মিলুর জন্য – ৭

হিমাদ্রিকে ডাক্তারবাবুরা চায়ে ডাকলেন। যেমন নিয়ম। চা—পানের পর ওঁদের কথা বলতে দিয়ে সরে গেলেন। এটাও নিয়ম। হেমকায়া ফরসা নয়, কালোও নয়। চেহারায় চোখে পড়ার মতো হল, বাঙালি মেয়ে আন্দাজে বেশ লম্বা। কোনও সাজগোজের ধার ধারে না। চোখ বড় না হলেও উজ্জ্বল, আর লম্বা চুলে মোটা একটা বিনুনি বাঁধা। বাঁ হাতে ঘড়ি। সুন্দর নয়, অসুন্দরও নয়, ব্যক্তিত্ব আছে। গলার স্বর মৃদু ও সুন্দর। হিমাদ্রিই কথা শুরু করলেন।

—আপনি তো সবই শুনেছেন।

—শুনেছি, এঁরা যতটা জানেন।

—বুঝতেই পারছেন, প্রয়োজনে বিয়ের কথা ভাবতে হচ্ছে, নইলে…

—প্রয়োজন তো আমারও। মাসিমার হার্ট ভাল নয়, ওষুধ খেতে হয়। আমার জন্যে খুব দুশ্চিন্তা করেন। বুঝতে পারছি, আমি বিয়ে করলে ওঁরা নিশ্চিন্ত হবেন।

—স্কুলে এতদিন চাকরি করে…

—পরের দিকে ভাল লাগছিল না। অনেক ঘোরপ্যাঁচ, অনেক কূটনীতি।

একটু হেসে বলল, ছাড়িয়ে না দিলে নিজেই ছেড়ে দিতাম। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে চলতাম না। কই, আপনি কী কী জানতে চান, বলবেন না?

—বলব? ক’দিন সময় লাগবে।

—কোনও পণযৌতুকে আমি নেই।

হিমাদ্রি বললেন, সেসব কথা উঠছেই না।

—আমি বাংলায় এম. এ.; লম্বায় পাঁচ ফুট, ছ’ইঞ্চি। কথা বেশি বলি না, আজ বলতে হল।

—এ বিয়ে তো নিজেরা, মানে দু’জন অ্যাডালট লোক বলে কয়ে বিয়ে হবে। আমার যেমন কিছু শর্ত থাকবে…

—আমারও থাকবে। আগেই সব বলে নেওয়া ভাল।

—ঠিকই তো। পরে যেন অসুবিধে না হয়।

—আজ তা হ’লে…

—হ্যাঁ, উঠি, নমস্কার।

—নমস্কার। আপনার নামটা বেশ…

—মা রেখেছিল। কেন রেখেছিল কে জানে। অনীতা, অলকা, আরতি, হেমকায়া।

—ওঁরা তো এখানে থাকেন না।

—কুচবিহার, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি। দাদারা মধ্যমগ্রাম আর ক্যানিংয়ে। কেউ আসবে না।

সদুঃখে হেমকায়া বলল, মাসিমার কাছে টাকা চাইত, চাহিদা বাড়ছিল। অথচ যে—যার মতো কিছু তো করে। আমিই ওটা বন্ধ করেছি। ফলে আমার ওপর রাগ।

হিমাদ্রি বেরিয়ে এলেন।

সকলকে বললেন, এমন মেয়েই ভাল। ব্যক্তিত্ব আছে। জানে কী চায়। বুদ্ধি, গাম্ভীর্য, সবই আছে।

অমিয় বলল, দেখো! তোমার স্ত্রীর মতো তো…

—কে আবার কার মতো হয়? সংসার বিষয়ে নিশ্চিন্ত হব। বাড়ি টেনে চালাবে, আমি নিশ্চিন্ত হব। শাশুড়ি আছেন বলে শালা, শালাজ, তাদের সাত গুষ্টি…আমি যেন হাঁপিয়ে উঠেছি।

—দেখো! তোমার স্ত্রী—ভাগ্য তো ভাল।

—সুন্দরী নয়।

দেবাংশু বলল, দেখার চোখ পালটাও। আজকাল বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব, ইত্যাদি দেখা যায়। ট্রাডিশনালি সুন্দর মেয়ে আর ক’জন?

হিমাদ্রি ভেবেছিলেন, একা তাঁর শর্ত থাকবে। হেমকায়া ওঁকে অবাক করে দিল।

হিমাদ্রি জানিয়েছিলেন তাঁর শর্ত।

রণজয় ও দূর্বার মা হতে হবে। ওদের মানুষ করতে হবে। এটাই সবচেয়ে বড় প্রয়োজন তাঁর। তারপর, সংসার পরিচালনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব হেমকায়ার।

হিমাদ্রি তা নিয়ে কোনও কথা বলবেন না। আর হিমাদ্রির ব্যক্তিগত চলাফেরা ইত্যাদি নিয়েও কোন কথা বলবেন না হেমকায়া। হিমাদ্রির মা এখনও এখানেই থাকেন। তাঁকেও দেখতে হবে।

ডাক্তারবাবু বললেন, ম্যারেজ এগ্রিমেন্ট যখন, তখন হেমকায়ারও শর্ত আছে ও লিখে দিয়েছে।

রণজয় ও দূর্বার ”মা” হতে পারবে না হেমকায়া। তবে দায়িত্ব নিয়ে পালন করবে। ”মানুষ” করা বিষয়ে কথা দেওয়া যাবে না, কেন না কে মানুষ, কে নয়, অত বড় কথা হেমকায়া জানে না।

সংসার পরিচালনার দায়িত্ব সে নেবে।

হিমাদ্রির কোন ব্যাপারে হেমকায়া কথা বলবে না যেমন, হেমকায়ার কোন ব্যাপারেও হিমাদ্রি যেন কথা না বলেন। আর একটা কথা, হিমাদ্রির বাড়ি বা সম্পত্তি, এর কোনও কিছুই হেমকায়া চায় না।

হিমাদ্রি বললেন, আমার অবর্তমানে?

—সে দায়িত্ব থেকে মুক্তিই দিলাম।

হিমাদ্রি কেন হেমকায়াকে বিয়ে করছেন, সেটা বোঝা যাচ্ছিল। হেমকায়া কেন এ বিয়েতে রাজি হল, সেটা জানতেন ডাক্তারবাবু ও তার স্ত্রী।

স্ত্রী বললেন, যদি ওরা পরে জানে?

ডাক্তার বললেন, দোষ তো কিছু করছে না। তমলুকে একটি ছেলেকে ভালবেসেছিল। সাত বছর ধরে জেনেছিল ছেলেটি ওকেই বিয়ে করবে। ছেলেটি হঠাৎ ওকে ছেড়ে চাকরিদাতার মেয়েকে বিয়ে করল, তাতেই ওর মন থেকে বিশ্বাস চলে গেছে।

হেমকায়া ঘরে এসে বসল।

—আমার কথা বলছেন?

—হ্যাঁ হেম, তোমার কথাই বলছি।

—আমি কোনও ভুল করছি না মাসিমা। আমার জন্যে আপনাদের মনে শান্তি নেই। মাসিমার হার্টের অসুখ আমিই বাড়িয়ে দিচ্ছি। এরকম বিয়েই আমার ভাল। ভদ্রলোককে দেখে মনে হল, উনি আমার কাছে প্রেম, ভালবাসা, ইত্যাদি আশা করবেন না। ওঁর সংসারের দায়িত্ব নিলেই উনি নিশ্চিন্ত হবে।

—তুমি ভালো থেকো মা।

—আমি তো ভালই থাকি।

কী বলবেন ডাক্তার দম্পতি? ছোটবেলা থেকেই ওর দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু হেম চিরকাল নিজেকে একটু তফাতে রেখেছে। উপকারক এবং উপকৃত, দুয়ের মাঝখানের লক্ষ্মণের গণ্ডী অতিক্রম করেনি।

বিয়েটা হয় রেজেস্ট্রি করে। না, হিমাদ্রির মা—দাদার ভাষায় ”ভিখিরি বিয়ে” হয়নি। ডাক্তারবাবুরা লোকজন ডেকেছিলেন। হেমকায়াকে গয়নাগাঁটি দিয়েছিলেন। রেজেস্ট্রির পর আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়নি। তবে ছোটখাটো বৌভাত একটা হয়েছিল।

নীলাদ্রির স্ত্রী বলেছিলেন, ভলট থেকে প্রথমার গয়নাগাঁটি এনে সাজিয়ে দাও।

হেমকায়া বলেছিল, তা হয় না। ও গয়না তাঁর ছেলে ও মেয়ের। আর আমাকে সাজাতে হবে না। আমি নিজেই সেজে নেব।

এসব নিয়ে অনেক মেয়েগজালি হয়। হেমকায়া সেসব গায়েও মাখেনি। কয়েকদিনেই হিমাদ্রির মা বুঝেছিলেন, এ প্রথমা নয়। ব্যক্তিত্ব আছে, কাজ ও কথার ওজন আছে। মেয়েগজালি পছন্দ করে না।

বিয়ের সময়ে প্রথমার মা নাতিনাতনিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফুলশয্যার পরদিনই হেমকায়া বলল—

—ওদের নিয়ে আসুন।

—এখনি?

—নিশ্চয়। এখন তো আমি আছি।

—কিন্তু…রণো তো বড় হচ্ছে…

—ওদের দেখার জন্যে তো আমি এসেছি।

—দূর্বার জন্যে হিমানীও আসুক?

—কোনও দরকার হবে না।

—শোবার ব্যবস্থা কেমন হবে?

—এখন তো আমার কাছেই ওদের থাকা দরকার। হিমাদ্রির সঙ্গে রণজয় ঢুকেছিল। হিমানী দূর্বাকে কোলে করে এনে রেখে গেল।

হেমকায়াকে দেখিয়ে হিমাদ্রি বললেন, রণো! তোমার নতুন মা।

হেমকায়া বলল, না রণো। আমি তোমার হেম মা।

একমাসেই হিমাদ্রি বুঝলেন লাখ টাকার বিয়ে করেছেন। সকালের টোস্ট, বা অফিসের পোশাক, বা রাতের স্যুপ, সব আগের নিয়মে পেয়ে যান।

সংসার এবং বাড়িতে শ্রী ফিরল।

সবচেয়ে অবাক কথা। রণজয়ের মন জয় করে নিল হেমকায়া। আর দূর্বাকে এত যত্ন করে মানুষ করতে লাগল, যেমনটি দেখা যায় না।

সৎমাকে ছেলে কেমন করে গ্রহণ করে এটা দেখার কৌতূহল মানুষের থাকে। তাই মেঘাদ্রির বিধবা বউ ছোট বউকে দেখতে এলেন। বললেন, রণো সৎমা পেয়ে খুশি তো?

হেমকায়া বললেন, আপনার চায়ে ক’চামচ চিনি দেব?

—না, তার মতো নও বটে ছোট বউ।

—আমার নাম হেমকায়া।

—প্রথমার ছবিগুলো খোলনি?

—খোলার কথা ছিল?

—সর্বদা যদি মায়ের ছবি দেখবে…সৎমাকে তবে…

—শুনুন। এ বাড়িতে ”সৎমা” শব্দটা উচ্চারণ করবেন না। রণো ভাল করেই জানে, ওটা ওর মায়ের ছবি। আমি ওর হেম মা।

—বড় যে আত্যিসুয়ো দেখছি। দেখব, নিজের দুটো হলে এ সব কোথায় থাকে।

হেমকায়া টেবিল ছেড়ে উঠেই গেল। বড় বউ গেলেন শাশুড়ির কাছে। শাশুড়ি হেমকায়াকে বললেন, এ তোমার বড় জা হয়। অন্যায় তো কিছু বলেনি।

হেমকায়া রাতে হিমাদ্রিকে বলল, তোমার মা থাকবেন সে কথা ছিল। তোমার বউদিরা এসে রণোকে শেখাবেন আমি ”সৎমা”। এ আমি সহ্য করব না।

—আমি যেভাবে চালাচ্ছি ছেলেমেয়েকে মানুষ করছি, সে নিয়ে কারো নাকগলানো সহ্য করব না। তোমার কাছে আমার পরিবার যেমন অসহ্য, আমার কাছেও তোমার পরিবার তেমনি অসহনীয়।

—হেমকায়া!

—আমি তোমার প্রথম স্ত্রী নই। শর্ত করে বিয়ে করেছ। শর্ত লঙ্ঘন কোরো না। করলে আমি চলে যাব, পিছন ফিরে তাকাব না।

—হ্যাঁ, জানি।

—আরেকটা কথা আলোচনা করে নেওয়া ভাল। আমি সন্তান চাই না। আমারও সন্তান হলে, আমি জানি না রণো আর দূর্বার প্রতি যথা—কর্তব্য করতে পারব কিনা। না পারাই সম্ভব।

—তার মানে…

—তুমিই ভেবে দেখো। সাবধান তোমাকেই হতে হবে। তুমিই ভাব।

—হিমাদ্রি বলেন, তুমি খুব কঠিন হতে পারো।

—হয়তো তোমার তাই মনে হবে। কিন্তু এখন তোমার তেতাল্লিশ, তোমার ছেলের পাঁচ, মেয়ের তিন মাস। এখন তোমার সন্তান হলে, তুমি রিটায়ার করলে সে নাবালকই থাকবে।

—তোমার নিজের…

—এই বয়সে?

হিমাদ্রি বুঝেছিলেন, হেমকায়াকে যুক্তি দিয়ে পরাজিত করতে পারবেন না।

হিমাদ্রির অভিযোগ করার মতো কিছু ছিল না। সংসার এমন নীরবে, এমন সুশৃঙ্খলভাবে চলেনি কখনও। ছেলেমেয়ে যেন হেমকায়ার প্রাণ। কাজকর্ম সেরে তিনি আসবেন বলে হেমকায়া বসে থাকে না। দূর্বাকে ঠেলা গাড়িতে শুইয়ে গাড়ি ঠেলে লেকে চলে যায়, সঙ্গে দৌড়য় রণো। রণোর অনেক বন্ধু ওখানে, ওরা বল খেলে। সন্ধ্যার সময় তিনজন ফিরে আসেন।

রবিবার দেখলেন রণো নিজের স্কুলের জুতো রং করছে।

—রণো ওর জুতো রং করছে কেন?

—রোজই তো করে।

—কিন্তু কেন?

—জুতো রং করে। টেবিল গোছায়। অনেক কাজ করে।

—কেন, তাই তো বলছি।

—ওকে স্বাবলম্বী করে তৈরি করছি।

—আমি জীবনেও…

—তোমার জীবন তুমি কাটিয়ে যাচ্ছ। ও যখন বড় হবে তখন জীবন অনেক অন্যরকম হবে। তাছাড়া, নিজের কাজ নিজে করবে, এতে আত্মসম্মান বাড়ে। দেখো। আমি ওদের ভার নিয়েছি। আমি আর ওরা। এর মধ্যে ঢুকো না। তাতে ওদের ক্ষতি হবে।

—অর্থাৎ, তুমি চলে যাবে।

—হ্যাঁ। এ তো আগেও বলেছি।

আর লোক পাননি হিমাদ্রি। লতুকে এসব বলেছিলেন। লতু একটু হেসে বলল, এতদিনে জব্দ আপনি। প্রথমা আপনাকে ভয় পেত, হেম পায় না। ছেলেকে স্বাবলম্বী করে মানুষ করছে, যাতে আপনার মতো পরনির্ভর না হয়।

—আশ্চর্য, মা হতেও চায় না। এটা কি ন্যাচারেল?

—জানি না। তবে খুব ন্যাচারেল হলে আপনার সঙ্গে টিকতে পারত? প্রথমা পেরেছিল?

—ঝগড়াই করে যাবে লতু? যেন আমি একটা…

—নন, কিছুই নন। একটা ভাল চাকরি করেন, পৈতৃক টাকা পয়সা আছে। বাড়ি করেছেন। কে করে না? শুনুন, মিনার থেকে নামুন। বাস্তবতার মুখোমুখি হন। হেমকায়া একটি শ্রদ্ধা করার মতো মেয়ে। আপনি অভ্যস্ত কিসে? না সবাই আপনাকে ভয় পাবে, যারা আপনার আশ্রিত। আপনার যেটা লাগছে, তা হল হেমকায়া আপনাকে ভয় পায় না। এটা তো বোঝেন, ডক্টর বসুর দরজা ওর জন্য খোলাই আছে। আর এটা আশা করি বোঝেন, ও নিজের পেট চালাতে সক্ষম।

—সত্যি লতু। প্রথমা থাকতে…।

—কাঁদবেন না। সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। তাছাড়া, প্রথমার বেলাও বোঝেননি কি পেয়েছিলেন। এর বেলাও বুঝছেন না। বুঝতে চেষ্টা করুন।

—তুমি খুব হৃদয়হীন।

—আপনি কী চাইছেন বলুন তো? একদা, ছোট ছিলাম, মাখোমাখো হতে চাইতেন। এখনও তাই চাইছেন?

—না লতু, তা মনে হলে…ক্ষমা কোরো।

হেমকায়াকে লতুই বলেছিল। সন্তান তুমি চাও না হেম?

—যদি বাপের মতো হয়?

—রণো?

—যাতে না হয় সেই চেষ্টাই করছি। যেটা খুব আপত্তিকর তা হল, ওদের বাবা কখনও ছেলের সঙ্গে আধ ঘণ্টা সময়ও কাটায় না। কখনও নয়।

—কারো জন্যই সময় খরচ করেনি। ঐ রকমই তো। প্রথমার বেলাও যা দেখেছি…

—যার এত চাই চাই, সে কী করে ভাবতে পারে…

—আমার মনে হয় কলকাতায় সবচেয়ে পশ্চাৎপদ ফিউডাল দুটো বাড়ি প্রথমাদের আর এদের। হিমাদ্রিবাবু তার মধ্যেও…নীলাদ্রিবাবু অন্তত…

—রণোর দরকার ভালবাসা। ওর বাবার ভালবাসা। যা ও বুঝতে পারবে। পায় না বলেই আমাকে…

—তুমি কিন্তু ওদের সত্যিই ভালবাসো।

—সেটাই স্বাভাবিক, না?

—কী জানি। আমি তো মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষী নই।

—আমি রণোর মা নই, হেম মা। ছেলেটা চাপা, সেনসিটিভ, নিজের মাকে ঘুমের মধ্যে এখনও খোঁজে।

—হয়তো প্রথমার মতো হয়েছে তবে।

—ছবি দেখে মনে হয় খুব নরম মানুষ ছিলেন।

—তা ছিল। ওর কথা থাক হেম। ওই যে বললাম, ওই দুটো পরিবার। বিশেষ প্রথমার পরিবারের মতো এমন ভয়ানক পরিবার আমি দেখিনি।

—অথচ তোমাদের আত্মীয়।

—কিসের আত্মীয়। প্রথমার ছোটমাসির ভাগ্যক্রমে বিয়ে হয় একটি খাঁটি মানুষের সঙ্গে। সত্যিকারের খাঁটি মানুষ। জাতীয়তাবাদী ছিলেন, রাজনীতিতে নামেননি। স্ত্রীকে লেখাপড়া শেখান, তখনকার দিনে আপার মিডল পাশ করান। দু’জনে বাঁকুড়ার কাছাকাছি মেয়েদের স্কুল আর হস্টেল তৈরি করেন, চালান। নারী শিক্ষা বিস্তারে খুব উৎসাহী ছিলেন।

—তোমার কে। ওঁরা?

—ওদের ছেলে আমার দিদির গান শুনে প্রেমে পড়ে, বিয়েও করে। আমার বাবা বর্ধমানে ডাক্তার ছিলেন। ভাইরা কেউ ডাক্তারি পড়েনি। আমি পড়লাম। প্রথমা আর আমি এক বয়সীই হব। কলকাতায় পড়তাম। ফলে দিদির মাসশাশুড়ির বাড়ি আসতাম মাঝে মাঝে। তখন এরকমই নিয়ম ছিল। লতায়পাতায় আত্মীয়রাও আপনজন। সেই থেকেই যাওয়া আসা।

—সেই মেসো আর মাসি আছেন?

—সপাটে বেঁচে আছেন। ওই স্কুল নিয়ে নয়। বাঁকুড়াতেই কোন গ্রামে কী এক সর্বোদয় কেন্দ্রে থাকেন। প্রথমাদের বাড়ি এখনও উনিশ শতকে, আর ওঁরা দুজন এক সময়ে যথেষ্ট প্রগতিশীল বলে বিবেচিত হতেন। আজকের লোকরা হয়তো ওঁদের সেকেলে বলবে।

—সেই জন্যেই যাও আসো?

—ডাক্তার হয়েছি তো। চেনাশোনা একজন ডাক্তার থাকার সুবিধে ওঁরাও বোঝেন। আমি প্রথমাকে ভালবাসতাম। হয়তো ওর বিয়েটা দেখেই বিয়ের ব্যাপারে মন বিদ্বেষী হয়ে যায়, অবশ্য কথাটা যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ হল না।

—আজ উঠি লতুদি।

—আবার ”দিদি” কেন? আমার ভাইপো—ভাইঝি—বোনঝি, এরা তো আমাকে লতুই বলে।

—রণোও লতু বলে।

—হ্যাঁ। কিন্তু হেম, তুমি নিজে কিছু করবে না?

—নিশ্চয় চেষ্টা করব। ওরা বড় হোক। দূর্বার ওজন ঠিক আছে তো?

—স—ব ঠিক আছে।

—আসি তাহলে?

—এসো। তোমার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলে আমি খুব খুশি। একটু স্বার্থপরের মতো খুশি। রণো আর দূর্বার ব্যাপারে প্রথমাও তো হিমাদ্রিবাবুর শাসন মেনে নিতে বাধ্য হত। এখন তা হবে না। তোমার জন্য নিশ্চয়ই খারাপ লাগে। ভাবি কী পাবে এখানে।

হেমকায়া ঈষৎ হাসল। বলল, আমি তো জেনেশুনেই বিয়ে করেছি। আর ডাক্তার মেসোরা খুব নিশ্চিন্ত হয়েছেন। আমার ব্যাপারে একটা নৈতিক দায়িত্ব ছিল তো ওঁদের মনে। দুজনেই খুব ভাল।

—ডক্টর বোস তো আমাদের পড়াতেন।

—আসি লতু!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *