মুখ – ৬

রূপা বলে, পড়লে?

—হ্যাঁ…নাও।

—কি বলবে?

ঋষি বলে, আমি কি বলছি সেটা সব নয়। আসল কথা হল, এরপর কি করব আমরা।

চিনু বলে, তুমিই বলো না, বুড়ি, আপনি…

—দূর! আমাকে তুমি ”তুমিই” বলো।

—বেশ তো, বলো।

রূপা বলে, দাঁড়াও, বেল বাজল।

উঠে যায় ও, যাকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে আসে, সে যে বিক্রম তা বলে দিতে হয় না ঋষিকে।

—বোস বিক্রম।

রূপা পারতপক্ষে কাউকে ”দাদা” বলার মধ্যে নেই ”আপনি”ও ও পারতপক্ষে বলে না।

বিক্রম বসে। ওর চেহারা দেখে মনে হয় শ্মশান থেকে এল। মুখ চোখ সব জ্বলে গেছে।

আস্তে বলে, ছবিগুলো সরাও।

—দেখবে না?

গোপার চিঠি পেয়ে খড়্গপুর, ঝাড়গ্রাম, কাঁটাজুড়ি হয়ে ফিরেছি। সবই জেনে এসেছি।

বিক্রম টেবিলে ঘুসি মারে ও কেঁদে ফেলে।

—বারবার বললাম, আমার সঙ্গে চলো, আমার বাড়ি চলো। বাবা মা দাদারা জানে, আমি কোনদিন কারো কথা শুনি না, নিজের মতে চলি। গোপা স্বচ্ছন্দে থাকতে পারত। ওখানে গোপার গায়ে হাত দিতে পারত না কেউ। আমাদের সমর্থক প্রচুর মানুষ।

—আমি ওর ঋষিদা।

—আপনার কথা বলত।

—তোমার ওখানে যায় নি, রূপাকেও জানায় নি, রূপারা তো কাছেই ছিল।

—কেন, কেন এমন করল?

—একা থাকতে চেয়েছিল।

—ফুলমণি তো সে রাতে আসে নি। ওর জ্বর হয়েছিল। গোপা মঙ্গলকেও ঘরে পাঠিয়ে দেয়। তবে…মঙ্গলরা গাড়ির শব্দ পেয়েছিল।

—কখন?

—মঙ্গলকে দেখেছেন?

—না।

—খুব নেশা করে। নেশার ঘুমে কে আর সময়ের খেয়াল করেছে।

—ও বাড়িতে মঙ্গলরা সকালে গেল?

—হ্যাঁ…কে মারা গেছে শুনে, ওরা যখন যায় তখন তোমরা চলে গেছ। ব্যাগ, জামাকাপড়, সব আমাকেই দিয়ে দিল ওরা। ব্যাগে…আমার…একটা ছবি…

বিক্রম নিঃসংকোচে কাঁদে।

—মেরে ফেলল? মেরে ফেলল?

রূপা আবার বেরিয়ে যায়। কফি নিয়ে আসে। অসম্ভব বড় কাপ, আধ কাপ কফি।

—বিক্রম, চোখ মোছ, কফি খাও।

—কবে থেকে বলছিলাম…শুনল না।

চিনু হঠাৎ তেতে উঠে বলে, বাস বাস। পরের স্টপে চলো। এখন কি করা যাবে তাই বলো।

—কেস করব।

—রূপা! এবার পুলিশ রিপোর্টার বলুক?

—বলো।

—এই ছবি, এই চিঠি, বিশেষ এই ছবি, জ্বলন্ত প্রমাণ যে এই গোপা।

—এবং তাকে খুন করেছে সুজয়।

—সুজয়ের মুখ থেকে স্বীকারোক্তি না পেলে সে কথা প্রমাণ করা যাবে না।

—বাঃ সবুজ গাড়ি চালিয়ে ও যায় নি?

—ও হল ঘুঘু। প্রমাণ করে দেবে সে সময়ে ও অন্য কোথাও ছিল।

চিনু বলে, তা ছাড়া, বস আর সুজয় হাত মেলালে কতদূর কি করবে পুলিশ…

ঋষি বলে, সুজয় যে গোপাকে মেরেছে সেটা জানলে বসও হয়তো…

রূপা বলে, বস বলবে, যা হবার হয়ে গেছে, গোপা তো ফিরে আসবে না।

ঋষি বলে, আমার বিশ্বাস, রিমকি চিঠি পেয়ে সুজয়ের কাছে যায়। সুজয় মরিয়া হয়ে ওঠে। ঠিকানাও পেয়ে যায়। গোপা রিমকিকেও বিষিয়ে দিয়েছে। হাত থেকে সব বেরিয়ে যাচ্ছে…

—ওদের একসঙ্গে করে সামনে সব প্রমাণ ফেলে দেয়া যায়। তারপর বলা যায়, বোন হিসেবে আমি কেস করব। ছবি দেখে বাবা কি বলে, সেটাই দেখার বিষয়। মার সামনে না হলেই ভাল হত। কিন্তু মারও তো জানার অধিকার আছে যে তার মেয়ের কি হাল।

চিনু বলে, কেলোর কীর্তি হবে। বস ঢাক বাজিয়ে ”নো” শুরুই করতে যাচ্ছে।

ঋষি ইষৎ হেসে বলে, ধস নেমে যাবে। তবে রূপা…কেসের ব্যাপারে অনেকদূর ভাবতে হবে।

—কি ভাবব?

—মেয়ে বাপকেও তো অভিযুক্ত করছে। গোপাকে উনি চিনেও চেনেননি।

বিক্রম বলে, ওঁদের দুজনেই কেন জেনে শুনেও ”না” বললেন। সে সব নিয়েও লেখালেখি হবে।

রূপা যন্ত্রণায়, বেদনায় বলে, বস ভেঙে যাবে। তবু তাই হোক, তাই হোক। ওদের মুখ বাঁচাবার জন্যে আমরা সব চেপে যাব, ওরা ক্যানসারের মত বাড়তে থাকবে?

ঋষি বলে, তুমি ভাবো।

—কি ভাবব?

রূপা জ্বলে ওঠে। তুমি না বলছিলে, এ বিষয়ে কাজের কাজ করলে তবেই দিদির পারলৌকিক হবে?

—এখনো তাই বলছি। শুধু ছেলেমানুষী না করে এটা ভেবে দেখ খুব ঠাণ্ডা মাথায়। কেন না, তোমাকেই প্রধান ভূমিকা নিতে হবে। যা ভাববার, তা আগে ভাবো। রিমকির সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব?

—ফোনে পাচ্ছি না। মানে, ফোন কাজই করছে না বলতে গেলে।

—তোমাকে যা লিখেছে তাই যথেষ্ট। তবে পরের দিকে রিমকিকে দরকার হবে।

—তবে বাবাকে ফোন করি কাল। কাল, সন্ধ্যাবেলা, বাবা আর সুজয় দুজনেই যেন থাকে।

—সুজয়, আসবে?

রূপা বলে, আমি কাল অনুতপ্ত মেয়ে হয়ে যাব। সুজয়কেও বলব আসতে। দুজনকেই বলল, ঝাড়গ্রামে আমার মাথা ঠিক ছিল না, রূঢ় ব্যবহার করেছি। ভাব দেখাব, যেন সব ভুলে গিয়ে আমি বাড়িতে থাকতে যাচ্ছি।

চিনু বলে, তুই অভিনয় করবি?

—পারব।

চিনু প্রাজ্ঞের মতো বলে, কেস করে তো এদের শাস্তি দেয়া যায় না। দুজনেরই অনেক খুঁটি। কিন্তু এ ভাবে ধাক্কা খেলে ওদের জগতও ধসে যায়। সুজয় টোপ খেলেও খেতে পারে। গোপাদি নেই, তুই বসের একমাত্র মেয়ে এখন, দেখ।

ঋষি বলে, উঠি। রুদ্র আছে। কাল কখন, কোথায় তা জানিও। সব কিছুর পরেও তোমার মার জন্যে আমার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এ রকম কাহিনীর শেষ তো সুখী সুখী হতে পারে, না। বিক্রম, যাবে না?

চিনু বলে, আমার সঙ্গে চলুক। একা থাকতে ওর ভালো লাগবে না।

বিক্রম বলে, গোপা আর আমি একসঙ্গে কোনদিন থাকব বলে, বাড়ির খোঁজ নিতাম, জানেন? ওর কথাতেই ব্যাঙ্কের পরীক্ষা দেব… হয়ে গেল!

—আমি চলি রূপা।

বেরিয়ে এসে হাঁটতে থাকে ঋষি। ভেতর ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে এক সময় বালিগঞ্জের ফাঁড়ি। আট নম্বর বাস পেলে ল্যান্সডাউন বাজারের পরের স্টপে নামবে। তারপর পশ্চিম পানে শুধু হাঁটা। নবীন চাঁদ রোডকে টেনে কাছে আনা বড় কষ্ট।

রুদ্র তো ঘুমিয়েই যাবে।

বস, ঋষি, কতকালের চেনা?

বসের বাড়িতে সন্ধ্যাবেলা ঋষি, চিনু আর বিক্রমকে দেখে সুজয় প্রথম সন্দিগ্ধ হয়! তার আগে অবধি ও বেশ সহজ ছিল। বসের মুখ খুবই গম্ভীর, বিষণ্ণ, এবং চোখে কোনো অস্থিরতা।

রূপার হঠাৎ মনে হয় ও যেন বিচারক। গোপাকে ”গোপা নয়” বলার শাস্তি বাবা এখনি পাচ্ছে। টাকার জোরে হয়কে নয় করে ছুটে চলা এক কথা। মুখ বাঁচাবার জন্যে মেয়ের মরামুখ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেবার পরেও সমান আত্মবিশ্বাস তো থাকে না। ভেতরে কোথাও যন্ত্রণা হয়। ”ও গোপা” বলে বাবা মনে করেছে বাবা মুখ বাঁচাল। কিন্তু দাড়ি কামাবার সময়ে স্নানের পরে, বিকেলে স্নানের পর, রাতে শোবার সময় চারবার আয়নার সামনে দাঁড়ালেই তো বাবা বুঝছে। ও ভাবে মুখ বাঁচালেও যার মুখ সে মানুষ ভেতরে ভেতরে মরতে থাকে।

আর মা! মা প্রথমত এত কিছু জানে না, বোঝে না। বাবার কথামতো জল উঁচু জল নিচু করতে করতে মার নিজস্ব বলতে কিছু নেই। দিদির জন্যে কাঁদে, সেও লুকিয়ে। রূপার কাছে গোপার খবর নিত, সেও লুকিয়ে।

চিনু বলেছে, আমরা যা করতে যাচ্ছি তা বড় ভয়ানক জিনিস রূপা। সত্যিমিথ্যে জড়িয়ে কতকগুলো সম্পর্ক এতদিন ছিল। এরপর সব ভেঙে যাবে।

হ্যাঁ, বড় প্রচণ্ড ধাক্কা দিতে চলেছে রূপা। প্রাগৈতিহাসিক যুগে, পৃথিবী যখন নবীনা, তখন মহাদেশ ছিল না, ছিল একটি জমাট ভূখণ্ড।

কোন কল্পনাতীত চাপে, বিস্ফোরণে, সমুদ্রের চাপে, সেই একপিণ্ড পৃথিবী ভেঙে গেল, সরে গেল।

আজ মহাদেশদের টেনে এনে কাছাকাছি জুড়ে দিলে তারা খাঁজে খাঁজে অনেকটা জুড়ে যায়। কিন্তু কে পারে তা করতে? পৃথিবী এখন বৃদ্ধ, নিরাসক্ত, উদাসীন।

এ বাড়ির লোকজনের মধ্যে মানবিক, রক্তের, এসব সম্পর্কে যা হয়তো খানিক অবাস্তব, খানিক বাস্তব।

রূপা স—ব ভেঙে দেবে।

রূপাও তা জানে।

সুপ্তি বসুর বেশবাস যত্নহীন। চুল খোলা, চোখ দেখে ঋষির মনে হল, ঘুমের ওষুধ নিয়মিত খাচ্ছেন।

আজ দুপুরে রূপা এসেছে। নিজের ঘরে ঘুরছিল, দিদির ঘরেও। দেয়ালে গোপার ছবি। বিছানাটা ঢাকাই থাকে, বাথরুমে থাকে সাবান, শ্যাম্পু তোয়ালে। যেন এ বাড়ির বড় মেয়েটি আসে যায় নিয়মিত।

আলমারি খুললে দিদির বিয়ের আগেকার কিছু জামাকাপড় কি দেখা যাবে না?

বারান্দায় ঝাঁপিয়ে নেমেছে ঝুমকোলতা। ওই গাছের নিচে লুকিয়ে পড়ে রূপা পরীক্ষার সময়ে পড়ত। ওর থ্রিলার পড়ার জায়গাও ছিল ওটা।

কি একটা বিদেশী পাখি অসম্ভব দামে কিনেছিল বাবা। সে হতভাগা সকলকে নকল করত।

—রূপা!

—গোপা!

—রূপা!

—গোপা!

ডাকত ওদের। পাখিটা মরে গেছে। কিন্তু রূপা যে বয়ামে বয়ামে ফর্মালিন ঢেলে ডুবিয়ে রাখত কাঁকড়া বিছে, ব্যাঙ, একটা সাপ, সেগুলো আছে।

দিদি আর ওর স্কুলের বইগুলোও আছে। মা কেন স—ব জমিয়ে রেখেছে? ওগুলোই কি মার কাছে ওর হারানো, দূরে চলে যাওয়া মেয়েরা।

মা প্রচণ্ড আঘাত পাবে।

রূপার নিজেকে কসাই মনে হচ্ছে। বাবা যদি তখন মুখ বাঁচাতে না যেত, বলত ”এ গোপা’, তাহলে তো এত কিছু হত না। পুলিশ স্বাভাবিক নিয়মে যতটা এগোবার এগোত। অদৃশ্য চাপ আনলে আর না এগিয়ে কেসকে গোলকধাঁধায় ফেলত।

কেসে কি আর বড়লোক ফাঁসে?

বাবা ”এ গোপা” বলেনি।

সেজন্যেই তো রূপাকে কসাই হতে হচ্ছে।

আর তো ফেরা চলে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *