মিলুর জন্য – ৮

আজ, সত্তর বছরের জন্মদিনের সকালে হিমাদ্রির অনেক কথাই মনে পড়ছে। প্রথমার সঙ্গে বিবাহিত জীবন সতেরো বছরের, তো হেমকায়ার সঙ্গে সাতাশ বছরের। সাতাশ বছরের জীবন, এরকম শূন্য করে দিয়ে চলে গেল হেমকায়া? এখন কি শর্তের কথা মনে করবেন হিমাদ্রি? হেমকায়া কী করে না করে সে বিষয়ে হিমাদ্রি কিছু বলতে পারেন না?

হঠাৎ খুব একলা মনে হল নিজেকে। খুব অসহায়। তিনি তো সদম্ভে চলেন। বুঝিয়ে দেন যে কাউকেই দরকার নেই তাঁর?

এখন তা মনে হচ্ছে না।

”মিলুর জন্য” বেশ লিখেছে হেমকায়া। কী হতে পারে মিলুর? অথবা মিলু কী এমন মানুষ, যে জন্য স্বামীর বিশেষ জন্মদিনটি উপেক্ষা করা যায়?

কেন এ জন্মদিনের উপর গুরুত্ব দিলেন হিমাদ্রি, তা জানতেও চাইল না। কেন বুঝল না দেবাংশুর মৃত্যু তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছে, তিনিও মারা যেতে পারেন? হেমকায়া তো জানে। হিমাদ্রি মৃত্যুকে কী ভীষণ ভয় পান? নিজের ছোড়দা নীলাদ্রির সময়েও শ্মশানে যাননি।

হেমকায়া বলে, মৃত্যুকে ভয় পাও কেন?

—ভয় নয়। কেমন একটা…

—তোমার তো কোষ্ঠীতে খুব বিশ্বাস। কোষ্ঠীই বলছে, তুমি বিরাশি অবধি বাঁচবে।

এখন তো তাও ভরসা দিচ্ছে না। বাড়িটা বা এত খালি খালি লাগছে কেন?

রণো তো দূর্বাকে আনতে গেছে।

না, হেমকায়াকে বাধা হিমাদ্রি দিতে পারেননি। রণজয় আর দূর্বার বেলা তো একেবারে নয়। রণোকে নিয়ে কিছু ভাবতেই হয়নি হিমাদ্রিকে। বছর বছর যে ভাল রেজাল্ট করত তা নিয়ে হিমাদ্রি মনে মনে খুশি হতেন। আর মুখে বলতেন, বাপের ধারা পেয়েছে।

রণোর যখন দশ, আর দূর্বার যখন পাঁচ, তখন হেমকায়া পাড়ায় শিক্ষামন্দির স্কুলে মাস্টারিতে ঢুকল।

হিমাদ্রি বলেছিলেন, আমার স্ত্রী হয়ে তুমি পাড়ার স্কুলে পড়াতে যাবে?

—তোমার স্ত্রী হয়ে বাজার—দোকান যাই, ছেলেকে মাঠে নিয়ে যেতাম, মেয়েকে স্কুলে পৌঁছাই, চাকরি করতে যেতে পারব না কেন?

—শিক্ষামন্দির তো নেবেই তোমায়, ডক্টর বোস অত টাকা দিলেন ওঁদের।

—মাসিমা মারা গেলেন। উনিও টাকা দিলেন। তাছাড়া, পড়াবার অভিজ্ঞতা আমার আছে।

—মেয়েরা কাজ করলে সংসার ভেসে যায়।

—আশ্চর্য তো! আজকাল কোন মেয়েটা ঘরে বসে থাকে?

—ছেলেমেয়ের অবহেলা হবে।

—পড়াব ছোটদের, সকালে। দূর্বা ওখানেই পড়ছে। ওকে নিয়ে বারোটায় ফিরব।

—যাবে কখন?

—আটটায়।

—অর্থাৎ আমি বেরোবার সময়ে তুমি থাকবে না।

—না, থাকব না। আর যদি দেখি, চার ঘণ্টা স্কুল করলে সংসার রসাতলে যাচ্ছে, তখন ছেড়ে দেব।

—ক’টাকাই বা পাবে?

—স্কেল পাব না। তবে হাজার টাকা তো পাব।

—টাকার দরকার খুব?

—হয় বই কি। বড়দির স্বামী মারা গেছে। চিঠি লিখেছে। ওকে ক’মাস টাকা পাঠালে ওর ছেলেটা পরীক্ষার ফল বেরোলে বাপের কাজটা পাবে।

—দেওয়াটা ভাল নয়। ওতে মানুষ…

—ভিখিরি হয়ে যায়? তাই বলবে? কী করব বলো। যোগাযোগ তো রাখি না। খবর পেলে স্থির থাকাটা ঠিক হয় না।

—রণো যখন যাবে…

—রণো নিজের জামাকাপড়, ব্যাগ গোছায়। টিফিন চেয়ে নেয়। স্বাবলম্বী করে দিয়েছি।

—সেটাও তো একরকম…আমরা কখনও…

—তোমাদের কালে…

হেমকায়া শান্ত গলাতেই বলেছিলেন, তোমাদের কালে, সব বাড়ির কথা জানি না, তোমাদের বাড়িতে ছেলেদের জন্য আলাদা চাকর ছিল। আমি রণোকে তেমন অভ্যেস করাইনি। এখনি লোক রাখা ব্যয়সাধ্য। ও যখন বড় হবে, তখন তো আরও ব্যয়সাধ্য হবে।

—সোজা কথা, তোমার কাজ করতে যাওয়া আমার ভাল লাগছে না।

—আমি কথা দিচ্ছি, যদি বাড়ির, বা ছেলেমেয়েদের কোনও কষ্ট হয়, কাজ ছেড়ে দেব।

—সেই বড়দিদির কথা তুলছ…

—বলেছিলাম ওরা আসবে না। কোনদিন আসেনি। লিখেছে বড়দির স্বামী যখন হাসপাতালে, আমার বাড়ি আসছিল বড়দা।

—চমৎকার!

—আসেনি। বাইরে থেকে বাড়ি দেখে ঢুকতে সাহস পায়নি।

—এক হিসেবে ভালই করেছে। ওরা আসতে থাকলে…

—ওরা আসত না। আমি তো শর্ত মেনে চলছি।

—শুধু ভাবি…আমি যেন নিরাপত্তা খুঁজেছিলাম। তুমি কী খুঁজেছিলে?

—এখানেই ব্যাকগ্রাউন্ডের তফাত বোঝা যায়।

—হ্যাঁ, রণোর মা আর আমি, দুজনে অনেক তফাত।

এসব কথা কেন বলেছিলেন হিমাদ্রি?

”রণোর মা” বলাও তো ঠিক নয়। হেমকায়া ওদের যে ভাবে বড় করছে, আর কে পারত?

এখন হিমাদ্রির মনে হয়, অনেক সময়ে অনেক আঘাত দিয়েছেন হেমকায়াকে। অযথা অপমান করেছেন।

রণো যখন এই কাজ পায়, হেমকায়াকে বলেছিল, হেম মা! তুমি আমার কাছে গিয়ে থাকবে তো?

—নিশ্চয় যাব মাঝে মাঝে। কিন্তু রণো তুই এতদূরে চলে যাচ্ছিস…

দূর্বা বলছিল, কী করবে? এখানে হাঁপিয়ে উঠেছে দাদা।

দূর আবার কী? তুমি যেন কেমন হয়ে যাচ্ছ হেম মা। বিদেশে তো যাচ্ছে না।

ছেলে, মেয়ে আর হেমকায়া কেউই বোঝেনি, হিমাদ্রি ওদের কথা শুনতে পাচ্ছেন। হিমাদ্রির মনে হয়েছিল, এখন আবার মনে হল, জীবনেও ছেলেমেয়ের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে পারেননি।

কী হবে। হেম যদি না ফেরে?

”মিলুর জন্য” লিখেছে কেন?

হ্যাঁ, একদা পদস্খলন হয়েছিল হিমাদ্রির। সে তো পঁয়তাল্লিশ ছেচল্লিশ বছর আগে। কিন্তু মনোরমার কথা তো হেম জানে না? হঠাৎ মনোরমার নামই বা মনে পড়ল কেন?

হেম যদি না ফেরে?

ছেলে এ শহরেই থাকে না। এলেও তাঁর সঙ্গে কথাই হয় না।

আর দূর্বাকে তো বলেইছিলেন। তোমাদের হেম মা বলছেন, আমি সহযোগিতা করছি এই মাত্র। কিন্তু মোটেই সমর্থন করছি না।

দূর্বা বলেছিল, ও বাবা! তুমি গ্রেট। সত্যি জ্যাঠারাও তোমার মতো ফসিল ছিল, তাই না?

রণো বলেছিল, এই দূর্বা!

—চুপ কর দাদা। তুই এত ভাল মানুষ যে এ যুগে তুই অচল।

একদম!

হেম বলেছিলেন, আর না, দূর্বা!

—মোমোকেও ধন্য ধন্য। দাদার এত ভালবাসা…যা না, ছেলেটাকে নিয়ে আয় না।

—লাভ হবে কোনও?

—অ্যাবসার্ড একটা বিয়ে হয়েছিল।

দূর্বার কথা ওইরকম। এই স্বাস্থ্য, ময়লা রঙ। ঝকঝকে চেহারা। চুল ছোট করে কাটা। প্রথমার সঙ্গে কোনও মিল নেই।

হেম মা ফিরলে?

দূর্বা তাকে কতটুকু দেখবে? দূর্বাকে তো তিনি চেনেনই না। সেদিন ”দি টেলিগ্রাফ” কাগজে দূর্বা মহান্তির প্রোফাইল বেরিয়েছে। জিনস আর পাঞ্জাবী পরে বসে আছে দূর্বা। ছি ছি ছি। বাঙালী মেয়েরা শাড়িও পরবে না?

রণো হেমকায়াকে বলেছে, বাবা যদি এ শতকে ফিরত। দেখতে পেত মেয়েরা কতজন শাড়ি পরেই না।

—ওই কাজটাই তো অসম্ভব রণো।

—একে তো বাড়ির ব্যাকগ্রাউন্ড ওরকম। তারপর তুমিও আগলে রেখে রেখে…

—সব তোদের জন্যে।

—তোমাকেই জানে না বাবা। ভাবলে…

—আমি তো খারাপ নেই রণো।

—বাবার সঙ্গে বসবাস করার জন্যে তোমাকে অ্যাওয়ার্ড দেওয়া উচিত।

—অভ্যাস হয়ে যায় রণো। লোকটা বড় হতভাগ্য। নিজের লোকদের চেনে না। ধরে নেয় স্ত্রী অনুগত থাকবে। ছেলেমেয়ে অনুগত থাকবে। সেটাই নিয়ম। কিন্তু মানবিক সম্পর্ক যে তৈরি করতে হয় তাতে ওরও কিছু করার আছে। তা জানে না।

—আমার তো মাকে সামান্য মনে পড়ে। মা কেন বা বাবাকে বিয়ে করেছিল তখন…

—বিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

—তুমি তো নিজে বিয়ে করলে।

—খারাপ করেছি?

—তুমি না থাকলে…কিন্তু বাড়িটা এর চেয়ে আনন্দমুখর হতে পারত।

—মোমোর জন্যে তোর খুব কষ্ট, রণো?

—কষ্ট আগের মতো হয় না। তবু…

—ওর বাবা মাও চলে গেছেন।

—জানি। ওরা বাড়িও কিনেছে। মোমোর মা বুটিক করেছেন। মোমো যে কী করছে…

—আর ভাবিস না। হ্যাঁ রে, বিয়ে কি করবি না আর?

—তোমার এই একান্ত বাঙালী রুচির রণোকে কে বিয়ে করবে হেম মা?

—সেই কৃষ্ণা আয়ার?

—বুঝতে পারি না। আমি তো জানো…আমার দরকার একটি ঘরোয়া মেয়ে। আমাকে বিয়ে করে যে খুশি হবে।

—দেখাই যাক…

এসব কথাই হিমাদ্রিকে বলেছেন হেমকায়া। ছেলেমেয়ের প্রসঙ্গ নিয়েই তো যত গল্প ওঁদের।

হিমাদ্রি বলেছেন, রণোর অনেক ভাল বিয়ে দিয়ে উনি দেখিয়ে দেবেন।

হেমকায়া বলেছেন, রণোকে নিয়ে কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা নয়।

এমনিতেই ও মরমে মরে আছে।

হিমাদ্রি বলেছেন, রণো তার ছেলেকে চিঠি লেখে?

হেমকায়া বলেছেন, জন্মদিনে তো লেখে। এর তার হাতে উপহারও পাঠায়।

তারপর বলেছেন, রণোকে নিয়েই ভাবনা। ও দূর্বার মতো নয়। অসম্ভব বুক চাপা। ওর মায়ের মতো হয়েছে কি?

হায়, আজ এ সব কথা মনে পড়ছে কেন? প্রথমার কথা বলেছিল হেমকায়া। কিন্তু কেমন করে বলতেন, প্রথমা তাঁর মনে অসম্ভব আবছা একটি ছবি।

প্রথমার কথা মনে পড়লে মনে হয়, ষাটের দশকের সর্দারশংকর রোড। আজকের তুলনায় অনেক নিরিবিলি। বাগানে ছোট্ট রণোকে নিয়ে ঘাসে বসে আছে একটি মেয়ে, যার মুখ আবছাই মনে পড়ে।

হেমকায়া অবশ্য ভুলতে দেননি। রণোর বিয়ের সময়ে প্রথমার গহনা ভলট থেকে আনলেন। সমান দু’ভাগ করলেন। সে সব ”ও! অ্যান্টিক জুয়েলরি” অর্ধেক পায় মোমো। দূর্বার বিয়ের সময়ে বাকি অর্ধেকটা তাকে দেন হেমকায়া।

হিমাদ্রির ঘোর আপত্তি ছিল। হেমকায়া বলেছিলেন, এ কি তোমার সম্পত্তি? ওর মায়ের জিনিস ও পাবে।

দূর্বা ভ্রূ কুঁচকে বলেছিল। কিচ্ছু নেব না।

হেমকায়া বলেছিলেন, যথেষ্ট হয়েছে দূর্বা। এগুলো তোমার। তারপর এ নিয়ে যা হয় কোরো।

দূর্বার বিয়ে নিয়েই বড্ড বাড়াবাড়ি করেছিলেন হিমাদ্রি। শেষ অবধি বিয়েটা হয় রেজিস্ট্রারের অফিসে। হেমকায়া বললেন, ছোটখাট রিসেপশান, সে বাড়িতেই হোক।

—কক্ষনো না।

—ছোট্ট রিসেপশান দূর্বা, আমি বলছি।

—কেন এমন করছ হেম মা?

—আমার আর রণোর খরচে হবে। এখানে কেন হবে বল তো? আমার ইচ্ছা তাই।

—তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছ।

—আমার ইচ্ছা মতো একটা কাজ তো করতেই পারি। কোনদিন করিনি তা বলব না…

—থাক। হেম মা! আমি সব জানি।

—তোর বাবা…ওই রকম…কী করবি বল? আমার স্কুলে কাজ করা নিয়ে…মেনে তো নিলেন।

—জানি না। বাবাকে আমার চিরকালই দুর্বোধ্য লাগে। আর এখন তো…কী ভাষা? প্রদীপ না কি উড়ে! ওরা চার জেনারেশন এখানে…হেম মা! তোমার হারটা কিন্তু দেবে আমাকে।

—খুব পছন্দ?

—খুব। তোমার গলায় থাকে তো!

—দেব। তুইও রিসেপশানটা মেনে নে।

হিমাদ্রিকে হেমকায়া বলেছিলেন, এখন একেবারে শান্ত হয়ে সহযোগিতা করো। নইলে…

—আমি আর কে দূর্বার!

—বাবা। আর আজ যদি ওর মনে ব্যথা দাও, কোনদিন ওকে কাছে পাবে না।

সে কথাও তো মেনেছিলেন হিমাদ্রি। এ বাড়িতে, প্রদীপদের ওখানে। খুব সময়োচিত ভদ্রতা করেছিলেন। বাড়ি এসে অবশ্য বলেছিলেন, সবই হল, তবে তোমাদের মতে।

হেমকায়া বলেছিলেন, কেন এরকম হল, কেন ওদের কাছে আমার মতের এত দাম, এটা তোমার মতে কী? জানি, বলবে ওরা বাবাকে সম্মান করে না।

হিমাদ্রি বলেছিলেন, তোমার মতে কী?

—ওদের বড্ড দূরে সরিয়ে রেখেছ চিরকাল। এটা ঠিক করোনি। তোমার ছেলে মেয়ে অত্যন্ত ভাল।

—হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ তো…

—তুমি বড় অভাগা, জানো? আপনজনদের চিনতে পারো না। কী হবে হেম যদি না ফেরে?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *