এক
এমনিতে একটু রাত হলেই মুনিয়া আর চোখ খুলে রাখতে পারে না। লণ্ঠনের সামনে বই নিয়ে বসে ঢুলতে আরম্ভ করে। তখন ওর মা ভাতের থালা নিয়ে এসে আধঘুমন্ত অবস্থাতেই ওর মুখে কোনোরকমে দু’গাল ভাত ঠুসে দিয়ে, মুখ ধুইয়ে শুইয়ে দেয়। বালিশে মাথা দেওয়ার আগেই মুনিয়া ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু আজ মুনিয়ার কিছুতেই ঘুম আসছিল না।
পনেরোদিন আগেও দাদামণি পড়ার সময় পাশে বসে থাকত। অঙ্ক কিম্বা বানান আটকালে দাদামণি দেখিয়ে দিত। গত পনেরোদিন ধরে মুনিয়া একা একাই পড়াশোনা করছে। আজ মা ডাকতেই সে রান্নাঘরের মেঝেয় ভাতের থালার সামনে গিয়ে বসল। কিন্তু খেল না কিছুই, কেবল ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল।
মা একটু অবাক হয়ে বলল, কি রে, তোর ঘুম পায়নি?
উঁহু। মুনিয়া মাথাটা ভাতের থালার দিক থেকে না তুলেই ঘাড় নাড়ল। তারপর ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, দাদামণি কবে ফিরবে মা?
মা আটা মাখছিল। কোনো উত্তর দিল না। কিন্তু মুনিয়া খেয়াল করল, ওর প্রশ্নটা শুনেই মায়ের হাতটা আটার তালের ওপর স্থির হয়ে গেল। হঠাৎ যেন মা পাথর হয়ে গেল।
মুনিয়া এবার ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, দাদামণি না ফিরলে আমি ঘুমোব না, খাবো না। পড়বোও না।
এই দ্যাখো বোকা মেয়ে। মা তাড়াতাড়ি ঘটির জলে হাত ধুয়ে মুনিয়ার মাথাটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল। বলল, দাদামণির জন্যে চিন্তা করে তুই জেগে বসে আছিস? কিসের চিন্তা মা? তোর দাদামণিকে যারা নিয়ে গেছে তারা কত ভালো লোক। কত লেখাপড়া জানা, কেমন হাসিখুশি। তুই তো নিজের চোখেই তাদের দেখেছিস? দেখিসনি?
দেখেছে তো মুনিয়া। ভাগ্যিস লোকগুলো সেদিন সকালবেলাতেই চিতলভাসা গ্রামে এসে পৌঁছেছিল। আর একটু দেরি করে এলেই মুনিয়া ইস্কুলে চলে যেত, আর তখন পুরো ব্যাপারটাই ঘটে যেত ওর চোখের আড়ালে। এত বড় ব্যাপারটা ওকে পরের মুখে শুনতে হত।
চিতলভাসা গ্রামটা একে ছোট্ট, তার ওপরে পাহাড়ের গায়ে ঢালু জমিতে ধাপে ধাপে তৈরি। তাই গরুবাথানের দিক থেকে যে রাস্তাটা এসে গ্রামে মিশেছে, সেই রাস্তাটা ধরে সেদিন যখন একটা বড় ল্যান্ড-ক্রুজার ওদের গ্রামের ওকগাছটার নিচে এসে দাঁড়াল, তখন সবাই যে যার বাড়িতে বসেই সেগুলোকে দেখতে পেয়েছিল। একজন-দুজন করে লোক তখনই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গাড়িটাকে ঘিরে ধরল। আর গ্রামের কমবয়সি বাচ্চা তো একটাও ঘরে রইল না। পাঁই পাঁই করে দৌড়িয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সবাই সেখানে উপস্থিত। মুনিয়া আর মোহন দুই ভাইবোনও সেই দলে ছিল। মুনিয়ার বয়স আট আর মোহনের পনেরো।
আসলে চিতলভাসার লোকজন বছরের মধ্যে কয়েকবার এরকম আগন্তুক আসতে দেখে অভ্যস্ত। সামতা ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের এন্ট্রি পয়েন্টের ঠিক আগে এই চিতলভাসা গ্রাম। এখান থেকেই সামতা ভ্যালির ট্রেকিং শুরু হয়।
সামতা ভ্যালির আয়তন অষ্টআশি বর্গ কিলোমিটার; অনেক সংরক্ষিত বনাঞ্চলের থেকেই কম। কিন্তু জীবজন্তু পাখি প্রজাপতি আর অর্কিডের সংখ্যায় সামতা ফরেস্ট অনেক নামজাদা জঙ্গলকে পেছনে ফেলে দেবে। বেশ কয়েকটা প্রজাতির অর্কিড আর প্রজাপতি আছে যা একমাত্র সামতার জঙ্গলেই পাওয়া যায়। আর আছে অতি দুর্লভ, অতি মিষ্টি সেই প্রাণী—রেড পান্ডা। বিশেষ করে রেড পান্ডাদের নির্ঝঞ্ঝাটে বাঁচতে দেওয়ার জন্যেই সামতা ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের দরজা এখনো সাধারণ ট্যুরিস্টদের জন্যে খুলে দেওয়া হয়নি। এখন এখানে ঢুকতে পান কেবল দেশবিদেশের প্রাণী ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা। বিশ্ববিখ্যাত প্রকৃতিবিদেরা।
সেইজন্যেই চিতলভাসার গ্রামপথে বছরের মধ্যে বেশ কয়েকবার সাফারি-জিপের চওড়া রেডিয়াল-টায়ারের ছাপ পড়ে।
ল্যান্ড-ক্রুজারের মাঝের সিটটা থেকে তিনজন যুবক লাফিয়ে নেমে এসে আড়মোড়া ভেঙে এদিক-ওদিক চাইল। তারা বিদেশি নয়, ভারতীয়। কথা বলা মাত্র বোঝা গেল, শুধু ভারতীয়ই নয়, বাঙালি। নিজেদের মধ্যে তারা বাংলাতেই চিতলভাসার স্বর্গীয় সৌন্দর্যের কথা বলাবলি করছিল। বেশ গর্ব হচ্ছিল মুনিয়ার। ও তো জানেই ওর জন্মভূমি এই গ্রামটা কত সুন্দর। এরকম বড় বড় গাছের ছায়া, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া হরলং ঝোরা, চোখ মেললে নীল আকাশের গায়ে বরফের পাহাড়—কটা জায়গায় এরকম দেখা যায়?
ড্রাইভারের সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে সামনের সিটের একমাত্র আরোহীও এবার মাটিতে পা রাখলেন। ছিপছিপে চেহারা, কাঁচাপাকা দাড়ি-গোঁফ। গায়ে একটা হাতা গোটানো চেক-শার্ট আর অনেকগুলো পকেটওলা প্যান্ট। বয়স পঞ্চাশের একটু ওপরেই হবে। হাসতে হাসতে গ্রামের মানুষদের দিকে এগিয়ে এসে তিনি বললেন, ডব্লিউ ডব্লিউ টি, মানে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্টের তরফ থেকে আমরা সামতার জঙ্গলে পাখি গুনতে এসেছি। আমার নাম বিজিত মণ্ডল। ওনারা আমার সহকর্মী—অরিত্র বসু, চিত্রভানু সান্যাল আর সিদ্ধার্থ মজুমদার। লোকটি হাতজোড় করে সবাইকে নমস্কার করেছিলেন।
তিনজন যুবকও হাতজোড় করে হাসিমুখে এগিয়ে এল ওদের দিকে।
গ্রামের মানুষদের মধ্যে বিশাইদাদুরই বয়স সবচেয়ে বেশি। তিনিই এই গ্রামের মোড়ল। বিশাইদাদু লোকগুলোকে বললেন, আরে, আপনাদের বড় সাহেব উদয় কার্গেকে তো আমি খুব ভালো করে চিনি। তিনি কতবার এসেছেন এই সামতা ভ্যালির ফরেস্টে। প্রত্যেকবারই জঙ্গলে ঢোকার আগে আমাদের গ্রামের মানুষদের খোঁজখবর নিয়ে যেতে ভোলেননি। দেবতার মতন লোক কার্গে সাহেব। কেমন আছেন উনি?
মুনিয়া অবাক হয়ে দেখল, বিজিত মণ্ডল এই প্রশ্নে কেমন যেন থতমত খেয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ভালোই তো…ভালোই আছেন কার্গে সাহেব।
বিশাইদাদু বললেন, তাহলে চলুন, আমার বাড়িতে বসে চা খেতে খেতে আপনাদের কথা শুনি।
বিশাইদাদুর বাড়ির উঠোনে একটা মোরগ, চারটে মুরগি আর দশ-বারোটা মোরগছানা খুঁটে খুঁটে কি সব খাচ্ছিল। তাই দেখে ওদের আবার কি ফুর্তি! দ্যাখ, দ্যাখ কি সুন্দর গোলগাল মুরগিছানা। একদম সফট টয়েজের মতন। এই বলে যে যার ক্যামেরা বার করে ছবি তুলতে শুরু করল।
মুনিয়া মনে মনে বলল, এরা সায়েন্টিস্ট না ট্যুরিস্ট? মুরগি দেখে লাফাচ্ছে! তাছাড়া ডব্লিউ ডব্লিউ টি বা অন্যান্য সংস্থা থেকে যাঁরা গ্রামে আসেন তাঁরা কেউ গ্রামের লোকের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে হলে আগে তাদের পারমিশন নিতে ভোলেন না। সেটাই ভদ্রতা। এরা কি সেটাও জানে না?
বিজিত মণ্ডল নামের বয়স্ক মানুষটিই ওদের টিম-লিডার। চা খেতে খেতে বিজিত মণ্ডল বিশাইদাদুকে ওঁদের এখানকার প্রোগ্রামটা পুরো খুলে বললেন। পুরো জঙ্গলটায় পরিযায়ী পাখিদের কতরকম প্রজাতি আসে এবং কত সংখ্যায় আসে সেটা দেখবার জন্যেই ওনারা এসেছেন। বিশাইদাদুকে ওরা জিজ্ঞেস করল কিরকম সময় লাগতে পারে ওই কাজে?
বিশাইদাদু বললেন, আগে যে সব টিম এই কাজ করে গেছে, তাদের কারুরই তো মাসখানেকের কম সময়ে কাজ শেষ হয়নি।
বিজিত মণ্ডল নমস্কার করে বললেন, তাহলে আমরা চলি।
বিশাইদাদু অবাক হয়ে বললেন, চলি মানে? আপনারা কি একেবারে একমাসের জন্যে জঙ্গলে চললেন?
বিজিত মণ্ডল আবার থতমত খেয়ে বললেন, কেন? কিছু ভুল করলাম না কি?
না, মানে এরকম তো কেউ করে না। কিছু কিছু রসদ নিয়ে জঙ্গলে ঢোকে, একদিকের কাজ শেষ করে, তারপর আবার চিতলভাসায় ফিরে এসে বাকি রসদ নিয়ে জঙ্গলের অন্যদিকে চলে যায়। এতে সুবিধে হয় কি, পুরো মালটা একসঙ্গে বইতে হয় না। তারপর ধরুন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে সব মালপত্র একসঙ্গে খোয়াবার ভয়ও থাকে না।
বিজিত মণ্ডল একটু ভেবে বললেন, উঁহু। আমাদের সেরকম করবার উপায় নেই। কেন নেই সেটা কিন্তু বললেন না। বিশাইদাদু বা গ্রামের অন্য কেউও ভদ্রতাবশত ও প্রশ্ন করল না।
এইসব কথাবার্তা যখন চলছে, তখনই একটা কাণ্ড হল।
বিশাইদাদুর উঠোনের ঠিক নীচে, পাহাড়ের ঢালে অনেকগুলো বড় বড় গাছ আছে। গাছগুলোতে সারা দিন নানা রকম পাখির মেলা লেগে থাকে। সেরকমই একটা গাছের ঘন পাতার ফাঁক থেকে ভারী সুরেলা একটা পাখির ডাক ভেসে এল। একটা নয়, ডাক শুনে মনে হল একঝাঁক পাখি।
কথা থামিয়ে চারজন পক্ষীতত্ত্ববিদ কানখাড়া করে সেদিকে তাকাল। বিজিত মণ্ডল খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ডাক শুনেই পাখিগুলোর নাম বলে দিলেন—সিবিয়া।
উঁহু, সিবিয়া নয়। হোয়াইট থ্রোটেড লাফিং থ্রাস।
বিজিতবাবুর কথার প্রতিবাদটা বার্ড-ওয়াচারদের মধ্যে থেকে নয়, ভেসে এল গ্রামবাসীদের মধ্যে থেকে। বিজিত মণ্ডল আর তার টিমের বাকিরা চোখ গোলগোল করে দেখল কথাটা বলেছে বছর পনেরোর একটা ছেলে। তার গায়ে পুরনো সস্তা জ্যাকেট আর রংচটা একটা জিনসের প্যান্ট। মাথার চুলগুলোয় অনেকদিন কাঁচি পড়েনি। সে একমনে গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে।
বিজিত মণ্ডলের মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে উঠল। তিনি বললেন, আমি বলছি সিবিয়া।
খুব শান্ত গলায় ছেলেটা বলল, আমি জানি, ওটা হোয়াইট থ্রোটেড লাফিং থ্রাসের ডাক।
ওরা কেউ আর কিছু বলার আগে, যেন ওদের তর্ক থামাতেই, পাখিগুলো ঘন পাতার আড়াল থেকে লাফিয়ে গাছের মাথায় উঠে এল। সকালের উজ্জ্বল আলোয় দেখা গেল তাদের খয়েরি শরীর। গলার কাছের পালকগুলো ধবধবে সাদা। আবার তারা মধুর কণ্ঠে কলকল করে গান গেয়ে উঠল সেই গান, যা একটু আগেই পাতার আড়াল থেকে ভেসে এসেছিল।
তিন যুবক সমস্বরে বলে উঠল, হোয়াইট থ্রোটেড লাফিং থ্রাস। তারপর তারা হাঁ করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। বিজিত মণ্ডল আস্তে আস্তে ছেলেটার দিকে এগিয়ে গিয়ে একগাল হেসে তার কাঁধটা জড়িয়ে ধরলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে বাবা? এই গণ্ডগ্রামে বসে এরকম সাংঘাতিক পাখি চিনলে কেমন করে?
ছেলেটা লাজুক মুখে বলল, আমার নাম মোহন। মোহন ছেত্রি।
পুরো ব্যাপারটা চোখের সামনে দেখে মুনিয়ার তখন গর্বে বুক দশহাত। তার দাদার পাখিদের সম্বন্ধে এমন জ্ঞান যে শহরের সায়েন্টিস্টরাও তার কাছে হেরে যায়। সে টুক টুক করে এগিয়ে গিয়ে দাদামণির হাতের আঙুলটা ধরে তার পাশেই দাঁড়াল। যেন দেখাতে চাইল, এটা আমার দাদামণি। তোমাদের নয়।
কী হল? বললে না তো। এত সুন্দর পাখি চিনলে কেমন করে?
মুনিয়া জানে উত্তরটা। কিন্তু তাকে তো আর জিজ্ঞেস করেনি। সে কেমন করে জবাব দেয়? এদিকে দাদামণিটা এমন লাজুক, সে আর কিছুতেই মুখই তোলে না। তখন বিশাইদাদু এগিয়ে এলেন।
বিশাইদাদু বললেন, চিনবে না কেন? আমাদের মোহনের বাবা যে সামতা ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের ফরেস্ট গাইড ছিল। তার নাম ছিল মুক্তিনাথ ছেত্রি। সে শুধু পাখি নয়, এই জঙ্গলের সমস্ত জন্তুজানোয়ার, সাপখোপ, প্রজাপতি, অর্কিড এমন কি গাছপালাগুলোকে অবধি নিজের হাতের তালুর মতন চিনত। দেশবিদেশের যত বৈজ্ঞানিক, প্রকৃতিপ্রেমিক এখানে আসতেন, তাঁরা আগেই মুক্তিনাথের খোঁজ করতেন। মানুষটাও বড় ভালো ছিল তো। ওকে সফরসঙ্গী হিসেবে পেলে জঙ্গলে নিশ্চিন্তে ঘোরা যেত। আর মুক্তিনাথেরও ভালোই লাগত ওনাদের সঙ্গে জঙ্গলে ঘুরতে। ওনাদের কাছে থাকতে থাকতেই তো সমস্ত গাছপালা, পশুপাখির ইংরিজি নাম শিখে ফেলেছিল। শুধু কি তাই? কোন পাখি বারোমাস এখানেই থাকে, কোন পাখি বিদেশ থেকে উড়ে আসে, কোন পাখি কী খায়, কোথায় কখন বাসা বাঁধে—সমস্ত শিখে নিয়েছিল মুক্তিনাথ।
মোহন একটু বড় হওয়ার পর থেকেই ওকে নিয়ে মুক্তিনাথ জঙ্গলে ঢুকত। বাপের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে বেটাও অনেক কিছু শিখে নিয়েছিল। আরো অনেক কিছুই শিখত, যদি না….।
যদি না?
যদি না ওর বাবা হারিয়ে যেত।
মোহন আর মুনিয়া দুজনেই মাটির দিকে মুখ নামিয়ে নিয়েছিল। একবার তাদের দিকে তাকিয়ে বিজিতবাবু অবাক গলায় প্রশ্ন করলেন, ওদের বাবা হারিয়ে গেছেন! কী ভাবে? কোথায় হারিয়ে গেলেন?
বিশাইদাদু বললেন, ওই সামতা ভ্যালির জঙ্গলেই, যেখানে আপনারা যাচ্ছেন।
কী হয়েছিল বলুন তো ব্যাপারটা।
আসলে মুক্তিনাথ অনেক দিন ধরেই একটা কিছু খুঁজছিল। মাঝে মাঝেই একা একা সাতদিন-দশদিনের জন্যে জঙ্গলে চলে যেত। বিশেষ করে এই শীতকালের শুরুটায়। একটা প্রচণ্ড অস্থিরতাও দেখা দিত তখন ওর মধ্যে। কী খুঁজছিল কে জানে? ওর স্ত্রী প্রশ্ন করলেও নানারকম উল্টোপাল্টা উত্তর দিত। কখনো বলত, একটা কোন গাছের শেকড় থেকে ক্যানসারের ওষুধ হয় বলে শুনেছে। সেই গাছটা খুঁজছে। কখনো বলত একটা নতুন প্রজাতির পাখিকে একপলক দেখতে পেয়েছে। সেই পাখিটাকে খুঁজছে। বোঝাই যায় সব বানানো কথা। ও তো আর বৈজ্ঞানিক ছিল না। পাখি বা ফুল ও খুঁজতে যাবে কেন? সারা বছর এত বৈজ্ঞানিক আসছেন এখানে। খোঁজার হলে তো তাঁরাই খুঁজতেন।
তারপর?
তারপর গতবছরের শীতকালের শুরুতে সেই যে একবার জঙ্গলে গেল, আর ফিরল না। আমরা গ্রামের লোকেরা জঙ্গলের আনাচে-কানাচে সব জায়গায় ওকে খুঁজেছি। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকেও কত খোঁজাখুঁজি হয়েছে। কিন্তু মানুষটা যেন ওই সামতার জঙ্গলে কর্পূরের মতন মিলিয়ে গেছে। এক বছর হতে চলল মুক্তিনাথের কোনো খবর নেই।
কথাটা শুনেই সঙ্গে সঙ্গে বিজিতবাবু মোহনকে কাছে টেনে নিলেন। অন্য তিনজন অফিসারও ওদের ঘিরে ধরেছিল। তাদের দিকে তাকিয়ে বিজিতবাবু বললেন, সিদ্ধার্থ, ভানু, অরি—মোহনকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে গেলে কেমন হয়? ও এই জঙ্গলকেই যে শুধু ভালো চেনে তাই নয়, আমার থেকেও ভালো পাখি চেনে। ও সঙ্গে থাকলে আমরা নিশ্চিন্ত।
তারা একসঙ্গে হই হই করে বলে উঠল, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। মোহনকে ছাড়া চলবে না স্যার।
বিজিতবাবু বিশাইদাদুকে জিজ্ঞেস করলেন, কী মোড়লমশাই? আপনাদের আপত্তি নেই তো যদি মোহনকে আমরা নিয়ে যাই? একমাসের তো ব্যাপার। অফকোর্স উই উইল পে হিম হ্যান্ডসামলি।
ততক্ষণে মুনিয়া আর মোহনের মা রাধিকাও পায়ে পায়ে ভিড়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বিশাইদাদু হাঁক দিয়ে বলল, কী গো মোহনের মা? মোহন বাপের মতন ফরেস্ট গাইডের চাকরি করতে যাবে। তোমার আপত্তি নেই তো?
অত লোকের সামনে মা আর কী বলবে? মিনমিন করে বলল, ওর বয়স যে বড় কম।
বিশাইদাদু বলল, কম আবার কোথায়? পনেরো হল তো। বলতে নেই, দেখলে মনে হয় কুড়ি। তারপর একটানা তো আর বাইরে থাকছে না। পনেরোদিন বাদেই ছেলেকে দেখতে পাবে। দাও, ছেড়ে দাও। বেচারার বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর পয়সার অভাবে কালচিনির হস্টেলে থেকে স্কুলে পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। সবই তো জানি। ভগবান সেইজন্যেই বোধহয় শহর থেকে এনাদের পাঠিয়েছেন। একমাসে ওনারা মোহনকে যা দেবেন তাতে আবার ক’দিন স্কুলে পড়তে পারবে।
ওর মা-ও ঠিক এই কথাটাই মনে মনে ভাবছিল। মুক্তিনাথ যখন হারিয়ে গেল, তখন মোহনের বয়স চোদ্দ। ক্লাস নাইনে পড়ছিল। কিন্তু টাকার অভাবে ওকে স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে চলে আসতে হয়েছে। হস্টেলে থাকতে গেলে মাসে দু’হাজার টাকা করে খরচা। কে দেবে? তাইতে মোহনের মনে ভীষণ কষ্ট। রাধিকার নিজের কষ্টও কম নয়। ও জানত, কোনোরকমে একবার মাধ্যমিক পরীক্ষাটায় বসতে পারলে মোহন নিশ্চিত স্কলারশিপ পাবে। তখন ওকে পড়াতে আর কাউকে পয়সা খরচ করতে হবে না। ওর যা বুদ্ধি তাতে ও ঠিক একদিন বিরাট পণ্ডিত হবে, এ ব্যাপারে শুধু রাধিকা কেন, গাঁয়ের কারুর কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু আরো একবছর পড়াবার উপায়টা কী হবে সেটাই রাধিকা বুঝতে পারছিল না।
এইসময় বিজিতবাবুদের এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। আজ বিজিতবাবুরা এসেছেন। যদি ওদের সঙ্গে থেকে ভালো কাজ দেখাতে পারে তাহলে কাল এরকমই আরেকটা দল এসে মোহন ছেত্রির খোঁজ করবে। এইভাবে কয়েকদিনে কিছু টাকাপয়সা জমিয়ে নিতে পারলে মোহন আবার কালচিনিতে ফিরে গিয়ে মাধ্যমিক অবধি পড়াটা শেষ করতে পারবে।
রাধিকা একবার ছেলের মুখের দিকে তাকাল। মায়ের চোখ বুঝতে ভুল করে না। রাধিকা দেখল মোহন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ওর চোখদুটো উৎসাহে জ্বলজ্বল করছে। রাধিকা নিশ্চিত তার ছেলে টাকাপয়সার কথা ভাবছে না, ভাবছে জঙ্গলের কথা। ভাবছে বাপের কথা। এই দলটার সঙ্গে সামতার জঙ্গলে ঢুকতে পারলে ও প্রাণ ভরে ওর বাবাকে খুঁজতে পারবে। কারণ এই ধরনের দলগুলোর সঙ্গে টেন্ট থাকে, শুকনো খাবারদাবার থাকে, সার্চলাইট, ওষুধপত্র সমস্তকিছু থাকে। দীর্ঘদিন জঙ্গলে কাটাতে হলে এরকম দলের সঙ্গে না গিয়ে উপায় নেই।
রাধিকা ধীরে ধীরে বিজিতবাবুর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর বলল, দাদা, ছেলেকে আপনার হাতেই ছেড়ে দিলাম। ওর ভালোমন্দের দায়িত্ব আজ থেকে কিন্তু আপনার।
বিজিতবাবু রাধিকার মাথার ওপর আলতো করে হাতটা রেখে বললেন, সে কথা কি বলে দিতে হবে বোন? আমার কাছে ওই সিদ্ধার্থ, অরিত্র বা চিত্রভানু যা, এখন থেকে মোহনও তাই। চিন্তা কোরো না, দু-তিন দিন বাদে বাদে মোহনকে এটা-ওটা নিতে এই চিতলভাসায় তো পাঠাবোই। তখনই নিজের চোখে দেখে নেবে, ছেলে কেমন আছে।
মায়ের সঙ্গে বিজিতবাবুর এই কথার পরেই দাদামণি একছুটে বাড়ি ফিরে, ব্যাকপ্যাকটা গুছিয়ে, হাইল্যান্ডার জুতোদুটো পায়ে গলিয়ে পাঁচমিনিটের মধ্যে তৈরি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাদার গোছগাছ দেখছিল মুনিয়া। হঠাৎই দাদামণির এই ঘর ছাড়ার ব্যস্ততা দেখে তার খুব অভিমান হল। সে বলল, আমার জন্যে তোর মন কেমন করবে না?
বিজিতবাবুদের দলটাকে ধরবার জন্যে দৌড়ে বেরিয়েই পড়েছিল মোহন। বোনের কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর পিছিয়ে এসে বোনের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে বলল, মুন্নিসোনা, আমি তো দু’দিন পর পরই বাড়ি আসবো। তার মধ্যেও তোর জন্যে একটু একটু মন কেমন করবে ঠিকই। কিন্তু ভাব তো, মাইনের টাকাটা যখন হাতে পাবো, তখন তোর জন্যে যে সেই রঙিন ছবিওলা রামায়ণের বইটা কিনে দিতে পারব, সেই যেটা তুই ওদলাবাড়ির দোকানে দেখেছিলিস। একশো টাকা দাম বলে যেটা মা সেদিন তোকে কিনে দিতে পারেনি।
ঠিক দিবি তো দাদামণি?—একগাল হাসিতে ভরে গিয়েছিল মুনিয়ার মুখ।
দেব, দেব, দেব। তিনসত্যি করে আবার বিশাইদাদুর বাড়ির দিকে ছুট লাগিয়েছিল মোহন। সেখান থেকেই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ওরা পাঁচজন সামতা ফরেস্টের গহন অন্দরের দিকে রওনা হয়ে গিয়েছিল। সে আজ থেকে পনেরোদিন আগের কথা।
পরের দিনই দাদামণি একগাল হাসতে হাসতে বাড়িতে এসে ঢুকল। তখন দুপুর। মা আর মুনিয়া তো অবাক। কি রে, এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি?
হাসতে হাসতেই মোহন বলল, আরে, ওরা অনেক কিছু নিয়েই আসেনি। ভাবতে পারো, মশার ক্রিম আনেনি, ব্যাটারি-লণ্ঠন আনেনি, এমন কি জল পিউরিফাই করার ট্যাবলেট অবধি আনেনি। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম, জঙ্গলে এই প্রথম এলেন না কি? ওই জিনিসগুলো ছাড়া এই জঙ্গলে বাঁচা যায়? তখন জিভ কেটে বললেন, তাড়াহুড়োয় ভুলে গেছি। এখন ওগুলো আমাকেই জোগাড় করে নিয়ে যেতে হবে।
সুবিধে হল চিতলভাসায় ওর সবকটা জিনিসই পাওয়া যায়। জঙ্গলের অভিযাত্রীদের জন্যেই গ্রামের দোকানে ওসব জিনিস থাকে। মোহন একেবারে কিনে নিয়েই ঢুকেছে।
মা বলল তুই আজ রাতে থাকবি তো?
না মা। ওদের যে জায়গাটায় রেখে এসেছি সেটা বড্ড গভীর জঙ্গল। রাতে না ফিরলে আমার নিজেরই ওদের জন্যে চিন্তা লাগবে। আমি ঘণ্টাদুয়েক থেকেই ফিরে যাব।
কী আর করা যাবে? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা দাদামণির প্রিয় ডিম-তড়কা আর মকাইয়ের রুটি বানাতে বসল। দাদামণি রান্নাঘরের চৌকাঠে বসে মুনিয়ার হাজারটা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিল। মা-ও কান পেতে সেইসব কথা শুনছিল।
উত্তরপূর্ব ভারতের বহু জঙ্গলে নাকি এই দলটা ঘুরেছে, কিন্তু সামতাতে এইবারেই প্রথম।
সেদিন দাদামণি ওদের সকলেরই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিল। বলেছিল, ওরা সবাই এত ভালো যে তুমি চিন্তাই করতে পারবে না মা। আমাকে মোহনভাই বলে ডাকে আর একদম ভাইয়ের মতনই দেখে। একসঙ্গে এক জায়গায় বসে এক খাবার খাচ্ছি। বিজিতস্যারের সঙ্গে এক টেন্টে কাল রাতে শুয়েছি। আর তেমনি হাসিখুশি সকলেই। সারাক্ষণ মজা করছে, গান গাইতে গাইতে পথ চলছে। আমাকে দিয়েও গান গাইয়েছে।
সেই একবারই বাড়ি ফিরেছিল মোহন। তারপর চোদ্দদিন কেটে গেছে। আর একবারও সে আসেনি।
কিন্তু বিজিতবাবু যে বলেছিলেন মাঝে মাঝে মোহনকে গ্রামে পাঠাবেন এটা-ওটা নিয়ে যেতে। তার কী হল?
পরক্ষণেই রাধিকা নিজের মনকে এই বলে সান্ত্বনা দেয় যে, নিশ্চয় সেরকম কোনো জিনিসের প্রয়োজন পড়েনি। প্রয়োজন না থাকলেও কি কাজের ক্ষতি করে মোহনকে ছুটি দেবেন?
তবু এতদিন মোহনকে না দেখে রান্নার সময় তার মায়ের হাত চলে না। মুনিয়ারও কিচ্ছু ভালো লাগে না। ওরা দুজনেই অপেক্ষা করে, কবে মোহন বাড়ি ফেরে।
দুই
সেদিন বাড়ি থেকে বিজিতস্যারদের ক্যাম্পে ফেরার পথে একটু সমস্যায় পড়েছিল মোহন। তেমন কিছু নয়, একটা হাতির পাল রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
হাতি জিনিসটা মোহনদের গা-সওয়া। প্রায়ই নুনের লোভে তাদের গ্রামের মুদিখানায় হাতি হানা দেয়। তাছাড়া যখন খেতে ভুট্টা পাকে তখন দল বেঁধে ওরা ভুট্টাখেতে হামলা চালায়। খেতের মাঝে মাঝে উঁচু উঁচু টংঘর বানানো আছে। সেখানে সারা রাত ক্যানেস্তারা, পটকা নিয়ে গ্রামের লোকেরা পাহারা দেয়। হাতিদের আসতে দেখলেই ক্যানেস্তারা পিটিয়ে, পটকা ফাটিয়ে, মশাল জ্বেলে তারা হাতি তাড়াবার চেষ্টা করে। সব সময় যে সফল হয় তা নয়। অনেক সময়েই হাতির পাল ওসব হল্লাগুল্লার থোড়াই পরোয়া করে ইচ্ছেসুখে ভুট্টা খেয়ে সকাল হলে আবার জঙ্গলে ঢুকে যায়।
দলবদ্ধ হাতিকে চিতলভাসা গ্রামের কেউই তেমন ভয় পায় না। ভয় পায় দলছুট একলা দাঁতাল হাতিকে। তারা খুব রাগি হয়। তাদের সামনে যদি কোনো মানুষ পড়ে যায় তাহলে প্রাণ নিয়ে ফেরা মুশকিল। শুঁড়ে করে আছড়ে, পা দিয়ে পিষে মেরে ফেলবে। ওই একলা দাঁতালদের ভয়েই ছোটবেলায় মোহনরা যখন তিন কিলোমিটার দূরের পাঠশালায় পড়তে যেত তখন পকেট ভর্তি করে বনদপ্তরের দেওয়া ভুঁইপটকা নিয়ে যেত। দাঁতাল যদি চার্জ করে তাহলে তার সামনে ওই ভুঁইপটকা আছড়ে ফাটালে দারুণ আওয়াজ হবে আর দাঁতাল পিছিয়ে যাবে, এই ভরসায়। অবশ্য সেরকম পরিস্থিতির সামনে মোহন কখনো পড়েনি।
প্রায় আধঘণ্টা চুপ করে অপেক্ষা করার পর মোহন দেখল দলটার রাস্তা ছেড়ে সরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই নেই। ওখানে দাঁড়িয়েই ওরা গা নাড়াচ্ছে, গাছের ডাল ভেঙে চিবোচ্ছে, বাচ্চাগুলো এ ওর সঙ্গে শুঁড়ে শুঁড় জড়িয়ে খুনসুটি করছে। এই অবস্থায় অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করারও থাকে না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে সন্ধে নেমে আসছে। অন্ধকার হয়ে গেলে মোহনের মতন জঙ্গলের ছেলেরাও জঙ্গলকে ভয় পায়। এতে লজ্জার কিছু নেই। বাবা বলত ওই ভয়টাই জঙ্গলে বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
একটু চিন্তা করে মোহন অন্য একটা পথে ক্যাম্প সাইটের দিকে যাবে বলে মনস্থ করল। সেটা একটু ঘুরপথ। সময় বেশি লাগবে ঠিকই, কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে সারা রাতেও সে ছাড়া নাই-ই পেতে পারে।
মোহন হাতির পালের থেকে মুখ ঘুরিয়ে শুঁড়িপথ ধরে পা চালাল। এই শুঁড়িপথগুলো মানুষের চলার জন্যে বানানো নয় মোটেই। বুনো জন্তুদের চলার পথে তাদেরই পায়ে পায়ে এই পথগুলো তৈরি হয়েছে। এগুলোকে স্থানীয় লোকেরা বলে ”চোরাবাটো”।
এই চোরাবাটোটায় এর আগে মাত্র দু’তিনবার এসেছে মোহন, বাবার সঙ্গে। সেইজন্যেই সে যেতে যেতে একবার পথ ভুল করল।
পথ ভুল করল বলেই সে দেখতে পেল দূরে জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় ধোঁয়া উঠছে। ওটা দাবানলের আগুন নয়। তাহলে অনেক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জ্বলত। একটা মাত্র জায়গায় ধোঁয়া উঠছে মানে ওখানে মানুষ আছে। কে হতে পারে? কিম্বা কারা?
চিতলভাসা গ্রামকে এড়িয়ে বনদপ্তরের লোকই হোক কিম্বা বাইরের লোক—কারুরই জঙ্গলে ঢোকার উপায় নেই। এই সামতা ভ্যালি ন্যাশনাল ফরেস্টের চেক-পয়েন্টটা চিতলভাসার একটু পরেই। এই যে বিজিতদাদুরা জঙ্গলে ঢুকেছে, সেও ওই চেক-পয়েন্টে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের পারমিট দেখিয়ে তারপর। মোহন জানে, গত একমাসের মধ্যে অন্য আর কেউ জঙ্গলে আসেনি।
আরো একটা কথা মোহনের মনে হল। জঙ্গলে যারাই আসুক, তারা সব সময়েই চেষ্টা করে মূল রাস্তার কাছাকাছি থাকতে। এই দলটা অত দূরে, ওরকম বনজঙ্গলের মাঝখানে আস্তানা গেড়েছে কেন?
মোহন নিশ্চিত—যারাই ওখানে আগুন জ্বেলে থাকুক, তারা সোজাপথে ঢোকেনি। তারা সোজা লোকও নয়। খুব সম্ভবত ওরা পোচার।
‘পোচার’ শব্দটা মনে পড়তেই মোহনের চোয়ালগুলো শক্ত হয়ে গেল। পোচার মানে চোরাশিকারি। তার বাবা এরকম কোনো পোচারের দলের হাতেই মারা পড়েনি তো? তার খুবই সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ দীর্ঘ এক বছর একলা একটা মানুষের পক্ষে সামতার জঙ্গলে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আর জংলি জানোয়ারের হাতে মরবার মানুষ মুক্তিনাথ ছেত্রি ছিল না। জানোয়ারদের মতিগতি বাবা ভীষণ ভালো বুঝতে পারত। যদি বাবা মারা গিয়ে থাকে তাহলে মানুষের হাতেই মরেছে।
এরকম হতে পারে একলা ঘুরতে ঘুরতে তার বাবা এরকম কোনো পোচারের দলের সামনে পড়ে গিয়েছিল। তখন সেই পোচারেরা হয়তো কোনো বুনো জানোয়ারকে মারবার উদ্যোগ নিচ্ছে। মোহন নিজের বাবাকে যতটা চেনে তাতে সে নিশ্চিত, সেরকম কোনো ঘটনার সামনে পড়লে তার বাবা নিজের কথা একটুও না ভেবে পোচারদের বাধা দিতে এগোবে। হয়তো সেরকমই কিছু হয়েছিল আর তখনই পোচাররা তার বাবাকে মেরে ফেলেছিল।
আপাতত মোহন ওই ধোঁয়ার উৎসের দিকে আর এক পা-ও না এগিয়ে খুব সাবধানে গাছপালার আড়াল দিয়ে নদীর বেডের দিকে নেমে গেল। মোহনের বয়স কম হলেও তার বাস্তববুদ্ধি কম নয়। সে বুঝতে পেরেছিল একা নিরস্ত্র অবস্থায় ওদের মুখোমুখি পড়ে গেলে শুধু সেই-ই যে বিপদে পড়বে তাই নয়, বিপদে পড়বে বিজিতদাদুদের পুরো দলটাই।
একটাই স্বস্তির কথা, এখান থেকে বিজিতস্যারদের ক্যাম্প-সাইটটা অনেক দূরে। হয়তো এযাত্রায় পোচারদের সঙ্গে মুখোমুখি হতে হবে না। দু-তিনদিনের মধ্যে তারা আরো দূরে চলে যাবে, আরো পূর্বদিকে। সেদিকে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের একটা বিট-অফিস আছে, ওয়াচ-টাওয়ার আছে। একবার সেই ফুলটুসি-বিটের এরিয়ায় ঢুকে যেতে পারলে তারা সকলেই নিরাপদ।
জঙ্গল পেরিয়ে হরলং নদীর তীরে এসে দাঁড়াতেই মোহনের মন থেকে সব দুশ্চিন্তা একপলকে কোথায় উড়ে চলে গেল। সে দেখল, সাদা বালির রিভার-বেডে তিনটে লাল, নীল, সবুজ নাইলন কাপড়ের টেন্ট। টেন্টগুলোর ভেতরে লণ্ঠন জ্বলছে বলে বাইরে থেকে সেগুলোকে ঠিক আকাশে উড়িয়ে দেবার ফানুস বলে মনে হচ্ছে। তিনটে টেন্টের মাঝখানের জায়গাটাতে কাঠকুটো জোগাড় করে ওরা ক্যাম্পফায়ার জ্বেলেছে।
ক্যাম্পফায়ার ঘিরে বসে আছে সিধুদা, অরিদা, ভানুদা। ওদের মধ্যে সিধুদার হাতে গিটার। অরিদা দু’টুকরো চ্যাপটা পাথর দু’হাতে তুলে নিয়েছে। সেই দুটো ঠুকে চমৎকার তালবাদ্যের আওয়াজ তুলেছে। ওদের বাজনার সঙ্গে ভানুদা ভরাট গলায় দোলা-লাগানো সুরের কি যেন একটা গান গাইছে। ওদিকে আকাশ থেকে সূর্যাস্তের শেষ রঙের ছোপটুকুও মুছে যাচ্ছে দ্রুত। দূরদূরান্ত থেকে ময়ূরের ডাক ভেসে আসছে। এই পরিবেশে বিপদের কথা মনেও আসে না। একদৌড়ে মাঝখানের বালিটুকু পেরিয়ে মোহন ওদের পাশে বসে পড়ল। তারপর গান আর গান আর গান।
বাংলা ভাষাটা মোহন খুব ভালো করেই জানে। ছোটবেলা থেকে কালচিনির ইস্কুলে পড়ছে সে। সেখানে সহপাঠীরা বেশিরভাগই তো বাংলায় কথা বলে। সেইজন্যেই ভানুদার গাওয়া গানগুলো খুব ভালো লাগছিল মোহনের। সে রবীন্দ্রসঙ্গীতও শুনেছে অনেক। কিন্তু এগুলো ঠিক রবীন্দ্রসঙ্গীত বা আধুনিক গান নয়। গানগুলোর কথা তার চেনা মনে হচ্ছিল না। তবে চেনা না হলেও খুব সুন্দর। ঠিক মনে হচ্ছিল মুখোমুখি বসে কেউ কথা বলছে।
আর থাকতে না পেরে একটা গান শেষ হওয়ামাত্র সে জিজ্ঞেস করে বসল, এই গানগুলো কার গান? কে লিখেছে, কে সুর দিয়েছে?
ওরা সবাই মিটি মিটি হাসছিল। সিধুদা হাসতে হাসতেই বলল, বুঝতে পারিসনি তো? এগুলো তোর বিজিতস্যারের লেখা গান।
মোহন এত অবাক হয়েছিল যে বলবার কথা নয়। ওই রসকষহীন লোকটা এই সুন্দর গানগুলো বেঁধেছে?
রাতে শোয়ার পর সেই কথাটাই মোহন বিজিতস্যারকে জিজ্ঞেস করল—কেমন করে পারেন?
বিজিতস্যার স্লিপিং ম্যাট্রেসের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে একটা ডায়েরিতে কি সব যেন নোট করছিলেন। এখানে বিদ্যুৎ বা ইন্টারনেটের কানেকশন নেই। তাই ল্যাপটপে কোনো কাজ করা যায় না। যা করার হাতে লিখেই করতে হয়।
মোহনের প্রশ্ন শুনে বিজিতস্যার বললেন, একটা মানুষের মধ্যে কতগুলো মানুষ লুকিয়ে থাকে, জানিস? একটা বিজিত মণ্ডল পাখির অঙ্ক কষে, আরেকটা বিজিত মণ্ডল গান বাঁধে। ভেবে দ্যাখ তো, তুইও কি একটা মোহন? না কি অনেকগুলো মোহনের যোগফল?
সারাদিনের হাঁটাহাঁটির পরে মোহনের ঘুম আসছিল। কিন্তু বিজিতস্যারের কথাটা ভাবতে ভাবতে তার চোখ থেকে ঘুম ছুটে গেল। সত্যিই তো, তার ভেতরে কটা মোহন ছেত্রি রয়েছে?
একটা মোহন সারাদিন ঝরনার ধারে বসে জলের স্রোতে শুকনো পাতা ভেসে যাওয়া দেখতে পারে। অন্য একটা মোহন, যে বইটা সে কিনতে পারবে না, স্কুলের লাইব্রেরিতে বসে সেই বইটার পাতার পর পাতা কপি করে যায়। একটা মোহন বোনকে ছেড়ে একদিনও থাকার কথা ভাবতে পারে না। আরেকটা মোহনের মনে হয় সারা জীবন ধরে শুধু এই পৃথিবীর মহান অরণ্যগুলোয় ঘুরে বেড়ায়। আফ্রিকার ভেল্ট, ব্রাজিলের রেইন-ফরেস্ট, সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা তাকে ঘুমের মধ্যেও ডাক পাঠায়।
কিন্তু আপাতত যে মোহনটা তাকে জাগিয়ে রেখেছে সে মুক্তিনাথের ছেলে মোহন। সে কেবলই তাকে বলছে, ছি ছি ছি। কেমন ছেলে তুমি? বাবা হারিয়ে গেল, আর তুমি তাকে খুঁজতে যাচ্ছ না!
বিজিতস্যার যাতে শুনতে না পান সেইজন্যে মোহন খুব আস্তে আস্তে বলল, আমি জানি বাবা তুমি বেঁচে আছো। যদিও মাকে জিজ্ঞেস করলে বলে, ওই ভয়ঙ্কর জঙ্গলে কি কেউ একা একা এক বছরের ওপর বেঁচে থাকতে পারে?
সাধারণ মানুষ হয় তো পারে না। কিন্তু তুমি তো ঠিক সাধারণ ছিলে না। ওই সামতার জঙ্গল ছিল তোমার ঘরবাড়ি। সেইজন্যেই এক বছর ওখানে কাটানো তোমার পক্ষে কোনো ব্যাপারই নয়।
শুধু জানি না তুমি কী খুঁজছ যার কথা আমাদেরও বলা যায় না।
ঠিক আছে, বলতে হবে না। আমরা কেউ তোমাকে জিজ্ঞেসও করব না। শুধু তোমাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনবো। বাড়ি থেকেই তুমি যত ইচ্ছে তোমার খোঁজাখুঁজি চালাও।
তিন
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল কত কি ভাবছিল মুনিয়া। হঠাৎই সে পাশ ফিরে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, মা, বাবা কি আকাশের তারাদের দেশে চলে গেছে?
একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে রাধিকা বলল, কি জানি! তুমি ঘুমোওনি এখনো?
না। ঘুম আসছে না। আচ্ছা মা…..!
কী বলছ?
বলছি, বাবার হাতে যে আংটিটা ছিল সেটাও কি বাবার সঙ্গে সঙ্গে ওই তারাদের দেশে চলে গেছে?
হ্যাঁ মা।
কিন্তু আর সবকিছুই যে রয়ে গেছে? বাবার ব্যাকপ্যাক, যেটা সেদিন দাদামণি নিয়ে গেল। বাবার জুতো। বাবার পাখির বইগুলো। বাবা শুধু আংটিটা কেন নিয়ে গেল?
রাধিকা এক মিনিট ভেবে জবাব দিল, ওটা তোমার বাবার হাতে খুব টাইট হয়ে আটকে গিয়েছিল তো, খুলতে পারেনি বোধহয়। না হলে, তারাদের দেশে যাওয়ার সময় কিচ্ছু নিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই।
রাধিকা বুঝতে পারে বাবার আঙুলের ওই ঝুটো পাথরের আংটিটার কথা মুনিয়ার মনে থেকে গেছে। জল্পেশের মেলা থেকে একশো টাকা দিয়ে ওই হলুদ পাথরের আংটিটা মুক্তিনাথ শখ করে কিনেছিল। সস্তার জিনিস হলেও ওটা দেখতে বেশ অদ্ভুত ছিল। হালকা হলুদ রং। মাঝখানে আবার সবজেটে একটা আভা। আংটিটা খুব প্রিয় ছিল মুনিয়ার বাবার। সারাক্ষণ হাতে পরে থাকত। মুনিয়া আর মোহনকে মজা করে ওই আংটিটা নিয়ে নানারকমের উদ্ভট গল্পও শোনাত। সেইজন্যেই মেয়ের ওটার কথা এত বেশি করে মনে পড়ে। মাঝেমাঝেই আংটিটার কথা বলে মুনিয়া। সেরকম একটা গল্প মনে পড়ছিল রাধিকার।
ডুয়ার্সের কোন জঙ্গলে নাকি বাঘ শিকার করতে এসেছিলেন রাজস্থানের মহতাবগড়ের মহারাজা সুমেধ সিং। তাঁর সঙ্গী হয়েছিল মুক্তিনাথ ছেত্রি। রাজামশাই জেদ ধরলেন, হাতির পিঠে চেপে কিম্বা মাচানে বসে নয়, তিনি পায়ে হেঁটে বাঘ শিকার করবেন।
মুক্তিনাথ যতই বোঝায়, অমন বিপজ্জনক কাজ করবেন না মহারাজ, ডোরাকাটা বাঘের মতন চালাক জন্তু আর নেই। কখন যে পেছন থেকে এসে আপনাকে অ্যাটাক করবে, বুঝতেও পারবেন না।
শুনে তো মহারাজ জঙ্গল কাঁপিয়ে খুব একচোট হা হা করে হাসলেন। তারপর ডানহাতটা মুক্তিনাথের নাকের সামনে তুলে ধরলেন। ডানহাতের অনামিকায় এত বড় হলুদ হিরের আংটি। তার আলোর ছটায় মুক্তিনাথের চোখে ধাঁধা লেগে যায় আর কি।
মহারাজা সুমেধ সিং বললেন, দেখেছ? কী বলো তো এটা।
মুক্তিনাথ কিন্তু কিন্তু করে বলল, আমরা গরিব মানুষ মহারাজ। রত্ন-টত্ন কি আর চোখে দেখেছি, যে নাম বলতে পারব? তবে দেখে তো হলুদ হিরেই মনে হচ্ছে।
মহারাজ তাই শুনে আরেক দফা ঠা ঠা করে হাসলেন। বাংলোর বাইরে একপাল বাইসন চরে বেড়াচ্ছিল। তারা সেই হাসির আওয়াজ শুনে চার পা তুলে দৌড় লাগাল।
কোনোরকমে হাসি থামিয়ে মহারাজ বলেন, হিরে নয়, হিরে নয়। ইয়োসিন প্লিস্টোসিন যুগে পৃথিবীতে তরোয়াল-দন্তী বাঘেরা ঘুরে বেড়াত, জানো কি? ইংরিজিতে তাদের বলা হয় sabre toothed tiger। এখনকার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের চারগুণ বড় শরীর ছিল তাদের। আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল ওপরের চোয়াল থেকে বেরিয়ে থাকা দুটো তরোয়ালের মতন বড় দাঁত। ওই দাঁত দিয়ে তরোয়াল-দন্তীরা ম্যামথের হৃদপিণ্ড ফুটো করে দিত। এটা হচ্ছে তাদেরই একজনের চোখের ফসিল। পৃথিবীতে এ জিনিস এখনো অবধি দুটি খুঁজে পাওয়া গেছে। একটা বাঘেরই দুটো চোখ। একটা আছে আমার কাছে, আর অন্যটা ছিল জিম করবেট সাহেবের কাছে। তাঁর মৃত্যুর পর সেটা কোথায় হারিয়ে গেছে জানি না। এই পাথুরে চোখের গুণ কী জানো?
মুক্তিনাথ শুকনো মুখে ঘাড় নাড়ল।
এই চোখ যে শরীরে ধারণ করবে, জাগুয়ার হোক, লেপার্ড হোক, চিতা হোক কিম্বা রয়াল বেঙ্গল, পৃথিবীর কোনো বাঘ তার গায়ে একটা আঁচড়ও কাটবে না। সে সামনে এলেই বাঘেরা সুড় সুড় করে পালাবার পথ খুঁজবে। কাজেই আমার ভালোমন্দ নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না মুক্তিনাথ। কাল সকালেই তুমি আর আমি ঘাসবনে বাঘ শিকার করতে যাচ্ছি। ইয়েস, পায়ে হেঁটে।
মোহন আর মুনিয়া চোখ গোলগোল করে বলত, তারপর?
পরদিন সকালে মহারাজ তেলেভাজা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারছিলেন। আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বললেন, তোমার কাছে অস্ত্রশস্ত্র কী আছে?
আমি বললাম, একটা কুকরি ছাড়া কিছুই নেই।
মহারাজ হাতটাত না মুছেই চেয়ারের পাশ থেকে একটা গাদা বন্দুক তুলে আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটা রাখো। তোমাকে এটা আমি উপহার দিলাম। আজকে তো আমি সঙ্গে আছি, তোমার বন্দুক-কুকরি কিছুই লাগবে না। তবে পরে এটা দিয়ে পাখি-টাখি শিকার কোরো।
আমি বন্দুকটা মাথায় ঠেকিয়ে বললাম, হুজুরের জয় হোক।
তারপর তো আমরা সেই বাঘের বাসা ঘাসবনে ঢুকে পড়লাম। সত্যি বলছি, তখন আমার গা-হাত-পা থরথর করে কাঁপছিল। ঘাসবনে সড়সড় করে শব্দ হলেই মনে হয় ওই বুঝি বাঘটা পেছু নিয়েছে। এই করতে করতে….।
কী হল?
বাঘটা ঘাসবনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল। শুকনো ঘাসের সঙ্গে তার শরীরের হলুদ-কালো ডোরা এত সুন্দর মিশে গিয়েছিল যে, পাঁচহাত দূর থেকেও তাকে দেখতে পাইনি।
তারপর?
বাঘটা কিছুক্ষণ অগ্নিদৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। সেই সঙ্কটের মুহূর্তেও আমার মনে পড়ছিল মহারাজের হাতে তো বাঘের চোখের আংটি রয়েছে, তাঁকে তো বাঘে ছোঁবে না। তাহলে আমাকেই নিয়ে যাবে নিশ্চয়।
ছেলে-মেয়ের মুখের অবস্থা দেখে তখন করুণা হত রাধিকার। কেঁদে ফেলে আর কি। কোনোরকমে শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করত, তারপর? বাঘটা তোমাকে নিয়ে গেল?
দূর বোকা! তাহলে তোদের সামনে বসে গল্প বলছি কী করে? বাঘটা ধীরেসুস্থে মহারাজের টুঁটিটা কামড়ে ধরে এক লাফে আবার ঘাসবনের ভেতর মিলিয়ে গেল। আমি সম্বিত ফিরে পেয়েই চোঁ চাঁ দৌড় দিয়ে একেবারে বাংলোর উঠোনে এসে অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। যখন জ্ঞান ফিরল তখন প্রথমেই মনে হল, ব্যাপারটা কী হল? মহারাজকে বাঘে ধরল কেমন করে? তাহলে কি বাঘের চোখের আংটি-টা মহারাজ নিতে ভুলে গিয়েছিলেন?
হঠাৎ আমার হাতে ধরা গাদা বন্দুকটার দিকে নজর পড়তেই সব হিসেব মিলে গেল। দেখি কি বন্দুকের ট্রিগারের সঙ্গে আটকে আছে আংটিটা। আর বন্দুকটা ছিল আমার হাতে। তাহলে বাঘ আর আমাকে ধরে কেমন করে? ধরল আংটিছাড়া সুমেধ সিংকেই। আসলে হয়েছিল কি, তেলেভাজা খেতে খেতে যখন মহারাজ আমার হাতে বন্দুকটা তুলে দিলেন তখনই তেলে স্লিপ করে আংটিটাও আঙুল থেকে খুলে বেরিয়ে এসেছিল। সেটা তিনি আর খেয়াল করেননি।
ছোট্ট মুনিয়া হাত বাড়িয়ে মুক্তিনাথের আঙুল থেকে আংটিটা খুলে নিয়ে বড় বড় চোখ করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখত। আংটির পাথরটা দেখে দেখে তার আশ মিটত না।
আজ এতদিন পরে কি জানি কেমন করে তার আবার বাবার সেই আংটিটার কথা মনে পড়ে গেছে। কেমন করে মনে পড়েছে, সেটা অবশ্য মুনিয়ার পরের কথাতেই পরিষ্কার হয়ে গেল। মুনিয়া বলল, আংটিটা থাকলে ওটা দাদামণিকে পরিয়ে দিতাম। তাহলে জঙ্গলে আর কোনো ভয় থাকত না দাদামণির। কেন যে বাবা ওটা নিয়ে গেল!
মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে রাধিকা বলল, একদিন তোর বাবা ওটা ঠিক ফেরত দিয়ে যাবে।
কেমন করে দেবে? বাবা কি আসবে?
না, বাবা তো আসতে পারবে না, তবে স্বর্গ থেকে যে হাঁসেরা আসে তাদের কারুর সঙ্গেই ওটা নিশ্চয়ই ফেরত পাঠিয়ে দেবে।
উত্তেজনার চোটে বিছানায় উঠে বসল মুনিয়া। বলল, মা, ওই যে আকাশে তিরের ফলার মতন লাইন করে প্রতিবছর পাহাড় ডিঙিয়ে যে হাঁসেরা আসে, ওরা স্বর্গ থেকে আসে? ওরা বাবাকে দেখতে পায়?
হ্যাঁ পায়। তুমি এখন লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো তো।
ঘুম কি আসে? মুনিয়া শুয়ে শুয়ে শুধু ভাবে, বাবার সঙ্গে যোগাযোগের এত ভালো একটা উপায় থাকতেও দাদামণি কিম্বা মা যে কেন সেটাকে কাজে লাগাচ্ছে না? অনেক রাতে ঘুমিয়ে পড়ল বটে মুনিয়া, কিন্তু পরদিন সকালে ইস্কুলে যেতে যেতে হঠাৎই সে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার সঙ্গে অন্য যে মেয়েরা হাঁটছিল তারা বলল, কী হল রে?
মুনিয়া বলল, আমার বড্ড পেটে ব্যথা করছে। আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। তোরা এগো।
মুনিয়ার বন্ধুরা পথের বাঁকে মিলিয়ে যেতেই মুনিয়া বাড়ির দিকে না গিয়ে সামতা ফরেস্টের গেটের দিকে হাঁটা লাগাল। গেট দিয়ে সে ঢুকল না অবশ্য। একটু দূরে তারের বেড়ার গায়ে একটা ফাঁক আছে। সেটার কথা চিতলভাসার সব বাচ্চাই জানে কারণ, বনের মধ্যে চেরি কিম্বা বুনো আপেল কুড়োতে হলে ওরা ওই ফাঁকটা দিয়েই জঙ্গলে ঢোকে। আজকেও মুনিয়া ওখান দিয়েই ঢুকল, তবে চেরি কিম্বা বুনো আপেলের গাছের দিকে না তাকিয়ে সোজা হেঁটে চলল।
মুনিয়া জানে ওই জঙ্গলের মধ্যে বিরাট একটা লেক আছে। রাস্তাটাও চেনে। কিন্তু জানতো না যে, বছরের একটা সময় ওই লেকের জলেই হিমালয় পেরিয়ে হাঁসেরা আসে, তারা ওই লেকের জলে সাঁতার কেটে বেড়ায়, তারপর আবার পাহাড় ডিঙিয়ে ওদিকের দেশটায় ফিরে যায়। লেকটাতে তাকে পৌঁছতে হবে। আজকেই।
ওখানে গেলে মুনিয়ার সঙ্গে নিশ্চয়ই হাঁসেদের দেখা হবে। তাহলে ও হাঁসেদের কাছ থেকে বাবার আংটিটা তো নেবেই, ওদের মুখ দিয়েই বাবাকে একটা চিঠিও পাঠিয়ে দেবে। আজ সকালেই অঙ্ক খাতার পেছনের পাতায় সেই চিঠিটা সে লিখে এনেছে। চিঠিটা তার স্কুল ব্যাগের মধ্যেই রয়েছে। ওটাতে সে লিখেছে—”বাবা, তোমার জন্যে আমার বড্ড মন কেমন করে। তুমি পারলে একবার এসো। দাদামণি বাড়ি ফিরছে না। ওর জন্যেও আমার বড্ড ভয় করছে। মায়েরও ভয় করছে। মা কাল রাত্তিরেও লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছিল। আমি শুনে ফেলেছি। তোমার সেই বাঘের চোখের আংটিটা পেলে দাদামণি জঙ্গলে গেলেও আমাদের আর ভয় করবে না। আংটি-টাই তো ওকে বাঘের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখবে, তাই না? ইতি তোমার মামণি।”
ঘণ্টাদুয়েক হাঁটার পরে মুনিয়া ঝিলটার ধারে পৌঁছে গেল। স্বাভাবিক অবস্থায় মুনিয়া এই ভয়ঙ্কর নির্জন ঝিলের ধারে কিছুতেই আসত না। তার প্রচণ্ড ভয় করত। কিন্তু কাল রাত থেকে সে এক স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে রয়েছে, একটা হাঁসের স্বপ্ন—যে স্বর্গ থেকে নিয়ে আসবে তার বাবার আংটি।
ঝিলের ধারে শরবনের মধ্যে লুকোনো একটা জায়গায় মুনিয়া হাঁসটাকে দেখতে পেল। দুটো বাঁশের মধ্যে বাঁধা খুব উঁচু একটা জালের মধ্যে আটকা পড়েছে হাঁসটা। সেখানেই ঝটপট করছে। তার পায়ে বাবার আংটি। মুনিয়া তো অবাক। এ তো তার আংটি। তার জন্যে বাবা পাঠিয়েছে। এই হাঁসটাকে কেন কেউ অত উঁচুতে আটকে রাখবে? রাগে-দুঃখে চোখে জল চলে এল মুনিয়ার। সমস্ত ক্লান্তি ভুলে সে পেছন ফিরে দৌড়ল। থামল একেবারে বিশাইদাদুর বাড়ির সামনে গিয়ে। ডাকল, বিশাইদাদু, বিশাইদাদু! শিগ্গির চলো।
চার
মুনিয়ার মতন মোহনেরও তেষ্টা পাচ্ছিল। ভয়ঙ্কর তেষ্টা। দু’দিন ধরে হাত- পা বাঁধা অবস্থায় একটা গুহার মেঝেতে পড়ে থাকলে যেরকম তেষ্টা পায় সেরকম তেষ্টা।
শুধু তেষ্টা নয়, খিদেও। দু’দিন আগে শেষবার সে এক প্লেট নুডলস খেয়েছিল। খাওয়া শেষ করে যখন সে প্লেটটা নিয়ে ক্যাম্পের পেছনে ঝোরার জলে ধুতে গেছে, তখনই সে দেখতে পেয়েছিল সেই গা হিম করে দেওয়া দৃশ্যটা। সে বোকার মতন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। সেটাই ভুল হয়েছিল। সে যদি তখন চুপচাপ টেন্টে ফিরে আসত, তাহলে পরে কোনো একসময় নিশ্চয়ই লোকগুলোকে কবজা করতে পারত।
মোহন ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। পিঠের কাছে ঠিক তারই মতন পিছমোড়া অবস্থায় বসে আছে যে লোকটা তাকে দেখে মনে হচ্ছে না তার কোনো কষ্ট হচ্ছে। এইজন্যেই মুক্তিনাথ ছেত্রি সবার থেকে আলাদা। এইজন্যেই তার বাবা এক বছর ধরে একা সামতার জঙ্গলে বেঁচে থাকতে পারে। এত কষ্টের মধ্যেও মোহনের হাসি পেল। সে যেটা বোঝে, মা সেটা বুঝতে পারল না কেন কে জানে! খালি বলবে বাবা মরে গেছে, আর চোখের জল ফেলবে।
বাবাও ঠিক তখনই মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। মোহনের চোখে চোখ পড়তেই একগাল হাসল। এক বছর বাদে তারা দুজনে দুজনকে দেখছে। এই এক বছরে বাবা অনেক রোগা হয়ে গেছে। সারা মুখে গোঁফদাড়ির জঙ্গল। চুলগুলো বাড়তে বাড়তে ঘাড় অবধি লুটিয়ে নেমেছে। কিন্তু এক বছর জঙ্গলবাসের ফলে শরীরটা যেন আগের থেকেও অনেক শক্ত হয়ে উঠেছে। গেঞ্জির ফাঁক দিয়ে বাবার কাঁধ আর হাতের পাকিয়ে ওঠা পেশিগুলো দেখতে পাচ্ছিল মোহন।
মোহন! বাবা আস্তে করে ডাকল। খুব কষ্ট হচ্ছে বেটা?
মোহন ঘাড় নাড়ল।
মোহনের মাথাটা আবার বুকের ওপর লুটিয়ে পড়ল। আচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যে তার মাথায় বারবার ভেসে আসছিল পরশুর সেই ছবিটা। তখন দুপুর দুটো-টুটো বাজে বোধহয়। খাবারের প্লেটটা ধোবার জন্যে ক্যাম্পের পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে দেখতে পেল সিধুদা, অরিদা, ভানুদা আর বিজিত মণ্ডলের উল্লাস। ওদের মধ্যে ভানুদা আর সিধুদার হাতে একটা করে জ্যান্ত রেড পান্ডা ছটফট করছে।
কাল পাশের ওই বাঁশের জঙ্গলের মধ্যে ওরা ফাঁদ বসিয়েছিল। সেই ফাঁদেই ধরা পড়েছে বেচারা পান্ডাদুটো।
মোহন জানে গত দশ-পনেরোদিনে ওরা এইভাবে বেশ কয়েকটা দুষ্প্রাপ্য হর্নবিল, মানে ধনেশপাখি, প্যাঁচা, ফেজ্যান্ট, আর জায়ান্ট স্কুইরেল ধরেছে। মোহনের ব্যাপারটা একটুও ভালো লাগেনি। ফাঁদ দিয়ে জন্তু ধরা কেন? জন্তু বা পাখিকে দু’চোখ ভরে দ্যাখো, তাদের ছবি তোলো। তোমার রিসার্চের কাজে দরকার পড়লে তাদের সংখ্যা গুনে নাও, কোথায় কখন দেখতে পেলে নোটবুকে টুকে রাখো। কিন্তু ধরার দরকার কী?
তার আরো খারাপ লেগেছে কারণ, প্রত্যেকটা জন্তু বা পাখিকে সে নিজে ধরেছে। এই লোকগুলো কেমন বৈজ্ঞানিক সে জানে না, কিন্তু গত কয়েকদিনে সে বুঝেছে এরা কোনো জন্তুর স্বাভাবিক বাসস্থান, স্বভাব, খাদ্য কিছুই জানে না। শুধু জন্তুর নামটাই জানে। কোন খাবার দিয়ে দিনের কোন সময়ে কোথায় ফাঁদ পাতলে জন্তু বা পাখিটা ধরা পড়বে তার জন্যে ওদের পুরোপুরি নির্ভর করতে হয়েছে মোহনের ওপর।
মোহনের রাগ দেখে বিজিতস্যার ওকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, জন্তুগুলোর ব্লাড-স্যাম্পল নেওয়ার দরকার পড়েছে। ব্লাড নিয়েই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু কোথায়? একটাও পাখি বা জন্তুকে ওরা ছাড়েনি। তাদের কারুর ব্লাড-স্যাম্পেল নিতেও দেখেনি মোহন। ছোট ছোট কাঠের বাক্সের মধ্যে দুমড়ে-মুচড়ে ওদের আটকে রেখেছে। কালকেই একটা বড়ো ধনেশ পাখি বাক্সের মধ্যে মারা পড়েছে। আরেকটার অবস্থাও খুব খারাপ। সেটাও ঝিমোচ্ছে।
মোহন বুঝতে পারছিল, এই লোকগুলো সুবিধের লোক নয়। ডব্লিউ ডব্লিউ টির বৈজ্ঞানিক তো নয়ই। এরা জঙ্গলের কিচ্ছু চেনে না।
দু’দিন আগেই ভোরবেলার দিকে মোহন চুপি চুপি টেন্ট থেকে বেরিয়ে পালাতে যাচ্ছিল। কিন্তু বেরিয়েই সে অরিদার মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল। হাতে একটা রাইফেল নিয়ে একটা পাথরের ওপর বসেছিল অরিত্রদা। মোহনকে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরোতে দেখে একগাল হেসে বলল, এত ভোরে কোথায় চললে, মোহনভাই?
মোহন অবাক হয়ে ভাবল, তার মানে এরা সারারাত পালা করে পাহারা দেয়! কিন্তু কেন? তাকে আটকে রাখার জন্যে?
অরিদার প্রশ্নের উত্তরে সে থতমত খেয়ে বলল, না, না, মনকেমন নয়। আসলে বাড়িতে বাবার একটা ভালো পাখির বই আছে। ভাবছিলাম ওটা নিয়ে আসব। অনেক পাখিই চিনতে পারছি না।
অরিদার মুখের চেহারা মুহূর্তের মধ্যে বদলে গিয়েছিল। কঠিন গলায় বলেছিল, পাখি চেনার দরকার নেই। চুপচাপ টেন্টে ঢুকে যাও। আমরা যে যে পাখি বলব, সেগুলোকে ধরে দিলেই হবে।
টেন্টে ফিরে যেতে যেতে তখনই মোহন ভেবেছিল, সত্যিই তো। এই লোকগুলো শুধু সেই সেই পাখি কিম্বা জন্তুই ধরছে যেগুলোর চিনের চোরাবাজারে দাম আছে। চিন এখান থেকে বেশি দূর নয়। ওখানে ফেজ্যান্ট, হর্নবিল আর নানান জাতের প্যাঁচার আকাশছোঁয়া দাম। ওখানে এইসব প্রাণীর শরীর থেকে বানানো ওষুধের চাহিদা খুব বেশি। নিজেদের জঙ্গলের জন্তুজানোয়ার সাফ করে ওরা এখন ভারতের জঙ্গলের দিকে হাত বাড়িয়েছে। এইসবই বাবার কাছ থেকে শুনেছিল মোহন।
রাগে-দুঃখে মোহনের কান্না আসে। সে পরিষ্কার বুঝতে পারে, না জেনেই সে একটা জন্তুজানোয়ারের চোরাচালান-চক্রের মধ্যে পড়ে গেছে। সেও এই পাপের ভাগী হয়ে যাচ্ছে।
সেইদিনই দুপুরে পান্ডা ধরার ব্যাপারটা ঘটল। মোহন আর সহ্য করতে না পেরে ভানুদার মাথা টিপ করে হাতের থালাটা ছুঁড়ে মেরেছিল। মোক্ষম জায়গায় মার খেয়ে ভানুদা ঘুরে পড়ে গেছিল আর তখনই ওর হাতে ধরে থাকা জন্তুটা ছাড়া পেয়ে সড়সড় করে উঠে পড়েছিল পাশের একটা বড় গাছে। হারিয়ে গিয়েছিল ডালপালার আড়ালে।
বিজিত মণ্ডল মুহূর্তের মধ্যে পকেট থেকে একটা বিভলবার বার করে মোহনের মাথার দিকে তাক করেছিলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিলেন, খুনই করে ফেলব এটাকে। কত লাখ টাকা পেতাম কে জানে জন্তুটাকে বিক্রি করে। এর জন্যেই সব হারালাম।
হয়তো বিজিত মণ্ডল সত্যিকারেই গুলি চালিয়ে দিতেন, যদি না অরিত্র বলে ছেলেটা ছুটে এসে তার হাত চেপে ধরত। অরিত্র বলেছিল, করছেন কী? আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এই শান্ত জঙ্গলের মধ্যে ফায়ারিং-এর শব্দ কতদূর ছড়িয়ে পড়ে জানেন? এক্ষুনি ফরেস্ট গার্ডদের হাতে ধরা পড়ে যাব যে।
তাহলে কী করব একে নিয়ে? আমাদের যেতে তো আরো দু’দিন। তার মধ্যে এই বিচ্ছুটা কখন পালিয়ে গিয়ে লোকজন ডেকে আনবে বলা যায়?
অরিত্র ছেলেটার মাথাতেই শয়তানি বুদ্ধি সবচেয়ে ভালো খেলে। সে হাসতে হাসতে বলল, কেন? ওর বাবার পাশে ওকে রেখে আসুন না।
মোহন কথাটা বুঝতেই পারেনি। বাবাকে আবার ওরা পেল কোথায়?
বুঝতে পারল, যখন ওকে টেনে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে আধ কিলোমিটার দূরে একটা পাহাড়ের গুহার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে এল। সেখানেই হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়েছিল তার বাবা, মুক্তিনাথ ছেত্রি।
মুক্তিনাথের কাছেই শুনেছিল মোহন এই গ্যাঙটার কার্যকলাপের কথা। এদের হাত থেকে বন্যজন্তুদের বাঁচানোর জন্যেই মুক্তিনাথের এতদিনের অজ্ঞাতবাস। মুক্তিনাথকে এই গ্যাঙটার কথা বলেন ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্টের কর্মকর্তা সেই উদয় কার্গে সাহেব। মুক্তিনাথকে খুব ভালোবাসতেন তিনি। জানতেন, মুক্তিনাথ পশুপাখিদের জন্যে যে কোনোরকম ত্যাগ স্বীকার করতে পারে। তাই তাকেই তিনি বলেন ডব্লিউ ডব্লিউ টির অসহায় অবস্থার কথা।
বলেন, তাঁদের ঘোরতর সন্দেহ যে, তাঁদেরই অফিসারদের নাম করে চোরা-চালান চক্রের লোকজন জঙ্গলে ঢুকে পড়ছে। নিখুঁত আইডেন্টিটি কার্ড নকল করে নিয়েছে ওরা। কিন্তু তারা কারা সেটা গোপনে খুঁজে বার করতে হবে। গোপনীয়তা দরকার এইজন্যেই যে ডব্লিউ ডব্লিউ টির সঙ্গে যাঁরা জড়িত তাঁরা কেউই সামান্য লোক নন। সকলেই প্রায় বৈজ্ঞানিক এবং প্রকৃতিপ্রেমী। বিশ্বজোড়া তাঁদের সুনাম। ফলে তাঁদের যদি সরাসরি চ্যালেঞ্জ করা হয়, তাহলে ব্যাপারটা ভালো হবে না।
মুক্তিনাথ সেই কর্মকর্তাকে কথা দিয়েছিল সে খুঁজে বার করবে কারা এই চোরাচালান চালাচ্ছে। তারপর থেকেই সে সামতার জঙ্গলে লুকিয়ে বসে থাকে। আড়ালে থেকে লক্ষ রাখে কোন দলের কাজকর্ম কী ধরনের। দেখতে দেখতে তার নজরে পড়ে যায় জীবন্ত পশুপাখির চোরা-চালানের থেকেও বড় এক অপরাধ।
মুক্তিনাথের চোখে পড়ে এই সামতা বনের বিশাল ঝিলে যে পরিযায়ী হাঁসেরা প্রতিবছর হিমালয়ের ওপাশের দেশটা থেকে উড়ে আসে, এখান থেকে ফিরে যাবার সময় তাদের কয়েকটার পায়ে ক্যামেরা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। কারণটা বুঝতে মুক্তিনাথের সময় লাগে না, কারণ সে এই সীমান্ত অঞ্চলের খুঁটিনাটি সমস্তই জানে। জানে পরিযায়ী হাঁসেরা বছরের পর বছর যে নির্দিষ্ট আকাশপথ ধরে উড়ে যায়, উড়ে আসে তার হদিশও। এই আকাশপথের নীচেই রয়েছে ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা মিলিটারি ক্যাম্প।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর রাডারের নজর এড়িয়ে কোনো বিদেশি বিমানের পক্ষে ওই আকাশসীমায় উড়ে আসা অসম্ভব। অনেক আগেই ভারতের অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফট গান তাদের গুলি করে নামিয়ে আনবে। কিন্তু পরিযায়ী হাঁসেদের আটকাবে কে? তাই তাদের পায়েই ছোট কিন্তু শক্তিশালী ক্যামেরা বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সীমান্ত পেরিয়ে তারা বিদেশি রাষ্ট্রের কোন জলায় নামবে তাও সকলেরই জানা। সেখান থেকেই ওই হাঁসেদের ধরে তাদের পা থেকে ক্যামেরা খুলে নিলেই হাতে চলে আসবে ভারতের সেই সব গুরুত্বপূর্ণ মিলিটারি-ক্যাম্পের ডিটেইলস। পরে হয় তো যুদ্ধের সময় বিমান হানার কাজে লাগবে ওইসব আকাশ থেকে তোলা ছবি।
এই কাজটাই করছিল বিজিত মণ্ডল আর তার দলবল।
দুর্ভাগ্যক্রমে গত পরশুই যখন মুক্তিনাথ এরকম একটা পায়ে ক্যামেরা বাঁধা হাঁসকে জালে ধরে তার পায়ের ক্যামেরটা পরীক্ষা করে মিলিয়ে নিতে যাচ্ছে তার ধারণা সত্যি কি না, তখনই বিজিত মণ্ডলরা তাকে দেখে ফেলে। নিরস্ত্র মুক্তিনাথকে কবজা করতে তাদের সময় লাগে না। হয়তো মুক্তিনাথকে পরে তারা খুন করবে। আপাতত ওই গুহায় তাকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখেছে।
এই অবধি শুনে মোহন মনে মনে শিউরে উঠল। তাকেও বাঁচিয়ে রাখা মানে অনর্থক একজন সাক্ষীকে বাঁচিয়ে রাখা। কেনই বা বিজিত মণ্ডলের দলবল তাকে বাঁচিয়ে রাখবে? তার মানে তাকে আর বাবা-কে একইসঙ্গে ওরা খুন করবে?
আরো একটা কথা না ভেবেই পারল না মোহন। একজন বিজিত মণ্ডলের মধ্যে কতজন বিজিত মণ্ডল লুকিয়ে আছে। একজন গান বাঁধে, একজন অঙ্ক কষে। আর একজন পাশুপাখি চোরাচালানের গ্যাং-লিডার। লোভ কি মানুষকে এতটাই নামিয়ে দিতে পারে?
পাঁচ
গুহার মুখটা খুব ছোট। লম্বা-চওড়ায় বড়জোর সাত-আট ফুট হবে। মোহন একবার মাথা উঁচু করে দেখল এতক্ষণ সেখানে যে আলোটুকু ছিল সেটা আস্তে আস্তে নিভে যাচ্ছে। তার মানে রাত নামছে। আরো একটা রাত। কাল সকালের আলো কি ও আর দেখতে পাবে? নাকি তার আগেই ওরা ফিরে আসবে?
গুহার মুখে একটা ছায়া পড়ল। অনেকগুলো কুকুরের ডাক ভেসে এল। কুকুর নাকি নেকড়ে?
মুক্তিনাথ ছেত্রির মুখেও আতঙ্কের ছায়া দেখতে পেল মোহন। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নেকড়ের কামড়ে মরাটা নিশ্চয় সুখের ব্যাপার নয়। কিন্তু এই জঙ্গলে নেকড়ে আছে বলে সে তো জানে না।
না নেকড়ে নয়, কুকুরই। চারটে ডোবারম্যান কুকুর লকলকে জিভ বার করে ওদের দুজনকে ঘিরে ধরল। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল মুক্তিনাথ আর মোহন। ওরা ততক্ষণে দেখে নিয়েছে চারটে কুকুরের গলার বকলস ধরা রয়েছে চারজন ইউনিফর্ম পরা লোকের হাতে। ইন্ডিয়ান আর্মির ইউনিফর্ম।
প্রায় অচেতন মোহনের কানে এবার অন্য একটা শব্দ পৌঁছাল। একটা বাচ্চা মেয়ে কান্না জড়ানো গলায় ডাকছে—দাদামণি, দাদামণি!
মোহন তার অবশিষ্ট শক্তিটুকু জড়ো করে উঠে বসল। তারপর বোনের বাড়িয়ে ধরা দুটো হাতের মধ্যে নিজের মুখটা গুঁজে দিল।
ভয় নেই। ভয় নেই মোহন। আর কেউ তোমাদের ধরে রাখতে পারবে না। মুনিয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে যে বয়স্ক মানুষটি এই কথা বললেন, তাঁকে দেখে মুক্তিনাথের মুখে হাসি ফুটে উঠল। উনি উদয় কার্গে, ডব্লিউ ডব্লিউ টির রিজিওনাল হেড।
মুনিয়া আর কার্গে সাহেবের পেছনে পেছনে আরো অনেক লোকজন ঢুকে এল গুহার ভেতরে। বিশাইদাদু আর চিতলভাসার অন্য কয়েকজন গ্রামবাসী। তাদের সকলের মুখেই যুদ্ধজয়ের হাসি।
কার্গে সাহেব বললেন, মুক্তিনাথ ছেত্রি, তুমি সারা জীবনে কোনো অন্যায় করোনি। তার জন্যে ভগবান তোমাকে সবচেয়ে বড় পুরস্কার কী দিয়েছেন জানো? তোমার এই ছেলে আর ওই মেয়ে। দে আর ব্রেভ হার্টস। বোথ অফ দেম। মুনিয়া যদি ওই হাঁসটাকে নিয়ে জঙ্গল থেকে বাড়ি ফিরে না যেত তাহলে আমরা জানতেও পারতাম না তুমি এখানে এই অবস্থায় পড়ে রয়েছ। বিশাই মোড়ল আমাকে যোগাযোগ করা মাত্র আমি লোকজন নিয়ে তোমাদের গ্রামে পৌঁছে গেলাম। দেখলাম হাঁসের পায়ে বাঁধা বিদেশে বানানো শক্তিশালী ক্যামেরাটাকে। আমার আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না। তারপর মুনিয়াই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো এখানে। বাকি কৃতিত্ব অবশ্য আর্মির স্নিফার ডগদের।
মুনিয়া ততক্ষণে একবার দাদামণিকে আর একবার তার বাবাকে জড়িয়ে ধরছে। তাকে কোনোরকমে সরিয়ে আর্মির এক জওয়ান মোহন আর মুক্তিনাথের হাত-পায়ের বাঁধন কেটে তাদের ধরে ধরে বাইরে নিয়ে গেল। ঘণ্টাখানেকের যত্ন-আত্তিতে তারা সেরেও উঠল।
বাড়ি ফেরার পথে মুনিয়া এক হাতে বাবার আর অন্য হাতে দাদামণির আঙুল ধরে হাঁটছিল। মুক্তিনাথ চুপি চুপি মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, মামণি, হাঁসটা অত কষ্ট করে তোমাকে তোমার বাবার আংটিটা স্বর্গ থেকে এনে দিল, আর সেটা তুমি কার্গে আঙ্কলকে দিয়ে দিলে? তোমার দুঃখ হল না?
বাবার আঙুলে হলুদ পাথর বসানো আংটিটা নিয়ে খেলা করতে করতে মুনিয়া লাজুক মুখে বলল, হ্যাট, মিথ্যুক।
___
সমাপ্ত