মুখ – ৫

সাধন নেশা করলেও ঋষিকে অনেক খবরাখবর দেয়। ঝাড়গ্রাম আর সে ঝাড়গ্রাম নেই। আনাজ থেকে সব দাম বাড়ছে। টাউনে পয়সা আছে, কিন্তু হাওয়া ভালো নেই। রিকশাও সংখ্যায় বাড়ছে। চারদিকে বাবু! বড় গোলমাল! সাধনের মতো লোকের বাঁচা দায়। গরিবের কথা বোঝে এমন মানুষ নেই। সেদিন সাধন পাঁচ টাকার বাজার করল, শুধু আলু আর ডাল।

এতক্ষণ কাফকার জগতে বন্দী ছিল ঋষি। সাধনের কথাগুলি বড় ভালো লাগে ওর। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের দুঃখের কথাতেও যেন ভালো লাগে। এতক্ষণ অস্বাভাবিক মানুষদের অস্বাভাবিক আচরণ ওকে দুঃস্বপ্নে বন্দী করে রেখেছিল। ঋষি একদা পুলিশ রিপোর্টার ছিল। যে নাটকটা হয়ে গেল, তার নেপথ্যকাহিনী ও আন্দাজ করতে পারছে।

গোপা, অথচ গোপা নয়!

—গাছগুলান কেট্যে টাউন ধুলাধুলি হয়ে গেল বাবু। তাতের কালে ছায়া পাই না।

—তোমার বাড়ি কোথায়?

—হোই, দুধরাজপুর!

—বিয়ে করেছ?

—তিনটা ছেলে মেয়ে।

—স্কুলে যায়?

—না। কথা লেয় না।

—স্কুল তো আছে।

—পেটে ভাত না জুটলে বাবু ………

অনেক চিন্তা করে সাধন বলে। ছেলেটিকে ভাতবাগালিতে দিব।

—নেশাতেও তো পয়সা যায়।

—লিশ্চয়।

এবার সাধন চুপ করে যায়। রিকশা ডাইনে ঘোরে। চলে। ঝাড়গ্রামের আকাশ কি পরিষ্কার, তারা কি উজ্জ্বল। ঋষি এক সময়ে তারকাপুঞ্জ চিনবে বলে বই জোগাড় করেছিল। রুদ্র প্ল্যানেটোরিয়ামে গিয়ে অনেক তারা চিনেছে। হ্যালির ধূমকেতুটা ওর দেখা হল না। খুব ইচ্ছে ছিল।

—এসে গেলম বাবু।

সাধন থামায় রিকশা। ঋষি ওকে একটি পাঁচ টাকার নোট দেয়। নিয়ে যাও।

—হাঁ বাবু!

কলকাতার বাবুরা রেট শুধায় না বলে বেশি ভাড়া দেয় মাঝে মাঝে, তা সাধন জানে।

—কাল টাউন দেখবেন বাবু?

—না সাধন, কাজে এসেছি।

বাড়িতে ঢোকে ঋষি।

চিনু আর রূপা বসে আছে। রূপা চার্মস আঙুলে ধরে রেখেছে।

—রূপা।

—এসো ঋষিদা।

চিনু বলে, চা খাবেন?

—খাব। রান্নাবান্না হচ্ছে?

—হ্যাঁ। বূধরাজ তো থাকেই।

—কেয়ারটেকার?

—যা বলেন! সেনদা ওদের ঘর তুলে দিয়েছেন। পাকা ঘর, টিউবওয়েল, স্যানিটারি পায়খানা। আগে ওঁর প্রজেক্টে ছিল।

—খিদেও পেয়েছে।

—রান্না হয়ে যাবে।

—রূপা কিছু খেয়েছে?

—চা, সিগারেট। আমি চা নিয়ে আসি।

চিনু চলে যায়।

রূপা ঋষির দিকে তাকায়।

—তাহলে নাটক শেষ?

—আমি জানি?

—কে জানে ঋষিদা?

—তুমি জানো।

—আমি তো ফালতু হয়ে গেলাম।

—আমার কাছে নয়।

—তুমি তো ”নো”—তে কাজ করছ।

—হ্যাঁ… কিন্তু …

ঋষিদা বেদনামলিন চোখ তোলে। অনেক সহজ মনে হচ্ছে কেন? এ বিষয়ে ও কোন পক্ষ নেবে সে বিষয়ে যদি বা সংশয় ছিল, গোপাকে দেখার পর কোনো সংশয় নেই। বুকটা পুড়ে যাচ্ছে।

—ও তো গোপা, রূপা!

—হ্যাঁ, দিদি। কিন্তু বাবা … বাবা …

রূপা হঠাৎ কাঁদতে শুরু করে। ঋষি ওকে কাছে টেনে নেয়, মাথায় হাত বুলায়। হাজার হলেও রূপা তো বয়সে খুব তরুণ। তরুণ মনে মূল্যবোধ থাকলে আঘাত লাগে বেশি। রূপার মতো তরুণ যারা, তারা সাদা কালো ছাড়া কোনো রং মানে না।

ধবধবে সাদা আর কৃষ্ণপক্ষে কালো, দুয়ের মাঝামাঝি তো ধূসরের নানা স্তর থাকে। সে গুলোর সঙ্গে লড়াই করতে চাইলেও অভিজ্ঞ হতে হয়।

তরুণ, নিষ্পাপ রূপা তা জানবে কেমন করে?

কাঁদুক, কেঁদে হালকা হোক। প্রায় বাহাত্তর ঘণ্টা তো ও চলেছে উত্তেজনায় টানটান হয়ে।

—রূপা!

কান্নাবিকৃত গলায় রূপা বলে, এত বড় অবিচার ঋষিদা, এত বড় অবিচার! দিদিকে দিয়ে সমস্ত মেয়েদের ব্যাপারটা বোঝো ঋষিদা। দিদি! আমার দিদি!

—রূপা!

—বলো।

—এখন শক্তি হারালে চলবে না। তুমি স্নান করবে, খাবে, ঘুমোবে।

—তুমি আমার কাছে থাকবে।

চিনু চা নিয়ে ঢোকে।

—অবশ্যই থাকবে। শোবার ঘর, একটা, খাট দুটো, মশারি দুটো। আমি তুই, ঋষিদা ও ঘরেই থাকব। ঋষিদার কথা শুনবি তো?

—শুনব।

রূপা কাঁদতে কাঁদতেই বলে, আমি খাই নি বলে তুইও খাস নি, রবিও খায় নি…

—এখন খাব। ওঃ, ও.সি. লোকটা কিন্তু খারাপ নয়। অন্তত সকাল অব্দি কথাটথা বলছিল। আপনারা আসার আগে কি যে ফোন পেল…

রূপা বলে, ঋষিদা?

—বলো? বাঃ বেশ চা তো।

—চিনু করেছে। আচ্ছা ফোনটা কে করাল, সুজয় না বস, তা জানো?

—সত্যি জানি না। সকালে বসের ফোন পেয়ে ওবাড়ি গেলাম। ঝাড়গ্রাম আসতে হবে শুনে বাড়ি চলে গেলাম। বেলায় ওঁরা দুজন গাড়ি নিয়ে এলেন। ওঁদের দুজনের যে কেউ হতে পারেন। তবে বস খুব বিচলিত ছিলেন। আয়, সুজয় বারবার বলছিল, এটা সার্কাস হচ্ছে।

—সার্কাস! ও তার রিং মাস্টার?

—ব্যাপারটা যথেষ্ট ঘোরালো।

—না, ঘোরালো নয়।

রূপা মাথা নাড়ে, মাথা নাড়ে।

—এই চিঠিটা পড়লেই বুঝবে। পরে পোড়ো। দিদি যদি একবার জানত ও কত কাছে ছিল!

চিনু বলে, চিঠিটা ব্রেসনেতে এসেছিল। আমাদের ইউনিট তো চলে গেল। ক’দিন এখানে থাকবে রূপা জানত না ওরা। রবি কাল এল, চিঠিটা ভাগ্যে আসল।

—আজ ও চলে গেল?

রূপা চোখ মোছে। বৃষ্টি হলে আকাশ পরিষ্কার। কান্নার পর রূপার চোখ উজ্জ্বল।

—আমার সঙ্গে ইউনিট ছিল। দিদির অনেক ছবি চিনু লাইনের পাশেই তুলেছে। রবি নেগেটিভ নিয়ে চলে গেল। বস আর সুজয় যে ব্যাপারটা ঘোরালো করবে, চিনু তা ভেবেছিল।

চিনু একটু ঝুঁকে বসে। উজ্জ্বল, বুদ্ধিমান, দক্ষ একটি ছেলে, অসম্ভব স্মার্ট।

গোপা পছন্দ করত অন্যরকম পুরুষ। সাধারণ, ভদ্র, স্বভাববিনয়ী, ব্রিলিয়ান্ট না হলে কিছু এসে যেত না ওর। অরূপ যেমন ছিল। হয়তো বিক্রম তেমনই একটা ছেলে।

চিনু বলে, পিঠাডিহা থেকে ঝাড়গ্রাম কয়েকবার এসেছি, গিয়েছি। ঠিক তিনদিন আগে, এক ঝলক দেখলেও সুজয়কে আমি সবুজ গাড়ি চালিয়ে যেতে দেখেছি। রূপাকে বললাম;

—আমি বিশ্বাস করি নি। আমি তো… জানতাম না… দিদি কাঁটাজুড়ির কাছেই ছিল!

মণ্ডলও সুজয় এবং সবুজ গাড়ির কথা বলেছে।

—তুমি কবে জানলে?

—চিঠি পড়ে?

—কাঁটাজুড়ির কাছে!

চিনু বলে, অরবিন্দ সেন, মানে সেনদা। ওখানে আগে প্রজেকট করতে যায়, পরে ছেড়ে দেয়। জমিটা সুবিধের নয়, জল দাঁড়ায় না। বাড়ি একটা ছিলই।

—অরবিন্দ সেন জানতেন?

—ওখানেই তো দিদি মার খেল ঋষিদা। সেনদা তো কলকাতায়। দিদি আগে পিঠাডিহা এসেছে, কাঁটাজুড়িও গেছে। ওখানে যে থাকে, মণ্ডল দিদিকে চেনে। লোকটা একটু নেশাড়ে। দিদিকে বাড়ি খুলে দিয়েছে। রাতে শুতে আসত, ওর বোন থাকত। সব সময়ে না থাকতেও পারে। দিদি একা হতে চেয়েছিল।

—বিক্রম কোথায়?

—ওর মার অসুখ! কাঁথি চলে গেছে। দিদি লিখছে, বিক্রম আর রিমকিকেও লিখলাম।

—সুজয় জানত কাঁটাজুড়ির কথা?

—রিমকিকে লিখেছে, সে বলতে পারে।

হ্যাঁ, একের পর এক মিলে যাচ্ছে। শব্দ ধাঁধার শব্দ যেমন মিলিয়ে দেয় হিসেব।

ঋষি মন ঠিক করে।

—এখানে আর নয়। কলকাতায় গিয়ে সব ঠিক করা যাবে। রূপা! স্নান করো।

—যাই। শরীর এলে আসছে।

চিনু আর ঋষি কুয়োর জলে স্নান করে। চিনু রূপাকে বালতি ভরে জল দেয়। কুয়োর জল খুব ঠাণ্ডা।

বুধরাজের বউ ভাত, ডাল, আলুসেদ্ধ এনে দেয়। খেতে না খেতে রূপা ঘুমিয়ে পড়ে।

ঋষি আর চিনু বাইরে বসে।

—অরবিন্দ সেনের কত টাকা।

—অনেক। সেন অ্যানড সেনদত্ত জুয়েলার্স নাম জানেন না? উনি ব্যবসার অংশ ছেড়ে দিয়ে টাকা নিয়ে এখানে চলে আসেন। তবে ছিয়াত্তর বছর বয়স হল, এ বয়সে কিডনির নানা গণ্ডগোল! বিয়ে করেন নি। ওঁর পর কে চালাবে কে জানে!

—কে চালাবে?

—ট্রাস্ট করছেন একটা। দ্বিজেনবাবু যদি থাকে, চলবে। নইলে গণ্ডগোল!

—সমবায় আছে না?

—সবই সমবায়। তবে আদিবাসীদের ঠকিয়ে ব্যাপারটা হাত করতে অনেকেই চায়।

—দ্বিজেনবাবু কে?

—দ্বিজেন হেমব্রম। স্কুলটা চালায়। খুব সৎ সজ্জন। আর নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা রাখে। সেনদার হাতে তৈরি কর্মী। ওঁর বাবাই প্রথম থেকে ছিলেন।

—কেউই গোপাকে দেখে নি?

—না, গোপাদি তা চায় নি।

—ওকে… পেলে কি করে?

—খুব অদ্ভুত। আমরা ঝাড়গ্রামে ফিরছি। একদিন থেকে চলে যাব। ছবিটা ভালো তোলা হয়েছে। কাজের সময়ে খাওয়াদাওয়ার ঠিক থাকত না। ঝাড়গ্রামে এসে মাংস ভাত খাব… খুব। যাকে বলে খুশিয়াল মেজাজ! তা, হঠাৎ দেখি লাইনের ধারে ভিড়।

—তারপর?

—ওরাই এগিয়ে এল। বলল, একটা বাবু মেয়ে মরে পড়ে আছে। আমরা তো ঝাড়গ্রামের দিকে যাচ্ছি। থানায় যদি খবর দিই।

—তোমরা নামলে?

—নামলাম। তারপর তো…

—কি করলে?

—আমি রূপার কাছে থাকলাম। ওরা ঝাড়গ্রামে থানায় বলে ম্যাটাডোর ভাড়া করে নিয়ে এল। তারপর … গোপাদিকে … টেলিফোনে কলকাতা ধরা …

—চিনু!

—বলুন।

—মুখের বাঁ দিকটা ও রকমই ছিল?

—শেষ অবধি রিপোর্টে কি থাকবে কে জানে। কিন্তু ডাক্তার বলেছিল, মুখের বাঁ দিকে মেরে এমন ভাবে ফেলা হয়েছে, যে গোপাদি নিশ্চয় জ্ঞানে ছিল না। ফেলার আঘাতে ঘাড় ভেঙে যায়। অবশ্য এটাও বলেছে, মৃত্যু অন্তত আগের রাতে হয়েছে। শরীরের যে সব দাগ ছিল, ছেঁচড়ে নিয়ে ওখানে ফেলা হয়েছে মনে হয়।

—কাছে কোনো লোকালয় নেই?

—না না। জল দাঁড়ায় না, চাষ হয় না, ঝোপঝাড় আর বুনো ঘাস। কাছে গ্রামও নেই।

—ও সব লোক কোত্থেকে এল।

—ওরা কাজে যাচ্ছিল। লাইন ধরে হেঁটে যাওয়াই তো সুবিধে ওদের।

—তুমি ছবি তুললে?

—হ্যাঁ, আমি তো একটু সন্দিগ্ধ প্রকৃতির বরাবরই। মনে হল তুলে রাখি। রূপাও একটু সামলে নিয়েই বলল, ছবি তোল চিনু। এরপরে কতক্ষণ যাবে, চেহারা বিকৃত হয়ে যাবে। আসলে রূপা আঁচ করেছিল যে ওর বাবা, সুজয় ঘোরপ্যাঁচ কষতে পারে। তবু বাবা যে ”না” বলে দেবে, অতটা ভাবেনি। ভেবেছিল, বাবা দেখলে ”হ্যাঁ” বলবে।

—ওটাতেই ওর লেগেছে বেশি।

—স্বাভাবিক।

—তুমি খুব অবাক হওনি।

—না না। ওরা যে শ্রেণীর লোক! ওরা সব পারে। আর গোপাদি আমাদের দিদি, বন্ধু। আমরা তো বুঝতাম যে ওকে অনেক সইতে হয়েছে। অরূপ টরূপ, সবই আমি জানি। আমি আর রূপা তো খুব বন্ধু।

—হ্যাঁ, অরূপ…

হঠাৎ কি কোনো চিঠি আসবে মধ্যপ্রদেশ থেকে? এলেও সে চিঠিতে ঠিকানা থাকে না কোনো। কেমন করে ঋষি জানাবে যে গোপা আর নেই। কে বা কাহারা গোপাকে হত্যা করে কিছু বুনো ঝোপ, বুনো ঘাসের প্রযত্নে রেখে সরে পড়েছে?

”কে বা কাহারা” শব্দগুলির কি বিশাল বিস্তার। খুন, জখম, রাহাজানি, অত্যাচার, যেখানেই প্রভাবশালী মানুষ বা দল খবর চেপে দিতে চায়। সেখানেই অপরাধীদের নাম থাকে না। সবাই ”কে বা কাহারা” হয়ে যায়।

—শুয়ে পড়ুন ঋষিদা।

—হ্যাঁ, চলো।

বুধরাজের বউ এসে দাঁড়ায়।

—কাল তোরা থাকবি?

না রে বউ।

—সকালে টিফিন কি খাবি?

—সকালে দেখা যাবে।

—দরজা বন্ধ করে দেখে নিস।

—হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই ভাবিস না।

ওরা ঘরে ঢোকে। চিনু বারান্দার চেয়ার ঘরে তোলে। দরজা জানলা বন্ধ করে। আলো নেভায়।

রূপা অঘোরে ঘুমোচেছ।

চিনু বলে, ভাগ্যে আপনি এলেন!

ওরা শুয়ে পড়ে। চিনু বলে বালিশ আপনি নিন।

আমি বালিশে শুই না।

ঋষির ঘুম আসে না। গোপা, গোপা, এখন বেওয়ারিশ লাশ। কাল হয়তো পুলিশ জ্বালিয়ে দেবে। কি প্রচণ্ড আঘাতে মুখ ওভাবে থেঁতলে যায়?

কোনো সময়ে ঘুম আসে। কেন না মুখে রোদ পড়তে ঋষির ঘুম ভাঙে।

চিনু নেই, রূপা নেই। ওরা চলে গেল?

রূপা মুখ ঢোকায়, উঠে পড়ো।

—হ্যাঁ বেলা হয়ে গেছে।

বেঁচে গেছ খুব। বস, গাড়ি, হাঁকাহাঁকি,—আমি বললাম ঋষিদাকে যেতে দেব না, আমার সঙ্গে যাবে, আমরা ট্রেনে যাব।

—ওঁরা চলে গেছেন?

—যাবেন না? আটটা তো বাজে।

—আটটা!

চিনু চা নিয়ে ঢোকে!

—হ্যাঁ, আটটা এবং আমরা স্নান সেরে দৌড়ব, দৌড়ব। স্টেশনের কাছের হোটেলে খাব। দশটা পাঁচের এক্সপ্রেস বাস ধরে দুটোয় হাওড়া পৌঁছব।

—রূপা রেডি?

—নিশ্চয়।

উঠে চা খেয়ে, স্নানাদি সেরে ওরা বাইরে এসে বসে। বুধরাজ দোকানে গেছে। ওকে সব বলে, বুঝিয়ে দিয়ে যেতে হবে।

—গোপার চিঠিটা!

—জেরক্স করে তবে দেব।

—এখানেই পড়ে নিই?

—না, ঋষিদা। তোমার মন খারাপ হয়ে যাবে। জেরক্স করব আর এটা যত্ন করে রেখে দেব। কাউকে ধরতে দেব না। রাগ কোর না, তোমাকেও দেব না। দিদি তো আর লিখবে না।

—না, আর লিখবে না।

—বিক্রমকেও দরকার।

বুধরাজ এসে পড়ে। দিনের আলোয় দেখা যায় বুধরাজের ঘরের সামনে মুরগি কয়েকটা। উঁচু বেড়ার ঘেরে কিছু সবজি চাষ।

রূপা বলে, বুধরাজ বাড়ি বিষয়ে ভীষণ সজাগ। সেনদার বিষয়ে ও অসম্ভব অনুগত। হবারই কথা। সেনদা ওকে লিখে পড়ে এ বাড়ি দিয়ে দিয়েছে। সেনদা মরে গেলে এখানে আমরা এলেও ভাড়া দিতে হবে।

—ও কি রক্ষা করতে পারবে?

—ওর ছেলেরা আছে না?

—তারা কোথায়?

—একজন এখানে রাজ কলেজে পড়ে, আরেকজন খড়্গপুরে কি ট্রেনিং নিচ্ছে। সব সেনদার জন্যে। ওর মেয়েকে তো দেখিনি। তার বর বাঁকুড়ায় হোমিওপ্যাথ। মেয়ে যা সুন্দরী, নায়িকা হতে পারে।

বুধরাজের বউ এগিয়ে এসে হঠাৎ রূপার হাত ধরে, দিদি, ভাবিস নাই।

—না বউ!

—আবার কবে আসবি?

—এই রকমই, হঠাৎ।

ওরা বেরিয়ে আসে। যাক, সুজয় এবং বস, আর অরবিন্দ সেন, সবই সত্যি। ঋষি বলে, থেকে যাবার মতো বাড়িটা।

—আমরা তো অনেক থেকেছি।

—বুধরাজরা বলাবলি করবে না তো?

—না, বারণ করেছি।

হাঁটতে হাঁটতে, হাঁটতে হাঁটতে, স্টেশনের কাছে। হোটেলে ভাত, ডাল, আলুভাজা, টক। খেতে না খেতে এক্সপ্রেস বাস।

রূপা জানলার ধারে বসে।

ওর চোখ দিয়ে চল পড়তে থাকে। চিনু একটা তোয়ালে রুমাল এগিয়ে দেয়।

রূপা বলে, ঝাড়গ্রাম আসতে পারব না মনে হচ্ছে। এলেই স—ব!

বাস দ্রুত চলে। ঋষি আশ্বস্ত হয় যে বাসে ক্যাসেটে গান বাজছে না।

চিনু বলে, রূপা! যাবি কোথায় ঠিক করেছিস? না কলকাতায় পৌঁছে ঠিক করবি।

ঋষি বলে ও বাড়ি না যায়, আমার ওখানে যাবে। কোনো অসুবিধে নেই।

রূপা বলে, বিজয়া প্যাটেলের ওখানে যাবি এখন। ও তো কবে থেকেই বলছে। ওদের ঘরও আছে, অসুবিধেও নেই। বাড়িতে গিয়ে জামাকাপড় আনতে হবে, মাকেও বলতে হবে, কিন্তু এখনই পারছি না।

—আমার বাড়িতেও থাকতে পারো।

—ভাড়া নেবেন তো?

—ভাড়া দেবার আলাদা ঘর নেই, তবু সর্বদাই তুমি স্বাগত।

—আপনার ওখানে গেলে বাবা যখন তখন যাবে।

—তাও সত্যি। তাতে আমার কিছু নয়….

—না, না, মাসিমা অসুস্থ তাকেন। রুদ্র আছে।

—বিজয়া প্যাটেল কে?

—আমাদের সহকর্মী। প্রজেকট করে।

—কোথায় বাড়ি?

—বালিগঞ্জ প্লেস ইস্ট। এত প্রশ্ন কেন, আপনি আমার গার্জেন হয়ে গেলেন।

—হ্যাঁ, আপাতত। তুমি যত স্বাবলম্বী হও, আমার কাছে তুমি তবুও ছোট।

চিনু বলে, বাঁচলাম।

—কেন?

—আপনাকে দলে পেয়ে।

—আমি বিশ্বাসযোগ্য তো?

—বিশ্বাস ভাঙলে বিশ্বাসযোগ্য থাকবেন না।

ক্রমে দৃশ্যপট বদলায়। কাঁকরমাটি ও সামাজিক বন সৃজন থাকে পেছনে! কলাগাছ, ধানক্ষেত, পাকাবাড়ি, কাঁচাবাড়ি, অন্য দৃশ্যপট।

কলকাতা অমোঘভাবে কাছে আসতে থাকে। কালই কি এমন সময়েও ঋষি সবে কলকাতা ছেড়েছিল?

রূপা হঠাৎ বলে, আমার কোনো বিশ্বাস নেই, কিন্তু বসের আছে। দিদিকে বেওয়ারিশ লাশ করে দিল। কোনো শ্রাদ্ধশান্তি…..

—তোমার ইচ্ছে হলে কোর। তবে সব ব্যাপারটা ঠিক মতো ওতরালে তাতেই পারলৌকিক হবে।

—রূপা বিষণ্ণ হেসে বলে, তাই ঠিক।

—কলকাতা পৌঁছে আগে ব্রেসনে?

—হ্যাঁ।

—ঠিক থাকবে তো?

—নিশ্চয়ই। আর কি ভাঙি? … মেয়েরা সমাজের সব স্তরেই খরচের খাতায়।

—মেয়েদেরই সেটা বদলাতে হবে।

—সময় লাগবে। চারদিকে এত মধ্যযুগ।

কলকাতা পৌঁছেই ঋষি বলে, বস ফোন করলে আজ বলিস কমল, বাড়িতে নেই। কাল দেখা যাবে।

কুমুদিনী ওর হঠাৎ চলে আসায় যেন একটু নিরাশ কয়েকদিন থাকবেন বলে এসেছিলেন।

ঋষি বলে, তুমি থাকবে ক’দিন। শুধু ছেলে নাতিদের রেঁধে খাওয়াবে কেন? তুমি থাকলে রুদ্রও কত ভালো থাকে, তা তো দেখতেই পাও।

—চেহারা কালি বর্ণ কেন?

—যাওয়া আসার ধকল নেই!

কমল ঘরে আসে।

—ওদিকে কি হল?

—চূড়ান্ত জঘন্য ব্যাপার।

—থাক, পরে শুনব।

—এদিকে তোমার সাম্রাজ্য সব ঠিক আছে। মাসি এসে যেতেই আরোই ঠিকঠাক সব।

—মা, রুদ্র?

—মাসিমাকে তো দেখলেই। রুদ্রও ভালো। তবে দমাদম লাথি মারে ঘুমিয়ে। আগে তো মারত না।

—আগে তো টি.ভি.তে বিশ্বকাপ দেখে নি।

—বালিশ গুঁজে নিও।

—হ্যাঁ… তোয়ালেটা ফেলে এলাম।

—যাক গে।

—গোপাকে দেখার পর…

—গোপাই তবে?

—স—ব বলব।

স্নান করলেও স্মৃতি যাচ্ছে না। গোপার মৃতদেহ মনকে যেন কলঙ্কিত করে রেখে গেছে। আজ রাতে একটা ঘুমের ওষুধ খেতে হবে। খুব গাঢ় ঘুম দরকার।

রানী চা নিয়ে আসে।

—কিছু খাবে?

—কিছু না।

—মাসী নাতির জন্যে মোচার চপ ভাজছে।

—তাহলে আনো।

দৈনন্দিনতায় ফিরতে চায় ঋষি। দৈনন্দিনতায়। কি গোপার গলিত রক্তাক্ত দেহ এখন সব কিছু ঢেকে দিচ্ছে। কলকাতার ওপর দিয়ে বিছিয়ে যাবে না কি গোপার শব কেন, কেন গোপার এমন পরিণতি হবে?

জল ঢালে ঋষি, অনেক জল ঢালে।

ফোনটা রিসিভার থেকে নামিয়ে রাখে। বস হয়তো ফিরেই ফোন করতে থাকবেন।

সকাল না হতেই ফোন আসে। কমল ধরে।

—ঋষিদা, রূপা!

—রূপা। কেমন আছ?

—শোনো, সন্ধ্যায় এখানে এসো। ঠিকানাটা লিখে নাও। আর শোনো, বস ফোন করলে…

—”জানি না” বলব।

—না, বলবে রূপাই যোগাযোগ করবে। বলবে, আমি ফিরছি না বলে হইচই করলে ফিরবই না।

—বাড়ি যাবে তা হলে?

—একবার তো যাবই। না গেলে বস যা করবে, তোমার অশান্তির শেষ থাকবে না।

এবং বেলার দিকে বস ফোনে গর্জে ওঠেন।

—ব্যাপার কি, ঋষি?

—কিসের ব্যাপার?

—তোমার খোঁজ নেই। রূপার খোঁজ নেই। কাল থেকে ভাবতে ভাবতে … তোমরা কি চাও আমি পাগল হয়ে যাই?

—শুনুন, রূপা, আমরা কালই ফিরেছি।

—রূপা কোথায়?

—ওর কোনো পরিচিতের বাড়িতে। আমাকে বলে নি। আজ ফোন করেছিল। বলেছে, প্রথমত ওই যোগাযোগ করবে। দ্বিতীয়ত, ওর খোঁজে হইচই করলে ও আর ফিরবেই না।

—খোঁজও করব না?

—ওর মনের যা অবস্থা…

—বড্ড বেড়ে গেছে।

—ও যা বলেছে, বললাম। তারপর আপনি বুঝে দেখবেন। তবে রূপা তো গোপা নয়।

—ওঃ…!

—রাখছি।

—তুমি আসছ না কেন?

—আমি একটু অসুস্থই ওখানে যাবার পর… রাখছি।

—এখনি যাবার তো দরকারও নেই।

—বেশ!

ফোন নামিয়ে রাখেন উনি।

ঋষি বুঝতে পারে যে ওঁর মাথাও ছিঁড়ে যাচ্ছে! অবশ্য তাতে ভয়ের কিছু নেই। সকালে হাঁটেন, সারাদিন কাজ করেন, নিয়ম বেঁধে খান, মাঝে মাঝে ডাক্তার দেখে। রক্তচাপ, রক্তশর্করা, রক্তে ক্লোরেস্ট্রাল, হৃদযন্ত্রে যান্ত্রিক গোলযোগ, কিছু নেই। য়ুরোপ থেকে যখনি ফেরেন, তখন অত্যন্ত তরুণ।

—যাবার জন্যে য়ুরোপ, আমেরিকা, আর থাকার জন্য ভারতবর্ষ, বুঝলে ঋষি?

—বুঝেও তো আমি নবীনচাঁদ রোডেই থাকব।

বসের মাথাও ছিঁড়ছে।

রূপা ব্যাপারটা নিয়ে কি করবে তা জানতে না পারলে উনি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। গোপাকে উনি মুছে ফেললেন মন থেকে?

মানুষ সব পারে।

নবীনচাঁদ রোডেই ”দেবস্মৃতি” বাড়ি আজও আছে। ওই বাড়িটি বিক্রি করে মালিক চলে গেছে।

ঋষির জন্মেরও আগে ও বাড়ির মেয়ে সুজাতা এক বেজাতের ছেলেকে ভালোবেসেছিল। ওর বাবা মা খুবই দাম্ভিক ছিলেন। কিন্তু শেষ অবধি যা করলেন, তা পিশাচেও করে না।

রাত দশটা অবধি সুজাতাকে সবাই দেখেছে। ভোরে দেখা গেল ওর বাপ ভাই দাদারা শ্মশান থেকে ফিরছে। রাত বারোটায় কলেরা। একটায় মৃত্যু, চারটায় দাহ শেষ, এই গল্পটি বাজারে ছাড়া হল। মেয়েকে ওঁরা বিষই দেন, ঝি চাকররা বলে।

সবচেয়ে ভীষণ হল, এই মৃত্যুর বাইশ দিন বাদেই সুজাতার বাবা মা ফুলসাজে সেজে, সানাই বাজিয়ে নিজেদের বিয়ের তিরিশ বছর উদযাপন করেন। এই প্রথম বিবাহজয়ন্তী, তাও ওই মৃত্যুর পর।

মানুষই তো সব পারে। বস যদি গোপাকে খরচযোগ্য মনে করেন, রূপাকে ছেড়ে দেবেন? তা ছাড়া, ওঁর তো ছেলে আছে, ভাস্বর। রূপার কারণে যদি ওঁর সাম্রাজ্য বিপন্ন হয়, তাকে ছাড়বেন না।

রূপার নিরাপত্তা দরকার।

সন্ধ্যায় যেতে হবে বালিগঞ্জ প্লেস ইস্ট।

বালিগঞ্জ প্লেস ইস্টে রূপা একটি স্বতন্ত্র কামরা পেয়েছে। বিজয়ার বাবা মরে যেতে বিজয়ার মা অত্যন্ত সাহসে বাড়ি বিক্রির ব্যবসায়ে নেমে যায়। এখন ওঁর ‘উর্বশী’ বুটিক খুব দাঁড়িয়ে গেছে। দোকানটি পার্ক স্ট্রীটে। ছেলে আমেরিকায়, মেয়ে ব্রেসনেতে। একটি ঘর ও বাথরুম উনি চেনাজানার মধ্যে ভাড়া দিতেই চান। বাড়িতে লোক থাকা ভালো।

ঘরটি বড়সড়। একান্তেও বটে। এ ঘর থেকে বেরোবার দরজা আলাদা। ফলে বাড়ির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। বিজয়ার মা পাঞ্জাবিনী। বাবা গুজরাতী। ঠাকুমা মারাঠী। ফলে বাড়ির হাওয়া খুব আধুনিক। শত কাজেও বিজয়ার মা গোবিমটর, ছোলেপনির বা সর্ষে কা শাক রেঁধে যান। রূপার ধারণা, খেয়ে খেয়ে ও মোটা হয়ে যাবে।

চিনু, রূপা আর ঋষি বসে।

—আমরা একজনের জন্যে অপেক্ষা করছি ঋষিদা। ততক্ষণে তুমি ছবিগুলো দেখ, দিদির চিঠিটা পড়ো। দেখ, ছবি আর চিঠি সবই চার সেট। বস, সুজয় তুমি, আমি।

ছয়টি ছবি। গোপার ঘাড় ঘুরে গেছে। হাত এলানো। মুখের বাঁ পাশ থেঁতলানো।

আরো ক্লোজআপে গোপার চিবুকের নিচে জরুল, পেটের বড় তিল স্পট। হাত—পার আলাদা ছবি। বাঁ পায়ে বুড়ো আঙুলটা বেঁকা।

—আঙুল ভেঙে গিয়েছিল। ঠিক হয়নি।

সর্বাঙ্গ আভরণ হীন। চোখ একটু খোলা। হালকা ছাপা কাপড়, হাতকাটা জামা।

—শাড়িটা আমি দিছলাম।

—এখানে তো বডি খুব স্বাভাবিক।

চিনু বলে, ওই গরম! বরফের কোনো ব্যাপার নেই। ঝাড়গ্রামে নেবার পর পচ ধরে গেল, রস কাটল, কত রকম হল।

—চিঠিটা পড়ো।

গোপার চিঠি খুব পরিষ্কার। ছোটবেলা থেকে ভালো হাতের লেখার জন্যে পুরস্কার পেত।

”রূপা”!

ঠিকানাটা দেখে অবাক হবি। তোরা কাছেই আছিস, কাজ করছিস! তা জেনেও আমি যোগাযোগ করিনি। আমি একলা নিজের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম।

সেনদার এ বাড়িটায় কি শান্তি কি নির্মলতা। জানলা জানলা দিয়ে চাইলে আকাশ। জানলার বাইরে গাছের ডালে রোজ একটা লক্ষ্মীপেঁচা এসে বসে। কোনো বই পড়ি না। তিনটে কাপড় নিয়ে চলে এসেছি। মঙ্গলের বোন ফুলমণি রাতে শুতে আসে। ওদের কোনো বানানো সমস্যা নেই। একটা শুওরের দখল নিয়ে ফুলমণির সঙ্গে মঙ্গলের বউ ঝগড়া করে। ওই বউয়ের কেমন ভাইয়ের সঙ্গেই ফুলমণির প্রেম হয়েছে।

বিয়ের সময়ে বর ফুলমণির অভিভাবক মঙ্গলকে একটি শুওর দেবে। ফুলমণি তখন নিজের পালিত শুওরটি নিয়ে যাবে। ফুলমণির জন্যে আমি রাতে রেঁধে রাখি। কাঠের আগুনে ভাত, শাক, ও খায়। আমিও খাই। সকালে দুধ ছাড়া চা। কুয়োর জল তুলে স্নান করি।

সত্যি বলতে কি, পিঠাডিহাতে তুই আছিস, আর এত কাছে, মানে কয়েক মাইল উত্তর পশ্চিমে কাঁটাজুড়িতে আমি আছি। তবু তোকে জানাইনি। আমি তো নিজের সঙ্গে নিজে একা থাকব। যে সিদ্ধান্ত নেব সেটা হবে আমার একার, তার মধ্যে তুই, বিক্রম, কেউ থাকবি না। এটা আমার নিজের জন্যেই খুব দরকার ছিল।

একলা থাকার কি যে আনন্দ তা আগে বুঝি নি। একা তো আমি বরাবরই। বাবা কত বড়, আমি কত অযোগ্য, এটা তো আমাকে অনেক আগেই বুঝিয়ে দেয়া হয়। তোর কত বুদ্ধি, আর আমি কোনোদিন চক্রবৃদ্ধি সুদের অঙ্কই বুঝতাম না বলে ”বোকা, গবেট” তো কম শুনি নি।

কোনদিন তোকে হিংসে করার কথা মনেও হয়নি। বরং খুব গর্ব হয়েছে বরাবর। তারপর, আমি তো আমাকে মুক্তি দিতে পারছিলাম না। যেন মাকড়সার জালে জড়িয়ে পড়ছিলাম। বাবা, মা, সুজয়, সকলেই আমার কাছে অলীক। তবু নিজে নিজের জন্যে কি করছিলাম! তুই তো আমাকে ”ব্রেসনে”তে নিয়ে এলি। বেরিয়ে এসে আবিষ্কার করলাম। এটা আরো আগে আমিই করতে পারলে নিশ্চয় আরো আগে জালটাও অলীক হয়ে যেত।

বাবা আর সুজয়ের সুবিধার্থে, বিয়ে।

মাকড়সার জাল খুব বাস্তব। একই সঙ্গে খুব অলীক। ”অলীক” সেটা নিজে জানতে হয়। জানার পরেও মুক্তি পায় কতজন? সকলের তো রূপা থাকে না ব্রেসনে না অনুরূপ কিছু থাকে না। থাকে না আমার মতো কিছু লেখাপড়া ও যোগাযোগ থাকার জোর।

আমার একাকীত্বের কথা বলছিলাম।

অরূপের সঙ্গে সে সময়টা একা ছিলাম না। অরূপের জেল হল, লজ্জা, লজ্জা! পথ না পেয়ে মরতে গেলাম। সে সময় যদি মনে জোর এনে চেঁচিয়ে বলতে পারতাম, আমার বয়স উনিশ! কেউ ফুসলে আনে নি আমাকে!—এ সব কথা লিখছি, কেন না অরূপ আমার মনে কোথাও বিবেকের মতো জেগে থাকে।

তারপর একা, তারপর সুজয়।

কয়েকটা কাজের কথা বলি। সুজয় রিমকির ব্যাপারেও এক ব্যবহারই করেছে। বিধবাকে বিয়ে করতে ওর সংস্কারে বাধে। তাই বিয়ে করে নি।

রিমকি ভেবেছে সুজয় ওকে ভালবাসে।

সুজয় কাউকে ভালবাসতে পারে না। রিমকিকে ও ছাড়বে না কেন না রিমকির স্বামী চা বাগান থেকে অনেক টাকা করেছিল। সল্টলেকের বাড়ি, ব্যাঙ্কের টাকা, সবই সুজয় বাগাবে।

সুজয় সুকৌশলে রিমকির ভাইকে মঞ্চ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এরপর রিমকিকে হয়তো চিরতরে সরাবে। কেন না আমি রিমকিকে ফোনে সেদিন বলেছি, তোমরা বিয়ে কর না কেন?

শুনলাম, আমি ডিভোর্স দিচ্ছি না।

তখন দেখা করে সব খুলে বললাম। আর আজ একই সঙ্গে রিমকিকে সব খুলে লিখেছি।

বিক্রমকেও লিখেছি।

আমার চিঠি পেলে রিমকির যদি কোনো দুর্বলতা থাকে, তা কেটে যাবে। অবশ্যই ডিভোর্সের পর ও সুজয়কে বিয়ে করতে পারে। না করলেই বুদ্ধির পরিচয় দেবে। অন্তত এটা ভাবতে ভালো লাগছে যে আমার চিঠি পেয়ে রিমকি ওকে চেপে ধরবে। সুজয় দেখবে আমি আর রিমকি, ওর পা রাখার দুটো জায়গাই নেই।

রিমকিকে বলেছি, সুজয়কে দেখালে জেরকস চিঠি দেখিও। চিনুর কথা শুনে শুনে আমার চোখ বেশ খুলেছে।

বিক্রমের কথা বলি।

ও যে আমাকে চায়, সে তো আমি জানি। কিন্তু একেবারে একলা না হলে আমি কেমন করে জানব যে আমি সব কিছুর পরে ওকেই চাই?

একা, একা, নিজের মনের জোরে জটগুলো খুলছি। আমি জানি, এবার ফিরে গিয়ে ডিভোর্স করব। বিক্রমকে লিখেছি, তোমার জন্যে আজ ডিভোর্স চাই, সেটা সত্যি নয়।

মুক্তি চাই নিজের জন্যে।

তোমাকে পরে যদি বিয়েও করি, তাহলেও যেন নিজের মনে এ অহংকার থাকে, যে অসহ ও ব্যর্থ জীবন টানব না বলেই ডিভোর্স করেছি। তুমি আমার জীবনে না এলে, আমায় পরেও বিয়ে না করলে, তবু আমি সুজয়কে ছাড়তাম।

বিক্রমকে এ সব কথাই লিখেছি। ও অবশ্য কথাটা জানে। আমিই বলেছি।

বিক্রমের ধরন—ধারণ, ভদ্রস্বভাব, স্বভাবনম্রতা কেমন যেন অরূপের সঙ্গে মেলে, তাই না?

আমার ওরকম সাধারণ মানুষই ভাল লাগে।

আজ তোকে সব কথা লিখলাম। তুই, রিমকি, বিক্রম, কিছু আগে পরে চিঠি পাবি।

আর দিন সাতেক বাদে আমি কলকাতা ফিরব।

এখানে ঝোপে কি যেন নীলচে তুলোর পুঁটলির মতো ছোট ছোট নরম ফুল ফোটে। ফুলমণি রোজ খোঁপায় পরে, কিন্তু কী আশ্চর্য, ফুলটার নাম জানে না।

তোকে লিখতে লিখতে রাতই হয়ে গেল। রোজ রাতে মঙ্গলদের গ্রামে মাদল বাজে গান হয়।

সেদিন ওরা আমাকে বলছিল, এখানে ইস্কুল করে আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়া তুই।

সেটাই বা মন্দ জীবন কি! সেনদার এ বাড়িটা তো থাকবেই না, পোড়ো হয়ে যাচ্ছে।

সাতদিন পরে তোদের দেখব, তোকে দেখব, ভাবলেও ভালো লাগছে।

এই তো! সব কথা কি বললাম?

সব কথা কি বলা শেষ হয় কখনো?

দেখলে বেশ অবাক হবি। আমি বুঝতে পারি, আমি যেন নতুন মানুষ হয়ে গেছি।

একই জন্মে অনেক জন্ম, জন্মান্তর ঘটানো যায়। নিজেকেই বারবার জন্ম নিতে হয়।

ঋষিদাকে সব বলিস। ও তো চিরকাল আমাকে স্নেহ করেছে।

তুই অত সিগারেট খাস না।—দিদি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *