মুহূর্তরা দু’বছর আগে – ১৩

১৩

আজ রোববার। মেঘলা একটা দিন। মার্চের প্রথমে হঠাৎ এখন মেঘ করল কেন? খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল আদি। নর্থ কলকাতাটা বেশ রুক্ষ। দিনকে দিন যেন আরও রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে! আদির ঘর থেকে জানলা দিয়ে একটা হিজিবিজি তারের জটলা দেখা যায়। মনে হয় আকাশটার গায়ে যেন কোনও বাচ্চা ডটপেন দিয়ে অসংখ্য আঁচড় কেটেছে। আদির ওই দিকে চোখ পড়ত না আগে। কিন্তু এখন পড়ে। মনখারাপ করাটাও যেন চোখে পড়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে। কেন এমন একটা আঁচড়-কাটা আকাশ চোখে পড়ে আদির? কেন কষ্ট হয় এত? কোলবালিশটা টেনে নিয়ে পাশ ফিরল ও।

দেওয়ালে একটা বড় পোস্টার লাগানো রয়েছে। অনেকটা খোলামেলা পোশাক পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেগান ফক্স। আধখোলা ঠোঁট। বান রুটির মতো বুকের আভাস। অদ্ভুত ছাই রঙের চোখ। আদি ওই দিকে তাকিয়ে রইল। কার বাড়ির মেয়ে এই মেগান? এমন খোলামেলা পোশাকে সারা পৃথিবীতে কেন বিক্রি করছে নিজেকে? ওর বাবা ওকে বকে না? ওর নিজের খারাপ লাগে না? আচ্ছা, সকালে ঘুম থেকে উঠে ওর চোখে পিচুটি হয়? মুখে গন্ধ হয়? ওর নখের তলায় ময়লা জমে? একান্তে শব্দ করে ঢেকুর তোলে? নাকে আঙুল দেয়? ওর কষ্ট হলে কাঁদে? কখনও লোকের সামনে বোকার মতো প্রশ্ন করে? খাবার না খেয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় না যে, একদিন তেলেভাজা খাই খুব করে? ইচ্ছে হয়? হয়তো হয়। নিশ্চয়ই হয়। মেগান ফক্সও তো মানুষ। আদি বোঝে না আসলে কী চায় মানুষ! আর তাকে থাকতে হয় কীভাবে!

কোলবালিশে মুখ গুঁজে আড়চোখে পোস্টারটার দিকে তাকিয়ে রইল আদি। মেগান ফক্সও তাকিয়ে রইল ওর দিকে। আর ক্রমশ মেগান ফক্সের ছবি ছিঁড়ে বেরিয়ে এল গতকাল রাতের সেই মেয়েটা-সুমেধা মোতওয়ানি।

মেয়েটাকে বার থেকে তুলেছিল আদি। গতকাল, প্রায় মাঝরাতে। তুলেছিল? ‘তুলেছিল’ কথাটা এই সকালবেলা নিজের কানেই খট করে লাগল আদির। কেমন অশ্লীল শোনাচ্ছে। মনে হচ্ছে খুব খারাপ একটা ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু গতকাল রাতে তো তা মনে হয়নি।

গতকাল শনিবার ছিল। ছুটি থাকার কথা। কিন্তু এখন শনিবারও কাজ করতে হয়। বেশ কিছু প্রজেক্ট নিয়ে জট পাকিয়ে আছে। সেগুলো না খুলে অবধি শান্তি নেই। গৌর তাই আর ছুটি দেয় না ওকে। আর পারলে রোববারও কাজ করায়।

আসলে ওই টুর্নামেন্টটা করে ওদের ব্র্যান্ড ভ্যালু বেশ কিছুটা বেড়েছে। আরও কিছু হাউজিং প্রজেক্ট নিয়ে উদ্যোগী হয়েছে গৌর। মানুষজনের থেকে সাড়াও পাচ্ছে। কিন্তু মূল ব্যাপারটা অন্য জায়গায়। বারাসতের প্রজেক্টকে যে সামনে রেখে ওরা এগোবে, সেখানেই তো বাধা। লোকের মনে বিশ্বাস জন্মাতে হলে একটা কমপ্লিট প্রজেক্ট আর ক্লায়েন্ট স্যাটিসফ্যাকশনের সার্টিফিকেটের চেয়ে বড় বিজ্ঞাপন কিছু হয় না। কোটি টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন করলেও যে-কোনও কিছুর পারফরমেন্সই তার আসল বিজ্ঞাপন। তাই গৌর এখন উঠেপড়ে লেগেছে। সঙ্গে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে আদিদেরও। তবু রবিবার ছুটির দিনটা এখনও বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে আদি।

গতকাল অফিস থেকে বেরিয়ে কেমন যেন বদ্ধ লাগছিল আদির। মালিনী অফিসে ছিল না। গাড়ি নিয়ে গিয়েছিল অন্য কাজে। তাই যেন আরও ফাঁকা আর একা লাগছিল আদির। ট্যাক্সি ধরে সোজা পার্ক স্ট্রিটে চলে গিয়েছিল।

বারের এক কোণটায় একা, ঝুম হয়ে বসেছিল ও। আসলে যেন মদ খাওয়ার জন্য নয়। বরং হইহট্টগোলের মধ্যে একা থাকাটাই আসল উদ্দেশ্য ছিল ওর। গ্লাসের সূর্য রঙের তরলটার দিকে তাকিয়ে চুপ করে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে ছিল আদি। দুটো চৌকো স্ফটিকের মতো বরফ ভেসে বেড়াচ্ছিল তরলের ভেতর। যেন আগুন আর বরফের সহাবস্থান। একদম কিচ্ছু আসছিল না মাথায়। আদি শুধু চুপ করে তাকিয়ে ছিল ওই তরলের দিকে। আর কষ্ট হচ্ছিল খুব, গলার কাছে যেন পাথর আটকে ছিল। চারদিকের চিৎকার চেঁচামেচি আর হইহট্টগোলের শব্দ একটা ফোঁটাও আসছিল না ওর কাছে। শুধু এক দীর্ঘ, তীব্র বিষাদ যেন ঘিরে ফেলছিল ওকে। আর আদি অবাক হয়ে দেখছিল, বহু বহু বছর বাদে হারিয়ে যাওয়া দু’-এক কুচি জল কোত্থেকে যেন জমে উঠছিল চোখের কোনায়। আর ঠিক তখনই চোখ তুলে মেয়েটার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হয়েছিল আদির।

দূরে পাঁচ-ছ’টা ছেলেমেয়ের একটা জটলা বসে হুল্লোড় করছিল। তার ভেতরেই একটা পিঙ্ক স্প্যাগেটি টপ আর জিন্‌স পরে বসে ছিল মেয়েটা। ওই জটলার ভেতরে থাকলেও মেয়েটার চোখ যেন এদিকেই ছিল। আদিকে যেন চোখ দিয়ে আটকে রেখেছিল মেয়েটা।

আদি কি কাঁদছিল? আচ্ছা, কাঁদলেই কি শুধু চোখ দিয়ে জল বেরোয় এমনভাবে? আর অন্য কোনও কারণ কি নেই? কেন চোখ দিয়ে জল বেরোচ্ছিল আদির? কীসের মনখারাপ ওর? ওর জীবনে তেমন তো কোনও অভাববোধ নেই। তা হলে? কেন কষ্ট পাচ্ছিল আদি? কার জন্য কষ্ট পাচ্ছিল?

বুড়ো আঙুল দিয়ে চোখের কোনা থেকে জলটা সরিয়ে রুমাল বের করেছিল আদি। আর দেখেছিল দূর থেকে মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে যেন হাসছে। না, ব্যঙ্গের হাসি নয়। বরং খানিকটা যেন ভরসার হাসি, যেন সাহসের হাসি। মেয়েটা যেন বলছিল, ‘কান্না তো আছেই, কিন্তু তারপর জল মুছে হেসে ওঠাটাই তো জীবন।’ মেয়েটা ওই দূরে বসেই যেন মনে মনে হাত ধরেছিল আদির।

বেশ রাত করেই বেরিয়েছিল আদি। রাস্তায় ইতস্তত জটলা থাকলেও কলকাতারও যেন হাই উঠছিল। কলকাতাও যেন চোখ ঢুলছিল ঘুমে। আদির ইচ্ছে করছিল না বাড়ি যেতে। বরং বিরক্ত লাগছিল বাবা আর মায়ের মুখটা মনে পড়াতে। ওর চলে যেতে ইচ্ছে করছিল অন্য কোথাও। মনে হচ্ছিল স্ট্র হ্যাট পরে জিন্‌স গুটিয়ে গিয়ে বসে থাকে কোনও শান্ত নীল জলের ধারে। তারপর সেইখানেই বসে থাকে যতক্ষণ না ছিপে ট্রাউট মাছ ওঠে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিল না ট্রাউট মাছ কেমন দেখতে হয়। তবু সেই না দেখতে পাওয়া, অচেনা মাছটাকেই প্রাণপণে ধরতে চাইছিল আদি। আর ঠিক তখনই আবার দেখেছিল সেই পিঙ্ক টপটা।

মাথাটা সামান্য ঘোলাটে লাগছিল আদির। লম্বা লাইটপোস্টগুলো কেমন যেন তেরছাভাবে ঢুকে আসছিল দৃশ্যের ভেতরে। আর সেই আলোকস্তম্ভের তলায় আলতো পায়ে এসে দাঁড়িয়েছিল সেই মেয়েটা।

‘আর ইউ অলরাইট?’ মেয়েটির গলায় কেমন অদ্ভুত প্রজাপতির শব্দ শুনেছিল আদি। ও ভাল করে চোখ মেলে তাকিয়েছিল।

‘আয়াম।’ ছোট্ট করে মাথা নেড়েছিল আদি।

‘ও। বাট ইউ লুক সিক।’ মেয়েটার গলায় কি উদ্বেগ ছিল?

‘না, আয়াম অলরাইট।’ আদির গলার স্বর নুয়ে আসছিল ক্রমশ।

‘আমার গাড়ি নেই। থাকলে তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিতাম।’ মেয়েটা আলতো করে কাঁধে হাত দিয়েছিল আদির।

‘কিন্তু রাস্তায় তো ট্যাক্সি আছে।’ আদি হেসেছিল। আবছা দুর্বল হাসি।

‘যেতে পারবে তো?’ মেয়েটার গলায় কি সত্যিই উদ্বেগ ছিল?

আদি হাত তুলে সামনে দিয়ে যাওয়া একটা ট্যাক্সিকে দাঁড় করিয়েছিল তৎক্ষণাৎ। হলুদ ট্যাক্সির সামনে থেকে মেঘলা রঙের ড্রাইভারটা মুখ ঝুঁকিয়ে তাকিয়েছিল। আদি বুঝতে পারছিল এমন সময় এই অঞ্চল থেকে এমন অনেক মাতালকে গাড়িতে ওঠাতে অভ্যস্ত এই লোকটা।

আদি মাথা ঝুঁকিয়ে তাকিয়েছিল ড্রাইভারের দিকে। কলকাতা যেন আরও বেঁকে যাচ্ছিল। হালকা একটা হাওয়া পার্ক স্ট্রিটের পুরনো বাড়িগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে আচমকা হামলা চালাতে শুরু করেছিল। হলুদ আলোগুলো যেন নেমে আসছিল নীচে। আদি বুঝতে পারছিল না ট্যাক্সিটা এমন বাঁকাচোরা চ্যাপটা চৌকো শহরের মধ্যে দিয়ে যাবে কী করে! ট্যাক্সিওয়ালা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী হল? কিছু বলবেন? যাবেনটা কোথায়? আচ্ছা মাতালের পাল্লায় পড়া গেছে তো!’

মাতাল? কে মাতাল? আদি বুঝতে পারছিল না ট্যাক্সিওয়ালা কার সঙ্গে কথা বলছে। আচ্ছা, ওর পিছনে কি আরও কেউ এসে দাঁড়িয়েছে? ট্যাক্সিওয়ালা কি তার সঙ্গে কথা বলছে?

‘আচ্ছা মুশকিল।’ ট্যাক্সিওয়ালা গিয়ার পালটে চালাতে শুরু করেছিল গাড়ি। কিন্তু তখনই আবার সেই গোলাপি মেয়েটা। গোলাপি মেয়ে? না, গোলাপি টপ? আচ্ছা, কলকাতাটা গোলাপি নয় তো?

মেয়েটা বলেছিল, ‘আপনি যাবেন? শোভাবাজার।’

শোভাবাজার? আদি তো শোভাবাজার যাবে না। তা হলে? ও মেয়েটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। মেয়েটা কী করে জানল ও শোভাবাজার থাকে? আসলে তো শোভাবাজারে থাকে না আদি। ও অন্য একটা জায়গায় থাকে। যেখানে রাস্তার পাশে অনেক পুরনো বাড়িঘর। যেখানে গাছপালা কম। যেখানে এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পুরনো শহরটা থেকে গিয়েছে কিছুটা। সেখানে একটা বাড়িতে থাকে আদি। তার জানলা দিয়ে দেখা যায় পুরনো একটা আকাশ। যার গায়ে বাচ্চাদের কাটাকুটি দাগের মতো অসংখ্য তারের রেখা। সেখানেই, হ্যাঁ, সেখানেই থাকে আদি। কিন্তু কী যেন নাম জায়গাটার? শোভাবাজার? না তো, শোভাবাজার তো নয়। তবে কি সত্যিই নেশা হয়ে গেল আদির?

মেয়েটা আলতো ঠেলায় আদিকে তুলে দিয়েছিল গাড়িতে। তারপর গাড়িতে উঠে বসেছিল নিজে।

রাতের কলকাতা ফাটিয়ে হু হু করে ছুটছিল গাড়ি। আদি আলতো কাত হয়ে মাথা হেলিয়ে ছিল। গলার আলগা টাইটা আরও আলগা করে দিয়েছিল ও।

মেয়েটা ঝুঁকে বলেছিল, ‘আর ইউ ফিলিং অলরাইট?’

‘ইয়েস, আমি ঠিক আছি।’

‘আয়াম সুমেধা, সুমেধা মোতওয়ানি। তুমি?’

‘আমি? আমি।’ আদির চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল হাওয়ায়। কলকাতাটা এতক্ষণ বাঁকাচোরা ছিল। এবার যেন আলোও কমে আসছিল তার।

‘কোথায় থাকো?’

মনে হচ্ছিল একটা লম্বা কুয়োর ভেতর শুয়ে ওই ওপর থেকে ঝুঁকে পড়া মেয়েটার গলার স্বর শুনছে ও। স্বরটা যেন আস্তে আস্তে দূরে চলে যাচ্ছিল, যেন মিলিয়ে যাচ্ছিল শূন্যে। অনেক গভীর এক গর্তের ভেতরে যেন আস্তে আস্তে গড়িয়ে নেমে যাচ্ছিল আদি। একদম নেমেই যাচ্ছিল…

‘এই যে ওঠো। এই…,’ মেয়েটার আলতো ঠেলায় চোখ মেলেছিল আদি। সরু গলি। চারদিকে ইটের দাঁত বের করা বাড়িঘর। ময়লা বাতিল জামার মতো আলো। এটা কোন জায়গা? এখন ক’টা বাজে? ও আস্তে আস্তে গাড়ি থেকে নেমেছিল। মনে হচ্ছিল যেন পা দুটো শোলার তৈরি আর মাথাটা পারদের। দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়েছিল আদি। তবে এবার আস্তে আস্তে মনে পড়ছিল সব। এটাই বোধহয় শোভাবাজার। আর ওই গোলাপি টপের মেয়েটা এনেছে ওকে এখানে। কী যেন নাম মেয়েটার? কী যেন… ও সুমেধা। আর আদি থাকে যেন কোথায়? ও, ইয়েস, সুকিয়া স্ট্রিট।

আদি ভরসা পেয়েছিল। যাক। মনে পড়েছে, ঠিক আছে, এখন শোলার পা আর পারদের তৈরি মাথাটা বদলে স্বাভাবিক হলেই হয়।

সুমেধা বলেছিল, ‘দোতলায় আমার অ্যাপার্টমেন্ট। চলো একটু ফ্রেশ হয়ে নেবে। তারপর না হয় বাড়ি যেয়ো। কোথায় বাড়ি তোমার মনে পড়েছে?’

আদি হেসে বলেছিল, ‘মনে পড়েছে, থ্যাঙ্কস।’

সুমেধা ওকে আলতো করে ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল।

সুমেধার ফ্ল্যাটটা ছোট্ট। একটা কিচেন কাম ডাইনিং আর একটা বেডরুম। আর ডাইনিং রুমের পাশে ছোট একটা দু’জন বসার মতো সোফা। আদি বসেছিল সেখানে, হলুদ রঙের সোফাটা বেশ পরিষ্কার। ঘরটাও পরিপাটি করে সাজানো। তবে অবাক হয়ে আদি দেখছিল ঘরের দেওয়ালটার রং গোলাপি।

‘বসো, আমি আসছি।’ সুমেধা ছোট্ট বেডরুমটায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।

নিস্তব্ধ শহর। অচেনা বাড়ি। আদির মনে হয়েছিল ও বোধহয় কোনও দ্বীপান্তরে এসেছে। গলার থেকে টাইটা খুলে পাশে সোফায় রেখেছিল আদি। তারপর নিজের মাথার চুল মুঠো করে ধরে ঝাঁকিয়েছিল। এখানে কী করছে ও? অচেনা একটা মেয়ের ফ্ল্যাটে এভাবে বসে আছে কেন? আর তারপরই ওর মনে হয়েছিল, আরে, আজ একবারও তো মালিনী ফোন করেনি ওকে? কেন ফোন করল না মালিনী? কোথায় গেছে যে, একবার ফোনও করতে পারেনি?

আচমকা গরম লাগতে শুরু করেছিল আদির। একটা ঘামের দাগ কে যেন কানের পিছন থেকে ঘাড় অবধি টেনে দিয়েছিল নিমেষে। মাথার পারদগুলো ফুটতে শুরু করেছিল। শোলার পায়ে কে যেন ধরিয়ে দিয়েছিল আগুন। পোড়া গন্ধটা ঠিক পেয়েছিল আদি। বুঝতে পেরেছিল হিংসেয় সমস্ত শরীরে আগুন লেগে গেছে ওর।

ঠিক সেই সময়ে আচমকা দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিল সুমেধা। চমকে গিয়েছিল আদি। সুমেধা শুধু একটা তোয়ালের বাথরোব পরে আছে। হাঁটু অবধি এসে রোবটা আচমকা শেষ হয়ে গেছে। আর তার তলায় স্ফটিকের মতো দুটো পা। আচমকা ফুটন্ত পারদটা মাথা থেকে নীচের দিকে নামতে শুরু করেছিল আদির।

সুমেধা তীব্র চোখে তাকিয়ে একদম গা ঘেঁষে এসে বসেছিল আদির। টাইটা তুলে হাতে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলেছিল, ‘তোমার গালের লাল তিলটা তো খুব সুন্দর! তা তোমার নামটা?’

সুমেধার ক্রস করে রাখা পা বিপজ্জনকভাবে সরিয়ে দিয়েছিল রোবের আড়াল। আর সেই বিপদ-সীমানায় সুমেধার লেসের প্যান্টির সীমান্ত দেখা যাচ্ছিল। পারদ তার অধগতি বাড়িয়ে দিয়েছিল আরও।

আদি শুকনো জিভে বলেছিল, ‘আদিত্য।’

‘চোপড়া?’ হেসেছিল সুমেধা, ‘আমি তো মোতওয়ানি। তুমি কী?’

‘ব্যানার্জি।’ আদির অবাধ্য চোখ আর নিষেধ শুনছিল না।

সুমেধা টাইটা দরজার পাশে রাখা একটা স্ট্যান্ড ল্যাম্পের দিকে ছুড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠেছিল আচমকা। বাথরোবের কোমরবন্ধটা একটা ঝটকায় খুলে ফেলে রোবটা নামিয়ে দিয়েছিল শরীর থেকে। তারপর গভীর গলায় বলেছিল, ‘লেট্‌স মেক ইট ইজি ফর ইয়োর আইজ।’

গোলাপি! ভেতরের অন্তর্বাসদ্বয়ও গোলাপি! আদি হাঁ করে তাকিয়ে দেখেছিল। গোলাপি ব্রেসিয়ারের ভেতর থেকে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে বান রুটি। পারদ তার নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে জানান দিচ্ছিল উপস্থিতি।

সুমেধা আদির চোখে চোখ রেখে এগিয়ে এসেছিল ওর দিকে। তারপর হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিল আদির সামনে। অস্ফুটে বলেছিল, ‘ওয়ান্ট মি?’

আদির কথা সরছিল না। ঘরটা এবার কেমন যেন রং পালটাচ্ছে মনে হচ্ছিল ওর। সুমেধা ক্রমশ বিপজ্জনকভাবে এগিয়ে গিয়েছিল ওর দিকে। আর তারপর মাথা নামিয়ে এনেছিল আদির দৃঢ় দুর্বলতায়।

আদি মাথা পিছনে হেলিয়ে তাকিয়েছিল সিলিংফ্যানের দিকে। আর ওর হাত নিজের অজান্তেই চলে গিয়েছিল সুমেধার মাথায়। কতক্ষণ ও বসেছিল ওই অবস্থায়? তরল সূর্য সরিয়ে ধীরে ধীরে আগ্রহী হয়ে সাড়া দিয়েছিল শরীর। সুমেধা অনায়াসে উঠে নিজেকে গোলাপি কাপড় মুক্ত করে বসে পড়েছিল আদির ওপর। পাতালযাত্রার আগে অভিযাত্রীর মতো কেঁপে উঠেছিল আদি। হয়তো ভয়েই ধরে ফেলেছিল সুমেধার কোমর। তারপর ঢেউ আর স্রোত। চুলের বাদামি ঝরনার ভেঙে পড়া। চিৎকার আর নখের দাগ। আদি ক্রমশ দেখতে পাচ্ছিল সেই অভিযাত্রীকে। লক্ষ্যে পৌঁছোচ্ছে, ক্রমশ লক্ষ্যের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে সে। আদি দাঁতে দাঁত চেপে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল আর একটু। আর একটু পথ…। বহু দিন পর, আর একটা অভিযান শেষ করতে যাচ্ছে ও।

আর ঠিক তখনই মুখটা মনে পড়েছিল আদির। মাখনের মতো রং। বাদামি চোখ আর সেই ঘূর্ণির মতো টোল। ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মালিনী ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে! সারাদিন পরে, মালিনী এমন সময় তাকিয়ে রয়েছে! সুমেধা পাগলের মতো ছটফট করছে ওর ওপর। সেই দেখেই কি মালিনী হাসছে? নাকি আদির মনখারাপ আর হিংসের পাশাপাশি এমনভাবে শরীর সমর্পণের বৈপরীত্য দেখে হাসছে? কেন হাসছে মালিনী? কার দিকে তাকিয়ে হাসছে?

আদি ওই অবস্থাতেই মাথা সোজা করে তাকিয়েছিল সুমেধার দিকে। গোলাপি লিপস্টিক ছেতরে গেছে। চোখের একটা ফল্‌স আইল্যাশ খুলে ঝুলছে চোখ থেকে। মাথার চুল ভাঙা, জড়ো করা নুডুলসের মতো লাগছে।

এ কোথায় এসেছে আদি? এ কার ভেতর ঢুকে বসে আছে? হঠাৎ গা ঘিনঘিন করে উঠেছিল ওর। শরীর গুলিয়ে উঠেছিল। একটা মনখারাপের চাদর ঝপ করে এসে যেন ঢেকে দিয়েছিল ওকে। নিমেষে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল আদি। সুমেধাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে প্যান্টের জিপ টেনে দিয়েছিল। জামা ঠিক করে উঠে পড়েছিল। আর দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল টলমল ভাবে।

‘ইউ বাস্টার্ড,’ সুমেধা খোলা বইয়ের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল মাটিতে। চিৎকার করে বলেছিল, ‘জানোয়ার। ইমপোটেন্ট। পালাচ্ছিস কেন? কোথায় পালাচ্ছিস? টাকাটা কে দেবে, তোর বাপ? ট্যাক্সির ভাড়া, আমাকে লাগানোর দাম কে দেবে? তোর কোন বাপ দেবে?’

আদি দরজার পাশের ল্যাম্প স্ট্যান্ড থেকে টাইটা তুলে নিয়েছিল। তারপর পকেট থেকে কয়েকটা পাঁচশো টাকার নোট ছুড়ে দিয়েছিল সুমেধার দিকে।

বাইরে বেরোতে বেরোতে আদি দেখেছিল, সুমেধা ঝাঁপিয়ে পড়ে ছড়িয়ে থাকা নোটগুলো কুড়োচ্ছে। আর দূরে এক কোণে পড়ে আছে গোলাপি রঙের দু’টুকরো কাপড়।

রাতের কলকাতায় ধাক্কা খেতে খেতে হাঁটছিল আদি। যেন দেখতে পাচ্ছিল মালিনী হাসছে। ওর দিকে তাকিয়ে ক্রমাগত হাসছে হা হা করে। কেন হাসছে মালিনী? এমনভাবে হাসছে কেন? কোথায় শেষ হবে এই হাসি? আদির মাথার ভেতরে টলমল করছিল কলকাতা। বাড়ির রাস্তা যেন খুঁজে পাচ্ছিল না। আচমকা ভূতের মতো কোত্থেকে যেন এসেছিল একটা ট্যাক্সি। আদি কিছু না ভেবে প্রায় ঝাঁপিয়ে উঠে পড়েছিল গাড়িতে। তারপর অবসন্ন গলায় শুধু বলেছিল, ‘সুকিয়া স্ট্রিট।’

এই সুকিয়া স্ট্রিট। কলকাতা শহরের অন্যতম পুরনো বাসিন্দা এই সুকিয়ারা। শুনেছে আদি। তাদের নামেই কি এই রাস্তার নাম? হবে হয়তো। ইতিহাস নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা কোনওদিনই ছিল না আদির। আজও নেই। আসলে স্কুলজীবন থেকে ইতিহাস খুব বোরিং লাগত আদির। তবু উত্তর কলকাতায় থাকা অনেকটা যেন ইতিহাসের বইয়ের পাতার ভেতরেই থাকা। এই গড়পারের রাস্তা। রামমোহন লাইব্রেরি। ওই বিদ্যাসাগরের বাসস্থান। তা ছাড়া পুরনো মিষ্টির দোকান। ঝরোকা লাগানো বারান্দা। কবেকার খিলান দেওয়া বাড়ি। বাদুড়বাগান মাঠ, পুরনো কলকাতার স্কুল। ফুটের তেলেভাজা। লাল রোয়াক। লুকোচুরি খেলতে খেলতে ঢুকে পড়া গা-ছমছমে মন্দির। এসবের ভেতরেই তো আদির বেড়ে ওঠা। দাদাভাইয়ের সঙ্গে বেড়ে ওঠা।

আজ সকালে শুয়ে মেঘলা মার্চের আকাশে ওই হিজিবিজি দাগের মতো তারগুলো দেখে হঠাৎ কেন যে এমন তীব্রভাবে দাদাভাইয়ের কথা মনে পড়ল আদির কে জানে! আসলে তার বলতেই তাতে পেঁচিয়ে যাওয়া ঘুড়ির কথা মনে পড়ে আদির। কালোর ওপর হলুদ গোল্লা আঁকা একটা ইয়াব্বড় চাঁদিয়াল।

তখন সদ্য ঘুড়ি ওড়াতে শিখেছিল আদি। কিগানের সঙ্গে ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াত। মাঝে মাঝে কিগান উড়িয়ে দিত আর তারপর ঘুড়ির সুতোটা ধরিয়ে দিত আদির হাতে। তখন কোন ক্লাসে পড়ত আদি? ফোর কি ফাইভ। বাবা একটা চাঁদিয়াল কিনে এনে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘আস্তে আস্তে ওড়াবি। যদি নষ্ট করিস আর কিনে দেব না।’

আস্তে আস্তে ওড়াবে মানে? এ কি সাইকেল নাকি যে, আস্তে আস্তে চালাবে? তবু ছাদের ওপর ঘুড়িটা উড়িয়ে খুব সাবধানে টানছিল আদি। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ছিল সেটা। গোটা আকাশটা মোজাইকের মতো ছিটছিট রঙে রাঙানো ছিল। তার ভেতর সাবধানে ঘুড়িটা রেখেছিল আদি। তখন তো আর টাকা পেত না হাতে, তাই সম্পদ বলতে ছিল ওই একটাই ঘুড়ি।

তবু, ছোট ছিল তো, তাই লোভ হয়েছিল হঠাৎ। মনে হয়েছিল আর একটু বাড়ালে কী হবে? ও তো আর কারও সঙ্গে প্যাঁচ খেলতে যাচ্ছে না। মাঞ্জা সুতোই তো ওর নেই। শুধু সাদা সুতো। তাই নিজেই নিজেকে বুঝিয়ে, বাড়িয়েছিল ঘুড়িটা। আর সত্যি বলতে কী দিব্যি উড়ছিল চাঁদিয়াল। ক্রমশ আত্মবিশ্বাস বাড়ছিল। মনে হচ্ছিল, বাঃ, সত্যিই তো ভাল ঘুড়ি ওড়াতে শিখেছি আমি।

আর তখনই কোত্থেকে যে একটা মুখপোড়া ঘুড়ি এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওর ওপর! থতমত খেয়ে ঘুড়ি বাঁচাতে আদি টান দিয়েছিল সুতোয় আর মাখনের মতো সাদা সুতো কেটে গিয়েছিল কুট করে। কিন্তু ঘুড়ির লম্বা সুতোটা ঝুলতে ঝুলতে গিয়ে জড়িয়ে গিয়েছিল ওই অজস্র তারের ভেতরে।

প্রায় দোতলা সমান উঁচুতে ঝুলছিল আদির চাঁদিয়াল। ওর একমাত্র সম্বল। বাবা জানলে তো আজ ভীষণ মারবে! ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল আদির। কষ্ট হচ্ছিল খুব। চোখ দিয়ে জল বেরোচ্ছিল হু হু করে। এবার কী করবে ও?

চিলেকোঠার ঘর থেকে ঠিক এই সময় বেরিয়ে এসেছিল দাদাভাই। জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী রে তুই কাঁদছিস কেন?’

ফোঁপাতে ফোঁপাতে আদি বলেছিল কারণটা। দাদাভাই হেসেছিল খুব, ‘এই জন্য কাঁদছিস? বোকা কোথাকার! আমার হাতে পয়সা আছে। তোকে আমি কিনে এনে দিচ্ছি আর-একটা ঘুড়ি।’

‘না, বাবা নিজে কিনেছে ঘুড়িটা। খুব ভাল করে চেনে। ওটাই চাই আমার।’

কিগান কথাটা শুনে চুপ করে চিন্তা করেছিল কিছুক্ষণ। তারপর বলেছিল, ‘দাঁড়া, আমি দেখছি। তুই কাঁদবি না একদম। কেমন?’

অদ্ভুত এক দক্ষতায় দাদাভাই হাতে একটা লম্বা লাঠি নিয়ে নেমে গিয়েছিল ছাদের কার্নিশে। তারপর ছোট্ট এক লাফে চলে গিয়েছিল পাশের ছাদে। নর্থের বাড়িগুলো গায়ে গায়ে বলে দাদাভাইয়ের সুবিধে হয়েছিল। তবু পাশের ছাদ থেকে খুব সহজে ঘুড়ির সুতোর নাগাল পাওয়া যায়নি। তবে বয়সের তুলনায় লম্বা দাদাভাই অনেক কসরত করে ঘুড়িটা দড়িতে পেঁচিয়ে নিয়ে এসেছিল। তারপর এক হাতে ঘুড়ি আর অন্য হাতে লাঠি নিয়ে এ কার্নিশে আসতে গিয়ে সামান্য টাল হারিয়েছিল। দাদাভাই লাঠিটা ফেলে হাত দিয়ে ছাদের পাঁচিলটা ধরে খুব জোর সামলে নিয়েছিল নিজের পড়ে যাওয়াটা। কিন্তু লাঠিটা পড়ে গিয়েছিল নীচে টালির ছাদ দেওয়া একটা কাঠের দোকানের মাথায়। টালি ভেঙে গিয়েছিল একটা।

সন্ধেবেলা সেই দোকানের মালিক এসে অভিযোগ করেছিল দাদাভাইয়ের নামে। আর দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আদি দেখেছিল বাবা আর মা অশ্রাব্য গালিগালাজ করছে। দাদাভাই সেদিন মাথা নিচু করে শুনেছিল সব। কিচ্ছু বলেনি। আর আদি মরমে মরে যাচ্ছিল একদম। কষ্ট হচ্ছিল। দাদাভাই যে অন্যায় করেনি সে তো দেখেছিল ও। তবে? তা হলে কেন বলেনি আদি? কেন পারেনি বলতে?

আদি পারে না। আদি ভিতু। ডরপোক আদমি। এই যে দাদাভাইকে বাবা জুতো ছুড়ে মারল। চরিত্রহীন, লম্পট বলে গাল দিল। তখন কিছু বলতে পেরেছিল আদি? বলতে পেরেছিল যে, দাদাভাইয়ের দোষ নয় সবটা? পারেনি। কিচ্ছু পারেনি ও। কিচ্ছু পারে না। এতটা জীবন কি শুধু নিজেরটা দেখেই কাটিয়ে দিল আদি? শুধু স্বার্থপরতা করে কাটিয়ে দিল? আচ্ছা, ও যে এমন তা কি সবাই বোঝে? তাই কি সবাই ওকে এড়িয়ে যায়? তাই কি মালিনী বলেছিল, ‘তুমি আমাদের ওল্ড এজ হোমে যাবে? তোমার ওদের কথা চিন্তা হয়? তুমি কনসানর্ড?’

মোবাইলটা হঠাৎ ক্যাঁক ক্যাঁক করে বেজে উঠল। আবার কে? বিরক্ত হয়ে ফোনটা ধরল আদি। আরে, এ যে চমক! ও হঠাৎ? ও হো, আদির মনে পড়ল, বারাসতের ঝঞ্ঝাটটা যে এখনও মেটেনি!

ফোনটা তুলে আদি যথাসম্ভব নরমভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, বলুন।’

চমক বলল, ‘ছুটির দিনে বিরক্ত করলাম বলে ক্ষমা চাইছি।’

‘আরে এমন বলছেন কেন?’

‘না, আপনাদের জীবন তো আর আমাদের মতো নয় যে, ছুটি বলে কিছু নেই। তাই বলছি আর কী। কিন্তু কী করব বলুন? কিছু তো করার নেই আমার। আমায় তো আমার কাজ করতেই হবে। সুধাদি যে আমায় চিবোচ্ছেন।’

‘ভেরি সরি মিস্টার চক্রবর্তী,’ আদি বিছানায় উঠে বসল। মাথাটা এখনও কেমন যেন বেসামাল লাগছে। মনে হচ্ছে যেন নৌকোয় চড়েছে ও। আর ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকোটা যেন দুলছে অল্প অল্প।

‘আরে আপনি সরি হচ্ছেন কেন?’ চমকের গলাটা হঠাৎ কেমন যেন শান্ত লাগল, ‘আপনার সরি হওয়ার কিছু নেই। আপনারা চান না বারাসতের প্রজেক্টটা শেষ হোক। আপনাদের প্রজেক্ট। আপনাদের টাকা। আমি কী বলব বলুন? আসলে আমি দূত মাত্র। সুধাদি বললেন আপনাদের সঙ্গে কথা বলে জানাতে যে, সুধাদির আর আপনাদের প্রজেক্টের ব্যাপারে আগ্রহ নেই।’

‘আরে আপনি রাগ করবেন না প্লিজ!’ আদির হঠাৎ ঘাম দিল। ও ভেবেছিল ঝঞ্ঝাটটা মিটিয়ে এনেছে। কিন্তু মিটছে কই! এ তো আরও বাড়ছে!

আসলে গৌরের কাছে বকুনি খেয়ে আদি বুঝেছিল যে, ও যদি কিছু না করে, তা হলে সত্যিই ওর চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে।

আদি আগেই খবর নিয়ে জেনেছিল সুধারানি সমাজপতি হল এই অঞ্চলের পার্টির সর্বেসর্বা। তাই এই ভদ্রমহিলাকে ধরতে হবে। স্থানীয় লোকেদের কাছ থেকেই সুধাদির সম্পর্কে খবর নিতে শুরু করেছিল আদি। আর তখনই উঠেছিল চমকের নাম।

চমক চক্রবর্তী। চাপাডাঙার নামকরা মানুষ রাঘব চক্রবর্তীর ছেলে। সুধাদির সবচেয়ে কাছের লোক। আদি বুঝেছিল ওর কাজ বাগাতে হলে এই চমককে ওর চাই। তাই সময় বুঝে আর চমকের সাহায্যে ফোনে সুধাদির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল ও। সুধাদির সঙ্গে গৌরের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টও ঠিক করে দিয়েছিল। শুধু নিজে যায়নি। শরীর খারাপ বলে বসে ছিল বাড়িতে। কারণ সেদিন কলকাতায় দাদাভাই ছিল। দাদাভাই গৌরের সঙ্গে গাড়ি করে নাকি বারাসত অবধি গিয়েছিল। না, গৌর দাদাভাইকে মিটিং-এ নিয়ে যায়নি। কেন নেবে? দাদাভাই তো অন্য জায়গার এমপ্লয়ি। তা ছাড়া প্রোডাকশনের লোক। ম্যানেজমেন্টের লোক তো নয়।

মিটিং সেরে ফিরে পরদিন গৌরের মুখ দেখেই আদি বুঝেছিল যে, মিটিংটা খুব একটা ভাল হয়নি। তাও আদি জিজ্ঞেস করেছিল, কী হয়েছে? গৌর প্রথমে কিচ্ছু বলছিল না, তারপর ওর পেটেন্ট গালি দিয়ে বলেছিল, ‘শালি, ফ্ল্যাট মাঙ্গ রহি হ্যায়।’

‘অ্যাঁ, মানে?’ ঠিক ধরতে পারেনি আদি।

‘তু লিয়াজঁ অফিসার হ্যায় অর ইয়ে নেহি সমঝ পা রাহা হ্যায়? তু ঘণ্টা তরক্কি করেগা। আরে সুধা বলছে যে, ওই কমপ্লেক্সের তিনটে ফ্ল্যাট ওকে ছেড়ে দিতে হবে। তা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনটে ফ্ল্যাট, হ্যাঁ? আমার কি হারামের পয়সা? নিজেরা অশান্তি করে এখন ব্ল্যাকমেল হচ্ছে? দাঁড়াও আমিও দেখছি শালা?’

তা সত্যিই দেখেছে গৌর। আর সেই ব্যাপার নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি। বরং আরও ওপর মহলের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে কথা বলার জন্য চেষ্টা করছে গৌর। বলছে, ‘বাপেরও বাপ হয়। আই উইল টিচ দেম আ লেসন। শালে, পয়সা কেয়া পেড় পে উগতা হ্যায়?’

পয়সা যে গাছে হয় না তা আদি জানে। পয়সা আসলে মাথায় জন্মায়। পয়সা আসলে আরও দশ লক্ষ পয়সার পেটে জন্মায়। তাই সেই গর্ভযন্ত্রণা টের পায় বলে মানুষ পয়সাকে সন্তানের মতো আগলে রাখে।

আদি আর গৌরকে কিছু বলেনি। কী বলবে? গৌর কারও কথা শোনার পাত্র নয়। নিজে যা ভাল বুঝবে তাই করবে। তিনটে ফ্ল্যাটের দাম সব নিয়ে প্রায় সত্তর-আশি লাখ টাকা হবে। তার চেয়ে কম দামে যদি পার্টির ওপর মহল থেকে কাজটা হাসিল করে নেওয়া যায়! আসলে এই ত্রয়ণ বলে ত্যাঁদড় ছেলেটার জন্যই তো এসব হচ্ছে। আদি এখনও জানে না এরপর কী হবে। আর এর ভেতর এমন ফোন!

চমক বলল, ‘কী হল আদিত্য? আপনি এমন চুপ মেরে গেলেন কেন? সুধাদির কথাটা কানে ঢুকেছে তো?’

‘চুপ মেরে’ কথাটা কানে বাজল আদির। চমকের কথার ভঙ্গির ভেতরেই একটা প্রচ্ছন্ন হুমকি রয়েছে। ও বলল, ‘আসলে, কী হয়েছে, জানেন তো…ফ্ল্যাটের এত টানাটানি যে…’

‘ঢপ দেবেন না তো। মটকা গরম হয়ে যায়।’ চমকের ভাষা শুনে আদি বুঝল খোলস ছেড়ে আসল মানুষটা বেরোচ্ছে। ও তো শুনেছে চমক কী ধরনের মানুষ!

চমক আবার বলল, ‘ফ্ল্যাটের টানাটানি চলছে, না? পার্কটার জন্য প্রজেক্ট ঝুলে আছে জেনে, পজেশন পাওয়ার সময় ঠিক নেই জেনে ক’জন টাকা ফেরত চাইছে? আমাদের কি গা…মানে ইয়ে মনে হয় নাকি? সুধাদি বলেছে আর ইন্টারেস্ট নেই এ ব্যাপারে। বুঝেছেন?’

আদি বলল, ‘প্লিজ মিস্টার চক্রবর্তী। পুরোটা শুনুন। জানেন তো বাজারের অবস্থা। তিনটে ফ্ল্যাটের দাম বুঝছেন তো? গৌর স্যারকেও বোর্ড অব ডাইরেক্টর্সের সামনে রাখতে হবে কথাটা। এত টাকার ব্যাপার। সময় তো লাগবেই। দেখবেন, নিশ্চয়ই একটা সমাধান আসবে। আসলে আপনাদের ওই ত্রয়ণ ছেলেটা…’

‘কে?’ ফোঁস করে উঠল চমক, ‘ওই বানচোতটার নাম নেবেন না। আপনি আমায় আর সুধাদিকে যোগাযোগ করেছেন। ওই ত্রয়ণের নাম এর মধ্যে আসে কেমন করে? ও কেউ নয়।’

আদি বলল, ‘কিন্তু ওর লিডারশিপেই তো…’

‘কে লিডার? ত্রয়ণ? আর আমরা কী? শুনুন ওসব ফালতু কথা সাইডে রাখুন। আমি আর সুধাদিই মেন লোক। আর সুধাদি বলেছেন যে, ইন্টারেস্ট নেই। বুঝেছেন?’

আদি হাসল মনে মনে। পেয়েছে। একটা সূত্র ও পেয়েছে। ত্রয়ণকে একটা ঘুঁটি যদি করতে পারে তা হলে কাজ হবে হয়তো। কিন্তু তার জন্য সাবধান হতে হবে। আর তার জন্য ওকে সাহায্য নিতে হবে…আদি বুঝতে পারছে যে, সুধারানি সমাজপতির যথেষ্ট আগ্রহ আছে ওদের ফ্ল্যাটের ওপর। তাই চমক এতক্ষণ ধরে কথা বলছে।

ও বলল, ‘আপনি আর একটু সময় দিতে বলুন সুধাদিকে। আমি পার্সোনালি দেখব ব্যাপারটা। কেমন? প্লিজ, আর একটু।’

চমক চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর যেন ভীষণ অনিচ্ছুক, এমনভাবে বলল, ‘আপনি এত করে যখন বলছেন তখন না হয় আমি দেখছি। কিন্তু ঢপবাজি দিয়ে কিছু হবে না বলে দিচ্ছি। আমার দুর্নাম জানেন তো? মার্চেন্ট মাল্টিপল্‌সকে কীভাবে নর্থ চব্বিশ পরগনা থেকে গোটাতে হয় আমি জানি। বুঝলেন?’

ফোনটা কেটে একটু ঝুম হয়ে বসে রইল আদি। মাথার সেই টলমল ভাবটা অনেকটা কেটেছে। তবু, কেমন যেন ক্লান্ত লাগছে। শালা, ছুটির দিনেও রেহাই নেই। সব কাজ এসে বসবে মাথার ওপর।

আদি ঘড়ি দেখল। সওয়া ন’টা। আরও একটু ঘুম দরকার। শরীরটা কেমন যেন ক্লান্ত লাগছে। বাইরের আকাশটার রং যেন আরও ক্লান্ত করে দিচ্ছে ওকে।

আদি পা গুটিয়ে শুয়ে পড়ল আবার। আজ আর কিচ্ছু করবে না। শুধু আলসেমি করে কাটাবে। কোনও কাজ করবে না। ফোনটাও কি বন্ধ করে রাখবে? কিন্তু যদি মালিনী ফোন করে? তবে? কিন্তু কেন ফোন করবে মালিনী? কী দরকার ওর? ও শুধু তো কলিগ মাত্র। মালিনী তো তা কথায় কথায় বোঝায়। তা হলে রোববার ছুটির দিন ওর গ্র্যান্ড মাদারের ইন্টারেস্টিং কম্পানি ছেড়ে কেন বেকার বেকার ওকে ফোন করবে মালিনী? খেয়েদেয়ে কাজ নেই ওর? আদির ভেতরে একটা হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বাচ্চা ছেলে মুখ ভার করে রইল। মনে হল এখনই বাইরে জানলা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় মোবাইলটা। ফালতু একটা যন্ত্র। অকর্মার ঢেঁকি। সকাল থেকে বাজে বাজে ফোন আসবে। কে কোথাকার মাস্তান। কে কোথাকার গৌর। তাদের মাঝে পড়ে ওকে খিস্তি খেতে হবে! এটা কি ছুটির দিন?

আদি ফোনটাকে বন্ধ করে দিল। আর ঠিক তক্ষুনি ঘরে ঢুকল মা। আদির মাথায় যে রক্তটা উঠেই ছিল সেটা যেন এবার ব্রহ্মতালু ভেদ করে পিচকিরির মতো শূন্যে উঠে যেতে চাইল। মা কেন এল এখন? তাও না বলে হুট করে এমন দরজা ঠেলে ঢুকল কেন? কী চাই মায়ের? আবার কোনও ভ্যানতাড়া নিয়ে আসেনি তো?

আদি বিরক্ত গলায় বলল, ‘তুমি? কী চাই?’

মা একটু আহত হল যেন, ‘কী চাই মানে? এমন করছিস কেন?’

আদি অনেক কষ্টে রাগটা সামলাল। বলল, ‘যা বলতে এসেছ বলো।’

‘তোর কাছে একটা মেয়ে এসেছে।’ মা গম্ভীর গলায় বলল।

‘মেয়ে?’ আদি উঠল। আবার গোটা দৃশ্যটা নৌকোর মতো দুলল সামান্য, ‘কে মেয়ে? কী নাম?’

‘নাম জিজ্ঞেস করিনি।’ মা গম্ভীর গলায় বলল, ‘বসার ঘরে বসে আছে। যা গিয়ে দেখে নে কে। আমায় জ্বালাস না প্রশ্ন করে।’ মা আর দাঁড়াল না। দুদ্দাড় করে চলে গেল।

কে এল এমন সময়? কোন মেয়ে? বিরক্ত লাগল আদির। গতকাল রাতের ওই মেয়েটার তেতো স্বাদ এখনও মন থেকে যায়নি ওর। প্রচুর ঘুমিয়ে গতকাল রাতটাকে দ্রুত মুছে ফেলতে হবে মন থেকে। সেই প্রস্তুতির মাঝে কে এল বাগড়া দিতে?

আদি খাট থেকে নেমে চটিটা পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। ওর ঘরের বাইরে লম্বা সবুজ রঙের মেঝের করিডর। তার শেষ প্রান্তে বসার ঘর। হালকা লেবু রঙের পরদা ঝুলছে। আর তার সামান্য ফাঁক দিয়ে একজন মহিলাকে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ঠিক কে বোঝা যাচ্ছে না। আদি বিরক্ত মুখে ঘরটার দিকে হাঁটা দিল।

জুঁই ফুলের গন্ধটা পরদা সরাতেই পেল আদি। আর নিমেষে হাত-পা জমে গেল ওর। মালিনী? ওর বাড়িতে? কেন? তেলরঙে আটকে যাওয়া শ্যামাপোকার মতো দরজার কাছে আটকে গেল আদি। এ মেয়েটা কেন এসেছে এখানে? কে ওকে ঠিকানা দিল এ বাড়ির? মালিনী কি বিশেষ কিছু বলতে এমন ছুটির দিনে এসেছে? আদি কিচ্ছু বলতে পারল না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। আর ওর মনে হল গতকাল রাতের মতোই আবার কলকাতা কেমন যেন বেঁকেচুরে, ভেঙে, চ্যাপটা হয়ে ধেয়ে আসছে ওর চারদিকে। এ তো মুশকিল হল! এমন ভাঙাচোরা শহরটায় বাঁচবে কী করে আদি?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *