মুহূর্তরা দু’বছর আগে – ১২

১২

রবিবার বলে ছুটিটা পেয়েছে। না হলে সরস্বতী পুজোর দিনেও অফিস যেতে হত জিয়ানাকে। বহু বছর পর এবার বাড়িতে সরস্বতী পুজো করছে ওরা। জিয়ানা করতে চায়নি। কিন্তু শাশুড়িমা এমন করে বললেন যে, আর ‘না’ করতে পারেনি। তবে বুকু আপত্তি করেছিল। বলেছিল, ‘আবার এসব ঝামেলা কেন করছ?’

‘আমি করছি না। মা চান তাই। তবে তুতুলের একটা এক্সপিরিয়েন্স হবে। ওর স্কুলের কয়েকজন বন্ধুকে নেমন্তন্ন করব। মা-বাপি আসবে। আমার অফিস থেকে ললিত আর খুরানা স্যারকে ডাকব। একটা ছোট গেটটুগেদারও হয়ে যাবে।’

‘তাই?’ বুকু ল্যাপটপের থেকে মুখ তুলে চশমাটা মাথার ওপর ওর কাঁচা-পাকা চুলের ভেতরে গেঁথে তাকিয়েছিল, ‘তা বেশ। বাট ডোন্ট এক্সপেক্ট মি টু ডু এনিথিং। আমার এসব ভাল লাগে না।’

‘সে তো জানি। এ আর নতুন কী।’ জিয়ানার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। বুকু মাঝে মাঝে এমন ভঙ্গিতে কথা বলে যেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। যেন দু’বেলা প্রণাম করে অটোগ্রাফ নিতে হবে। জিয়ানার ইচ্ছে করেছিল যে, একটা ঝগড়া বাধিয়ে তুলবে।

কিন্তু বুকু সে পথ মাড়ায়নি। বরং আলতো হেসে বলেছিল, ‘তবে আমার একটা আবদার আছে।’

‘আবদার?’ জিয়ানা ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল।

‘ওই লিস্টে আরও তিনজনকে যোগ কোরো। খেয়াদিদের দু’জন আর রুহান।’

‘কে?’ জিয়ানা অবাক হয়েছিল। বুকু নিজে থেকে গেস্টদের নাম বলছে!

‘ওই যে ছানার কী একটা প্রিপারেশন পাঠিয়েছিল না। আমরা তো একটা রিটার্ন থ্যাঙ্কসও দিইনি। তাই বলছিলাম…’

জিয়ানা আর কথা বাড়ায়নি। বলেছিল, ‘ঠিক আছে। তবে দোহাই সেদিন সবার সামনে তোমার কাজ খুলে বোসো না। একটু অ্যাটেন্ড কোরো গেস্টদের।’

বুকু মাথার ওপর থেকে চশমাটা নামিয়ে চোখে দিয়ে আবার ফিরে গিয়েছিল কাজে। আর যেতে যেতে বলেছিল, ‘তুমি তো আছ। জানোই তো এসব আমার আসে না। আরে, ছাগল দিয়ে কি আর হাল চাষ হয়?’

জিয়ানা আর কথা বাড়ায়নি। তবে রুহান আর খেয়াদিদের ও ফোনটা নিজেই করেছিল। মানে প্রথমে খেয়াদিদের তারপর সেখান থেকে রুহানের নম্বর নিয়ে রুহানকে।

রুহান তো আশ্চর্যই হয়ে গিয়েছিল জিয়ানার ফোন পেয়ে। যদিও সম্পর্কে কাকিমা হয়, তবু যেহেতু বুকুকে দাদা বলে তাই জিয়ানাকে বউদি বলেই কথা বলেছিল রুহান। ছেলেটার গলাটা ফোনে একদম বাচ্চাদের মতো লাগছিল।

জিয়ানা বলেছিল, ‘তুমি রুহান বলছ তো? আমি জিয়ানা।’

রুহান এক মুহূর্তও দেরি করেনি, বলেছিল, ‘ও বউদি! বলুন!’

‘তুমি চিনতে পেরেছ? আমি তো ভাই তোমায় কোনওদিন দেখিনি। কীভাবে চিনলে?’

‘বুকুদার বউকে চিনব না? বুকুদা কি যেমন তেমন লোক? কত গুণী মানুষ। আমার ছোটবেলার হিরো যে।’

‘ও বুকুদার জন্য চিনেছ।’ জিয়ানা মজা করে একটু গম্ভীর ভাব দেখিয়েছিল।

‘না বউদি, শুধু তাই নয়। আপনার নামটাও তো জানি। খুব আনকমন। তাই মনে আছে।’

‘তাই? যাক গে, যে জন্য ফোন করেছিলাম। সামনে সরস্বতী পুজোর দিন দুপুরে আমাদের বাড়িতে এসো। বুকুদা কিন্তু তোমার কথা বিশেষভাবে বলেছে। আর আমি তো বলছিই।’

রুহান হেসেছিল প্রাণ খুলে, ‘বুকুদা বলেছে?’

‘হ্যাঁ, তাই বলছিলাম। জানোই তো কেমন আপনভোলা মানুষ। সে যখন বলেছে, তুমি নিশ্চয়ই খুব স্পেশ্যাল। ভুল কোরো না কিন্তু। দিনটা রবিবার। নিশ্চয়ই অসুবিধে হবে না।’

তা এসেছিল রুহান। আর পুজোর প্রসাদ খেয়ে, দুপুরের খাবার খেয়ে তুতুলের সঙ্গে খেলা করে চলে গেল একটু আগে। তুতুলের খুব পছন্দ হয়েছে রুহানকে। রুহান চলে যাওয়ার সময় খুব কান্নাকাটি করেছে। জিয়ানা অনেক কষ্টে মেয়েকে টেনে এনে ঘরে শুইয়ে থাবড়ে থুবড়ে ঘুম পাড়িয়েছে। কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত ছিল বলেই কিনা কে জানে তুতুল এই বিকেলে ঘুম নিয়ে ঝামেলা করেনি।

তুতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল জিয়ানা। আধো অন্ধকার ঘর। তার ভেতর তুতুলের মুখটা অবিকল নিজের মতো লাগছে। মাতৃমুখী কন্যা নাকি দুঃখী হয়। কবে সেই ছোটবেলায় শুনেছিল। আজ আবার হঠাৎ এখন মনে পড়ল। ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল জিয়ানা। ওকেও তো মায়ের মতোই দেখতে। তা হলে? তা হলে কি ও অসুখী?

কিগান অবশ্য বলত, ‘তোর মাকে অনেক সুন্দর দেখতে। ভুল করে তোর প্রেমে পড়লাম। তোর মাকে আগে দেখলে…’

জিয়ানা হাসত, আলতো করে ঘুষি মেরে বলত, ‘লম্পট!’

কিগান বলত, ‘তবে যাই হোক, তোকে তো তোর মায়ের মতো দেখতে অনেকটা। ঠিক আছে, তাতেই হবে।’

কী হবে? কতটা হবে? তাতেই সত্যি হবে তো? সেসব আর জিজ্ঞেস করেনি জিয়ানা। কারণ ও তো তখন জানত কিগান ওর। সম্পূর্ণটাই ওর। তাই প্রয়োজনই হয়নি কিচ্ছু জিজ্ঞেস করার। বরং কিগান কিছু বলতে গেলেই এমন করে তাকাত যেন ও তো জানে কিগান কী বলতে চায়। বরং উলটে ধমক দিত তখন। বলত, ‘আমায় শুধু প্রেম নিবেদন করলে কিন্তু কেমিস্ট্রিতে গোল্লা পাবি। এগজামিনার কিন্তু তোর চাঁদবদন দেখে নম্বর দেবে না। পড়াশোনা করছিস তো?’

কিগান হাসত, বলত, ‘আরে কেমিস্ট্রির সঙ্গে প্রেম করার সারাজীবন সময় পাব। তোর সঙ্গে যদি না পাই! তাই সেরে রাখছি। তোর বাবা-মা যদি আমায় সুযোগ না দেয়! যদি তখন তুই পাল্টি খেয়ে যাস? আয়াম জাস্ট ইউজিং দ্য বেস্ট অপরচুনিটি অফ মাই লাইফ।’

জিয়ানা হাসত। তারপর ঠোঁট উলটে বলত, ‘তা ঠিক। দাঁড়া মাকে আগে তোর কথা বলি। যদি মা অ্যাপ্রুভ করে তা হলে হবে, না হলে এই কেমিস্ট্রির সঙ্গে প্রেম করে কাটাতে হবে সারাজীবন। বুঝেছিস?’

এখন কার সঙ্গে প্রেম করে কিগান? কোথায় থাকে ও? বিয়ে করেছে? কেমন আছে? আর কি জিয়ানার কথা মনে আছে ওর? কে জানে! জিয়ানা তো নিজের হাতেই সব দরজা-জানলাগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল। নিজের হাতেই তো কাঁটাতার বুনে দিয়েছিল ওর আর কিগানের মধ্যে। আর তারপর থেকে তো ওরা সম্পূর্ণ আলাদা দুটো দেশ। তারপর থেকেই তো বুকুর সঙ্গে আলাপ। ঘোরাফেরা। বিয়ে। বিদেশ। তুতুল। ওর ভেতর কোথাও তো কিগান নেই। কোত্থাও তো প্রেম আর স্পর্শ করে না জিয়ানাকে। মাঝে মাঝে ওর মনে হয়, সত্যি ওই জীবনটা ছিল তো? ওই গোলাপি বা নীল সালোয়ার পরা মেয়েটা সত্যিই ছিল তো? সত্যি ও কোনওদিন লেকের রাস্তা ধরে হাঁটত কিগানের সঙ্গে? কিগান কি দূরে একা দাঁড়িয়ে থাকত কখন বাসে করে এসে নামবে জিয়ানা, সেই অপেক্ষায়? আচ্ছা, সেইসব দৃশ্যের ভেতরের ওই মেয়েটা সত্যি জিয়ানা তো? সে অন্য কেউ নয় তো? কোনও এক অদ্ভুত স্বপ্নের স্মৃতিকে সত্যি ভেবে মাথায় নিয়ে ঘুরছে না তো জিয়ানা?

মা। মাকে কেন যে, এত তাড়াতাড়ি কিগানের কথা বলতে গেল ও!

খোলা জানলা দিয়ে একঝলক হাওয়া এসে জানলার সামনে ঝোলানো উইন্ড চাইমটা একটু নাড়িয়ে দিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে টুংটাং শব্দ, জাল থেকে বের করে দেওয়া প্রজাপতির মতো ছড়িয়ে গেল চারদিকে। জিয়ানার খেয়াল পড়ল। ও দেখল তুতুল ঘুমিয়েই চলেছে। গত বছর দশেক এভাবেই কি ঘুমোয়নি জিয়ানা?

খুব আবছা পায়ে বিছানার থেকে নামল জিয়ানা। তুতুলের ঘুম ভীষণ পাতলা। চট করে ভেঙে যায়। রুহানের জন্য যেভাবে মেয়ে কেঁদেছে আজ, তারপর অনেক কষ্টে ঘুম পাড়ানো গেছে। একবার জেগে গেলে খুব মুশকিল হবে।

তবে রুহানকে প্রথম দেখে আজ একটু অবাকই হয়েছিল। আরে এই ছেলেটা রুহান? অফিসে তো দু’-একবার দেখেছে। টুকটাক সাইটের কাজকর্ম দেখাশোনা করে না ও? রুহান যে-পোস্টে আছে তার সঙ্গে জিয়ানার কাজের আকাশ-পাতাল তফাত। ওদের মতো সুপারভাইজারদের সঙ্গে জিয়ানাদের কথাই বলতে হয় না। রুহানকে দু’-একবার পারচেস ডিপার্টমেন্টে দেখেছে ও। তাই আজ বসার ঘরে যখন কলির পিছন পিছন রুহান এসে ঢুকেছিল তখন দেখে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল ও।

আসলে আজকাল মনে হয় পৃথিবীটা দেশলাই বাক্সের মতো ছোট। মনে হয় সবাই এ ওর গায়ে গা লাগিয়ে বেঁচে আছে।

জিয়ানাকে দেখে রুহানও যেন থমকে গিয়েছিল। তারপর বলেছিল, ‘আপনিই বউদি? অফিসে আপনাকে দেখেছি না?’

জিয়ানা হেসে বলেছিল, ‘তাই তো! কী অদ্ভুত কোয়েনসিডেন্স।’

জিয়ানার কলিগ ললিতও আশ্চর্য হয়েছিল, ‘আরে, তোমরা রিলেটেড?’

বুকু সোফার এক কোণে রুহানকে হাত দিয়ে বসতে বলে বলেছিল, ‘উই আর অল রিলেটেড। একটা তাস ধরে নাড়ালে গোটা ঘরটাই ভেঙে পড়বে। শুধু আমরা বুঝতে পারি না যে, আমরা যুক্ত। তাই বড্ড বেশি আমি-আমি, আমরা-আমরা করি, বুঝি না যে, এই পৃথিবীর সব কিছুই পরস্পরের সঙ্গে অরগ্যানিক্যালি যুক্ত।’

জিয়ানার হাসি পেয়েছিল। এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা বুকু হঠাৎ এমন দার্শনিক হয়ে উঠেছিল কেন কে জানে! রুহান বোকার মতো হেসে বসে পড়েছিল বুকুর পাশে। তারপর গল্প জুড়েছিল। আর জিয়ানা অবাক হয়ে দেখেছিল বহু বহু বছর পর বুকু কী সাবলীলভাবে কথা বলছে কারও সঙ্গে!

জিয়ানা মেয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে আলতো করে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। সকাল থেকে আজ অনেক খাটুনি গেছে। বহু দিন এসব পুজো-আচ্চা করেনি, তাই প্রায় ভুলে গিয়েছিল কতটা ঝঞ্ঝাটের হয়। নেহাত গতকাল থেকে মা এসেছিল। তাই হাতে হাতে করেছে। আর খেয়াদিও এসে করেছে। নীচের কাকিমাও এসেছিল। কিন্তু বাতের ব্যথা বলে করতে পারেনি কিছু। তবে তুতুল প্রথম প্রথম এইসব ফল কাটা, ঠাকুর সাজানো, বাড়ি ঘরদোর সাজানোটা এনজয় করলেও পরে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। আর ওর স্কুলে যে-ক’জন বন্ধুকে নেমন্তন্ন করেছিল, তারাও আসেনি। সবার বাড়িতেই নাকি পুজো হয়। রুহান এসে তুতুলের ওই একঘেয়েমি কাটিয়েছিল।

একটা আড়মোড়া ভেঙে শাশুড়িমায়ের ঘরের দিকে গেল জিয়ানা। আজ সারাটা সকাল হুইলচেয়ারে বসে ছিলেন মানুষটা। কারও কথা শোনেননি। বরং জড়িয়ে জড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আমার ভাল লাগছে।’

ঠাকুরদেবতার সঙ্গে এই বয়স্ক মানুষগুলোর যে কী সম্পর্ক কে জানে! এত ভক্তি কোত্থেকে পায় এরা? জিয়ানার অবাক লাগে। ভক্তি, ভাব, সমর্পণ এসব তো কই ওর ভেতরে আসে না! যাদের আসে, তারা কী উপায়ে আনে এসব?

শাশুড়িমা এখন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। নার্সটিও পাশের চেয়ারে বসে একটু ঘাড়টা এলিয়েছে। গোটা বাড়িটাই কেমন যেন একটু ঝিমিয়ে পড়েছে। জিয়ানার অদ্ভুত লাগল। কলিটা কই? ও-ও কি ঘুমোচ্ছে নাকি? না বাইরে গেছে?

ঠিক তখনই ফোনের রিংটা শুনতে পেল জিয়ানা। পুরনো হিন্দি গানের সুরে মোবাইল ফোনটা বাজছে। ডাইনিং রুমটা এই প্যাসেজের পাশেই। সেখানে ফ্রিজের মাথাতেই রাখা আছে ফোনটা। এসময় আবার কে ফোন করল?

দ্রুত পায়ে খাওয়ার ঘরে গিয়ে ফোনটা তুলল জিয়ানা। ললিত। আরে, ওর আবার কী হল? এতক্ষণ তো এখানেই ছিল।

‘হ্যালো? কী হল?’ জিয়ানা প্রশ্ন করল।

‘জিয়ানা, মানিব্যাগটা বোধহয় তোমাদের বাড়িতে ফেলে এসেছি।’ ললিতের গলায় টেনশনটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

‘সে কী! এখানে ফেলে গেছ?’

‘বোধহয়।’ ললিত বলল, ‘আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স আর চারটে ক্রেডিট কার্ড আছে। একটু দেখবে প্লিজ। আমি হোল্ড করছি।’

‘দেখছি,’ জিয়ানা খাওয়ার ঘরটা দেখল। না, নেই। পাশের বসার ঘরটায় দেখল, তাও নেই। বড় লিভিং রুমটায় পুজো হয়েছে। সেখানেও ললিত গিয়েছিল। কিন্তু জিয়ানা খুঁজে দেখল সেখানেও নেই। সর্বনাশ। ললিত অন্য কোথাও ফেলেনি তো? মানে, রাস্তায় পড়ে যায়নি তো?

জিয়ানা চিন্তিত মুখে বলল, ‘ললিত কোথাও দেখছি না তো। তুমি যাওয়ার পর রুহান গেল। তারপর আমি মেয়েকে নিয়ে ঘুম পাড়াতে গেলাম। এর ভেতর…’

ললিত বলল, ‘রুহান আবার…’

‘কী যা তা বলছ!’ জিয়ানা ধমক দিল।

‘না, মানে সরি। তা ঠিক বলছি না। আচ্ছা, একটু ঠান্ডা মাথায় দেখো। পেলে একটা ফোন কোরো প্লিজ। লাইসেন্স, ক্রেডিট কার্ড হারালে শালা পুলিশে ডাইরি করতে হবে। বহুত হুজ্জুতের কেস। প্লিজ একটু দেখো।’ ললিত ফোনটা রেখে দিল।

ললিতের কথার ইঙ্গিতটায় মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল জিয়ানার। মানুষ কত সহজে অন্যের দিকে আঙুল তুলে দেয়!

রুহানকে দেখলে বোঝা যায় যে, অবস্থাটা খুব একটা ভাল নয় ওর। কোম্পানিতে যে-পদে চাকরি করে তাতে মাইনে খুবই কম পায়। তবে আজ শুনল খুব ভাল ক্রিকেট খেলে। খেয়াদি বলছিল। কিন্তু রুহান অবশ্য তাতে সায় দেয়নি। বরং বলেছিল, ‘না বউদি। একসময় মোটামুটি খেলতাম। এখন খেলাটা গেছে। ঠিক পারি না খেলতে। প্রথম শ্রেণির দলে চান্স হয় না।’

কথাগুলো এমন বিষণ্ণ গলায় বলেছিল রুহান যে, ওর মুখের হাসিটা দেখে কষ্ট হয়েছিল জিয়ানার। এই কষ্টের ধাঁচটা জিয়ানা বোঝে। কোনও কিছু হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, আর তবু মানুষ কিছু করতে পারছে না। সব জেনে, সব বুঝেও কিছু করতে পারছে না। তাকে শুধু দেখতে হচ্ছে যে, ধীরে ধীরে সে তলিয়ে যাচ্ছে। এই কষ্টটার মধ্যে যে অসহায়তা লুকিয়ে থাকে, তা নিজে অনুভব করেছে জিয়ানা। তাই রুহানের মুখ দেখে বুঝেছিল ও।

নিছক সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই বলেছিল, ‘ভাল করে মন দিয়ে খেলো, দেখবে ঠিক হয়ে যাবে সব। চিন্তা কোরো না।’

রুহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেসেছিল আবার। বলেছিল, ‘চিন্তা করি না আর।’

ফোনটা আবার ফ্রিজের মাথায় এনে রেখে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল জিয়ানা। সত্যিই তো কোথায় গেল মানিব্যাগটা? ওদের বাড়ি থেকে কখনও কিচ্ছু হারায় না।

অনাবশ্যক কার্পেটগুলো তুলে দিয়েছে ও। তাই শূন্য মেঝের প্যাসেজে পায়ের শব্দ পেয়ে পিছনে ঘুরল জিয়ানা। বুকু। জিন্‌স আর ফতুয়া পরে এসেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে বেরোবে। রোববার দিন বিকেলে কোথায় বেরোচ্ছে ও? জিয়ানা জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

বুকু বুঝল। বলল, ‘আমি একটু বেরোচ্ছি। লন্ডন থেকে ফোন এসেছে। কিছু জিনিস ক্রসচেক করে আজকেই পাঠাতে হবে। কাল মানডে ফার্স্ট আওয়ারে মিটিং আছে।’

‘ও’, কথাটা শুনেও একটু অন্যমনস্কভাবে বলল জিয়ানা। আসলে ললিতের ইঙ্গিতটা মাথা থেকে বেরোচ্ছে না কিছুতেই।

বুকু দেখল জিয়ানাকে। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু হয়েছে? ইউ লুক লস্ট।’

‘হ্যাঁ,’ বিরক্তটি আর চেপে রাখতে পারল না জিয়ানা, ‘ললিত মানিব্যাগটা খুঁজে পাচ্ছে না। আমায় ফোন করেছিল। বললাম পাচ্ছি না এখানে, তখন রুহানের নামে একটা ইঙ্গিত করল।’

‘রুহানের নামে?’ বুকু এতক্ষণ ঢিলেঢালা ভাবে কথা বলছিল, এবার হঠাৎ যেন টানটান হল, ‘কেন, রুহানের নামে বলছে কেন? মানিব্যাগটা সোফার কুশনের ফাঁকে গুঁজে পড়ে ছিল। আমি তুলে ঘরের ভেতরে টেবিলের ওপর রেখেছি। এর ভেতরে রুহান আসে কোথা থেকে?’

বুকুর চাপা রাগটা কান বা চোখ কিছুই এড়াল না জিয়ানার। ওর অবাক লাগল, যে-মানুষটা কোনও কিছুতেই রিঅ্যাকশন দেয় না সে হঠাৎ এমন রাগ রাগ গলায় কথা বলছে কেন?

বুকু বলল, ‘বোঝো, কেমন লোকজনদের সঙ্গে কাজ করো! যাক গে, আমি আসি।’

বুকু আর না দাঁড়িয়ে ছোট আলমারির মাথা থেকে গাড়ির চাবিটা তুলে বেরিয়ে গেল। জিয়ানা ঠোঁট কামড়ে বুকুর চলে যাওয়ায় দিকে তাকিয়ে রইল। শেষ কথাটা কি শুধু ললিতের উদ্দেশেই বলা? না, তার ভেতরে ভেতরে জিয়ানার জন্যও বিষ লুকোনো আছে? ললিতের সূত্র ধরে বুকু কি ওকেও কিছু বলে গেল?

মা-বাবা ব্যালকনিতে বসে তখন থেকে গল্প করে যাচ্ছে। খেয়াদিরা অনেক আগেই নীচে চলে গেছে নিজের মায়ের কাছে। জিয়ানার ক্লান্তিটা আবার ফিরে এল। আর এবার সঙ্গে করে নিয়ে এল একটু বিষাদ আর বেশ অনেকটা রাগ। বুকুর শেষ কথাগুলোর মধ্যে সত্যিই কি কোনও ইঙ্গিত ছিল? আচ্ছা, এমন একটা মানুষকে হঠাৎ বিয়ে করতে কেন রাজি হয়েছিল জিয়ানা? শুধু মা বলল বলে? শুধু মায়ের চাপের জন্য? নাকি অমন কেরিয়ার আর উন্নতির সোনার সিঁড়িটা দেখে ওরও মাথা ঘুরে গিয়েছিল? কিগানকে কেন ওর বাবা আর মা পছন্দ করল না?

কিগান নামটা মনে পড়তেই হঠাৎ খচ করে যেন বুকে লাগল জিয়ানার। এক মুহূর্তের ভেতরে কে যেন দুলিয়ে দিল ওর বেঁচে থাকাটুকু। জিয়ানা ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলাতে চাইল। একটু সময় নিয়ে সামলাল ও। তারপর শোওয়ার ঘরের দিকে গেল।

টেবিলের ওপর মেরুন মানিব্যাগটা পড়ে রয়েছে। ও শোওয়ার ঘরের ল্যান্ডলাইন থেকে ললিতকে ফোনে ধরল।

‘হ্যালো?’ ললিত দু’বার রিং হতেই ধরল ফোনটা।

‘তোমার মানিব্যাগ পেয়ে গেছি। বুকু তুলে রেখেছিল। কাল অফিসে দিয়ে দেব। কেমন?’ জিয়ানা দায়সারাভাবে বলল।

‘থ্যাঙ্ক গড।’ ললিতের গলা থেকেই বোঝা গেল যে, ও টেনশনে ছিল।

‘আর টেনশন কোরো না, ঠিক আছে?’

‘না, আর করব না। বাই দ্য ওয়ে, খুরানা স্যার ফোন করেছিলেন। তোমার বাড়ির ডিরেকশন জিজ্ঞেস করছিলেন।’ ললিত বলল।

‘তাই?’ জিয়ানার অবাক লাগল, ‘তা স্যার আমাকেই তো ফোন করতে পারতেন।’

‘জানোই তো স্যারকে। বললেন, তোমার বাড়িতে গেস্টরা রয়েছেন, তাই এসব জিজ্ঞেস করে বিরক্ত করবেন না। আমি ডিরেকশন দিয়ে দিয়েছি। ঘণ্টাখানেকের ভেতরে পৌঁছে যাবেন।’ ললিত হাসল। তারপর আবার ধন্যবাদ জানিয়ে রেখে দিল ফোনটা।

ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দার দিকে গেল জিয়ানা। ওদের বারান্দাটা বেশ সুন্দর। পুরনো দিনের বলে, বড়ও। সাবেক ধরনের গ্রিল দিয়ে ঘেরা। লাল রঙের মেঝে। বাড়ির সব কিছু পালটালেও বারান্দাটা পালটায়নি বুকু। সেই ভিন্টেজ কলকাতার একটা কুচি যেন থেকে গিয়েছে। বারান্দায় প্রচুর গাছ রেখেছে জিয়ানা। সেই জন্যই কিনা কে জানে বারান্দাটা আরও সুন্দর লাগে। দুটো বিনব্যাগ আর একটা ইজিচেয়ার রাখা থাকে বারান্দায়।

জিয়ানা দেখল বাবা ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছে। আর মা পাশের একটা বিনব্যাগে বসে নিচু গলায় রবি ঠাকুরের গান গাইছে। জিয়ানা বারান্দায় ঢোকার দরজার থেকে দেখল পুরো দৃশ্যটা। দু’জনের কেউ বুঝতে পারছে না যে, জিয়ানা দাঁড়িয়ে রয়েছে। মা বিভোর হয়ে গাইছে আর বাবা শুনছে। বাবার চোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মা গাইছে,

‘জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি

তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি।

মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন

তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম॥’

বাবার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। ছোট্ট, এক কুচি জল চোখের পাতা থেকে দুষ্টু ছেলের মতো লাফিয়ে নেমেছে গালে। তারপর মনমরা, বন্ধুহীন বালকের মতো মাথা নিচু করে হাঁটছে গালের ঢাল বেয়ে। আশপাশের বাড়ির থেকে ধাক্কা খেয়ে আসা নরম আলো বারান্দার সবুজের সঙ্গে মিশে এসে পড়েছে জলের ভেতর। তাতে যেন মনে হচ্ছে নীল এক ফোঁটা জল বয়ে চলেছে একা। দুঃখী মানুষের ভেতরের বরফের পাহাড় থেকে বেরিয়ে সে মিশতে চাইছে সময়ে। মিশতে চাইছে অনন্ত গোধূলির সেই নদীতে। সেই নদী, যেখানে এ গান ‘সত্য’। যেখানে একদিন প্রথম শিখে এ গান একটি বালিকা শুনিয়েছিল তার বাবা-মাকে। সেই পা ভাঁজ করে বসে, সামান্য অপটু হাতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে একটি বালিকা বহু বহু দিন আগে শুনিয়েছিল,

‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম

নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম॥

মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন

তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম॥’

জিয়ানা এখনও দেখতে পায় সেই শেষ বিকেলটা। সেদিনও শীতকাল ছিল। ফুলহাতা গোলাপি সোয়েটার, মাথায় বিনুনি, সামনে রাখা বাদামি হারমোনিয়াম। আর দিদি গাইছিল, সুর করে টেনে টেনে গাইছিল, ‘তু্মি রবে নীরবে হৃদয়ে মম’।

সেই গোলাপি আলো। পরদার আলতো উড়ে যাওয়া। ছোট্ট সুন্দর আঙুলগুলোর হারমোনিয়ামের ওপর ঘুরে বেড়ানো। আলতো প্রজাপতির মতো একটা চিকন সুর উড়ে বেড়াচ্ছিল ঘরে। আর ছোট্ট জিয়ানা দেখেছিল চেয়ারে বসে রয়েছে বাবা। বিভোর হয়ে শুনছে গান। আর চোখের কোল দিয়ে বয়ে নামছে এক কুচি জল। আনন্দের।

জল তার ধর্ম পালটায়। জীবন পালটে যায় অনেক। নদী ঘুরিয়ে নেয় তার গতিপথ। আর বহু বহু বছর পর তেমনই এক শীতের শেষ বিকেলে বাবা বসে থাকে চুপ করে। সেই গান ফিরে আসে আবার। সেই সুর ফিরে আসে। দুঃখ বেদনা আর ‘সফল স্বপন’, তাও ফিরে আসে। শুধু সে ফিরে আসে না। সেই গোলাপি মেয়েটা আর পা ভাঁজ করে বসাটুকু মনের মধ্যে নিয়ে কাটিয়ে দিতে হয় অনন্ত সময়। জল তার রং পালটে মাথা নিচু করে হাঁটে। জীবন্ত মানুষের ভেতরের একটা মানুষ মরে যায় নিভৃতে।

মা গান শেষ করে এবার তাকাল বাপির দিকে। বিস্মিত গলায় বলল, ‘আরে, তুমি কাঁদছ?’

বাপি তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে বসল। দু’হাতে চোখের কোণের জল মুছে হাসার চেষ্টা করল। বলল, ‘দুর…কোথায়? তুমি না কী যে বলো।’

বাপির গলাটা ধরা ধরা শোনাচ্ছে। জিয়ানার কষ্ট হল খুব। বাপি চিরকাল নরম সরম মানুষ। জোরে কথা বলতে পারে না। বকতে পারে না। যত কষ্টই হোক, চুপ করে থাকে। তাই লোকজনও খুব করে সুবিধে নেয় তার।

মা বলল, ‘তুমি কাঁদছ কেন? এ বাবা। তোমার বয়স বাড়বে না!’

বাপি ইজিচেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে গিয়েও বলল না। চোখ পড়ল জিয়ানার ওপর। জিয়ানার অস্বস্তি লাগল। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। বাপি হাসল, ‘আয় মা। বোস।’

মা-ও ঘুরে তাকাল এবার, ‘আরে মিষ্টি তুই? কখন দাঁড়িয়েছিস এসে?’

জিয়ানা আলতো করে হেসে গিয়ে বসল একটা বিনব্যাগে, বলল, ‘এই তো এলাম। তুমি এখনও কী ভাল গাও মা!’

‘তাই? ধ্যাৎ। কতদিন প্র্যাকটিস নেই।’ মায়ের ফরসা মুখটা সামান্য লাল হল। মা লজ্জা পেয়েছে।

জিয়ানা মায়ের হাত ধরে বলল, ‘কেন প্র্যাকটিস করো না? কী ভাল গাও এখনও। বাপি, তুমি কিছু বলতে পারো না?’

‘তোর বাপি কী বলবে? দেখ না গান শুনে কাঁদছে।’ মা বলল।

বাপি হাসল। অপ্রস্তুতের হাসি। সন্তানের সামনে কোন বাবাই বা নিজেকে দুর্বল দেখাতে চায়?

বাপি বলল, ‘তোর মা’র কথায় কান দিস না। শোন, তোরা কথা বল, আমি একটু ভেতরে গিয়ে টানটান হই। পিঠটা ব্যথা করছে।’

মা উদ্বিগ্ন হল, ‘তুমি ওষুধ খাওনি সকালে? আর কেন যে ব্যায়ামটা বন্ধ করো! তোমায় নিয়ে পারি না। ডাক্তারের কথা শুনলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হবে?’

বাপি বারান্দা থেকে ঘরে যেতে যেতে বলল, ‘এমন টেনশন কোরো না। আমি ঠিক আছি। তোমরা মা মেয়েতে মিলে একটু গল্প করে নাও।’

বাপি চলে যেতেই মা জিজ্ঞেস করল ‘হ্যাঁরে, বুকু কই?’

‘বুকু? একটু বেরিয়েছে। অফিস যাবে বলল।’

‘অফিস? সে তো অনেক দূর। আর তারপর আজ রোববার না? আজও অফিস?’ মা অবাক হয়ে তাকাল জিয়ানার দিকে।

জিয়ানা হাসল, ‘অত বড় চাকরি করে। অত টাকা মাইনে। এমনি এমনি মুখ দেখে দেয়? প্রচুর খাটিয়ে উশুল করে নেয়। কখনও কখনও রাতেও ফেরে না আজকাল।’

‘রাতেও ফেরে না!’ মা ভুরু কুঁচকে তাকাল। তারপর সামান্য দ্বিধার সঙ্গে বলল, ‘তোদের মধ্যে সব ঠিক আছে তো?’

‘মানে?’ জিয়ানা বিরক্ত হয়ে তাকাল, ‘ঠিক আছে মানে?’

‘না…,’ মা ঠোঁট চাটল, ঢোঁক গিলল। তারপর একটু সময় নিয়ে বলল, ‘না, ঠিক বুঝি না তো। তাই ভয় লাগে। বুকু তো এমনিতেই কম কথার মানুষ। তাই…’

‘তাই কী? দেখো, বিয়ের বহু বছর হয়ে গেছে। আমরা তো আর টিনএজার নই যে প্রেমে হাবুডুবু খাব।’

মা বলল, ‘এমন করে বলছিস কেন? আমাদের কথা শুনে কি খুব খারাপ আছিস? এমন বর, এত টাকা, অমন একটা পুতুলের মতো মেয়ে। কোথায় অভাব তোর? এমন ভাব করছিস যেন তোকে হাত-পা বেঁধে আমরা ফেলে দিয়েছি জলে!’

‘শুধু টাকা দেখো না তোমরা?’ জিয়ানার শরীরের ভেতরটা রাগে পাক দিয়ে উঠল।

‘তুই এমন করছিস কেন মিষ্টি? এমন করে কথা বলছিস কেন?’ মায়ের গলা ভারী হয়ে গেল হঠাৎ। মা রুমালটা চেপে ধরল চোখে।

‘আঃ, কাঁদছ কেন?’ জিয়ানার বিরক্ত লাগল।

‘কাঁদছি কেন? বুঝবি। মেয়ে বড় হয়ে তোকে এমন বলুক, তখন বুঝবি। আমরা কি অর্থপিশাচ যে শুধু টাকা চাইব? আমরা তোর ভাল চেয়েছি বলেই…’

‘আর বোলো না।’ জিয়ানা অনেক কষ্টে রাগ সামলাল। ভাল, সবাই এত ভাল চায় কেন কে জানে!

‘তা তুই বা আমার সব কথা শুনিস কোথায়?’ মা সামলে নিয়ে তাকাল জিয়ানার দিকে, ‘বললাম, তুতুলের একটা ভাই বোন নে। শুনছিস আমার কথা?’

‘আশ্চর্য। আমরা আর চাই না।’

‘জীবনে কখন কী হয় তার ঠিক আছে? দেখছিস তো আমাদের। একটু আগে দেখলি তো তোর বাবাকে? এক সন্তান ভাল নয়।’

‘আচ্ছা দুই সন্তান মানে কি ব্যাক-আপ সিস্টেম? মানুষের বদলে আর একটা মানুষ? তোমরা বলো যে, মেটিরিয়াল চিন্তা করো না। কিন্তু দেখো, সেটাই বলছ। কেউ কারও বিকল্প হতে পারে? আমি হতে পেরেছি দিদির বিকল্প? হতে পারলে বাপি এমন কষ্ট পেত? তোমরা কেন এভাবে চিন্তা করো? মানুষ জামাকাপড় নাকি যে, একটা ছিঁড়ে গেলে আর একটা ব্যবহার করা যাবে?’

‘আঃ, তুই এভাবে ভাবছিস কেন?’ মা হাত তুলল, ‘তুতুলের তো একজন সঙ্গীও হবে। সেটা তোরা ভাববি না? শুধু নিজেদের ইচ্ছেটাই দেখবি?’

‘মা,’ জিয়ানা বলল, ‘স্কুল, নাচ, সাঁতার, ড্রইং, গল্পের বই… এরপর আর খেলার সঙ্গী লাগে? তোমাদের সময় এত অলটারনেটিভ ছিল না, তোমরা অনেক সন্তান চাইতে। কিন্তু এখন দিন পালটেছে। আমরা আর ইন্টারেস্টেড নই।’

‘তা হলেও…’ মা বলল, ‘বুকু চায় না? ও খুশি নয় তোকে নিয়ে?’

‘কী মুশকিল!’ জিয়ানা দাঁড়াল, ‘তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলাই বিপদ। সবসময় এক ধাঁচের কথা। কেন এমন বলছ?’

‘আঃ, তোর বড্ড মেজাজ,’ মা বিরক্ত হল, ‘তোর বাপিও বলছিল এই কথাটা।’

‘বাপি বলছিল?’ জিয়ানা ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ, বাপি বলছিল যে, তুতুলের আর একটা সঙ্গী হলে ভাল হয়।’

‘মা, কেন সব কিছু বাপির নাম দিয়ে চালাও?’ জিয়ানার বিরক্ত লাগল।

‘না রে সত্যি, তোর বাপি মাঝে মাঝেই বলে।’

জিয়ানা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এ মায়ের পুরনো ট্যাকটিস। কোনও কিছু নিজে বলে করাতে না পারলেই বাপির নাম বলে। সেই কিগানের সময়ও এমন করেছিল। জিয়ানা বুঝতে পারে না যে, অতই যদি বাপির বলার ইচ্ছে হয়, বাপি নিজে বলে না কেন?

জিয়ানা বলল, ‘মা, আমি আর সেই ছোট্টটি নেই। বাপির যদি বলার ইচ্ছে হয় নিজে বলে না কেন? সবসময় তুমি বলো কেন?’

‘তোর বাপিকে জানিস না? কত চুপচাপ আর লাজুক মানুষ। জানিস তো সবাই সুবিধে নেয়।’

‘তুমিও নাও মা, তুমিও সুবিধে নাও।’ জিয়ানা ফস করে বলে ফেলল।

‘মানে?’ মা থতমত খেয়ে তাকাল, ‘তুই আমায় এমন বললি?’

‘বাদ দাও। ঘরে চলো। কলিটা যে কোথায় যায়! মাথা ধরেছে খুব, চা খেতে হবে। ভাল লাগছে না।’

মা তাও মাথা নামিয়ে বসে রইল। বিড়বিড় করে বলল, ‘তুই আমাকে এমন করে বললি? আমি তোর মা, তাও বললি? পারলি বলতে? এত বছর হয়ে গেছে, তাও তুই এখনও এমন করে বলিস? তুই ভুলিসনি না রে? সেই ছেলেটাকে ভুলিসনি, না? তোর মাথাটা ও তখন এমনভাবে খেয়েছিল? কী সাংঘাতিক ছেলে রে!’

‘মানে? কী বলছ তুমি? কে সাংঘাতিক? কে মাথা খেয়েছে আমার? তুমি কার কথা বলছ?’ জিয়ানা চোয়াল শক্ত করল।

মায়ের গলায় রাগ, ‘বুঝতে পারছিস না কার কথা বলছি?’

‘শোনো মা,’ জিয়ানা কঠিন গলায় বলল, ‘ওকে অমন মুখের ওপর না করে দেওয়ার পরে ও কিন্তু আর আমায় বিরক্ত করেনি। কষ্ট দেয়নি। আর কিন্তু কিচ্ছু করেনি। জাস্ট উবে গেছে আমার জীবন থেকে। তারপর তো তোমাদের যা ইচ্ছে সেভাবেই আমি থেকেছি। যা বলেছ তাই করেছি। তা হলে আবার পুরনো কথা তুলছ কেন? কেন ওর নামে শাপশাপান্ত করছ? বাপ-মা মরা একটা ছেলে। কেন ওকে নিয়ে তোমার মনে এত বিষ? ও তো তখন কোনওদিন তোমাদের নামে খারাপ কথা বলেনি। যে-ক’বার দেখা হয়েছে পায়ে হাত দিয়ে প্রণামও করেছে। তা হলে? তা হলে কেন এমন বলছ? কেন?’ জিয়ানার গলায় হঠাৎই বাষ্প জমল যেন। ব্যথা করে উঠল গলার দু’পাশ। মাথাটাও কেমন যেন ভার হয়ে গেল। ও চোখ বন্ধ করে পাতা উপচে আসা জলটাকে সামলাল। আর ঠিক তখনই যেন দেখল কুয়াশার ঝাঁঝরির ভেতর মিলিয়ে যাচ্ছে একটা সাইকেল। গোলাপি স্কার্ফ উড়ছে কোথাও। গাছেদের ফাঁকে তুলোর মতো গোল্লা কাটছে হাওয়া।

জিয়ানা চোখ খুলে দেখল মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। জিয়ানা আর কথা না বাড়িয়ে উঠতে গেল। মা চট করে হাতটা ধরল ওর, বলল, ‘মিষ্টি তুই এখনও…তোর… মনে…’

জিয়ানা কিছু বলার আগেই ডোরবেলটা বেজে উঠল এবার। জিয়ানা মায়ের হাত ছাড়িয়ে উঠে পড়ল। কলি এল কি?

দরজাটা খুলে জিয়ানা দেখল মদন খুরানা। হাতে ফুল, চকোলেটের প্যাকেট আর মুখে সেই পরিচিত হাসি। লোকটা বেঁটে। মাথায় বিশাল টাক। ফরসা, মোটা চেহারা। গাল দুটো কাশ্মীরি আপেলের মতো লাল।

জিয়ানা দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসুন স্যার, আসুন। আমি ভাবতে পারছি না আপনি এসেছেন! আয়াম ভেরি গ্ল্যাড।’

খুরানা হাসলেন। বললেন, ‘কিউ, ম্যায় আপনা বেটিকে ঘর নেহি আউঙ্গা?’

‘না না, তা কেন? আসুন স্যার। বসুন।’ জিয়ানা সোফাটা দেখিয়ে হাসল।

খুরানা বসলেন। তারপর চারদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘খুব সুন্দর বাড়ি তোমার। ভেরি প্লেজেন্ট। তবে পুজোর বাড়ি এত চুপচাপ কেন? ইতনি সন্নাটা কিউ হ্যাঁয় ভাই? কেউ নেই। আমি খুব লেট করেছি, না?’

‘সবাই চলে গেছে। আমার মা আর বাবা আছেন শুধু।’

‘আর মিস্টার বোস? আর, শুড আই সে ডক্টর বোস? কোথায় তিনি? দেখছি না তো?’

জিয়ানা একটু অপ্রস্তুত হল। তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে বলল, ‘স্যার ও আপনার জন্য ওয়েট করছিল। কিন্তু হঠাৎ অফিস থেকে এমন একটা ফোন এল যে…মানে ও খুব বলছিল যে, আপনার সঙ্গে দেখা হল না।’

খুরানা হাসলেন, টেবিলে রাখা ফুল আর চকোলেট জিয়ানার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে। আর একদিন দেখা হয়ে যাবে। কী বলো? আসলে আমারই লেট হয়ে গেল। কী করব? মাঝে মাঝে এমন এমন সব ঝামেলা পপ-আপ করে না! দুটো সাইটে গন্ডগোল হয়েছে। মেশিনারিজ চুরি হয়ে গেছে। সাইটে, লোকাল গুন্ডাদের টাকা দিয়েও যদি এমন প্রবলেম ফেস করতে হয় তবে আর কী বলব। এমনিতেই কম্পিটিটিভ মার্কেট। জানোই তো কী রেটে কাজ করতে হয়। তার ওপর যদি এমন করে চুরিচামারি হয়, বলো, ভাল লাগে?’

জিয়ানা মাথা নিচু করল। কাজের সাইটে সত্যি নানা রকমের অশান্তি লেগে থাকে।

খুরানা এবার হাসলেন। বললেন, ‘বাদ দাও। বোর্ড অব ডাইরেক্টরস-এর মিটিং ছিল গতকাল। এতদিন চুপ করে থাকা ওই নর্থ চব্বিশ পরগনার চাপাডাঙার প্রজেক্টটা আবার জাগছে। তোমায় সেই নিয়ে কাজ করতে হবে এবার। তুমি আর ললিত দেখবে ওটা। কেমন? সরি টু টক অ্যাবাউট বিজনেস টুডে। কিন্তু কাল সকালের ফ্লাইটে আমি ইতালি যাব। ওয়াটারবার্ড বিদেশিদের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে গেছে। আমাদের কিছু একটা ট্রাই করতে হবে। তাই…’

‘দ্যাটস ও কে স্যার।’ জিয়ানা হাসল।

‘শোনো ওই পার্টিক্‌ল বোর্ডের ফ্যাক্টরিতে সব ডিটেলের জন্য ওদের ওখানকার চিফ প্রোডাকশন ইনচার্জ কাম নতুন প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটরের কনট্যাক্ট আমি তোমায় দিয়ে দিচ্ছি। মিট হিম। টেক দ্য নিউ ডিটেলস। আর তারপর কাজ শুরু করো। কেমন?’

‘কোনও প্রবলেম নেই স্যার, আপনি প্রসাদ খাবেন তো?’

খুরানা বললেন, ‘সুগার আছে, কোলেস্টরলও হাই। তাই বলছি যে মিষ্টি দিয়ো না। তোমরা তো খই খাও, না? গিভ মি সাম অব দ্যাট। আর আমি খুব একটা বাইরে খাই না, রেস্ট্রিকটেড ডায়েটে থাকি।’

‘একটা সন্দেশ দিই স্যার? ডায়াবেটিক সন্দেশ। আপনার জন্য আনিয়েছি।’ জিয়ানা অনুরোধের ভঙ্গিতে বলল।

‘ঠিক আছে,’ খুরানা হাসলেন, ‘তবে তুমি আনো। আমি তোমার মোবাইলে ওই ভদ্রলোকের নম্বরটা পাঠিয়ে দিচ্ছি। কেমন?’

জিয়ানা যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, ‘তা কী নাম স্যার ভদ্রলোকের?’

‘নাম?’ খুরানা ভাবলেন একটু। তারপর বললেন, ‘ব্যানার্জি। এই বলেই সেভ করেছি মোবাইলে। পুরো নামটা…দাঁড়াও…’ খুরানা চোখ বন্ধ করে ভাবলেন আরও একটু। তারপর বললেন, ‘পুরো নাম মনে নেই। ইনিশিয়ালটা মনে পড়েছে। কে. এ.। কে. এ. ব্যানার্জি। মনে রেখো, আমাদের প্রজেক্টের জন্য খুব ইম্পর্ট্যান্ট লোক। তোমাকে ওর সঙ্গে র‍্যাপো বিল্ড-আপ করতে হবে। মনে রাখবে জিয়ানা, কাজটা কিন্তু চাই বেটি। অ্যাট এনি কস্ট চাই। তখন তুমি আমায় রসগুল্লা দেবে, আমি তাও খেয়ে নেব। কেমন?’

জিয়ানা হাসল। মনে মনে উচ্চারণ করল দু’বার, কে.এ. ব্যানার্জি। তারপর চলে গেল সন্দেশ আনতে। সন্দেশ, কিন্তু মিষ্টতাহীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *