মিলুর জন্য – ৬

হেমকায়ার সঙ্গে বিয়েটা দিলেন কিন্তু ডাক্তারবাবু। তিনিই বললেন, বউ না থাকলে আপনার তো চলবে না।

—আমার যেমন দরকার, তেমন মেয়ে পাব কোথায়?

—কচি খুকি চান না নিশ্চয়।

—না, না, আমারই তেতাল্লিশ।

—দেখি, খোঁজ রাখব। অনেকেই তো বলে টলে, দেখব অখন।

হেমকায়ার সঙ্গে বিয়ের পর হিমাদ্রির মা এবং প্রথমার মাকে, আত্মীয়স্বজনকে, বন্ধুবান্ধবকে, সকলকে মানতে হয়েছিল যে হিমাদ্রি ঈশ্বরের প্রিয় সন্তান। তিনিই যেমনটি প্রয়োজন, তেমনটি দেখে বেছে হিমাদ্রির বউ হিসেবে জুটিয়ে দিচ্ছেন। নইলে এমন হয় কী করে?

বস্তুত, তেতাল্লিশ বছরে আবার বিয়ে করার ব্যাপারটা হিমাদ্রির কাছে যেমন স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল, বাইরের জগতে তেমন নয়।

হিমাদ্রির দাদার শ্যালক বলে গেলেন, তেত্রিশ বছর বয়স আমার, বউ মরে গেল। আমি কি বিয়ের কথা চিন্তাও করেছি?

—আমার মেয়ে যে বড়ই ছোট।

—আরে আমার ছেলেরাও ছোটই ছিল। মা মানুষ করলেন।

তোমার তো মা আছেন?

—মা পারেন না।

—লোক রেখে নাও।

—মাইনে করা লোক কি মায়ের জায়গা নিতে পারে?

—বিয়েই করবে তাহলে?

—অগত্যা।

—সৎমা কি আপন মায়ের মত হবে?

—সে একটা রিসক বটে।

ডাক্তারবাবুকেই ধরলেন হিমাদ্রি। নেহাৎ ছেলেমেয়ের জন্যে। নইলে কে ভাবে বিয়ের কথা? যে গেছে তার মত কি আর পাবেন?

না, তা পাবেন না।

—মেয়ে টেয়ের খোঁজ পাচ্ছেন?

—এখন আর দোজবরে বিয়ে দিতে চায় না সহজে। দিনকাল পালটাচ্ছে তো।

—আমি তো তেমন অপাত্র নই।

—সে তো আপনি বললে হবে না।

—দেখি কাগজে বিজ্ঞাপন দিই। এই যে শুনি মেয়েদের বিয়েই হয় না, মেয়ের বাপ গড়াগড়ি যায়, সে সব কি মিথ্যে?

—কচি খুকি তো মিলবে না। ছেলেমেয়ের ভার নিতে হবে জানলেই মেয়েরা পিছিয়ে যায়।

—হ্যাঁ, দিনকাল খুব পালটে গেছে।

লতু কটকট করে প্রথমার মা—কে বলেছিল, ভেবেছেন কি সবাই আপনাদের মত? আপনার তো যা মতিগতি দেখছি, আরেকটা মেয়ে থাকলে এঁর সঙ্গে বিয়ে দিতেন।

প্রথমা আপনার মেয়ে ছিল না?

প্রথমার মা চোখ মুছে বললেন, ছিল, আমারই মেয়ে গেছে। কিন্তু সে যে আরেকটা মেয়ে রেখে গেছে, তার কি হবে বলতে পারো?

—সাবিত্রীকে নিয়ে দরাদরি না করলে ও থেকে যেত।

প্রথমা হয়তো একলাম্পশিয়াতে মারা যেত না।

এ সব আমি ভুলব কখনো মাসিমা?

—ভালই তো ছিল, সাধ খাওয়ালাম…

—থাক, প্রথমার কথা থাক। মোট কথা হিমাদ্রিবাবুর মতো মানুষ স্ত্রীকে মর‍্যাদা দিতে অক্ষম। কই, চেষ্টা তো করছেন, দলে দলে মেয়ের বাবারা এসে পায়ে পড়ছে? নিজে মানুষ করুন না মেয়েকে। এই তো ডাক্তার সরকার কি ভাবে দুটো যমজ বাচ্চাকে বড় করে তুললেন।

প্রথমার মা ফিসফিস করে বললেন, প্রথমা যে ঠাকুরসেবা করত লতু! জামাই জল গড়িয়ে খাননি কোনদিন।

—সেবাদাসী আসুন, সেবা করবে।

হিমাদ্রিকে দেবাংশু বললেন, নিজে ধর্মে মন দাও। আয়া রেখে মেয়েকে মানুষ করো। ছেলেকে হস্টেলে দাও। তোমার দেখছি বিয়ের বাজারে তেমন দাম নেই।

হিমাদ্রি এই প্রথম শুনতে থাকলেন, স্বামী হিসেবে তাঁকে পাষণ্ড বলা যায়।

প্রথমাকে তিনি ঝিয়ের মতো খাটাতেন। প্রথমার কোন সামাজিক জীবন ছিল না।

এ সবই নতুন জানলেন।

প্রথমার ওপরেই নিষ্ফল রাগ হল। এত দুঃখ ছিল তোমার? আমাকে শুনতে হচ্ছে বাইরের লোকের কাছে?

প্রথমা এখন ছবি। আশ্চর্য সুন্দরী একটি মেয়ে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর তো বয়স বাড়বে না, মেয়ে তো বড় হবে।

হিমাদ্রি ডাক্তারবাবুর কাছেই গেলেন। বললেন, আমার জন্যে নয়, ছেলেমেয়ের জন্যে বলছি। কত চেনাজানা আপনার। একটি মেয়ে দেখে দিন।

আমি সত্যিই বিপন্ন।

—আজকালকার মেয়েরা…রণোর মায়ের মত হবে না।

মানে….

—বুঝেছি। আমি স্ত্রীকে সম্মান করব, কখনো অসম্মান করব না।

—কয়েকদিন বাদে আসুন, একটু দেখি।

ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, একটি মেয়ে আছে, বিয়ে করতে পারেন। আপনাদের স্বজাতি।

—বয়স কম হবে না তো?

—না, তিরিশ তো হবেই।

—লেখাপড়া জানে?

—এম.এ. পাশ, অবশ্য বাংলায়।

—সে আমাকে বিয়ে করবে কেন?

—আমার স্ত্রীর কথায়। তিনিই তার অভিভাবক।

—আপনি নিজে তো…

—নিঃসন্তান। মেয়েটি বড় দুঃখী, মানে দুঃখই পেয়ে আসছে সারাজীবন। বাংলাদেশে থাকত ওর বাবা মা। মা আমার স্ত্রীর কোনওরকম লতায় পাতায় আত্মীয়। বোধহয় ১৯৬০ বা ১৯৬২তে ওরা চলে আসে। বাবা নেই, দাদারা বা দিদিরা ওর ভার নিতে অক্ষম, তা আমার স্ত্রীই ওর লোকাল গার্জেন হয়ে ওকে হস্টেলে রেখে পড়িয়েছেন। মা মারা যেতে আমরাই ওর সব হয়ে উঠেছি।

—দেখিনি তো কখনও?

—আপনি বড় জোর চেম্বারে গেছেন। ক’বছর অবশ্য চেম্বার বন্ধ করি যখন, একটু গিয়ে বসেন। আমার বাড়ি যাননি।

—আপনার বাড়িতেই থাকে?

—না, না। আজ আট বছর ধরেই তমলুকের কাছে একটা অর্গানাইজিং স্কুলে কাজ করছিল। স্কুলটা অনুমোদন পেল, তবে প্যানেল থেকে কিছু টিচার নিল। ওরও বি. এড. করা হয়নি। ওকে নিয়ে অশান্তি হচ্ছে, ও ছেড়ে দিল, বা দিতে বাধ্য হল। খুব আত্মসম্মানী মেয়ে। ছাত্রজীবন থেকেই টিউশনি করত।

—একদিন আলাপ হয় না?

—যখনি বিয়ের কথা বলেছি, বলেছে টাকা পয়সা বা যৌতুক দিয়ে বিয়ে দেবেন তো? সে আমি করব না। আলাপের কথা বলছেন, ওর এক কথা, যদি বিয়ে হয় তবেই ও কথাবার্তা বলে নেবে।

—দাদাদের, দিদিদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই?

—তারা যৎসামান্য কাজ করে দূরে দূরে থাকে। বাড়িতে হেমকায়াই অন্যরকম। অবশ্য, খুলেই বলি, ওর মা নিজেও আত্মসম্মানী ছিলেন। দেশের বাড়ির বদলে মধ্যমগ্রামে জমিজমা, একটা ছোট বাড়ি পেয়েছিল ওরা। ওর কাকা সব ঠকিয়ে নিলেন। বিধবা মহিলা, লোকের বাড়ি রেঁধে বেড়ে ছেলেমেয়ে মানুষ করেছেন। হেমকায়াকেই নিয়ে আসেন আমার স্ত্রী। ওর ভাই—বোনদের সংগতিও নেই যে ওর বিয়ে দেয়।

—আপনি রেকমেন্ড করেন?

—আমি তো ওকে শ্রদ্ধাই করি।

—মানে…ছ্যাবলা প্রকৃতির হবে না তো?

—থাক হিমাদ্রি বাবু, আপনার কথাবার্তা শুনলেই আমার স্ত্রী ”না” বলবেন।

—মাপ করবেন। বলছিলাম কি, চপল তো নয়?

—চাপল্য আসবে কোথা থেকে? আমার স্ত্রী ওর গার্জেন, পড়িয়েছি আমরা, কিন্তু টিউশানি করেছে অনেক বছর, তারপর কাজ করেছে।

—তারপর?

—এত লড়াইয়ের জীবন হলে চাপল্য করবার সময় পাবে কোথা থেকে? আমার চোখে ওর মতো মেয়ে কোটিতে গোটিক।

—বিয়ে হয়নি কেন?

—আমাদের চেষ্টা করতেই দেয়নি। আর বিয়ের কথা উঠছে আমার স্ত্রীর চাপাচাপিতে। তাঁর শরীর তো ভালো নয়। হেমের বিয়ে না হলে উনি মরেও শান্তি পাবেন না।

—আপনার যা কিছু…

—হেম নেবে না।

—উনি বিয়ে করতেই চাননি?

—না। খুব অন্যরকম মেয়ে। যুবকদের ভরসা পায় না। কিসে রাজী হ’ল জানেন?

—কিসে?

—আপনার বিয়ের জন্যে পাত্রী খোঁজার কথা তো ও শুনেছে। সেদিন বলল, প্রৌঢ় লোক, ছেলেমেয়ে আছে, তাতে কি? এখানেই কথা বলুন। আমার বিয়ে না হ’লে তো আপনারা নিশ্চিন্ত হবেন না। কথা বলুন।

—ভাবি, কথা বলে দেখি কেমন লাগে?

ডাক্তারবাবু ঈষৎ হাসলেন। বললেন, ও কিন্তু কাদার পুতুল নয়, বিয়ে করলে ধন্য হয়ে যাবে, তাও নয়। ওর নিজেরও বক্তব্য থাকবে।

—নামটা সেকেলে, হেমকায়া।

—ওর মা রেখেছিলেন। রং পাকা সোনার মতো নয়। মানুষটা খাঁটি সোনা।

—বাড়িতে বলি…একটু ভাবি।

—ভাবুন। আমাদের স্বার্থ কি? কাছে পিঠে থাকবে। চেনাজানা মানুষ আপনি…দেখুন, আপনার কথা আমরা বলিনি। আপনার স্ত্রী যেভাবে মারা যান…হেমই বলল।

হিমাদ্রির মনে হল, হাতি খানায় পড়লে ব্যাঙের লাথি খায়, কথাটা সত্যি।

—কি বলব বলুন। সোনার প্রতিমা তো আমিই হারিয়েছি।

ডাক্তারবাবু খুব অভিভূত হলেন না। নিরুত্তাপ সৌজন্যে বললেন, কথা খুব কম বলে। সকলকে সম্মান করে। সর্বদা সম্মানজনক আচরণ প্রত্যাশা করে। নীরবে সইবার মেয়ে নয়।

—না…অসম্মান করব কেন?

এমন এক মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন শুনে হিমাদ্রির মা বেজায় শোরগোল তুললেন। কাঁদতে বসলেন প্রায়।

—মা রান্নার কাজ করত? রাঁধুনি ছিল? ছি ছি ছি, মেয়ের বয়স নাকি অনেক? তায় চাকরি করত?

—আরেকটা রণোর মা পাচ্ছ কোথায়?

—এ মেয়ে লতুর মতো হবে। দারোগামার্কা মেয়েছেলে। এ সব মেয়ে ঘরসংসার করে, না ছেলেমেয়ে দেখে?

—মা! এ বিয়ে তুমি দিচ্ছ না, আমি করছি। বিয়ে না করলে আমাকে চাকরি ছেড়ে ছেলেমেয়ে দেখতে হবে ঘরে বসে।

—কি দিনকাল হ’ল মা? বেটাছেলে, এমন সোনার চাঁদ ছেলে, তার বৌ জোটে না?

—থাক মা। চেষ্টা তো করেছিলে।

প্রথমার মা—ও খুব খুশি হননি।

—ডাক্তারবাবু কাকে না কাকে ঘাড়ে চাপাবেন কে জানে। আমার মেয়ের সাজানো সংসারে একটা রাঁধুনীর মেয়ে রাজত্ব করবে?

—আপনি আপনার নাতনিকে নিয়ে যাবেন? আমি খরচ দেব।

—খরচের কথা বলে অপমান কোর না বাছা। শরীরে কুলোলে মেয়ে নিয়ে যেতাম বইকি?

—কেউই যখন ছেলেমেয়ের ভার নিতে পারবেন না, তখন কথা বলবেন না আর।

—সৎ মা কি ছেলেমেয়েকে…

—নিজের মা থাকলেও ছেলেমেয়ে মানুষ হয় না সব সময়ে। সন্তান মানুষ হয় বাপের প্রভাবে। যেমন, আমাকে দেখুন।

হিমাদ্রির সব চেয়ে পছন্দ হয়েছে মেয়েটির বিচারবুদ্ধি। সে যুবকদের বিশ্বাস করে না।

বুদ্ধিমতী মেয়ে!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *