মুখ – ৮

সবাই স্তব্ধ, স্তব্ধ।

—এবার আমাকে লেখা চিঠিটা শোন।

রূপা পড়তে তাকে। সুজয় এখন মাথা রাখে নিজের হাতে। বস খুব নিশ্চল।

চিনু চার্মস ধরায়।

রূপার চিঠিটা পড়া শেষ হয়।

সুপ্তি বোস কাঁদছেন, মার জন্যে কষ্ট হয়, মার জন্যে করুণা হয়। গোপা, গোপা, গোপা!

রূপা চিঠি ও ছবি ব্যাগে ভরে।

—এবার?

সুজয় মুখ তোলে।

—এবার কি? ফাইন! গোপা একা থাকছে, গোপা স্বাধীন হচ্ছে, চমৎকার উপসংহার।

ঋষি গলা সাফ করে।

—উপসংহারটা ওভাবে হয়নি সুজয়।

—বলুক, পুলিশ রিপোর্টার বলুক।

—বলছি। গোপা কোথায় গেছে তুমিও জানতে না।

সম্ভবত গোয়েন্দা এজেন্সির সাহায্যে ওর ওপর নজর রাখছিলে। বস কি মনে করেন?

বস রক্তাক্ত ঘোলাটে চোখ থেকে হাত সরান। সুজয়ের দিকে তাকান।

—রাখছিল। আমায় বলেছে।

—একশো বার রাখব। আমার বউ আমার মুখ হাসিয়ে একটা তিন পয়সার কেরানীর সঙ্গে ঘুরবে? আমি ডিভোর্স করব বলে খবর নিচ্ছিলাম।

ঋষি একটু থেমে থেমে কথা বলে।

—ডিভোর্স করতে ওকে?

—অবশ্যই।

—মনে হয় না। তুমি এবং বস, তোমাদের যা সম্পর্ক, বসের মেয়েকে ডিভোর্স তুমি করতে না।

—তার আগেই তো ”ডিভোর্সের চিঠি পাবে” লিখে গোপা চলে গেল না?

—শুনেছি খাতার ছেঁড়া পাতার আধখানায় ওকথা লেখা ছিল। হয়তো ওরকম লেখা খাতায় লিখতই। যদ্দিন সাহস পায় নি।

—কি বলতে চাও?

ঋষি ক্লান্ত গলায় কথা বলে।

—গোপার চিঠি দেখার পর ব্যাপারটা এরকম ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। গোপা চলে যাওয়াতে তোমার অহংকারে ভীষণ লাগে। ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো তুমি ওকে খুঁজছ। কেননা ডিভোর্স তোমার ইচ্ছে নয়। তার চেয়ে ও মরে গেলে তুমি বাঁচো। তুমি বসকে ছাড়তে পার না, বসও তোমাকে ছাড়তে পারেন না। যদিও, তুমি কোন স্তরে নামতে পার তা বসও বোঝেন নি বলেই আমার মনে হয়। উনি ঠিক তুমি নন।

—না, উনি আলবার্ট সোয়াইৎজার, উনি বাবা সাহেব আমতে, আমি একা চার্লস শোভরাজ!

—সুজয়, মাত্রা ছাড়িও না।

—একশোবার ছাড়াব।

—বাস্টার্ড! বাস্টার্ড!

বস ভাঙা গলায় বলেন। ওঁর সাম্রাজ্য ভেঙে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে, গলা তো ভাঙবেই।

—আমি বলেছিলাম তুমি আমার মেয়ের পেছনে হকিং হান্ট লাগাও?

—বস! আপনার কাছে এ রকম ভুল অপ্রত্যাশিত। কথাটা হান্টিং হক, শিকারী বাজ!

—ওই হল।

ঋষি বলে, গোপা তোমাকে ছেড়ে যাওয়াতেই তুমি রাগে গোমরাচ্ছ। মেয়ে চলে গেলে বস ক’দিন খুশি থাকবে তা তুমি জানো না। তোমার ভয়। বাপ মেয়েতে যদি মিলমিশ খেয়ে যায়, তুমি আরো বিপন্ন হবে।

—চমৎকার! বলে যাও।

—আসলে তুমি কত বিপন্ন তা তুমি বুঝলে যখন রিমকি তোমায় চেপে ধরল। গোপা ওর সঙ্গে দেখা করেছে, তোমার স্বরূপ কি, তা বলে গেছে, তা জেনেছ যখন তখনি কিন্তু গোপার মৃত্যু পরোয়ানা লিখেছ তুমি। কেননা, আমার ধারণা, রিমকি তোমাকে সন্দেহ করতে থাকে, অ্যাটর্নিকে ডেকে সব বলে। এবং তোমাকে চাপ দিতে থাকে। বাড়িটা তো ওর!

—রিমকি! একটা ভদ্রলোকের বিধবা হয়ে দেওরের সঙ্গে সম্পর্ক করে… বেশ্যা একটা। আমায় বিয়ে করো। সুজয় ওকে বিয়ে করবে?

রূপা মন্ত্রমুগ্ধ। সুজয়ের মতো লোক হয়, তা ও পড়েছে বইয়ে, চোখে দেখেনি।

ঋষি বলে, তোমার মতো লোকের পক্ষে এ ভাবে ভাবাই স্বাভাবিক। রিমকিকে তুমি ব্যবহার করেছ। ওর গর্ভে তোমার মেয়ে হয়েছে, ওর বাড়িতে গেড়ে বসে আছ। সেই রিমকি বিগড়ে যাচ্ছে গোপার কথায়। তুমি আর কত সইতে পারো। গোপাকে খুন করাই সমাধান।

—ঠিক বলেছ ঋষি।

সুপ্তি বোস ও ভাস্বর একসঙ্গে কথা বলেন।

—বাড়ি তোমার নয়?

—বাবা! তুমি কি দেখেছিলে?

—মাসতুত বউদি! ছি, ছি, ছি!

—অমার্জনীয়। জঘন্য।

সুজয় বলে, কোন মহাপুরুষ তোমার বোনকে বিয়ে করত হে ভাস্বর বোস? বেশি বোক না।

ঋষি বলে, আমি শেষ করিনি।

—ও, তোমার রূপকথা।

ঋষি ঈষৎ হাসে।

—বেশ তো রূপকথাই হোক। গোপাকে খুন করবে বলে তুমি মনে মনে অন্ধ, অথচ ঠিকানা জানো না। তারপর রিমকি যখন চিঠি চার্জ করে, তখন তুমি ঠিকানা জানলে, এবং সেদিনই ট্যুর থেকে ফিরেছ। রিমকি যদি বোকা না হয়, সে চিঠির জেরকস তোমাকে দেয়, বিকেলেই তুমি সবুজ গাড়ি নিয়ে কাঁটাজুড়ি ছোটো।

—বাঃ, তারপর?

তারপর….. এমন অন্ধ তখন তুমি… রাতে ওখানে পৌঁছও। গোপা তো নতুন গোপাকে আবিষ্কার করে নির্ভীক, সাহসী তখন, ও দরজা খুলে দেয়।

—মিথ্যে কথা!

—ট্যুর থেকে তোমার সঙ্গে যে রাতুলও ফেরে। রাতুল তোমার সেক্রেটারি, আমার স্ত্রীর কি রকম ভাই, তুমি তা জানো না।

—কি? রাতুল…. তোমাকে…..

—স্বভাবতই বলেছে। এটা একটু কাকতালীয় হয়েছে। রাতুল আমার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ।। আজ সকালে ও রুদ্রকে, প্রমিস করা ”সুপারম্যান” খেলনা পৌঁছতে এসেছিল। খেলনাটা কেনার সময়ে বম্বেতে তুমি তো গাড়িতে বসেছিলে।

—কোনো প্রমাণ নেই।

—কেন থাকবে না? ঝাড়গ্রামে তোমাকে সিগারেট কিনতে, ওদিকে যেতে দেখেছে চিনু।

সুজয় এখন এদিক ওদিক ঘাড় ঘোরায়। বুনো শুওরকে কারা যেন বেড়াজালে ঘিরছে বর্শা তুলে। বন্যবরাহের মত ও কোণঠাসা মরিয়া।

—না, দেখে নি।

—দেখেছি। পরনে স্টোনওয়াশ, সবজে জ্যাকেট, সন্ধ্যাবেলাতেও চোখে সানগ্লাস। নিতাইয়ের দোকানে সিগারেট কিনলেন, চেঞ্জ নিলেন না। শনিবার, জাস্ট গত শনিবার। আরো বলছি, কাঁটাজুড়ির সঠিক পথটা নিতাইয়ের কাছেই জেনে নেন।

—না!

বস, সুপ্তি, ভাস্বর, এ—ওর গায়ে ঠেসে বসেন। ওঁরা বিপন্ন, অসহায়। সুজয়কে ভয় পেতে হচ্ছে যে জন্যে ওঁরা অত্যন্ত বিপন্ন। বস সুপ্তির দিকে তাকান। সুপ্তি! সুজয় যে এত খারাপ তা আমি জানতাম না। ওঁর চোখ বলে।

সুপ্তি ওঁর দিকে তাকান না। ঝুঁকে বসেন, কথা শোনেন।

—সুজয়! যে ভাড়া গাড়িতে আমরা গেলাম, তার ড্রাইভার মণ্ডল আমাকে রূপাদের বাড়িতে পৌঁছবার সময়েই জিগ্যেস করেছিল তোমার সবুজ অ্যামবাসাডর আছে কি না, তুমি ঝাড়গ্রামে যাও কি না। মণ্ডল হরদম ঝাড়গ্রামে যায়, তোমাকে দেখে থাকবে।

—তাতে কি প্রমাণ হয়?

”কি” শব্দের ওপর যথেষ্ট জোর।

ঋষির গলা নৈর্ব্যক্তিক হতে থাকে।

—তুমি খুঁজতে শুরু করলে প্রমাণ বেরোবে বইকি। যথেষ্ট প্রমাণ বেরোবে। শুধু… সুজয়… সঙ্গে মেয়েটিকে নিয়ে গেছল কেন? কেন?

সুজয় চেঁচিয়ে ওঠে, মিথ্যে কথা! কোনো মেয়ে সঙ্গে ছিল না। আমি একলা… আমি..

সুজয় চারদিকে তাকায়।

ভাস্বর, ”ওলড স্পাইস” সুরভিত ভাস্বর, গোপার ছবি দেখেই যে বমি করছিল। সেই ভাস্বর লাফিয়ে ওঠে, তুমি স্বীকার করছ, তুমি একলা গিয়েছিলে?

সুজয় বলে, ঋষি! তুমি ফাঁদে ফেলে আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিলে?

হঠাৎ ও ক্ষিপ্ত বাঘের মতো বোধহয় ঋষিকে আক্রমণ করতে যাচ্ছিল। চিনু ওর দু—হাত টিপে ঝাঁকি মেরে বসিয়ে দেয়।

সুজয় ”আঃ” বলে চেঁচিয়ে ওঠে ও বলে আমার হাতে ভেঙে দিয়েছে!

—ভাঙিনি চাঁদ। কিছুক্ষণ ঝনঝনাবে।

ঋষি বলে, এটা কি প্যাঁচ, চিনু?

—সম্পূর্ণ স্বদেশী। রকের ট্র্যাডিশনাল প্যাঁচ। তোমাকেও শিখিয়ে দেব।

—আর না সুজয়, এবার বলো। একলা গিয়েছিলে, তারপর? তারপর কখন পৌঁছলে?

সুজয় বলে, জল খাব।

রূপা উঠে গিয়ে জল এনে দেয়। জলের জাগ। গেলাস কয়েকটি। রূপাকে এ বাড়িতে সামান্য কাজ করতে দেখলেও অবাক লাগে ঋষির।

নীরবে ও মা, দাদা, বাবা, বিক্রম, চিনু, ঋষিকে জল দিতে থাকে।

সুজয় বলে, জল দান বড় পুণ্যের কাজ।

—আর নয়। বলো।

সুজয়ের চোখ স্বপ্নিল। স্বপ্নিল। ও কি করেছে তা বলে অপার আনন্দ পাচ্ছে। এমনভাবে ও বলে, যেন এভারেস্টে ওঠা বা বিশ্ব কাপে খেলার মতো বাহাদুরির কথা বলছে।

হিংস্র আনন্দে ও দাঁত বের করে।

—ঋষি ইজ রাইট!

—সুজয়, সুজয়।

—বস, আপনি গাধা! ঋষি ঠিক বলছে।

—তুমি… গোপাকে…

—নিশ্চয়। আমাকে ছেড়ে যাবে, আস্পর্ধা। রিমকিকে বিষিয়ে দেবে। লম্পট একটা মেয়ে, বিয়ে করে ধন্য করে দিয়েছি, পাপোশের মত পড়ে থাক। থাকত, তাই থাকত। যদি রূপা, ওই কুত্তীটা না যেত।

আবার জল খায় সুজয়।

—হঠাৎ দেখি, ওকে আর ধরাছোঁয়া যাচ্ছে না। নিজের চারদিকে খোলস গজিয়ে ও বদলে যাচ্ছে, প্রজাপতি হচ্ছে। কুত্তী।

—বিশেষণ বাদ দিয়ে সুজয়।

ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো ঘাড় বাঁকায় সুজয়।

—রিমকিকে চিটি লেখার আগেই ওকে খুঁজছি, মেরে ফেলব। বিক্রমের সঙ্গে যায়নি, কোথায় গেছে? তারপর রিমকি এই চিঠি নিয়ে আমাকে চার্জ করল।

—তারপর?

—তারপর….

সুজয় এখন থামতে পারে না। হড়বড়িয়ে বলতে থাকে, কথা উপছে পড়ে মুখ থেকে।

না, তারপরে আর দেরি করিনি আমি। তখন আমার অবস্থা কোণঠাসা জন্তুর মতো। আমি তখন ক্ষ্যাপা কুকুর। বিবাহিত স্ত্রীর মর‍্যাদা দিয়েছি। দিয়েছি অঢেল টাকা। তারপরে আর কি চাইতে পার তুমি?

স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক তুমিই তৈরি করতে দাওনি। গোটা দুই বাচ্চা বিয়ালে তুমি ঠাণ্ডা হয়ে যেতে। আমার কোনো আপত্তি ছিল না। আপত্তি ছিল তোমার।

যাতে ধরা না পড়ি সে চিন্তা আগে ছিল, পরে সব গোলমাল হয়ে যায়। মাথা কাজ করছিল না। গাড়ি চালাবার সময়ে বারবার মনে হচ্ছিল পাশে কেউ বসে আছে।

বিশ্বাস করবে কেউ? কিচ্ছু খাইনি সারাদিন। মেচেদা পৌঁছে প্রথম জল খেলাম। মদ খাইনি। মদ খেলে মাত্রা থাকবে না ভয় ছিল।

ঝাড়গ্রামে মণ্ডল আমাকে দেখেছিল? সবই সম্ভব। বেরোবার সময়ে পথের দুইদিকেই মড়া দেখলাম। খুব কুলক্ষণ। তা ছাড়া মেচেদাতে একটা বিকট দর্শন পাগলী হঠাৎ আমাকে গালাগালি করল। খুব কুলক্ষণ। এ রকম সব কুলক্ষণ দেখতে দেখতে গেলাম।

আশ্চর্য কি, ঝাড়গ্রামে আমাকে চিনু দেখবে, দেখবে মণ্ডলও। কুলক্ষণগুলো যে দেখলাম। তার অভিশাপ তো ফলতে হবে কোনো না কোনো সময়ে। এক হারামজাদার দোকানে সিগারেট কিনলাম। মনে আছে।

ঝাড়গ্রাম থেকে কাঁটাজুড়ি পৌঁছতে সময় লেগেছিল, পথ চেনা নেই বলে। পথে লোকও পাই না যে জিগ্যেস করব।

কাঁটাজুড়ি ছাড়িয়ে ওই বাড়িটাতে পৌঁছবার আগেই অস্বস্তি হচ্ছিল। বাড়ির সামনে গাড়ি রাখলাম। সঙ্গে সঙ্গে এক রাশ তারা। গাছে গাছে বাতাস, বুনো ফুলের গন্ধ। আর অপার নৈঃশব্দ্য আমাকে আক্রমণ করল। আমি এতে অভ্যস্ত নই। আমি চাই শব্দ, বাজনা, আলো, ক্লাব, অনুগত মেয়েমানুষ রিমকি। বাথরুমে গেলেও আমি ক্যাসেট বাজাই।

এত তারা। এমন বাতাস, এমন নীরবতা, এমন অজানা ফুলের গন্ধে আমার ভয় করল।

ঋষি একটা ভুল করেছে। দরজায় টোকা মেরে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। হাতে ছিল ভারি হাতুড়ি। হাতুড়ি খুব ভালো হাতিয়ার। মারতে জানলে হাতুড়ি খুব ভালো।

আমি তো বিশ্বাস করিনি গোপা একা আছে। চিঠিতে যাই লিখুক, আমার হিসেব বলছে যে বিক্রমকে ওখানে থাকতেই হবে। থাকুক। অতর্কিতে হাতুড়ি মারলে দুজনেই মরবে।

গোপা বলেছিল, কে?

বলেই বোকার মতো ও দরজা খুলল। দরজা খুলতেই লাথি মেরে কপাটে ধাক্কা মেরে আমি ভেতরে ঢুকলাম।

—তুমি? এখানে?

নোট করো, নোট করো ঋষি, গোপা শুধু বলতে সময় পেয়েছিল, ”তুমি? এখানে?”

তারপরেই তো আমি ওর মুখে প্রচণ্ড জোরে হাতুড়ি মারি। তারপরেই তো ও পড়ে যায়। হাতুড়ির পর হাতুড়ি মেরে মেরে, মেরে মেরে… তাতেও নিশ্চিন্ত না হয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ওর ঘাড় শুদ্ধ মাথা ঘুরিয়ে দিই।

তারপর গাড়ি থেকে পলিথিন এনে ওকে জড়িয়ে তুলি গাড়িতে। আবার ফিরলাম। ঘরের কলসি লাথ মেরে ভেঙে রক্তের দাগের ওপর জল গড়িয়ে দিলাম। এখানে আমার আঙুলের ছাপ নিতে আসবে কে?

হাতুড়িটা নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। গাড়ির বুকে গোপা, বুট লক করেছি। তারপর গাড়ি চালিয়ে এসে পথে গাড়ি থামালাম। কাঁটাজুড়ির পথে। পাকা রাস্তায় উঠিনি।

বসে বসে দেখলাম তারা ঘুরে যাচ্ছে, আকাশ ফিকে হচ্ছে। ব্যস, পাকা রাস্তায় উঠে গাড়ি দাঁড় করিয়ে গোপাকে খানিক বয়ে খানিক ছেঁচড়ে লাইন অবধি নিলাম।

সে সময়ে কোনো লরি বা ট্রাক গেলে ধরা পড়তাম। ধরা পড়িনি।

ঝোপের পাশে ওকে আছড়ে ফেলতে মাথাটা সম্পূর্ণ বেঁকে গেল। পলিথিনটা নিয়ে বললাম, সো লং গোপা।

সে সময়ে একটা আশ্চর্য আনন্দ। এত সহজে সব হয়ে গেল? বেশি বিগড়ালে রিমকিকেও আমি কোথাও অন্য কোনো ভাবে…

তারপরে ঘরে ফেরা, ঘরে ফেরা। কলকাতা ফিরে গাড়ির বুট পরিষ্কার। পলিথিন কেটে কেটে খাটের নিচে ঢোকানো, হাতুড়িটা পথেই ফেলে দিই…. তারপর স্নান করে টলতে টলতে ফ্রিজ খুলে কি সব খেলাম।

তারপর ঘুমোচ্ছিলাম।

পরদিন আপনি ফোন করলেন। সে সময়ে আমার বাড়িতে রিমকি।

গোপা আর নেই। তবুও রিমকি বলল ও কানপুরে যাচ্ছে। আর বৈষয়িক ব্যাপারে ভবেন দত্ত কথা বলবে।

দেখুন কপাল। রিমকি নেই, আমি নিঃস্ব নিঃস্ব, তবু গোপার বডি দেখতে যেতে হল আমাকে।

আপনি বলুন। বঞ্চিত স্বামীর ভূমিকায় কি চমৎকার অভিনয় করে গেলাম?

রিমকি যায় যাক। গোপার ব্যাপারটা যদি চাপা পড়ত। তাহলেও বাঁচতাম।

না, রূপা সব উলটে দিল।

আমার শেষ জিজ্ঞাসা বসকে।

আমি ”গোপা নয়” বলব, কেন বলব তা জানতাম। আপনি কেন বললেন?

মুখ বাঁচাবার জন্যে তো?

সামনে ”নো”—এর উদ্বোধন, ফার্মের বিশাল বিস্তৃতি, এ সবের মধ্যে গোপার ব্যাপারটা জানাজানি হলে চলবে না।

আমার আপনার মুখ বাঁচানো দরকার! তা এদেরকে দয়া করে বলুন। কাদা ঘাঁটলে গোপা ফিরবে না। আপনার কনিষ্ঠাকে বোঝান।

পুলিশে আমার কিছু চেনাজানা আছে, ঝাড়গ্রামের ব্যাপারে তা বুঝেছেন। এখন যাতে আমাদের মুখ বাঁচে কাজের কাজ হয়…

এতক্ষণে বিক্রম কথা বলে।

—সত্যি। কি করলে ঠিক হয়, বলুন তো? আপনার কথা তো শুনলাম।

—ভুলে যান সব। আমাদের কাজ করতে দিন। ঘরে যেয়ে একটা ভালো মেয়েকে বিয়ে করুন। মনেও রাখবেন না কিছু।

—”নো” বেরোবে?

—নিশ্চয়। নৌকো বোঝাই শুধুই পাপী, সে নৌকো কি ডোবে?

—গোপার ব্যাপারটা?

—ওর খোঁজ চলুক না। খোঁজ চলতে বাধা নেই। অবশ্য এ ক্ষেত্রে….

বিক্রম হঠাৎ লাফিয়ে দাঁড়ায়। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সুজয়ের ওপর।

সুজয় নিজেকে ছাড়ায়। টেবিল উলটে দেয়। ঝনঝন গেলাস ভাঙে, জাগ।

সুজয় লাফিয়ে বেরিয়ে যায়। দৌড়য়, দৌড়য়, গাড়ির শব্দ।

ঋষি বিক্রমকে ধরে।

—যেও না। ও কোথায় যাবে এরপর?

—কিসের পর?

—সব কিছুর পর?

—পুলিশ কখনো ওদের ধরে?

রূপা বলে। সব যদি ছেপে বেরোয়, আমার রিপোর্ট হিসেবেও, তাহলেও…..

হঠাৎ সবাই চুপ করে যায়।

সুপ্তি বোস বলেন, সুজয় চলে যাচ্ছে। গাড়ির শব্দ। ঋষি। ভাস্বর।

তারপর একই তীব্র তীক্ষ্ন অস্বাভাবিক গলায় বসকে বলেন, সুজয় খুনী, সে সেজন্যে ”গোপা নয়” বলেছে। তুমি বাপ হয়ে কি জন্যে বললে? কি জন্যে? মুখ রাখবার জন্যে? তুমি তোমার মুখ বাঁচাতে চেয়েছিলে? বলো, বলো। আমাকে বলো। মেয়ের মরামুখ দেখে বাপ হয়ে…..

গলাটা ওপরে উঠতে উঠতে চিরে যায়। রূপা ওঁকে ধরে। আর ঋষি হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে।

—বস।

বস ঢলে পড়ছেন, ঢলে পড়ছেন। শরীর কাঁপছে, মুখের একপাশ যেন বেঁকে যাচ্ছে।

—ভাস্বর। ডাক্তারকে ডাকো।

সুপ্তি অজ্ঞান প্রায়, ধসে পড়েছেন।

বস অবশ, অক্ষম।

ভাস্কর ডাক্তারকে ফোন করে।

বিক্রম উঠে আসে।

—ওঁর বোধহয় স্ট্রোক হয়েছে। শুইয়ে দিন! মাথাটা উঁচু রাখুন। চামচ দিন, মুখ ফাঁক না রাখলে জিভে কামড় বসে যেতে পারে।

চিনু কোথা থেকে ঠাণ্ডা জল এনে বলে, রূপা। তোর মার মুখে চোখে জল দে।

দেয়াল থেকে দেগার ঘোড়ার ছবির ঘোড়াগুলো গভীর আগ্রহে মুখ নামায়। তিব্বতী মুখোশের সবুজ চোখেও গভীর বিস্ময়। যামিনী রায়ের পট থেকে যশোদার কোল থেকে মাথা উলটে গোপাল দেখে গভীর কৌতূহলে। এ ঘরে এমন বিশৃঙ্খলা তো কাচের কেসে সাজানো ড্রেসডেনের পুতুলরাও আশা করেনি।

এবং ডাক্তার এসে পড়েন।

—হ্যাঁ। সামান্য হলেও স্ট্রোক। কয়েকদিন খুব টেনশনে ছিলেন কি? নার্সিংহোম। বেলভিউ।

এ সবের মধ্যে সুজয় ছিল না! ছিল না।

গাড়ি ঘুরিয়ে লোয়ার সার্কুলার। বেরিয়ে যেতে হবে সল্টলেক। আশ্চর্য। মণ্ডল আর চিনু ওকে এখনো দেখছে। দেখে নাও, দেখে নাও।

পথের প্রহরী হঠাৎ লাল আলো জ্বালে।

লালবাতি দাঁড় করায়।

হলুদ বাতি—গাড়িতে স্টার্ট।

সবুজ বাতি—চালাও গাড়ি।

—গাড়ি থামিও না।

গোপা বলে!

—গোপা! তুমি।

—নিশ্চয়।

—না, গোপা নয়।

সুজয় গাড়ির স্পীড বাড়ায়। গাড়ি ও বাসের জঙ্গল থেকে বেরোতে হবে, বেরোতে হবে। হর্ন চীৎকার ভীষণ গণ্ডগোল। রিকশা ছিটকে পড়ে। মিনিবাসের হেলপার আর্তনাদ করে, সবুজ অ্যামবাসাডর দৌড়তে গিয়ে আকাশ চেরা আর্তনাদে একটি লরির সঙ্গে চেপটে যায়! পিষে যায়। হুইল ক্ষেপে গিয়ে সুজয়ের বুক গুঁড়িয়ে ওকে চেপে ধরে।

সুজয় জ্ঞান হারাতে হারাতে সভয়ে দেখে লরি থেকে লোহার রড কাচ ভেঙে ওর মাথা…. ওর কপাল…

ওর চেতনায় প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। তারপর সব ঢেকে যায় অন্ধকারে।

দু’মাস কেটে যায়।

পথ দুর্ঘটনায় সুজয়ের মৃত্যু এবং ব্রজেন বোসের পক্ষাঘাত জনিত অসুস্থতা যার প্রেসার ছিল না, তার প্রেসারও চড়তে পারে।

বালিগঞ্জ সার্কুলারের বাড়িতে এখন অপার নৈঃশব্দ্য একমাত্র সুপ্তি বোসই নতুন হয়ে ফিরে এসেছেন।

কেননা বস এখন তাঁর ওপরেই নির্ভরশীল।

ভাস্বর বোস, কেজিয়া ও দরানি এনটারপ্রাইজের ”নো” বেরোচ্ছে, বেরাচ্ছে।

ভাস্বর বোস তাঁর অংশ বিক্রি করে দিচ্ছেন ভাটিয়া ও জো পরাশরকে। বাঙালীদের চেয়ে ওরা ব্যবসা ভাল বোঝে।

ভাস্বরের শালা ”নো” আপিসে বসছে।

রূপা বিজয়ার চেষ্টায় ও বাড়িতেই ঘরটিও পেয়ে গেছে ফলে ও এখন বেজায় খুশি।

ঋষি থমকে ছিল, বোবা হয়ে ছিল।

বিক্রম বলে, ভালোই হয়েছে ঋষিদা। কেস করলে দাঁড় করানো যেত না।

—কে জানে।

—শুধু মাঝখান থেকে বহু অপচয় ঘটে গেল।

চিনু বলে, কাব্যিক বিচার। পোয়েটিক জাস্টিস। এক নম্বর আসামী নিহত। দু’নম্বর মঞ্চ থেকে আউট।

—ভাস্বর চলে এসেছে শূন্য স্থানে।

—ভাস্বর বস হতে পারবে না। ”নো” দেখেছ? দুধু ভাতু পত্রিকা। উঠে যাবে।

বিক্রম বলে, ঋষিদার কাজটা গেল।

ঋষি বলে, সে তো গেলই। তবে সেদিন মারদাঙ্গা করে সুজয় আমার চশমাটা ভাঙল। বড় শখের চশমা ছিল।

চিনু বলে, ভ্যান ভ্যান কোর না। বন্ধুর দোকান থেকে চশমা তোমায় করিয়ে দিয়েছি। তা ছাড়া বিক্রম দেখছে বলে রুদ্র অঙ্কে ভালো নম্বর পাচ্ছে। তা ছাড়া সেনদা পিঠাডিহি থেকে যে সব লতাপাতার ওষুধ পাঠাচ্ছে, তা খেয়ে তোমার মা অনেক ভালো আছেন।

ঋষি হাসে।

মনে মনে বলে, গোপা। তুমি চলে গেলে, কিন্তু আমার সংসারটা কত বড় করে দিয়ে গেলে। বিক্রম, চিনু, রূপা। তুমি শুধু দেখে গেলে না।

এরই মধ্যে রুদ্রর জন্মদিন এসে পড়ে। দশ বছর পেরিয়ে যাব বাবা, এবার শুধু জন্মদিন করো। বড় হয়ে গেলে আর কেউ জন্মদিন করে না।

জন্মদিনে স্ক্র্যাবল বোর্ড কিনতে বেরোল ঋষি। আবার পুরনো কাগজে ফিরে যেতে হচ্ছে, পুরনো কাজে, ভালো লাগে না ভাবতে।

স্ক্র্যাবল বোর্ড কিনে ফিরে ঋষি কি অবাক, কি অবাক, তা বলা যায় না।

সিঁড়ির মুখে রূপা। শাড়ি পরেছে বলে খুব অন্যরকম দেখাচ্ছে।

—জন্মদিনের অভিনন্দন ঋষিদা।

—জানলে কি করে? রুদ্র আর আমার এক তারিখেই জন্ম, এ কথা তো কেউ জানে না।

রূপা বলল, মাসিমা?

কমল, বিক্রম, চিনু, বিজয়া, রূপা, অনেক লোক, অনেক লোক। একতলার মাসিমা, মেসোমশাই, কুশল।

ভোঁদাকেও দেখা গেল।

—তুই কি করছিস?

—সার্ভিস দিচ্ছি। দাদা কেটারিং খুলেছে, বউনি তোমার ওপর দিয়ে হচ্ছে।

—ব্যবস্থা করল কে?

রূপা বলল, আমি, কমল….

বড় আনন্দ সন্ধ্যা। রুদ্রর এমন জন্মদিন কোনোদিনই হয়নি। নলিনী আর রানী বলল, বাড়ি এমন গমগম করলে তবে না ভালো লাগে।

খেতে খেতে রূপা একটা খাম এগিয়ে দিল ঋষিকে, খুলে দেখ।

—কি?

—তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। ব্রেসনে এখানে আর ইউনিট রাখবে না। আমরাও বম্বে যাব না। আমরা নিজেরা ইউনিট করেই ডকুমেন্টারি তুলব, অনেক কাজ করব, তুমিও থাকবে আমাদের প্রজেকট অফিসার হয়ে। বিক্রম অবশ্য অবৈতনিক পরামর্শদাতা, কিন্তু শাড়ি পরা ভীষণ গোলমাল বাপু সামলানো দায়। —যাক! খুশি হয়েছ তো?

এতদিন বাদে রূপা যখন এই প্রথম খুশি হতে পারে, ঘাড় কাত করে হাসতে পারে, ঋষি বা খুশি হবে না কেন, বিশেষ, ছাপা শাড়ি পরে রূপাকে যখন কেমন যেন গোপার মত দেখাচ্ছে?

ঋষি খুশি হয়েছে। ঋষি হাসে। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে গলা যেন আটকে যায়।

রূপা বলে, আমাদের মধ্যেই দিদিও আছে। যারা ওকে ভালবাসে তাদের মধ্যে।

ঋষি মাথা হেলায়। হ্যাঁ রূপা, সত্যি বলেছ। ভালবাসাই তো শেষ অবধি সত্যি আর ভালোবাসা একশো রকম। সময় থাকতে সবাই যদি বুঝত।

রূপা বলে, আনন্দের দিনে নো বরুডং।

—নো পুডিং বাবা।

রুদ্র চেঁচিয়ে বলে। ও সবটা শোনে নি।

সবাই হেসে ফেলে, ঋষিও।

__

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *