মুহূর্তরা দু’বছর আগে – ১

‘ওই দেখ, তোর ভেতর সূর্য ভাসছে।’

গুন্ডার কথায় চমকে উঠল দিঘি। বুকের ভেতর আচমকা চড়াই ঝাপটাল ছ’টা। দম বন্ধ হয়ে এল মুহূর্তের জন্য। কথাটা কি ইচ্ছে করে বলল গুন্ডা? সব জেনেশুনে এমনভাবে বলতে পারল ও? দিঘি কিছু না বলে মাথা নিচু করে নিল। চড়াইদের ডানার আঁচড়ে বুকের ভেতরটা জ্বালা করছে।

গুন্ডা আবার বলল, ‘অবশ্য কলেজ স্কোয়ারের এই পুলটাকে কি দিঘি বলা যায়? কে জানে! কিন্তু দেখ, জলে সূর্যের রিফ্লেকশনটা কী দারুণ লাগছে!’

গুন্ডা বড্ড বেশি কথা বলে। একবার শুরু করলে থামতেই চায় না। অন্যের কেমন লাগছে, না লাগছে তা কেয়ারই করে না একদম।

‘আঃ গুন্ডা, তুই চুপ করবি?’ রূপ ধমক দিল, ‘গত দেড় ঘণ্টা ধরে বকে যাচ্ছিস। আর বোর করিস না।’

‘বোর?’ গুন্ডা থমকাল। ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ঝুলপির পাশ থেকে ঘাম সরিয়ে বলল, ‘কেন, বোর হচ্ছিস কেন? আর চুপ করব কেন? কেউ মরে গেছে নাকি?’

রূপ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ওফ, তুই বড় হবি না? অবস্থার গুরুত্ব বুঝিস না? জানিস না আজ কোন দিন?’

‘আজ? কেন? তুই জানিস না কোন দিন? থারটিন্থ আগস্ট। আর বড় বললি? আর কত বড় হব রে? প্রায় উনিশ বছর বয়স, একশো কুড়ি কেজি ওজন। ছেচল্লিশ কোমর। শালা আর কত বড় হব বল?’

রূপ ওর আইলাইনার লাগানো চোখ ওপর দিকে তুলে কাঁধ ঝাঁকাল। তারপর পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল। বলল, ‘ইউ আর জাস্ট ইনকরিজিব্‌ল!’

‘শালা, সিগারেট খেয়ে পয়সা নষ্ট করিস। দে না আমায়। একটা মটন রোলের খরচ তো উঠে যায়।’ গুন্ডা রূপের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে দিঘির দিকে ঘুরল, ‘তা ছাড়া, দিঘির আজ তো সেলিব্রেট করার দিন। সেই পার্ভার্টটা আজ বিদেয় হচ্ছে। ইউ শুড থ্রো আ পার্টি।’ গুন্ডা খিকখিক করে হেসে, দুটো হাত ঘষল।

পার্ভার্ট! কথাটা অ্যাসিডের মতো ঢুকল কানের ভেতরে। দিঘি চোয়াল শক্ত করল। ওর মনে পড়ে গেল ঠোঁটের ওপর তিল। মনে পড়ে গেল ভেজা স্বাদ। বুনো জঙ্গলের গন্ধ। আচমকা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল ওর। বৃন্ত দুটো কোনও এক স্পর্শের স্মৃতিতে উন্মুখ হল। শীত করে উঠল দিঘির। দেখল কলেজ স্কোয়ারের জলে সূযর্টা ম্রিয়মাণ হয়ে এসেছে। আর কিছুক্ষণ পর থাকবেই না!

কিছু থাকে না। দিঘি জানে, কিচ্ছু থাকে না জীবনে। শুধু স্মৃতি থেকে যায়। মনখারাপ থেকে যায়। ছোঁয়া যায় না, এমন একটা কষ্ট ফড়িঙের মতো ওড়ে পাঁজরের আনাচকানাচে।

‘দিঘি, কী হয়েছে?’

দিঘি মুখ তুলে আর্যকে দেখল। কালো টি-শার্ট আর বাদামি জিন্‌স পরেছে আজ। পিঠে ব্যাগ। ফরসা লম্বা চেহারা একটু এলোমেলো। মুখচোখ লাল হয়ে আছে। গালে দু’দিনের না কামানো দাড়ি।

‘কিছু না,’ দিঘি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘তুমি হাঁপাচ্ছ কেন?’

আর্য হাসল, ‘তোমায় বলেছিলাম যে, পাঁচটায় আসব, কিন্তু স্যার এমন আটকে দিলেন যে… তা ছাড়া, জে ইউ-র ক্যাম্পাস থেকে এই অবধি আসতে গেলে তো হাঁপাতেই হবে। তাও দেখো, জাস্ট ওয়ান আওয়ার লেট।’

দিঘি হাসল। ইচ্ছে করছে না, তবু হাসল। সত্যি আর্য ওর জন্য অনেক করে। না, ও কিছু করতে বলে না, কিন্তু তবু করে। নিজে থেকে করে।

আর্যর পুরো নাম আর্যনীল ঘোষ। যাদবপুরে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ে। থার্ড ইয়ার। বড়লোক বাপের একমাত্র ছেলে। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের ওপর আর্যদের বাড়ি। না, ঠিক বাড়ি নয়, বাংলো। চারটে গাড়ি, শিফ্‌টে শিফ্‌টে বদল হওয়া দারোয়ান, মালি, উর্দি পরা কাজের লোক, কী নেই? নেই, আর্যর মা নেই।

তাই বিদেশে আর্যকে পড়তে পাঠাননি ওর বাবা। যদিও ভদ্রলোক মাসের মধ্যে পনেরো দিন বিদেশেই থাকেন। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে হয়তো বিদেশেই ম্যানেজমেন্ট পড়তে চলে যাবে আর্য। ইংল্যান্ডে সেইমতো একটা বাড়িও কিনে রেখেছেন আর্যর বাবা। আর্য নিজে কখনও এসব বলেনি দিঘিকে। বলেছে স্নেহা।

রূপের মতো স্নেহাও দিঘির বান্ধবী। একই সঙ্গে ইকনমিক্স নিয়ে পড়ে। স্নেহারা আবার আর্যদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। সেই সূত্রেই গত বছর স্নেহার জন্মদিনে আর্যর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল দিঘির।

স্নেহাদের বাড়িটা আদ্যন্ত ক্লাসিক্যাল। সবাই চৌকো ভারী ফ্রেমের চশমা পরে। দাবার ছকের মতো বারান্দায় বাড়ির বড়রা ডেকচেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ে। আনন্দ হলে রবীন্দ্রনাথের গান গায়। দুঃখ হলেও রবীন্দ্রনাথেরই গান গায়। ওদের বাড়ির খাটে উঠতে হলে ফায়ার ব্রিগেডের সিঁড়ি লাগে। এখনও ঠাকুরদাদা ঘড়ি সময় জানায় পাড়া কাঁপিয়ে। ওরা সরগম মেনে হাসে। ওদের স্টাডিতে ঢুকলে মনে হয় আস্ত একটা কলেজ স্ট্রিট।

স্নেহার জন্মদিনে তাই অমন একটা বাড়ির ভেতর জিন্‌স, টপ, লিপ-স্টাড, রিস্ট-ব্যান্ড পরা ছেলেমেয়েরা ঢুকে নিজেরাই বেজায় অস্বস্তিতে পড়েছিল। রূপের ঘণ্টায় চারটে সিগারেট ছাড়া চলে না। গুন্ডা কথায় কথায় ‘এফ’ শব্দের হরির লুঠ দেয়। রিধিমার লো ওয়েস্ট জিন্‌স মাঝে মাঝেই বিপদসীমা লঙ্ঘন করে। ওরা সবাই ‘কোথায় এলাম’ ধরনের মুখ করে বাড়িতে ঢুকেছিল। দিঘির সেই অবস্থা না হলেও অস্বস্তি হচ্ছিল ওরও।

ওরা সবাই জড়সড় হয়ে বসেছিল এক কোনায়। স্নেহার এক মাসিমা পিয়ানো বাজিয়ে পূজাপর্বের একটি গান গাইছিলেন। গুন্ডা বারে বারে হাই আটকাতে আটকাতে বলছিল, ‘এরা সিন্নি খাইয়েই বাড়ি পাঠিয়ে দেবে না তো রে?’

রিধিমা মোবাইলে টেক্সট করে যাচ্ছিল অবিরাম। রূপ ঘনঘন সিগারেটের প্যাকেটে হাত দিচ্ছিল। আর দিঘি বেজার মুখে তাকিয়েছিল সামনে।

ঠিক তখনই পিছন থেকে একটা গলা ফিসফিস করে দিঘির কানের কাছে বলেছিল, ‘রবীন্দ্রনাথ নিজে শুনলেও হাই তুলতেন। এরাই রবীন্দ্রসংগীতের বারোটা বাজাচ্ছে।’

দিঘি চট করে পিছনে তাকাতেই তামাকের হালকা কিন্তু মিষ্টি গন্ধ পেয়েছিল একটা। আর দেখেছিল মাখনের থেকে ছুরি দিয়ে কেটে বের করা একটা মুখ।

দিঘি ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল। কে এমন গায়ের ওপর এসে পড়ছে?

ছেলেটা ফিসফিস করে বলেছিল, ‘হাই, দিস ইজ আর্য। ওয়ান্ট আ রিয়েল পার্টি? জাস্ট ফলো মি। ছাদে আমরা নিজস্ব অনুষ্ঠান করছি।’

দিঘিরা লঘু পায়ে ফলো করেছিল আর্যকে।

কিন্তু সেই সন্ধের পর আর্য ফলো করতে শুরু করে দিঘিকে।

আর্য গুন্ডাকে ঠেলে বসে পড়ল বেঞ্চে। তারপর বাঁ হাতটা দিয়ে দিঘির কাঁধ জড়িয়ে বলল, ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড সোনা?’

দিঘি কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাতটা সরিয়ে দিল, বলল, ‘নট ইন দ্য মুড।’

‘কেন? আজ তো দারুণ দিন। দ্যাট বাস্টার্ড ইজ গোয়িং আউট।’ আর্য হাসিমুখে বলল, ‘ইউ শুড বি হ্যাপি।’

রূপ বলল, ‘না আর্য, ব্যাপারটা তা নয়। আসলে দিঘির হয়তো সব হিউমিলিয়েশনগুলো মনে পড়ছে। মানে, ওর সঙ্গে যা হয়েছে…’

‘চুপ কর না তোরা।’ দিঘি বিরক্ত গলায় বলল, ‘একটা বিষয় পেলে তোরা এত ড্র্যাগ করিস না!’

‘তা হলে অমন পেঁপেসেদ্ধর মতো মুখ করে বসে আছিস কেন তুই?’ গুন্ডা ফোঁস করে উঠল, ‘তুই মাঝে মাঝে এমন ক্যালানের মতো বিহেভ করিস না!’

দিঘি দু’হাত দিয়ে মুখটা ঘষল। ক্লান্ত লাগছে খুব। ঘুম পাচ্ছে। গতকাল সারারাত ঘুমোতে পারেনি। কেবল সেইসব কথা মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল সে চলে যাবে। পড়াশোনার বইপত্তর খুলেও এক লাইন পড়তে পারেনি দিঘি। ওর জলে ডুবে থাকার মতো কষ্ট হচ্ছিল। শ্বাস নিতে পারছিল না যেন। ঘাড়ে মুখে জল দিচ্ছিল। তবু পারছিল না মনঃসংযোগ করতে। তারপর একসময় বইপত্তর গুটিয়ে রেখেছিল। বুঝেছিল ওর শত চিন্তাতেও যা হওয়ার তা পালটাবে না, তা হবেই।

যা হওয়ার তা চিরকালই হয়, দিঘি জানে। কেউ কিচ্ছু করতে পারে না। শুধু মাঝখান থেকে কষ্ট আর টেনশন করে মানুষ। মনখারাপ করে। ভয় পায়। দিঘি নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করছিল খুব। তবে পারছিল না। শুধু মনে পড়ছিল দেওয়ালে ঝোলানো গিটারটার কথা। মনে পড়ছিল মাস্কের গন্ধ। দুটো নীল চোখ!

‘কী রে কিছু বলছিস না কেন?’ আর্যকে টপকে গুন্ডা খোঁচা মারল দিঘিকে।

‘কী বলব?’

‘একটা পার্টি দে না। এমন মহান দিনে শালা জলের ধারে বসে অমন দুঃখকষ্টের মুখ করছিস কেন রে?’

‘ইয়েস, লেট্স হ্যাভ সাম ফান।’ আর্য উৎসাহিত হল, ‘অন্তত প্যারামাউন্টে চলো, সবাই একটা করে লেমন ড্রিঙ্ক মেরে আসি।’

দিঘি বলল, ‘তোমরা যাও, আমার ভাল লাগছে না।’

‘ডোন্ট বি আ স্পয়েল স্পোর্ট। চল না।’ রূপ খোঁচা মারল এবার। বলল, ‘রিধিমা আর স্নেহারাও তো অন দ্য ওয়ে। ওদের বলে দিই, ওরাও চলে আসবে। তুই ফালতু ঝামেলা করিস না।’

দিঘি কিছু বলতে গিয়েও পারল না। সাইড ব্যাগ থেকে ট্যাঁ ট্যাঁ করছে মোবাইলটা। ও ফোনটা বের করল। আরে শমীদা!

‘হ্যাঁ শমীদা, বলো।’ দিঘি কানে লাগাল ফোনটা।

‘কী রে তুই কোথায়?’

‘এই কলেজের কাছে। কলেজ স্কোয়ারে বসে আছি। কেন?’

‘না, মানে… তুই…’ শমীদা ইতস্তত করল, ‘তুই ঠিক আছিস তো?’

‘হ্যাঁ, কেন?’ দিঘি বিরক্ত হল।

শমীদা সামান্য তোতলা। দিঘির বিরক্তি বুঝতে পেরে আরও কথা আটকে গেল। বলল, ‘না-ন্-না, তু-তুই র-র-রাগ…’

‘করছি না।’ দিঘি ব্যাপারটা সহজ করার চেষ্টা করল।

শমীদা শব্দ করে হাসল। বলা যায় হাসার চেষ্টা করল। বোঝাতে চাইল যে, একটুও ঘাবড়ায়নি। মানুষটার এই লো-কনফিডেন্সপনার জন্যই দিদিকে ধরে রাখতে পারল না। সবসময় যেন ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। যেন ইউনেসকো থেকে সবাইকে খুশি করার কনট্র্যাক্ট শমীকে দেওয়া হয়েছে। অমন ম্যাদামারা হয়ে থাকলে কেউ পাত্তা দেয়? অবশ্য শমী হয়তো তেমন পাত্তা পেতেও চায় না। শুধু পাত্তা দিতে চায়। সবাইকে মাথায় তুলে রাখতে চায়। এই এখন যেমন দিঘিকে চাইছে।

দিঘি বলল, ‘তা হঠাৎ ফোন করলে?’

‘তোর মনে আছে তো?’

‘হ্যাঁ আছে। আটটা নাগাদ পৌঁছে যাচ্ছি।’

‘ইয়ে… মানে… ঠিকঠাক আসছিস তো?’ শমীর গলায় অনিশ্চয়তা।

‘মানে? দিদির কথা বলছ কি?’ দিঘি জানতে চাইল, ‘তুমি একটা কথা কতবার বলবে শুনি? দিদিকে তো নিয়েই যাব।’

‘আসলে মহুল তো, তাই বলছিলাম সব ঠিকঠাক আছে তো? মানে ওর যা মাথা গরম!’

‘এত পাত্তা দাও কেন বলো তো?’ দিঘির বিরক্ত লাগল।

‘কেন দিই?’ বলল শমী, ‘সত্যি এটা ভেবে দেখিনি তো।’

‘ঠিক আছে এখন রাখছি। ঠিক পৌঁছে যাব।’

ফোনটা কেটে খাপে ঢুকিয়ে রাখল দিঘি। সত্যিই মাঝে মাঝে শমীকে খুব করে বকুনি দিতে ইচ্ছে করে ওর। কেন এমন হয়ে থাকে মানুষটা?

