১৪
ললিত ওর দূর সম্পর্কের মামা। মানে মায়ের খুড়তুতো ভাই। আচ্ছা, এটা কি খুব একটা দূরের সম্পর্ক? কে জানে। মা তো বলে, ‘তোর দূর সম্পর্কের মামা।’ কী ভিত্তিতে বলে মা? ললিত খুব একটা যোগাযোগ করে না বলে? না নিজের ভাই নয় বলে? আসলে এইসব কাছের বা দূরের ব্যাপার দিয়ে সম্পর্ক মাপাটা ঠিক বোঝে না দিঘি। দূরের মানুষ মানে কি মনে থেকে দূরে না অবস্থানের থেকে দূরে? আর যে কাছের? সে? পাশে বসে রয়েছে বলেই কি সে কাছের? নিজের চিন্তাগুলো মাঝে মাঝে নিজের কাছেই ধাঁধার মতো মনে হয় ওর। কিন্তু উত্তরও যে পায় না! তাই মনের মধ্যে সবসময় একটা অস্বস্তি হয় ওর।
সার্দান অ্যাভিনিউয়ের ওপর এই বিশাল বাড়িটা আর্যদের। অনেকটা দুর্গের মতো। তিন-চারটে বড় বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে সবসময়। এর কয়েকটায় দিঘি চড়েওছে। আগে কয়েকবার এসেছে দিঘি। বাড়ির ভেতরে সুইমিং পুলও রয়েছে। একটা জিম রয়েছে। কিন্তু কোনওটাই আর্য তেমনভাবে ব্যবহার করে না। শারীরিক পরিশ্রমের ব্যাপারে একটা অনীহা রয়েছে ওর। তাই হয়তো একটু মোটা হয়ে যাচ্ছে। আসলে লম্বা বলে চট করে বোঝা যায় না, কিন্তু যখনই জড়িয়ে ধরে ওকে, ও বোঝে আর্যর শরীরে মেদ বাড়ছে। অবশ্য তা নিয়ে বললে আর্য গা করে না। বলে, ‘অমন সিক্স প্যাক, এইট প্যাক অ্যাব্স বানানো আমার কম্ম নয়। আমি পড়াশোনাতেই ইন্টারেস্টেড। আর পড়াশোনা করতে গেলে অমন শরীরচর্চা হয় না। কোনও পালোয়ান কোনও কোম্পানির সিইও হয়েছে তুমি শুনেছ?’
দিঘি ওকে বাধা দেয়, ‘আঃ, পালোয়ান হতে কে বলেছে? তা বলে ধীরে ধীরে কুমড়োপটাশ হবে! একটু ফ্রি হ্যান্ড তো করতেই পারো। তাতে কি খুব সময় নষ্ট হয়?’
আর্য উত্তরে বলে, ‘দেখো, ওসব আমার দ্বারা হবে না। ব্রেন থাকতে শরীরটাকে খাটিয়ে কী লাভ?’
সব কিছুতেই কি আর লাভ লোকসান হয়? কিন্তু আর্যকে কে বোঝাবে? আর শুধু আর্য কেন? আশপাশের সমস্ত মানুষজনকেই বা কে বোঝাবে? সবাই তো সবসময় লাভ আর লোকসান নিয়ে পড়ে থাকে। সে বাবা-মা বলো আর বন্ধুবান্ধব। সবাই যে কেন সবসময় লাভ হবে কিনা জিজ্ঞেস করে, কে জানে! হয়তো এমনিই বলে। কথার কথা। কিন্তু তবু লাভ-লোকসানটা জীবনের এমন একটা জায়গায় ঢুকে গেছে মানুষের যে, তা উপচে বেরিয়ে আসে। আসলে দিঘিও তো আগে বলত এমন। বলত, ‘কী লাভ বলো?’ কিন্তু আর বলে না। ওই মানুষটা একদিন আলতো করে বলেছিল তো যে, লাভ-লোকসান বলাটা খুব মনোরম কিছু নয়।
দোলের কিছুদিন পরের ঘটনা। মায়ের সঙ্গে হঠাৎই গন্ডগোল হয়েছিল দিঘির। আসলে মা সবসময় পড়া নিয়ে খিচখিচ করত। যেন ও বাচ্চা মেয়ে। আরে বাবা, ওর কি কোনও দায়িত্ব নেই? মাকে তাই নিয়ে বলতেই মা খুব বকেছিল। বলেছিল, ‘বড় হয়ে গেছিস, না? খুব লম্বা-চওড়া কথা শিখেছিস দেখছি! পড়তে বসার নাম নেই শুধু ফালতু গল্প। হয়েছেও সব একগাদা বাজে বন্ধু।’
‘বন্ধুদের নিয়ে কিছু বলবে না,’ দিঘি চিৎকার করে উঠেছিল, ‘আর আমার পড়া আমি ঠিক পড়ে নেব। আমার জন্য তোমাদের অত ভাবতে হবে না।’
‘মানে?’ মা চট করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সামনে, ‘এত বড় কথা বলছিস তুই? এক দিদি তো হাড় ভাজা ভাজা করে খাচ্ছে। তার ওপর তুইও এমন কথা বলছিস? খুব লায়েক হয়ে গেছিস, না?’
‘দিদিকে মানুষ করতে পারোনি, সেটা কি আমার দোষ?’ দিঘির যে সেদিন কী হয়েছিল!
মা চিৎকার করেছিল আবার, ‘তুই…তুই…অসভ্য মেয়ে। অসভ্যতা করছিস? তোর লজ্জা করে না? তুই এত বড় কথা বলিস? এত বড়…’
‘বেশ করব।’ দিঘি রাগ করে বিছানা থেকে নেমে বেরিয়ে যাচ্ছিল ঘর থেকে।
‘বেশ করবি?’ মা আর পারেনি। পাশ দিয়ে জোর পায়ে হেঁটে যাওয়া দিঘির হাত ধরে এক হ্যাঁচকায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। দিঘিও এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়েছিল একদম। মা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল দিঘির দিকে।
দিঘি চিৎকার করে বলেছিল, ‘ডোন্ট টাচ মি। জাস্ট ডোন্ট টাচ মি।’
ঠাস করে চড়টা এসে চোয়ালের কাছে লেগেছিল দিঘির। মনে হয়েছিল নিমেষের মধ্যে কে যেন লক্ষ লক্ষ ফোঁটা বিষ ঢেলে দিয়েছে গালে। মাথাটাও সামান্য টাল খেয়ে গিয়েছিল। চোখে জল চলে এসেছিল ওর। মা মারল? এমনভাবে মারল ওকে? গায়ে হাত দিল? কী এমন কথা বলেছিল ও যে, এমনভাবে গায়ে হাত দেবে মা? কেন মা এমন করে? দিদি সারাজীবন এত ঝামেলা করে গেছে, কই তখন তো বাবা-মা কিছু বলতে পারেনি? আজ এখন যত রাগ, তেজ, শাসন সব ওর ওপরে? মা পারত কোনওদিন দিদিকে এমনভাবে মারতে? না, পারত না। কোনওদিন পারত না। তা হলে? ওকে মারল কেন? ও সারাজীবন বাবা-মায়ের কথা শোনে, তাই?
দিঘি মায়ের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। বিষের ফোঁটাগুলো ক্রমশ গাল থেকে রক্তের সঙ্গে এসে মিশছিল বুকের ভেতরে। মাথাটা পাগল-পাগল লাগছিল। কোথায় গেলে যে বিষগুলো শরীর থেকে বের করতে পারবে বুঝতে পারছিল না। ও কোনওমতে পাতলা স্লিপারটা পায়ে গলিয়ে আর টেবিল থেকে ব্যাগটা তুলে বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। ভেবেছিল চলে যাবে। এদের থেকে অনেক দূরে চলে যাবে।
বাইরে বেরোতেই সন্ধের কলকাতা যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওর ওপর। মিষ্টির দোকান, পুরনো বাড়ির বারান্দা, চপের টং, স্ন্যাক্স ভাণ্ডার, বাজারের লোকজন, সব উন্মাদের মতো যেন লাফাচ্ছিল চারদিকে। এই শহরটা কি একটা পাগলাগারদ? এখানে কি কেউ সুস্থ নয়? কেউ স্বাভাবিক নয়? এর ভেতর, সত্যিই তো, কোথায় যাবে, কতদূরে যাবে দিঘি?
সেই বাড়ির দরজাটা খোলা ছিল অর্ধেক। ভেতর থেকে লাজুক কিশোরের মতো একরত্তি আলো এসে পড়ছিল ফুটপাথে। দিঘির চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল ক্রমশ। ছোট্ট লাজুক আলোটা যেন দুলছিল। যেন ডাকছিল ওকে। ও তাকিয়েছিল ওপরের দিকে। দক্ষিণের জানলায় আলো দেখা যাচ্ছিল। নীল, হলুদ, লাল, সবুজ কাচের ওই রঙিন জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল নরম একটা আলো। দিঘির হঠাৎ ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল মাথাটা। ওই লম্বা মানুষটা যেন টানছিল ওকে। ওই দুঃখী মুখ, না কামানো গাল আর ওই নীলচে চোখ যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছিল দিঘিকে। সম্মোহিত খরগোশের মতো দিঘি উঠে গিয়েছিল সিঁড়ি দিয়ে। ঠাকুরমা কই? ওর মনে প্রশ্ন আসেনি। ফ্রস্টেড আলোর করিডর ধরে সাদাকালো দাবার ছকের মতো মেঝে ছুঁয়ে না ছুঁয়ে, দিঘি এসে থেমেছিল সেই ঘরের সামনে। সেই লেমন রঙের পরদা, তার তলা দিয়ে গড়িয়ে আসা নরম আলো, আর গিটারের টুং-টাং।
কোনওরকম নক করেনি দিঘি। সোজা ঢুকে গিয়েছিল ঘরে। কিগান খেয়ালই করেনি। দিঘি দেখেছিল মাথা নিচু করে মানুষটা দরজার দিকে পিছন করে বসে বাজিয়ে যাচ্ছে গিটার। আচ্ছা মানুষ তো! চেয়ারটার শব্দ করে টেনে তার ওপর ধপ করে বসে পড়েছিল দিঘি। আর সেই শব্দে এবার মুখ তুলে তাকিয়েছিল কিগান। চোখমুখে অবাক ভাব। আসলে হঠাৎ দিঘিকে দেখেই অমন হয়েছিল ওর।
কিগান গিটারটা নামিয়ে রেখে ঘুরে বসেছিল, ‘তুমি?’
‘কেন, আসতে নেই?’ গলায় ধারালো ছুরির মতো কথা ঝুলছিল দিঘির।
‘তা কেন?’ হেসেছিল কিগান, ‘আমি বলতে চাইছি, তোমার কি মুড অফ?’
দিঘি কিছু বলার আগেই করিডরে মায়ের গলার স্বর শুনেছিল। হৈম ঠাকুরমার গলাও শুনেছিল। দিঘি চোয়াল চেপে রাগের গলায় বলেছিল, ‘ওই যে এসেছে। হল তো শান্তি, আমি এবার যাব।’
কিগান হাসছিল তখনও, ‘মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে?’
‘মা? ফালতু যত্ত সব। কী লাভ এমন মা থেকে? এখন আবার ঢং করে ডাকতে এসেছে! এমন মা থাকলে লাভের চেয়ে লোকসান বেশি। ডিসগাস্টিং।’
‘ডিসগাস্টিং!’ কথাটা শুনে হঠাৎ চোখমুখ শক্ত হয়ে গিয়েছিল কিগানের, ‘এমন করে কেউ বলে?’
দিঘি রাগের গলায় বলেছিল, ‘তুমি বুঝবে না। এমন করেই বলে। মা যে কেমন করে আমার সঙ্গে তুমি জানো না। তোমার মা নেই তো, তাই বুঝবে না তুমি।’
‘সেই জন্যই তো বলছি, এমন করে বলতে নেই। মা নেই বলেই বলছি। জানো, আমার মায়ের কথা মনে পড়লেই একটা লাল হয়ে যাওয়া চেরি গাছ দেখতে পাই। মনে হয় বাইরে, কোথায় যেন বরফ পড়ছে। আর টেপ রেকর্ডারে বাজছে ক্রিসমাসের গান। জানো দিঘি, মাকে শেষ যেদিন দেখেছিলাম, একটা পার্পল ছাতা সরিয়ে মা হেসেছিল আমার দিকে তাকিয়ে। ওই শেষ, তারপর আর কিচ্ছু নেই। আমার মা বলতে এইটুকুই। আসলে কিন্তু এইটুকু নয়। এখানে এসে স্কুলে ভরতি হওয়ার পর বন্ধুদের মায়েরা নিতে আসত। ওদের টিফিন মায়েরা তৈরি করে পাঠাত। রেজাল্টের পর মায়েরা যখন ওদের আদর করত, আমি মাথা নিচু করে সরে আসতাম ওদের সামনে থেকে। গলায় কষ্ট হত খুব। বুকে চাপ লাগত। আমি চোখ বন্ধ করে ফেলতাম। দেখতাম পার্পল ছাতা সরিয়ে একঝলক মায়ের মুখ। মা হাসছে। এই না থাকাটা কি লোকসান? থাকলে তো মা নানা কারণে আমায় বকত। বাধা দিত নানা কাজে। আমারও রাগ হত। কে জানে হয়তো চড়চাপড়ও মারত আমাকে। তা, সেই দিক থেকে বিচার করলে কি তা হলে মায়ের না থাকাটা লাভ হয়েছে? তাও তো নয়। সব কিছু লাভ লোকসানে মাপা যায় না। মা, বাবা, বন্ধু, বান্ধব, ওদের লাভ লোকসানে মাপতে যেয়ো না। নিজেই কষ্ট পাবে। নিজেই পরে বুঝবে যে, কী পেলাম সেটা সবসময় বড় হয় না। মা হয়তো তোমার সঙ্গে আজকে রূঢ় ব্যবহার করেছে, কিন্তু সেটাই কি আসল মা? আমাদের সমস্যা কী বলো তো? মানুষের ভাল ব্যবহার মনে রাখি না। আর একদিনের রূঢ় ব্যবহারটা দিয়েই শুধু তাকে মাপতে যাই। রাগ তো রাগকেই বাড়ায়। তাই বলছি এমন ভেবো না। দেখবে কাল সকালে উঠেই সব ঠিক হয়ে গেছে।’
এর পরেই ঠাকুরমাকে নিয়ে মা ঘরে ঢুকেছিল। ঠাকুরমাও আলতো করে বকেছিলেন দিঘিকে। বলেছিলেন, ‘এমনভাবে হুট করে কেউ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে?’
দিঘি কিছু বলেনি। মাথা নিচু করে বসে ছিল।
মা বলেছিল, ‘খুব অসভ্য হয়ে গেছে আজকাল। একটু টোকা মেরেছ কী রাগ। খুব তেজ দেখাতে শিখেছে! কোত্থেকে শিখছে এসব জানি না? ওইসব বন্ধুবান্ধবদের পাল্লায় পড়েই তো।’
দিঘি চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘দেখলে তো কিগানদা? এর পরও তোমার কথা মাথায় রাখব?’
কিগান হেসে বলেছিল, ‘এর পরেও তো রাখতে হবে। অপ্রিয় হবে জেনেও যদি কেউ তোমায় শাসন করে, উদ্বিগ্ন হয়ে তোমার জন্য ছুটে আসে, তার কথা তো শুনতেই হবে, না?’
‘চল,’ মা এসে হাত ধরে টেনেছিল দিঘিকে।
দিঘি স্থির চোখে শুধু তাকিয়েছিল কিগানের দিকে। এলোমেলো চুল। কনুই অবধি গোটানো পাঞ্জাবি। সামান্য অন্যমনস্ক চোখ। দিঘির হঠাৎ কষ্ট হচ্ছিল খুব। মায়ের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিল কিগানকে। রাগ চলে গিয়ে অদ্ভুত এক শূন্যতা চেপে ধরছিল ওকে। মনে হচ্ছিল আজকাল কিগানকে এতটা মিস করে বলেই কি ওর কষ্ট হয় এরকম? তাই কি এমনভাবে মেজাজ হারায়? সারা পৃথিবীকে শত্রু মনে হয়? এসব কি কিগানের জন্যই হয়? আচ্ছা, ও কি খারাপ মেয়ে? বয়সে বড় এমন একজনের প্রতি এই যে টান অনুভব করে ও, এটা কি অনুচিত? সবাই জানলে কি ওকে খারাপ বলবে? তবু সবাইকে খুব বলতে ইচ্ছে করে ওর। সবার কাছে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করে কিগানের জন্য কতটা কষ্ট পায় ও। কতটা মনখারাপ হয়ে থাকে ওর। তবু বলতে পারে না। আর না বলা কথাগুলো ওর ভেতরে বোলতার মতো উড়তে থাকে।
সেদিন মায়ের পিছন পিছন চলে যেতে যেতে, করিডরের মাঝ বরাবর গিয়ে একবার পিছনে ফিরে তাকিয়েছিলে ও। আর অবাক হয়ে দেখেছিল, ঘরের থেকে ওর দিকেও অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে কিগান! ঘরের আলোয় ওর নীল রঙের চোখটা যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল দিঘি। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? দিঘি জানে অমনভাবে দেখতে পাওয়া যায় না। ও চোখের ভুল। নির্ঘাত চোখের ভুল। তবু সেই ভুলটুকু আজও মনের ভেতর রেখে দিয়েছে দিঘি। ও আজও হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পায় একজোড়া নীল চোখ ওকে দেখছে। তখন খুব অস্থির লাগে ওর। তখন এদিক-ওদিক তাকায় দিঘি। মনে হয় গোটা কলকাতাটাকে ওলটপালট করে খোঁজে একবার। মনে হয় বইয়ের মতো কলকাতাকেও ফরফর করে ওলটায়, ঝাঁকায়, মনে হয় এই বুঝি নীলচে মতো বইয়ের পাতার ভেতর থেকে টুপ করে খসে পড়বে ওই চোখজোড়া। তবু, পড়ে না। কলকাতা তার মতোই থাকে-চলমান, ভাবলেশহীন। দিঘি বোঝে আর কোনওদিন ওই চোখজোড়া ফিরে আসবে না। ও নিজেই যে হারিয়ে ফেলেছে তাদের!
আজ আর্যদের বাড়িতে একটা পার্টি আছে। আর্যর বাবা ব্যাবসার কিছু মানুষজনকে নেমন্তন্ন করেছেন। আর আর্য আলাদাভাবে নেমন্তন্ন করেছে নিজের বন্ধুবান্ধবদের। এখনও কেউ আসেনি তেমন। শুধু আর্য গাড়ি পাঠিয়ে সুবর্ণ আর দিঘিকে নিয়ে এসেছে। এ ছাড়াও জয়, রূপ আর স্নেহা আসবে। গুন্ডা কতটা আসবে বলা যাচ্ছে না। কারণ আর্য ঠিকমতো বলেনি ওকে।
আর্যর ঘরেই বসে রয়েছে দিঘি। ঘরটা খুব সুন্দর। হিন্দি ছবিতে এমন ঘর দেখা যায়। পুরোটা কার্পেট মোড়া। দেওয়ালে বিশাল বড় চ্যাপটা টিভি। এক দিকের দেওয়াল জুড়ে কাচের জানলা। তার সামনে ভার্টিকাল ব্লাইন্ডস। ঘরটা তিনতলায়, তাই সাদার্ন অ্যাভিনিউটা দেখা যায়। ঘরের চারদিকে বই আর ডিভিডি ছড়ানো। খাটের পাশে একটা বেডসাইড টেবিল। তাতে দিঘির একটা ছবি খুব কায়দা করে ফ্রেম করা। ছবিটা দেখেই ছ্যাঁত করে উঠল দিঘির বুক। এটা আর্য প্রায় জোর করে ওর বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল চারদিন আগে। দিঘি দিতে চায়নি তবু নিয়ে এসেছিল। বলেছিল, ‘কেন এমন করছ? আমি তো শুধু ছবি চেয়েছি, তাও দেবে না? তোমার এমন রাগ রাগ মুখটা যে কী সুন্দর তা তুমি জানবে কেমন করে!’
জানে, রাগ করলে ওকে যে সুন্দর দেখায় সেটা জানে দিঘি। না, আর্যর কথা নয়। কিগান বলেছিল ওকে। ছবিটা যে কিগানই তুলে দিয়েছিল। এক বর্ষার বিকেলে বাড়ির ছাদে তোলা হয়েছিল ছবিটা। দিঘির স্পষ্ট মনে আছে।
হাতের ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। আর্য কি? সুবর্ণ আর আর্য বিয়ার কিনতে গেছে। অনেকক্ষণই গেছে। আসতে দেরি হচ্ছে বলে কি ফোন করল? দিঘি খাপ থেকে মোবাইলটা বের করে নরম সোফাটায় হেলান দিয়ে বসল। অচেনা নম্বর। কে এটা? অচেনা নম্বর চট করে ধরে না দিঘি। তবু আজ ধরল। কেন, কে জানে, তবু ধরল, ‘হ্যালো?’
‘হাই দিঘি। কেমন আছ?’
গলাটা চট করে চিনতে পারল না দিঘি, ‘কে বলছ?’
‘বলো তো কে?’ ওপারের গলাটা হাসল এবার।
‘সরি, বুঝতে পারছি না।’ কোন মেয়ে ফোন করল ওকে? দিঘির আশ্চর্য লাগছে।
‘আমি হোমি। চিনতে পেরেছ?’
‘হোমি?’ এক মুহূর্ত থমকাল দিঘি। তারপরই মনে পড়ল, ‘আরে হোমিদি।’ বলে উঠল ও।
‘হ্যাঁ আমি। কেমন আছ তুমি?’
‘আমি? ভালই তো।’ দিঘি হাসল। কেমন আছ প্রশ্নটা খুব বোকা বোকা লাগে দিঘির। আচ্ছা, ঘ্যানঘ্যানে লোক না হলে কেউ বলবে যে, ‘আমি খারাপ আছি, অম্বলে ভুগছি। টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে জলের মতো, ঘুম হচ্ছে না।’ লোকে কেন যে ‘কেমন আছ’ ধরনের প্রশ্ন করে ভগবান জানে!
হোমি বলল, ‘সেই গুন্ডাদের বাড়িতে আলাপ হল। তারপর তো ভুলেই গেলে! বলেছিলাম না আমাদের এখানে আসতে? এলে না তো।’
দিঘি শব্দ করে হাসল এবার। শব্দটা ওই দিকে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই কতকটা। তারপর বলল, ‘আরে হোমিদি, কলেজ-পরীক্ষা কত কী ঝঞ্ঝাট বলো তো।’
‘তা হলেও,’ হোমি বলল, ‘তোমরা কলকাতার নামকরা কলেজে পড়ো। তোমরা এলে আমাদের কাজটা আরও জোরদার হবে। প্লাস গ্রামবাংলার একটা ট্রেলারও দেখে যাবে।’
‘যাব, নিশ্চয়ই যাব। দেখো, আমরা সবাই যাব।’ দিঘি আশ্বাস দেওয়ার মতো করে বলল।
‘আর দিঘি,’ হোমি এবার যেন সংকোচ করল একটু, ‘আসলে আর একটা কথা ছিল।’
‘কী কথা? বলো না। ডোন্ট হেসিটেট।’
‘কিছু ফান্ড যদি তোমরা জোগাড় করতে পারো ভাল হয়। আসলে, আমরা ঠিক করেছি যে, গ্রামে গ্রামে কিছু মেডিক্যাল ক্যাম্প করব। দু’-একটা ওষুধের কোম্পানির সঙ্গে কথা বলেছি। ওরাও হেল্প করবে বলেছে। কিন্তু বুঝতেই তো পারছ। বাংলার অজ গ্রাম। ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া, ডিসেন্ট্রির দেশ। তার ওপর ম্যালনিউট্রিশন। এ তো আফ্রিকার গ্রাম নয় যে, ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজের ড্রাগের বেআইনি টেস্টিং গ্রাউন্ড পেয়ে মক মেডিক্যাল ক্যাম্প করে ফাটিয়ে দেবে। তাই আমাদের নিজস্ব ফান্ডিংটা খুব দরকার। তোমরা একটু তোমাদের মতো করে দেখবে? কোনও প্রেশার নেই। জাস্ট বাবা-কাকাকে বলে টাকা জোগাড় করা আর বাড়তি, এক্সপায়ার্ড হয়নি এমন ওষুধ জোগাড় করা। যদি একটু দেখো।’
দিঘি বলল, ‘এমন করে বলছ কেন? আমি নিশ্চয়ই দেখব। বাকিদেরও বলব। স্নেহার এক কাকা ওষুধ কোম্পানিতেই আছে। হি মে হেল্প আস।’
‘সরি।’ হোমিও এবার শব্দ করে হাসল, ‘এতদিন পরে ফোন করে শুধু এই চাই, ওই চাই বলে গেলাম। আসলে কলকাতার থেকে দূরে থেকে এমন কাজ করা যে কী কঠিন না! ওষুধের কোম্পানিগুলোর ঝামেলা, পলিটিক্যাল ইন্টারফিয়ারেন্স, লোকজনের অশিক্ষা, ফান্ডের অভাব। ওই সোনালি চতুর্ভুজের কথা শোনো না? স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এসে দেখবে চতুর্ভুজটি ঠিক আছে, কিন্তু সোনালি নয়, তা লোহার। কারাগারের মতো। এত বাধা সামলিয়ে কি সহজে এগোনো যায়? যায় জানো, যদি লোকবল থাকে আর আমাদের কষ্টটাকে যদি ঠিকমতো পুট-আপ করা যায়। তাই বলেছিলাম যে, তোমরা এলে আমাদের খুব ভাল হত।’
দিঘি ফোনটাকে কানের থেকে সরিয়ে নিয়ে মাথাটা ঝাঁকাল একটু। ওরে বাবা, এ যে ভাঙা রেকর্ড একেবারে! কান ঝালাপালা করে দিল।
দিঘি বলল, ‘আমরা নিশ্চয়ই যাব। আর শোনো না, রাহিদি কেমন আছে গো?’
‘রাহি? ওর কথা আর জানতে চেয়ো না। সে তো মীরাবাই হয়ে গেছে।’
‘মীরাবাঈ!’ দিঘির অবাক লাগল, ‘সে কীরকম?’
‘আর বোলো না,’ হোমি গুছিয়ে নিল যেন কথাটা, তারপর বলল, ‘এখানের একজনের জন্য তো রাহি একদম লাট্টু। এদিকে সেই লোকটা মানে, কী…’
‘চুপ কর একদম,’ দিঘি হঠাৎ ফোনের ওপারে আর একটা গলা শুনল। একটু থমকে গেলেও তার পরমুহূর্তেই বুঝল এ রাহির গলা। মানে রাহিও আশপাশেই ছিল। হোমির কথায় লজ্জা পেয়ে এতক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক, দিঘি কে যে অমন পার্সোনাল কথা ওকে শুনতে হবে?
আসলে গুন্ডাদের বাড়িতে সেই ক্রিসমাসের দিনেই দুই বান্ধবীকে ভাল করে লক্ষ করেছে দিঘি। হোমি যেমন প্রচুর কথা বলে, ইয়ারকি করে, তেমনই রাহি আবার তার উলটো।
টমটমের এই ইংরেজি গানটা শুনে রাহির চোখ ছলছল করছিল। দিঘি লক্ষ করেছিল। রাহি দূরে ঝুলনের মতো করে সাজিয়ে রাখা যিশু আর মেরির পুতুলগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল অপলকভাবে। আর টমটমের গানের সঙ্গে সঙ্গে দিঘি দেখেছিল যে, রাহির চোখের কোণ দিয়ে সামান্য, খুব সামান্য, ভিতু, দুর্বল এক কুচি জল অভ্রর মতো চিকচিক করেছিল। কেন? কেন গানটা শুনে রাহির চোখে জল এসেছিল? নীল চোখের ছেলে মানে তো প্রিয় ছেলে। তা হলে কেউ কি বিশেষ প্রিয় আছে রাহির? তার কথাই বলতে চাইছে হোমি? আর তার কথা বলতে দেবে না বলেই কি ফোনটা কেড়ে নিল রাহি? সত্যিই তো যার জন্য চোখের জল ফেলে মানুষ, তার কথা কি আর লোকের সামনে ফলাও করে বলা যায়? বলা যায় না। দিঘি তো নিজেও বলতে পারে না। সবসময় তো মনে হয় বুকের ভেতর শূন্য একটা হাওয়া পাক মারছে। লাল ধুলো উড়ছে। জং ধরা একটা রেললাইন পড়ে রয়েছে। পাথরের ফাঁক দিয়ে ঘোলাটে চোখ তুলে উঁকি মারছে গিরগিটি। মনে হয়, সব থেকেও কে যেন নেই। কে যেন আর আসে না পাড়ায়। দক্ষিণের জানালার লাল-সবুজ কাচের ফাঁকে আর আলো জ্বলে না। আর আলো জ্বলবে না।
সেদিন যখন টমটম গান গাইছিল, ‘And now he’s gone and left me alone/ An orphan girl without a home’ দিঘিরও তো জল চলে এসেছিল চোখে। মনে হয়েছিল, সত্যিই তো তাই। তা ছাড়া আর কী? শুধু পার্থক্য এই যে, নিজেকে নিজেই একা করেছে দিঘি। কিগান তো প্রথম থেকে দিঘিকে বারণ করত। বোঝাত। নিষেধও করত। এমনকী দু’-একবার রাগও করেছে। কিন্তু দিঘি তো শোনেনি। আর ওর জন্যই কিনা এমনটা হল? কিন্তু কিগান তো কিছু বলল না? মাথা নিচু করে চলে গেল। আর দিঘি? ও কিছু বলতে পারল কি? পারল তো না! রাগ কি অন্ধ করে দিয়েছিল ওকে? কয়েকটা মাত্র কাগজ কি সব গন্ডগোল করে দিয়েছিল?
জানে না। দিঘি কিচ্ছু জানে না। ও শুধু জানে, শূন্য একটা হাওয়া পাক খাচ্ছে একা আর নির্জন রেল লাইন পড়ে রয়েছে দিগন্ত ছাড়িয়ে।
সেদিন গুন্ডাদের বাড়িতে খাওয়ার সময়, দিঘি নিজের থেকেই গিয়ে দাঁড়িয়েছিল রাহির পাশে। খুব সাবধানে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড। তোমার কি শরীর খারাপ? মানে, আর ইউ ফিলিং আনওয়েল?’
‘আমার!’ চমকে উঠেছিল রাহি। অপ্রস্তুত হয়ে হেসে বলেছিল, ‘কই, না তো কেন? হঠাৎ তোমার এমন মনে হল কেন?’
‘না, মানে…’ দিঘি আর কথা বাড়াতে চায়নি। বুঝতে পারছিল যে, রাহি অস্বস্তিতে পড়েছে। ও বলেছিল, ‘ইউ সিমড টু বি লিট্ল অফটিউন।’
‘তাই?’ রাহি খাবার প্লেট হাতে হেসেছিল। বলেছিল, ‘আসলে এত ভাল গাইছিল গানটা, তাই…হয় না? খুব আনন্দের কিছু হলেও আমাদের মন একটু খারাপ হয়ে যায়, না?’
‘হ্যালো? হ্যালো?’ দিঘির এবার হুঁশ হল। ফোনের ওপারে রাহির গলা।
রাহি বলল, ‘হ্যালো দিঘি, কেমন আছ?’
আবার সেই প্রশ্ন! দিঘির মনে হল বলে যে, ইকনমিক্সের সেকেন্ড পেপারটা এখনও ভাল প্রিপেয়ার হয়নি। গালে একটা বিরক্তিকর ব্রণ উঠেছে। গতকাল রাতে রুটি খাওয়া নিয়ে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। আর বলে যে, কিগানের জন্য ওর ভীষণ, ভীষণ, ভীষণ মনখারাপ করছে। সব মিলিয়ে খুব বিচ্ছিরি আছে ও। খুব বিদ্ঘুটে আছে।
দিঘি বলল, ‘আমি ভাল আছি। তোমরা সব ভাল তো?’
‘হ্যাঁ গো,’ রাহি হাসল, ‘তুমি এই হোমিটার কোনও কথা ধোরো না কিন্তু। ও আসলে খুব ফাজিল। তা তোমরা আসছ কবে? তোমাদের সঙ্গে আলাপ করে কিন্তু আমার খুব ভাল লেগেছিল। আমি এখানে দীপা আর মাকেও তোমাদের কথা বলেছি। তোমাদের আসতে হবেই কিন্তু। ওই হোমির হিজিবিজি কাজের জন্য না হলেও আমাদের বাড়িতে আসতে হবে। আমি কিন্তু কোনও অজুহাত শুনব না।’
দিঘি বলল, ‘তোমরাও এসো আবার।’
‘নিশ্চয়ই আসব। ঠিক আছে? আজ রাখি, কেমন?’
‘আচ্ছা।’ দিঘি দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। আসলে ওর আর ভাল লাগছে না।
ঘড়ি দেখল দিঘি। পৌনে সাতটা। সুবর্ণ আর আর্যর এত সময় লাগছে কেন? আর অন্যরাও এখনও পৌঁছোতে পারল না কেন? আর কতক্ষণ এখানে একা-একা বসে থাকবে ও সঙের মতো? একটা কি ফোন করে দেখবে? দিঘি ফোনটার দিকে তাকাল। তারপর ভাবল না, দেখবে না। কেন দেখবে? দিঘি যে একা আছে সে ব্যাপারে কি কারও মাথাব্যথা আছে? ও সেধে পড়ে ফোন করতে যাবে কেন?
দিঘি ফোনটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। এখানে ঢোকার সময় নীচের লনে যে-পার্টি চলছে সেখানে ললিতের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তবে বিশেষ কথা হয়নি। এবার নীচে গিয়ে ললিতের সঙ্গে একটু কথা বললে অন্তত কিছুটা সময় কাটবে।
আর্যদের বাড়িটা দিঘির চেনা। আর্যর ঘর থেকে বেরিয়ে একটা বিরাট বড় বসার ঘর আছে, তার শেষ প্রান্তে নীচে যাওয়ার সিঁড়ি। সিঁড়ির পাশের দেওয়ালে সার দিয়ে সব ছবি আটকানো। সেখানে আর্যদের গুরুদেব থেকে ঠাকুরদা, দাদামশাই, সবার ছবি আছে। সেসবগুলো দেখতে দেখতে দিঘি নীচের হলঘর পেরিয়ে লনে নেমে এল।
লনের একপাশে বেশ বড় সুইমিং পুল। গোটাটা নিয়েই পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। আর পুলের এক পাশে বার কাউন্টার আর অন্য পাশে খাওয়ার বুফে কাউন্টার। তার ভেতরেই খুব নিচু স্বরে মিউজিক বাজছে।
এখানে এসে দিঘির ভাল লাগল। ঘরের দমবন্ধ পরিবেশের চেয়ে এটা ভাল।
যদিও বিশেষ কাউকেই চেনে না। তবু ভাল লাগছে ওর। তার ওপর হালকা একটা হাওয়াও বইছে। বসন্তের হাওয়া এখন দুষ্প্রাপ্য। তবু, দু’-একদিন পথ ভুলে সে এসে পড়েই।
ললিত এক কোনায় দাঁড়িয়ে খুব আলগাভাবে দু’-একজনের সঙ্গে কথা বলছিল। দিঘিকে দেখে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। হাত তুলে ওর দিকে এগিয়ে এল। দিঘি পাশ দিয়ে যাওয়া বেয়ারার ট্রে থেকে একটা ফ্রেশ লাইম সোডা তুলে নিয়ে ললিতকে দেখে হাসল, ‘হাই মামু। হোয়াট্স আপ?’
‘আর আপ! সব ডাউন। বুঝলি তো?’ ললিত দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
‘কেন?’ দিঘি দেখল একজন সুন্দরী মহিলা এসে চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে দাঁড়াল ললিতের পাশে।
ললিত বলল, ‘দেখ না, মদন পুরীর নেমন্তন্ন ছিল। মালটা আসতে পারেনি বলে ফুলের বোকে হাতে আমাদের মতো দুটো বোকাকে এখানে পাঠিয়েছে।’
‘আঃ, ললিত। মদন পুরী কী? খুরানা স্যার। আর কিপ ইয়োর ভয়েস ডাউন। অন্যরা শুনতে পেলে কী ভাববেন?’
ললিত হাসল, ‘দুর, কে শুনবে? সব মাল খেয়ে টাল হয়ে আছে।’ তারপর দিঘির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যাক, আলাপ করিয়ে দিই, দিঘি, ইনি আমার কলিগ। মিসেস জিয়ানা বোস। আর জিয়ানা এ আমার ভাগ্নী, দীঘল। তবে আমরা সবাই ওকে দিঘি বলি।’
দিঘি হাসল, ‘হাই।’
জিয়ানা হাসি ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘দিঘি ইজ আ গুড নেম। তুমি কী পড়ো দিঘি? ডোন্ট মাইন্ড, তুমি বললাম।’
‘শিয়োর। ইকনমিক্স নিয়ে পড়ছি।’
‘গ্রেট! আমার তো ভয়ই লাগে সাবজেক্টটা।’ জিয়ানা হাতে ধরা গ্লাসটা থেকে চুমুক দিল একটু। গাঢ় বাদামি রঙের পানীয়। দিঘি জানে এসব কথার কথা। কোনও উত্তরের প্রত্যাশা নেই।
জিয়ানা সামান্য ক্ষণ চুপ করে যেন কথা হাতড়াল। তারপর বলল, ‘তা দিঘি। কোথায় থাকো তুমি? আমি নিউ মার্কেটের কাছে থাকি।’
‘আমি সুকিয়া স্ট্রিট।’
‘কোথায়?’ সামান্য যেন চমকে উঠল জিয়ানা। হাতে ধরা গ্লাসটা থেকে সিপ নিতে যাওয়া অবস্থায় গ্লাসটাও চলকাল একটু। জিয়ানা আবার বলল, ‘সুকিয়া স্ট্রিট?’
‘সুকিয়া স্ট্রিটের কোথায়?’
‘রামমোহন লাইব্রেরির কাছে। আপনি চেনেন?’ দিঘি প্রশ্ন করল।
জিয়ানাকে কেমন যেন এলোমেলো লাগল হঠাৎ। ও বলল, ‘না, মানে…ইয়ে…তুমি কি একজনকে…বাদ দাও।’
‘কী? আপনি বলতে পারেন।’ দিঘি বলল।
জিয়ানা মাথা নাড়ল জোরে। হাসলও। বলল, ‘বাদ দাও। কবেকার কথা! তোমার জানার কথা নয়। কত বছর হয়ে গেল। জানো একসময় আমি ওখানে যেতাম।’
‘আমিও যেতাম।’ ললিত কথার মধ্যে ঢুকে পড়ল, ‘এখন আর সময় পাই না। এই দিঘি, দিদি ব্যাপক খচে আছে না আমার ওপর?’
‘মা?’ দিঘি হাসল, লাইম সোডায় চুমুক দিয়ে বলল, ‘তা ধরো একটু না হয় রাগল। তাতে কী এমন ক্ষতি হল!’
ললিত ভুরু কুঁচকে, মাথাটা হেলিয়ে তাকাল, ‘তুইও কি রেগে গেছিস?’
‘কেন মামু? আমরা তো জানি যে, তুমি ব্যস্ত।’
‘আর ব্যস্ত!’ ললিত দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘দেখ না, আমাদের স্যার আসতে পারবেন না বলে আমায় আর জিয়ানাকে পাঠিয়েছেন এখানে। কাউকে চিনি না। শালা বোর হয়ে মরে যাব এবার। তেমন সন্ধেও হয়নি যে, খ্যাটন মেরে কেটে পড়ব। শালা, ওই মদন পুরীটার জন্য যত ঝাড় হল।’
‘স্যারকে অমন নামে ডেকো না। আর কী বাজে কথা বলছ? তোমার নিস তোমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর সেখানে স্ল্যাং ইউজ করে যাচ্ছ তখন থেকে। জাস্ট কন্ট্রোল ইয়োরসেল্ফ।’
‘আর স্ল্যাং! এরা খুব বড় পাম্প, মোটরের ডিলার। তো মাথা কিনেছে নাকি? কী যে বাজে লাগছে না। তার ওপর মদটাও ভাল নয়। জল মেরেছে নির্ঘাত! তা দিঘি, তুই এখানে? দেখলাম, এদের গাড়ি থেকে নামলি?’
দিঘি হাসল। ললিত চিরকাল এরকম। ভাল আর ভুলভাল। মুখের আগল নেই।
দিঘি বলল, ‘আসলে তোমরা যে-কোম্পানির নেমন্তন্নে এখানে এসেছ, সেই অনিল আঙ্কেলের ছেলে আমার বন্ধু। আর্য নাম ওর।’
‘ব-ন-ধু?’ টেনে টেনে উচ্চারণ করে ললিত ফিক করে হাসল, ‘বাঃ, বেশ বড় হয়ে গেলি, বল? বেশ বয়ফ্রেন্ড ট্রেন্ড রাখছিস।’
‘বয়ফ্রেন্ড!’ দিঘি নিজেই ঠিক বুঝল না কেন ও অপ্রস্তুত হল।
‘নয় তো কী?’ ললিত ফিকফিক করে হাসল, ‘না হলে কেউ গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে আসে? ভাল মাছ ধরেছিস।’
ভাল মাছ! দিঘির কান গরম হয়ে গেল হঠাৎ। ললিতের কি নেশা হয়ে গেছে? না হলে এমন অপমানকর কথা বলছে কেন? ইচ্ছে করে বলার লোক তো নয়। তবু এই কথার তো প্রতিবাদ করতেই হয়।
দিঘি বলল, ‘এসব কী বলছ?’
ললিত থমকাল একটু। দিঘির কঠিন চোখমুখ দেখে বুঝল ভুলভাল বলে ফেলেছে। ললিত হাসল। ভাবটা এমন যেদিন কিছুই হয়নি। বলল, ‘আরে জাস্ট ইয়ারকি মারছি। এত বড় হলি এটাও বুঝিস না?’
দিঘি দেখল পাশ থেকে জিয়ানা ইশারায় বলছে যে, ললিত আর নিজের মধ্যে নেই। এটা একদম সহ্য হয় না। দিঘির। সিগারেট, মদ বা অন্য কোনও নেশা একদম ভাল লাগে না ওর। মনে হয় নেশাখোরদের কান ধরে ওঠবোস করায়। নেশা করাটা যে কী চরম ব্যর্থতা মানুষগুলো যদি একবার বুঝত! কিগান কিন্তু একদম নেশা করত না। কোনও নেশাই ছিল না ওর। চা-ও খেত না। ওর কাছে গেলেই কী সুন্দর গন্ধ পাওয়া যেত! এত ভাল লাগত দিঘির! আর সবচেয়ে বেশি ভাল লাগত যখন… কখন? কখন ভাল লাগত দিঘির সবচেয়ে বেশি? যদি অতই ভাল লাগত, তা হলে এমন নষ্ট করল কেন ও সব? আর এখন কেন ঠোঁট শুকনো লাগছে ওর? বুক ধড়ফড় করছে? কেন মনে পড়ে যাচ্ছে সেই দিনটাকে?
দিন চলে যায়। খুঁজতে খুঁজতে একটা বাঁক থেকে অন্য একটা বাঁকে ঘুরে যায় দিন। সঙ্গে করে সে আর কিচ্ছু নেয় না। শুধু আলোটুকু নিয়ে চলে যায়। ছোট্ট দীপ্ত সূর্যটাকে নিয়ে চলে গেছে দিন। দিঘির জীবনে এখন সেই আলো নেই। শুধু তার গন্ধের স্মৃতি লেগে আছে।
দিঘি আরও কিছু বলত হয়তো কিন্তু ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। এখন আবার কে? আরে, এ যে বাড়ির নম্বর। মা তো এমন সময় ফোন করে না!
‘এক্সকিউজ মি,’ বলে সরে গিয়ে ফোনটা ধরল দিঘি। বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যালো?’
‘দিঘি…দিঘি…’ মা যেন হাঁপাচ্ছে।
‘কী হয়েছে মা?’ দিঘি ঘাবড়ে গেল একটু।
‘দিঘি…’ মা যেন কথা বলতে পারছে না।
দিঘি চারদিকের মানুষজনকে দেখল। এর ভেতর দাঁড়িয়ে কথা বলা মুশকিল। ও দ্রুত পায়ে একটু দূরে বড় চারটে পান্থপাদপ গাছের কাছে সরে গেল। ফোনটাকে উত্তেজনায় চেপে ধরে বলল, ‘কী হয়েছে মা?’
‘দিঘি রে, শমীকে বোধহয় তোর দিদি মেরেই ফেলল।’
‘কী!’ দিঘির হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল।
‘বসার ঘরের পিতলের ফুলদানি দিয়ে মহুল একদম মাথাটা থেঁতলে দিয়েছে ছেলেটার। অজ্ঞান হয়ে গেছে শমী। কে জানে বাঁচবে কিনা!’ মায়ের কথা কেমন যেন ভয়ের চোটে জড়িয়ে যাচ্ছে।
দিঘি বলল, ‘কী যা তা বলছ…’
‘তুই আয়, এক্ষুনি আয়…’ মা যেন আর কথা বলতে পারছে না।
‘আসছি আমি। ডাক্তারকে খবর দিয়েছ?’
মা জড়িয়ে আরও কিছু বলল। কিন্তু দিঘি শুনতে পেল না স্পষ্ট। ও আর সময় নষ্ট না করে ফোনটা কেটে দিল।
হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে দিঘির। কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে যেন। দিদি এটা কী করল? কেন করল? আর ও-ই বা এখন বাড়ি ফিরবে কী করে? আর্য কোথায়? এত ইরেসপন্সিবল কেন আর্য? তবে যে আর্য ওকে আদর করতে করতে বলেছিল কোনওদিন বিপদে একা ছাড়বে না? তা হলে? ও দ্রুত মোবাইলে আর্যর নম্বরটা বের করে কল করল। ওই রিং হচ্ছে। চারটে, পাঁচটা। ছ’নম্বর রিঙে ধরল আর্য, ‘হ্যালো ডার্লিং। বলো।’
দিঘি উত্তেজনা, রাগ আর বিরক্তিতে বলল, ‘হ্যালো? কোথায় তুমি? কিগানদা তুমি কোথায়?’