মিলুর জন্য – ১৪

১৪

”গঙ্গোত্রী নার্সিংহোম”—এর ভিতরে লতুর ঘরে বসেছিলেন হেমকায়া।

সত্যিই মিলু ঘুমিয়েছে। আর সকালে যখন ওঠে তখন ও শান্ত।

শান্ত, কিন্তু অবিকল সংকল্প।

গর্ভবতী হয়ে থাকলে বেঁচে কোন লাভ নেই। গর্ভপাত করা মহাপাপ। সন্তান জন্মালে তার পিতৃ পরিচয় থাকবে না। স্বামীর ঘরে তো ফিরবেই না। মা ক্ষমতাহীন। হেমকায়াকে বা ও বিপন্ন করবে কেন?

তখন লতু বলেছে, আগে তোমাকে দেখি। তারপর নয়, আত্মহত্যার ব্যবস্থা আমিই করে দেব।

—আপনি ঠাট্টা করছেন।

—তোমার দায়িত্ব আমি নেব মিলু। গঙ্গাদিদিকে তো দেখলে। ও বিধবা ছিল। তারপর কোনও লোক ওকে নষ্ট করে। আত্মহত্যা করতে যায়। হাসপাতালে ওকে পাই। আমার কাছে আনি আদালত থেকে ছাড়িয়ে।

—আদালত কেন?

—আত্মহত্যার চেষ্টা করে লোকে নানা কারণে। বেঁচে ফিরলে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। অবশ্য এখন আর আত্মহত্যা অপরাধ নয়, তখনও সে আইন ছিল। ওকে আমি রেখেছি। ওর সে ছেলে পড়াশোনা করেছে মোটর গ্যারেজে কাজ করছে। রান্না করে যে সুমিলা, ও—ও অমনি স্বামীর তাড়ানো একটি মেয়ে। সুমিলা মেশিনে উলের জামা বোনে।

—আপনি কতজনকে পুষবেন?

—সে আমি বুঝব। মাসে বিশ—ত্রিশ হাজার টাকা তো কামাই।

এ কথার পর মিলু চুপ।

এখন ওর পরীক্ষা চলছে।

হেমকায়া কাগজ পড়তে পারছেন না।

—হেম মা! এই নাও।

—এ কী, পিপু?

—তোমার আর লতুর জন্যে কফি এনেছি। তুমি আর রণো তো কফি খাও নিজেরা বানিয়ে।

—রণো বলেছে?

—রণো আমাকে সব বলে।

প্রায় রণোর মতোই লম্বা, কালো, পেটানো শরীর, ছেলেদের মতো চুলছাঁটা একটি মেয়ে। এক হাতে একটা ঢাউস ঘড়ি, পরনে জিনস, ঢোলা শার্ট, চশমার পিছনে ঝকঝকে চোখ, মেকাপের বালাই নেই।

রণো ওকে সব বলে।

—আর কী বলে রণো?

—সব বলে। ও আমার বন্ধু তো। আমি তোমায় ”তুমি” বলছি, কারণ আমি কাউকে ”আপনি” বলি না।

—বেশ করেছ।

—রণোকে কি বড় বড় চিঠি লেখো!

—রণোও লেখে।

—তুমিও তো রণোর বন্ধু।

—রণো আর দূর্বারও খুব ভাব।

—লতু ঢুকল।

—ওঃ পিপু! কফি দে!

লতু…মিলু?

—বলছি।

কফি খেয়ে লতু হেলান দেয় ঘোরানো চেয়ারে। বলে, যোগ ব্যায়াম আবার ধরতে হবে। শিরদাঁড়া যা কনকন করছে! হেম, তুমিও ধরো। ভাল থাকবে।

—আমি ভালই আছি।

—সাতাশ বছরে চেহারা তেমন বুড়োয়নি।

—মিলুর খবর কী?

—ডায়াগ্রাম এঁকে ডাক্তারি ভাষায় বলতে পারতাম। তবে সোজা বাংলায় বলি। এক নম্বর কথা, মিলু সন্তানসম্ভবা হয়নি।

—কিন্তু…

—ওভারিতে টিউমার। এমন কিছু বিরল নয়। সে জন্যই মাসে মাসে…কয়েক মাসের গ্রোথ।

—টিউমার?

—হ্যাঁ হেম।

—তাহলে?

—ম্যালিগন্যান্ট হোক, বা না হোক, অপারেশান করতেই হবে। সে জন্যে অনেক রকম টেস্ট দরকার। আমি খুব দেরি করতেও চাই না।

—ও জানে?

—বলব। তোমার সঙ্গে কথা বলে নিই।

—ওকে এখানে রাখা কি…

—তুমি যা বলবে তাই হবে।

—লতু! চিরকাল তোমার কাছেই দৌড়েছি। তুমিই ওর ভার নাও। টাকা—পয়সার জন্যে ভেবো না। এখানে চার্জ কত তাও জানি না। অপারেশনে কত লাগবে…টেস্ট…ওষুধ…যা দরকার, স—ব করো।

—সবই করব।

—টাকা…

—বাড়ি যাই, তখন দিও। তুমি মিলুর সঙ্গে কথা বলবে চলো। তারপর পিপুর সঙ্গে বাড়ি যাও, মানে আমার বাড়ি।

মিলু চোখ চেয়ে শুয়েছিল।

—মিলু!

—মাসিমা! আমার কি হয়েছে?

—ডাক্তার মাসি বলবে।

—তোমার গর্ভ হয়নি মিলু। টিউমার হয়েছে, টিউমার। অপারেশন করতে হবে।

—গর্ভ নয়?

—না, মিলু।

—অপারেশান করলে সব সেরে যাবে?

—তাই তো মনে করি।

হেমকায়া বললেন, মিলু! তুই এখানেই ভর্তি থাকবি।

ডাক্তার মাসিই তো সব করবেন। এতে আমারও সুবিধা। তুমিও নিশ্চিন্ত হলে। আর পাগলামি করার দরকার নেই, বুঝেছ?

—আপনার যে অনেক খরচ হবে…

—হোক। সব আমি করব। শুধু মনে রাখবে, ভাল হয়ে কোন ভাল কাজ শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। এটুকুই আমি দেখতে চাই। এখন…আমি যেমন বলব, তুমি তেমন চলবে।

লতু বলল, তবে তাই!

—ক্ষিদে পাচ্ছে।

—এরা খেতে দেবে।

—মাকে বলবেন না মাসিমা।

—সে আমি বুঝব।

বেরিয়ে এসে হেমকায়া বললেন, লতু! তুমি কখন ফিরবে?

—দুটোর মধ্যে এসে যাব। চলো, তোমাদের নামিয়ে দিয়ে যাই।

.

—লতু বললেন, তাহলে তুমি বাড়ি ফিরবে?

—হ্যাঁ লতু। মিলুর ব্যবস্থা না হলে ফিরতাম না। মিলুর ব্যবস্থা হল। টিউমার ম্যালিগন্যান্ট না হলে তো আরওই নিশ্চিন্ত। মিলুর বাকি জীবনের চিন্তা রয়েই গেল, এখনকার সমস্যার তো ব্যবস্থা করে দিলে।

—ঋণ শোধ করছি।

—কার? রণোর মা’র?

—নিজের বিবেকের ঋণ। সে সময়ে যদি প্রথমাকে টেনে নিয়ে আসতে পারতাম…

পিপু বলল, পারতে না। আজ তোমার যে জোর আছে, সেদিন ছিল না।

—পিপু! তুই আমাকে একটু সেন্টিমেন্টালও হতে দিবি না?

—না, তোমাকে বিশ্রী দেখায়।

—তোরা যাচ্ছেতাই।

—বাঃ তুমি আমার আইডিয়াল না?

—বুঝেছি। তাহলে বাড়ি ফিরবে হেম?

—নিশ্চয়। দশ হাজার রেখে গেলাম। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলব…মিলুর যা যা লাগবে…

—ওর জামাকাপড় দু’সেট…টুথ ব্রাশ, পেস্ট, সাবান, পাউডার দুটো নাইটি…

নাইটি কিনতে হবে।

—এ টাকা থেকেই সুমিলা এনে দেবে।

—বাড়ি একবার না গেলে রণো অত্যন্ত চিন্তা করবে। ওর জন্যে কি আমার কম চিন্তা?

—মিলুর জিনিসপত্র পৌঁছে দিই। ওকে অ্যাডমিট করা হোক। তুমি ফর্মে সই করো। কাজটা মিটিয়ে চলো আমরাও যাই।

—দূর্বাও হয়তো আটকে থাকবে।

—আর দূর্বার বাবা?

—ওঁর কথা তো আমি ভাবি না। এগ্রিমেন্টের বিয়ে লতু, ওঁর কথা ভাবব, এমন শর্ত তো ছিল না। শর্তের বাইরে? সে তো নিজের স্বভাব আর আচরণের কারণে উনি সব দাবিই হারিয়েছেন। ওঁর কথা ভাবছি না। রণো ওর পছন্দমতো একটি মেয়েকে বিয়ে করলে আমি সত্যিই মুক্ত হয়ে যাব। মিলুর দায়িত্ব নিয়েছি। ওর জীবনটা যাতে ব্যর্থ না হয়, সেটা দেখাও আমার নৈতিক কর্তব্য। কিন্তু রণোর বাবার বিষয়ে কোনও নৈতিক কর্তব্য আছে বলে মনে করি না।

—বুঝেছি। চলো, খেয়ে নেওয়া যাক।

—লতু! আমিও যাব।

—সে কি আমি জানি না? যা। খাবার নিয়ে নে।

পিপু চলে যেতে হেমকায়া বললেন, কী চমৎকার মেয়ে। ঠিক তোমার মতো।

—যদি জানতে প্রথমার মা—ভাইরা, শাশুড়ি—স্বামী, সবাই আমাকে কী চোখে দেখত!

—জানতেও চাই না, চলো।

.

ওঁরা নীচেই বসেছিলেন।

দূর্বা দরজা খুলতে গেল।

হিমাদ্রির বুক ধড়াস ধড়াস করছে।

লতু, হেমকায়া, আরেকটি মেয়ে।

রণো হাঁ করে তাকাল, হেম মা? পিপু তুই?

—আজ্ঞে

—হেম মা! লতু মাসি! এসো এসো।

হিমাদ্রি নির্বাক।

দূর্বা বলল, মিলু কোথায় হেম মা?

—নার্সিংহোমে। তারপর…জন্মদিন কেমন হল?

—হেম!

হিমাদ্রির মাথা নিচু।

—আমাকে ক্ষমা করতে পারবে হেম? জানি…এ কথা বলার অধিকার আমার নেই। কিন্তু…কিন্তু…এই দু’দিনেই আমি বুঝেছি, তোমাদের তিনজনেরই আমাকে…দণ্ড দেবার অধিকার আছে।

—আগে বসি। রণো, এর মানে কী?

—বাবাই বলুক। সকলের সামনেই বলুক। এবার হেম মা! অপমান সহ্য করে এক মিনিটও থাকবে না তুমি। আমার জন্যে সইছিলে তো? আমি তোমাকে নিয়ে চলে যাব।

—সন্তানদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে?

—হ্যাঁ।

—লতুর কাছে?

—লতু…

—ঠিক আছে, আপনি বসুন।

—হেম! চলে যেয়ো না।

—সেটা তোমার প্রত্যহের আচরণের ওপর নির্ভর করবে।

হেমকায়া গলা নিচুই রাখলেন, রণো আর দূর্বাকে তোমার মতো হতে দেব না বলে এত সহ্য করছি…ওরা তোমার মতো হয়নি। সেখানে আমার জয়। আর তারপরেও…মিলুর জন্য…মিলুর জন্য…

—কী হয়েছে মিলুর। তা যদি…

—হেম মা। মিলু কি…?

—মিলু ঠিক আছে তো?

লতু আঙুল তুললেন। বললেন, হেম তো তোমাদের বাঁচাবার জন্যেই…মিলু আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করছিল…ওর ধারণা ছিল ও প্রেগনান্ট।

—তাই তোমার কাছে গিয়েছিল, লতু মাসি?

—আর কোথায় যেত দূর্বা? যাক, আজই জানলাম ওটা প্রেগনানসি নয়। ওভারিতে টিউমার। অপারেশান হবে টেস্টের পর।

হেমকায়া শ্রান্ত গলায় বললেন, মিলু নিশ্চয় আমার কাছে প্রায়োরিটি ছিল। কিন্তু আমি তো মিলুকে নিয়েই চলে যেতে পারি। পারি না…রণোর জন্যে…ওর কী হবে…বুকচাপা, সেনসিটিভ ছেলে…বাপের সঙ্গে কোনও…

সবাই চুপ। হিমাদ্রি মাথা নিচু করে চিন্তায় তদগত।

রণো গলা খাঁখারি দিল। তারপর বলল, হেম মা! লতু মাসি! আমি…পিপুকে…বিয়ে করতে চাই…

পিপুর মুখ বিস্ময়ে ফাঁক হয়ে গেল। ও বলল, রণো! তুই প্রোপোজ করেছিলি? আমার তো মনে পড়ছে না।

—তুই তো জানতিস। ধর, এখনি…প্রোপোজ করি যদি?

লতু বললেন, ভ্যানভাড়াই ভাল লাগছে না। পিপু। তুই রণোকে বিয়ে করবি?

পিপু বলল, হ্যাঁ লতু! বোকাটা বলেই না। বলেই না…সত্যি!

পিপু লতুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলল।

লতু বললেন, হিমাদ্রিবাবুর পক্ষে টু মাচ হয়ে যাচ্ছে না তো সবটা?

হিমাদ্রি রুদ্ধ গলায় বললেন, না।

হেমকায়া অবাক হয়ে হিমাদ্রির দিকে তাকালেন। রণো হেমকায়ার কাঁধে মাথা রাখল হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে।

দূর্বা বলল, হেম মা! তুমি যা বলবে, তাই হবে।

.

হেমকায়া বললেন, তাই হোক! তোমাদের বাবার পরীক্ষা তো সবে শুরু।

হিমাদ্রি গলা পরিষ্কার করে বললেন, দূর্বা! ওদের কিছু আপ্যায়ন করবে না?

—হ্যাঁ…নিশ্চয়। আর দাদা!

ঘরে হিমাদ্রি আর হেমকায়া। হিমাদ্রি হাত বাড়ালেন। হেমকায়া ওঁর আঙুল সামান্য ছুঁয়ে প্রত্যহের শান্ত, নম্র গলায় বললেন, সাতাশ বছরের অবিচার ধুয়ে দেবার জন্য আরও সাতাশ বছর তো পাবে না। কী পারো, দেখো। এবার তোমার পালা। আমি যা পারতাম, সব করেছি।

—হ্যাঁ হেম! চেষ্টা করব।

—যাক! ও ঘরে যাওয়া যাক।

ও ঘরে ঢোকার পর লতু বলল, আয়রনম্যানকে অনুতপ্ত দেখলাম, এটা আপনার জন্মদিনে আপনার তরফে আমাদের প্রতি উপহার।

রণো বলল। ভাগ্যে মিলুকে এনেছিল হেম মা! নইলে তো মেয়েটা…

হেম বললেন, আত্মহত্যা করত। এখন বাঁচবে। অন্তত আমি সে চেষ্টাই করব।

পিপু হেমকায়ার কাছে ঘেঁসে দাঁড়াল। হেমকায়া বুঝলেন, কিছুই শেষ হয় না নিঃশেষে, কিছু থাকে, কিছু শুরু হয়, নইলে তা জীবন কেন?

__

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *