১১
চাপাডালির মোড়টায় আজ ভীষণ একটা জট লেগে আছে। বাস, সাইকেল, ভ্যান, রিকশা, অটো আর গাড়ির গিঁটের মধ্যে যেন আটকে আছে সন্ধেটা। ধোঁয়ায় রীতিমতো গলা-বুক জ্বলছে কিগানের। আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কে জানে! শশীবাবুর যদি কোনও একটা কাণ্ডজ্ঞান থাকে!
গৌর ওকে নামিয়ে দিয়েছে এখানে প্রায় কুড়ি মিনিট আগে। শশীবাবু তখন বলেছিল যে, দশ মিনিটের ভেতরে আসছে। কিন্তু তার এখনও পাত্তা নেই। শশীবাবুর দশ মিনিট কত মিনিটে হয়?
সামনের চায়ের দোকানটা বন্ধ। এর বাইরে একটা ভাঙাচোরা সিমেন্টের বেদির মতো আছে। কাঁধের ছোট ব্যাগটা তার ওপর রেখে বসল কিগান। এমন ভোগাবে জানলে বাস ধরে বেরিয়ে যেত ও। অপেক্ষা করতে ভাল লাগছে না কিগানের। শরীরে একটা কষ্ট হচ্ছে। কেমন যেন ঘুম পাচ্ছে ওর। মনে হচ্ছে যেন কয়েক লক্ষ বছর ঘুমোয়নি। আসলে তা কিন্তু নয়। মাত্র গতকাল রাতটা ঘুমোয়নি কিগান আর তাতেই মনে হচ্ছে যেন যুগ যুগ ধরে জেগে রয়েছে ও।
কলকাতা, বহু মাস পরের কলকাতা ওকে নিশ্চিন্তে রাত কাটাতে দেয়নি। কেন জানে না কিগান, কিন্তু গতকাল সারাটা রাত ও এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়েছিল। তারপর শেষ রাতের দিকে ও গেস্ট হাউসের বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিল একা একা। অবিকল সেই কলকাতা ছেড়ে চাপাডাঙায় চলে আসার আগের রাতের মতো।
হেড অফিস থেকে প্রেসিডেন্ট সাহেব এসেছেন কলকাতায়। দু’দিনের টুর। যাকে বলে ঝটিকা সফর। শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন আর বীরভূমের দিকে জমিও দেখতে এসেছেন। ফ্যাক্টরি বানাতে চান।
গত পরশু সন্ধেবেলা গৌরের ফোন পেয়ে চমকে উঠেছিল কিগান। না, গৌর ফোন করে, কিন্তু এমনভাবে কলকাতায় ডেকে পাঠায় না।
কিগান অবাক গলায় বলেছিল, ‘স্যার, আমায় কলকাতায় যেতে হবে?’
‘কিঁউ, ও কেয়া চান্দ পে হ্যায়?’ স্বভাবসিদ্ধ হালকা গলায় বলেছিল গৌর। তারপর যোগ করেছিল, ‘জাস্ট একদিনের জন্য আসতে হবে তোকে। প্রেসিডেন্ট বুডঢা তোর সঙ্গে দেখা করতে চায়। আই টোল্ড হিম অ্যাবাউট ইয়োর গুড জব। আর বলেছি যে, চাপাডাঙায় তোর ভালই রাজ চলে।’
‘রাজ চলে?’ অবাক গলায় জানতে চেয়েছিল কিগান, ‘স্যার, রাজ চলে মানে?’
‘মানে তুই ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারিস।’
‘স্যার, কী বলছেন?’ কিগানের অস্বস্তি হচ্ছিল খুব। কী বলছে গৌর? আর এমন বলছেই বা কেন?
‘স্যার, আমি কি একদিনেই ফিরতে পারব?’
‘না, ইউ হ্যাভ টু স্টে ফর দ্য ডে। রাতে তোর সঙ্গে মিট করবেন প্রেসিডেন্ট। তু ফিকর না করিও। পূর্ণদাস রোডে আমাদের গেস্ট হাউস আছে। সেখানে রাত কাটাতে পারিস। তবে তোর নিজের বাড়িও তো আছে।’
‘না স্যার, পূর্ণদাস রোড উইল বি ফাইন।’
গৌর দু’-এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলেছিল, ‘যেমন তোর ইচ্ছে। তবে কাল দেখা হচ্ছে। কেমন?’
ফোনটা রেখে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল কিগান। গেস্ট হাউসে থাকতে চায় বলায় গৌর হঠাৎ যেমন চুপ করে গিয়েছিল, তাতে তো ভয়ই পেয়েছিল। আসলে গৌর মানুষটা অন্যরকম। হঠাৎ হঠাৎ পার্সোনাল হয়ে যায়। আর একটু হলেই বাড়ি নিয়ে প্রশ্ন করে ফেলছিল আর কী!
বাড়ি! কথাটা চিন্তা করেই মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল কিগানের। প্রায় সারাটা জীবন যেখানে কাটাল সেখান থেকে এমনভাবে চলে আসতে হল ওকে? আর এমন একটা বদনাম মাথায় নিয়ে? দিঘি তো সব জানত, তবু একবারও কিচ্ছু বলল না?
দিঘি! কত বছরের ছোট ওর চেয়ে? পনেরো বছরের। দিঘি নিজেই বলেছিল। দিনটা এখনও মনে আছে কিগানের। দোল ছিল সেদিন। নিজের ঘরে বসে কবিতা পড়ছিল কিগান। মনখারাপ করা এক কবির লেখা। আর এতটাই মন দিয়ে পড়ছিল যে, রাস্তার আওয়াজ, হইহুল্লোড়, কিছুই কানে ঢুকছিল না। আর তাই হয়তো ওই আলতো পায়ের শব্দটাও শুনতে পায়নি।
‘তোমায় একটু আবির দেব?’ দ্বিতীয়বার প্রশ্নটা শুনে মাথা তুলেছিল কিগান। ও একটু চমকে উঠে তাকিয়েছিল পিছন দিকে। দেখেছিল হাতে একটা ছোট প্লাস্টিক নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দিঘি। পরনে কুর্তি আর প্যান্ট। গোটাটাই নানা রঙে রাঙানো। গালে আবির। হলুদ রঙের। আর তাতে যেন একদম অন্যরকম লাগছিল ওকে। সেই প্রথম ভাল করে দিঘিকে লক্ষ করেছিল কিগান। কেন করেছিল আজও জানে না।
কিগান চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কিছু বলছ?’
দিঘি গম্ভীর গলায় বলেছিল, ‘জিজ্ঞেস করছিলাম রোবটরা কি দোল খেলে?’
‘রোবটরা?’ থতমত খেয়ে গিয়েছিল কিগান, ‘অ্যাঁ? রোবটরা? মানে?’
‘মানে, আমি কি তোমায় আবির দিতে পারি?’
‘আমায়?’ খুব কঠিন এক প্রশ্ন যেন। কিগান কী বলবে বুঝতে না পেরে তাকিয়েছিল ওর দিকে।
দিঘি ঠোঁট বেঁকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলেছিল, ‘কী হল? দুটো প্রশ্ন করলাম, একটাও তো উত্তর দিলে না?’
কিগান যেন অন্য একটা দিঘিকে দেখছিল। গত সপ্তাহেও তো দেখেছিল, কিন্তু এমন তো লাগেনি। এই দিঘি যেন হঠাৎ হল মস্ত বড়! ও বলেছিল, ‘আমায় তুমি রোবট বলছ?’
‘তা নয় তো কী? দুর্গাপুজোয় দেখলাম, পুজো শুরুর আগে কাজ করলে, কিন্তু পুজোয় পাত্তা পাওয়া গেল না। কালীপুজোয় বারান্দায় পর্যন্ত এলে না! সরস্বতী পুজোতেও একই সিন! আর আজ দোল, সেখানে কিনা ঘরে বসে বই পড়ছ? রোবট হয়ে বাঁচতে ভাল লাগে?’
‘রোবট?’ হেসেছিল কিগান, ‘না, রোবট কেন? আমার একা থাকতে ভাল লাগে খুব।’
‘একা থাকতে ভাল লাগে?’ দিঘি যেন প্রথম শুনছে এমন কথা। ও ঠোঁট কামড়ে তাকিয়েছিল কিগানের দিকে। তারপর বলেছিল, ‘এটা তো একটা সাংঘাতিক সাইকোলজিকাল ডিসঅর্ডার।’
‘তাই?’ কিগান অবাক হয়েছিল, ‘তুমি জানো কী ডিসঅর্ডার?’
দিঘি বলেছিল, ‘তা জানি না। তবে হবে কিছু একটা জটিল রকমের, কমপ্লেক্স ডিসঅর্ডার ফর আ কমপ্লেক্স ম্যান।’
কিগান হেসে বলেছিল, ‘দাও, রং দাও। তবে অল্প একটু। আমার রং-টং ভাল লাগে না।’
‘তোমার গার্লফ্রেন্ড তোমায় কিছু বলে না?’ আচমকা প্রশ্ন করেছিল দিঘি।
‘গার্লফ্রেন্ড!’ দিঘির মুখে এই প্রসঙ্গ শুনে আচমকা ধাক্কা খেয়েছিল কিগান, ‘কীসব বলছ তুমি?’
‘কেন? কীসব বলছি মানে?’ দিঘি স্থিরভাবে চোখ রেখেছিল কিগানের চোখে।
‘না, মানে…’ কিগান চুপ করে গিয়েছিল কিছুক্ষণ। তারপর বলেছিল, ‘এসব ঠিক জিজ্ঞেস করতে নেই। তা ছাড়া তুমি এখন অনেক ছোট।’
‘ছোট! হ্যালো,’ দিঘি ঠোঁট কামড়ে ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল কিগানের দিকে, ‘আমায় দেখে তোমার ছোট মনে হয়? আয়াম সিক্সটিন। আগেকার দিনে এই বয়সে মেয়েরা মা হয়ে যেত।’
কিগান ভীষণ বিব্রত হয়ে তাকিয়েছিল দিঘির দিকে। ও জানত যে, দিঘি চটপটে, কথাবার্তাতেও ভাল। কিন্তু ওর ভেতরে যে এমন একটা মেয়ে লুকিয়ে আছে সেটা বুঝতে পারেনি কিগান!
দিঘি আবার বলেছিল, ‘তা, বললে না তো? তোমার গার্লফ্রেন্ড কিছু বলে না?’
কিগান সামান্য হেসে ওর চেয়ারে বসে পড়েছিল, ‘না, বলে না।’
দিঘি ভুরুটা সামান্য কুঁচকে আবার সোজা করে নিয়েছিল। তারপর খুব সাধারণ গলায় বলেছিল, ‘কেন? হ্যান্ডসাম বয়ফ্রেন্ডকে কিছু বলতে কষ্ট হয়?’
‘না, কষ্ট হয় না।’ কিগান ক্লান্তভাবে হেসেছিল সামান্য।
‘তা হলে?’ দিঘি যেন হঠাৎ অধৈর্য হয়ে উঠেছিল।
‘কী তা হলে?’ কিগান হাসছিল। টেবিলের পেপার ওয়েটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল একা একা।
‘তুমি বলবে না?’ দিঘির অধৈর্য গলাটা অভিমানের দিকে বাঁক নিচ্ছিল ক্রমশ।
‘তুমি আমার চেয়ে অনেক অনেক ছোট দিঘি।’
‘ও, কাম অন।’ দিঘি এগিয়ে গিয়েছিল কিগানের দিকে, ‘জাস্ট ফিফটিন ইয়ার্স, এটা কোনও পার্থক্য হল!’
‘পনেরো বছর অনেক সময়। আর আমি তো বুড়ো।’ কিগান বইটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে বলেছিল, ‘এসব বাদ দাও দিঘি। মনে হচ্ছে দোল খেলতে তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
দিঘি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল কিগানের দিকে, তারপর আচমকা প্রায় লাফিয়ে পড়ে হাতের মুঠোর আবির মাখিয়ে দিয়েছিল কিগানের চুলে, কপালে আর গালে।
কিগান আচমকা এমন ঘটনায় হতচকিত হয়ে গিয়েছিল। তারপর নিজেকে ছাড়াতে গিয়ে চেয়ারসুদ্ধ উলটে পরেছিল মাটিতে। দিঘিও টাল সামলাতে না পেরে কিগানের বুকের ওপর পরে গিয়েছিল।
শব্দটা ভালই হয়েছিল। দূর থেকে আস্তে হলেও ঠাকুরমার পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছিল কিগান। শব্দ শুনে ঠাকুরমা আসছে! আর ও এমনভাবে পড়ে আছে মেঝেতে? প্রায় লাফিয়ে মেঝে থেকে উঠে পড়েছিল কিগান। দিঘিও নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে পড়েছিল।
ঠাকুরমা এসে একটু অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল দরজায়, ‘এ কী রে? এমন রং মেখে রয়েছিস যে! আর চেয়ারটা উলটে গেল কী করে?’
কিগান আমতা আমতা করছে দেখে দিঘি চটপট বলেছিল, ‘আরে, তোমার নাতি এত ভিতু। দেখো না, রং দেব বলে পালাতে গিয়ে চেয়ার নিয়ে পড়েছে। তবে আমি ছাড়িনি। তাও ভূত করে দিয়েছি একেবারে। হুঁ, খুব সাহেবিপনা দেখায়। ঠিক করিনি ঠাকুরমা? তুমি বলো, এমন হুঁকোমুখো হয়ে কেউ থাকে?’
ঠাকুরমা হেসে বলেছিলেন, ‘ঠিক করেছিস। ও এমন বুড়োটে হয়ে থাকে না এই বয়সে!’
কিগান অপ্রস্তুত মুখ করে বলেছিল, ‘আমি তো বুড়োই। দিঘির তুলনায় আমি যথেষ্ট বুড়ো। আমার এসব ভাল লাগে না।’
ঠাকুরমা দিঘির হাত ধরে টেনে বলেছিল, ‘চল তো। ওকে অমন করে একাই থাকতে দে। তুই আমার সঙ্গে চল। আজ ভোগ দিয়েছি। বাড়িতে নিয়ে যাবি।’
দিঘি ঠাকুরমার সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেও একটু পরে আবার দৌড়ে ঘরে এসে ঢুকেছিল। তারপর টেবিলের ওপর রাখা আবিরের প্যাকেটটা দেখিয়ে বলেছিল, ‘এটা ফেলে গিয়েছিলাম। আর বাই দ্য ওয়ে,’ দিঘি গলাটাকে হঠাৎ নামিয়ে বলেছিল, ‘তোমার আফটার শেভটা দারুণ। একদিন দেখো, এটাকে আমি…’
জীবনে যা কিছু অর্ধেক হয়, অসমাপ্ত হয়, তার ভেতরেই নানারকম সম্ভাবনা আর আশঙ্কা লুকিয়ে থাকে। দিঘির চলে যাওয়াটুকুর ভেতরে আশঙ্কাটাই দেখতে পেয়েছিল কিগান। আর অবাকও লেগেছিল। মেয়েটার হলটা কী? দিব্যি আসত পড়া দেখিয়ে নিতে। টুকটাক গল্পও করত। কিন্তু এ তো অন্যরকম হয়ে গেল পুরো! কিগানের মাথার ভেতর কেমন যেন জট লেগে যাচ্ছিল সব। বুকে কষ্ট হচ্ছিল। এমনিতেই নানা চিন্তা ঘিরে থাকে, তারপর আরও নতুন ঝামেলা হওয়ার আশঙ্কায় মুখটা বিস্বাদ লাগছিল।
সত্যিই কি শুধু বিস্বাদ লেগেছিল কিগানের? অমন ঘন বাদামি চুল থেকে ভেসে আসা গন্ধ। নরম স্পর্শ। মনোযোগ। শুধু কি আশঙ্কাই জাগিয়েছিল ওর বুকে? ভাললাগা কি জাগায়নি এতটুকুও?
এই বন্ধ চায়ের দোকানের সামনে বসে ঠান্ডা হাওয়ার ভেতরে হঠাৎ দু’বছর আগের দোলের দিনটায় যেন মনে মনে ফিরে গেল কিগান। কেমন ছিল সেদিনের রোদ? চুলের ভেতর আবির মাখানো আঙুলগুলো কেমন ছিল? কেমন ছিল সেই ঘন বাদামি চুলের গন্ধ?
আচমকা শীত করে উঠল কিগানের। হিজিবিজি আলো আর আওয়াজ ভরতি এই চাপাডালির মোড়টার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ওই সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িটায় নিজের ঘরটার জন্য মন কেমন করে উঠল কিগানের। সেই চার বছর বয়স থেকে তো ওখানে আছে ও। তা হলে? তা হলে কেন এমনভাবে ওকে চলে আসতে হল? কেন? বারবার কেন ওকেই চলে যেতে হয়? কারও কাছে ও থাকতে পারে না কেন?
‘আরে কিগানদা, তুমি?’
বড় রাস্তার দিকে আলো থাকলেও, এই বন্ধ দোকানের সামনেটা বেশ অন্ধকার। কিগান চোখ কুঁচকে তাকাল। আসলে একটু অন্যমনস্ক হয়েছিল বলে চট করে বুঝতে পারেনি। কিন্তু এখন একটু তাকিয়ে বুঝল, আরে, ত্রয়ণ যে!
কিগান জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি? এখানে কী করছ? বাড়ি ফিরছ নাকি?’
‘বাড়ি? এখনই?’ ত্রয়ণ হাসল, ‘সুধাদি এসেছেন। ওঁর সঙ্গে এসেছি। তারপর একবার পার্টি অফিসে যাব। আসলে কালচারাল একটা অনুষ্ঠান করার ইচ্ছে আছে সামনের সরস্বতী পুজোয়। সেই জন্য একটু দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে।’
‘কালচারাল অনুষ্ঠান? খুব ভাল।’ কিগান উৎসাহ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল।
‘আর ভাল,’ ত্রয়ণ শ্বাস ফেলল, ‘পার্টিটা শালা নোংরামির জায়গা হয়ে গেছে। নিজেদের পেটোয়া লোক ছাড়া ফাংশনে গাইতে দেবে না। পার্টির ভেতরে যদি এত ভাগ, এত দলাদলি থাকে তা হলে কোনও কাজ হয়? একটা সামান্য ফাংশন, সেই নিয়েই অশান্তি। আর সবকিছুর পিছনে আছে চমকদা। সুধাদিকে কতবার বলি চমকদার ডানা ছাঁটতে, কিছুতেই শোনে না। বলে, ও নাকি দলের অ্যাসেট। তুমি বলো, এই ফাংশনেও চমকদা ছড়ি ঘোরাবে! কাজের কাজ তো একটাও করে না। সমস্ত প্রতিবাদ, সভা, বিক্ষোভ সব জায়গায় আমরা যাব আর চমকদা শুধু মেশিন নিয়ে গুন্ডাগিরি করে বেড়াবে।’
কিগান কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে গেল। আসলে ত্রয়ণের সঙ্গে টুকটাক কথা হয় বটে, কিন্তু সেটা এমন নয় যে, যার জন্য ওকে এত কথা বলবে ছেলেটা। কিগান বুঝল, পার্টির ভেতরেই চমককে নিয়ে ত্রয়ণের একটা সমস্যা আছে। কিন্তু ওকে এসব কেন বলছে ত্রয়ণ তা ঠিক বুঝতে পারছে না।
ত্রয়ণ আবার বলল, ‘মানুষ কি কিছু বোঝে না ভেবেছ? তারা সব বোঝে। সামনের বার ভোটে দেখো না সুধাদির কী দশা হয়! রাস্তার ধারের গাছ কাটায় কমিশন মারবে, বেআইনি প্রোমোটারিতে মদত দেবে, বর্ডার থেকে টপকানো মালে কমিশন খাবে। গোটা উত্তর চব্বিশ পরগনার কাটা তেলের ওপর টাকা ঝাড়বে। পাবলিক এসব বোঝে না? সবাই কি ঘাস খায় নাকি? আর সুধাদির এই সব কিছুতেই চমককে দরকার। আমি বললাম ফাংশনের কথা। বলে, চমককে জিজ্ঞেস করতে হবে। বোঝো, একটা মাধ্যমিক পাশ, তার কাছ থেকে এসব শিখতে হবে আমায়! পলিটিক্সের স্ট্রাকচারটাই এই নেতানেত্রীরা গুন্ডা-বদমাশের হাতে তুলে দিচ্ছে। গভর্নমেন্ট চালানো যে, একটা সার্ভিস, সেটা এরা বোঝে না। সব বাপের তেজারতি পেয়েছে। তুমি বলো, ওয়েল ফেয়ার অব দ্য স্টেট বলে কিছু নেই? সবাই কেন নিজের পকেট ভরবে? তবে তো মুদিখানা খুলে দু’কেজি আটার থেকে আড়াইশো গ্রাম ওজনে মারতে পারত। এই দেখো না, সুধাদি এখানে এসেছে তোমাদের কোম্পানির ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা বলবে বলে। বারাসতের ওই হাউজিংটায় একটা চিলড্রেন্স পার্ক করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, এখন না করে বেরিয়ে যেতে চাইছে। আমরা চেপে ধরেছি। আমাদের বাগে আনতে পারছে না দেখে সুধাদির সঙ্গে মিটিং ফিক্স করেছে। সুধাদির কথাতেই আমি এলাম। আর যেই আমি ন্যায্য কথা বলতে গেলাম, আমায় বলল, তুই গিয়ে পাশের ঘরে ফাংশনের বাজেটটা কর। টাকা খেয়ে সুধাদি সব মেনে নেবে! আর তোমাদের ওই গৌর রওশন দিওয়ান জানোয়ারটা ড্যাং ড্যাং করে বেরিয়ে যাবে পার্ক টার্ক না করে। আমি তখনই সুধাদিকে বলেছিলাম ওই আদিত্য মালটার সঙ্গে দেখা না করতে। কিন্তু সুধাদি যা। দেখা করল। আদিত্য কী যে মন্ত্র দিল, ব্যস, ডিরেক্টরের সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়ে গেল। সব শালা করাপ্ট! এত করাপশন থাকলে কিচ্ছু হবে না। কিন্তু আমিও ছাড়ব না। গাছ কাটা নিয়ে অলরেডি সুধাদির সঙ্গে আমার ঝামেলা হয়েছে। এবার সুধাদি বেগড়বাই করলে এটা নিয়েও হবে।’
কিগান কিছু না বলে চুপ করে তাকিয়ে রইল ত্রয়ণের দিকে। না গুঁজে পরা জামাটা সোয়েটারের তলা দিয়ে বেরিয়ে আছে। আবছা আলোতেও দাড়ি আর উসকোখুসকো মাথার চুল দেখা যাচ্ছে। ছেলেটা রেগে আছে খুব। কিগান জানে, এখানে ওর বদলে অ’বাবু বা ক’বাবু থাকলেও ত্রয়ণ এই কথাগুলোই বলত। কারণ, এখন ত্রয়ণকে বলতে হবে। বদ রক্তের মতো কথাগুলো শরীর থেকে ওকে বের করে দিতে হবে। না হলে ত্রয়ণের কষ্ট হবে। আসলে ত্রয়ণ যে ক্রমশ পার্টির ভেতরে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে সেটা বুঝতে পারছে ও। তাই হয়তো ডুবন্ত মানুষদের মতো এলোপাতাড়ি হাত-পা ছুড়ছে।
কিগানের এসব নিয়ে একদমই আগ্রহ নেই। ওর এসব ভাল লাগে না। তবে কেউ বললে ভদ্রতাবশত চুপ করে থাকে। কিগান শুনেছে চমক সাংঘাতিক ছেলে। লোকে বলে চমক নাকি মার্ডারও করেছে। কিন্তু কিগান সেসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। চমক ওর সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করে। তাই ওকে ভালই মনে হয় কিগানের। হ্যাঁ, এসব ব্যাপারে কিগান ‘নাইভ’। মানে দিঘি বলত। কিন্তু তাতে কিছু এসে যেত না কিগানের। তবু দিঘি বলত, ‘যে যা বলে বিশ্বাস করো কেন? কেউ একটু ভাল ব্যবহার করলেই অমন গলে যাও কেন? মানুষকে চিনতে শেখো। শুধু বড়ই হয়েছ বয়সে। বুদ্ধিটা দশ বছরের বাচ্চার মতো। এত নাইভ কেন তুমি?’
এই আধো অন্ধকার জায়গায়, হঠাৎ দিঘির মুখটা মনে পড়ে গেল কিগানের। বুকের ভেতরে কোথাও একটা ছোট্ট নৌকো দুলে উঠল যেন। যেন তার ছইয়ের ওপরে বসা নীলকণ্ঠ পাখি উড়ে গেল কোথাও। যেন মাঝরাতে আচমকাই ঝরে গেল সমস্ত বকুল। কিগান মাথা নিচু করল।
‘তুমি বোর হচ্ছ, না?’ ত্রয়ণের যেন এতক্ষণে হুঁশ হল, ‘আমি এবার যাব। তবে দেখো কিগানদা, তোমাদের ফ্যাক্টরি নিয়েও ব্যাপক ক্যাচাল হবে। ওই জমিটা নিয়ে রাঘবজেঠু আর গৌরের ভেতর টানাটানিটা ভালই হবে। তুমি দেখো।’
কিগান বলল, ‘মাথা গরম কোরো না ত্রয়ণ। যা হবে তা তো হবেই। তুমি শুধু শান্ত থেকো।’
ত্রয়ণ হাসল, ‘হ্যাঁ, শান্ত থাকব! কোনও সুস্থ মানুষ পারে শান্ত থাকতে? যাক গে, বাদ দাও। তুমি তো চাপাডাঙাতেই ফিরবে। আমার সঙ্গে এখানকার ঠেকটায় চলো না। সুধাদির সঙ্গে গাড়ি করে ফিরবে। এই ভুতুড়ে জায়গায় বসে মশার কামড় খাবে কেন ফালতু?’
‘না গো,’ কিগান হাসল, ‘আমাদের ফাক্টরির শশীবাবু আসবেন গাড়ি নিয়ে। থ্যাঙ্ক ইউ ফর আস্কিং।’
‘ঠিক আছে, তা হলে আসি।’ ত্রয়ণ কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে গেল।
শশীবাবুকে আর একবার ফোন করবে কিনা ভাবতে ভাবতে মোবাইলটা বের করল কিগান আর সঙ্গে সঙ্গেই একটা ফোন এল। রাহি। নামটা দেখে কিগান চোয়াল শক্ত করল। আবার এই মেয়েটা কেন? কিগান একটু সময় নিয়ে ফোনটা ধরল, ‘হ্যাঁ, বল।’
‘তুমি কোথায়?’ রাহির গলাটা আনন্দের শোনাচ্ছে।
‘কেন?’ কিগান সংক্ষেপে জিজ্ঞেস করল।
‘আজ পায়েস হয়েছে। মা বলল তোমায় দিয়ে আসতে। তোমার বাড়িতে গিয়ে দেখলাম তুমি নেই। তাই জিজ্ঞেস করছি।’
‘আমি বারাসতে। আসতে অনেক দেরি হবে।’ কিগান গলাটা যতটা সম্ভব নিরুৎসাহ করে বলল।
‘কত দেরি হবে?’
‘ঠিক বলতে পারছি না। তুই প্লিজ কষ্ট করে আসিস না ওসব দিতে।’
‘কষ্ট করে!’ রাহির গলাটা জেদি বাচ্চার মতো শোনাল।
‘মানে, আনিস না। তা ছাড়া রাতে আর মিষ্টি খাব না।’
‘কিন্তু আমি নিজে শিমুইটা বানিয়েছি। জীবনে প্রথমবার। আর তুমি খাবে না?’
কিগানের অস্বস্তিটা বাড়ল। এই মেয়েটা ভাল কিন্তু কেমন যেন একটু গায়েপড়া। মানুষকে যে স্পেস দিতে হয়, তা মানে না। আর মেয়েটা এমন এমন কাণ্ড করে মাঝে মাঝে যে, কিগানের খুব খারাপ লাগে।
‘কী হল খাবে না?’ বলল রাহি।
‘দেখি কখন ফিরতে পারি। ঠিক বুঝতে পারছি না।’
কিগান আর কথা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে কেটে দিল ফোনটা। মেয়েটা বকতে থাকলে বকতেই থাকবে। ওর পরিমিতি বোধটাই নেই। এই কিছুদিন আগেই তো একটা কেলেঙ্কারি করেছিল।
রাহি কলকাতায় গিয়েছিল বড়দিনের সময়। সেখান থেকে ওর গিটারের জন্য চার সেট স্ট্রিং কিনে এনেছে। এটা যে আনবে কিগান জানত। কারণ, ও-ই বলেছিল কিনে আনতে। কিন্তু তারপরেই যেটা বের করেছিল সেটা দেখে চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল কিগানের। একটা বেশ দামি রিস্টওয়াচ। আরে, এটা কেন? ভাল তো লাগেইনি বরং খারাপ লেগেছিল কিগানের। ও বলেছিল, ‘এটা কার?’
‘তোমার জন্য এনেছি।’ রাহি হাসিমুখে বলেছিল।
‘আমার জন্য? কেন?’
‘আরে আমাদের ফ্ল্যাটের সামনেই বিশাল বড় মল। সেখান থেকেই আনলাম। পছন্দ হল তাই…।’
‘দেখ রাহি,’ কিগান বোঝাতে চেয়েছিল, ‘আমি এত দামি জিনিস নিতে পারি না।’
‘কেন পারো না?’ রাহির গলার স্বরটা পালটাচ্ছিল।
‘পারি না কারণ, কেন নেব?’
‘কেন নেবে না?’ রাহি নাছোড়বান্দা হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।
‘আশ্চর্য। এটা বুঝতে পারছিস না?’ কিগানের অসহায় লেগেছিল খুব।
‘না, পারছি না। কেন নেবে না তুমি?’ রাহির গলাটা কঠিন হচ্ছিল।
‘কী হিসেবে নেব? হঠাৎ নেবই বা কেন? এত দামি বিদেশি ঘড়ি কেন নেব? তোর বাবা জানতে পারলে রাগ করবেন।’
‘ও, শুধু দামটাই দেখলে?’ রাহির গলার ভেতর থেকে ছিপছিপে নদীর শব্দ পাচ্ছিল কিগান, ‘আমি এত পছন্দ করে আনলাম, সেটা দেখলে না? আর বাবা জানতে পারলে কিচ্ছু বলবে না। আমার বাবা অমন নয়।’
কিগান জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বাবাকে কি তুই বলেছিস?’
‘বাবাকে?’ এবার সামান্য থমকে ছিল রাহি, ‘না, এখনও বলিনি।’
‘কেন, বলিসনি কেন? বলা উচিত ছিল।’
‘না, বলব না,’ রাহির নদীটা স্পষ্ট হচ্ছিল আরও, ‘কেন বলব? আমার নিজের ইচ্ছে বলে কিছু নেই? আমার কাউকে কিছু দিতে ইচ্ছে করতে পারে না? মেয়ে হয়েছি বলে কি সব সময় অনুমতি নিয়ে চলতে হবে নাকি? ভেবেছিলাম তারের দামটাও নেব না, তোমায় ফেরত দেব তোমার টাকা। কিন্তু তা আর করলাম না। ভাবলাম ঘড়িটা তুমি নেবে। ঠিক আছে, এই রইল ঘড়ি, তোমার ইচ্ছে হলে তুমি পরবে আর না হলে ছুড়ে ফেলে দেবে। বুঝেছ?’ ঘড়িটা ঠক করে টেবিলে রেখে গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল রাহি।
ঘড়িটা আজও রাখা আছে। পরা হয়নি। আসলে পরতে ইচ্ছেই করেনি কিগানের। ও বোঝে কেন রাহি বারবার আসে। কেন অমন করে। কিন্তু কিগানের তো কিছু দেওয়ার নেই রাহিকে। কিছু বলার নেই। কিগান তো চিন্তাও করতে পারে না রাহিকে নিয়ে। কিন্তু কীভাবে বলবে মেয়েটাকে? আসলে রাহি তো কিছু বলে না। ও শুধু নিজের মতো করে কাজ করে যায়। আর কিগান কখনও বাধা দিলে রাগ দেখায়। তাই কিগান ধীরে ধীরে বাধাও দেয় না আর। ক্রমশ চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে কিগান। আরও শান্ত, বৃষ্টি শেষের রেন ফরেস্টের মতো একা হয়ে যাচ্ছে কিগান।
কেন এমন হয়ে যাচ্ছে কিগান? কার ওপর রাগ করে ক্রমশ নিজেকে গুটিয়ে, সরিয়ে নিচ্ছে ও? রাতে, চারদিক যখন নিস্তব্ধ হয়ে যায়, তখন ওর ঘরের সামনের ব্যালকনিতে গিটার নিয়ে একা একা বসে থাকে কিগান। টুংটাং, বাজায় একটু। তারপর, এমনিই চুপ করে বসে থাকে। দেখে, দূরে ওদের ফ্যাক্টরির লম্বা চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। দেখে, সেই ধোঁয়ার অনেক অনেক ওপরে ছড়িয়ে রয়েছে মহাকাশ। ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নীল সব তারা। আকাশের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাঝে মাঝে হালকা লাগে কিগানের। মনে হয় ওর কোনও ওজনই নেই। কোনও পা নেই। হাত নেই। মনে হয় ওর আসলে কিছুই নেই, কেউই নেই। শুধু অসীম এক শূন্যতা হাঁ করে রয়েছে। এক অদ্ভুত চুম্বক ওকে টানছে সেই অশেষ হাঁ-এর দিকে। কিগানের মনে হয় যে-কোনও মুহূর্তে, যে-কোনও মুহূর্তেই ও গ্যাস বেলুনের মতো ভেসে যেতে পারে, উড়ে যেতে পারে, মিলিয়ে যেতে পারে ওই অন্ধকারে। কিগানের মনে হয়, আসলে ওখানেই যেতে হবে ওকে। অনেক দূর হলেও ওই অন্ধকারেই যেতে হবে ওকে। যেতে হবে, একা।
‘শশীবাবু? আপনি কি আসবেন? মানে আজকের মধ্যে আসবেন?’ কিগান ফোনটা কানে লাগিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল।
শশীবাবু অমাইক গলায় বলল, ‘স্যার, একটা ঝামেলা হয়েছে। গাড়িটার ইঞ্জিনে গন্ডগোল। বুঝতে পারছি না কী হয়েছে! স্যার, আপনি কি আর একটু অপেক্ষা করবেন?’
‘আপনার কত সময় লাগবে?’
‘বুঝতে পারছি না। ড্রাইভারটা মিস্ত্রি ধরতে গেছে।’
‘বোঝো কাণ্ড!’ কিগানের বিরক্ত লাগল, ‘ঠিক আছে, বাদ দিন, আমি অন্য বন্দোবস্ত দেখছি। গাড়ি সারানো হয়ে গেলে সোজা চাপাডাঙা ফিরে যাবেন।’
কিগান মাথা নিচু করে ওই বন্ধ দোকানের থেকে বেরিয়ে এল। এখন চারদিকে খুব ভিড়। যতই চেষ্টা করুক, ভিড় জিনিসটা কিছুতেই সহ্য করতে পারে না কিগান। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। এখনও দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাস, ট্রেকার আর শাট্ল গাড়িগুলো দেখে থমকে গেল কিগান। সামনে তিতুমির বাস টার্মিনাসের বিশাল বড় ছাউনিটা দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে বাসে উঠে বসে যাওয়া যায়। কিন্তু যেতে যেতে যা ভিড় হবে বাসটায়, কিগানের দম বন্ধ হয়ে আসবে।
আসলে ছোট থেকেই ঠাকুরমা গাড়িতে ট্যাক্সিতে চড়িয়ে বড় করেছে। অফিসে যেতে ধরত মেট্রো। এমনকী জিয়ানার সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে সবসময় ট্যাক্সিতে চড়ত কিগান। ট্যাক্সি ছাড়া জিয়ানাকে নিয়ে অন্যভাবে ঘুরতে যাবে ভাবতেও পারত না কোনওদিন। আর সত্যি বলতে কী, ট্যাক্সিতেই তো জিয়ানাকে প্রোপোজ করেছিল কিগান।
গরম ছিল, সেই দিনটা ভীষণ গরম ছিল। পিচ গলে যাচ্ছিল প্রায়। কলকাতার সমস্ত মানুষগুলোকে কারা যেন মিষ্টির রস মাখিয়ে দিয়েছিল। গাছের পাতা নড়ছিল না একটাও। শুধু আস্ত একটা শহর এক কড়াই তেলে টগবগ করে ফুটছিল।
সেকেন্ড ইয়ারে কিগানদের একটা গ্রুপ ছিল বন্ধুদের। তার মধ্যে মৃগাঙ্ক নামে একটা ছেলে জিয়ানার সঙ্গে একদম জোঁকের মতো লেগে থাকত। কলেজে আসার সময় জিয়ানাদের বাড়ি থেকে জিয়ানার সঙ্গেই আসত মৃগাঙ্ক। আর তারপর সন্ধের মুখে আবার বাড়ি অবধি পৌঁছে দিত একদম। রাগ হত কিগানের। মৃগাঙ্ককে দেখলেই মাথা গরম হয়ে যেত ওর। মনে হত আচ্ছা করে পিটিয়ে দেয় ধরে।
সেদিন জিয়ানার সঙ্গে সামান্য কারণেই রাগারাগি হয়েছিল কিগানের। জিয়ানা আর শেষ পিরিয়ড থেকে কথা বলছিল না ওর সঙ্গে। কিগানেরও মনে হয়েছিল ফিরে যায় বাড়ি। কিন্তু কেন কে জানে যেতে পারেনি। গ্রুপটার সঙ্গেই হাঁটতে হাঁটতে গিয়েছিল ফোটোকপির দোকান অবধি। মৃগাঙ্ক সেদিনও আঠার মতো লেগেছিল জিয়ানার সঙ্গে। আর জিয়ানাও যেন বড্ড বেশি পাত্তা দিচ্ছিল মৃগাঙ্ককে। এমনকী ফোটোকপি করতে দিয়ে সবার সঙ্গে আড্ডার ফাঁকে টিফিনবক্স খুলে সন্দেশও খাইয়ে দিয়েছিল মৃগাঙ্ককে। এটা আর সহ্য করতে পারেনি কিগান। মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছিল। রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়া একটা ট্যাক্সিকে হাত তুলে দাঁড় করিয়েছিল ও। তারপর এক হ্যাঁচকায়, সবার চোখের সামনে দিয়ে জিয়ানাকে টেনে তুলে নিয়েছিল গাড়িতে। জিয়ানার হাতের অর্ধেক সন্দেশ আর টিফিনবক্স ছিটকে পড়ে গিয়েছিল রাস্তায়। ট্যাক্সিতে উঠে কিছু না ভেবে বাবুঘাটের দিকে যেতে বলেছিল কিগান। তারপর জিয়ানার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে বসেছিল।
ঘটনার আকস্মিকতায় জিয়ানা একদম চুপ করে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। তারপর হঠাৎ এক ঝটকায় ওর হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলেছিল, ‘এটা কী করলি তুই?’ কিগান উত্তর দেয়নি কোনও। জানলা দিয়ে আসা গরমের হলকায় মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিল জিয়ানার। ও দু’হাত দিয়ে কিগানের জামাটা ধরে টেনে, ঝাঁকিয়ে বলেছিল, ‘আমার দিকে তাকা। তাকা আমার দিকে। বল এবার। কেন এমন করলি? সবার মধ্যে থেকে কেন এমনভাবে আমায় নিয়ে এলি তুই? কী ভেবেছিস তুই? কী ভেবেছিস? যা খুশি তাই করবি?’
কিগান মুখ ফেরাচ্ছিল না কিছুতেই। তবু জিয়ানা ঝাঁকিয়ে যাচ্ছিল ওকে। আর প্রশ্ন করছিল, ‘কেন এমন করলি? কেন, বল?’
জিয়ানার গলায় কান্নার আওয়াজ পেয়ে অবশেষে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছিল কিগান। একটা ফুটন্ত কলকাতার ভেতর জিয়ানার চোখের দিকে তাকিয়ে খুব কষ্ট হয়েছিল কিগানের। ও আলতো গলায় বলেছিল, ‘আমার রাগ হয়। ভীষণ রাগ হয়।’
‘কেন? কেন রাগ হয় তোর?’
‘আমি তোকে,’ কিগান চুপ করে গিয়েছিল মুহূর্ত কাল, তারপর বলেছিল, ‘আমি তোকে খুব ভালবাসি। তাই তোকে অন্যের সঙ্গে দেখলে আমার…’
ট্যাক্সিটা আচমকা খ্যাঁচ শব্দে ব্রেক করে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। আর সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে চিৎকার, গাড়ির হর্ন ভেসে এসেছিল। আর ডুবিয়ে দিয়েছিল কিগানের বাকি কথাগুলো। জিয়ানার উত্তর শোনার আগেই কিগান দেখেছিল ওদের গাড়ির সামনে একজন বৃদ্ধ লজেন্সওয়ালা পড়ে গিয়েছে। না, সেই বৃদ্ধের কিচ্ছু হয়নি। তবে সেই দিনের পর থেকে কিগানের গোটা জীবনের অনেক কিছু পালটে গিয়েছিল।
‘আরে কিগানদা কোথায় যাবে?’ রাস্তায় উঠেই প্রশ্নটা শুনে একটু অবাক হল কিগান, ‘কী হল?’
কিগান দেখল সামনে একটা বড় গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আছে চমক।
আজ কি সব পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হবেই? আসলে মাঝে মাঝে এমন একটা দিন আসে যেদিন এমন দেখাসাক্ষাৎ হয়ে যায়।
কিগান বলল, ‘আরে দেখ না, অফিস থেকে গাড়ি আসার কথা। কিন্তু শশীবাবু গাড়ি নিয়ে আসেনি। গাড়িটা খারাপ হয়েছে পথে।’
চমক নিজের দিকের দরজাটা খুলে দিয়ে সরে বসল, ‘উঠে এসো, দাঁড়িয়ে থেকো না।’
কিগান একটু দ্বিধা করল। আসলে সংকোচের কারণ নেই। তবু দ্বিধা হয় কিগানের। কারও থেকে সামান্যটুকু নিতেই দ্বিধা হয়। দিঘি বলত, ‘ইগো, তোমার বড্ড ইগো।’
‘আরে, এসো।’ চমক এমনভাবে বলল যে, কিগানকে এবার উঠে বসতেই হল গাড়িতে। চমক বলল, ‘তোমাদের শশী মালটা খুব হারামি। দেখো, গাড়ি খারাপ হয়নি কিছুই, দত্তপুকুরের ওখানে ওর বাঁধা মেয়েছেলে আছে। সেখানেই আছে। সত্যি কিগানদা তোমার চোখকানগুলো একদম কাজ করে না।’
কিগান হাসল, বলল, ‘সেন্স কাজ করে না বলছিস? তা হয়তো আমি সত্যি ননসেন্স। তবে কী জানিস, ঠিকই বলেছিস, আমার পাঁচটা সেন্স বিশেষ কাজ করে না। আমার যা একটু-আধটু কাজ করে তা হল সিক্সথ সেন্স।’
চলন্ত গাড়ি দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আলতো হাসল চমক।
কিগান কী কথা বলবে বুঝতে না পেরে বলল, ‘জানিস, আজ ত্রয়ণের সঙ্গে দেখা হল। সুধাদির সঙ্গে এখানে এসেছে।’
চমক সামান্য হাই তুলে বলল, ‘জানি, সুধাদির সঙ্গে ঢ্যামনাটা এসেছে।
‘তুই জানিস?’ অবাক হল কিগান।
‘তোমার বস গৌরের সঙ্গে তো সুধাদির মিটিং আছে। তোমার ভাইটি তো আমার সঙ্গে কথা বলেই সুধাদি অবধি পৌঁছোতে পেরেছে। গত সপ্তাহতে তো আদিত্য এসেছিল চাপাডাঙায় আমার সঙ্গে দেখা করতে। তুমি জানো না?’
‘আদিত্য চাপাডাঙায় এসেছিল? কই, ফ্যাক্টরিতে তো আসেনি!’ নিজের অজান্তেই কথাগুলো যেন মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল কিগানের।
‘তুমি এটাও জানো না?’ চমক শব্দ করে হাসল, ‘কেন, তোমার সঙ্গে দেখা করেনি?’
‘না, মানে…’ কিগান কথা খুঁজে পেল না।
আদি বেশ কয়েক মাস এখানে আসে না আর। অবশ্য খুব একটা দরকার পড়ে না। শুধু ডিসপিউটেড জমিটা নিয়ে কথা বলতে মালিনী বলে নতুন মেয়েটা এসেছিল। আসলে কিগান বোঝে, কলকাতা থেকে চলে আসার পর আদি আর মুখোমুখি হতে চায় না কিগানের। কেন চায় না? আদিও কি বিশ্বাস করে যে, কিগান অমন কাজ করেছে? নাকি আদি নিজে স্পষ্ট করে জানে কী ঘটেছিল!
চমক বলল, ‘তোমার সঙ্গে কি কোনও খিঁচ আছে তোমার ভাইয়ের?’
কিগান শক্ত হল একটু। তারপর সাধারণ গলায় বলল, ‘আমার দিক থেকে তো কিছু নেই। জানি না ওর মন কী ভাবছে, বা চাইছে। সব তো বোঝা যায় না।’
‘তা ঠিক বলেছ।’ চমক দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
চমক চুপ করে গেল আচমকা। কিগান দেখল চমকের গলাটা কেমন যেন ভারী শোনাচ্ছে। ও কথা ঘোরাতে বলল, ‘জানিস ত্রয়ণকে খুব আপসেট দেখলাম।’
‘তাই? আমি সুধাদিকে বলেছিলাম যে, মালটাকে যেন সঙ্গে না রাখে। শালা সমাজসংস্কারক হবে। শুয়োরের বাচ্চার পিছন দিয়ে সমাজ দেব।’
‘চমক তুই মাথা গরম করিস না।’ কিগান সাবধানে বলল।
‘মাথা গরম এখনও করিনি। তবে যেদিন করব ত্রয়ণ কেন, ওর বাপও রেহাই পাবে না। জানোয়ারের এত সাহস ও রাহির দিকে হাত বাড়িয়েছে।’
‘মানে?’ কিগান চমকে উঠল।
‘দীপা বলেছে আমায়। ওর সন্দেহ হয় যে, ত্রয়ণ রাহিকে ডিস্টার্ব করে। ওর নোংরামো বের করছি আমি। কী ভেবেছে, আমি মরে গেছি?’
‘তুই মাথা গরম করিস না।’ কিগান আবার বলল।
চমক হঠাৎ ওর দিকে ঘুরে বসে হাতটা ধরল, ‘রাহি তো তোমার কাছে যায়, ওকে একটু জিজ্ঞেস কোরো তো ত্রয়ণ ওকে বিরক্ত করে কিনা। আমি জিজ্ঞেস করলে ও উত্তর দেবে না। তুমি একটু জিজ্ঞেস করবে তো কিগানদা?’
কিগান কিছু বলার আগেই পকেটে ফোনটা বেজে উঠল। অচেনা নম্বর। কার? কিগান ভুরু কোঁচকাল। একটু সময় নিয়ে ফোনটা ধরল তারপর, ‘হ্যালো?’
‘আরে কিগানদা কেমন আছ?’
‘কে বলছ?’ গলাটা চেনা লাগলেও ঠিক চিনতে পারল না কিগান।
‘আমি গো আমি, আবেশ।’
‘আবেশ!’ থতমত খেল কিগান। এতদিন পর আবেশ এল কোত্থেকে!
‘হ্যাঁ দাদা। খুব দরকার, তোমার সঙ্গে খুব দরকার। প্লিজ, কালকে দেখা করতে পারব তোমার সঙ্গে?’
‘আমার সঙ্গে!’ কিগান অবাক হল, ‘তুই জানিস আমি কোথায় থাকি?’
‘জানি দাদা। চাপাডাঙায়। খুব জরুরি কাজ আছে তোমার সঙ্গে।’
কিগান অবাক হল, ‘ঠিক আছে আয়।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ দাদা। কাল বিকেলে যাব। কেমন?’ আবেশ যেমন হঠাৎ করে ফোন করেছিল ঠিক তেমনই হঠাৎ করে কেটেও দিল ফোনটা।
কিগান অন্ধকারের দিকে তাকাল। শীতের হাওয়া ঢুকে আসছে জানলা দিয়ে। অন্ধকার ঘিরে ধরছে ক্রমশ। কী দরকার আবেশের? কেন চমক ওকে এমন অনুরোধ করল? কী জিজ্ঞেস করবে ও রাহিকে? কী করবে ও? এত কিছু পারবে ও? ওর থেকে যার যা দরকার, তাকে-তাকে তারটুকু দিয়ে যেতে পারবে ও? জ্যাকেটের চেনটা গলা অবধি টেনে একটু হেলান দিয়ে বসল কিগান। যেতে হবে, ওকে আরও অনেক দূরত্ব পেরোতে হবে। ও দেখল, সামনের রাস্তাটুকু ঠান্ডা আর অন্ধকার।