মীরাবাঈ – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

মীরাবাঈ

ভূমিকা

বাড়িতে টিয়া থাকলে, কাঁশি বাজিয়ে বাসনওলা চলে যাবার পর নিঃসঙ্গ দুপুরে সে হঠাৎ ‘চিক’ করে ডেকে ওঠে। তারপর শৃঙ্খলাবদ্ধ এক-পা তুলে, ঘাড় কাৎ করে দাঁড়িয়ে থাকে কান পেতে। পা-ফেলে পা-ফেলে বাসনবোঝাই মুটেটাও গলি দিয়ে চলে যায়। পাশের বাড়িতে টিয়াপাখি থাকলে তখন সে তার উত্তর দেয়। উত্তর শুনে, এ-বাড়ির টিয়ার সে কী ছটফটানি; যদিও চাপা অহংকারে গলা ফুলে যায়, লাল বৃত্তের ভিতর চোখদুটো পালটে যায় ঘন-ঘন, কিন্তু উত্তেজনা প্রকাশ করে না তবু, হাঁটে পদক্ষেপ গুনে গুনে—দাঁড়টা তাই সম্পূর্ণ ঘুরে যায় না, হাওয়ায় দোলে। আমাদের বাড়ির টিয়াটার সঙ্গে পারেকসাহেবের বাড়ির টিয়াপাখিটির বন্ধুত্ব পুরানো হতে চলল।

পারেকের বাড়ি মানে আমাদের বাড়িরই একটা অংশ, আমরা বলতাম ছোটবাড়ি, একদিন ওটা আমাদেরই বাড়ি ছিল। ঠাকুরদার আমলে বিক্রি হয়ে যায়, কিনেছিল পারেকের মামা। ছোটবাড়ি ও আমাদের বাড়ির মধ্যে তাই মিউনিসিপ্যাল আইনের চার ফুট ফাঁকও নেই। ওদের একতলা বাড়ির ছাদ আর আমাদের দোতলার দালানের মাঝখানে তাই একটা সাদা দেওয়াল, দেওয়ালের গায়ে প্রায় দেড়মানুষ-উঁচু এক বিশাল জানালা, একদিন সম্ভবত যেটা দরজা ছিল। জানালাটা ছিল আগাগোড়া একটা জাল দিয়ে মোড়া, আজও তাই আছে, গরাদের ওপাশে ছোটবাড়ির ছাদের দিক থেকে আঁটা। দ্বিতীয়পক্ষের বউ ঘরে আনার পরে পারেকসাহেব ওটা নিজের হাতে এঁটে দিয়েছিলেন।

পারেকসাহেবের বউ, মানে আমাদের কৈশোরের মীরাবৌদি। আসলে কী নাম ছিল কে জানে, ওরা দেশি খ্রিস্টান, হয়ত ছিল মেরী, কিন্তু মা ডাকত মীরা। কী রূপ ছিল মীরাবৌদির!

জ্বলন্ত টর্চ-লাইট চেপে ধরতুম ছেলেবেলায়, মুঠি-করে-ধরা সেই আঙুলগুলি মনে পড়ে, আর মনে পড়ে মীরাবৌদির গায়ের রঙ। বহুদিন পর্যন্ত মা বলত, তাও মনে পড়ে, ‘ও যখন ঘোমটা দিত, ওর লাল কপাল আর শাড়ির পাড় আলাদা করা যেত না।’ অমন পাকা শরীর আমি আর দেখিনি, মনে হত এই বুঝি ফেটে যাবে তা, যা দশ বছরের দাম্পত্য সত্বেও টাল খায়নি কোথাও।

ঊরু দুটো পরস্পর এত ঘননিবদ্ধ ছিল যে, ছেলেবেলায় তা নিয়ে কিম্ভূত ভাবতুম। ভাবতুম যে, মীরাবৌদির পা-দুটি বোধহয় হাঁটুর নিচু থেকে শুরু হয়। পা ফাঁক করে হাঁটতেন যখন, যখন রাজহংসীর মতো পা ফাঁক করে, গোড়ালি থেকে আঙুল পর্যন্ত পায়ের পুরো পাতা পড়ত। অতগুলি ছেলেপিলের মা হয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত, অথচ যখন হাসতেন, রুক্মিণীর হাসির কথাই আমার মনে পড়ে যেত। কোলজোড়া শেষতম মেয়েটির ওপর কাচের চুড়িবোঝাই সোনালি লোমে-ভরা দুটি হাত, ঢালু কাঁধ, প্রতিমার পরচুলার মত কৃষ্ণ এলোচুলে ঢাকা কান, কানে সোনার জুঁই, ছোট্ট কপালে গোল সিঁদুরের টিপ— জানালার জালের ওপাশে সোনার দুপুরে বসে-থাকা সরু মফচেন ও রূপালি ঘামের দুগাছি হারসমেত বাঁকানো গ্রীবার ওই মূর্তিটি আমার আজও মনে পড়ে। মীরাবৌদির সবই স্পষ্ট মনে পড়ে, কিছুই অনুমান করতে হয় না, শুধু চোখদুটি ছাড়া। কেমন বা ছিল তার চাহনি, সুদীর্ঘ পাতা ছিল কি চোখের? খুব টানা-টানা ছিল কি, চোখের তারা দুটি কি ছিল মার্বেলের মতো বড়ো বড়ো? আমার মনে পড়ে না মোটে। আর মেয়েদের চোখের দিকে চোখ তুলে চাইবার বয়সও সেটা ছিল না।

আজ আর মা নেই যে জেনে নেব। ‘সাবিত্রীসমান হও মা’, মা বলত বৌদিকে, ‘তোমার সিঁদুর-আলতা অক্ষয় হোক।’ পাড়ায় বলে বেড়াত, ‘সাক্ষাৎ মীরাবাঈ। ওর মতো সতী এ-যুগে হয় না। পারেকটা বাঁদর, মীরার মর্ম ও কী বুঝবে?’

পারেকসাহেবকে আমরা কদাচিৎ কথা বলতে শুনেছি। শুনে থাকলেও মনে নেই। মাঝে মাঝে শুনেছি শুধু ভয়ংকর গলা-খাঁকারি দেবার আওয়াজ। যেন কেউ তাঁকে ভয় দেখাতে এসেছে, তিনি তাকে ভয় পাইয়ে দিতে চান। পরনে চেকলুঙি, আদুড় গা, বুকে চুলের জঙ্গল, গা ভরতি বড়শির মতো লোম ও ছড়ানো কুঁচ-বিচির মত একরাশ লাল তিল, মাথায় একচাপড়া কোঁকড়ানো চুল, যার দুচারগাছি সবসময়েই ফণা তুলে থাকত। হাঁটতেন থপথপ করে, বুড়ো গরিলার মতন বিশ্বাসে। বসন্তক্ষতে বিকৃত তাঁর বীভৎস ও ফরশা নতমুখ আমরা দৈবাৎই দেখে থাকব। পারেকসাহেবের ভ্রূ-কঞ্চন মনে পড়ে, ভ্রূ-দুটো ঠেকাতে পারতেন, যেন দুটো জোঁক পরস্পরের রক্তপান করে কালো হয়ে যাচ্ছে। সকালবেলায় যে-ঘণ্টাকয়েক ছাদে থাকতেন পারেকসাহেব, একমনে কন্বি দিয়ে কোপাতেন টবের মাটি, সার গুলতেন কনুই অবদি হাত ডুবিয়ে। কাঁচি দিয়ে আলতোভাবে, যেন ভালবেসে, পোকাধরা পাতাগুলি কেটে দিয়ে পাউডার ছড়িয়ে দিতেন তার ওপর। ঝাঁঝরি দিয়ে জল ঢালতেন গাছের গায়ে, মগে করে গোড়ায়। এই সব করতেন সকাল গড়িয়ে যেত, দোকানে বের হবার সময় হয়ে যেত তাঁর। এ-সব কাজই তিনি করতেন হেঁটমুখে, ব্যস্ত না হয়ে ও বিনয় সহকারে। মাথা তোলবার অবকাশ কোনোদিন হয়নি।

এ-ছাড়া ছিল পাখি। ছেলেবেলায় ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনই আমার মনে হত, বুঝি জলধারার পাশে শুয়ে আছি। পরমুহূর্তেই হতাশা। না, মীরাবৌদি স্নান করছেন, কী যে স্নান করতেন একঘণ্টা ধরে, ও-রকম ভোরে, গা থেকে রগড়ে কী যে তুলে ফেলতে চাইতেন অতক্ষণ ধরে, আর অত ঘটা করে! তুমুল শব্দ হত, মনে হত মীরাবৌদি বুঝি জলপ্রপাতের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। কতদিন জলপ্রপাতের স্বপ্ন দেখতে-দেখতে জেগে উঠে ভেবেছি, আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি। কোনোদিন বা ঘুম ভেঙেই মনে হত, ‘আরে, বাগান?’

সত্যিই, পারেকসাহেবের বাড়ি ছিল পাখিতে ভরতি। কত রকমের যে পাখি ছিল, চিড়িয়াখানা বললেই হয়। চার-পাঁচটি টিয়াপাখি ত ছিলই, হরিয়াল ছিল, বুলবুলি-টুনটুনি ছিল, রাঙা খাঁচায় ছিল বন্দি কোকিল। ক্যানারি ছিল। একটা কমলারঙের ল্যাজঝোলা ছিল, কাকাতুয়া-পায়রা ছিল অনেক। কালো সিল্কের তাফতায় মোড়া মস্তবড়ো খাঁচায় ছিল একটা সোনালি ময়না। একদিন পরদা তুলে দেখেছিলুম। কথাকলির মুখোশের মতো কারুকার্যকরা ভীষণ সুন্দর, কী বিপুল চোখ ছিল তার।

ছাদের এককোণে জালের ঘরে আর ছিল একটা ময়ূরী। আমাদের এ-তল্লাটে আর কারও বাড়িতে ময়ূর নেই, কুণ্ডুরা অত বড়োলোক, তাদের বাড়িতেও ছিল না। নুরওয়ালা শ্বেতির দাগে ভরতি এক রোগা মুসলমান নিত্য আসত, সাইকেলের ঘণ্টি শুনতুম বিছানায় শুয়ে। পাখিদের জন্যে সে আনত নানারকম পোকামাকড়, টিয়ার জন্যে টুকটুকে তেলাকুচা। ময়ূরীর জন্যে আনত হরেক জিনিস দিয়ে মাখা পাউরুটির গোটাকতক গোল্লা, এক ঠোঙা কেঁচো। কোনোদিন দিয়ে যেত আধমরা সাপ। দু-আঙুলে সাপটাকে চাবুকের মতো করে ঝুলিয়ে, লোমশ ও বিশাল পারেকসাহেবকে দরজা খুলে ময়ূরীর ঘরে প্রবেশ করতে আমি স্বচক্ষে দেখেছি। দরজা বন্ধ হয়ে যেত সশব্দে। ভিতরে সাপের হিসহিস, শানের ওপর ঠোঁটের ঠোক্করের শব্দ, পাখার ঝটপটানি, এই সব শুনতে পেতুম। শব্দহীন শুধু পারেকসাহেব। কোনোদিন পাখার ঝাপটায় টিনের চাল বেজে উঠত ঝনঝন করে। ময়ূরীটা ডাকত বছরে কয়েকবার, কিন্তু বাকি এতগুলি পাখি অন্ধকার থাকতেই মাঝে-মাঝে ডেকে উঠত, চেঁচামেচি শুরু করে দিত আলো ফুটলে। ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে তাই আমার কতদিন মনে হয়েছে, ‘আরে, বাগান!’

কিন্তু সে যা হোক ফুল-ফোটাবার ভারি মিষ্টি হাত ছিল পারেকসাহেবের। লাটসাহেবের বাড়ির প্রদর্শনীর সবচেয়ে বড়ো সূর্যমুখীর চেয়ে দুইঞ্চিবড়ো ফুল পারেকের টবে সবসময়েই থাকত। নকশা-করা লাল টবে ছাদের কার্নিশ কোনোদিনই দেখা যেত না, দিশি-বিলিতি নানা জাতের ফুল ছাদ বোঝাই হয়ে থাকত। আজ যদি আমি বলি, ‘আমি পুষ্পের প্রতিমা দেখেছি, পারেকের টবে ফুটে থাকতে দেখেছি বিরল অ্যাজেলিয়া’, কেউ আমাকে বিশ্বাস করবে কি, করবে না! একটা গাছ ছিল, তার ফুলে আঠার-উনিশটা পাপড়ি হত, (আমি আর রুক্মিণী সংখ্যার ওপর বাজি ধরে তার পাপড়ি ছিঁড়তুম)। প্রত্যেকটি পাপড়ির রং ছিল আলাদা, কিন্তু তাদের সমবেত রংয়ে একটা নীলাভা ছিল। কী তীব্র মত্ততা ছিল তার গন্ধে, নীল কানপাশার মতো সেই ফুলে। আমরা বলতাম পাগলাফুল।

আর হত গোলাপ, ইজিহিল, বার্সিলোনা, এটোলি-ডি-লিঅন—এইসব। একটা কালো গোলাপের গাছ ছিল। এক ঋতুতে সাত-আটটার বেশি ফুল হত না। এক-একটা ফুল ফোটার আগে তার সারা গায়ে বড়ো বড়ো কাঁটা দিত। সেই গোলাপগুলির একটি আমাকে দিয়ে, হাড়-চিববার সমর্থ সাদা দাঁতগুলি বের করে পারেক একদিন মাকে বলেছিল, ‘ব্ল্যাকপ্রিন্স কি ভারতবর্ষে জন্মায় মাসিমা, জন্মাবে কেন! এ হল নিগ্রিটি। গেল বছর বেরিয়েছে এই ফুল।’ মা কত সলাপরামর্শ নিত, কত রকমের সার দিত, পারেকসাহেবের কাছে প্রায়ই চেয়ে নিত কলমকরা গোলাপ ডাল, চারা কি বীজ। কিন্তু মায়ের হাতে তেমন ফুল ফুটত কৈ! মা তাই বলত, ‘তোমার হাতদুটো আমাকে দাও পারেক। নইলে ফুল হবে না।’

এই রকম অদ্ভুত নেশা ছিল পারেকসাহেবের। পারেকসাহেব গাছ পেলেই টবে পুঁতে দিত। পাখি পেলেই খাঁচায়।

যতদূর বিশ্বাস, পারেকসাহেবের বাড়ি থেকেই আমার কিশোরবয়সী মনে প্রথম অলৌকিক রহস্যের চেতনা আসে। ছোট বাড়িটা ছিল, যে-কোনো খণ্ড আংশিক জিনিস যেমন শ্রীছাঁদহীন—একটা দেশলাইয়ের খোলের মতো। না কোনো বারান্দা, না রোয়াক, না একটা বড়ো উঠান কি লম্বা দালান, কিছুই ছিল না। সারাদিন আমাদের বাড়ির ছায়া পড়ে থাকত তার গায়ে, রোদ্দুরের জন্য ছোটবাড়িটা অপেক্ষা করে থাকত অপরাহ্নকাল পর্যন্ত। রাস্তার দিকের আলকাৎরা-মাখানো জানালাদুটি বন্ধ থাকত সবসময়, দরজাটা প্রয়োজনে ছাড়া খুলত না। বাইরে আসা দূরে থাক, খেলার জন্যে বাড়ির ছেলেমেয়েদের ছাদে পর্যন্ত উঠতে দেখা যেত না।

ছোটবাড়ির ছাদে রোজ সকালে পারেকের এঁটিলি-মারা লোমশ পিঠ তাই আমায় ভয় দেখাত, যদি পারেকসাহেব ঘুরে দাঁড়ায়, তাঁর রক্তের ছাট-ধরা চোখের ওপর পরস্পর-রক্তচোষা জোঁকদুটি কপাল জুড়ে বেঁকে যায়, যদি। তবুও কৌতূহল! আকাশ ঝুলে পড়েছে মেঘে, ভিজে হাওয়া বাইরে সোঁ, সোঁ, ময়ূরীটা কই ডাকছে না ত। কী করছে সে জালের ঘরে? রুক্মিণী কী করে দুপুরবেলা? ঘুম, না পড়ে, না শুধু জেগে থাকে আমার মতো? মেঘ করলেও পড়ে?

ও-বাড়িতে আমরা কালেভদ্রে যেতে পারতুম, কাজেকর্মে পারেকসাহেবের মামা যখন মারা যান, মেহগিনি খাটের পালঙ্ক থেকে তাঁকে ইঁদুর-আরশোলায় ভরতি ভাঁড়ার ঘরে শুয়েই দেওয়া হয়েছিল। মামা বেঁচে থাকতে থাকতেই নতুন বউকে নিয়ে পারেক তাঁর পালঙ্কে শুত, মামার অসুখের সুযোগ নিয়ে দোকানটা লিখিয়ে নিয়েছিল, মৃত্যুর পর বাড়িটা গ্রাস করেছিল মামিমাকে ঠকিয়ে। কালো কাপড় পরে, গলা অবদি ঘোমটা টেনে, পারেকের মামিমাকে একদিন ছেলেপিলের হাত ধরে বেরিয়ে যেতে দেখেছি।

পারেকের মামার মৃত্যুদৃশ্যে আমি মায়ের আঁচল ধরে ঘরের কোণে বসেছিলুম। ঘরভরতি আত্মীয়স্বজন, তার মাঝখানে একপাল বোকা ছেলেমেয়ে নিয়ে পা ছড়িয়ে বসে তাঁর বোধহীন স্ত্রী। রবীন্দ্রনাথের মতো সোনালি দাড়ি ছিল পারেকের মামার, মহাভারতের রাজা যযাতির ছবির মতো তিনি শুয়েছিলেন, স্থবির বুক থেকে ফতুয়ার সবকটি বোতাম খুলে দেওয়া হয়েছিল, তাঁর ফেটেপড়া চাহনি পারেকসাহেবকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।

পারেকসাহেব এল মধ্যরাতে, কালো কিংখাবের মত লরেন্স কোম্পানির গম্ভীর গাড়িতে চেপে। ঘুম থেকে জেগে উঠে আমরা সবাই অন্ধকার বারান্দা থেকে সারবন্দি ঝুঁকে রইলুম। কফিনটা রাস্তায় নামানো, তার চতুর্দিকে হি হি ঠান্ডার মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে কয়েকটি ছায়াশরীর, চাপাস্বরে ব্যস্ততাহীন কথাবার্তা বলছে সকলেই, দূর থেকে দূরে বসানো গ্যাসলাইটগুলো ধোঁয়া ছাড়ছে, সম্মুখের সমস্ত পথটা আলোকিত করে গাড়ির হেডলাইট জ্বলছে। আলোয় বৃষ্টির কণা উড়ছে ফরফর করে, অদূরে মোড়ে দীর্ঘ ডাকবাক্স নীরব ও নতমুখ মানুষের বর্ণনার মতো দাঁড়িয়ে।

এরই মধ্যে এক-একবার পারেকের উদ্ধত গলা-খাঁখারি শোনা যায়। একটু পরে গলি দিয়ে লম্বা গাড়িটা ক্রিমেটোরিয়ামের দিকে বেরিয়ে গেল হর্ণ না দিয়ে। ভিড় সরে গেল। কোনো জানালা খোলেনি, ছোটবাড়ির দরজা শব্দ করে বন্ধ হল। সেদিন বাড়ির ভিতর রোদনের কোনো চিত্ররূপ ছিল কিনা বলা যায় না, কিন্তু যতক্ষণ দরজা খোলা ছিল কান্নার অস্ফুটতম কোনো ধ্বনিও বাইরে আসেনি।

মা বলল, ‘শয়তান!’

বাবা বলেছিলেন, ‘ও ভোগ করতে পারবে ভেবেছ, ওর বুকে বজ্রাঘাত হবে।’

পারেকের দ্বিতীয়পক্ষের বউ মীরাবৌদি এল মামার মৃত্যুর কিছু আগে। পারেকসাহেব তখন সদ্য লাগিয়েছে সেই পাগলা-ফুলের চারা, তখনও তার ফুল হয়নি, তখন তার সমস্ত পাতাই নবীন, রাতারাতি উৎসাহে বেড়ে উঠে পামগাছটার পা জড়িয়ে, খাঁজকাটা গা জড়িয়ে, গলা পর্যন্ত লতিয়ে উঠবে। এই আশায় পারেকসাহেব চারাটা পুঁতেছিল পামগাছের গোড়ায়।

মীরাবৌদির চোখের সামনেই পারেকের বিধবা মামিমা ছেলেপিলের হাত ধরে অধোবদনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন একদিন। মামিমা ঝি-গিরি করত, বেশি দূর নয়, তাও মীরাবৌদির শ্রুতির মধ্যেই ছিল। একদিন পারেক ছাদের সুদীর্ঘ জানালাটা জাল দিয়ে মুড়ে দিল। জালের ওপাশে ছাদের আলসেয় বসে কতদিন দুপুরবেলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মীরাবৌদি বলেছে, ‘কী করব মাসিমা। আপনার ছেলেকে ত জানেন।’

পারেকের বাধানিষেধ ছিল অনেক। ছাদে ওঠা বৌদির বারণ ছিল। তবু পারেকসাহেব দোকানে বেরিয়ে গেলে মীরাবৌদি রোজ দুপুরে এসে বসত ছাদের আলসেয়।

স্কুল থেকে ফিরে কতদিন দেখেছি, তখনও দিদির সঙ্গে আড্ডা চলছে। আমাকে দেখলেই বৌদি বলে উঠত, ‘কী গো, প্পা-প্পা-প্পা-পাউরুটি?’ আমি ছিলুম তোৎলা। দিদি বলত যা, কেন লজ্জা দিচ্ছ বেচারাকে।’ আমি বসে পড়তুম দিদির গা ঘেঁষে।

দিদি বলত, ‘লাল শায়া পরেছ, পারেকশাহেব জানতে পারলে?’

বৌদি বলত, ‘ধুর!’

‘আচ্ছা, তবে কিনে দেয় কেন, পরবে না যদি?’

‘পরি ত।’

‘কখন পরো?’ দিদি যেন জানে না কিছু।

‘পরি।’ মীরাবউদি বলত অধরে জিভ বুলিয়ে।

‘রাত্তিরে পর?’

‘যাঃ নেকি কোথাকার।’ মীরাবৌদি মেয়ে রুক্মিণীর মতো হেসে ফেলত ফিক করে।

‘আচ্ছা বৌদি’, অস্থির হয়ে উঠে দিদি এক-একদিন বলে উঠত’, ‘তোমার যে এত দামি-দামি জামাকাপড়, তোরঙ্গভরতি, আলমারিভরতি। কই, পরো না ত কিছু।’

‘কেন, এই ত পরেছি।’

‘এ ত বিচ্ছিরি। সস্তা।’

‘কী করব রে।’ মীরাবৌদির লাল মুখটা বড়ো অসহায় দেখাল, ‘তোর দাদা যে এই বের করে দিয়ে গেল আজ। অন্য কিছু পরলে জানিস ত, রক্ষে আছে!’

‘সিল্ক পরো না? জর্জেট পরো না, ব্রোকেডের সেই ব্লাউজটা?’

‘পরি ত।’

‘রাত্তিরে?’ দিদি চোখ নামিয়ে জিজ্ঞাসা করত ফের।

‘আচ্ছা মীরাবৌদি’, ভুরু তুলে, ঘাড় কাৎ করে, পা ছড়িয়ে মীরাবৌদি ভাবতে বসত, ‘ইশ! সেই গেরুয়া-রঙেরটা, পুজোর সময় যেটা বাগবাজার একজিবিশন থেকে কিনেছিলুম, না? সত্যিই তো, ওটা ত পরিনি কোনোদিন।’ এরপর মীরাবৌদি চুপ করে বসেছিল অনেকক্ষণ। সূর্যের পড়ন্ত আলোয় ক্রমশ রক্তিম হয়ে উঠেছিল তার মুখটা, ব্যথায় করুণ দেখাচ্ছিল। যেন জ্বর হয়েছে তার। গ্রীবা বাঁকিয়ে সূর্যের দিকে চেয়ে অতক্ষণ কী ভাবল কে জানে, দিদিও জিজ্ঞেস করার মত আর-কিছু না পেয়ে চুপ, হয়ত মীরাবৌদি তার ভুলে-যাওয়া গেরুয়াবসনের জন্যে অত্যন্ত মমতা বোধ করছিল।

হঠাৎ কী মনে পড়ায় চকিত হয়ে উঠে বৌদি বলল, ‘ওই যা একদম ভুলে গেছি। উঠে দাঁড়িয়ে দিদির দিকে চেয়ে বলল, ‘ওটা কী পরেছিস রে, ধুতি, কার বিশুঠাকুরপোর? কেন তোর থান কী হল?’

বিশেদা আমার পিসতুত দাদা, বিধবা হবার ন-মাস পরে নাড়ি কাটা হয় মা ও ছেলের, তার ছোটবেলাতেই পিসিমা মারা যান। আমার জন্মের আগের ষোলোবছর বাবা-মার অপত্যস্নেহে বিশেদারই একমাত্র অধিকার ছিল।

আমার ছ-বছর বয়সের সময় যুদ্ধ বাধে, কিরকিতে মাসআটেক ট্রেনিং নিয়ে বিশেদা যুদ্ধে যায়। ঠিক তখনকার কোনো স্মৃতি নেই বিশেদার, শুধু মনে পড়ে এটা আমার বড়ো আশ্চর্য লাগত যে, ডাকটিকিট লাগে না, খামের উপর খালি ‘অন হিজ ম্যাজিস্টিস সার্ভিস : লোকো ড্রাইভার ১০০০৭, এফ পি ও’, লিখে দিলেই তার কাছে চিঠি চলে যায়।

মণিপুর রোড স্টেশন অবধি ফ্রন্টে এঞ্জিন চালাত বিশেদা। যুদ্ধের শেষাশেষি বাঁ-হাতের কবজি জখম হওয়ার ফিরে এল, তখন জাপানিরা পশ্চাদপসরণ করেছে। হসপিটাল হিল দখলের জন্যে তুমুল যুদ্ধ হচ্ছে তামু-প্যালেল রোডে।

পিঠে হ্যাভারস্যাক, কাঁধে ফেল্টের ওয়াটার-বটল ও সাদা কলারে মগ, জামার পকেটে ও কাঁধের ফিতেয় আঁটা নানারকম স্মারকচিহ্ন—বুটের শব্দ তুলে হেঁটে এসে, বিশেদা যেদিন দরজায় দাড়িয়ে ডাকল, ‘মামিমা’, বস্তুত বিশেদা-সম্পর্কে আমার স্মৃতির সেইদিন থেকে শুরু। সেদিন ছিল দোল, আমার জ্বর হয়েছিল। জানালা ফাঁক করে আমি দেখেছিলুম, বিশেদা মোড় বেঁকলো, পরনে নীল মিলিটারি স্যুট তার; ভারি বুটের শব্দ তুলে রঙিন রাস্তা মাড়িয়ে হেঁটে এল সমস্ত গলিটা, পাশে বাবা; দেখেছিলুম শম্ভু, বাদল, মহিম, লাবি, রুক্মিণী এরা সরাই পিচকিরি নামিয়ে নিল একে একে, ভয়ে কেউ বাবার গায়ে পর্যন্ত রঙ দেয়নি। বিশেদাই জানালার জালের গায়ে কনুই অবদি হাত ঢোকাবার মত করে চৌকো গর্তটা কেটে দেয়।

পারেকসাহেব বেরিয়ে গেলে দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে কাপড়-জামা শুকুতে দেবার জন্যে মীরাবৌদি ছাদে উঠত রোজ। জালের ওপাশে বসে থাকা তার অলস-মূর্তি বেশ মনে পড়ে, পাশে আলসের ওপর রাখা মেয়েদের জামাকাপড়, পারেকের চেকলুঙির পাশেই নিঙড়ানো সায়া, নিঙড়ানো তার ফুলগুলিও। পিঠময় ভিজে চুল, খোঁপা আমি কখনও দেখিনি। চুলের মোটে যত্ন নিত না মীরাবৌদির। আজ মনে হয় বিবাহিত-জীবন তার খুবই ব্যস্ততায় কেটে থাকবে, নিশ্বাস ফেলার সময় পেল আর কই, দশবছরের বিবাহিত জীবনে তাকে আটটি সন্তান প্রসব করতে হয়েছিল।

সূর্যের দুপুরে কি মেঘের, মীরাবৌদি কথা মনে করতে গিয়ে এখন মনে হচ্ছে বৌদি যে জালের ওপাশে তাঁর উঁচু পেট নিয়ে বসে আছে, ঋতুগুলি তার মুখে ছায়া ফেলে চলে যাচ্ছে। শীতে তার শরীর কাঁপছে, সাদা র‍্যাপারের ভিতরে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে মীরাবৌদি, গ্রীষ্মে ঝকঝক করছে তার লেস-বসা থ্রি-কোয়ার্টার ব্লাউজ, কনুই-এর পর থেকে আলসের ওপর রাখা তার এলানো হাত নিশ্চল পথের মতো পড়ে আছে, গ্রীষ্মের রোদ্দুরে পথের মতোই উপায়হীন জ্বলে যাচ্ছে; খোলাহাওয়ায় উড়ছে তার চুল, চিলের ডাক শুনে মীরাবৌদি আকাশের দিকে মুখ তুলছে; পরমুহূর্তে সমস্ত উজ্জ্বলতা ম্লান করে দিয়ে মেঘ তার মাথার উপর এসে দাঁড়ায়। টপ করে একফোঁটা জল পড়ে হাতের ওপর। নগ্ন বলতে শুধু হাতটুকু, শিউরে তুলে নিয়ে হাতের দিকে চেয়ে আছে মীরাবৌদি, যেন ওটা তারই একখণ্ড, বলছে, ‘ইশ, ভগবানের কথা মনে পড়ল রে।’

‘আজ যে পান খাচ্ছ বড়ো, পান ত রাত্তিরে?’ জালের এপাশে বসে দিদি জিজ্ঞেস করে।

‘কী করব, বমি পাচ্ছিল যে বড়ো। যাকগে ঘুয়ে ফেলবে।’ তারপর বৌদি বলল, ‘তোর দাদার জ্বালায় আর পারি না ভাই।’

‘দিদি গালে হাত রাখল, ‘সে কী গো এর মধ্যেই?’

কোমরের আড় ভেঙে, নাকের পাতা ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মীরাবৌদি বলত, ‘আর পারি না।’ দিদি বলত, ‘সে কি গো খাওয়াচ্ছ কবে?’

মীরাবৌদির ঠোঁটদুটির কথা ভেবে আজও বিস্ময় বোধ করি। শুকনো ঠোঁট শীতে অসম্ভব ফাটত, জিভ বুলিয়ে বুলিয়ে সাদা করে ফেলেছিল। বোজা থাকলে হাঁ-মুখটা দেখাত এতটুকু, বাচ্চা মেয়েদের মতো ছোট, কথা বলার সময় ছোট, কান্নার সময় চাপা সরলরেখা, হাসতেন যখন শুধু তখনই কী অসম্ভব বেড়ে যেত ঠোঁটদুটি, অত ছোট ছোট দুটি ঠোঁট কী করে অমন চওড়া হাসি হাসত মীরাবৌদি আমি জানি না, যদি কখনও কোনো মহিলাকে ও-রকম হাসতে দেখি আর, তাকে জিজ্ঞেস করব। মীরাবৌদি হেসে বলত, ‘বা, বিয়ের আগেই নেমন্তন্ন খাবি নাকি?’

সারাদুপুর দরজার পরিবর্তে জাল-আঁটা সেই বিশাল জানালার পাশে মীরাবৌদি বসে থাকত রোজ। রোজই লেভেল ক্রশিং-এর গেট নেমে আসত একসময়, তীব্র সিটি বাজিয়ে দূর থেকে ছুটে আসত। মেলট্রন, নাটবল্টুপিস্টনফিসপ্লেট, বগির ঠোকাঠুকি, সব মিলিয়ে আওয়াজ হত ঝন্ ঝন্ ঝন্ ছুটন্ত ট্রেনে লহমায় লহমায় মুখ, এগজস্ট-পাইপ থেকে গলগল করে ধোঁয়া উড়ে এসে গ্রাস করত তাকে, দুহাতে কান চেপে ধরে ধোঁয়ার ভিতর থেকে আবার পরিস্ফুট হয়ে উঠত মীরাবৌদি, তারপর আবার সেই বসে-থাকা।

বছর বছর মেয়ে হত, মেয়েদের প্রতি মীরাবৌদির নিষ্ঠুরতা ছিল জানোয়ারদের থেকেও বেশি। জন্তুজানোয়ারদের তবু একটা বয়স পর্যন্ত সন্তানের প্রতি মমতা থাকে, তার তাও ছিল না। অমন টসটসে শরীর, বহু বছরের দাম্পত্য সত্বেও কোথাও টাল খায়নি যা, তবু কিশোরী মেয়েদের মতো তার ছোট ছোট স্তনে দুধ হত না একফোঁটা। অনেক ইনজেকশন নিতে হয়েছিল, নামকরা ডাক্তার দেখেছিল অনেক, কোনো ফল হয়নি। প্রতিবছরই বস্তি থেকে সদ্যপ্রসূতির ডাক পড়ত তাই। ছ-সাত মাস মোটা মাইনে দিয়ে তাকে রাখতে হয়। অথচ শেষ সন্তান গর্ভে আসার পর থেকে প্রসবের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সে কী উত্তেজনা তার। এটার নাকটা কী-রকম হবে কে জানে, টিকলো হবে কি, মেনির মত খাঁদা না হয় আবার। ‘ব্যাটাছেলের চোখের তারা বেশ বড়ো হবে, বুঝলি ঠাকুরঝি, ভ্রূ-দুটো হবে টানা-টানা, তবে ত।’

‘ইশ, নড়ছে যে রে পেটের ভিতর।’ শিউরে উঠে একটু পরে আধোজাগা গলায় মীরাবৌদি বলত। ‘ভীষণ, ভীষণ কালো হবে’ দুদিকে অবিরল অস্থিরভাবে মাথা নাড়িয়ে বলত, ‘আমার ছেলেকে যেন কোনদিন কাজল পরতে না হয়। কী করে বলব তোকে কেমন হবে তার চাউনি, কত বড়ো বড়ো হবে তার চোখের পাতা, বুকের ভেতর গিয়ে পড়ে থাকবে।’

‘আর গায়ের রঙ?’

‘সত্যি সত্যি বলছি’, জালের ওপাশে উনুনের মাটি চিবুতে চিবুতে বৌদি বিরক্তমুখে উত্তর দিত, ‘ফরশা ব্যাটাছেলে আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। আমার গা ঘিনঘনি করে— এ ম্যাগো!’

পারেকের মা ছিল ইহুদি। তার চোখের তারা কটা, গায়ের রঙ খোসছাড়ানো সেদ্দ আলুর মত ফ্যাঁসফ্যাসে-হলদে।

দিদি জিজ্ঞেস করত, ‘তাহলে পারেকসাহেব?’

‘ব্যাটাছেলের গায়ের রং ঠিক কালো হবে না।’ দেখতে দেখতে আবার অপরাহ্ণকাল এসে যেত, মন্দিরের চূড়া থেকে ঠিকরে এসে আলো লাগত মীরাবৌদির মুখেচোখে, বুকে; ‘শ্যামল হবে, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ হবে, বুঝলি?’ নিচু গলায়, যেন গোপন খবর, বৌদি বলত, ‘এই যেমন কৃষ্ণের ছিল।’

‘কে বাঁশি বাজাচ্ছে রে!’ ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াত মীরাবৌদি, তার হাতের চুড়ি বেজে উঠত ঝমঝম করে। ‘ও!’ আমূল উৎপাটিত গলায় তারপর বলত, ‘এই যা। রেডিও আরম্ভ হয়ে গেল? যাই; শনিবার, তোর দাদা এসে পড়বে। কী বই এনেছে রে বিশুঠাকুরপো?’ বিশেদা লাইব্রেরি থেকে আনত ‘রমাহারা মোহন।’ দিদির হাত থেকে মীরাবৌদি নিত জালের গর্ত দিয়ে কনুই অবদি হাত ঢুকিয়ে।

দুবার চেষ্টা করে ক্লাশ এইট-এ প্রমোশন না পেয়ে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে দিলে কি হবে, বিশেদার হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মত গোটা গোটা। পাড়ার মেয়েমহলে এজন্যে বিশেদার চাহিদা ছিল খুবই। ছুঁচের কাজ, পিক্টোগ্রাফ বা আসনের জন্যে অনেকেই বিশেদাকে দিয়ে ‘পতি পরম গুরু’ বা ‘জননী জন্মভূমিশ্চ’, ‘কিছু লয়ে আসে নাই কিছু নাহি লয়ে যাবে’ কি ‘যে-জন দিবসে মনের হরষে’— এইসহ লিখিয়ে নিয়ে যেত। একখণ্ড কালো মখমলের ওপর বিশেদা দিদিকে লিখে দিয়েছিল, ‘সোনার হরিণ, তুমি কোন বনেতে থাক?’ বিশেদার সঙ্গে মীরাবৌদির কথাবার্তা ছিল না। বৌদি দিদিকে একটা বীডিং-করা শাদা বেড-কভার পাঠিয়ে দিয়েছিল একদিন। বলেছিল, ‘ঠাকুরপোকে বলিস ত একটা কিছু লিখে দিতে।’

বিশেদা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম শুনেছিল। ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি’ বা ‘দুই বিঘা জমি’ পড়েছিল ছেলেবেলায়, জন্মদিনের সভায় ‘পঞ্চনদীর তীরে’ বা ‘প্রশ্ন’ কবিতার আবৃত্তিও বারংবার শুনে থাকবে। অথচ কোথা থেকে বা কী করে কে জানে, মীরাবৌদির সাদা বিছানার চাদরের ওপর, মুক্তোর মত ঝরঝরে হস্তাক্ষরে বিশেদা বড় বড় হরফে লিখে দিয়েছিল:

‘যতবার আলো জ্বালাতে চাই

নিবে যায় বারে বারে

আমার জীবনে তোমার আসন

গভীর অন্ধকারে।’

চাদরটা বহু বছর টিকেছিল, খাটজোড়া বিছানার পর সেটা পাতা হত বছরে দু-চারবার, বড়োদিনের সময় নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে আমি একবার দেখেছি। ছাদের তারে তার অক্ষরগুলি গ্রীষ্মের রোদে শুকতো, বসন্তে মনোরম বাতাসে দুলে উঠে গাছের পাতার মত উলটে যেত অক্ষরগুলি। হঠাৎ বৃষ্টি এলে ছাদে আসত মীরাবৌদি, প্রবল বৃষ্টির মধ্যে চাদরটা নামিয়ে নিতে তাকে কত দেখা গেছে। বৌদির বিবাহের তোরঙ্গে আজ জাল বুনে যাচ্ছে মাকড়শা, ভিতরে চাদরের পাটের ওপর শুধু ‘তোমার আসন’ এই শব্দ দু-টি, বাকিগুলি ভাঁজে ভাঁজে, তার ওপর গ্রুপফোটো, চিঠিপত্র, লাল চেলি কি জয়পুরে তোলা তার একা বালিকা বয়সের ছবিটা, তোরঙ্গের ভিতরের অন্ধকারে এই দৃশ্য আমি কল্পনা করতে পারি।

গল্প

মীরাবৌদির কথা এই পর্যন্ত লিখে আর সবকিছু মুছে দিয়ে এইমাত্র এমন-একদিনের স্মৃতি ভেসে উঠল, যা আগে মনে পড়েনি কোনোদিন। সেই কোন কিশোরবেলার কথা, দেখে তখন কিছুই মনে হয়নি, তখুনি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে থাকব। কিন্তু যেহেতু আমি ছাড়া জীবিত আর কেউ সে-কথা জানে না, যেহেতু কারুকে বলিনি কোনোদিন, এতকাল পরে এই প্রকাণ্ড ভেসে-ওঠার তাই এত বিস্ময়, গোপনতার এমন দারুণ মূল্য। নিজেকে তাই জাতিস্মর মনে হচ্ছে।

সেদিন বাড়িতে কেউ ছিল না। স্কুল থেকে সোজা চলে গিয়েছিলুম মাঠে। সেদিন এম এস পি সি এইচ স্কুলের সঙ্গে ফাইনাল ম্যাচ ওয়াকওভার হয়ে গেল, স্কুলের সেরা গোলকিপার আমি বাড়ি ফিরে এলুম তাড়াতাড়ি। যুদ্ধ থেকে ফিরে বিশেদা একটা মাড়োয়ারি ফার্মে ট্রাক চালাত। একপশলা বৃষ্টিতে ভিজে ট্রাকটা আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। কীভাবে পড়ে গিয়েছে কে জানে, দেখি, কাদামাখা সামনের একটা টায়ার জড়িয়ে সেই পাগলাফুলের ছিন্নলতা, যার নাম ক্যাথিফ্লোরা, তার নীলনীল কানপাশার মত ফুলসুদ্দু।

বগলে ফুটবল, হাতে বই, গায়ে মোহনবাগানের জার্সি, সিঁড়ি দিয়ে শব্দহীন উঠে দরজার একটা পাল্লা ফাঁকা করে আমি দেখলুম। দীর্ঘ দালানের শেষে জানালার জাল, জালের অনেকগুলি গর্ত কমলালেবুর ছিবড়ে ও পানের পিকে বোজা, জালের ওপাশ থেকে বিশেদার সারা গায়ে বৃষ্টিশেষের ভেসে-ওঠা আলোর একটা জাল ছুঁড়ে দিয়ে মীরাবৌদি বসে আছে। কনুই-অবদি সোনার চুড়ির অভাবে আজ তার নগ্ন হাত জালের গর্ত দিয়ে ঢোকানো, বিশেদা তার লোহারঙের সমর্থ দুটি হাতে জলে অঞ্জলি দেবার মত করে মীরাবৌদির কনুই অবদি ডানহাতটা ধরে এদিকে বসে আছে। শীতকাল; বৃষ্টিপাত হয়ে গেছে। মানুষ কাঁপতে ভালোবাসে, তবু দুজনেই সাড়হীন নীরব।

মীরাবৌদির পিছনে প্রকাণ্ড গোলাপের মত সূর্য। সূর্য ঝরে যায়। মূল আলো নেপথ্যে চলে গেলে থাকে তার বিম্ব; দীর্ঘ গাছ, পাখির গা কি জানালার আর্চ, সর্বত্র থেকে বিম্বিত হতে হতে অবশেষে লাগে মন্দিরের চূড়ায়। মন্দিরের চূড়া জ্বলে ওঠে। মন্দিরের চূড়া থেকে ঠিকরে বৌদির মুখেচোখে, তার আভা যেন মীরাবৌদির বুকে লেগে আছে। সাজানো গৃহস্থালি তার মনে নেই।

ওরা মুখোমুখি বসে। অন্ধকার হয়ে এলে পাখিরা চ্যাঁচামেচি শুরু করে। শিশুদের কোলাহল বেড়ে যায়। শাঁখ বেজে ওঠে।

দূর থেকে শব্দ ওঠে। একটি মালগাড়ি ব্যাক করছে। বৃষ্টিভেজা রেললাইনদুটি তাদের সমান্তরাল দীর্ঘতা জুড়ে চকচকিয়ে ওঠে, থরথর করে কাঁপছে। মালগাড়িটা আরও কাছে এসে পড়ে। এখন বাড়ি কাঁপছে, রাস্তা কাঁপছে, জানালা ঝনঝন করে বাজছে। ফিসপ্লেটনাটবল্টুপিস্টনের সমবেত ঝনাৎকারের মধ্যে চাকাগুলি দাত কামড়ে বসে যাচ্ছে লাইনের ওপর। তেতাল্লিশটা বগির অন্ধকার শোভাযাত্রা তাদের শৃঙ্খলের শব্দ তুলে পিছু হটে।

অবশেষে এঞ্জিনটা যায়। মাথায় রুমাল-বাঁধা, নীল হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি-পরা ড্রাইভার বিধাতার অপূর্ব কারুকার্যময় এঞ্জিনের অভ্যন্তরে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে। ইয়ার্ডে ঢোকার সময় এঞ্জিনটা ধীরে, অতি ধীরে বাঁক নেয়। ঝক, ঝক, ঝক, ঝঝঝঝঝঝঝঝ-ঝক, ঝক, ঝক, ঝক, ঝক… ধীর ও উন্মত্ত শব্দের উত্থান ও পতনের মধ্যে অকস্মাৎ ছাদের তারে ঝুলন্ত চাদরটার ওপর হেডলাইটের তীব্র আলো এসে পড়ে।

হাওয়ায় ফেঁপে ওঠে চাদরটা। অক্ষরগুলি আলোর ঢেউ-এ দুলতে থাকে। সিঁড়ির কাছ থেকে দেখে মনে হয়, যেন একটা কালো পিঁপড়ে ‘যতবার আলো’ থেকে কিলবিল করে হেঁটে ‘গভীর অন্ধকার’ পর্যন্ত পারাপার করছে।

আবার অন্ধকার। বিশেদার নগ্ন হাতের ওপর মীরাবৌদির কনুই-অবদি নগ্ন হাত, যেন একটা নগ্ন হাতের ওপর আর-একটা নগ্ন হাত। পিছনে চাদরটা উড়ছে পতপত করে। খরখর শব্দ করছে অক্ষরগুলি। অদূরে নিশ্চিত খড়গের মতো লেভেলক্রসিং-এর গেট উঠে যাচ্ছে।

উপসংহার

বাবা বলেছিলেন, ‘ও ভোগ করতে পারবে ভেবেছ, ওর বুকে বজ্রাঘাত হবে।’ পারেকের বুকে বাজ পড়েনি, বজ্রাঘাত হয়েছিল পামগাছটার মাথায়। কবর খুঁড়ে খাড়া-করা অলৌকিক অবয়বের মতো রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, জ্যোৎস্নায় ম্লান হয়ে, পোড়া পামগাছটা আজও দাঁড়িয়ে আছে; শবদেহের ওপর যেমন রোদ, যেমন বৃষ্টি, যেমন জ্যোৎস্না। অমাবস্যার কালো হাওয়ার তার গলার ভয়ংকর নীল মালাটা দোলে, জোনাকির ঝাঁক এসে তাকে ছেঁকে ধরে যখন।

আজও পারেক দোকানে বেরোয় নিত্য, কিন্তু দোকানের সে কালোবাজারি জৌলুস আর নেই। ফার্নিচার যা আছে সবই ভাঙাচোরা, এখন ধুলায় মলিন। পাখি নেই, কিছু নেই, ফুল নেই। ময়ূরীর খাঁচাটা ভেঙে গেছে কবে, শ্বেতির দাগে ভরতি নুরওয়ালা রোগা মুসলমান সাইকেলের ঘণ্টি বাজিয়ে আর আসে না। পারেকের প্রথম পক্ষের ছেলে বাইরে চাকরি নিয়ে চলে গেছে, অনুচ্চারণীয় ভাষায় বাবাকে গালাগালি করবার জন্যে মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে সে বাড়ি ফেরে, রুক্মিণীর বিয়ে হয়ে গেছে। পারেকের কানি ঝি-টা মীরাবৌদির মেয়েদের অসম্ভব মারপিট করে, বিকট চিৎকার করে, মারতে মারতে হাঁফিয়ে উঠে ঝি-টা বলে, ‘সেই মানুষটা কোন সকালে খাটতে গেছে, তোদের এ্যাট্টুকুন মায়াদয়া নেই র‍্যা’, আমরা এ-বাড়ি থেকে শুনতে পাই। ‘মেয়েগুলোর জন্যে খাটতে খাটতে নঙ কালো হয়ে গেল মা’, ছাদজোড়া কুমড়ো গাছ ডিঙিয়ে। এসে জালের ধারে দাঁড়িয়ে সে মাকে বলত। মীরাবৌদির আইবুড়ো মেয়েটা মীরাবৌদির ঢাকাই পরে বিকেলে গা ধুয়ে ছাদে এসে দাঁড়ায়, অসম্ভব বোবা, যেন তার মুখে রুমাল গোঁজা।

তবে তাঁর অনুমান মিথ্যে হয়নি, পরপর সাতটি মেয়ের পর অষ্টম গর্ভে মীরাবৌদি পুত্রসন্তান প্রসব করেছিল। তার আরও অনুমান সত্য বলে প্রমাণ হয়েছিল। তার ছেলের নাক মেনির মত খাঁদা হয় নি, টিকালো হয়েছিল। সে ফরসা হয়নি, তার ভ্রূ-দুটি হয়েছিল টানাটানা। মীরাবৌদি সত্যিসত্যি নীল সন্তান প্রসব করেছিল। আজ আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, ইচ্ছা হলে গায়ে কাঁটা দেয়, যে, তবে কি, অষ্টমবার গর্ভধারণ করে মীরাবৌদি কোনো দৈববাণী শুনেছিল?

জন্মের কিছু পরে সে মারা যায়। চোখের তারা বড়ো বড়ো হয়েছিল কি না, পল্লবগুলি কেমন হয়েছিল, কেমন-বা ছিল চার চাহনি, মুহূর্তের জন্যে মীরাবৌদির হয়ত তা দেখে থাকবে। আমি যখন মা-র সঙ্গে যাই, বৌদির তখন জ্ঞান ফেরেনি, তাকে গিরে আছে ডাক্তার, ধাই, প্রতিবেশী দু-একজন ও স্বয়ং পারেকসাহেব। পাশেই মেঝের ওপর, কাঁথার মস্ত বড়ো পদ্মের ওপর, চোখ বুজে শুয়ে আছে তার নীল ছেলে; যেন সে গর্ভের আঁধার থেকে বেরতে চায়নি, যেন তাকে ছিঁড়ে বের করে পদ্মের ওপর আছড়ে ফেলেছে কেউ, নীল হয়ে যেতে যেতে—গলা কাটা যাবার আগে নিশ্চিত খড়েগর দিকে চেয়ে যেমন মানুষের বোধহীনতার মধ্যে আচম্বিতে বোধ জেগে ওঠে, বেদনাহীন দুঃখে বিদ্যুচ্চমকের মধ্যে সে তার সকল অতীত দেখে নেয়, যেমন ক্ষণপরে তার গলাকাটা মুণ্ডু তার বিচ্ছিন্ন ধড়টার দিকে একলহমা ধরে চেয়ে দ্যাখে—তেমনই, নীল হয়ে যেতে যেতে মীরাবৌদির অষ্টমগর্ভে জাত সন্তান কি তার মাতৃমুখ দেখে যেতে পেরেছিল?

বছরচারেক পরে সকলের অজ্ঞাত কারণে রেলএঞ্জিনের ড্রাইভার বিশেদাকে রেলএঞ্জিনের চাকার নিচে গলা পেতে দিতে হয়েছিল। সেই মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আমার। খুব কাছে এসে গিয়েছে তখন মালগাড়িটা। ঝক, ঝক, ঝক, ঝক, শব্দ উঠছে, ঝক, ঝক, ঝক, তারপর আবার সেই উন্মত্ত, ঝঝঝঝঝঝঝঝ-ঝক, ঝক, ঝক শব্দ উঠছে ঝক, ঝক, ঝক… পাঁচিলের ওপাশে রেলইয়ার্ডের মধ্যে লাইন-পালটানোর শব্দ হিসাব করে তেতাল্লিশটা বগি গুনেছিলুম সেদিন, বিছানায় ভয়ে কাঠ হয়ে শুয়ে।

পরদিন মর্নিং-স্কুলে যাবার পথে শুনি রেলবাঁধের ওপর সুইসাউড করেছে একজন লোক। বাঁধে উঠে দেখি, কাঁধের কাছ থেকে কাটা একটা ধড় পড়ে আছে, তাকে ঘিরে একদল অপরিচিত লোক, তারা সকলেই নিমগ্নভাবে দাঁড়িয়ে, তখনও পুলিশ আসেনি। বেচু ও আমি বাঁধের ওপর দিয়ে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে লাইনের ধারে এক জায়গায় কনুই থেকে কাটা একটা নীল হাত পড়ে রয়েছে দেখি, সম্ভবত চাকার সঙ্গে আটকে গিয়ে থাকবে। আমি হেঁট হয়ে তা স্পর্শ করতেই, ‘এ্যাই বিজন’, বেচু চমকে বলে উঠেছিল, ‘কী করলি!’ আমি বললুম, ‘তোকে ছোঁব না। কিন্তু মাকে বলিস না, খবরদার।’ তারপর আমরা দুই বন্ধু রেললাইন ধরে হাঁটতে লাগলুম পূর্বদিকে, পাশাপাশি, বহুদূর। যতদূর যাই, দেখি, মাঝে মাঝে শ্লিপারের ওপর রক্তের ফোঁটা দানা বেঁধে আছে। হয়ত রাতের মালগাড়ির কোনো বগিতে কলকাতার জন্যে ছালছাড়ানো ভেড়া কি শূয়ারের মাংস চালান যাচ্ছিল।

কিন্তু সেই স্পর্শে আমার জ্ঞান সেই স্পর্শের কথা আমার মনে পড়ে, তার স্মৃতি আমার মূলে আজও শিউরানি জাগায়। যখনই মনে পড়ে, যাই ছুঁয়ে থাকুক আমার হাত, বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত আমি বন্ধুর কাঁধ থেকে হাত তুলে নিই, সরিয়ে নিই বই থেকে, আলমারি থেকে, লোভ, আশা, তৃপ্তি থেকে। সেই স্পর্শ আমাকে চোখের সামনে বারবার প্রতিভাত করে তোলে। ঘূর্ণির মতো তাদের সর্বগ্রাসী মানে আমাকে টানে, অর্থ না জেনে যে পঙক্তিকটি ব্যবহার করে তার অজ্ঞতা, আজ আমি বুঝতে পারি, বুঝতে পারি অজ্ঞতার ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।

রেলের লাইনে গলা পেতে তার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত সুদূরের শব্দ নয়, মাত্র এক হাত দূরে এঞ্জিনটা যখন, তখন থেকে গলায় চাকা বসার মুহূর্ত পর্যন্ত বিশেদা কি এঞ্জিনের শব্দ শুনতে পেয়েছিল? পেয়েছিল নিশ্চয়, তবু গলা তুলে নিতে পারেনি! তারপর বিশেদার কাটামুণ্ডু ক্ষণেকের জন্য তার ছিন্ন ধড়ের দিকে চেয়ে ছিল নাকি? কী দেখেছিল— কী সেই অজ্ঞাত কারণ, যা রেলএঞ্জিনের-ড্রাইভার বিশেদাকে রেলএঞ্জিনের চাকার গলা পেতে রাখতে বাধ্য করেছিল, গর্ভের প্রহেলিকার মতো ঘিরে ধরে স্পর্শের সেই রোমাঞ্চ আজ আমাকে তা জানায়।

আটমাসের গর্ভবতী অবস্থায় নীল সন্তান প্রসব করে মীরাবৌদি মারা যায়। তার জরায়ুতে ক্যানসার হয়েছিল, সে কারণ নয়। তারপরেও বিশেদা বিয়ে করেছিল, বধূ ছিল, শিশু ছিল, সে কারণ নয়। বস্তুতপক্ষে মীরাবৌদির কোনো অসুখে মৃত্যু হয়নি, এই মৃত্যু ছিল তার একান্ত নিজস্ব মৃত্যু, তার অবধারিত। সন্তানের জন্ম দিয়ে, সন্তানের জন্ম দিতে দিতে, শরীরকে ক্রমাগত কাঁদানোর এ-ছাড়া আর কী শাস্তি হতে পারত তার!

মা যতই বলুন, ‘মীরার মতো সতী এ যুগে হয় না’, যতই বলুন, ‘সাক্ষাৎ মীরাবাঈ’, একদিন বিকেলবেলার স্মৃতি ও একদা ভোরবেলার কাটা নীল হাতের স্পর্শ থেকে আমি জানি, কী সূক্ষ্মভাবে চরিত্রহীন ছিল মীরাবৌদি, আর সেই অজ্ঞাত শিল্পচেতনাকে স্পর্শ করার জন্য ব্যাকুল পারেক কী অবর্ণনীয় বোধহীনতায় পাখি পেলেই খাঁচায় পুরে দিত ত্বরিতে ও গাছ পেলেই টবে। ফুটপাতে শ্যু-এর শব্দ তুলে গলির মুখ থেকে জনহীন পারেক তাই হেঁটে আসত মাঝে মাঝে, মধ্যরাতের বন্ধ দরজার ওপর দুইহাতের মুঠি দিয়ে ঘুসি মারত কৃপাপ্রার্থী সে; স্খলিত-অস্ফুটস্বরে তাই সে ডাকত, ‘দরজা খোলো।’ ‘দরজা খোলো।’

হতভাগ্য পারেক তাই ১৯৬০টা পেরেক-মারা খ্রিস্টের ছবির পাশ থেকে নামিয়ে নিত তার নির্জীব চাবুক, কোলের মেয়েটাকে বুকের কাছে চেপে ঝি ঘর থেকে বের করে নিয়ে যেত, দরজা-জানালা একে একে বন্ধ হয়ে গেলে পারেকসাহেব তাই মাঝে মাঝে মধ্যরাতে কাফ্রী হয়ে যেত। লেজের কাছ থেকে চেপেধরা জ্যান্ত সাপের মতো চাবুক দুলিয়ে ঘরের মাঝখানে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে এ-যুগের সতীর মুখোমুখি হত।

১৯৬০

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *