মুখার্জি অদৃশ্য – মহাশ্বেতা দেবী
মুখার্জিবাবুকে আমি কখনো নিজের চোখে দেখিনি। আর দেখতে চাইও না কখনও। সামনাসামনি দেখতে পাওয়াটা অবশ্য এই মুহূর্তে সম্ভবও নয়। কারণ ওঁর কারেন্ট রেসিডেন্স এই মুহূর্তে হচ্ছে পরলোক। তবে ওঁকে ঘাঁটানোর ফল যে কী হতে পারে তা আর কেউ না বুঝক, আমি বা আমার বাড়ির সকলেই বেশ ভাল করেই বোঝে। সেই গল্পই বলা যাক।
মুখার্জিবাবুর গল্প আমি শুনেছিলাম দিম্মার কাছে। সেবার আগস্ট মাসে দিম্মা আর দাদু বেড়াতে এল আমাদের এখানে। একমাস থাকার কথা। তখন বর্ষাকাল। একদিন সন্ধেবেলা জেদ ধরে বসলাম যে দিম্মাকে গল্প বলতে হবে। আর যে সে গল্প নয়, ভূতের গল্প। দিম্মা প্রথমে তো বলেই দিল যে সে ভূতের গল্প বলতে রাজি নয়। কিন্তু অনেক ঝুলোঝুলি করবার পর শেষ পর্যন্ত দিম্মা তার বৌদির মানে আমার মায়ের মামিমার বা আমার মামিদিম্মার একটা গল্প শুরু করল।
গল্পটা দিয়ার ভাষাতেই বলা যাকঃ
বৌদি থাকতেন বালিগঞ্জের কাছে একা একটা তিনতলা বাড়ির দোতলায়। আর মুখার্জিবাবু ছিলেন ওনারই প্রতিবেশী। সেই বাড়িটারই চিলেকোঠায় ভাড়া থাকতেন তিনি। মুখার্জিবাবুর চেহারার বর্ণনা আর নাই দিলাম, তবে এইটুকু বলে রাখি, উনি ছিলেন বিশাল লম্বা। স্বভাবের দিক থেকেও ওনার খুব একটা নাম ছিল না। বাড়ির বাকি সবার সঙ্গে ছিল ওনার রাম ঝগড়া। সংসার কিম্বা ছেলেপুলেও ছিল না। একাই থাকতেন। বৌদির সঙ্গে ওনার খুব একটা ভালো সম্পর্ক কোন কালেও ছিল না। কিন্তু দুজনেরই বয়স হয়েছে, আর তাছাড়া দুজনেই একা থাকেন বলে ইদানিং কালে বৌদির সঙ্গে একটু বন্ধুত্বই হয়ে গেছিল মুখার্জিবাবুর। ছাদেটাদে গেলে বৌদি দুদণ্ড গল্প করে যেতেন মুখার্জিবাবুর সঙ্গে আর মুখার্জিবাবু নিচে নামলে বৌদির সঙ্গে দেখাটেখা করতেন।
এরকমই একটা বিকেলে বৌদি ছাদে মুখার্জিবাবুর সঙ্গে গল্পসল্প করছিলেন। কথায় কথায় সিনেমার প্রসঙ্গ উঠল। মুখার্জিবাবু বললেন, ‘আচ্ছা দিদি, আজকের কাগজে সপ্তাহের সিনেমার লিস্টটা দেখছিলাম। দেখলাম শনিবার দেবদাস হবে। না, না, পুরোনোটা নয়, সেই যে বোম্বের খান না কি, তার করা নতুনটা। আমি তো সেই পুরোনো দেবদাসই দেখেছি।
বৌদি বললেন, ‘শাহরুখ খানের হিন্দি দেবদাস ! ওটার কথাই বলছেন?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সেটাই । আসলে কি হয়েছে জানেন দিদি, বড্ড দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে সিনেমাটা। আমরা তো দেখেছিলাম সেই পুরোনো দেবদাস। তাছাড়া, আমার ঘরে টিভিও নেই যে দেখব কিছু।’
‘তা আসুন না আমার ওখানে এই শনিবার। দেখব’খন দেবদাস। আমার তো একটা টিভি আছেই।’
‘তাহলে সেই কথা রইল। আমি আসবো কিন্তু শনিবার দিন।’
কিন্তু শনিবার আর মুখার্জিবাবুকে আসতে হল না। কারণ বৃহস্পতিবার দিন সকালেই তিনি পরলোকগমন করলেন। মুখার্জিবাবুর কাজের মেয়ে প্রতিমা আসে রোজ সকালে, ওনার দুধ নিয়ে। তারপর ওনার ঘরের বিছানাপত্র গুছিয়ে, পরিষ্কার করে চলে যায়। বৃহস্পতিবার সকালে প্রতিমা একটু তাড়াতাড়িই চলে এসেছিল। মুখার্জিবাবুর ঘরে যাওয়ার আগে বৌদির সঙ্গে একটু গল্পও করে গেছিল। কিন্তু চিলেকোঠায় পৌঁছেই তার চীল চিৎকার, ‘ও মাসিমা, গো ! শিগগিরি এসো গো ! কি সব্বোনাশ হয়ে গেল গো ! ’
বৌদি দৌড়ে উঠে গেল চিলেকোঠায়। মুখার্জিবাবু বাথরুমের সামনে শুয়ে ছিলেন। গা ঠান্ডা। নিঃশ্বাস পড়ছে না মোটেও। হাত থেকে ওষুধের কোটোটা পড়ে চৌচির হয়ে আছে মেঝেতে, ওষুধটাও ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে।
সে সপ্তাহে নানা ঝামেলায় বৌদির আর দেবদাস দেখা হয়নি। মুখার্জিবাবুর মৃত্যুর মাস কয়েক কেটে গেছে তারপর। একদিন সকালে বৌদি কাগজ খুলে দেখলেন, সেদিন আবার সন্ধে সাতটায় কোন হিন্দি চ্যানেলে দেবদাস হবে। বৌদির মুখার্জিবাবুর কথা মনে পড়ে গেল। আহা রে লোকটা এত করে বলেছিল দেবদাস দেখবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর দেখতে পেল না। দুঃখ একটু হল বটে কিন্তু সন্ধে সাতটায় বৌদি কিন্তু টিভি খুলতে ভুললেন না। দেবদাসটা দেখবার তারও যে অল্পবিস্তর ইচ্ছা ছিল।
বৌদি খাটে বসে একমনে সিনেমা দেখছিলেন। তখন রাত আটটা। হঠাৎ মনে হল খাটের পাশে রাখা চেয়ারে যেন কে বসে আছে। বৌদি টিভি থেকে চোখ সরাতে সাহস পেলেন না। খালি মনে হচ্ছিল চেয়ারে বসে রয়েছে মুখার্জি। কিন্তু সেটা কী করে হতে পারে? তিনি তো মারা গেছেন আজ তিন মাস হল। তাহলে? চেয়ারে তবে কে বসে রয়েছে? বৌদি ঘামতে লাগলেন দরদর করে। মুখার্জিবাব এত করে বলেছিলেন আসবেন দেবদাস দেখতে। সেই ইচ্ছাটাই বুঝি তাঁকে পরলোক থেকে টেনে এনেছে!
সে’রকমভাবে কতক্ষণ যে বসেছিলেন বৌদির জানা নেই। সিনেমা হয়েই চলেছে আর মুখার্জিবাবুও যেন চেয়ারে বসে রয়েছেন। ওঠবার নামটি করছেন না। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। বৌদির খেয়াল হল যে সেদিন আরতির আসার কথা। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন একবার চেয়ারটার দিকে। মুখার্জিবাবু ঠায় বসে রয়েছেন। ওদিকে কলিং বেল বেজে চলেছে বার বার। আরতিও সাড়া না শুনে ডাক দিচ্ছে, ‘মাসিমা, ও মাসিমা! দরজা খুলুন!’ কিন্তু বৌদির তো হয়েই গেছে। থরথর করে কাঁপছেন। নড়াচড়ার শক্তি যেন হারিয়েই ফেলেছেন।
তারপর একসময়, মনের সমস্ত সাহস একত্র করে বৌদি ছুটলেন দরজার দিকে। কোনরকমে দরজা খুললেন আর দরজা খুলেই এলিয়ে পড়েলেন আরতির কোলে। পরে বৌদির মুখে আরতি সমস্ত কথা শুনে বলেছিল, ‘ও মাসিমা, জানেন একবার আমি ছাদে গিয়েছিলাম পেয়ারা আনতে। দেখি চিলেকোঠার ঘরের পর্দাটা সরানো। আমি পর্দাটা ঠিক করে দিয়ে এলাম। সেদিন রাত্রে স্বপ্নে দেখি মুখার্জিবাবু আমায় বকছেন, ‘আমার ঘরে উঁকি মারছিলিস কেন রে?’ তারপর থেকে আমি, মাসিমা, আর কখনো ছাদে যাই না। সেদিন স্বপ্নে এসেছিলেন, আবার গেলে যদি দেখা দিয়ে দেন!’
দিম্মার মুখে মুখার্জিবাবুর গল্প শুনে আমার মনে হল এটা নিয়ে অনেক কিছু করা যায়। যেমন, সিনেমা বানানো। মুখার্জিবাবুর প্রত্যাবর্তন নিয়ে তো বেশ ভালো এক খানা শর্ট ফিল্ম বানানো যায়! বাড়িতে লোকজনও আছে অনেক। অতএব অভিনেতা-অভিনেত্রীরও অভাব হবে না। দিম্মা এককালে নাটক করত। বাড়ির অন্য লোকেরাও খুব একটা আনাড়ি নয়। আর তাছাড়া দিম্মাদের সঙ্গে ইন্দোরে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান কয়েকদিন পরেই, অতএব কাজ তাড়াতাড়ি শুরু না করলে শেষ আর না-ও হতে পারে। অতএব সেই সন্ধে থেকেই কাজ শুরু করা গেল।
শুরু করলাম স্ক্রিপ্ট দিয়ে। মা-বাবার সঙ্গে বসে মুখার্জিবাবুর গল্প নিয়ে একখানা জম্পেশ স্ক্রিপ্ট বানাতে লাগল এক ঘন্টা মতন। তার শুরুতেই অভিনেতা অভিনেত্রীরা কে কে হবে সেটা ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল। বৌদি হচ্ছে দিম্মা, মুখার্জিবাবু হচ্ছে দাদু, আরতি হবে রানি মাসি আর মুখার্জিবাবুর কাজের মেয়ে প্রতিমা হবে মা। সিনেমাটা খুব বড় হবে না, বড়জোর দশ মিনিট মতন, তার বেশি কিছু না। ডিজিটাল ক্যমেরা দিয়েই ভিডিও গুলো তোলা হবে – ঠিক করা হল। তারপর সেগুলোকে কম্পিউটারে তুলে সম্পাদনা-টনা করে সিনেমাটা তৈরি হবে। বাড়ির সকলেই খুব উত্তেজিত ! সিনেমা বলে কথা ! অতএব বেশি দেরি না করে পরদিন থেকেই কাজ শুরু করে দেওয়া হল।
সিনেমায় আমিই ক্যামেরাম্যান, আমিই পরিচালক। দিম্মা তাঁর যৌবনে অনেক নাটক করেছে অতএব তাঁকে নিয়ে অসুবিধা হওয়ার কথাও নয়, অসুবিধা হলও না। কিন্তু যত অসুবিধা ওই দাদুকে নিয়ে। দাদু নাটক দেখেছে বিস্তর তবে নিজে একবারও নাটক বা ওই ধরনের কিছু করেনি। বলতে গেলে দাদু এ ব্যাপারে বেশ আনাড়ি। মুখার্জিবাবুর এক একটা সিন দাদুকে দিয়ে মোটামুটি দু-তিনবার করে করাতে হল, তারপরে পছন্দসই হল সেটা।
আমাদের বাড়ির একতলার বসবার ঘরে সাজানো হল বৌদির ঘর, আর ওপরে মায়েদের ঘরে সাজানো হল চিলেকোঠা মানে মুখার্জিবাবুর ঘর। চিলেকোঠার দরজায় তো নেমপ্লেট লাগাতে হবে অতএব একটা সাদা কাগজের ওপর কালো স্কেচ পেন দিয়ে ইংরেজিতে মোটা মোটা অক্ষরে লিখলাম, ‘এ কে মুখার্জি’। সেটাকে সেঁটে দিলাম শোবার ঘরের দরজায়। সত্যিই মনে হচ্ছিল যেন ওটা মুখার্জি বলে কারো ঘর। ওদিকে শুটিং চলতে লাগল পুরোদমে। রোজ তিনটে চারটে করে সিন শুট করা হচ্ছে। শেষে, মোটামুটি চার-পাঁচ দিন মতন পরে, আমরা শেষ সিনটা শুট করলাম।
এই সিনটাই বলতে গেলে সিনেমার মুখ্য জায়গা। মুখার্জিবাবুর দেবদাস দেখতে আবির্ভাব। বসবার ঘরে সাজানো হল সেট। সবচেয়ে লো ভোল্টেজের আলো জ্বালানো হল যাতে ব্যাপারটা আরও ভূতুড়ে লাগে। টিভিতে বন্ধুর থেকে ধার করে আনা হিন্দি দেবদাসের সিডি চালিয়ে দিলাম। সব মিলিয়ে আসর জমজমাট। যেহেতু এই সিনটায় বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই, এইবার আর দাদুকে নিয়ে বিশেষ কোন অসুবিধাই হল না আমার। দিম্মাও সবসময়কার মতো একেবারে ন্যাচারাল অভিনয় করল। বেশ সুন্দর ভাবেই শেষ হল শুটিং।
পরদিন শনিবার। আমার স্কুল ছুটি। সকালবেলা সবাই মিলে বসলাম কম্পিউটারের সামনে। এডিটিং করা হবে এবার। বাবা আর আমি দু’জন মিলে করলাম এডিটিং। একের পর এক সিন জুড়ে জুড়ে তৈরি হল সিনেমা। সঙ্গে আরও যোগ হল ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আর তার ভিডিও এফেক্ট। তবে সারাদিন কাজ করেও এডিটিং পুরোপুরি শেষ করতে পারলাম না সেদিন। পরদিন আমাদের ইন্দোরের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার কথা। সেখান থেকেই দিম্মাদের প্লেনে তুলে দেওয়া হবে। ফলে অসম্পূর্ণ সিনেমাটা কম্পিউটারে রেখে ইন্দোরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম পরদিন সকালে। দিম্মা-দাদুদেরও আর তাদের অভিনীত সিনেমা দেখা হল না।
কম্পিউটারে অসমাপ্ত সিনেমাটাকে এমনি এমনি রেখে না গেলেই হয়তো ভালো ছিল। যে লোক দেবদাস দেখবার জন্য একেবারে পরলোক থেকে আবির্ভূত হতে পারে সে যে আরও অনেক কিছুই করতে টরতে পারে এটা আমার বোঝা উচিৎ ছিল। যদি সেই রকম কোন ব্যবস্থা করে যেতাম তাহলে হয়তো এর পরের অঘটনটা ঘটত না।
ইন্দোর যেতে গাড়িতে মোটামুটি লাগে চার ঘন্টা। রবিবার দিন বাড়ি থেকে বেরোন হল ঠিক সকাল ন’টায়। ইন্দোরে পৌঁছুলাম দুপুর একটায়। সেখানকার গেস্টহাউসে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করে, একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ওঙ্কারেশ্বরের উদ্দেশ্যে। তারপরের চারদিনে পুরো ওই এলাকার সমস্ত জায়গায় বেড়াতে যাওয়া হল। প্রথমে ওঙ্কারেশ্বর, তারপরে মহেশ্বর , সেখান থেকে মান্ডু, আর মান্ডু থেকে আবার ইন্দোর। বৃহস্পতিবার ইন্দোর এয়ারপোর্ট থেকে দুপুরের প্লেনে দিম্মাদের তুলে দিলাম আমরা সবাই। সিনেমার কথা তখনকার মতন সবাই একটু ভুলেই গেছিলাম হয়তো।
বাড়ি ফিরেই বুঝতে পারলাম যে কিছু একটা ঘটে গেছে। পরিবেশটা এমনিতে খুব একটা না বদলালেও কেমন যেন থমথমে লাগছিল। আমার বিশেষ করে কেমন যেন ভয় ভয় করছিল।
সেদিন রাতে আর এডিটিং নিয়ে বসলাম না। এমনিতেই ঘোরাঘুরি করে বেশ ক্লান্ত হয়ে গেছিলাম, তারপরে গাড়ি করে মাইলের পর মাইল ঘোরার ফলে সকলের মাথা একেবারে বনবন করে ঘুরছিল। খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। বন্ধুকে ফোন করতে সে বলল পরদিন কোন কারণে স্কুল বন্ধ। অতএব শান্তিতে ঘুমোন গেল সারারাত। যাকে বলে এক ঘুমে রাত কাবার।
পরদিন সকালে আবার বসলাম এডিটিং নিয়ে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, যেটা নিয়ে এডিটিং করব সেটাই অদৃশ্য। কম্পিউটারের সব জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেও খুঁজে পেলাম না আমার অসম্পূর্ণ সিনেমা। এমন কি, উধাও হয়ে গেছে আমার ক্যামেরা থেকে তুলে আনা ভিডিওগুলোও। রীতিমত ভয় পেয়ে গেলাম, ক্যামেরাতেও খুঁজে দেখলাম, ভিডিওগুলো আছে নাকি। কিন্তু না, কোন লাভ হল না তাতে। ভিডিওগুলো সেখান থেকেও উধাও। সারাদিন খোঁজাখুঁজি করার পরও কিছুই পাওয়া গেল না। না অসম্পূর্ণ সিনেমাটা, না ভিডিও ক্লিপগুলো। বাবা অফিস থেকে ফেরবার পর আরও একপ্রস্থ খোঁজাখুঁজি হল। কিন্তু না। মুখার্জিবাবুর সিনেমাটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কোন চিহ্নই নেই সেটার। বাড়িতে এতদিন ঠাম্মা আর রানি মাসি ছাড়া আর কেউই ছিল না। আর ঠাম্মা বা রানিমাসি – কারুর পক্ষেই কম্পিউটার চালিয়ে, সিনেমাটা আর ভিডিওগুলো খুঁজে বের করে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। তাহলে ? কী হয়েছে সেগুলোর ?
বুঝলাম, যে মানুষ দেবদাস দেখবার জন্য একেবারে যমলোক থেকে নেমে আসতে পারে, তাকে ঘাঁটালে ফল ভালো হয় না । একেবারে হাড়ে হাড়ে বুঝলাম। মুখার্জিবাবুর হয়তো সিনেমাটা ভালোই লাগেনি। পরে দিম্মা সব শোনবার পর বলেছিল, ‘ভালই হয়েছে, বুঝলি। ওই সব মরা মানুষকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে নেই। আর ওই মুখার্জিবাবু লোকটা সিনেমা দেখতে খুব ভালবাসত। তাকে নিয়ে উল্টোপালটা সিনেমা বানানোটা উচিৎ হয়নি মোটেই। কম্পিউটারের ওপর একটু গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিস মনে করে। দুর্গা, দুর্গা।’
এরপর থেকে মুখার্জিবাবু হয়ে গেলেন বাড়ির একটা নিষিদ্ধ প্রসঙ্গ। তাকে নিয়ে মজা তো করা আর হয়ই না, কেউ তাঁর ব্যাপারে কথা বললেও মুখ সামলে কথা বলে। মুখার্জিবাবুর নাম লেখা সেই সাদা কাগজটা তারপর অনেকদিন শোবার ঘরের দরজায় লাগানো ছিল। কেউ খুলতে সাহস করেনি সেটা। কিন্তু, আগেরবার সিনেমাটা গায়েব করেছিলেন, এবার যদি দরজাটাও গায়েব করে দেন, এই ভয়ে একদিন আমরা সবাই মনের সমস্ত সাহস একত্র করে সেটাকে ছিঁড়ে পুড়িয়ে দিলাম। মুখার্জিবাবুর শেষ চিহ্নটাও মিলিয়ে গেল অবশেষে। খুব হাল্কা লাগছিল সবার।
তাই বলছিলাম, মুখার্জিবাবুকে কখনও দেখতে চাই না আমি। ওঁকে ঘাঁটানোর ফল যে কি তা তো ভালো করেই বোঝা গেছে।