মহুলের সঙ্গে শমীর যখন বিয়ে হয় তখন ক্লাস এইটে পড়ে দিঘি। সম্বন্ধ করেই বিয়ে। বিয়ের আগে মাত্র দু’বার শমীকে দেখেছিল ওরা। বেঁটে, ফরসা মানুষ। মুখটা আমুদে। সবসময় একটা হালকা হাসি যেন লেগেই থাকত মুখে। আর মহুল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। হাতে মাথা কাটে টাইপ। নিজেই তখন ব্যাবসা শুরু করেছিল মহুল। ইন্টিরিয়র ডিজাইনিং-এর ব্যাবসা। মনপ্রাণ দিয়ে ব্যাবসা জমানোর চেষ্টা করত মহুল। প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা এসবের দিকে মোটেই মন ছিল না ওর। তাই বাবা যখন বিয়ের কথা তুলেছিল মহুল দু’দিন সময় চেয়ে ‘হ্যাঁ’ করে দিয়েছিল।

দিঘির আপত্তি ছিল বেশ। কত বয়স তখন মহুলের? বড়জোর পঁচিশ। এই বয়সে এখন কেউ বিয়ে করে? মহুলকে আপত্তির কথা বলেওছিল দিঘি। বলেছিল, ‘কী রে দিদি, তুই এখনই বিয়ে করবি? পাগল হয়ে গেছিস?’

‘কেন? পাগল হওয়ার কথা বলছিস কেন?’

‘বা রে, কেউ এমন হুট বলতে বিয়ে করে নাকি? তাও অ্যারেঞ্জড! ইয়াক্।’

‘বাজে কথা বলিস না। হি হ্যাজ আ গুড প্রসপেক্ট।’

‘মানে? গুড প্রসপেক্ট মানে?’ দিঘির অবাক লেগেছিল। কী বলছে মহুল?

‘মানে?’ মহুল খাটে গুছিয়ে বসেছিল। একটা হালকা চাদর গায়ে পেঁচিয়ে নিয়ে বলেছিল, ‘শোন দিঘি, আমায় বিজনেসের জন্য এটা করতে হবে। আগেকার দিনের রাজ-রাজড়াদের মতো। শমীন্দ্রদের বিশাল বড় কাঠের ব্যাবসা! ওদের ফার্নিচারের ব্র্যান্ড সারা দেশে এত পপুলার, সেখানে বিয়ে হলে আমার ইন্টিরিয়র ডিজাইনিং-এর ব্যাবসাটার কত লাভ হবে বল তো! বিয়েটা আমার কাছে স্ট্র্যাটেজিক অ্যালায়েন্স। নাথিং মোর দ্যান দ্যাট।’

‘ব্যস, শুধু তাই?’ দিঘির অবাক লেগেছিল খুব, ‘তোর শমীদাকে পছন্দ হয়নি? এমনি এমনি বিয়ে করছিস?’

মহুল হেসেছিল খুব। বলেছিল, ‘তোদের এই টিন এজটা ভীষণ ডেঞ্জারাস। আননেসেসারি গ্লোরিফাই করাটা এই বয়সের স্বভাব। আরে বাবা জীবন হল হার্ড রিয়্যালিটির জায়গা। সারভাইভাল অত সোজা কিছু নয়। তা ছাড়া যেদিন শমীন্দ্ররা আমায় দেখতে এসেছিল, তুই বুঝিসনি যে, ছেলেটা একটু ল্যাবাকান্ত টাইপ। একে পকেটে পোরা খুব সোজা।’

‘দিদি তুই একটা যাচ্ছেতাই। আর সে কথাই যদি বলিস তা হলে এটাও জেনে রাখিস যে, শমীদারা তিন ভাই-ই ব্যাবসার পার্টনার। তা ছাড়া শমীদার মাথার ওপর ওর বাবা আছে। তুই যা চাইছিস তা সফল নাও হতে পারে।’

‘আরে দেখ না মজাটা। বাবা চিরকাল চাকরি করে গেল। হোক না বড় চাকরি, কিন্তু চাকরি তো। অন্যের কাছে নিজের সময় আর ইচ্ছে গচ্ছিত রাখা। একটা তিন লাখের গাড়ি। সেকেন্ড হ্যান্ড পুরনো দিনের ফ্ল্যাট। এর বেশি কিছু করতে পেরেছে বাবা? ব্যাবসাই হচ্ছে আসল জিনিস। বাঙালিদের সেই এজ ওল্ড ছুঁতমার্গের আর কোনও জায়গা নেই। অমন টিপে টিপে জীবন কাটাতে ইচ্ছে করে না দিঘি। তাই তো এক বছর চাকরি করে নিজে ব্যাবসা শুরু করলাম। এখনও অনেক কিছু অ্যাচিভ করতে হবে জীবনে। অনেক কিছু। আগে বিয়েটা হতে দে, তারপর দেখ তামাশা।’

সত্যি তামাশাই দেখেছে ওরা। মহুল পুতুলনাচ থেকে সার্কাস সব দেখিয়ে ছেড়েছে সবাইকে। আর দিঘিরা সবাই ট্রাপিজের খেলা দেখার মতো করে তাকিয়ে থেকেছে অবাক হয়ে। কখনও নিজে রাগ করে মহুল চলে এসেছে বাপের বাড়ি। কখনও শমীর মা ফোন করে নালিশ করেছে যে, মহুল বাথরুমে ঢুকে নিজেকে বন্ধ করে নিয়েছে। কখনও আবার মাঝরাতে গাড়ি নিয়ে ক্ষতবিক্ষত শমী এসে বলেছে, মহুল খিমচে এই দশা করেছে ওর।

দিঘিরা প্রথম প্রথম বুঝত না কেন এই অশান্তি হচ্ছে। মা জিজ্ঞেস করত মহুলকে, কিন্তু উত্তর পেত না। বাবা জিজ্ঞেস করত, কিন্তু উত্তর পেত না। এমনকী শমীও বলত না কিছু।

শমীদের অফিস ছিল ক্যামাক স্ট্রিটে। একদিন বাবা সেখানে আলাদাভাবে গিয়ে দেখা করে শমীর সঙ্গে। রাতে যখন মাকে বাবা সেই সাক্ষাতের কথা বলছিল, দিঘি পাশের ঘর থেকে, একরকম আড়ি পেতেই শুনেছিল বাবা-মায়ের কথা।

মা অবাক হয়ে বলেছিল, ‘এই জন্য? শুধুমাত্র এই জন্য মহুল অশান্তি করছে?’

‘হ্যাঁ,’ বাবাকে দেখতে না পেলেও, দিঘি বুঝতে পেরেছিল যে, বাবা মাথা নিচু করে বসে রয়েছে। বাবা বলেছিল, ‘গন্ডগোলটা মহুল নিজেই করছে। শ্বশুরমশাইকে বলছে ওর কোম্পানিতে ইনভেস্ট করতে আর ওর ব্র্যান্ডটাকে নিজেদের সিস্টার কনসার্ন হিসেবে তুলে ধরতে। শমীর অন্য ভাইরা এতে আপত্তি করায়, শ্বশুরমশাই মত দিচ্ছেন না। ব্যস, রেগে লাল হয়ে গেছে তোমার মেয়ে! তাণ্ডব শুরু করেছে! শমীকে তো প্রায়ই মারধর করে মহুল। শেষ পর্যন্ত যে কী হবে!’

মা কাঁদছিল। এ ঘরে বসে বিরক্তি আর লজ্জা একসঙ্গে অনুভব করছিল দিঘি। মহুল ওর চেয়ে প্রায় এগারো বছরের বড়, কিন্তু চিরকাল এমন ছেলেমানুষি করে গিয়েছে। দিঘি আর মহুলের ভেতর কে যে বয়সে বড় বোঝা দায়!

সাড়ে ছ’টা বাজে। প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। এবার উঠতে হবে। আর্যরও শমীর কাছে নেমন্তন্ন আছে। কলেজ স্কোয়ার থেকে এখন গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউতে যেতে হবে। সেখানে বছরখানেক হল নতুন একটা দু’কামরার ফ্ল্যাট নিয়েছে মহুল। সেখান থেকে ওকে পিক-আপ করে নিয়ে তারপর পার্ক স্ট্রিট যাবে। সেখানকার বড় চৌমাথার মিউজিক স্টোর্সের সামনে ওদের জন্য অপেক্ষা করবে শমী। শমী ওদের রেস্তোরাঁয় খাওয়াবে। কারণ শমীদের দক্ষিণ কলকাতার ওই পেল্লায় বাড়িটায় মহুল আর যাবে না কোনওদিন। ওই বাড়ির লোকদের মুখোমুখি আর দাঁড়াবে না।

অবশ্য শমীর সামনেও যেতে চায় না মহুল। বলে, ‘ওই লাউগাছটার সামনে যেতে আমার ঘেন্না করে।’

শমী ব্যাপারটা ভালই জানে তাই গত পরশু নিজে মহুলকে ফোন না করে, ফোন করেছিল দিঘিকে। তখন কফি হাউজ থেকে বেরিয়ে মেট্রোর দিকে যাচ্ছিল দিঘি। রবীন্দ্রসদনে আর্যর সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। ফোনটা পেয়ে সামান্য বিরক্ত হয়েছিল ও। শমীকে মোটামুটি পছন্দই করে দিঘি। কিন্তু শমীর ওরকম দুর্বল পার্সোন্যালিটিটা ঠিক মানতে পারে না। লোকটার ভেতরে কেমন যেন একটা হাহাকার ঘুরে বেড়ায় সবসময়। মনে হয় যেন কোনও গভীর গর্তে পড়ে আছে মানুষটা। কেউ উদ্ধার করার নেই।

দিঘিরও শমীকে ছোটখাটো বিষয়ে উদ্ধার করতে ইচ্ছে করে না। বিশেষ করে যদি তা মহুল সংক্রান্ত হয়। এমন ন্যাদ্যাবোদা ছেলে দেখলে পিত্তি জ্বলে যায় দিঘির।

তবু ফোনটা ধরেছিল, ‘হ্যাঁ, বলো শমীদা।’ গলার বিরক্তিটা বিন্দুমাত্র লুকোতে চায়নি ও।

‘তুই রাস্তায় আছিস দিঘি?’

আচ্ছা আহাম্মক! কলেজের দিনে বিকেলবেলায় আর কোথায় থাকবে ও? দিঘি বলেছিল, ‘হ্যাঁ, এবার মেট্রো ধরব। তাড়াতাড়ি বলবে একটু, কী দরকার।’

‘ও ব্যস্ত আছিস?’ শমীর গলায় দ্বিধা বুঝতে পেরেছিল দিঘি।

ও বলেছিল, ‘তাতে প্রবলেম নেই। শর্টে বলে নাও কী বলবে।’

‘বলব?’ শমী ইতস্তত করছিল তাও।

‘শমীদা প্লিজ, মেক ইট ফাস্ট।’

শমী গলা পরিষ্কার করে বলেছিল, ‘একটা হেল্‌প দরকার ছিল। আর্জেন্ট হেল্‌প।’

‘কী হেল্‌প?’

‘পরশু আমার বার্থডে দিঘি।’

‘তাই?’ দিঘি কী বলবে বুঝতে পারছিল না।

‘হ্যাঁ। থার্টিন্থ আগস্ট। সেদিন আমি তোকে, আর্য আর তোর দিদিকে একটা ছোট ট্রিট দিতে চাই।’

‘তাই? কিন্তু কেন আবার এত ঝামেলা করছ শমীদা? এসব বাদ দাও না। তা ছাড়া আর্য ফ্রি আছে কিনা, বা দিদি ফ্রি আছে কিনা জানি না।’

‘আর্য ফ্রি আছে। তোকে ফোন করার আগে ওকে ফোন করেছি আমি। তুই জাস্ট মহুলকে রাজি করিয়ে নিয়ে আসবি। আটটার সময় পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে বড় মিউজিক স্টোরটার সামনে।’

‘আমি? কেন?’ দিঘির আশ্চর্য লেগেছিল।

‘আরে মহুল কিছুতেই আমার কল রিসিভ করছে না। আমি কুড়িবার ফোন করেছি। প্রতিবার কেটে দিয়েছে। তারপর এসএমএস করে কীসব গালিগালাজ লিখে পাঠিয়েছে দেখ না। প্লিজ দিঘি, তোর দিদিকে একবার নিয়ে আয়। আরে, মাই লাইফ ডিপেন্ডস অন ইট। মহুলকে আমি কি ছাড়তে পারি?’

‘দেখো শমীদা, আমি দিদিকে কী বলব? আর দিদিই বা শুনবে কেন? তুমি জানো না দিদির কেমন জেদ?’

‘প্লিজ দিঘি। মহুল একমাত্র তোর কথাকেই যা একটু গুরুত্ব দেয়। তুই প্লিজ না করিস না।’

শমীর গলাটা শুনে দিঘির মনে হয়েছিল যে-কোনও সময়ে কেঁদে ফেলবে মানুষটা।

‘আরে ঠিক আছে। ডোন্ট বি সো সেন্টি। তুমি এমন কেন গো শমীদা? নিজের বউকে এত ভয় পাও কেন?’

‘আর বউ!’ শমী দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল।

‘আরে তোমার সঙ্গে না থাকলেও ডিভোর্স যখন হয়নি, তখন বউ-ই। কেন তুমি অনর্থক ভয় পেয়ে এমন করছ?’ দিঘি মেট্রো স্টেশনের সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলেছিল কথাগুলো।

‘না দিঘি, অনর্থক নয়… তুই… তুই প্লিজ মহুলকে…’ শমীর গলাটা ভিজে ভিজে শোনাচ্ছিল।

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে শমীদা। আমি দিদিকে নিয়ে পৌঁছে যাব। ডোন্ট ওরি। টেক কেয়ার, বাই।’

প্রাথমিক বিরক্তিটা চলে গিয়ে দিঘির বেশ খারাপ লাগছিল শমীর জন্য। শমী হয়তো দুর্বল মানুষ। কিন্তু দুর্বল মানুষরা ভালবাসতে পারবে না এমন তো কোনও আইন এখনও নেই। মহুল যে কেন প্রেমকে গুরুত্ব দেয় না!

এখন মহুলের ইন্টিরিয়র ডিজাইনিং ব্যাবসা মোটামুটি ভালই চলছে। শমীর বাড়ি থেকে তো চলেই এসেছিল আগে। আর গত বছর বাবা-মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউতে নতুন একটা ফ্ল্যাটে উঠে গেছে মহুল। বাবার শত অনুরোধেও চিঁড়ে ভেজেনি। মহুল ফিরে আসেনি। এবার মহুলের ইচ্ছে একটা ছোট গাড়ি কিনবে।

মহুলকে মানুষ হিসেবে যতই ডেসপারেট, অ্যারোগ্যান্ট আর সেলফিশ লাগুক না কেন, দিঘির মনে হয় ভেতরের মেয়েটা কিন্তু খুব ভাল। তবে সেই ভাল, নরম মেয়েটার নাগাল পাওয়া যে সহজ নয় তাও জানে দিঘি। সেই নরম মেয়েটার নাগাল কীভাবে পাবে, কীভাবে মহুলকে রাজি করাবে শমীদার নেমন্তন্নে নিয়ে যেতে তাই ভাবছিল দিঘি। ভাবছিল কথাটা কীভাবে বলবে মহুলের সামনে।

রাতে, খাওয়া দাওয়া সেরে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বসতে যাবে, এমন সময় ফোনটা বেজেছিল দিঘির। নামটা দেখে সামান্য চমকে গিয়েছিল ও। মহুল! আরে, দিদিকেই তো ফোন করবে ভাবছিল।

‘বল, দিদি,’ ফোনটা ধরে খাটে গুছিয়ে বসেছিল দিঘি।

‘দিঘি, কেমন আছিস তুই?’

‘ভাল আছি। শোন না, আমি তোকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম।’

‘আমায়?’ মহুল হেসেছিল। দিঘি বুঝতে পারছিল যে, মহুলের মেজাজ ভাল আছে।

‘হ্যাঁ, তবে আগে তুই বল কেন ফোন করেছিস।’

মহুল খুশির গলায় বলেছিল, ‘শোন না, তোকে কাল আমার সঙ্গে একটা জায়গায় যেতে হবে। কনভ বলেছিল যাবে, কিন্তু আমি রাজি হইনি। দিঘি, তুই যাবি আমার সঙ্গে। কেমন?’

কনভ, মানে কনভ রাঠোর। মহুলের নতুন প্রেমিক। বা বলা যায় প্রেমের লাইনে ইট পেতে অপেক্ষা করা এক প্রত্যাশী। মহুল ছেলেটা সম্বন্ধে তেমন সিরিয়াস নয়। বলে, ‘ছাব্বিশ বছর বয়স, কী রে অত প্রেম? আমার চেয়ে কম সে কম তিন বছরের ছোট। তারপর ওকে দিয়ে আমার ব্যাবসারও কোনও লাভ হবে না।’ তবে কনভ ছেড়ে দেয় না। লেগে থাকে মহুলের সঙ্গে।

কনভ রাঠোর, বিশাল বড়লোকের ছেলে। ওদের গ্রুপ অব কোম্পানিজ আছে। তারই একটা, রাঠোর পার্টিকল অ্যান্ড হার্ড বোর্ড মিল্‌স লিমিটেডের ডিরেক্টর এই কনভ। যেমন লম্বা তেমন টকটকে গায়ের রং কনভের। দেখলে মনে হয় হিন্দি ছবির নায়ক। থুতনির কাছে একটা কাটা দাগ মুখটার অন্য একটা অ্যাপিল তৈরি করেছে। দিঘির বান্ধবী রূপ তাই বলেছিল একটা গেট টুগেদারে কনভকে দেখে। বলেছিল, ‘এ যে একদম চন্দ্রচূড় সিংহ রে।’

আসলে কনভ পাশের ব্যানার্জি বাড়িতে খুব আসত একসময়। আদিত্যদার সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল। সেসময়ই ওর আলাপ হয়েছিল মহুল আর দীঘলের সঙ্গে। তবে কনভ আর বেশি দিন দেশে থাকবে না। ওদের ব্যাবসা দেখাশোনার জন্য ওকে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যেতে হবে। তবু চলে যাওয়ার আগে ও মহুলকে নিজের দিকে টানতে চেষ্টা করে।

‘এই দিঘি, কী হল, কী ভাবছিস?’ মহুল খুঁচিয়েছিল, ‘উত্তর দিলি না তো! কাল যাবি তো আমার সঙ্গে?’

‘কোথায় যাব?’ দিঘি অবাক হয়েছিল।

‘কাল গাড়ি দেখতে বেরোব। কয়েকটা শোরুমে ঘুরতে হবে। আমি আর তুই যাব। বিকেল তিনটে নাগাদ আমার অফিসে আসবি। কেমন?’

দিঘি হেসেছিল, ‘তা হলে গাড়ি কিনবিই ঠিক করলি?’

‘হ্যাঁ, আর সেটা পছন্দ করতে তুই যাবি আমার সঙ্গে।’

‘দিদি, আমি যাব। কিন্তু আমার একটা কথা তোকে শুনতে হবে তার আগে।’

‘শিয়োর, কী কথা?’ খুশির গলায় জানতে চেয়েছিল মহুল।

‘পরশু তোকে আমার সঙ্গে এক জায়গায় যেতে হবে। রাজি তো?’

‘পরশু? কোথায়?’ এবার একটু আশ্চর্য হয়েছিল মহুল।

‘শমীদার জন্মদিন, তোকে নেমন্তন্ন করেছে। আমাকেও। তোকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।’ এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে দিয়েছিল দিঘি।

‘মানে?’ ফোনের ওপ্রান্ত থেকে ছিটকে এসেছিল মহুলের গলা, ‘কী বললি? শমীর জন্মদিনে আমায় যেতে হবে?’

‘হ্যাঁ, নেমন্তন্ন করেছে যখন, যেতে তো হবেই।’

‘তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ওই জানোয়ারটার জন্মদিনে আমি যাব? আর চল্লিশের বুড়ো ভাম! তার আবার জন্মদিন কী রে?’

‘আঃ, শোন না,’ দিঘি কিছুতেই থামাতে পারছিল না মহুলকে, ‘আরে তুই তো ফোন তুলছিস না। আসলে ওদের বিজনেস হাউসের হয়ে তোর কাছে একটা প্রপোজাল রাখতে চায় ও।’

‘প্রপোজাল?’ আচমকা নরম হয়ে গিয়েছিল মহুলের গলা।

দিঘি বুঝেছিল যে, ওষুধ ধরেছে। মহুল আর শমীর যত গন্ডগোল তো এই বিজনেস নিয়েই। দিঘি তো জানে মহুল বিজনেসের জন্য সব করতে পারে। তাই ঝুঁকি নিয়ে মিথ্যে কথাটা বলেই দিয়েছিল। ভেবেছিল আগে তো মহুল যেতে রাজি হোক। তারপর না হয় শমীকে ব্যাপারটা বলে একটা উপায় বের করা যাবে।

‘তা, কী প্রপোজাল শুনি?’ মহুল সন্দেহের গলায় বলেছিল।

‘সে কি আর আমায় বলেছে? আমরা গেলে খেতে খেতে বলবে। আসলে পার্ক স্ট্রিটে খাওয়াবে তো!’

‘পার্ক স্ট্রিটে! বাড়িতে নয়! ও…’ মহুলের স্বস্তির শ্বাসটা স্পষ্ট বুঝেছিল দিঘি। আর এও বুঝেছিল যে, মহুল আর খুব একটা অরাজি নয়।

মহুল আবার বলেছিল, ‘তা হঠাৎ দু’বছর পর টনক নড়ল বাবুর?’

‘তুই বড্ড বেশি খুঁতখুঁত করিস। আমার মনে হল তোর কাজের ক্ষেত্রে উন্নতি হবে তাই বললাম। এখন বাকিটা তোর ওপর। বল, কী বলব শমীদাকে? যাবি তো?’

ফোনের ওপারে নিস্তব্ধতায় ডুবে গিয়েছিল মহুলের গলা। তারপর একসময় জলের গভীর থেকে বুদবুদ ওঠার শব্দে আলতো করে মহুল বলেছিল, ‘হ্যাঁ, যাব।’

ফোনটা রেখে বিছানায় ঠোঁট কামড়ে বসেছিল দিঘি। মহুলকে রাজি করাতে এ কী করে ফেলল ও? যখন জানে যে, মহুল আর শমীদার ভেতরের গন্ডগোলের মূল কারণ মহুলের ব্যাবসার প্রতি আগ্রহ, তখন কেন ও এমন একটা কাণ্ড করল?

দিঘির মাঝে মাঝে নিজের ওপর রাগ হয়। হঠাৎ হঠাৎ ও এমন এক-একটা কথা বলে ফেলে যার খেসারত দিতে গিয়ে নিজেই ঝঞ্ঝাটে জড়িয়ে পড়ে।

সেই রাতে আবার নিজের চারদিকে জালটা দেখতে পেয়েছিল দিঘি। অনিচ্ছাকৃতভাবে ও আবার একটা নতুন ঝঞ্ঝাটে জড়িয়ে গেল না তো? আর আচমকা, একদম আচমকাই, কোনও কারণ ছাড়াই দিঘির চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল একটা হলুদ গিটার, একটা ছাদের ঘর আর এক জোড়া নীল রঙের চোখ।

‘কী হল, প্যারামাউন্টে যাবে?’ আর্য কনুই দিয়ে আলতো ধাক্কা মারল দিঘিকে।

‘না, যাব না,’ বিরক্ত লাগল দিঘির। এমনিতেই মন ভাল নেই তার ওপর এরা এমন শুরু করেছে যে, বিরক্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে আরও। ও বলল, ‘তোমার মনে নেই শমীদার ওখানে নেমন্তন্ন আছে?’

‘নেমন্তন্ন!’ আর্যর কাছে যাওয়ার আগেই খপ করে কথাটাকে ধরল গুন্ডা, ‘আমায় বলিসনি তো? কোথায় নেমন্তন্ন? কার কাছে?’

‘তাতে তোর দরকার কী?’ রূপ আর একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল।

‘সেটা তোকে বলব কেন রে? শালা খাস তো ধোঁয়া, সলিড ফুডের মর্ম তুই কী বুঝবি?’ গুন্ডা উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল, ‘শালা ডাল, আলুসেদ্ধ আর পাঁপড়ভাজা খেয়ে খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গেল। ড্রেজার নামিয়ে পেট পরিষ্কার করাতে হবে!’

‘বড্ড হ্যাংলা তুই। আর্য আর দিঘির কোথায় নেমন্তন্ন তা জেনে তুই কী করবি? ম্যানার্স, এটিকেট বলেও একটা ব্যাপার আছে গুন্ডা, বুঝেছিস?’

‘ম্যানার্স?’ গুন্ডা ওর মেদবহুল শরীর কাঁপিয়ে হাসল, ‘ওসব ম্যানার্স মারাস না। তোদের তো শালা খিদেই পায় না। বুঝিস খিদে পেলে কেমন লাগে? আমার ফ্যামিলিতে ন’জন থাকে। মাস্টারবেট করার পর্যন্ত প্রাইভেসি পাই না। বাবার চটকল বন্ধ। দাদার কেরানিগিরি আর ঘুষের টাকায় বেঁচে থাকি। দুটো অবিবাহিত পিসি আছে যারা সারাদিন মায়ের পিছনে পড়ে থাকে। ভাইটা সারাদিন গিটার নিয়ে টিং টাং করে মাথা খায়। বউদি রাতে চারটের বেশি রুটি দেয় না আমায়। কী করে যে বেঁচে আছি আমি জানি। যাদবপুরের কলোনি থেকে ওই পশ কলেজে আসতে আসতে জানিস নিজেকে কতটা মেরে ফেলতে হয়? তোর সারা মাসের যা সিগারেটের খরচ না, সেটা দু’বাড়ি টিউশন করে আমায় তুলতে হয়।’

দিঘি দেখল উত্তেজনায় গুন্ডার সারা শরীরে জলের মতো ঢেউ খেলছে। দরদর করে ঘামছে ছেলেটা। দেখে মায়া হল দিঘির। সত্যি গুন্ডাদের অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। না, ও নিজে গুন্ডাদের বাড়িতে যায়নি। কিন্তু স্নেহা গেছে। ওই বলেছে। তবে পড়াশোনায় গুন্ডা খুব ভাল। আর টিউশনিও করে চুটিয়ে। গুন্ডার কথায়, ‘আরে, ও ছাত্র পড়ানো, শিক্ষা দান, ঢপের কনসেপ্ট। আমি জাস্ট খাওয়া-পরার কাজ করি। ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে মাসের শেষে মাইনে আর সন্ধেবেলার টিফিনটা হয়ে যায়।’

রূপ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে মাটিতে ফেলে জুতো দিয়ে পিষে দিল আগুনটাকে, তারপর গুন্ডার হাত ধরে ওকে বসাল। ঠান্ডা, নরম গলায় বলল, ‘বাবা রে বাবা, এত সেন্টু খেয়ে যাস কেন তুই? বড্ড অভিমান তোর। মাথাটা ঠান্ডা কর। যা ড্রামা শুরু করেছিলি না, আ পারফেক্ট টিয়ার জার্কার।’

গুন্ডা রূপকে পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘কোথায় রে তোর নেমন্তন্ন দিঘি?’

‘শমীদার কাছে, আজ ওর জন্মদিন।’

‘জন্মদিন! এই বয়সে! শিং ভেঙে বাছুর?’ গুন্ডা আবার উঠে দাঁড়াল, ‘তবে ভাল। সেই জন্যই না খ্যাঁটের বন্দোবস্ত করেছে। শালা, শমীদাটা কিন্তু মাইরি ব্যাপক কিপটে, আর্য আর তোকে খেতে বলল আর আমি বাদ? তা ছাড়া বছরে মাইরি মোটে একটা জন্মদিন ওর। যাক গে, আমি যাব। শমীদাকে ফোন করে বলে দে।’

গুন্ডা শেষ কথাগুলো এমন করে বলল যেন সরকার থেকে সার্কুলার দেওয়া হয়েছে যে, গুন্ডাকে বাদ দিয়ে কোনও নেমন্তন্ন বা অনুষ্ঠান হবে না।

দিঘি চোয়াল শক্ত করল। গুন্ডাটা যদি যায় তা হলে শমীদা একটু অস্বস্তিতে পড়বে। নেমন্তন্ন যে নিছকই বাহানা সেটা তো দিঘি ভাল করেই জানে। হঠাৎ কেন এই নেমন্তন্ন, কেন এই খাওয়ানোর ইচ্ছে, তা শমীদা নিজেই বলেছিল, সে রাত্রেই।

মহুলের ফোনটা ছেড়ে চুপ করে বিছানায় বসেছিল দিঘি। এমনিতেই গত দু’সপ্তাহ ওর মনমেজাজ ভাল নেই। তার ওপর আবার মহুল-শমীর ঝঞ্ঝাটে নিজের বোকামোর জন্যই ঢুকে যাওয়া-সব নিয়েই খুব বিরক্ত ছিল দিঘি। ও ঠিক করেছিল সেই রাতেই শমীদাকে ফোন করে মহুলকে ও কী বলেছে তা বলে দেবে।

একবার রিং হতেই ফোনটা ধরেছিল শমী, ‘এই তোর ফোনের জন্যই এতক্ষণ বসেছিলাম। তা কী খবর? মহুল কী বলল?’

দিঘি বলেছিল, ‘বলেছে আসবে। তবে…’

‘আসবে?’ শমী আনন্দ আর উত্তেজনায় এমন চিৎকার করেছিল যে, ফোনটাকে কান থেকে সরিয়ে নিয়েছিল দিঘি।

শমী বলেছিল, ‘তা মহুল রাজি হয়ে গেল? তুই কী এমন বললি ওকে?’

‘সেটা বলতেই ফোন করেছি।’ দিঘি সংক্ষেপে ঘটনাটা বলেছিল শমীকে।

আঁতকে উঠেছিল শমী, ‘অ্যাঁ, করেছিস কী? এমন বললি কেন?’

‘তো কী বলব? বলব যে, জন্মদিনে শমীদা বউকে সোহাগ করবে বলে ডাকছে।’ মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল দিঘির। আচ্ছা লোক, নিজের কিছু করার মুরোদ নেই, অথচ হাতে লাল পেন নিয়ে অন্যের কাজকর্ম কারেকশন করবে বলে বসে আছে।

‘এখন আমি কী করব?’ অসহায় শুনিয়েছিল শমীর গলা, ‘বাড়িতে যদি জানতে পারে? যদি মহুল এ ব্যাপার নিয়ে হুট করে দাদাকে ফোন করে? একদম সর্বনাশ হয়ে যাবে আমার।’

দিঘি জানে, বাড়ির ছোট ছেলে হিসেবে শমীর আদর যেমন সবার ওপরে, তেমনই ব্যাবসাপত্তরের ক্ষেত্রে ওর গুরুত্ব সবার নীচে। লো-কনফিডেন্স, সামান্য তোতলা মানুষটা বাড়িতেও কেমন যেন একটু গুটিয়ে থাকে সবসময়।

দিঘি বলেছিল, ‘শোনো শমীদা, অত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। দিদিকে এ ছাড়া নিয়ে যাওয়ার আর কোনও উপায় ছিল না। তুমি যেমন তেমন একটা ঢপ মেরে দিয়ো না। অত ঘাবড়াচ্ছ কেন? আর তোমার মুখ থেকে ব্যাবসাপত্তরের কথাবার্তা না শুনে দিদি কাউকে ফোন করবে না। ফলে ভয় পেয়ো না একদম। আর শোনো, তোমার গ্যাঁট ভাল করে খসাব সেদিন, তৈরি থেকো কিন্তু, কেমন।’

‘কী রে দিঘি, অমন চুপ করে গেলি কেন বল তো?’ গুন্ডা ভুরু কুঁচকে তাকাল।

‘কোথায়?’ দিঘি উঠল। আর বসে থাকলে হবে না। এবার উঠতে হবে। এখান থেকে গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউ খুব একটা দূরে নয়। ট্যাক্সি নিয়ে নিলেই হবে।

‘আচ্ছা মুশকিল। গেলি চুপ করে! আর বলছিস, কোথায়?’ গুন্ডাও উঠে দাঁড়াল।

সন্ধে হয়ে আসছে এবার। আশপাশের আলো জ্বলে উঠছে। সাঁতারুরা সামনের জল থেকে উঠে গা মুছছে। গল্প করছে। একটু দূরে জলের এক কোনায় বাঁশের তৈরি আধ-খ্যাঁচড়া খাঁচাটাকে এই সন্ধেবেলা কেমন যেন ধ্বংসস্তূপের মতো লাগছে। পুজো, দুর্গাপুজোর জন্য তৈরি হচ্ছে শহর। অক্টোবরের প্রথমেই এবার পুজো। তার তোড়জোড় সারা শহর জুড়ে চলছে।

রূপ বলল, ‘আমি এবার আসি রে। তোরা যা।’

গুন্ডা বলল, ‘কেন, তুইও চল আমাদের সঙ্গে।’

‘মানে?’ আর্য এতক্ষণে কথা বলল, ‘এই গুন্ডা, তোকে কে নিচ্ছে?’

‘কেন? তুইও দিঘির বন্ধু, আমিও বন্ধু। তুই যেতে পারলে আমিও যেতে পারব।’

‘আমি শুধু বন্ধু নই, বুঝেছিস?’ আর্য গম্ভীরভাবে কথাটা বলে দিঘির দিকে তাকাল।

দিঘি চোখ সরিয়ে নিল আর্যর চোখ থেকে। আর্য শুধু ওর বন্ধু নয়? তা হলে আর্য কে? আর্য বন্ধুর বেশি। সেই জন্যই তো আর্য দিঘিকে আদর করে। চুমু খায়। নির্জনে হাত ধরে বসে থাকে। সেই জন্যই তো আর্য কোথাও ঘুরতে গেলে দামি গিফ্‌ট নিয়ে আসে। শরীর খারাপ হলে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন করে। সত্যিই তো, আর্য কি শুধুই বন্ধু?

দিঘির বুকের ভেতরে অদ্ভুত একটা কষ্ট পাক খায়। একটা নেই-নেই হাওয়া ঘুরে বেড়ায়। মনে হয়, নির্জন মাঠের ভেতর দিয়ে ছোট্ট একটা মেয়ে হাঁটছে একা। মনে হয়, কেউ নেই তার হাত ধরার। আচমকাই নীল একজোড়া চোখ দেখতে পায় দিঘি। হলুদ গিটার দেখতে পায়। দেখতে পায় ছাদের ঘরে এক পুজোর সকাল। সত্যিই আর্য কি শুধুই বন্ধু নয়?

ভেজা একটা হাওয়া শরীরের ভেতরে পাক খেয়ে গেল দিঘির। আজ তেরোই আগস্ট। আজ মৃত্যুদিন না?

‘জন্মদিন, শমীদার জন্মদিন। ব্যস, আমি যাব।’ গুন্ডা চিৎকার করে উঠল, ‘আজ গেলে শমীদা কিচ্ছু মনে করবে না।’

‘তা হলে ট্যাক্সিতে তুই সামনে বসবি।’ আর্যর গলা দিয়ে রাগ ছিটকে বেরোল।

খিকখিক করে হাসল গুন্ডা, ‘শালা রং নিবি না। মনে থাকে যেন আমাদের পাড়ার ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাস।’

‘তো? মারবি নাকি?’

গুন্ডার হাসি বেড়ে গেল, ‘শালা পিছনের সিটে দিঘিকে একা চাস তো?’

‘শালা, তোকে, শালা…’ আর্য কী বলবে যেন বুঝতে পারল না।

‘চুপ করবি গুন্ডা। আমার অসহ্য লাগছে।’ দিঘি চিৎকার করে উঠল, ‘সবসময় এমন করিস না তো! যাবি যখন চুপচাপ চল।’

কলেজ স্ট্রিট অঞ্চল এই সময়টা জমজমাট থাকে। দোকানিদের বই ফেরির চিৎকার, ট্যাক্সির অনর্থক হর্ন, সোল খয়ে যাওয়া জুতোর মতো এক দিকে কেতরে থাকা বাস আর অটোর অ্যাক্রোব্যাটিক পার হয়ে দিঘিরা ইউনিভার্সিটি গেটের সামনে এল।

রূপ বলল, ‘ও কে, কাল ক্লাসে দেখা হবে। কেমন? বাই।’

দিঘি বলল, ‘তুইও কিন্তু যেতে পারতিস। কোনও প্রবলেম হত না।’

‘আমি? পাগল!’ রূপ আর-একটা সিগারেট ধরিয়ে কাঠিটাকে টোকা দিয়ে রাস্তায় ফেলে বলল, ‘তোর ওই ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান টাইপ দাদা-দিদির পাল্লায় পড়ব ভেবেছিস? এত্ত ঝগড়া কেউ করে! বিশেষ করে তোর দিদি। বাবা, যা এক পিস প্রোডাকশন তোর বাবা-মা দিয়েছে না! বাদ দে। আমি কাটি, বাই।’

রূপ চলে যেতেই আর্য হাত তুলে একটা ট্যাক্সিকে দাঁড় করাল। তারপর কোথায় যাবে বলে গাড়ির সামনের দরজাটা খুলে গুন্ডার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওঠ।’

গুন্ডা হাসল, ‘দেখিস, যে রেটে তুই দিঘির সঙ্গে চিপকাচ্ছিস, টু-টু জা ফোর না হয়ে যায়!’

কলকাতায় অফিস টাইমের রাস্তা আর বাচ্চাদের ভাতের থালা-দুটোই এক। দিঘি অবাক হয়ে দেখে শহরে রোজ কচুরিপানার মতো গাড়ি বাড়ছে। লোন নিয়ে গাড়ি আর বাড়ি বাঙালির অ্যান্টাসিড অ্যাডিকশনের চেয়েও সাংঘাতিক হয়েছে আজকাল। ছোট ছোট বুট জুতোর মতো দেখতে গাড়িগুলো পোকার মতো ঘুরে বেড়ায় শহরের রাস্তাঘাট দিয়ে। দেখে বিরক্ত লাগে দিঘির। কষ্ট হয়। ভাবে, এত গাড়ির কি সত্যিই দরকার আছে? কত বড় বড় সুন্দর দেখতে বাস বেরিয়েছে এখন। নতুন ভাবে মেট্রো চলছে। অটো, ট্যাক্সিতে বাটি উপচে উঠছে শহরের। তারপরেও এত গাড়ি কীসের জন্য দরকার? অবশ্য ওদেরও এমন একটা ছোট্ট বুট জুতো রয়েছে। আর ওর দিদিও তো গতকাল একটা বুট জুতো পছন্দ করেছে।

ট্যাক্সিতে বসেই গুন্ডা সামনের সিট থেকে পিছন দিকে ঘুরে বসল, বলল, ‘আমি এভাবেই বসব। দেখি কী করিস তুই আর্য।’

আর্য ভুরু কুঁচকে দিঘির থেকে সরে বসল একটু। বলল, ‘গুন্ডা, তোর লজ্জা করে না রে? এমন যেচে নেমন্তন্নে যাস, অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে পিপিং টম হোস, এমন হাতির মতো মোটা তাও গোগ্রাসে গিলিস, লজ্জা নেই তোর?’

গুন্ডা হি হি করে হাসল, ‘যতই যা বলিস, আমি সামনে ঘুরে বসব না। দিঘিকে নিয়ে অসভ্যতা করবি, আমি হতেই দেব না। আর আর্য, ব্যাপারটা ভাব, দিঘি কীরকম রাফ প্যাচের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, সেটা বুঝছিস না তুই?’

গুন্ডার দিকে তাকাল দিঘি। আবার সেই প্রসঙ্গে ঢুকছে ছেলেটা।

গুন্ডা বলল, ‘তবে আজকের পর থেকে আর সেই জানোয়ারটাকে দেখতে হবে না তোকে, শালাটাকে আরও আগে বাড়ি থেকে লাথি মেরে বের করে দেওয়া উচিত ছিল। তবে বেটার লেট দ্যান নেভার। আচ্ছা দিঘি, মালটা তোকে ঠিক…’

‘চুপ করবি?’ ঝাঁঝিয়ে উঠল দিঘি, ‘বড্ড বাজে বকছিস তখন থেকে, বড্ড বাজে বকছিস গুন্ডা। চুপ কর।’

গুন্ডা থতমত খেয়ে বলল, ‘যাঃ বাবা, আমার ওপর রাগছিস কেন? আমি কী করলাম? তুই ফালতু খচে যাচ্ছিস। যাক গে, যা হওয়ার হয়েছে। ওসব ভুলে যা। নোংরা মানুষদের যত ভুলবি ততই ভাল হবে।’

ভাল? কীসে ভাল হয় মানুষের? কার কথা ভুলতে চায় সে? ভুলে গিয়ে সে কী রাখতে চায় মনে?

দিঘি জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। আগস্ট বর্ষার মাস। তবে এবার বৃষ্টি তেমন হচ্ছে না। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে কিছু বিদ্যুতের শিকড় আচমকাই জেগে উঠল আকাশে। হঠাৎ ঠান্ডা হাওয়া ট্যাক্সির জানলা দিয়ে এসে আলতো ছুঁয়ে গেল দিঘির মুখ। অসংখ্য আঠারো বছর বয়সিদের মতো, বর্ষার সম্ভাবনায় দিঘিও কেঁপে উঠল ভেতরে ভেতরে।

মহুলের ফ্ল্যাটটা পাঁচতলায়। ছোট, কিন্তু ছিমছাম। দিঘির খুব ভাল লাগে মহুলের ফ্ল্যাটটা। শুধু নির্জনতা, সুন্দর সাজানো বা সাউথ ফেসিং বলে নয়। এই ফ্ল্যাটটা আসলে প্রতীক। মহুলের একা বেঁচে থাকার, সবার মুখে থাপ্পড় মেরে একা বেঁচে থাকার প্রতীক। পরিশ্রম আর নিষ্ঠার জোরে একটা খুব সাধারণ মেয়েও যে কলকাতায় ভদ্রভাবে বাঁচতে পারে, সে ব্যাপারে মহুল একটা উদাহরণ। কে না বিরোধিতা করেছে মহুলের এই শমীর থেকে আলাদা থাকার সিদ্ধান্তের, বাবা-মায়ের থেকে আলাদা থাকার সিদ্ধান্তের, এমনকী দিঘিরও মনে হয়েছিল যে, মহুল বাড়াবাড়ি করছে। শমীর সঙ্গে ঝামেলার জেরে একা একা থাকার কোনও মানে নেই। মনে হয়েছিল যে, শমীকে ছেড়ে চলে আসার পর মহুলের সঙ্গে মা যতই খারাপ ব্যাবহার করুক, তাতে বাড়ি ছেড়ে নতুন ফ্ল্যাটে একা থাকাটা বাড়াবাড়ি।

কিন্তু এখন দিঘি মহুলের বাড়াবাড়ির কারণটা বোঝে। পাখনা মেলে আকাশে ভেসে থাকা পায়রার আনন্দটা বোঝে। ওর মনে হয়, ইস, এমন যদি একটা জীবন পেত ও!

মহুল ওকে এখানে এসে মাঝে মাঝে থাকার কথা বলে। বলে যা খুশি করতে পারে দিঘি এই ফ্ল্যাটে এসে। কিন্তু দিঘি চট করে আসে না। কোথায় যেন বাধে। মহুল ওর নিজের দিদি, তাও মহুলের জিনিস নিতে কষ্ট হয় ওর। ভাবে যেদিন ও নিজে পারবে, সেদিন ও-ও ডানা মেলবে।

পাঁচতলায় লিফ্‌ট থেকে নেমে দিঘি ডোরবেল বাজাতে যাবে, ঠিক এমন সময় ব্যাগের ভেতর থেকে মোবাইল বেজে উঠল।

এখন আবার কে? বিরক্ত লাগল দিঘির। কাল টিউশন আছে। স্যার নয় তো! স্যারটা মহা ফাঁকিবাজ। হয় কি নয় কামাই করে।

দিঘি ফোনটা বের করল, আরে, সুবর্ণ! হঠাৎ এ সময়?

দিঘিদের পাড়ায় থাকে সুবর্ণ। সমবয়সি ছেলেটা খুবই ভাল। তবে বেশ রগচটা। ইংরেজি অনার্স নিয়ে পড়ে। দিঘির খুব বন্ধু।

দিঘি ফোনটা কানে লাগাল, ‘হ্যাঁ রে সুবর্ণ, বল কী ব্যাপার?’

সুবর্ণ বলল, ‘দারুণ খবর দিঘি। যাকে বলে পাড়ার ব্রেকিং নিউজ।’

‘কী খবর?’ দিঘি জিজ্ঞেস করল।

সুবর্ণ শ্বাস নিল একটু। খানিকটা যেন মনে মনে গুছিয়ে নিল নিজেকে। তারপর বলল, ‘শুয়োরের বাচ্চাটা এইমাত্র কাটল।’

‘মানে?’ দিঘি বুঝল না ঠিক।

‘আরে ট্যাক্সি ডেকে এনেছিল। তাতে ঢাউস দুটো ব্যাগ আর দুটো ছোট ব্যাগ তুলে মালটা বেরিয়ে গেল এইমাত্র। শালা, পাড়াটা বাঁচল যেন। আবর্জনা দূর হল!’

দিঘি ফোনটা ধরে রইল কানে। ও যেন দেখতে পেল সুকিয়া স্ট্রিটের গলির মুখ দিয়ে একটা হলুদ ট্যাক্সি বাঁক নিয়ে চলে গেল।

কত দূরে গেল ট্যাক্সি? কোথায় নিয়ে গেল মানুষটাকে? কার কাছে নিয়ে গেল? আচ্ছা, যা যা ঘটেছে সবাই তো ভালই হয়েছে বলবে, তা হলে দিঘির এমন লাগছে কেন? এমন চাপা কষ্ট হচ্ছে কেন বুকে?

সুবর্ণ বলল, ‘তোর আজ লাকি ডে দিঘি। আর ভয় পেতে হবে না তোকে। আজ থেকে মন খুলে থাকতে পারবি। সবার কাছে তেরো সংখ্যাটা আনলাকি, তোর কাছে লাকি। তেরোই আগস্ট তোর লাকি ডে, বুঝলি?’

তেরোই আগস্ট! আজ মৃতুদিন না? আর আজকেই এভাবে চলে যেতে হল ওকে? মাথা নিচু করে, একরাশ কলঙ্ক আর অন্ধকার নিয়ে চলে যেতে হল? কার জন্য যেতে হল? দিঘির জন্য?

দিঘির মোবাইল ধরা হাতটা কান থেকে নেমে এল আপনা-আপনি। সুবর্ণ এখনও অনেক কিছু বলছে। কিন্তু পৌঁছোচ্ছে না, দিঘির কাছে কিচ্ছু পৌঁছোচ্ছে না। শুধু বুকের ভেতর চাপ লাগছে ভীষণ। পাঁজর ফাটিয়ে পাথরের দেওয়াল উঠছে যেন। আর সেই দেওয়াল টপকে দিঘি কিছুতেই পৌঁছোতে পারছে না নিজের কাছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *