মুখ – ৭

ওদের ঢুকতে দেখে বস চোখ তোলেন।

রূপা বলে, ঋষিদাকে সবাই চেনে। চিনু আমার সহকর্মী। আর এর নাম বিক্রম।…. ইনি মা ইনি বাবা, ইনি সুজয়।

বিক্রমের ছবি সুজয়ের কাছেই দেখেছেন বস, এবং সত্যিই বিশ্বাস করেছেন ওরা এক সঙ্গে চলে যায়। তারপর ঝাড়গ্রামে ধাঁধায় পড়েন, কেননা সুজয় অগে বলেছিল ওরা দুজনে মাসখানেক উধাও। পরে বলল, বিক্রম না গোপা কে যেন সাত আট দিন আগে পরে…

—বিক্রম! এই বিক্রম?

সুপ্তি! সোজা হয়ে বসেন।

—বিক্রম! গোপা কোথায়?

—রূপা বলে, বিক্রম জানে না মা, আমি জানি। সো সরি বাবা, তুমি আমাকে বাধ্য করলে।

—না।

বলে চেঁচাতে যান বস, কিন্তু রূপা বলে আর ”না” বললে হবে না বাবা। ”হ্যাঁ” বলতে হবে।

এ সময়ে ভাস্বর ঢোকে।

গোপা ও রূপার দাদা।

—কি ব্যাপার জরুরি তলব?

”দাড়ি কামাবার পরে লাগান ওলড স্পাইস লোশন”—এর মৃদু গন্ধ। চিকনের পাঞ্জাবী ও যোধপুরী। সঞ্জয় গান্ধী যে পাশে—বোতাম পাঞ্জাবি ও যোধপুরীকে ”অমর রহে” করে রেখে গেছেন।

পায়ে চটি, হাতে পাইপ।

—এসো ভাস্বর।

সুপ্তি আবার বলেন, বিক্রম। গোপা কোথায়?

ভাস্বর বলে, এ বিক্রম?

রূপা বলে, হ্যাঁ, তবে প্রশ্নের উত্তরটা জানি আমি। বোসো দাদা।

—হঠাৎ গোলটেবিল বৈঠক? কতক্ষণ চলবে?

তোমার তাড়া আছে?

—একটা গেট টুগেদার…

—বোসো। সবটা শোনো। সুজয় উসখুস করছে। চিনু তুই আর ঋষিদা ওর দু’পাশে বোস।

—আমার পাশে বোসো সুজয়।

—না মা। তুমি যেখানে আছ থাকো। আচ্ছা, আমি শুরু করছি। সেদিন ঝাড়গ্রামে কি হয়েছে তোমরা জানো।

ভাস্বর বলে, কার না কার বডিকে ”গোপা” বলে তুমি….. ছি ছি, রূপা! নিজেকে ভগবান ভাবা ঠিক নয়।

—অবশ্যই। এই ছবিগুলো তোমরা প্রত্যেকেই দেখ। বাবার চেয়েও সুজয়ের ভুল হয়েছিল, মর্গের বিকৃত লাশটার যে ছবি পুলিশ তোলে, সে ছবিই একমাত্র ছবি মনে করা। দিদিকে প্রথম দেখি আমরা। ব্রেসনের একটা ইউনিট। তোমরা ভুলেই গেলে যে আমরা ফিল্ম ইউনিট নিয়ে বেরিয়েছি।

সে সময়েই চিনু তোলে ছবিগুলো।

সুজয়ের চোখের ওপর কোনো ঢাকনা বা পর্দা নামে। ঈষৎ হেসে ও বলে, ভুল হয়নি। ভুলেও যাইনি। আমি বলা সত্ত্বেও আমার সিক্রেট সার্ভিস ফেল করল। ওরা ব্রেসনেতে কোনো ছবি বা নেগেটিভ পায় নি।

চিনু বলে, গোয়েন্দা সার্ভিস?

—হ্যাঁ, দি হান্টার হক।

—হলিউডের ছবি হয়ে গেল।

সুজয় বলে, রূপাকে আমি কোনোদিন বিশ্বাস করিনি, সেদিনও নয়। তবে আমি জানতাম খুব সময় পাবে না। বর্তমানে আমি সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছি।

বস বলেন, এ সব কথার মানে?

সুজয় বলে, রূপা বলুক। আজকের খেলা রূপার খেলা। সুযোগ্য সহকারী ঋষি, চিনু, বিক্রম।

—ছবিগুলো দেখ। এখন বাবা আর সুজয় আবার বলুক এ গোপা নয়।

—ছবি? এটা কার ছবি? গোপা, গোপা এমন করে ঘাড় ভেঙে, মুখের বাঁ পাশে এ কি, গোপা, গোপার…. গোপা ছবি এটা।

বস ঘামতে থাকেন।

সুপ্তি বলেন, তুমি কেন বললে গোপা নয়?

—আমি …. আমি এ ছবি দেখিনি।

—স্বাভাবিক, বাবা। ছবি তোলে চিনু, বিকেলের ট্রেনে রবি চলে আসে নেগেটিভ, ক্যামেরা সব নিয়ে। রবিই প্রিন্ট করতে দেয়।

—নেগেটিভ কোথায়?

—বলা গেল না। দুঃখিত সুজয়।

সুপ্তি আমার বলেন, ছবি না দেখ, তাকেই তো দেখেছিল। কেন বললে গোপা নয়?

—খুব বিকৃত বডি সুপ্তি। দেখে চেনা খুব—কঠিন। যদি তুমি দেখতে…

—আমি দেখলে বলতাম ”এ গোপা!” বিকৃত বডি? কত বিকৃত বডি? সুজয় কি করে ভুল করলে? গোপার সঙ্গে এত বছর ঘর করেছ, চিনতে পারলে না? ভাস্বর! তুই কিছু বলছিস না কেন?

—আমি …. আমি …..

ভাস্বর হঠাৎ ককিয়ে ওঠে ও উঠে যায়। বমির শব্দ। ডাইনিং রুমে বেসিনে ও বমি করছে।

—সুজয়! তুমি বলো।

—রূপাই বলবে।

পাশে বসে ঋষি টের পায়, পাশে রাখা ফ্লাসক থেকে সুজয় হুইস্কি খাচ্ছে।

—রূপা কি বলবে। সে তো আগাগোড়াই বলেছে দিদির বডি পেয়েছি, তোমরা এসো।

রূপা বলে, ধূর্তামি অনেক করতে হয়েছে মা। ডাক্তার আমাকে আর চিনুকে বলেছে, দিদিকে মুখ ও মাথার বাঁ দিকে মেরে ঘাড় ভেঙে ফেলে দেওয়া হয়েছে। নইলে এমন ভাবে ফেলা হয়েছে, যাতে ঘাড় ভেঙে যায়। মোটকথা দিদিকে খুন করা হয়েছে।

সুজয় ধূর্ত হাসে, বিক্রম খুন করে থাকবে। আমাকে তুমি খুনে জড়াতে পারছ না রূপা,—আঃ।

বিক্রম প্রচণ্ড জোরে চড় মারে ওকে।

রূপা বলে, না বিক্রম, না।

—ওকে আমি…

সুজয় এটাও মেনে নেয়। ঘাড় নেড়ে বিড়বিড় করে বলে, সময়টা ভায়োলেনসের!

রূপা বলে, বাবা কিছু বলবে?

বস মুখ ঢেকেছেন। হাত নেড়ে বলেন, ”না”।

—হ্যাঁ, নো! এ সব ছবিসহ রিপোর্ট দিয়ে ”নো” কাগজের উদ্বোধন করো।

—রূপা…ডোনট বি ক্রুয়েল!

বসের গলা চাপা।

—দাদা কোথায় গেল?

সাদা মুখে ভাস্বর ফিরে আসে।

—আমি তুমি নই রূপা। গোপার ছবি দেখে…

—ছবি দেখেই ভেঙে পড়লে? আমি বডির ওই অবস্থা থেকে পচে যাওয়া অব্দি সঙ্গে থেকেছি। দিদির বডির গন্ধ আমার ভেতরে ঢুকে গেছে।

ঋষি বলে, রূপা থেমো না।

—হ্যাঁ…সুজয় বলছ, বিক্রম খুনী?

—আর কে? লাভার…জেলাসি…দেখ রূপা! গোপা নেই।

এখন পোষ্টমর্টেম করে কি হবে?

ঘটনাটি পোষ্টমর্টেম করলে তবেই বুঝবে, জীবিত দিদির চেয়ে মৃতা দিদির শক্তি বেশী।

সুজয় যেন সবিস্ময়ে বলে, কেন, কেন? গোপার গল্প লিখতে চাও?

পুরনো ত্রিভুজের নকশায় ফেলো, ব্যাখ্যা পেয়ে যাবে। গোপা আর আমি। গোপা আর বিক্রম।

বিক্রম গোপাকে…..

রূপার চোখ নেচে ওঠে।

—দিদি একই দিনে আমাকে, বিক্রমকে, আর রিমকিকে চিঠি লেখে।

—আবার রিমকি কেন?

সুজয় মুখ মোছে। মুখ থেকে অদৃশ্য মাছি তাড়ায়। তারপর বলে রিমকি এখন ভবেশ দত্তের কথায় উঠছে বসছে, এবং আমাকে গেট আউট করে কানপুরে ওর ভাই, সেই আই. এ. এস. অরুণের কাছে চলে গেছে ওকে বাদ দাও।

বস মুখ ঢেকে রেখেই বলেন, সেদিন তো দেখলাম মহিলাকে। তিনি তোমাকে যা বললেন….

রূপা বলে, কি বলেছে আমি আন্দাজ করতে পারি। দিদি বিক্রমকে কি লিখেছে। শোন…

—বিক্রমকেও?

নিশ্চয়। ”বিক্রম, তোমাকে খুব বড় চিঠি লিখব না। কেন না, দেখা আমাদের হচ্ছে। যেখান থেকে লিখছি, সে জায়গাটা কেমন, তা ভাবতেও পারবে না। পিঠাডিহার চেয়ে অনেক বুনো, অনেক পিছিয়ে থাকা এই কাঁটাজুড়ি। আছি সেনদার বাড়িতে, বাড়িটা বেজায় পোড়ো। মঙ্গল, ফুলমণি, ওদের তুমি চেনো না। ওদের হেফাজতে আছি বলতে পারো।

কাগজ নেই, রেডিও নেই, টি.ভি. নেই, সিনেমা নেই, মানুষও বলতে গেলে নেই।

অনেক কাঠবেড়ালী আছে। আছে পাখি।

ওরা কোনো ডিসটার্ব করে না।

নিজের সঙ্গে একা থাকব বলেই এখানে আসা। রূপারা কাছেই ছবি তুলেছে। ওরাও জানে না যে আমি এখানে আছি। লুকিয়ে থাকার কি মজা!

তুমি বলা সত্ত্বেও তোমার গ্রামে যাইনি। তার কারণ, কখনো চাইনি, তোমাকে ভয় করে মুক্তি পেতে।

অরূপের কাছ থেকে আমাকে সরিয়ে আনার পর থেকে যে রকম জীবন হয়ে উঠেছিল বাড়িতে, সুজয়ের কাছে, সেটাও অপমানজনক। আমি নিজেই নিজেকে অপমান করছিলাম। তাই মুক্তিটা আমাকে একলাই নিতে হবে। বলতে পারো এই নতুন গোপা, যে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তার শক্তি সামর্থ্য বোঝার জন্যেই চলে এসেছি।

চলে এসে কোনো বিবেকদংশন হচ্ছে না। বাবার মুখ থাকল না গেল তা তুচ্ছ মনে হচ্ছে। বিয়েটা বাবা ও সুজয়ের ব্যবসায়িক সুবিধার্থে হয়েছিল। ওদের ব্যাপার ওরাই বুঝুক।

মার জন্যে কষ্ট হয়। করুণা হয়। মা তো মুক্তি পাবে না কোনোদিন। এ কথা ভাবতেও পারবে না।

রূপাকে সবই লিখলাম।

রিমকিকেও সবই লিখলাম। সুজয় ওকে বুঝিয়েছিল। আমি ডিভোর্স দিচ্ছিনা বলে সুজয় ওকে বিয়ে করতে পারছে না। সুজয় ওকে বিয়ে করবে না। কেননা রিমকির নাকি বৈধব্য যোগ আছে এবং সুজয় মরতে ভয় পায়।

ওর সঙ্গে দেখা করে বলেছি, লিখে জানালাম, যে সুজয় ওর বাড়ি, টাকা সব নিচ্ছে। নেবে। রিমকি যেন সেটা বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়।

কলকাতায় ফিরছি বিক্রম। আগে ডিভোর্স করি। তারপর তুমি আর আমি বিয়ে করব কিনা, তুমি আর আমি ঠিক করব।

তুমি পারলে, আমি আর তুমি এ বাড়িতেই একটা স্কুলও খুলতে পারি। খুব অন্যরকম জীবন হবে।

আমার জন্যে চিন্তা কোর না। আমি খুব ভাল আছি। এত ভাল আছি যে ভাবলে পরে মাতাল মাতাল লাগে। বেঁচে এত আনন্দ।

তুমি ভাল থেকো।

শীগগিরই একটা নতুন গোপাকে দেখতে পাবে। তাকে ”এসো, পাশে বোস” বলতে পারবে তো? তোমাকে দেখব বলে খুব ভাল লাগছে সব কিছু।

—গোপা।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *