৩
সাবিত্রীর ইন্টারভিউ হয়েছিল। প্রথমা উল বুনতে বুনতে মাঝে মাঝে হেসে ফেলছিল। হিমাদ্রি অতীব গম্ভীর।
—কী, নাম ধাম ল্যাখবেন?
—লিখব।
—ল্যাখেন নাম সাবিত্রী সা; বয়স তা আটতিরিশ হইব।
—ঠিকানা?
—ভজন যাদবের বস্তি, হাতিবাগান বাজার। পাঠার দোকানের পিছনে।
—স্বামীর নাম?
—নাম তো আছিল পীতাম্বর সা। অহনে দশ বৎসর সাক্ষাৎ নাই। অলপাইয়া আছে না নাই, কেমনে জানতাম?
—কিন্তু…সন্তানাদি?
—মাইয়ারা বিয়া কইরা কাইটা পড়ছে। অহন শুধা আপনি আর কপনি সম্বল।
—এতে তো বোঝা গেল না কিছু?
—কী অত বোঝবেন? লতু মাসি আমারে সাত বৎসর চিনে। কঠিন রোগী, যারে দ্যাখলে যম ডরায়, আমি তারে স্যাবাযত্ন করি। তিনি তো কইল, আপনের বউরে, পোলারে দেখনের লোক দরকার। দরকার থাকে, তয় টাকা পয়সা। কামের কথা কয়েন।
—হ্যাঁ, লতু তো তোমায় চেনে।
—চিনে মানে? উনার বাপরে স্যাবা করতে তো লইয়া গিছিল। এগারো মাস বুড়ারে স্যাবা করছি।
—কত দিত?
—তিনির মতো কে পারব? মাস গেলে দুই শৎ টাকা, কাপড় চোপড় রে, খাওয়াদাওয়া। কইত, তুমি বাড়ির একজন, সাবিত্রী! বাপ মরতে আমারে এক ভরি সোনার হার দিল! তার কথা থোয়েন। আপনাগো কী কাম, কত দিবেন, কয়েন!
হিমাদ্রি ইংরিজিতে বললেন, লতু কুত্তাকে লাই দিয়ে মাথায় উঠিয়েছে। কী বলব?
প্রথমা বললেন, আমি আবার কবে এসব ঠিক করি? তুমিই তো করো।
—অত পারব না। তবে…ধরো পঞ্চাশ?
খাওয়াদাওয়া তো পাবে?
—কার লগে কথা কন? মাসে দুইশৎ টাকা আমি এমতেই কামাই। শোনেন, বউ পোলা রাইখা নিশ্চিন্ত থাকবেন। আমি একশৎ টাকা নিমু। খাওয়াদাওয়া জানি পরিষ্কার মতো দেয়। ঘরের কাম করুম না। তয় কই, ডাকবেন সাবিত্রী বইলা। আর, কেউ যেন ”ঝি” না কয়। ”আয়া” কইতে পারেন। অহন সাফ সাফ জবাব দেয়, নয় আমি চল্লাম।
—বেশ, একমাস কাজ করো, দেখি!
ঘরে এসে প্রথমা হেসে কুটিপাটি।
—হাসছ!
—যাক, একজনকে দেখলাম, কথায় এঁটে উঠতে পারলে না। হিমাদ্রি যে রাগটা সাবিত্রীকে দেখাতে পারেননি, সেটা প্রথমাকে দেখালেন।
—তোমার জন্যেই লোক রাখার কথা উঠছে। মেয়েদের সন্তান তো হয়েই থাকে। সে জন্যে লোক রাখতে হয়?
প্রথমা আস্তে বলল, নিশ্চয়। তাই যদি মনে করো, তবে রেখো না।
—তুমি আমাকে অমানুষ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছ।
—কী যে বলো! সেই কবে থেকে আমাকে তো গড়া হচ্ছে, তোমার মনের মতো হবার জন্যে। আমি তোমার মুখের ওপর কোনদিন কথাও বলিনি। রণজয় হবার আগে লতু আসত বলে দেখেছে। আলাদা করে কোনও ডাক্তার কোনও ওষুধবিষুধ…
—কী বলছ বলো তো?
—কিছুই না। টাকা তোমার। মাইনে দেবে তুমি। এখন ভেবে দেখো।
—টাকাটা প্রশ্ন নয়, ওর কথাবার্তা…
—ওর তো তোমাকে দরকার নেই। তোমারই ওকে দরকার। তাই নয়?
—আমার দরকার? না তোমার?
প্রথমা উঠে গেল। হিমাদ্রি শুনলেন ও বলছে, লতু মাসি, মিছে দুশ্চিন্তা করছে সাবিত্রী। আমার কোনও লোকের দরকার নেই।
—সে তোমরা বুঝবে। এই হাত পা দেখি ফুলছে, রক্ত নাই দেহে, তাই দেইখাই তো মাসি আমারে…
লতু এসে বলেছিল, তুমি কি মরতে চাইছ প্রথমা? জানো, তোমার এখন কতটা আরাম দরকার? ওষুধ…ইঞ্জেকশান…রণোর পিছনে দৌড়ানো…
—আমি তো ওকে মাইনে দেব না ভাই! তাছাড়া লতু, মেয়েদের সন্তান হয়েই থাকে। সেটা এমন বড় কিছু নয় সংসারে।
—নিশ্চয় হিমাদ্রিবাবু কিছু বলেছেন।
প্রথমা নিরুত্তর।
—না, এতটা বর্বরতা সহ্য করা যায় না।
—আমার সয়ে গেছে লতু।
লতু এ কথা সকলকে বলেছিল। হিমাদ্রি এত রেগে যান, যে প্রথমার সঙ্গে কথাই বলতেন না। রান্নার লোক আছে। ঠিকে ঝি আসে। চাকর+মালী+দোকানবাজারের জন্যে একটি কিশোর, এর পরেও লোক দরকার?
প্রথমাও কথা বলত না।
দূর্বার জন্ম হয় মাকে গভীর কষ্টে ফেলে। আর দূর্বার জন্মের পর একলাম্পসিয়া হয়ে প্রথমা মারাও যায়।