৫
হিমাদ্রির জন্ম ১৯২৪ সালে। ১৯৬৭ সালে প্রথমা যখন মারা যায়, তখন তাঁর বয়স তেতাল্লিশ। সবে জয়েন্ট সেক্রেটারি এডুকেশন হয়েছেন। অফিসে অনেকের মতে তিনি উল্কাগতিতে ওপরে উঠেছেন। অনেকে ব্যঙ্গভরে বলে থাকেন, আর তো সতেরো বছর আছ। দেখ, চিফ সেক্রেটারি হয়ে যাও কিনা। সবই তো কপালে করে।
ঈর্ষা, ঈর্ষা। বড়লোকের ছেলে ছিলেন। প্রপিতামহের নামে উত্তর কলকাতায় একটি গলিও আছে। পৈতৃক ধনে সর্দারশংকর রোডে ”হিমাদ্রি নিবাস” বাড়ি করেছেন। বিয়েতেও প্রচুর পেয়েছেন। মদ বা সিগারেট খান না। কথা বলেন মেপে, গাম্ভীর্য রেখে। অফিসের কাজে গাফিলতি নেই। দেবাংশু বলত, শুধু কাজ দেখিয়ে উন্নতি হয় না রে ভাই। কাজ—না—করা স্বাধীন ভারতে সকলের গণতান্ত্রিক অধিকার।
—তবে কি খোশামোদ করব?
—খোশামোদ করবে। রাজনীতি করবে…
—আই হেট পলিটিকস। আমাদের বাড়িতে কেউ কোনদিন রাজনীতি করেনি।
—যারা করেছিল, তাদের বোলবোলাও দেখছ?
—আমি দেখি না।
—বউও ভাল পেয়েছিলে। এখন তো বউদের উশকানিতেই স্বামীরা উন্নতির সোজা পথ খোঁজে।
—না ভাই। আমার স্ত্রী…
—তাঁর সাহসই ছিল না। এই তো?
থাকবে কেন? কী পায়নি প্রথমা? শিক্ষিত, সচ্চরিত্র, অফিসার স্বামী পেয়েছে। প্রচুর গহনাগাঁটি আছে তার। নিজের বাড়ি আছে। গাছপালার সঙ্গে কথা বলে। বাগান করে। বংশতিলক যে ছেলে, সে মায়ের মতোই রূপবান। একজন স্ত্রীলোক এর চেয়ে বেশি কিছু চাইবে কেন?
স্ত্রী বারো বছর মা হয়নি। হিমাদ্রি কি আরেকটা বিয়ে করেছিলেন? করেননি তো। অথচ হিমাদ্রির নিজের পিসিমাকে সতীন নিয়ে ঘর করতে হয়েছিল। হিমাদ্রির বাবা ভগ্নীপতিকে কিছুই বলেননি। বউয়ের যদি পরপর শুধু মেয়ে হয়, পুত্রার্থে স্বামী আবার বিয়ে করতেই পারে।
হিমাদ্রি তা করেননি। কিন্তু প্রথমা প্রথম ও শেষ দুর্ব্যবহার করল মরে গিয়ে। ছেলের স্কুল, মেয়ের কান্না, বাজার দোকান, এ বেলা কী রান্না হবে, কাপড় ইস্ত্রি হয়নি কেন, এসব কথা তো ভাবেননি কোনদিন।
শাশুড়িকে যাই বলুন, হিমাদ্রি আবার বিয়ের কথাই ভাবছিলেন। আশঙ্কা শুধু, প্রথমার মতো কোনও মেয়ে পাবেন কিনা।
প্রথমা বেঁচে থাকতে যা মনে হয়নি, এখন তাই মনে হয়। জ্ঞান হওয়া থেকেই প্রথমা জানতেন, বিয়ে হয়ে স্বামীর ঘর করবে বলেই মেয়েদের জন্ম হয়।
চোদ্দ থেকে ষোলো হল, ভয়ানক বিপজ্জনক সময়। চোদ্দ হলেই তো মেয়েরা বালিকা থাকে না, নারী হয়ে যায়। হিমাদ্রির বড় জ্যাঠা যখন জন্মান, হিমাদ্রির ঠাকুমার বয়স চোদ্দ ছিল। চোদ্দ থেকে ষোলো। মানে প্রলোভনের ডাকে ধরা দেবার জন্য একটি মেয়ের শরীর একেবারে তৈরি।
মনোরমার বয়স অবশ্য উনিশ ছিল। প্রথমার মতো হরতনের বিবি মার্কা ছবি ছবি সুন্দরী ছিল না সে। কালো, আঁটোসাঁটো, বর্বর যৌবনা মেয়ে। ওরকম মেয়ের প্রতি আকর্ষণ আজও আছে হিমাদ্রির। যদিও তা প্রকাশ করেন না।
কালো মেয়ে সুখশয্যায় ভাল। ফুলশয্যায় ফরসা মেয়েই মানায়। হিমাদ্রির মা তো রং দেখে দেখে বউ আনতেন। তাঁর বউরা ফরসা, ছেলেরা কালো। সৌভাগ্যক্রমে তাঁর নাতনিরা ফরসা।
দূর্বা ফরসা নয়। কী করা যাবে। প্রথমার মতো দেখতে হবে না ও।
সব দিকেই যোগ্য ছিল প্রথমা। হিমাদ্রির সঙ্গে বিয়ে হবে। বেশ! হিমাদ্রি শিক্ষিতা মেয়ে চান। প্রাইভেটে বি. এ. পাশ করে নিল। বিয়ের পর থেকে যা বলেছেন, তাই করেছে। কখনও উঁচু গলায় হাসেনি, স্নানের ঘরে গান গায়নি, বারান্দায় ঝুলে পড়ে রাস্তা দেখেনি।
সতেরো বছরের বিবাহিত জীবন। অর্থাৎ ছয় হাজার দুশো পাঁচদিন। প্রতিদিন হিমাদ্রি মচমচে টোস্ট পেয়েছেন, ধপধপে বিছানা, দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম। অফিসে যাবার জামাকাপড়, ঝকঝকে জুতো। বাড়িতে কোথাও ধুলো থাকত না। তাঁকে কোনদিন বলেনি,”বাজারে যাও”, বা ”রণোকে একটু দেখো”।
প্রথমা তাঁর এতই চেনা যে তাকে চেনার কোন চেষ্টা করেননি।
অচেনা প্রথমাকে একদিনই দেখেছিলেন। রণজয়ের জন্মের পর যখন হার দিলেন।
প্রথমা বলেছিল, মনোরমাকেও হার দিয়েছিলে?
কী ভয়ঙ্কর আঘাত! জানত ও, মনোরমার কথা জানত, যৌথ পরিবারে জানাজানি হয়েই যায় সব। কিন্তু প্রথমা তা জেনেও কী নিখুঁতভাবে পতিসেবা করে গেল।
যাক গে, সে অধ্যায় তো সমাপ্ত। কিন্তু হিমাদ্রি নিজেই বুঝতে পারছেন, বিয়েই তাঁকে করতে হবে। নইলে সব গোলমাল হয়ে যাবে। প্রথমার মতো অমন দুধে ধোওয়া নরম বয়সী নিষ্পাপ মেয়ে নয়। শক্তপোক্ত, দায়িত্ব নিতে সক্ষম মেয়ে।
মহীতোষরা বলল, বউদির মতো মেয়ে পাবে কোথায়? কেষ্টনগরে ফরমাশ দাও। মাটি দিয়ে গড়ে দেবে।
তারপর মন্ত্রবলে তাকে জ্যান্ত করে নাও।
নীলাদ্রি বললেন, কাগজে বিজ্ঞাপন দাও।
লতু বলল, আবার বিয়ে কেন? মোটা মাইনে দিয়ে দুটো ঝি রাখুন। অবশ্য আমি কোনও লোক পাঠাব না সাবিত্রীর কথা কি ভুলব কখনও? না প্রথমাকে ভুলব?
—বিয়ে একটা প্রয়োজন লতু।
—কই, আমি তো দিব্যি আছি।
—সবাই কি একরকম হবে?
—বিয়ে করতে গেলে আমি কিন্তু বাগড়া দেব।
প্রথমার মা বিরক্ত স্বরে বললেন, কত কষ্টে ”হ্যাঁ” বলিয়েছি, তুমি আর বাগড়া দিও না বাছা! নিজে তো সংসার করলে না! সংসারের মর্মও বুঝলে না।
—কেন বুঝব না? ভাইপো ভাইঝিকে নিয়ে সংসার করি না? ওরা তো এখানে থেকেই পড়ে।
—তোমাদের বাড়িতে শুধু পড়া আর পড়া!
—এটা উনিশ শতক নয় মাসিমা?
—ওই সব পাকা পাকা কথা!
—নিন, মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন, জামাইয়ের বিয়ে দিন এবার।
লতু দূর্বাকে দেখল, আদর করল, চলে গেল।