একদম হাড় ভেঙে দেব তোর, বুঝেছিস?’
আদির বাবা একবার খুব দামি ঘড়ি দিয়েছিল ওকে। তখন ওরা স্টুডেন্ট। হাতে পয়সাকড়ি থাকত না বিশেষ। আর অত সুন্দর ঘড়ি রুহান দেখেওনি কোনওদিন। ও আদিকে বলেছিল, ‘কী সুন্দর ঘড়ি রে আদি, দারুণ দেখতে।’
আদি অবজ্ঞার সঙ্গে বলেছিল, ‘বাবা দিয়েছে। বিদেশি। তোর পছন্দ?’
‘খুব সুন্দর,’ রুহান আলতো করে হাত বুলিয়েছিল ঘড়িটায়।
‘এই নে,’ ঘড়িটা এক নিমেষে খুলে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল আদি।
‘মানে? পাগল নাকি?’ রুহান থতমত খেয়ে গিয়েছিল।
‘কেন? তোর পছন্দ যখন, নে। কোনও প্রবলেম নেই।’
রুহান নেয়নি। কিন্তু ছাত্রজীবনে, অত অবহেলায়, নির্মোহ হয়ে কাউকে ও অমন সুন্দর জিনিস দিয়ে দিতেও দেখেনি।
সেই আদি ওকে অমন কথা বলছে! রুহানের গলার কাছটা ব্যথা করছিল। কষ্ট হচ্ছিল। ভাবছিল একবার জিজ্ঞেস করে, ‘আদি, তোর সেই ঘড়ির ব্যাপারটা মনে আছে?’ কিন্তু জিজ্ঞেস করেনি। রুহান বুঝেছিল ছোটবেলাটা বহু দিন আগে ফেলে এসেছে ওরা। ফেলে আসা সেইসব চিহ্ন ধরে আর অতীতে ফিরে যাওয়া যায় না। ফলে সময়ের ভাঁজে হারিয়ে যাওয়া সেই আদি, হারিয়েই যায়।
লেভেল ক্রসিং পার করেই বাঁ দিকে একটা কোল্ড ড্রিঙ্কের দোকান দেখল রুহান। একটা ঝাঁজালো কোল্ড ড্রিঙ্ক খেয়ে দেখা যেতে পারে, একবার ভাবল ও। তারপর দাম চিন্তা করে অন্য দিকে দৃষ্টি ফেরাল। কাউন্টারের ওপরে একটা জলের জাগ রাখা আছে। চাইলে নিশ্চয়ই খেতে দেবে। ও দোকানটার দিকে দু’পা এগিয়ে গেল। আর ঠিক তখনই আবার ফোনটা বাজল। রুহানের রাগ হল এবার। আদির কি এমনি গালাগালি করে শখ মেটেনি যে বারবার ফোন করছে? ভাবল, একবার ধরে শুনেই নেয়, ব্যাপারটা কী। তারপর যদি খারাপ কিছু বলে, তা হলে না হয় কেটে দেবে লাইন। না হলে তো বারবার ফোন করেই যাবে। ও রাস্তার পাশে সরে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করল। আর তারপরেই আশ্চর্য হল, আরে, এটা কার নম্বর!
রিংটা হচ্ছে এখনও। ফোনটা কাঁপছে। নম্বরটা কিছুতেই চিনতে পারছে না রুহান। আচ্ছা, আদি আবার অন্য নম্বর থেকে ফোন করছে না তো! ধরবে? দ্বিধার সঙ্গে ফোনটা ধরল রুহান, ‘হ্যালো?’
‘এটা কি রুহানবাবুর নম্বর?’ একটা নরম মেয়েলি গলায় প্রশ্নটা এল।
‘আপনি কে বলছেন?’ রুহান পালটা প্রশ্ন করল।
‘এটা কি রুহানবাবুর নম্বর?’ গলাটা এবার যেন সামান্য অধৈর্য।
‘হ্যাঁ, বলছি।’
‘ও,’ গলাটা থমকাল এক মুহূর্ত। তারপর বলল, ‘নমস্কার, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?’
‘নিশ্চয়ই বলা যাবে। তবে তার আগে যদি কাইন্ডলি একটু বলতেন আপনি কে বলছেন?’ রুহান নরম গলায় পালটা প্রশ্ন করল।
‘আপনি আমায় চিনবেন না। আপনার একজন খুব পরিচিত মানুষ আমাকে আপনার নম্বরটা দিয়েছেন। বলেছেন যে, আপনি আমায়, মানে আমাদের হেল্প করতে পারবেন।’
‘তাই? কিন্তু আমি কি জানতে পারি আপনার নামটা?’
‘সরি,’ মেয়েটি হাসল, তারপর বলল, ‘আমার নাম সৌদামিনী চক্রবর্তী। তবে সবাই আমায় রাহি বলে। তা বলি আমার বক্তব্য?’
রাহি? এ কে? রুহান টালুমালু চোখে উলটো সিঁথি কাটা কলকাতার দিকে তাকাল। ভাবল, এ আবার নতুন কে এল ওর ভাঙাচোরা গল্পে?