১০
গতকাল থেকে ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। কলকাতায় এমন ঠান্ডা আশা করেনি রাহি। বহুদিন পর কলকাতায় এল ও। স্কুল, বাড়ি আর চাপাডাঙার এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতেই সময় কেটে যায় রাহির। কলকাতায় আসার কথা মনে পড়ে না। বা আরও ভাল করে বললে, ইচ্ছেও হয় না।
আসলে পিছনে বনগাঁ আর সামনে বারাসত। এর বাইরে যেতে হয় না রাহিকে। আর কলকাতার কথা মনে পড়লেই কালো ধোঁয়া, প্যাঁচানো ফ্লাইওভার, অটোর গুঁতোগুঁতি আর নাক গলা জ্বালা-পোড়ার কথাই মনে পড়ে ওর। তাই ইচ্ছেই করে না। বাবা-মা বললেও তাই বারবার এড়িয়ে যায়। আর গত কয়েক বছরে যে-ক’বার ঘুরতে গেছে, তখন প্লেনেই গেছে। দমদম থেকে। তাই কলকাতার পেটের মধ্যে আর ঢুকতে হয়নি।
এইবারও কলকাতায় আসার তেমন ইচ্ছে ছিল না ওর। কিন্তু তবু এসেছে দুটো কারণে। এক, হোমি বারবার বলেছে; আর দুই, ত্রয়ণ। ওই ছেলেটা দু’দিন এসে নাকি থাকবে ওদের বাড়িতে। তাই ওকে এড়ানোর জন্যই হোমির কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল রাহি।
বাবা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল খুব। আশ্চর্য হয়ে তাকিয়েছিল খানিকক্ষণ, তারপর হেসে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তা হঠাৎ, এমন ইচ্ছে হল তোর?’
ত্রয়ণের কথা তো আর বলা যায় না। তাই হোমির কথাই বলেছিল বাবাকে। বলেছিল, ‘ওই হোমিটা অনেকদিন থেকে মাথা খাচ্ছে। এবার ক্রিসমাসে ওর মামাতো ভাইয়ের বাড়িতে নেমন্তন্ন আছে। তাই নাছোড় হয়ে বলছে যে, আমাকেও যেতে হবে। কতবার বললাম যাব না। তবু…’
বাবা বলেছিল, ‘কেন যাবি না? অবশ্যই যাবি। আর স্কুলও ছুটি থাকবে। শোন, আনোয়ার শাহ রোডের ওপর আমাদের নতুন ফ্ল্যাটে থাকবি। কাজের লোকজন সব আছে আর চব্বিশ ঘণ্টা গাড়ির বন্দোবস্তও করে দেব। একটু ঘুরে আয়। দেখবি ভাল লাগবে। তুই তো বেরোতেই চাস না একদম।’
সত্যিই, বাড়ি থেকে একটু দূরে কোথাও যেতে হলেই আলস্য লাগে রাহির। কেমন যেন ভয়ও করে। কীসের ভয়, কেন আলস্য, এসব বোঝে না ও। কিন্তু হয়, ঠিক এমনটাই মনে হয় ওর। আর এখন তো আরও একটা কারণ হয়েছে। কিগান। বাড়ি থেকে চলে গেলে তো আর কিগানকে দেখতে পাবে না।
শুধু ত্রয়ণ। ওর জন্যই ও যাচ্ছে। অমন রোগা, সিরিয়াস দেখতে ছেলেটা যে কেমন তা একমাত্র রাহি জানে। ইস, নিজের সেই বছর তিনেক আগের ভুলটার জন্য সারা জীবন ছেলেটার সামনে ওকে গুটিয়ে থাকতে হবে। মানুষের একটা ভুল যে জীবনে তাকে কতটা অসহায় করে দেয়!
রাহি কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় যাবে শুনে দীপার মুখটা একটু কালো হয়ে গিয়েছিল। আসলে দীপার তো রাহি ছাড়া আর কোনও বন্ধু নেই। বাড়িতে এমনিতেই চমকের ব্যবহারের জন্য দীপা গুটিয়ে থাকে। এ নিয়ে দীপাকে হাজারবার বুঝিয়েছে রাহি, তবু দীপা বোঝেনি। রাহি বলেছে, ‘তুই এমন গুটিয়ে থাকিস কেন রে দীপা? দাদা যা করে তার দায় দাদার। তোর নয়। তা হলে এমন ভয় পেয়ে থাকিস কেন?’
‘না রে, অন্য কারও সঙ্গে বিয়ে হলে হয়তো তোর দাদা এমন থাকত না।’
‘হোয়াট রাবিশ!’ রাহি রাগ করে বলেছিল, ‘বোকার মতো কথা বলিস না। দাদা তোকে প্রায় জোর করে তুলে এনে বিয়ে করেছে। আর অন্য মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে কিছু হত না, বলাটা খুব পাতি শোনাচ্ছে।’
‘না রে রাহি, স্ত্রীদের তো একটা গুণ থাকে। আমার বোধহয় সেটা নেই। কিন্তু দেখ, আমি তো চেষ্টা করি। ওর সব কথা শুনি, সাধ্যমতো যা চায়, যেমনভাবে চায় তাই দিই। তবু আমি ওকে শোধরাতে পারি না। আমি খুব খারাপ!’
রাহি আর কিছু বলেনি। কোনও কোনও মানুষ, নিজের জীবনের কন্ট্রোল নিজে না নিয়ে, শুধু ‘আমি খুব খারাপ’ এই কথাটা ভেবে একটা বর্ম তৈরি করে আর কষ্টের বিলাস দেখায়। দীপার মধ্যে খারাপ গুণ বলতে শুধু এটুকু। তবে এটুকুও যে দীপা বলে তা কেবল রাহিকেই। বাবা, মা বা দাদার সামনে তো প্রায় কথাই বলে না।
দীপা যখন শুনেছিল যে, রাহি কলকাতা চলে যাচ্ছে, তখন খুব ধীর গলায় বলেছিল, ‘তুই চলে যাবি? ঘুরতে?’
রাহি দেখেছিল যে, দীপার চোখ দুটো ছলছল করছে। রাহি হেসে বলেছিল, ‘আরে, তাতে তুই এমন আপসেট হচ্ছিস কেন? জাস্ট চার-পাঁচ দিন তো!’
‘না, মানে…’ দীপা চুপ করে গিয়েছিল। তারপর সামান্য দ্বিধার সঙ্গে বলেছিল, ‘দেখ, ত্রয়ণকে আমি আসতে বারণই করেছিলাম। কিন্তু ও এমন নাছোড়বান্দা…’
‘মানে?’ রাহি সচকিত হয়ে উঠেছিল।
‘না না,’ দীপা বুঝেছিল যে, কথাটা রাহির ভাল লাগেনি। ও বলেছিল, ‘আসলে আমি জানি যে, তুই ওকে পছন্দ করিস না। আমিও করি না। সবসময় বড় বড় কথা! একদম ভাল লাগে না। সত্যি মানুষটাকে লুকিয়ে ও নিজের যে-ইমেজটা প্রোজেক্ট করে তার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। তবু, কী করব বল? আত্মীয়রাই তো বিষ হয়!’
রাহি পরিস্থিতিটা সহজ করার জন্য বলেছিল, ‘আরে ছাড় তো। খালি বাজে কথা ভাবিস না।’
‘দেখ, হয়তো ও তোকে পছন্দ করে। কিন্তু, সে তো তোকে অনেকেই পছন্দ করে। তাই ওকে আজ বলেওছি। আর ও বলে…’
‘বলেছিস মানে?’ আঁতকে উঠেছিল রাহি। ত্রয়ণকে দীপা এসব বলেছে? উলটে ত্রয়ণ আবার সব বলে দেয়নি তো? ত্রয়ণের কাছে যে ওর গোপন চাবিটা রয়েছে।
দীপা বলেছিল, ‘ও বলে, আমি নাকি ভুল ভাবছি। ওর তোর প্রতি ইন্টারেস্ট নেই। ও নাকি দেশের কাজের জন্য নিজেকে তৈরি করছে। ওর জীবনে নাকি প্রেমের কোনও জায়গা নেই।’
‘তাই!’ ভুরু তুলে বলেছিল রাহি।
‘আরও বলেছে যে, তুই নাকি ওর টাইপ নোস। তুই বড্ড শ্যালো। তাই…’
‘শ্যালো!’ রাহি ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল। শয়তান ছেলে! সবার সামনে এমন করছে যেন কত সাধুপুরুষ! একবার যদি বাবাকে বলে দেয় না যে, ত্রয়ণ কী করতে চায় ওর সঙ্গে, তা হলে ত্রয়ণের বারোটা বাজতে সময় লাগবে না একটুও। আর ও বুঝবে কত ধানে কত চাল!
কিন্তু এক মুহূর্তেই এই চিন্তাটা মাথা থেকে চলে গিয়েছিল রাহির। কারণ ত্রয়ণের বারোটা বাজাতে গেলে ত্রয়ণও ওর বারোটা বাজিয়ে দেবে। রাহি যে ত্রয়ণের কাছে বদ্ধ! তাই তো ত্রয়ণ বলেছিল, ‘তুমি আমারই থাকবে। তবে আমি জোর করব না। যেদিন তুমি রেডি হবে, সেদিনই আমি রাজি।’
শয়তান একটা! আস্ত শয়তান। রাজি! কীসের জন্য রাজি? আর রাজি না হলে কি সবাইকে দেখিয়ে দেবে সব? রাহি মাঝে মাঝে বোঝে না কী করবে! কোথায় যাবে! কার কাছে গেলে এই শাপমুক্তি হবে! একটা ভুলের জন্য কি ওকে সারা জীবন কষ্ট পেতে হবে? ভীষণ দমবন্ধ লাগে রাহির। মনে হয় যেন অক্টোপাস আটকে ধরেছে ওকে। কোথায় গেলে যে নিস্তার পাবে ও!
দীপা বলেছিল, ‘ছাড় তো ওর কথা। তুই চলে গেলে আমার এত খালিখালি লাগে!’
রাহি হেসে বলেছিল, ‘তা হলে তুইও চল আমার সঙ্গে। থাকবি, ঘুরবি। খুব মজা হবে।’
‘আমি!’ মুখটা কালো হয়ে গিয়েছিল দীপার।
নিজের ভুলটা চট করে বুঝতে পেরেছিল রাহি। তাই তো! দীপা যাবে কী করে? মা তো যেতেই দেয় না কোথাও দীপাকে! এই ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারে না রাহি। ওর শান্ত, নিরীহ, ভালমানুষ মা কেন যে দীপার বাইরে যাওয়া নিয়ে এতটা পজেসিভ হয়ে ওঠে, তার কোনও ব্যাখ্যা পায় না ও। শুধু দেখে যে, দীপার বাইরে যাওয়ার কথা উঠলেই মা গোমড়া হয়ে যায়। বলে, ‘ঠিক আছে। যাক, ঘুরে আসুক। ঝিগিরি করার জন্য বাড়িতে তো আমি রইলামই।’
ঝিগিরি! মায়ের কথা শুনে অবাক হয় রাহি। মা কিন্তু বাড়িতে কুটো ভেঙে দুটো করতে দেয় না দীপাকে। সবসময় আগলে রাখে। বলে, ‘ঠাকুর চাকর আছে কী করতে?’ বলে, ‘হাতের এত সুন্দর গড়নটা নষ্ট হয়ে যাবে যে!’
সেই মা-ই যখন দীপা বেরোবে বললে এমন বলে, তখন খুব অবাক হয়ে যায় রাহি। কেন এমন করে মা? দীপা বাপের বাড়িতেও যেতে পারে না তেমন। গেলেও এক রাতের বেশি থাকতে পারে না। কোনও কেনাকাটা করতে গেলে মা নিয়ে যায় সঙ্গে করে। এমনকী বারাসতের বিউটি পার্লার থেকে লোককে গাড়ি করে নিয়ে আসা হয়, দীপার যখন দরকার পড়ে তখন।
দীপার অমন কালো হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে খুব কষ্ট লেগেছিল রাহির। ও ব্যাপারটাকে সহজ করতে বলেছিল, ‘অবশ্য বোরও হয়ে যেতে পারিস তুই। আমি আর হোমি থাকব। “হেল্প আর্থ”-এর জন্য ব্রোশিয়োরের ডিজাইন দেখতে হবে। তারপর হোমির কাজিন গুন্ডার বাড়িতে ক্রিসমাসের নেমন্তন্ন আছে। তোর ভাল লাগবে না।’
দীপা বিষণ্ণ গলায় বলেছিল, ‘জানি, আমি বোর হয়ে যাব। যখন তোর বিয়ে হবে, দেখবি তখন তোকেও কত জিনিসে বাধ্য হয়ে বোর হতে হচ্ছে।’
বিয়ে! চিন্তা করলেই গায়ে জ্বর আসে রাহির। বুকে কষ্ট হয়। মনে হয় বিয়ে তো করতেই পারে। কিন্তু যাকে ইচ্ছে তাকে কি বিয়ে করতে পারবে? সে তো পাত্তাই দেয় না!
কিগান এত চুপচাপ থাকে যে, মনে হয় নিজেকে যেন লোহার পাঁচিল দিয়ে ঘিরে রেখেছে। একটা মানুষ এতটা একা থাকতে পারে দেখে মাঝে মাঝে অবাক লাগে রাহির। না, একা মানে একক নয়। ফ্যাক্টরি আর চাপাডাঙার অনেক মানুষই ঘিরে থাকে কিগানকে। তবু, তার ভেতরেও কোথায় যেন মানুষটাকে একা লাগে রাহির। মনে হয়, সবাই যেন ছেড়ে চলে গেছে কিগানকে। মনে হয় জীবনের থেকে বোধহয় আর কিছু পাওয়ার নেই ওর।
রাহি নিজে নিজেই কিগানের কাছে, ওর ঘরে যায়। প্রথম প্রথম কিগান সামান্য আপত্তি করলেও, পরে বুঝেছে যে, রাহিকে বলে লাভ নেই। তখন বলেছে, ‘তুই এত পাগলি কেন রে রাহি?’
‘সে আমি কী জানি? আর তুমি এত একাচোরা কেন? আমি কি তোমায় চিমটি কাটছি যে, বিরক্ত হচ্ছ? মনে রেখো, যে-ফ্যাক্টরিতে চাকরি করো, সেটা কিন্তু আমাদের জমিতেই তৈরি!’
উত্তরে কিগান আর কথা বাড়ায়নি। শুধু হেসেছে।
কিগানের ঘরে গিয়ে ওর বই নাড়াচাড়া করে রাহি। মিউজিক সিস্টেমে গান শোনে। টুকটাক এটা-ওটা গুছিয়ে দেয়। কখনও বাড়িতে নতুন কিছু রান্না হলে গিয়ে দিয়ে আসে।
মাঝে মাঝে রাহি ভাবে যে, কিগান ওকে পছন্দ করে। কিন্তু তারপর হঠাৎই আবার কোনও কোনও সময় এমন চুপ করে যায়, এমন নির্লিপ্ত হয়ে যায় যে, রাহি ঘাবড়ে যায়। মনে হয় কিগান যেন ওকে বহু দূরে ঠেলে দিচ্ছে। যেন কিগান ওকে চেনেই না!
একবার তো রাহি সাহস করে জিজ্ঞেসও করেছিল কিগানকে। বলেছিল, ‘আচ্ছা, মাঝে মাঝে তোমার কী হয় গো কিগানদা? এমন চুপ করে যাও কেন? কোনও কথা বলো না কেন? বোঝো না যে, তোমার আশপাশের মানুষেরা এতে কষ্ট পায়? অপমানিত বোধ করে!’
কিগান বিহ্বল হয়ে বলেছিল, ‘আমি কথা না বললে লোকে কষ্ট পায়? অপমান বোধ করে? কেন রে? আমি কে এমন মানুষ?’
‘তুমি? তুমি…’ রাহির রাগ হয়েছিল খুব। মনে হয়েছিল কিগানের চুলগুলোকে দু’হাতের মধ্যে ধরে নিয়ে খুব করে ঝাঁকায়। ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে একদম টেনে নেয় বুকের মধ্যে। দাঁতের দাগ বসিয়ে দেয় ঠোঁটে। ওর বুকের ওই তিনটে লাল তিলে। মনে হয়েছিল এমন করে শাস্তি দেয়, যেন আর কোনওদিন ওর প্রতি অমনোযোগী না হতে পারে কিগান।
কিগান হেসে বলেছিল, ‘দুর পাগলি। স্কুলে পড়াতে পড়াতে তুই সবাইকে নিজের ছাত্র ভাবিস, না? শোন, আমি তোর চেয়ে অনেক বড়। প্রায় বুড়ো। আর বুড়োরা একটু একাই থাকে। বুঝেছিস?’
‘এঃ, বুড়ো! তুমি তো থার্টি থ্রি,’ রাগ দেখিয়েছিল রাহি, ‘জানো আমি কত? আমার বয়স কত ধারণা আছে তোমার?’
কিগান মুচকি হেসে বলেছিল, ‘কত হবে? পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন!’
‘কী? আমায় অমন লাগে? আমি অত বুড়ি?’
কিগান বলেছিল, ‘যা পাকা পাকা কথা বলছিস তাতে তো আরও বেশি বলা উচিত ছিল। আমি তো কমই বললাম।’
‘আমি চব্বিশ। তোমার চেয়ে মাত্র ন’ বছরের ছোট।’
‘তুই আমার বয়স জানলি কোথা থেকে রে?’
‘তোমার একটা বইয়ের ভেতরে লেখা আছে। নাম আর বছর। জানো, নয় বছরটা কোনও ডিফারেন্সই নয়। জানো আমার বাবা-মায়ের ডিফারেন্স একুশ বছর। তাই বলছিলাম আমাদের ন’ বছরটা…’
কিগান আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে। আর রাহি বুঝেছিল যে, নিজের অজান্তেই ও অন্য একটা জায়গায় পা দিয়ে ফেলেছে।
এরপর বেশ কিছুদিন যায়নি ও কিগানের বাড়িতে। ভেতরে ভেতরে একটা লজ্জা আর সংকোচ একদম আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল ওকে।
কিন্তু কিগানই তারপর রাহিকে রাস্তায় ধরেছিল একদিন। বলেছিল, ‘কী দিদিমণি, তোদের বাড়িতে কি আর ভাল রান্নাবান্না হচ্ছে না? নাকি আমায় দিলে তোর ভাগে কম পড়ে যাবে?’
রাহি বলেছিল, ‘কম যে পড়বে না তা তোমার চেয়ে ভাল আর কে জানে!’
কিগান হেসেছিল। তারপর বলেছিল, ‘মেয়েরা বড্ড রাগ করে, তাই না রে?’
রাহি গম্ভীর গলায় বলেছিল, ‘আর ছেলেরা? সবার মাথায় বরফের ফ্যাক্টরি আছে, না? অসহ্য। ছেলেগুলো সব অসহ্য!’
কিগান হেসে বলেছিল, ‘দাঁড়া, তোর বিয়ের সময় তোর বরকে বলব এই কথাটা।’
রাহির ইচ্ছে হয়েছিল বলতে যে, ‘বললাম তো। আমিই বললাম তো আমার বরকে।’ কিন্তু বলেনি। বরং গম্ভীর গলায় বলেছিল, ‘বিয়ে নিয়ে ইয়ারকি মারাটা উনিশশো ষাটের পর একটু ডেটেড হয়ে গেছে, বুঝলে?’
তারপর থেকে কিগানের সঙ্গে আবার সহজ হয়ে গিয়েছে সম্পর্কটা। এই তো কলকাতায় আসবে শুনে কিগান ওকে বলেছিল গিটারের জন্য চার সেট তার কিনে আনতে। টাকাও দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তখন টাকাটা নিলেও এখান থেকে গিয়ে সেটা ফেরত দিয়ে দেবে ও। এটা ও নিজেই কিনে দিতে পারে।
‘কী রে? এমনভাবে কী ভাবছিস তুই?’ হোমির প্রশ্নে ফিরে তাকাল রাহি।
এই ঠান্ডাতেও সন্ধের মুখে স্নান করেছে হোমি। জামাকাপড় পরে তৈরি হয়ে গেলেও মাথার চুলগুলো ভিজে ভিজে লাগছে। যতই গরম জলে স্নান করুক, তবু হঠাৎ করে নতুন জায়গায় এমন করে স্নান করাটা ঠিক নয়। বলেওছিল কথাটা হোমিকে। কিন্তু মেয়েটা শুনলে তো!
রাহি বলল, ‘দেখ, স্নানটা সেই করলি! জ্বর হলে কিন্তু কেলেঙ্কারি হবে।’
‘দুর,’ হোমি সামনের কাচের টেবিলের ওপর থেকে কফির কাপটা তুলে নিয়ে হাসল। তারপর চুমুক দিয়ে বলল, ‘তোদের এই রান্নার লোকটা কিন্তু ব্যাপক কফি বানায়। তা এমন বিরহিণী রাধিকা হয়ে জানলা দিয়ে কী দেখছিস?’
‘বিরহিণী!’ রাহি হাসল, ‘এত উঁচু থেকে শহরটাকে কী অদ্ভুত লাগে, দেখ! মনে হচ্ছে অসংখ্য জোনাকি নেমে এসেছে মাটিতে!’
‘দেখ রাহি, কেস কী বল তো? ছেলেটা কে?’
‘মানে?’ রাহি জানলার পাশের চেয়ারটা থেকে উঠল, ‘কী যা তা বলছিস!’
হোমি হাসল, ‘প্রেমে পড়লে সবাই এত সাবজেক্টিভলি পৃথিবীকে দেখে যে, মনে হয় আর্ট ফিল্মের ডায়ালগ শুনছি!’
‘ওফ, তুই থামবি?’
‘থামব, তবে যদি তাড়াতাড়ি ড্রেস করে নিস, গুন্ডার বাড়িতে সাতটার ভেতর পৌঁছোতে হবে। তাড়াতাড়ি কর না।’
‘ওকে, জাস্ট পাঁচ মিনিট লাগবে। কোনও প্রবলেম নেই।’ রাহি ভিতরের ঘরের দিকে চলে গেল। সাজগোজ করতে সত্যি রাহির খুব একটা সময় লাগে না।
রাহির ছোটবেলা থেকেই উঁচু বাড়িতে থাকার খুব ইচ্ছে ছিল। তাই ওর কথামতোই আনোয়ার শাহ রোডের ওপর এই এত্ত উঁচুতে ফ্ল্যাটটা কিনেছে বাবা। সবাই বারণ করেছিল বাবাকে। বলেছিল, ‘অত দূরে কেন ফ্ল্যাট কিনছেন?’
কিন্তু বাবা কারও বারণ শোনেনি। বরং বলেছিল, ‘রাহির ইচ্ছে হয়েছে, সেটাই তো বড়। আর ইনভেস্টমেন্টও হয়ে থাকল। সমস্যা কোথায়?’
ফ্ল্যাটটা দেখেই ভাল লেগে গিয়েছিল রাহির। চব্বিশ তলার ওপর। জানলা খুললে মনে হয় কে যেন কলকাতাকে সামনে মাদুরের মতো বিছিয়ে রেখেছে। শহিদ মিনারটাও আবছা দেখা যায়! এত হাওয়া যে, বেডরুমে দেওয়াল জোড়া জানলাটা খুলে ওর মনে হচ্ছিল ছোট্ট এক কুচি কাগজের মতো ও হয়তো ভেসেই যাবে কোথাও।
রাহিকে আর কিছু বলতে হয়নি। বাবা বলেছিল, ‘এই নে। এই তোর চাবি।’
কী যে আনন্দ হয়েছিল রাহির! কী যে মুগ্ধ হয়েছিল ও! মনে হয়েছিল মাসের অর্ধেকটা এখানেই এসে থাকবে। আর মনের সুখে কলকাতায় ঘুরবে। কিন্তু এই কিগান এসেই তো সব গন্ডগোলটা বাধাল!
কলকাতায় যে আর আসতেই ইচ্ছে করে না ওর। চাপাডাঙা ছেড়ে যে নড়তেই ইচ্ছে করে না। কেবল মনে হয় কলকাতায় চলে গেলে তো আর কিগানকে দেখতে পাবে না।
বাবা তো একদিন আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করেছিল, ‘তুই যে বললি কখনও কখনও ওই ফ্ল্যাটটায় গিয়ে থাকবি। যাস না তো!’
রাহি আদুরে গলায় বলেছিল, ‘তুমি চাও আমি চলে যাই?’
‘আরে, না না,’ বাবা অপ্রস্তুত হয়েছিল, ‘তাই বললাম নাকি? আসলে তোর পছন্দ হয়েছিল তো, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।’
মা পাশ থেকে বলেছিল, ‘তোমার কোনও বিবেচনা নেই। পাগলি মেয়েটার কি আর মাথার ঠিক আছে? ওর কথায় নেচে কেউ কি অত টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনে? এই তোমার বুদ্ধি!’
বাবা বলেছিল, ‘মেয়ের ইচ্ছেটার চেয়ে কি টাকা দামি?’
‘মেয়েকে নিয়ে তোমার চিরটাকাল আদিখ্যেতার স্বভাব।’ মা পান সাজতে সাজতে বলেছিল।
বাবা সামান্য হেসে বলেছিল, ‘হবে না? মেয়েটা যে আমার।’
শোওয়ার ঘরের বড় আয়নায় জামাকাপড় পালটানোর মাঝে নিজেকে একবার দেখল রাহি। শরীরে কি মেদ কিছুটা কমেছে? খুব চেষ্টা করছে আজকাল যাতে একটু হালকা হয় ও। কিন্তু তবু হচ্ছে না। জল খেলেও যেন ওর ওজন বেড়ে যায়! মা বলে, এমন ফরসা, গোলগালই নাকি ভাল। কিন্তু নিজেকে রাহির মাঝে মাঝে তুলোর বস্তার মতো লাগে। এতটা গোলগাল হওয়াটাও কাজের কথা নয়। টিভিতে বিকিনি পরা মেয়েদের দুর্গম খাঁজওয়ালা শরীর দেখলে বড্ড কষ্ট হয় রাহির। আর তার চেয়েও কষ্ট হয় যখন মনে মনে ও নিজেকে কিগানের পাশে কল্পনা করে। অমন সাঁতারুর মতো একটা মানুষের পাশে নিজেকে খুব বেমানান লাগে ওর। মনে হয় এমন ফিগারের জন্যই কি কিগান ওর দিকে ফিরে তাকায় না?
আজকাল ডায়েট করার চেষ্টা করছে রাহি। কম খায়। হাঁটে। এমনকী ঘরের ভেতর স্কিপিংও করে। কিন্তু তিন-চারদিন করার পরই কেমন যেন একটা দুর্বোধ্য টানে গুচ্ছের কাজুবাদাম, নারকেল, ঘিয়ে ভাজা লুচি খেয়ে ফেলে, আর সমস্ত কিছুই আবার যেমন ছিল তেমন হয়ে যায়। প্রবৃত্তি! প্রবৃত্তিকে সামলানো যে কী কঠিন তা বুঝতে পারে রাহি।
আজও শুধু ব্রা আর প্যান্টি পরে সামান্য সময় নিয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। নাহ্, ফ্যাট, প্রোটিনের বাড়াবাড়ি একটুও কমেনি। থাইতে স্ট্রেচমার্কস এসেছে। জঘন্য। একদম জঘন্য। নিজের ওপর খুব রাগ হল রাহির। একটুও সংযম নেই ওর। থাকলে এমন দুর্ভিক্ষের কারণ ধরনের চেহারা হত না!
নিজেকে দেখলে আরও কষ্ট বাড়বে। তাই চটপট একটা জিন্স, টি-শার্ট আর জ্যাকেট চাপিয়ে নিল রাহি। একটু ঢিলেঢালা কাপড় পরলে মোটা ব্যাপারটা একটু কম চোখে পড়ে।
কলকাতায় এলে জিন্স, টি-শার্ট পরতে পারে রাহি। চাপাডাঙায় পারে না। বা বলা ভাল, মা পরতে দেয় না। বলে, লোকে কী বলবে! মায়ের খুব লোকেদের কথার ভয়। হ্যাঁ, সামান্য গ্রাম্য জায়গায়, এ ওর হাঁড়ির খোঁজখবর বেশি নেয়। নিন্দামন্দও বেশি হয়। তা বলে মানুষ, যা পরতে ইচ্ছে হয়, তা পরবে না? আর টি-শার্ট, প্যান্ট তো খুব ভদ্র পোশাক। কিন্তু মাকে কে বোঝাবে! শাড়ির প্রতি এই অন্ধ আনুগত্যের কোনও ব্যাখ্যা ঠিক খুঁজে পায় না রাহি। তবে এই নিয়ে বিশেষ ঝঞ্ঝাট করে না। মায়ের কথামতোই শাড়ি পরে। আর ইচ্ছে হলে বড়জোর চুড়িদার পরে।
রাহি ঘর থেকে বেরোতেই ছটফট করে উঠল হোমি, ‘এই তোর পাঁচ মিনিট হল? রাহি, কাকিমা বহুত রাগ করছে, বলছে, আর আসতে হবে না। এখানেই রাতের খাবারটা গুন্ডাকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবে।’
‘সরি সরি,’ রাহি ব্যাগটা সোফার ওপর থেকে তুলে বলল, ‘চল, চল। তবে যাদবপুর তো, খুব একটা সময় লাগবে না।’
‘নাঃ, তোকে বলেছে! আজ পঁচিশে ডিসেম্বর। সামনেই বিশাল মল। তার জ্যাম, যাদবপুর থানার জ্যাম, এইট বি-র জ্যাম। পুরো ঝাড় কেস একদম। তুই এত লেট করলি না!’
রাহি বলল, ‘আমি দেরি করলাম? না, স্নান করতে গিয়ে তুই দেরি করলি?’
‘আচ্ছা, আচ্ছা, চল।’ হোমি প্রায় ধাক্কিয়ে রাহিকে বের করে আনল ঘর থেকে।
কলকাতায়, বাবার এক বন্ধু, নিজের একটা গাড়ি চব্বিশ ঘণ্টা ব্যবহারের জন্য দিয়ে রেখেছে রাহিকে। তাই রাস্তা থেকে ট্যাক্সি ধরার ঝামেলা নেই।
গাড়িতে বসে রাহি বলল, ‘কোথাও থেকে মিষ্টি কিনে নিতে হবে। প্রথমবার তোর কাকুর বাড়ি যাচ্ছি তো!’
‘ধুর, ফর্মালিটি বাদ দে তো!’
‘না, ওটা ভদ্রতা। মিষ্টির দোকান দেখলে গাড়ি থামাস তো।’
‘আমার কাকু-কাকিমা কিন্তু এমন কিছুতে বিশ্বাস করে না। ওরা শুধু আমরা গেলেই খুশি হবে। আজ ওই যিশুর জন্মদিনটা ওদের কাছে খুব আনন্দের। কাকু-কাকিমা সাধ্যমতো চেষ্টা করে এই ক্রিসমাসের সন্ধেটা ভাল করে কাটাতে। আমার কাকিমাকে জাস্ট একবার দেখবি। কাকুকে বিয়ে করলেও বছরের এই দিনটা এলেই কাকিমা বাচ্চা মেয়ের মতো ক্রিসমাস পালন করে।’
গুন্ডা বলে ছেলেটাকে দেখেছে রাহি। ইয়া মোটা চেহারা। দাড়িগোঁফ কামানো। আর খুব ঘামে। ছেলেটা প্রচুর কথাও বলে, যেগুলো আপাতপক্ষে রূঢ় শোনালেও আসলে ছেলেটা যে ভাল সেটাই প্রমাণ করে। কারণ, অমন সহজ-সরলভাবে কথা বলতে অনেকেই ভয় পায়, পাছে অন্যের কাছে নিজের ভালমানুষের ছবিটা বদলে যায়! কিন্তু গুন্ডা অতশত কিছু ভাবে না। বরং নিজের ভাল-খারাপের তোয়াক্কা না করেই সত্যিগুলো স্পষ্ট করে বলে দেয়।
সারা বছর সাধারণভাবে কাটালেও এই পঁচিশে ডিসেম্বর দিনটায় ওরা আনন্দ করে। কয়েকজনকে নেমন্তন্ন করে। কেক কাটে। গুন্ডার ভাই টমটম গিটার বাজিয়ে গানও গায়। তারপর সবাই রাতে ডিনার করে।
শুনেছে, এই সবই হোমির কাছে শুনেছে রাহি। হোমির বাবা-মা চায় না যে, হোমি ওর কাকার সঙ্গে সম্পর্ক রাখুক। হোমির কাকা খ্রিস্টান মেয়েকে বিয়ে করেছে বলেই ওরা এমন করে। কিন্তু হোমি কোনওদিন কারও কথা শোনে না, বিশেষ করে সেটাকে যদি অন্যায় মনে করে। আর এই স্বভাবের জন্যই তো ‘হেল্প আর্থ’-কে নিয়ে সব বাধা কাটিয়ে মুভ করতে পারে ও।
কাকাকে বাড়ি থেকে বের করা নিয়ে নিজের ঠাকুরদার সঙ্গে প্রায়ই তর্কাতর্কি করে হোমি। বলে এটা জঘন্য অন্যায়। তাই এটার একটা প্রতিকার ও নিজের মতো করে করবে। তবে শুধু অন্যায়ের প্রতিকারই নয়, গুন্ডাকেও খুব ভালবাসে হোমি। এমনকী বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রায় লড়াই করে গুন্ডাকে মাঝে মাঝে চাপাডাঙায় নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখে ও। হোমির বাবা-মাও, কেন কে জানে, গুন্ডাকে সরাতে পারে না।
গাড়িটা থেকে নামতে নামতে একটু অস্বস্তি লাগল রাহির। আসলে কোনওদিন আসেনি তো। তার ওপর ওরা তো সরাসরি নেমন্তন্নও করেনি। কে জানে ওরাই নেমন্তন্ন করেছে, না হোমি নিজে আগ বাড়িয়ে ওকে নিয়ে আসবে বলেছে!
গলিটা সামান্য অন্ধকার। এখন কলকাতার অনেক জায়গাতেই বড় বড় সাদা রঙের আলো লাগানো হয়েছে। এ পাড়াতেও হয়েছে, কিন্তু কোনও কারণবশত এখানের দু’-একটা আলো জ্বলছে না।
গলির পাশ দিয়ে আরও একটা সরু গলি চলে গিয়েছে। হোমির পিছন পিছন সেটাতে ঢুকল ও। এই গলিটা যথেষ্ট স্যাঁতসেঁতে। পায়ের তলায় ইট পাতা। একটু এদিক-ওদিক হলেই কাঁধ ঘেঁষে যাচ্ছে পাশের দেওয়ালে। রাহির মনে হল, গুন্ডা এই গলি দিয়ে কীভাবে রোজ বাড়িতে ঢোকে আর বেরোয়?
গলিটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে একটা কাঠের দরজা। তবে দরজাটা বেশ ভাঙাচোরা। আর তার গায়ে একটা দুর্বল লেটার বক্স ঝুলছে। দরজাটার মাথায় একটা চল্লিশ পাওয়ারের বাল্ব জন্ডিস রোগীর চোখের মতো জ্বলছে। ময়লা আলোয় জায়গাটাকে আরও যেন ময়লা লাগছে। এখানে হোমির কাকারা থাকে?
হোমি দরজার কড়া ধরে খুব জোরে নাড়া দিল। এই রে! দরজাসুদ্ধ খুলে পড়বে না তো! ভয় লাগল রাহির। দরজাটার যে খুব খারাপ অবস্থা!
গুন্ডাই দরজা খুলল। আর রাহি ওই দুর্বল আলোতেই দেখল গুন্ডা একটা পাতলা গোল গলার টি-শার্ট পরে রয়েছে। একটু হাঁফাচ্ছেও যেন।
হোমি ভেতরে ঢুকে বলল, ‘কী রে গুন্ডা, তোর ঠান্ডা লাগছে না?’
‘ঠান্ডা!’ গুন্ডা এমন গলায় বলল যেন এখন জ্যৈষ্ঠের দুপুর।
‘আজ তো দারুণ ঠান্ডা পড়েছে। তোর মালুম হচ্ছে না?’
‘সত্যি দিদি, তুমি কী যে বলো না!’ গুন্ডা সারা শরীর খেলিয়ে হাসল। তারপর নিজের পেটের ওপর চাপড় মেরে বলল, ‘ঠান্ডার সাধ্য আছে আমার এই চাইনিজ ওয়ালকে টপকায়?’
বাইরেটা এমন অগোছালো হলেও ঘরের ভেতরে ঢুকে ভাল লাগল রাহির। ওই দরজা থেকে একটা ছোট্ট উঠোন পেরিয়ে ঘরে ঢুকতে হয়েছে রাহিদের। উঠোনের এক পাশে ছেড়ে রাখা কিছু জুতোর পাশে ওরাও জুতো খুলেছিল। ঘরে ঢুকে সেইসব জুতোর মালিকদের দেখল ও।
বেশি নয়, ছ’জন। তিনটে মেয়ে আর দুটো ছেলে। আর ঘরের এক কোণে গিটার কোলে নিয়ে বসে রয়েছে একটা ষোলো-সতেরো বছরের ছেলে। এটা নিশ্চয়ই টমটম।
হোমির গলা পেয়ে ঘরের পরদা সরিয়ে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাও ঘরে ঢুকল। হোমি বলল, ‘কাকু, এই দেখো কাকে এনেছি আমার সঙ্গে। রাহি। আয় রাহি, এই আমার কাকু জয়ন্ত রায় আর কাকিমা শিবানী এমিলিয়া রায়।’
শিবানীকে দেখে একটু অবাক হল রাহি। একদম ওর মায়ের মতো। শাড়ি, শাঁখা, সিঁদুর সব একরকম। তবে যে হোমি বলেছিল ক্রিশ্চিয়ান? নিজেকে সামলে নিল রাহি। ক্রিশ্চিয়ান মানেই কি আর বিদেশি? অনেক বাঙালি ক্রিশ্চিয়ানও তো থাকে। শিবানীকাকিমা নিশ্চয়ই তেমন একজন।
কাকিমা হেসে বলল, ‘বোসো রাহি। হোমি এলেই তোমার কথা বলে। তাই ভাবলাম একবার নেমন্তন্ন করি তোমায়। না হলে তো আর আমাদের বাড়িতে তুমি আসবে না।’
‘না না, তা কেন?’ রাহি হাসল, ‘আসলে অত দূরে থাকি তো তাই চট করে আসা হয় না। কিন্তু দেখুন, আমি এলাম তো!’
কাকু বলল, ‘বাড়িতে অন্যরা আজ তেমন নেই। আমরাই ক’জন আছি। তো, তোমরা গল্প করো। আমরা বুড়ো-বুড়ি একটু পরে আসছি।’
কাকুরা চলে যেতেই গুন্ডা পুরনো কাঠের সোফাটায় খুব সুন্দর দেখতে একটা ছেলে আর সামান্য চাপা রঙের মেয়ের মধ্যে জোর করে গুঁজে দিল নিজেকে। তারপর রাহির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই রাহিদি, এরা সব আমার বন্ধু। ও হচ্ছে জয়। ওর পাশে স্নেহা, তার পাশে রূপ। আর আমার বাঁ দিকে এইজনের নাম দিঘি আর ডান দিকের এই কার্তিক ঠাকুরটি হল আর্য।’
সবাইকে দেখে ভাল লাগল রাহির। অল্পবয়সি সবাই। ওর চেয়ে সামান্য ছোট।
আর্য বলল, ‘তোমার নামটা খুব আনকমন। রাহি। গ্রেট। গুন্ডার কাছে শুনেছি, তোমাদের নাকি র্যাঞ্চ আছে? তোমরা নাকি সেখানে থাকো?’
‘র্যাঞ্চ!’ হাসল রাহি, ‘তেমন কিছু নয়।’
গুন্ডা বলল, ‘না রে আর্য, গেলে দেখতে পাবি। ব্যাপক ব্যাপার!’
আর্য বলল, ‘নিশ্চয়ই যাব। কিন্তু তোর সঙ্গে নয়। তুই একটা মোটা অসভ্য।’
‘মানে?’ গুন্ডা এমন করে ঘুরল যে, দিঘি উফ করে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গে পুরনো কাঠের সোফাটাও আর্তনাদ করল।
‘মানে, আমার আর দিঘির মধ্যে তুই এমন অসভ্যের মতো ঢুকে পড়লি কেন?’
‘অ্যাঁ, আমি অসভ্য?’ গুন্ডা চোখ পাকাল, ‘অসভ্য তো তুই। তোকে নেমন্তন্ন করেছি আজ যে, তুই এসেছিস?’
আর্য গলা তুলে বলল, ‘বেশ করেছি এসেছি। তুই যে বিনা নেমন্তন্নে সব জায়গায় ঢুকে পড়িস! তখন মনে থাকে না? দেখ, তোর বাড়িতে অমনভাবে কেউ এলে কেমন লাগে।’
গুন্ডা বলল, ‘তাও তো খালি হাতে এসেছিস! আর এটা আমার বাড়ি, আমি যেখানে খুশি বসব। ইচ্ছে হলে দিঘির কোলে বসব।’
আর্য উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘তবে রে মোটা। মেরে তোর হাড় ভেঙে দেব।’
‘হাড়?’ খিকখিক করে হাসল রূপ, ‘অমন চর্বি পেরিয়ে অত অবধি পৌঁছোতে পারবি?’
রাহি দেখল, এত সবের মাঝে থেকেও দিঘি কেমন যেন অন্যমনস্ক। কেমন যেন চুপচাপ। মেয়েটা কি কোনও কষ্টে আছে? রাহি এমন মুখ চেনে।
দিঘি উঠে গিয়ে এবার টমটমের পাশের শোকেসটায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল। আলতো গলায় বলল, ‘টমটম একটা গান কর তো। এই পরিবেশটাকে একটু ঠিক কর।’
‘ঠিক কর মানে?’ গুন্ডা তেরিয়া হয়ে উঠল, ‘আর্য দেখ, তোর দিঘি কী বলছে! শালা, আমরা কী…’
‘আঃ,’ এবার হোমি ধমক দিল, ‘গুন্ডা, এত এক্সাইটেড কেন তুই? তখন থেকে আনসান বকে যাচ্ছিস! চুপ করে বোস। একদম লাফাবি না।’
গুন্ডা কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল।
হোমি এবার টমটমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী রে গা। গান গা। দিঘি তো ঠিকই বলেছে। গিটার নিয়ে সঙের মতো বসে না থেকে একটা গান শোনা।’
টমটম গিটারটাকে ধরে চোখ বন্ধ করে বসল কিছুক্ষণ। তারপর গিটার স্ট্রাম করে ধরল,
‘Tis true the rain that has no end
It’s hard to find a faithful friend
And when you find one just and true
He’s dropped the old one for the new
Bring back my blue eyed boy to me
Bring back my blue eyed boy to me
Bring back my blue eyed boy to me
That I may ever happy be…’
রাহি শুনল টমটম গানের শেষে ‘Bring back my blue eyed boy to me’ লাইনটা আরও কয়েকবার গাইল। ও দেখল, আর্য উঠে গিয়ে দাঁড়াল দিঘির সামনে। তারপর আলতো হাত ধরে টানল নাচের জন্য। কিন্তু দিঘি আচমকা এক ঝটকায় সরিয়ে দিল আর্যর হাত। আর্য অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল দিঘির দিকে। আর গুন্ডা সেই দেখে শব্দ করে হেসে বলল, ‘কী রে আর্য, খেলি তো ঝাড়! দিঘির মনে হচ্ছে সেই ব্লু আইড বয়টিকে মনে পড়ছে। কী রে দিঘি, তাই তো?’
রাহি দেখল গুন্ডা হাসছে। স্নেহা আর জয় হাসছে। আর্য দাঁড়িয়ে আছে থতমত খেয়ে। রাহি দেখল দিঘির মুখে ঘন হচ্ছে মেঘ। যিশুর জন্মদিনে মনখারাপের একটা মেঘ যেন পাক খাচ্ছে শহরে। কোথাও কিছু নেই, তবু যেন মনখারাপ তার খয়েরি ডানাটায় ঢেকে ফেলছে মানুষকে। আর নীল চোখের তাকে হঠাৎ খুব মনে পড়ছে রাহির। খুব মনে পড়ছে। আচ্ছা, দিঘি গানটা শুনে এমন হয়ে গেল কেন? ও-ও কি কোনও নীল চোখের মানুষকে চেনে? ওরও কি কোনও নীল চোখের মানুষের জন্য মনখারাপ করে? হাজার হাজার বছর আগে বেথলেহেমের মাথায় যে-নীল রঙের তারাটি এসে স্থির হয়ে গিয়েছিল, এতদিন পরে এই যাদবপুরের ছোট্ট পাড়ার মাথায় সে কি ফিরে এল আবার? গান কি তাকে ফিরিয়ে আনল নতুন করে? নাকি সে ছিলই সারাজীবন? সমস্ত ভালবাসার মানুষদের মাথার ওপর সে জ্বলেই ছিল আজীবনকাল! শুধু আজ তাকে দেখা গেল স্পষ্ট করে!
রাহি দেখল দূরে ঝুলনের মতো সাজানো পুতুলদের মাঝে মেরির কোল আলো করে হাসছেন যিশু। যেন বলছেন, ভালবাসার দিন শুরু হল।