১
খুব সকালে ফোনটা বেজেছিল, ঋষি যখন অগাধ ঘুমে। খুব আশ্চর্য ব্যাপার। স্বপ্নে ও প্রেমজার কাছে ছিল। নার্সিংহোমে প্রেমজা। পেনিসিলিনে প্রেমজার অ্যালার্জি আছে কিনা, সে কথা জিগ্যেস না করেই ডাক্তার ইনজেকশান দিয়েছে। রুদ্র সবে জন্মেছে, সিজারিয়ন শিশু।
পেনিসিলিনের প্রতিক্রিয়ায় প্রেমজা ফুলে যাচ্ছে। সেলাই ছিঁড়ে যাচ্ছে। ঋষি অসহায়। অসহায়। প্রেমজার চোখ আচ্ছন্ন। ঋষি অসহায় দর্শক।
আজ থেকে দশ বছর আগে অঘ্রানে শীতের রাতে নিষ্ঠুর শিশিরাঘাতে ঋষি রাত তিনটে অবধি নার্সিংহোমে ছিল। এক সময়ে বাড়ি এল টাকা নেবে বলে। প্রেমজার অবস্থা তখন খুব খারাপ, অথচ টাকা চাই।
ততক্ষণে ভোর হয়ে গেছে।
ভোর না হতে ফোন বেজেছিল।
—কনডিশান খারাপ। চলে আসুন।
এটা কি নিয়ম? মরে গেছে না বলা? ”কনডিশান খারাপ” বলা?
—বেঁচে আছে?
—চলে আসুন।
ঋষি ছুটে নেমেছিল। ট্যাক্সি খুঁজতে ওকে যেতে হয়নি। কমল ট্যাক্সি নিয়ে এসেছিল।
—কমল!
—উঠে পড়ো।
—বলো, বলো কমল…
কমল অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিল।
—বউদি নেই।
—প্রেমজা নেই।
—এই তো আধ ঘণ্টা আগে…
—তুমি কি করছিলে? আধঘণ্টা আগে আমি কেন খবর পাইনি? কেন, কেন?
নার্সিংহোম পৌঁছে গিয়েছিল ওরা। প্রেমজার ঘরে নার্স, ডাক্তার, এবং অন্য ডাক্তার।
—ডাক্তার পাল কোথায়?
কমল আস্তে বলেছিল সম্ভবত এক্স—রে করাচ্ছে। আমার হাতে তিনটে ঘুসি খেয়েছে তো।
গভীর সন্তোষে, হিংস্র আনন্দে বলে, চোখ থেকে চশমার কাচ বের করাক এখন। চোখটা থাকবে না।
—তুই ওকে—
—এটা প্রথম অধ্যায়। কেসে তুলব ওকে কাঠগড়ায়।
প্রেমজা, প্রেমজা। রোগী মারা যাবার পর নার্সিংহোমের পক্ষ থেকে অপার সহযোগিতা। প্রেমজার বাবা, মা, ভাই।
বাবার বুক ভাঙা প্রশ্ন, কি হল? আমার কথায় তোমরা এখানে আনলে ওকে…
—পেনিসিলিন দিয়েছিল।
—অ্যান্টিবায়োটিকের অনেকগুলোতে ওর অ্যালার্জি। লিখে দেয়া হল, তারপরেও সেই ইনজেকশান দিল?
তারপরেও। এ রকম ভুল কখনো কখনো হয়ে যায়। ঋষি কাগজে পড়েছে। কখনো শুনেছে।
কিন্তু তার প্রেমজা তেইশ বছর বয়সে অত স্বাস্থ্য, লাবণ্য, অত ভালবাসা নিয়ে নির্বোধ এক ডাক্তারের ভুলের শিকার হবে তা কে জানত?
তারপর সব ধোঁয়া ধোঁয়া, আচ্ছন্ন।
সত্যি ক্যাওড়াতলা। সত্যি বিদ্যুৎ চুল্লীতে প্রেমজার ঢুকে যাওয়া। সত্যি কমলের কথা, ঋষিদা, রুদ্র আছে। সেটা ভাবো।
.
আশ্চর্য। স্বপ্নে ও প্রেমজার মৃতদেহের সামনে ছিল। কিন্তু ফোন বাজতেই ওর মনে হল, তবে প্রেমজার মৃত্যু সংবাদ এসেছে। রিসিভার তুললেই শুনবে, অবস্থা খারাপ।
চোখ কচলে ঋষি উঠে বসে। না, দেয়ালে হরতনীর পোশাকে প্রেমজার সহাস্য নৃত্যভঙ্গিমা। ওই ছবি ছাড়া এ ঘরে কোথাও প্রেমজা নেই।
রুদ্র বালিশের ওপর উঠে উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। জ্ঞান হওয়া থেকে মাকে দেখেনি। মাকে না পাওয়ার দুঃখ ওর নেই। ভালো, খুব ভালো।
অন্তত নিরূপ আর মমতার ছেলেমেয়ের চেয়ে রুদ্র অনেক ভাগ্যবান। ‘মা’ শব্দটার কোনো তাৎপর্য নেই ওর কাছে।
নিরূপ আর মমতা তিন বছর আগে পরে ওদের ছেলেমেয়েদের অনাথ করে রেখে গেছে। বাপ যাবার সময়ে ওদের বয়স এগারো আর আট। মা যাবার সময়ে চোদ্দ আর এগারো। বাবা মার কথা ওদের মনে আছে। আর ওদের দিদিমাও সে কথা ভুলতে দেন না।
রিসিভার তোলে ঋষি।
—ঋষি বলছি।
—ঋষি। যত তাড়াতাড়ি হয় চলে এসো।
—কোথায়?
—আমার বাড়িতে।
—ঘণ্টাখানেক লাগবে।
—এক ঘণ্টা?
—রুদ্র ওঠেনি…মা…দেখছি।
—সকালের কাগজ দেখেছ?
—না। এই তো উঠলাম।
—লাইনের পাশে মৃতদেহ—
—দেখছি।
—যত তাড়াতাড়ি পার এসো।
.
এটা আদেশ। বসের আদেশ। বস আদেশ করতে পারেন, করেন। ঋষি তো ওঁর কাছে ঋণবদ্ধ।
বস বুঝে ফেলেছেন জমি ও বাড়ির ফাটকা, ঠিকাদারি, এসবে প্রচুর টাকা করে ফেললে হবে না। হাতে কাগজ থাকলে ক্ষমতা আরো বাড়বে।
সেইজন্যই উনি ”নো” নামে ইংরিজি সাপ্তাহিক বের করতে চলেছেন।
”নো”, অর্থাৎ জানো।
কাগজের পরিকল্পনাও ওঁর। মধু আগরওয়াল সম্পাদক। এ কাগজ পাঠককে জানাবে মোহনেশ স্বামীর আরো খবর, পাঞ্জাবের রাজনীতি, পাইলটের চিত্রতারকা হবার ইতিহাস। শিল্পপতিদের খবর এবং অবশ্যই সে সঙ্গে থাকবে ”ইওর ইন্ডিয়া” বা ”তোমার ভারত” বিভাগ। যাতে বেগার শ্রমিক, হরিজন হত্যা, আদিবাসী উন্নয়নের নামে টাকা লুঠ, পণপ্রথার নামে বধূহত্যা, এমন অনেক বিষয়ে তদন্তধর্মী রিপোর্ট।
সমান গুরুত্ব পাবে মেয়েদের বিভাগটি। সেটি সম্পাদনা করবে রুচি পেরেরা। ব্যাঙ্গালোরে রেসের ঘোড়ার মালকিন হওয়া আর মেয়েদের বিভাগ সম্পাদনা করা, সবই রুচি সমান জোরকদমে করবে।
বস থাকছেন নেপথ্যে। ঋষি হবে ”তোমার ভারত” বিভাগের সম্পাদক। পুরনো ফিলমি গানের মতো বস ”দিল্লি সে দুলহন আর বোম্বাই সে বালম” আনেননি। দিল্লি ও বম্বের দুই শিল্পপতি এ কাগজের অর্থদাতা। ওঁরা যে যার জায়গায় বসে আছেন।
ওঁদের বিরুদ্ধে লেখা যাবে না।
না যাক। ঋষি আপাতত ”নো” কাগজের সঙ্গে থাকতে পেরে খুব আশ্বস্ত। ডুরাই পেপার ফ্যাক্টরির কেচ্ছা লিখে ঋষি ”ফর ইউ” কাগজ থেকে বিতাড়িত, কে জানত যে রঙ্গনাথনরা এমন শক্তিশালী।
শেষ অবধি ও কি করত জানে না। আবার কি পুলিশ রিপোর্টার হয়ে ফিরে যেত পুরনো কাগজে? ঋষি তখন রীতিমত বিভ্রান্ত। সে সময়ে বস ওকে তুলে আনলেন হতাশার অন্ধকার থেকে।
বসের দুরাশা অন্তহীন।
কলকাতার কয়েকটি বহুতল বাড়ির প্রোমোটর উনি। এ ভূমিকায় ওঁকে দেখা যেত না, যদি না তার আগে সরকারী আবাসন বিভাগে উনি ঠিকাদারি করতেন।
তারপর নিজের পাখার কারখানা করে ফেললেন সকলকে তাজ্জব করে। এবং ”স্নো কুল” পাখার বিজ্ঞাপন যখন দূরদর্শনেও দেখা যায়, তখন বোঝাই যায় যে পাখার কারবারে উনি জিতে গেছেন।
দূরদর্শনের আগামী এক সিরিয়ালে উনি, মানে ”স্নো কুল” হবে প্রযোজক।
কলকাতা নয়। বম্বে, দিল্লী, পরিচালক থেকে তারকারা। প্রতিটি ছবির গল্প যারই লেখা হোক, বিশেষ আবশ্যিক হল, প্রতি ছবিতে ”নো” কাগজের ডামি দেখানো হবে।
দেখুক, ডামি দেখুক। কাগজের নামটা জানুক। তারপর কাগজের প্রথম সংখ্যা উদ্বোধন করা হবে একই সঙ্গে বম্বে, দিল্লী ও কলকাতায়।
বর্তমানে ”নো” কাগজের আপিস সাজানো চলছে। বস চান, তারপরেই বাংলা দৈনিকে নামতে।
কলকাতায় না কি অপার সম্ভাবনা। এ শহরে এখনো নাকি কয়েকটি দৈনিক, কয়েকটি সাপ্তাহিক চলতে পারে। বসের কেন যেন মনে হচ্ছে, ওঁর কাজ এখনো অনেক বাকি।
কাগজটা খোলে ঋষি।
খবর কোথায়, কোথায় খবর। এই তো। ঝাড়গ্রাম ছাড়িয়ে লাইনের পাশে যুবতীর মৃতদেহ। ছবি দেখে কে বোঝে কার। এ খবরে বস এত বিচলিত হলেন?
আগের কাজ আগে।
রুদ্র ভীষণ ঘুমোচ্ছে।
ঋষি বাথরুমে ঢুকে যায়। স্নান টান সেরে ফেলা দরকার। খুবই সৌভাগ্য যে পাইপ পালটাবার পর জলকষ্ট ঘুচেছে। আগে জলের বড় কষ্ট ছিল। কমলই উদ্যোগ করে পাইপ বদলায়। গত বছর বাড়ি চুনকাম কমলই করিয়েছে। প্রেমজা যাবে বলেই যেন কমল এ বাড়িতে এসেছিল এ সংসারের হাল ধরতে।
ঋষির ডানহাত হবে বলে। এ কথা তো সত্যি, যে কমল আছে বলে ঋষি অনেক, অনেক নিশ্চিন্ত।
কমলের এ বাড়িতে আসাটা খুব অদ্ভুতভাবে ঘটে যায়। এখন কেউ বলতেও পারবে না যে কমল এ বাড়ির কেউ নয়।
.
আজ বৃহস্পতিবার, ছুটি। রুদ্রর ইস্কুল আজ বন্ধ থাকে। রুদ্র একতলায় মাসিমার বাড়ি নেমতন্ন খাবে, দূরদর্শনে ফুটবল দেখবে। মেসোমশায় রুদ্রকে খুব পছন্দ করেন। ওঁদের দায়িত্বে যে ছেলেকে রেখে ওঁর মেয়ে জামাই কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিল, মোটর দুর্ঘটনায় তারা আর ফেরেনি।
কুশল একলা, রুদ্রও তাই। কুশল আর রুদ্র একই ইস্কুলে পড়ে। মাসিমারা বড় বড় তিনটে ঘরের জন্যে দেড়শো টাকা ভাড়া দেন। কিন্তু ওঁদের কাছে ঋষি এত উপকার পায়! সম্পর্কটাও এমন, যে ভাড়া বাড়াবার কথা বলতে পারে না।
আরেকটি ছোট ঘর ঋষিই কমলকে দিয়েছে। কমলের একটা রাজনীতিক অতীত আছে। জেল থেকে বেরোবার পর কমল তখন কোথায় যায়, কি করে ভেবে পাচ্ছিল না। ঋষি ওকে নিয়ে আসে। তখনো কমলের চোখে খুব যন্ত্রণা, হাতের আঙুল নাড়াতে কষ্ট।
অথচ কি নির্যাতন সয়েছিল, কি হয়েছিল, জিগ্যেস করলে বলত না।
—কি হবে ঋষিদা? আমি তো একলা নই। কত ছেলে আরো কত সয়েছে। কতজন মরে গেছে।
তখনো ঋষির জীবনে প্রেমজা আসেনি। কমলকে চিকিৎসা করানো, ওকে সুস্থ করা—একদিন কমল রাতে প্রচুর মদ খেয়ে ফিরল। তারপর ঋষিকে কি অশ্লীল গালাগালি! বাপ মা তুলে গালাগালি।
—কেন আমাকে সাহায্য করছো বেজন্মা? দয়া দেখাচ্ছ? কে চায় তোমার দয়া?
ঋষি ওকে টেনে একটা চড় মেরে ঘরে ঢুকিয়ে তালা আটকে দেয়।
পরদিন কমল ব্যাগ গোছাচ্ছিল।
—ওটা কি হচ্ছে?
—চলে যাব।
—কোথায় যাবে?
—যেখানে হয়।
—আর না কমল, আর না। বাঁচতে শেখো। চলে যেতে দেবই বা কেন? তোমার পেছনে আমার সময়, টাকা, খরচটা ভেবে দেখেছ? খরচটা তুলে নেব না।
—কি করব আমি? কি করার যোগ্যতা আছে আমার? দেখতেই পাচ্ছ আমি একটা—
—কমল! তুমি এত দুর্বল?
—দুর্বল! আমি!
—কাজ করো।
—কি করব?
—একটা ছোট ইলেকট্রিকের যন্ত্রপাতির দোকান খোলো। এখানেই খোলো, দরজাটা রাস্তার ওপর আছে—পেছনের বারান্দাটা ঘিরে নিলে শুতে পারবে—কাজ তো একটু আধটু জানো। এ ক’মাসে দেখেছি।
জানত কমল, কাজ জানত। ইলেকট্রিক দোকানের কর্মী কমল। লেখাপড়া শেষ করতে না—পারা কমল, পাড়ার ধারালো, রাজনীতিক, ব্যক্তিত্বউজ্জ্বল দীপেন্দুর অন্ধ ভক্ত ছিল। তারপর দীপেন্দুর সঙ্গে রাজনীতিতে ঢুকে প্রথম মনে হল আমারও দাম আছে। তারপর সে কি আশ্চর্য আশাউজ্জ্বল দিন, দিনের পর দিন।
বহুযুগের ওপার থেকে স্মৃতিকণা বহে মনে ভেসে আসে অতীতের মেঘ।
—দীপদা! আমি গ্রামে যাব না?
—তুই যেখানে আছিস সেটাই তোর ক্ষেত্র। সবাই সব জায়গায় যাবে না।
—এখানেই থাকব?
—খবর পৌঁছনো, কর্মীদের সাহায্য করতে দৌড়ে বেড়ানো, হাতিয়ার লুকিয়ে রাখা—
খুব কাজের ছেলে হয়ে উঠেছিল কমল। দীপদা—র কাকার ছেলে নবেন্দু ওকে লক্ষ্য করে যেত। পরে নবেন্দুই ওকে ধরিয়ে দেয়।
নবেন্দু এখন কর্পোরেশনে কাজ করে। কর্পোরেশনে কাজ করেই কয়েক বছরে বাড়ি দোতলা করেছে। মোটর সাইকেল কিনেছে, ডেকোরেটরের দোকান দিয়েছে, কেটারিংও খুলবে।
দীপদা—র ছবিটা দীপদাদের বাড়িতে কোথাও ঝুলছে অথবা ঝুলছে না। কমল জানে না।
কমলের বাড়ির লোকেরা সব চলে গেছে বেহালায়। আজাদগড়ে ওদের বাড়ি তো ছিল ভাড়া বাড়ি। ভাড়া বাড়ি থেকে কমলের বাবা দাদাদের ওঠানো খুব সহজ কাজ ছিল সে সময়ে। মনে পড়ে, সব মনে পড়ে। যদিও কমলের খোঁজ বাবা কিংবা দাদারা রাখেনি, কমলও রাখেনি।
যারা খোঁজ রাখে না, তাদের খোঁজ ও করবে কেন? আজাদগড়ে গেল, তা বাড়িঅলা বললেন, বস, বলতে আছি। দেখ! তোমার লিগ্যা বাড়িতে পুলিশ রে! পার্টির পোলারা রে! হেই ডরেই তোমার বাপ কইল, আমি চইলা যাই। আমিও কই হেই ভালো! তা বাপ তোমার, কাইন্দা বইলা গেল, হেয় যদি কুনোদিন আসে, তয় কইবেন, আমু এহন পোলাদের অন্নদাস। পোলারা তার মুখ দেখব না। আমার ক্ষমতা নাই যে হেয়ার লগে যুগাযুগ রাখি।
বড়দা, মেজদা, বউদি দুজন, সকলে চাকরি করত। কমলের তো পোজিশানই ছিল না। এতকাল পরে তারা কেন কমলকে থাকতে দেবে?
বন্ধুর বাড়িতে ফিরে এসেছিল কমল। সেখানেও পোজিশান খুব সম্মানের ছিল না। ঋষি ওকে নিয়ে এসেছিল। কেন, আমার বাড়ি নেই?
—কি করব গিয়ে?
—দোকান করতে পারবে?
—পারব। টাকা?
—দেখছি। সব হিসেব রেখে চলব। তুমি আমায় একে একে সব একদিন শোধ করে দেবে।
—যদি না পারি?
—বড় কাজ করতে গিছলে, ছোট কাজ করতে পারবে না? আর আমারও স্বার্থ আছে। মা আছে, তুমি থাকলে—
কয়েক বছরে কমলের দোকান টুক টুক করে করে চলতে লেগেছে। ঘরভাড়া একশো টাকা ও দিয়ে যায়। বড় কাজ ধরতে পারলে ঋণ বাবদ কিছু শোধও দেয়। ডেকোরেটরদের হয়ে যখন কাজ করে। পাড়ার কালীপুজোয় কমলের বিদ্যুৎসজ্জা বেশ নাম করেছে। এখন পাড়ার নেতা স্বয়ং ভজন কমলের ভক্ত। ফলে বিয়ে বাড়ির কাজ, ফাংশনের কাজ, দুর্গাপুজোয় পথ ও মঞ্চের আলোক সজ্জার কাজ, কমল মন্দ রোজগার করে না।
কমলকে ছাড়বে না ঋষি।
—বিয়ে কর কমল। এখানেই থাক।
—বিয়ে কেউ করে?
—সবাই করে।
—কি দরকার? এখনো মাসিমা বেঁচে আছেন। শয্যাশায়ী। রুদ্র এখনো বেজায় ছোট। বিয়ে করলে সংসার আমাকে স্বার্থপর করে দেবে। এদের দেখব কি করে?
—তুমি কি ব্রহ্মচারী হয়ে থাকবে?
—দেখাই যাক।
ঋষির মা সংসারে থেকেও নেই। হাঁপানিতে উনি অচল।
হাঁপ যখন ওঠে। অসহ্য কষ্ট পান।
হাঁপ যখন ওঠে না, মনোকষ্টে কাঁদেন।
কমল ধমক দেয়। আবার কাঁদছেন?
—কাঁদব না? অমন জ্বলজ্বলে বউ চলে গেল। একটা ছেলে আমার, জীবনটা ছন্নছাড়া হয়ে গেল। নাতিটাকে কাছে ডাকতে পারি না। অসুখের ঘর।
—কাঁদলে কিন্তু আমি চলে যাব।
—যাস না বাবা।
—তবে চোখ মুছুন।
—দেখতে পারি না কিছু সংসারে।
—আপনিই তো চালান সব।
—ওই, বলে বলে দিই।
বাড়িতে দুটি মহিলা কাজ করে। নলিনী আর রানী। অনেকদিনের লোক বলে মায়ামমতা আছে। ঋষির মার পরিচর্যা, রুদ্রকে দেখা, রান্না, বাসনকোসন, কাপড় কাচা, ঘরদোর, কাজ কম নয়।
সংসার চালায় ঋষি। কমল সহকারী।
রুদ্র আর কমল পরস্পর খুব ঘনিষ্ঠ। কমল কাকু রুদ্রকে মেট্রো রেলে চড়ায়, চিড়িয়াখানা নিয়ে যায়। স্কুলের বন্ধুদের জন্মদিনে পৌঁছে দেয়।
রুদ্রর মামাবাড়ি। ওর পিসির বাড়ি। ঋষির মামার বাড়ি। সর্বত্র কমল হল রুদ্রর বাহন।