মিলুর জন্য – ৪

খুব, খুব কেঁদেছিলেন হিমাদ্রি।

নিজেকে জিগ্যেস করতেন, সেসময়ে লোক রাখলে কি প্রথমা বাঁচত?

কেন রাখেননি?

না, একশো টাকা মাস মাইনেটা কোনও ব্যাপার ছিল না। জেদ চেপেছিল, রাগ হয়েছিল।

তা বলে প্রথমা মরে যাবে, এ তো ভাবেননি। সে সময় দূর্বারও মরে যাবার কথা। কিন্তু দেখা গেল দূর্বার বাঁচার ক্ষমতা প্রচুর। খিদে পেলে চ্যাঁচায়, চক চক করে দুধ খায়। বেশ হৃষ্টপুষ্ট, বেশ স্বাস্থ্য।

প্রথমার মা এসে হাল ধরেছিলেন। তিনি লতুকে বলেছিলেন, কাজের লোক একটা দেখে দাও লতু। কচি মেয়ে মানুষ করবে কে?

—ওর বাবা ভাবুন গে।

—সে তো তোমার বোন ছিল বললেও হয়।

—আমার বোন হলে অন্যরকম মেয়ে হত। আমাকে জ্বালাচ্ছেন কেন মাসিমা? আপনাদের বাড়িতে এককালে ছাত্রজীবনে গিয়েছি, থেকেছি। তার প্রতিদানে এত বছর তো আপনাদের রোগে ভোগে অনেক করলাম।

—প্রথমার মেয়ে বলে কথা!

—প্রথমার…নাম…করবেন না।

হিমাদ্রিও বুঝছিলেন, শাশুড়ি বরাবর থাকবেন না। তখন মেয়ে নিয়ে কী করবেন?

নীলাদ্রির বউ বললেন, আমার পক্ষে অসম্ভব। নিজের কোলেরটার বয়স ন’বছর। আমি পারি ওইটুকু মেয়ে মানুষ করতে?

হিমাদ্রির মা—র যদিও ঠাকুরঘর সম্বল, এবং মাঝে মাঝেই কুণ্ডু স্পেশালে তীর্থে যান। সংসারের ব্যাপারে কথা কইতে ছাড়েন না।

তিনি বললেন, মা মরলে ছেলেপুলে কাকি জ্যেঠির কাছেই মানুষ হয়।

—ঠাকমার কাছে হয় না?

—তোমার কোলেরটি যদি ন’বছরের হয় বাছা, আমার কোলের সন্তান হিমুর যে তেতাল্লিশ। তাছাড়া আমাদের কালে ছেলে মানুষ করত ঝি।

প্রথমার মা অগত্যা থেকে গেলেন। প্রথমার দাদা বলল, মেয়ে থাকতে যেতে না, এখন যাচ্ছ?

—তা তোমরা যেমন পাষাণ, আমি তেমন হতে পারছি কই?

ঠাকমা দেখবে না, জ্যেঠি তো বাপের বাড়ি। কাকি হাত ধুয়ে ফেলে দিল। মামা মামীদের মনে হল, বোনঝিকে নিয়ে আসি? আমি বাছা, অকর্তব্য হতে পারব না।

—তোমার জামাইও তো মা! নেমন্তন্ন করলে আসেনি, প্রথমাকে ঘড়ি দেখে রেখে যেত, ঘড়ি দেখে নিয়ে যেত। তার কাছে মেয়ের কথা বলবে কে?

আরেক ছেলে, বলল, এখানে বা কচি মেয়ে মানুষ করবে কে? এখন ওর দরকার যত্ন।

—লোক রাখতে হবে।

—ওই লোক রাখতে মেয়ে যদি রাজি হত তখন…জামাই তো একটার জায়গায় চারটে লোক…পেটের মেয়ে হলে কী হয়। কী স্বামী পেইছিল তা বোঝেনি। জামাইয়ের সব টাইমে টাইমে চাই। তা সে তো বাগান নিয়ে পড়ে থাকত। কী জানি বাছা!

প্রথমার মা তাঁর খাসদাসী পদ্মর মেয়ে হিমানীকে কানপাশা কবুল করে জামাই বাড়ি নিয়ে এলেন।

হিমাদ্রি চিরকালই নিয়মের রাজত্বে অভ্যস্ত। প্রথমার মৃত্যুতে তাঁর অসুবিধে সবচেয়ে বেশি। টোস্ট কড়া হলে খান না, বেশি মাড় থাকলে জামা পরেন না, বিছানা নিভাঁজ টান টান না হলে শোন না। জুতোয় ধুলো আছে কি না ফুঁ দিয়ে দেখেন।

রণজয় কাঁদলে তিনি চমকে যান। প্রথমা থাকতে ছেলের কান্না তো শোনেননি। বারো মাস সকালে খান মুসুর ডাল সেদ্ধ, গলা ভাত ও ঘি। সামান্য ঘরে পাতা দই। আপিসে নিয়ে যান দুটো আটার রুটি, একটু তরকারি, একটি কলা। বিকেলে খান ঘরে তৈরি নিমকি বা লুচি। রাতে টোস্ট, মাংসের স্টু।

প্রথমবার মা ক’দিনেই বুঝলেন, এ তাঁর সাধ্য নয়। জামাইকে বললেন, অভাগার ঘোড়া মরে, ভাগ্যবানের বউ মরে। সে আবাগী তো ড্যাংডেঙিয়ে চলে গেল। তুমি বাছা! আবার বিয়ে করো।

হিমাদ্রি তখন, স্ত্রী বিয়োগের পর, মুখে যত কম কথাই বলুন, মনে তাঁর অনেক উন্নতমার্গের চিন্তা। যেমন ম্যারেজেস আর মেড ইন হেভেন।

—স্ত্রী বিয়োগে পতি, পতি বিয়োগে পত্নী, পুনর্বিবাহ—ঈশ্বর অনুমোদিত নয়।

—কে করে বিয়ে? সংসার তো শুধু দুদিনের খেলা!

রাতে হিমাদ্রি খেতে বসলে, শাশুড়ি মাংস ও পাঁউরুটির স্পর্শ বাঁচিয়ে দূরে মোড়ায় বসে কথা বলেন।

—বে না করলে তোমার চলবে না।

—হিমানী তো বেশ চালাচ্ছে।

—ও আইবুড়ো মেয়ে। ওরও বে হবে। তাছাড়া কখনও কাজ করেনি কোথাও। নেহাত আমি বললাম বলে এখানে এসেছে।

—আপনিও থেকে যান না।

—সে কি হয় বাছা? জামাইয়ের ভাত খেতে নেই, নেহাত মেয়েটা চলে গেল বলে…

পাড়ায় যাঁর পসার সবচেয়ে বেশি, সেই ডাক্তার হিমাদ্রির বন্ধু। হিমাদ্রি মনে মনে ভাবলেন, ওঁকেই জিগ্যেস করব।

শাশুড়ি বললেন, বে করতে চাইলে মেয়ের অভাব? কত মেয়ের বাপ এসে পা ধরবে। আমার ভাইয়ের মেয়ে চন্দনাকে তো তুমি দেখেছ। দিব্যি মেয়ে। আই এ ফেল। ঘরে লোক রেখে সেলাই শিখছে। গান শিখছে, সব কাজ জানে। পুজোর জোগাড় দেয়া থেকে কনে সাজানো।

—না; আমার মন চায় না।

—তোমাকেই বা দেখবে কে বাবা? মানুষের দেহ, অসুখ বিসুখ আছে। ছেলেমেয়ে মানুষ করতে হবে। দায়িত্ব কি কম রেখে গেছে?

—সৎ মা কি যত্ন করবে?

—ঝি চাকরের চেয়ে তো ভাল হবে।

কী করবেন হিমাদ্রি? ছেলেটাকে হস্টেলে পাঠাবেন? মেয়েকে বিলিয়ে দেবেন? অফিসে, পাড়ায়, পরিবারে, সমাজে ঢি ঢি পড়বে না?

—আমাকেও ছুটি করে দাও বাবা।

—কয়েকটা দিন সময় দিন আমাকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *