মিলুর জন্য – ২

হেমকায়াকে বিয়ে করার পিছনেও নিখুঁত হিসেব ছিল। তখন তিনি শিক্ষা বিভাগে জয়েন্ট সেক্রেটারি। বউ মরে গেলে সব বয়সেই ল্যাজেগোবরে হয়ে যেতে হয়। আবার নতুন বিয়ে করার ঝুঁকিও অনেক।

শাশুড়ি সে সময়ে হিমাদ্রির সংসারে ক’মাস থাকলেন। প্রথমা তাঁর একতমা কন্যা, আর চারটিই ছেলে।

ছেলেরা যে—যার জীবনে সুপ্রতিষ্ঠ। বউ—ছেলে—মেয়েতে ভরাভর্তি সংসার। শাশুড়ি সে সংসারে সাম্রাজ্ঞী বললেও হয়। ছেলেরা মা বলতে গদগদ। বউরা শাশুড়ির অতীব অনুগত। শ্বশুর ছিলেন বড়লোকের ঘরজামাই। শাশুড়ির পা ও হাতে ছয়টি করে আঙুল। অপারেশনে গুরুদেবের মানা ছিল। তিনি বলতেন, ”পাঁচটা আঙুল তো হকলেরই থাকে। তোমার বুঁচির ছয়টা আঙুল ক্যান? ইয়ার পিছনে ভগবানের কুনো উদ্দেশ্য আছে, বোঝলা?”

সধবা অবস্থায় ছয় আঙুলে আংটি পরেছেন, রতনচূড়। বাড়ি তাঁর, আসবাবের ব্যবসা তাঁর বাবার, আমডাঙার জমিজমা ও পুকুর তাঁর। বুদ্ধিমতী জননী ছেলেদের বুঝিয়েছেন, আমার জীবৎকালে বাড়ি যেমন, তেমন থাকবে। আমি মরলে তোমরা যা হয় কোরো। চার ছেলে আমার ঘরও তো বারোটা গো! একেক জনকে দুটো করে ঘর দিইছি।

—বাকি ঘরগুলো?

—তোমাদের বোন নিতে আসবে না। শুধু তো সরকারি বড় চাকরে নন জামাই, ল্যান্সডাউন রোডে বাপের তৈরি বাড়ি। অবস্থা কম কিসে?

না, অবস্থা কম ছিল না হিমাদ্রিশেখরের। যদিও ল্যান্সডাউন রোডের সে বাড়ি পরে বেচে দেন তিনি ও নীলাদ্রিশেখর। সর্দারশংকর রোডে জমিটা পান সুলভে। মালিক বিপদে পড়ে বেচে দেন। সেই থেকে তিনি স্বগৃহে গৃহস্বামী। না, সেই গোত্রের অফিসার নন, যাঁরা রিটায়ার না করলে বাড়ি করতে পারতেন না। এখনকার কথা আলাদা, চাকরি জীবনেই অনেকে বাড়ি করে।

দশবছর বয়েসেই প্রথমাকে পাখিপড়া করে শেখানো হয়েছিল, বিয়ের জন্যেই তাঁর জন্ম।

পড়ানো হয়েছিল বেলতলা স্কুলে। চৈত্রমাসে সাতসকালে মাটির শিব গড়ে পুজো করতে হত। শিবরাত্রির ব্রত পালন করতে হত। লালপাড় সাদা শাড়ি পরে মাটির দিকে চোখ রেখে স্কুলের বাসে উঠতেন।

বাড়িতে কড়াকড়ি, সর্বদা নজরে নজরে বাস, তার মধ্যেই কি আশ্চর্য, পাশের বাড়ির এক কিশোর তাঁকে প্রেমপত্র লিখে ছাতে ছুঁড়ে মারল।

সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে বিচারসভা বসল। আজ প্রেমপত্র লিখবে, কাল বলবে, জানলায় দাঁড়াও। তারপর হয়তো আরো কিছু হবে।

প্রথমার মা ছেলে বউদের বললেন, আরো সিনেমা দেখাও? আরো স্বাধীনতা দাও? মেয়ে হল রূপের ডালি! রূপে কি করে মা? বদনামটি হলেই কেলেংকার।

প্রথমা তার পরিবারের যুক্তিগুলো বুঝতেই পারেনি। এখন থেকে স্কুল যাবে না, বাড়িতে পড়ে পরীক্ষা দেবে কেন? স্কুলে যে টুকু সময় থাকে, তাই তার কাছে স্বর্গ, বাড়িতে বন্দীজীবন কাটাবে কেন?

প্রথমা বলল, আমি সে ছেলেকে চিঠি লিখিনি। সে লিখেছে বলে আমাকে বন্দী করছ কেন?

মা বললেন, লেখাপড়া তো বিয়ের জন্যে মা! ঘরে বসে পরীক্ষা দেয় না কেউ?

—যদি কেউ ডাকে চিঠি দেয়, তাহলে কি করবে মা?

—অলক্ষুণে কথা বলিস না।

—আমি স্কুলে যাব। না যেতে দিলে কি করি তাই দেখো।

সর্বনেশে কথা বটে। কয়েকমাসও হয়নি, ক’বাড়ি বাদে মোড়ের বাড়ির মেয়ে বিনতা ছাত থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। অন্যজাতের ছেলে, তায় গৃহশিক্ষক, তাকে বিয়েতে বাধা। মেয়ে ছাত থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মরল।

প্রথমার মা নিশ্বাস ফেলে বললেন, তাই যেও স্কুলে।

এটাই প্রথমার জীবনে প্রথম ও শেষ বিদ্রোহ।

বেলতলা থেকে ম্যাট্রিক, সাউথ ক্যালকাটা গার্লস কলেজ থেকে বি. এ.।

ম্যাট্রিক পাশ করার পরেই অবশ্য জানা গেল, কোন এক বিয়ে—বাড়িতে প্রথমাকে দেখে হিমাদ্রির বাবা পছন্দ করেছেন।

প্রথমা লতুকে বলল, আমাদের বাড়িতে চিরকাল যা হয়েছে তাই হবে লতু।

এ সব কথা ও লতুকেই বলতে পারত।

প্রথমার একটি মাত্র মাসি। তিনি একেবারেই প্রথমার মায়ের মত নন। প্রথমার মাসিকে যিনি বিয়ে করেন, তিনি না কি স্বদেশী করতেন। ঘরজামাই থাকতে রাজী হননি। নিজেও জমিদারের ছেলে, কিন্তু বাপের সম্পত্তিও নেননি। শ্বশুরের এবং বাপের সম্পত্তি নেবে না এমন ছেলে যে ভিক্ষে করবে তাতে সন্দেহ ছিল না কারো।

কি আশ্চর্য, তিনি ভিক্ষেও করলেন না। শিক্ষকের কাজ নিলেন এবং স্ত্রীকে পড়িয়ে পড়িয়ে ম্যাটিক পাশ করালেন। তারপর বাঁকুড়ায় করলেন একটি মেয়ে ইস্কুল।

সবাই ছি ছি করেছিল।

—চাঁদা তুলে ভিক্ষে করে মেয়ে ইস্কুল গড়লি? বউটাও বোকা। সর্বস্ব সোনার গয়না দিয়ে দিল।

প্রথমা চিরকাল ছোটমাসির গল্প শুনেছে। তাঁরা ইস্কুলের পাশেই থাকেন ছোট্ট বাড়িতে। মাসি নিজেও স্কুলে পড়ান। ওঁদের গরু আছে, সবজির বাগান আছে, মাসি আর মেসো ”ছোটলোকদের” মত মাটি কোপান, দুধ দোয়ান, দুজনে খুব ভাব। ওখানকার লোকজন মেসোকে খুব ভক্তি করে।

এঁদের ছেলেই সেই অদ্ভুত কাজ করে, যা প্রথমাদের বাড়ির কেউ করেনি কখনো। একটি মেয়ের গান শুনে ভাল লেগেছিল বলে তার সঙ্গে ভাবভালবাসা করে, বিয়েও করে।

প্রথমা মাসিকে দেখেনি, মেসোকেও দেখেনি। তবে এই মাসতুত দাদা আর বউদিকে দেখেছে। এরা প্রথমাদের বাড়ি আসে যায়। এই বউদির বোন লতু কলকাতায় এল ডাক্তারী পড়তে। বউদি বলল, মাসিমা, লতু আসা—যাওয়া করবে কিন্তু।

—ওমা! মোটে চেনে না তো!

—আপনাদের গল্প শুনে শুনে…

—ডাক্তার হবে?

—ভাইরা তো পড়ল না। বাবা ডাক্তার, লতুও ডাক্তার হবে। আপনি ভাববেন না, লতু যা গায়ে—পড়া মেয়ে। পাথরকেও কথা বলাতে পারে।

সত্যি লতু এ বাড়িতে নিয়ে এল ঝোড়ো হাওয়া।

প্রথমার মাকে বলল, আমি কিন্তু ”তুমি” বলি সকলকে। রাগ করতে পারবে না।

রাগ করলেই কি সে শুনবার মেয়ে? প্রথমার মাকে বড় ডাক্তার দেখিয়ে চোখের চিকিৎসা করাল। প্রথমার দাদার ছেলের টাইফয়েডে রাতদিন সেবা করল। যখনি আসে, অনেক মিষ্টি আর ফল আনে।

প্রথমার মা—ও গলে গেলেন।

তিনি তা বলে কথা শোনাতে ছাড়তেন না। চিরকাল কথা শুনিয়েছেন, মানুষ শুনেছে। লতু কিন্তু কটকট করে জবাব দিত।

—তোর বে’ হবে না লতু! যে মেয়ে মদ্দানী হয়েছিস!

—তোমার মেয়ের তো বিয়ে হবে?

—ও মা! বে’ তো কবেই হয়ে যেত। জামাই আবার বি. এ. পাশ মেয়ে চান।

—জানি তোমার জামাইকে।

—কেমন ছেলে, বল?

—দেখতে ভালো নয়, গোমড়ামুখো, মেজাজী।

—বেটাছেলে যেমন হতে হয়।

—আমি কেমন মেয়ে গো?

—ওই! মদ্দা মার্কা মেয়েছেলে!

—কি যে বলো!

—ডাক্তারী করা কি মেয়েদের মানায়? তোর দিদি কেমন ঘরসংসার করছে।

—গানও গায়।

—তোকে তোর মা কিছু বলে না?

—মোটেই না। মা খুব খুশি আমাকে নিয়ে।

—আমার বোন যদি তোর দিদির সঙ্গে ছেলের বে’ না দিত, ভাল হত।

লতু হেসে গড়িয়ে যায়। বলে, দিত কী গো মাসিমা। দিদির গান শুনে তোমার বোনপো…

—তোর বাবার তো শুনি পয়সা আছে।

—বাবা তো খুব খুশি। বাবা বলেন, মেয়েকে এর—তার সামনে বসাব, তারা দেখবে, এ আমি কোনদিন পছন্দ করি না।

—তুমিও তাহলে দেখেশুনেই বে’ করবে?

—দাদাদের দিয়ে তো হল না। বাবার অমন প্র্যাকটিস, অমন ডাক্তার… আমি ডাক্তারি পড়ছি, বাবা ভীষণ খুশি।

—যা হোক বাছা, বে’ হল আসল কথা। আমার প্রথমাকেই দেখ। লক্ষ্মী মেয়ে। বি এ পড়ছে, জামাই চান যে লেখাপড়া জানা মেয়ে বিয়ে করবেন।

লতুর এ বাড়ি আসা যাওয়া প্রথমার মা বা দাদাদের পছন্দ নয়। কিন্তু সম্পর্কে কুটুম্ব। বাপ থাকেন বর্ধমানে। কলকাতায় হস্টেলে থেকে ডাক্তারি পড়ে। আসে যায়, খায়, থাকে। বলা তো যায় না কিছু।

লতুর যাওয়া আসা প্রথমার বড় পছন্দ। কী স্বাধীন লতু! বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা যায়, বেড়ায়। ট্রামে বাসে ঘোরে। পুরুষ সহপাঠীদের সঙ্গে ডাক্তারি পড়ে, কী অন্যরকম জীবন!

লতু বলল, কী শুনছি রে প্রথমা?

—কী শুনলি?

—বর না কি বি এ পাস মেয়ে চায়?

—শুনেছিস তো!

—তাই তোকে পড়াচ্ছেন মাসিমা!

—কেন, পড়া কি খারাপ?

—তোর হবু বরটি কেমন মানুষ? বি এ পাস তো উনিই করাতে পারতেন।

—কী বলব, বল?

—তোর এ বিয়েতে ইচ্ছে আছে?

—জানি না ভাই।

—সত্যি! তোদের বাড়িটা একটা…

—বিয়ে ছাড়া আমার মতো মেয়ে কী করবে বল?

—সেই তো কথা প্রথমা!

—আমাকে জিগ্যেস করে তো বিয়ে ঠিক হচ্ছে না। আর…দাদারা বলে…ছেলে খুব ভাল।

—না, এ দেশে কিছু হবে না। তোর নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে নেই কিছু?

—মাকে তো জানিস! বেঁচে থাকতে বাবাও ওঁকে ভয় পেতেন। মা যখন ঠিক করেছেন…আর মা কি জেনেশুনে ক্ষতি করবেন আমার?

—কী জানি! মাসিমাও তোকে পুতুল করেই রেখেছেন। হিমাদ্রিবাবুও একটা পুতুলই চান…

—দেখ না, ছোটমাসি কত বলেছেন, একবারও যেতে দিলেন বাঁকুড়া? না, সেটা গরম দেশ। রং জ্বলে যাবে, চুল উঠে যাবে, বিয়ে হবে না।

—বিয়ে হবে বলে তোর ভাল লাগছে?

—এখান থেকে তো বেরনো যাবে।

—আমার মনে হচ্ছে, এক খাঁচা থেকে আরেকটা খাঁচায় গিয়ে ঢুকছিস।

কার্যকালে অবশ্য লতুর কথা অক্ষরে অক্ষরে মেলে না, মোটামুটি মেলে।

হিমাদ্রি ও তাঁর শাশুড়ি এ—ওর খুব মনোমত হন।

মেয়েছেলের জন্ম যে বিয়ের জন্যেই, সে বিষয়ে দু’জনেই একমত।

হিমাদ্রির মতে শাশুড়ির বেলা এটা ‘গোড়ামি’, কিন্তু তাঁর বেলা এটা মমতাময়তা। মেয়েদের ব্যক্তিত্ব রমণীয়, পুরুষের আশ্রয় ছাড়া সে কি বাঁচবে?

শাশুড়ি মনে করেন, ম্যাট্রিক মানে উচ্চ শিক্ষা।

হিমাদ্রি মনে করেন গ্রাজুয়েশন উচ্চশিক্ষা। কেন না শিক্ষিতা মা ব্যতীত ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শেখে না। শাশুড়ি মনে করেন, মেয়েকে রাশ ছেড়েছ কি, সে গোল্লায় যাবে।

হিমাদ্রি মনে করেন, মেয়েরা হটহাউসে লালনযোগ্য সুন্দর ফুল। বাইরের জগতের কুৎসিত অসভ্যতা থেকে তাদের বাঁচানো দরকার।

লতু বিষয়ে শাশুড়ির মত, ও মেয়েকে এখানে পুঁতলে বর্ধমানে গাছ বেরুবে।

হিমাদ্রি মনে করেন, লতু হল আজকের সমাজে যা দরকার, তেমন মুক্ত নারী।

লতুর সঙ্গে মাখোমাখো হবার চেষ্টা করেছিলেন হিমাদ্রি। বলেছিলেন, তোমাকে আমি সমর্থন করি লতু! আমি তো রক্ষণশীল নই। আমি শিক্ষিত, অতএব মুক্ত মন আমার। তোমাকে আমি…

—তবে আমাকেও বিয়ে করুন।

—বিয়ে?

—কেন, দুটো বিয়ে করে না কেউ? একটা বউ ঘরে থাকল, আরেকটা বউ বেরল?

—ছি ছি ছি লতু…

—আয়নায় নিজেকে দেখেছেন। লণ্ঠনের মতো ঝোলানো মুখ, মাথায় টাক পড়ো পড়ো?

হিমাদ্রির বিয়েতে অসম্ভব ধুমধাম হয়। তখনও বাজারে কেটারার ঢোকেনি। ফলে বিয়েতে বরকে যদি বসানো হয় ফুলের তৈরি দোলনায়, বৌভাতে বউকে বসানো হয় ফুলে গড়া ময়ূর সিংহাসনে।

.

তখনও ফুলশয্যা—গায়ে হলুদের তত্ত্বে ক্ষীরের মাছ, বুড়োবুড়ি, এ সব যেত। সানাইওয়ালা সানাই বাজাত। দু’বাড়িতেই গালচের আসনে বসিয়ে অতিথিদের খাওয়ানো হয়েছিল। লতু ছাড়া কেউ জিগ্যেস করেনি, প্রথমা! তোর ভয় করছে না তো?

.

লতু ছাড়া কাউকে প্রথমা বলেনি, বড্ড ভয় করছে। এরা সবাই কেমন কটকট করে চাইছে। কেউ বলছে, খাট কি বউয়ের ঠাকুমার? পালিশ করিয়ে দিয়েছে?

—ছি ছি!

—কী হবে লতু?

প্রথমার এক জা বললেন, সরকারি অফিসার হোক, আর্কিটেক্ট হোক, এ বাড়ির ছেলেরা বিয়ে করে মায়ের দাসীই আনে।

লতু বলল—এমন যদি কনজারভেটিভ, শিক্ষিতা মেয়ে চায় কেন?

—ও টুকু নইলে চলে না। ছেলে মেয়েকে ভাল রেজাল্ট তো করতে হবে।

—তারপর?

—মেয়েরা যাবে শ্বশুরবাড়ি, ছেলেরা করবে কেরিয়ার। প্রথমা তো ভাগ্যবতী। স্বামীর সঙ্গে দেশবিদেশ ঘুরবে।

প্রথম বিয়ের সময়ে তো হিমাদ্রি থাকেন কলকাতা। বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী নতুন বউ আগে পান চা—জলখাবারের ভার। বড় জা বলেন, তোর কপাল ভাল ভাই। এখন পাউরুটি—মাখন—জ্যাম সন্দেশ চলে। আমার কালে গোছাগোছা লুচি পরোটার চল ছিল। একটি পরোটা নিখুঁত না বেললে শাশুড়ি কাঁদিয়ে ছাড়তেন।

প্রথমার মনে হয়েছিল, সব বিষয়েই বাড়িটা বাপের বাড়ির মতো। তেমনি মেপে চলো, মেপে হাসো, দুপুরে ঘুমোও, বিউটি স্লিপ যাকে বলে। রোদ লাগিও না, বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখো না পার্কে শিশুদের খেলা।

তফাত কি নেই? তফাত আছে। বাপের বাড়িতে তরকারি কোটেনি। আঙুলে কষ লাগবে। রান্না করেনি, তাপ লেগে মুখের রং ঝলসে যাবে। এখানে তরকারি কোটো, চা করো, রুটি সেঁকো।

আর হিমাদ্রির জামাকাপড় ইস্ত্রি করো। হিমাদ্রি গেঞ্জিটিও ইস্ত্রি না হলে পরেন না। তিনি ফেরার আগে প্রথমাকে চুল বেঁধে কাপড় ছেড়ে সেজে গুজে থাকতে হয়। রাতে পুরুষরা আগে খান, মেয়েরা পরে। এরকম সব ছোটখাট তফাত।

তবে হ্যাঁ, হিমাদ্রি পত্নীগত প্রাণ। তাই প্রথমা বাপের বাড়ি রাত্রিবাস করতে পারেন না।

হিমাদ্রি একদিন বললেন, তোমাকে তেমন হাসি খুশি তো দেখি না।

—আমি তো ওখানেও খুব হাসতাম না।

—এখন তো হাসবে! আমাদের সেক্রেটারিও বলেছিলেন, তোমার বউ বড় কম কথা বলে।

—এখন থেকে বলব।

—লতু কী চটপটে বলো তো?

—লতু অন্য ভাবে মানুষ!

—ওকে আসতে বোলো।

—বলব, আসবে কি না জানি না।

—কেন আসবে না?

—ওর হয়তো ভাল লাগে না। ও তো যা ইচ্ছে হয়, তাই করে। কোনদিন কারো কথা শোনে না।

এমনি করেই চলছিল, চলছিল প্রথমার জীবন। কিন্তু বিয়ের দু’বছর যেতে না যেতে সকলে প্রথমাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল। সে মেয়ে মেয়ে কী, যার বিয়ে হয় না। সে বিয়ে বিয়ে কী, বউ যখন গর্ভিণী হয় না? শিক্ষিতা মেয়ে বিয়ে করার উদ্দেশ্য তো একটাই, সে সন্তানদের শিক্ষার ভার নেবে। মায়ের কাছে সন্তান ভাল শেখে, এটা হিমাদ্রির মধ্যের আধুনিক মনের সিদ্ধান্ত।

হিমাদ্রির মনে হতে লাগল, প্রথমাকে বিয়ে করে তিনি ঠকেছেন। হিমাদ্রির মতো আর কে জানে, যে তিনি নপুংসক নন?

লতু বলল, এত ভাবনা কিসের? আমি নিয়ে যাব প্রথমাকে ডাক্তারের কাছে।

—পুরুষ ডাক্তারের কাছে?

—আপনি এক জগাখিচুড়ি বটে! ঠিক আছে, মেয়ে ডাক্তারই দেখবে। ধরুন, ওর কোন ত্রুটি বেরল না, সে ক্ষেত্রে আপনিও ডাক্তার দেখাবেন তো?

—ফাজলামি হচ্ছে?

—ফাজলামি তো সম্পর্ক। আমার দিদি, ওর মাসতুত বউদি। সম্পর্কের আমি আপনার শ্যালিকা হলাম।

—দেখো! যা হয় করো।

প্রথমা নিজেকেও হতভাগিনী ভাবতে শুরু করল। সন্তানহীনা নারী, ফলহীন গাছ বললে হয়। লতু বলল, গুচ্ছের বাংলা ছবি দেখিস, আর প্যানপেনে গল্পের বই পড়িস। মাথাটা একেবারে গেছে তোর। এটা উনিশশো পঞ্চান্ন সাল মশাই। পৃথিবী এগোচ্ছে। প্রথমা কাতর চোখে চাইল। সময় এগোচ্ছে? এ বাড়ি তৈরি ১৯১১ সালে। সেখানেই তো থেমে আছে সব। এঁরা মেয়েদের ধর্তব্য মনে করেন না। মেঘাদ্রিশেখর, নীলাদ্রিশেখর, হিমাদ্রিশেখর, ছেলেদের নিয়ে বাড়ি। মেঘাদ্রি যদি আরকিটেক্ট, নীলাদ্রি ও হিমাদ্রি সরকারি অফিসার। পরের মেয়েকে ভার‍্যা রূপে আনা, সে তো পুত্রার্থে।

লতু বলল, ভয় বা পাচ্ছিস কেন?

—যদি আরেকটা বিয়ে করে?

—সরকারি অফিসার? হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট পাশ হবার বছরে? কোর্টে কেস করলে নাকটি কাটা যাবে না?

—অমন করে বলিস না ভাই।

—নে, চলতো ডাক্তারের কাছে।

না, প্রথমার দেহযন্ত্র নিখুঁত। সন্তান হতে কোনও বাধাই নেই তার।

হিমাদ্রি বললেন, তবে হচ্ছে না কেন?

লতু বলল, আপনি ডাক্তারের কাছে যান না।

—তার…দরকার…হবে না।

কেন হবে না, তা ব্যাখ্যা করলেন না।

প্রথমার মা বললেন, ঠাকুরদেবতা, তাগাতাবিজ, মাদুলি কবচ করলে সন্তান হয় না?

প্রথমা বলল, কোথায় হয়? তোমার ভাইয়ের হয়েছিল? সে তো দু’বার বিয়ে করেছিল।

—তোর তো খুব মুখ হয়েছে এখন।

—বললে, তাই বললাম।

প্রথমা লতুকে বলল, ও আবার বিয়ে করুক গে।

হিমাদ্রির তখন প্রমোশান আসন্ন। সতীর্থরা বললেন, হিন্দু বিবাহে দ্বিতীয় বিয়ে একটা অপরাধ। আর, ডাইভোর্স করতে পারো।

ডাইভোর্স! প্রথমত ‘ডাইভোর্স’ শব্দটাই অসহ্য। তারপর ডাইভোর্স করলে স্ত্রীও পুনর্বিবাহ করতে পারে।

লতু বলল, ডাইভোর্সই করুন মশাই। প্রথমাকে নিয়ে গিয়ে ওর ছোটমাসির কাছে রেখে আসি। সেখানে ও মানুষ হয়ে যাবে, নয়তো আমার দিদির কাছে।

হ্যাঁ, চারদিকে কেচ্ছা ছড়াক।

কেচ্ছা ও কেলেঙ্কারির ভয়েই হিমাদ্রি স্ত্রী থাকতে আবার বিয়ে এবং ডাইভোর্স করে আবার বিয়ে করতে পারেননি।

তাঁর পরিত্রাতা হয়ে এলেন প্রথমার দাদা। তিনি হিমাদ্রিকে নিয়ে গেলেন বাঁকুড়ার সোনামুখীতে। সেখানে থাকেন তাঁর কুলগুরু। যাঁর প্রতিটি গণনাই অব্যর্থ। তিনি চারদিন ওঁদের আশ্রমে রাখলেন। কোষ্ঠি পত্রিকা বারবার বিচার করলেন। তারপর জলবৎ তরলং করে সব বুঝিয়ে দিলেন।

—তুমি তো বাবা অপুত্রক নও। শুদ্রাণীর গর্ভে তোমার একটি সন্তান তো হয়েছিল।

—সে একটা পদস্খলন বলতে পারেন।

তারা কি আছে?

না…টাকাপয়সা দিয়ে…

হিমাদ্রির এখনও মনোরমার কথা মনে হয়। মনোরমা তাঁকে আকর্ষণ করত, উত্তেজিত করত।

প্রথমা যেন পুতুল। তাঁকে উত্তেজিত করতে পারে না। এ কথা কি বলা যায়?

—এ বিয়েতেও সন্তানাদি হবে। তারা বেশ নামকরার মতোই হবে। তবে এখন নয়। এখনও কয়েক বছর…যাকে বলে…

হিমাদ্রি একটি কবচ ধারণ করে ফিরে এলেন। প্রথমাকে অপার বিস্মিত করে বললেন, দার্জিলিংয়ে বদলি হচ্ছি। তোমাকে নিয়ে যাব।

—দার্জিলিংয়ে।

—বছর দুই, তারপর কুচবিহার, না বহরমপুর, সিউড়ি, না বারাসাত, জানি না।

দার্জিলিংটি অবশ্য মালদা হয়ে যায়। প্রথমা কিন্তু বেরতে পেরেই খুশি। শ্বশুরবাড়ি, বা বাপের বাড়ির নিষেধবন্ধন নেই। শুধু দু’জনে, শুধু দু’জনে।

ট্রেনে বসে প্রথমা বলল, তুমি তো সেই আপিসেই থাকবে। আমি কী করব?

—সামাজিক জীবন আছে, মানুষজন যাবে আসবে। দেখো, তুমি সিঙাড়া, নিমকি করতে পারো তো?

—করিনি তো কখন।

—শিখে নেবে, শিখে নেবে। ধরো ম্যাজিস্ট্রেট এলেন, নয়তো এস পি, যদি খাইয়ে দাইয়ে খুশি করতে পারো, আমার ভাল হবে।

প্রথমা কয়েক মাস বাদে লতুকে লিখল, ”আগে বলেছিল বি. এ. পাস বউ দরকার। ছেলে মেয়ে ভাল লেখাপড়া শিখবে। বইগুলো নিয়েই এসেছি। কিছু তো মনে নেই। আবার পড়ছি ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান হেনতেন। কোনদিন না কি মা হব। সেদিন যেন তাদের শেখাতে পারি। এখন বলছে সিঙাড়া—কচুরি—নিমকি—গজা—চপ—কাটলেট করতে শেখা দরকার। আমি নারী সমিতির বেলাদির কাছে রান্না শিখছি।

আর, বাগান করতে শিখছি মালীর কাছে। আগের হাকিম বাগান পছন্দ করতেন না। আমার খুব ভাল লাগে বাগান করতে, গাছ লাগাতে। ম্যাজিস্ট্রেটের বউ মিসেস আয়েঙ্গার বলেন, আমার আঙুলে জাদু আছে। এই প্রথম আমি নিজে কিছু করছি যা আমার ভাল লাগছে।”

এরপরের চিঠি ‘লতু, আমার গাছে ম্যাগনোলিয়া গ্রান্ডিফেলারা ফুটেছে। ছবি পাঠালাম। এখন দেখছি হিমাদ্রিও বেশ খুশি। একটু গর্বিতও, কেন না বাগান করলে অফিসারদের কাছে সুনাম পাওয়া যায়, এটা জানত না।’

প্রথমার জীবনের ফুলের বাগান করাটা এমন একটা জিনিস যা নিয়ে ও স্বতন্ত্র এক ব্যক্তিত্ব খুঁজে পেল। কলকাতায় ও ছাদে বাগান করেছিল। ওর ডালিয়া প্রদর্শনীতে পুরস্কার পায়। আর কলকাতায় তো ফেরেনি, ফিরেছিল বারাসাত। সেখানে আলাদা বাংলো, অনেক জমি। হিমাদ্রিশেখর প্রথমাকে ‘দুই বোন’ কিনে দেন। বলেন, গার্ডেনিং নিয়ে লেখা বই। পড়ে দেখো।

—পড়েছি।

—আমি ভুলে গেছি।

—সময় পেলে পড়ে দেখো।

সে সময় তো হিমাদ্রির হয়নি। বিয়ের বারো বছর বাদে রণজয় জন্মাল, মাকে কোনও কষ্ট না দিয়ে। লতু ততদিনে প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। বলল, প্রথমা, দেখ কী সুন্দর বেবি হয়েছে।

—যাক, বাঁচা গেল। ও তো ছেলে চেয়েছিল।

এতকাল বাদে সন্তান, সেও ছেলে। প্রত্যাশিতভাবেই প্রচুর ধুমধাম করে অন্নপ্রাশন হল। ১৯৬৪ সালে পৃথিবী নিশ্চয় আরোই এগিয়েছিল। শুধু সে খবর প্রথমার শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছয়নি। সোনামুখীর গুরুদেবকে গাড়ি চাপিয়ে আনা হল। তিনি কয়েক মিটার লম্বা একটি কোষ্ঠিপত্র করলেন।

হিমাদ্রি প্রথমাকে একটি হার দিলেন। প্রথমা বলল, এটা কি ছেলের মা হবার বখশিস?

—আমার বংশরক্ষা করলে, কৃতজ্ঞতা।

—মনোরমাকে কি দিয়েছিলে গো?

—মনোরমা? সে কে?

—তারও তো ছেলেই হয়েছিল।

—কে, কে বলল তার কথা?

—তোমার বউদিরাই বলতেন, কবেই শুনেছি।

—থাক তার কথা।

—হ্যাঁ, আমি একটু ঘুমোই।

—লতু বলল, অবাক করলে প্রথমা। এ কথা বলার সাহস পেলে?

—বারো বছর ধরেই শুনেছি, রণুর বাবা নপুংসক নয়। মনোরমার ছেলে তার প্রমাণ।

—সে কে? কোথায় থাকে?

—শুনেছি ওর চাপরাশির বোন। ঘরের কাজ করত। তাকে বোধহয় টাকা পয়সা দিয়েছিল। আমি কী করে জানব কোথায় থাকে?

—তোমার ভয় করল না বলতে?

—আগে হলে ভয় করত। এখন, অনেকদিন ভয় করে না।

বস্তুত, ছেলের দু’বছর বয়স না হতে প্রথমা জেদ ধরে। কলকাতায় থাকব। কলকাতায় না থাকলে ছেলের জন্যে ডাক্তার পাব না, স্কুলের অসুবিধে হবে।

—মায়ের কাছে আমরাও শিক্ষা শুরু করি।

—আমি তেমন মা হয়তো নই।

এই সময়েই, বা বছর খানেকের মধ্যে মেঘাদ্রিশেখর মারা যান। তারপর ল্যান্সডাউনের বাড়ি বিক্রি করে সর্দারশংকর রোডে হিমাদ্রি ও নীলাদ্রি আলাদা বাড়ি তোলেন। মেঘাদ্রির স্ত্রী ছেলেমেয়ে ও ভাগের টাকা নিয়ে পিত্রালয়ে গেলেন। শাশুড়ি শেষ অবধি হিমাদ্রির ভাগেই পড়লেন। প্রথমা বললেন, এখন কি উনি আজ এর ভাগে, কাল ওর ভাগে থাকবেন? আমার কাছেই থাকুন।

থাকলে কী হবে, ছেলের স্নান খাওয়াতে শাশুড়ির হস্তক্ষেপ নিষেধ। কিছুকাল চেঁচামেচি, অনাহার, ছেলের কাছে বউয়ের নামে নালিশ করলেন।

খুব সুবিধে হল না। ও বাড়ি বেচে দেবার সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন নিয়মকানুনও চলে গেল। দু’বাড়িতেই বউরা স্বাধীন চলাফেরা করে। প্রথমা বাগান করে মন দিয়ে। নীলাদ্রির মেয়ে একদিন লম্বা চুল কেটে হাজির হল কাকিকে দেখাতে।

শাশুড়ি মূর্ছা যান, যান প্রায়।

হিমাদ্রি বললেন, স্মার্ট দেখাচ্ছে।

ঠাকুমা বললেন, বুদ্ধি দিল কে?

—কে আবার, আমি নিজেই চলে গেলাম কাটতে।

—হায় হায়, বিয়ে হবে কী করে?

—দেখতেই পাবে। ঠাকুমা একটু এগোতে শেখো। সময় বদলাচ্ছে।

—তোর মা কিছু বলল না?

—মার সময় কোথায়? মা রান্নার ক্লাসে যাচ্ছে।

—কালে কালে হল কী?

অঙ্ক অনার্স পড়া ঝকঝকে নাতনি বলল ও বাড়িটার নাম ছিল ঊনবিংশ শতক। এখন আর তখনকার নিয়মকানুন খাটাতে পারবে না।

—আমার ছেলেরা বা সইছে কী করে?

—না সয়ে করবে কী? তাছাড়া কাকি বাগান করছে, মা রান্না শিখছে নানা দেশের, অন্যায় করছে কিছু?

বাজে বকো না তো!

শাশুড়ি অগত্যা ঠাকুরঘর আশ্রয় করলেন। লতু বলল, পুজো করুন, সকালে লেকে হাঁটুন, ভাজাভুজি, ঘি, মিষ্টি কম খান, সেঞ্চুরি করে ফেলবেন।

—তুমিও তো মা বিয়ে করলে না।

—বিয়ে করার মতো মানুষই পেলাম না।

—সেই জন্যেই বলি, অত যদি না পড়তে…

—অত আর পড়লাম কোথায়। বাবা মারা গেলেন, বিলেত যাওয়া হল না। এখন তো প্র্যাকটিসে নামিনি। হেলথ সার্ভিস করছি। এবার নিজেরা একটা ক্লিনিক খুলব।

—ওসব বেটা ছেলেরাই করুক মা!

লতু মিষ্টি হেসে বলল, জানতাম, আপনি তাই বলবেন। কিন্তু আমাদের ক্লিনিকে আপনারা চিকিৎসার কত সুযোগ পাবেন, একবারও ভেবেছেন কি?

প্রথমা বলল, দেখো এসো কী চমৎকার ঝুমকোলতা ফুটেছে আমার বাগানে।

—বাগানে বসতে সময় পাও?

—রণোকে নিয়ে তো বসি।

—আবার সন্তানের কথা ভাবছ?

—রণো বড় হোক একটু।

রণোর পাঁচ বছর বাদে দূর্বা হয়। দূর্বা হবার আগে এই শান্ত নিয়মশাসিত, লতাকুঞ্জ ঘেরা বাড়িতে অনেক ঘটনা ঘটে যায়।

হিমাদ্রির মা কুণ্ডু স্পেশালে তীর্থ করতে গিয়ে পুরী ঘুরে আসেন। হিমাদ্রি ডাইরেক্টর সেকেন্ডারি স্কুল বোর্ড—এর কী সব গন্ডগোল ধরে ফেলেন। এবার প্রোমোশন। জয়েন্ট সেক্রেটারির পদে তো বটেই। প্রথম দিকের আই—এ—এস তখনও দাপট খুব।

প্রথমা গর্ভাবস্থায় নানা অসুস্থতায় ভোগে। লতু বলে, এবার ডেলিভারিতে ভোগাবে বলে মনে হয়।

হিমাদ্রি লতুকেই বলেন, একটি ভাল মেয়ে পাওয়া যায় না?

—ভাল মেয়ে বলতে কেমন ভাল?

—প্রথমাকে দেখবে, রণোকে দেখবে। প্রথমা তাহলে অনেকটা নিশ্চিন্ত হতে পারে।

—প্রথমার ছোট মাসিকে বলব।

—তিনি কী করবেন?

—অসহায় মেয়েদের নিয়েই তো পড়ে আছেন। কোন কোন মেয়ে যে কোন কাজ করে টাকা রোজগার করতে চায়। সব মেয়ে তো লেখাপড়া শিখব, নার্সিং পড়ব, সেলাই শিখব, ততটা চায় না।

—বিশ্বাসী হওয়া চাই। বিশ্বাসী।

—ওঁকে বলে দেখব। কিন্তু আপনি সাবিত্রীকে রাখুন না কেন?

—সবিত্রী কে?

—হাসপাতালে আয়ার কাজ করে। নিজেই বলছিল, রোজ তো কাজ মেলে না। আমার মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। আমি একটা ভাল বাড়িতে কাজ পেলেই করি।

—সধবা, না বিধবা?

—আমি জানি না। বলে মেয়েদের বাপ বাংলাদেশে থাকে। সেখানে তার আরেকটা সংসারও ছিল। দশ বছর দেখা সাক্ষাৎ নেই, থাকলে আছে, না থাকলে নেই।

—ম্যারেজ একটা ইনস্টিটিউশান লতু!

—সমাজের সর্বত্র নয়।

—না, তুমি সেই বিদ্রোহিনীই রয়ে গেলে।

—রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের পর আর এগোতে পারেননি। অন্তত বাংলা ভাষায়। চলি স্যার।

—আমি সাবিত্রীর ইন্টারভিউ নেব কিন্তু।

—নেবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *