মিলুর জন্য – ৯

দরজায় বেল বাজল। হিমাদ্রি স্থাণু হয়ে বসে আছেন!

রণো একলা ফিরল, একা?

দূর্বা ডাকল, বাবা!

রণো আর দূর্বা ঢুকল, হ্যাপি বার্থ ডে বাবা।

হিমাদ্রি চোখ ঢাকলেন।

রণো বলল, আমরা…সব সামলে নেব।

—তোমাদের হেম মা কোথায় গেছে?

দূর্বা বাবার পিঠে হাত রাখল। জীবনে এই প্রথম। চোখ ঢেকেই হিমাদ্রি অন্য হাতের আঙুলগুলো দূর্বার আঙুলের ওপর রাখলেন।

তারপর দূর্বা বলল, স্থির হও বাবা।

—মিলুর…কী হতে পারে?

—আমি কিচ্ছু জানি না বাবা। দাদা জানিস কিছু?

—আমি কী জানব? এবার হেম মা লিখেছিল, বাড়িতেই থাকতে হবে যতদিন থাকি। বাবার সত্তরবছরের জন্মদিন আসছে। যেন ভুলে না যাই।

না, ভুলে যায় না রণো। একটা ফোনোগ্রাম সকালেই পৌঁছে যায় বাড়িতে। রণোর শুভেচ্ছা।

দূর্বা বলল, বোস দাদা।

হিমাদ্রি বললেন, মধুলা? প্রদীপ?

—প্রদীপ তো সন্ধ্যায় আসবে। মধুলাকে ওই আনবে।

—ওইটুকু মেয়েকে ছেড়ে এলে?

—ওর ঠাকুমা আছেন তো কিছুদিন। মধুলার লোকও আছে।

দূর্বা, যেন পরিবেশটা খুব সহজ করার জন্যেই বলল, তোমার নাতনির কথা আর বোলো না। সকলের কাছে থাকে, কোনও কান্নাকাটি নেই, কোনও বায়না নেই। সময়ে খাইয়ে দাও, নিশ্চিন্ত।

—প্রদীপের মা এসেছেন?

—হ্যাঁ, এ সময়টা উনি প্রতি বছরই আসেন। এখন না হয় ব্যাঙ্গালোরে থাকেন। এখানেই তো ছিলেন। অনেক বন্ধু আছে ওঁর।

—কিছু বলেনি হেম মা তোমাদের?

—আমাকে কাল টেলিফোনে বলল, সকাল থেকে আসতে হবে। সব দেখে শুনে সামলাতে হবে। হেম মা’র কী কাজ আছে যেন। আর বলল, তুমি কিছু জানো না।

রণো বলল, আমাকে তো সকালে বলল। বাবা বেরোলেন, তখনি বলল, সব ব্যবস্থা করা আছে রণো। সন্ধ্যাবেলা খাবারদাবার সব দিয়ে যাবেন ইতু মাসিমা। তোমরা ভাইবোনে আজকের দিনটা সামলে দাও।

—সব ব্যবস্থা করে গেছে?

—স—ব।

রণো বলল, অত ভেবো না বাবা। হেম মা কখনও এমন কোনও কাজ করে না, যার কারণ নেই।

—সেটাই তো দুশ্চিন্তার কথা।

—সে তো বলেছে, চিন্তার কোনও কারণ নেই।

হিমাদ্রি বুঝতে পারছেন তাঁর এতদিনের উত্তরাধিকার। (স্বোপার্জিতও বটে) যে কাঠিন্য, তা ভেঙে যাচ্ছে। দুর্বল হয়ে পড়ছেন তিনি। বার্ধক্যের লক্ষণ। অবুঝ হয়ে যাচ্ছেন।

—তার…যাবার কোনও জায়গা নেই…আমি চিন্তা করব না?

—চিন্তা করলে টেনশান বাড়বে।

দূর্বা বলল, দাদা! হেম মা’র মাসিমারা কি আছেন?

—মেসোমশাই তো ছিলেন বলে…

—লোকজন এলে কী বলা যাবে দাদা?

—বলব, হেম মা’র স্কুলের কোন কলিগ অসুস্থ। আটকে গেছেন। বলব, ফিরতে পারলে ফিরবেন।

দূর্বা বলল, চলো বাবা, খাবার টেবিলে বসবে। গল্প করতে করতে রান্না করে ফেলব।

—তুমি রান্না করতে পারো?

—দাদাও পারে। হেম মা কোন কাজটা শেখায়নি? ফার্নিচার পালিশ, সুইচ পালটানো, ফিউজ মেরামত, রান্না, কাপড় কাচা, ইস্ত্রি করা।

আশ্চর্য, হিমাদ্রি এসব কিছুই জানতেন না। আর হেমকায়া রণোকে স্বাবলম্বী হতে কতটা শিখিয়েছে, দূর্বাকে কতটা, তাও জানতেন না। একেবারে নতুন নতুন লাগছে সব কথা।

.

রান্নাঘরের দায়িত্বে সরমাকে দেখে হিমাদ্রি যতটা অবাক হল, দূর্বা বা রণো ততটা নয়।

—মাসি, কখন এলে?

—কেন। সকালেই? নাটকু আনতে গেল…দিদি অবশ্য বলেই রেখেছিল।

হিমাদ্রি অবাক। সরমা তো মিলুর মা।

হেমকায়ার স্কুলের ইতু যখন বাড়িতে কেটারিং ব্যবস্থা করল, সরমা ওখানে কাজ করত। মিলুকে হেমকায়াই এনেছেন। সরমা আগে স্কুলে কাজ করেছে।

—কী কী রান্না হবে তা জানো?

—সব জানি বাছা। সব লিখে রেখে গেছে দিদি। তবে তুমি এলে, ভাল হল। মোচাঘণ্ট আমার হাতে তেমন হয় না।

রণো বলে, দিনের মেনু কী?

—বাবা যা ভালবাসে? মুগের ডাল, মোচাঘণ্ট, কইপাতুরি, পোস্তর বড়া আর চাটনি। দেখেছ, কী বড় বড় করে লিখেছে? কিছু ভেবো না মাসি। স—ব আমি করে ফেলব। আগে একটু চা খাওয়া যাক। বাবা তো চা খাওই না।

—আজ…না হয় খাই।

রণো বলে, মাসিকে ছেড়ে দে দূর্বা। তুই হয়তো ডোবাবি।

—কতদিন রেঁধেছি, ডুবিয়েছি?

সরমা বলে, করতে চাও, করো।

—কিছু না করলে তো ভালও লাগছে না।

ছেলে ও মেয়ে এত সহজ ব্যবহার করছে। হিমাদ্রি কি হেরে যাবেন? হেমকায়া বলে, কোনও সময়েই নর্মাল হতে পারো না কেন?

পারেন। হিমাদ্রি পারেন। কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটা তো অস্বাভাবিক এক পরিস্থিতিতে ঘটছে।

চা এগিয়ে দিয়ে দূর্বা বলে, বাবা তো চা খাও না। শরীর খারাপ হবে না তো?

—না, না। দাঁড়াও, কাগজটা নিয়ে আসি।

ভাইবোন এ—ওর দিকে তাকায়। রণো বলে, সত্যি কাগজ দেখোনি?

—না, কাগজ আর কখন দেখলাম। সকালে…

—চা খাও। পরে দেখো।

রণো বলে, হায়দ্রাবাদে আয়। মাংসের রেজালা যা রাঁধতে শিখেছি না?

হিমাদ্রি বলেন, তুমি নিজেই রাঁধো?

—সকালে তো ব্রেকফাস্ট তৈরি করে নিই। খেয়ে বেরিয়ে যাই। অফিসে লাঞ্চ করি। রাতে নিজেই করে নিতাম। এখন আমার এক কলিগের বাড়ি থেকে পাঠায়।

—তোমরা কি কাছাকাছি থাকো?

—সবাই অফিসের কোয়ার্টারেই থাকি।

—আর সব কাজ?

—আমি নিজে করি। অনেকে লোক রাখে।

দূর্বা বলে, মধুলা একটু বড় হোক।

—যথেষ্ট বড় হয়েছে।

—যাব। এবার শীতেই যাব। প্রদীপেরই সময় হয় না। সেজন্যেই তো…

—তুমিও তো বেরিয়ে যাও, দূর্বা।

—হ্যাঁ, তবে শনি আর রবি বাড়িতে থাকি।

দূর্বা চায়ের ট্রে নিয়ে চলে যায়। যেতে যেতে বলে, হেম মা পারেও। এই পেয়ালাগুলো কবেকার, বল তো দাদা?

—উনিশ শো সাতাশি। তোমার বন্ধুর সেরামিকের একজিবিশান। মনে আছে।

এখন টেবিলে হিমাদ্রি আর রণো।

—রণো?

—কিছু বলবে?

—লতু হয়তো জানবে।

—কয়েকবার ফোন করেছি। তিতিল বলল, আজ অপারেশন করে লতু মাসি কখন ফিরবে ঠিক নেই।

—তিতিল?

—লতু মাসির ভাইপো।

—আমি বলছিলাম…মানে মনে হয় খুবই…তুমি কি আর বিয়ে করবে না?

রণো খুব সহজভাবে বলে, এখনও ভাবিনি। করলে তো জানবেই।

—তখন বুঝিনি…তোমার বয়সও কম ছিল…

—অতীত নিয়ে কথা বলে কী হবে বাবা?

দূর্বা রান্নাঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে বলে, নাটকু এত দেরি কেন করছে রে?

—এসে পড়বে।

—লাঞ্চের পর ঘুমোবি না দাদা। সব টিপ টপ করে ফেলতে হবে। খুব ভাল করেছে হেম মা, ইতু মাসিকে অর্ডার দিয়ে। মাসি, রুটি কি বাড়িতে হবে?

—সব ওখান থেকে আসবে।

—সেটা কোথায়, দূর্বা?

—পরাশর রোড বাবা, দূরে নয়।

—আমি…একটু কাগজ দেখি।

—স্নান করেছিলে?

—হ্যাঁ…সকালেই…

সকালে স্নান করেছিলেন, টেবিলে এসে বসেছিলেন, তারপর থেকে জীবনটা হঠাৎ ওলটপালট। কেননা হেমকায়া নেই। এ অবস্থার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেবেন কী করে, তা হিমাদ্রি জানেন না। কেননা প্রথমার সঙ্গে সতেরো বছর, হেমকায়ার সঙ্গে সাতাশ বছর কেটেছে। চুয়াল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবনে এমন একবারও ঘটেনি যে স্ত্রী চলে গেছেন, তিনি পড়ে আছেন।

হঠাৎ মনে হল। রণোর কেমন লেগেছিল?

নিশ্চয় প্রচণ্ড লেগেছিল। সে জন্য এখনও বিয়ের কথা তুলতেই এড়িয়ে যায়।

না, বত্রিশ বছর বয়সে ছেলেটার জীবন অভিশপ্ত হয়ে যাবে, এ হয় না।

হেমকায়া ফিরে এসো। তোমার রণো যাকেই বিয়ে করুক, আমি মেনে নেব। আজ তো দেখতে পাচ্ছি, তোমার কথার সম্মানে ছেলেমেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। না দাঁড়াতেও পারত। ছেলেমেয়ের সঙ্গে কখনও ঘনিষ্ঠ হইনি।

মাতৃহারা রণোকেও ঠাকুমা বা দিদিমার কাছে সঁপে দিয়েছিলেন। হেমকায়া না এলে…

কাগজ খুললেন, কাগজটা রণো পড়েছে। ভাঁজ করে রেখেছে। অভ্যাস মতো পার্সোনাল কলাম দেখলেন। এ কলামটা দেখেন মৃত্যুসংবাদ পড়ার জন্যে। চেনা জানা, সহকর্মী, সিনিয়ার, জুনিয়ার, কতজনের মৃত্যু সংবাদই না দেখেন।

দেখে প্রথমেই মনে হয় যাক, আমি তো বেঁচে আছি।

যেমন নিয়মে থাকি। একশো পার করে দেব!

আজ মনে হচ্ছে সত্তর বছর অনেক বয়স। এর ভার টানা কঠিন।

চোখটা আটকে গেল।

পার্সোনাল কলামে তাঁকে শুভ জন্মদিন বার্তা জানিয়েছে হেমকায়া, রণো, দূর্বা, প্রদীপ, মধুলা।

এটাও এই প্রথম।

হিমাদ্রি কেমন করে এত শুভেচ্ছা নেবেন? তিনি তো কিছুই দেননি এদের।

হেমকায়া, ফিরে এসো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *